অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
এবছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যখন মদমহেশ্বর গঙ্গা উপত্যকার ওপর ভাগে অভিযান চালানোর জন্য IMF-এর অনুমতিপত্র হাতে পেলাম তখনই প্রবল বর্ষণে নিম্ন মদমহেশ্বর গঙ্গা উপত্যকা বিপর্যস্ত হবার খবর সংবাদপত্রের শিরোনামে এল ৷ খবরে পড়লাম নিম্ন মদমহেশ্বর গঙ্গা উপত্যকার লেঙ্খ, মনসুনা, উখিমঠ প্রভৃতি অঞ্চলে প্রবল ধস ও ব্যাপক ধ্বংসলীলার কথা ৷ খবরে আরও জানলাম লেঙ্খ গ্রামের নিচে বিশাল এক ধসে মদমহেশ্বর গঙ্গার গতিপথ অবরুদ্ধ হয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক জলাশয়ের, যার ফলে ওই অঞ্চলে বিপদের সম্ভাবনা আরও বেড়ে গিয়েছে ৷ যদি কোনওভাবে ওই অবরোধ মদমহেশ্বর গঙ্গার জলরাশির চাপে ভেঙে যায়, তাহলে লেঙ্খ-মনসুনা-উখিমঠ তো বটেই, এমনকী কালীমঠ, কুণ্ডচটি, চন্দ্রপুরী, সিয়ালসোর, অগস্ত্ব্যমুনি ইত্যাদি মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে ৷ এমন পরিস্থিতিতে আমাদের অভিযান কিছুদিন পিছিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ রইল না ৷
১ অক্টোবর ১৯৯৮ চেপে বসলাম দুন এক্সপ্রেসে ৷ ৩ অক্টোবর রাত কাটালাম হৃষীকেশের যাত্রা বাসস্ট্যান্ডের হোটেল দিগ্বিজয়ে ৷ খোঁজ নিয়ে জানলাম মনসুনা যাবার বাস পরদিন ছাড়বে না ৷ অগত্যা ৪ অক্টোবর ভোর চারটেয় উঠলাম GMOU-এর রুদ্রপ্রয়াগগামী এক বাসে ৷ সকাল সাড়ে নটায় রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে পেয়ে গেলাম উখিমঠগামী একটি বাস ৷ প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে বাসটি রুদ্রপ্রয়াগ ত্যাগ করল সকাল সাড়ে এগারোটায় ৷ বেলা একটায় উখিমঠ পৌঁছতেই হোটেলের দালালরা ছেঁকে ধরল ৷ দুয়েকজনের মুখে ভ্রমণ-এর নামও শুনলাম ৷ উখিমঠে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে মনসুনাগামী জিপে আমাদের মালপত্র চড়িয়ে ঝুলতে ঝুলতে আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম মনসুনা ৷ মনসুনায় ভোজন সেরেই শুরু হল হাঁটা ৷ পথ প্রথমেই নেমে চলে নদীখাতে ৷ মধ্যাহ্নের রোদ মাথায় নিয়ে আমরা নদীর পাথরের পর পাথর ডিঙিয়ে চলতে থাকি লেঙ্খ গ্রামের উদ্দেশে ৷ একটু পরেই এসে পড়ি প্রকৃতির ব্যাপক ধ্বংসলীলার একবারে মাঝখানে ৷ দেখি জুগাসু পুলের কোনও চিহ্নই নেই, জুগাসুর ঠিক ওপরেই পাহাড়টার গা থেকে বিশাল ধস নেমে অবরুদ্ধ মদমহেশ্বর গঙ্গার পথ ৷ গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ছোট্ট সেতু দিয়ে মদমহেশ্বর গঙ্গা পেরিয়ে লেঙ্খ-এর চড়াই পথ ধরি ৷ বিকেল সাড়ে তিনটেয় লেঙ্খ-এ পৌঁছে আশ্রয় নিই পুরনো বন্ধু শিব সিং নেগীর বাড়িতে ৷ শিব সিংয়ের বাড়ি থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় মদমহেশ্বর গঙ্গার ওপর সৃষ্ট বর্তমান জলাশয়টি ৷ আরও দেখা যায়, ধসের বুক চিরে মদমহেশ্বর গঙ্গা নিজের পথ করে নিয়ে বয়ে চলেছে ৷ অবরোধ ভেঙে গিয়ে নিম্ন উপত্যকায় বন্যার ভয় এখন তাই কিছুটা কম ৷ সরকার থেকে তবুও লেঙ্খ গ্রামাঞ্চলকে বিপদগ্রস্ত অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং গ্রামবাসীদের অঞ্চল ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ৷
৫ অক্টোবর সকাল সকাল লেঙ্খ থেকে বেরিয়ে পড়লাম ৷ সঙ্গে আছে শিব সিংয়ের করা রুটি আর কুমড়োর তরকারি ৷ লেঙ্খ গ্রামের সীমানা ছাড়াতেই তিনটি বড় বড় ধস পেরোতে হল ৷ ওনিয়ানা, রাঁসি, গোন্ডার ছাড়িয়ে অবশেষে বানতোলি পৌঁছলাম বেলা আড়াইটেয় ৷ লেঙ্খ থেকে বানতোলির দূরত্ব পনেরো কিলোমিটার ৷ এখানে বীরবল সিংয়ের ব্যবস্থাপনায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ভালোই ৷ রাতে খাওয়ার পর হাঁটতে বেরোই ৷ কোজাগরীর চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে উপত্যকা ৷ মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকি মদমহেশ্বর গঙ্গা ও মার্কণ্ডেয় গঙ্গার সঙ্গমের দিকে ৷
পরদিন, ৬ অক্টোবরের পথ মাত্র ৯ কিলোমিটার, কিন্তু আগাগোড়াই চড়াই ৷ ৩ কিলোমিটারের পর নানুতে থামি জলপানের উদ্দেশে ৷ পুরনো বন্ধু সুন্দর সিং পাঁওয়ার আমাদের পথ চেয়েই বসে ছিল ৷ ওর সঙ্গে কিছু দরকারি কথা সেরে নেওয়া গেল, কারণ পরশু থেকে ওই হবে আমাদের সঙ্গী ৷ নানু থেকে মদমহেশ্বর ৬ কিলোমিটার পথ বেশ ভালোই চড়াই ৷ ব্যাপকভাবে গাছ কাটায় রোদে পুড়েই পথ চলতে হয় ৷ বেলা দেড়টা নাগাদ মদমহেশ্বর পৌঁছে যাই ৷ দর্শনমাত্রই শারীরিক ও মানসিক কষ্ট উধাও হয়ে যায় ৷ আশ্রয় নিই মন্দির কমিটির যাত্রীনিবাসের একটি ঘরে ৷ বিকেলের পড়ন্ত রোদে আমি ও আমার সঙ্গী গা এলিয়ে দিই বুড়া মদমহেশ্বরের ঢালে ৷ চা চলে আসে রাকেশ পাঁওয়ারের দোকান থেকে ৷ যেচে গিয়ে আলাপ করি পূজারীজির সঙ্গে ৷ ত্রিশোর্ধ্ব যুবক, মহারাষ্ট্রে বাড়ি ৷ গল্প করে কিছুটা সময় কেটে যায় ৷ স্বপ্নভঙ্গের মতো সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে জনা-ত্রিশেকের দুটি দল উপস্থিত হয় ৷ একটি দল শ্যামবাজারের, অপরটি সালকিয়ার ৷ তাদের সকলেরই বয়স ত্রিশের মধ্যে ৷ মদমহেশ্বর মন্দিরকে নিয়ে তারা বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলতে থাকে ৷ নৈঃশব্দ্যের স্বর্গপুরী যেন এক লহমায় পরিণত হয় কোলাহলমুখর জনপদে ৷ দলদুটির উচ্ছৃঙ্খলতা মনকে আহত করে ৷
পরদিনও আমরা মদমহেশ্বরেই থাকলাম ৷ তার একমাত্র কারণ শরীরকে উচ্চতা এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ৷ আমাদের এবারের অভিযানের মূল উদ্দেশ-উচ্চতর মদমহেশ্বর গঙ্গা উপত্যকার কিছু অজানা, অচেনা অঞ্চলের পথ খুঁজে বার করা ৷ ব্যাপক এলাকা আজও অজ্ঞাত পর্যটকের কাছে ৷ যাই হোক, সারাদিনটা টুকিটাকি নানা কাজের মধ্য দিয়ে কেটে গেল ৷ সকালেই গতকাল আসা দলদুটি নেমে গেল ৷ সারাদিন তাই আবার আমরা একা ৷ সন্ধ্যায় অন্ধকারে সুন্দর সিং আরেকজন কুলি নিয়ে হাজির হল ৷
পরদিন বেরতে বেরতে সাতটা বেজে গেল ৷ আমি আর সঙ্গী সুব্রত কুলিদের আগে চললাম ৷ গত বছরও আমরা এইপথে এসেছি ৷ তাই পথ চিনতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না ৷ এই পথ মূলত ভেড়াওয়ালাদের ৷ মদমহেশ্বর মন্দিরের পিছন দিয়ে রাস্তা প্রবেশ করেছে গভীর জঙ্গলে ৷ জঙ্গলের মধ্যে এঁকেবেঁকে পথ উঠে চলে ৷ কিছুক্ষণ পরেই ট্রি-লাইন ছাড়িয়ে প্রবেশ করি ছায়াহীন রুক্ষ পাহাড়ের ঢালে ৷ পথ এখানে আরও চড়াই ৷ বলতে গেলে এখানে কেবলই ওঠা ৷ চারদিকে থোকা থোকা হলুদ ঘাসের রাজত্ব ৷ বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছই নন্দবারারি খড়কে ৷ এই জায়গার উচ্চতা প্রায় তেরো হাজার ফুট ৷ এটি ভেড়াওয়ালাদের একটি রাত কাটাবার প্রিয় জায়গা ৷ কুয়াশায় চারদিক ঢেকে যায় হঠাৎই ৷ স্টোভ জ্বালিয়ে আমরা কফি এবং ছাতু খাই ৷ আবার শুরু হয় পথ চলা ৷ নন্দবারারি খড়কের পর রাস্তা কিছুটা উতরাই, অজস্র ছোট বড় পাথরের ওপর দিয়ে ৷ তারপর শুরু হয় কাচনি খালের চড়াই ৷ কুয়াশার মধ্যে বেলা দুটো নাগাদ উঠে আসি কাচনি খালের মাথায় ৷ কাচনি খাল একটি গিরিপথ ৷ এর উচ্চতা তেরো হাজার পাঁচশো ফুট ৷ মদমহেশ্বর থেকে নন্দীকুণ্ড বা পাণ্ডুসেরা যেতে এই কাচনি খাল পেরোতে হয় ৷ খালের মাথায় বসে সুন্দর সিংয়ের আনা কাঁকড়ির সদ্ব্যবহার করি ৷ তারপর আবার হাঁটা শুরু ৷ পাণ্ডুসেরার দিকে না নেমে আমরা উত্তর দিকে চলতে শুরু করি ৷ কিছুটা খাড়া (২০০ ফুট) ঢাল বেয়ে ওঠার পরই একটি সমতল জায়গা পাই ৷ পাশেই বয়ে চলেছে ছোট্ট একটি জলের ধারা ৷ তাঁবু খাটাবার আদর্শ জায়গা ৷ আবহাওয়া খারাপ হয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ পড়া শুরু হয় ৷ আমরাও তাঁবু লাগাই ৷ বড় পাথরের আড়ালে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয় পাকশালা ৷ হাতে হাতে গরম টমেটো স্যুপের কাপে জমে ওঠে আড্ডা-আগামীকালের পরিকল্পনা ৷
পরদিন ভোরবেলা তাঁবুর বাইরে এসে পা রাখলাম সারারাতের জমে থাকা বরফে ৷ তাঁবুর বহির্গাত্রে পুরু বরফের আস্তরণ ঝরিয়ে দিতে থাকলাম সকলে ৷ দক্ষিণে বহু নিচে দেখা যাচ্ছে সমগ্র নিম্ন মদমহেশ্বর গঙ্গা উপত্যকা ৷ উত্তর-পূর্ব থেকে পূর্বদিক পর্যন্ত ঝলমল করছে বিষ্ণুগড়ধার গিরিশিরা ৷ অজস্র নামহীন তুষারশৃঙ্গের বরফগলা জলে সৃষ্ট অগুনতি নালা মিলে সৃষ্টি হয়েছে মদমহেশ্বর নালার ৷ সেই ধারা পাণ্ডুসেরার সবুজ উপত্যকার পাশ দিয়ে বয়ে নেমে গেছে গভীর অরণ্যের পথে ৷ বানতোলিতে এই মদমহেশ্বর নালার সঙ্গেই মিলিত হয়েছে মার্কণ্ডেয় গঙ্গা ৷ আমরা চলেছি সেই মার্কণ্ডেয় গঙ্গার উৎস সন্ধানে ৷ সূর্যের প্রথম কিরণ আমাদের শিবিরে পড়ামাত্র আমরা প্রাতরাশ সেরে চলা শুরু করি ৷ উত্তরে, আরও উত্তরে ৷ আমাদের পরিকল্পনা ছিল আজ দুনম্বর শিবির স্থাপন করব মাইন্দাগাল্লা তালের ধারে ৷ সেইমতো এগোতে থাকি ৷ আজ থেকে কোনও পথের চিহ্ন নেই ৷ বিশাল এক বোল্ডার জোন ধরে এগনো ৷ কম্পাস দেখে দিক ঠিক রাখা ৷ পাথরের খাঁজে খাঁজে অজস্র ব্রহ্মকমল, ফেনকমল ফুটে আছে ৷ আমরা যেন এগিয়ে চলেছি কোন অমরাবতীর অমোঘ আহ্বানে ৷ বেলা এগারোটা নাগাদ উপস্থিত হলাম মাইন্দাগাল্লা তালে ৷ এই তালের উচ্চতা চোদ্দ হাজার ফুট ৷ কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করলাম তালে এক বিন্দু জল নেই ৷ তাই এখানে শিবির করার পরিকল্পনা ত্যাগ করে এগিয়ে চললাম উত্তর-পূর্বদিকে ৷ পাথরের পর পাথর ডিঙিয়ে আরও প্রায় পাঁচশো ফুট উঠে এলাম ৷ এখানে পাথরের খাঁজে বরফ জমে আছে ৷ মোটামুটি কম ঢাল দেখে এক জায়গায় দুনম্বর শিবির স্থাপন করা হল ৷ পাথরের খাঁজে জমে থাকা বরফ পাত্রে নিয়ে চাপানো হল স্টোভে ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো কফির আমেজে আমরা মশগুল হলাম ৷ আজ আমাদের মধ্যে উত্তেজনার অন্ত নেই ৷ কারণ, আজ আমরা যেখানে শিবির স্থাপন করেছি, সেখানে এর আগে কোনও পর্যটকের পা পড়েনি ৷ এখানে প্রয়োজন নেই কোনও গাইডের ৷ কারণ মদমহেশ্বর উপত্যকার কোনও মানুষই কোনওদিন আসেনি এ পথে ৷ এখানে পথ ঠিক করছি আমরাই মানচিত্র ও কম্পাসের সাহায্যে ৷ সুন্দর সিংও যথেষ্ট উত্তেজিত ৷ কারণ, আগামীদিনে ও-ই হতে চলেছে এ পথের এক এবং একমাত্র গাইড ৷ রাঁসি গ্রামের শিউরাজ সিং ছিল এতদিন এ অঞ্চলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ গাইড ৷ কিন্তু শিউরাজ সিংও এ পথ চেনে না ৷ তার প্রমাণ আমরা গত বছর পেয়েছি ৷ স্থানীয় গাইড বা কুলিরা মাইন্দাগাল্লা তাল পর্যন্ত চেনেন ৷ তাই অতীতে পর্যটকদের গতিবিধি সেখানেই সীমিত থেকেছে ৷
পরদিন ভোরে কিছু শুকনো খাবার, ফল ও জল নিয়ে আমরা উঠে চলি উত্তর-পূর্বদিকে ৷ আমাদের মানচিত্র অনুযায়ী এই পথেই আমরা পাব এক দুরূহ গিরিপথ যা পেরিয়ে পৌঁছনো যাবে এক অদৃষ্টপূর্ব উপত্যকায়-:মার্কণ্ডেয় গঙ্গার উৎস যেখানে ৷ একটু পরেই বরফের ঢাল শুরু হয় ৷ কঠিন বরফের খাঁজে পা রেখে চলতে বেশ সুবিধাই হয় ৷ একটু পরেই দেখতে পাই আমাদের দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত গিরিপথ ৷ সকাল আটটায় এসে দাঁড়াই গিরিপথের মাথায় ৷ এই স্থানের উচ্চতা পনেরো হাজার পাঁচশো ফুট ৷ দুনম্বর শিবির থেকে এখানে উঠতে আমাদের এক ঘণ্টার কিছু কম সময় লাগে ৷ বাকরুদ্ধ আমাদের তিনজনের ৷ এই প্রথম কোনও পর্যটকের পদচিহ্ন পড়ল গিরিপথের বরফে ৷ আমরা এই কল বা গিরিখাতের নামকরণ করলাম আমাদের ক্লাবের নামে ORION COL ৷ কলের উত্তরদিকের অনেকটা জুড়ে আছে বিখ্যাত চৌখাম্বা শিখর শ্রেণী ৷ আর উত্তর থেকে উত্তর-পূর্বে গোল হয়ে ঘিরে অজস্র অনামী শৃঙ্গরাজি ৷ চারদিকে শুধু বরফ ৷ ধীরে ধীরে চোখ নিচের দিকে নামাতেই আরেক বিস্ময় ৷ পান্না সবুজ এক বিশাল সরোবর ৷ চৌখাম্বার সমতলে যেন ধ্যানমগ্ন ৷ আমরা বিস্মিত, কারণ এর উল্লেখ কোনও মানচিত্রে নেই ৷ আমরা সাবধানে নামতে থাকি সরোবরের দিকে ৷ ছবির পর ছবি তুলতে থাকি ৷ চৌখাম্বা এবং আশপাশের শৃঙ্গের বরফগলা জলে সৃষ্ট এই সরোবরের থেকেই সৃষ্টি মার্কণ্ডেয় গঙ্গার ৷ সরোবরের পাশ থেকে এগিয়ে যাই আরও উত্তরে-উন্মুক্ত হয়ে দেখা দেয় মান্দানি শৃঙ্গ ও উপরি গান্ধারপোঙ্গী বা মার্কণ্ডেয় গঙ্গা উপত্যকা ৷ চৌখাম্বার গায়ে অ্যাভালাঞ্চ নামে গুমগুম শব্দে ৷ আমরা তুষারক্ষেত্রে নিথর, নিঃশব্দ তিনটি বিন্দু ৷ সরোবরের জলপান করতে গিয়ে দেখি স্বচ্ছ তুষারের স্তর ঢেকে রেখেছে গোটা সরোবর ৷ বরফ কুঠার দিয়ে বরফ ভেঙে জলপান করি ৷ মনে হয় এমন সরোবরের নাম না রাখলেই নয়! আমাদের পরমপ্রিয় প্রয়াত পর্বতারোহী, প্রকৃতিপাগল শ্রী সুজল মুখোপাধ্যায়ের মুখ ভাসে চোখের সামনে ৷ মুহূর্তের মধ্যে মনে আসে ‘সুজল সরোবর’ নাম ৷ সুজল সরোবর অবধি পথে উৎসাহী পদযাত্রীরা যেতে পারেন ৷ তবে পথে তাঁবু, স্টোভ, কেরোসিন তেল, স্লিপিং ব্যাগ ও ভারি উলের জামাকাপড় রাখা জরুরি ৷ গাইডের জন্য যোগাযোগ করুন এই ঠিকানায়:
সুন্দর সিং পাঁওয়ার, গ্রাম-গোণ্ডার, পোঃ রাউলেঙ্খ
জেলা-রুদ্রপ্রয়াগ, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ ৷
গাইডের রেট দেড়শো টাকা প্রতিদিন ৷ সাধারণ কুলি একশো টাকা রোজ-এর মধ্যে পাওয়া যায় ৷ মনসুনা বা উখিমঠ থেকে কুলি নিতে পারেন ৷ আশা রাখি ভবিষ্যতে সুজল সরোবর একটি উল্লেখযোগ্য গন্তব্য হয়ে উঠবে ৷
ভ্রমণ ডিসেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন