অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
সাতানব্বই-এর অক্টোবরে আমরা উলানবাটোর গিয়েছিলাম ৷ মোঙ্গলিয়া ৷ আমাদের টিকিট হয়েছিল থাই এয়ারওয়েজে ব্যাঙ্কক, সেখান থেকে কোরিয়ান এয়ারে সোল (Seul) ৷ সোল থেকে কোরিয়ান এয়ারওয়েজের অন্য ছোট প্লেনে উলানবাটোর ৷
ব্যাঙ্ককে, সোলে মালপত্র ডেলিভারি নিয়ে আবার অন্য প্লেনে ওঠা বড় হয়রানির কাজ ৷ তাছাড়া সোলে আমাদের প্লেন বদলাবার সময় ছিল খুব কম ৷
কলকাতা এয়ারপোর্টে তাই জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের মোটঘাট কি সোজা বুক করা যাবে উলানবাটোর পর্যন্ত?
যিনি আমাদের চেক-ইন করছিলেন, এয়ারলাইন্সের কর্মী, চমকে উঠেছিলেন ৷ বললেন, উলানবাটোর? সে কোথায়?
পরে বলেছিলেন, চোদ্দ বছর এই কাজ করছি মশাই, কেউ উলানবাটোর যাচ্ছে বলে কখনও শুনিনি ৷
প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আমরা এই না-জানা শহরে যাচ্ছি কেন? অনেক শহর তাদের নামেই আমাকে আকর্ষণ করে ৷ সেই আকর্ষণে যাবার ইচ্ছা ছিল ইরকুটস্ক, আলমাআটা, উরুমচি ৷ দিল্লি থেকে কাজাখস্তানের আলমাআটার বিমান যেত একসময় ৷ খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম কাজাখস্তানে যাবার ভিসা পাওয়া যায় না ৷ ওখান থেকে কেউ আপনাকে নিমন্ত্রণ না পাঠালে ভিসার দরখাস্ত নেওয়াই হবে না ৷
অতএব স্থির হল উলানবাটোর ৷ ভ্রমণ সম্পাদক অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে ইউরোপে উলানবাটোরের এক মহিলার পরিচয় হয়েছিল ৷ অমরেন্দ্রর অনুরোধে তিনি একটা নিমন্ত্রণবার্তা পাঠিয়েছিলেন ৷ শহরে হোটেলও ঠিক করে দিয়েছিলেন ৷
যাতায়াত কোন পথে সুবিধা হয়, এখান থেকে সব খবর পাওয়া যায় না ৷ কলকাতা-ব্যাঙ্কক-সোল-উলানবাটোর ছাড়াও অন্য পথে, কলকাতা-ব্যাঙ্কক-বেজিং-উলানবাটোর, যাওয়াও সম্ভব ছিল ৷ এখবরটা আমরা যাত্রার পূর্বে জানতাম না ৷
মোঙ্গলিয়া যাবার অন্য কারণও আছে ৷ নৃতত্ববিদেরা সারা পৃথিবীর মনুষ্যকুলকে কয়েক গোষ্ঠীতে ভাগ করেন ৷ তার মধ্যে অন্যতম হল দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের অধিবাসী মোঙ্গলয়েড ৷ এমনকি আমাদের পার্বত্য ভারতীয়দের মধ্যেও মোঙ্গলয়েড ছাপ পাওয়া যায় ৷
ছেলেবেলায় ভূগোলে পড়েছিলাম, মোঙ্গলীয়রা যাযাবর প্রকৃতির ৷ কোথাও স্থায়ী আস্তানা করে না ৷ তাঁবুতে বাস করে ৷ পশুপালন তাদের প্রধান কাজ ৷ ইচ্ছেমতো তাঁবু ও তাদের ঘোড়া-ভেড়া-ছাগল নিয়ে অন্য চারণক্ষেত্রে চলে যায় ৷ ঘোড়াই তাদের একমাত্র বাহন ৷ মোঙ্গলিয়েরা অত্যন্ত দক্ষ অশ্বারোহী ৷
মোঙ্গলিয়া ছোট দেশ নয় ৷ আয়তনে ভারতবর্ষের অর্ধেক ৷ অথচ জনসংখ্যা ছাব্বিশ লক্ষ মাত্র ৷ তারমধ্যে ছ-লক্ষের বাস উলানবাটোর শহরে ৷
এই ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠী থেকে দুই ‘খান’ একদা অর্ধেক পৃথিবী জয়ের পথে এগিয়েছিলেন ৷ চেঙ্গিস খান ও তাঁর নাতি কুবলাই খান ৷ খান মানে শাহানশাহ বা সম্রাট ৷ পৃথিবীর সমগ্র ইতিহাসে এত বিস্তৃত ভূখণ্ড জুড়ে সাম্রাজ্যের আর কোনও উদাহরণ নেই ৷
আমরা উলানবাটোরে নামলাম, তখন ভরা দুপুর ৷ আমাদের যাত্রার সময়টা যে ভুল ছিল সেকথা প্লেন থেকে নেমেই হাড়ে হাড়ে বুঝে গিয়েছিলাম ৷ এতটা ঠান্ডা হবে অনুমান করিনি ৷ তাপাঙ্ক চার বা পাঁচ ডিগ্রি ৷ ওভারকোট চড়াবার সিকি মিনিট সময়েই জমে গিয়েছিলাম ৷ উলানবাটোরেও এয়ারপোর্ট ও প্লেনের সংযোগের চলমান বাহু আছে ৷ সম্ভবত নামার সময় ব্যবহার হয় না ৷ আমাদের প্লেন থেকে হেঁটে এয়ারপোর্টে ঢুকতে হল ৷
কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশনে সময় লাগল না ৷ বাইরে বেরিয়ে আশা করে তাকিয়ে ছিলাম ৷ হয়তো কেউ আসবে ৷ আসবার কথা নয় ৷ শ্রীমতী নারানজারগাল, অমরেন্দ্রর বন্ধু, আমাদের হোটেল ঠিক করে দিয়েছেন ৷ তারপরই তিনি ইউরোপে চলে গিয়েছেন ৷ হোটেলের নাম জানি ৷ একটা ট্যাক্সি জোগাড় করতে পারলে হোটেলের পথে রওনা হতে পারি ৷
এক তরুণী আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন ৷ ছোটখাটো মানুষটি, সঙ্গে সুদেহী, দীর্ঘ এক পুরুষ ৷ মহিলা ইংরিজিতে জিজ্ঞাসা করলেন আমি মিঃ রায়, কিনা ৷ জিজ্ঞাসার প্রয়োজন ছিল না ৷ ছোট প্লেনে এসেছি সোল থেকে ৷ বেশি যাত্রী ছিল না প্লেনে ৷ সবই মোঙ্গলীয় চেহারা ৷ আমাদের মতো কৃষ্ণকায় আর্য কোথাও নেই ৷
তরুণী আমাদের ইন্টারপ্রেটর, দোভাষী ৷ তাকে পেয়ে খুব আশ্বস্ত হলাম ৷ সঙ্গের পুরুষটি গাড়ির চালক ৷ অবলীলায় আমাদের সুটকেশ দুটি তুলে নিয়ে গাড়িতে পৌঁছে দিল ৷ তরুণীর নাম ইয়াডমটসু ৷ অমরেন্দ্রর বন্ধু শ্রীমতী নারানজারগাল লিখেছিলেন মোঙ্গলিয়াতে আমাদের ইন্টারপ্রেটর লাগবে ৷ তিনিই মেয়েটিকে নিযুক্ত করেছিলেন ৷ পারিশ্রমিক দৈনিক ত্রিশ ডলার ৷ গাড়ি নারানজারগালের ৷ আমরা যে কদিন থাকব, ব্যবহার করতে পারব ৷
এইবার চারপাশ দেখবার অবকাশ হল ৷ আমরা দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরের মধ্যে রয়েছি ৷ বহু দূরে পর্বতশ্রেণী দেখা যাচ্ছে তিনদিকে ৷ তৃণলেশহীন, একটা গাছ নেই কোথাও, নিরলঙ্কার, চরাচরে অপার বৈরাগ্যের চেহারা ৷ তার সঙ্গে প্রায় বেমানান পরমাশ্চর্য নীল আকাশ ৷ সমস্ত রাস্তায়, আধঘণ্টার, বিশেষ বাড়িঘরও নেই, কয়েকটা অফিসবাড়ি, একটা ছোট কারখানা ৷ বৃক্ষহীন প্রান্তরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে পথ জনহীন ৷ কদাচ, দুয়েকটা গাড়ি বিপরীতমুখী ৷ সব জানলা বন্ধ, আরোহীদের দেখা যাচ্ছে না ৷ একটা নদী পেরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষাকৃত ঘন বসতি দেখা গেল ৷ তারপর, আবার এক প্রান্তরের মধ্য দিয়ে এসে নিঃসঙ্গ দুটি বারোতলা বাড়ি দেখতে পেলাম ৷ এই দুই বাড়ি নিয়ে আমাদের হোটেল বায়ানগোল ৷ হাওয়া দিচ্ছে শনশন, অতি শীতল হাওয়া ৷
এই যে এখন শীতের প্রারম্ভে দিগন্তব্যাপী ধূসর রিক্ত ছবি, এমন চলবে মে মাস পর্যন্ত ৷ তার আগেই জমিতে রং ধরতে শুরু করবে ৷ কল্পনা করছিলাম, আদিগন্ত নির্বাধ সবুজ, যত দূর চোখ যায়, না জানি কী অপূর্ব রূপ হবে তখন ৷ এই হল মোঙ্গলিয়া ৷ বছরে নমাস শীত, তিনমাস গ্রীষ্ম ৷ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন ৷ উত্তরে রাশিয়া, দক্ষিণে, পুবে ও পশ্চিমে চিন ৷
দোভাষী মেয়েটির কেন দরকার, প্রত্যহ ত্রিশ ডলারের বিনিময়ে, ক্রমশ বুঝতে পারছি ৷
বড় হোটেলের মধ্যে বায়ানগোল দ্বিতীয় ৷ বিদেশীদের বেশ যাতায়াত আছে ৷ এখানেও কেউ ইংরিজি বলে না ৷ যারা হোটেলের অভ্যর্থনার কাউন্টারে, তারাও ভাঙা ইংরিজির বেশি বলতে পারে না ৷ সব কথা, অন্তত আমাদের উচ্চারণে, বুঝতেও পারে না ৷ বুঝতে পারলাম দোভাষী না পেলে এই তৃণহীন, বৃক্ষহীন দেশে বাক্যহীন থাকতে হত ৷
আমাদের হোটেলটি ভালো ৷ দুজনের জন্য দৈনিক একশো ডলার ৷ শ্রেষ্ঠ হোটেলটি খুবই ভালো ৷ দাম কিছু বেশি ৷ এখানে সব ভালো জিনিসেই চেঙ্গিসের নাম ৷ বড় হোটেলের নাম চেঙ্গিস হোটেল, শ্রেষ্ঠ ভদকার নাম চেঙ্গিস ভদকা ৷ বৃহত্তম রাস্তার নাম চেঙ্গিস অ্যাভেনিউ ৷ হোটেলের লাউঞ্জ ছোট ৷ কিন্তু বাসকক্ষ প্রশস্ত ৷ সুখের সব উপকরণ মজুত ৷ এমনকী, এখন যা সর্বত্র প্রচলিত, ঘরে একটি ইলেক্ট্রিক কেটলিও আছে ৷ নিজের চা তৈরি করে নেবার জন্য ৷
হোটেলের ভোজনশালায় সেদিন দ্বিপ্রহরে লাঞ্চ করে দোভাষীকে ছেড়ে দিলাম ৷ একটু বিশ্রামের দরকার ৷ সে আমাকে একটা প্রোগ্রাম ধরিয়ে দিয়ে গেল ৷ শ্রীমতী নারানজারগাল আমাদের জন্য সাতদিনের ঠাসা প্রোগ্রাম করে দিয়ে গিয়েছেন ৷
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর চা করতে গিয়ে আমার স্ত্রী আবিষ্কার করলেন দুধ, চিনি ও কফির ছোট ছোট প্যাকেট আছে, চা নেই ৷ অনুমান করলাম চায়ের প্যাকেট রাখতে ভুলে গিয়েছে ৷ নিচে রিসেপশনে টেলিফোন করে অনুযোগ বোঝাতে অনেক সময় লাগল ৷ রিসেপশনের মেয়েটি সব কথার শেষে খালি বলে, নিচে আসুন, এখানে পাবেন ৷
নিচেই যেতে হল শেষপর্যন্ত ৷ মেয়েটি বোঝাল এই হোটেলে চায়ের প্যাকেট দেওয়া হয় না ৷ আমরা যদি চাই, তাহলে বাইরে প্রায় দুটো ফুটবল মাঠ পার হয়ে যে কয়েকটি দোকান দেখা যাচ্ছে সেখানে পেতে পারি ৷ তখনও বেশ রোদ রয়েছে, যদিও হিমশীতল হাওয়া বইছে শনশন করে ৷
মস্ত বড় মাঠের মধ্যে পাঁচ-ছটি স্বতন্ত্র ছোট ছোট দোকান ৷ কাঠের ঘর ৷ কেবিন বা কিয়স্ক বলা যায় ৷ হাড় জমানো হাওয়ার প্রকোপে দোকানদার ছোট্ট একটা ফোকরের ওপর কাচ নামিয়ে দিয়ে কেবিনের ভেতরে বসে ৷ খদ্দের এলে কাচ তুলছে ৷ বাইরের শোকেস দেখে অনুমান করতে হয় কীসের দোকান ৷ আমরা একটা দোকানের মানুষটিকে আমাদের প্রয়োজনের কথা বললাম ৷ সে নির্বিকার তাকিয়ে থাকল ৷ অনেক চেষ্টা করলাম বোঝাবার, কিন্তু কিছুই হল না ৷ দ্বিতীয় দোকানেও ব্যর্থ হলাম ৷ তৃতীয় দোকানের বিক্রেতাও আমাদের হাঁকিয়ে দিচ্ছিল, হঠাৎ দেখতে পেলাম ভেতরের শেলফে লিপটন ছাপ মারা প্যাকেট ৷ টি ব্যাগ ৷ এক বাক্স কিনে হোটেলে ফেরবার আগে জলও দু বোতল নেওয়া হল ৷ এক বোতল জলের দাম পনেরোশো তুগরুক, অর্থাৎ প্রায় দু ডলার ৷ ভেবে আশ্বস্ত হলাম এই ঠান্ডার দেশে বেশি জল খাবার প্রয়োজন হবে না ৷
মোঙ্গলিয়ার জল যে নির্ভয়ে পান করা যায় না, সোল থেকে প্লেনে আসবার সময়ই বুঝতে পেরেছিলাম ৷ প্লেনে প্রত্যেক আসনের সামনের পকেটে, এই প্রথম অভিজ্ঞতা হল, এক বোতল মিনারেল ওয়াটার ৷ জিজ্ঞাসা করতে এয়ারহোস্টেস বলেছিল, মোঙ্গলিয়ার জল না খাওয়াই ভালো ৷
আসলে মোঙ্গলিয়ায় জল খাবার রেওয়াজ নেই ৷ অন্যতম পানীয় হল ভদকা ৷ তাছাড়া বিয়ার এবং স্থানীয় সস্তার মদ্য এদের পিপাসা নিবারণের পানীয় ৷ ঘোড়ার দুধ থেকে চোলাই করা মদ কুমিস সাধারণ মানুয়ের প্রিয় পানীয় ৷
আমরা আটদিন থাকব এদেশে ৷ প্রথমদিনটা তো কেটেই গেল ৷ দ্বিতীয়দিন থেকে আমাদের প্রোগ্রামের শুরু ৷
নিজের ঘরের উষ্ণ পরিবেশ ছেড়ে সন্ধ্যার পর আর কোথাও যেতে মন চাইল না ৷ হোটেলের ভোজনশালাতেই ডিনার সম্পন্ন করা গেল ৷ সেই বিনা মশলার ইউরোপীয় খাদ্য ৷ স্বাদ চেনা, নামও চেনা ৷ আশ্চর্য, হোটেলে কোনও মোঙ্গলিয়ান খাবার পরিবেশিত হয় না ৷ ভোজনকক্ষের পরিচারক ইংরিজি বুঝতে পারে ৷ কিছু বলতেও পারে ৷ বলল, মোঙ্গলিয়ান পদ চাইলে নিচের বায়ানগোল রেস্টুরেন্টে যেতে হবে ৷ এই বিশাল রেস্টুরেন্ট সম্পূর্ণ গোলাকার ছাদের নিচে, হোটেলের দুই বাড়ির মাঝখানে ৷ গোলাকার ভোজনশালা বলে নাম বায়ানগোল, তা কিন্তু নয় ৷ বায়ান মানে ঐশ্বর্যময়ী, গোল মানে নদী ৷ আমাদের হোটেলের ইংরিজি নাম হতে পারত রিচ রিভার ৷
বায়ানগোল রেস্টুরেন্টে পরে অনেকবারই গিয়েছি ৷ সেখানেও মোঙ্গলদের নিজস্ব ভোজ্যের সংখ্যা নগণ্য ৷ আসলে, সম্পূর্ণ মেনু কার্ডটিই ছোট ৷ বেশি পদের আয়োজন নেই ৷
যেহেতু আমি খবরের কাগজের সঙ্গে যুক্ত, অমরেন্দ্রর বন্ধু তাই আমার জন্য যে প্রোগ্রাম করেছেন তাতে সংবাদপত্র অফিস পরিদর্শনের প্রাধান্য ৷ ভদ্রমহিলা নিজেও পরোক্ষে সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত ৷ তাঁর একটি বড় ছাপাখানা আছে ৷ সেখানে পাঁচ-ছটি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্র ছাপা হয় ৷ সর্বপ্রথম তাই দেখতে গেলাম দ্বিতীয়দিন সকালে ৷
মোঙ্গলীয়রা সাজসজ্জা ভালোবাসে ৷ মেয়েরা তাদের স্বাভাবিক গোলাপি রঙের ওপরও রং চড়ায় ৷ মেয়েদের চুল দীর্ঘ এবং নিকষ কালো ৷ এখন শীত পড়েছে, স্ত্রী-পুরুষ সবাই গাম বুটের মতো জুতো পরেছেন ৷ এখানে চামড়া সহজলভ্য এবং সস্তা, তাই ভালো জুতো পরার বিলাসিতা এদের ছাড়তে হয় না ৷
নটার সময় প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ৷ আটটা না বাজতেই দোভাষী পৌঁছে গেল ৷ মেয়েটির চেহারা সাধারণ মোঙ্গলিয়ানদের সঙ্গে মেলে না ৷ ছোট হালকা শরীর, কচিমুখ ৷ আজ সকালে মাথায় প্লাস্টিকের ফুল ৷ কালো ভারি পশমের জামার ওপর কালো ওভারকোট ৷ আমরা তখনও ব্রেকফাস্টে ৷ তাড়াতাড়ি নেমে এলাম ৷ মেয়েটি অধীর পায়চারি করছে ৷ বললাম, এখনও তো অনেক সময় আছে ৷ ইয়াডমটসু বলল, তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো, যদি দেরি হয়ে যায় ৷
দোভাষীর নাম উচ্চারণ করা সহজ নয় বলে, সে নিজেই বলল, নামের প্রথম অংশটা উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট হবে ৷ অর্থাৎ ইয়া ৷ পরে ইয়া নামেই তাকে ডাকা হত ৷
মেয়েটি ইংরিজি ভালো বলে ৷ গ্র্যাজুয়েট হবার পর, এক বছর ইংরিজির ক্লাস করেছে ৷ সাধারণ পর্যটকের জন্য তার জ্ঞান যথেষ্ট ৷ কিন্তু আমরা তো সাধারণ নয় ৷ শ্রীমতী নারানজারগাল আমাদের এমন গুরুত্ব দিয়েছেন যে আমরা গুরুগম্ভীর বাক্যালাপ না করলে তাঁর মান থাকবে না ৷ বিভিন্ন কাগজের অফিসে যাব, সম্পাদকদের সঙ্গে মিটিং হবে, যথার্থ কথা না বলতে পারলে, কঠিন প্রশ্ন না করলে আমার নিজের সম্পাদকত্বই বা থাকবে কোথায়?
প্রথম প্রশ্ন করেই হোঁচট খেতে হল ৷ এখানে সংবাদপত্র কি এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন? ইংরিজি প্রশ্নে ফ্রি কথাটি যোগ করেছিলাম ৷ তৎক্ষণাৎ ইয়া বলল, না না আদৌ ফ্রি নয় ৷ সব কাগজের দাম লাগে ৷
ভুল শোধরাবার জন্য বললাম, সরকারি কোনও বাধানিষেধ নেই? উত্তর শুনলাম, না, যার যেমন ইচ্ছা দাম রাখতে পারে ৷
অকারণ আর বাক্য বাড়াইনি ৷
শ্রীমতী নারানজারগালের অফিস খুব বড় কিছু নয় ৷ একটি অফসেট রোটারি আছে ৷ ম্যাগাজিনগুলি মুদ্রণের কাজে ব্যবহৃত হয় ৷ নারানজারগাল নিজেও একটি সাপ্তাহিকপত্র শুরু করেছেন, খুব বিক্রি হয় মনে হল না ৷ অফিসের মানুষগুলি ভালো ৷ হাসিমুখে চেয়ে থাকে, কথা হয় না ৷ সমস্ত অফিসে মাত্র একজনই ইংরিজি বলতে পারে ৷ একই বাড়িতে আরও কয়েকটি অফিস ৷ তার মধ্যে একটি হল প্রেস ইনস্টিটিউট ৷ ডিরেক্টর ইংরিজি ভালো বলেন ৷ বিদেশে নানা সেমিনারে গিয়েছেন ৷ পৃথিবীর খোঁজখবর রাখেন ৷ তাঁর কাছে শুনলাম, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর মোঙ্গলিয়ার পুনর্জন্ম হয়েছে ৷ দেশে বিশেষ কোনও শিল্প গড়ে ওঠেনি ৷ পশুপালন এবং কোনও কোনও অঞ্চলে চাষ-আবাদের ওপর নির্ভর করত মোঙ্গলিয়ার অর্থনীতি ৷ ১৯৯০ সালে প্রথম সোভিয়েত আওতার বাইরে মোঙ্গলিয়া স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ঘোষিত হয় ৷ একদলীয় রাজনীতির শেষও হয় তখন ৷ এখন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে ৷ বহুদলীয় প্রথম নির্বাচনে পুরাতন কমিউনিস্ট পার্টিই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল ৭৬ সদস্যের পার্লামেন্টে ৷
তখন কথাটা মনে হয়নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ৭৬ সদস্যের মধ্যে মাত্র সাতজন মহিলা নিয়েই সন্তুষ্ট মোঙ্গলিয়ার মানুষ ৷ পরে একজন মহিলা সংসদ সদস্যের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তিনি দেশের শাসনব্যবস্থায় মহিলাদের স্থান নেই বলে আক্ষেপ করেছিলেন ৷ তিনিও শতকরা তেত্রিশ জন সংরক্ষণের কথা বলেননি ৷ আশ্চর্য এই যে, মোঙ্গলিয়া প্রায় পূর্ণ সাক্ষর দেশ ৷ কাগজপত্রে দেখেছি, মোঙ্গলিয়ার সাক্ষরতার হার শতকরা পঁচানব্বই ৷ সংখ্যাটায় কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন ৷ ডেনমার্কের এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ৷ এদেশে গ্রামোন্নয়নের কাজ করছিলেন ৷ তিনি বললেন, এদের কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় ৷ পঁচানব্বই পারসেন্ট সাক্ষরতা অবাস্তব ৷ আসলে পঁচাশি পারসেন্ট হবে ৷ মেরে কেটে নব্বই ৷
সাক্ষরতায় যারা এত এগিয়ে সেদেশে খবরের কাগজের প্রসার নেই কেন? ডিরেক্টর বললেন, সেদিন পর্যন্ত সার্বভৌম মোঙ্গলিয়া গঠনের পরও কমিউনিস্ট প্রাধান্যে সংবাদপত্রের ওপর নানা বিধিনিষেধ ছিল ৷ সবে দুবছর হল অকমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর খবরের কাগজ সত্যিকারের স্বাধীন হয়েছে ৷ এখন পঞ্চাশ-ষাটটি সাময়িকপত্রের নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে ৷ তার মধ্যে চারটি দৈনিক কাগজ ৷
এই সব দৈনিকপত্রের অফিসেই আমাকে যেতে হয়েছিল ৷ সাপ্তাহিকেরও কয়েকটি অফিসে গিয়েছি ৷ আমাদের তুলনায় এখানকার পত্রপত্রিকা অতি সাধারণ ৷ বিক্রিও বিশেষ নেই ৷ তার অবশ্য অন্য অন্তরায় আছে ৷ প্রকাণ্ড দেশ, যানবাহন নেই পর্যাপ্ত, বাঁধানো রাস্তাও অল্প ৷ তার ওপর, এক লাখের ওপর জনসংখ্যার শহর মাত্র চারটি ৷ সেখান থেকে দুটি-চারটি সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয় ৷ শহরের বাইরে কোনও কাগজের বিক্রি নেই বললেই চলে ৷ উলানবাটোরের নিকটতম বড় শহর দুশো কিলোমিটার দূর ৷
সেদিন দ্বিপ্রহরের ভোজন হল নারানজারগালের অফিসের ক্যান্টিনে ৷ মোট ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন কর্মীর জন্য ক্যান্টিন ৷ আহারাদির ঘটা নেই ৷ সবাই এক বাটি নুডল খাচ্ছেন ৷ নুডলে ছোট মাংসখণ্ড এবং কিছু সবজি মেশানো ৷ আমাদের জন্য বিশেষ খাবার, ফ্রায়েড রাইস এবং মাংসের কবাব ৷ ফ্রায়েড রাইস চলনসই ৷ বিনি মশলার ভোজ্যে যেমন স্বাদ হবে কাবাবের স্বাদ তেমনই ৷ তবে ঝলসানোর সুগন্ধ ছিল ৷ জলের বদলে আমাদের জন্য স্প্রাইট বা কোকাকোলা ৷ ভোজনান্তে মস্ত বড় বাটিতে করে সুপের ধরনের কিছু এল ৷ নাম শুনলাম সুখে ছ্যা ৷ অর্থাৎ দুধের চা ৷ ছ্যা শব্দটা জানা ছিল না বলে কাল চা কিনতে গিয়ে এত হেনস্থা ৷ সুখে ছ্যা-ও আমাদের অন্যভাবে হেনস্থা করেছিল ৷ চা-এ চিনির বদলে নুন দেওয়া ৷ শুনেছিলাম তিব্বতীরাও নাকি নুন-যুক্ত চা পান করে ৷ তারা আরও একটু বেশি, দুধের বদলে মাখন যুক্ত হয় চা-এ ৷ দুপুরটা আমাদের ছুটি ৷ সকালে কিছুক্ষণ উলানবাটোরের ম্যাপ দেখেছিলাম ৷ খুব ছড়ানো শহর, জনসংখ্যার পক্ষে ৷ বাস চলাচল করে ঘন ঘন ৷ একদা-অশ্বারোহীদের কাউকে অশ্বপৃষ্ঠে দেখলাম না ৷ এমনিতে অফিস অঞ্চল ছাড়া, সর্বত্র মানুষজন কম ৷
নারানজারগালের গাড়ি ব্যবহার করবার সুযোগ পেয়ে আমাদের ভারি সুবিধা হয়েছিল ৷ ক্যামেরার জন্য ব্যাটারি কোথায় পাওয়া যাবে দোভাষী বলতে পারলেন না ৷ ড্রাইভার বুদ্ধিমান ব্যক্তি ৷ সে একটা মস্ত দোকানে নিয়ে গেল ৷ মূল্যবান ক্যামেরা, ভিডিওর যন্ত্রাদি, সাউন্ড সিস্টেম, কী নেই ৷ দোকানটা যেন উলানবাটোরের সঙ্গে মেলে না ৷ একেবারে সর্বাধুনিক ৷ কেনাকাটাও হচ্ছে খুব ৷ রাতে আমাদের অপেরা দেখবার প্রোগ্রাম ৷ পাঁচটার সময় এসে ইয়া আমাদের নিয়ে গেল ৷
মনে করেছিলাম অনেক দূরে যেতে হবে ৷ তা নয় ৷ সুখবাটার স্কোয়্যারের পিছন দিকে ৷ মিনিট দশেক লাগল ৷ শো আরম্ভ হবে ছটায় ৷ তাহলে এত তাড়াতাড়ি এলাম কেন? ইয়া বলল, যদি দেরি হয়ে যায়, তাই ৷ তখনই অবশ্য অনেকে আসতে আরম্ভ করেছে ৷ অপেরা বাড়িটার বাইরের বারান্দায় এক সার গ্রিক করিন্থিয়ান স্তম্ভ ৷ তারপর চওড়া বারান্দা পার হয়ে প্রবেশদ্বার ৷ এটি জাতীয় সম্পত্তি ৷ অপেরা এবং ব্যালে এখানেই অনুষ্ঠিত হয় ৷ প্রায় প্রত্যহই কিছু না কিছু অনুষ্ঠান থাকে ৷ ভেতরটাও বেশ মনোজ্ঞ ৷ ইউরোপিয়ান অপেরা হাউসের মতো লাল ভেলভেটে মোড়া নয় ৷ পিছনের অংশ দোতলা ৷ আমরা বিশিষ্ট আসন পেয়েছি, আমাদের জন্য বক্স ৷ বক্সে আসীন হয়ে নিচে দর্শকদের আনাগোনা দেখছি ৷ সবাই বেশ সাজগোজ করে এসেছেন ৷ অনেকের আপাদমস্তক চামড়ার জামা ৷ মেয়েদের সুগৌর বর্ণে লালের ছোঁয়া, মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল ৷ সবার পায়েই গামবুট ৷
ইতিমধ্যে আমার শীত করতে আরম্ভ করেছে ৷ বুঝতে পারলাম প্রেক্ষাগৃহে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই ৷ ওভারকোট বাইরে রেখে আসা ভুল হয়েছে ৷ আমাদের বক্সের তিনটি খালি চেয়ারে এবারে দুজন অনুচর নিয়ে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আসন নিলেন ৷ তাঁর গায়ে আজানুলম্বিত ওভারকোট ৷ আমি লোভাতুর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে থাকলাম ৷ তিনি মনে করলেন কথা বলতে চাইছি ৷ তিনিও অনেক কথা বললেন, যার বিন্দুবিসর্গ আমরা বুঝতে পারলাম না ৷ আমাদের দোভাষী তাঁকে কী বলার পর তিনি কথোপকথনে নিরস্ত হলেন ৷ ইতিমধ্যে অপেরা শুরু হবার আগে অর্কেস্ট্রা শুরু হয়েছে ৷ এই দৃশ্যটা বড় সুন্দর ৷ সুন্দর পোশাকে কন্সার্টের প্রত্যেকটি শিল্পী সুসজ্জিত ৷ কন্ডাক্টারের হাত ও মাথা নাড়ার সঙ্গে বাজনা বাড়ছে, আবার কখনও কানে কানে কথা বলার মতো একান্ত হয়ে উঠছে ৷
অপেরার কাহিনী ইয়ার কাছে আগেই শুনে নিয়েছিলাম ৷ প্রণয়ীযুগল যখন সুখের সপ্তম স্বর্গে, তখনই মঞ্চে আবির্ভাব অত্যাচারী শাসকের ৷ লুণ্ঠিতা নায়িকার সন্ধানে প্রণয়ী অরণ্য, মরুপ্রান্তর পার হয়ে পাপিষ্ঠ শাসককে হত্যা করে প্রেমিকাকে উদ্ধার করলেন ৷ যতক্ষণ নৃত্যগীত চলছিল, শীতের প্রকোপ ভুলে ছিলাম ৷ অনুষ্ঠান শেষ হতেই শীত যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর ৷ প্রেক্ষাগৃহ এত ঠান্ডা? অথচ অন্য কারও সামান্যতম কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয় না ৷ আমার পাশের দীর্ঘ ওভারকোট পরা পদাধিকারী উঠে দাঁড়িয়ে সম্ভ্রমের সঙ্গে বিদায় নিলেন ৷ আমি কাঁপতে লাগলাম ৷ দরজার সামনে ভিড়, উত্তেজিত আলোচনা হচ্ছে, মানুষের চোখমুখে প্রশংসার আলো ৷ ভিড় আর এগুতেই চায় না ৷ আমি ওভারকোটের কাছে পৌঁছবার জন্য ব্যাকুল ৷ অবশেষে ওভারকোট পাওয়া গেল ৷ যেন পরশমণি পেলাম ৷ ওভারকোটের উত্তাপ প্রাণমন দিয়ে সেবন করতে করতে ভেতরের বারান্দা পার হয়ে বাইরের বারান্দায় পৌঁছলাম ৷ সঙ্গে সঙ্গে হিমশীতল বাতাস যেন ধাক্কা দিয়ে তার উপস্থিতি আমার হাড়ে হাড়ে পৌঁছে দিল ৷ তখনও জানি না আর কত কষ্ট বাকি আছে ৷
ক্রমে ভিড় কমে এল ৷ ইয়া আমাদের গাড়ি ও ড্রাইভার ডাকতে গেল ৷ সামনে যে চার-ছটি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল, সেগুলি যাত্রী নিয়ে চলে গেল ৷
ইয়া ফিরে এসে বলল, ড্রাইভারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, গাড়িও নেই ৷ হয়তো কিছু খেতে গিয়েছে, অথবা … ৷ এতক্ষণে শেষ দর্শকও চলে গেল, অপেরা হাউসের মস্ত বড় বড় দরজা খুব শব্দ করে বন্ধ হয়ে জায়গাটা নিথর নিঝুম ৷ তারমধ্যে আমি শীতে কাঁপছি ৷ আমাদের মাথার ওপর আলো জ্বলছে, কিন্তু সামনেটা নিরেট অন্ধকার ৷ এবারে সে আলোও নিভে গেল, দুটি ছোট আলো ছাড়া ৷ ইয়া বলল, আরেকবার ড্রাইভারকে খুঁজে আসি ৷ কোথায় যেতে পারে?
চলে যেতেই আমার শীতের কাঁপুনি আরও বাড়ল ৷ অচেনা দেশে, জনহীন প্রান্তরের অন্ধকারে, বিশাল অট্টালিকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমি নানা দুর্বিপাকের কল্পনা করতে লাগলাম ৷
ইয়া আর আসে না ৷ কতক্ষণ কেটে গিয়েছে কে জানে, ইয়া এসে বলল, ড্রাইভারকে পাওয়া গেল না ৷
তাহলে উপায়? ইয়া বলল, একটু যদি হাঁটতে পারেন ওই দূরের রাস্তার আলোর দিকে কিছু উপায় হবে ৷ আমরা তৎক্ষণাৎ রাজি ৷ হাঁটতে আরম্ভ করলাম অন্ধকারে ৷ ক্রমে সামনে একটা বড় রাস্তা স্পষ্ট হল, সেখানে দুদিকের গাড়ি চলেছে ৷ আমরা রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালাম ৷ আমি দুচোখ জ্বেলে ট্যাক্সি খুঁজছি, ইয়া হঠাৎ একটা গাড়ি থামাল হাত তুলে ৷ ড্রাইভারের সঙ্গে কী কথা বলে বলল, আসুন, উঠে পড়ুন ৷ কার গাড়ি, কোথায় যাচ্ছি, এসব ভাবনা ছিল না তখন ৷ কিছুক্ষণ পরেই আমাদের হোটেলের দরজায় পৌঁছে গেলাম ৷ ইয়া আমাকে আর কথা বলার অবসর না দিয়ে চলে গেল ৷
পরদিন সকালে শুনলাম, উলানবাটোরে ট্যাক্সি সংখ্যায় কম বলে সব গাড়িই খালি থাকলে ট্যাক্সির কাজ করে ৷ ভাড়াও বাঁধা, প্রতি কিলোমিটার ২০০ তুগরুক, অর্থাৎ ছ-সাত টাকা ৷ পরে আমরাও রাস্তায় এমন চলন্ত গাড়ি থামিয়ে ব্যবহার করেছি ৷
রীতিটা আমার খুব ভালো লেগেছিল ৷ কত সহজে কঠিন সমস্যার সমাধান হয় ৷ হঠাৎ মনে হয়েছিল, আমাদের ড্রাইভারও এমনই কোনও সওয়ারি নিয়ে সে রাতে অন্যত্র চলে গিয়েছিল ৷ ইয়াকে প্রশ্ন করে বিব্রত করতে ইচ্ছা হল না ৷
প্রত্যহ একটি দুটি খবরের কাগজের অফিস দেখে বেড়াচ্ছি ৷ এদেশ এখনও সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে নিতান্ত নাবালক ৷ বিক্রি সামান্য হয়, তার মধ্যে মোঙ্গলিয়ান ভাষার সরকারি দৈনিকটির বিক্রি শুনলাম পঞ্চাশ হাজারের ওপর ৷ বিপক্ষদলের একটি কাগজ আছে, সেটি সন্ধ্যায় সরকারি খবরের কাগজের ছাপাখানায় মুদ্রিত হয় ৷ বিলি হয় পরের দিন ৷ নতুনত্বের মধ্যে মোঙ্গলিয়ান পার্লামেন্টের একটি খবরের কাগজ আছে ৷ রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের আগে নাকি পুলিশের একটা দৈনিক কাগজ ছিল ৷
শহরে সংবাদপত্রের বিতরণ হয় পোস্ট অফিস মারফত ৷ চিন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নেও একদা এই ব্যবস্থা ছিল ৷ রাজনৈতিক পালাবদল হবার পর, মোঙ্গলিয়ার ডাকব্যবস্থা এখন বেসরকারি পরিচালনাধীন ৷ খবরের কাগজ বিক্রির স্টলও দেখেছি উলানবাটোরে, সংখ্যায় বেশি নয় ৷
মোঙ্গলিয়ার যে ছবি আমার মনে উৎকীর্ণ ছিল, তার সামান্যই দেখছি উলানবাটোরে ৷ আধুনিক রীতির কিছু অ্যাপার্টমেন্ট হাউস দেখেছি, কিন্তু যে যাযাবর জাতি তাঁবুতে বাস করে, ঘোড়া যাদের প্রধান বাহন তাদের দেখছি না ৷ ইয়া বলল, এখন শহরের মধ্যে তাঁবুতে বাস কমে গিয়েছে ৷ বড় বাড়িতে ফ্ল্যাট পাবার পর অনেকেই তাঁবু ছেড়ে বাড়িতে উঠে এসেছে ৷ আবার এমনও আছে, চার দেওয়ালের বন্দিত্ব অসহনীয় বলে ফ্ল্যাট ছেড়ে কেউ কেউ তাঁবুতে ফিরে গেছেন ৷ আর, অশ্বারোহী? তাদের দেখা যাবে শহরের বাইরে ৷ তাও বেশি নয় ৷
শহরের এক প্রান্তে টেলিভিশন স্টুডিওতে যাবার পথে তাঁবু দেখলাম ৷ অস্থায়ী বেড়া দিয়ে ঘেরা খানিকটা জায়গায় কয়েকটি কাঠের ও টিনের বাড়ি, তারই মধ্যে দশ-পনেরোটি গোল সাদা তাঁবু ৷ মাথাটা চূড়ার ধরনে, সেখান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে ৷ এই হল মোঙ্গলীয়দের স্বাভাবিক বাসস্থান ৷ ক্রমশ আরও কিছু তাঁবু দেখলাম শহরের নানা অঞ্চলে ৷ বোঝাই যায় তাঁবুর সংখ্যা কমে আসছে ৷ মানুষ ক্রমশ সভ্যতার আশ্রয় অ্যাপার্টমেন্টে উঠে আসছে ৷
এখনও প্রয়োজনের অনুরূপ বাসস্থান নির্মিত হয়নি ৷ তাই অনেককেই একটি দুটি ঘর নিয়ে থাকতে হয় ৷ বেসরকারিকরণ শুরু হয়েছে, তাই শহরের অনেক স্থানেই নির্মাণকার্য দেখা যায় ৷
সোভিয়েত ইউনিয়নের যে সব অঙ্গদেশে গিয়েছি, বড় বড় বাড়ি তৈরির কাজ দেখেছি ৷ শাসকদল প্রাসাদোপম অট্টালিকা পছন্দ করতেন ৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের সব দেশেই জাতীয় সৌধগুলি চমকপ্রদ ৷ মোঙ্গলিয়াতেও তার পর্যাপ্ত নিদর্শন ৷ আরও একটা বিশেষ নজর ছিল সেকালীন শাসকদের, দেশে সাক্ষরতার বিস্তার করা ৷
আসতে যেতে আমাদের পথে বিশাল একটা বাঁধানো চত্বর পড়ে ৷ সুখবাটার স্কোয়্যার ৷ সুখবাটার মোঙ্গলিয়ার জাতীয় হিরো ৷ মোঙ্গলিয়ার পরিবর্তন আনার ভগীরথ ৷ রাজতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে মোঙ্গলিয়াতে জনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নেতা ৷ সুখবাটারের উদ্যোগে ১৯২৪ সালে মোঙ্গলিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নে যুক্ত হয় ৷ স্কোয়্যারের মাঝখানে অশ্বারোহী সুখবাটারের মূর্তি ৷ স্কোয়্যারের একদিকে পার্লামেন্ট ভবন, আরেকদিকে অপেরা ও ব্যালে থিয়েটার ৷ দুটিই বিশাল এবং বিশিষ্ট সৌধ ৷ সকালে বিকালে অনেক মানুষ এই স্কোয়্যারে বেড়াতে আসে ৷ মস্কোর রেড স্কোয়্যার বা বেজিংয়ের তিয়েন আন মেন স্কোয়্যারের মতো বিরাট না হলেও সুখবাটার স্কোয়্যার গুরুত্বে কম নয় ৷ এক রবিবার সকালে দেখলাম বিয়ের পর নবদম্পতি সুখবাটারের মূর্তিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসেছে ৷ সুসজ্জিত স্ত্রী-পুরুষ, চঞ্চল শিশুর দল স্থানটিকে জীবন্ত করে তুলেছিল ৷
স্কোয়্যারের নানা স্থানে দলে দলে শিশুরা খেলা করছে, মা-বাবারা অলস ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বয়স্করা বেঞ্চে বসে বিদায়ী সূর্যের উষ্ণতায় বিশ্রাম নিচ্ছেন, প্রত্যহ বিকেলেই এই দৃশ্য দেখতাম ৷ সূর্যাস্তের পর প্রবলতর শীতে কী হত এখানে আমাদের দেখবার সাহস হয়নি ৷
উলানবাটোর ছড়ানো শহর বলে কোথাও ভিড় নেই ৷ গাড়ি চলাচল হয় সমান গতিতে, যানজটে আটকে পড়িনি ৷ ইয়ার সঙ্গে সরকারি ডিপার্টমেন্ট স্টোরে গিয়েছিলাম ৷ উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখলাম না ৷ সাধারণ জামাকাপড়, চামড়ার কম দামের জ্যাকেট, টপ বুট ৷ হাতের কাজ প্রায় কিছুই নেই বললে চলে ৷ দুটি মোঙ্গলীয় পোশাকে সজ্জিত ছোট পুতুল কেনা হল ৷ মনে হচ্ছে দাম অনুচিত বেশি ছিল ৷ আমাদের হোটেলের কাছে এবং অন্যত্র দুয়েকটি ছোট বুটিক জাতীয় দোকান ছিল ৷ সেখানে প্রধানত মোঙ্গলীয় পুতুল, জলরঙে আঁকা মোঙ্গলিয়ার ল্যান্ডস্কেপ, মেয়েদের স্টোল ৷ সবই বড় বেশি দাম ৷ মনে হল বিদেশীদের কাছ থেকে যৎপরোনাস্তি ডলার সংগ্রহের চেষ্টা সর্বত্র ৷
বড় দোকান যে নেই তা নয় ৷ একটি বড় সুপার মার্কেটে গিয়েছিলাম ৷ বিদেশী চিজ মাখন জ্যাম সস ড্রেসিং ফ্রুটজুস কী নেই সেখানে? ডেনমার্কের হ্যাম, জার্মানির সসেজ, ইটালির সালামি, যা চাই ৷ নানাবিধ সবজিও ছিল ৷ এবং ফল ৷ তারও কিছু কিছু বিদেশ থেকে আমদানি করা ৷ বিদেশী পানীয় জল, যা সত্যিই মিনারেল ওয়াটার, তারও উচ্চমূল্যের বোতল ৷ মাছ-মাংসের কাউন্টারগুলিও দেখবার মতো ৷ টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, স্নো, ক্রিম, শ্যাম্পু, ময়শ্চারাইজার সব বিদেশ থেকে আমদানি করা ৷ দাম যথেষ্ট বেশি, অন্তত টাকার হিসাবে ৷ সম্ভ্রান্ত বিদেশীদের তৃপ্তি ও পরম আরামে রাখবার ব্যবস্থা ৷
বলা বাহুল্য, এ দোকান সাধারণ মোঙ্গলিয়ের জন্য নয় ৷ তাদের প্রধান আহার গম এবং মাংস ৷ ছাগ বা মেষ মাংসের দাম খুব কম, প্রতি কেজি ৮০০ তুগরুক ৷ বিফের দাম বেশির দিকে, এখানে বিফের চল নেই তেমন ৷ মুরগির দাম চড়া ৷ দেশে হাঁস-মুরগি পালন উন্নত স্তরের নয়, তাই সরবরাহ কম ৷
আমাদের ভোজনের অসুবিধা হচ্ছিল না ৷ রকমারি পদ নেই সত্যি, কিন্তু সাধারণ খাবার হিসাবে খারাপ নয় ৷ প্রাতরাশ তো পূর্ব এশিয়া বাদ দিয়ে সর্বত্র এক হয়ে গিয়েছে ৷ ডিম, পাউরুটি, চা-কফি ৷ অথবা তার রকমফের ৷ পূর্ব এশিয়াতে নানা রূপে ভাত থাকে প্রাতরাশ টেবিলে ৷
উলানবাটোরে আমাদের প্রধান দুটি ভোজনে, গ্রিলড ল্যাম বা চিকেন, ল্যাম স্টু, ল্যাম স্নিটশেল অথবা চিকেনের ওই পদগুলি ৷ মিষ্টান্নে ক্যারামেল কাস্টার্ডের বাইরে যেতে পারিনি ৷ হোটেলের ভোজনশালার খাদ্যতালিকা অতি সংক্ষিপ্ত বলে আমরা প্রায়ই বায়ানগোল রেস্টুরেন্টে যেতাম ৷ হোটেলের দুই বাড়ির মাঝখানে বিশাল রেস্টুরেন্ট-শ’তিনেক আসন আছে ৷ পঞ্চাশ-ষাটজনের বেশি অতিথি থাকত না ৷ এক রাতে দেখি বেশ ভিড়, সামান্য কটি টেবিল খালি আছে ৷ আমরা আসন নিয়ে আমাদের প্রয়োজন বললাম ৷ সাধারণত ঠান্ডা পানীয় বা ফলের রস নেওয়া হত ৷ কদাচিৎ ভদকা বা ওয়াইন ৷ আট-দশ ডলারে দুজনের পূর্ণ ভোজন ৷ প্রত্যাশা করিনি, হঠাৎ একজন আপাদমস্তক ভারতীয় আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন ৷ দক্ষিণী উচ্চারণে ইংরিজিতে জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কোথা থেকে আসছি ৷ আলাপ জমতে দেরি হল না ৷ তাঁর এক সহকর্মীও ছিলেন ৷ আমরা চারজন এক টেবিলে বসলাম ৷ প্রথম ভদ্রলোক দক্ষিণ ভারতের ৷ বিলেতের ইউনিলিভারের এজেন্টের কর্মচারী ৷ সানলাইট সোপ থেকে ডাভ, ক্লোজআপ বিক্রি করেন ৷ এখানে পরিবার নিয়ে আছেন, স্ত্রী এবং শিশু কন্যা ৷ দুবছর হয়ে গিয়েছে ৷ শীতকালে সত্যিই নির্বাসিত মনে হয় ৷ অন্য সময় কষ্ট হয় না ৷ বরফ পড়ে না উলানবাটোরে ৷ কিন্তু ঠান্ডা শূন্যের ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে নেমে যেতে পারে ৷ গ্রীষ্মের তাপমাত্রা কুড়ি ডিগ্রির ওপরে ওঠে না ৷ ভদ্রলোক আরও বললেন, শহরটা শান্ত, মানুষেরা নির্বিবাদী ৷ এখানে রাতে পথ চলাচল নিরাপদ ৷
তাঁর সঙ্গী হংকং থেকে কদিনের জন্য এসেছেন ৷ তাঁদের হংকং অফিস থেকে চার-ছ মাস অন্তর কেউ না কেউ আসেন ৷ সঙ্গে নিয়ে আসেন ভারতীয় খাদ্যদ্রব্য, মশলা ইত্যাদি, তাই খাওয়াদাওয়ার কোনও কষ্ট নেই ৷ রাত্রি হয়েছিল, আমাদের এবার উঠতে হবে, পরশুদিন আমরা চলেও যাব, তাই আর দেখা হবে না ৷ বিদায় নেবার সময় ভদ্রলোক বললেন, আপনারা আসাতে উলানবাটোরে ভারতীয়ের সংখ্যা বেড়ে এক ডজন হয়েছিল ৷ তাঁর সহকর্মী ফিরে গেলে আবার নজন হয়ে যাবে, যার মধ্যে দূতাবাসের পাঁচজন ৷
নতুন দেশে ভোজনের নতুনত্ব হচ্ছে না বলে আমরা ইয়াকে আমাদের কোনও মোঙ্গলীয় রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে বলি প্রায়ই ৷ ইয়া হোটেলের সংযুক্ত রেস্টুরেন্টগুলি দেখিয়ে দেয় ৷ মোঙ্গলীয় খাবার কোথায় পাব তার হদিশ পাই না ৷
আমাদের হোটেলের সামনে যে চত্বর, সেখানে চার-ছটি কিয়স্কে দোকান, সেখানে একটি ছোট চালাতে খাবার বিক্রি হয় দেখেছি ৷ দুপুরবেলা স্কুলের ছেলেমেয়েরা বোধহয় টিফিনের ছুটিতে সেখানে ভিড় করে ৷ কাগজের বাক্সে নুডল জাতীয় কিছু কিনে খায় ৷ সেই দোকানেও আমাদের প্রয়োজন বোঝাতে পারি না ৷ স্কুলের একটি ছাত্র সামান্য ইংরিজি বোঝে, তাই দুবাক্স নুডল, মাংসখণ্ড সহযোগে নেওয়া গেল এবং দু বোতল বিয়ার পাশের দোকান থেকে ৷ হোটেলের ঘরে বসে আপাত-মোঙ্গলীয় সেই খাবার খারাপ লাগল না ৷ কিন্তু কোনও নতুনত্ব নেই ৷ অন্য এক খাবারের দোকানে দেখলাম, পাউরুটির মাঝখানে মাংসখণ্ড দিয়ে বার্গার জাতীয় কিছু বিক্রি হচ্ছিল ৷ আর দেখলাম আমাদের মাছের ফ্রাইয়ের আকারে অথবা বলতে পারি চেপ্টা সিঙাড়ার আকারে কিছু বিক্রি হচ্ছে ৷ এই পদটির নাম পরে দোভাষীর কাছে জেনেছি, খুরুস ৷ খুরুস ময়দার খোলে কিমা ভরে ভাজা ৷ ভালো লেগেছিল ৷ এটি প্রকৃতই মোঙ্গলীয় পদ ৷
ইংরিজি সাপ্তাহিক উলানবাটোর নিউজে একটা বিজ্ঞাপনে দেখি, মোঙ্গলীয়দের সনাতন তাঁবুর ছবি, তলায় লেখা ঘের রেস্টুরেন্ট ৷ আমরা তো হাতে স্বর্গ পেলাম ৷ ইয়া কোনওদিনই আমাদের সঙ্গে খায় না ৷ হোটেলের রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করে আমরা দুজনে এক দুপুরে সেখানে রওনা হলাম ৷ রিসেপশনই বলে দিল, ঘের রেস্টুরেন্ট হাঁটা পথ, হোটেলের পিছনদিকে ৷
দুপুরবেলা, আকাশে যেমন রৌদ্র, বাতাসে তেমনই ঠান্ডা ৷ খুঁজে খুঁজে হয়রান, ঘের রেস্টুরেন্টে আর পৌঁছতে পারি না ৷ কাকে জিজ্ঞাসা করব, এই অঞ্চলটায় বিশেষ মানুষজন নেই পথে, একদিকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি, সেখানে গিয়ে কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা সমীচীন হবে কিনা ভাবছি, এমন সময় এক মধ্যবয়স্কা মহিলাকে আসতে দেখা গেল ৷ ভাষায়, ইঙ্গিতে অনেক বোঝাতে হল ৷ বারবার ঘের শব্দটা উচ্চারণ করতে লাগলাম এবং ভোজনের মুদ্রা দেখাতে তিনি বোধহয় বুঝতে পারলেন ৷ কথা না বলে আমাদের হাত ধরে তাঁর যাবার পথের বিপরীত দিকে অনেকখানি নিয়ে গেলেন ৷ আমরা বুঝতে পারছি না তিনি আদৌ আমাদের অভিলাষ বুঝেছেন কিনা, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ৷ হঠাৎ একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের পিছনে একটি সাদা ক্যানভাসের ঘের দেখা গেল ৷ আমাদের তার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে মহিলা আবার ফিরে গেলেন ৷ ঘেরের দরজায় সাবেকি পোশাকে এক তরুণী আমাদের অভ্যর্থনা জানাল ৷ কিন্তু সেদিন ওখানে ভোজন হল না ৷ একটা বড় আমেরিকান দল সব আসন দখল করে লাঞ্চ খাচ্ছেন তখন ৷
দ্বিতীয় দিন আবার গিয়ে দেখি জনপ্রাণী নেই ভোজনকক্ষে অর্থাৎ ঘেরের মধ্যে ৷ যথারীতি উষ্ণ অভ্যর্থনা হল ৷ আমরা দুজন, একছত্র দম্পতি সমস্ত ঘের অধিকার করে বসলাম ৷ পরিচারিকার সাজ বড় সুন্দর ছিল, সাবেকি মোঙ্গলীয় পোশাক ৷ মেয়েটিও সুন্দরী ৷ তারই পরামর্শে, অর্থাৎ অসম ভাষার দ্বৈরথে যতটুকু পরামর্শ করা সম্ভব, সিদ্ধান্ত হল আমরা হরহখ ভোজন করব ৷ ভোজ্য আসতে বুঝতে পারলাম হরহখ মানে মেষমাংসের গ্রিল ৷ ঝলসে নেওয়া মাটন বলা যায় ৷ কিছু সবজি সহযোগে ভালো লেগেছিল ৷ ঘেরের ভেতরটা চমকপ্রদ ৷ সেখানে বসে সব কিছুই বুঝি ভালো লাগবে ৷ বৃত্তাকার তাঁবুটির ব্যাস হবে কুড়ি ফুট বা সামান্য বেশি ৷ সমস্ত মেঝে পুরু কার্পেটে মোড়া, দেওয়ালেও কার্পেট টাঙানো আর মাঝে মাঝে কোনও লোমশ প্রাণীর চামড়া ৷ মাথার ওপরেও রঙের বাহার ৷ ঘেরের মাঝখানে একটি ঢাকা লোহার বাক্সের মধ্যে আগুন জ্বালানো হয়েছে ৷ তার নল ধোঁয়া নিষ্কাশনের জন্য তাঁবুর চূড়া দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে ৷ সাধারণ মানুষের বাসের ঘেরও এই ধরনের, সাজসজ্জা থাকে না অবশ্য ৷ কিন্তু এমনই ফেল্টের তৈরি, শীত নিবারণের জন্য ৷ মাঝের আগুন জ্বালাবার বাক্সটি ঘেরকে উত্তপ্ত রাখে, ওখানেই রান্নাবাড়া হয় ৷ আমাদের ক্ষেত্রে অবশ্য ঘের শুধুই ভোজনকক্ষের কাজ করছে ৷ রান্না হচ্ছে বাইরে অন্যত্র ৷ টেবিল-চেয়ারের বদলে কাঠের শয্যা, আর বিশেষ কোনও আসবাব থাকে না ৷
জায়গাটা ভালো লেগেছিল, সেই দ্বিপ্রহরে শুধুমাত্র আমাদের দখলে বলে আরও ৷ দুপাত্র ভদকা আদেশ করলাম ৷ বললাম, ছোট ৷ পরিচারিকা বাইরে থেকে ফিরে এসে বলল, ছোট ভদকা নেই ৷ তখনই আমার খটকা লাগা উচিত ছিল ৷ ছোট ভদকা নেই মানে কী? অল্প পরিমাণ ভদকা যদি না থাকে বড় ভদকা কী করে দেবে ৷ এসব কথা আমার কিছু মনে হল না ৷ বললাম, বেশ তো বড় ভদকা দাও ৷ মেয়েটি চেঙ্গিস খান ভদকার বড় নতুন বোতল খুলে আমাদের দুপাত্র ভদকা পরিবেশন করল ৷ পরিবেশ পছন্দের, ঘেরের উষ্ণতা সুখের, আমরা ধীরেসুস্থে ভদকা সেবন করে হরহখে মনোনিবেশ করলাম ৷ মাংসখণ্ডগুলি সুপক্ব, সদ্য রন্ধনের সৌরভ-আয়োজন সামান্য হলেও সুন্দরী পরিচারিকার হাসিমুখ যুক্ত হয়ে দুপুর ভালোই কাটল ৷ বিল চাইলাম ৷
বিল হাতে নিয়ে একটু আশ্চর্য হলাম ৷ মূল ভোজ্যের দাম সাত ডলার, তার ওপরে সালাদ ইত্যাদির সামান্য দু-এক ডলার, আর ভদকার দাম কুড়ি ডলার ৷ দুই বড় পেগ ভদকার দাম কুড়ি ডলার! একটু সময় লাগল বুঝতে ৷ কেন বলেছিল ছোট ভদকা নেই তাও স্পষ্ট হয়ে গেল ৷ এখানে বোধহয় মদ্য পরিবেশনের রীতি নেই ৷ অতিথি চেয়েছেন বলে তাঁর জন্য এক বোতল ভদকা দিতে হল ৷ এবং ছোট বোতল ছিল না বলে বড় ৷
বিল চুকিয়ে বড় বোতলসুদ্ধ চেঙ্গিস খান ভদকা নিয়ে হোটেলে ফিরেছিলাম ৷
শ্রীমতী নারানের ব্যবস্থায় এক মোঙ্গলীয় যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ৷ নাম ওডজারগাল ৷ চল্লিশের নিচে বয়স ৷ নানারকম ব্যবসা করেন ৷ সফল মানুষ ৷ কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ৷ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর কিছুদিন আমেরিকায় ছিলেন ৷ এখন দেশে বেসরকারিকরণের হাওয়ায় পাল তুলে দিয়েছেন ৷ অফিস দেখলেই তাঁর উন্নতি বোঝা যায় ৷ আমেরিকান কায়দায় সাজানো অফিস ৷ সব কাজে কম্পিউটার ৷ এখন একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সি খোলার ইচ্ছা ৷ তাই নারানের উদ্যোগে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন ৷
দ্বিপ্রহরে একটি সুন্দর রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন ৷ ইউরোপের যে কোনও অভিজাত ভোজনশালার সমকক্ষ ৷ আমাকে জিজ্ঞাসা করাতে মোঙ্গলিয়ান খাদ্য চেয়েছিলাম ৷ বললাম, বেজিংয়ে একটা পদ খেয়েছিলাম, মোঙ্গলিয়ান হটপট ৷ অত্যন্ত পাতলা করে কাটা ছাগ মাংসখণ্ড ক্ষণিক ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে নানাবিধ সস সহযোগে গ্রহণ করা হয় ৷ ওডজারগাল এমন কোনও পদের নাম শুনেছেন বলে মনে হল না ৷ বললেন, মোঙ্গলিয়ান পট আমাদের বিশিষ্ট স্যুপ ৷ সেটা পরখ করে দেখতে পারেন ৷ তিনিই আমাদের জন্য খাবার নির্বাচন করে দিলেন, লুলিয়া কাবাব ৷ এখানেও মশলা প্রায় নেই বললেই চলে, কিন্তু ছাগ মাংস কোনও প্রক্রিয়ায় অতি কোমল এবং পরম সুস্বাদ ৷ মনে হয়েছিল সামান্য রসুনের স্পর্শ আছে ৷
এসেছিলেন মার্সিডিজ গাড়ি চালিয়ে ৷ আমাদের ফেরত নিয়ে এলেন তাঁর সহকারী আরেকটি মার্সিডিজে ৷ অফিসের সামনে আরও একটি মার্সিডিজ দাঁড়িয়েছিল দেখেছি ৷ ওডজারগালের সাফল্য ও সম্পদ বুঝতে দেরি হল না ৷
অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে ওই মার্সিডিজ গাড়িগুলি এদেশে এসেছে ৷ অত্যন্ত উচ্চমূল্যের গাড়ি ৷ সাধারণের অগম্য ৷ জামার্নির কোনও বন্দর থেকে জাহাজে করে গাড়িগুলি এসেছে চিনের বন্দর সাংহাইতে, তারপর সেখান থেকে দীর্ঘ দুর্গম স্থলপথে উলানবাটোর ৷ মোঙ্গলিয়া স্থলভূমিতে ঘেরা ৷
ওডজারগালের অতিপূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খান কী করে এই দুস্তর দূরত্ব পার হয়ে তাঁর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আজকের সহজ ভ্রমণের যুগেও কল্পনা করা কঠিন ৷ ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চেঙ্গিস যাযাবর এক মোঙ্গলীয় গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন ৷ মোঙ্গলিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন যাযাবর গোষ্ঠীকে একত্রিত করে তাদের অভিষিক্ত দলপতি চেঙ্গিস খান রাজ্য আহরণে বেরিয়েছিলেন ৷ তখনও কামান গোলাবারুদের আবিষ্কার হয়নি ৷ সত্যিকার মরু গিরি নদী কান্তার পার হয়ে, প্রতিকূল নিষ্ঠুর প্রকৃতির মধ্যে চেঙ্গিস এবং তাঁর পরে তাঁর পৌত্র কুবলাই খান যে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইয়েলো রিভার থেকে ইউরোপের কৃষ্ণসাগর পর্যস্ত বিস্তৃত সেই সাম্রাজ্যের মতো বড় সাম্রাজ্য পৃথিবীর ইতিহাসে আর পাওয়া যায় না ৷ অশ্ব ছাড়া বাহন ছিল না ৷ অথচ কত দুস্তর দূরত্ব অবহেলায় পার হয়েছিলেন তাঁরা ৷ চেঙ্গিস ভারতবর্ষের সিন্ধুপ্রদেশ পর্যন্ত এসেছিলেন ৷ কঠোর প্রকৃতির মানুষ এই খানেরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ছিলেন, বলা যেতে পারে পৈশাচিক ৷ যেখানে গিয়েছেন দৈব অভিশাপ মনে করেছে পরাভূত মানুষ ৷ লুণ্ঠন ও হত্যালীলার এমন উদাহরণও পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ৷
কুবলাই বুঝে গিয়েছিলেন অশ্বপৃষ্ঠে দেশ জয় করা যায়, কিন্তু রাজ্য শাসন করা যায় না ৷ তিনি তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের রাজধানী করেছিলেন সেই স্থানে যেখানে আজকের বেজিং ৷ সমগ্র চিন তখন তাঁর পদানত ৷ কুবলাই খান চিনে নতুন রাজবংশের পত্তন করলেন, ইউয়ান রাজবংশ ৷ কুবলাই খানের মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মানুষদের স্থান হয়েছিল ৷ বিশ্রুত ইটালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলো কিছুকাল কুবলাইয়ের সভাসদ ছিলেন ৷
কুবলাই খান চিনা বিদ্বানদের সহযোগিতায় প্রথম মোঙ্গলীয় লিপির প্রবর্তন করেছিলেন ৷ সাতশো বছর পরে রাশিয়ান প্রভুরা মোঙ্গলীয় লিপির পরিবর্তে রাশিয়ান সেরেলিক লিপি প্রবর্তন করেন মোঙ্গলীয় ভাষা লেখবার জন্য ৷ প্রকৃতিতে যতই নিষ্ঠুর হন, কুবলাইয়ের চরিত্রে মার্জিত বুদ্ধিদীপ্ত বিচক্ষণতা ছিল ৷
কুবলাইয়ের ইউয়ান রাজবংশ চিনের ওপর বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি ৷ একশো বছর পরে ভাগ্যের চাকা ঘুরে গিয়ে চিন মোঙ্গলিয়া অধিকার করল ৷ চিনের সে রাজত্ব চলল ২০০ বছর ৷ ১৯১১ সালে মোঙ্গলিয়া স্বাধীন হল ৷ কিন্তু সেও স্বল্পকালের জন্য ৷ শেষ খানকে সিংহাসনচ্যুত করে সোভিয়েত রাষ্ট্রের অন্যতম গণতন্ত্র হল মোঙ্গলিয়া ৷ তারপরের ইতিহাস আমাদের জানা ৷
মোঙ্গলিয়ার শেষ খান বোগড খানের শীতকালীন প্রাসাদ ও মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলাম একদিন ৷ শহরের উপকণ্ঠে এই মিউজিয়াম অন্যতম দ্রষ্টব্যের মধ্যে পড়ে ৷ প্রাসাদের সবই এই শতাব্দীর প্রথম ভাগের ৷ মিউজিয়ামেরও প্রায় তাই ৷ বিশেষ প্রাচীন কিছু প্রায় দেখাই যায় না মোঙ্গলিয়াতে ৷ এক ডাইনোসর ছাড়া ৷ ছ কোটি বছর পূর্বের এই অতিকায় প্রাণীগুলির একদা উপস্থিতি নিয়ে মোঙ্গলিয়ার গর্বের অন্ত নেই ৷
কোথাও পড়েছি পৃথিবীর নানা স্থানে যত ডাইনোসরের অস্থি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে মোঙ্গলিয়া দ্বিতীয় ৷ শুনলাম মোঙ্গলিয়ার দক্ষিণাংশ গোবি মরুভূমিতে তল্লাশ করলে এখনও কিছু অস্থি এবং ডিম পাওয়া আশ্চর্য নয় ৷ জাতীয় সংগ্রহশালায়, প্রাপ্ত অস্থি দিয়ে ডাইনোসরের পুনর্গঠিত পূর্ণ কঙ্কাল দেখলে শিউরে উঠতে হয় ৷ অনেকগুলি নানা মাপের প্রস্তরীভূত ডিমও আছে ৷ এই মিউজিয়ামটিতে ডাইনোসরের কঙ্কাল ছাড়াও দেখবার মতো অনেক জিনিস ছিল ৷
ফাইন আর্ট মিউজিয়াম আমাদের দেখা হল না ৷ মোঙ্গলিয়ানদের জন্য সামান্য প্রবেশমূল্য, আর বহিরাগতদের জন্য পাঁচ ডলার বা তার বেশি ৷
প্রত্যহ সকালে নটার মধ্যে বেরোতে হয় ৷ ইয়া তার ঘণ্টা খানেক আগে পৌঁছে যায় ৷ তাকে কিছুতে বোঝানো যাচ্ছে না যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখবার জন্য অত আগে বেরোবার দরকার নেই ৷
মাঝে একদিন কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না ৷ দশটা নাগাদ বেরোবার কথা, গ্রামাঞ্চল দেখতে যাব ৷ গ্রাম মানে তো দশ-পনেরোটা তাঁবুর জটলা ৷ সেদিনও ইয়া সকাল আটটাতেই হাজির ৷ ছুটির সকালে মন্থরে তৈরি হব, তার উপায় নেই ৷ বেরিয়ে পড়তে হল ৷ আমাদের গন্তব্য শহরের পুবদিকে টেরিলজ সংরক্ষিত বনাঞ্চল ৷ ষাট কিলোমিটার দূরে ৷ শহর ছাড়িয়ে প্রকাণ্ড প্রান্তরের মধ্য দিয়ে যাত্রা ৷ মাঝে মাঝে পাহাড়, আর না হলে অনন্ত পর্যন্ত প্রসারিত তৃণহীন গৈরিক সমতল ৷ কোনও পাহাড়ের মাথায় হঠাৎ সবুজ পাইন গাছের ঘন অরণ্য ৷ পাশের পাহাড়টা হয়তো সম্পূর্ণ রিক্ত ৷ কদাচ দুয়েকটি ঘের অর্থাৎ বাসের তাঁবু দেখা যাচ্ছে ৷ অব্যর্থ সাদা রঙের ৷ কখনও এক দুজন মোঙ্গলীয় স্ত্রী-পুরুষ, সারা পথে দশটির বেশি অশ্বরোহী দেখিনি ৷ ওই শুষ্ক প্রান্তরে দূর থেকে সাদা তুলোর মতো ভেড়ার পাল ৷ শুষ্ক পৃথিবী থেকে তারা কী পুষ্টি সংগ্রহ করছে কে জানে ৷ দু-চারটে ছোট পাহাড়ও পার হলাম, পথ উঁচু-নিচু, সর্বত্র সমতল নয় ৷ চেকপোস্টে এক সৈন্য গেট খুলে আমাদের সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দিল ৷ এবারে কিছু বড় গাছ, পাইন, ফারও আছে ৷ তৃণহীন পাথুরে পাহাড়গুলোর চেহারা বিচিত্র, যেন কোনও উন্মাদ ভাস্করের রচনা ৷ আলাদা আলাদা বিশাল গ্র্যানাইটের খণ্ড ওপরে নিচে, পাশাপাশি সাজানো ৷ এতক্ষণে দুটি বাস দেখলাম ৷ পর্যটক দল নিয়ে এসেছে ৷ বড় রাস্তা থেকে বাঁদিকে একটু নেমে বড় শুষ্ক মাঠের ওপর যেন এক অতিকায় কচ্ছপ, গ্র্যানাইটের ৷ কারও তৈরি করা নয় ৷ হাজার হাজার বছর ধরে ঝড়-বৃষ্টি বরফে পাহাড়টা এই বিচিত্র রূপ পেয়েছে ৷ আমরা এগিয়ে চললাম ৷ এখানে উন্মুক্ত প্রান্তর নেই, আমরা পাহাড়ের মাঝখানের উপত্যকা দিয়ে চলেছি, কোথাও সংকীর্ণ কোথাও প্রসারিত ৷
টেরিলজ রিসর্টে মস্ত খোলা জায়গায় একটি ত্রিতল বাড়ি ৷ হোটেল ৷ যাঁরা বাড়িতে থাকতে চান না তাঁদের জন্য কম্পাউন্ডের মধ্যে পাশাপাশি ছটি ঘের ৷ একটি ঘেরের ভেতরে গিয়েছিলাম ৷ আমাদের দেখা ঘের রেস্টুরেন্টের মতো, সাজসজ্জা কিছু কম ৷ চেয়ার-টেবিলের বদলে দুদিকে দুটি শোবার খাট ৷ আরেকদিকে একটি লেখবার টেবিল ৷ তাঁবু গরম রাখবার সেই সনাতন ব্যবস্থা ৷ লোহার বাক্সে আগুন জ্বালানো রয়েছে ৷ ধোঁয়া বেরোবার নল তাঁবুর চূড়া ভেদ করে বেরিয়ে গেছে ৷ ঘেরের পিছনে পাকা বাড়িতে শৌচাগার ৷
জায়গাটা মনোরম ৷ পাশে গভীর খাদ ৷ তিনদিকে গাছে ঢাকা পাহাড় ৷ মোঙ্গলিয়ার এই এক বৈচিত্র্য ৷ তৃণশূন্য প্রান্তরের পাশে পাহাড়ের মাথায় আচমকা সবুজের সমারোহ ৷ উলানবাটোরের কর্মচঞ্চলতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে পর্যটক এখানে আসেন কদিনের জন্য ৷ ত্রিসীমানায় আর কোনও জনবসতির চিহ্ন নেই ৷
উলানবাটোর শহরের মধ্যে প্রত্নতাত্বিক গুরুত্বের কোনও নিদর্শন নেই ৷ শহরের বাইরের দিকে গন্ডন টেকচিলেন বৌদ্ধবিহার বিশেষ প্রাচীন নয় ৷ শহরে সব পুরনো মন্দির, বিহার এই শতাব্দীর প্রথমভাগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ৷ গন্ডন টেকচিলেন বিহার, তার পাশে আরও একটি এবং লামাদের শিক্ষালয়, এই সব নতুন হলেও স্থানটি সুন্দর ৷ ১৯২১ সালের বিপ্লবের পর এই সৌধগুলি অবহেলায় ও অনাদরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৷ এখন আবার সংস্কার করে সৌধগুলি এবং সমগ্র চত্বর খুব দেখাশোনা করা হয় ৷ দর্শনার্থীও অনেক আসে ৷ হাওয়া যদি তাড়া না করে বিহার চত্বরে একটা সকাল বেশ আনন্দে কাটিয়ে দেওয়া যায় ৷ এখানে সাবেকি পোশাকে কিছু লামা ও ভক্তদের দেখেছি ৷
উলানবাটোর ছাড়বার আগের দিন বেশি কোথাও যাবার ছিল না ৷ আমরা ইয়াকে ছুটি দিয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার গিয়েছিলাম ৷ শহর থেকে বেরিয়েই একটা ছোট কারখানা, তারপর ইতস্তত ছড়ানো পাহাড় এবং জনহীন প্রান্তর ৷ দশ-পনেরো মাইল যাবার পর ছোট শহর, জুমোড পড়ল ৷ দশ-বিশটা দোকান, একটা বড় অফিস বাড়ি, কিছু বাসের তাঁবু, টিনের, কাঠের বাসস্থান এবং কয়েকটি মাথা উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট হাউস ৷ শহর ছেড়ে আবার একই নিসর্গ ৷ মাঝে মাঝে পাহাড়ের ঢালেও মাথায় পাইন, পপলার গাছের ছোট জঙ্গল ৷ দুয়েকজন অশ্বারোহী, নিঃসঙ্গ ঘের মাঝেমাঝে, আর শুষ্ক চারণভূমিতে আহাররত মেষের দল ৷ আমরা চলেছি মনজশির বিহার, প্রাচীন বুদ্ধমন্দিরে ৷ আমাদের পথ খেন্তি গিরিশ্রেণীর মধ্য দিয়ে ৷ একপাশে বোগড খান উল, পবিত্র বোগড খান শিখর ৷ বোগড খান শুধু রাজা নয়, তিনি ধর্মীয় প্রধানও ছিলেন ৷ এদেশের বৌদ্ধেরা লামাবাদী ৷
জুমোড থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে পাঁচ-ছ কিলোমিটার গেলে মনজশির মনাস্ট্রি এবং মিউজিয়াম ৷ মনজশিরের অবস্থান বড় সুন্দর ৷ তিনদিকে পাইন ফার বার্চ গাছের জঙ্গল ৷ তাদের পিছনে গাছের মাথা ছাড়িয়ে নগ্ন গ্র্যানাইটের পাহাড় ৷ আদি মনাস্ট্রি তৈরি হয়েছিল ১৭৩৩ সালে ৷ কালে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে ৷ বর্তমান বাড়িটি মাত্র কয়েক বছর আগে তৈরি হয়েছে ৷ আদি মনাস্ট্রির ধ্বংসাবশেষ ইতস্তত দেখা যায় ৷ মনাস্ট্রির সমসাময়িক ব্রোঞ্জের একটি বড় হাঁড়ি এখনও অক্ষত আছে ৷ আমাদের গাড়ির ড্রাইভার বলল, এখানে এক হাজার মানুষের জন্য রান্না করা যায় ৷
উলানবাটোরে পৌঁছে মনে হয়েছিল এখানে আটদিন কী করে কাটাব ৷ আশ্চর্য, সাতদিন রীতিমতো ব্যস্ততার সঙ্গে কেটে গিয়েছে ৷ কাল আমাদের ফেরার দিন ৷ বুঝতে পারছি মোঙ্গলিয়ার সামান্যই দেখা হল ৷ সময় থাকলে এবং আরেকটু তৎপর হলে একদিন গোবি মরুভূমির প্রান্ত থেকে ঘুরে আসা যেত ৷ এই দেশের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে গোবি মরুভূমি ৷ সব দিন প্লেন যায় না উলানবাটোর থেকে ৷ গাড়ি করে গেলে সারাদিন লেগে যেত ৷ গোবির এক তৃতীয়াংশ বালির পাহাড় আর মরুভূমি ৷ বাকি অংশে মাঝে মাঝে তৃণভূমি আর মরূদ্যান ৷ উঁচু নিচু পাহাড়ও আছে গোবির অনেকখানি জুড়ে ৷
সোল থেকে উত্তরে গোবি পার হয়ে উলানবাটোর পৌঁছেছিলাম ৷ ফেরার পথ ভিন্ন ৷ আমরা বেজিং হয়ে সোল যাব ৷ মোঙ্গলিয়ার যে অংশ ইনার মোঙ্গলিয়া, তার ওপর দিয়ে বেজিং যেতে হবে ৷
ইরকুটসক না যাওয়ার দুঃখ থেকে গেল ৷ মোঙ্গলিয়ার উত্তর সীমান্ত জুড়ে বৈকাল হ্রদ ৷ ইরকুটসক থেকে বৈকাল যেতে হয় ৷ রাশিয়ান ভিসা করানো হয়নি, তাই ইরকুটসক যাওয়া সম্ভব ছিল না ৷
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন