অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
পাতাল-ভুবনেশ্বর গুহায় এখন জেনারেটারে আলোর ব্যবস্থা হয়েছে ৷ অন্ধকারে নিচে নামা বেশ বিপজ্জনক ছিল ৷ আলো দেওয়াতে দর্শনার্থী সমাগম বেড়েছে ৷ নেমে যেতে পারছে ছোট ছেলেমেয়েরাও ৷
গুহার সামনে বসে দেখছিলাম দর্শন সেরে বেরিয়ে আসা যাত্রীদের ৷ ছবি তুলে রাখার মতো মুখের চেহারা একেক জনের ৷ যেন ফিরে আসছেন দ্বিগিজয় করে ৷ নিষ্কৃতি পাওয়ার আনন্দটাও চাপা থাকছে না ৷
খুবই আগ্রহ হচ্ছিল গুহাটা দেখার জন্য ৷ কিন্তু বসে থাকতে হচ্ছিল গাইড নেই বলে ৷ মাত্র একজনই গাইড কাজ করছেন সেদিন ৷ অন্যরা অনুপস্থিত ৷ আর গাইড ছাড়া গুহায় ঢোকার অনুমতি পাওয়া যায় না ৷ তবে ভালোই লাগছিল চাতালের রেলিংয়ের ধারে চেয়ারে বসে থাকতে ৷ গাছের ছায়ায় দুপুরের রোদটাও গায়ে লাগছে না ৷ চারপাশে পাহাড়ের ঢাল জুড়ে দেওদার বন ৷ হাওয়ায় কাঁপছে দেওদারের ঝিরিঝিরি পাতা ৷ লম্বা লম্বা ডাল ছড়িয়ে সোজা দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একেকটা গাছ ৷ পাতার ফাঁকে ফাঁকে গাছের নিচে আলো আঁধারিতে পরিবেশ মোহময় ৷
পাহাড় ঘুরে গুহার কাছে পথ এসেছে শিব আর শক্তির প্রাচীন মন্দিরের সামনে দিয়ে ৷ ৮ কিলোমিটার দূরের গুপ্তরি থেকে কাঁচাপথে গাড়িও চলে আসে আজকাল সেই মন্দির পর্যন্ত ৷ তারপর কংক্রিটের রাস্তায় মিনিটপাঁচেক হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় গুহায় ৷ আগে গুপ্তরি থেকে আসতে হত পাহাড়ি পথে হেঁটে ৷ পুণ্যার্থীরা আসতেন গঙ্গোলিহাটের কালীমন্দির দেখে মহাদেবের এই গুহা দর্শনে ৷
চাতালের এক কোণে বসে ভাণ্ডারীজি যাত্রীদের তদারক করছেন ৷ নাম-ঠিকানা লিখে রাখা হচ্ছে গুহায় ঢোকার আগে ৷ ফিরে এসে প্রণামী দেওয়া নিয়ম তাঁর কাছে ৷ আমাদের গাইড পেতে এত দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইলেন ভাণ্ডারীজি ৷ কথায় কথায় জানাচ্ছিলেন গুহার মাহাত্ম্যের কথা ৷ মানসখণ্ডে বর্ণনা করা হয়েছে, অযোধ্যার সূর্যবংশীয় রাজা ঋতুপর্ণ শিকারে বেরিয়ে বন্যবরাহের পিছনে ধাওয়া করে প্রথম এই গুহায় এসে পৌঁছন ৷ ক্ষেত্রপালের নির্দেশে গুহায় ঢুকলে নাগকন্যারা তাঁকে নিয়ে যায় পাতালরাজ শেষনাগের কাছে ৷ শেষনাগ তাঁকে পাতালগুহা দর্শন করান ৷ তাঁর বরে দিব্যদৃষ্টি পেয়ে ঋতুপর্ণ দর্শন পান পাতাল-ভুবনেশ্বর মহাদেবের ৷
ভাণ্ডারীজির সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেখলাম গুহা দেখে বেরিয়ে আসছে আরেকটা দল ৷ হাতে পায়ে কাদা অথচ দিব্যজ্যোতিতে ঝলমল করছে পরিদর্শকদের মুখ ৷ ফটোগ্রাফারের আদর্শ সাবজেক্ট হয়ে বেরিয়ে আসছেন একেকজন ৷ গাইড পেয়ে যাওয়াতে একটু পরেই আমরাও ফটোগ্রাফারের সাবজেক্ট ৷ যদিও গুহাপথে ছবি তোলা দুষ্কর ৷
যেভাবে নামতে হচ্ছিল, জয়ন্তীর মহাকাল গুহার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল ৷ সেখানেও এরকমই সংকীর্ণ পাথরের ফোকর দিয়ে নিচে যেতে হয় ৷ কিন্তু এত গভীরে নামতে হয় না সেখানে ৷ ঢোকার আগে একজন বলেছিলেন খুব বেশিক্ষণ নিচে যেতে হবে না, পাওয়া যাবে সমতল গহ্বর ৷ তাই মনে মনে তৈরি ছিলাম সেরকমই ৷ আর প্রত্যেক ধাপে অবাক করে দিয়ে আরও লম্বা হতে হতে চলেছিল সুড়ঙ্গপথ ৷ চলেছিল পাতাল লক্ষ করে ৷
কুয়োর সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাবে না সেই গুহাকে ৷ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যেভাবে বাঁক নিয়ে এগিয়েছে গুহাপথ, একটু পরে মনে হল যেন স্বয়ং শেষনাগ দাঁড়িয়ে আছে ফণা তুলে ৷ আমরা বেয়ে নামছি সেই মহাসর্পের মুখ দিয়ে ঢুকে ৷
রাজা ঋতুপর্ণকে নিশ্চয়ই মশাল নিয়ে নামতে হয়েছিল পাতালপুরীতে ৷ এখন টিমটিমে বিজলি আলো জ্বলছে ৷ কিন্তু বড়ই অপ্রতুল সেই আলো ৷ বাল্ব লাগানো হয়েছে যেখানে পারা গেছে ৷ মাথা তুলেই দাঁড়ানো যায় না যেখানে, সেখানে আলো লাগাবে কোথায়! তাছাড়া সামনে পিছনের যাত্রীর আড়ালে পড়ে থেকে থেকেই পথ ঘুটঘুটে অন্ধকার ৷ টর্চ নিয়ে আসা উচিত ছিল ৷ আলো আছে ভেবে টর্চ আনেননি কেউই ৷
আট-দশজনের দলকে নিয়ে চলেছেন গাইড ৷ লাইন করে পরপর নেমে চলেছেন যাত্রীরা ৷ অসমান পিছল পাথর ৷ চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল ঢুকেছে চুনা পাথরের গুহায় ৷ ওপরের পাথর থেকে মাথা বাঁচিয়ে নামতে হচ্ছে প্রায় উবু হয়ে বসে বসে ৷ লোহার শিকল রয়েছে ধরে নামার জন্য ৷ দুপাশ দিয়েই চলেছে শিকল, কিন্তু এমনভাবে মাটিতে লেপটে আছে যে সামনে পিছনের লোকের টানাটানিতে শিকল-ধরা হাত পাথরে ঘষে যাবার ভয় ৷ না ধরেই চলার চেষ্টা করছি, ঋতুপর্ণ যখন এসেছিলেন তখন তো যেতে হয়েছিল শিকল ছাড়াই ৷ পিছনের ভদ্রমহিলা শিকল ধরতে গিয়ে পাথরে ঘষা খেয়ে মৃদু অভিযোগ জানাচ্ছিলেন মাঝে মাঝে, একবার অন্ধকারে ভুল করে পাশের ইলেক্ট্রিক লাইন ধরে ফেলে কঁকিয়ে উঠলেন ৷ চেঁচিয়ে হুঁশিয়ার করলেন পিছনের সঙ্গীদের ৷ অবশ্য হাত পড়লেও ভয়ের কিছু নেই, সেদিক থেকে যথেষ্ট সুরক্ষিত ইলেক্ট্রিক লাইন চলেছে শিকলের পাশে পাশে ৷ পিছনে তাকিয়ে দেখি ভদ্রমহিলা নামছেন পুরোপুরি পাথরে বসে, সুন্দর সালোয়ার কামিজের মায়া ত্যাগ করে জল কাদায় মাখামাখি হয়ে ৷ মুখে আর্তনাদের মতো জয়শঙ্কর ধ্বনি ৷ বারবার অনুরোধ করছেন তাঁকে সাহায্য করতে, আর গাইডের উদ্দেশে চলেছে গালিগালাজ ৷ গণ্ডগোল বুঝে গাইড অপেক্ষা করছিলেন বাঁকের মুখে ৷ ভদ্রমহিলার স্বামীকে নির্দেশ দিলেন সামনে হেঁটে তাঁকে সাহায্য করতে ৷ কিন্তু ভদ্রমহিলা কারও ভরসাতেই আর এক পাও এগোতে চান না ৷ ফিরে যেতে চান সেখান থেকেই ৷ কিন্তু যাবেন কী করে! তাহলে ফিরতে হয় পুরো লাইনটাকেই ৷ ‘আউর থোরাসা’ বলে তাঁকে আশ্বাস দিয়ে দিয়ে নামিয়ে নিয়ে চললেন গাইড ৷
অতল গুহার তল পাওয়া গেল অবশেষে ৷ নেমে আসা গেল একটা পাথরের ঘরের মতো জায়গায় ৷ সেখান থেকে এপাশে ওপাশে আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে সুড়ঙ্গপথ ৷ প্রায় সাত-আটতলা বাড়ির সমান সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে হাঁপ ছাড়লেন যাত্রীরা ৷ গাইডকে ঘিরে দাঁড়ালেন সেই পাতালপুরীর কাহিনী শোনার আগ্রহে ৷
পুরাকালে লোকের ধারণা ছিল না কত গভীর এই পৃথিবী, বললেন গাইড ৷ ঋষিরা ব্যাসদেবের কাছে জানতে চেয়েছিলেন পাতাল কত দূরে, পৃথিবীর শেষ কোথায় ৷ ব্যাস বলেছিলেন, মহাজ্ঞানী বশিষ্টর মতো মুনিরাও সে কথা জানেন না ৷ তাঁরা শুধু ততটাই জানেন যতটা পাতাল-ভুবনেশ্বরে গেলে জানা যায় ৷ যেখানে মহাদেব থাকেন ৷ পুণ্যবলে রাজা ঋতুপর্ণ দেখে এসেছেন সেখানে স্মর, সুমেরু, স্বধম নামে তিন আশ্চর্য গুহা ৷ পাপীরা যেতে পারে না সেখানে ৷ কলিযুগে বন্ধ হয়ে যাবে সেই গুহার বিভিন্ন দিক ৷
ঋতুপর্ণ গুহায় মর্কটমণি জ্যোতি ঘিরে ঋষিদের তপস্যা করতে দেখেছিলেন ৷ মাঝখানে বসে কপিলেশ শিবলিঙ্গের সামনে ধ্যান করছিলেন কপিলমুনি ৷ গহ্বরের নানা জায়গায় ছিল বৈদ্যনাথ শিবলিঙ্গ, গণনাথ শিবলিঙ্গ, সতীশ্বর শিবলিঙ্গ, সৌরেশ্বর শিবলিঙ্গ ৷ আশপাশে ছিল ভয় জাগানো দৈত্য দানবের ভবন ৷ পার হয়ে এসে চন্দ্র, তারা, গন্ধর্বদের দেখা পেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ৷ দেখেছিলেন অনন্তসর্প মাথায় ধারণ করে আছে পৃথিবী ৷ সুড়ঙ্গপথে হেঁটে স্মরগুহায় এসে মহাদেব আর পার্বতীকে পাশা খেলতে দেখেছিলেন ৷ অন্য দেবতারা স্তুতি করছিলেন তাঁদের ৷ দিব্যদৃষ্টি নিয়ে ঋতুপর্ণ গুহাপথে মানস সরোবর, রামেশ্বর, কাশী, উজ্জয়িনী, গঙ্গাসাগরের মতো পুণ্যতীর্থ ভ্রমণ করে এসে সুমেরু গুহায় বাঘছাল পরা জটাধারী শিবকে শয়ন করতে দেখেছিলেন ৷ পাশে বসেছিলেন উগ্রতারাদেবী ৷ স্বধম গুহায় নিয়ে গিয়ে শেষনাগ তাঁকে তেজময় জ্যোতি দেখিয়েছিলেন ৷ সেই জ্যোতি থেকেই সৃষ্টির আদিকালে উৎপন্ন হয়েছেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ৷ গুহাতলে বয়ে চলা পুণ্য উদকস্রোত থেকে জল পান করে ঋতুপর্ণ কেদারযাত্রার পথ ধরে কেদারনাথ দর্শন করেছিলেন ৷
আরও নানা অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিলেন ঋতুপর্ণ গুহার কন্দরে ৷ দেখেছিলেন মুণ্ডহীন গণেশের দেহ, বহুপদ ঐরাবত হাতি, মহাদেবের বিশাল জটা ৷ ব্রহ্মদ্বার গুহায় ছিল কামধেনু ৷ তার দুধ গড়িয়ে এসে নিচে তৈরি হয়েছে শিবকুণ্ড ৷ সেখানে অবগাহন করছিলেন অন্য সব দেবদেবীরা ৷ সেই জল পান করলে মহাদেবের ত্রিশূলাঘাতে মৃত্যু অনিবার্য ৷ রাজা ঋতুপর্ণ মহাদেবের আজ্ঞায় শিবকুণ্ডের জল পান করে অমরলোকে স্থান পাওয়ার যোগ্য হয়েছিলেন ৷
কাহিনী শেষ করে গাইড দর্শনার্থীদের নিয়ে গেলেন গুহার একপাশে ৷ আঙুল দিয়ে দেখালেন, শেষনাগ ৷ একদিকে ঢালু হয়ে নেমেছে গুহার ছাদ ৷ সেদিকে তাকিয়ে দর্শনার্থীরা হতবাক ৷ দেওয়াল বেয়ে ছাদের গায়ে ফণা মেলেছে মহাসর্প ৷ বিষের থলিও রয়েছে, ছাতার মতো ফণার ভেতরে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন গাইড ৷ পাথরের গায়ে আপনা থেকেই তৈরি হয়েছে এই ভাস্কর্য ৷ এখানেই তবে পাতাল অধিপতি শেষনাগের দেখা পেয়েছিলেন রাজা ঋতুপর্ণ!
গাইড নিয়ে চললেন গুহার ভেতরে ৷ যেতে যেতে মাটির দিকে ইশারা করে দেখালেন, শেষনাগের স্কেলিটন ৷ মেঝেতে মসৃণ পাথরের ঢালে দেখা গেল এক প্রকাণ্ড সাপের কঙ্কালের মতো ছাপ ৷ তার ওপরেই পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন কেউ কেউ, গাইডের কথায় চমকে সরে এলেন ৷ অবিকল সাপের শিরদাঁড়ার দুপাশে কাঁটার মতো হাড়ের সারি খোদাই হয়ে রয়েছে ৷ বিস্মিত যাত্রীরা সন্তর্পণে পার হয়ে এলেন জায়গাটাকে ৷
গুহার খাঁজে শিবলিঙ্গের আকারের চার পাথর দেখিয়ে গাইড বলছিলেন সেগুলো চার যুগের প্রতীক ৷ স্থির হয়ে আছে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ৷ বেড়ে উঠছে কলিযুগ ৷ চুনাপাথরের গুহায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে জলের ফোঁটা জমে তৈরি হয় এরকমই নানা আকৃতি, বুঝিয়ে বলছিলেন গাইড ৷ তাদের ছেড়ে এগিয়ে গেলাম গুহার আরও ভেতরে ৷ দল ছেড়ে এলে নির্জন পাতালপুরী আরও রোমাঞ্চকর ৷ চারপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শুধু পাথরের স্রোত ৷ বড় বড় ঢেউয়ের মতো মেঝে আর ছাদ ৷ দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে নানা চিত্র-বিচিত্র প্রতিকৃতি ৷ কল্পনা করা কঠিন নয়, দৈত্য দানব দেবদেবীরা ভিড় করে আছেন চারদিকে ৷ বিজলি আলোয় দেখতে সুবিধা হলেও কমে গেছে রহস্যময়তা ৷ অন্ধকার গুহায় মশাল নিয়ে যখন যেতে হত তখন দেওয়ালের আনাচে-কানাচে মশাল তুলে হঠাৎই পাওয়া যেত আবিষ্কারের চমক ৷ গুহা থেকে গুহায় ঋতুপর্ণ খুঁজে পেয়েছিলেন চমকের পর চমক ৷ পরিচিত জগৎ থেকে বহু বহু দূরে পাতাল গুহার নিচে দেবদেবীর প্রতিকৃতির অলৌকিক আবিষ্কারে রাজা ঋতুপর্ণের দিব্যদৃষ্টির উন্মোচন অস্বাভাবিক নয় ৷
গাইড এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন দলটাকে অন্যদিকে ৷ ফিরে গিয়ে যোগ দিলাম দলে ৷ গণেশদ্বার দিয়ে ঢোকার পথে দেখা গেল মুণ্ডহীন গণেশের মূর্তি ৷ ছাদ থেকে তখনও ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে তার ওপরে ৷ জলে দ্রবীভূত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট জমা হতে হতে বড় হয়ে উঠছে কলেবর ৷ ঠিক গলার মাঝখানেই টপ টপ করে ঝরে পড়ছে জলের ফোঁটা ৷ তৈরি হচ্ছে গণেশের মাথা ৷ তবে হয়তো সময় লেগে যাবে হাজার হাজার বছর ৷ এভাবেই জমে জমে স্ট্যালাগমাইট শিবলিঙ্গ তৈরি হয়ে আছে গুহার নানা জায়গায় ৷ পার হয়ে অন্য গুহার দ্বারপথে দেখা দিল বিশাল শিবের জটা ৷ ছাদ থেকে জল গড়িয়ে আসছে জটা দিয়ে ৷ ভাঁজে ভাঁজে পাথরের কারিকুরি বিস্ময়কর ৷ ভক্তিতে নতজানু যাত্রীদল ৷
ছাদের ওপরে দেওয়ালের খাঁজে সাপের প্রতিকৃতি হয়ে আছে নানা জায়গায় ৷ এক দেওয়ালে দেখা গেল সরু সরু সাপেরা যেন ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে নিচের গর্তে ৷ জন্মেজয়ের যজ্ঞকুণ্ড, বললেন গাইড ৷ পুরাকালে সর্পমেধ যজ্ঞ করেছিলেন রাজা জন্মেজয় ৷ তপস্যাবলে যজ্ঞের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ হারাচ্ছিল সমস্ত পৃথিবীর সর্পকুল ৷ বহুপদ ঐরাবত হাতি দেখারও সৌভাগ্য হল দর্শনার্থীদের ৷ ছাদ থেকে পরপর ঝুলে আছে স্ট্যালাকটাইট সংগঠন ৷ অবিকল পেটের নিচ থেকে হাতির পায়ের মতো দেখাচ্ছে তাদের ৷ পৌরাণিক কাহিনীর একের পর এক আবিষ্কারে যাত্রীরা তখন মন্ত্রমুগ্ধ ৷ গাইড নিয়ে গেলেন আরেক গুহায় ৷ দ্বারপথে সেখানে যেন পাথরের কারুকার্যময় পেলমেট ৷ দেশলাই জ্বালিয়ে আলো ফেললেন গাইড ৷ ফোঁটা ফোঁটা দুধ গড়িয়ে আসছে পেলমেট থেকে ৷ কামধেনুর দুধ, গাইড জানালেন ৷ এটাই রাজা ঋতুপর্ণের দেখা ব্রহ্মদ্বার গুহা ৷ এখানেই শিবকুণ্ডের জল পান করেছিলেন তিনি ৷
‘নৈনিতালে যে সাহেবগুলো বেড়াতে আসে তাদের সবাইকে এখানে পাঠানো উচিত’, রেগে রেগে ফিসফিস করে বললেন এক সহযাত্রী ভদ্রলোক ৷ ‘দেখে যাক সবাই ভারতের পৌরাণিক ঐতিহ্য ৷ দুদিনের কালচার নিয়ে ভারত গর্ব করে না’ ৷ ভদ্রলোকের বাড়ি হলদোয়ানির কাছে ৷ কুমায়ুনের ঐতিহ্য নিয়ে তিনি বিশেষভাবে গর্বিত ৷ অনেক কিছু দেখেছেন তবে পাতাল-ভুবনেশ্বরে প্রথমবার এলেন ৷ এই পুণ্য থেকে এতদিন বঞ্চিত ছিলেন কপালের দোষে ৷ ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় সব সময় ৷ ভজন-পূজন প্রায় হয়েই ওঠে না ৷ প্রণাম করতে আদেশ দিলেন তিনি সহধর্মিনীকে ৷ জোড় হাত কপালে ঠেকালেন সবাই ৷
এদিকে কামধেনুর দুধ স্পর্শ করে আরেক ভদ্রমহিলা অত্যন্ত বিচলিত ৷ হাত দিলে দুধ জল হয়ে যাচ্ছে ৷ কলিযুগের পাপে জল ঝরছে কামধেনুর পয়োধর থেকে ৷ ভয়াতুর যাত্রীরা আর নিচের শিবকুণ্ডের জলে হাত দিলেন না ৷ সেখানে নিমজ্জিত আছেন অন্য সব দেবদেবীরা ৷ বিনা আজ্ঞায় জল ছুঁলে শিবের ত্রিশূলাঘাতের কথা মনে ছিল ৷ এগিয়ে চললেন কপালে হাত ঠেকিয়ে ৷
পিছল পাথরে টাল সামলে সংকীর্ণ ফাটল দিয়ে গাইড নিয়ে এলেন একপ্রান্তের ছোট্ট আরেক গুহায় ৷ সেখানে রয়েছে পাতাল ভুবনেশ্বর শিবলিঙ্গ ৷ গাইডের নির্দেশে শিবকে ঘিরে বসলেন যাত্রীরা ৷ প্রার্থনা করলেন মনস্কামনা পূরণের আশায় ৷ সামান্য দক্ষিণা রেখে ফিরে চললেন সবাই নিঃশব্দে ৷
গাইড বলছিলেন, আরও অনেক বড় ছিল এই গুহা ৷ যাওয়া যেত বহুদূর ৷ কলিযুগে সত্যিই বন্ধ হয়ে গেছে তার নানা পথ ৷ তবু এখনও যোগ আছে গঙ্গোলিহাটের মহাকালী মন্দিরের কাছের পাতালগঙ্গার সঙ্গে ৷ এরকমই প্রাকৃতিক গুহা আছে সেখানেও ৷ ফেরার পথে একটা গর্ত দেখালেন গাইড, যেখান দিয়ে ঢোকা যেতে পারে আরও ভেতরে ৷ মাটির কাছাকাছি ছোট্ট সেই সুড়ঙ্গে ঢুকতে হবে শুয়ে পড়ে ৷ যাত্রীরা আর উৎসাহী নন ৷ আলোও নেই সেদিকে ৷ যা দেখা গেছে তাই যথেষ্ট ৷ ধাপ বেয়ে ওপরে উঠে চললেন সবাই ৷
পিছল গুহায় নামার চেয়ে উঠে আসা কম কষ্টকর ৷ বেরিয়ে আসার তাগিদে শিকল ধরে ধরে দলটা ওপরে উঠে এল চটপট ৷ দিনের আলো কত আনন্দের তা বোঝা যায় এরকম একটা গুহার বাইরে এলে ৷ ফোকর দিয়ে বেরিয়ে এসে সামনের বারান্দা, পাহাড়, দেওদারের জঙ্গল, ভাণ্ডারীজির হাসি আরও মনোরম ৷
দর্শনী দিতে হবে বাক্সে ৷ জমা রেখে যাওয়া ব্যাগ জুতো নিতে হবে ৷ গাইডকেও দিতে হবে দক্ষিণা ৷ কোনও বাধ্যবাধকতা নেই ৷ পাঁচ-দশ টাকা যা অভিরুচি দিয়ে চলে যাচ্ছেন অনেকে ৷ অন্তত জেনারেটার চালানোর তেলের খরচটাও যে উঠছে না, তাতেও আপত্তি করছেন না মন্দির কমিটি ৷ হাত পায়ের কাদা ধুতে হবে ৷ পাশের কলের কাছে গামছা-সাবান নিয়ে অপেক্ষা করছেন একজন ৷ ভালো করে সাবান ঘষে কাদা ধুয়ে আলাদা গামছায় পা হাত মুছে তাঁকে দিচ্ছে সবাই দক্ষিণা ৷ না দিলেও কিছু না, তিনি শুধু দাঁড়িয়ে আছেন হাত জোড় করে ৷ বিকেলের আলোয় পাহাড়ের দেওদার বন অসাধারণ ৷ তার ওপর ব্যবস্থাপকদের আচরণে, দিনের বেলাতেই চারপাশে গঞ্জিকা সেবনে ঢুলু ঢুলু ব্যক্তিত্ব দর্শনে যাত্রীরা অভিভূত ৷ ফিরে যাচ্ছেন সবাই খুশি খুশি মনে ৷ যাওয়ার পথে ঘুরে যাচ্ছেন চন্দ্ররাজাদের তৈরি শিব আর শক্তির প্রাচীন মন্দির থেকে ৷ সামনের ঝুপড়ি দোকানে খেয়ে যাচ্ছেন চা আর ঘুগনি ৷
ফিরতে হবে সবাইকে গুপ্তরি হয়েই ৷ কাছাকাছি থাকার হোটেল আছে গুপ্তরি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরের গঙ্গোলিহাটে ৷ সেখানে জাগ্রত মহাকালী মন্দিরে পুজো দিতে আসেন দূর দূর থেকে পুণ্যার্থীরা ৷ জনশ্রুতি, আগে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল সেই মন্দিরে ৷ মন্দির থেকে ধ্বনি শোনা যেত, দেবী ডাকছেন কীর্তি বাগেশ্বর মহাদেবকে ৷ সেই ডাক যে শুনতে পেত অনিবার্য ছিল তার মৃত্যু ৷ দেবীর রক্তরোষে দূরে পালাচ্ছিলেন আশপাশের গ্রামের মানুষেরা ৷ জনশূন্য হয়ে পড়েছিল সরযূ আর রামগঙ্গা নদী ঘেরা প্রাচীন গঙ্গাবলী পরগনা ৷ আদি শঙ্করাচার্য স্বয়ং এসে তপস্যা করে নিবারণ করেন দেবীর নররক্ত পিপাসা ৷ আবার শ্রী ফিরে পায় গঙ্গোলিহাট ৷ পাতাল-ভুবনেশ্বর আর গঙ্গোলিহাট ঘুরে যাওয়া যায় আলমোড়া কিংবা পিথোরাগড় থেকেও ৷ ১,২০০ থেকে ১,৫০০ টাকায় জিপ রাজি হয়ে যায় দিনে দিনে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৷ বাসে আসতে চাইলে রাতে থাকতেই হবে কাছাকাছি কোথাও ৷ সাধারণ হোটেল আছে গুপ্তরির ১৯ কিলোমিটার উত্তরে বেরিনাগ শহরেও ৷ সেখান থেকে হিমালয়ের তুষার শিখরের দৃশ্যও অসাধারণ ৷ শহরের দেড় কিলোমিটার ওপরে আছে নাগনাথের প্রাচীন মন্দির ৷ মন্দিরের কাছ থেকে আরও সুন্দর দেখায় তুষার হিমালয় আর তার নিচে পাহাড়ের ঢালে বেরিনাগ শহরের দৃশ্য ৷ তবে বেরিনাগের হোটেল খুব পছন্দসই হবে না ৷ থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা বেরিনাগ থেকে আরও ১০ কিলোমিটার দূরের চৌকরি ৷ সুন্দর পরিবেশে ট্যুরিস্ট বাংলো আছে সেখানে ৷ ইংরেজ আমলে চা-বাগানের জন্য বিখ্যাত হয়েছিল বেরিনাগ-চৌকরি অঞ্চল ৷ এখন চৌকরি কুমায়ুনের পর্যটন মানচিত্রে এক নতুন আকর্ষণ ৷ সবুজ পাহাড়ের ঢালে নির্জন চৌকরির ট্যুরিস্ট লজ থেকে শরতের নীল আকাশে ঝকঝকে রুপোলি হিমালয় মনে হয় যেন ছুটে গিয়ে ছোঁয়া যাবে ৷ আলমোড়া থেকে বাগেশ্বর হয়ে বাস ছাড়াও শেয়ারের জিপ আসছে চৌকরিতে ঘণ্টাছয়েকে ৷ চৌকরি থেকেও বাসে বা শেয়ারের জিপে বেরিনাগ হয়ে চলে আসা যায় ২৯ কিলোমিটার দূরের গুপ্তরিতে ৷ গুপ্তরি থেকে পাতাল-ভুবনেশ্বর গ্রামে যাওয়ার শেয়ার জিপ পাওয়া যায় ৷ তবে শেয়ার জিপে এলে মন্দিরে পৌঁছতে হাঁটতে হবে কিলোমিটার দুয়েক ৷ পুরো জিপ ভাড়া করে এলে চলে যাওয়া যায় মন্দির পর্যন্তই ৷ খাওয়া-দাওয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই পাতাল-ভুবনেশ্বরে ৷ পিকনিকের মেজাজে দিনটা সেখানে কাটাতে চাইলে সঙ্গে খাবার-দাবার নিয়ে আসতে হবে ৷ গুহা আছে কুমায়ুন পাহাড়ের নানা জায়গাতেই ৷ কিন্তু পাতাল-ভুবনেশ্বরের সঙ্গে তুলনা চলে না অন্য কোনও গুহার ৷ এখনও তীর্থযাত্রীদের কাছেই বেশি পরিচিত এই জায়গা ৷ নৈনিতাল-আলমোড়ায় বাইরে থেকে যত লোক বেড়াতে আসেন তার একভাগও এসে পৌঁছন না পাতাল-ভুবনেশ্বরে ৷ তবে নির্জনতার টানে যাঁরা চৌকরিতে আসেন তাঁরা সবাই ঘুরে যান এদিক থেকে ৷ চৌকরির বরফচুড়োর কাছে আয়েশী বাংলোতে একরাত কাটিয়ে পাতালগুহা দেখে যাওয়ার স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে থাকে কুমায়ুন ভ্রমণে ৷
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন