অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
ভরসা একটাই, গাড়িটা ফোর হুইল ড্রাইভ ৷ না হলে এতক্ষণে বোধহয় পিছনে গড়াতে শুরু করতাম ৷ এইবার খানিকটা সমতল ৷ ওটাই বুঝি ‘গোয়িং টু দি সান’ মাউন্টেন? তবে তো আসল জায়গাতেই এসে পড়েছি-লোগন পাস, গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক ৷
যাত্রা করেছিলাম গতকাল সন্ধে আটটায় সল্টলেক সিটি থেকে ৷ আমাদের সাতজনের দলে তিনজন দক্ষ ড্রাইভার-তাই চিন্তা কী! অতিকায় সাবার্বান গাড়ি ছুটেছে একনাগাড়ে প্রায় সাতশো মাইল ৷ চলে এসেছি আমেরিকার মনটানা রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমে আন্তর্জাতিক শান্তি উদ্যান হিমবাহের জন্মভূমিতে ৷
নামটি গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক হলেও জ্যান্ত হিমবাহের আখড়া নয় এটি মোটেও ৷ প্লেয়িস্টোসিন যুগে হিমবাহের রমরমা ছিল এখানে ৷ মহাশিল্পীর খেয়ালে সেই সমস্ত হিমবাহই রূপ দিয়েছে এখানকার ভূপ্রকৃতিকে ৷
ওয়েস্ট গ্লেসিয়ারে বাঁয়ে একটা জব্বর মোড় নিতে হল ৷ একটা বিরাট তোরণের ভেতর দিয়ে যখন ঢুকছি পার্কের সীমানার মধ্যে তখন বুকটা হঠাৎ দুরুদুরু করতে লাগল ৷ তবে কি আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে! মার্কিনি জাতীয় সড়ক-২-কে ডাইনে ছেড়ে, ‘গোয়িং টু দি সান রোড’-কে একটুখানি ছুঁয়ে এসে দাঁড়ালাম পার্কের সদর দপ্তর আপগারে ৷ রেঞ্জার যখন হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিলেন পার্কের নিজস্ব মানচিত্র আর ক্যাম্পসাইটের প্রবেশাধিকারপত্র তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না এমন স্বর্গীয় জায়গায় প্রবেশ করার সৌভাগ্য আমার সত্যি হয়েছে বলে ৷
গত এক সপ্তাহ ধরে ইন্টারনেট তোলপাড় করে এত তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম যে মনে হচ্ছিল না গিয়েই পৌঁছে গেছি আমার স্বপ্নের গন্তব্যে ৷ কিন্তু আজ সত্যি যখন এসে গিয়েছি এখানে তখন বুঝতে পারছি আমাদের জ্ঞেয় অনুভূতির ওপারে অজ্ঞেয় পুরুষ এত রূপ রস শব্দ গন্ধ দিয়ে এই পৃথিবীকে সাজিয়ে রেখেছেন যে যতক্ষণ না তাঁর সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করছি ততক্ষণ তার স্বরূপ বোঝার উপায় নেই ৷
১৯৩২ সালে প্রায় দশ লক্ষ একর জমি নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই জাতীয় উদ্যান ৷ কানাডার অ্যালবার্টা প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে ওয়াটারটন ন্যাশনাল পার্কের প্রায় ৭৪ হাজার একর এলাকাও এই পার্কে সামিল হয়েছে ৷ হিমবাহ চলার পথে এক বিশেষ রূপ দিয়ে যায় ভূ-প্রকৃতিকে ৷ উচ্চবচ ড্রামলিন, এস্কার আর ঘন সবুজাভ নীল হ্রদগুলি স্মরণ করায় সে কথা ৷ দুর্গম এই জাতীয় উদ্যানে বরফ গলে অনেক দেরিতে ৷ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে যাওয়াই শীতকাতুরে বাঙালির পক্ষে অনুকূল ৷
অনেক দুর্লভ প্রাণী ও উদ্ভিদের সংগ্রহশালা বলা যায় এই উদ্যানকে ৷ গ্রিজলি ভালুক, ধূসর নেকড়ে আর ঈগল হল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ৷
এ তো গেল তথ্যের কচকচি ৷ আসল কথা হল, যেই যাত্রা শুরু করলাম ‘গোয়িং টু দি সান রোড’ ধরে লেক ম্যাকডোনাল্ডকে বাঁয়ে রেখে পূর্বমুখে সোজা সেন্ট মেরির উদ্দেশে, তখুনি মনে পড়ে গেল নগাধিরাজ হিমালয়কে ৷ তফাতটা খালি ব্যবস্থাপনায় ৷ হৃষীকেশের বাসস্ট্যান্ডে এক্কেবারে বোকার মতো দাঁড়িয়ে জনস্রোতে নাকাল হওয়া আর সুপরিকল্পিত পারিপাট্যের মার্কিনি রকি মাউন্টেনে বেশ একটা ফারাক আছে ৷ ভারতীয় হিসাবে বুকে একটা ব্যথা জাগে-সব থেকেও আমাদের কিছুই নেই ৷
হঠাৎ ব্রেক কষতে হল ৷ সামনে সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে ৷ একপাল এল্ক নাকি দেখা গেছে রাস্তার ধারেই ৷ দূরবীন হাতে আমিও ব্যর্থ চেষ্টা করি তাদের খুঁজে পাওয়ার ৷ আবার চলতে শুরু করি ৷ রেঞ্জার বলে দিয়েছিলেন ক্যাম্পসাইটে না পৌঁছে আর কোনও অ্যাডভেঞ্চারের চেষ্টা না করতে ৷ গোয়িং টু দি সান রোড দৈর্ঘ্যে মাত্র ৫২ মাইল হতে পারে কিন্তু বাস্তবে দু ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে এইটুকু পথ পেরোতে ৷ দুর্গম এই পথ; কিন্তু পথের ধারে রূপের ডালি সাজিয়ে রেখে প্রকৃতিদেবীই সব হিসাবের কড়ি লুকিয়ে ফেলেন-দেরি হয় তাতেই ৷
লালমুখো এক কাঠবেড়ালী ৷ একলাফে গাছ থেকে নেমে সটান আমার কাছে চলে এল ৷ নিশ্চিন্তে আমার হাতের মুঠোর মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দেখে গেল খাবারদাবার আছে কিনা ৷ খাবার দেওয়া বারণ ৷ অ্যালপাইন প্রকৃতির বনজ প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস বদলে দেওয়ার চেষ্টা দণ্ডনীয় অপরাধ ৷ এটা হল লোগান পাস ৷ এই পথের উচ্চতম অংশ ৷ চারধারে তুষারমৌলি শৃঙ্গরাজি ৷ মধ্যে ঘাসের গালিচায় বসে মনটানার বাঙালি ৷ খনিবিদ্যার উচ্চশিক্ষা নিতে এসে পথের নেশায় বেরিয়ে পড়েছি অধরাকে ধরতে ৷ সঙ্গে ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তামিল ছাত্র ছয়টি ৷ বাক্যালাপ হয় আবার ইংরিজিতে!
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ পথের ডানদিকে দেখা গেল সেন্ট মেরি লেক ৷ পথপার্শ্বের ঘন সবুজ আবরণের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে উঁকি দিতে লাগল ট্রিপল ডিভাইডের শৃঙ্গ ৷
এই তো এসে পড়েছি! বাঁয়ে ওটাই তো ক্যাম্পসাইট ৷ এক্কেবারে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে ৷ কিন্তু মুশকিল আবার ওটাই ৷ গ্রিজলি ভালুকরা ভুলে যায় যে ওটা তাদের পথের মধ্যে পড়ে না ৷ বজ্জাত কালো ভালুকরা আবার ভেবেই নেয় মানুষের খাদ্যে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার-আর তাতেই বাধে সংঘর্ষ ৷ ক্যাম্পসাইটের কঠিন অনুশাসনে বারংবার বলা আছে, খাদ্যের ব্যাপারে সাবধানতার কথা ৷ কোথাও যেন এতটুকু উচ্ছিষ্ট পড়ে না থাকে; রাতের পরিধেয় বস্ত্রে যেন খাবারের গন্ধ না থাকে; আরও কত কী! কিন্তু বাপু রাতে যদি অন্ধকারে তিনি না দেখতে পেয়ে আমার তাঁবুটিতে হোঁচট খান-তবে কী হবে?
পরের কথা পরে ৷ এখন আলো থাকতে থাকতে দৌড় লাগাতে হবে মেনি গ্লেসিয়ার উপত্যকার দিকে ৷ তাঁবু খাড়া হল; একটা করে স্যান্ডউইচ পেটে পড়ল, আবার সেই সেভি সাবার্বান গাড়ি দুদ্দাড় করে ছুটল ৷
মেনি গ্লেসিয়ার পার্কের অন্য জায়গাগুলোর থেকে বেশ বিচ্ছিন্ন আর প্রকৃতির আরও যেন অন্তঃপুরে ৷ অনেকগুলো হিমবাহজাত হ্রদ আছে এই উপত্যকায় আর আছে গ্রিজলি ভালুকের নিকট সান্নিধ্য ৷ দূর থেকে একজন একটু দর্শন দিলেন; তবে কাছে এলেন না ৷
দুধসাদা নৌকো যাচ্ছিল দিনের শেষ ফেরিটা দিতে ৷ সাত ভারতীয়ের বিজাতীয় আর্তরবে দাঁড়িয়ে পড়ল সে ৷ তবেই না সম্ভব হল আমাদের গ্লেসিয়ার লেকে জলযাত্রা ৷ এটা সুই• কারেন্ট লেক ৷ জলের রং যে এত সুন্দর হয় জানা ছিল না ৷ এ যেন আকাশ ধরা পড়ে গেছে মর্তের ছলনায় ৷ বোটের চালিকা হলেন মনটানারই এক হাসিখুশি তরুণী ৷ বুঝিয়ে বলছিলেন কেন লেক জোসেফিন আরও ঘন নীল সুই• কারেন্ট লেকের থেকে ৷ গ্লেসিয়ার ফ্লাওয়ার কেমন করে নীল করে তোলে জলের রং ৷
রাতের অন্ধকার নামে এখানে প্রায় দশটায় ৷ সুতরাং অসুবিধা কী? মোটরবোটের পালা শেষ হতেই দাঁড় হাতে ক্যানুতে ৷ প্রকৃতিতে মিশে যাই ৷
রাতে বুকটা যে একটু দুরুদুরু করেনি তা বলতে পারি না; তবে ভালুক আসেনি ৷ তাই পরদিন সকাল দশটা নাগাদ রেঞ্জার অফিসে একগাল হাসি দিয়ে দ্বিতীয়দিনের যাত্রাটাও শুরু করলাম নির্বিঘ্নে ৷ আজকের তালিকায় দুটি গন্তব্য-হিডন লেক আর লেক কিন্টলা ৷
হিডন লেক যেতে হয় হাঁটাপথে লোগান পাস থেকে ৷ তাই ফের চলেছি পশ্চিমে-আবার সেই ‘সূর্যমুখী’ পথে ৷
ক্লেমেন্টস মাউন্টেনের পায়ের তলা দিয়ে ‘তাইরে নাইরে না’ করে চলেছি ৷ অল্প চড়াই ৷ হঠাৎ চুপচাপ! সবাই চুপ! বন্যপ্রাণী দেখা গেছে ৷ যদিও দেশে ফিরলে লোকে বলবে ‘ছাগল দেখে ফিরে এলি?’ কিন্তু সত্যিই নাকি সংবেদনশীল এই অ্যালপাইন প্রকৃতিতে পাহাড়ি বন্য ছাগলের দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা ৷
আপগার থেকে লেক কিন্টলা ৩০ মাইল হল পাথুরে রুক্ষ পথ ৷ আমেরিকার মোমের মতো মসৃণ রাজপথ নয় ৷
সত্যি এ এক অপরূপ অভিজ্ঞতা ৷ বাঁধাপথের বাইরে অকৃত্রিম আদিম বন্যতা ৷ আদিম অরণ্য, অফুরন্ত প্রাণ, আদিম আমেরিকার সভ্যতার চিহ্ন ছড়ানো এখানে ওখানে ৷ লেক কিন্টলার জনহীন তীরে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছিল সভ্যতার প্রথম সোপানে ৷
কিন্তু এই স্বর্গের রাজ্যে থাকার মেয়াদ শুধু আজকের রাতটুকু ৷ ফিসক্রিক ক্যাম্পসাইটে অত্যুচ্চ বনস্পতিদের মধ্যে রাতটুকুও কেমন যেন সুখস্বপ্নের মতো ফুরিয়ে গেল ৷ আবার জাতীয় সড়ক-২-আবার বিউট, আবার সল্টলেক সিটি ফিরে চলা চিরব্যস্ত মানব সভ্যতার দৈনন্দিনতায় ৷
গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ও মানচিত্র পাওয়া যাবে www.nps.gov/glac থেকে অথবা টেলিফোনে (৪০৬) ৮৮৮-৭৮০০ থেকে ৷ ঠিকানা: গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক, পোস্টবক্স-১২৮, ওয়েস্ট গ্লেসিয়ার, এম টি ৫৯ ৯৩৬, ইউ এস এ ৷
নিকটতম বড় শহর মিসুলা প্রায় ১৮০ মাইল ৷ মিসুলা থেকে সল্টলেক সিটি এবং লস এঞ্জেলেসের নিয়মিত বিমান যোগাযোগ আছে ৷
ভ্রমণ জুলাই, ২০০২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন