অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
সারারাত অবিশ্রান্ত বৃষ্টির পর মেঘলা সকাল হল ধারাখড়কে, উচ্চতা ১৫,০০০ ফুট ৷ স্লিপিং ব্যাগ গুটোতে না গুটোতেই গরম কালো কফির মগ হাতে তাঁবুতে ঢোকে বলবীর ৷ গতকালই আমরা পেরিয়ে এসেছি ভুইন্দার গিরিপথ, যার উচ্চতা ১৬,৭০০ ফুট ৷ অমৃতগঙ্গা উপত্যকার গামসালি গ্রাম থেকে চলা শুরু করে, তৃতীয়দিনে গিরিপথ পেরিয়ে, গতকাল পৌঁছে গেছি ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স-এর এই অন্তিম প্রান্তে ৷ ঠিক এমন করেই ১৯৩১-এর ৯ জুলাই ফ্র্যাঙ্ক স্মাইথের কামেট বিজয়ী দল প্রবেশ করেছিল এই অপূর্ব উপত্যকায় ৷ ফুলের উপত্যকার স্বর্গীয় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে স্মাইথ সাহেব নাম দিয়েছিলেন ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স ৷ ভিজে তাঁবু গুটিয়ে হাঁটা শুরু হল ৷ টিপরা হিমবাহের বিপজ্জনক মোরেনের রাজত্ব শেষ করে এক সময় আমরা পৌঁছলাম সবুজ ভুইন্দার উপত্যকার কোলে ৷ অভিযানের দ্বিতীয় পর্বে আমাদের লক্ষ্য স্কাই পিক ৷
১৯৭৮ সালে স্যার এডমন্ড হিলারির নেতৃত্বে ভারত-নিউজিল্যান্ডের যৌথ উদ্যোগে সংগঠিত অভিযানের নাম ছিল ‘সাগর থেকে আকাশ’ (OCEAN TO SKY)/ হলদিয়া থেকে জেটবোটে যাত্রা শুরু করে গঙ্গানদীর উৎস পর্যন্ত যাওয়াই ছিল সেই অভিযানের প্রথম পর্ব ৷ নদীপথে অভিযানের এই পর্বটি বাধা পায় কর্ণপ্রয়াগের কিছু পরে অলকানন্দার নদীপ্রপাতে ৷ তখন অভিযাত্রীদল নৌকা ছেড়ে গাড়িতে করে প্রথমে আসেন গোবিন্দঘাট ৷ সেখান থেকে হাঁটাপথে পবিত্র তীর্থ হেমকুণ্ড এবং ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স দেখে আবার চলে আসেন বদ্রীনাথ ৷ এখানে হিলারির লক্ষ্য ছিল নীলকণ্ঠ শৃঙ্গের (৬,৫৯৫ মিটার) উত্তর-পূর্ব গিরিশিরার পড়শী নারায়ণ শৃঙ্গ আরোহণ ৷ কিন্তু নারায়ণ পর্বতে উঠতে তাঁরা ব্যর্থ হন ৷ এবার হিলারির চোখ পড়ে নারায়ণ পর্বতের ঠিক উল্টোদিকের নরপর্বতে ৷ নরপর্বত আরোহণ করতেও তাঁরা ব্যর্থ হন ৷ ইতিমধ্যে স্যার হিলারি আক্রান্ত হন পালমোনারি ইডিমায় ৷ হেলিকপ্টারের সাহায্যে তাঁকে উদ্ধার করে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বেরিলির সামরিক হাসপাতালে ৷ ২৭ অক্টোবর, ১৯৭৮ পিটার হিলারি, গ্রেম ডিংগল এবং মারে জোনস আরোহণ করেন ১৯,২০০ ফুট উচ্চতার একটি অনামা শৃঙ্গে ৷ সুদূর গঙ্গাসাগর থেকে জেটবোটে বয়ে আনা গঙ্গাজল ঢেলে দেন সেই শৃঙ্গের শীর্ষে ৷ যেহেতু তাঁদের ঐতিহাসিক অভিযানের নাম ছিল সাগর থেকে আকাশ-তাই অনামা শিখরটির নামকরণ হয় স্কাই ৷
৪ জুন, ২০০১ ৷ বলবীর বুরকেল এবং আমি পৌঁছলাম বদ্রীনাথ ৷ বদ্রীনাথের উচ্চতা প্রায় ১০,২০০ ফুট ৷ পূর্ব পরিকল্পনামাফিক, দেখা হয়ে গেল অভিযানের বাকি চার সদস্যের সঙ্গে ৷ কলকাতা থেকে ৩১ মে যাত্রা শুরু করে ওরা গতকালই পৌঁছে গেছে এখানে ৷ বদ্রীনাথের বিশাল উপত্যকা, অলকানন্দার গর্জন আর নীলকণ্ঠের অপার্থিব ঝলক দর্শনে সময় কেটে গেল ৷ পরদিনটি পূর্ব পরিকল্পনামাফিক ছিল সমীক্ষা বা রেকি-র দিন ৷ দলের বয়োজ্যেষ্ঠ আকাশদা, বলবীর, আব্বাস এবং আমি বেরোলাম মানচিত্র, কম্পাস এবং দূরবীন যন্ত্রে সজ্জিত হয়ে ৷ দিগন্ত এবং সুব্রত ব্যস্ত হয়ে পড়ল শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় ৷
মানচিত্র অনুযায়ী, বদ্রীনাথ শহরের ঠিক পূর্বদিকের খাড়া পাহাড়টার মাথা টপকাতে পারলেই পাওয়া যাবে কুবের হিমবাহ ৷ তবুও নিশ্চিত হবার জন্য অনেকটা সময় কাটানো হল মানাগ্রামের মানুষজন এবং ভেড়াওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে ৷ হিমালয়ের দুর্গম পথের হদিশ থাকে ভেড়াওয়ালাদের কাছেই ৷
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল বদ্রীনাথের ঠিক পূর্বদিকের পাহাড়টার ঘাসের ঢাল বেয়ে ওঠা হবে ৷ খোঁজা হবে কুবের হিমবাহে যাবার পথ ৷ মানাগ্রামের বয়স্করা বলেন, কুবের ভাণ্ডার ৷ মার্চা পিতামহেরা বলেন, কুবেরের বিপুল ধনরাশি নাকি ওখানে আছে ৷ ওপথে গেলে কেউ ফেরত আসে না ৷ কিন্তু কুবেরের ধনসম্পদ নয়, আমাদের লক্ষ্য ছিল তার প্রকৃত সম্পদ নরপর্বত এবং স্কাই শৃঙ্গ ৷
অলকানন্দা উপত্যকার সমস্ত হিমবাহের ওপর একটি ভূতাত্বিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ‘মাউন্টেনিয়ার্স ইউথ রিং’ জার্নালের তৃতীয় সংখ্যায় ৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনোতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই রিপোর্ট থেকেই জানা ছিল কুবেরের অবস্থান ৩০০৪র্৫ অক্ষাংশ এবং ৭৯০৩র্১ দ্রাঘিমাংশে ৷ মূল কুবেরের হিমবাহের দৈর্ঘ্য মাত্র তিন কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ সাতশো মিটার ৷ হিমবাহটির মুখ অর্থাৎ স্নাউটের উচ্চতা ৪,০০৮ মিটার, অর্থাৎ, তেরো হাজার ফুট ৷ সেই রিপোর্টে আরও বলা ছিল, অসংখ্য চোরা ফাটল বা ক্রিভাসে ঢাকা এই হিমবাহের ঢাল অত্যন্ত খাড়াই এবং হিমবাহ পথে উচ্চতর শৃঙ্গে আরোহণ হবে খুবই দুরূহ ৷
এইভাবেই একটি ভূতাত্বিক রিপোর্ট, কয়েকজন ভেড়াওয়ালার মতামত এবং একটি কনট্যুর মানচিত্রের ফটোকপির ভিত্তিতে আমরা অভিযান শুরু করলাম ৷
৬ জুন, ২০০১ ৷ বদ্রীনাথের বাজারে আলুর পরোটা খেয়ে আমাদের ট্রেক শুরু হল ৷ মানাগ্রাম যাবার চওড়া পিচের রাস্তা ছেড়ে আমাদের দল উঠতে শুরু করল ঘাসে ঢাকা খাড়া ঢাল বেয়ে ৷ ইন্দো-টিবেট সীমান্ত পুলিশের একদল জওয়ান প্যারেডের ফাঁকে অবাক হয়ে দেখতে লাগল আমাদের ৷ পথ বলতে কিছুই নেই ৷ দুহাতে ঘাসের গোছা ধরে, ঘাসের গোড়ায় পা রেখে উঠে চলা ৷ পথ এতটাই খাড়াই যে দুদণ্ড বসে হাঁফ ছাড়াও যায় না ৷ ঘাসের ঢালের মাঝে বিপদের মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে এবড়ো-খেবড়ো পাথরের দেওয়াল ৷ সেই বিপজ্জনক আলগা পাথুরে এলাকার পরই কিছুটা সমতল ৷ একে একে সবাই পৌঁছে যাই সেই আপাত সমতল ঘাসের জমিতে ৷ ভেড়াওয়ালাদের তৈরি ছোট্ট মন্দির ৷ হাজার ফুটেরও বেশি নিচে দেখি অলকানন্দার রুপোলি স্রোত আর তার পাশে বদ্রীনাথ যেন এক খেলনা শহর ৷
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার উঠে চলা ৷ একের পর এক বিপজ্জনক ঘাসের ঢাল ৷ পাঁচ ঘণ্টা চড়াইয়ের সঙ্গে দারুণ লড়াইয়ের পর আমরা পৌঁছলাম ভেড়াওয়ালাদের রাত কাটাবার এক স্থানে ৷ গাড়োয়ালে এই ধরনের আস্তানাকে বলা হয় খড়ক ৷ এই অদ্ভুত সুন্দর, সবুজ খড়কে বসল আমাদের প্রথম শিবির বা অন্তর্বর্তী শিবির ৷ উচ্চতা ১৩,০০০ ফুট ৷ বদ্রীনাথ থেকে আমাদের দলে যোগ দিয়েছে তিনজন মালবাহক-রমেশ, সুখদীপ এবং অশোক ৷ ওরা যাবে মূল শিবির পর্যন্ত ৷ চারদিকে রুক্ষ, হলুদ ঘাসের ঢালের মধ্যে একচিলতে সবুজ সমতল ৷ তাতেই পড়েছে আমাদের তিনটি তাঁবু ৷ দলের ওষুধের ভাণ্ডার দিগন্তর কাছে ৷ বলবীর তার নাম দিয়ে ফেলেছে ‘ডাক্তার সাব’ ৷ তাকে ঘিরে মালবাহকদের ‘শিরদর্দের গোলি’ নেওয়ার জটলা ৷ রান্নাঘরের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে আকাশদা ৷ আকাশদার হাতে হাতে নানা কাজের জোগানে ব্যস্ত সুব্রত ৷ বলবীর এবং আমি বেরোলাম আগামীকালের সম্ভাব্য পথ খুঁজতে ৷
পাহাড় টপকে সূর্যের আলোর আমাদের শিবিরে পৌঁছনোর অনেক আগেই হাঁটা শুরু ৷ যতই ওপরে উঠছি ঘাস কমে আসছে ৷ এখন কেবলই পাথর আর পাথর ৷ মাঝে মাঝে পেরোতে হচ্ছে ঝরনা ৷ এই জলধারাগুলি সবই আসছে কুবের হিমবাহ থেকে ৷ এক জায়গায় থমকে দাঁড়াতেই হয় ৷ ঝরনার ওপর জমে আছে বিশাল বরফের ঢাল ৷ সময় নষ্ট না করে শুরু হয়ে গেল বরফের গায়ে আইস অ্যাক্সের সাহায্যে ধাপ কাটা ৷ এই ঢালে উঠতে হবে প্রায় ত্রিশ ফুট ৷ তারপর আড়াআড়িভাবে ট্রাভার্স করে পৌঁছনো যাবে বরফহীন গিরিশিরায় ৷
বরফের ঢালের সেই খাড়া অংশে বরফকুঠার গেঁথে দড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হল ৷ বিপজ্জনক সেই ঢালে সাবলীলভাবে উঠে এল সাতান্ন বছরের আকাশদা ৷ এরপর আরও ঘণ্টাদুয়েক পথ চলার পর দেখা পাওয়া গেল কুবের হিমবাহের হিমপ্রপাতের ৷ একটা বিশাল জলপ্রপাত যেন বিধাতার অঙ্গুলীহেলনে তুষারীভূত হয়েছে ৷ হিমপ্রপাতের দক্ষিণ-পশ্চিমে, নিরাপদ দূরত্বে মূল শিবির স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ৷ আব্বাস এবং দিগন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ল তুষার আরোহণের সাজসরঞ্জামগুলোর শেষমুহূর্তের পরীক্ষা নিরীক্ষায় ৷ মানচিত্র এবং কম্পাসের সাহায্যে আমি বুঝে নিতে চাইলাম নিজেদের অবস্থান ৷ ঈগলের চোখে যেন দেখতে পেলাম তিব্বত সীমান্তের মানা গিরিপথের দিক থেকে আসা সরস্বতী নদীর উপত্যকা আর অলকানন্দার হঠাৎ বাঁক নেওয়া ভগীরথ খড়ক হিমবাহের দিকে ৷ তার পাশেই ভগ্নু হিমবাহের অনামা শিখরগুলি ৷ তার ঠিক পশ্চিমেই ধ্যানমগ্ন নীলকণ্ঠ ৷ উর্বশী আর নারায়ণ যেন তার আজানুলম্বিত দুই বাহু ৷ আমাদের সম্মোহিত চোখে নীলকণ্ঠ তখন যেন দেবাদিদেব স্বয়ং ৷ অস্তগামী সূর্য তার সিঁদুররং নীলকণ্ঠে মাখিয়ে বিদায় নিল ৷ উত্তরে সরস্বতী উপত্যকার দিক থেকে দমকা হিমেল হাওয়া আমাদের ঠেলে ঢুকিয়ে দিল তাঁবুতে ৷ এখানকার উচ্চতা ১৫,৫০০ ফুট ৷
পরদিন, বলবীর, আব্বাস এবং আমি রওনা হলাম বেসক্যাম্প পিছনে ফেলে ৷ আজ থেকে আমাদের পায়ে সর্বক্ষণের জন্য ক্লাইম্বিং বুট-কোফলা ৷ বরফের দেওয়াল আর মাঝে মাঝেই পাথরের দেওয়াল ৷ পর্বতারোহণের পরিভাষায় রক ব্যান্ড ৷ ষোল হাজার ফুট উচ্চতায় চলল শৈলারোহণ ৷ হাতের আইস অ্যাক্স সেখানে বোঝা ৷ চারটি রক ব্যান্ড পার হয়ে মুখোমুখি হলাম একটি খাড়া বরফের দেওয়ালের ৷ বুটের তলায় লাগানো হল ক্র্যাম্পন ৷ শুরু হল এক রোমাঞ্চকর তুষার আরোহণ ৷ হিমপ্রপাতের বিশাল চোরা ফাটলগুলোকে বাঁদিকে রেখে আমরা সোজা উঠতে লাগলাম ওপরের তুষারক্ষেত্রের লক্ষ্যে ৷
ঘণ্টাচারেক দুরূহ আরোহণের পর চড়াইয়ের মাত্রা কমতে শুরু করল ৷ ক্রমেই পৌঁছে গেলাম কুবের হিমবাহের বিশাল তুষার ময়দানের পশ্চিম কোণে ৷ সেদিনের মতো যাত্রার শেষ ৷ কিন্তু বিশ্রাম নয় ৷ আইস অ্যাক্সের সাহায্যে বরফের ঢাল কেটে তৈরি করা হল একফালি সমতল জমি ৷ তার ওপরই লাগল আমাদের ছোট্ট নীল তাঁবু ৷ বেলা বারোটার মধ্যেই আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেল ৷ সারা বিকেল, সারা রাত তুষারপাত চলল ঝিরঝির করে ৷ এখানকার উচ্চতা ১৭,৫০০ ফুট ৷
পরদিন সকালে বরফ পড়া থেমে গেছে ৷ কিন্তু ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারদিক ৷ আমরা ঠিক কোথায় আছি এবং কোন দিকে যাব তা বোঝার উপায় নেই ৷ তা সত্বেও আমরা আরোহণ শুরু করি ৷ মানচিত্র অনুযায়ী যেতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ৷ সেই আন্দাজেই আমাদের উঠে চলা ৷ একে একে পেরিয়ে আসি তিনটি হাম্প, প্রায় সাতশো ফুট ৷ কিন্তু কুয়াশা কমার লক্ষণ নেই ৷ শেষে দশ ফুট দূরের বস্তুও দেখা যায় না ৷ বিপজ্জনক তুষার প্রান্তরে পদে পদে থাকতে পারে মরণ ফাটল ৷ তাই অন্ধের মতো মৃত্যুর পথে না এগিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অপেক্ষা করার ৷ একঘণ্টা বসে থাকি সেই তুষার প্রান্তরে, কুয়াশা ফিকে হবার আশায় ৷ কুয়াশা আরও গাঢ় হয় ৷ হতাশ হয়ে ধরি ক্যাম্পে ফেরার পথ ৷ উঠে আসার সময় রেখে আসা পায়ের চিহ্নই আমাদের পথ দেখায় ৷ সারা সকাল আর দুপুর কাটে হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ৷ বিকেল সাড়ে তিনটেয় পূর্ব আকাশে দেখা দেয় নীল দিগন্ত ৷ সঙ্গে সঙ্গে বলবীর এবং আমি বেরিয়ে পড়ি সমীক্ষায় ৷ কতক্ষণ আবহাওয়া অনুকূল থাকবে জানা নেই ৷ তাই পথ চলি যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে ৷ তিনটি বরফের কুঁজ পেরোতেই দেখি পৌঁছে গেছি কুবের হিমবাহের সেই তুষার মালভূমিতে ৷ আমাদের ঠিক পূর্বদিকে নরপর্বত (১৯,৩০০ ফুট) এবং তারই দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরায় স্কাই শৃঙ্গ (১৯,২০০ ফুট) ৷ যার ছবিই শুধু দেখেছি এতদিন ৷
১০ জুন, ক্র্যাম্পনের শরশয্যায় ক্লাইম্বিং বুট চড়িয়ে ধীর স্থির ছন্দে এগিয়ে চলেছি আমরা তিনটি প্রাণী ৷ প্রতিটি পদক্ষেপই মাপা, যন্ত্রবৎ ৷ ক্ষুরধার গিরিশিরার কার্নিশ ভাঙলেই ডানাভাঙা পাখির মতো আছড়ে পড়ব নয় হাজার ফুট নিচে বদ্রীনাথ উপত্যকায় ৷ তাই একটু বাঁদিক ঘেঁসে প্রায় ষাট ডিগ্রি খাড়াই বরফের ঢালে আড়াআড়িভাবে সাবধানী ট্রাভার্স ৷ তারপরই খাড়া দেওয়াল বেয়ে পৌঁছে গেলাম শৃঙ্গের শীর্ষে ৷ উচ্চতা ১৯,২০০ ফুট ৷ আইস অ্যাক্সকে বরফের দেওয়ালে আমূল গেঁথে দিয়ে তার সঙ্গে আরোহণ দড়ি বেঁধে নিজেদের নিরাপত্তা বাড়াই ৷ পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিগন্ত জুড়ে ঝলমল করছে নন্দাদেবী স্যাঙ্কচুয়ারির বিখ্যাত সব শৃঙ্গ ৷ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ট্যাংবাং, কলঙ্ক, দুনাগিরি, নন্দাদেবী, বেথারতোলি ৷ পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম আকাশ নীলকণ্ঠ, চৌখাম্বা, বালাকুন, নারায়ণ, সতোপন্থের দখলে ৷ ঠিক উত্তরে দু-তিনটি গিরিশিরার মাথা টপকে উঁকি মারছে কামেট ৷ আর একেবারে ঘাড়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে নরপর্বত ৷ তার পায়ের তলায় ঢেউখেলানো, বিশাল, তুষারপ্রান্তর ৷ অজস্র চোরাগোপ্তা মরণ ফাটলের আঁকিবুঁকি তার গায়ে ৷ ওটাই কুবের হিমবাহের উপরিভাগের তুষার ময়দান বা মালভূমি ৷ আমরা উঠে এসেছি ওই পথেই ৷
আর বেশিক্ষণ নয়, এবার নামতে হবে ৷ পর্বতারোহণে সংখ্যাতত্বের বিচারে বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই ঘটে নামার সময় ৷ তাই দ্বিগুণ সাবধানতা অবলম্বন করে তিনজন নামতে থাকলাম সেই ধারালো গিরিশিরার ঢাল বেয়ে ৷ অবশেষে একঘণ্টা ধরে শ্বাসরোধকারী অবরোহণের পর পা পড়ল আপাত সমতলভূমিতে ৷ টানটান উত্তেজনা শেষ হয় এতক্ষণে ৷ আনন্দে, গর্বে আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরি ৷ বেসক্যাম্পে অপেক্ষমাণ সঙ্গীদের কাছে খবরটা পৌঁছে দিতে আর তর সয় না ৷ স্কাই শিখর ৷ ভারতীয় হিসাবে আমরাই প্রথম স্কাই শিখর স্পর্শ করলাম ৷ শিখর স্পর্শের পরিতৃপ্তি নিয়ে ফিরে চলি এক নম্বর শিবিরের পথে ৷ আবহাওয়া আজ বেশ ভালো ৷ তাই শিবির গুটিয়ে আজই নেমে যাব বেসক্যাম্প ৷
ভ্রমণ জানুয়ারি, ২০০২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন