অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
বাবা বলতেন, বাঙালি জাতটা যখন তৈরি হয় তখন ভগবান তাদের পায়ে রসিকতা করে একটু সুড়সুড়ি দিয়ে দিয়েছিলেন ৷
ভগবান পরে নিশ্চয় পস্তেছিলেন ৷ কেননা, তাঁর এই রসিকতার ফলে গোটা বাঙালি জাতটা যখন সাত কোটি থেকে সতেরো কোটিতে দাঁড়াল, তখন তারা ভ্রমণতাড়িত হয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল ৷ দুই বাংলায় ভাগ হয়ে গিয়েও সে বাতিক কমা তো দূরের কথা, যেন বেড়েই চলল ৷ আর সেই কারণেই যে ‘ভ্রমণ’ পত্রিকার জন্ম এটা হলফ করে বলতে পারি ৷
এখন আমার ওপর নির্দেশ এসেছে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে কীভাবে একজন যাত্রীকে মস্কো থেকে বেজিং-এ পৌঁছে দিতে পারে তার বিবরণ লিখে ফেলা ৷ ভেবে দেখুন!
কমবয়েসের চরকি-ঘোরা সেইসব দিনগুলোর কথা মনে করতে অবশ্য ভালোই লাগে ৷ দৃশ্যগুলো চোখে ছবির মতো ভেসে ওঠে ৷ সেবার যেতে হচ্ছে বেজিংয়ে (তখন পিকিং বলা হত) শিশু-রক্ষার দায়ভার নিয়ে আমরা তিন তরুণী আগেভাগে চলেছি মস্কো থেকে চিনের দিকে, সম্মেলনের প্রস্তুতির কাজে ৷ তখন ছিল হিন্দি-রুশি ভাই-ভাই আর হিন্দি-চিনি ভাই-ভাইয়ের যুগ ৷ আমরা বয়েসে তরুণ হলেও খাতির পাচ্ছিলাম প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়ার মতো ৷
আমরা তিনজনই ছিলাম এশিয়ার মেয়ে ৷ ইরানের মেয়ে ১৯ বছরের তুরান ছিল সবচাইতে ছোট ৷ ছোট্টখাট্ট পুতুলের মতো ছিল ভিয়েতনামের হো-থি-মিন ৷ আর আমি ভারতের ছটফটে বাঙালি ৷
মস্কো থেকে ছাড়ে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলগাড়িটি ৷ ময়াল সাপের মতো পড়ে থাকে স্টেশনগুলোয় ৷ যখন চলে তখন বোঝাই যায় না এ সেই স্টেশনে পড়ে পড়ে ঝিমনো ট্রেন ৷ হু-হু গতি আর হি-হি শীতের মধ্যে এর চলার কায়দাই আলাদা ৷ সাতটি দিন ধরে কেবল চলতেই থাকবে চিনের দিকে ৷ মাঝখানে পড়বে অসংখ্য শহর আর গ্রাম, বন আর পাহাড়, হ্রদ আর থমথমে আকাশ ৷ আর যদি শীতকালে যান, তাহলে সত্যিই বিদেশ আসার মজা পাবেন বরফের খেলা দেখে ৷
ইভান ইভানোভিচের ওপর ছিল আমাদের দেখভালের ভার ৷ মস্কো থেকে আমাদের জন্য যাচ্ছে তিন মন ওজনের রকমারি খাবার ৷ এছাড়া ট্রেনের যাত্রীদেরও কিছু-না-কিছু দেবার মতো জিনিস ছিল ৷ সকলেই এই লম্বা সফরে আমাদের মতো তিনটি বিদেশিনী পেয়ে মহা খুশি ৷
অজগরের মতো বিরাট ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলগাড়িতে ভেতরটার তাপ নিয়ন্ত্রিত ৷ গরম কামরায় বসে সেই নভেম্বরের শীতে আমরা সাইবেরিয়ার ব্যাপারটা কল্পনাও করতে পারছিলাম না ৷ আমার গরম জামাকাপড়ের ওপর যে ওভারকোটটা ছিল তা শুনলাম নাকি হেমন্তকালীন, শীতকালীন নয় ৷ সেটা যে কেন এত ভাবনার বিষয় হল তখন বুঝিনি ৷ পরে বেশ মালুম হয়েছিল ৷
ওরা আমাকে বলত সূর্যের দেশের মেয়ে ৷ কেননা, আমার সত্যিই শীতবোধটা ছিল কম ৷ আমার ইন্টারপ্রেটার ছিলেন প্রাভদার করেসপন্ডেন্ট ওলগা চেচটকিনা ৷ ভারতে এবং কলকাতায় একাধিকবার এসেছেন যুব-প্রতিনিধি হিসেবে ৷ তিনি হেসে রুশি বন্ধুদের বলতেন, ওর কিচ্ছু হবে না এই শীতে ৷ ও ভারতের সূর্য ধরে এনেছে ওর রক্তে ৷
ট্রেন যেদিন সাইবেরিয়ায় পৌঁছে থামল ইস্পাত শহর সভার্ডলভস্কে, সেদিনটি ছিল থমথমে আর হাড়কাঁপানো ঠান্ডা ৷ বন্ধুবান্ধব, ওলগা কেউই নামতে চাইল না স্টেশনে ৷ অথচ আমি তো ঠিকই করে রেখেছিলাম সাইবেরিয়ায় পৌঁছে আইসক্রিম খাব ৷ দেশে ফিরে বন্ধুবান্ধবদের বলতে হবে না? মাইনাস তিরিশ ডিগ্রিতে আইসক্রিম না খেলে তো অ্যাডভেঞ্চারই হল না ৷ শুনে এক ইঞ্জিনিয়ার আমাকে আইসক্রিম খাওয়ালেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে ৷ ওঁর অবশ্য ব্যাপারটা তেমন কিছু লাগেনি ৷ গল্প শুনে পরে পিকিংয়ে আমাদের এক আফ্রিকান মহিলা প্রতিনিধি বলেছিলেন, বলিহারি যাই তোমাকে, আমি তো মরেই যাব ভেবেছিলাম ৷ জানো, জীবনে আর দেশে ফিরে কখনও বলব না সাইবেরিয়ার মতো ঠান্ডা হাওয়া বইছে ৷ বাপরে বাপ!
পরদিন ভোরে কুপেতে শুয়ে-শুয়ে মনে হল আবহাওয়াটা যেন কীরকম-কীরকম ৷ ওলগা শুয়েছিলেন নিচের বাঙ্কে ৷ ওপর থেকে নেমে মনে হল খালি পায়ের পাতার নিচে কীসব যেন কচমচ করে উঠল ৷ জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি কেমন যেন ঝাপসা-ঝাপসা ঘষা কাচের মতো দেখাচ্ছে সব কিছু ৷
ট্রেনের কুপ থেকে করিডরে এসে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ঠান্ডা সেদিন মাইনাস পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি ছাড়ি-ছাড়ি করছে ৷ বাইরের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি-ওই তো পৃথিবীর বৃহত্তম বৈকাল হ্রদ ৷ আমাদের ট্রেন চলেছে তার গা ঘেঁসে ৷ অপূর্ব! এত ঠান্ডা, তবু জল বরফ হয়ে যায়নি তখনও ৷ ফেরার পথে, চারমাস পরে, আমি একা ফিরছিলাম ৷ হ্রদটা কোথায় বুঝতে পারিনি ৷ সমস্ত জল তার জমে বরফ হয়ে একটা সাদা মাঠের মতো দেখিয়েছিল ৷
বৈকাল হ্রদকে হ্রদ না বলে সমুদ্র বললেই মানায় ৷ সেটা পেরোতে আমাদের কদিন লেগেছিল মনে নেই ৷ কিন্তু যতদূর মনে পড়ে, দুদিন তো বটেই ৷ আমার মনে হয়, যারা শীতকাতুরে তাদের এসব দেশে গরমকালে আসাই ভালো ৷ তাছাড়া ফুল, গাছপালা, প্রাকৃতিক শোভা সবই হিম হয়ে থাকে শীতের সময় ৷ অবশ্য আমায় জিজ্ঞেস করলে বলব, সাইবেরিয়ায় আমি শীতেই যেতে চাই ৷
চিতা স্টেশনে পৌঁছতে হইচই করে লোকে ট্রেন থেকে নামতে লাগল ৷ চিন, চিন ৷ চিনের বর্ডার টাউনে পৌঁছে গেছি ৷
বাইরে সেদিন একটু ব্লিজার্ড অর্থাৎ বরফ-ঝড়ের লক্ষণ ৷ আমরা সেদিন আর কেউ দেশি পোশাক পরিনি ৷ ভেতরে মোটা-মোটা গরম জামা ৷ ওপরে মোটা ওভারকোট (আমারটা ধার করা) ৷ পায়ে স্নো-শু ৷ কিন্তু হায়! চিতা স্টেশনে নেমে দেখি ঠান্ডা হাওয়া আমাদের পেড়ে ফেলার জন্য তৈরি হয়ে বয়ে চলেছে ৷ মনে হচ্ছে দেহের হাড় অবধি তার অবাধ গতিবিধি ৷ দেখতে-না-দেখতে চোখের পাতা, ভুরু সব সাদা-সাদা হয়ে উঠল ৷ এমনকী চোখের জলও যেন জমে উঠতে থাকল ৷ আমরা শীতের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে বড়ই কাবু হয়ে পড়ছিলাম ৷
বাঁশি বেজে উঠল ৷ আমরা এবার সোভিয়েতের সীমানা ছেড়ে চিনের দিকে এগিয়ে চলেছি ৷ গজেন্দ্র গতিতে ঢিলেঢালাভাবে সীমানা পেরোতেই ওই-ওই চিন ওই-ওই ৷ বরফজমা ট্রেনের জানলার কাচে নাক লাগিয়ে, খানিকটা অংশ হাত দিয়ে ঘঁষে নিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেলাম, দূরে ইস্টিশান মাঞ্চুরি ৷ সেখানে চিনের তারা লাগানো লাল পতাকা ৷ পতাকার নিচে অসংখ্য মানুষজন ৷ ছেলে-মেয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে ৷
মাঞ্চুরি ছেড়ে পিকিংয়ের দিকে যাবার পথে প্রতি স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে লোকে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে লাগল-ফুল, পুতুল, উপহার ডাঁই হয়ে উঠল আমাদের কামরায় ৷ ওন-ওন-সি স্টেশনটা মনে পড়ে ৷ ছোট্ট-ছোট্ট বাচ্চারা স্টেশনেই ইয়াকো নাচ নাচছে বিরাট খঞ্জনীর তালে-তালে ৷ অনেক রাতে চাও-ডাং স্টেশনে পৌঁছে দারুণ অবাক হয়ে গেলাম ৷ মাঞ্চুরিয়ার শীত অগ্রাহ্য করে রাতদুপুরে অনেক লোকজন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে ৷
পিকিং পৌঁছবার আগে, এক স্টেশনে, একজন বৃদ্ধা আমার হাত ধরে কেঁদেছিলেন ৷ কেন জানি না, আমারও চোখে জল এসেছিল ৷ আজ সেইসব হাসিকান্না কোন হাঁড়িতে ঢালা আছে তাই ভাবি ৷
সাতদিনের এই লম্বা ভ্রমণের সত্যি বলতে কী, আর জুড়ি নেই ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন