সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

বাঘ দেখতে সুন্দরবন যাইনি আমি ৷ প্রায় আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটারে যেখানে মাত্র দুশো তেষট্টিটি বাঘ আছে সেখানে বাঘ যে দেখতে পাব না-তা তো অঙ্কের হিসেবেই বলে ৷ সত্যি সত্যি প্রতি বর্গকিলোমিটারে ০.১০৫৮৭৭৬টির মতো বাঘ থাকার কথা, কিন্তু আমাদের খুশি করার জন্য আধখানা বাঘও যে থাকবে, তার গ্যারান্টি কোথায়? এম ভি চিত্ররেখা নামে ওই ‘লাক্সারি’ লঞ্চে সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ রাজেন চক্রবর্তী মশাই এইরকম একটা পরিসংখ্যানই দিলেন ৷ আড়াই হাজার (আসলে ২৪৮৪) বর্গকিলোমিটার হল পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন এলাকা ৷ এর প্রায় দ্বিগুণ অঞ্চল আছে বাংলাদেশে ৷ সেখানে কতজন বাঘ আছেন এবং আমাদের বাঘেরা তাঁদেরই আত্মীয়স্বজন কিনা তা অবশ্য বলতে পারব না ৷ তবে পৃথিবীতে বাঘ আমরা মানুষেরা মেরে শেষ করে এনেছি (বীরত্বে আমাদের বুক ফুলে উঠুক), সুন্দরবন ছাড়া রয়্যাল বেঙ্গল জাতীয় বাঘের দেখা আর খুব বেশি জায়গায় পাওয়া যাবে না ৷ সেরকম দেখা পান ব্যাঘ্রবিশেষজ্ঞরা ৷ আমরা সাধারণ মানুষেরা বাঘের গুজব শুনেই সন্তুষ্ট থাকি ৷

আমি সুন্দরবন গিয়েছিলাম শুধু জল আর জঙ্গল দেখব বলে ৷ ভ্রমণ পত্রিকা এবং পর্যটন উন্নয়ন করপোরেশন ব্যবস্থা করেছিলেন, ফলে গত ৩১ অক্টোবর সকাল সাতটায় পৌঁছে গেলাম ডালহৌসিতে পশ্চিমবঙ্গ ট্যুরিজমের অফিসে ৷ মেরিন ভেসেল চিত্ররেখায় কেবিনে সিট বুক করা আছে, আমাকে তাতে আসীন হয়ে শনি-রবিবারের সুন্দরবন দেখা সেরে আসতে হবে ৷ চমৎকার! কিন্তু আগের দিন কলকাতা বৃষ্টিতে প্রায় ডুবে গিয়েছিল, সকালে যখন বেরোই তখনও আকাশ মেঘাক্রান্ত এবং টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে ৷ ফলে মনে উদ্বেগ ছিল ভ্রমণসূচি আদৌ বজায় থাকবে কি না ৷ ভোর ছটায় ফোন করতে একজন (ভোর ছটাতেই অফিসে এসে গেছেন দেখে ভালো লাগল) ঘুম ভাঙা স্বরে বললেন, ‘দ ট্রিপ ইজ অন ৷’ সুতরাং বাড়ি ছেড়ে বেরোতেই হল ৷ ডালহৌসিতে বৃষ্টি থামল এবং তখনও কি ভাবতে পেরেছিলাম যে, মেঘ সম্পূর্ণ সরে গিয়ে উজ্জ্বল রোদ উঠবে এবং পুরো দুটো দিন সুন্দরবনের জল জঙ্গল আকাশ বাতাস তাদের পরিপূর্ণ মহিমা নিয়ে আমার সামনে উন্মোচিত হবে?

ডালহৌসিতে আমাদের একটি প্রাইভেট কোচ-এ উঠে বসতে বলা হল ৷ সিটে যেহেতু নম্বর দেওয়া, ফলে সামনে জানলার ধারে বাঁদিকে একটি সিট পেয়ে বর্তে গেলাম ৷ ড্রাইভারের পিছনকার দেওয়ালের মাথায় কেন জানি না একটি লন্ডন ব্রিজের ছবি লাগানো, দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠল ৷ কয়েকটি গুজরাটি পরিবার উঠলেন, আর বাঙালি বলতে আরেকজন, উনিও প্রবাসী ৷ কানপুরে মানুষ, আর দীর্ঘদিন কানাডার নিউ ব্রানসউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্যাটিস্টিক্সের অধ্যাপক ৷

আমি বোকার মতো ভেবেছিলাম যে, এ বাস আমাদের গঙ্গায় চাঁদপাল ঘাটে নিয়ে যাবে, সেখান থেকে গঙ্গাপথে আমরা সুন্দরবন যাব ৷ দেখলাম ব্যাপারটা ঠিক তা নয় ৷ বাসে যেতে হবে বাসন্তীর এপারে সোনাখালি বন্দরে, সেখানে গিয়ে আমরা এম ভি চিত্ররেখাতে চড়ব ৷ সোনাখালি কলকাতা থেকে আটানব্বই কিলোমিটার, যেতে সাড়ে তিনঘণ্টার মতো লাগবে ৷ শুনলাম প্রাইভেট লঞ্চ ভাড়া করে এই একই পরিক্রমা করা যায়-সেগুলো ছাড়ে ক্যানিং থেকে ৷ তবে তাতে বড় দল হলে ভালো হয় ৷

বাস ঠিক সাড়ে সাতটায় ছাড়ল আর পার্ক সার্কাস কানেক্টার হয়ে ধাপার পাশ দিয়ে সোনাখালির পথ ধরল ৷ আগে ধাপা কীরকম ছিল সবাই জানেন ৷ একসময় আমাকে দুবেলা তার পাশ দিয়ে যাতায়াত করতে হত, নাকে রুমালসুদ্ধ হাত প্রায় যান্ত্রিকভাবে উঠে যেত, তাই আমি তার নাম দিয়েছিলাম গন্ধমাদন পাহাড় ৷ এখন আর ধাপাকে সেই নামে ডাকবার উপায় নেই ৷ চমৎকার একটি বাগানে বদলে যাচ্ছে সেই আবর্জনাস্তূপ ৷ খুব শিগগিরই তা কলকাতার আরেক দর্শনীয় জায়গা হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই ৷

এই রাস্তা দিয়ে আগেও গেছি ৷ সেই বানতলা, নতুনবাজার, ঘটকপুকুর ইত্যাদি হয়ে গ্রামগঞ্জের মাঝখান দিয়ে যাত্রা ৷ ঘটকপুকুরে চা হল, তার আগেই কেটারার রসনা চটপট সকলের কোলে জলখাবারের প্যাকেট আর হাতে মিনারেল ওয়াটারের বোতল পৌঁছে দিয়েছিল ৷ বানতলা-ঘটকপুকুর হয়ে ঘুসিঘাটা পর্যন্ত সাধারণ গ্রাম্যপথ-একদিকে বাঁয়ে চলেছে কলকাতার নোংরা জলের নিকাশি নালা, তার কালো স্থির জল ক্রমশ চওড়া হচ্ছে, অন্যদিকে ঘরবাড়ি, কখনও লেদার কমপ্লেক্সের জন্য বড় বড় পাঁচিল ঘেরা জায়গা ৷ তার পিছনে ধানখেত ৷ সবই ঘন সবুজ, আর গতকালকার বৃষ্টিতে আপাদমস্তক স্নান করে গাছপালা সব ফুর্তিতে ঝলমল করছে ৷ নিকাশি খালের ওপারে বাবলা বা সুবাবুলের ঝোপ জলের ওপর ঝুঁকে আছে, রাস্তার ধারে অজস্র শিশু, অ্যাকেশিয়া বা আকাশমণি, কোথাও কোথাও এমনকী ইউক্যালিপ্টাস আর দেবদারু ৷ আর গ্রামের নিসর্গচিত্রের সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য আমার চোখে পড়ে তা হল ঝোপঝাড়ের ওপর অজস্র লতার রাজ্যপাট-ধুঁধুলের লতা, কুঞ্জলতা, কখনও বা একটা-দুটো স্বর্ণলতায় আক্রান্ত গাছ ৷

ঘুসিঘাটা থেকে ডানদিকে ঘুরে গেল পথ, আর গ্রামীণ দৃশ্যও বদলাল একটু ৷ এবার যেন রাস্তা একটু নিচে নেমে এল, তার দুপাশে মাছের ভেড়ি, ধানজমি (এগুলোই কি আবার ধান উঠে গেলে ভেড়ি হয়ে যায়?) আর তার মধ্যিখানে ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া মোমবাতির মতো চিমনিওয়ালা ইটভাটি ৷ চতুর্দিকেই নানা আয়তনের জলের প্রাচুর্য ৷ বাড়ির চারপাশে জল, সেখানে উঠোনে গাছতলায় বসে বাড়ির বউ ছিপ ফেলছে সেদিনকার মতো আমিষব্যঞ্জনের উপাদান সংগ্রহের জন্য; ধানখেতে ধানগুলো কোমরজলে দিব্যি খুশি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মাথায় ঘন শস্যের অলংকরণ ৷ রাজহাঁস থেকে শুরু করে নানা আকারের হাঁস চরছে, রাস্তার ধারে শান্ত গরুবাছুর এই লাক্সারি বাস নামক প্রাণীটার রহস্য বোঝবার চেষ্টা করছে ৷ ভেড়ির প্রশস্ত আয়তক্ষেত্রাকার জল, আর প্রান্তে পাহারা দেবার ঝুপড়ি-মাচান ৷ এদিকে বাড়ির চারপাশে মর্নিং গ্লোরির বেড়া, কখনও-বা রাংচিতা গাছের ঘের ৷ এধরনের রাংচিতার বেষ্টনী এই দক্ষিণ অঞ্চলেই বেশি দেখা যায় ৷ গ্রীষ্মে এগুলোতে ভারি সুন্দর লাল ফুল ফুটবে ৷ মালঞ্চতে বড় মাছের বাজার ৷ সেখান থেকে আবার ডানদিকে ঘুরে, রাজবাড়ি সরবেড়িয়া কুলতলি ইত্যাদি হয়ে আমরা প্রায় এগারোটা পঁচিশ নাগাদ সোনাখালি পৌঁছলাম ৷

বাস যেখানে থামল সেখান থেকে ঘাট আধ কিলোমিটারও হবে না ৷ আমাদের দলের সঙ্গে জুটে গেল অজস্র প্রত্যাশী দরিদ্র শিশু ৷ তারা হাত বাড়িয়ে মৃদুস্বরে গুঞ্জন করছে, না হয় মাল বহন করে কিছু পাবার অধিকার প্রার্থনা করছে ৷ যাঁদের হাতে বহন করার মতো মালপত্র ছিল তাঁরা সকলেই স্বাবলম্বনকেই শ্রেষ্ঠ পন্থা বিবেচনা করলেন ৷ যাত্রী এবং প্রার্থী বালকবালিকাদের মিছিল পারঘাটাতে এসে শেষ হল ৷ তারপর একটি ভটভটিতে চড়ে আমরা হোকর নদীর মাঝখানে নোঙর করে রাখা এম ভি চিত্ররেখা নামে সুন্দর লঞ্চটিতে গিয়ে উঠলাম ৷ লঞ্চটি স্থির, কিন্তু তার ইঞ্জিনটি জেগে আছে, তার একটি ‘হামিং’ আওয়াজ আর মৃদু কম্পন আমরা উঠেই টের পেলাম ৷ কেন জানি না, ব্যাপারটা বেশ ভালো লেগে গেল ৷ এক নম্বর কেবিনে আমার আর অধ্যাপক ব্যানার্জির জায়গা হয়েছিল ৷ কিন্তু আমরা দুজনেই কোনওরকমে কেবিনে ব্যাগ সামিল করে দিয়ে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত ছাদের ডেকে চলে গেলাম ৷ এর পর যে ছত্রিশ ঘণ্টা কাটবে এই লঞ্চে তাতে এই কেবিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কমই থাকবে ৷ কেবল রাতে ঘণ্টা ছয়েক ঘুমের জন্য আমরা খুব অনিচ্ছাসত্বে তার মধ্যে ঢুকব ৷ এতে কেবিন সম্বন্ধে কোনও নিন্দামন্দ করছি না আমরা ৷ তিন সিটের এই কেবিন চমৎকার সাজানো, ফ্যান, আলো, টেলিফোন, আয়না সবই আছে, বাথরুমটিও আয়না, শাওয়ার ইউরোপীয় কমোড-সজ্জায় সজ্জিত ৷ কিন্তু সুন্দরবন দেখতে এসে কেবিনে সময় কাটায় কোন মূর্খ?

ছাদের ঢাকা ডেকে টেবিল চেয়ার সাজানো রেস্তোরাঁর মতো খাবার জায়গা, আবার পাইলটের ঘরের সামনে আর দুপাশেও চেয়ার ৷ আমরা প্রত্যেকে চেয়ার দখল করে বসে গেলাম, গুজরাটি পরিবারের অর্ধডজন বালক-বালিকা হৈ হৈ করতে লাগল, অনেকের ক্যামেরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে; তারই মধ্যে নোঙর তুলে লঞ্চ ছাড়ল ৷ ইলেক্ট্রিক হর্নের শব্দ করে, হোকর নদীতে পিছনে লম্বা ত্যারছা ঢেউ তুলে তুলে সে এগোতে লাগল ৷ এটা সুন্দরবনের আবাদ হাসিল করা বসতি এলাকা ৷ আমাদের লঞ্চ বসতি এলাকা ছাড়িয়ে আজ ঢুকবে মধ্যস্থ এলাকা বা ‘বাফার জোন’-এ ৷ তারপর কাল যাবে কেন্দ্রীয় বনাঞ্চল বা ‘কোর এরিয়া’তে ৷

বসতি অঞ্চলের একটা চিহ্ন হচ্ছে নদীর ধারে ধারে লাল ইটের বাঁধ ৷ এসব বাঁধের ওপর দিকে লাল রং এখনও কিছুটা বজায় আছে ৷ তার তলায় যে স্তরটা তাতে গভীর কালো ছোপ এবং তারও নিচে শ্যাওলা-পড়া সবুজ রং ধরেছে ৷ নিচের দিকে নদীর আঘাতে-আঘাতে বাঁধের দেওয়াল ভেঙে চুরমার, আলগা ইট ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, জলের তলায় চলে গেছে কিছু ৷ এখন ভাঁটা চলছে বলেই হয়তো এসব দেখা যাচ্ছে ৷ বাঁধের এদিকেও নদীর পাড় বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে ৷ কোথাও কোথাও বন্যার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে হালকা সবুজ ঘাস-গুল্ম গজিয়েছে ৷ তাতে ছাগল চরছে; কিন্তু ছাগলদের একটা বিশেষত্ব হল, তারা ঘাস ছেড়ে শূন্য কাদাভর্তি পাড়ে কোনও কিছুর সন্ধানে ব্যস্ত-সেখানে তারা কী খেতে পাবে জানি না ৷ পাড়ে মাঝে-মধ্যে খড়ের চালাঘর, তার পাশে হয়তো একখানা বাঁশের খুঁটিওয়ালা বেঞ্চি-তাতে বসে ছোট ছেলেমেয়েরা আমাদের দেখে চ্যাঁচাচ্ছে আর হাত নাড়ছে ৷ পাশ দিয়ে যেসব ভটভটি যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে, তার ছাদে দাঁড়িয়েও দুয়েকটি শিশু হাত নাড়ছে-আমরাও তাদের দিকে হাত নেড়ে দিচ্ছি ৷ এর মধ্যে আকাশে নীলের ফাঁকফোকর ক্রমশ বিস্তারিত হচ্ছে এবং মনে হচ্ছে অন্তত এ যাত্রা রৌদ্রের বাহিনী যুদ্ধ জিতে গেল, সূর্য আবার তাঁর রাজ্যপাটের দখল নেবেন ৷ ডেকে চমৎকার ঠান্ডা হাওয়ার প্রলেপ খেতে খেতে আমরা এইসব দৃশ্য দেখছি ৷

ভাঁটার জন্য নদীর গভীরতা কম ৷ লঞ্চকে অনেক সাবধানে গভীর অংশ ধরে এঁকেবেঁকে এগোতে হচ্ছে ৷ তার সামনে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে দড়ি দিয়ে জল মেপে চলেছে ৷ ফলে প্রথমে যেখানে গিয়ে ভিড়বার কথা-সেই সুধন্যখালি ব্যাঘ্র প্রকল্পে পৌঁছতে আড়াই ঘণ্টার মতো লাগবে বলে রাজেনবাবু জানালেন ৷ পরদিন জোয়ারে এই রাস্তাটুকুই চল্লিশ মিনিটে চলে এসেছিলাম ৷ যেতে যেতে মধ্যাহ্নভোজন দিয়ে দেওয়া হল, ওপরের কাউন্টারে ছেলেরা সেই ট্রেনের ঘর-ঘর কাটা ট্রেতে পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে ফেলল, তারপর টেবিলে টেবিলে সার্ভ করে গেল ৷ আমরা এর মধ্যে দুর্গাদোয়ানি নদীর তীরে গোসাবা বন্দর ছাড়িয়ে গেলাম ৷ এটি যে হ্যামিল্টন সাহেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটা রাজেনবাবু উল্লেখ করতে ভুললেন না ৷

আমরা সুধন্যখালি ব্যাঘ্র প্রকল্পের দিকে চলেছি, আর মানুষের পৃথিবী ক্রমশ পশ্চাদপসরণ করছে ৷ এগিয়ে আসছে জল আর জঙ্গল, সেখানে গাছপালা, নদী আর আকাশ ছাড়া আর জনপ্রাণীর দেখা নেই ৷ অবশ্য কিছু পাখি দেখতে পাচ্ছি, দুয়েকটি বক, কয়েকটি মাছরাঙা ৷ আমাদের বিনোদনের জন্য কি না জানি না, একটি বাটা জাতীয় ছোট মাছ দুবার জল থেকে কাত হয়ে লাফিয়ে লঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা এগিয়ে গেল ৷ ভটভটি বা জেলেডিঙিও বিরল হয়ে আসছে ৷ সকালে বেরোলে নিশ্চয়ই আরও অনেক জেলেডিঙির দেখা পাওয়া যেত ৷ আরেকবার যখন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার সভাধিপতি নন্দদার দাক্ষিণ্যে ধেমোখালি থেকে বুড়ির ঢাবু পর্যন্ত ঘুরে এসেছিলাম তখন সকালে প্রচুর জেলেডিঙি নাইলনের হালকা জাল পেতে বসে আছে দেখেছিলাম ৷ তাদের নৌকোর নোঙরগুলো ছিল খুব অদ্ভুত ৷ একটা মোটা প্লাস্টিকের ব্যারেলের সঙ্গে দড়ি জড়িয়ে দড়ির আরেক প্রান্তে পাথর বা ইট বেঁধে জলে ছেড়ে দাও-ব্যস, সেটা একটা ‘বয়া’ হয়ে গেল ৷ এবার ওই বয়ার সঙ্গে নৌকোর নাকের দড়ি বেঁধে দিয়ে যতক্ষণ খুশি ভেসে থাকো ৷ ছোট ছোট সাদা বেলুনের মতো বয়াও ভাসতে দেখেছিলাম ৷ নৌকোগুলোতে ভারতীয় পতাকা লাগানো ছিল, শুনেছিলাম বাংলাদেশের যেসব নৌকো আসে সেগুলো থেকে আলাদা করার জন্যই সে ব্যবস্থা ৷ বাংলাদেশের নৌকোও তখন বেশ কয়েকটা চোখে পড়েছিল ৷ তাতে নৌকোর পিছনে তাদের জাতীয় পতাকা উড়ছে ৷

আর দেখেছিলাম ‘মীনশিকারি’দের ৷ আবালবৃদ্ধবনিতার দল একা একা নদীর ধার ঘেঁসে বুকজলে হেঁটে চলেছে, দড়ি ধরে টেনে নিয়ে চলেছে একটা হাতজাল ৷ সে জালে ধরা পড়বে চিংড়ির মীন, যা ভেড়িতে বা চিংড়িপালনের ফার্মে চড়া দামে বিক্রি হবে ৷ এতে তাদের দৈনিক একশো-দেড়শো টাকা রোজগার হবে ৷ সহযাত্রীরা দুঃখ করছিল, চিংড়ির পোনা বেছে নিয়ে তারা অন্য মাছের পোনাগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দেয়, এতে প্রচুর মৎস্যসম্পদ নষ্ট হয় ৷

এবারে দুপুর পেরিয়ে যাওয়া রৌদ্রে এসব দৃশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করেনি ৷ অনেক নৌকো শুকনো ডাঙায় তাদের ঘন আলকাতরা মাখানো পিঠ দেখিয়ে কাত হয়ে শুয়ে হাওয়া খাচ্ছিল, কারও বা পিঠে লাগানো ছিল বাঁশের ঠেকা ৷ তারা ছিল মেরামত ও প্রসাধনের অপেক্ষায় ৷ আর নদীর পাড়ে জলধারা নেমে তৈরি করেছে বহু ছোট বড় খোয়াই, কোথাও বা খাড়ি চলে গেছে ভেতরে ৷ খাড়ি আপাতত শুকনো, তার মধ্যেও বিশ্রাম করছে কিছু নৌকো ৷ খাড়িটি যেন নৌকোর সাময়িক গ্যারেজ ৷ আর আমরা দেখেছিলাম ভাঁটার টানে জল সরে নেমে আসায় সুন্দরী ও অন্যান্য গাছের অনেকগুলো শিকড় বেরিয়ে পড়েছে, যেন একগাদা শিকড়ের ঠেকনোর ওপর ডালপালা মেলে খাড়া হয়েছে গাছগুলো, তাদের কাণ্ডের দেখা নেই ৷ ভালো কথা, এত বয়স পর্যন্ত আমাদের ধারণা ছিল যে, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট মানেই বুঝি সুঁদরি গাছের জঙ্গল-অর্থাৎ ম্যানগ্রোভ হল সুঁদরি গাছ-যার থেকে নাম হয়েছে সুন্দরবন ৷ রাজেনবাবু জানালেন মোটেই তা নয়, সুঁদরি, ক্যাওড়া, হেঁতাল, গরান ইত্যাদি যাবতীয় গাছের একটা যৌথ নাম ম্যানগ্রোভ ৷ বাড়িতে এসে ওয়েবস্টার সাহেবকে সাক্ষী মানলাম ৷ দেখলাম যে হ্যাঁ, তিনিও লিখেছেন-গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে জলাভূমি অঞ্চলে যেসব গাছ ভেজা নরম মাটি আঁকড়ে থাকার জন্য শিকড়ের অধোগামী ডালপালা মেলে দিয়ে মাটির সঙ্গে শক্তপোক্ত বন্ধন তৈরি করে সেসবের সমষ্টিগত নাম ম্যানগ্রোভ ৷ শুধু যে তারা শিকড়ের ডালপালা মাটির ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে তা নয়, একেবারে ভেতর অংশে দেখলাম মাটির তলা থেকে আবার ছোট ছোট অ্যান্টেনার মতো অজস্র শিকড় মাটি ফুঁড়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ এগুলো শ্বাসমূল, নোনা জল সরে গেলে বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয় ৷

সুধন্যখালিতে পৌঁছে দেখি, তার ধাপে ধাপে বেয়ে নামা কাঠের সিঁড়িওয়ালা ঘাটটি ভেঙে চুরে হাড়গোড় ভাঙা ‘দ’ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে ৷ চক্রবর্তী মশাই বললেন, এখন সুধন্যখালি ব্যাঘ্র প্রকল্পে লঞ্চ ভেড়ানো সম্ভব নয়, কাল সকালে ফেরার পথে চেষ্টা করা যাবে ৷

এবার চলো সজনেখালি ৷ আরও ঘণ্টা আড়াই পথ ৷ রাজেনবাবুরা বারবার বলতে লাগলেন বাঘ দেখা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করবে ৷ আমাদের পুরো সফরে এই ভাগ্য একেবারেই পলাতক ছিল, থাকবে যে এরকম আমি জানতাম ৷ বস্তুতপক্ষে পর্যটকদের কাছে বাঘ দেখা যাবে এমন আশা তৈরি করার কোনও অর্থ হয় না ৷ বাঘ ছাড়াই সুন্দরবনের অন্য আকর্ষণ আছে ৷

সজনেখালিতে একটি বেশ ভালো যাত্রীনিবাস আছে ৷ ইটের বড় বড় দেওয়ালের ওপর দোতলায় কাঠের ঘর-প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে সবুজ রং করা ৷ সামনে সুন্দর বাগান ৷ রাজেনবাবু আমাদের সাবধান করে বলেছিলেন, নেমেই সোজা ওয়াচ টাওয়ারের দিকে দৌড়বেন ৷ টাওয়ারে উঠে বাঘ দেখার চেষ্টা করবেন ৷ সত্যি দৌড়ে টাওয়ারে গিয়ে উঠলাম ৷ দেখা গেল, জঙ্গলের মধ্যে গোটা তিনেক জায়গা পরিষ্কার করে যেন তিনটি রাজপথ মতো তৈরি করা হয়েছে ৷ সেসব খোলা অবকাশে বাঘ বেরিয়ে এসে আমাদের ‘গুড আফটার নুন’ বলতে পারে এমন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হল না ৷ তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের চোখে জল আসার মতো অবস্থা হল এবং গাছের গুঁড়ি, মাটির স্তূপ, শুকনো ডাঙা ডাল ইত্যাদি যাবতীয় কিছুকে আমরা বাঘ কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হবার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না ৷ শেষে আরেকটা খোলা জায়গায় কিছু হরিণ আর বাঁদর দেখে ছেলেমেয়েরা হৈ হৈ করে উঠল, দুয়েকজন ক্যামেরার টেলিফোটো লেন্স বাগিয়ে ধরলেন ৷ হরিণ দেখা অবশ্য এমন কিছু নয় ৷ আসার পথে নদীর ধারে আমরা আরও দুদল হরিণ দেখেছি-গলা উঁচু করে তারা গাছের পাতা খাচ্ছে ৷ বাঘেদের যেমন লোকলজ্জা, হরিণদের তেমন কিছু নেই ৷

টাওয়ার থেকে নেমে আমরা ঘের-দেওয়া কুমিরপুকুরে এলাম ৷ শুনলাম সেখানে চারটি কুমির প্রতিপালিত হচ্ছে ৷ কিন্তু আমাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করবার জন্য তারা বিশেষ ব্যগ্র বলে মনে হল না ৷ একদল কী-একটা দেখে, ‘ওই যে, কুমিরের নাক দেখা যাচ্ছে!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল ৷ আমার খুব সন্দেহ ওটা আদৌ কুমিরের নাক ছিল কিনা ৷

সজনেখালিতে একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার বা বাদাবন সংগ্রহশালা ও পরিচিতি কেন্দ্র তৈরি হয়েছে ৷ তাতে সংগ্রহ ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে, এখন ম্যাপ-ট্যাপ কিছু রাখা হয়েছে ৷ পুরো তৈরি হলে এটা বেশ কাজের হবে ৷ আর ব্যাঘ্র প্রকল্পগুলির মধ্যে এটিতেই কেবল মধু পাওয়া যাবে বলে শুনলাম ৷ কাজেই ৪৫ টাকা কেজি দরে মধু কেনবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ৷ একটাই অসুবিধা, পাত্র সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় ৷ অনেকে মিনারেল ওয়াটারের খালি বোতল নিয়ে গেছে ৷ তখন জিজ্ঞাসা করা হল, ওগুলো নোনা জলে ধোয়া হয়েছে কিনা, কারণ মিষ্টি জল লেগে থাকলে মধু নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা ৷ যাই হোক, ওই ঘরেই সাদা প্লাস্টিকের দু-কেজির ব্যারেল কিছু ঝোলানো ছিল ৷ উচিত মূল্যে তা কিনে মধুলোভী কেউ কেউ সমস্যা সমাধান করলেন ৷

এম ভি চিত্ররেখার একটি নিজস্ব ছোট মোটরবোট আছে, তাতে চড়েই আমরা লঞ্চ থেকে তীরভূমিতে যাতায়াত করছি ৷ মধু কিনতে কিনতে সন্ধ্যা নামতে লাগল, সজনেখালির সোলার লাইট বা সৌরদীপ জ্বলে উঠল ৷ আজ রাতে লঞ্চ এখানেই নদীর মধ্যে নোঙর ফেলে থাকবে, এখানেই জলের ওপরে আজ আমাদের রাত্রিবাস ৷

আবার এসে ওপরের ডেকে একটা চেয়ার নিয়ে বসলাম ৷ আকাশে ছড়ানো-ছিটানো মেঘ, তারই মধ্য দিয়ে অস্তগত সূর্যের গোলাপি আভা আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে এল ৷ সামনে নদীর দুদিকে আরও দুটি নদী বেরিয়ে গেছে, তার তীরে তীরে দূরের বনসমাচ্ছন্ন দ্বীপগুলিতে রাত্রি নেমে এল ৷ সমুদ্রের স্বচ্ছন্দ ও শীতল বাতাস শরীরে আরাম ছড়িয়ে দিচ্ছে ৷ দৃশ্যপট মূলত অন্ধকার, অন্য তীররেখা সামান্য জেগে আছে, সেখানে একটি-দুটি সৌরদীপের আলো ম্লান হয়ে জ্বলছে ৷ সজনেখালির অন্য ঘাটে অন্য একটি বেসরকারি লঞ্চে কিছু যাত্রী এসেছে, সেখানেও কোলাহল স্তব্ধ ৷ তাতে স্পিকারে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে, ‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম ৷’ একেবারে ‘মেড-টু-অর্ডার’ সন্ধ্যা, সবাই যেন ব্যবস্থা করছে এই সন্ধ্যাটিকে আমার জন্য অসামান্য মনোরম করে তোলার জন্য ৷ একটু পরেই মেঘ নিঃশব্দে সরে গেল, একটা আকাশের চেয়েও মস্ত বড় আকাশ মাথার ওপর ছড়িয়ে গেল, আর তার গায়ে ফুটে উঠল লক্ষ লক্ষ তারার সলমা-চুমকির কাজ ৷ এত বেশি আকাশ আর কোথায় দেখতে পাওয়া যাবে, এত বেশি গ্রহতারা, এমন দিগন্তব্যাপী আকাশগঙ্গা? আমি তো মনে মনে বলতে লাগলাম-‘আর কি কখনও কবে, এমন সন্ধ্যা হবে?’ আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে এই সন্ধ্যাকে সমস্ত রোমকূপ দিয়ে আত্মসাৎ করতে লাগলাম ৷

অবশ্যই স্তব্ধতায় সকলে অংশ নেয় না, মানবসমাজে তা দীর্ঘায়ু হওয়াও কঠিন ৷ একটু পরে ডিনারের আয়োজন হল প্রখর আলোয় ৷ আর ডিনারের আগে অবশ্যই একটু বিনোদন ছিল ৷ গুজরাটি পরিবারগুলির শিশুরা সারেঙের ঘরের পিছনে উঁচু মতো জায়গাটাকে স্টেজের মতো ব্যবহার করে নানারকম হুল্লোড় করল ৷ কেউ সিলিংয়ের পাইপ ধরে ঝুলতে লাগল সার্কাসের অনুকরণে, দুটি মেয়ে মুম্বই ছবির ‘মেরা নাম চিন চিন চু’ গানের সঙ্গে চমৎকার পুরোদস্তুর নাচ নেচে দিল ৷ ক্যাসেট বাজিয়ে আরও দুয়েকটি গানের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি সহ নিখুঁত নাচ নাচল তারা ৷ আমি অবাক হয়ে বোকার মতো ভাবতে লাগলাম-‘এ তো অসাধারণ ক্ষমতা! একবার-দুবার ছবি দেখেই পুরো নাচটা তুলে নিয়েছে!’ পরে বোঝা গেল তা নয়, তাদের বাড়িতে এসব ছবির ভিডিও আছে, তারা বারংবার দেখে কঠোর অনুশীলন করে এই শিল্প আয়ত্ত করেছে ৷ তারপর কিছুক্ষণ হিন্দি ও ইংরিজিতে নানা জোকস বলা হতে লাগল ৷ তারপর ডিনার-সেদিক থেকে অভিযোগের কিছু ছিল না ৷ তারপরেও আমরা অনেকক্ষণ ওই নক্ষত্রপরিকীর্ণ আকাশের নিচে বসে রইলাম ৷

পরদিন সকালে উঠে দেখি চতুর্দিকে জোয়ার ৷ লঞ্চের স্পিকারে সকালের রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে ৷ চা-পর্ব সাঙ্গ হবার পর যখন লঞ্চ ছাড়ল-প্রথমে কালকের না-দেখা সুধন্যখালি এবং তারপর নেতিধোবানির ব্যাঘ্র প্রকল্পের উদ্দেশে, তখন মনে হচ্ছে সমস্ত অরণ্যপ্রদেশ জলের ওপর ভাসছে ৷ গাছগুলির কাণ্ড বা শিকড়বাকড় কিছু দেখা যাছে না, পাড়ে মাটির চিহ্ন নেই ৷ জলে কোনওরকম মাথাটুকু জাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সব গাছপালা ৷ সুন্দরবনে লম্বা গাছপালা নেই বললেই চলে, ফলে ভয় হচ্ছিল জল আরেকটু বেশি হলেই আর কিছু থাকবে না, তখন ‘জল শুধু জল’ ৷

সুধন্যখালিতে এবার ভিড়ানো গেল মোটরবোট, কিন্তু এখানেও বাঘের দেখা পাওয়া গেল না ৷ টাওয়ারে উঠে বৃথাই দূরবীন কষলেন কয়েকজন ৷ এই ব্যাঘ্র প্রকল্পগুলোর একটা মজা হল, এতে মানুষের জন্যই খাঁচার ব্যবস্থা, পশুরা বাইরে পরম ফুর্তিতে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায় ৷ আমরা ঘাট থেকে তারের জালের ঘের দেওয়া রাস্তা দিয়ে যাই, টাওয়ারে উঠি, আর ওই আপাদমস্তক জালাবরণের রাস্তা দিয়েই ফিরে আসি ৷ অনেকেই দেখালেন পাশে একটি মিষ্টি জলের পুকুর, সেখানে বাঘেরা নাকি জল খেতে আসে, কিন্তু আমরা যখন গেলাম তখন কোনও তৃষ্ণার্ত বা ক্ষুধার্ত বাঘ তার ত্রিসীমানাতেও ছিল না ৷ রাজেনবাবুরা অবশ্য বলেছিলেন যে খুব নিঃশব্দে চলাফেরা করতে হবে আমাদের, মানুষের একটু সাড়া পেলেই বাঘ গা ঢাকা দেয় ৷ কিন্তু শিশুবাহিনীকে নিঃশব্দ রাখা কি চাট্টিখানি কথা?

নেতিধোবানি ব্যাঘ্র প্রকল্পে যেতে লঞ্চ জলের অলিগলি পথের মধ্যে ঢুকে পড়ল ৷ এ হচ্ছে সেই ‘কোর এরিয়া’ বা কেন্দ্রীয় বনাঞ্চল, মানুষের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে ৷ বনবিবিভরানি নদী, সেখান থেকে কলসিমারিতে ঢুকে দেখি দুদিকে গাছপালা খুব কাছে এগিয়ে আসছে ৷ কোথাও মাইলের পর মাইল হেঁতালের ঝোপ ৷ কোথাও ঝাঁকড়া গাছে ঘটের মতো ফল ঝুলে আছে-শুনলাম তারও নাম ধুঁধুল ৷ গাছপালা সব গলা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, লঞ্চের ঢেউয়ে দুলছে তাদের ভাসন্ত ডালপালা ৷ পাখি ছাড়া আর কোনও প্রাণী ধারেকাছে নেই ৷ এদিকে শুধু খালি দিয়ে নাম-নদীর হোক, জায়গার হোক ৷ তাই সুন্দরখালি, বিলখালি, গাজিখালি-এইসব নাম যখন স্পিকারে ভেসে আসছিল তখন সেগুলি নদী না জঙ্গল না দ্বীপ সবই মাথার মধ্যে গুলিয়ে যাচ্ছিল ৷ তারপর পাঁচটি জলধারার বিশাল প্রশস্ত এক মোহনা এসে পড়ল পঞ্চমুখানি-সেখানে পৌঁছলাম দেউলভরানি নদীর পথ ধরে ৷

এই পরিক্রমায় মনে হচ্ছিল, আর কী চাই? এই বিশাল আকাশ, এই অনন্ত জলরাশি, এই সতেজ, অবিরাম আদিম জঙ্গল যার মধ্যে অনেক জায়গাতেই কোনও মানুষের পা পড়েনি-এই কি যথেষ্ট নয় ৷ বাঘ-বাঘ বলে লোকে কেন এত হন্যে হয়? এর আগের বার দেখেছিলাম নদীর পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে গাছের ডালে একটা জামা ঝুলিয়ে রাখা আছে ৷ লঞ্চের লোকেরা বলেছিল, ওটা বাঘে খেয়েছে এমন লোকের জামা ৷ এখানে ঝুলিয়ে লোককে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে যে, এখানে বাঘের ভয় আছে ৷ একদিকে মানুষ বাঘকে ভয় পাচ্ছে, অন্যদিকে বাঘ মানুষের ভয়ে কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে কে জানে ৷ তার চেয়ে শুধু এই নিসর্গ দ্যাখো-প্রকৃতির অকৃত্রিম ঐশ্বর্য-অরণ্য আর জল, আর ওই আকাশ ৷ জীবনানন্দের ভাষায় যাকে বলা যায় ‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে ৷’ এই লঞ্চযাত্রা আমাদের বেশ কিছুক্ষণ ওই অনন্তের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দেয় ৷

নেতিধোবানি ব্যাঘ্র প্রকল্প নেতাই নদীর ধারে ৷ তারও কাঠের ধাপ খুব নড়বড়ে অবস্থায় আছে, মাঝখানে পুলটি বেঁকে গেছে ৷ এক বছর আগেই নাকি এ কাঠের পুল তৈরি হয়েছিল ৷ পাশে একটি নতুন কাঠের পুল তৈরি হচ্ছে অবশ্য ৷ যারা কাজ করছিল তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কদিন টিকবে?’ তারা খুব আনন্দিত হয়ে উত্তর দিল, ‘এই এক বছর ৷’ আরেকজন আরও একটু উল্লাসের সঙ্গে বলল, ‘আজ্ঞে ছ মাস বড় জোর ৷’ যাই হোক, আবার সেই জালে ঘেরা পথ ধরে দৌড়ে টাওয়ারে গিয়ে ওঠা এবং আবার হতাশ হয়ে ফেরা ৷ এর কাছাকাছি একটি প্রাচীন মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি প্রত্নতত্ব বিভাগের অধীনে দেওয়া হয়েছে, তবে তাঁরা এখনও এটি নিয়ে তেমন কোনও কাজ করে উঠতে পারেননি ৷

নেতিধোবানি ব্যাঘ্র প্রকল্পে সজনেখালির মতোই একটি বনবিবির মন্দিরও আছে-সামনে হোর্ডিং-এ শা জঙ্গলি বনবিবি ও দক্ষিণ রায়ের উপাখ্যানও কিছুটা বলা আছে ৷ এখানেই এমন একটি প্রাণীর দেখা পাওয়া গেল জনবসতি এলাকায় যার দেখা প্রচুর মেলে কিন্তু এখানে তাকে দেখা একটু আশ্চর্যের ৷ সেটি একটি নধরকান্তি পাঁঠা ৷ বনবিবির কাছে মানত করে লব্ধকাম এক দম্পতি নাকি গত জানুয়ারিতে এই পাঁঠাটিকে বনবিবির পায়ে দিয়ে গেছে ৷ বনবিবির পা থেকে মানুষের পেট পর্যন্ত রাস্তা পাঁঠার পক্ষে খুব দীর্ঘ নয়, কিন্তু এই নিয়ে নাকি প্রকল্পের লোকেরা দুটো দলে ভাগ হয়ে যায় ৷ একদল পাঁঠাটিকে আশু উদরসাৎ করার পক্ষে, অন্য দল মায়ের জিনিস মানুষের ভোগে লাগানোর সম্পূর্ণ বিপক্ষে ৷ এই স্ট্র্যাটিজিগত সুবিধা নিয়ে পাঁঠাটি দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছে এবং মহানন্দে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে ৷ এই পাঁঠাটিকে নাকি বাঘেও ছোঁয় না ৷ যাই হোক, একে দেখে যাত্রীদের অনেকেই বাঘ না দেখার দুঃখ কিছুটা ভুললেন বলে মনে হল ৷

নেতিধোবানি থেকে আমাদের ফেরার পর্ব ৷ ঢেউডাঙা খাল থেকে বিশাল মাতলা নদীতে পড়লাম, তা থেকে জলের একটি গলি ধরে বিদ্যাতে পড়তে হবে ৷ এখানে নদী বিশাল চওড়া-ওপার ধু ধু দেখা যায় ৷ বোঝাই যাচ্ছে সমুদ্রের খুব কাছাকাছি এসেছি আমরা ৷ চক্রবর্তী মশাই বললেন আর ঘণ্টাখানেক দক্ষিণে গেলেই বঙ্গোপসাগর ৷ কোথাও কোথাও বারো-তেরো কিলোমিটার দূরত্ব এপার আর ওপারের ৷ এই পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যাবলী শেষ হল তারপর কখন আবার ভাঁটার রাজত্বে ঢুকে পড়লাম জানি না ৷ ফিরে এলাম মানুষের চেনা পৃথিবীতে ৷ সেই ইটের বাঁধ, সেই জল সরে যাওয়া শুকনো পাড়ের ওপরে বিশ্রামরত নৌকো, ভটভটি আর মোটর লঞ্চ, সেই ছাগল-চরা নদীর ধার, সেই খড়ের চালের বাসগৃহ দোকানপাট, মাঝেমধ্যে পাকাবাড়ি, আর সেই নদী পর্যন্ত ধাপে ধাপে নেমে আসা কংক্রিটের পুল, যার গায়ে ভটভটি গিয়ে ভেড়ে ৷ এইভাবে একসময় সোনাখালি-বাসন্তী এসে পড়ল, আমরা তলপি-তলপা গুটিয়ে ডাঙায় এসে আবার সেই বাসের গহ্বরে ঢুকে পড়লাম ৷ বৈকালিক চা-জলখাবারে আপ্যায়িত করে সাড়ে সাতটা নাগাদ, অর্থাৎ প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা পরে, বাস আমাদের কলকাতায় নামিয়ে দিল ৷ যা পিছনে ফেলে এলাম তা সত্য না স্বপ্ন তাই ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম ৷

ভ্রমণ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন