সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

১৯৬৭ সালের ২০ ডিসেম্বর আমার জীবনের এক শুভ লগ্ন ৷ সেদিন কলকাতার রাজভবন থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম দুচাকায় দুনিয়া চক্কর দেওয়ার জন্য ৷ যদিও একক চেষ্টা, তবুও তৎকালীন ও প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন ও প্রফুল্ল ঘোষ আমার দুপাশে দাঁড়িয়ে আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন ৷ যাত্রা হোক সফল, ফিরে এস দিগ্বিজয়ী হয়ে-সামান্য দুটো কথা ৷ কিন্তু মনে হল, একটা ব্রত পালনের জন্য তাঁরা আমাকে ঠেলে দিলেন এই পৃথিবীর রাস্তায় ৷ অনুষ্ঠানে কোনও জাঁকজমক ছিল না; মাত্র পঞ্চাশ-ষাটজনের উপস্থিতিতে সেদিন শুরু হয়েছিল আমার যাত্রা ৷ সকাল ৭টায় ইছাপুর থেকে যখন রাস্তায় বেরোই তখন পকেটে ছিল মাত্র ১৬ টাকা ৷ পাঁচ বছর লেগেছিল আমার সেই ভ্রমণ-ব্রত সাঙ্গ করতে, ফিরে এসেছিলাম ১৯৭২ সালে ৷

বছরখানেক যাবৎ ‘ভ্রমণ’ পত্রিকায় আমার তখনকার দুষ্প্রাপ্য বইয়ের কিছু কিছু অংশ প্রকাশিত হচ্ছে আর সেইসঙ্গে পাচ্ছি অনেক চিঠিপত্র ৷ এই লেখায় ভূ-পর্যটনের কিছু অজানা তথ্য জানাচ্ছি যা আমার কোনও বইতেই লেখা হয়নি ৷ কোথায় কতদিন থাকলাম, কতটা দূরত্ব পার হলাম এবং যেসব দেশে গেলাম সেখানকার বৈশিষ্ট্য ও দ্রষ্টব্যস্থানের বিশদ বিবরণ এ-লেখায় পাওয়া যাবে না, তার অনেকটাই ‘ভ্রমণ’ পত্রিকায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে ৷

সাইকেলে ভূ-প্রদক্ষিণ কথাটা একটু ভেবে দেখা দরকার ৷ সাইকেল সাঁতার কাটে না, ওড়ে না ৷ কাজেই নদ-নদী-সাগর-মহাসাগর পার হবার জন্য সাহায্য নিয়েছি জলযানের আর পাহাড়-পর্বত ও নিষিদ্ধ এলাকার জন্য অধিকাংশ সময় উড়োজাহাজের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম ৷ গ্রিনল্যান্ড গিয়েছিলাম হেলিকপ্টারে আর সমুদ্রগর্ভ দেখেছি সী স্কোপের মাধ্যমে ৷

ভারতের বাইরে যেতে হলে চাই ভারত সরকারের অনুমতি, যাকে বলে পাসপোর্ট ৷ আর যে দেশে যাব সেই দেশের সরকার দেবে প্রবেশপত্র, যার নাম ভিসা ৷ ভারতের উত্তরে হিমালয় ডিঙিয়ে তিব্বত ও চিনে যাবার চিন্তা করা যায় না, আর মায়ানমার হয়ে পূর্বদিকে যাওয়া মানে সাগরের কাছে গিয়ে থেমে যাওয়া ৷ ভারতের তিনদিকে বঙ্গোপসাগর, আরসবসাগর আর ভারত মহাসাগরের বাধা, কাজেই ইউরোপে আসতে হলে একমাত্র পথ হচ্ছে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে ইরান, তুরস্ক হয়ে যাওয়া ৷ এখানেই প্রথম বাধা পেলাম ৷ পাকিস্তান সাইকেলে করে দেশ দেখার জন্য কিছুতেই অনুমতি দিল না ৷ তাই বাধ্য হয়েছিলাম বোম্বাই থেকে খোরামসাহের (ইরান) পর্যন্ত জাহাজে আসতে ৷ বম্বের পামবিচ হাই স্কুলে দেড়মাস কাজ করে জাহাজের ভাড়া তুলেছিলাম ৷ ভারত ছাড়লাম জলপথে ৷ ইরান থেকেই আমার সত্যিকারের সাইকেলযাত্রা আবার শুরু করেছিলাম ৷ অবশ্য কলকাতা থেকে বোম্বাই সাইকেলেই এসেছিলাম দিল্লি ও রাজস্থান হয়ে ৷

জাহাজে আরবসাগর ছেড়ে চারদিন পর পারস্য উপসাগর পেরিয়ে পৌঁছলাম শাট-এল আরবের খোরামসাহের বন্দরে ৷ নদীর দুপাশের খেজুরগাছের বন আর তারই মাঝে মাঝে গ্রামীণ দৃশ্য অতি চমৎকার ৷ ইরানে পৌঁছে আবদান-শিরাজ পার হতে লাগল আরও কয়েকদিন ৷ পথে খোরাসান ভূমিকম্প এলাকায় কাটালাম প্রায় একমাস ৷ ইস্পাহানে পৌঁছবার আগেই সেখানকার যাযাবরদের সঙ্গে থেকে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা লাভ করলাম ৷ এখানকার রাস্তাঘাট অনেকটা রাজস্থানের মরুভূমি এলাকার মতো ৷ তবে ঠিক মরুভূমি নয় ৷ ইস্পাহানের ইয়ুথ হস্টেলে উঠলাম ৷ কথায় বলে ইস্পাহান দেখলে পৃথিবীর অর্ধেক দেখা হয় ৷ জপদি নদীর ধারে ইস্পাহান অনেকটা মরূদ্যানের মতো ৷ ইস্পাহানের কার্পেট আর মসজিদ আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল ৷ বিশেষ করে সাফাবিদ স্কোয়্যারের শাহ মসজিদ এবং লুৎফুল্লদ মসজিদ দেখবার মতো ৷ ইস্পাহান ও তার চারপাশে ঘুরে তারপর এলাম ইরানের রাজধানী তেহরানে ৷ তেহরানে প্রথম উঠি ওখানকার স্কাউট হাউসে তারপর ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ভাই মাখখন সিং তাঁর গুরদোয়ারা গেস্টহাউসে রাখেন তারপর ইরান ভেজিটারিয়ান সোসাসটির প্রেসিডেন্ট ও স্বনামখ্যাত লেখক জাহাঙ্গির ইরমেন তাঁর বাড়িতে আমাকে আমন্ত্রণ জানান ৷ সেখানে সপ্তাহখানেক ছিলাম ৷ তেহরানে দেখবার অনেক কিছু আছে ৷ পৃথিবীর যে কোনও রাজধানীর মতোই এখানে দ্রষ্টব্যস্থানের অভাব নেই ৷ যাদুঘর, মসজিদ, পার্ক-রাজবাড়ি ইত্যাদি ৷ এখানেই আমি প্রথম পেলাম আধুনিক ইউরোপের গন্ধ ৷ অতি আধুনিক রাস্তাঘাট, অফিস, পরিবহণ আর উন্নত ধরনের পুলিশি ব্যবস্থা ৷ বারোশো শতকের একটি বর্ধিষ্ণু শহর, ১৭৮৮ সালে মোহম্মদ শা কাদজার-এর আমলে পরিণত হয়েছিল ইরানের রাজধানীতে ৷ এখানকার ট্রেজারি হাউসে দেখলাম ভারতের ময়ূরসিংহাসন ৷

উত্তর ইরানের পার্বত্যাঞ্চল আর দক্ষিণের পারস্য উপসাগরীয় সমতলভূমি ৷ মাঝে রয়েছে অসমতল উপত্যকা ৷ যাঁরা সাইকেলে ইরান ঘুরবেন তাঁদের বহু দৈহিক কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে ৷ কাজেই সাবধান ৷

দিল্লি থেকে ইরান-তুরস্ক-গ্রিস ও রাশিয়ার ভিসা নেওয়া ছিল ৷ ভেবেছিলাম, তেহরান হয়ে সরাসরি ক্যাস্পিয়ান সাগর হয়ে রাশিয়ায় পৌঁছব ৷ কিন্তু রুশ দূতাবাসে গিয়ে হোঁচট খেতে হল ৷ রাশিয়ায় যে কোনও সীমান্ত দিয়ে আমাকে ঢুকতে দেবে না ৷ আমাকে মস্কোয় সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব স্পোর্টস আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং আমার ভিসাতে এন্ট্রি লেখা হয়েছে আফগানিস্তান হয়ে তাসখন্দের দিক দিয়ে ৷ কাজেই আমাকে যেতে হবে আফগানিস্তানের দিকে ৷

বাধ্য হলাম আবার ইস্পাহানে ফিরে যেতে ৷ আমি এ পর্যন্ত যেসব বড়সড় শহর পার হয়েছি তাদের নাম যথাক্রমে খোরামসাহের, আবদান, শিরাজ, ইস্পাহান, তেহরান ৷ আবার ইস্পাহান তারপর যেতে হবে মেশেদ হয়ে আফগানিস্তানের হিরাট শহরে ৷ মেশেদ সীমান্তশহর ৷ রাশিয়া যাবার ভিসা থাকায় আফগানিস্তানের সীমান্তপুলিশ আমাকে কোনওরকম হয়রানি করেনি ৷ মেশেদে একটি স্কুলে রাত্রিবেলা ছিলাম ৷ আফগানিস্তানের হিরাট শহরটা দক্ষিণ ইরানের মতোই ৷ সেখান থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে সরাসরি কাবুল পর্যন্ত গিয়েছে ৷ ইরান এবং আফগানিস্তানের মাইলস্টোন ধরে চলা মুশকিল কারণ অধিকাংশ সময়েই মাইলস্টোনের অক্ষর বোঝা যায় না ৷ হয় অস্পষ্ট নয়তো পুস্ত ভাষায় লেখা ৷

আফগানিস্তানে ছোট-ছোট হোটেলের অভাব নেই ৷ চায়ের দোকানেও রাতে কিছু পয়সা দিলে দোকানঘরের টেবিলেই কম্বল বিছিয়ে শোয়া যায় ৷

হিরাট থেকে পাহাড়ি রাস্তায় অতিকষ্টে কাবুলে পৌঁছতে লাগল প্রায় উনিশ দিন ৷ কাবুল নদীর ধারে কাবুল শহরটি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম-পুরনো শহরের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অতি আধুনিক শহর ৷ লোকজনদের দেখে মনে হয়েছিল অনেকটা পাকিস্তানের কাশ্মীরি ৷ কাবুল থেকে কান্দাহার হয়ে ইরান যাওয়া যায় কিন্তু সাইকেলে অত্যধিক কষ্টকর ৷ বিশেষ করে ১৯৬৮ সালে আঠারো বা কুড়ি গিয়ারের সাইকেল ছিল না ৷ আমার সাইকেলটি ছিল মাত্র তিন গিয়ারের ৷ কাবুলে এসে বুঝলাম যে, পাকিস্তানের ভিসা পেলেও ১,০৬৭ মিটার উঁচু ও সাংঘাতিক খাইবার পাস দিয়ে এই সাধারণ সাইকেলে করে আসা সম্ভব ছিল না ৷ কাবুলে এসে আবার অপেক্ষা করতে হল নয়দিন ৷ কাবুলের রুশ দূতাবাস আমার কাগজপত্র দেখে টেলিগ্রাম পাঠালেন মস্কোতে ৷ সেখান থেকে কনফার্মেশন আসার পর আমাকে তাঁরা জানালেন, সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব স্পোর্টস রাশিয়া যাবার সব বন্দোবস্ত করেছে বটে; তবে সাইকেলে নয়, প্লেনে ৷ আমার জন্য অ্যারোফ্লোট এয়ারওয়েজ-এ কাবুল-তাসখন্দ-মস্কো ও লেনিনগ্রাদে ট্যুর প্রোগ্রাম করা হয়েছে ৷ প্লেনে মস্কো ও লেনিনগ্রাদ ঘুরব একদিকে আনন্দসংবাদ আর অন্যদিকে ভাবছি প্লেনে গেলে রাশিয়া দেখা হল কই? কিন্তু আমার করার কিছুই নেই ৷ রাজি হয়ে গেলাম ৷

কাবুল থেকে প্লেনেই উঠলাম ৷ লেনিনগ্রাদে পৌঁছলাম বিকেল চারটেয় ৷ এয়ারপোর্টেই একজন সরকারি প্রতিনিধি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ৷ তাঁর নাম কমরেড সোকোলোভ ৷ তিনিই একাধারে আমার গাইড ও ইন্টারপ্রেটার ৷ তাঁকে সরকার থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাকে লেনিনগ্রাদ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তবে সাইকেলে নয়, সাধারণ ট্যুরিস্ট হিসাবে ৷ সাইকেলটাকে বিমানবন্দরে রেখে আসতে বাধ্য হলাম ৷

লেনিনগ্রাদ শহরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম ৷ হঠাৎ যেন অন্য এক জগতে সে পড়েছি ৷ রাস্তাঘাট-মানুষ-ঘরবাড়ি সবই ইরান বা কাবুলের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ৷ ইউরোপের এক আজব শহর এই লেনিনগ্রাদ ৷ যত দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি ৷ প্রথমেই নজরে পড়ে এখানকার বিরাট বিরাট চার্চের সোনালি ডোম ৷ এই ধরনের বাস্তুকলাকে বলে বারোক অর্থোডক্স স্টাইল ৷ দেখার অনেক কিছু আছে, মিউজিয়াম, সরকারি বাড়ি, অতি সুন্দর সাজানো রাস্তা, ফুলে ভরা বাগান আর সবচেয়ে ভালো লাগে এখানকার বাজার ৷ বারবার আপসোস হচ্ছে, এমন সুন্দর একটি শহরে সাইকেলে ঘুরতে পারছি না ৷ সোকোলোভ আমার পিছনে আঠার মতো লেগে আছে ৷ লেনিনগ্রাদেই বুঝলাম যে ব্যক্তিস্বাধীনতা হারিয়ে ঘোরায় কোনও আনন্দ নেই ৷ সরকার থেকে আমাকে খাওয়াদাওয়ার জন্য কুপন দেওয়া হয়েছে ৷ সেই কুপনগুলো তাদের নির্ধারিত দোকান বা রেস্তোরাঁতে দেখালেই খাবার মেলে ৷ লেনিনগ্রাদের বাইরে যেতে হলেও আমাকে আলাদা ভিসা নিতে হবে ৷ আমি বাউণ্ডুলে তাই এইসব আইনকে বন্দীজীবনের অঙ্গ বলে মনে হয়, লেনিনগ্রাদ যত সুন্দরই হোক না কেন আমার আর সেখানে ভালো লাগল না ৷ সোকোলোভকে তাই অনুরোধ করলাম আমার ফিরে যাবার বন্দোবস্ত করতে ৷ অ্যারোফ্লোটের টিকিট তৈরিই ছিল ৷ স্বাধীনতা হারিয়ে আমার মস্কো দেখারও ইচ্ছা নেই ৷ ছদিনের দিন আমাকে লেনিনগ্রাদ থেকে প্লেনে তুলে দিয়ে সোকোলোভ বিদায় নিল ৷ সোভিয়েত দেশের জনসাধারণের সঙ্গে পরিচয় হল না ৷ পরে আবার আসব বলে বিদায় জানালাম ৷

কাবুলে ফিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ৷ কাবুল থেকে আবার ধরলাম ইরানের পথ, আফগানিস্তান গরিব দেশ কিন্তু মানুষের আতিথেয়তার কথা ভোলার নয় ৷

আফগানিস্তান থেকে আবার এলাম ইরানে, একের পর এক পার হলাম জাহেদান, কেরমান ৷ শিরাজে পৌঁছে ঠিক করলাম যে, বুশের হয়ে বাহরেন বোটে যাব বাহরিন-এ ৷ তারপর সেখান থেকে যাব মক্কা ও মদিনার দিকে ৷ বাহরিন পৌঁছতেই মনে হল ভারতের মাটিতে এসে পড়েছি ৷ সেখানকার ভারতীয় ব্যবসায়ীমহল আমাকে নিয়ে মেতে উঠল ৷ থাকা-খাওয়ার কোনও অসুবিধা হল না ৷ শুধু তাই নয়, তাঁরা আমার হাতে বেশ কিছু টাকাও তুলে দিলেন ৷ সৌদি আরবের পথেঘাটে চলতে চলতেই চারদিকে নজরে পড়ে মসজিদের ছড়াছড়ি, নমাজপাঠ আর আল্লার মহিমাকীর্তন ৷ দেশটা মরুভূমিতে ভরা ৷ রুক্ষ ও গরম আবহাওয়া পর্যটকদের আকৃষ্ট করে না ৷ কিন্তু কী অদ্ভুত এই রুক্ষ আবহাওয়াতেই আল্লার অবতার হজরত মোহম্মদ এসেছিলেন তাঁর বাণী নিয়ে ৷ আরবের মক্কার মাটিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন অবতার মোহম্মদ আর মাটির তলায় ছিল জগতের অন্যতম সম্পদ পেট্রল ৷ তাই সৌদি আরব আজ দুদিক থেকেই ধনী ৷ রাস্তায় চলতে চলতে চারদিকে নজরে পড়ে বেদুইন ও গরিব দেশবাসী ৷ উট এখানকার প্রধান বাহন ৷ এখানকার তিনটি প্রধান শহর মক্কা, জেদ্দা ও মদিনা ৷ মক্কা শহরে রয়েছে প্রাচীন ও আধুনিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ, চারদিকে দোকান ও হোটেল লোহিতসাগরের ধারে জেদ্দা শহরে তিনটি নতুন এয়ারপোর্ট তৈরি হচ্ছে ৷ একটি আন্তর্জাতিক বিমানের জন্য, একটি সৌদি আরবের ডোমেস্টিক ফ্লাইটের জন্য আরেকটি শুধু হজ-এর জন্য ৷

সৌদি আরবের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল মরুভূমিতে ঢাকা ৷ প্রচণ্ড গরম ৷ দক্ষিণাঞ্চল পাহাড়ি ৷ লোহিতসাগরের হাওয়ায় গরমটা হাল্কা হয়ে আসে ৷ সাইক্লিং করতে খুব অসুবিধা হয় কিন্তু এখানকার সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে সবসময় উৎসাহ পাওয়া যায় ৷ এই অঞ্চলেই আমি মরুঝড়ে পড়েছিলাম ৷

রিয়াদ, তাইফ, মক্কা, জেদ্দা, মদিনা ও হাইদ হয়ে আমি এসে পৌঁছলাম ইরাকের সীমানায় ৷ হাইদকে চলতি কথায় বলে হাইল ৷ রাস্তা ভীষণ কষ্টের ৷ মরুভূমির রাস্তা জনমানবশূন্য, ছায়া নেই কোথাও, শুধু বালি আর বালি ৷ হাইল-এর পর শ-খানেক মাইল দূরে আলমাইয়া শহর ৷ আলমাইয়ার লোকেরা আমার সাহস দেখে অবাক ৷ দিনের প্রচণ্ড উত্তাপে সাইক্লিং করা প্রায় অসম্ভব ছিল, সন্ধের পরই বেশি চলতাম ৷ আলমাইয়ার পর লিনাহ হয়ে সীমান্তশহর রাফহাতে কয়েকদিনের জন্য থামলাম ৷ পকেটে পয়সা নেই ৷ শরীর প্রায় কঙ্কালসার তবুও মনের জোরে টিকে আছি ৷ আমার এই দুরবস্থা দেখে এক ভদ্রলোক তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিলেন ৷ নাম মালেক ৷ কিছুদিন বিশ্রাম করে তারপর ঢুকলাম ইরাকে ৷ আলজুমাইমা হয়ে আন নাফাজ-এ পৌঁছলাম ৷ সেখান থেকে কারবালা শহরে এসে আবার থামতে বাধ্য হলাম ৷ একটা রেস্তোরাঁতে বাসন ধোয়ার কাজ পেলাম ৷ ভারতের বাইরে এই প্রথম চাকরি ৷

বাগদাদ ইরাকের রাজধানী ৷ দেশের লোকসংখ্যা প্রায় চোদ্দ মিলিয়ান, ইরাকে ঢোকার পর একটা জিনিস লক্ষ করলাম-এখানে মুসলমানদের মধ্যে দুটো ভাগ ৷ অধিকাংশ শিয়া হলেও রাজ্যের শাসনভার সুন্নিদের হাতে ৷ সাধারণ ট্যুরিস্টদের চোখে সহজেই এই দলভাগ নজরে পড়ে ৷ দশদিন পর বাগদাদে এলাম ৷ নদীর ধারে সুন্দর শহর বাগদাদে দেখার অনেক কিছু আছে ৷ সবচেয়ে আকর্ষণীয় এখানকার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ৷ ব্যাবিলন-মেসোপটেমিয়ার কথা এখানকার পাথরে গাঁথা হয়ে আছে ৷ ইরাকের ভাষা আরবি ৷ দক্ষিণের কিয়দংশ মরুভূমি এলাকা, যেখানে সাইক্লিং করা কষ্টকর ৷ দক্ষিণের শাট-এল-আরবের উর্বর সমতলভূমিতে সাইক্লিংয়ের মজা আছে কিন্তু উত্তরে পাহাড়ি এলাকা ৷ এতদিনে হিসাব করে দেখলাম যে, গত তিনমাসে আমি প্রায় ২,৫০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছি ৷ দিনে গড়ে ১০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েছি মাত্র ৷ সৌদি আরব থেকে আসার পর শরীরটা খুব ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে ৷ খাওয়াদাওয়াও ঠিকমতো হয়নি ৷ রুটি, সবজি, মাংস, খেজুর যখন যা জুটেছে খেয়েছি ৷ অনেকদিন উপোসও থাকতে হয়েছে ৷ বাগদাদে তাই চারদিন না ঘুরে যতটা সম্ভব বিশ্রাম করে শরীরটাকে চাঙ্গা করবার চেষ্টা করেছিলাম ৷ বাগদাদের একটা যুব সংস্থা আমার বক্তৃতার বন্দোবস্ত করেছিল ৷ সেখানেও কিছু পকেটমানি সংগৃহীত হয়েছিল ৷ আর মক্কা থেকে সাইকেলে বাগদাদে এসেছি-এখবর স্থানীয় খবরের কাগজে প্রকাশিত হওয়ায় আমার যাত্রাপথ অনেকটা সুগম হল ৷

বাগদাদ থেকে আমি এবার রওনা হলাম তুরস্কের পথে ৷ সহজ পথ হল সানানদাদি হয়ে তাব্রিজ ৷ অর্থাৎ আবার ইরান হয়ে তুরস্কের পথে সরাসরি উত্তরে ৷ চারদিন পরই অনেক দূরের মাউন্ট আরারাত চোখে পড়ল ৷ অনেকটা জাপানের ফুজি পাহাড়ের মতো দেখতে ৷

আমি সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ঢুকলাম তুরস্কের আরারাত পাহাড়ের পাশ দিয়ে এরজুরুম শহরে ৷ এখানে হঠাৎ যেন সব পাল্টে গেল ৷ আরবি ভাষায় লেখা হঠাৎ উধাও হল ৷ তুরস্কের ভাষা আরবি হলেও কিন্তু লেখা ল্যাটিন হরফে ৷ বুঝতে না পারলেও পড়তে অসুবিধা হয় না ৷ এখানে এসেই মনে হল যেন আমি ইউরোপের পথে নেমে পড়েছি ৷ এরজুরুম, সিভাস, কেইসেরি শহর পেরিয়ে দশদিনের মধ্যেই পৌঁছলাম রাজধানী আংকারাতে ৷ আংকারায় ডাঃ গুলতেকিন জয়মাস নামে একজন আমাকে তাঁর বাড়িতে সাদর আহ্বান জানালেন ৷ ভদ্রলোক বহুদিন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন এবং তাঁর স্ত্রী আমেরিকান ৷ ডাঃ জায়মাস ভারতদরদী ৷ সেখান থেকে কেনিয়ায় তুরস্কের মেভলানা উৎসবে যোগদান করলাম, তারপর ধরলাম ইস্তাম্বুলের পথ ৷ তুরস্কের মধ্য দিয়ে চলার আনন্দ আছে, কারণ, এখন শীত পড়েছে; সাইকেল চালাতে আগের মতো আর কষ্ট হয় না ৷

ইস্তাম্বুলে ঢুকতেই মুখোমুখি হলাম রয়টার প্রেসের ৷ তারা সংবাদপত্রে আমার বিরাট ছবি সহ সাইকেলে বিশ্বভ্রমণের কথা লিখল ৷ তাতে সুবিধাই হল ৷ এখানকার ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের সঙ্গে পরিচিত হলাম ৷ ওরাই আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করল ৷ কয়েকদিন পর স্থানীয় ডাক্তার হাসান বাসরি কারাহানের সঙ্গে দেখা করতে যাই, কারণ আমাকে সর্দি-কাশি ভীষণভাবে কাহিল করেছিল ৷ ডাঃ কারাহান আমার সব কথা শুনে আমাকে রেখে দিলেন তাঁর কাছে ৷ বললেন, শীতকালে সাইকেল চালালে আমি আর বাঁচব না ৷ তাঁর অতিথি হয়ে যতদিন ছিলাম, ততদিন আমি তাঁকে ডিসপেন্সারিতে টুকিটাকি সাহায্য করতাম ৷ ইস্তাম্বুল অতি সুন্দর শহর ৷ বসফরাসের তীরে বাইজানটাইন রীতির ব্লু মস্ক (Blue Mosque)-এর কথা কে না জানে ৷ এখানকার আমেরিকান কলেজের প্রফেসর বেকটেল আমাকে একদিন নিমন্ত্রণ করলেন তাঁর বাড়িতে ৷ ইস্তাম্বুলের পারিবারিক আবহাওয়ায় আমার শরীরটা সেরে উঠল ৷ ডাঃ কারাহান হয়ে উঠলেন আমার প্রিয় বন্ধু ৷

কিছুদিন বাদে বরফ পড়া শুরু হল ৷ ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকলাম ৷ তারপর জানুয়ারিতেই আবার রওনা দিলাম গ্রিসের পথে ৷ বরফ পড়া এখনও থামেনি ৷ ইস্তাম্বুল থেকেই শুরু হয়েছে ইউরোপ ৷ আমি এশিয়া ছাড়লাম ৷ ঢুকলাম ইউরোপে ৷ প্রথমেই গ্রিস ৷ আলেকসান্দ্রোপলিশ সীমান্তের প্রথম শহর ৷ হঠাৎ যেন মুসলমান রাজত্ব ছেড়ে ঢুকলাম খ্রিস্টান রাজত্বে ৷ ভাষা ও ধর্ম দুটোই নতুন ৷ গ্রিসের সবাই অর্থোডক্স খ্রিস্টান ৷ গ্রিসে ইয়ুথ হস্টেলের ছড়াছড়ি ৷ খুব ভালো বন্দোবস্ত ৷ আমাকে আর রাস্তায় শুয়ে কাটাতে হবে না ৷ কুমেদিনি ও কাভালা পেরিয়ে পেলাম আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের দেশ থেসালনিকি ৷ প্রাচীন ম্যাসিডনিয়া ৷ এখানেও উঠলাম ইয়ুথ হস্টেলে ৷ সেখানে দুদিন থেকে তারপর অলিম্পাস পাহাড় ডিঙিয়ে লারিসা হয়ে পৌঁছলাম এথেন্সে ৷ এথেন্সের মতো এত সম্মান এবং আদর আপ্যায়ন এর আগে আর কোথাও পাইনি ৷ স্থানীয় খবরের কাগজ ‘তা-নেয়া’ পরপর তিনদিন আমার নামে সম্পাদকীয় কলমে লিখল ৷ কেউ বলল দার্শনিক, আবার কেউ বলল গ্লোবট্রটার ৷ আমন্ত্রণ পেলাম রেডক্রস সোসাইটির তরফ থেকে ৷ রোটারি ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব, গভর্নর অব কোরিনথ সবাই আমাকে ডাকছে গল্প শোনার জন্য ৷ ডাক এল গ্রিসের ধনী ব্যবসায়ী অ্যারিস্টটল ওনেসিসের তরফ থেকেও ৷ মিঃ ওনেসিস আমার ভূ-পর্যটনের কথা শুনে ভূমধ্যসাগরের দ্বীপগুলো ঘোরার জন্য বিনা পয়সায় সব বন্দোবস্ত করে দিলেন ৷ অর্থাৎ জাহাজে ফার্স্ট ক্লাসে চেপে আমি ভূমধ্যসাগরের যে কোনও বন্দরে যেতে পারি ৷ পিরাও বন্দর থেকে গেলাম ক্রিট ও রোডোস হয়ে দক্ষিণে ইজিপ্ট পর্যন্ত ৷ জাহাজ ছাড়লাম আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে ৷ সেখান থেকে শুরু করলাম আবার সাইক্লিং ৷ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম নীলনদের সৌন্দর্য আর রহস্যাবৃত পিরামিড ৷ নীলনদের ধার ধরে সাইক্লিং শুরু করলাম ৷ দেখতে লাগলাম কায়রো, কোমোমবো, আবু সিমবেনের বিখ্যাত নীলনদের উপত্যকা ৷ নীলনদ ধরে সরাসরি ঢুকে পড়লাম সুদানে ৷ সময় লাগল প্রায় একমাস ৷ সুদানের সহজ-সরল মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হলাম ৷ পরিচিত হলাম পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ নুবিয়ানদের সঙ্গে ৷ ঘুরে ঘুরে দেখলাম দোংগলা, কারিয়েমা ও আবু হামিদ ৷ তারপর পৌঁছলাম সুদানের রাজধানী খার্তুমে ৷ খার্তুমের ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব আমাকে সম্বর্ধনা জানাল ৷ তারপর আবার নীলনদ ধরেই উঠে এলাম উত্তরে ইজিপ্টে ৷ প্রায় দুমাস পর আবার এলাম আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে ৷ জাহাজের যে টিকিটটা পেয়েছিলাম তার মেয়াদ ছিল একবছরের, কাজেই আবার ফিরে এলাম এথেন্সে ৷ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম মিঃ ওনেসিসকে ৷ এবারে পরিচিত হলাম গ্রিসের স্বনামখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডঃ কস্তা করিলোসের সঙ্গে ৷ তিনি আমাকে সরাসরি তাঁর বাড়িতে তুললেন ৷ তাঁর ছেলেও আমার বয়সী ৷ ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল ৷ দেখতে লাগলাম ঐতিহাসিক দেশ গ্রিস ৷ গ্রিসে প্রায় আড়াই মাস কাটালাম ৷ থাকা-খাওয়ার জন্য একটা পয়সাও খরচ হয়নি ৷ শরীর ও মন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ৷ উৎসাহে মনের জোর দ্বিগুণ বেড়েছে ৷ গ্রিসের টেলিভিশন প্রোগ্রামে ভারত ও তার দর্শন সম্পর্কে কয়েকবার বক্তৃতা দিয়ে ভালো পয়সা ও প্রশংসা দুই-ই পেলাম ৷ গ্রিসের বিভিন্ন শহর দেখে আবার জাহাজে চাপলাম ৷ করিনথোস, পাত্রাস ও কিরকিরা হয়ে ইটালির ব্রিন্দিসি বন্দরে এসে পৌঁছলাম ৷ সেখান থেকে শুরু হল আবার সাইক্লিং ৷

ইটালিতে পৌঁছেই বুঝলাম যে, গ্রিকরা যেমন দর্শন ভালোবাসে ইটালিয়রা তেমনই ভালোবাসে সাইক্লিং ৷ ব্রিন্দিসি ও বারি হয়ে রোমে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে নিয়ে প্রেসের লোকেরা হইচই শুরু করল ৷ রোমের ভারতীয় দূতাবাস আমাকে সম্বর্ধনা দিল আর বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক রোজালিনি আমাকে একটা পার্টিতে আমন্ত্রণ জানালেন ৷ সেখানেই পরিচিত হলাম মিসেস রোজালিনির সঙ্গে ৷ তিনি শান্তিনিকেতনের মেয়ে ৷ ডাকনাম সোনালি ৷

রোম সম্রাটের শহর ৷ এখানকার ভাটিকান সিটি, মিউজিয়াম আর বড় বড় প্রাচীন বাড়ি ও স্কোয়্যার দেখবার মতো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো আর পোপের আশীর্বাদধন্য এই রোম শিল্পীদের পীঠস্থান ৷

রোম, ভেনিস ও মিলানো হয়ে তারপর ধরলাম পাহাড়ি পথ দোমোদোসোলা ৷ শুরু হল আল্পস অভিযান ৷ রোম থেকে আমি দশ গিয়ারের সাইকেল উপহার পেয়েছিলাম, দিয়েছিলেন রোমের অলিম্পিক কমিটি ৷ তা সত্বেও ভীষণ কষ্ট ৷ প্রফেশনাল সাইক্লিস্ট ছাড়া এই পথে ওঠা অত্যন্ত কঠিন ৷ অধিকাংশ সময়েই হেঁটে উঠেছি ৷ আল্পস পার হতে লাগল চারদিন ৷ আল্পসের নয়নাভিরাম দৃশ্য সব কষ্ট ভুলিয়ে দিল ৷

ইউরোপে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা জিনিস লক্ষ করেছি যে, এখানকার লোকেরা শ্রমের দাম দিতে পারে আর পরিশ্রমীদের উৎসাহ দেয় ৷ ইউরোপের যে কোনও দেশে ভারতীয়দের ভিসা পাওয়া মুশকিল ৷ একবার ভিসা পেলে বাকি সমস্যার সমাধান সহজে হয়ে যায় ৷ খবরের কাগজে ভূ-পর্যটকের কথা উঠলে ভিসা পেতে অসুবিধা হয় না, এথেন্স থেকেই ইটালি, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ফ্রান্সের ভিসা সংগ্রহ করেছিলাম ৷ আল্পস পার হয়ে এসে পৌঁছলাম সুইজারল্যান্ডে ৷ এখন মে মাস ৷ রাস্তায় বরফ নেই ৷ সুইজারল্যান্ডে ঢুকেই বুঝলাম যে এটি একটি সাজানো দেশ; প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ৷ বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ, লোক আর চারদিক সবুজে ঢাকা ৷ সুইজারল্যান্ডে ঢুকলাম সিমলা দিয়ে ৷ আস্তে আস্তে পার হলাম ব্রিগ মনত্রো ৷ তারপর লেকের ধার ধরে পেলাম লজান আর লেকের শেষ অংশে পেলাম জেনেভা শহর ৷

জেনেভা আন্তর্জাতিক শান্তিকামী শহর ৷ দেখেই ভালো লেগে গেল ৷ এমন শহরে থাকাটাও যেন ভাগ্যের কথা ৷ এখানকার ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা দিতে গিয়েই পরিচিত হলাম ভারতদরদী মিস গ্রাঁজোর সঙ্গে ৷

সুইজারল্যান্ডে কয়েকদিন থেকে ধরলাম ফ্রান্সের পথ ৷ ফ্রান্স-সীমান্ত জেনেভা শহরকে ছুঁয়েছে ৷ কাজেই অসুবিধা হল না ৷ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী ৷ এখানে সবাই সবাইকে সম্মান করে ৷ আমি ফ্রান্সের দক্ষিণে রওনা হলাম ৷ আবার ভূমধ্যসাগরের দিকে ৷ পথে পড়ল আনেসি, গ্রনোবল, মঁপলিয়ে ও পেরপেনিয়াঁ ৷ তারপর ধরলাম স্পেনের পথ ৷

ফ্রান্সের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ আছে ৷ জনসাধারণ শিক্ষিত উদার আর বাঙালিদের মতোই আড্ডাবাজ ৷ দেশটি আমার মতো পরিব্রাজকদের স্বর্গরাজ্য ৷ এখানে রাতে থাকার কোনও অসুবিধা নেই ৷ মিউনিসিপ্যালিটি বা গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বললেই ব্যবস্থা হয়ে যায় ৷ ইটালি ও ফ্রান্সের লোকেরা সাইক্লিস্টদের বেশ সমীহ করে ৷ ইউরোপে আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছি, এখানে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলে মোটামুটি রাস্তা চলার মতো পয়সা উঠে যায় ৷ গ্রনোবলের পরই রাস্তা সমতল ৷ দিনে ২০০ কিলোমিটার অনায়াসে পার হওয়া যায় ৷

জেনেভা থেকে স্পেনের ভিসা নিয়ে নিয়েছিলাম, কাজেই সরাসরি পাড়ি দিলাম স্পেনের দিকে ৷ স্পেনের ফিগুয়েরাস পাড় হয়ে এসে পৌঁছলাম বার্সিলোনায় ৷ বিরাট শহর ৷ সেখানে করিদা খেলা দেখার সুযোগ হল ৷ ঘোড়ায় চড়ে ও হাতের ছোট বর্শা দিয়ে শক্তিশালী ষাঁড়কে নিহত করার খেলা ৷ স্পেনের এটা জাতীয় ক্রীড়া বলা যায় ৷ একটা অবলা জন্তুকে হাজার হাজার দর্শকের সামনে নিহত করার মাহাত্ম্য আমি কিছু বুঝলাম না ৷

বার্সিলোনা থেকে আমি মরক্কোর ভিসা পেলাম ৷ জিব্রাল্টার পার হবার জন্য আর কোনও ট্রানজিট ভিসার প্রয়োজন হল না ৷ বার্সিলোনা থেকে ভ্যালেনসিয়া মালাগা হয়ে জিব্রাল্টার ৷ জিব্রাল্টার পার হলাম ফেরিবোটে ৷ সময় লাগল প্রায় দুঘণ্টা ৷ মরক্কোর তানজে বন্দরে এসে আবার সাইক্লিং শুরু করলাম ৷ মরক্কোতে সবাই প্রায় ফরাসি ভাষা জানে ৷ ইংরিজির বিশেষ প্রচলন নেই ৷ এখানকার রাস্তাঘাট খুব উন্নত ৷ দেশটির বেশ কিছু অংশে মরুভূমি আছে ৷ মরক্কোর বড় বড় শহরগুলিতে ট্যুরিস্টদের জন্য খুব সুন্দরভাবে সাজানো হোটেল রয়েছে ৷ কেনিত্রা, রাবা, কাসাব্লাঙ্কা, মারাকেশ, বেনিমেল্লাল ও ফেজ ঘুরে তিন সপ্তাহ পর আবার ফিরে এলাম জিব্রাল্টারে ৷ সৌদি আরব, ইজিপ্ট, সুদান ও মরক্কো ঘোরার পর আর আফ্রিকার অভ্যন্তরে যাওয়ার ইচ্ছা হল না ৷ আমি তাই আবার ফিরে এলাম জিব্রাল্টার হয়ে ইউরোপে ৷

ইউরোপে আস্তে আস্তে সব দেখতে লাগলাম ৷ ইয়ুথ হস্টেল, বিভিন্ন শিক্ষাশিবির ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চলার পথে যোগাযোগ করতে লাগলাম ৷ আর সেইসঙ্গে দেখাতে লাগলাম এদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ৷ স্পেনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলাম উত্তরের দিকে ৷ সান্তামারিয়া, সেভিই, মেরিভা, মাদ্রিদ, সারাগোজা হয়ে আবার এসে পড়লাম ফ্রান্সে ৷ তারপর পো, অরলিয়াঁ-প্যারিস, বেভিই হয়ে এসে পৌঁছলাম ক্যালে ৷ প্যারিসে জঁন পিয়ার নামে একজন উকিলের বাড়িতে আটদিন ছিলাম ৷ সেখানকার সাইক্লিস্ট ফেডারেশন আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল ৷ বিভিন্ন পত্রিকায় আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত ছাপা হওয়াতে রাস্তায় নতুন করে আর পরিচয় দিতে হয়নি ৷

ক্যালে থেকে ডোভারে যাই বোটে ৷ লন্ডনে ভারতীয় ছাত্রাবাসে আটদিন ছিলাম ৷ বি বি সি থেকে দুবার ডাকল অনুষ্ঠান করার জন্য ৷ তাতে কিছু পয়সা পেলাম ৷ ব্রিটিশ সাইক্লিং ফেডারেশন সমস্ত গ্রেট ব্রিটেন ঘোরার জন্য সবরকমের সহযোগিতার আশ্বাস দিল ৷ তারপর ঘুরলাম অক্সফোর্ড, বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার ও লিভারপুল ৷ সেখান থেকে বোটে করে এলাম ডাবলিন ৷ সেখানে দেবলা মার্ফি আমাকে নদিন রাখলেন ৷ মিস দেবলা মার্ফি লন্ডন থেকে দিল্লি সাইকেল সফর করেছেন ৷ আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা হল ৷ আমি খুব উৎসাহিত হলাম ৷ সেখান থেকে এলাম বেলফাস্ট ৷ সেখান থেকে বোটে করে এলাম পোর্ট প্যাট্রিক, তারপর গ্লাসগো, কারনিসল, শেফিল্ড, কেম্ব্রিজ হয়ে আবার লন্ডনে ৷ লন্ডনের অনতিদূরে ব্রাইটনে দুমাস ছিলাম ৷ সেখানে একটি হঠযোগ কেন্দ্রে যোগ শেখাবার জন্য কাজ করি ৷

এরপর কার ধরে এলাম উস্টেন্ডে ৷ অর্থাৎ প্রবেশ করলাম বেলজিয়াম ৷ সেখান থেকে আসি ব্রুসেলসে ৷ সেখানে একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে দুসপ্তাহের জন্য কাজ করলাম ৷ তারপর লিয়েজ হয়ে পশ্চিম জার্মানির আখেন শহরে ঢুকলাম ৷ বন-এর ভারতীয় দূতাবাস তদানীন্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের আগমন উপলক্ষে আমাকেও সম্বর্ধনা দিল ৷ সেখানকার টেলিভিশনে পরপর তিনবার ডাক এল অভিজ্ঞতার কথা বলার জন্য ৷ পকেটে কিছু পয়সাও এল ৷ তারপর আবার শুরু করলাম ভ্রমণ ৷ জামার্নিতে অধিকাংশ সময়ে ইয়ুথ হস্টেলেই রাত কাটিয়েছি ৷ ডার্টমুন্ড, হ্যানোভার হয়ে এলাম ব্রিমেনে ৷ সেখানে এক জার্মান পরিবারে সপ্তাহখানেক কাটিয়েছি ৷ তারপর সেখান থেকে হামবুর্গ হয়ে কিয়েল ৷ কিয়েল ইউনিভার্সিটিতে ভারতীয় দর্শনের ওপর চারদিন চারটে বক্তৃতা দিয়ে কিছু পয়সা পেলাম ৷ ইউরোপে চলার পথ এখন আমার কাছে খুব সুবিধাজনক হয়ে গেছে ৷ এখানে প্রচারেই সব কিছু হয় ৷ জার্মানির খবরের কাগজগুলোতে আমার ট্যুর সম্পর্কে এত প্রচার হয়েছে যে, আমি নিজেও অবাক হয়ে গিয়েছি ৷ জার্মানি থেকে বোটে করে এলাম ডেনমার্কে ৷ কোপেনহেগেনে চারদিন থেকে চলে গেলাম সুইডেনে ৷ ঘুরে বেড়ালাম হেলসিংবুর্গ, হাস্কিয়ার্না, জোংকোপিং, নারকোপিং, স্টকহোম ৷ স্টকহোম ইয়ুথ হস্টেলে বিনা পয়সায় থাকার বন্দোবস্ত হল ৷ এক ভদ্রলোক তাঁর রেস্তোরাঁতে বিনা পয়সায় রোজ খাওয়াতেন ৷ সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গেও খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল ৷ থাকলাম দুসপ্তাহ ৷

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর ভিসা সীমান্ত থেকেই পেলাম, কোনও অসুবিধা হয়নি ৷ ইংরিজি জানলেই চলে ৷ সাধারণ মানুষরা হাসিখুশি বটে তবে খুব ঠান্ডা ধরনের, কম মিশুকে ৷ স্টকহোম থেকে ওরেব্রো, কালসবাদ, আর্সাকম হয়ে এলাম নরওয়ের অসলো শহরে ৷ রাজধানী হিসাবে শহরটাকে ছোটই মনে হল ৷ অসলোর নোবেল কমিটি আমাকে ডেকে একদিন চা খাওয়ালেন ও উৎসাহিত করলেন ৷ সেখানকার টেলিভিশনে বক্তৃতা দেওয়ার পরদিনই নর্থপোল যাবার আমন্ত্রণ পেলাম ৷ নর্থপোল ঘুরে এলাম রেজিনা মাগনা বোটে ৷ তাঁরা আমাকে ট্রমসোতে নামিয়ে দিলেন ৷ সেখান থেকে আবার সাইক্লিং শুরু করলাম ট্রনটাইম, ভিত্তেদাল, ওল্ডেন হয়ে স্টাভেনজ-এ এসে পৌঁছলাম বহু কষ্টে ৷ শীত এবং পাহাড়ি রাস্তায় খুব কষ্ট হয়েছে ৷ কোপেনহেগেনে ফিরে এসে আবার থামলাম দুসপ্তাহের জন্য, স্থানীয় এক ভদ্রমহিলার অতিথি হয়ে ৷

এরপর আবার এলাম জার্মানিতে, পার হলাম পূর্ব জামার্নির রস্টক, পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিন, লিপজিগ, তারপর এলাম পশ্চিম জার্মানির মিউনিখে ৷ পাসপোর্টে লেনিনগ্রাদের স্ট্যাম্প ছিল বলে ইস্ট ব্লকগুলোতে ভিসা পাওয়ার কোনও অসুবিধা হয়নি ৷ মিউনিখ থেকে ঢুকলাম সালসবার্গ অর্থাৎ অস্ট্রিয়ায় ৷ বড় বড় শহর ছাড়া ইয়ুথ হস্টেল নেই কাজেই অধিকাংশ সময়েই রাতে রাস্তার ধারে দরজায় ধাক্কা মেরে অনুরোধ করতে হয়েছে রাতের আশ্রয়ের জন্য ৷ অধিকাংশ সময়েই হতাশ হতে হয়েছে অথবা সামান্য দক্ষিণা দিয়ে বোঝাপড়া করতে হয়েছে ৷ কাসবুর্গ, ভিয়েনা, গ্রাজ, ভিলাস হয়ে এলাম ইটালির ত্রিয়েস্তা শহরে ৷ সেখানে দশদিন থাকলাম একটা ছোট্ট ইয়ুথ হস্টেলে ৷ তারপর ঢুকলাম যুগোস্লাভিয়ায় ৷ ত্রিয়েস্তা শহরটি অস্ট্রিয়া ও যুগোস্লাভিয়ার খুব কাছে ৷ লুবিয়ানা, জাগ্রেব, দুব্রোভেনিক, স্কপিয়া পার হলাম ৷ তবে পথ সুবিধার নয় আর জনসাধারণের কাছ থেকেও সহযোগিতা পাইনি ৷ তাই ওই পথে আবার ফিরে না গিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়লাম আবার গ্রিস ৷ থেসোলিনিকা শহর থেকে আবার চলে এলাম এথেন্সে ৷ গ্রিসে ডাঃ কারলোস আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘরে তুলে নিলেন ৷ এইবার গ্রিসে থাকলাম দেড়মাস ৷ ডাঃ কারলোস বললেন, আর একই পথে সাইক্লিং করতে হবে না, তিনি আমার হতে একটি পিরাও-জেনোয়ার টিকিট ধরিয়ে দিলেন ৷ অবশ্যই জাহাজের টিকিট ৷ রাজসিক হালে এসে পৌঁছলাম ইটালির জেনোয়া বন্দরে ৷ জেনোয়া থেকে আওস্ট হয়ে পার হলাম ইউরোপের সবচেয়ে লম্বা টানেল, মঁ ব্লাঁ ৷ সাইকেল চালানো নিষেধ ৷ তাই বাস ধরতে হল ৷ ইটালির দিকে পায়ে হেঁটেই উঠেছিলাম ওপরে আল্পস পেরোবার জন্য ৷ অত্যধিক কষ্টকর টানেল শেষ হয়েছে ফ্রান্সের শাঁমোনিতে ৷ সেখান থেকে আনমাস হয়ে আবার এলাম জেনেভায় ৷ মিস গ্রাঁজো আমাকে তুলে নিলেন নিজের ঘরে ৷

ইউরোপ ট্যুর শেষ করলাম ৷ এবার তৈরি হতে লাগলাম মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার জন্য ৷ ইউনাইটেড স্টেটস-এ যাবার জন্য চাই প্রচুর টাকা ৷ প্লেনভাড়া, হাতখরচা ও সেখানে ঘেরাফেরার জন্য যথেষ্ট টাকা না দেখালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না ৷ শুরু হল চাকরির চেষ্টা ৷ ভাগ্য ভালো, জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন আমাকে একটা কাজ দিল ৷ তিন মাস চাকরি করার পর পেয়ে গেলাম আমেরিকার ভিসা ৷ শুধু তাই নয়, আইসল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত মিঃ বেনেডিক্ট আইসল্যান্ড হয়ে নিউইয়র্ক যাবার খুব সস্তায় টিকিট পাইয়ে দিলেন ৷ লুক্সেমবুর্গ থেকে আইসল্যান্ডে এসে রাজধানী রেকজাভিকে থাকলাম কয়েক সপ্তাহ ৷ এই আইসল্যান্ড থেকেই আমি যাই গ্রিনল্যান্ডে ৷ আইসল্যান্ডের হেকলা ক্যাম্পিং-এও কিছুদিন ছিলাম ৷

আইসল্যান্ড থেকে পরে এসে পৌঁছলাম নিউইয়র্কে ৷ নিউইয়র্কে শিল্পমেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ৷ নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, ওয়াশিংটন, পিটসবার্গ, ক্লিভল্যান্ড, বাফেলো, ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক যোগ সংস্থা (International Yoga Federation) এবং শ্রীমতী রুবি ব্রু আমাকে খুব সাহায্য করেছেন ৷ বাফেলো থেকে চলে যাই কানাডায় ৷ কানাডা থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখে টরেন্টো অটোয়া হয়ে আসি মন্ট্রিলে ৷ সেখানে উত্তরের কাবোংগা এস্কিমোদের সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল ৷ মন্ট্রিলের অনতিদূরে ভালো মরিন নামক স্থানে স্বামী বিষ্ণু দেবানন্দাশ্রমে আশ্রম সংগঠনের জন্য তিনমাস থাকলাম ৷ সেখানেই পরিচিত হলাম পণ্ডিত রবিশংকরের সঙ্গে ৷

কুইবেক থেকেই আবার যাই গ্রিনল্যান্ড, আংগমাগশালিক ও গডসহাব ৷ ঘুরে বেড়াই এস্কিমোদের সঙ্গে ৷ তারপর ফিরে আসি আবার কানাডায় ৷ কুইবেক থেকে ভ্যাংকুভার পর্যন্ত সাইক্লিং করি ক্যানাডিয়ান ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে ৷ তারপর সেখান থেকে দল ছেড়ে চলে যাই আলাস্কার কাচিকান শহরে ৷ আলাস্কা থেকে প্লেনে ফ্রি রাইড পেয়ে চলে আসি চিকাগোতে ৷

চিকাগোতে প্রফেসর বেকটেলের বাড়িতে দুমাস কাটাই, ইস্তাম্বুলে এই প্রফেসারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ৷ এই দুমাস হুইটন কলেজে ও অন্য ক্যাম্পিং এরিয়াতে কাজ করি ৷ এখন থেকেই দক্ষিণ আমেরিকা যাবার জন্য প্রস্তুতি আরম্ভ করি ৷ বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করবার সুযোগ পাই এবং তাঁরাই প্রেস পাবলিসিটির মাধ্যমে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৷ তাঁরা আমাকে দুবার বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেন ৷ ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিকসনের সঙ্গেও কথাবার্তা হয়েছিল ৷ আমেরিকায় সবসুদ্ধ ছিলাম দুবছর ৷ তারপর আবার শুরু করি সাইক্লিং ৷

সেন্ট লুইস, কানসাস, র্যাপিড সিটি, ব্ল্যাক হিল, সল্ট লেক সিটি, সানফ্রান্সিসকো, সান্তা বারবারা, লস অ্যাঞ্জেলস, লাস ভেগাস, গ্র্যান্ড ক্যাপিয়ন, আলবুকার্ক ফোনিক্স, তিসকন হয়ে ঢুকে পড়ি মেক্সিকোতে ৷ মেক্সিকো থেকে শুরু হয় আবার নতুন অভিযান ৷ মেক্সিকোর মায়া স্থাপত্য আর সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রা দেখে অবাক হয়ে যাই ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এত কাছে অথচ সম্পূর্ণ এক আলাদা জগৎ ৷ মেক্সিকোর নোগাল, গুইমাস গুয়াদালাজারা, মোরেলিয়া হয়ে মেক্সিকো সিটিতে এসে থামলাম ৷ প্রায় কুড়ি দিন মেক্সিকো সিটির চারদিকে ঘুরে আবার রাস্তা ধরলাম, মেক্সিকোর লোকেরা খুব হাসিখুশি ও আমুদে ৷ এরা গরিব কিন্তু ভীষণ পরোপকারী ৷ গান-বাজনা করেই এরা বেশি আনন্দ পায় ৷ এখানে ডলারের মূল্য কম ৷ পুয়েবলো, ভেরাক্রজ, পালেংক, মেরিদা, চিচেন পার হয়ে এলাম গুয়াতেমালায় ৷ ইউনাইটেড স্টেটস থেকেই এইসব দেশের ভিসা নেওয়া ছিল, কাজেই কোনও অসুবিধা হল না ৷

গুয়াতেমালার স্যান জোসে ঘুরে আস্তে আস্তে দক্ষিণদিকে পা বাড়ালাম ৷ ছোট ছোট দেশ ৷ এখানকার মূল ভাষা স্প্যানিশ তবে ইংরিজি জানা থাকলে কোনও অসুবিধা হয় না ৷ জনসাধারণের হাবভাব খুব মিশুকে ৷ এল সালভাডোরের সান সোনাটিও এবং সান সালভেডোর ঘুরে এসে ঢুকলাম মানাগুয়ায় ৷ সেখানকার পনতারেলাস ও সান জোসে পার হয়ে এলাম পানামায় ৷ পানামা বরডার টাউন ডেভিড তারপর বোথেন ৷ এখানে এসে আমি থামতে বাধ্য হলাম ৷ দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া, পেরু, চিলি, বলিভিয়া ইত্যাদি দেশগুলোতে সাইক্লিং করার জন্য ভিসা পেলাম না ৷ সিকিউরিটির দোহাই দিয়ে আমাকে নিরস্ত করল ৷ অন্য উপায় না পেয়ে অনেক খোঁজখবর করে শেষে একটা ফ্রেঞ্চ মার্চেন্ট নেভিতে চাকরি পেলাম, থাকা-খাওয়া আর সামান্য হাতখরচার বিনিময়ে দেশ দেখা যাবে ৷

কাজেই আমার কাছে একটা বিরাট পাওয়া ৷ জাহাজে চারমাস ঘুরলাম ৷ কলম্বিয়ার কারতাগেনা ও তান্তা মারিয়া ৷ তারপর এলাম ভেনিজুয়েলায় ৷ ঘুরলাম কারাকাস ও কুসানা ৷ তারপর ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেন ৷ শেষে আবার ফিরে এলাম পানামায় ৷ পানামায় পরিচিত হলাম সমুদ্রবিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন কুবের সঙ্গে ৷ তিনি আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমাকে তাঁর দলভুক্ত করে নিলেন ৷ তাঁর ইয়টে করে ঘুরলাম প্রশান্ত মহাসাগরের বহু জানা ও অজানা দ্বীপ ৷ বিশেষ করে চিলির অন্তর্ভুক্ত গালাপাগোস ও তাহিতি ৷ ফরাসি পলিনেসিয়ার তাহিতি দ্বীপে আমি বেশ কিছুদিন থাকি ৷ দ্বীপবাসীদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতার কথা চিরদিন মনে থাকবে ৷

তাহিতির পর এলাম অভিশপ্ত দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ড, যার নাম ফরাসিতে ইল-দ্য-প্যাক, স্প্যানিশ ভাষায়-ইসলা দ্য-পাসকুয়া ৷ যেখানে বিরাট বিরাট রহস্যময় স্ট্যাচু দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে ৷ প্রায় ছ-মাস বিভিন্ন দ্বীপে এদিক-ওদিক ঘুরে ইস্টার আইল্যান্ড থেকে প্লেনে এলাম নিউজিল্যান্ডের রাজধানী অকল্যান্ডে ৷ এখানে পেলাম প্রচুর উৎসাহ ৷ বন্ধুত্ব হল অনেক পর্বতপ্রেমিকের সঙ্গে, বিনিময় হল অভিজ্ঞতা ৷ নিউজিল্যান্ড অতি সুন্দর দেশ ৷ বলা হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সুইজারল্যান্ড ৷ নিউজিল্যান্ডের সাইক্লো-ট্যুরিস্ট অ্যাসোসিয়েশন আমাকে উপহার দিল আবার আসার একটা টিকিট ৷ সেখান থেকে এলাম প্লেনে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ৷ অস্ট্রেলিয়ান স্কাউটদের নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম ৷ ব্রিসবেন ও কেপ ইয়র্কে ৷ অস্ট্রেলিয়া থেকে জাকার্তায় এলাম কোয়েন্তাস এয়ারওয়েজে ৷ সেখানে দুদিন ঘুরে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে সিঙ্গাপুর হয়ে এলাম মাদ্রাজে ৷

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মহাসচিব উ থান্ট আমাকে বারবার করে বলেছিলেন যে ভূ-পর্যটন শেষ হলেই যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি ৷ তিনি চান যে, আমি আন্তর্জাতিক মহলে কাজ করি ৷ আবার ওদিকে সুইজারল্যান্ডের মিস গ্রাঁজো জেনেভায় আমার জন্য একটা কাজের বন্দোবস্ত করে রেখেছেন ৷ সিডনিতে থাকতেই টেলিফোনে কথা হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন জেনেভায় যাই ৷

কাজেই মাদ্রাজ থেকে কলকাতা সাইকেলে না গিয়ে বিমানে কলকাতায় এসে আমার ভূ-পর্যটনের অধ্যায় শেষ করি ৷ কলকাতায় যাঁরা সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করব অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অব স্পোর্টস-এর প্রাক্তন সম্পাদক শম্ভুনাথ মল্লিক, জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘের তরফ থেকেও অনেকেই এসেছিলেন ৷ এক্সপ্লোরার ক্লাবের সভ্য-সভ্যারা ৷ ভারতীয় স্কাউটস অ্যান্ড গাইডস-এর সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন ৷

ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন