হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু

সহসা হিমালয়

হিমালয়কে আচমকাই প্রথম দেখে ফেলেছিলাম ১৯৬৮ সালে-দার্জিলিংয়ের নিচে লেবং রেসকোর্সের গেটের পাশে একা একা দাঁড়িয়ে ৷ মে মাস ৷ আকাশে যথেষ্ট মেঘের আনাগোনা ৷ তিন দিন আগে দার্জিলিংয়ে এসেছি ৷ তারপর থেকে স্বর্ণশিখর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতেই পাইনি ৷ একটা অতৃপ্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম ৷ কোনও মানুষকে কেউ চারদিক থেকে যতই দেখুক, যতক্ষণ তার মুখ না দেখা যাচ্ছে ততক্ষণ তাকে দেখা যেমন সম্পূর্ণ হয় না-হিমালয়ের ক্ষেত্রেও তেমনই তুষারমণ্ডিত কোনও শৃঙ্গ না দেখলে তাকে দেখা সম্পূর্ণ হয় না ৷ আড়াল সরিয়ে অনেকটা নতুন বউয়ের মুখ দেখার মতো ৷

দার্জিলিং থেকে হাঁটতে হাঁটতে লেবংয়ের মাঠের গেটের কাছে যখন সকালবেলা পৌঁছেছিলাম তখনই সহসা কী মন্ত্রবলে কয়েক মুহূর্তের জন্য জমাট মেঘের আবরণ একটুখানি সরে গেল-আর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল কাঞ্চনজঙ্ঘার অলকস্পর্শী সমুজ্জ্বল মুখমণ্ডল ৷ জীবনে প্রথম দর্শন-আমি একা-আর এমন মহিমময় দৃশ্য-রাস্তার ওপর যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানেই চিত্রার্পিতের মতো স্থির হয়ে গেলাম ৷ কয়েক মুহূর্ত ৷ আবার মেঘের অবগুণ্ঠনে ঢাকা পড়ে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা ৷ সম্বিত ফিরে এল ৷ ম্যল থেকে তিব্বতী বস্তির পাশ দিয়ে যে পথে নেমে এসেছিলাম সেই পথে না গিয়ে গাড়ি চলা ঘোরা পথে ধীরে ধীরে দার্জিলিং শহরের দিকে ফিরছিলাম ৷ তখনও হিমালয়ের ‘মুখ আমি দেখিয়াছি’র মতো ভাবে বিভোর আমি ৷

অনেকটা আসার পর দেখি রাস্তার ঠিক পাশেই আন্দাজ ৫০-৬০ ফুট উঁচু একটা অনাবৃত শিলাস্তরের মাঝ বরাবর একজন লোক পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে এবং তিনি খুব ধীরে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছেন ৷ ‘রক ক্লাইম্বিং’ কাকে বলে তখনও আমার কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না ৷ ভাবলাম এত জায়গা থাকতে ওই কঠিন জায়গাটায় উনি খামখা যেতে গেলেন কেন! উনি কী করেন সেটা দেখার জন্য পাহাড়ি রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে যে সাদা কালো রং করা পাথরের চওড়া বেঞ্চের মতো সামান্য উঁচু আরক্ষণ থাকে তারই একটাতে বসে পড়লাম ৷ লোকটি দেখলাম একটু পরেই সুন্দর ওপরে উঠে গেলেন ৷ উঠেই রাস্তার দিকে ফিরে তিনি সেই শিলাস্তরের মাথায় ভালোভাবে বসলেন ৷ বসেই নিচে আমাকে একা দেখতে পেয়ে ডান হাত নাড়িয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন ৷ উনি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ কী করবেন! আমি তো এতক্ষণ হাঁ করে ওঁরই দিকে তাকিয়ে ওঁর বাহাদুরি দেখছিলাম ৷ প্রত্যুত্তরে আমিও হাত নাড়লাম ৷ আর নাড়তে নাড়তেই ওঁনার মুখটা ভালো করে দেখতে পেয়ে মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল-আকে এঁকে তো আমি চিনি-অনেক দিন ধরেই চিনি ৷ তেনজিং নোরগে ৷

বাকি রাস্তায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম তেনজিং-এর মতো পর্বতারোহী, সেও কিনা ছাত্রদের রক ক্লাইম্বিং-এ প্রশিক্ষণ দেবার আগে নিজেকে উপযুক্তভাবে তৈরি করে নিচ্ছেন-যেমন যোগ্য অধ্যাপক ক্লাসে ঢোকার আগে নিজে পড়াশুনা করে আসেন ৷ প্রতিভার সঙ্গে নিষ্ঠার এবং সততার এক বিরল সম্মিলন ৷

তারপরই মন চলে গেল অনেক পিছনে সেই ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি সময় ৷ তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি ৷ সকালে স্কুল ৷ হঠাৎ শুনলাম এই ক্লাসটার পরেই ছুটি হয়ে যাবে ৷ অন্য সময় ছুটি হলে কে কার আগে ক্লাস থেকে বেরিয়ে বাড়ির পাশে খেলার মাঠে পৌঁছবে তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত ৷ আজ কিন্তু তা হল না ৷ উল্টে সবাই মিলে মাস্টারমশাইকে চেপে ধরলাম-কেউ বাড়ি যাবে না, যার জন্য ছুটি হয়েছে তার কাছে নিয়ে যেতে হবে ৷

এভারেস্ট জয়ের পরে বিশেষ আমন্ত্রণে তেনজিং বাটানগরে এসেছিলেন ৷ এবং তাঁরই সম্মানার্থে আমাদের ছুটি দেওয়া হয়েছিল ৷ বাটানগরে আমাদের স্কুলের কাছেই বাটা কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারের বাংলো ৷ আর সেই মুহূর্তে তিনি সেখানেই অবস্থান করছিলেন ৷ আমাদের জেদাজেদিতে মাস্টারমশাই আমাদের লাইন করিয়ে নিয়ে চললেন সেই বাংলোর দিকে ৷ বাংলোর সামনে এসে আমাদের চেঁচামেচিতে তেনজিং বাংলোর দোতলার বারান্দায় হাসিমুখে এসে দাঁড়ালেন ৷ হাত নাড়লেন ৷ যেমন করে নেড়েছিলেন একটু আগে রাস্তার ধারে পাথরটার মাথা থেকে ৷ আমরাও সবাই একসঙ্গে লাফাতে লাফাতে চিৎকার করে হাত নাড়তে লাগলাম ৷ কিন্তু তাতে আমাদের মন ভরল না ৷ আমরা তাকে নিচে নেমে আসার জন্য হাত দিয়ে ডাকতে লাগলাম ৷ এতগুলো কচি প্রাণের আহ্বান তিনি অগ্রাহ্য করতে পারলেন না ৷ নেমে এসে বাংলোর গাড়ি বারান্দায় দাঁড়ালেন ৷ ডান হাতটা সামনের দিকে বাড়ানো ৷ হাতের পাঁচটা আঙুল একটু ফাঁক করা ৷ আমরা লাইন করে এগিয়ে পাঁচজন পাঁচজন করে আমাদের ভাগের একেকটা করে আঙুল ধরে হ্যান্ড শেকের কাজ সেরে পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম ৷

এতদিন পরে মনে হল সেদিন সেই সদ্য বিজয়ী বিশ্ববন্দিত পর্বতারোহীর হাত স্পর্শ করে আমরা প্রকারান্তরে এভারেস্টকেই স্পর্শ করার আনন্দ পেয়েছিলাম ৷

আর তাই আজকে ধাঁধায় পড়ে গেলাম-হিমালয়কে প্রথম কবে দেখেছি, কবে তাকে প্রথম হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি-আজ না পনেরো বছর আগে শৈশবের বাটানগরে!

হিমালয়ে হনিমুন

এই দার্জিলিং আমার বড় প্রিয় শহর ছিল-অন্তত সত্তরের দশকে তো বটেই ৷ তাই সেই সময় ছোটবেলাকার বন্ধু দিলীপ বিয়ের পর যখন জিজ্ঞেস করেছিল হনিমুনে কোথায় যাবে, তখন আমি চোখ বুজে দার্জিলিংয়ের নাম বলে দিয়েছিলাম ৷ ‘হনিমুন’ হিমালয়ের ঠান্ডা ছাড়া কোথাও জমে না ৷

দার্জিলিং থেকে ফিরে দিলীপ কিন্তু আমার সঙ্গে আর দেখাই করল না ৷ তারপর হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা হতেই অভিযোগের সুরে যেই বললাম-কি রে, তুই তো আর দেখাই করলি না! দার্জিলিংয়ের হিমালয়ে হনিমুন কেমন কাটালি বল?

দিলীপ বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল-নিকুচি করেছে তোর হিমালয়ের-এটা একটা জায়গা হল! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-কেন কী হয়েছে? আরও বিরক্ত হয়ে দিলীপ বলল-রাস্তায় একটু স্বস্তিতে হাঁটার উপায় নেই! হয় নামো নয় ওঠো ৷ নামলেই উঠতে হয়, আবার উঠলেই নামতে হয় ৷ আমার ‘হনিমুন’টাই মাঠে মারা গেল ৷ শতকোটি নমস্কার তোর হিমালয়কে ৷

বড় বিস্ময় লাগে

১৯৭৬-এর অক্টোবরে আমার প্রথম হিমালয় অভিযান ৷ তখনও আজকের মতো কৈলাস-মানস সরোবরের রাস্তা খুলে যায়নি ৷ সেই সময় আমাদের অভিযানের গতিপথ ছিল-কাঠগুদাম থেকে বাসে পিথোরাগড়, সেখান থেকে ধরচুলা হয়ে তাওয়াঘাট ৷ তাওয়াঘাট থেকে ট্রেক শুরু-পাঙ্গি, সিরখা, জিপটি, মালপা, বুধি, গারবিয়াং, গুঞ্জি হয়ে কুটি গ্রাম পর্যন্ত ৷ সেখান থেকে আমরা যাব সামজুর্কচেন হিমবাহ সমীক্ষায় ৷ এখন এই গুঞ্জি গ্রাম থেকেই ডানদিকে লিপুলেখ গিরিপথ হয়ে চলে গেছে মানস সরোবরের পথ ৷ গুঞ্জি গ্রাম থেকে বাঁদিকের রাস্তা ধরে কুটি নদীর উত্তর তীর বরাবর ২১ কিলোমিটার হাঁটলে আমরা এ প্রান্তের শেষ গ্রাম কুটিতে পৌঁছব ৷ প্রায় ১০০ কিলোমিটার ট্রেক ৷

ট্রেক শুরু হওয়ার পর থেকেই হিমালয়ের অপার ঐশ্বর্য প্রতি পদক্ষেপে উন্মোচিত হতে লাগল ৷ জীবনের প্রথম ট্রেক করছি বলে কিনা জানি না, প্রতিদিনই কোনও না কোনও বিস্ময়ের ডালি নিয়ে সে হাজির ৷ আমরা সকলে মুগ্ধ চিত্তে তার রসাস্বাদন করেই চলেছি ৷ প্রথমেই নারায়ণ স্বামী মন্দির, তারপর রং লিং টপের ঘন জঙ্গল, গভীর গিরিখাত সহ কালী নদীর ভয়ঙ্কর রূপ, নাজাং জলপ্রপাত, বুধির আগে পাতলা সাদা শাড়ির মতো উড়তে থাকা পেলস্টি জলপ্রপাত, ছালেগে হলুদ ফুলের বুটি দেওয়া সুন্দর ঘাসের আস্তরণ, গুঞ্জির পর হঠাৎ প্রশস্ত হয়ে যাওয়া কুটি উপত্যকা জুড়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া কুটি নদীর শান্তশ্রী, গুঞ্জির ওপর দিয়ে দেখা নেপালের সমুদ্ধত আপি গিরি শৃঙ্গ অথবা সামজুর্কচেন হিমবাহের ওপর থেকে দুরন্ত গতিতে ধাবমান সাবু দানার মতো তুষার-মনকে একের পর এক বিস্ময়ে অভিভূত করে চলেছে ৷

ধরচুলা, তাওয়াঘাট হয়ে গুঞ্জি পর্যন্ত সবকটি জায়গাতেই আমরা থাকার জন্য সরকারি বাংলো পেয়েছিলাম ৷ রান্নার ব্যাপারে সেই বাংলোর চৌকিদারদের অকুণ্ঠ সহযোগিতাও পেয়েছিলাম ৷কিন্তু গুঞ্জি এসে শুনলাম কুটিতে এই সুবিধা পাওয়া যাবে না ৷ কোনও বাংলো নেই সেখানে ৷ তার ওপর গুঞ্জি থেকে কুটির দূরত্ব প্রায় ২১ কিলোমিটার ৷ একই দিনে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে ৷ ফলে কোথায় থাকব, কে রান্নার কাঠ, জল ইত্যাদি জোগাড় করে দেবে সে বিষয়ে চিন্তিত ছিলাম ৷

যেহেতু আমাদের অভিযানটা নিতান্তই মামুলি ট্রেক ছিল না বরং বিভিন্ন বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মালমশলা জোগাড় করতে করতে আমাদের চলা-আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত অবস্থায় সন্ধের মুখে কুটি পৌঁছলাম ৷ উচ্চতার জন্য সেই গ্রামে তাপমাত্রাও তখন শূন্যাঙ্কের সামান্য ওপরে ৷ গতকাল নাকি সামান্য বরফও পড়েছে ৷ আমাদের শ্রান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করেই যখন সেখানকার সীমান্ত রক্ষীদের বললাম-থাকার কোনও ঘর পাওয়া যাবে কি না, তারা তখন গ্রামের সকলের কাকী বলে পরিচিত এক মহিলার বাড়ি নিয়ে গেল ৷ আমাদের কিছু বলতেও হল না ৷ তিনি আমাদের দেখামাত্রই স্নেহশীলা মা-কাকীমার মতোই তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন ৷ বললেন, আরাম করো ৷ আমি এখুনি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি ৷ আমরা তাঁর বসার ঘরের পাথরের মোটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম ৷ মধ্যে কাঠের আগুন জ্বলছে ৷ স্থানীয় পশমের তৈরি মোটা কার্পেটের ওপর বসে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে তাপ নিতে নিতে বেশ আরাম লাগছিল ৷ কাকীর আশ্বাসবাণী-চা পাঠিয়ে দিচ্ছি-শুনে মনে হচ্ছিল দীর্ঘ পরিক্রমার পর নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি ৷ চা দিতে দিতে কাকী বললেন, তোমাদের সঙ্গে রেশন যা আছে তার থেকে রাতের খাবারের মতো যা লাগে বার করে দাও, আমি রান্নার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি ৷ আমরা তো হাতে স্বর্গ পেলাম ৷

কুটিতে আমরা তিন দিন ছিলাম ৷ কাকীর অসীম দয়া বলতে হবে, আমাদের আর কিছু করতে হয়নি ৷ কাকীর লোকজনই আমাদের সব রান্না করে দিত ৷

একদিন বাদে রাতে এমন বরফ পড়ল কুটির সমস্ত বাড়ির ছাদ সাদা, সমস্ত চাষের জমি একেবারে সাদা ৷ কুটির সকলেরই ধরচুলাতেও আরেকটা করে বাড়ি আছে ৷ গরমের সময় অর্থাৎ জুন থেকে অক্টোবর-এই মাস পাঁচেক তারা কুটিতে থাকে, চাষবাস করে, ভেড়া পুষে তার লোম কেটে বিক্রি করে ৷ কম্বল, চাদর বানায় ৷ তারপর অক্টোবরের শেষে যখন বরফ পড়তে শুরু করে তখন সমস্ত ঘরদোর বন্ধ করে বাড়ির দরজা গাছের জাল পাতা দিয়ে আটকে, অপদেবতার হাত থেকে যাতে তার বাড়ি ঘর রক্ষা পায় তার পুজো করে গরম কম্বল, কিছু খাবার, টাকা পয়সা, গরু ভেড়া এমনকী পোষা কুকুরটা পর্যন্ত কোলে নিয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করে ৷ যেখানে জল আছে সেখানে শুধুমাত্র সেই গরম কম্বল সম্বল করে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে পরদিন আবার যাত্রা শুরু ৷ ইংরিজিতে একে বলে transhumance ৷ বাংলায় ‘মানব-সঞ্চরণ’ বলা যায় বোধ হয় ৷

গ্রামে অবশ্য তরুণ কিছু ছেলে গ্রাম পাহারা দেবার আর অথর্ব যারা নিচে ১০০ কিলোমিটার রাস্তার প্রচণ্ড চড়াই উতরাই ভাঙার ক্ষমতা রাখে না, তাদের দেখভাল করার জন্য থেকে যায় ৷ ভালো বরফ পড়া শুরু হয়েছে দেখে অনেক পরিবারই নিচে ধরচুলার পথে রওনা দিল ৷ কাকীরও যাবার কথা ছিল কিন্তু আমাদের জন্য তিনি যেতে পারলেন না ৷ বললেন, তোমাদের এখানে ফেলে যাই কী করে? তোমরা যাবার পর আমি যাব ৷ কাকীকে কীভাবে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছিলাম না ৷

কাকীর সঙ্গে সন্ধেবেলা কথা বলে বুঝতে পারলাম হিমালয়ের এই প্রত্যন্ত প্রদেশে পড়ে থাকলেও যথেষ্ট আধুনিক তিনি ৷ কয়েক বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন ৷ তার দুই মেয়েকে তিনি মানুষ করছেন ৷ তারা নৈনিতালের কলেজে পড়ে ৷ তাদের ছবি দেখালেন ৷ তিনি কন্যাকুমারী অবধি ঘুরে এসেছেন ৷ দিল্লিতে আকাশবাণীতে নিজের অঞ্চল আর তার মানুষজনের সংস্কৃতি ও সমস্যা নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন ৷ এমনকী ছবি দেখিয়ে বললেন, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলছেন ৷ আমাদের বিস্ময়ের শেষ ছিল না ৷

যেদিন আমরা চলে আসব তার আগের দিন পূর্ণিমা ছিল ৷ আকাশ পরিষ্কার ৷ চারদিকে স্নিগ্ধ আলোর বন্যা ৷ কাকী বললেন, আজ রাতের জন্য তোমাদের আর রেশন বার করতে হবে না ৷ আজ আমার বিশেষ পুজো আছে ৷ পুজোর প্রসাদেই তোমাদের রাতের খাবার হয়ে যাবে ৷ পাহাড়ের ঢালে একটা খচ্চর রেশনসুদ্ধ পড়ে যাবার ফলে রেশনে আমাদের একটু টানাটানিই ছিল ৷ ফলে কাকীর এই প্রস্তাবে আমরা খুশিই হলাম ৷

বিশেষ পুজো দেখার জন্য যখন ওঁর বড় শোবার ঘরে ঢুকলাম, দেখি, ঘরের এক কোণে আমাদের বাড়ির মতো ঠাকুরের আসন পাতা ৷ এই অঞ্চলের লোকেদের ভোটিয়া বলে ৷ তিব্বতী প্রভাব আছে ৷ বুদ্ধের ভক্ত এরা ৷ তাদের ঘরে বাঙালি ঘরের মতো ঠাকুরের আসন দেখে প্রথমে একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম ৷ কিন্তু অবাক হবার তখনও আরও অনেক বাকি ছিল ৷ ঠাকুরের আসনের সামনে প্রণাম করতে গিয়ে দেখি-একি! আমি ভুল দেখছি না তো! যুগপৎ বিস্ময় এবং আনন্দ মনকে নাড়া দিয়ে গেল ৷ আমি অবাক চোখে কাকীকে না বলে থাকতে পারলাম না-এ কী কাকী! ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব এখানে এলেন কী করে? কাকী আমার মনের কথা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে উত্তর দিলেন-ভগবানের কি কোথাও যাবার বাধা আছে? তিনি যে ভাবে সব জায়গায় যান, এখানেও সেই ভাবেই এসেছেন ৷

বুঝলাম মূর্খের মতো একটা প্রশ্ন করে ফেলেছি ৷ সত্যিই তো তাঁর তো কোথাও যাবার বাধা নেই! আর কোনও প্রশ্ন কাকীকে করতে সাহস পেলাম না ৷ মন্ত্রমুগ্ধের মতো হিমালয়ের গহন গভীর উপত্যকায় ঠাকুরের পুজো দেখলাম ৷ প্রসাদ পেলাম ৷ হিমালয় ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ প্রসাদ ৷

সামবডি হ্যাজ এনটার্ড

এর কয়েক বছর পর আবার হিমালয়ের পোকা মাথার মধ্যে নড়েচড়ে বসল ৷ যাদের সঙ্গে জীবনের প্রথম ট্রেক করেছিলাম তাদের কয়েকজন আর নতুন দুজনকে নিয়ে দল এবার চলল সুন্দরডুঙ্গার পথে ৷ শেষ গ্রাম জাতোলি ৷ ঢাকুরি থেকে সকালে রওনা দিয়ে বিকেলের মধ্যে সেখানে আরামসে পৌঁছে গেলাম ৷ পদম সিং-এর ওপরের ঘরটা পুরো আমাদের দখলে ৷ ঘরের সামনের দিকটা আমাদের শোওয়ার জন্য রেখে পিছনের অংশে সব মালপত্র সাজিয়ে রাখা হল ৷

নিচে রান্নাঘরে আমরা চায়ের কাপ নিয়ে পরের দিনের যাত্রাপথ নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন ৷ এমন সময় পদম সিং আমাদের চায়ের আসরে ঢুকে পড়ল ৷ পদম সিং অভিজ্ঞ লোক ৷ আমরা ওকেও মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করছিলাম ৷ কিন্তু আমাদের আলোচনা শেষই হচ্ছে না দেখে ও উসখুশ করতে লাগল ৷ শেষে থাকতে না পেরে বলল-বাবুরা, আপনাদের আলোচনা কতক্ষণ চলবে বুঝতে পারছি না ৷ আমার একটা জরুরি কথা ছিল-যদি কিছু মনে না করেন তবে এখন সেটা বলে ফেলি ৷

আমরা শশব্যস্ত হয়ে প্রায় একসঙ্গেই সবাই বলে উঠলাম-নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, বলুন পদমজি কী বলবেন ৷ পদম সিং আস্তে আস্তে বললেন-আমাকে একটা জিনিস আপনাদের দিতে হবে ৷ এবং সেটা কালই লাগবে ৷ আমরা একটু অবাক হলাম ৷ দলনেতা বললেন-কি জিনিস চাই আপনার?

-এক কিলো চিনি ৷ আমাদের প্রায় সবার মুখ দিয়ে এক সঙ্গে বেরিয়ে এল চি-নি!!

কিন্তু কেউ উত্তর না দিয়ে দলনেতার দিকেই তাকিয়ে রইল ৷ নেতা অতি বিচক্ষণ ৷ সবে তিন দিন ট্রেক হয়েছে ৷ এখন হিমালয়ের গহন গভীরে ঢোকার পালা ৷ সেখানে দোকানপাট কিছুই নেই ৷ কিসে কী হয় কেউ বলতে পারে! আর চিনি একটা দারুণ প্রয়োজনীয় জিনিস ৷ আমাদের সবার যদি ডায়াবেটিস থাকত তাও বুঝতাম ৷ সুতরাং নেতা সঠিক পথে পদম সিংকে নরম করে সাফ জানিয়ে দিলেন-না দাদা, এ যাত্রায় এক কিলো চিনি দিতে পারছি না ৷ ফেরার সময় যদি কিছু বাঁচে তখন দিতে পারব ৷ ব্যাপারটা ভালো হল না খারাপ হল সেটা বোঝার আগেই পদম সিং মুখ ব্যাজার করে চায়ের আসর থেকে বেরিয়ে গেল ৷

এর পরের দৃশ্য-পদম সিং-এর গৃহের ওপরের কক্ষ ৷ সময়-শেষ রাত্রি ৷

কক্ষের সম্মুখ ভাগে কলিকাতা আগত হিমালয় অভিযাত্রীগণ পাশাপাশি শুইয়া অঘোরে নিদ্রা যাইতেছেন ৷ কক্ষের এক কোণায় মাত্র পাঁচ-ছয় ধাপের এক ছোট্ট সিঁড়ি নামিয়া গিয়াছে ৷ তাহার পরেই কপাট ৷ বাহির হইতেই এই কপাট খুলিয়া উপরের কক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব ৷ পূর্ণিমা রাত্রি, চতুর্দিক জ্যোৎস্নায় ভাসিয়া যাইতেছে ৷ বিশ্ব চরাচর নিস্তব্ধ ৷ হঠাৎ এক গগন-বিদারী চিৎকার ‘সামবডি হ্যাজ এনটার্ড’-‘সামবডি হ্যাজ এনটার্ড ৷’ কাঁচা ঘুম হইতে জাগরিত হইবার পর চাঁদের সামান্য আলোর আভাসে চশমাবিহীন অবস্থায় অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে দেখিলাম-আমাদের অন্যতম সদস্য চাঁদু যে সিঁড়ির এবং ঘরের এক মাত্র কপাটের পাশে প্রথমে শুইয়া ছিল সে গলা হইতে হস্তযুগল এবং পদযুগল পর্যন্ত আবৃত ফুটফুটে সাদা আর চাপা ড্রয়ার এবং উলিকট পরিহিত অবস্থায় একটা ছোট্ট টর্চ জ্বালাইয়া সামবডি হ্যাজ এনটার্ড, সামবডি হ্যাজ এনটার্ড এই কথা উচ্চৈস্বরে বলিতে বলিতে ভূতের মতো নৃত্য সহযোগে সারা ঘরময় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে ৷ কাহাকেও কোথাও না পাইয়া সে শেষ পর্যন্ত প্রদীপের উদরে একটি পা ফেলিতেই প্রদীপ ওরে বাবারে মারে বলিয়া লম্ভ দিয়া উঠিয়া বসিল ৷ সেই সঙ্গে বাকি সকলে ৷ অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সহিত সমস্ত টর্চ যখন চাঁদুর মুখমণ্ডলে ফোকাস করা হইল তখন দেখা গেল প্রচণ্ড ভীত চাঁদুর চাঁদপানা মুখটি ভয়ে শুকাইয়া আমসি হইয়া গিয়াছে এবং সেই মুখমণ্ডল হইতে চক্ষুরত্নের মহারত্নটি ঠিকরাইয়া বাহিরে আসিবার চেষ্টা করিতেছে ৷

মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নাটকের ক্লাইমেক্সের আকস্মিকতা কেটে যাবার পর আমরা চাঁদুকে বসিয়ে ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে জল খাইয়ে প্রকৃতিস্থ করলাম ৷ ও একটু ঠান্ডা হলে জিজ্ঞেস করলাম-বল এবার তোর কী হয়েছে? চাঁদু তখনও হাঁপাচ্ছে ৷ এই প্রচণ্ড শীতের রাতেও ও দরদর করে ঘামছিল ৷ তারপর ধীরে ধীরে যে কাহিনী বলল তা হল এই-

গতকাল রাত্রে নিচে খাওয়াদাওয়ার পর আমরা যখন ওপরে শুতে আসি তখন সেই সিঁড়ি লাগোয়া কপাট বন্ধ করতে গিয়ে দেখা গেল কপাটে কোনও ছিটকিনি, আগল বা শেকল কিছুই নেই ৷ কী আর করা ৷ আমরা আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যে লাঠি ছিল তাই আড়াআড়ি ভাবে বন্ধ কপাটের ওপর চাপিয়ে রাখলাম-এই আশায় যে কেউ যদি ঢুকতে চায় হুড়মুড় করে সবগুলো লাঠি পড়বে আর আমরাও জেগে যাব ৷

কপাট আর সিঁড়ির পাশে প্রথমে শুয়েছিল চাঁদু ৷ ওর পাশে আমি, তারপর বাকিরা ৷ খুব পাতলা ঘুম ওর ৷ হঠাৎ শেষ রাত্রে খুট করে শব্দ হতেই ওর ঘুম ভেঙে যায় ৷ ও চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল ৷ চোখ খুলতেই দেখতে পেল-একটা লম্বা চওড়া হাত কপাটটা একটু ফাঁক করে আড়াআড়ি ভাবে রাখা লাঠিগুলো এক এক করে ধরছে আর নিঃশব্দে বার করে নিচ্ছে ৷ এই সময়েই একটা লাঠির সঙ্গে কপাটের সামান্য গুঁতো লেগে খুট করে শব্দ হয়েছিল ৷ কপাটটা পুরো খুলে যাবার পর পেছনে চাঁদের আলোর পশ্চাদপটে ও দেখল এক দৈত্যাকৃতি লোক দাঁড়িয়ে ৷ বুঝল, যমদূত প্রবেশ করতে চাইছে তাদের ঘরে ৷ আলো না থাকায় শরীরের কাঠামো ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ৷ কিন্তু এটা পরিষ্কার বোঝা গেল আজ মৃত্যু অবধারিত ৷ এই অবস্থায় চিৎকার করে আমাদের যে ডাকবে তাও পারছে না ৷ আসন্ন মৃত্যুর করাল ছায়া বোধ-বুদ্ধি সব গ্রাস করেছে ৷ মনে হচ্ছে গলাটা কে যেন চেপে ধরে আছে ৷ পাশে আমি শুয়ে আছি, হাতটা একটু বাড়িয়ে আমাকে ঠেলতে গিয়ে ওর মনে হল হাত-পা কে যেন বেঁধে রেখেছে ৷ এই পরিস্থিতিতে সেই ‘যমদূত’ যখন বোঝার চেষ্টা করছে ঘরের কোথায় কে শুয়ে আছে তখন চাঁদু বুঝে গেল ওকেই প্রথম মৃত্যু বরণ করতে হবে ৷ ও চিৎ হয়ে শুয়েছিল বলে, ওর মনে হল, ছোরাটা বুকে বিঁধলে বেশি লাগবে ৷ ও তাই অনেক কষ্টে-আবার কী দেখে ফেলবে-সেই কারণে চোখ বন্ধ করে নিজের শরীরটা আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে উপুড় হয়ে শুল ৷ কিন্তু কী আশ্চর্য ওর পিঠে কেউ ছোরা মারল না ৷ একটু বাদেই পাশ থেকে চাপা গলায় আওয়াজ এল-আঃ আঃ ৷ চাঁদুর মনে হল যমদুতটা ওকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে মারল বোধহয় ৷ (আসলে এই সময় বুকে হাত দিয়ে শোওয়ার জন্য প্রদীপকে বোবায় পেয়েছিল ৷ তারই ফলে ওই আওয়াজ) ৷ কিছুক্ষণ এইভাবে চোখ বন্ধ করে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার পরেও যখন কিছু হল না তখন চাঁদু আস্তে আস্তে সম্বিত ফিরে পেল ৷ ধীরে ধীরে উঠে বসল ৷ কেউ কোথাও নেই অথচ কপাট হাট করে খোলা ৷ তারপরেই শুরু হয়ে গেল সতীবিহীন শিবের প্রলয় নৃত্য-সামবডি হ্যাজ এনটার্ড ৷

সকাল হল ৷ আমরা মালপত্র গোছাতে শুরু করলাম ৷ কোয়ার্টার মাস্টার প্রবাল হঠাৎ দেখল চিনির প্যাকেট যে বস্তায় ছিল সেটা খোলা ৷ আর তার গোনা প্যাকেটগুলো থেকে একটা প্যাকেট হাওয়া ৷

তদন্ত নিষ্প্রয়োজন ৷

সংযম

হিমালয় অভিযানের স্বাদ পাল্টাবার জন্য একবার ঠিক হল স্পিতিতে যাওয়া হবে ৷ নানা দিক ভেবে মনিরং শৃঙ্গ আর তার উল্টো দিকে এক অনামা শৃঙ্গ বেছে নেওয়া হয়েছে ৷ আমি পর্বতারোহী নই তবু শৃঙ্গ বেছে দেবার নজরানা হিসেবে আমাকেও দলভুক্ত করা হল ৷ আমার অবস্থাটা হল ঠিক হংস মধ্যে বক যথা ৷

কলকাতা থেকে সিমলা, সেখান থেকে রামপুর, তাবো, পো হয়ে কাজার আগে সিজলিং-এ আমরা নেমে গেলাম ৷ সিজলিংয়ের চারদিকের শোভা দেখে মনে হল আর কোথাও যাবার দরকার নেই ৷ এইখানেই খেয়ে বসে শুয়ে আর পাশেই স্পিতির স্বচ্ছ জলে পা ভিজিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায় ৷ সিজলিংয়ের ওপরেই বিখ্যাত ডাংখার গুম্ভা ৷ লাদাখে যেমন হেমিস, স্পিতিতে সমান মর্যাদায় তেমনই ডাংখার ৷ আগে এই অঞ্চলের রাজধানীর মতো ছিল ৷ সিজলিং থেকে সকালে গিয়ে সব দেখে বিকেলে ফিরে আসা যায় ৷ যে দিন আমরা সিজলিং এলাম সেই দিনই চারদিকে পাহাড়ের মাথায় প্রাক-শীতের প্রথম বরফ পড়ল ৷ যে তাপমাত্রা কলকাতায় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল তা সিমলায় ১৩ ডিগ্রি, সিজলিং-এ সন্ধেবেলা ৬ ডিগ্রি এবং পরদিন ভোরে ২ ডিগ্রিতে নেমে গেল ৷

সিজলিং থেকে স্পিতি নদী পার হয়ে ৬০০ ফুট ওপরে মানে গ্রামে একটু বিশ্রাম নিয়ে সোজা চলে গেলাম ইয়াং হ্রদের ধারে ৷ সেপ্টেম্বরের শেষ বলে হ্রদে এখন খুব একটা জল নেই ৷ থাকলে ট্রাউট মাছ পাওয়া যেত ৷ হ্রদের পিছন দিকটা ক্রমশ সরু হয়ে গেছে ৷ একটা লম্বাটে পরোটার আকার নিয়েছে ৷ জল নেই বলে তলার মাটি এক বিরাট ফুটিফাটা সমতল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ৷ তার ওপর দিয়ে আরামে হাঁটতে হাঁটতে হ্রদের অন্যপ্রান্তে চলে গেলাম ৷ পাহাড়ের গা ঘেঁসে আমাদের তাঁবু পড়ল ৷ বেসক্যাম্প ৷

এই পথের একটা ছোট্ট ইতিহাসও আছে ৷ আমাদের সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে বৌর্ন অ্যান্ড শেপার্ডের যে ফটোর দোকান আছে, সেই বৌর্ন হিমালয়ের ছবি তোলার জন্য এই পথে এসেছিলেন ৷ বৌর্নের জন্ম ১৮৩৪ সালে ৷ ছিলেন ব্যাঙ্কের ক্লার্ক, হয়ে গেলেন ফটোগ্রাফার ৷ ভারতে আসেন ১৮৬৩ সালে ৷ ১৮৬৩, ১৮৬৪ এবং ১৮৬৭ তে পর পর তিনটি অভিযানে তিনি হিমালয়ে যান ৷ শেষের অভিযানটি ছিল সিমলা থেকে নারকান্ডা, জালোরি গিরিপথ, কুলু, নগ্গর, হামতা গিরিপথ, কুনজুম গিরিপথ, লোসার হয়ে কিবার ৷ তারপরেই এই মনিরং গিরিপথ হয়ে কিন্নরে নেমে সিমলায় ফেরা ৷ সেই সময়ে তার তোলা ১৮,৬০০ ফুট উঁচুতে মনিরং গিরিপথের ছবি ১,৮৮০ সাল পর্যন্ত একটা রেকর্ডের দাবিদার ছিল ৷ তখন পর্যন্ত এত উঁচুতে আর কারও তোলা ছবি ছিল না ৷ বৌর্নকে আমরা শুধু একজন ভালো ফটোগ্রাফার হিসাবেই চিনি ৷ কিন্তু এটা জানি না যে তার ভেতর একজন অসীম সাহসী হিমালয়প্রেমিক অভিযাত্রীও লুকিয়ে ছিল ৷

আমাদের বেসক্যাম্পের পাশেই কিন্তু অনেকটা সমান জায়গা ছিল বলে হাওয়ার তীব্রতা সব সময় বেশি ৷ তাপমাত্রাও বেশ কমের দিকে ৷ রাতে তো বটেই, দিনেই শূন্যের নিচে তাপ আমাদের রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত করে রাখল ৷ সন্ধের মধ্যেই খাওয়াদাওয়া সেরে তাঁবুর ভেতর ঢুকে যাওয়া হবে ঠিক হল ৷ কিন্তু দেখা গেল তিনজনের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে ৷ স্পিতি অঞ্চলে গাছপালা কম থাকার দরুন বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কম ৷ তাই একবারে অনেকটা উচ্চতায় চলে এলে উচ্চতাজনিত অসুস্থতার সম্ভাবনা থাকে ৷ এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে ৷ সিজলিং থেকে একদিনে ইয়াং হ্রদে না এসে নিচের গ্রামে থাকলে ভালো হত ৷ কিন্তু এখন আর সে কথা ভেবে কাজ নেই ৷ তিনজনেই সারা রাত মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করল ৷ আমার আবার কোনওরকম যন্ত্রণা না হলেও বুঝতে পারছিলাম শরীরটায় স্বস্তি পাচ্ছি না ৷

পরদিন আর না এগিয়ে বেসক্যাম্পেই থাকা ঠিক হল ৷ শুধু দুজন সদস্য এগিয়ে গিয়ে সামনের রাস্তা কেমন এবং পরবর্তী ক্যাম্প কোথায় হবে সেটা দেখে এল ৷ এর মধ্যে দুজনের শরীর ঠিক হয়ে গেলেও আশিসের অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেল ৷ মাথা যন্ত্রনা তো ছিলই ৷ এখন বমিও শুরু হয়ে গেছে ৷ আমার অবস্থাও তথৈবচ ৷ না উন্নতি না অবনতি ৷

পরদিন সকালেও আশিসের অবস্থার যখন কোনও হেরফের হল না, তখন দলনেতা সিদ্ধান্ত নিলেন আশিসকে নিচে নেমে যেতে হবে ৷ নিচে মানে একেবারে সমতলে ৷ কিন্তু ওকে তো আর একা একা ছেড়ে দেওয়া যায় না ৷ তাই সঙ্গে কে যাবে সেই প্রশ্ন উঠতে আমিই এগিয়ে গেলাম ৷ কেননা আর যাই হোক আমি পর্বতারোহী নই ৷ তার ওপর আমিও অল্পবিস্তর অসুস্থ ৷ নিজেদের মালপত্র সব গুছিয়ে আমরা দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে মানে গ্রামে নেমে এলাম ৷ দুদিন আগে গ্রামের ভেতর দিয়ে ওপরে ওঠার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ৷ বারবার বলেছিলেন তার বাড়িতে থাকার জন্য ৷ সেখানেই উঠলাম ৷ ভদ্রলোকের ঘরের ভেতরে গিয়ে আমাদের তো চক্ষু ছানাবড়া ৷ ঘরটা প্রায় ১৫ ফুট বাই ৪৫ ফুট হবে ৷ পুরোটা সুন্দর কার্পেট মোড়া ৷ দুদিক দুটো মোটা তোশকের ওপরে চাদর বিছিয়ে সামান্য উঁচুতে বিছানা করা ৷ নিচু কাঠের টেবিল, তার ওপর বড় বড় ফ্লাস্ক, প্লেট, গ্লাস, চামচ ৷ গোটা তিনেক বড় বড় বাতিদান ৷ জানলায় সুন্দর পর্দা ঝুলছে, দেওয়ালে তিব্বতী ছবি ৷ একতলার ঘর থেকে একটা বড় টিনের চোঙার মতো বস্তু ছাদ ভেদ করে ওপরে উঠে গেছে ৷ এটা আসলে ঘর গরম রাখার দেশজ পদ্ধতি ৷ নিচের ঘরে আগুন জ্বালালে তার উত্তাপ এই চোঙাকে অবলম্বন করে ওপরের ঘরে ছড়িয়ে পড়ে ৷ বাইরে থেকে এতকিছু বোঝবার উপায় নেই ৷

সারাক্ষণ ভদ্রলোকের সঙ্গে আড্ডা মারলাম আমরা ৷ জেনে নিলাম স্থানীয় লোকজনের দৈনন্দিন জীবনের কথা ৷ কুটির মতো এই গ্রামের মানুষেরা শীতের সময় নিচে নেমে যায় না ৷ প্রায় ছয় মাস ঘরেই বন্দী থাকে ৷ ভদ্রলোক বললেন, ওই সময় আসুন, বাইরে যখন বরফ জমে থাকবে, আমরাও ভেতরে ছমাস জমিয়ে আড্ডা দেব ৷ প্রস্তাবটা মন্দ লাগল না ৷ সেই রাতে তাঁর আতিথেয়তার কথা কোনওদিন ভুলব না ৷

পরদিন খুব ভোরে প্রচণ্ড ঠান্ডার ভেতরেই আমরা বিদায় নিলাম ৷ কেননা কাজা থেকে সিমলাগামী বাস ধরার জন্য এখনও আমাদের ছ কিলোমিটার হাঁটতে হবে ৷ সিজলিংয়ে নামতেই মনে হল আমরা আবার অসুস্থ ছিলাম কবে! যাইহোক বাস ধরলাম ৷ ওয়াংটুতে এক রাত থেকে পরদিন সিমলা ৷ কালকা মেলের টিকিটও পাওয়া গেল পরদিনের ৷

সকালবেলা ছোট ট্রেনে যাত্রা হল শুরু ৷ খুব একটা ভিড় ছিল না ৷ আমাদের উল্টোদিকেই এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক সপরিবারে সিমলা ভ্রমণ শেষে কলকাতায় ফিরছেন ৷ ফলে মুহূর্তে আলাপ জমে উঠল ৷ ফলে কে কোথায় থাকি, কী করি পর্বের পরেই প্রশ্ন হল আমরা কোথা থেকে আসছি ৷ যেই শুনলেন পর্বতারোহণের কথা অমনই সোজা হয়ে বসলেন ৷ আর আমাদের গায়ে তখনও অর্ধসমাপ্ত হলেও পর্বতারোহণের গন্ধ লেগে আছে বুঝতে পেরে উনি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন ৷

আসলে উনিও খেলাধুলার জগতের লোক ৷ কলকাতার কোনও এক মাঝারি মাপের ফুটবল ক্লাবের কর্মকর্তা ৷ ফুটবল আর তাঁর খেলোয়াড়দের বিষয়ে অনেক কিছু জানলেও পর্বতারোহণ এবং পর্বতারোহীদের সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার যে একবারে শূন্য ছিল তা তাঁর প্রশ্নের ধরন দেখেই বুঝে গেলাম ৷ আমি অবশ্য এই প্রশ্নোত্তর পর্বের গোড়াতেই ওঁকে সবিনয়ে জানিয়ে রাখলাম-দেখুন আমি কিন্তু পর্বতারোহী নই ৷ গোলেমালে এদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি ৷ আপনার প্রশ্নের উত্তর যা দেবার ওই আশিসই দেবে ৷ যতদূর মনে পড়ছে সিমলা-কালকা ছোট ট্রেনে ১৩৩টা সুড়ঙ্গ পার হতে হয় ৷ ভদ্রলোক এতদিন পরে আশিসের মতো এক আস্ত পর্বতারোহীকে সামনে পেয়ে প্রায় সমসংখ্যক প্রশ্নবাণে ওকে ধরাশায়ী করবে বলে মনে হল ৷

কারা পর্বতারোহণে যায়, কত বয়সে যায়, কখন যায়, হিমালয়ের কোথায় যায়, সেখানে কী কী করতে হয়, কী কী অসুবিধা সেখানে ভোগ করতে হয়, জামাকাপড় কী লাগে, বিশেষ যন্ত্রপাতি কী লাগে, সেগুলো কোথায় পাওয়া যায়, তার কত দাম, আপনাদের ক্লাব কীভাবে চলে, ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে মূল পার্থক্য কী, সরকার থেকে কিছু সাহায্য পান কিনা, কী ধরনের বিপদ এই খেলায় আসে, শরীর ঠিক রাখার জন্য কী ধরনের ব্যায়াম এবং খাবারের প্রয়োজন হয় ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ ভদ্রলোক যেমন আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন আশিস তার থেকেও বেশি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রত্যেকটার যথাযথ উত্তর দিয়ে যাচ্ছে ৷ আমার গর্বে বুকটা ভরে উঠছিল-পৃথিবীতে অন্তত একজন লোকও আমাদের পর্বতারোহীদের সম্বন্ধে আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং তিনি আমাদের কথা শুনে যারপরনাই তৃপ্ত ৷ আর কী চাই! আমরা পর্বতারোহীরা গরিব হতে পারি কিন্তু অন্য খেলাধুলার থেকে আমাদের স্বাতন্ত্র্য ঈর্ষণীয় ৷

এতদূর হবার পর ভদ্রলোক আশিসকে আরেকটা অত্যন্ত নিরীহ প্রশ্ন করলেন-আচ্ছা আপনি সারাদিন সময়টা কাটান কীভাবে?

-কেন? সকালে ভোর সাড়ে চারটে-পাঁচটায় উঠে এক ঘণ্টা পাড়ার মাঠে জগিং করি, একটু ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম করি ৷ অফিসে যাই, বিকেলে সাঁতার কাটি, নয়তো যোগ ব্যয়াম করি ৷ সন্ধ্যায় মাউন্টেনিয়ারিং, ট্রেকিং, রক -ক্লাইম্বিং-এর ওপর বইপত্র পড়ি ৷ মঙ্গল আর শনিবার অফিসের পর ক্লাবে যাই ৷ রাত নটার মধ্যে খেয়ে ১০টার মধ্যে ঘুম ৷ রবিবার একটু অন্যরকম হয় ৷

-রবিবার ছুটির দিন বাদে সব কটা দিন এইভাবে কঠিন নিয়মে কাটান? আশ্চর্য! আমি না যতই শুনছি, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি ৷ আমাদের ফুটবলের ছেলেগুলো এর খানিকটাও যদি নিতে পারত, আজ বাংলার ফুটবল অন্য জায়গায় চলে যেত ৷

ট্রেন দ্রুত নেমে যাচ্ছে স্বপ্নের হিমালয় ছেড়ে সমতলের দিকে ৷ ট্রেন-পথে সবদিক থেকে এমন উপভোগ্য ভ্রমণ অনেকদিন করিনি ৷ কিন্তু ঠিক এই সময় আশিস একটা কাণ্ড করে বসল ৷ এবং সেটা এত নিঃশব্দে যে তখন তখন বুঝতেও পারলাম না ৷

ও ভদ্রলোকের শেষ কথার উত্তরে আমতা আমতা করে বলল-আজ্ঞে না, সপ্তাহের সব কটা দিন মোটামুটি একই নিয়মে কাটালেও শুক্রবার বিকেলটা এর থেকে বাদ ৷

ভদ্রলোকের দ্বিগুণ কৌতূহল ৷ কেন, শুক্রবার বাদ কেন?

-ওইদিন আমি একটা সিনেমা দেখি ৷

-সিনেমা? সে আর এমন কী কথা!

-না মানে, শুক্রবার কোনও না কোনও বই যখন রিলিজ করে তখন সেটা আমার দেখা চাই-ই ৷

-সে তো দেখতেই পারেন ৷ প্রথম দেখার একটা আলাদা মজা আছে ৷

-না মানে, দরকার হলে ব্ল্যাকেও বেশি দামের টিকিট কেটে দেখি ৷ সেদিন আমাকে যে করেই হোক সিনেমা দেখতেই হবে-বলে গুণমুগ্ধ ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে হেঁ হেঁ করে দাঁত বার করে হাসতে লাগল ৷

এইবার দেখলাম ভদ্রলোক হঠাৎ একেবারে গম্ভীর হয়ে গেলেন ৷ আশিসের চোখের দিকে একদৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন ৷ ভদ্রলোকের মুখের জিওগ্রাফি দ্রুত পাল্টাতে দেখে আশিসেরও দাঁত বুজে এল ৷ ভদ্রলোক এরপর সেই যে মাথা ঘুরিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে হিমালয়ের শোভা দেখতে লাগলেন, আশিসের সঙ্গে আর একটা কথাও বললেন না ৷

বুঝতে না পেরে, অস্বস্তির হাত থেকে রেহাই পেতে, উল্টোদিকে একটা সিট খালি হতেই আশিস উঠে গেল ৷ আমি একা কুম্ভ পতনোন্মুখ দুর্গ রক্ষা করার জন্য হতভম্বের মতো বসে রইলাম ৷ কালকা প্রায় পৌঁছে গেছি ৷ মালপত্র ঠিক করার জন্য ভদ্রলোক মাথা ঘোরাতেই আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম-আপনি কি আমাদের ওপর রাগ করেছেন?

অত্যন্ত ক্ষুব্ধ স্বরে তিনি বললেন-আপনাদের সম্বন্ধে আমার একটা উঁচু ধারণা তৈরি হয়েছিল ৷ আপনার বন্ধুর একটা কথা শুনে নিমেষে তা লোপও পেয়ে গেল ৷

-কেন ও কী এমন বলল যাতে-৷

-বলে কিনা, শুক্রবার সিনেমা দেখার জন্য, দরকার হলে, ব্ল্যাকেও টিকিট কাটেন উনি! এতবড় একটা খেলার খেলোয়াড় হয়ে-এত ভাবে নিজেকে তৈরি করার পরেও সামান্য একটা সিনেমা দেখার জন্য ব্ল্যাকে টিকিট কাটতে হয় ওঁকে! এইটুকু সংযম নেই! আর, তা যদি নাই থাকে, বৃথাই ওর নিজেকে খেলোয়াড় বলে দাবি করা ৷ সংযম ছাড়া কোনও খেলোয়াড় খেলোয়াড় পদবাচ্যই নয় ৷ আমার আর কিছু বলার নেই ৷ বলেই তিনি ট্রেন থামতেই মালপত্র নিয়ে আমাদের আর কিছু না বলে সোজা হাঁটা দিলেন ৷

অনন্ত হিমালয়-অন্তহীন পথ

একবার পর্বতারোহী বন্ধুরা মিলে ধরল, তুমি এমন একটা উপত্যকা আর শৃঙ্গের হদিশ দাও যেখানে আজ পর্যন্ত কেউ কখনও যায়নি ৷ কেউ যেখানে যায়নি তার হদিশ কোনও পর্বতারোহী বা অভিযাত্রীর কাছ থেকে আর পাওয়ার উপায় থাকল না ৷ ভরসা শুধুমাত্র মানচিত্র-অভিযাত্রীর তৃতীয় নয়ন ৷ সেই তৃতীয় নয়নের ওপর নির্ভর করেই সেই ১৯৮৫ সালে সুপিন উপত্যকা ধরে থিমলোগা শৃঙ্গ অভিযানে আমরা বার হলাম ৷

এই অভিযানের প্রথম থেকেই একটা অশুভ ছায়া আমাদের তাড়া করে ফিরছিল ৷ কলকাতা থেকে দেরাদুনে আমরা সব সদস্য নানা কারণে একসঙ্গে পৌঁছতে পারলাম না ৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দেরাদুনের পর থেকেই রাস্তা এত খারাপ যে একদল আগে বেরিয়ে যাবার পর, পরের সদস্যদের বাস গেল উল্টে, যে পথে বাস যায় সে পথে সময় ও শক্তি আর পয়সা নষ্ট করে হেঁটে যেতে হল-এ সবই অবশ্য হিমালয়ের নিয়মের মধ্যেই পড়ে ৷

অগ্রবর্তী দলের সদস্য হিসেবে দেরাদুন থেকে পুরোলা হয়ে মোরিতে পৌঁছে আমাদের পাঁচদিন অন্য সদস্যদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৷ এই ক’দিন অবশ্য বসে না থেকে মোরির আশপাশে যা কিছু দেখার ছিল সব দেখে ফেলেছিলাম ৷ অনন্ত রূপরাশি নিয়ে হিমালয় এমন এক মহার্ঘ্য বস্তু, এত ঐশ্বর্যমণ্ডিত যে এ সহজে ফুরায় না ৷ কোথা দিয়ে যে পাঁচদিন কেটে গেল বোঝাই গেল না ৷ মোরির ধারে তন্বী তমসার দৃপ্ত গতির ভঙ্গিমা, তার দুপাশে অসংখ্য পাখি সহ পাইনের নির্জন বন, পাহাড়ের গা বেয়ে বয়ে আসা নির্ঝর ঝরনা-আর সবার ওপরে উদার নীল আকাশ নয়তো মেঘের ভয়াল ভ্রূকুটি-আমাদের পাঁচদিন একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখে দিল ৷

সাকরিতে গিয়েই আমাদের প্রথম বড় ধাক্কা খেতে হল ৷ যাকেই জিজ্ঞেস করি সুপিন উপত্যকার কথা, মানচিত্র থেকে উদ্ধার করা কয়েকটা গ্রামের কথা, সেই বলে-আরে উস তরফ জানে কা জরুরৎ ক্যা হ্যায় ৷ মর জায়গা আপলোগ ৷ জানা হ্যায় তো হর-কি-দুন যাইয়ে ৷

শেষ পর্যন্ত এক লালাজিকে ধরে করে দুজন মালবাহক আর কয়েকটা খচ্চর পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল ৷ খচ্চরওয়ালা যাবার দিন সকালে এসে বলল-ওর ভালো খচ্চরগুলো মোরি চলে গেছে মালপত্র আনতে ৷ এখন আর কোনও ভালো খচ্চর নেই ৷ আর ওরা পরশু ফিরলেও পরের গ্রাম জাখোলের পর আর যাবে না-কেননা খচ্চর যাবার মতো রাস্তা নেই ৷ দুটো দিন নষ্ট হবার ভয়ে আমরা বললাম-তোমার কাছে যে খচ্চর আছে তাই দাও ৷

অনিচ্ছা সত্বেও সে তাই করল-একটু দেরিও হল সেগুলোকে সাজগোজ করাতে ৷ স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে আমাদের গতকালের কথোপকথন-‘মর জায়গা আপলোগ’ এই সব কথা খচ্চরগুলো আড়ি পেতে শুনেছিল কিনা কে জানে! তারা কিছুতেই যাবে না ৷ অনেক সাধ্যসাধনার পরে তারা ব্যাজার মুখে একটু নড়েচড়ে ধীরলয়ে চলতে শুরু করল ৷ আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ৷ কিন্তু খচ্চরগুলো অতটা ভদ্রলোক ছিল না ৷ সতেরো বছর আগে ব্রেক ড্যান্স কী তখনও জানতাম না ৷ দেখা তো দূরস্থান ৷ এতদিন পরে সেদিনের কথা ভাবলে মনে হয় খচ্চরগুলোর শিক্ষা-দীক্ষার যথেষ্ট অভাব থাকলেও ওই বিষয়ে তারা প্রত্যেকে যথেষ্ট পারঙ্গম ছিল ৷ দশ পা যেতে না যেতেই তারা সব কটা হাত পা ছুঁড়ে এমন নৃত্য শুরু করে দিল যে আমরা সবাই এক লাফে খচ্চরওয়ালার পিছনে লুকোলাম ৷ একটু পরে দেখি আমাদের সযত্নে প্যাক করা জিনিসপত্র চতুর্দিকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় আর পাহাড়ের ঢালে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিচ্ছে ৷ আর খচ্চরগুলো এমন গা-জ্বলুনি স্টাইলে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে যেন কিছুই হয়নি ৷

পরদিন অবশ্য কুলির পিঠে মাল পৌঁছে গেল জাখোলে ৷ সেখান থেকে খচ্চর বা কুলি না পেয়ে স্থানীয় স্কুলের বেশ কিছু জোয়ান ছেলে আমাদের মাল নিয়ে চলল পরবর্তী গ্রাম লেওয়ারির দিকে ৷ পথে পড়ল ফিতারি গ্রাম ৷ সেখানকার লোকেদের কী কৌতূহল! কোনওদিন শহরের লোকজন দেখেনি ৷ আমাদের কথা শোনার পর ওদের সুখ দুঃখের কথা শুনতে হল ৷ সুখের কথা প্রায় হলই না ৷ নানা দুঃখের গল্পমালার এক দুঃখের নায়ক একটি বাচ্চা ছেলে ৷ বছর পাঁচ-ছয় বয়স হবে ৷ কবে পড়ে গিয়ে মাথায় একটু কেটে গিয়েছিল ৷ সেটা পেকে পুঁজ জমে এক মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করেছে ৷ তাকানো যাচ্ছে না ৷ বাচ্চাটা নির্বিকার ৷ আমাদের সময়ের টানাটানি ছিল ৷ তবু এই বাচ্চাটার কষ্ট কিঞ্চিৎ লাঘব না করলে ভগবান আমাদের ক্ষমা করতেন না ৷ তাই ডাক্তার অঞ্জন প্রয়োজনমতো চুল কেটে, গরম জল করে ভালো করে ধুয়ে, ওষুধ গজ দিয়ে জায়গাটা মেরামত করে দিয়েছিল ৷ ফেরার সময় দেখেছিলাম মাথাটা একেবারে পরিষ্কার ৷ কে বলবে এইখানে একটা মারাত্মক ক্ষত ছিল! এত ভালো লাগছিল! এই অভিযানে আমাদের কার কী উপকার হয়েছিল জানি না, কে কী জয় করেছে তাও জানি না ৷ কিন্তু বাচ্চাটা, তার পরিজন এবং সেই সঙ্গে গ্রামের সমস্ত লোকজনের মন যে আমরা জয় করেছিলাম, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ৷

শেষ গ্রাম লেওয়ারি পৌঁছে পরদিন সকালে দেখলাম গ্রামের এক কর্মব্যস্ত রূপ ৷ এই কর্মযজ্ঞের আসল কারিগর অবশ্য সবই মেয়েরা ৷ কেউ ছাগল ভেড়া গরুর জন্য ঘাসপাতা কেটে আনছে, কেউ ঝরনা থেকে খাবার জল নিয়ে আসছে, কেউবা জ্বালানির শুকনো ডালপালার বোঝা নিয়ে আসছে ৷ সবই দড়ি বেঁধে আনা ৷ দড়ি বোঝার একদিক থেকে এসে কপাল ছুঁয়ে বোঝার অন্যপ্রান্তে মিলিত হয়েছে ৷ পাহাড়ি মেয়েদের এই কপালটাই সব থেকে খারাপ ৷ ছেলেরা যখন রোদে আরাম করে বসে তামাক সেবন করছে, মেয়েরা তখন এই কপালগুণেই উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলেছে ৷ অনন্তকাল বোধহয় এই ভাবেই কাটাতে হবে ওদের ৷ সমস্ত পাহাড়ি অঞ্চলেই মোটামুটি এই একই চিত্র ৷ সর্বংসহা এই নারীকুলের অবস্থা ফেরানোর কোনও পথই বোধহয় খোলা নেই ৷

লেওয়ারি থেকে দুদিন হাঁটার পর সুপিন উপত্যকার শেষ প্রান্তে আমরা পৌঁছে গেলাম ৷ ঘাসে ছাওয়া মোটামুটি এক বিস্তৃত সমতল ক্ষেত্র ৷ উচ্চতা চার হাজার মিটারের সামান্য কম ৷ এখানেই মূল শিবির পড়ল ৷

সবাই যখন মূল অভিযানে অংশ নিতে আরও দুর্গম, পার্বত্য, হিমবাহ অঞ্চলে উঠে যেত, আমি তখন সারাদিন একা একা এই শিবির সামলাতাম ৷ সন্ধের আগেই অবশ্য ডাক্তার অঞ্জন এবং আরেকজন মালবাহক মূল শিবিরে ফিরে আসত ৷ সঙ্গে ওপরের অভিযানের অগ্রগতির সংবাদ আর এখান থেকে পরদিন কী কী জিনিস ওপরে লাগবে তার একটা ফর্দ ৷ আমি সেটা গুছিয়ে মালবাহককে দিতাম ৷ পরদিন খুব সকালে ও আর ডাক্তার আবার চলে যেত ওপরের শিবিরে ৷ আমি আবার একা ৷ দুদিকে গগনচুম্বী গিরিশিরা, মধ্যে এই প্রশস্ত প্রায় সমতল জমি, যার মধ্য দিয়ে সুপিনের বহুধাবিভক্ত ধারা মেয়েদের চুলের বিনুনির মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে ৷ জলের গভীরতা খুবই কম ৷ এক হাঁটুও হবে না ৷ কিন্তু অসম্ভব ঠান্ডা ৷ হিমবাহের মুখ এখান থেকে খুবই কাছে ৷ ওই হিমবাহের পিছনে দেখা যেত এক শ্বেতশুভ্র উত্তুঙ্গ পর্বতশৃঙ্গ ৷ এই বরফের রাজ্য নানা সময়ে, কখনও কুয়াশায়, কখনও মেঘের আড়ালে, কখনও বা ভোরের নরম আলোয়, কখনও মধ্যাহ্নের তীব্র রোদে অথবা কখনও চাঁদের মোহিনী আলোয় নানা রূপ ধারণ করত ৷ সব মিলিয়ে এই প্রত্যন্ত প্রদেশে, অসম্ভব প্রাণবন্ত অথচ প্রশান্ত নির্জন পরিবেশে, সারাদিন প্রায় একা থাকার ফলে এই অনুপম প্রকৃতির পবিত্র প্রসন্নতা প্রতি পলে প্রবাহিত হত আমার মনের গভীরে ৷

একদিন অঞ্জন সকালে আর ওপরে গেল না ৷ দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বলল-চলুন একটু ঘুরে আসি ৷ আমাদের শিবিরের উত্তরে যে পাহাড়ের ঢাল, আমরা তাই বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম ৷ যত ওপরে উঠছি ঠান্ডা হাওয়ার তীব্রতা তত বাড়ছে ৷ তাঁবু নিয়ে নিচে পুরো অঞ্চলটা আমাদের চোখের সামনে খুলে গেল ৷ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হাজারও ফুলের মেলা ৷ যত ওপরে যাচ্ছি ততই ফুলের পরিমাণ কমে আসছিল ৷ ডাক্তার বরফের রাজ্যে যেতে চাইছে ৷ আমি তাই নিচে যেদিকে ফুল বেশি সেদিকেই চললাম ৷ এ যেন আরেক ‘ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স’-অল্প ঘাসের সঙ্গে শুধু ছোট ছোট হাঁটু সমান ফুলের গাছ ৷ আমার মনে আছে একটা পাথরের ওপর বসে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে আমার হাতের নাগালের মধ্যে আমি পনেরো-ষোল রকমের ফুল দেখেছিলাম ৷ আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ফুলের মেলায় একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি ৷ এমন সময় দেখি একটু দূরে একটা ছোট্ট ঝোপের ওপর কম করে পঞ্চাশ-ষাটটা হাল্কা আকাশি রঙের মাঝারি মাপের অদ্ভূত আকারের ফুল ধরে আছে ৷ এতক্ষণ ধরে যে ফুল দেখেছি তার থেকে এ সম্পূর্ণ আলাদা ৷ আমি সেই ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলাম ৷ হাত বাড়িয়ে যেই একটা ফুল ছুঁতে গেছি, তখনই এই অনন্যা প্রকৃতির এক আশ্চর্য কবিতা রচিত হল ৷ আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই আকাশী ফুলগুলো, যা আসলে প্রজাপতি ছিল, নিঃশব্দে হাসতে হাসতে উড়ে গেল ৷ মনে হল যেন অনেক ফুলের পাপড়ি এক সঙ্গে ডানা মেলে দিয়েছে ৷ আমি বিস্ময়ে হতবাক ৷ একটা ঘোরের মধ্যে তাঁবুতে ফিরে এলাম ৷

এরপর একদিন অভিযান শেষ হল ৷ আমরা ফিরে এলাম লেওয়ারি হয়ে জাখোল ৷ তার পরদিন বত্রিশ কিলোমিটার পথ একদিনে পার হয়ে নেমে আসতে হবে মোরি ৷ দুপুরে নাইটওয়ারের এক হোটেলে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ক্লান্ত পায়ে মোরির রাস্তায় হাঁটছিলাম ৷ পাশে পাশে তীব্র বেগে ধেয়ে চলেছে যৌবনমদমত্তা তন্বী তমসা ৷ অন্য পারে শুধু ঘন পাইনের শনশনানি ৷ বিকেলের রোদে কোনও তেজ নেই ৷ যেখানেই ভালো লাগছে সেখানেই পাথরের ওপর বসে পড়ছি ৷ তমসার প্রবহমান স্রোতের দিকে চেয়ে কেমন উদাস হয়ে যাচ্ছিলাম ৷ আজ যেন অনেকদিন পরে ছুটি পেয়েছি ৷ কোনও দুশ্চিন্তা নেই ৷ উদ্বেগ নেই ৷ ঠিক সময়ে পৌঁছনোর তাড়া নেই ৷ জেতাও নেই ৷ নদীর স্রোতে খড়কুটো যেমন লক্ষ্যহীন ভাবে ভেসে যায়-মাঝে-মধ্যে পাথরে গাছে আটকে গিয়ে একটু থিতু হয়, আবার একটু বাদে জলের তোড়ে আপন মনে ভেসে চলে-আমাদের চলার ধরনটাও ছিল প্রায় সেইরকম ৷ এ যেন, ঘর ছাড়া পথিকের সমস্ত চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে অনন্তের পানে নিশ্চিন্ত ভ্রমণ ৷ এর শুরু হয়তো আছে, শেষ নেই ৷

ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০২

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন