অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
শুরুতেই অলক্ষণ! মায়েরা কেউ থাকলে নিশ্চয় বলতেন: হাতেপায়ে লক্ষ্মী একেবারে বাঁধা!
বেড়াবার সময়ে ভার বাড়াতে নেই, রেলবিজ্ঞাপনে একথা বারেবারেই বলে দেয় ৷ তার সঙ্গে আরও যেটা বলা উচিত তা হল: আপাদমস্তক নির্ভূষণ হতে হয় বেড়াবার সময়ে ৷
বেতলার জঙ্গলের সামনে দাঁড়ানো সায়ন্তন এক দলীয় বিলাপের কথা মনে পড়ে ৷ বিলাপের কাছাকাছি পৌঁছে সেদিন শুনেছিলাম বিপর্যস্ত একটি দল তখনই হাজির হল নেতারহাট থেকে ৷ অভিজ্ঞতা তাঁদের ভালো হয়নি নেতারহাটে, সূর্যাস্তের শোভা দেখবার বদলে তাঁদের না কি দেখতে হয়েছিল ডাকাত কয়েকটি যুবাকে, সর্বস্ব তাদের কাছে উপঢৌকন দিয়ে তবে সেদিন ফিরতে পেরেছিলেন তাঁরা ৷ সেই সর্বস্বের মধ্যে ছিল মহিলাদের বিচিত্র সব অলংকার ৷ গতস্যের শোচনা নিয়ে বিলাপপ্রলাপ চলছিল সেই সন্ধ্যায়, বেতলার জঙ্গলে ঢুকবার ঠিক মুখোমুখি পথটিতে ৷
‘ওইজন্যেই তো সঙ্গে গয়না রাখতে নেই’ -মুরুব্বির ভঙ্গিতে তাঁদের বলেছিলাম সেদিন ৷ কিন্তু জানতাম কি আর, বেড়াতে বেরোবার শুরুতেই আমরাও পড়ব গয়নারই এক ঝঞ্ঝাটে?
ভুটান রওনা হব জলপাইগুড়ি থেকে ৷ জলপাইগুড়িতে আমার গৃহিণীর পিত্রালয়, কটা দিন সেখানে আদরেবিশ্রামে কাটাবেন তিনি, তারপর পাহাড় ৷ পাহাড়ি ধকল সইতে হবে বলে তার আগে বিশ্রামের কিছু আধিক্যই হয়তো ঘটেছিল ৷ সে-রকমই এক বিশ্রাম-অবসানে, বৈকালিক শয্যা থেকে গাত্রোত্থানের পর, ঘোষণা করলেন তিনি: তাঁর সাধের দুলটি কর্ণচ্যুত ৷
এ-রকম মাঝে মাঝে ঘটে থাকে, এ নিয়ে বিচলিত হওয়া নিষ্প্রয়োজন ৷ কিন্তু পিত্রালয়ে দুলহীনতা? এই অসম্ভব ব্যাপারের প্রতিকারের জন্য চতুর্দিকে শুরু হল ব্যাপক সন্ধানপর্ব ৷ বালিশের খোল, খাটের তলা, বারান্দার কোণ কিংবা উঠোনের ঘাস-কোনও জায়গাই বাদ রইল না আর ৷ সর্বত্র সবাই খুঁজছেন সেই দুল, সর্বক্ষণ; কখনও গোচরে, কখনও-বা অগোচরে ৷ কিন্তু ‘ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না’র আদর্শ অনুসরণে অত্যন্তভাবেই প্রচ্ছন্ন রইলেন সেই দুল ৷
আর সেই অধীর বিয়োগব্যথা পিছনে রেখে, কোনও-এক সকালবেলায় আমরা উঠে বসলাম সুদৃশ্য এবং সুরম্য এক মিডিবাসে ৷ তার শিরোদেশে লেখা আছে ‘জয়গাঁও’ ৷
একটা দেশের শেষ বিন্দু আরেকটা দেশের শুরু, এ-রকম একটা সন্ধিজায়গায় পা রাখবার সুযোগ কি সহজে মেলে? দুদেশের সীমানারেখার মাঝখানে তো খানিকটা না-মানুষের জায়গা থাকে বলে শুনেছি ৷ হয়তো কয়েক হাত দূরেই, তবুও হাত বাড়িয়েই তো বলতে হয় ‘ওই-যে ওই অন্য একটা দেশ ৷’
কিন্তু জয়গাঁও আর ফুন্টসোলিং, ভারতের শেষ আর ভুটানের শুরু, তেমন-কোনও ‘ওই’-এর জায়গা ফেলে রাখেনি এরা ৷ দুপা দুদেশে রেখে বলতে হবে সেখানে ‘এই-যে এই অন্য একটা দেশ ৷’
চোখ বেঁধে ঘুরপাক খাইয়ে ছেড়ে দিলেও অবশ্য টের পাওয়া যাবে কোন পা কোন দেশে ৷ এ-পায়ে কি জলকাদা লাগছে, ও-পায়ে তা নয়? এ-পা তাহলে ভারতে আর ভুটানে ওই পা ৷ এদিকে কি ঘিনঘিনে লাগছে আর ওদিকে ছিমছাম? এদিকটাতে ভারত তবে, ওদিকে ভুটান ৷ এইদিকে কি লোকের ভিড়, ওইদিকে নির্জন? এদিকটাতে ভারত তবে, ওইদিকে ভুটান ৷ মাঝখানে শুধু দাঁড়িয়ে আছে সুদৃশ্য এক চিত্রকরা তোরণ ৷
ফুন্টসোলিংয়ের ‘ব্লু ড্রাগন’-এ আস্তানা নেবার পর, মুহুর্মুহু এপারওপার করি ৷ বাঃ, নিয়ম নেই না কি কোনও? হ্যাঁ, নিয়ম একটা আছে ৷ ঢুকতে হবে বাঁদিক দিয়ে, বেরোবার পথ ডাইনে ৷
আসল কথা, দুবারই বাঁয়ে ৷ শরীরটাকে ঘুরিয়ে নিলে ডানদিকই তো বাঁদিক ৷ পড়োনি রবীন্দ্রনাথ? ‘দেহটা যেমনই করে ঘোরাও যেখানে/বাম হাত বামে থাকে, ডান হাত ডানে’! অন্যমনস্কভাবে সেটা খেয়াল না করলে মৃদুভাষী ভুটানি পুলিশ আলগোছে বলবে শুধু: এদিক নয়, ওদিক ৷
‘বারে বারে এপারওপার করছেন কেন’ একথা অবশ্য বলবে না কখনও তারা ৷ বললে তো কতবারই বলত তারা আমাকে ৷ কেননা, থেকে-থেকেই বলছিলাম আমি: ‘চলো একটু ভারত ঘুরে আসি ৷’ আর তার ঠিক পরেই: ‘চলো এবার ভুটান ৷’
অবশ্য, ফুন্টসোলিং পর্যন্তই ওই আবদার, তার পরে আর নয় ৷ তারপরে একটা পরিচয় চাই ৷ আমি যে আমি, সেই পরিচয় ৷
তা কি আর জানি না? সেইজন্যেই আমাদের সঙ্গে আছে পাসপোর্ট ৷
পাসপোর্টে কী হবে? এর জন্য চাই পারমিট ৷
পাসপোর্ট কি পারমিট নয়?
ঠিকই তো ৷ হতেও পারে তা ৷
আরেকজন বলেন: না, না-ও হতে পারে ৷
এইরকম কিছু অনিশ্চয়ের বিতর্ক চলল হোটেলের কাউন্টারে ৷ একজন শেষে বললেন: অন্তত কটা ছবি তো তুলিয়ে রাখুন ৷ চারটে করে ছবি ৷ পারমিটের জন্য লাগে ৷ কাল কিন্তু পাবেন না কিছু আর, কাল মঙ্গলবার, সব দোকানই বন্ধ থাকবে কাল ৷
কাজেই আমরা ছবি তুলিয়ে নিই কটা, দরকার হবে থিম্পু যাবার পথে ৷ তুলিয়ে নিই ছবি, আর ঘুরে বেড়াই সানুদেশের পথঘাট ৷ পাহাড়ের আদলটা শুধু শুরু হয়েছে এখানে, একটুখানি ঘুরে দাঁড়ালেই সামনে প্রসারিত সমতল আর পিছনে ঘুরে-ঘুরে উঠে যাচ্ছে পথ ৷ আমাদের হোটেলের ঠিক পিছনেই প্রশান্ত এক গুম্ভা, চারপাশে-ঘেরা বারান্দা ঘুরে-ঘুরে ঘণ্টাগুলিতে অবিরাম দোলা দিয়ে যাচ্ছেন কোনও-না-কোনও ধর্মভীরু, বা ঘুরিয়ে চলেছেন সারি সারি ধর্মচক্র ৷ তার সামনে দিয়েই নেমে এসেছে দোকানপসারের পথ, একটু পিছনে ওপরদিকে উঠে এলেই নিঃসীম নিরিবিলি ৷ একজন দুজন কোথাও শুধু বলে: ‘ট্যাক্সি চাই? ট্যাক্সি?’ কিন্তু এছাড়া আর কোনও শব্দপাত নেই, পাহাড়ের নিশ্বাসের মতো অন্ধকার আস্তে আস্তে ঘিরে নেয় আমাদের ৷ সেই অন্ধকার একসময়ে হয়ে উঠবে মেঘ ৷ খানিক পরে ঝমঝমে পাহাড়ি বৃষ্টির মধ্যে তৈরি হবে চমৎকার এক ঘুমের আবেশ ৷
পরদিন, ঝকঝকে ভোরবেলায়, হোটেল-মালিক এসে বলেন, ‘ব্যস্ত ছিলাম কাল, দেখা হয়নি ৷ কোনও সমস্যা নেই তো? পারমিট নিশ্চয় করা হয়নি এখনও?’
‘পারমিট কি লাগবে? ওঁরা যে বলছিলেন পাসপোর্টেই হবে?’
‘হতে পারে ৷ তবু পারমিটটা করিয়ে রাখা ভালো ৷ চা খেয়ে নিন ৷ আমিই এসে নিয়ে যাব আপনাদের ৷’
সত্যি সত্যিই নিয়ে গেলেন তিনি, খানিকটা উঁচুতে ভারতীয় দূতাবাসের দপ্তরে ৷ ফর্ম সই করে, এখানেওখানে টিক দিয়ে, দুদুটো করে ছবি লাগিয়ে, অধিকর্তার সই নিয়ে বেরিয়ে আসছি যখন, জিজ্ঞেস করি: ‘এখানে কি আমাদের আসতেই হত? আন্তর্জাতিক এই পাসপোর্ট কি পরিচয় হত না?’
‘না, হত না ৷’ বেশ অমায়িকভাবেই জানান অধিকর্তা ৷
ভাগ্যিস তোলানো হয়েছিল ছবিগুলো ৷ দুখানা নিলেন এঁরা, আরও দুখানা না কি লাগবে আরেকটা কাগজে, রওনা হবার পরে, অল্প খানিকটা দূরে ৷ পারমিট যদি পাসপোর্ট হয়, ওকে বলা যাক ভিসা ৷
ঘুরে ঘুরে চলেছে গাড়ি আর বিকেল হয়ে আসছে ৷ অন্য অনেক পাহাড়ের তুলনায় এর আছে একটু শুকনো শুকনো ভাব, প্রথম কিছুদূর পর্যন্ত মনে হয় যেন উদ্ভিজ্জের সবুজও এখানে কম ৷
বৃষ্টি নামে আবার ৷ তত ঘন বৃষ্টি নয় যে সব একাকার করে দেবে বা মুছে দেবে সামনের সমস্ত ছবি ৷ গাড়ির কাচের মধ্য দিয়ে জল, জলের মধ্য দিয়ে পাথর বা আকাশ ৷ আস্তে আস্তে সন্ধে হয়ে আসে ৷ এবার জলের ভেতর দিয়ে উঁচুতে-নিচুতে সারি সারি আলোর ক্ষীণ বিন্দু ৷ বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনও শহর আমরা ছেড়ে এলাম দূরে কিংবা সামনে আসছে নতুন কোনও শহর ৷ তারই মধ্যে কখন এসে যায় থিম্পু, প্রায় যেন নিঃসাড়ে ৷ ভুটান-সময়ের সাতটা বাজে তখন, আমার ঘড়িতে সাড়ে ছয় ৷ পুরো সাত ঘণ্টাই লেগে গেল তবে!
কিন্তু এই না কি রাজধানীর বাসস্ট্যান্ড? অন্ধকার, জনহীনপ্রায় ৷ যাত্রী যাঁরা ছিলেন, টুপটাপ টুকটাক নেমে চলে যান নিজের নিজের দিকে ৷ আমরা কোথায় যাব? একটি দুটি ট্যাক্সিঅলা এসে দাঁড়ায় ৷ কোনদিকে যেতে চাই আমরা? বৃষ্টিটা ভাগ্যিস থেমেছে ৷ যে-কোনও একটি ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে বলি: ‘হোটেল’ ৷ ‘কোন হোটেল?’ ‘যে-কোনও একটা ৷’
ট্যাক্সিঅলা মুহূর্তে পাক দিয়ে ঘুরিয়ে নেয় গাড়ি ৷ আলোকিত কিন্তু জনবিরল বড় রাস্তায় পৌঁছে একেকটা হোটেলের সামনে দাঁড়াতে থাকে, আর গাড়িতে বসেবসেই বহিরবয়ব দেখে কারণে-অকারণে আমরা নাকচ করতে থাকি সব, আবার শেষ পর্যন্ত তেমনি অকারণেই নির্বাচন করে নিই একটা ৷ আর, ঘর সাব্যস্ত হবার আগেই, বেশ সবজান্তা ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করি প্রথমেই: ‘রুমহিটার আছে তো? রুমহিটার?’
কেননা কলকাতায় একজন আমাকে বলেছিলেন, রুমহিটার ছাড়া থাকবেন না থিম্পুতে, ঠান্ডা কিন্তু খুব ৷
কাজেই, আলো আছে কি না জল আছে কি না ঠান্ডা আছে কি না এমনকী ঘর আছে কি না জানতে চাইবার আগেই বলে বসি আমি: ‘রুমহিটার আছে? রুমহিটার?’
ঈষৎ সন্ত্রস্ত ছোটখাটো রিসেপশনিস্ট মেয়েটি জানায়: ‘দিয়ে দেব একটা ৷’
বেশ, তাহলে তো কোনও সমস্যাই রইল না আর ৷
এই তাহলে থিম্পু?
ভোরের আলোয় একলা একবার বেরিয়ে পড়েছি পথে, হোটেল থেকে ডাইনে ৷ এ দার্জিলিং গ্যাংটক বা সিমলার পথ নয়, হোটেলের সামনে প্রধান রাজপথটা এখানে সমান টানে চলে গেছে তার বাঁকহীন দীর্ঘতা নিয়ে ৷ সে যে সমতল নয়, সে যে পাহাড়ি পথ, বোঝা যেন শক্তই সেটা ৷
কিন্তু কাল আমরা নেমেছিলাম কোথায়?
সেটার আবিষ্কার হল একটু পরে ৷ গোটা শহর এক চক্কর দেখে নেব বলে দুজনে যখন বেরিয়েছি আবার, বাঁয়ের দিকে এবার, কয়েক পা হেঁটে একটা চত্বরের পিছনদিকে নেমে এসেছি যেই, দেখি-আরে, এই তো সেই স্ট্যান্ড! এইখানেই নেমেছিলাম কাল? আর এখান থেকেই অত পাকফেরতার পর পৌঁছলাম সামনেই আমাদের হোটেলে?
এ-রকম দুচারবার ঠকে যাওয়াটা অবশ্য বেড়াতে বেরোবার ভবিতব্য ৷ তাই সেকথা আর না ভেবে আমরা ভাড়া করে ফেলি একটা গাড়ি, ঘুরে দেখা যাক রাজধানী ৷ চোখে দেখে যতটা ছোটখাটো মনে হচ্ছে ততটাই কি ছোট এ শহর? ততটাই খেলনাবাড়ি?
পথ চলতে চলতে মনে হয়, এই তো একটা গুম্ভা ৷ এত এত গুম্ভা চারদিকে? ভুল ভেঙে যায় একটু পরে ৷ না, কোনওটাই তা নয় ৷ একই ধাঁচে তৈরি সুঠাম বাড়িগুলির শীর্ষাংশে চিত্রবিচিত্র রংরূপ দেখে ও-রকম মনে হয় বটে, কিন্তু এ-বাড়িটা ব্যাঙ্ক ৷ ও-বাড়িটা? পোস্ট অফিস ৷ আর ওইটে? ওটা হল থানা ৷ সুদৃশ্য বাড়ির সঙ্গে সুরম্য পোশাক, সুভদ্র ব্যবহারের সঙ্গে সুমিত বাচন, স্থির শান্ত চারদিক, আর তার সঙ্গে যেদিকে চাও থরে থরে সাজানো পিচ ফলের গাছ, বেগনি ফুলে ফুলে ভরে আছে ডালপালা ৷ একে কি আর নিছক একটা শহর বলা চলে? এ হল সাজিয়ে রাখা এক খেলনাবাড়ি শহর ৷
মাঝখানে বয়ে গেছে শীর্ণ একটা জলধারা, এই তাদের নদী, থিম্পু চু ৷ নদীটা অবশ্য চলছেই চলছেই পাহাড়পথের সঙ্গে সঙ্গে, খানিক দূরে গিয়ে মিশে যাবে পারো থেকে আসা আরেক ধারার সঙ্গে, তারপর একসঙ্গে নেমে যাবে নীচে, তখন তার নাম ওয়াং চু ৷ থিম্পু চু-এর একটা বাঁকে দাঁড়িয়ে গোটা শহরটার আদল একবার দেখে নিই উঁচু থেকে ৷ ওই দূরে রাজবাড়ি, এই এদের জোং, তাশিছো জোং ৷ জোং কথাটার মানে দুর্গ, কিন্তু এ-জায়গাটা আসলে শাসন-পরিচালনার কেন্দ্র ৷ ওই যে ইন্ডিয়া হাউস, আর ওই হল সার্ক-এর জন্য তৈরি করা বাড়ি ৷ ‘জানেন তো, সার্ক-এর প্রথম সম্মেলন হয় এইখানে, এই বাড়িতে? সেইজন্যই এত জাঁক ৷ আর এই হচ্ছে ক্রিকেটমাঠ ৷’
‘ক্রিকেট? এখানে ক্রিকেটখেলাও হয় না কি?’
‘ক্রিকেট হয়, গল্ফ হয় ৷ দেখাচ্ছি চলুন গল্ফ খেলবার জায়গাটা ৷’
কিন্তু ক্রিকেটের কথায় মনে পড়ে যায় আজ ভারত-অস্ট্রেলিয়ার খেলা ৷ বেড়াতে এসেছি বলে খেলা দেখব না না কি? অতটা হয় না! কিন্তু দেখব-বা কেমন করে? আমাদের হোটেলে রুমহিটার আছে, টিভি তো নেই! ড্রাইভার-ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করি: ‘টিভি কোথায় দেখা যাবে বলো তো?’
‘টিভি? টিভি কোথায় পাবেন? ভুটানে তো টিভি নেই ৷’
‘নেই?’
‘নাঃ ৷ যদি লুকিয়ে-লুকিয়েও দেখে কেউ তো তার ফাইন হয়ে যাবে ৷’
টিভি নেই, ১পত্রিকা নেই, রেডিয়ো চলে সন্ধ্যায় মাত্র দুঘণ্টা, খবর জানে কেমন করে এরা? জানে এদের সাপ্তাহিক একটা ট্যাবলয়েড থেকে, ‘কুয়েনজেল’ তার নাম ৷ যারা পড়তে জানে জোংখা (ভুটানি) বা নেপালি বা ইংরিজি, প্রত্যেক শনিবারের সকালবেলায় তারা ভিড় করে ঝুঁকে পড়ে তিন ভাষায় প্রকাশিত ওই কাগজের ওপর ৷
‘আর সিনেমাহল? সিনেমাহল কটা?’
‘একটাই মাত্র ৷’
‘কোথায় সেটা? কতদূর?’
‘বাঃ, সে তো আপনাদের হোটেলের ঠিক গায়ে গায়ে লাগানো ৷ ঠিক সঙ্গেই ৷’
সিনেমাহল ওটা? তাই লোকজনের ওই ভিড় দেখেছিলাম কাল রাতে? হোটেলের নীচের তলাতেই দোকানপসারের বাহার দেখে ওটাকেও আমি ভেবেছিলাম একটা সুপারমার্কেট ৷
গাড়ি চালাতে চালাতে শেতেন দোরজি (এই হল আমাদের চালকের নাম) বলে: ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাবেন?’
‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি? নিশ্চয়ই যাব ৷’
স্কুলকলেজের বিশেষ আধিক্য নেই এ-শহরে, পড়বার ব্যবস্থা আছে কেবল বারো ক্লাস পর্যন্ত, আরও কিছু পড়তে হলে যেতে হবে থিম্পুর বাইরে ৷ সেই থিম্পুতে গোটা একটা ন্যাশনাল লাইব্রেরি? দেখতেই হয় সেটা ৷
চোদ্দ বছর আগে তৈরি হয়েছে এই বাড়ি ৷ কিন্তু ভেতরে ঢুকে ঘরগুলির প্রসারিত শূন্যতা দেখতে দেখতে ধন্দ লাগে মনে ৷ ছিমছাম সাজানো কোনও তাকে দশখানা বই কোনওটায় বিশখানা, অনেকগুলি ফাঁকাও ৷ বই রাখবার অন্য কোনও প্রচ্ছন্ন জায়গা কি আছে তবে? ন্যাশনাল লাইব্রেরির লাইব্রেরিটা কই? সমাসীনা একমাত্র কর্মিণীটির সামনে গিয়ে বলি: ‘মহাশয়া, একটা কথা কি জিজ্ঞেস করতে পারি? এ-লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা কত?’
‘তিন হাজার ৷’
তিন হাজার! খেলনা শহরের খেলনা লাইব্রেরি ৷ আর, তিন হাজার বলেই বই খুঁজে পাবার কোনও সমস্যা নেই ৷ ‘লিটারেচার’-চিহ্নিত কোণটিতে গিয়ে দেখি তাকের ওপর সাতাশখানা বইয়ের মধ্যে আগম আব ত্রিপিটকের ঠিক পাশেই গোর্কির ‘On Literature’-সংকলন, হ্বিনটারনিৎসের ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসের পাশেই ‘Noh Drama’!
বই তিন হাজার হলেও দুষ্প্রাপ্য পুঁথি এখানে আছে দশ হাজার ৷
লাইব্রেরি অবশ্য দেখেছি এখানে আরও একটা, পাবলিক লাইব্রেরি ৷ বড় রাস্তার পাশেই, পাড়ার পাঠাগারের মতো ছোট একটা বাড়ি, কিন্তু সেখানে বরং দশ হাজার বইয়ের জমায়েত ৷ ব্যবহার হয় তো তার? বলা মুশকিল ৷ সাতানব্বই সালের অক্টোবর মাস থেকে সপ্তাহে দু-তিনদিন (‘depending upon the response’) গল্প পড়ে শোনানো হবে ছোটদের, কিংবা তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে তাদেরই পড়বার মতো বই, এই মর্মে একটা বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে দেওয়ালে ৷ ‘কেমন জমছে এই আসর?’ ছমাস পরে মার্চের শেষে আমার এই প্রশ্নের উত্তরে জানি, তখনও শুরুই হতে পারেনি সে-অনুষ্ঠান, response-এর দশা হল এই ৷
কিন্তু স্কুলপোশাক পরে পিঠে বইয়ের ঝোলা চাপিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটেই চলেছে হেঁটেই চলেছে আটদশবারো বছরের ছেলেমেয়েরা, এদিকে বা ওইদিকে, আসতেযেতে এ-ছবিটা হামেশাই চোখে পড়বে ভুটানে ৷ পারোর পথে দেখেছিলাম যেমন, যাবারও পথে, আসবারও পথে ৷
শেতেন দোরজিকে বেশ ভালো লেগে যায়, ছাড়া হবে না একে ৷ ‘পারো যাব আমরা, নিয়ে যাবে তুমি?’ শেতেন বলে: ‘নিয়ে যাব, ফিরিয়েও আনব ৷ থাকবেন না তো আর ওখানে? থাকবার দরকার কী! ছোটখাটো জায়গা ৷’
‘এরও চেয়ে ছোট?’
‘হ্যাঁ, এরও চেয়ে ছোট ৷’
‘কিন্তু শুনেছি যে ওখানে একটা এয়ারপোর্ট আছে?’
‘প্লেন নামে বটে, কিন্তু ওকে কি আর এয়ারপোর্ট বলে? একফালি রাস্তা মাত্র ৷ দেখতেই পাবেন চোখে ৷’
ঘড়িধরা ঠিক সময়ে শেতেন এসে হাজির হয় সকালে ৷ আমরা তখনও তৈরি হতে পারিনি পুরো ৷ কিন্তু ওকে কি আর দাঁড় করিয়ে রাখা উচিত? চটপট, চটপট! এটা-ওটা কাঁধে ফেলে ঝটিতি তৈরি হয়ে নিই ৷ বেরিয়ে পড়ি আলোয়ভরা আমেজভরা শীতের পথে ৷ থিম্পু চু-র সাঁকো পেরিয়ে, বড় বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে (হ্যাঁ, বড় স্ট্যান্ডও আছে একটা), বারো ক্লাসের ইস্কুল পেরিয়ে অনেকখানি এগিয়ে এসেছি আমরা ৷ সামনেই সিমটাখ ৷ ধারাবিবরণ দিতে দিতে চলেছে শেতেন ৷ বেশ আলাপী ছেলেটি ৷ হঠাৎ প্রশ্ন করে: ‘পারমিটটা তো পকেটেই রেখেছেন?’
‘পারমিট?’
‘হ্যাঁ, পারমিট ৷ নেই সঙ্গে? পারমিট লাগবে না? কোন কোন শহরে ঢুকতে পারবেন সে তো বলা আছে কাগজটায় ৷ কাগজ না দেখালে ঢুকতে দেবে কেন? কী হল? ফেলে এসেছেন?’
‘মনে তো হচ্ছে হুটোপুটিতে ফেলেই এসেছি হোটেলে ৷’
পকেট হাতড়ে দেখি তবু দু-একবার ৷ আর, মুখে মৃদু বিরক্তিচিহ্ন নিয়ে উল্টোদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে দেয় শেতেন ৷ এবার তার কথা নেই কোনও ৷ দ্রুততম বেগে পৌঁছে দেয় হোটেলে ৷ লাফ দিয়ে লাফ দিয়ে সিঁড়ি টপকে উঠতে থাকি ঘরে, কেননা পার্কিং-এর নিয়ম নেই এ-হোটেলের সামনে ৷ দরজা খুলি ঝটপট ৷ দেরাজ খুলি ৷ কিন্তু কই? কাগজপত্র যে এইখানে রেখেছিলাম, কোথায় গেল সেসব?
ভোরবেলাতেই বেরোতে হবে বলে সেসব যে কাল রাতে গুছিয়ে রেখেছিলাম কাঁধঝোলাতেই, সেকথাটা মনে পড়ে যায় হঠাৎ ৷ কাঁধেই সেটা ঝোলানো ৷ তার মধ্যে হাত দিয়ে দেখি ঠিক-ঠিক জায়গাতেই রয়ে গেছে পারমিট, সমস্যা নেই কিছু ৷
লাফিয়ে লাফিয়ে ফিরে আসি আবার ৷
‘নিয়ে নিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ ৷’
সেই মুহূর্তে কাউকে আর ফাঁস করি না কথাটা ৷
দু-চারবার বোকা বনে যাওয়াটা তো বেড়াতে বেরোবার ভবিতব্যই!
আবার সিমটাখ হয়ে নামসেলিং হয়ে ওয়াংসিসিনা হয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি ৷ শেতেনের গাম্ভীর্য এখনও অটুট ৷ কেবল, দূরে একটা চৌরাস্তার মোড় আসছে জানিয়ে দিয়ে সে বলে একবার: পারমিটটা বার করুন ৷
থিম্পু চু পারো চু মিলে গেছে ওইখানে, মিলেমিশে নেমে গেছে ওয়াং চু ৷ ত্রিবেণীসংগম বললেই চলে ৷ এই মোড় থেকে পথ একদিকে নেমে গেছে ফুন্টসোলিং-এ, একটা উঠে গেছে হা-এর দিকে, আরেকটা পারোয় ৷ ‘হা পর্যন্ত পৌঁছলে তবে আমার গ্রাম’, বলে শেতেন ৷ ‘কতদূর সেখান থেকে?’ ‘তিরিশ কিলোমিটার হাঁটলেই পৌঁছে যাই ৷’ ‘হাঁটতেই হবে অতটা? অন্য কোনও ব্যবস্থা নেই?’ ‘কোনওই ব্যবস্থা নেই আর ৷’
এই চৌরাস্তার সন্ধিমুখে চেকপোস্ট ৷ পারমিট নিয়ে শেতেন নেমে যায় অফিসঘরের জানলায় ৷ ঘুরেফিরে খানিক পরে ফিরে আসে, জানলায় কেউ নেই ৷ ‘নেই কেউ ৷ চলুন যাই ৷’ ডানদিকে বাঁক নিয়ে আমরা চলতে থাকি পারোর পথে ৷ আলতো একবার জিজ্ঞেস করি শুধু: ‘কাজে লাগল না পারমিটটা?’
নিরুত্তর শেতেন গাড়ি থামায় পথবর্তিনী এক ভুটিয়া যুবতীকে দেখে ৷ জিজ্ঞেস করে: ‘কতদূর?’
‘পারো ৷’
আমাদের কিছুমাত্র পাত্তা না দিয়ে তাকে সে তুলে নেয় গাড়িতে ৷ মেয়েটিও যত সহজভাবে উঠে আসে, মনে হয় নিশ্চয়ই ওর জানাশোনা কেউ ৷
একটি দুটি কথা বলছে তারা ৷ ক্যাসেটে বেজেই চলেছে হিন্দি গান ৷ সঙ্গে সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে শেতেন মিহি স্বরে ৷ বেশ সুরেলা তার গলা ৷ জিজ্ঞেস করি: ‘ভুটানি গান গাও না তোমরা? শোনো না?’
‘গাই ৷ শুনি ৷ অল্প ৷’
‘ভুটানি সিনেমা? দেখানো হয় না কখনও?’
‘হয় ৷ এখনই তো হচ্ছে একটা ৷ তোমাদের ঠিক পাশের সিনেমাহলেই তো ৷’
‘ভুটানি ওটা? কেমন ছবি?’
‘ওই যেমন তোমাদের হয়, হিন্দিরই মতো ৷ এ ওকে love করল ৷ আর তার পর, ইন্ডিয়াকা মাফিক, ঢিশুমঢুশুম ৷’
আরে, এও-যে বলে ঢিশুমঢুশুম ৷ এ কি একেবারে আন্তর্জাতিক শব্দ হয়ে গেল তবে?
আর ওই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে প্রফুল্লতা ফিরে এল শেতেনের ৷
‘সবসময়েই এত হিন্দি বলছ তোমরা, শেখো কী করে? সিনেমা দেখে?’
‘হাঁ, সিনেমা দেখে ৷ আর তাছাড়া ইন্ডিয়ান মিলিটারির কাছে ৷’
‘মিলিটারির কাছে? পাও কোথায় তাদের?’
‘কেন? সবসময়েই তো এপথ দিয়ে যাওয়াআসা করছে তারা ৷ দেখোনি গাড়িগুলি? এরই মধ্যে তো চলে গেল কটা ৷ ফুন্টসোলিং থেকে হা পর্যন্ত কেবলই এরা যায় ৷ দেখছ না পথগুলি কত মজবুত সেইজন্যে, কত পরিষ্কার? হা তো তিব্বতের বর্ডারের কাছে ৷ সেখানে আছে মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট ৷ তার হাবিলদার থেকে কর্নেল পর্যন্ত সবাই আমার বন্ধু ৷ তাদের সঙ্গে কথা বলে বলে শিখে নিয়েছি সব ৷ তোমরা কলকাতার লোক? কলকাতায় হিন্দি বলে না লোকে?’
‘বলে ৷ খুবই বলে ৷’
‘ঢিশুমঢুশুম দেখে?’
‘সে তো দেখেই ৷ এখন বাংলা ছবিতেও সেটা দেখে ৷’
‘কিন্তু ইন্ডিয়া কালচার আমি ভালোবাসি না ৷’
‘কেন?’
‘ইন্ডিয়ায় ছেলেরা বিয়ে করবার সময়ে টাকা চায় ৷ এ খুব খারাপ আছে ৷ তোমাদের ওখানেও নেয়? এখনও?’
‘এখানে নেয় না? এখানে কীভাবে বিয়ে হয়?’
‘এখানে? কেউ কাউকে পছন্দ করল ৷ বাপকে গিয়ে বলল সাদি করবে ৷ বাপ রাজি হল তো ভালো, না হল তো ভেগে পড়ল দুজন ৷ ব্যস, খতম ৷ কেউ কিছু বলল না ৷’
‘বেশ ভালো ৷’
‘লেকিন, আভি একটু একটু ইন্ডিয়া কালচার ঢুকছে!’
‘ওই-যে দেখুন পারোর এয়ারপোর্ট ৷ ফিরবার সময়ে ওর একেবারে পাশ দিয়েই ফিরব আমরা ৷ আর এই নদী হল পারো চু ৷ উঁচুতে ওই তাকান ৷ দেখতে পাচ্ছেন একটা বিল্ডিং? ওটা ন্যাশনাল মিউজিয়াম ৷’
ন্যাশনাল লাইব্রেরির অভিজ্ঞতার পর ন্যাশনাল মিউজিয়াম কথাটা মস্ত কিছু হিল্লোল তোলে না মনে ৷ কিন্তু পারোর দিকে পৌঁছতে পৌঁছতে মনে হচ্ছে এবার যেন আমরা নেমে আসছি একটু ৷ অল্প আগে থেকে আবার মেঘ জমেছে আকাশে ৷ পদ্মফুলের পাপড়ির মতো চারদিকে উঠে আছে পাহাড়, মাঝখানে যেন প্রায় সমতলভূমি, নিঃসঙ্গ নির্জন উপত্যকা ৷ শান্ত একখানা গ্রামের মতো শুয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ রেখে ৷ খুব ভুল হয়ে গেল ৷ এক লহমা দেখেই মনে হচ্ছে এখানেই থাকা উচিত ছিল কদিন ৷
থামল একটু গাড়ি ৷ নেমে গেল মেয়েটি ৷ যাবার সময়ে অল্প কয়েকটা কথার বিনিময় তাদের ৷ পরে আমি জিজ্ঞেস করি: ‘চেনা বুঝি তোমার?’
‘না-না-’
‘এইখানে ওর বাড়ি?’
‘না, এখানে এসেছে পড়তে ৷’
‘কী পড়ছে?’
‘বারো ক্লাসের পরীক্ষা দেবে ৷ বলে কী, ভাড়া কত লাগবে ৷ ভাড়া দেবে আমাকে! কী করে দেবে? কীভাবে এরা পড়াশোনা করে আমি তো জানি ৷ আমার তো হলই না লেখাপড়া ৷ আমি বললাম: বহিন, ভালো করে পরীক্ষাটায় পাশ করো ৷ যদি পাশ করো, তাহলে জানবে সেটাই আমায় ভাড়া দেওয়া হল ৷’
বোকা হতে হল আরও একবার ৷
গাড়ি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ন্যাশনাল মিউজিয়ামের পাশে ৷ আড়াই ঘণ্টায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার গাড়িতে আসতে আসতে এই দুপুরটায় মনে হল গরমই লাগছে ৷ গরম চাদর তাই গাড়িতেই রেখে ঢুকছি এসে মিউজিয়ামে ৷ শেতেন জানাচ্ছে, গাড়ি চলল নীচের দরজার দিকে, ছতলা বাড়ির নীচতলায়, সেখান দিয়েই বেরোতে হবে আমাদের ৷
ঘরে ঢুকবার অল্প পরেই টের পাই আমার মূর্খতা ৷ কাঁপন লাগছে হী হী ৷ ঠান্ডায় জমাট হয়ে আছে আবদ্ধ সেই ঘরগুলি, হা, কোথায় আমার রুমহিটার, কোথায়-বা চাদর! প্রত্যেক তলাতে দুচোখ ভরে দেখবার মতো অঢেল সামগ্রী সাজানো থরে থরে, সময় নিয়ে দেখবার ৷ সময়ের কোনও অকুলোনও নেই আমাদের ৷ আঃ, কেবল চাদরটা যদি থাকত এই সময়ে!
এখানকার ন্যাশনাল মিউজিয়াম দেখছি ন্যাশনাল লাইব্রেরির মতো নয় একেবারেই ৷ আট হাজার শ্লোকের স্বর্ণাক্ষর ‘অষ্টসাহস্রিক-প্রজ্ঞাপারমিতা’ থেকে শুরু করে প্রাচীন পার্বত্য দেবতা আর বৌদ্ধ দেবদেবীদের ছোট বড় মূর্তিতে ভরে আছে ঘরগুলি ৷ খ্রিষ্টপূর্ব যুগ থেকে একেবারে হাল আমল পর্যন্ত ভুটানিদের পোশাক ভূষণ তৈজস এক-এক ঘরে সাজানো, এমনকী ডাকটিকিটেরও বিচিত্র বাহার ৷ আর একেবারে শেষ পর্বে এক উপাসনাঘর ৷
কিন্তু এক উপাসনাঘর থেকে অন্য উপাসনাঘরে এবার যেতে হবে আমাদের! বৌদ্ধদের দুই উপভাগের দুটো ভিন্ন গুম্ভা আছে পারোতে, কিচু আর তাকসাং ৷ কোনওটারই অবশ্য ভেতরে গিয়ে দেখবার আর উপায় নেই এখন ৷ কেন? রাজকীয় নিষেধ ৷ ভেতরে গিয়ে ছবি তুলে নিয়ে বাইরে সবাই বাণিজ্য করছে, এই অপরাধে ঘরে ঢোকাই বারণ হয়ে গেছে বছর পাঁচেক হল ৷ কিচুর শুধু প্রাঙ্গণ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলাম আমরা, দেখতে পেলাম শুধু তার বছরজোড়া ফলফলানো কমলালেবুর গাছ, খুদে খুদে ফল ৷ এর নীচে না কি আছে জলাশয়, কিংবদন্তি বলে ৷ কেউ কখনও দেখেনি অবশ্য ৷
আর তাকসাং?
দশ কিলোমিটার দূরে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে দিয়ে, অতল গহ্বরের ওপারে সুদূর এক উচ্চতায় কোনও-একটা স্তূপের অস্পষ্ট আভাসের দিকে তর্জনী নাচিয়ে শেতেন বলে: ‘ওই-যে দেখুন ৷’
আরে! এ কী চালাকি না কি? এইভাবে দেখিয়ে দিলেই হল? যেতে হবে না কাছে?
‘যাবেন? গেলে তো পায়ে হেঁটে যেতে হবে ৷ গাড়ির পথ তো নেই ওখানে ৷ সরু পথ বেয়ে উঠতে উঠতে সে অনেক ঘণ্টার পথ, যেতে যেতেই সন্ধে হয়ে যাবে ৷’
‘যায় না বুঝি কেউ?’
‘কাউকে কাউকে তো যেতেই হয় ৷ মানত করা থাকে তো অনেকের ৷ আমাদের গাঁয়ের দুজন মেয়েকে প্রত্যেক বছর আসতে হয় এখানে পুজো দেবার জন্য ৷ খুব তকলিফ ওদের ৷ আর পুজো তো আমাদের করতেই হবে, হবে না? দিতেই হবে পুজো ৷ পয়সা ভি খরচ হবে খুব ৷ তা বিশ হাজার টাকা তো লেগেই যাবে ৷ আপনাদের টাকা আর আমাদের টাকা তো সমান-সমান, তাই না?’
‘পুজোর জন্য কুড়ি হাজার?’
‘বাঃ, তা লাগবে না? লামারা আছে গুম্ভায় ৷ লামারাও তো মজুরই একরকম? একশো টাকা করে তো দিতেই হবে তাদের ৷ তাহলে কী হল? তিরিশ জন লামার জন্যই তো তিন হাজার হয়ে গেল ৷ তার পর গাঁয়ের সবাইকে খাওয়ানো ৷ খরচ আছে তার ৷’
‘গাঁ-সুদ্ধ খাওয়াতে হবে?’
‘হবে না? মানতকরা পুজো, খাওয়াতে হবে না সবাইকে? ওটাই নিয়ম ৷’
‘এত টাকা পাও কী করে?’
‘বছর জুড়ে যে যা জোটাই, রেখে দিতে হয় সেটা ৷ বেশির ভাগটাই চলে যায় পুজোয় ৷ বাঁচতে তো হবে ৷ পুজো না করলে লোকে বাঁচবে কী করে?’
থিম্পুর দিকে যখন ফিরে আসছি আবার, বিকেল হয়ে গেছে, পেরিয়ে এসেছি সেই ত্রিবেণীসংগম, চলতে চলতে আবারও হঠাৎ থেমে যায় গাড়ি ৷ কী হল? থামলে কেন? শেতেন চুপ ৷ পিছনে তাকিয়ে দেখি পাহাড়িপথে নেমে আসছেন শিশুকোলে এক মহিলা, তাঁর এক পুরুষসঙ্গীর হাতে পুঁটুলি ৷ সঙ্গীটি এসে গাড়ির পিছনে তুলে দিলেন পুঁটুলিটা, আর শিশুকোলে মহিলাটি উঠে বসলেন ড্রাইভারের পাশে ৷ কোনও বাগবিনিময় নেই ৷ গাড়ি আবার চলতে শুরু করে ৷
ওই মহিলার কাছে পয়সা নিয়েছিল কি না শেতেন, সেটা আর জানা হয়নি আমাদের ৷ কেননা হোটেলে আমাদের নামিয়ে দেবার সময় পর্যন্ত তাঁর গন্তব্য এসে পৌঁছয়নি, নামবেন তিনি আরও একটু পরে ৷ নেমে যাবার সময়ে এঁকে কী বলবে শেতেন? বলবে কি: বাচ্চাকে মানুষ করে তোলো ভালোভাবে, সেইটেই হবে আমায় ভাড়া দেওয়া?
ভুটান ছাড়বার সময় হল আমাদের ৷ বিদায় নেবার সময়ে সকলেই জানতে চায় কেমন লাগল তাদের দেশ ৷ উত্তরে, আমাদের উচ্ছ্বাসের কোনও অন্ত থাকে না ৷
এ-রকম এক উচ্ছ্বাসের সময়ে পাশে ছিলেন প্রৌঢ় এক সুগম্ভীর শিখ ৷ থিম্পুতেই কাজ করেন তিনি ৷ আমাদের আবেগ শুনে তাঁর ঠোঁটের কোণে জেগে ওঠে অল্প একটু বাঁকা ঢেউ ৷ বলেন: ‘সাতদিনের জন্য এলে ওইরকম লাগে ৷’ তারপর, একটু থেমে: ‘থাকতেন যদি একমাস তো বুঝতাম ৷ অসহ্য! বোরিং! কিচ্ছুই করবার নেই এখানে ৷’
সন্তর্পণে সরে আসি আমরা ৷
থিম্পু চু-কে ডাইনে রেখে নামছি আমরা ফুন্টসোলিংয়ের দিকে ৷ চলতে চলতে দেখি থাকে থাকে আপেল গাছের জমি তৈরি হয়ে আছে, শুকনো ডালপালা মেলে গাছগুলি যেন কাত হয়ে আছে অনেকখানি, যেন প্রতীক্ষায় আছে তারা ৷ কিছুদিন পরে যখন এত এত গাছ ভরে উঠবে ফলেপাতায়, কেমন তার ছবিটা হবে ভাবি ৷
চৌরাস্তায় পৌঁছবার পর এবার কিন্তু বুঝি, চেকপোস্টটা একেবারেই খেলাখেলা নয় ৷ ফুন্টসোলিংয়ে নামবার পথে যাত্রীদের খানাতল্লাশিটা বেশ বড় মাপেই ঘটে ৷ বাসের ছাদে উঠে সুটকেস খুলে খুলে, বাসের ভেতরে ঢুকে ব্যাগ-হাতব্যাগ খুলে খুলে, বেশ জবরদস্ত পরীক্ষা করেন এঁরা, সবকিছুই ৷ কী এত পরীক্ষা করেন? কী এমন পাচার করবে লোকে? নিরীহভাবে কথাটা জানতে চাইলে একজন কর্মী খানিকটা উপেক্ষা নিয়ে তাকান, বলেন না আর কিছু ৷
ছেড়ে দেয় আবার বাস ৷ ফুন্টসোলিংয়ে রাত কাটিয়ে কাল আবার জলপাইগুড়ি ৷
বেড়ানো সাঙ্গ করে জলপাইগুড়ি থেকেই ফিরে আসব আবার ৷ ট্রেন ধরতে হবে পাঁচটায় ৷
জিনিসপত্র সব গোছানোই আছে ৷ রিকশা নিয়ে স্টেশনে গেলেই হল ৷ নিরুদবেগ বিশ্রামে বসে আছি টেবিলের ধারে, আর অলস হাতে ওলটাচ্ছি টেবিলের-ওপর-পড়ে-থাকা মস্ত একখানা ‘মনুসংহিতা’, এ-বাড়ির প্রাচীন সংগ্রহের অন্যতম একটা বই, বন্যার পলিতে আগাগোড়া আটকে-আটকে-যাওয়া তার পাতা ৷
জিনিসপত্র তো সব গোছানোই আছে? ‘আছে’-গৃহিণী বলেন -‘শুধু চটিগুলো মুড়ে নিতে হবে ৷’
চটির একটু বিলাসিতাই তিনি করেছিলেন এবার ৷ ঘরে কোনটা বাইরে কোনটা, সমতলে কোনটা পাহাড়ে কোনটা, মর্মের গভীরে এর কোনও ভেদাভেদ হয়তো ছিল, হিসেবটা যদিও ঠিক থাকেনি সবসময়ে ৷
আমি ঝুঁকে আছি টেবিলে, পিছনে দাঁড়িয়ে তিনজোড়া চটির শেষ জোড়াটি উনি পেলব যত্নে মুড়ে নিচ্ছেন কাগজে, এমন সময়ে অস্ফুট এক শব্দ শুনি: আলিবাবা ৷
আলিবাবা? হঠাৎ কেন আলিবাবা? পিছনে তাকিয়ে দেখি, স্থির মূর্তি ৷ ‘স্ট্যাচু’ বললে ছোটবেলায় যতখানি স্থির হয়ে দাঁড়াতে হত, ঠিক ততটাই স্থির, চোখও পলকহীন ৷ কাগজের শেষ পাকটা চটির ওপর পড়বার আগে স্থির হয়ে আছে হাত, স্ফারিত চোখের সামনে চটির তলদেশ ৷ সেই স্থিরমূর্তির মুখ থেকে আরও একবার ফিসফিস শব্দ ভেসে এল: আলিবাবা ৷
ওঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না ৷ কিন্তু তা কি হঠাৎ এতটাই খারাপ হল যে মাথাতেও এল বিকার? ‘মনুসংহিতা’ গুটিয়ে রেখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি: ‘কী বলছ?’
এবার, দুপা এগিয়ে এসে, চটির তলদেশ আমার মুখের সামনে উত্থাপন করে তিনি বলেন: ‘এই-যে, আলিবাবার গল্প!’
তাকিয়ে দেখি, চটির তলায় ঝকঝক করছে তাঁর সেই হারিয়েযাওয়া দুল, যেন বিষ্ণুর বুকে কৌস্তুভের মতো গেঁথে আছে সুখে ৷ আর এই হল সেই চটি, জলপাইগুড়ির ঘরের পর যা তিনি ব্যবহার করেছেন গোটা ভুটান জুড়ে, এই কয়েকটা দিন ৷
গালে হাত দিয়ে ভাবি, ফিরবার পথে পুঙ্খে পুঙ্খে চেকিং-এর সময়ে চটির তলা তো দেখতে চাননি অফিসাররা ৷ উচিত ছিল না কি দেখা? আর, দেখতেন যদি? কাগজে কি সোনাপাচারের খবর উঠত তবে?
অবশ্য, জানি না এখনও, দুলটা ঠিক সোনারই ছিল কি না!
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন