নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র

সন্ধ্যা সাড়ে আটটা নাগাদ কায়রো এয়ারপোর্টে সগৃহিণী অবতরণ করলাম ৷ আমরা গিয়েছিলাম ইউরোপ থেকে, কিন্তু ভারতবর্ষ থেকেও কায়রো যাওয়ার কিছুমাত্র অসুবিধা নেই ৷ এমনকী ইউরোপ-আমেরিকা যাবার পথে একই খরচে কায়রো বেড়িয়ে যাওয়া যায় ৷ তবে দূরপাল্লার বিমানে চাপলে চলবে না ৷ এরা একছুটে দিল্লি থেকে লন্ডন যায় ৷ মাঝে কোথাও থামে না ৷ আমাদের বেছে নিতে হবে আরেকটু ছাপোষা লাইন-যার অনেকগুলো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়ানো আছে ৷ ভারতবর্ষ থেকে কায়রো হয়ে ইউরোপ-আমেরিকা পাড়ি দিতে হলে খোঁজ করুন রয়্যাল জর্ডন বা গালফ এয়ারের ৷ এরা আই এ টি এ-র সভ্য ৷ দক্ষতায় দড় এবং শিষ্টতায় কারোর চেয়ে কম যায় না ৷ অধিকন্তুর মধ্যে এরা আপনাকে কোনও-না-কোনও জায়গায় মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত বিনাশুল্ক-সামগ্রী কেনার সুযোগ দেবে ৷

মিশরের ভেতরে বেড়াতে হলে একজন দেশীয় ভ্রমণ তত্বাবধায়কের শরণ নেওয়া উচিত ৷ তা না হলে কে কাটবে ট্রেন বা প্লেনের টিকিট ৷ কে বা অগ্রিম বুক করবে নীল নদের জাহাজ ৷ আমাদের এইরকম একটি সংস্থার সঙ্গে বন্দোবস্ত করা ছিল ৷ এয়ারপোর্টে ঢুকতেই চোখে পড়ল যে রেলিংয়ের ওপারে তাঁদের তরফ থেকে মাহুমুদ সাহেব প্ল্যাকার্ড হাতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন ৷ ছিপছিপে একহারা হাস্যমুখ যুবক ৷ রং ময়লার দিকেই বলতে হবে ৷ তাঁর মাধ্যমে এয়ারপোর্টের করণীয়গুলি সুশৃঙ্খলে এবং অবিলম্বে সমাপ্ত হল ৷ রেলিংয়ের বাইরে এসে প্রথম প্রশ্ন করলাম, হোটেলে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে ৷ একনজরে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কতক্ষণ লাগবে তা বলা বেশ মুশকিল, তবে হ্যাঁ, সঙ্গে তাঁবুটাবু এনেছেন তো ৷ আকাশ থেকে পড়লাম ৷ সে কি! আমরা তো হোটেলে থাকব ৷ কিন্তু তার আগে তো হোটেলে পৌঁছতে হবে ৷ আর কায়রোর রাস্তায় এমন ট্র্যাফিকের ভিড় যে কখনও-কখনও গাড়ি থামিয়ে রাস্তার ধারে দু-চারদিন থেকে যেতে হয় ৷ বলার সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠে অভয় দিলেন-না না অত খারাপ নয়, মাঝে-মাঝে যে দু-চারঘণ্টা হয় না তা নয়, তবে এখন সন্ধ্যা গভীর হয়ে এল, আধ ঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যাব ৷ একটা জিনিস মিশরে বরাবর লক্ষ করলাম ৷ ওরা বেশ কৌতুকপ্রিয় ৷ কথায় কথায় হাসি-ঠাট্টা, রসিকতা, মজার গল্প ৷ নীল নদের ধারেই আমাদের হোটেল তেরো কি সতেরোতলা মনে পড়ছে না ৷ একটু মনোক্ষুণ্ণ হলাম নদীর দিকের ঘর পেলাম না বলে (পরে বদলে দিয়েছিল) ৷ তা আর কী করা যাবে ৷ হোটেলেই খাওয়াদাওয়া সেরে শুতে গেলাম ৷ সারাদিন পথের ক্লান্তি ৷ হলই বা এরোপ্লেনে ৷

এ-কাহিনী কায়রো ভ্রমণের নয় ৷ তবু যখন এসে পড়েছি তখন শহরটার সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে নিই ৷ প্রথম কায়রোতে আসি ১৯৫০ সালে ৷ তারপর ১৯৭০ সাল ৷ তখন নীল নদের এপার থেকে বাপ্পাদিত্যের গল্পে পড়া ত্রিকূট পাহাড়ের তিনটি চূড়ার মতো গির্জার তিন পিরামিডের শীর্ষভাগ দেখা যেত ৷ এখন আর যায় না ৷ সারি সারি হাইরাইজের আড়ালে পিরামিড এমন ঢাকা পড়ে গেছে যে এক মাইলের মধ্যে পৌঁছেও জিজ্ঞেস করতে হয় পিরামিডের রাস্তা কোনদিকে ৷ পিরামিডে পৌঁছে আরেকটি আশাভঙ্গ হল ৷ তখন বালি-গুল্মভরা রুক্ষ জনহীন প্রান্তরে বহুদূর ছড়ানো এবড়োখেবড়ো পাথরের চাঙড়ের মাঝখানে দেখেছিলাম পাশাপাশি দুটি পিরামিডের (তৃতীয় পিরামিডটি আকারেও ছোট এবং একটু দূরে) ভ্রূক্ষেপহীন মহিমা-যেন তারা এ-পৃথিবীর নয় ৷ আর এখন, স্ফিংসের চারদিকে বেড়া থাকলেও পিরামিড দুটি ঘিরে রথ বা দোলের মেলা বসে গেছে ৷ লোকে লোকারণ্য, পিরামিড মার্কা গেঞ্জি, ধাতু পাথর আলাবাস্তারের তৈরি ক্ষুদি ক্ষুদি পিরামিড, কাঠের ওপরে আঁকা ছবি ৷ টুটেনখামেনের মুখোশ, ভেঁপু, বাঁশি ৷ ছেলেভুলানো বেহালা সব পাওয়া যায় ৷ খুপরি খুপরি স্টল আর ফেরিওয়ালা ৷ পায়ে হেঁটে, সাইকেল চড়ে, গাধা মায় উট সওয়ারিতে চারদিক থেকে সবাই ছেঁকে ধরছে ৷ কিছু একটা কেনো ৷ একমাত্র আশ্বাস এই যে, এর মধ্যে চা, শরবত, কাবুলি, ঘুগনি বা ফল-ফুলুরির প্রবেশ নেই ৷ খাদ্য পানীয়ের ব্যবস্থাগুলো বেশ দূরে একটা সারিতে আবদ্ধ ৷ ফলে পিরামিডের চারপাশে কোলাহল, ঠেলাঠেলি যথেষ্ট হলেও আবর্জনা নেই ৷ পরে মনে হয়েছিল যে আশাভঙ্গের কারণ, আমার পরিণত বয়স ৷ এখানকার বালক-বালিকা, যুবক-যুবতী মায় প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ারাও পিরামিডের নবজন্ম মেনে নিয়ে আনন্দে হুটোপুটি করছে ৷

মেমফিস সাকারা

নীল নদের ওপারে গেলে খালি পিরামিড দেখে ফিরে আসবেন না ৷ মেমফিস এবং সাকারাও দেখে আসবেন ৷ হলই বা মাইল কুড়ি দূর ৷ মেমফিস হল ফারাওয়ের প্রথম রাজধানী ৷ প্রায় পাঁচ হাজার বছর এর বয়স ৷ এখন সেখানে স্মৃতিমাত্র আছে ৷ চোখে দেখবার বিশেষ কিছু নেই ৷ দুহাজার বছর পরে তৈরি রামেসিমের এক বিরাট প্রস্তরমূর্তি ছাড়া ৷ সাকারা হল মেমফিসের সমাধিক্ষেত্র ৷ আর সমাধিক্ষেত্র বলেই বোধহয় সাকারা মেমফিসের তুলনায় অনেক বেশি অটুট আছে ৷ পিরামিডের ভেতরে মৃতদেহ মমি ৷ কীভাবে কোথায় রাখত তা দেখতে গেলে সাকারায় কয়েক বছর আগে খুঁড়ে বার করা মেঘেমঘেটের কবর দেখতে যাওয়াই ভালো ৷ দর্শকদের ভূগর্ভপ্রকোষ্ঠে নামা এবং চলাফেরার বন্দোবস্ত এখানে গিজ্জার পিরামিডের তুলনায় অনেক ভালো ৷ আর এখানেই দেখবেন ইমহোটেপের ছকে তৈরি (খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০) স্টেপস পিরামিড যাকে তখনকার লোকেরা স্বর্গের সিঁড়ি বলত ৷ স্বর্গের সিঁড়ি হোক আর না-হোক স্টেপস পিরামিডই হল পৃথিবীর প্রথম মহাস্থাপত্য এবং পরের সমস্ত পিরামিডের পূর্বপুরুষ ৷ ইমহোটেপ ছিলেন একাধারে প্রধানমন্ত্রী, স্থপতি, চিকিৎসক, জ্যোতির্বিদ ও দার্শনিক ৷ অ্যারিস্টটলের সঙ্গে তুলনীয় ৷ নীল নদের বন্যা সম্বন্ধে তাঁর মতামত এখনও প্রামাণ্য বলে ধরা হয় ৷ দেড় হাজার বছর পরে দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে, ইমহোটেপ দেবতার আসন পান ৷

কায়রোতে অ্যান্টিকুইটি মিউজিয়াম অবশ্য দেখবেন ৷ প্রাচীন ইজিপ্ট বিষয়ে এর চেয়ে ভালো সংগ্রহ পৃথিবীর আর কোথাও নেই এবং দেখতে গেলে কেবল দোতলায় টুটেনখামেনের ঐশ্বর্য দেখেই পালাবেন না ৷ একতলায় ঘরের পর ঘরে সেই আদিকাল থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন মূর্তি, বস্তু, স্থাপত্যের নিদর্শন সময়ানুসারে সাজানো আছে ৷ মনে হবে যেন সে যুগের একটা ফিল্ম দেখছেন ৷ সব আছে, খালি বাসিন্দারা নিপাত্তা ৷ কায়রো ছাড়ার আগে খান-এল-খলিলিতে কেনাকাটার জন্য নিশ্চয় যাবেন ৷ ওখান থেকে দুপা এগোলেই আল আজহর বিশ্ববিদ্যালয় ৷ পৃথিবীর প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা আজ এগারোশো বছর ধরে বিদ্যা বিতরণ করে চলেছে ৷ ইসলাম ধর্মশাস্ত্রের জন্য পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিদ্যাকেন্দ্র ৷ ইসলাম ছাড়াও আরও বিভিন্ন বিষয়ে এখানে আধুনিক শিক্ষা দেওয়া হয় ৷ আগে থেকে বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে বিদ্যালয় সীমানার ভেতরে ঢুকতে পারবেন না ৷ প্রহরী বাধা দেবে ৷ অল্প আয়তনে এই সুবিশাল বিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং ছাত্রদের যা ভিড়, তাতে দর্শকদের মুক্তভাবে ঢুকতে দিলে আর রক্ষা থাকত না ৷ তবু রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বিদ্যালয়ের বহুতল অট্টালিকা দেখতে পাবেন আর দেখবেন বই-খাতা হাতে দলবাঁধা ছাত্রদের ভিড় ৷ ঠিক যেমন আমাদের প্রেসিডেন্সি কলেজ, হিন্দু হস্টেলের জটলা ৷

এবার নীল নদ ৷ আরবি নাম নহর আন-নিল ৷ পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী ৷ ৬৬৫০ কিলোমিটার ৷ প্রধান নদীটি বেরিয়েছে মধ্য আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়া থেকে ৷ নাম শ্বেত নীল ৷ প্রধান শাখাটি বেরিয়েছে ইথিওপিয়ার পাহাড়ে ছ হাজার ফুট উঁচু লেক টানা থেকে ৷ এর সংজ্ঞা হল নীল নীল ৷ আয়তনে ইনি শ্বেত ভগ্নীর চেয়ে ছোট হলেও জলভারে এবং প্রবাহে গরিষ্ঠ ৷ নীল নদের যে বাৎসরিক বন্যা-ইজিপ্টের জীয়নকাঠি, মরণকাঠি, তার জলভাগের বেশিটা জোগান ইনি ৷ মাটি অবশ্য শ্বেত ভগ্নীটির দান ৷ নীল নদের জল-মাটি নিয়েই মিশর দেশ ৷ আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক ভৌগোলিক হোরাডোটাস তাই বলেছিলেন, মিশর তো একটা দেশ নয় ৷ মিশর একটি নদী ৷

মোটামুটি সমতলের কাদা ধোয়া জল বয়ে প্রধান নদীটির জল কাদাগোলা সাদা ৷ নীল ভগ্নীটি নেমে আসছেন পাহাড় ভেঙে ৷ ধাতু সম্পদে গরীয়ান পাথর গুঁড়িয়ে ৷ তার জলের রং নীল কৃষ্ণ ৷ দুই ভগ্নীর মিলন হচ্ছে সুদানের রাজধানী খারটুমে ৷ এখান থেকে দুই বোন হাত ধরাধরি করে এক খাতে বয়ে চলেছে আরও ৩৩০০ কিলোমিটার ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ৷ খারটুম থেকে আনুমানিক আশি কিলোমিটার দূরে নীলের অন্যতম প্রধান শাখা-নদী আটবারার মোহনা ৷ ব্যস, তারপর আর কোনও নদী, উপনদী, ধারা, প্রস্রবণ নেই ৷ বৃষ্টিপাত যৎসামান্য ৷ ঊষর বন্ধুর মরুপ্রান্তরের মাঝখান দিয়ে একটি জলস্রোত, একটি প্রাণস্রোত বয়ে চলেছে যার দুপাশে সবুজের ছোপ, তৃণভূমি, চাষ-আবাদ, গ্রাম জনপদ ৷ আবার এই সবুজের বেড়া পার হলেই দুপারে ধু-ধু মরুভূমি বালির পাহাড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ৷ যেখানে তৃষ্ণার জল নেই, ক্ষুধার খাদ্য নেই, সূর্যের তাপ থেকে মাথা বাঁচানোর আশ্রয়টুকু পর্যন্ত নেই ৷ খারটুম থেকে উত্তর সুদানের দুহাজার কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে নীল মিশর প্রবেশ করলেন ওয়াদি হালফাতে-যেখানে আসোয়ান হাই ড্যাম হবার আগে নীলের পঞ্চম ক্যাটারাক্টটি ছিল ৷ এখন এই ক্যাটারাক্ট লেক নাসেরের গভীরে মিলিয়ে গেছে ৷ এখান থেকে মাত্র পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে আবু সিম্বেলের জগদ্বিখ্যাত মন্দির ৷ কিন্তু সেকথায় পরে ফিরে আসব ৷

নীল নদের ক্যাটারাক্টগুলির কথা না বললে নীলের পুরো পরিচয় হয় না ৷ সংক্ষেপে বলি ৷ ক্যাটারাক্ট ইংরিজি শব্দ ৷ মানে হল, যেখানে জলপ্রবাহ পাথর কেটে উঁচু থেকে নিচে নেমে আসছে ৷ নৌকো, জাহাজ বা কোনওপ্রকার জলযান এই বাধা অতিক্রম করতে পারে না ৷ খারটুম থেকে আসোয়ানের ২০০০ কিলোমিটারের মধ্যে এরকম ছটি ক্যাটারাক্ট আছে ৷ ষষ্ঠ এবং শেষটি হল আসোয়ানে ৷ ক্যাটারাক্টের দুস্তর বাধার জন্যই সেই ফারাওদের আমল থেকে নেপোলিয়নের বাহিনী পর্যন্ত কেউ নদীপথে আসোয়ানের দক্ষিণে যেতে পারেনি ৷ এ অগম্য বাধা প্রথমে দূর করেন ১৯ শতকের গোড়ায় অটোমান খেদিভ (নামে খেদিভ হলেও আসলে তিনি তখন মিশরের তখত তাউস দখল করেছেন) মহম্মদ আলির ছেলে ইব্রাহিম ৷ অপরিমিত লোকবল নিয়ে তিনি তাঁর নৌকোগুলি ক্যাটারাক্টের পাশ দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নাব্য অংশে নিয়ে আসেন ৷ একই কারণে নীল নদের উৎস সন্ধানে এত দেরি হল ৷ ভেবে দেখুন, পৃথিবীর ইতিহাসে সুখ্যাত এই নদীটির উৎসের সন্ধান পাওয়া যায় মোটে এই বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে ৷ তার কুড়ি বছর আগে মানুষ উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু পৌঁছে গেছে ৷

জলভ্রমণ

নীল নদে প্রমোদভ্রমণের দৌড়ও ওই আসোয়ান পর্যন্ত ৷ সারা পৃথিবীর ট্যুরিস্ট নিয়ে দুই শতাধিক জাহাজ কায়রো থেকে আসোয়ান আনাগোনা করে ৷ এইসব জাহাজের মালিক বিভিন্ন কোম্পানি হলেও এদের বুকিং হয় কায়রোতে এবং ইউরোপ-আমেরিকার বড়-বড় শহরে, ট্র্যাভেল এজেন্টদের হাতে ৷ ভালো ট্র্যাভেল এজেন্টের মাধ্যমে বুক করলে সেই এজেন্টরাই আপনাকে কায়রো এয়ারপোর্টে নিতে আসবে, কায়রোতে হোটেল ঠিক করে দেবে, আবার কায়রো ছাড়ার পর বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে আবার কায়রোতে এনে প্লেনে তুলে দেবে ৷ সমস্ত ব্যাপারটা ছকে ফেলা ৷ নিতান্ত কপাল খারাপ না হলে ঝামেলায় পড়বার সম্ভাবনা নেই ৷

জাহাজগুলি আকারে এবং গঠনে একরকম হলেও, আয়তনে এবং বিশেষ করে আরামে-বিলাসে যথেষ্ট তফাত আছে ৷ অগভীর জলে চলবে বলে সব জাহাজই চ্যাপটা চওড়া খোলের ৷ তার ওপরে দুই-তিন-চারতলা ডেকের সারি ৷ মাত্র কুড়িজন যাত্রী নেয় এমন জাহাজও আছে আবার ১৫০ জন যাত্রী বইতে পারে এমন জাহাজও চলছে ৷ চার বা পাঁচতারার জাহাজগুলো সম্পূর্ণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ৷ ছোট জাহাজ বলে ক্রীড়াক্ষেত্র, মল্লভূমি, সিনেমা ইত্যাদি নেই কিন্তু একাধিক খাবার জায়গা, বার, লাউঞ্জ এবং ছোট একটা সুইমিং পুল আছে ৷ অবশ্য সময় কাটাবার জন্য এসব জাহাজে এর বেশি কিছু দরকার হয় না ৷ দুধারে নীল তটভূমির দৃশ্য তো আছেই ৷ দুই বা তিনতারার জাহাজও আছে ৷ সেখানে হয়তো শীতাতপনিয়ন্ত্রণ নেই ৷ কেবিনগুলোও অপেক্ষাকৃত ছোট, কিন্তু তেমন কিছু ঘেঁসাঘেঁসি হয় না ৷ আর দামেও অনেক সস্তা ৷

কায়রো থেকে আসোয়ান যাতায়াতের মেয়াদ চোদ্দদিন ৷ ওটাকে বাড়িয়ে তিন সপ্তাহও করা যায় ৷ যাদের হাতে অঢেল সময়, অনেক পয়সা, তারা সমস্ত সফরটাই জাহাজে করতে পারে ৷ কিন্তু সাধারণ লোক অতটা বাড়াবাড়ি করতে চায় না ৷ তাদের পক্ষে সংক্ষিপ্ত সফর হল-কায়রো থেকে আসোয়ান (৮৯০ কিলোমিটার) উড়ে যাওয়া এবং সেইদিনই এবং সাধারণত সেই এক প্লেনেই আসোয়ান থেকে আবু সিম্বেল (২৮০ কিলোমিটার) পর্যন্ত যাওয়া ৷ ঘণ্টা দুই আবু সিম্বেলে কাটিয়ে আবার আসোয়ানে ফিরে এসে ওইখানে জাহাজে চড়া ৷ তারপর চার বা পাঁচ রাত জাহাজে কাটানো এবং দুদিকে নানা নবীন ও প্রাচীন দৃশ্য দেখতে দেখতে আসোয়ান থেকে লাকসোর (২২৫ কিলোমিটার) পাড়ি দেওয়া ৷ লাকসোর হল মিশরিয় পুরাতত্বের মুকুটমণি ৷ যেখানে সবকিছু দেখে, লাকসোর থেকে বায়ুপথে কায়রো (৬৬৬ কিলোমিটার) ৷ ইউরোপের যাত্রীরা অনেক সময় লাকসোর থেকেই কায়রোয় না গিয়ে সোজা দেশে ফেরেন ৷ আরেকটা পথ হল কায়রো থেকে এরোপ্লেনে প্রথমে লাকসোর ৷ সেখান থেকে জাহাজে আসোয়ান ৷ আসোয়ান থেকে একছুটে (প্লেনে বা বাসে) আবু সিম্বেল যাওয়া যায় ৷ তারপর আসোয়ান থেকে ব্যোমমার্গে কায়রো বা লাকসোর ৷ আমরা প্রথমে আসোয়ান দেখলাম ৷

আবু সিম্বেল

ভোর সাড়ে ছটায় ইজিপ্ট এয়ারের বিমান কায়রো ছেড়ে আসোয়ান হয়ে আবু সিম্বেল পৌঁছল সকাল নটা নাগাদ ৷ ছোট্ট এয়ারপোর্টের বাইরে বাস তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৷ আমরা দল বেঁধে উঠতেই ছেড়ে দিল ৷ দশ মিনিট পরে যেখানে নামলাম, সেখানে বালি-পাথর-কাঁকর ছড়ানো বিস্তীর্ণ প্রান্তর, নদীর দিকে একটা টিলার মতো উঠে গেছে ৷ দুদিকে সারি বাঁধা স্যুভেনিরের দোকান, কোল্ড ড্রিঙ্কসের স্টলের মাঝখান দিয়ে গিয়ে একটা রেলিংঘেরা জায়গায় টিকিট নেওয়া হল ৷ তারপর টিলাটাকে বেড় দিয়ে নদীর দিকে নামতে শুরু করলাম ৷ অক্টোবর মাসের শেষ ৷ তেমন গরম না-হলেও রোদ্দুরের তেজ আছে ৷ কাঁকুরে এবড়োখেবড়ো রাস্তায় সন্তর্পণে পা ফেলতে ফেলতে ভাবছিলাম গল্পের মতো, কাহিনীর মতো সেই আবু সিম্বেলের মন্দির ৷ তারপর একটা মোড় ঘুরতেই একসঙ্গে চোখে পড়ল দুশো ফুট উঁচু খাড়া পাহাড় আর সেই পাহাড় খোদাই করা চারটি সুবিশাল মূর্তি ৷ তিনটি অক্ষত ৷ কেবল বাঁদিক থেকে দ্বিতীয় মূর্তিটির বুকের থেকে মাথা পর্যন্ত ভেঙে নিচে পড়ে আছে ৷ এই মূর্তি চারটির কথা অনেক শুনেছি, অনেক ছবি দেখেছি, তবু মন এই বিশালত্বের জন্য প্রস্তুত ছিল না ৷ মনে হল যেন পাঁজরার ওপরে একটা হাতুড়ির ঘা পড়ল ৷ গুরগুর করে উঠল বুকের ভেতর ৷ মুহূর্তের জন্য চারপাশের জনস্রোত, কোলাহল সব মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠল এক অখণ্ড অবিচ্ছিন্ন সত্তা ৷ ওই মূর্তি চারটি আর আমি ৷ চটকা ভেঙে দেখলাম দল একটু এগিয়ে গেছে ৷ আবু সিম্বেলে আবার কখনও যাব কিনা জানি না কিন্তু গেলেও এ-অনুভূতি আর হবে না ৷ প্রথম সমুদ্র দেখার মতো, প্রথম হিমালয় দেখার মতো, এ-সুযোগ জীবনে একবারই আসে ৷

চারটি মূর্তিই দ্বিতীয় রামেসিসের ৷ ফারাও কুলের বিখ্যাততম নরপতি ৷ খ্রিস্টপূর্ব ১৩০৪ সাল থেকে ১২৩৭ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৬৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন তিনি ৷ বহু যুদ্ধ জয় করেছেন, বহু নগর-গ্রাম-জনপদ তৈরি করেছেন ৷ আর সারা মিশর জুড়ে সর্বত্র বসিয়েছেন নিজের বিরাট বিরাট মূর্তি, প্রতিকৃতি-তাঁর রাজত্বের বিভিন্ন ঘটনাবলীর ছবি ৷ পণ্ডিতেরা বলেন যে, পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁর মতো আত্মম্ভরী লোক আর দেখা যায় না ৷ সে যাই হোক, মূর্তিগুলি কিন্তু অপূর্ব ৷ হাঁটুর ওপর হাত রেখে উপবিষ্ট মূর্তি ৷ সৌম্য শান্ত মুখ ৷ সে মুখে ভয়, রাগ, দ্বেষ, উদ্বেগ কোনও মানবিক ভাবের ছাপ নেই ৷ সে মুখ যেন দেবতার মুখ ৷ সে চোখের দৃষ্টি নীল নদের ওপারে কোনও দূর ভবিষ্যতের দিকে ন্যস্ত ৷ মূর্তিগুলির চারদিকে পায়ের গোড়ায় ছড়ানো-ছিটানো আরও অনেকগুলি মূর্তি ৷ তার মধ্যে রামেসিসের মা রানি টি এবং তাঁর প্রিয়তমা ভার্যা রানি নেফেরটারির মূর্তি চোখে পড়ে ৷ একটু খুঁজে দেখলে আরও চোখে পড়বে মূর্তিগুলির গায়ে পাথর কেটে নানারকমের আঁকি-জুকি গ্রাফিটি ৷ তিন হাজার বছর ধরে দর্শকদের অমর হবার প্রচেষ্টা ৷ একটি মূর্তির পায়ের কাছে ২১০০ বছর আগেকার গ্রিক ভাষায় লেখা আছে ‘আমরা এটা লিখলাম ৷ আমোয়াবিচোসের ছেলে আর্চন এবং উডামাসের ছেলে পেলোকাস ৷’

দুই জোড়া মূর্তির মাঝখান দিয়ে মন্দিরে ঢোকবার চারকোনা দরজাটি আকারে ছোটই বলতে হবে ৷ বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙে সেখানে উঠতে হয় ৷ সিঁড়িগুলি আবার পিছনদিকে সামান্য হেলানো ৷ মানে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে উঠতে হয় ৷ রামেসিসের অনুজ্ঞাতেই সিঁড়িগুলি এইভাবে তৈরি হয়েছিল যাতে সবাইকে তাঁর মূর্তির সামনে মাথা নিচু করতে হয় ৷ মন্দিরের বাইরে দক্ষিণের দেওয়ালে ইজিপসিয়ান আলেখ্যলিপিতে রামেসিসের সঙ্গে হিটাইটদের সন্ধিপত্রটি খোদাই করা আছে ৷ দুই যুযুৎসু শক্তির মধ্যে এধরনের শান্তিকামী সন্ধিপত্র পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম এবং রামেসিসই এই সন্ধির রচয়িতা ৷

একটা আস্ত পাহাড় খোদা মন্দিরটির দরজা থেকে দেবস্থল পর্যন্ত দৈর্ঘ্য প্রায় দুশো ফুট ৷ তার মধ্যে প্রথম কক্ষটি যাকে পুরাতাত্বিকরা বলেন বিশাল হিপোস্টাল হল (সারি সারি থামের ওপর সিলিং), সেটিই প্রায় ১৫০ ফুট ৷ থামগুলির ওপরেও রামেসিসের মুখ বসানো আছে ওসিরিসের পোশাকে, ইনি মৃতের দেবতা ৷ হিপোস্টাইলের পরে আরেকটি হল ৷ আনুমানিক ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২৫ ফুট প্রস্থ ৷ এই হলটি পেরিয়ে ছোট একটি কামরা যেখানে বেদীর ওপর দেবতাদের আসন ৷ সমস্ত হলগুলিতেই দেওয়াল, থাম, সিলিং সর্বত্র বিচিত্র খোদাই করা এবং কোনও-কোনও জায়গায় তুলি দিয়ে আঁকা রঙিন চিত্রসমষ্টি ৷ সুড়ঙ্গের মতো হলের দুধারে বত্রিশশো বছর আগে আঁকা ছবিগুলি মৃদু অন্ধকারে জ্বলছে ৷ সবই রামেসিসের বিভিন্ন কীর্তি-কাহিনী ৷ কোথাও বা রামেসিসের সঙ্গে দেবতাদের সাক্ষাৎকার ৷ সব ছবিতেই রামেসিস হলেন প্রধান ব্যক্তি ৷ এমনকী দেবতাদের সামনে তাঁর সেই ঋজু দৃপ্তমূর্তি ৷ কোনওপ্রকার নতি স্বীকার রামেসিসের ধাতে ছিল না, তা সে দেবতা, মানুষ যাই হোক না কেন ৷ হিপোস্টাইল হলের দুপাশে বহু ছোট-ছোট কামরা ৷ কোনওটা রামেসিসের বসবার ঘর, কোনওটা তাঁর বিশ্রামকক্ষ ৷ একটি কামরায় সারি সারি তাক ৷ এটা ছিল রামেসিসের লাইব্রেরি ৷

দুটি হল পরপর পেরিয়ে এবার মন্দিরের গর্ভগৃহ ৷ গ্র্যানাইটের তৈরি বেদীর ওপর চারটি দেবতার উপবিষ্ট মূর্তি ৷ সামনে আরেকটি বেদীর ওপর পূজার উৎসর্গ দ্রব্যাদি রাখবার ব্যবস্থা ৷ চার দেবতার একজন হলেন টা-পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এবং মেমফিসের আরাধ্য দেবতা ৷ অন্য দুজন হলেন রা-হারাখটি এবং আমন-রা ৷ দুজনেই সূর্যের বিভিন্ন রূপ, তবে প্রথমজন হলেন হেলিওপোলিসের প্রধান দেবতা এবং দ্বিতীয়জন রামেসিসের রাজধানী থিবসের হর্তাকর্তা ৷ চতুর্থটি কে বলুন তো? রামেসিস স্বয়ং ৷ আর তিনি যে এই তিন দেবতার একীভূত রূপ তার অকাট্য সৌরনির্দেশ রেখে গেছেন মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীতে ৷ অক্টোবর মাসে যেদিন রামেসিসের জন্মদিন বলে ধরা হয় এবং ফেব্রুয়ারি মাসে যেদিন তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়েছিল এই দুটি দিন, সকালের সূর্যের প্রথম আলো মন্দিরের দুশো ফুট অন্ধকার ভেদ করে রামেসিসের মূর্তিকে আলোকিত করে-অন্য দেবতাদের গায়ে সে আলো পৌঁছয় না ৷ সাবাশ রামেসিস -সঙ্গে সঙ্গে সাবাশি দিচ্ছি এ যুগের সেই বিশ্বকর্মাদের যাঁরা মোটে এই তিরিশ বছর আগে পাহাড়সমেত সমস্ত মন্দিরটাকে নদীর ধার থেকে তুলে এনে নব্বই ফুট ওপরে এখনকার জায়গায় বসিয়েছিলেন ৷ চার লক্ষ টন পাথর এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করলেন তাঁরা, যে মন্দিরের অভ্যন্তরীণ কারুকার্য বিন্দুমাত্র ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটল না, এমনকী সূর্যের আলো এখনও একই সময়ে, একই রাস্তা দিয়ে একই জায়গায় পৌঁছয় ৷ মন্দির দেখে বেরোবার সময় পাশের একটি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেতে হয় ৷ তখন দেখা যায় মন্দিরের ছাদের ওপরে সারি সারি কংক্রিটের থাম, খিলানের ওপরে আরেকটা ছাদ আছে ৷ দুই ছাদের মাঝখানে নানারকম ছবি আর মডেল দিয়ে দেখানো হয়েছে কীভাবে মন্দিরটি নব্বই ফুট নিচ থেকে ছোট-ছোট খণ্ডে কেটে ওপরে আবার জোড়া দেওয়া হয়েছিল ৷ দ্বিতীয় ছাদের ওপরে নিচেকার পাথর ফেলে সেই পাহাড়টির প্রতিকৃতি করা হয়েছে -যে পাহাড় খুঁড়ে রামেসিস তাঁর মন্দির বসিয়েছিলেন ৷ এত কাণ্ড করা হল কেন? না-হলে, রামেসিসের অতুল কীর্তি, পৃথিবীর অন্যতম সম্পদ আসোয়ান উচ্চ বাঁধের জলে তলিয়ে যেত ৷

আবু সিম্বেল নামের সঙ্গে কিন্তু রামেসিসের কোনও প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ নেই ৷ আরবি ভাষায় আবু মানে বাবা আর জায়গাটির নাম সিম্বেল ৷ বোধহয় রামেসিসের বিরাট মূর্তি দেখে এখনকার বাসিন্দারা আবু সিম্বেল নাম দিয়েছিল ৷ রামেসিসের মন্দির ছাড়াও এখানে আরও কিছু পুরাকীর্তি আছে, তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য -নেফারটারির মন্দির ৷ এখানে দেবতা হলেন হাথোর -আদ্যাশক্তি, মাতৃদেবতা ৷ এই মন্দিরটিও একটা আস্ত পাহাড় খুঁড়ে তৈরি, তবে রামেসিসের মন্দিরের চেয়ে অনেক ছোট ৷

আসোয়ান

আবু সিম্বেল থেকে বেরিয়ে আবার এরোপ্লেন ৷ চল্লিশ মিনিট পরে আসোয়ান ৷ বাসে করে নীল নদের খেয়াঘাট ৷ সেখানে পুরো দল দুদিকে বেঞ্চিওয়ালা বৃহৎকায় চ্যাটাল খোলা মোটর লঞ্চে চড়ে বসলাম ৷ ভটভট করে লঞ্চ এগিয়ে চলল ৷ একদিকে ঝুঁকে নীলের জলে হাত ঠেকালাম ৷ গা শিউরে উঠল ৷ ইতিহাসের সেই নীল নদ-ফারাও, ইহুদিরা, মোজেস, ডেরিয়াস, আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার -একটা পুরো ইতিহাস মার্চ করে চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল ৷ লঞ্চের সারেং তখন আমাদের হাত তুলে দেখাচ্ছে উঁচু টিলার ওপর পোস্ট অফিস লালরঙা সুদৃশ্য বাড়িগুলি ৷ অর্ধশতাব্দীর ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিখ্যাত পুলম্যান ক্যাটারাক্ট হোটেল ৷ আগাথা ক্রিস্টির ভক্ত পাঠকরা জানবেন তাঁর উপন্যাস Death on the Nile-এর চিত্ররূপের জন্য এই হোটেলটি ব্যবহার হয়েছিল ৷ এখান থেকে কোনাকুনি দক্ষিণে পাড়ি দিলে নিউ আইসিস হোটেল, যার প্রায় সামনেই ভাসছে আমাদের নীল নদের জাহাজ SUN BOAT III. প্রথম দর্শনেই প্রেম হল ৷ সাদা আর নীলে মিশিয়ে চওড়া ফাঁদলের নাতিবৃহৎ জাহাজটিই সান বোট ৷ সী গালের মতো অবলীলাক্রমে ঢেউয়ের ওপর ভাসছে ৷ তার সাবানধোয়া মসৃণ গায়ে দুপুরের রোদ হাসছে ৷ সে যেন আকাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটুকরো মেঘ ৷

রেলিংঘেরা কার্পেট বিছানো পাটাতন বেয়ে জাহাজে উঠতেই সহাস্য সম্ভাষণ জানালেন জাহাজের প্রধান ব্যবস্থাপক হুসেন, তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে মোহামেদ, প্রধান স্টুয়ার্ড ৷ জাহাজ সম্বন্ধে কয়েকটি প্রয়োজনীয় কথা জেনে এবং এক গ্লাস উত্তম শরবত-ওই দেশেরই সোরেল ফুলের পাপড়ির নির্যাস, কালচে লাল রঙের সুশীতল পানীয়-পান করে, যে যার ঘরের চাবি নিয়ে জাহাজের ভেতরে চলে গেলাম ৷ সুন্দর সাজানো গোছানো ঘরটি ৷ সংলগ্ন শাওয়ার এবং টয়লেট ৷ জানলার পর্দা সরাতেই চোখে পড়ল ৫০ গজ দূরে নদীতট ৷ সেখানে কেউ কাপড় কাচছে, কেউ চান করছে, কেউ বা পোষা মোষের গা রগড়ে কাদা ধুয়ে দিচ্ছে-এক-আধটা ডিঙি-নৌকোর আনাগোনা-বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে এ-দৃশ্য দেখা গেল না, কেননা দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে এবং খিদেও বেশ পেয়েছে ৷ খানা দেশি এবং বিলাতি মিলানো ৷ এখানে বলে রাখি ইজিপ্টের খাওয়া-দাওয়া মধ্যপ্রাচ্য-ঘেঁসা ৷ ফেলাফেল, বাবা গাপুষ, কাবাব, কোফতা ইত্যাদি, তবে মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় এরা মশলা একটু বেশি ব্যবহার করে ৷ ফলে খাবার অপেক্ষাকৃত সুস্বাদু হয় ৷ তবে, আমাদের ভারতীয়দের মতো মশলার কৌশল এরা কেউ জানে না ৷ ইজিপসিয়ানদের নিজস্ব ডিশ বলতে ফুলমুতামমাস, একরকমের বিন, টম্যাটো মশলা দিয়ে সেদ্ধ করা হয় ৷ কখনওবা তার মাথায় একটা ভাজা ডিম দেওয়া হল ৷ বাটি করে এমনি বা পাউরুটি বা হাতেগড়া রুটি (পিঠা ব্রেড) দিয়ে খাওয়া হয় ৷ খেতে মন্দ নয় ৷ আরেকটা হল মুলুখিয়া ৷ একরকমের শাক কুটে চিকেন বা খরগোসের মাংসের ব্রথের সঙ্গে ফোটানো হয় ৷ ইজিপসিয়ানরা ভাতও খায় এবং রোজ বেল খালতা হল কিসমিস, বাদাম, মাংস, মেটে মেশানো একরকম ভাতভাজা ৷ পায়রা এদের অন্যতম সুখাদ্য ৷ খোলা আগুনে রোস্ট করে ঈষৎ ধোঁয়া গন্ধ পায়রা খুব চলে ৷ পানীয়ের মধ্যে চা, কফি, কোকাকোলা, লিমকা তো আছেই, ইজিপসিয়ান গৃহজাত মদ্যাদিও খারাপ নয় ৷ দাম গেরস্তপোষা ৷ বিলাতির দাম কিন্তু আকাশছেঁায়া ৷

ফেলুকা

জাহাজের খানা কামরায় ভূরিভোজন সেরে সবে ভাবছি যে এবার কেবিনে গিয়ে একটু গড়ানো যাক ৷ সেই কখন ভোর চারটেয় উঠেছি, এমন সময় দরজার বাইরে পা দিতেই কপাৎ করে ধরলেন ইব্রাহিম-আমাদের সঙ্গী ট্যুর গাইড, ফর্সা ছিপছিপে চেহারার হাস্যমুখ যুবকটি, অনতিত্রিংশ বর্ষীয়-কোথায় চললে! ফেলুকা চড়তে যাবে না? একটু আমতা আমতা করি-ফেলুকা মানে, ইয়ে …. ৷ ইব্রাহিম কোনও ওজর আপত্তি শুনবেন না ৷ আসোয়ানে এসে ফেলুকা চড়বে না-সে কি কথা? এখন বিকেল হয়ে এল ৷ উজানে তিনটে পাল তুলে দেব ৷ পাখির মতো উড়ে চলবে ফেলুকা ৷ সেই ফুরফুরে হাওয়ায় বসে দেখবে না এলিফ্যান্টাইন আইল্যান্ডের ভাঙাচোরা মন্দির, কিচেনারের বাগান-দ্বীপ, উঁচু টিলার ওপরে তোমাদের আগা খাঁর স্মৃতিমন্দির-যেখান থেকে নীল নদ পেরিয়ে, সবুজের বেড়া ডিঙিয়ে ওপারের মরুভূমির বালিয়াড়ি দেখা যায় ৷ এ-অনুরোধ এড়ানো যায় না ৷ বিশ্রামের কথা ভুলে ফেলুকায় গিয়ে বসলাম ৷ ফেলুকা হল নীল নদের নৌকো ৷ আমাদের যেমন বজরা ৷ চিনেদের সাম্পান ৷ সামনের দিকে ছুঁচলো উঁচু গলুই ৷ চ্যাপ্টা চওড়া মধ্যভাগ, পিছনদিকে আবার সরু হয়ে পাটাতন দিয়ে আটকানো ৷ হাল এবং হালির জায়গা সেইখানে জলের কাছাকাছি ৷ বিরাট তিনকোনা হাল, ফেলুকার পিছনের পাটাতনের সঙ্গে আটকানো এবং হালি হাল নাড়াচাড়া করছে দুপায়ের চাপে ৷ হালির হাতে রয়েছে পালের দড়ি, যা দিয়ে পালের মোড় ফিরিয়ে হাওয়ার বেগ ধরা যাবে ৷ ফেলুকা নানা মাপের হয় ৷ বিশ-ত্রিশ জন লোকের জন্য এক ডেকের ফেলুকা আছে ৷ আবার শতাধিক যাত্রী নিতে পারে এমন ফেলুকাও আছে যাদের শেষের আধখানা জুড়ে, এক বা দুই কামরা এবং সেই কামরার ঢালা ছাদে যাত্রীদের আরামে বসে হাওয়া খাওয়ার বন্দোবস্ত ৷ স্পিড বোট, মোটর লঞ্চ থেকে জাহাজ পর্যন্ত নানারকমের নৌযান এখন নীলের বুকে চলাফেরা করে, কিন্তু সেই অনাদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত-আমাদের গরুর গাড়ির মতো কী যাত্রী, কী মাল বহনে ফেলুকার স্থান কেউ নিতে পারেনি ৷

এলিফ্যান্টাইন দ্বীপ আগা খাঁ

ইব্রাহিমের কথা না শুনলে ঠকতে হত ৷ পাশাপাশি তিনটি সমকোণী ত্রিভুজাকৃতি পাল তুলে ফেলুকা আসোয়ানের দক্ষিণে উজানে পাড়ি দিল ৷ ডানদিকে হাতির রিলিফ ছবির মতো এলিফ্যান্টাইন আইল্যান্ড ৷ আফসোস এই যে, ওখানে নামা হল না ৷ বিভিন্ন পর্যটকের বৃত্তান্তে এই দ্বীপের নম্রমুখী পীবর বক্ষ ন্যুবিয়ান সুন্দরীদের ভূয়সী প্রশংসার কথা পড়া ছিল ৷ এলিফ্যান্টাইন পেরিয়ে যেখানে গিয়ে পড়লাম সেখানে নদী বেশ সরু হয়ে এসেছে, দুদিকে গ্র্যানাইটের বেড়া ৷ ইব্রাহিম বললেন যে, এই হচ্ছে নীলের প্রথম ক্যাটারাক্ট যার প্রচণ্ড স্রোত ঠেলে নৌকো এগোতে পারত না ৷ এখন অবশ্য সব জল আসোয়ান হাই ড্যামে আটকে আছে ৷ সে জলধারাও নেই, সে স্রোতও নেই ৷ পুরনো নদীর পাথুরে খাতে ড্যামের যে উদ্বৃত্ত জলটুকু বয়ে চলেছে, তাতে সন্তর্পণে ফেলুকা চলতে পারে-স্টিমলঞ্চ, নদীপোত আসে না ৷ তাদের দৌড় সাত কিলোমিটার উত্তরে আসোয়ান বন্দর পর্যন্ত, সেখানে পাথুরে জমির পরে জল আবার অপেক্ষাকৃত গভীর ৷ এবার ফেলুকার মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হল ৷ পশ্চিম কূলে অনুচ্চ পাহাড় ৷ পাহাড়ের মাথায় সুবিশাল মন্দির ৷ আগা খাঁর মসোলিয়াম ৷ তার থেকে কিছুটা নেমে এসে পাহাড়ের গায়ে একটি সুদৃশ্য বাংলো ৷ আসোয়ান আগা খাঁর অতি প্রিয় জায়গা ছিল ৷ এই বাংলোটি তিনি শখ করে তৈরি করেছিলেন ৷ আসোয়ানে জনবিরল জায়গায় কিছু অবসরযাপনের জন্য ৷ এখনও আগা খাঁর পঁচাশি বছর বয়স্ক বিধবা এই বাংলোয় শীতকালের দুমাস কাটান ৷ মনে মনে দেখলাম ৷ শীতের কোনও সন্ধ্যায়, কুয়াশা ভেদ করে নিঃসঙ্গ বাংলোর বারান্দায় বসে বৃদ্ধা দেখছেন-ওই যেখানে আগা খাঁর স্মৃতিমন্দিরে আলো জ্বলছে ৷

ফেলুকা যেখানে কূলে ভিড়ল, সেখানে ছোট একটি গঞ্জ ৷ আমি সেখানে ঘোরাফেরা করতে লাগলাম ৷ গৃহিণী বাকি দলের সঙ্গে মসোলিয়াম দেখতে গেলেন ৷ ছোট্ট পাহাড় ৷ ১০-১৫ মিনিটের চড়াই, তবুও আমি সাহস করলাম না ৷ ওঁদের ফিরে আসতে চল্লিশ মিনিটের মতো লাগল ৷ তার মধ্যে গঞ্জের দোকানদার ফিরিওয়ালাদের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেল ৷ মাদ্রাজের রেল পোর্টারদের মতো ইংরিজি অনেকেই জানে, আর বিদেশির সঙ্গে ভাব জমাবার জন্য ভাষারই বা কী প্রয়োজন ৷ হাবেভাবে বেশ কাজ চলে যায়, বিশেষ করে বিদেশিরা যদি মিশুক ব্যক্তি হয় ৷ মিশরিরা যথেষ্ট মিশুক এবং আমি ভারতীয় শুনে ওদের ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল ৷ দোকানপত্তর খুবই সাধারণ-মুদির দোকান, চায়ের স্টল, জামাকাপড়, জুতো, কফিখানা ইত্যাদি ৷ খদ্দের যে খুব আছে তা নয় কিন্তু তা নিয়ে দোকানদারদেরও বিশেষ চিন্তিত দেখলাম না ৷ ওরা নিজেদের মধ্যেই হৈ-হল্লা আড্ডা দিয়ে সিনেমার গান বাজিয়ে যথেষ্ট আমোদে আছে ৷ মাঝে মাঝে রাস্তার ওপর সতরঞ্চি বা জাজিম পেতে ছোট-ছোট গ্রুপে এক ফরসিতে তামাক খাচ্ছে ৷ নল এ-হাত থেকে ও-হাতে ঘুরছে ৷ সামনে বাঘবন্দির মতো কী একটা খেলার ছক পাতা ৷ আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কয়েকবার সমবেত সভ্যরা আমার দিকে নলটি তুলে ধরলেন ৷ সাহস হল না ৷ ইজিপ্টজ্ঞ মুজতবা আলি সাহেব লিখেছিলেন যে, ইজিপসিয়ানরা তামাকের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে বালাখানা করতে শেখেনি ৷

দল ফিরে আসার সময় হতে আমি ফেলুকার ঘাটে গিয়ে ফিরিওয়ালা পরিবৃত হয়ে দাঁড়ালাম ৷ সবাই নানারকমের তৈরি জামা ফতুয়া পাজামা বেচছে ৷ ইতিমধ্যে ওদের সঙ্গে বেশ একটা হাসিঠাট্টার সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে এবং আমি কিছু কিনব না জেনেও ওদের আমুদেপনায় কোনও ভাঁটা নামেনি ৷ ওদেরই একজন হঠাৎ এসে বলল, ওই দেখ তোমাদের দল এসে গেছে ৷ বল তো তোমার বৌ কোনটি? একটা মজা করব ৷ তারপর যেই উনি ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছেন ফিরিওয়ালা তার ঠ্যাঙা বাড়ির মতো ডাণ্ডা, যার মাথায় এড়ো কাঠের সারিতে ওর সওদা সাজানো আছে, উঁচু করে সাঁ-সাঁ করে ওঁর দিকে তেড়ে গেছে ৷ আমার স্ত্রী আঁৎকে উঠলেন আর ফিরিওয়ালার হো হো করে হাসি ৷

মিশরিদের হাসতে বা হাসাতে খুব উদ্যোগ-আয়োজনের দরকার হয় না ৷ ফেলুকাতে উঠে স্ত্রী বললেন, আহা তুমি যদি মসোলিয়াম দেখতে আসতে-মসোলিয়ামের জন্য নয়, আগা খাঁর মসোলিয়ামের তুল্য সুগম্ভীর স্থাপত্য আরও অনেক জায়গায় দেখা যাবে এবং এটা কোনও সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক প্রাসাদও নয়, কিন্তু ওপারে পশ্চিমদিকের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি সত্যি নীল নদের সবুজ বেড়া পেরিয়ে ওপারের মরুভূমি দেখতে পেলাম ৷ সেখানে বালিয়াড়ির ওপর লম্বা ছায়া ফেলে একক আরোহী নিয়ে একটা উট চলে গেল ৷ এরকম দৃশ্য কেবল সিনেমাতেই দেখেছি ৷

কিচেনারের দ্বীপ

হস্তি দ্বীপের পশ্চিমকূল ধরে যেতে যেতে উল্টোদিকে পাহাড়ের গায়ে সারি সারি কিছু গুহামন্দির দেখা যায় ৷ এগুলো হল রামেসিসেরও আগে ইজিপসিয়ান সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সমাধি ৷ ডানদিকে দ্বীপের একেবারে শেষে কতকগুলো আধুনিক ঘরবাড়ি দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ওগুলো কী? ইব্রাহিম বললেন, এ-কোনও পুরাতত্ব নয় ৷ তোমাদের ওবেরয় কোম্পানির রিসর্ট হোটেল ৷ সারা পৃথিবীর ধনী ব্যক্তিরা ওখানে অবসর বিনোদন করতে আসেন ৷ দামও তেমনই ৷ পরের স্টপ হল কিচেনারের দ্বীপ ৷ হ্যাঁ, সেই বিখ্যাত লর্ড কিচেনার যিনি মিশরেও বহু কাণ্ডকারখানা করেছিলেন ৷ উনিশ শতকের শেষের দিকে আসোয়ান থেকে সুদানের খারটুম অবধি, বারোশো মাইল ভয়ঙ্কর মরুভূমি ভেদ করে রেললাইন বসিয়েছিলেন তিনি ৷ উদ্দেশ্য, ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন মিশরের সৈন্যদলকে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে খারটুমে পাঠানো ৷ সুদানের ধর্মনেতা মাজদির কবল থেকে সুদানকে আবার মিশরের হাতে ফিরিয়ে আনার জন্য ৷ অবশ্য মিশরের হাতে ফিরিয়ে আনাটা নামেমাত্র ৷ কারণ তখন মিশরের খেদিভ মোহামেদ আলি অটোমান-কুল ত্যাগ করে ব্রিটিশের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন ৷ আসোয়ান কিচেনারের প্রিয় জায়গা বলে মোহামেদ আলি এই দ্বীপটি কিচেনারকে উপহার দেন ৷ কিচেনার এই দ্বীপে বহুদিন ছিলেন এবং সমস্ত দ্বীপ জুড়ে মনোরম একটি উদ্যান তৈরি করেছিলেন ৷ সে উদ্যান এখনও আছে এবং কী তার শোভা ৷ ঘন সন্নিবদ্ধ বনস্পতি, লতায়, পাতায়, কুঞ্জে-কুসুমে পাখির কাকলিতে, ঝরনা, ফোয়ারা, অগভীর নালি বেয়ে জলের কুলুকুলু শব্দে মনে হয় যেন নন্দনকাননে এসে পড়েছি ৷ আর মনে হয় কিচেনারের মতো ধুরন্ধর রাজনীতিক ও কট্টর যুদ্ধ ব্যবসায়ী কী করে, কী স্নেহে, কত ভালোবাসায় বাগানটি গড়েছিলেন ৷ জনশ্রুতি এই যে, কিচেনার আজীবন এই বাগানটির তত্বাবধান করেছিলেন ৷ কখনও সাক্ষাতে কিন্তু প্রধানত পত্রযোগে ৷ পৃথিবীর যেখানেই তিনি থাকুন এই বাগানের রিপোর্ট নিয়মিত তাঁর কাছে যেত এবং সেই রিপোর্ট পেলে গুরুতর রাজকার্য সরিয়ে রেখে আগে তিনি দেখতেন গাছেরা কেমন আছে ৷ কোন লতায় ফুল ফুটল ৷ প্রতি ঋতুর পাখি সময়ে দেখা দিল কিনা ৷

কিচেনারের দ্বীপ থেকে ফেলুকায় উঠতে সন্ধ্যার ঘোর লেগে গেল ৷ টুপ করে হাওয়াও পড়ে গেল ৷ মাঝি পাল নামিয়ে নিল ৷ তখন সেই নিস্তরঙ্গ স্থির জলের ওপর দিয়ে নিথর বাতাসে ফেলুকা এগিয়ে চলল কেবল দুটি দাঁড়ির বাহুবল ভরসা করে ৷ ওঃ কী তাদের পরিশ্রম ৷ আধঘণ্টার রাস্তা সওয়া এক ঘণ্টায় কাবার করে আমরা যখন কূলে ভিড়লাম তখন দাঁড়ি দুটিকে দেখে মনে হল ওরা যেন কাপড়জামা সুদ্ধ নদীতে ডুব দিয়ে এসেছে ৷ ফেলুকা থেকে নেমে জাহাজে যাবার পথে নিউ সাইসিস হোটেলে ঢুকলাম ৷ ট্র্যাভেলার্স চেক ভাঙাতে হবে ৷ কাউন্টারে হাস্যমুখ মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ৷ মাথার কোঁকড়ানো চুল বাদ দিলে বেশ ভারতীয় ভারতীয় চেহারা ৷ আমার পাসপোর্ট দেখে বলল, ও তুমি ইন্ডিয়ান ৷ আমিও ইন্ডিয়ান ৷ আমার নাম বালকৃষ্ণ মেনন ৷ কেরালার লোক আমি ৷ একটু হতভম্ব হলেও ভাবলাম হবেও বা ৷ কেরালাতে কোঁকড়ানো চুলও কিছু দেখা যায় ৷ বললাম, তাই নাকি, কতদিন আছেন এখানে? আমি তো বরাবর এখানেই আছি আমার মা ইন্ডিয়া থেকে এসেছিলেন ৷ এইরকম সাত-পাঁচ গল্প করে হঠাৎ হেসে ফেলে বললেন, কেমন ঠকিয়েছি তোমায় ৷ আমি ইজিপ্টেরই লোক ৷ তবে কি জানো আমাদের কোম্পানিতে ভারতীয় এক ড্রাইভার ছিল তার নাম বালকৃষ্ণ মেনন ৷ কেরালার লোক ৷ তার কাছে তোমাদের দেশের গল্প শুনেছি ৷ চেক ভাঙিয়ে যখন জাহাজে ফিরলাম তখন সমস্ত আলো জ্বালিয়ে নদীর কালো জলে তার ছায়া ফেলে জাহাজ ইন্দ্রপুরীর মতো সেজে আছে ৷ খানাকামরার বাইরে বিরাট বোর্ডে লেখা Black+White night. সবাইকে সাদা-কালো মিশানো পোশাক পরে আসতে অনুরোধ করা হয়েছে ৷

সানবোট আটলান্টিকচারী কুইন এলিজাবেথ নয় ৷ চল্লিশজন যাত্রী আর জনা কুড়ি নাবিক নিয়ে এর কারবার ৷ লম্বায় আনুমানিক দুশো ফুট, চওড়ায় ৩০ ফুটের মতো আর জলের তলায় অনধিক তিন ফুট-এই হল এর চৌহদ্দি ৷ এইটুকুর মধ্যেও যাত্রীদের আমোদ দেবার জন্য প্রতি সন্ধ্যাবেলাতেই কিছু-না-কিছু বন্দোবস্ত থাকত ৷ যাত্রীরা নৈশভোজনের আগে, ব্যবস্থামতো পোশাক পরে খানাকামরার সংলগ্ন লাউঞ্জে জমা হতেন ৷ সেখানে জাহাজ কোম্পানির খরচে এক-আধ পাত্র সুরা ৷ টুকটাক কিছু খাওয়া, সারাদিন কী হল তার আলোচনা মানে গজালি হত ৷ টেপরেকর্ডে নাচের বাজনা বাজত ৷ ওরই মধ্যে উদ্যোগী-উদ্যোগিনীরা একটু নেচে নিতেন ৷ একদিন হল জেলেবায়া নাইট ৷ অনেকে শার্ট-প্যান্টের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের আলখাল্লার মতো পোশাক, জেলেবায়া চড়িয়ে এলেন ৷ আরেকদিন ফ্যান্সি ড্রেস হল ৷ সাহেবরা বিশেষ করে মেমেরা কত বিচিত্র ধরনের পোশাক পরে এলেন ৷ সব নিয়ে এনেছিলেন ৷ আমার স্ত্রী একটি শাড়ি পরেই কেল্লা ফতে করলেন ৷ সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল শাড়ি দেখতে ৷ সবচেয়ে জাঁকের অনুষ্ঠানটি হল শেষ সন্ধ্যায় ৷ Chief dinner খাওয়ার এলাহি কাণ্ড ৷ বুফে ডিনার ৷ টেবিলের ওপর থরে থরে খাদ্যসামগ্রী, আর পিছনের দিকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পঞ্চ প্রধান ৷ প্রধান ব্যবস্থাপক হুসেন ৷ প্রধান ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ ৷ নাবিক প্রধান বা ক্যাপ্টেন ইসমাইল ৷ প্রধান সুপকার সুলেমান এবং প্রধান স্টুয়ার্ড মোহামেদ ৷ ইসমাইল ছাড়া বাকি চারজন উত্তর ইজিপ্টের লোক, ফর্সা সেমিটিক-হামিটিক মেশানো চেহারা ৷ কেবল ইসমাইল হলেন কালা আদমি ন্যুবিয়ান ৷ প্রধানদের সঙ্গে আলাপের সময় কিছু হাসি-ঠাট্টাও হল ৷ সুলেমানকে দেখিয়ে হুসেন বললেন, জানো, আজ ওকে ছুটি দিয়েছি ৷ যাতে করে একদিন অন্তত তোমরা খাবার মুখে দিতে পারো ৷ ইসমাইলকে দেখিয়ে বললেন, আরে ও তো প্রশান্ত মহাসাগরেও জাহাজ চালাতে পারত ৷ খালি কম্পাস দেখতে জানে না কি না ৷ পরে শুনেছিলাম যে নীল নদের ওপর যে দুশো কলের জাহাজ চলে তার প্রত্যেকটি ক্যাপ্টেনই ন্যুবিয়ান মানে দক্ষিণ ইজিপ্টের লোক ৷ নীলের খাড়ি, চর, পাথুরে ডাঙা স্যান্ড বার সব ওদের নখদর্পণে থাকে ৷ রাডার দেখতে হয় না ৷

খানাকামরায় আমরা জনা বত্রিশ লোকের মোটামুটি তিন ভাগ ৷ বড় ভাগটি হল আমেরিকার সাহেবদের ৷ এই ভাগে দুজন ভারতীয়ও আছেন ৷ স্বামী-স্ত্রী ৷ প্যাটেল এবং সত্যিই ওঁরা ক্যালিফোর্নিয়ায় মোটেল চালান ৷ মাঝবয়সী গেরস্ত চেহারার লোক ৷ ওঁদের কথাও বেশ সাদাসিধে-খালি যখন ওঁরা ওঁদের সম্পদ-বাড়ি-গাড়ির কথা না বলেন ৷ কত টাকা, কত বাড়ি, কতগুলো মোটেলের মালিক ওঁরা-এসব কথাও এমন সরলভাবে বলতেন যে গা নিশপিশ করে উঠত না, বরং মায়া হত ৷ এঁরা আমেরিকানদের সঙ্গেই বসতেন এবং পুরুষটি অন্তত আমেরিকানদের হৈচৈতে পুরো যোগ দিতেন ৷ ছোট দলটি ইংল্যান্ডের সাহেব-মেমদের নিয়ে ৷ এঁদের টেবিলের কথাবার্তার আওয়াজ টেবিলের বাইরে শোনা যেত না ৷ কেবল মাঝে মাঝে এঁরা আমেরিকান কোলাহলের দিকে কৃপার দৃষ্টিতে চাইতেন ৷ তৃতীয় দলটি হল এই আমরা ঝড়তি-পড়তি ৷ আমরা ঠিক দল করে বসতাম না ৷ এখানে টেবিলগুলো আমাদের দখলে ছিল ৷ আমরা, আরেকটি ভারতীয় দম্পতি, বাঙালি, সঙ্গে দুটি বাচ্চা ৷ চার আর ছয় ৷ ভদ্রলোক ডাক্তার, সৌদি আরবের কোনও হাসপাতালে আছেন, এখন ছুটি নিয়ে বেড়াতে এসেছেন ৷ কোরিয়ার একটি ছেলে একক-এমনই সব ৷ খানাকামরায় আলাদা বসলেও কদিনে সকলের সঙ্গেই বেশ মেলামেশি হয়েছিল ৷

আসোয়ান হাই ড্যাম

পরদিন সকালে গাইড ইব্রাহিম দলকে তাড়িয়ে বার করলেন আসোয়ানের দ্রষ্টব্য দেখার জন্য ৷ প্রথমে আসোয়ান হাই ড্যাম ৷ হাই ড্যাম থেকে মাইল চারেক উত্তরে সমস্ত নদীজুড়ে একটা লো ড্যামও আছে, যেটা তৈরি হয় ১৯০২ সালে ৷ সেচকার্যের জন্য ৷ হাই ড্যামটি তৈরি হয় ১৯৬৪ সালে রাশিয়ানদের সহযোগে ৷ দুমাইল লম্বা ড্যামের ওপর প্রশস্ত রাজপথ ৷ তার মাঝখান থেকে দেখলে একদিকে ৩৬৪ ফিটের খাড়াই যার তলা দিয়ে অবরুদ্ধ নদীর জল তিরতির করে বয়ে চলেছে ৷ অন্যদিকে তিনশো মাইল লম্বা লেক নাসের ইজিপ্ট অতিক্রম করে অন্তত একশো মাইল সুদানের মধ্যে চলে গেছে ৷ লেকের প্রসার এক থেকে দেড় মাইল ৷ পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ এটি ৷ লেক নাসেরের জলে মাছের চাষ হয় ৷ লেক নাসেরের জল চারদিকের কৃষিকর্ম চতুর্গুণ বাড়িয়েছে ৷ বাঁধের জলের তোড়ে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তা ব্যবহার করে, চারদিকে শিল্প প্রগতি হয়েছে ৷ এতসব সত্বেও একটা কিন্তু আছে ৷ নীল নদের যে বন্যা মিশরের পক্ষে ভগবানের দান ছিল তার তোড় কমে গেছে ৷ নীল নদ ধোয়া পলিমাটি যা দশ হাজার বছর ধরে মিশরের জমিকে উর্বরা রাখছিল, তার বেশ কিছু অংশ হাই ড্যামের বেড়া পেরিয়ে নিচে নামছে না ৷ ফলে উত্তর ইজিপ্টে কৃষিকর্মের বেশ ক্ষতি হয়েছে ৷ যে মিশর রোমানদের শস্যভাণ্ডার বলে পরিগণিত হত সেই মিশর এখন বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করে ৷ ইকোলজির তো কথাই নেই ৷ মিশরের নীল নদ থেকে কুমির জলহস্তি সব লুপ্ত হয়েছে ৷ তারা এখন ডেরা বেঁধেছে আসোয়ানের দক্ষিণে, ন্যুবিয়ায় ৷

হাই ড্যাম থেকে বাসে করে দেখতে গেলাম গ্র্যানাইট পাথরের খনি ৷ যে খনি ফারাওদের সময় থেকে আজ পর্যন্ত তাবৎ ইজিপ্টের গ্র্যানাইট পাথরের জোগান দিয়েছে ৷ এই খনির প্রধান দ্রষ্টব্য হল একটি অসমাপ্ত ওবেলিসক (চতুষ্কোণ স্তম্ভ যা ওপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে গিয়েছে) ৷ সেকালের নতুন রাজত্বের জাঁদরেল রানি হাটসেপসুট (খ্রিস্টপূর্ব ১৬ শতক) ওবেলিসকটি তৈরি করাচ্ছিলেন তাঁর কোনও স্মৃতিমন্দিরে বসাবার জন্য ৷ একটা আস্ত পাহাড়ের গা কেটে ওবেলিসকটি প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে ৷ পিছন এবং চারপাশ থেকে খাঁজকাটা পাহাড় থেকে আলাদা করা হয়েছে খাম্বা ৷ কেবল নিচের দিকের জোড়টি বাকি এবং সেখানেও পাশাপাশি ফোকর করে কাঠ গোঁজবার বন্দোবস্ত সমাপ্ত ৷ এমন সময় ২০ বছর দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজত্ব করে রানি হাটসেপসুট মারা গেলেন ৷ ফারাও হয়ে বসলেন তাঁরই ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা তৃতীয় থুতমোস ৷ তিনি সিংহাসনে বসেই বললেন, হাটসেপসুট একটা অতি বজ্জাৎ নষ্ট মেয়েমানুষ ৷ ওর সমস্ত স্মৃতি মিশরের ইতিহাস থেকে মুছে দাও ৷ স্মৃতি অবশ্য মুছে দেওয়া যায়নি কিন্তু হাটসেপসুটের সাধের ওবেলিসক আর শেষ হল না ৷ ইব্রাহিম বললেন, ভালোই হয়েছিল ৷ অসমাপ্ত বলেই তো আজকে আমরা এই খাম্বাটি পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম কী করে প্রাচীন মিশরিরা এই বিরাট বিরাট গ্র্যানাইটের খাম্বাগুলি পাহাড়ের গা থেকে কেটে গড়িয়ে নিচে নদীতে নিয়ে যেত এবং সেখান থেকে ফেলুকা করে দেশ-দেশান্তরে পাঠাত ৷ হাটসেপসুটের এই যে খাম্বাটি-এর দৈর্ঘ্য ১২৫ ফুট ৷ ওজন ১১৭০ টন ৷ তলার ফোকরগুলিতে শক্ত করে বালসা কাঠ গুঁজে দেওয়া হত ৷ তারপর ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে কাঠগুলি ভেজানো হত ৷ ভেজা কাঠ ফুলে উঠে চির ধরত গ্র্যানাইটের খাঁজে এবং এক সময়ে সমস্ত খাম্বাটি (পিছন এবং দুপাশ আগেই কাটা হয়েছিল) আলগা হয়ে পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ত ৷ এইজন্যই ওবেলিসক যে কোনও পাহাড় কেটে করা যেত না ৷ খুঁজে পেতে বার করতে হত এমন খালি জায়গা যেখানে অপেক্ষাকৃত অল্প আয়াসে ওবেলিসক কেটে নিচে গড়িয়ে দেওয়া যাবে ৷ রানির নামের উচ্চারণ নিয়ে সাহেব-মেমদের অনেকে ফাঁপরে পড়ছেন দেখে ইব্রাহিম বললেন, হাটসেপসুট বলার সময় মনে করো হট চিকেন স্যুপ ৷ ভদ্রলোক রসিক বটে ৷

ফিলের মন্দির

হাই ড্যাম থেকে নেমে কিছুটা বাসে, কিছুটা মোটরবোটে দেখতে গেলাম ফিলের মন্দির ৷ নদীর মাঝখানে একটি দ্বীপের ওপর ৷ বহুকাল এই মন্দিরটি প্রায় সম্পূর্ণ জলমগ্ন ছিল ৷ এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে এটিকে তুলে উচ্চভূমিতে বসানো হয় ৷ মিশরের হিসাবে এ মন্দিরটি নিতান্ত বালক ৷ মাত্র খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মিশরের শেষ ফারাওরা এটি শুরু করেছিলেন এবং বৃহত্তম মন্দিরটি তাঁদের তৈরি ৷ মৃত্যুজগতের দেবতা ওসিরিসের স্ত্রী আইসিস এবং তাঁদের ছেলে হোরাস (বাল সূর্য) এখানকার আরাধ্য দেবতা ৷ ফারাও বংশ অচিরে লুপ্ত হল আলাকজান্ডারের হাতে (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২)-রাজা হয়ে বসলেন গ্রিকরা ৷ তাঁরা কিন্তু ইজিপ্টের ধর্মবিশ্বাসে কোনও আঘাত করেননি বরং আলেকজান্ডার পুরোহিতদের কাছ থেকে বিধান নিয়ে নিজেকে আমন মানে সূর্যের পুত্র হিসাবে চালু করেছিলেন ৷ গ্রিকরা এই মন্দিরের বহু সংস্কার করেন ৷ বহু গ্রিক ভাস্কর্য, কলোনাড দেখা যায় ৷ গ্রিকেরা এখানে স্থপতিদের মিশরিয় দেবতা ইমহোটেপের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ৷ গ্রিকদের পরে রোমানরা মিশর দখল করেন ৷ তাঁরা এই মন্দিরের নানাবিধ উৎকর্ষ করেন ৷ মন্দির প্রাঙ্গণ বহু বিস্তৃত করেন এবং এর মধ্যে অগস্টাস সিজারের একটি মন্দির বানিয়ে দেন ৷ আর্চ বিখ্যাত রোম সম্রাট হার্ডিয়ানও এখানে একটি আর্চ বসিয়েছিলেন ৷ ১৪টি পিলারের ওপরে রোম সম্রাট ট্রাজানের বিশ্রামস্থলটি দেখার মতো ৷ ফিলের মন্দির এখনও বেশ অভগ্ন অবস্থায় আছে ৷ দেওয়ালে আঁকিজুকি নানা ছবি-তবে এখানে যুদ্ধ জয়ের বা বন্দিদের শোভাযাত্রা খুব বেশি নেই ৷ এ মন্দির ফারাওদের ক্ষয়িষ্ণু দিনের ৷ বেশিরভাগই বিভিন্ন দেবতার সামনে ফারাওদের নতিস্বীকার ৷ এখানে আর সেই পুরনো মিশরের উজ্জ্বল সোনালি সবুজ পটুয়া ছবি নেই ৷ বোধহয় সে রংকার-রাও লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তখন ৷

আসোয়ান

ফিলের মন্দির থেকে ফিরে এসে জাহাজে দুপুরের খাওয়া ৷ তারপর কেবিনে গিয়ে কিছুটা ইজিপ্ট তত্ব পড়তে পড়তে একটা নিপাট ঘুম ৷ বিকেলবেলা যাত্রীরা যে যার নিজের মতো আসোয়ান শহর দেখতে বেরোল ৷ কেউ বা ফিলের মন্দিরে সন-এ-লুমিয়ের দেখতে গেল ৷ আমরা শহর দেখাই সাব্যস্ত করলাম ৷ আসোয়ান, এডফু, এসনা, মায় লাকসোর-সবই এক ছাঁচে গড়া ৷ ডেহরি-অন-সোন থেকে গাজিয়াবাদ পর্যন্ত পূর্ব রেলের ধারে বিহার ইউ পি-র শহরগুলোকে মনে করিয়ে দেয় ৷ অমনি ছিরিছাঁদহীন ন্যাড়া-ন্যাড়া দোতলা-তিনতলা বাড়িগুলো ৷ চারদিকে ধুলো কাঁকর বসানো রাস্তা ৷ শ্রীহীন বিপণিশ্রেণী ৷ সাইকেলভ্যানের ওপর স্টল ৷ কেবল নীল নদের ধারটা যা একটু ছিমছাম ৷ কয়েকটা গাছপালা ৷ কিনারায় শুকনো খাতে সাজানো আলো ঝলমল শামিয়ানার তলায় সারি সারি রেস্তোরাঁ ৷ কোনওটি রামেসিস কাফে, কোনওটি প্রাইড অব নাইল-সবই ট্যুরিস্টভোলানো কৌশল ৷ সাইকেল-রিকশা প্রচুর, বেশ কিছু ফিটন গাড়িও আছে সন্ধেবেলা নীল নদের হাওয়া খাওয়ার জন্য ৷ আমরা পায়দলে ঘুরে বেড়ালাম ৷ ডাঁই করে টি-শার্ট বেচছে এক ছোকরা ৷ সে বলল, তার বাড়ি অস্ট্রেলিয়া ৷ জিজ্ঞাসা করি, তাহলে ভালো ইংরিজি বলতে শিখলে না কেন? অস্ট্রেলিয়ার লোকেরাও ইংরিজি বলে নাকি, হো হো করে হেসে উঠল ছোকরা ৷ আরেকজন বললে, সে হল দুশোতম রামেসিস ৷ ঠাট্টায় গল্পে সন্ধ্যার আলো জ্বালিয়ে ফিটন চেপে জাহাজঘাটায় ফিরলাম ৷ ফিটনওয়ালা ঠকায়নি ৷ একটা জিনিস এরকম বহু জায়গায় লক্ষ করেছি ৷ সাহেব-মেমদের নাজেহাল করলেও কালা আদমিদের ওরা দুখ-দরদ করে, ঠকায় না ৷

সকালে উঠে দেখলাম জাহাজ চলতে শুরু করেছে ৷ আজ সারাদিনই এবং সন্ধ্যার প্রথম প্রহর পর্যন্ত জাহাজ চলবে ৷ আসোয়ান থেকে লাকসোর মোট ২২৫ কিলোমিটারের বেশিরভাগই-প্রায় ১৭৫ কিলোমিটার এসনা পর্যন্ত আজকেই চলে যাব ৷ এসনায় রাত্রিবাস ৷ পরদিন সকালে এসনার লেক পেরিয়ে আরও ৫০ কিলোমিটার গেলে লাকসোর যার পুরনো নাম ছিল থিবস ৷ প্রাচীন মিশরের গর্বোদ্ধত রাজধানী ৷ ওসব পুরনো কথা এখন থাক ৷ এখন দুচোখ ভরে দেখি নীল নদের কূলে কেমন বয়ে চলেছে সাধারণ মিশরির জীবনযাত্রা ৷ আসোয়ানের পরে নীল নদের অববাহিকা সাত থেকে পনেরো মাইল চওড়া, তারপরেই মরুভূমি-বালি, পাহাড় ৷ নদীগর্ভ থেকে মরুভূমি অত চোখে পড়ে না ৷ খালি মাঝে মাঝে কোনও বাঁকের মুখে হয়তো একটা পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়ায় ৷ তাছাড়া নদীর দুদিকেই শ্যামল তৃণভূমি, গম, তুলো, আখের খেত-মাঝে মাঝে একটা করে গ্রাম ৷ কাছের কূলে দেখতে পাচ্ছি গ্রামের লোকেরা তাদের নানা কাজে ব্যস্ত ৷ কোথাও মোষটা পানিচাক্কির চারধারে ঘুরে ঘুরে জল তুলছে, কোথাও চাষা নিজে অবিকল আমাদের ডোঙাকলের মতো একটা জিনিস দিয়ে নিচু জমির জল ওপরে তুলছে ৷ বাড়ি-ঘরদোর সব নিচু-নিচু ইটের তৈরি ৷ খাপরার চাল-মুদির দোকানে ক্রেতার ভিড় জাহাজ থেকেই দেখতে পাওয়া গেল ৷ দুটো মেয়ে নদীর উঁচু পাড় ধরে কোথায় যেন যাচ্ছে, মাঝে মাঝে জাহাজটাকে ঘুরে দেখছে ৷ জাহাজ আস্তে হয়ে গেল ৷ সামনে নদীর বিরাট বাঁক পশ্চিমদিকে আর সেই বাঁকের মুখে একটি পাহাড়, টিলা বললেই চলে ৷ টিলার ওপর নানারকমের প্রাচীন বাড়িঘর দেখা গেল ৷ কম অম্বো ৷ রেললাইন হবার আগে আসোয়ান হয়ে ন্যুবিয়া-সাবিসিনিয়া যাবার পথে এখানে ক্যারাভানের মস্ত বড় আড্ডা ছিল ৷ এখন ছোট ভাঙা গ্রাম একটি আর পাহাড়ের ওপরে ওই পুরাকীর্তি ৷ সেও বেশ ভাঙাচোরা ৷ এখানে দেবতা বাজমুখো হারোরিস (হোরাস মানে বাল সূর্য ক্রমে ক্ষমতা লাভ করে হারোরিস হন-এঁকে প্রভাত সূর্য বলা চলে) এবং কুমিররূপী দেবতা সোবেক (এঁকে সাক্ষাৎ ফারাওয়ের ভাবমূর্তি বলা হত, কেননা কুমির অসীম শক্তিশালী এবং ক্ষমতাধর জানোয়ার) ৷ মজার কথা এই যে, কোনও দেবতা যাতে না চটেন (এঁরা হয়তো মিশরের কাঁচাখেগো দেবতা ছিলেন), তার জন্য এঁদের মন্দিরকে সমান দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল ৷ একদিকে হারোরিস আর অন্যদিকে সোবেক ৷ আমার মতে ফারাওদের তুষ্টিসাধনের জন্যই পুরোহিতরা কুমির দেবতাকে প্রভাত সূর্যের সমান মর্যাদা দিয়েছিলেন ৷ এখানে ছোট একটি কামরায় কয়েকটি মমি করা দেহ রাখা আছে ৷

কম অম্বো দেখে এসে জাহাজর সর্বোচ্চ খোলা ডেকে ছড়িয়ে বসলাম ৷ একেকটি টেবিল ঘিরে কয়েকটি করে চেয়ার ৷ মাথায় রোদ্দুর আড়াল করার জন্য বিরাট পাখামেলানো ছাতা ৷ মোলায়েম করে হাওয়া দিচ্ছে ৷ টেবিলে সাজানো চা-কফি নরম এবং গরম পানীয়, যে যা খায় ৷ কাছের কূলে শরবনের মতো ঘন জঙ্গল ৷ ইব্রাহিম বললেন, এসব আখের খেত ৷ পূর্বদিকের পাড় ধরে হুস হুস করে একটা ট্রেন চলে গেল ৷ নদীর ধারে কেমন নিরালা স্টেশনটি ৷ এ-ট্রেন শুরু হয়েছে কায়রোতে, আসোয়ান হয়ে ১২০০ মাইল দূরে সুদানের রাজধানী খারটুমে যাত্রা শেষ করবে ৷ মন মোর ট্রেনের সঙ্গী ছুটে চলে যায় কত দূর-দূরান্তে যেখানে নীল নদের দুই প্রধান শাখা এসে মিশেছে ৷ সেই দ্বীপের মতো গেজিরা ৷ মাঝখানে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা মানুষ ডিংকাদের দেশ ৷ যেখানে এখনও জলহস্তী কন্দমূল খুঁজে বেড়ায় ৷ নদীর চড়ায় খেজুর গাছের মতো কুমির রোদ পোহায় ৷ ডেক চেয়ারে বসে চোখে পড়ে একঝাঁক পাখি ৷ দুপুরের রোদ রিমঝিম করে ৷ হঠাৎ চোখে পড়ে কোনও পরিত্যক্ত মন্দিরের দ্বারপালটি মরুর কিনারায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আজ কত হাজার বছর হল ৷

এডফু

আজ দুপুরের খাওয়ার পর ঘুমোনো হল না ৷ কেননা ততক্ষণে জাহাজ এডফুতে লেগেছে ৷ জাহাজ থেকে নেমে দশ মিনিট ফিটন চেপে এডফুর মন্দির দেখতে গেলাম ৷ সরু গলি, দুদিকে সারি সারি দোকান-বেশিরভাগই র্যাজড়া, খেলো জিনিস ৷ হংকং তাইওয়ানে তৈরি প্লাস্টিকের সস্তা মাল ৷ তার সঙ্গে কিছু ইজিপসিয়ান নকশা আঁকা কাপড়, জামা, পর্দার কাপড়, টেবিল ক্লথ (এগুলি উত্তম) আর স্যুভেনির-টুটেনখামেনের মুখোশ থেকে গির্জার পিরামিড পর্যন্ত যা চাও ৷ গলির শেষে নাতিপ্রশস্ত অঙ্গন ৷ আর তারপরে অন্তত কুড়ি ফুট সিঁড়ি দিয়ে নেমে এডফুর মন্দিরের মুখোমুখি দাঁড়ানো গেল ৷ সমস্ত মন্দিরটাই বালি চাপা পড়েছিল ৷ এখন খুঁড়ে বার করা হচ্ছে ৷ এডফুর এই মন্দিরও অপেক্ষাকৃত নবীন ৷ এটি শুরু করেছিলেন মিশরের গ্রিক রাজা দ্বিতীয় টলেমি খ্রিস্টপূর্ব ২৩৭ সালে ৷ তারপরে ২০০ বছর ধরে মন্দিরটি গড়ে উঠেছিল ৷ টলেমির আগে এবং প্রায় একই জায়গায় দুনম্বর রামেসিস একটি মন্দির বসিয়েছিলেন, যার কিছু অংশ এখনও এডফু গ্রামের তলায় চাপা আছে ৷ মন্দিরের বর্ণনা দিয়ে কাহিনী আর বাড়াব না তবে এডফুর মন্দিরের মতো অভগ্ন অক্ষত অবস্থায় খুব কম মন্দিরই বেঁচে আছে ৷ থাম, খাম্বা, দেওয়াল তো আছেই ৷ এমনকী ছাদ পর্যন্ত অটুট আছে এডফুর মন্দিরে ৷ দেবতা হোরাস এবং মানুষের শরীরে বাজপাখির মাথা বসানো নয় ৷ এখানে দেবতা পুরোপুরি বাজপাখির রূপে প্রকট ৷ টলেমিরা গ্রিক হলেও মিশরের শিক্ষা-দীক্ষা ঐতিহ্যের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে গিয়েছিলেন ৷ দেওয়ালে নানারকম নকশা ৷ তার মধ্যে হোরাস হিপোপটেমাস বধ করেছেন-চিত্রটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৷ মন্দিরের পিছনে উঁচু পাড়ের ওপর এখনকার এডফু গ্রাম ৷ হোরাসের মন্দিরে দাঁড়িয়ে দেখেছি ওপরে বাচ্চারা ছুটে বেড়াচ্ছে ৷ কেউ বা মুখ ভেংচে পালাল ৷ সরু সরু কাঠের বারান্দা জুড়ে কাপড় শুকোচ্ছে ৷ এক বুড়ো ফরসিতে তামাক টানছে ৷ দল বেঁধে সব ফিটন চেপে জাহাজে ফিরলাম ৷ কারও কারও হাতে দক্ষ শিল্পীর গড়া নবনির্মিত পুরাকীর্তি ৷

এসনার লকগেট

বিকেলের আলোয় জাহাজ ছাড়ল ৷ এবার এসনা ৷ সেখানে রাত্রিবাস করতে হবে কারণ পরদিন সকালের আগে এসনার লকগেট খুলবে না ৷ শ্রীনগরে যাঁরা শিকারায় চড়ে ডাল লেক থেকে পুরনো শহর ঘুরেছেন খাল দিয়ে, তাঁদের কাছে এসনার লকগেট কিছু নতুন নয় ৷ কিন্তু যাঁরা এ-সুযোগ পাননি তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি যে এই লক আসলে দুখানা জাহাজ ধরে এমন একটি চৌবাচ্চা, যার দুদিকে দুটি গেট আছে ৷ প্রথম গেট খুলে জাহাজ দুটি চৌবাচ্চায় ঢোকে ৷ দুটি জাহাজ পুরোপুরি লেকের মধ্যে এসে গেলে দ্বিতীয় গেটটি খুলে চৌবাচ্চার জল বার করে দেওয়া হয় ৷ চৌবাচ্চার জলের লেভেল নামতে থাকে ৷ সঙ্গে সঙ্গে জাহাজও নেমে সামনের নদীর সঙ্গে সমতলে দাঁড়ায় এবং উন্মুক্ত লকগেট দিয়ে বেরিয়ে যায় ৷ তখন দ্বিতীয় গেটটি বন্ধ করে প্রথম গেটটি খোলা হয় চৌবাচ্চার জলের লেভেল আবার পিছনের নদীর সমপর্যায়ে আনা হয় ৷ নদীজলের উচ্চতার হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ এসনার বাঁধ ৷ যার একপ্রান্তে লকগেট দুটি লাগানো হয়েছে ৷ বাঁধের ওপর দিয়ে রাশি রাশি গাড়ি, মোটর, ট্রাক যাতায়াত করে (আসোয়ানের পরে এই প্রথম স্থলপথে নদী পার হবার উপায়), কিন্তু লকগেট খোলা থাকলে রাস্তার সেই অংশটিও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় ৷ হাওড়ার পুরনো ভাসা পোলের মতো ৷ কাজেই লকগেট যখন তখন খোলা যায় না, নির্দিষ্ট সময়েই লকগেট খোলা এবং আসোয়ান লাকসোরের জাহাজকে এসনার অনুশাসন মেনে চলতে হয় ৷

এসনার মন্দির

রাতে খেয়েদেয়ে ডেকের ওপর থেকে দেখলাম বাঁদিকের বাঁকের ওপর এসনার আলোকে ম্লান করে এসনার বাঁধের ওপর সার দিয়ে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে ৷ সে আলোর ওপারে অন্ধকার আকাশ নদীতে নেমে এসেছে ৷ সেখানে মিটমিট করছে কয়েকটি তারা ৷ সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট খেয়ে এসনার মন্দির দেখতে গেলাম ৷ এ মন্দিরও নবীন, খ্রিস্টজন্মের মাত্র ২০০ বছর আগে গ্রিকদের তৈরি ৷ তবে পুরাতত্বের নিদর্শন আছে যে, খ্রিস্টজন্মের ১৫০০ বছর আগে অমিতপরাক্রম ফারাও তৃতীয় থুতমোস এই জায়গাতেই একটি মন্দির বসিয়েছিলেন ৷ যে মন্দিরের এখন আর কিছু নেই ৷ মন্দিরটি বেশ ভালো অবস্থায় আছে ৷ এখানে দেবতা হলেন ভেড়ামুখো খুনউম ৷ ইনি হলেন প্রজননের দেবতা এবং সেই সূত্রে নীল নদের বিশেষ করে ক্যাটারাক্টগুলির দেবতা ইনি ৷ নীলই তো মিশরের ধাত্রী জননী এবং ক্যাটারাক্টগুলি পার হয়ে, তাবৎ নীলের জলস্রোত মিশরের মাটিকে উর্বরা করে রাখে ৷ এসনা দর্শন একটু তাড়াহুড়ো করে হল, কেননা লক খোলার সময় হয়ে গেছে ৷ এসনার লক পেরিয়ে আবার পঞ্চাশ কিলোমিটার খোলা নীল নদ ৷ মাঝখানে একটা চর জেগে উঠে নদী দুভাগ হয়ে গেছে ৷ যেন দুটি নদীর মোহনা ৷ লাকসোরের যত কাছে যাচ্ছি নদীতে জাহাজের সংখ্যা তত বাড়ছে ৷ দুই জাহাজে পাল্লা চলছে ৷ এ-জাহাজ থেকে ও-জাহাজে নিশানের সংকেত করা হচ্ছে-যাত্রীরা পরস্পরকে হাত তুলে অভিনন্দন করছে ৷ এই করতে করতে দুদিকে বসতি ঘন হয়ে এল ৷ খেত-খামার আর বিশেষ নেই-বাড়ি-ঘর, রাস্তায় বাস-মোটর চলছে ৷ শহরের ভিড় ডানদিকেই বেশি, সারি সারি বাড়ি হোটেল এবং তাদের পিছনে সুবিশাল প্রাচীন মন্দিরের সিংহাবস্থান ৷ ইব্রাহিম বললেন, ওই হল ইতিহাসের থিবস ৷ প্রাচীন মিশরের গর্বোজ্জ্বল রাজধানী ৷ রূপকথার নগর ৷ খ্রিস্টজন্মের পনেরোশো বছর আগে নীল নদের দুধারে পনেরো স্কোয়্যার কিলোমিটার জায়গা নিয়ে মহানগরী থিবস গড়ে উঠেছিল ৷ নদীর দুধারে বিচিত্র ছবি-কারুকার্যমণ্ডিত প্রাসাদের সারি, বাগান ফোয়ারা ৷ পথে নাগরিক, কর্মী, দেশদেশান্তরের স্বার্থবাহী বণিকের ভিড় ৷ হঠাৎ রব উঠল-সরে দাঁড়াও, সব সরে দাঁড়াও ৷ পিছন ফিরে চোখ মাটিতে নিবদ্ধ কর ৷ আমন রার পুত্র প্রত্যক্ষ দেবতা আমেনহোটেপ ৷ সূর্যমন্দিরে পূজা দিতে যাচ্ছেন ৷ রুপোর খোলা পাল্কিতে সোনার সিংহাসনে বসা তাঁর যুগ্মমুকুটভূষিত মুখের দিকে যেন কারও দৃষ্টি না পড়ে ৷ দেবতার দ্যুতিতে চোখ অন্ধ হয়ে যাবে ৷ স্বপ্ন দেখছ নাকি? ইব্রাহিমের কথায় চটকা ভাঙল ৷ খাওয়াদাওয়ার পর জাহাজের রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে পুরনো শহরের দিকে চেয়েছিলাম ৷ দল বেঁধে লাকসোর আর কার্নাক শহর দেখতে নামলাম ৷ নীল নদের ওপর শহর যেমন হয় ৷ এবড়োখেবড়ো ছিরিছাঁদহীন চেহারা ৷ পলেস্তারা খসা ইট বার করা দোতলা, তিনতলা বাড়ি, তারও উচ্চতায় সমতা নেই ৷ একতলায় দোকান, দোকান আর দোকান ৷ ওপরে অফিস বা লোকের ডেরা ৷ কেবল ট্যুরিস্টদের মুখ চেয়ে নদীর ধারের রাস্তাটি মসৃণ বাঁধানো ৷ তার একপাশে সারি দিয়ে হোটেল, সরকারি অফিস, মিউজিয়াম এবং এগুলো মোটামুটি সুদৃশ্য ৷ বাস এই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল ৷ কিছু দূর গিয়ে ডানদিকে পাঁচিলের আড়ালে চোখ পড়ল কার্নাকের মন্দির দেওয়াল ৷ ইব্রাহিম বললেন, এখানে আমরা পরে আসব ৷ আগে কার্নাকের মন্দির দেখে আসি ৷ সেইটাই তো আসল ৷

কার্নাকের মন্দির

থিবসের প্রাসাদ-বাগান-ফোয়ারার পুরাতাত্বিক নিদর্শন ছাড়া আর কিছু নেই ৷ সব অনেক হাত মাটির তলায় চলে গেছে এবং সেই মাটির ওপরেই গড়ে উঠেছে আধুনিক লাকসোর আর কার্নাক ৷ যে মন্দিরগুলি আমরা দেখতে যাচ্ছি সেগুলোও মাটির তলা থেকে খুঁড়ে বার করা হয়েছে এই সেদিন ৷ বাস আরও সামান্য কিছু এগোল ৷ মাঠের মাঝখানে দেখলাম বিরাট এক তোরণদ্বার ৷ বেশ ভালো অবস্থায় আছে ৷ ইব্রাহিম বললেন, কার্নাক মন্দিরের উত্তর দেওয়ালে এই তোরণটি বসিয়েছিলেন গ্রিক আমলের তিন নম্বর টলেমি ৷ তোরণের সামনে দুদিকে সারি বাঁধা ভেড়ামুখো স্ফিংসের মাঝখানে পাথরবাঁধানো রাস্তার কিছুটা এখনও দেখা যায় ৷ বাকি পাঁচিল এবং তার আনুষঙ্গিক নানা সংযুক্তি, এমনকী খনসু মানে চন্দ্রের দেবতার মন্দিরটি-সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ৷ বাস ততক্ষণে কার্নাকের ভাঙা পশ্চিম পাঁচিলের পাশ দিয়ে এসে মন্দিরের প্রধান তোরণের সামনে থেমেছে ৷ সুবিশাল মন্দির চত্বর (মিশরের বৃহত্তম) থিবসের আরাধ্য দেবতা আমন রা-র উদ্দেশে তৈরি হয়েছিল ৷ আসলে এটা একটা মন্দির নয় ৷ আমন রার মূল মন্দির ঘিরে আদ্যিকালের সেসোসট্রিস থেকে সেদিনের টলেমি পর্যন্ত এই মন্দিরের ভেতরে এবং বাইরে যার যেমন ইচ্ছা তোরণ, রাস্তা, মন্দির, বিশ্রামাগার বাঁধানো উঠান ওবেলিসক বসিয়ে গেছেন এবং সব যে খুব প্ল্যানমাফিক বসানো হয়েছে তা নয় ৷ দ্বিতীয় রামেসিস তো চারটি ৭৮ ফুট উঁচু থামের মাথায়, ছাদ বসালেন, যাতে প্রধান মন্দিরে আলো-হাওয়া ঢুকতে পারে ৷ থিবসে বৃষ্টির বালাই ছিল না ৷ মন্দিরের প্রধান অংশগুলি মোটামুটি এক লাইনে পশ্চিম থেকে পুবে এবং প্রতি অংশের আলাদা তোরণদ্বার ৷ পুরো মন্দিরে এরকম দশটি তোরণ আছে ৷

হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে যায় ৷ উঁচু-নিচুতে বুকে হাঁফ ধরে তবুও তোরণ পেরিয়ে দেখতে হয় ৷ দিল্লির দেওয়ানি আমের মতো বিরাট প্রাঙ্গণ যেখানে নিশ্চয় সাধারণ লোকেরা পূজায় ভিড় জমাতো ৷ সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে রামেসিসের হিপোস্টাইল হল ৷ ১৩৪টি পিলারের ওপর (কিছু কিছু পিলার এখনও দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ছাদ কোথাও নেই) এই হলটির আয়তন পঞ্চাশ হাজার স্কোয়্যার ফুট ৷ পৃথিবীতে এত বড় হল আর নেই ৷ এছাড়াও নানা দেব-দেবীর মন্দির, রানি হাটসেপসুটের শ্রদ্ধার্ঘ্য ৯৭ ফুট উঁচু ওবেলিসক আগাগোড়া রক্তাভ গ্র্যানাইটের তৈরি ৷ ছাদ বড় একটা কোথাও না থাকলেও দেওয়াল প্রচুর আছে এবং তার ওপর উৎকীর্ণ ছবিগুলি ইজিপ্টের ২০০০ বছরের চলন্ত ইতিহাস ৷ ফারাওদের যুদ্ধযাত্রা, শিকার খেলা, দেবতাদের সঙ্গে মেলামেশা, অরাতি দমন প্রভৃতি নানারকম ছবি তো আছেই ৷ এক জায়গায় বেশ কিছু জন্তু-জানোয়ারের ছবি আঁকা আছে ৷ দিগ্বিজয়ী ফারাও তৃতীয় থুতমোস প্রজাকুলের চিত্ত-বিনোদনের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে বিচিত্র আকৃতির জন্তু-জানোয়ার ধরে এনেছিলেন ৷ এগুলো তাদের ছবি ৷ একটু খুঁটিয়ে দেখলে হাতি, ভাল্লুক, গণ্ডার প্রভৃতি ইজিপ্টে অলভ্য বেশ কটি জন্তু চেনা যায় ৷ আর আছে লম্বা মুখওয়ালা কুমিরের মতো একটি জানোয়ার, অনেকটা যেন আমাদের ভাগীরথীর মকর ৷ মন্দিরের পিছনদিকে পবিত্র পুষ্করিণী, যাতে এখনও জল টলমল করছে, দেবকার্যের সমস্ত জল এখান থেকেই সরবরাহ হত ৷ পুষ্করিণীর ধার থেকে একটি বাঁধানো রাস্তা উত্তর দেওয়ালের অন্য একটি তোরণ পর্যন্ত গেছে ৷ তোরণ পেরোলেই বিখ্যাত অ্যাভেনিউ অব দ্য স্ফিংস, দুমাইল লম্বা এই রাস্তাটির দুধারে সিংহমুখো স্ফিংসের সারি, যার মাথায় রাতে আলো জ্বলে ৷ রাস্তাটি দিয়ে হাঁটতে শুরু করলে আধ ঘণ্টার মধ্যে লাকসোরের মন্দিরে পৌঁছনো যায় ৷ আমাদের হাতে অত সময় (এবং পায়ে অত সামর্থ) ছিল না ৷ আমরা ফিরে এসে বাসে চড়ে লাকসোরের মন্দিরে এলাম ৷

লাকসোরের মন্দির

কার্নাকের সুবিশাল মন্দির সমষ্টির এত কাছে আরেকটি মন্দির কেন বসানো হল এ-প্রশ্ন অনেকেরই মনে জাগতে পারে ৷ বিশেষ করে দেবতা যখন সেই একই আমন রা ৷ অধিকন্তুর মধ্যে এখানে আমন রা-র সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মাট এবং ছেলে খনসুও আছেন ৷ কার্নাকে মাট এবং খনসুর আলাদা আলাদা মন্দির ৷ আমার মনে হয়, ফারাও তৃতীয় আমন হোটেপ কার্নাকের সর্বজনীন মন্দির ছাড়াও নিজের জন্য একটি ব্যক্তি মন্দির চেয়েছিলেন ৷ এবং মন্দির একবার শুরু হলে অন্য ফারাওরা বা কম যাবেন কেন? বিশেষ করে দ্বিতীয় রামেসিস ৷ রামেসিস মন্দিরের বহুবিধ সংস্কার সাধন করেন ৷ দুটি ওবেলিসক বসিয়েছিলেন ৷ তার একটি এখনও আছে ৷ অন্যটি ১৯৩১ সালে আধুনিক ইজিপ্টের তদানীন্তন শাসনকর্তা মুহম্মদ আলি ফ্রান্সের রাজাকে উপহার দেন ৷ এটি এখন প্যারিসের প্লাস দ-লা কোঁকর্দে শোভা পাচ্ছে ৷ উত্তর গ্রিস থেকে আগত সামান্য সৈনিক এই মুহম্মদ আলি ৫০ বছর ধরে দোর্দণ্ডপ্রতাপে মিশর রাজত্ব করে গেছেন ৷ তিনটি প্রধান শক্তির-ইংরেজ, ফরাসি এবং তুর্কির সঙ্গে সমানে মোকাবিলা করেছেন ৷ এর বিরুদ্ধে ওকে লড়িয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর রাজনীতির মূলকথা ৷ এ বিষয়ে তিনি ক্লাইভ, হেস্টিংস, ডালহৌসির নাক কাটতে পারেন ৷ কেবল মাঝে মাঝে পুরাকীর্তিপাগল ইংরেজ আর ফরাসিদের পুরনো ইজিপ্টের দপ্তর থেকে কিছু থাম দেওয়াল তোরণ ইনাম দিতেন ৷ এগুলি এখন লন্ডন এবং প্যারিসের নানা স্থানে ছড়ানো আছে ৷

কার্নাকের পরে আবার লাকসোরের মন্দিরের বিশদ বিবরণ দেবার দরকার নেই ৷ এখানে পরিচয় হল সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো নীল নদের মাপকাঠি (Nilometer)-র সঙ্গে ৷ কার্নাকের মন্দির চত্বরে বেড়াতে বেড়াতে দেখলাম একটা কুয়োর মতো, যার চারপাশ ঘুরে সরু সিঁড়ি নেমে গেছে ৷ কিন্তু সিঁড়িটা কুয়োর বাইরে কেন? জল তোলার জন্যই হোক আর পরিষ্কার করার জন্যই হোক সিঁড়ি তো কুয়োর ভেতরে হবে ৷ ইব্রাহিম বুঝিয়ে দিলেন যে জিনিসটা আদপে কুয়োই নয় ৷ ওটি হল সেই পুরাকালের Nilometer. নদীর সঙ্গে কুয়োর সংযোগ থাকার দরুন কুয়োর জলের লেভেল থেকেই নদীর (বন্যার সময়ে) জলের লেভেল মাপা যেত ৷ নদীর জল কখন কীভাবে বাড়ছে (বা বাড়ছে না) তার ওপরেই নির্ভর করত (এবং এখনও করে) সে বছর চাষবাস কেমন হবে ৷ অনেকটা আমাদের বর্ষার মতো ৷ কেবল একটা বিষয়ে নীল নদের চাষীরা আমাদের চেয়ে ভাগ্যবান ছিল ৷ চাষের খাজনাও এই বন্যার জলের সঙ্গে বাঁধা ছিল ৷ জল যদি ১২ ফুটের কম বা ২২ ফুটের বেশি হত তাহলে খাজনা পুরোপুরি মকুব তো বটেই, ফারাওয়ের শস্যভাণ্ডার থেকে জনসাধারণ বিনামূল্যে খাবার পেত ৷ এই Nilometer-এর পাশে আরেকটি জিনিস ইব্রাহিম দেখালেন যার বিষয় কেবল বইতেই পড়া ছিল ৷ কেমন করে মাটির নিচের সুড়ঙ্গপথে কৌশলী পুরোহিতরা সবার অলক্ষে দেবতার পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেন এবং দেবতার মুখ দিয়ে তাঁদের নিজেদের অনুজ্ঞা প্রকাশ করতেন ৷ মন্দির নির্মাতা আমেনহোটেপের বিধবা মা যখন আমেনহোটেপের জন্ম দিলেন তখন এই পুরোহিতরাই বলেছিলেন যে আমেনহোটেপের বাবা হলেন সাক্ষাৎ আমন রা ৷ লাকসোরের মন্দিরে এই বিষয়ে কিছু দেওয়ালে ছবি আছে ৷ মন্দির থেকে যখন বেরোলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা ৷ শহরের আলো জ্বলছে ৷ আবার লোকের মুখও বিনা আলোয় দেখা যাচ্ছে ৷ বাসকে বললাম, এইতো পাশেই জাহাজঘাটা ৷ আমরা একটু শহরের ভেতর দিয়ে ঘুরেটুরে যাই ৷ ঘাটে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার গাঢ় হয়ে এল হয়তো সেইজন্যই পথ ভুলে আঘাটায় নেমে পড়লাম ৷ জাহাজ তখনও দুশো গজ দূরে ৷ জলের ধার দিয়ে কাঁচা রাস্তা ৷ সেখান দিয়েই না হয় যেতাম কিন্তু ঠিক তার পাশে বসেই একদল ষণ্ডামার্কা লোক ফরসি ঘিরে তামাক খাচ্ছে ৷ এদিকে ঘাট জনশূন্য ৷ আমরা দুই বিদেশি ৷ কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল ৷ আবার এই খাড়া পাড় বেয়ে অতগুলো সিঁড়ি ভেঙে ওপারের রাস্তায় উঠে যাব ৷ আর সেও তো ওই দলটার পাশ দিয়ে ৷ আমাদের দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখে দল থেকে একটা লোক উঠে এল ৷ মুহূর্তের জন্য বুকটা ধক করে উঠল ৷ তারপরেই দেখি লোকটা আমাদের জাহাজেরই একজন খালাসি ৷ দড়িদড়া টানে ৷ আজ রাতে জাহাজ লাকসোরেই থাকবে ৷ সারাদিন জাহাজি খাটুনির পর ওরা একটু আরাম করে তামাক খাচ্ছে ৷

ভ্যালি অব দ্য কিংস

বৃহস্পতিবারের সকাল ৷ বারবেলা হলে ওই ভুতুড়ে জায়গাটিতে যাওয়ার কথায় মন খুঁতখুঁত করতে পারত কিন্তু এমন সকালে প্রসন্ন সূর্যালোকে আকাশ নীলের সমুদ্র, হাওয়া অনুকূল ৷ নদীর জলে মিঠে আওয়াজ ৷ সেই নদী আড়পার হয়ে পশ্চিমকূলে Valley of the Kings-এ পৌঁছলাম ৷ অষ্টাদশ, ঊনবিংশ এবং বিংশ রাজবংশের (১৫৬০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রায় সব ফারাওই এখানে সমাহিত হয়েছিলেন ৷ Valley of the Kings-এর ধারে, দক্ষিণদিকে Valley of the Queens এবং এই দুটি ভ্যালির পিছনের পাহাড়শ্রেণীতে পাত্র, মিত্র সমানদের সমাধি ৷ মিশরিয় প্রেততত্বের মূল কথা হল এই যে, দেহটিকে রক্ষা করতে হবে ৷ কারণ কল্পান্তরে বিদেহী আত্মা ফিরে এসে নিজ দেহে প্রবেশ করবে ৷ মৃত পুনরুজ্জীবিত হবে এবং কল্পকাল স্বর্গবাস করবে ৷ এইজন্যই প্রথম মিশরিয়রা পিরামিড তৈরি করেছিল এবং এক হাজার বছর পরে ফারাওরা দেখল যে যত সুদৃঢ়ভাবেই পিরামিড তৈরি হোক না কেন সমাধিতস্করদের হাত থেকে মৃতদেহ এবং তার আনুষঙ্গিক সোনাদানা ধনরত্নাদি বাঁচানো যায় না ৷ থিবসের ফারাওরা তাই নতুন এক কৌশল অবলম্বন করলেন ৷ নদের ওপারে যে অর্ধবৃত্তাকার পাহাড়শ্রেণী, সেই পাহাড়ে তাঁরা সুড়ঙ্গ কেটে ভূগর্ভস্থ কক্ষে মৃতদেহ রাখবার বন্দোবস্ত করলেন ৷ এই হল Valley of the Kings. যেখানে এখনও পর্যন্ত চৌষট্টিটি সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং খননকার্য এখনও চলছে ৷ কিন্তু এত করেও সমাধিতস্করদের নিবৃত্ত করা যায়নি ৷ চৌষট্টিটি সমাধির মধ্যে একমাত্র টুটেনখামেনের সমাধি ছাড়া প্রতিটি কন্দরে চোরেরা ঢুকে সব নিয়ে গেছে ৷ এরা আধুনিক চোর নয় ৷ সমাধি মন্দির তৈরি করার দু-তিনশো বছরের মধ্যেই সব চিচিং ফাঁক হয়ে গেছে ৷ মিশরিয় পুরনো পাপিরাসে পড়া যায় যে, খ্রিস্টজন্মের ১১০০ বছর আগে পূর্ব থিবসের মেয়র অভিযোগ আনলেন যে পশ্চিম থিবসের মেয়রের আনুকূল্যে Valley of Kings-এ অবাধে চৌর্যবৃত্তি চলছে ৷ এই ডামাডোলের মাঝখানে ফারাও টুটেনখামেনের সমাধিগহ্বর কী করে ১৯২২ সাল পর্যন্ত অক্ষত ছিল, সেটা সত্যিই এক প্রহেলিকা ৷ তবে আমাদের ভাগ্য ভালো যে ১৯২২ সালের সমাধি আবিষ্কারক তস্কর ছিলেন না ৷ তিনি ছিলেন পুরাতাত্বিক ৷ তিনি টুটেনখামেনের সমাধিতে যে ঐশ্বর্য পেয়েছিলেন তার সবটাই কায়রোর অ্যান্টিকুইটি মিউজিয়ামের সম্পূর্ণ দ্বিতীয় তলা জুড়ে সাজানো আছে ৷

ইব্রাহিম কয়েকটি সমাধির ভেতরে নিয়ে গেলেন ৷ বেশ ওঠানামা করতে হয় ৷ তবে পাহাড় খোঁড়া এইসব সমাধির মধ্যে পিরামিডের তুলনায় জায়গা অনেক বেশি এবং দেওয়ালের কারুকার্য, বিশেষ করে রঙিন ছবিগুলি চিত্তাকর্ষক ৷ এখানের ছবি কিন্তু যুদ্ধযাত্রা, অরাতিদমন, শত্রুনিধন এসব বিষয়ে নয় ৷ দেবতার সামনে প্রার্থনা, ফারাওয়ের শবানুগমন, শোভাযাত্রা এইসব বিষয়েরই প্রাধান্য ৷ আর আছে পুরো দেওয়াল-ছাদ জুড়ে মিশরের আলেখ্যলিপিতে বিভিন্ন মন্ত্রের পাঠ, যা মৃতের প্রয়োজন হবে পরজগতের আশ্রয় পাওয়ার জন্য ৷ মৃতের যাত্রাপথে যেসব বাধা আসতে পারে, তার ছবি-যেমন কোথাও বিরাট বিরাট সাপেরা ফুঁসছে, কোথাও দৈত্যকুল পথ আটকেছে, কোথাও বা কুমিরমুখো দেবী আম্মাট আত্মাটিকে খেয়ে নেবেন বলে থাবা পেতে বসেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিপদের প্রতিষেধক মন্ত্র, প্রাচীন শিল্পীর রঙিন তুলিতে ছবির মতো আঁকা হয়েছে ৷ আর আছে অভিসম্পাতবাণী ৷ মৃতের বিশ্রামে যারা ব্যাঘাত ঘটাবে সেইসব চোর-ডাকাত-লুটেরাদের জন্য ওসিরিসের ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসার ব্যবস্থা ৷ চোরেরা অবশ্য এসব অভিশাপের পরোয়া না করে সমাধি খুঁড়ে দুহাতে লুটেছে সমাধি কন্দরের ধনসম্পদ ৷ ফলে তাদের কী হয়েছে, ইতিহাস যে সম্বন্ধে কিছু বলে না, কেবল শেষ যাঁরা ১৯২২ সালে টুটেনখামেনের সমাধি ভেঙে জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের হোতা লর্ড বার্নার্ডান এক বছরের মধ্যে দুর্ঘটনায় মারা যান ৷ খননকার্য যাঁরা চালিয়েছিলেন তাঁদেরও বেশ কয়েকজন বহু দুর্দশায় ভুগেছিলেন ৷ মিশরের সমাধিতত্ববিদরা তখন ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন যে এরকম যে হবে সে তো আমরা আগেই বলেছিলাম ৷ কত করে বারণ করেছিলাম ওদের… ৷

ডেইর-আল-বাহরি

আমাদের ধারণা যে ইজিপ্ট, ইজিপ্টোলজি, ইজিপ্টোলজিস্ট প্রভৃতি নিয়ে মাতামাতি শুরু হয় এই মোটে দুশো বছর আগে, যখন নেপোলিয়ান ইজিপ্ট অভিযান করেন ৷ তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কয়েকজন অনুসন্ধিৎসু পুরাতাত্বিক গিয়েছিলেন যার অগ্রণী হলেন বুসার্ড নামে এক ফরাসি ভদ্রলোক ৷ বুসার্ড আবিষ্কার করেন বিশ্ববিখ্যাত রোজেটা স্টোন ৷ কালচে লাল রঙের এই প্রস্তর ফলকে তিনরকমের আলেখ্যলিপি ডেমোটিক (আলেখ্যলিপি টানা হাতে লেখা) এবং গ্রিক হরফে একই অনুজ্ঞা উৎকীর্ণ করা হয়েছিল ৷ প্রায় ত্রিশ বছর পরে এই লিপি থেকেই মিশরের প্রাচীন আলেখ্যলিপির রহস্য ভেদ হয় এবং পৃথিবীর পণ্ডিতমহলে ইজিপ্ট নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় ৷ এ হল আধুনিককালের কথা ৷ কিন্তু তার অনেক আগে নতুন রাজত্বের (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০) ইজিপসিয়ানরা মধ্য এবং প্রাচীন রাজত্বের (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ৩০০০) পাথর দেওয়াল থাম মন্দির নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল ৷ এরই একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখলাম ডেইর-আল-বাহরিতে, ভ্যালি অব দ্য কিংস-এর পূর্বে মাইল পাঁচেক দূরে রানি হাটসেপসুটের মরটুয়ারি মন্দির দেখতে গিয়ে ৷ মরটুয়ারি মন্দির হল যেখানে সমাধির আগে মৃতদেহ রেখে দেওয়া হল ৷

ডেইর-আল-বাহরিতে প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলি তিন থাকে সাজানো আছে ৷ সবগুলিই একসময়ে বালিতে চাপা পড়ে গিয়েছিল ৷ খোঁড়া শুরু হবার পরে প্রথম থাকে বেরোল সপ্তম শতকের এক মনাস্ট্রির ধ্বংসাবশেষ ৷ আরও খুঁড়তে খুঁড়তে বেরোল হাটসেপসুটের মন্দির ৷ সে এক পেল্লায় ব্যাপার ৷ কাশীর ঘাটের চেয়েও চওড়া এবং বিস্তৃত সিঁড়ি বেয়ে উঠে যান মন্দির চত্বরে যেখানে সারি সারি থামের মাথায় ছাদ এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে (বোধহয় বালিচাপা ছিল বলে) ৷ সারি সারি এক মাপের থামের ওপর বসানো ছাদ (কলোনাড) মিশরের চেয়ে গ্রিক ভাস্কর্যের কথা মনে করিয়ে দেয় ৷ আশ্চর্যের বিষয় এই, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ বছর আগে (পার্থেননের বয়স মোটে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) হাটসেপসুট এই ধরনের হল কলোনাডের ধারণা করলেন কী করে? মন্দিরের জায়গাটি খুঁজে বের করতেও মুন্সিয়ানার পরিচয় রয়েছে ৷ থিবান পাহাড়শ্রেণী এখানে অন্তরীপের মতো নদীর ধারে চলে এসেছে ৷ যেখানে সেই খাড়া পাহাড়ের ঠিক তলায় পাহাড়ের মতোই বিরাট মন্দিরগুলোর দিকে চেয়ে থাকতে হয় ৷ ডেইর-আল-বাহরির মন্দির মিশরের অন্যতম প্রধান বিস্ময় এবং ইজিপ্টের ট্যুরিস্ট বইতে প্রায়ই এই মন্দিরের ছবি দেখতে যায় ৷ মন্দির স্থাপন করবার উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে গিয়েই রানি হাটসেপসুট সেই পুরাকালেও মিশরের প্রত্নতত্বের সম্মুখীন হন ৷ তাঁর মন্দিরের পাঁচিল আরও পাঁচশো বছর আগে তৈরি রানি নেফরুর মন্দিরের রাস্তা আটকে দাঁড়ায় ৷ এখনও দেখা যায় সেই সরু গলিটির, যেটি হাটসেপসুটের অনুজ্ঞায় রাখা হয়েছিল যাতে রানি নেফরুর মন্দিরের পথ খোলা থাকে ৷ এই গলিপথের ওপর তখনকার দিনের গ্রাফিটিতে অনেক নাম লেখা আছে ৷ নেফরু এবং প্রথম মেন্টুহোটেপের তৈরি মন্দিরগুলি মাটির ওপর বিশেষ কিছু আর নেই ৷ হল ডেইল-আল-বাহরির তৃতীয় স্তর ৷ হাটসেপসুটের মরটুয়ারি মন্দিরের সঙ্গেই সংলগ্ন আছে তাঁর তৈরি মহাদেবী হাথোরের মন্দির ৷ এই মন্দিরটি সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল বলে দেখা হল না ৷

এবার ঘরে ফেরার পালা ৷ প্রথমে জাহাজে এসে মালপত্র নিতে হবে ৷ তারপর লাকসোর এয়ারপোর্ট ৷ সেখান থেকে কায়রো ৷ কায়রোতে এক রাত কাটিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরব বাহরিন ও দিল্লি হয়ে ৷ ইতিমধ্যে রোদ চড়েছে ৷ বালি কিছু তেতেছে ৷ এলোমেলো হাওয়া, সকালের তুলনায় গরম ৷ সেই রোদে তাতা হাওয়ার ভেতর দিয়ে নদীতে এসে শরীর জুড়োল ৷ নদী পার হবার সময় অপসৃয়মাণ থিবান পাহাড়গুলোর দিকে চেয়ে মনে হল, ওরা যেন মঙ্গল গ্রহের কেনও লুপ্ত সভ্যতার নিদর্শন ৷ আজকের পৃথিবীর সঙ্গে ওদের কোনও যোগ নেই ৷

লাকসোর থেকে কায়রো ৷ একঘণ্টার উড়ান ৷ এরোপ্লেনও নদীপথ বেয়েই চলেছে ৷ ত্রিশ হাজার ফুট থেকে সমস্ত নীল নদের উপত্যকা একসঙ্গে চোখে পড়েছে ৷ সেই ঠিক যেন একটা নকশাকাটা শাড়ির পাড়, গুটানো ফিতের মতো কেউ সমানে সামনে মেলে নিয়ে যাচ্ছে ৷ মাঝখানে কালো নদীর জল, তার দুপাশে সবুজ তৃণভূমি, শস্যক্ষেত্র ৷ সবুজের পরেই দুধারে বালি, বালিয়াড়ি, ধু-ধু মরুভূমি ৷ একই দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখে ঘুম নেমে আসে ৷ মোহ জন্মায় হঠাৎ মনে হয় যেন কোথাও যাচ্ছি না আকাশে একটা স্থির বিন্দু হয়ে আছি ৷ কিন্তু যে ভ্রম মুহূর্তমাত্র ৷ মাইক্রোফোনে ঘোষণা হল অচিরে প্লেন কায়রো এয়ারপোর্টে নামবে ৷ আমাদের পুরনো বন্ধু মাহমুদ আবার আমাদের নিতে এলেন এবং রাত্রিবাসের জন্য হোটেলে পৌঁছে দিলেন ৷ পরদিন গালফ এয়ারপ্লেন তিনিই ধরিয়ে দিলেন ঘরে ফেরার জন্য ৷ বিদায় ইজিপ্ট ৷ সারাজীবন এই কদিনের কথা ভুলব না ৷

ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন