অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
হয়তো স্বপ্ন, হয়তো স্মৃতি ৷ কিন্তু এ হল সত্যি ভ্রমণ-কথা ৷ আজকের কথা নয়গো ৷ ষাট-বাষট্টি বছর আগে থেকেই শুরু করি ৷ ১৯৩৮-এর শেষে বাবা যদিবা কলকাতায় বদলি হয়ে এলেন, তখনও আমরা কলকাতায় দুর্গাপুজো কখনও দেখিনি ৷ কারণটা কি, বলতে পারো?
পুজো মানেই তো দেশের বাড়ির পুজো ৷ আমার বাবার এমন ভাগ্যি, যে মামাবাড়িও আমাদেরই গ্রামে ৷ এই যে ভ্রমণের কথা লিখছি, তার কারণ আছে ৷
তখন জীবনের ছন্দ ছিল অন্য রকম ৷ আজকালকার দিন নয় যে ঝপাঝপ ব্যাগ কাঁধে ঝোলালাম, আর ট্রেনে-প্লেনে-বাসে চেপে রওনা দিলাম ৷ কিংবা প্যাকেজ ট্যুরে ঘুরে এলাম ভারতের যে-কোনও প্রান্ত থেকে ৷ রবিবার ফিরলাম, সোমবার অফিসে দৌড়লাম ৷ এখন দূরত্ব কমে গেছে, বৈচিত্র্যের রোমাঞ্চ হয়তো তেমন নেই ৷
তখন বাঙালি বেড়াতে হলে হাজারিবাগ, রাঁচি, দেওঘর, মধুপুর যেত ৷ তীর্থ করতে হলে তীর্থস্থানে যেত ৷ দিল্লি-আগ্রা-এলাহাবাদ? সে ছিল পশ্চিমে যাওয়া ৷
অথচ ট্রেন-স্টিমার যাত্রা ছিল নিরাপদ ৷ ট্রেনে ছিল প্রথম শ্রেণী (সঙ্গে ভৃত্যদের কামরা), দ্বিতীয় শ্রেণী, ইন্টার ক্লাস এবং থার্ড ক্লাস ৷ সব রকম আর্থিক অবস্থার লোকই যেতে পারত ৷ প্ল্যাটফর্মে হিন্দু চা, মুসলমান চা বিক্রি হত ৷ এ নিয়ে কোনও দাঙ্গা ছিল না ৷ পানি পাঁড়েরা তৃষ্ণার্ত যাত্রীদের জল দিয়ে যেত ৷ জীবনে নিরাপত্তা ছিল ৷
ধীর, মন্থর গতিতে চলতাম ৷ পুজোর সময়ে দেশের বাড়ি যাব, সে তো জানা কথা ৷ তখন কি কি সঙ্গে যেতই যেত, তা বলি ৷ জামাকাপড় বোঝাই হত বড় বড় লোহার ট্রাঙ্কে, তাতে তালা ঝুলত ৷ বিছানা বাঁধা হত বড় বড় হোলডল-এ ৷ লেপ, তোশক, চাদর, মশারি, বালিশ সব ঠেসে সেটি গোল করে গুটিয়ে চামড়ার স্ট্র্যাপে বাঁধা হত ৷ একটি ছোট হোলডলে বাচ্চাদের বিছানা যেত, ট্রেনে তো শোবে! সঙ্গে কুঁজো আর গ্লাস ৷ টিফিন ক্যারিয়ার বোঝাই খাবার ৷ এগুলো থাকবেই ৷ আর থাকত তালপাতার হাতপাখা, মায়ের পানের ডিবে ইত্যাদি ৷
কলকাতা থেকে যাব নতুন ভারেঙ্গা গ্রামে ৷ গ্রামটি ঢাকা-পাবনার সীমান্তে ৷ সন্ধ্যারাতে তিন-চারটে ঘোড়ার গাড়ি চেপে শিয়ালদা স্টেশন ৷ তারপর চাপো ঢাকা মেলে ৷ সারারাত ট্রেনে কাটল ৷ ভোরে নামলাম গোয়ালন্দ স্টেশনে ৷ তারপর গিয়ে উঠলাম স্টিমারে ৷ স্টিমারে ফার্স্ট ক্লাস, যেন আশ্চর্য ভালো ৷ তাছাড়া ফার্স্ট বা সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রীরা চাইলে শতরঞ্চি পেতে খোলা ডেকে বসতে পারত ৷ ওপরটা ঝকঝকে পরিষ্কার ৷ একতলাটি থার্ড ক্লাস যাত্রীতে বোঝাই ৷ ডেকে বসে বা দাঁড়িয়ে আমরা পদ্মা নদীর বুক দিয়ে চলতাম ৷ পাবনা জেলার দিকের অংশে নদীর নাম যমুনা ৷
মাঝে মাঝে স্টিমার স্টেশন আসত ৷ একটা ছাউনি দেওয়া কাঠের শক্ত পাটাতন বেয়ে মানুষ পাড়ে উঠত ৷ আর হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে বাঁশের ওপর খাঁচা বসিয়ে মানুষ পাতক্ষীর ও রসগোল্লা বেচত ৷ কলাপাতায় ঢালা সুমিষ্ট ঘন ক্ষীর, গড়িয়ে পড়ে যেত না ৷ পাতক্ষীর আর রসগোল্লা দিয়ে প্রাতরাশ সারা, সে যে কি স্বর্গীয় ব্যাপার, কি বলি!
নদীই কি কম রহস্যময় ছিল? বর্ষায় নদীর বুক এত চওড়া যে ওপার দেখা যায় না ৷ এ পারেই দেখতাম ঝপাস ঝপাস করে জমি, কুটির, খেত ভেঙে পড়ছে জলে ৷ নগরবাড়ি, আর্চিয়া, নটাখোলা, তারানগর, এমনই সব স্টিমার স্টেশনের নাম ৷
একবার ভারত বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়, স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে ডেকে সহযাত্রী ছিলেন ৷ আর্চিয়া নেমে নৌকাপথে দেশে যাবেন ৷
তারানগর-দেওয়ানজি বাড়ি ভেঙে ভেঙে নদীতে পড়তে দেখেছি ৷ মায়ের মাতামহ, যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী কোচবিহারে জজ-দেওয়ান ছিলেন ৷ ইনিই পৈতৃক গ্রাম তারানগরে বিশাল একতলা ইটের বাংলোবাড়ি করেন ৷ পদ্মাপাড়ে অতি বড় ধনীও ইটের বাড়ি করত না ৷ মাটির বাড়ি, টিনের চালা ৷ ভাঙনের লক্ষণ দেখা দিলেই দরজা-জানলা-টিনের চালা কেটে নিয়ে গরু-বাছুর-পরিবার, সব নিয়ে মানুষ নদী থেকে অনেক ভেতরে গিয়ে নতুন গ্রাম গড়ে তুলত ৷
যেমন আমাদের গ্রাম নতুন ভারেঙ্গা ৷ কবে ছিল দৌলতপুর-ভারেঙ্গা, কবে ছিল ধুলজানা-ভারেঙ্গা, তারপর পুরনো ভারেঙ্গা যা ১৯১৫ সালে নদীগর্ভে চলে যায় ৷ তারপর আমার চেনা নতুন ভারেঙ্গা ৷ নতুন ভারেঙ্গা স্টিমার স্টেশনে নামতাম ৷ তারপর সোনাপদ্মার খালে নৌকায় চাপতাম ৷ অনেকটা পথ দিয়ে তবে গ্রামে পৌঁছতাম ৷ বারো থেকে ষোলো ঘণ্টা তো লাগত ৷
আর আমার মেজোমামা, বাংলাদেশ হবার পরে ঢাকা গেলেন ৷ ফিরে এসে বললেন, খানিক স্টিমার, বাকিটা চমৎকার রাস্তা, গাড়িতে গেলাম ৷ ঢাকায় ব্রেকফাস্ট খেলাম ৷ নতুন ভারেঙ্গা দেখে এসে স্টিমারে লাঞ্চ খেলাম ৷
অর্থাৎ, এখন পথঘাট-যোগাযোগ-পরিবহন, সব কিছুতে দ্রুতগতির যুগ ৷
না, দীর্ঘ সময় ধরে পথ চলার দুলকি চাল আর নেই ৷ না থাকারই কথা ৷ তবু যখন ভাবি, কতটা সময় ধরে পথ চলার আনন্দ উপভোগ করতে করতে যেতাম, সেও তো চমৎকার ছিল ৷
তবে তেমন ধীরছন্দে নতুন ভারেঙ্গা যেতে হলে স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায়, তাই না?
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন