অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
জুন মাসের ২২ তারিখ কলকাতা ছেড়ে ২৪ তারিখ বিকেলে উত্তরকাশীতে উপস্থিত হলাম ৷ বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের গাইড রাজু, কুক ভরত এবং ওদের আরও দুজন সঙ্গীর সাহায্যে সব মালপত্র নিয়ে হোটেলে আশ্রয় নিলাম ৷ পরদিন সকালে উত্তরকাশী বাজার থেকে বাকি খাবার, আনাজ এবং কেরোসিন তেল সংগ্রহ করার জন্য দুজন চলে গেল ৷ আমরা প্রথমে গেলাম এজেন্সি অফিসে এবং তারপর জেলাশাসকের সদর দপ্তরে ৷ এখন নিয়ম হয়েছে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ আর গাইড এবং মালবাহক সংগ্রহ করতে পারবে না ৷ চার-পাঁচটি এজেন্সি আছে, তাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হবে ৷ আমরা গাইড এবং কুকের ব্যাপারে অনমনীয় ছিলাম, ওরা জোরাজুরি করলেও শেষ পর্যন্ত ওদের মাধ্যমে শুধুমাত্র মালবাহক নেবার জন্য আমাদের প্রস্তাবে রাজি হতে বাধ্য হল ৷ ঠিক হল, কজন লাগবে সেটা পরে ঠিক হবে, আপাতত বেশি মালবাহকের নামে ইনারলাইন পারমিট বানিয়ে নিতে হবে আজই ৷ সেইমতো ছবি তুলে নির্দিষ্ট ফর্ম ভর্তি করে নিয়ে জেলাশাসকের দপ্তরে উপস্থিত হলাম ৷ আমাদের সব কাগজপত্র যথাযোগ্যভাবে প্রমাণপত্র সহ ক্যুরিয়ার মারফৎ আগেই এখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ৷
কদিন ধরেই এদিকে একটানা বৃষ্টি হয়ে চলেছে, রাস্তায় কয়েকটি ধস পেরিয়ে আমাদের বাস পরদিন সকালে গঙ্গোত্রীতে এসে পৌঁছল নির্দিষ্ট সময়ের দুঘণ্টা পর ৷ আমাদের নির্দিষ্ট বাসস্থানে এসে দুপুরে খাওয়ার পর সব মালপত্র তালিকা করে প্যাক করে নিলাম ৷
আমাদের পায়ে হাঁটা পথের শুরু হল পরদিন সকাল আটটায় ৷ ভাগীরথীকে ডানদিকে রেখে হেঁটে চলেছি ৷ সহজ পথ, সামান্য চড়াই, হালকা মেজাজে সবাই হাঁটছি ৷ পথে এখন কয়েকটা অস্থায়ী চায়ের দোকান হয়েছে ৷ মাঝে মাঝে এরকম কোনও দোকানে বসে বিশ্রাম নিই, চা খাই, আবার চলা শুরু করি ৷ দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম ভুজবাসা ৷ গঙ্গোত্রীতে সুদর্শন পর্বতকে দেখে যাত্রা শুরু করেছিলাম, দক্ষিণ-পূর্বদিকে হাঁটার দরুন অনেক আগেই সুদর্শন আমাদের দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে গেছে ৷ এখন আমাদের সামনে মেঘের আড়ালে ভাগীরথী শৃঙ্গত্রয়ের ইঙ্গিত ৷ প্রথম দিনের পথশ্রমে সবাই ক্লান্ত ৷ পরদিনের প্রস্তুতির কাজ সেরে সবাই তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়লাম ৷
দ্বিতীয় দিন বোল্ডারের ওপর দিয়ে একঘণ্টা হেঁটে গোমুখে এসে উপস্থিত হলাম ৷ বর্ষার প্রভাবে ভাগীরথীর জলধারা এখন বেশ স্ফীত ৷ গোমুখে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার পিছিয়ে এলাম ৷ বাঁদিকের পথ ধরে আমাদের ওঠা শুরু হল গঙ্গোত্রী হিমবাহের ডান পাশের গ্রাবরেখা ধরে ৷ আমাদের বাঁদিকে ঝুরো পাথরের দেওয়াল, ধস নামা নিত্যকার ব্যাপার ৷ আমরা অবশ্য কোনও অঘটন ছাড়াই ওই অংশটুকু পার হয়ে এলাম ৷ গ্র্যানাইট পাথরের বিশাল সব বোল্ডার, একটার পর একটা লাফিয়ে আমাদের উঠে চলা ৷ প্রায় ঘণ্টা দুয়েক চলার পর রক্তবরণ হিমবাহের সাক্ষাৎ পেলাম ৷ বাঁদিকে রক্তবরণ এবং ডানদিকে গঙ্গোত্রী হিমবাহের মধ্যবর্তী গ্রাবরেখা ধরে আমরা উঠে চলেছি ৷ রক্তবরণের শরীরের রং লাল, গঙ্গোত্রীর শ্বেতগাত্রের প্রায় বিপরীত ৷ এর মধ্যে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে ৷ একে বোল্ডার ঠেলে ওঠা, তার মধ্যে বৃষ্টি, সকলেই কিছুটা বিধ্বস্ত ৷ হাঁটতে হাঁটতে বেলা বারোটা নাগাদ চতুরঙ্গী হিমবাহের দেখা পেলাম, বাঁদিক থেকে নেমে এসে মিশে গিয়েছে গঙ্গোত্রীর সঙ্গে ৷ রক্তবরণ ছোট হিমবাহ, কিন্তু গঙ্গোত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়নি, আলাদা স্নাউট তৈরি করেছে ৷ চতুরঙ্গীর দৈর্ঘ্য ১৮ কিলোমিটার, গঙ্গোত্রীর থেকে খুব একটা কম নয়, কিন্তু গঙ্গোত্রীর সঙ্গে মিলে গেছে ৷ তিন-তিনটে হিমবাহের তে-মাথার এই বিপজ্জনক জায়গা পেরিয়ে এলাম ৷ চড়াই শুরু হল ৷ ক্রমাগত ওঠা আর ওঠা ৷ সব চড়াই একসময় শেষ হয় ৷ দুটোর সময় নন্দনবনে এসে হাজির হলাম ৷ ঝিরঝির বৃষ্টি পড়েই চলেছে, সঙ্গে শনশনে হাওয়া ৷ সব সদস্য এবং মালবাহকদের আসতে বেশ দেরি হল ৷ তাঁবুর ভেতর ঢুকে ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে গেল সবাই ৷ রাতের দিকে আর বৃষ্টি নয়, ক্রমাগত বরফ পড়তে থাকল ৷ মাঝে মাঝেই উঠে ঝাড়াঝাড়ি করে তাঁবুকে বরফের ভারমুক্ত করতে হয়েছে ৷ আবহাওয়া খারাপ থাকার জন্য পরদিনটাও আমরা নন্দনবনে থাকতে বাধ্য হলাম ৷ বেলা বারোটা নাগাদ বরফ পড়া থামল বটে, কিন্তু মেঘ সরে যাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না, তবু যাই হোক বাইরে এসে একটু ঘোরাঘুরি করার সুযোগ পেলাম ৷
গঙ্গোত্রী হিমবাহের এপারে ভাগীরথী শৃঙ্গত্রয়ের নিচে আমাদের অবস্থান, কিন্তু ভাগীরথী আমাদের দৃষ্টির বাইরে ৷ হিমবাহের অন্য পারে শিবলিঙ্গ শৃঙ্গের নিচে তপোবন ৷ আকাশ মেঘে ঢাকা থাকায় আমরা শিবলিঙ্গকে দেখতে পাচ্ছি না ৷ অথচ এই নন্দনবন থেকেই শিবলিঙ্গকে (৬৫৪৫ মিটার) সবচেয়ে সুন্দরভাবে দেখা যায় ৷ তপোবন থেকে একটা সরু পথরেখা বাঁদিকে গঙ্গোত্রী হিমবাহের ধার বরাবর গিয়ে একটা বাঁকের মুখে হারিয়ে গেছে ৷ ওই বাঁক থেকেই একটা হিমবাহ এসে মিশেছে গঙ্গোত্রীর সঙ্গে ৷ ওটি কীর্তি হিমবাহ, কেদারডোম অথবা দক্ষিণ গাত্র বরাবর শিবলিঙ্গ শীর্ষে অভিযান করতে হলে ওই পথেই যেতে হয় ৷ মেঘের আড়ালে কেদারডোম এবং আরও বাঁদিকে করচাকুণ্ড পর্বতের আংশিক অস্তিত্ব চোখে পড়ছিল ৷ কিন্তু মোটামুটি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম গঙ্গোত্রী হিমবাহের বিস্তারকে ৷
আকাশের অবস্থা পরদিনও একইরকম, যদিও বরফ আর পড়েনি ৷ আজ আর অপেক্ষা নয়, পথে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে মনস্থ করে বেরিয়ে পড়লাম ৷ প্রায় একঘণ্টা লেগে গেল নন্দনবন ছাড়িয়ে চতুরঙ্গী হিমবাহের প্রান্তে এসে পৌঁছতে ৷ আমাদের ডানদিকে ভাগীরথীর অ্যাবালেশন ভ্যালি ৷ একসময় নাকি ভাগীরথী থেকে এক হিমবাহ নেমে এসে এখান দিয়ে চতুরঙ্গীর সমান্তরালভাবে গিয়ে মিশে যেত গঙ্গোত্রী হিমবাহের সঙ্গে ৷ এখন সেই হিমবাহ আর নেই, আছে পায়ের নিচে নরম ঘাস আর পাথরের কোণে রংবেরঙের ফুল, দিগন্ত জোড়া বরফের রাজত্বে এদের অস্তিত্ব বেশ আশ্চর্যজনক ৷ কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, চতুরঙ্গী হিমবাহের বামপার্শ্বীয় গ্রাবরেখার কঠিন ও সংকীর্ণ পথ ধরে চলা শুরু হল ৷ চতুরঙ্গীর বুকে ছোট ছোট কয়েকটি জলাশয়, গ্লেসিয়াল ট্যার্ন ৷ চকচকে নীল রঙের জলের ওপর ধবধবে সাদা বরফের গুঁড়ো ৷ বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ এসে উপস্থিত হলাম ডানদিক থেকে আসা বাসুকী হিমবাহের সঙ্গে চতুরঙ্গীর সংযোগস্থলে ৷ এখান দিয়ে বাসুকী হিমবাহ অতিক্রম করে অপর প্রান্তে যাবার কথা ভাবাই যায় না ৷ আমরা ডানদিকের দেওয়াল বরাবর আড়াআড়িভাবে অনেকটা পথ হেঁটে এলাম ৷ ছোট ছোট আলগা পাথর আর প্রায় ষাট ডিগ্রির ঢাল, খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে ৷ একসময় বাসুকী হিমবাহের মাঝামাঝি একটা অপেক্ষাকৃত সহজ জায়গায় এসে হিমবাহটা অতিক্রম করার জন্য প্রস্তুত হলাম ৷ জমাট বাঁধা শক্ত বরফ, স্টেপ কাটতে গিয়ে আমার দেশী আইস-অ্যাক্সের ডগা ভোঁতা হয়ে গেল ৷ হাঁ করে থাকা বরফফাটলগুলিকে বঞ্চিত করে আমরা এক সময় বাসুকী হিমবাহ অতিক্রম করে এসে উপস্থিত হলাম একটা ঝুরো পাথরের খাড়া দেওয়ালের সামনে ৷ রোপ ফিক্স করে একে একে সবাই উঠে এলাম ওই দেওয়ালের মাথায় ৷ আড়াআড়িভাবে আরও কিছুটা উঠে এসে দূরে নিচে দেখতে পেলাম বাসুকীতালকে ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাসুকীতালে (৪৮৯৮ মিটার) ৷
হিমালয়ে অসংখ্য সুন্দর সরোবর বা তাল আছে, বাসুকীতাল তাদের তুলনায় ছোট, কিন্তু পরিবেশ-গুণে অনন্য ৷ এখানে একদিকে একটা ঢালের গায়ে ছোট একটা গহ্বরে একটা মূর্তি আছে ৷ ভরতের অনুরোধে সবাই সেখানে হাজির হলাম ৷ ভরত পুজো দিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই নীল আকাশ পুরোপুরি মেঘশূন্য ৷ তিনদিন বিরক্তিকর আবহাওয়ার পর এখন ঝলমলে রোদ পেয়ে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম ৷ বাইরে সব জিনিস শুকোতে দিয়ে আমরা সবাই ঘাসের ওপর বসে গেলাম ৷ আমাদের দক্ষিণ দিকে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বাসুকী শৃঙ্গ (৬৫২৮ মিটার), সরোবরে ভাগীরথীর প্রতিফলন ৷
পরদিন মিনিট পনেরো হেঁটে আবার উঠে এলাম চতুরঙ্গীর তীরে ৷ আকাশ সামান্যতমও মলিন নয়, আমাদের চারপাশে শুধু বরফ মোড়া শৃঙ্গ ৷ দক্ষিণে বাসুকী (৬৫২৮ মিটার), পশ্চিমে ভাগীরথী, উত্তরে মন্দা (৬৫২৭ মিটার) ও রাধানাথ (৬৬১৭ মিটার), পুবদিকে চতুরঙ্গী (৬৫১৩ মিটার) এবং চন্দ্রপর্বত (৬৭২৮ মিটার) চোখ ধাঁধিয়ে যায় ৷ হাঁটতে হাঁটতে প্রায় দুঘণ্টা পর চতুরঙ্গী হিমবাহের সঙ্গে মিলিত হওয়া সুন্দর হিমবাহের সাক্ষাৎ পেলাম ৷ কালকের মতোই বাঁদিকে বেঁকে হিমবাহের বামপ্রান্তের দেওয়াল আড়াআড়ি অতিক্রম করে এসে সুন্দরের বুকে নেমে এলাম ৷ ম্যাপে সুন্দর এবং সুরালয় হিমবাহের স্পষ্ট বিভাজন আছে, কিন্তু এখানে এলে বোঝা যায় এই দুই হিমবাহের দূরতম প্রান্তদেশ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ৷ খুব সাবধানে সুন্দর হিমবাহ অতিক্রম করতে থাকলাম, এক সময় এক জায়গায় এসে সতোপন্থ শীর্ষের (৭০৭৫ মিটার) দেখা পেলাম ৷
আবার চলা শুরু করলাম ৷ বিস্তীর্ণ এই হিমবাহের ঢেউ একটার পর একটা পার হয়ে, বরফফাটলগুলিকে সন্তর্পণে এড়িয়ে এক আলগা পাথরের দেওয়ালের সামনে এসে উপস্থিত হলাম ৷ শ্লথ পদক্ষেপ, কিন্তু চড়াই বেশিক্ষণের নয় ৷ শীর্ষে উঠে দূরে নিচে দেখতে পেলাম সুরালয়কে, কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ক্যাম্পে (৫১০০ মিটার) ৷ সুরালয় কথার অর্থ দেবতাদের আলয় ৷ চারদিকে ঢাল, মাঝে নিচে কিছুটা সমতলক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ৷ একদিকে ঢালের মাথায় একটা বড় পাথর খাড়া দাঁড়িয়ে আছে, তাই এ জায়গার অন্য নাম খাড়া পাথর ৷ এখান থেকে উত্তরদিকে রাধানাথ পর্বত দেখা যাচ্ছে ৷ ১৯৬৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের একটি দল সতোপন্থ আরোহণে ব্যর্থ হয়ে এই অনামা শৃঙ্গটি আরোহণ করেন এবং রাধানাথ শিকদারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শৃঙ্গের নাম রাখেন রাধানাথ ৷ পুবদিকে দেখা যাচ্ছে খালিপেট হিমবাহ-এই নামকরণের একটি কাহিনী আছে ৷ ১৯৩৫ সালে মেজর গর্ডন অস্মস্টোন যখন এই হিমবাহ জরিপ করছিলেন, তখন একদিন কুলিরা ভুলবশত নিচ থেকে খাবার না নিয়ে ওপরে চলে আসে ৷ মেজর সেদিন কাজ বন্ধ রেখে কুলিদের নিচে নেমে যেতে বলেন ৷ কিন্তু কুলিরা রাজি হয় না, সারাদিন না খেয়েই এই দুর্গম হিমবাহে তারা জরিপের কাজ সম্পন্ন করে, তাই এর নাম খালিপেট হিমবাহ ৷ আমাদের অনেকে, বিশেষত মালবাহকেরা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, মাথা ধরা, বমি বমি ভাব, অনেকেই রাতে কিছু খেল না ৷
পরদিন সকালে মালবাহকদের দেখি নেতিয়ে পড়ে আছে ৷ বেরতে বেশ বেলা হয়ে গেল ৷ প্রতিদিন পথ চলার সময় মনে হচ্ছে আগের দিনের পথ অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল ৷ আজ আমাদের সুরালয় হিমবাহ অতিক্রম করতে হবে ৷ ব্যাপ্তি ও গভীরতায় এর সঙ্গে বাসুকী ও সুন্দর হিমবাহের কোনও তুলনাই হয় না ৷ যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু বোল্ডারের বিশৃঙ্খলা আর মুখ হাঁ করে থাকা বরফ-প্রান্তর ৷ একটা সুন্দর জলাশয় সহ সতোপন্থ শৃঙ্গ, চতুরঙ্গী ও অ্যাভালাঞ্চ শীর্ষ এবং সবার ওপর চন্দ্র পর্বত আমাদের পথ চলায় নিয়ত উৎসাহ দিচ্ছে ৷ তবে এটাও ঠিক, এই প্রতিরোধের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে কেমন যেন একটা গোঁ চেপে যায় ৷ খাড়া দেওয়াল বেয়ে কখনও নিচে নেমে যাওয়া, কখনও সংকীর্ণ বরফশিরার ওপর দিয়ে ব্যালেন্সের পরীক্ষা দেওয়া, কখনও দিগন্তবিস্তৃত বরফ-প্রান্তরের বরফফাটলগুলি সাবধানে অতিক্রম করা, কখনও চড়াই ভেঙে আকাশকে স্পর্শ করা, এভাবে সারাদিন হেঁটেও আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারলাম না, দু-কিলোমিটার আগে চন্দ্র পর্বতের গা ঘেঁসে একটা জায়গায় (৫৩০০ মিটার) থামতে হল ৷ তাঁবু খাটানোর কোনও জায়গা নেই ৷ শুধু পাথর আর পাথর ৷ সামান্য বিশ্রাম নিয়ে সবাই মিলে পাথরগুলি এদিক ওদিক সরিয়ে জায়গাটা যতটা সম্ভব সমান করে নিয়ে তাঁবু খাটালাম ৷ চারদিক সাদা ৷ দূরে শ্বেতা হিমবাহ দেখা যাচ্ছে ৷ ক্লান্তিতে ও ঠান্ডায় সবাই তাঁবুর মধ্যে ঢুকে গেলাম ৷
পরদিন আমরাও চলা শুরু করলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেল ৷ গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ আর হালকা হাওয়া, শীতের যাবতীয় পোশাক থাকা সত্বেও হাড়ে কাঁপন ধরে যাচ্ছে ৷ হোয়াইট আউটে কিছু দেখা যাচ্ছে না ৷ প্রথম একঘণ্টার পথ অন্যদিনের মতোই, তারপর চতুরঙ্গীর বুকে নেমে এসে একটা বড় খাদ পার হতে হল ৷ এখানেই চতুরঙ্গীর সঙ্গে আমাদের এতদিনের সম্পর্কের ইতি, এখানেই মিশেছে তিন-তিনটে হিমবাহ, চতুরঙ্গী, শ্বেতা এবং কালিন্দী ৷ চতুরঙ্গী ছেড়ে আমরা শ্বেতা এবং কালিন্দী হিমবাহের মধ্যবর্তী গ্রাবরেখা ধরে প্রায় দুঘণ্টা হাঁটলাম, তারপর নেমে এলাম কালিন্দী হিমবাহের বুকে ৷ আবহাওয়া আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে, দু-ফুট দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না, বিশাল বিশাল বরফের ঢেউ আর অসংখ্য ক্রিভাস অতিক্রম করে চলেছি ৷ মাঝে মাঝেই কেউ কেউ বরফের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে কোমর পর্যন্ত ৷ নিজেকে টেনে নিয়ে চললাম কোনওমতে ৷ বেলা তিনটের সময় ওই বিপজ্জনক আবহাওয়ার মধ্যে একেকটা বরফের মূর্তি হয়ে যখন কালিন্দীর পাদদেশে (৫৬০০ মিটার) এসে উপস্থিত হলাম, তখন আমাদের দেহ-মনে সামান্যতম শক্তিও অবশিষ্ট নেই ৷ বরফের প্রান্তরে কোনওমতে তাঁবু টাঙিয়ে সবাই ঢুকে গেলাম ৷ এইসব উচ্চতায় সন্ধ্যা বলে কিছু থাকে না, থাকে দিন এবং রাত ৷ সূর্য অস্তাচলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গভীর রাত নেমে এল ৷ ঠিক করলাম যদি শেষ রাতের দিকে আবহাওয়া ঠিক হয়ে যায়, তাহলে অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে পড়ব ৷ জানি সদ্য পড়া বরফে বিপদ অনেক ৷ ক্রিভাসগুলি ঢেকে যাবে, বরফে শরীর ডুবে যাবে, সবচেয়ে বড় কথা অ্যাভালাঞ্চ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৷ বিশেষত এখানে, যেখানে এমন একটা শৃঙ্গের পাশেই আমাদের অবস্থান, এমন একটা শৃঙ্গের গা ঘেঁসে আমাদের যেতে হবে যার নামই হল অ্যাভালাঞ্চ ৷ হোয়াইট আউটের জন্য যদিও আমরা কালিন্দী, অ্যাভালাঞ্চ বা অন্য কোনও শৃঙ্গকেই এখনও দেখতে পাইনি, কিন্তু জানি সে আশপাশেই আছে ৷ যদি কালকেও আবহাওয়া খারাপ থাকে, তবে অপেক্ষা করে দেখব ৷ তাতেও বিপদ হতে পারে ৷ কিন্তু পরশু আবহাওয়া ভালো হলে এগোব, না হয় ফিরে যাব ৷ ছটার মধ্যেই কিছু খেয়ে শুয়ে পড়লাম ৷ কিন্তু ঘুমতে পারলাম না সারারাত, উচ্চতাজনিত কোনও কারণে নয়, চাপা উদ্বেগে ৷
রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ বরফ পড়া থামল ৷ চারটের সময় শীতের যাবতীয় পোশাক পড়ে তাঁবুর বাইরে এলাম, গেইটারের ফাঁক দিয়ে বরফ ঢুকে যাচ্ছে ৷ যদিও আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে না, তবু হালকা হাওয়া দিচ্ছে, মনে হচ্ছে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে ৷ টেম্পারেচার মাইনাস সতেরো ডিগ্রি সেলসিয়াস ৷ তাঁবুতে তাঁবুতে গিয়ে সবাইকে জাগাতে থাকলাম ৷ প্রথমে বেরিয়ে এল বিজয় ৷ ঠান্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে, সবসময় জুতোর ভেতরে পায়ের আঙ্গুলগুলি কুঁচকিয়ে এবং ছেড়ে দিয়ে সচল রাখার চেষ্টা করছি ৷ আধো অন্ধকারে অল্প দূরে যেন একটা বরফের দেওয়াল দেখা যাচ্ছে ৷ হঠাৎ গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ, যেন কানের পাশে বজ্রপাত হল, জীবনে এত বীভৎস আওয়াজ শুনিনি ৷ অ্যাভালাঞ্চ হয়েছে বুঝতে পারছি, তার শিকার হইনি এটাও বুঝতে পারছি, কিন্তু ভয়ে যেন পাথর হয়ে গেলাম আমি ৷ রাজু, ভরত দৌড়ে এসে ওই বরফের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে প্রণাম করতে থাকল ৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যের আলোয় অদৃশ্য হয়ে গেল সব অনিশ্চয়তা ৷ মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলাম, চারদিকে একেবারে কাছে একটার পর একটা শৃঙ্গ, সর্বত্র শুধু শুভ্রতা ৷ একেবারে কাছে পুবদিকে কালিন্দী এবং অ্যাভালাঞ্চ শৃঙ্গ পাশাপাশি ৷ মাঝে যে বরফের ঢালটা উঠে গিয়েছে, ওই পথে আমাদের যেতে হবে ৷ যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রস্তুত হয়ে নিয়ে সাড়ে ছটা নাগাদ হাঁটা শুরু করলাম ৷ প্রায় এক ঘণ্টা উঠে এলাম ৷ এতদূর পর্যন্ত ঢাল বিশাল কিছু নয় ৷ চারদিকে শুধু বরফের কারুকার্য ৷ আর মাত্র দুশো মিটার দূরে একটা আইসফল, ওটা আমাদের অতিক্রম করতে হবে, এই পথের সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশ এইটি ৷ হঠাৎ একটা দুনিয়া কাঁপানো আওয়াজ, আর অ্যাভালাঞ্চ শৃঙ্গ থেকে দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসা কয়েক লক্ষ টন বরফের বন্যা ৷ আর মাত্র আধঘণ্টা আগে রওনা হলে আমরা বরফের তলায় চলে যেতাম ৷ যেমন হয়েছিল ১৯৮০ সালে পুনের একটি দলের দুই সদস্য বিজয় মহাজন এবং অরুন্ধতি যোশীর ৷ এখন আমাদের যেখানে অবস্থান তার থেকে সামান্য ওপরে কালিন্দী শৃঙ্গের গায়ে একটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় তাঁবুর মধ্যে ওরা ঘুমোচ্ছিল, পরদিন কালিন্দী আরোহণের আশায় ৷ কিন্তু রাতে অ্যাভালাঞ্চ শৃঙ্গ থেকে আসা এরকমই একটা বিশাল অ্যাভালাঞ্চের একেবারে প্রান্তিক ঝাপটায় ওদের তাঁবু ডুবে গিয়েছিল কয়েক ফুট বরফের নিচে ৷ কয়েকজন নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হলেও ওরা দুজন পারেনি ৷ ওখানেই সহযাত্রীরা সযত্নে ওদের শুইয়ে রেখেছে ৷ উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, এই শৃঙ্গকে নাকি কখনও থেমে থাকতে দেখা যায় না ৷
আধঘণ্টার মধ্যে আইসফল জোনের কাছে এসে একবার অ্যাভালাঞ্চ শীর্ষের দিকে তাকালাম ৷ যত দ্রুত সম্ভব এই অংশটুকু আমাদের অতিক্রম করতে হবে ৷ কিন্তু ভাবা যতটা সহজ, করা ততটাই কঠিন ৷ নিচের দিকে কম উচ্চতায় একেকটা বোল্ডার পার হওয়াই বেশ কষ্টকর, আর এই ঊনিশ হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায়, যেখানে শরীর সামান্য নড়াচড়া করলেই বুক ভরে শ্বাস নিতে হয়, সেখানে এত বড় বড় বরফের বোল্ডার পার হয়ে ওপরের দিকে ওঠা সত্যিই প্রাণান্তকর ব্যাপার ৷ এমনকী আমাদের মালবাহকেরা নির্দ্বিধায় বেশ কিছু মাল ফেলে দিচ্ছে, কোনও প্রলোভনেও আমাদের কথা শুনছে না ৷ তবু যখন একটা স্টোভ আর একটা স্লিপিং ব্যাগ পর্যন্ত ওরা ফেলে দিল তখন বাধ্য হয়ে রাগারাগি করলাম ৷ নিজেই ওই দুটো দুহাতে নিয়ে উঠতে থাকলাম ৷ দুঘন্টারও বেশি সময় লাগল আইসফলটা অতিক্রম করতে ৷ এখন আমরা অন্তত অ্যাভালাঞ্চের বিপদমুক্ত, কিন্তু পিছিয়ে পড়া দলের জন্য অপেক্ষা করার জায়গা নেই, আমাদের এখনও উঠে যেতেই হবে ৷ মাঝে মাঝেই নরম বরফে একেবারে কোমর পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে ৷ উঠতে উঠতে একসময় কালিন্দীর গায়ে মোটামুটি একটা জায়গা পেলাম যেখানে পিঠের স্যাক নামিয়ে রেখে একটু বসে পিছিয়ে পড়া দলের জন্য অপেক্ষা করা যায় ৷ কিন্তু ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে এই রোদেও শরীর কাঁপতে থাকে ৷ সবাই এল ঠিক দুঘণ্টা পর, একেবারে নিঃশেষিত অবস্থায় ৷ ইতিমধ্যে আবহাওয়াও খারাপ হয়ে গেছে, এতক্ষণ যে ভালো ছিল সেটাই আশ্চর্যের ৷ তবু ওদের বিশ্রামের জন্য কিছু সময় দিতেই হল ৷ তারপর আবার ওঠা, এবার সবার শেষে আমি ৷ মাত্র আধঘণ্টা উঠেই দেখি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে সবাই আঙ্গুলে ‘ভি’ চিহ্ন করে আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে ৷ ‘ভি’ মানে ভিক্ট্রি ! একটু উঠে ওদের সঙ্গে মিলিত হলাম ৷ নারকোল ফাটিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে পুজো দেওয়া হল ৷ আনন্দে কাঁদতে থাকল কয়েকজন ৷ আমরা দাঁড়িয়ে আছি ছোট্ট এক চিলতে জায়গায় যেখানে ১৯৩১ সালের ২০ জুলাই প্রথম পা রেখেছিলেন জে বার্নি ৷ তারপর একে একে ফ্রাঙ্ক স্মাইথ, এরিক শিপটন, এইচ ডব্লু টিলম্যান, মার্কো পালিস, আন্দ্রে রঁস, জে বি অডেন ইত্যাদি সব ইতিহাস প্রসিদ্ধ পর্বতারোহীরা ৷ ভারতীয়দের মধ্যে এখানে প্রথম এসেছিলেন স্বামী প্রবোধানন্দ ১৯৪৫ সালে, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৬৩ সালে ৷
আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেছে, সময় নষ্ট করার উপায় নেই ৷ ওই খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেই চলতে শুরু করলাম ৷ বরফের ঢাল আর শেষ হয় না ৷ নামতে নামতে দিনের শেষে একটা প্রায় আটশো ফুটের বাট্রেস পেলাম, খাড়া নেমে এলাম তার পাদদেশে, তারপরেও একটা প্রায় পঁচাশি ডিগ্রির খাড়া বরফের দেওয়াল, পাঁচশো ফুটের মতো র্যাপলিং করে নেমে এলাম এক বিস্তীর্ণ এবং বিপজ্জনক বরফ-প্রান্তরে ৷ তাড়াতাড়ি তাঁবু টাঙিয়ে প্রায় কিছু না খেয়েই সবাই স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে আশ্রয় নিলাম ৷
কালিন্দীর এদিকের পথে প্রতিবন্ধকতা অন্য প্রান্তের সমান ৷ ভারতীয় প্রতিরক্ষা দপ্তরের দৃষ্টিকোণ থেকে কালিন্দীর এই দিকের পথ খুবই সংবেদনশীল অঞ্চল, ছবি তোলা আইনবিরুদ্ধ ৷ পরদিন তিনটে দড়িতে নিজেদের বেঁধে নিয়ে সারাদিন বরফ-প্রান্তরের ওপর হাঁটতে হাঁটতে শেষে নেমে এলাম অরোয়াতাল ৷ তার পরদিন একটার পর একটা খরস্রোতা নদী বা ঝোরা পার হয়ে বড় বড় পাথরের সুদীর্ঘ শিরা লাফিয়ে লাফিয়ে এসে নদীর ধারে একটা জায়গায় রাত কাটালাম ৷ তারও পরের দিন আমাদের গন্তব্য বদ্রীনাথ ৷ কতদিন পর আমাদের পায়ের নিচে নরম, সবুজ ঘাসের কার্পেট, অসংখ্য ফুল ৷ ঘণ্টা তিনেক পর খাসতলি I.T.B.P ক্যাম্পের এক কিলোমিটার দূরে একটা সুন্দর কুণ্ডের দেখা পেলাম, উত্তর দিক থেকে সরস্বতী নদী এসে মিশেছে আমাদের গত দিনের সঙ্গী অরোয়া নদীর সঙ্গে ৷ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবাই চলতে শুরু করলাম ৷
ভ্রমণ এপ্রিল, ১৯৯৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন