অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
বহুদিনের মনের বাসনা সুদূর পূর্বাঞ্চল তাওয়াং দেখবার, সে ইচ্ছা পূরণ হল ৷ গত বছর ১৯৭১-এ যখন অরুণাচলের বমডিলা শহরে যাই তখন বর্ষায় রাস্তা ছিল খারাপ ৷ যাবার সুবিধা হয়নি তাই এবছরে দিনক্ষণ মাস আবহাওয়া বিচার করে রওনা হলাম ৷ মার্চের শেষে বর্ষা তেমন নামেনি এবং উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করেছে ৷ ইতিমধ্যে তাওয়াং গুম্ভার বিষয় অনেকখানি জেনেছি তাতে আরও কৌতূহল বেড়েছে ৷ বমডিলাতে মেঘ ও কুয়াশা থাকলেও দিনগুলি ছিল শুকনো ও ঠান্ডা ৷ বমডিলা (৮১৫০) থেকে যখন তাওয়াং গেলাম সেখানকার আবহাওয়াতে যেন নতুন শক্তি পেলাম ৷ দিনেরবেলায় শীত প্রায় নেই ৷ ১০,০০০ ফুট জায়গাটিতেও পরিষ্কার রৌদ্রকরোজ্জ্বল আবহাওয়া ৷ তত হাওয়া নেই, তবে রাতে বেশি শীত, আগুন না জ্বালালে ঘুমানো মুস্কিল-আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা সমস্ত ডাকবাংলো ও সরকারি বাড়িগুলিতেই আছে এই যা সুবিধা ৷
অরুণাচল শাসনের অধীনে একটি পরিবহন অফিস আছে তেজপুরে ৷ তাদেরই একটি গাড়িতে চড়ে মার্চের শেষে বমডিলা রওনা হলাম ৷ ৬০ মাইল মতো পার্বত্য সর্পিল পথে উঠতে হয় ৷ ৩০০ ফুট থেকে একদিনেই ৮১৫০ ফুট যেতে হবে ৷ গাড়ির যান্ত্রিক গোলযোগে রওনা দিতেই বেলা ২টো বেজে গেল ৷ সুতরাং রাত ১০টায় নিঝুম বমডিলাতে পৌঁছলাম খোলা লরিতে, তখনকার অবস্থা অবর্ণনীয় ৷ শীতে সবাই জমে যাচ্ছি ৷ একজন সঙ্গী সরকারি কর্মচারীর মেসের একটি ঘরে কোনওমতে রাত কাটানো গেল ৷ তার পরদিন অবশ্য সার্কিট হাউসে আরামে থাকা গেল ৷ এর আগেরবার যখন এসেছি তখন-রূপা, কলকটাং খোয়া, দিরংজঙ্গ প্রভৃতি গ্রামে তাদের উৎসব দেখে এসেছি তাই কিছুটা পরিচিত ছিল ৷ এখানকার অধিবাসী মোন-পা (Monpa) যারা ঠিক তিব্বতি নয় ৷ এরা ভোট জাতি গোষ্ঠীর লোক যারা তিব্বত ও ভারতের মধ্যবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে থেকে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য করত-প্রথমে নাকি ধর্মে কালী বা শক্তি উপাসক ছিল, বর্তমানে সকলেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও দালাই লামার গেলু-পা বা পীতটুপি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ৷ ভৌগোলিক দিক থেকে এ অঞ্চলের গুরুত্ব অসাধারণ কারণ তিব্বত থেকে ভারতে আসতে অন্যান্য পথের তুলনায় তাওয়াং-বুমলা গিরিপথই সব চাইতে সহজ ৷ তাই ১৯১৪ সালের সিমলা চুক্তিতে তিব্বতি প্রতিনিধি লোরচেন শার্ত্র (Lorchen Shatro) ইংরেজদের অনুরোধে এই অঞ্চলটি তাঁদের দেন ৷ তা সত্বেও এ অঞ্চল ভারতের নিয়মিত শাসনে এসেছে ১৯৫১ সাল থেকে ৷ অরুণাচলের প্রথম জেলা কামেং, এর উত্তর দিকে ভুটান-তিব্বত-ভারত, এই তিন দেশের মিলন স্থানে তাওয়াং অঞ্চল বমডিলা থেকে ১৮৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ৷ সর্বদা বরফাবৃত সে-লা গিরিপথ (১৪০০০) অতিক্রম করে তাওয়াং যেতে হয় ৷ অবশ্য এখন সামরিক বাহিনীর অবস্থানের ফলে রাস্তা বরফমুক্ত কারণ সর্বদাই রাস্তাকে পরিষ্কার করার লোকজন আছে ৷
১৯১৪ সালের আগে এ অঞ্চল ছিল তিব্বতের রাজধানী লাসার অধীনে ৷ এদের শাসক তান্ত্রিক ও ধর্মীয় গুরু দালাই লামা, কারণ প্রায় ৩৬০ বছর পূর্বে মোন-পাদের লামাধর্মে দীক্ষিত করেন তিব্বতের শেরে লামা বা মিরিক লামা ৷ তাঁর সমাধি বর্তমানে মঠের ভেতরেই আছে এখনও ৷ তিনি এখানকার খুব সম্মানিত ও পূজনীয় ব্যক্তি ৷ মোন-পাদের ভাষার অক্ষর তিব্বতি হলেও উচ্চারণে বেশ তফাত আছে ৷ এদের পূজা বা ধ্যানের মন্ত্র অবশ্য পালিতে ৷ মোন-পারা মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর লোক হলেও তিব্বতিদের মতো ভারী মজবুত গঠন নয় দেহের, পায়ের রং ঠিক পীতাভও নয়-রক্তিমাভ বলা চলে, অনেকখানি হালকা দেহের গঠন, গাল বা চোয়াল উঁচু ভারীও নয় ৷ ছিপছিপে গঠন, চোখগুলি বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল-খুব লম্বাও নয় হ্রস্বও নয় ৷ একজন মোন-পা যুবক বর্তমানে ওই অঞ্চলের সরকারি কর্মচারী, রিং চিং নাম ৷ বোধহয় cultural officer বা ওই ধরনের কিছু পদে আছেন, আমাদের সব বিষয়ে খুব সাহায্য করেছেন ও তাঁদের দেশ সম্পর্কে যাতে ওয়াকিবহাল হই তারও চেষ্টা করেছেন ৷ তাওয়াংয়ের মঠের নিচে তিব্বতি শরণার্থীদের অনেক বস্তি আছে ৷ সেখানেই এই দুই গোষ্ঠীকে একসঙ্গে দেখলে তফাতটা বোঝা যায় ৷
১৯১৪ সালের আগে তাওয়াং অঞ্চলটি ৭ জন রাজা দ্বারা শাসিত হত ৷ তার মধ্যে একজন প্রধান রাজা ছিলেন ৷ তিনি ছিলেন লাসার অধীনে, কর বা রাজস্ব যা কিছু দেয় এঁর মারফতেই এ অঞ্চল থেকে যেত ৷ লাসা থেকে কুরিয়াপাড়া ডুয়ার্স দিয়ে তেজপুর আসতে এটাই সব চাইতে সোজা ও হ্রস্বতম রাস্তা ছিল ৷ আসামের ওদলগিরির উত্তরে এ অঞ্চল এসে মিশেছে ৷ দালাই লামার দুজন প্রতিনিধি বা Zongpen-রাই প্রকৃতপক্ষে এ অঞ্চল শাসন করতেন ৷ তিব্বতের দক্ষিণ-পূর্বে kyakya গিরিপথ থেকে সমতলভূমি পর্যন্ত স্থানটিকে বলা হল Monyul (মনিয়ুল) বা নিচু ভূমি ৷ প্রধান শহর ছিল মেন তাওয়াং ৷ মোন-পা মানে সমতল বা নিচু ভূমির অধিবাসী ৷ সে-লা গিরিপথ পার হলেই দেখা গেল উন্মুক্ত উপত্যকায় তাওয়াং গুম্ভাটি ছবির ফ্রেমে আঁটা পরবলয়াকৃতি পাহাড়ের চূড়ার ওপর ৷ তাওয়াং-চু-নদীটি মঠের নীচ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে-আরও নিচে আছে দিরংচু, পাশেই দিরং গ্রাম-ভালো চাষবাস হয়-বেশ সমৃদ্ধ গ্রামগুলি ৷ তবে সে-লার উত্তরে তাওয়াং অঞ্চলে কৃষিরও উৎপাদন বেশি ৷ পাহাড়ের ঢালে চাষ হচ্ছে-গ্রামগুলিতে লোকও বেশ আছে, তারা সারাদিন পরিশ্রম করে ৷ মাঝে মাঝেই তিব্বতি শরণার্থীদের শিবির ৷ তারাও পরিশ্রমী ৷ নর-নারী নির্বিশেষ কাঠের কাজ, বাড়ি রং করা-সুন্দরভাবে সকাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে, কেউ বসে নেই ৷ এরা বরাবরই কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত ৷ সকাল থেকে যতক্ষণ আলো থাকবে ততক্ষণ খুব কর্মতৎপরতা সর্বত্র ৷
তাওয়াং এলাকায় কোনও সমতল জমি নেই ৷ সমস্ত বাড়ি, অফিস বা বাসস্ট্যান্ড সবই একেকটি উচ্চভূমির ওপর অবস্থিত ৷ আমাদের ডাকবাংলো থেকে ডেপুটি কমিশনারের বাড়ি যেতে খানিকটা নেমে আবার উঠতে হত, যদিও দুটি স্থানই মুখোমুখি ৷ একদিন সকালে ৩ মাইল দূরে তাওয়াং মঠটি যাবার জন্য সকাল ৯টায় রওনা হলাম ৷ সঙ্গে সেরিং দোরজে বলে একজন দো-ভাষী, হিন্দি জানে-তাছাড়া সে নিজেও কিছুদিন লামা ছিল ৷ পথে পড়ে শো গ্রাম, সেখানেই তার বাস ৷ বর্তমানে তার স্ত্রী-পুত্র আছে ৷ চুনা গিরিপথ দিয়ে তিব্বতের নানাস্থান থেকে ঘোড়া যখন এ অঞ্চলে আসত উর্বর উপত্যকায় প্রচুর ঘাস পেত ৷ তাতে ঘোড়াদের চলাফেরা সুবিধা ছিল তাই তিব্বতি ব্যবসায়ীরা এ পথেই বেশি চলাচল করত ৷ তিনদিনে বুমলা দিয়ে এখান থেকে তিব্বতে পৌঁছনো যায় ৷
তাওয়াং কথাটি অনেকের মতে এসেছে (রত) র্ত ও দাবং (ওয়াং) শব্দ দুটি থেকে ৷ কথাটির মানে হল হয়গ্রীবের আশীর্বাদ ৷ তিব্বতি ভাষার অধ্যাপক শ্রী সুনীতিকুমার পাঠকের মতে বা বর্ষীয়ানরা তাঁকে যা বলেছেন তা হল এক মস্ত বড় তিব্বতি যোগী ওই পাহাড়ের চূড়ায় বসে হয়গ্রীবের (ঘোড়া মুখ দেবতা তিব্বতি তামাদিন) সাধনা করেছিলেন ৷ সেই থেকে এই নাম ৷ পুরো তিব্বতি কথাটি হল র্ত-মগ্রিন গ্যি দবং ৷
মঠে ঢোকার মুখেই একটি গন্ধ পুস্পের গাছ, গন্ধ শুঁকে ও পাতা দেখে Magnolia grandiflora-র জাত ভাই বলে মনে হল ৷ আসার পথে জাং গিরিপথ ছাড়িয়ে পাহাড়ের কোলে অনেক সাদা ফুলের গাছ দেখেছি-ভিক্ষুদের মতে, একজন মহাপুরুষের গলার মালার ফুল যেখানে যেখানে পড়েছিল সেখানেই ওই ফুলগাছ ৷ তবে সেগুলি আসলে রডোডেনড্রন ফুলের সগোত্র ৷ একজন অরুণাচল নিবাসী অফিসার আমাদের সঙ্গে ছিলেন ৷ তাঁকেও দেখলাম এ মত পোষণ করতে ৷ কী জানি অত লাল ফুলগুলি কী করে এই উচ্চতায় সাদা হয়ে গেল! যাহোক আমাদের চক্ষুকে তারা খুবই আরাম দিচ্ছিল ওই বরফের রাজ্যে ৷
তাওয়াং গুম্ভা (আসল কথাটি নাকি গোন-পা বা বিজন স্থান-মঠগুলি লোকালয়ের বাইরে অবস্থিত হওয়ায় এই নাম) তিনতলা ৷ কাঠ ও পাথরে তৈরি ও টিনে ছাওয়া ৷ শিল্পকলা, ভারতের প্রাচীন শিল্পকলার অনুরূপ ৷ মন্দিরটি দক্ষিণ মুখো-সামনে প্রশস্ত অঙ্গন ৷ সামনে গো-ঘং বা গো-পুরমের মতো গেট ৷ সকালে ভিক্ষুরা কাজে বেরিয়েছেন-কাঠ জোগাড় করতে, খেতের তদারক করতে ৷ প্রধান লামা ভাবী লামাকে নিয়ে গ্রামে গ্রামবাসীদের বাড়িতে গেছেন দেখাশোনা করতে কিন্তু ধর্মাধ্যক্ষ, সম্পাদক মশায় সবাই ছিলেন ৷ গেট বন্ধ ছিল ৷ চাবি এলে দেখলাম কী বিশাল অদ্ভুত আকৃতির চাবি-একটা ছোটখাট যন্ত্র বিশেষ-দরজাটিও অবশ্য তেমনই বৃহৎ ও মজবুত ৷ সামনে দেওয়ালের গায় বিখ্যাত লামা ও বৌদ্ধ গুরুদের মূর্তি অঙ্কিত করা-অনেকের সামনে পুথি-খোলা রয়েছে ৷ তাছাড়া ড্রাগন ও অন্যান্য জাতকের গল্পের চিত্র ৷ মন্দির প্রদক্ষিণ করে প্রবেশ করতে হয় ৷ মঠের বিপরীত দিকে সংসদ ভবন ৷ বাঁদিকে সাধারণ রান্নাঘর-ডানদিকে দোতলায় গ্রন্থাগার-যেখানে রেশমের কাপড়ে মোড়া কানজুর (বুদ্ধের বাণী) তানজুর (বুদ্ধের উপদেশের ব্যাখ্যা) গ্রন্থগুলি রক্ষিত আছে ৷ এরমধ্যে প্রজ্ঞাপারমিতা অংশটি সোনালি জলে লেখা যাকে গেটাম্পো বলে ৷ তিব্বতি গ্রন্থগুলি কাঠের ব্লকে ছেপে করা হয় ৷ আশপাশে উঁচু পাহাড়ের গায় ভিক্ষুদের বাসস্থান ৷ কয়েকটিতে প্রবীণ ভিক্ষুরা দুয়েকজন শিষ্য নিয়েও থাকেন ৷ উৎসব বা বিশেষ দিন ছাড়া ভিক্ষুদের নিজেদের আহার্য তৈরি করে নিতে হয় ৷ মঠ থেকে কিছু দূরে মঠের শস্যাগার বা ডো-থ্যাং ৷ গো-ঘং পেরিয়েই সামনে মণিচক্র-‘ওঁ মণি পদ্মে হুঁ’ দেওয়ালের সামনে-তাছাড়া বহু স্থানে ওই মন্ত্রযুক্ত দণ্ড বা মণিঘাং পাথর ঝরনার জলের সঙ্গে ঘোরে-তাহলেই একেবারে অনেক পুণ্য সঞ্চয় হয় ৷ ঢুকেই সামনের কুলুঙ্গিতে অনেক দেবদেবীর মূর্তি বস্ত্র দিয়ে আবৃত ৷ প্রদীপের সাহায্যে বস্ত্র সরিয়ে নিলে দেখি সামনেই বিশাল কালীমূর্তি তাছাড়া অন্যান্য বোধিসত্ব মূর্তি ৷ মন্দিরের উত্তরের দেওয়ালের মাঝখানে বড় ধরনের সুবর্ণময় অবলোকিতেশ্বরের সাত মুখওয়ালা মূর্তি ৷ পাশে দেবী তারার বিগ্রহ ৷ একদিকে মঞ্জুশ্রী অন্যপাশে মৈত্রেয় বুদ্ধের মূর্তি ৷ একপাশে বুদ্ধদেব দুপাশে সারিপুত্ত ও মৌদগ্যাল্যায়নকে নিয়ে বসে আছেন ৷ কুলুঙ্গি ও দেওয়ালে অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি ৷ ধ্যানী বুদ্ধদেবের ৫টি মূর্তি, তাছাড়া শ্রীমতী দেবীর রুদ্রমূর্তি ৷ মন্দিরের বেশ ভেতরের কক্ষে বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি প্রকাণ্ড ঘর জুড়ে আসীন ৷ ঈষৎ পীতাভ মূর্তি, সোনালি রঙের আভাস, মুখে অর্ধনিমীলিত শান্ত চোখ-দোতলা সমান উঁচু মূর্তি তার উল্টোদিকে দশজন দেবীমূর্তি আসীনা ৷ অবলোকিতেশ্বর বা মৈত্রেয় বুদ্ধমূর্তির পাশে দুর্গামূর্তি আসীনা ৷ অবশ্য তিব্বতের বৌদ্ধধর্মে তান্ত্রিকতার এত প্রভাব যে হিন্দুদের বহু দেবদেবী এদের ধর্মে স্থান পেয়েছেন ৷ তাছাড়া ভারতীয় বৌদ্ধ পদ্মসম্ভবও এখানে গুরু রিমপোচে বলে পূজা পান-তিনি অষ্টম শতাব্দীর যে সময়ে এখানে আসেন তখনই বহু তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ ও দেবদেবী বৌদ্ধধর্মের মধ্যে প্রবেশ করে গিয়েছিল, কাজেই তিব্বতের লামা বৌদ্ধধর্মে তার প্রভাব পড়বে-তা তো খুবই সম্ভব ৷
দোতলায় না উঠলে পুরো বুদ্ধমূর্তিটি দেখা যায় না ৷ মঠের বেশ অভ্যন্তরে বিপুল আয়তনের বুদ্ধমূর্তির মাথায় ও গলায় শুভ্র স্কার্ফ-সম্মানের ও আরতির প্রতীক-ভক্তরা বাইরে থেকে ছুড়ে দেন ৷ প্রশান্ত মুখচ্ছবি, অর্ধনিমীলিত নয়ন দেখলে আপনিই শ্রদ্ধাতে মাথা নত হয় ৷ নেওয়ারি শিল্পীদের অনবদ্য শিল্পকলার সাক্ষ্য চতুর্দিকে ৷ ওই বিশাল ঘরজোড়া বুদ্ধমূর্তি তৈরি করার সময় বহু পবিত্র পুথি ও হাতে লেখা ধর্মপুস্তক ও শাস্ত্র মূর্তির ভেতরে পুরে দেওয়া হয়েছে, ওই দেশের রীতি অনুসারে ৷ দোতলার সামনের ঘরে, গুরু রিম-পো-ছে বা পদ্মসম্ভবের মূর্তি, ইনি ঞিম-মা-পা (nying ma pa) বা লালটুপি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন-এখানে তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপেরই প্রভাব বেশি ৷ গেলু-পা সম্প্রদায়ের মধ্যে ওইসব ক্রিয়াকলাপের প্রভাব কম ৷ পাশের ঘরে বিখ্যাত গুরু শোং-কা-পার মূর্তি-ইনিই গেলু-পা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে আসার পর ৷ একটি ঘরে দুজনের মূর্তির মধ্যে সুখাবতী স্বর্গের চিত্র অঙ্কিত ৷ আলমারিগুলিতে হাজার পিতলের বুদ্ধমূর্তি রয়েছে-এগুলি চিনা আক্রমণের পরে আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছে ৷ ভিক্ষু সকলেই প্রায় অঙ্কন ও চিত্রণ কার্যে পারদর্শী-শাস্ত্র পাঠের সঙ্গে এগুলিও তাঁদের শিখতে হয় ৷ তাছাড়া কয়েকজনের বিশেষ পারদর্শিতাও থাকে ৷ মহাযানী বৌদ্ধধর্ম এখানে প্রচলিত, এঁরা জন্মান্তরবাদে বিশেষ বিশ্বাসী ৷
ভেতরের ঘরে যেখানে মঠাধ্যক্ষ বা ঘেন-পো থাকেন-সেটি নির্জন ও কোলাহল মুক্ত ৷ ভেতরে কুলুঙ্গিতে সোনালি অবলোকিতেশ্বরের কয়েকটি মূর্তি আছে, জিজ্ঞেস করাতে মুদ্রার ব্যাখ্যাও করলেন আমাদের চা পানের সময় ৷ সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও প্রতিষ্ঠাতা রাজা স্রনসেংগাম-পোর চিনা রানি ওয়েং চেং কর্তৃক আনীত মৈত্রেয় মূর্তির প্রতিলিপি দেখালেন ৷ তাছাড়া দেওয়ালে মাথার ওপরে বৌদ্ধ দেব দেবীর ও ৭০-৭২ জন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের মূর্তি অঙ্কিত-খুব নিপুণ কাজ ৷ তিব্বতি ভক্ত কবি মিলা-রে পারও চিত্র আছে ৷ এটি ছবি দেখে এখানকার নেওয়ারি শিল্পী করেছেন ৷
মঠে প্রবেশ করার সময় দেখেছি-সূর্যকিরণে মঠের চূড়া দীপ্যমান-বাঁদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সোনার জলে কাজ করা ধর্মধ্বজা-নিচে তাওয়াং-চু বয়ে যাচ্ছে ও ঘন বন-পিছনে পাহাড়ের সারি-কয়েক মাইলের মধ্যে দুটি মেয়েদের গুম্ভা-তাদের বলা হয় আনী গুম্ভা-৩৩ জন করে ভিক্ষুণী থাকেন ৷ সুন্দর শান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশ-কলকাতার ভিড়ের পর খুবই ভালো লাগে এ স্থান ৷ বিশেষ করে সকালে বিকেলে যখন ৩০০ ভিক্ষু ঘণ্টা হাতে বজ্র নিয়ে বিভিন্ন মুদ্রায় দেবতার আহ্বান ও প্রার্থনা বন্দনা করতেন তখন যে কী এক গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হত! এখানকার খোল করতাল, ডম্বরু কোনটিই হালকা ধরনের নয়-সবই গুরু গম্ভীর-কাজেই তার আওয়াজও গুরু গম্ভীর ও অনেকক্ষণ তার প্রতিধ্বনি থাকে ৷ মোন-পা লামারা গাঢ় লাল ও ধূসর লাল রংয়ের পশমের পোশাক পরেন-গৃহীরা বাদামী লাল রংয়ের পোশাক, মাথায় কালো টুপি পরেন ৷ সারি সারি ভিক্ষুরা বসেছেন-প্রার্থনার সামনে মাখন গলানো ঘিয়ের প্রদীপ ঘণ্টা বজ্র ও জলপাত্র দূর্বাজাতীয় ঘাসের গুচ্ছ, হাতে জপের মালা, মাঝে মাঝে ছোট রেকাবে যব মিশ্রিত আতপ চাল আছে, আমাদের দেশের খইয়ের মতো ছিটিয়ে দেওয়া হয় ৷ মোন-পা পরিবারের সকলকেই কিছুদিন লামা হয়ে থাকতে হয়-তবে যেসব পরিবারে তিনজন ছেলে সেখানে এক জনকে ভিক্ষু হতে হয় ৷
সব মিলিয়ে তাওয়াং গুম্ভাটিকে, তার পরিবেশ ও সরল পরিশ্রমী লোকদের খুব ভালো লেগেছিল ৷ দালাই লামা ১৯৫৭ সালে এ পথ দিয়েই তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে এসেছিলেন-তিনি এদের ধর্মগুরু-সুতরাং তিনি কোথায় ছিলেন, কী করতেন, সকলে তাঁকে কীভাবে দর্শন করতে এল এসব গল্প শুনলাম অনেকবার ৷ কয়েকজন ভিক্ষুর ইচ্ছা তিব্বতি, পালি ও সংস্কৃত ভাষা শেখাবার জন্য স্কুল খোলেন ৷ বহু বই তিব্বতি হরফে সংস্কৃত ভাষায় অনূদিত হয়ে আছে, বা মূল সংস্কৃতে লেখা বই নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু তার ভালো অনুবাদ তিব্বতি ভাষায় আছে ৷ সপ্তম শতাব্দী থেকে শুরু করে ১৪শো শতাব্দী অবধি তিব্বতে বহু ভারতীয় ভিক্ষু ও পণ্ডিত গেছেন ৷ ১৩০৮ সালের দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান যাবার পর মহাযান বৌদ্ধধর্মকে অনেকখানি যাদুবিদ্যা, ভূত উপাসনা প্রভৃতির থেকে মুক্ত করে ধ্যান, প্রার্থনা প্রভৃতির ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়-পরবর্তীকালে গেলুকা সম্প্রদায়ের এইভাবেই প্রতিষ্ঠা হয়েছে ৷ তিব্বত থেকেও বহু ভিক্ষু, নালন্দা বিক্রমশীলা প্রভৃতি সংঘারামগুলিতে আসতেন ৷ তারপরে অবশ্য তিব্বতে তাদের মধ্যে থেকেই বহু ভক্ত ও পণ্ডিত জন্মান-লামা তারানাথের নাম তো বেশ বিখ্যাত-৭০০-৮০০ বছর ধরে বৌদ্ধধর্মের অনুশীলন করার পরে এবং যে সময়ে বহু গ্রন্থ অনুবাদ করা হয়েছে ও ধর্মাচার্যদের এদেশে শিক্ষা দিতে আসার ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় বৌদ্ধধর্ম কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে তিব্বত ও আশপাশের দেশগুলিতে এমনকী মঙ্গোলিয়াতে পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে ৷ এইসব বই আবার অনূদিত হলে ভারতের প্রাচীন ইতিহাসও অনেক জানা যায় ৷
এখন ধর্মের কথা যাক, আমার এক বিশেষ বন্ধু, তিনি এ অঞ্চলের পথঘাট, আচার-ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বললেই হয়, ভালো তিব্বতি জানেন, পায়ে হেঁটে তাওয়াংয়ের আশপাশে সরকারি কাজে বহুবার ঘুরেছেন ৷ তিনি একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন ৷ তাঁরা ১৯৫৫-৫৬ সালে শীতকালে তাওয়াং থেকে পূর্বদিকে রওনা দিয়েছিলেন পথঘাট দেখতে ৷ সময়টা ছিল শীতকাল ৷ কাজেই প্রচণ্ড শীত, পথে কস্তুরীমৃগের দুর্গম নিবাস ও চতুর্দিক বরফে ঢাকা! তাওয়াংয়ের পূর্বে গভীর ছোনা-চুর উপত্যকা ৷ সেখানে আছে দুটি উষ্ণপ্রস্রবণ-তার একটাতে ডিম হাফ বয়েল করে খেয়েছিলেন ৷ আরও পূর্বদিকে ছোনা-চুর একটা উপনদী নিউক-চা ধরে ধরে চলতে চলতে ক্রমশ ওপরে উঠে-পাতলা বাঁশের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলতে লাগলেন-এই উপত্যকার নাম নিউক-চা-রং বা ‘ছোট বাঁশের উপত্যকা’ ৷ দুদিন ক্রমাগত চড়ার পর এক উঁচু সমতলে পৌঁছে হল আশ্চর্য অভিজ্ঞতা-কোথাও বুনো ভেড়ার পাল কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে রইল, জংলী মুরগির পাশাপাশি জল খাওয়া, হঠাৎ হঠাৎ পাখির দল ভয় না করে গায়ে মাথায় বসতে লাগল-তার মধ্যেই আবার সবজির সন্ধান চলল ৷ পরে অবশ্য রসুনের মতো একরকম শাক প্রচুর সংগ্রহ করলেন ৷ পঞ্চমদিনে ওই সুন্দর উপত্যকা ধরে চলতে চলতে উপত্যকার শেষ হল ৷ সামনে কঠিন গিরিপথ, নাম গোংকর-লা (২২০০০ ফুট) ৷ সেদিন সন্ধেবেলা সেই বিশাল উচ্চতার নিচে তাঁবু ফেলে রাতে থাকলেন-রাতে খুব বেশি বরফপাত হল ৷ সকালে তাড়াতাড়ি উঠে রওনা হলেন ৷ তাঁর সঙ্গী ও কুলিরা ছিলেন অবশ্য সব তিব্বতি ও মোন পা ৷ প্রায় মাইল খানেক যাবার পর বরফের ওপর মানুষের পায়ের ছাপ দেখলেন, তখন তো গলদঘর্ম অবস্থায় আর বেশি কিছু দেখেননি-তাই অনুমান করলেন ওঁর আগে কেউ এই পথে ওপরে গিয়েছে! কে যে সেই যাত্রী তা ভাববার বা চিন্তা করার অবকাশও ছিল না-শুধু বোঝা গিয়েছিল যে খুব ভোরে সেই পদযাত্রী গেছে ৷ হয়তো সঙ্গী পাবেন ভেবে ভালো লাগছিল ৷ পায়ের দাগ ধরেই চলেছেন-পিছনে তিব্বতি সঙ্গীর ডাক শুনলেন-ওপথে নয়-অন্যদিকে যেতে হবে-পিছন ফিরে দেখলেন পোর্টাররা সম্পূর্ণ অন্য পথের দিকে দাঁড়িয়ে অনেকটা দূরে ৷ তিনি বলেন-অসম্ভব কথা-এই তো পায়ের ছাপ গিয়েছে, এটাই পথ? সঙ্গী দৌড়ে এসে পায়ের দাগটা পরীক্ষা করে মাটিতে থুতু ফেলল-বলল-তুষার মানব ৷ মোন-পা পোর্টাররাও তাই বলল ‘তুষার মানব’ ৷ তখন তিনি ভালো করে দেখলেন-সত্যি ঢ্যাঙ্গা ঢ্যাঙ্গা পাগুলো হাঁসের মতো উল্টানো-ফেরার পথে মেপে দেখলেন একটা পদচিহ্ন থেকে অন্যটার দূরত্ব প্রায় ৫ ফুটের মতো ৷ সেদিন তাঁরা বেলা তিনটেয় গোংকর-লার চূড়ায় পৌঁছেছিলেন ৷ হায়, এখন পথঘাট হয়ে গেছে আর কি ইয়েতিরা এ ধারে আসবে!
ইনি জাং দিয়ে ৬ দিনের হাঁটাপথে অন্য একটি পর্বতশ্রেণীর নিচে সুন্দর হ্রদ দেখার গল্পও করেছিলেন ৷ এঁর সব গল্পগুলি শুনি ও রোজই দেখি খচ্চরে, ঘোড়াতে চড়ে কর্মচারী ও লোকেরা দূর দূর থেকে আসছে ৷ কেউ পুব থেকে কেউ উত্তর বা পশ্চিম থেকে ৷ তাওয়াং থেকে ৪০ মাইল পশ্চিমে পড়ে তাসিজং-বর্তমানে ভুটানের অন্তর্গত ৷ এখানকার লোকেরা হাঁটাপথে সকলেই সেখানে গেছে-তাছাড়া একটি পার্বত্য পথে ভুটানের সঙ্গে জিনিসপত্রের আদানপ্রদান হয়-অন্য রাজ্য হলেও বিশেষ বাধানিষেধ নেই যাতায়াতের ৷ তিনটি পাহাড়ি পথ আছে পূঃ ভুটানের তাসিজংয়ে যাবার-কিন্তু স্থানীয় লোকেরা বোধহয় স্ত্রীলোক দেখেই আমাকে নানারকম ভয়ের কথা বলতে লাগল-পথ ভাঙা, গ্রাম নেই, বরফে রাস্তা আবৃত ৷ তবে আমাদের কাছে সব চাইতে বড় বাধা অনুমতি ৷ ভুটান সরকারের কাছে আগেই অনুমতিপত্র আনিয়েছিলাম ৷ তাঁরা জানিয়েছিলেন-যে দশ দিনের জন্য তাসিজংয়ে যেতে পারি-তবে তাওয়াং থেকে যাওয়ার পথ ভালো নয়-বরফ পড়ে পথঘাট ভেঙে গেছে সুতরাং রঙিয়া থেকে বাসে ভুটান সরকারের সীমান্ত দরঙ্গা বাজার-দরঙ্গা নদীর ওপাশে সমদ্রুক জগপেন-(ভুটান অঞ্চল)-দিয়ে যেন তাসীজঙ্গে যাই ৷ যাবার তারিখ পার হয়ে গেছে-তবু দরঙ্গা বাজারে ও সমদ্রুক জগপেনে গিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম ৷ তাওয়াং গুম্ভা গেছি; তাই সে সব অনুমতিপত্রাদি দেখে যাবার ছাড়পত্র মিলল-ডাকবাংলোতে বাসস্থানও মিলল ৷
সমদ্রুক জগপেন থেকে মাঠের ওপরের রাস্তা দিয়ে দরঙ্গা বাজারে (ভারতীয় এলাকায়) স্বচ্ছন্দে যাওয়া চলে ৷ এখানে ডাকবাংলোতে থাকার আগেই চেকপোস্টের পুলিশ যথাসম্ভব সার্চ করল ৷ Transport officer ছিলেন নেপালি মিঃ সুব্বা-তাঁর আন্তরিক সাহায্য ও সহযোগিতা না পেলে কী হত তা বলা মুশকিল ৷ তাসিজং বা তাসিগাঁও ১৭২ কিলোমিটার উত্তরে ও পূর্বে তিব্বত সীমান্তের বেশ কাছে ৷ ভুটানে পথঘাট তৈরি হয়েছে, আমাদের পি ডাব্লু ডি-র বহুলোক ও নতুন কর্মীরাও ওখানে কাজ করছেন ৷ ভেতর দিয়ে যাবার কোনও রাস্তা নেই-পাহাড়ি দুর্গম ৷ রাস্তাগুলি যা হচ্ছে তা সবই দক্ষিণ ভারত সীমান্ত থেকে ভুটানের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি পর্যন্ত অর্থাৎ দক্ষিণ উত্তর হয়ে গেছে ৷ আমরা গিয়েছি পূর্ব ভুটানে-যেখানে রাস্তাঘাট ও অন্যান্য ব্যাপারে পশ্চিম ভুটান থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে ৷ স্থানীয় লোকদের মতে তাদের দেশ জনবহুল হলেও দুয়ো রানির ব্যবহার পাচ্ছে, যা কিছু উন্নতি হচ্ছে পশ্চিম ভুটানে-যেখানে রাজধানী পারো, থিম্পু, ফুঙং, সিলং প্রভৃতি অবস্থিত ৷ যা কিছু বাড়ি, ঘর, শিল্প ইত্যাদি নাকি সেখানেই-পূর্বাঞ্চল উপেক্ষিত ৷ যাক আমরা আদার ব্যাপারি জাহাজের খবরে কাজ কি-তাই চুপচাপ সব শুনে যাই ৷
মানস বা ডাংমে চু পাশে রেখে তাসিগাঁও যেতে হয় ৷ মিঃ সুব্বা ডাকবিভাগের লাল জিপটির সঙ্গে আমাদের ব্যবস্থা করেছিলেন, না হলে তখন যানবাহন পাওয়া মুশকিল ছিল ৷ মানস নদী ভারতের কামেং সীমান্তের উচ্চ পার্বত্যভূমি থেকে নেমে আসা কুলং চুর সঙ্গে মিশেছে ৷ এরই একটি উপনদী তাজম চুর পথ বেয়ে তিব্বত থেকে পূর্ব ভুটানে আসার প্রাচীন যাতায়াতের পথ ছিল ৷ তাসিজংয়ের কাছে মানস ১৬০ ফুট চওড়া, সমুদ্র সমতল থেকে ২০০০ ফুট উঁচুতে প্রস্তর খণ্ডকে বিদীর্ণ করে প্রচণ্ড শব্দ করে চলেছে ৷ পথে লরিতে করে বহু লোক যাচ্ছে-কারণ জিজ্ঞেস করলে শুনি-সমস্ত দোকানদারের প্রতিনিধি নির্বাচন হচ্ছে-সকলকে ভোট দিতেই হবে, না হলে শাস্তি ৷ সেজন্য সরকারি কর্মচারীরা সকলেই ব্যস্ত ৷ সমদ্রুক জগপেন পার হয়ে জিপ উত্তরাভিমুখে চলল-প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ চেকপোস্ট দেও-থাং (দেবস্থান) ৷ এখানেই ভালোরকম করে খোঁজখবর তল্লাসি হয় ৷ ভারতীয় সৈন্যদলকেও দেখলাম মাঝে মাঝে ৷ দেওথাংয়ে প্রবেশ করার পথে অবশ্য গেটে ভুটানি বা দ্রুককে ভাষায় (যার অক্ষর তিব্বতি) বড় করে লেখা আছে ‘জেনথর লেকসো’ মানে welcome-কিন্তু সে কাদের জন্য, তাই Check post-এ বসে বসে ভাবি ৷ তিব্বতি ভাষার সঙ্গে বেশ কিছুটা মিল থাকলেও আশপাশের শব্দ ও idioms-এ ভাষায় বেশি আছে ৷ দেশটা এদের নিজের ভাষাতে বলে ‘Drukpa’, তাই ড্রককে (Druk-ke) এদের সরকারি ভাষা ৷ তবে পূর্ব ও পশ্চিম ভুটানে উচ্চারণেও শব্দের অর্থে বেশ তফাত আছে ৷ ভুটানিরা কারগুই-পা গোষ্ঠীর কারমা-পা ড্রুকপা ধর্মীয় গোষ্ঠীর অধীন ৷ এদের বলা হয় লালটুপি সম্প্রদায় ৷ এদের ধর্মে যাদুবিদ্যা ও তান্ত্রিক ক্রিয়ার প্রভাব বেশি-বন ধর্মের অনেক ক্রিয়াকর্ম এদের ধর্মে আছে ৷ এই ক্রিয়াকলাপ ও ধর্মমত পরে শোংকা-পা প্রভৃতি ধর্মাচার্যের হাতে অনেকখানি সংস্কৃত (Reformed) হয়ে গেলু-পা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে-অধুনা যার ধর্মগুরু দালাই লামা ৷ সেজন্য ভুটান ও তাওয়াংয়ের তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকলেও তফাতও আছে তাই রেষারেষিও আছে ৷ আসলে তিব্বত থেকেই ভুটানে বৌদ্ধধর্ম গেছে-(কারমা-পা) কারমা-পা সম্প্রদায়ের লামা ধর্ম ৷ কিন্তু পরবর্তীকালে তিব্বতের ধর্ম সংস্কার-এরা মেনে নেয়নি ৷ পুরনো গোষ্ঠীতেই আছে ৷
তিব্বত-ভুটানে, মানুষের জীবনই নিয়ন্ত্রিত হয় ধর্মীয় প্রভাবে ও অনুষ্ঠানের দ্বারা ৷ পথটি খুব সুন্দর-দিনটিও ছিল পরিষ্কার ৷ পথের দু ধারে কমলালেবুর গাছ, ভুটানের ক্ষুদ্রাকৃতি কমলাগুলির মিষ্টত্বের খ্যাতি আছে ৷ নেপালি ও ভুটানিদের সহজেই তফাত করা যায় কারণ সরকারি আদেশে ঢোলা হাতওয়ালা ভুটানি পোশাক-ছাত্র, কৃষক, সরকারি কর্মচারী সকলেই পরতে বাধ্য ৷ তবে খাবার জিনিস খুব পাওয়া গেল না-চা ছাড়া ৷ ভাত ও শুয়োরের মাংস অবশ্য পাওয়া যায়-আর যেটা সবচেয়ে সস্তা-সেটা হল মদ ৷ ভুটান সরকার পরিচালিত Distillery আছে বিভিন্ন জায়গায় ৷ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় খোলা হয়েছে ৷ জেসুইট ব্রাদারদের পরিচালিত ৫০০ ছাত্রছাত্রীর আবাসিক পাবলিক স্কুলটি আছে-ইয়াং ফুলাতে (৯০০০ ফুট) ৷ এখানকার নেপালি বাঙালি শিক্ষকদের সঙ্গে বেশ সহজেই আলাপ জমে উঠল ৷ এখনও পত্রালাপ চলে ৷ তবে Public Schoolটি স্থাপিত হয়েছে থিম্পুতে রাজধানীর কাছে, কিছুদিন আগে ৷
১৭২ কিলোমিটারের পথ-ওরং, মোরং, নরফাং জোনথাগ্রাম পুল সিলিঙ্গার, রিজের-বু, খাটিংলে, পেরিহান, ওয়ামরাং, কাংলুং, ইয়নফুলা পার হয়ে বিকেল তিনটেয় তাসিগাঁও বা জংয়ে পৌঁছলাম ৷ ৯০০০ ফুট উঠে বেশ শীত করছিল-কিন্তু তাসিগাঁও মাত্র ৩০০০ ফুট, কাজেই বেশ গরম লাগতে লাগল, ফলে রাত দশটায় স্নান ৷ পথে এক মুখ দাড়ি গোঁফ নিয়ে একজন ভদ্রলোক ইশারা করলেন গাড়ি থামাতে এবং জিপের মালপত্রের পিছনে বসলেন ৷ খানিক পরে আমাদের বাংলা কথাবার্তা শুনে-তিনিও যে বাঙালি এবং খাস বালিগঞ্জীয়-ভদ্রলোক তা বলতে লাগলেন ৷ সহজেই আলাপ জমে উঠল ৷ তিনি গিয়েছিলেন ভেতরে পি ডাব্লু ডি কাজের তদারকে ৷ আমাদের জিপটি না পেলে আরও তাঁকে কতক্ষণ বা কতদিন বসে থাকতে হত কে জানে! বালিগঞ্জের ছেলে এই গহন অরণ্যে কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করতে বললেন, ভালো আছি কাজের মধ্যে, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে গলা ছেড়ে গান গাই-এ কথা কলকাতা থাকতে ভাবতেও পারিনি-৷ তাছাড়া বেকার জীবনের জ্বালা তো নেই ৷ বালিগঞ্জে থাকতে এধরনের জীবনের কথা ভাবতেও পারিনি ৷ এরকমই কর্মী উৎসাহী ছেলেদের দেখেছি পি ডাব্লু ডি-র দপ্তরে তাসিগাঁওতে-আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি অঞ্চলের ছেলেরা-বিদেশে, যেখানে ভাষাটা একটা প্রধান বাধা মানুষকে বুঝতে সেখানে এদের পেয়ে যে কত আনন্দ হল তা বলাই বাহুল্য ৷ এদের কাজের সময়ও অদ্ভুত ৷ রাতে খাবার পর জিপ নিয়ে সীমান্তে ছুটল রাস্তা তৈরির তদারক করতে ৷ আমরাও কখনও সঙ্গী হয়েছি তাদের ৷ একজনের স্ত্রী-পুত্র পরিবার এখানেই থাকেন-কাজেই খাওয়াদাওয়ার বিশেষ অসুবিধা হল না ৷ ওদের পি ডাব্লু ডি বিভাগ থেকে রসদ আনাবার, ন্দ্রiপ্তপ্প আনাবার নানাবিধ ব্যবস্থা আছে ৷ তাতেই খাবার কিছু সুবিধা হয়েছে ৷
সরকারি অফিস, ডাকঘর, হোটেল, বাজার বাস রাস্তার পাশেই, নিচে ৷ মাঝে তাজম-চু বলে ছোট নদীটি ৷ ছোট ধারাটির পাশ দিয়ে রাস্তা গিয়ে সেই রাস্তা শেষ হয়েছে ৷ তাসিজং বা তাসি গুম্ভার নামানুসারেই স্থানটির নাম তাসিগাঁও ৷ তাসি কথাটির মানে ‘পবিত্র’, সিকিমে ভুটানে এই কথাটির ছড়াছড়ি ৷ প্রাচীন গুম্ভাটি পুড়ে গেছে-সেটি ছিল ২০০ বছরের পুরনো ৷ সেই জায়গায় একটি নতুন গুম্ভা প্রায় ৪০-৫০ বছর আগে তৈরি হয়েছে ৷ একটি Spur-এর ওপর অবস্থিত তে-তলা বাড়িটির সামনে প্রশস্ত অঙ্গন ৷ এখানকার জংগুলি আসলে দুর্গ, কেন্দ্রস্থলে পূজাস্থান বা মঠ, বাইরের দিকে শাসনকার্যের অফিস ৷ এখানেও তাই, শাস্তি বিচার, সরকারি কাজকর্ম সব এখানেই হয় ৷ গুম্ভার একটি আলাদা দরজা ও সমস্ত জংয়ের একটি প্রধান দরজায়, সন্ধে ৫টার পর লামাদের সান্ধ্য উপাসনার সময়ে বাইরের ভারি দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়-প্রহরী চাবি নিয়ে ভেতরেই থাকে ৷ ৫টার পর কারও ঢোকবার বা বের হবার হুকুম নেই ৷ অতবড় গুম্ভাটি দেখতে আমাদের বেশ সময় লেগেছিল ৷ তাই ৫টা বেজে গেলেও লামারা যখন সান্ধ্য উপাসনার জন্য তৈরি হচ্ছেন-তখন একজন লামা মশাল নিয়ে ও দুটি শিক্ষার্থী বালক লামাকে নিয়ে, একতলা দোতলা সব দেখাতে লাগলেন ৷ দোভাষী নেই-দুয়েকটা কথা বলে সব বুঝতে হচ্ছে ৷ দীপঙ্কর-‘অতীশ-অ’-এসব তো বুঝলাম ৷ অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি এখানে বড় একটা নেই ৷ তবে ১৬৫০ সালে ভুটানের রাজা ও কার-স্তইপা গোষ্ঠীর প্রবর্তক শিপটুন-থুচেনের বড় প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে-তাওয়াংয়েও দরজার সামনেও এঁর মূর্তি আছে ৷ এই মঠের দেওয়ালগুলি ৫ ফুট পুরু ও ৩০ ফুট উঁচু ৷ এর শাসককে বলা হয় জঙ্গদা-তিনি নির্বাচন উপলক্ষে তখন বাইরে ছিলেন ৷ তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরা আমাদের ভাষা, হিন্দি, ইংরিজি কিছুই বোঝেন না ৷ তাঁর অনুমতি নিয়েই গুম্ভায় ঢুকেছিলাম-সমস্ত দেখতে দেখতে ক্রমশ কৌতূহল বেড়ে যাচ্ছে ৷ বুদ্ধমূর্তির পাশে অমিতাভ বুদ্ধমূর্তি, অন্য পাশে কারমা-পা যিনি এখানকার প্রচলিত ড্রক-পা সম্প্রদায়ের মূল গোষ্ঠী কারমা-পা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ৷ মারণ উচাটন, শনি বা খারাপ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য নানারূপ তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ, অপ্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে আহ্বান, মণ্ডল ও চক্রের সাহায্যে নানাবিধ প্রক্রিয়া ও যাদুবিদ্যা প্রদর্শন এই ধর্মমতে বেশি দেখা যায় ৷ মন্ত্রের শক্তিতে এদের অন্যদের মতোই খুব বিশ্বাস ৷ ঠিকভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারলে সোনম (পুণ্য) অর্জন হয় ও মুক্তি হয় এই বিশ্বাসেই জপমালা বা ওঁ মণিপদ্মে হুঁ বাণীটি সর্বত্র পাহাড়ের গায়ে কাঠের গায়ে খোদিত ও উচ্চারিত হচ্ছে ৷ এখানে দশটি তারা মূর্তির চিত্র অঙ্কিত, তাছাড়া কোনও শিল্পী এখানকার মঠের চিত্রও করেছেন ৷ উপাসনাগৃহে বুদ্ধমূর্তি (মৈত্রেয়) আসীন তবে তাওয়াংয়ের মতো অত বিপুলায়তন নয় ৷ ভালো করে কথা বুঝতে না পারার বা যে জন্যই হোক সমস্ত দেখাশোনার পর গেটে এলে দেখি ৬টা বেজে গেছে, গেটে বৃহদাকার তালা ঝুলছে ৷ রক্ষী প্রহরী কিছুতেই খুলবে না-নিয়ম নেই ৷ বাইরের রক্ষী যে আমাদের অনুমতি দিয়েছিল-সে তো দারুণ রাগারাগি শুরু করল ৷ বলছে ওখানেই রাতে আটকে থাকতে হবে ৷ আগেই শুনেছিলাম জেলখানা মাটির নিচে, দারুণ চিন্তা হল-বিশেষ করে আমাদের পি ডাব্লু ডি বিভাগের যে ছেলেটি প্রদর্শক হিসাবে এসেছিল তার জন্য ৷ অন্য রাজ্যে এসেছি, এদের নিয়মকানুনের সঙ্গে পরিচিত নই, ভাষাও বোঝে না আমাদের ৷ ভেতরের রক্ষীকে অনেক অনুরোধ ও মিনতি করার জন্য এবং বোধহয় জঙ্গের ভেতরে মেয়েদের থাকার নিয়ম নেই সেজন্যও বটে, ৭টার পর দরজা খোলা হল-বাইরের রক্ষী কর্মচারী তো আমাদের তখনই পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায় আরকি! অবশেষে অনেক বকাবকির পরে, অনুনয় বিনয়ের পর ঠিক হল পরদিন তার কাছে গিয়ে পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা করা হলে তবে সে সিদ্ধান্ত নেবে ৷ জঙ্গদা থাকলে অবশ্য এতটা হত না ৷ পরদিন সকালে স্থানীয় বাঙালি পি ডাব্লু ডি-র একজন সিনিয়র কর্মচারী আমাদের সঙ্গে এসে বিষয়টা বুঝিয়ে বলাতে রক্ষা পাওয়া গেল-এমনকী আরও ২ দিন বেশি থাকবার অনুমতি পাওয়াও গেল ৷ ভাষা সমস্যা বেশ-তাছাড়া ভুটানের স্কুলগুলিতে ভুটানি ও ইংরিজি ছাড়া অন্য ভাষা পড়ানোও হয় না ৷
তাওয়াং থেকে এটি ৪০ মাইল দঃ পশ্চিমে অবস্থিত পুরনো ব্যবসা-বাণিজ্যের পথটি ছাড়াও অন্য দুটি পথে যাতায়াত করা যায়, তবে সেগুলি সবই পাকদণ্ডী ও খারাপ রাস্তা ৷ একেকটি অঞ্চলে জঙ্গ বা দুর্গ ঘিরেই শহর বা গ্রামগুলি গড়ে উঠেছে ৷ পুরনো বন ধর্মের অলৌকিক শক্তি ও দেবদেবীর প্রভাব বেশ অনেকখানি এদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছে-ঠিকভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারলে ঐশী শক্তির অধিকারী হওয়া যায়-কারমা-পা গোষ্ঠীর মতে ৷ তাই এখানে বর্তমানে বাইরের জগতের সঙ্গে তাল রেখে শিক্ষা-ব্যবস্থা, সামাজিক আইন সংস্কার খুব ধীরে ধীরে করতে হচ্ছে-কারণ অল্প কিছুদিন আগেও ভুটানে বাইরের লোকের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ ৷ জিগমি দোরজের হত্যার কারণও খানিকটা এই যে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, দেশটাকে উন্নতির পথে তাড়াতাড়ি এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন ৷ এখানকার প্রধান কর্মচারীরা বেশিরভাগ ভুটানি বা নেপালি ৷ জুম চাষের চাইতেও পাহাড়ি ঢালের ওপর চাষের পরিমাণ (Terraced cultivation) বেশি হয় ৷ বর্তমান সরকার দেশটার সার্বিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করছেন-দুর্গম পাহাড়ি পথে রাস্তা হচ্ছে, স্কুল, হাসপাতাল খুলেছেন-তবুও সকলে মন খুলে কথা বলতে ভরসা পায় না-বেশ সময় লাগবে এদের আধুনিক কালকে গ্রহণ করতে ৷ রাস্তা তৈরি করার হুniব্ধ-এর নাম ‘দস্তক’-তার একজন কর্তার সঙ্গে কথা হল-ভুটানি ভাষা জানেন-একটা বই পড়াতে আসবেন কলকাতায় জানালেন ৷ তিনি এদের আচার-ব্যবহার রীতি-নীতি সম্পর্কে বেশ জানেন ৷ পরবর্তীকালের অতীশ দীপঙ্করের প্রভাবে শোংকা-পা যে গেলু-কা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করে মহাযানী ধর্মকে আধিভৌতিক ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতি থেকে অনেকখানি মুক্ত করে ধ্যান ও প্রার্থনার দিকে জোর দিয়ে সংস্কৃত (reformed) করেছিলেন-সে মত এখানে গ্রহণ করা হয়নি ৷ সেইজন্যই হয়তো তাওয়াংয়ে লামা ভিক্ষুদের সংযত ও গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যবহার ও কথাবার্তা এত ভালো লেগেছিল এদের তুলনায় ৷
কিন্তু হিমালয়ের যত সৌন্দর্য কি শুধু উপত্যকায়? কুলাকাংরি চমলহরি শৃঙ্গ, উত্তরের উচ্চ উপত্যকাগুলি, ঘন অরণ্যবেষ্টিত মধ্য হিমালয়ের পর্বতশ্রেণী, মহান হিমালয়ের বরফাবৃত চূড়াগুলি আড়াআড়ি (transversal) নদী উপত্যকাগুলি কী অপূর্ব সুন্দর! হিমালয় তার অকৃত্রিম রূপে এখানে দৃশ্যমান ৷ নদীগুলির নামই বা কত বিচিত্র,-মানস, তোর্সা, রায়ডাক, সঙ্কোশ ৷ বড়পেটা থেকে মানস নদীর পারে ভুটানি অঞ্চলটিও কী সুন্দর! কাছেই বন্যজন্তুর অভয়ারণ্য ৷ ভুটান সিকিমকে রোনালডসে বলেছেন-বজ্রের দেশ ৷
আমাদের সরকারি ডাকবিভাগের জিপেই ফিরতে হল ৷ নেপালি ড্রাইভারটি খুব আমুদে ৷ অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, গান গাইছে, ভারতে ছিল, নেপালিরা হিন্দি ভাষা বেশ বোঝে তাই হিন্দি সিনেমার গান খুব রপ্ত করেছে ৷ আমাদেরও কথা বলাবে, গান গাওয়াবে-নাহলে ওর ঘুম এলে এই সর্পিল দুর্গম পথে বিপদের আশঙ্কা পদে পদে! কিছুদিন আগেই একটি জিপ এইভাবে খাদে পড়ে গিয়েছিল-দুয়েকজন মারাও গিয়েছিল ৷ উঁচু থেকে নিচু শ্রেণীর সকলেরই বহু সংস্কার আছে-রাস্তার সামনে কোনও জন্তু পার হলে অলক্ষণ, অবশ্য সে যদি শুধু দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে নয় ৷ জিগমি দোরজের মৃত্যুর আগে নাকি তাঁর বাগানে তিন রাতেই চিতাবাঘ ঢুকে ডেকেছিল-সেটা ওদের মতে অশুভ লক্ষণ, তার পরেই তিনি নিহত হন ৷
যাক, চেনা শোনার পালা শুরু হয়েছে ৷ সেখানকার বাঙালি কর্মচারী ও অন্যান্য শিক্ষকরা-আবার ওদের মধ্যে গিয়ে দেশটাকে ভালো করে জানবার জন্য অগ্রিম আমন্ত্রণ দিয়ে রাখলেন-যেন পশ্চিম ভুটানে, রাজার অভিষেকের সময় যাই ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন