পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

পিছনে পড়ে রইল কাঞ্চনজঙ্ঘা অঞ্চল ৷ গত কয়েকদিন আমার সমস্ত অস্তিত্বের সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা ৷ এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে হাঁটা, নতুন পথ ৷ পথপ্রদর্শক দোরজে ছেত্রীকে সামনে রেখে বরফের পথে উঠে এসেছিলাম নেপাল-সিকিম সীমান্তে সিঙ্গালিলা গিরিশিরার ওপর অবস্থিত চোংপা লা (উচ্চতা ৪,৪৩৬ মিটার) গিরিবর্ত্মের ওপর ৷ কাংলা কাং পর্বতচূড়ার দক্ষিণে এর অবস্থান ৷ পশ্চিম দিগন্তে ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে ক্ষণিকের জন্য উঁকি মারে মাকালু, লোৎসে ও এভারেস্ট শৃঙ্গমালা ৷ এক স্বপ্নময় মনোরম দৃশ্য ৷ আর পূর্বে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ ৷ দোরজে দেখিয়ে দেয় আমাদের পরবর্তী পথের নিশানা ৷ চোংপা লা হয়ে রিম্বি যাবার পথ ওর নখদর্পণে ৷ সময় লাগবে মাত্র দুদিন ৷ ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং সরকারি স্কুলের শিক্ষক শরৎচন্দ্র দাস মহাশয় দার্জিলিং থেকে লাসা যাবার পথে অর্থাৎ দ্বিতীয়বার তিব্বত যাবার পথে অতিক্রম করেছিলেন এই অঞ্চলের চুম্বক লা নামে একটি গিরিবর্ত্ম ৷ আমার ধারণা চোংপা লা ও চুম্বক লা একই গিরিবর্ত্ম ৷ এবার নামার পালা ভারতের মাটিতে ৷ তাঁবু ফেললাম পবিত্র জলাশয় রঙিন পোখরির ধারে ৷ এই অঞ্চলের অপর নাম সোদামদং ৷ আজ ৩০ অক্টোবর ১৯৯১ ৷ পূর্বশর্ত অনুযায়ী পরদিন সকালেই ছেড়ে দিতে হবে দোরজেকে ৷ সামনে ভাইটিকার উৎসব ৷ তাই ও বাসপথ অবধি আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হল না ৷ রাতে ভালো করে পরবর্তী পথের নকশা এঁকে নিলাম ৷

ভোর হতেই দোরজে আমাদের বিদায় জানিয়ে চোংপা লার দিকে এগিয়ে চলল ৷ আমরাও সমস্যায় পড়লাম ৷ এই নির্জনপুরীতে কে আমাদের পথ দেখাবে, কেইবা বইবে এত সব মালপত্র ৷ অগত্যা মালপত্রগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলাম ৷ নিজের জিনিসপত্র ছাড়াও আরও কিছু মাল চাপল ৷ প্রায় সমতল পথ ৷ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বোকতো খরকা (খরকার অর্থ পশুপালকদের অস্থায়ী আস্তানা) ৷ কোনও জনমানবের দেখা নেই ৷ একটু জিরিয়ে আবার পথ চলা ৷ সামনে আরও কয়েকটা শূন্য চালাঘর ৷ মূল পথটা চলে গেছে সম্ভবত তেগ্যাপ লার দিকে ৷ আমরা ডানদিকের এবড়োখেবড়ো পাথর ডিঙিয়ে উতরাই পথে নেমে এলাম বোকতো চু-এর ধারে (চু-র অর্থ নদী) ৷ একটুকরো কাঠের গুঁড়ির ওপর দিয়ে নালা পেরিয়ে একটা পশুপালকদের ঘর ৷ ভাঙা ভেজানো দরজাটা সরিয়ে ঢুকে পড়ি ৷ রান্না খাওয়া করতেই দিন পড়ে এল ৷ সকলের মত, তাঁবুতে না থেকে এ ঘরে একটু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যাক ৷ বহু বছরের প্রচেষ্টায় কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকের ও উত্তর-পশ্চিমদিকের মূল শিবির অঞ্চলে এক সফল পদযাত্রা অভিযান করে ঘরে ফেরার পালা ৷ ঠিক ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ে ট্রেকিংয়ের শেষে পূর্ব নেপালের ইয়ালুং ও নিরাংমা উপত্যকা হয়ে কাংলা গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করে পৌঁছে যাব জোংরি কিংবা চোরিকিয়াং হয়ে জোংরি ৷ কিন্তু বাদ সাধল আমাদের পথপ্রদর্শক ৷ ও কাংলার সঠিক পথ জানে না ৷ তাই দোরজে আমাদের চোংপা লা টপকে নামিয়ে দিয়েছিল সিকিমে ৷ আর ৪-৫ দিনের মধ্যে কলকাতা ফিরছি ৷

ভোর হতেই চড়াই পথে চলতে শুরু করলাম ৷ প্রোগ্রামের শেষের দিকে এত মাল নিয়ে চড়াই উঠতে বেশ কষ্ট হয় ৷ একটা ছোট্ট নালার ধারে ধারে স্পষ্ট পথে হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে এলাম এক বুগিয়াল এলাকায় ৷ যেন এক সবুজ গালিচা ৷ ডানদিকের স্পষ্ট পথটা এগিয়ে গেছে লক্ষ্মী পোখরির দিকে ৷ মালপত্র রেখে দোরজে নির্দেশিত পথটা দেখতে গেল এক সদস্য ৷ পূর্বদিকে গিরিশিরাটির শীর্ষে যাবার স্পষ্ট পথ রয়েছে ৷ ওর পিছু পিছু উঠে এলাম গিরিশিরাটির শীর্ষে ৷ স্পষ্ট হল চারদিকের দৃশ্যাবলি ৷ আমরা বিস্ময়স্তব্ধ ৷ ম্যাপ নিয়ে বসে পড়লাম শৃঙ্গমালার নাম উদ্ধারে আর সেই সঙ্গে নিজেদের অবস্থান খুঁজতে ৷ Contour ম্যাপের Xerox Copy নিয়ে বসলাম ৷ কাংলা কাং, কোকতাং, রাথোং, কাবরু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, পাণ্ডিম ও আরও অনেক শৃঙ্গমালা ৷ সব দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে ৷ অনেক দূরে রাথাং চু অববাহিকা ঘন অরণ্য ছাড়িয়ে অস্পষ্ট দেখা গেল জোংরির ডাকবাংলো ৷ আর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের বনানী অঞ্চলের ওপর ঘন মেঘের আবরণ ৷ আমাদের ধারণা আমরা পৌঁছে গেছি জামলে পাস বা দরুলার ওপর ৷ এখান থেকে জোংরির দিকে যাবার সরাসরি কোনও পথ নেই ৷ সেই মুহূর্তে জোংরি যাবার কোনও পরিকল্পনাও আমাদের ছিল না ৷ আমরা দোরজে নির্দেশিত দক্ষিণমুখো এক সুস্পষ্ট এবং প্রায় সমতল পথে চলতে শুরু করলাম ৷ পাহাড়ের ঢালে বাদামি ঘাসের মধ্য দিয়ে আড়াআড়িভাবে পৌঁছে গেলাম গোপেথাং খরকা ৷ অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করেও কোনও লোকজনের সাড়া মিলল না ৷ শীত আসতে আর বেশি দেরি নেই ৷ সবাই গবাদি পশু নিয়ে নেমে গেছে ওদের গ্রামের বাড়িতে ৷ আমাদের দক্ষিণে আরেকটা গিরিশিরার ঢাল নেমেছে ৷ এখান থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বদিকে পর পর তিনটে স্পষ্ট পথ চলে গেছে গিরিশিরাটির দিকে ৷ এই গিরিশিরাটি পেরোতে হবে ৷ কিন্তু পথ জানা নেই ৷ ঠিক তখনই দক্ষিণ কোণে দেখতে পেলাম দুজন লোক নেমে আসছে গিরিশিরাটির সর্বোচ্চ পথ ধরে ৷ আমরা চিৎকার করে ডাকতে থাকি ৷ ওরা ভয় পেয়ে লুকিয়ে পড়ে ৷ আমরাও নাছোড়বান্দা ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে ভয়ে ভয়ে নেমে আসে ওরা ৷ পশ্চিম সিকিমের বাসিন্দা তেগবাহাদুর সুব্বা সঙ্গে একজন মালবাহককে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন ৷ নেপালে গিয়েছিলেন তীর্থ দর্শনে ৷ এ অঞ্চলের কয়েকটা পবিত্র জলাশয় দর্শন করে বাড়ি ফিরবেন ৷ এ এলাকার পথঘাট সম্বন্ধে ওঁরা কিছু জানেন না ৷ আমরা জানাই যে আমাদের গন্তব্যস্থল রিম্বি ও নির্দেশিত পথ দক্ষিণ হয়ে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ৷ সুব্বা জানায় যে ওঁরা ওদিক থেকেই আসছেন ৷ আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি ৷ তবে কি ভুল পথে আবার নেপালের দিকে চলেছি ৷ ক্রমে দোরজে নির্দেশিত পথে আস্থা হারাই ৷ এরই মধ্যে চারদিকটা ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেল ৷ দূরের পথঘাট আর কিছুই দেখা যায় না ৷ বিভ্রান্তিকর অবস্থায় নামা শুরু হল সুস্পষ্ট এক উতরাই পথ ধরে ৷ সঙ্গে ওঁরা দুজন ৷ এপথ দোরজে নির্দেশিত পথ নয় আবার সুব্বার নির্ধারিত পথও নয় ৷ সুব্বার দেওয়া ভুট্টাভাজা খেতে খেতে দ্রুতগতিতে নামছি ৷ ক্রমে ঘাস অঞ্চলের শেষে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম ৷ কুয়াশার মধ্যে অস্পষ্ট রডোডেনড্রন গাছগুলো অদ্ভুত লাগছে ৷ ঘন কুয়াশায় দিক নির্ধারিত করতে ও পথঘাট খুঁজতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে ৷ অনেকক্ষণ চলার পর একটা ছোট্ট নালার ধারে পৌঁছলাম ৷ আমাদের ধারণা এটা নিশ্চয়ই চলেছে রিম্বি চু নদীর দিকে ৷ নালাটি পেরিয়ে বনমধ্যে একটা ভাঙা ঘর ৷ ঠিক হল আরও কিছুটা এগনো যাক ৷ আমরা নালাটির বাঁদিক ধরে নরম কাদামাটি মাড়িয়ে নামতে থাকি ৷ কিন্তু আর কোনও পথ নেই ৷ ফিরে এলাম ঘরটির কাছে ৷ আজ এখানেই থাকা যাক ৷ সুব্বা আশ্বাস দেন ওঁর সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে, পরদিন সকালে প্রকৃত পথ খুঁজে বের করবেন ৷

২ নভেম্বর ভোর হতেই সুব্বা বেরিয়ে পড়ল পথ খুঁজতে ৷ কোথাও কোনও স্পষ্ট পথের হদিশ পাওয়া গেল না ৷ এবার ভাবলাম উঠে যাই আবার সেই গিরিবর্ত্মের মাথায় ৷ ফেরার পথে এতসব মালপত্র নিয়ে কয়েক হাজার ফুট ওঠার জন্য কারও তেমন সাড়া পাওয়া গেল না ৷ শেষপর্যন্ত ঠিক হল এই নালাটি ধরেই নাম যাক ৷ আমাদের আশা যে সামনে নিশ্চয়ই পেয়ে যাব রিম্বি চু, আর নদী পেরিয়েই তো রামথাং গ্রাম ৷ কখনও নালাটির ডানদিক আবার কখনও বাঁদিক ধরে জুতো ভিজিয়ে পথ চলা ৷ মাঝে মাঝে উঠে আসি স্যাঁতসেঁতে পচা পাতার জঙ্গলে ৷ দ্রুত চলার চেষ্টা ৷ সুব্বা আর ওঁর মালবাহকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিলাম না ৷ একটা সময় নালাটিকে ডানদিকে রেখে কিছুটা ওপরে উঠে এলাম ৷ নালাটির ধার ঘেঁসে চলা সম্ভব হচ্ছিল না ৷ সুব্বার হদিশ না পেয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকি ৷ ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এল অনেকটা নিচু থেকে ৷ ঘন কুয়াশায় চারদিকটা ঢেকে গেল ৷ রডোডেনড্রন গাছের মধ্য দিয়ে ওঁদের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হল না ৷ ওদের সঙ্গ হারালাম ৷ এবার নিজেদের চেষ্টাতেই পথ চলা শুরু ৷ বাঁদিকের পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পাহাড়ের গা বেয়ে চলতে চলতে শুনতে পেলাম বড় একটা নদীর প্রবাহ গর্জন ৷ নিশ্চয়ই আমরা রিম্বি চু-এর কাছাকাছি এসে গেছি ৷ নদীগর্ভ অনেকটা নিচে ৷ একঝলক দেখাও যায় ৷ কিন্তু নামার মতো জায়গা নেই ৷ শেষপর্যন্ত খাড়া পিচ্ছিল দেওয়ালে দড়ির সাহায্যে দুটো পর্যায়ে র্যাপেল করে নেমে এলাম অনেকটা নিচে ৷ অন্ধকার হয়ে এল ৷ সামান্য একটু সমতল জায়গা পেলাম না যেখানে পাঁচজন কোনওরকমে শুয়ে বসে থাকতে পারি ৷ অবশেষে টর্চের আলোয় একটা হুমড়ি খাওয়া পাথর দেখতে পেলাম আর তারই ধারে এক টুকরো ঢালু জমি ৷ কেউ কেউ লেগে পড়ল আগুন ধরাতে ৷ এই স্যাঁতসেঁতে অরণ্যে এ এক অসাধ্য কাজ ৷ স্লিপিং ব্যাগটা পায়ে ঢুকিয়ে কোনওরকমে শোবার চেষ্টা ৷ গড়িয়ে খাদে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও বাদ দিতে পারছি না ৷ সারাদিন সকলে অভুক্ত ৷ সামান্য কয়েক টুকরো শুকনো খাবার খেয়ে কখন যেন কিছুটা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ৷

ভোর হতেই গোছগাছ করে নামতে থাকি পিচ্ছিল কর্দমাক্ত পাহাড়ের গা বেয়ে ৷ মাঝে মাঝে পা আটকে যায় গাছের শিকড়ে ৷ একধরনের কাঁটাযুক্ত শক্ত লতানে গাছ মাঝে-মাঝেই আটকে যায় রুকস্যাকে ৷ একে উপেক্ষা করা যায় না ৷ একটা নালা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মূল নদীটির ধারে ৷ আমাদের ধারণা এটাই রিম্বি চু ৷ কিন্তু কোথায় রামথাং গ্রাম ৷ ঘন অরণ্যে দূরের কিছুই দেখা যায় না ৷ নদী পেরোতে কাজে লাগালাম একটা উপড়ে পড়া গুঁড়ি ৷ তারপর হাত ধরাধরি করে পৌঁছে গেলাম নদীর বাঁদিকে ৷ কিন্তু ওদিককার জঙ্গল আরও ঘন ও পাহাড়টা আরও খাড়া ৷ অনেক চেষ্টা করেও পা রাখতে পারলাম না ৷ ফিরে আসি নদীর ডানদিকে ৷ মারাত্মকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল শুভময় ৷ নাকে মুখে চোটও পেল ৷ প্রতিটি পদক্ষেপ রাখতে হচ্ছে খুবই সাবধানে ৷ ঠিক হল নদীর ডান ধার ঘেঁসেই নামা যাক ৷ গত দুদিনে মাত্র একবেলা খাবার জুটেছে ৷ বসে পড়ি দুপুরের রান্নার আয়োজনে ৷ তাই কাঠ সংগ্রহের পালা ৷ এ স্যাঁতসেঁতে অরণ্যে কোথায় পাব শুকনো কাঠ ৷ অনেক কষ্টে আগুন ধরানো গেল ৷ প্রেশার কুকারে জল চাপিয়ে চাল, ডালের খোঁজ পড়ল ৷ ডালের পুঁটলিটা পাওয়া গেলেও চালের পুঁটলিটা পাওয়া গেল না ৷ অনেকটা চাল ছিল ৷ কারোর অসতর্ক মুহূর্তে চালের পুঁটলিটা পড়ে গিয়েছে রুকস্যাক থেকে ৷ শেষ সম্বলটুকুও হারালাম ৷ এক কাপ ডালের স্যুপ খেয়ে আবার চলা ৷ উঠে আসতে হয় ঘন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের গায়ে ৷ যেখানে সূর্যের আলোর প্রবেশ নেই ৷ হাত দিয়ে গাছের ডালপালা ভাঙতে ভাঙতে আবার কখনও শক্ত লতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে পথ করে চলা ৷ হাতে অজস্র কাঁটা ফোটে ৷ রক্তপাত হয় ৷ কিন্তু সেদিকে নজর দেবার সময় নেই ৷ ঘন রডোডেনড্রন জঙ্গলে সমস্যা আরও বেশি ৷ শক্ত ডালপালা ভাঙা এক অসাধ্য কাজ ৷ তাই কখনও হামাগুড়ি দিয়ে আবার কখনও শুয়ে কিংবা বসে চলতে হচ্ছে ৷ মাঝে-মাঝেই আছাড় খাচ্ছি ৷ নদীর ধারে মানুষের পায়ের ছাপ খোঁজার চেষ্টা ৷ সুব্বা ও তার সঙ্গী যদি এই পথেই গিয়ে থাকে ৷ কিন্তু ওদের পরিবর্তে পশুর পদচিহ্ন ৷ জল খেতে মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট পথে ওরা আসে, ফলে একটাই রাস্তা ৷ ওই রাস্তায় আমাদের চলার প্রয়াস ৷ কষ্টকর, কিন্তু তবু তো একটা রাস্তা ৷ মাঝে-মাঝেই ওদের টাটকা বিষ্ঠা ৷ ভয়ে ভয়ে হাঁটা ৷ বিকেল চারটে নাগাদ চলার বিরতি ৷ রাতের আস্তানার খোঁজ ৷ তাঁবু টাঙানোর মতো জায়গা পেলাম না ৷ একটা পাথরের ধারে কোনওরকমে পলিথিন চাদরটা টাঙিয়ে রাত কাটানো ৷ কাছেপিঠে কোথাও জল নেই ৷ খাড়া নদীগর্ভে নামা সম্ভব হল না ৷ অনেক নিচু থেকে দড়ির সাহায্যে সংগ্রহ হয় সামান্য জল ৷ কোনওরকমে চাপাচাপি করে শুয়ে পড়ি ৷ সারাদিন অনেক কসরতের পরেও চলতে পেরেছি সামান্য পথ ৷ নানা দুশ্চিন্তা দানা বাঁধে ৷ কীভাবে বের হব এই জঙ্গল থেকে ৷ কোন দিকে গেলে গ্রামের সন্ধান পাব ৷ সকলে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছি ৷ একটুকরো চকলেট আর জল খেয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করেও সারারাত ঘুম হল না ৷

পরদিন ৪ নভেম্বর কাদামাখা জুতো আর মোজা পায়ে চলা শুরু ৷ নদীটাই একমাত্র বাঁচার ভরসা আর পথ দেখাবার নিশানা ৷ আমাদের আশা নদী ধরে নামলে একদিন না একদিন কোনও গ্রাম পাব ৷ মাঝে-মাঝেই ছোট-বড় ঝরনা ৷ সরাসরি ওদের পেরিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য ৷ ফলে উঠে আসতে হয় অনেক ওপরে ৷ প্রায় ওদের মাথার কাছে ৷ অনেক পথ, অনেক সময় ৷ প্রায়ই এই খাড়া নদীগর্ভে রয়েছে বড় বড় পাথর কিংবা নদীটা প্রবাহিত হচ্ছে খাড়া দেওয়ালের ধার ঘেঁসে ৷ তাই উঠে আসতে হয় পাহাড়ের গায়ের স্যাঁতসেঁতে পচা পাতার অরণ্যে ৷ তবুও মাঝে-মাঝে নেমে আসি নদীর ধারে ৷ একটু উন্মুক্ত আকাশ আর দূরের কিছু দেখার চেষ্টা ৷ নদীটির ধারে এলে একটা বাঁচার আশা দেখতে পাই ৷ দুপুর নাগাদ একটা নালার ধারে পৌঁছনোর চেষ্টা করলাম ৷ পথ খুঁজতেই অনেকটা সময় চলে যায় ৷ হঠাৎই দেখলাম নির্মলের বেজায় ভারি রুকস্যাকটা ছিটকে চলেছে অনেকটা নিচে ৷ শেষপর্যন্ত একটা গাছের ডালে আটকে গেল ৷ আরও কিছুটা চলার পর নদীর ধারে নেমে এলাম র্যাপেল করে ৷ ভাগ্যিস সঙ্গে দড়ি ছিল ৷ বেজায় ভারি ও বড় আকারের রুকস্যাক নিয়ে এমন অরণ্যে দ্রুত চলা সম্ভব হচ্ছিল না ৷ তাই নদীর ধারে আমাদের আলোচনা বসল ৷ কেউ বলল, মালপত্র সব এক জায়গায় ফেলে রেখে শুধু স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে সকলে একত্রে চলতে শুরু করি ৷ কারও ইচ্ছে মূল্যবান আর একান্ত প্রয়োজনীয় টুকিটাকি ছাড়া সব মালই ফেলে দেওয়া হোক ৷ আবার কারও ধারণা তাহলেও দ্রুত চলা সম্ভব হবে না ৷ কারণ এই মুহূর্তে সকলের শারীরিক অবস্থা দ্রুত চলার উপযুক্ত নয় ৷ শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল যে নির্মল ও আলোক স্লিপিং ব্যাগ, দড়ি আর সামান্য টুকিটাকি নিয়ে নেমে যাবে দ্রুতগতিতে, লোক আর খাবারের সন্ধানে ৷ নির্মলের শরীরটা তখনও শক্ত-সমর্থ রয়েছে ৷ হিমালয়ের দুর্গম পথে ওর পদযাত্রার অভিজ্ঞতা অনেকদিনের ৷ অলোকের অভিজ্ঞতা নেহাত কম হলেও এই অঞ্চলে ম্যাপ এবং রুট নিয়ে ও যথেষ্ট নাড়াচাড়া করেছে ৷ এদিকে আমরা তিনজন মালপত্র সহ এখানে অপেক্ষায় থাকব ৷ আমার সঙ্গের দুজন এবছর নতুন দলে এসেছে, এত বড় ট্রেকে ওরা প্রথম এল ৷ সামান্য ডাল ও নিউট্রেলা অবশিষ্ট ছিল ৷ স্যুপ করে সকলে এক কাপ করে খেয়ে নিলাম ৷ বেলা দুটোয় ওরা চলে গেল নদীটির ডানদিক ধরে ৷ সঙ্গে খাবার মাত্র দুটো ক্যাডবেরি ৷ বাকি স্যুপটা প্রেশার কুকারসুদ্ধ রেখে দিলাম নালার ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে ৷ দূরের একটা বড় পাথরের ওপর তাঁবুর টকটকে লাল আউটার কভারটা টাঙানো রইল ৷ এ জায়গাটা একটু ফাঁকা ও শুকনো ৷ সন্ধে হতেই আগুন ধরানো হল ৷ দুশ্চিন্তা হয় ওদের এভাবে পাঠিয়ে ভুল করলাম না তো ৷ সকলে একসঙ্গে গেলেই হয়তো ভালো হত ৷ রাতে ঘুম নেই, তবুও কষ্ট করে শুয়ে থাকা ৷ ভোরে ওঠার তাড়া নেই, তবু ভোরেই ওঠা ৷

শুরু হল এক অন্তহীন প্রতীক্ষা ৷ নদীর শব্দ ও পাখির ডাক বুঝিয়ে দেয় আমরা বেঁচে আছি ৷ এই মুহূর্তে চলাফেরা করে কিংবা কথা বলে ক্যালোরি খরচ করাও উচিত নয় ৷ বিকেল হতেই একটা বড় পাথরের ওপর বসে চেয়ে থাকি দক্ষিণদিকে অর্থাৎ নদীর গতিপথের দিকে অন্ধকার হতেই আবার সেই গতানুগতিক আগুন ধরানো ৷ আগুন দেখতে পেলে হিংস্র জানোয়ারেরা কাছে আসবে না ৷ আর আমাদের আশা যদি দূরের কোনও লোকের নজরে পড়ি ৷ তাছাড়া আগুন ধরানোর খেলায় সময়ও কাটে কিছুক্ষণ ৷ আমাদের দুপুরের ও রাতের বরাদ্দ আধ কাপ করে ডালের স্যুপ ৷ আর রয়েছে নদীর পর্যাপ্ত জল ৷ দিন যায় রাত আসে ৷ ক্রমে নদীর শব্দটাও একঘেয়ে আর অসহ্য লাগে ৷ একটা দুশ্চিন্তা অনবরত তাড়া করে যাচ্ছে ৷ এইভাবে কাটে পাঁচটা রাত ৷ প্রতি মুহূর্তে মনে হয় নির্মল আসছে ৷ প্রতিটি শব্দই মনে হয় নির্মলের পায়ের শব্দ ৷ আশা আর আশাভঙ্গ এই আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী ৷ ডালের স্যুপটাও শেষ ৷

অবশেষে ৯ তারিখ হাঁটতে শুরু করলাম ৷ সঙ্গে নিলাম সকলের সমস্ত মূল্যবান জিনিসপত্র ও পথের একান্ত প্রয়োজনীয় টুকিটাকি ৷ বাকি সব পড়ে রইল তাঁবুর মধ্যে ৷ আর সঙ্গে রেখে গেলাম একটা চিঠি ৷ চলার শুরুতেই শুভাশিস মাথা ঘুরে পড়ে গেল ৷ ও নিজেকে সামলে নিতেই আমরা নদীর ডানদিক ধরে চলতে শুরু করলাম ৷ মাঝে মাঝে নামতে হচ্ছে পিচ্ছিল পাথরের দেওয়াল ধরে ৷ রুকস্যাকগুলো নামিয়ে দিতে হয় দড়ির সাহায্যে আর নিজেদের নামতে হয় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ৷ একটা রডোডেনড্রনের ঢাল ৷ হঠাৎ শুভাশিস ভারসাম্য হারিয়ে গড়িয়ে পড়ল আমার ওপর ৷ নিজেকে সামলানোর আগেই দুজনে আরও কিছুটা গড়ানোর পর থামলাম অনেকটা নিচে ৷ পায়ে সামান্য চোটও লাগল ৷ নদীর ধারের ঘন ঝোপের মধ্য দিয়ে পথ করে চলা খুবই কষ্টসাধ্য ৷ গাছের ডালে কিংবা শক্ত লতায় রুকস্যাক আটকে যায় বারবার ৷ গ্লাভস পরা হাতে কাঁটাগাছের ডাল ভাঙছি ৷ তবুও হাত পা ছড়ে যায় ৷ গ্লাভসও ক্ষতবিক্ষত ৷ নদীর ওপরের কয়েকটা পাথর পেরিয়ে এলাম আশ্চর্যভাবে ৷ কোনওটা টপকে আবার কখনও কোনও কোনও ফাটলের মধ্য দিয়ে ৷ সবচেয়ে হতাশ লাগে যখন অনেকটা নামার পর আর নামা সম্ভব হয় না ৷ উঠে আসতে হয় অন্য পথের সন্ধানে ৷ মাঝে-মাঝে কাদামাটির জঙ্গলে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হচ্ছে ৷ ট্রাউজার আর জ্যাকেটে কাদা মাখামাখি ৷ এরইমধ্যে পরনের পোশাক শতছিন্ন ৷ সারাদিনে নামতে পেরেছি সামান্যই ৷ তবুও ভালো লাগে ৷ গত পাঁচদিন এক জায়গায় বসে মনের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল আজ তা খানিকটা কমেছে ৷ নদীর ধারে কয়েকটা ঝোপ গাছ ৷ নীল আর বেগুনি রঙের ছোট ছোট ফল ধরেছে ৷ মনে পড়ে ১৯৭৮-এ গাড়োয়ালে রূপগঙ্গা ধরে একটা ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নামছিলাম ৷ সেবার আমার পথপ্রদর্শক রাজেন্দ্র সিং এই ফলগুলো তুলে আমায় দিয়েছিল ৷ একটু কষা হলেও বেশ মিষ্টি ৷ তাই ফলগুলো খেতে ভরসা পেলাম ৷ সেবার ফল তুলতে গিয়ে ভাল্লুকের সামনাসামনি পড়তে হয়েছিল ৷ এগুলো খেতেই ভাল্লুক নেমে এসেছিল নদীর ধারে ৷ আজ এখানেই পাথরের চাতালে প্লাস্টিক চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ি ৷ ওপরে চাঁদোয়ার মতো করে টাঙিয়ে দিই তাঁবুর লালরঙের আউটার কভারটা ৷ ততক্ষণে রাতের খাবার তৈরি হয়ে যায় ৷ শুধু নুন জল ৷

দিনের আলো ফুটতেই সঙ্গীদের ডাকাডাকি শুরু করি ৷ কিন্তু ক্লান্ত আর অবসন্ন শরীরের জড়তা কাটিয়ে উঠে দাঁড়াতে সময় লাগে ৷ একইভাবে এগনো ৷ চলতে চলতে যদি কোনও গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে না পারি তবে একে একে সকলে মারা পড়ব ৷ কিন্তু তবুও কেউ বসে পড়ব না, এই আমাদের প্রতিজ্ঞা ৷ সবসময় কোনও ডাকের জন্য কান খাড়া করে আছি ৷ সারাদিনই শুধু নামার চেষ্টা ৷ আমাদের উদ্ধারে যদি কেউ এ অরণ্যে আসে তবে এ বিশাল ঘন অরণ্যে তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম ৷ সেদিন রাত কাটাই নদীর ধারে হুমড়ি খাওয়া পাথরের নিচে একটা সুন্দর গুহায় ৷ সহজেই বোঝা যায় এটা জন্তু-জানোয়ারের আস্তানা ৷ নদীর ধারে বালিমাটিতে নির্মলদের জুতোর ছাপ আর একটুকরো কাগজ ৷ বুঝতে পারি ওরা এপথেই নেমেছে ৷ শুভময়ের পরনে লাল রঙের ট্রাউজারটা ক্ষতবিক্ষত ৷ তার থেকে একটুকরো ছিঁড়ে টাঙিয়ে দিই গুহাটির সামনে ৷

১১ নভেম্বর শুরুতেই ঝোপঝাড়ের ডাল ভেঙে পথ চলা ৷ মাঝে-মাঝে গাছের ডাল ধরে নামতে হয় খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে ৷ মস আচ্ছাদিত ডালপালায় ভরসা নেই ৷ ডাল ভেঙে পড়ে গেছি কয়েকবার ৷ কোথাও কোথাও শুকনো কিংবা পচা পাতার নিচে এবড়োখেবড়ো পাথর ৷ ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই ৷ পাথরের খাঁজে পা ঢুকে গেছে কয়েকবার ৷ অনেক কষ্টে টেনে তুলতে হয়েছে শরীরটাকে ৷ মাঝে মাঝে বড় বড় পাথরের গায়ে টিকটিকির মতো উঠে আসতে হয়েছে ওদের মাথায় ৷ প্রতি পাহাড়ের বাঁকেই মনে হয় এটা পেরোলেই দূরে দেখতে পাব রামথাং গ্রাম ৷ একটা বাঁক শেষ হতেই সামনে আরেকটা বাঁক হাজির ৷ বনমধ্যে নানারকমের ফল ধরেছে কিন্তু খেতে ভরসা পেলাম না ৷ চলতে চলতে শুভময় সংগ্রহ করে চলেছে মাশরুম ৷ আর আমি লেগে পরলাম বিছুটি গাছের ডগা তুলতে ৷ হিমালয়ের পথে মালবাহকের সংগৃহীত মাশরুম খেয়েছি ৷ আর বিছুটি শাক খাওয়ার সুযোগও অনেকবার ঘটেছে ৷ বিকেল হতেই নদীর ধারে কোনওরকমে মাথা গোঁজার মতো জায়গা করে নিলাম ৷ অনেক দরকারি কাগজপত্র পুড়িয়েও ভিজে কাঠে আগুন ধরানো গেল না ৷ সব চেষ্টাই বৃথা ৷ যথারীতি নুনজল খেয়ে শুয়ে পড়ি ৷ আমরা সঙ্গে বয়ে চলেছি কয়েক হাজার টাকা ৷ এই মুহূর্তে সেগুলো কাগজের বান্ডিল ছাড়া আর কিছুই নয় ৷ রাতে বৃষ্টি নামল ৷ আকাশ ধোয়া বৃষ্টি ৷ সব জায়গাটাই তখন একটা নদী ৷ কোনওরকমে বসে থাকা ৷ সবকিছু কাকভেজা ৷ একটু তন্দ্রা, ভোর হতেই চোখ খুলেই দেখি বিছুটি শাক ৷ পরম মমতায় হাত বোলাতে গিয়ে অনুভব করি আঙুলে টান ধরেছে ৷ হাতে পায়ে কেমন একটা আটকে যাওয়া ভাব ৷ সবকিছু শুকিয়ে নিয়ে চলা শুরু করতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল ৷ সামনে আমাদের পথ আটকে এক বিশাল ঝরনা ৷ উঠতে হবে ওর মাথায় ৷ সরু বাঁশের ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে উঠে এলাম ঝরনাটির মাথায় ৷ বড় একটা নালা নেমেছে পশ্চিমদিক থেকে ৷ ম্যাপের সঙ্গে কোনও মিল খুঁজে পাই না ৷ ম্যাপ আর ভরসা নয় ৷ ভরসা শুধু নদীর গতিপথ ৷

এখান থেকে একটা ফার্নের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আড়াআড়িভাবে চলার চেষ্টা ৷ নদীটা অনেক নিচে ৷ নামতে হবে অনেকটা ৷ পাথরের ফাটলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা একটা সরু রডোডেনড্রন গাছ ৷ ডালটা ধরে দেখছি কীভাবে নামা যায় ৷ পিচ্ছিল পাথরের ওভারহ্যাঙ ৷ ওখান থেকে নামা সম্ভব নয় ৷ হঠাৎই পাটা হড়কে গেল ৷ ডালটা ধরা ছিল, তাই না পড়লেও শূন্যে ঝুলছিলাম ৷ অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও দেহটাকে ওপরে তুলতে পারলাম না ৷ রুকস্যাকটাকে ফেলে দেওয়াও সম্ভব হল না ৷ কারণ এক হাতে নিজেকে ঝুলিয়ে রাখতে পারব সে ভরসাও ছিল না ৷ অন্যরাও অনেকটা ওপরে ৷ ওদের পক্ষেও কিছু করা সম্ভব নয় ৷ তাছাড়া দড়িটাও আমার কাছে ৷ নিচের দিকটা দেখে নিলাম ৷ সরাসরি পড়লে আর রক্ষে নেই ৷ দেওয়ালের দিকে মুখ করে দুপায়ে পাথরের দেওয়ালটাকে ঠেলে ডালটা ছেড়ে দিলাম ৷ পড়লাম রুকস্যাকের ওপর ৷ ছিটকে গেলাম জঙ্গলের ঢালের দিকে ৷ কয়েকটা এলোপাতারি ডিগবাজি খেতে খেতে চোখটা অন্ধকার হয়ে এল ৷ কতক্ষণ জ্ঞান হারিয়েছিলাম জানি না ৷ ওই অবস্থায় আরও কতটা নিচে গড়িয়েছিলাম তাও জানি না ৷ ক্রমে ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসে ৷ ওরা আমায় ডাকছে ৷ মনে হল অনেক দূরের শব্দ ৷ জ্ঞান ফিরতেই চোখ খুলে দেখি গাছের ডালে আটকে আছি ৷ চশমাটা ভেঙে দড়িতে ঝুলছে ৷ প্রথমে হাত দুটো, পরে পা দুটো নাড়লাম ৷ বুঝলাম আমি বেঁচে আছি ৷ রুকস্যাকের ফ্রেমটা ভেঙে চুরমার ৷ ততক্ষণে সঙ্গীরা কাছে পৌঁছে গেল অন্য পথে ৷ আমাকে টেনে তুলল ৷ সমস্ত শরীরটা কাঁপছে ৷ কিন্তু আশ্চর্য, আমার কোথাও কোনও মারাত্মক চোট লাগেনি ৷ আইস এক্সটা খোয়া গেল ৷ শেষ হাতিয়ারটাও হারালাম ৷ রুকস্যাকের মধ্যের ক্যামেরাগুলোর কী অবস্থা হল দেখার মতো ইচ্ছে আর নেই ৷ প্রায় ২৫-৩০ ফুট ওপর থেকে পড়েছিলাম ৷ সঙ্গে আরেকটা চশমা ছিল তাই ভরসা ৷ চশমা ছাড়া উঁচু-নিচু পাথুরে জায়গায় আমার পক্ষে এক পাও চলা সম্ভব নয় ৷ ক্রমে নদীর ধারে নামতে থাকি ৷ সেদিন আর বেশিদূর এগনো হল না ৷ গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে নদীর ধারে তাঁবুর আউটার কভারটা টাঙিয়ে নিলাম ৷ সারা শরীরে অনুভব করি অসম্ভব ব্যথা ৷

১৩ নভেম্বর বেরোতে যথারীতি দেরি হয়ে যায় ৷ ভাঙা রুকস্যাক নিয়ে শুরু হয় আরেক যন্ত্রণা ৷ দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে চলতে শুরু করলাম ৷ নদীটা হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে চলেছে ৷ নদীগর্ভ অসম্ভব খাড়া এবং সরু হয়ে এল ৷ ক্রমে নদীর ধার ঘেঁসে নামা অসম্ভব হয়ে ওঠে ৷ গতকালের দুর্ঘটনার পর পাহাড়ের গা বেয়ে উঁচুতে উঠতে মন সায় দেয় না ৷ তাই দ্বিধাগ্রস্ত ও বেসামাল হয়ে নামার চেষ্টা ৷ শতচ্ছিদ্র নোংরা বেশভূষা, উস্কোখুস্কো চুল, হাতে-পায়ে ময়লার আস্তরণ ৷ কঙ্কালসার শরীর, সব মিলিয়ে সকলের চেহারায় একটা পাগল পাগল ভাব ৷ কাদা মাখানো হান্টার জুতোগুলোর অবস্থা শোচনীয় ৷ ফাটতে শুরু করেছে ৷ ভয় হয় জুতো ছাড়া হাঁটব কী করে? ক্রমশ বাঁদিকের পাহাড়টা শেষ হয়ে আসছে ৷ তারপরই পূর্বদিক থেকে অন্য কোনও নদী এসে মিশেছে এই নদীটির সঙ্গে ৷ আমাদের আজ পৌঁছতে হবে ওই সঙ্গমস্থলের কাছে ৷ সারাদিনই নামার চেষ্টা ৷ কখনও নদীর ওপরের ভিজে আর পিচ্ছিল পাথর টপকে আবার কখনও ঝোপঝাড় ভেঙে ৷ কিন্তু সঙ্গমস্থল এখনও অনেকটা নিচে ৷ আজ আর পৌঁছনো গেল না ৷ এবার রাতের আশ্রয়ে খোঁজ ৷ নদীর ধারে জল আছড়ে পড়ছে ৷ ঠাঁই মিলল না ৷ কর্দমাক্ত জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ওঠার চেষ্টা ৷ হঠাৎ একটা বাঁশির শব্দ ৷ একটু থমকে গেলাম ৷ হয়তো বা কোনও পাখির ডাক ৷ এর আগে এরকম ভুল হয়েছে কয়েকবার ৷ ওপরের জঙ্গলে কোনও কিছুর চলার শব্দ ৷ ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম ৷ আকস্মিকভাবে ভূত দেখার মতো দেখলাম পাঁচজন লোক কুকরি দিয়ে গাছ আর ডালপালা কাটতে কাটতে নামছে ৷ আমরা চিৎকার করে ডাকতে থাকি ৷ হিন্দি, বাংলা আর নেপালি মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় আমাদের সমবেত আর্তনাদ-‘আমরা জঙ্গলে পথ হারিয়েছি ৷ অনেকদিন কিছু খেতে পাইনি ৷’ বলতে বলতে চোখে জল এসে গিয়েছিল ৷ ওরা দ্রুত নেমে আসে ৷ আমার হাতে দেয় একটা চিঠি ৷ নির্মল ও আলোক পাঠিয়েছে ৷ জানতে পারি নির্মলরা এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় আটদিনের শেষে ১১ নভেম্বর পৌঁচেছে ইয়াকসাম ৷ আর ১২ নভেম্বর সকালে পাঠিয়েছে এই উদ্ধারকারীদল ৷ আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না ৷ মানুষ দেখছি না ভূত দেখছি ৷ জেগে আছি না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি ৷ নিমেষে ওদের ধারাল কুকরির ঘায়ে শখানেক সরু গুঁড়ির গাছ শুয়ে পড়ল ৷ জায়গাটা পরিষ্কার করে তৈরি হয় রাতের আশ্রয় ৷ রান্না আরম্ভ হয় ৷ আবার জীবনে ফিরে আসি ৷ ম্যাগির স্যুপ আসে ৷

উদ্ধারকারীদলের সঙ্গে আমাদের দেখাটাও এক দৈবাৎ ঘটনা ৷ আমরা যখন রাতের আশ্রয়ের খোঁজে ওপরে উঠার চেষ্টা করেছিলাম ওরা তখন নামছিল নদীর ধারে রাত কাটাবে বলে ৷ ওরা ১১ নভেম্বর ইয়াকসামের নিচে নদীর ওপর পুল তৈরি করে ৷ আর ১৩ নভেম্বর চলে আসে নদীটির ডানদিকে ৷ প্রথমদিনই খুঁজে পায় আমাদের ৷ ওদের কাছেই প্রথম জানতে পারি আমরা যে নালাটি ধরে এতদিন নামছিলাম এর নাম রিম্বি চু নয় ৷ এর নাম রাথাং চু বা বেসক্যাম্প নালা ৷ নিচের সঙ্গমটি হল প্রেক চু-এর সঙ্গে রাথাং চু-এর মিলন ৷ মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারি আমাদের ভুলটা কোথায় ৷ দোরজে ছেত্রী নির্দেশিত পথের ওপর আস্থা হারিয়ে আমরা ভুল পথে নেমে এসেছিলাম রাথাং চু অববাহিকার ঘন অরণ্যে ৷ ওর দেখানো বা বোঝানো ম্যাপ আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি ৷ গোপেথাং খরকা থেকেই হয়েছিল আমাদের ভুল পথে যাত্রা ৷ সঠিক দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বমুখী পথ থেকে বিচ্যুতি ৷ উদ্ধারকারীদলের সবচেয়ে বয়স্ক ও শক্তসমর্থ লোকটা নদী থেকে ধরেছে কয়েকটা ব্যাঙ ৷ ব্যাঙের মাংসের স্যুপ খেলাম পরম তৃপ্তি করে ৷ ওদের কাছেই খবর পেলাম, নির্মলের মাথায় দারুণভাবে আঘাত লেগেছে ৷ ও এখন ইয়াকসামে চিকিৎসাধীন ৷ ওর মাথার পিছনদিকটা অনেকটা কেটে গেছে ৷ আর সেই রক্তাক্ত অবস্থায় আঘাত নিয়ে চলতে হয়েছে কয়েকদিন ৷ অবশ্য এখন ও অনেক ভালো, হোটেলে আছে ৷ ঠিক করলাম সমস্ত মালপত্র উদ্ধার করে দু-তিনদিনের মধ্যে ফিরে যাব ইয়াকসাম ৷

এবার আসি নির্মল আর অলোকের প্রসঙ্গে ৷ কীভাবে ওরা পৌঁছেছিল ইয়াকসাম ৷ ৪ নভেম্বর আমাদের বিদায় জানিয়ে নির্মল ও অলোক নদীটির ডানদিক ধরে দ্রুতগতিতে নামতে থাকে ৷ কখনও পাথর টপকে আবার কখনও পিচ্ছিল পাথরের গা বেয়ে ৷ সেদিন রাত কাটায় নদীর ধারে খোলা আকাশের নিচে ৷ পরদিন দুপুর নাগাদ পৌঁছে গিয়েছিল একটা ঝরনার মাথায় ৷ সরু বাঁশের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নামার পথে শুরু হয় মুষলধারায় বৃষ্টি ৷ তাই বেশিদূর আর এগোতে পারল না ৷ তৃতীয়দিন হন্যে হয়ে নামার চেষ্টা ৷ ম্যাপ দেখে ওদের ধারণা হল যে প্রকৃত পথ পাওয়া যাবে ডানদিকে পাহাড়ের গায়ে ৷ বনজঙ্গল ভেঙে অনেক কসরত করে উঠে এল অনেকটা ওপরে ৷ সঙ্গে ক্যাডবেরি দুটোও শেষ ৷ খাওয়ার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না ৷ বনমধ্যে অনেক রকমের ফলমূল ৷ কিন্তু খেতে ভরসা পেল না ৷ তবুও খিদের তাড়নায় ফল খাওয়ার চেষ্টা ৷ তার ফল হল উল্টো ৷ গলার যন্ত্রণা, রক্ত পায়খানা আর বমি হল অলোকের ৷ বেলা পড়ে এল ৷ নদীর ধারে নামতে হবে রাতের আশ্রয়ের জন্য ৷ সামনে পড়ল একটা পাহাড়ের ঢাল ৷ দড়ির সাহায্যে প্রথম পর্যায়ে নেমে এল একটা গাছের ওপর আর দ্বিতীয় পর্যায়ে বিছুটির জঙ্গলে ৷ অন্ধকারের মধ্যে খুঁজে পেল একটা প্রকাণ্ড পাথর ৷ তারই ধারে কোনওরকমে রাত কাটানো ৷ হাতে পায়ে তখন বিছুটির যন্ত্রণা ৷

চতুর্থদিন নামার পথে ঘটে এক দুর্ঘটনা ৷ পচা পাতা আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটা গাছের ডাল ধরে নামছিল নির্মল ৷ হাতে ধরা ডালটা ভেঙে গেল ৷ নির্মল গড়িয়ে পড়ে অনেকটা নিচে ৷ মাথাটা গিয়ে লাগল একটা পাথরে ৷ নিজের চেষ্টাতেই উঠে দাঁড়ায় ৷ হাত দিয়েই বুঝতে পারে মাথার পিছনদিকটা অনেকটা কেটে গেছে ৷ একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা হলেও চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়তে থাকে ৷ ওই অবস্থায় নেমে আসে নদীর ধারে ৷ শেষপর্যন্ত ব্যান্ডেজটা খুলতেই রক্তে ভেসে গেল আঘাতের জায়গাটা ৷ নির্মল কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারায় ৷ নতুন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয় অলোক ৷ ততক্ষণে জামা আর জ্যাকেটটা রক্তে ভেসে গেছে ৷ খোলা আকাশের নিচে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ে নির্মল ৷ পরদিন বন্ধ হয় রক্তপাত ৷ কিন্তু আর চলতে পারছিল না ৷ পথ করার দায়িত্বে যায় অলোক ৷ নির্মল বারবার পিছিয়ে পড়ে ৷ সেদিন আর বেশিদূর এগনো হল না ৷

৯ তারিখ চলার পথে দেখতে পেল দূরের জঙ্গলে আগুনের ধোঁয়া আর পুবদিক থেকে নেমে আসা একটা নালার ওপর ব্রিজ ৷ নেমে এল নদীর ধারে ৷ নদীটি পেরোতে হবে ৷ অলোক জানায় ম্যাপ অনুযায়ী ওদিকে রামথাং গ্রামে যাবার কোনও পথ নেই ৷ তাছাড়া নদীটাও প্রচণ্ড খরস্রোতা ৷ নদী পেরনোর আশা ছেড়ে দিয়ে নামতে থাকে নদীটির ডানদিক ধরে ৷ পূর্বদিকে দূরের পাহাড়ে অস্পষ্টভাবে দেখতে পায় চমরী গাই নিয়ে চলেছে লোকজন ৷ চিৎকার করে ডাকতে থাকে ৷ নদীর শব্দে সে আর্তনাদ ওদের কাছে পৌঁছয়নি ৷ পাহাড়ের গা বেয়ে চলতে চলতে বিকেলে দেখতে পায় দক্ষিণ-পূর্বদিকে একটা পাহাড়ের মাথায় গ্রাম রয়েছে ৷ ওদের ধারণা, ওরা পৌঁছে গেছে রামথাং গ্রামের উল্টোদিকে ৷ যে করেই হোক নদী পেরিয়ে পৌঁছে যেতে হবে ওখানে ৷ সেদিন নদীর ধারে নাম সম্ভব হল না ৷ রাত কাটায় একটা গিরিশিরার ঢালে ৷ কাছেপিঠে কোথাও একফোঁটা জল নেই ৷ খিদে আর পিপাসা পাল্লা দিয়ে চলে ৷ আর জিভ শুকিয়ে আসে ৷ ওষুধের প্যাকেট থেকে বের করল antacid tablet.ওগুলো চুষেও গলা ভিজল না ৷ শেষপর্যন্ত স্বমুত্র পান করেও তেষ্টা মেটাতে পারল না নির্মল ৷ গত চারদিন নুনজল ছাড়া কিছুই পেটে পড়েনি ৷ পরদিন সকালে নেমে এল নদীর ধারে ৷ অলোকের পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ৷ নিরুপায় হয়ে অভুক্ত অবস্থায় খেয়েছিল Brufen tablet. ফলস্বরূপ নদীর ধারে পৌঁছে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়ল অলোক ৷

১০ নভেম্বর সকালে ওদের সংকল্প যে করেই হোক নদীটা পেরোতে হবে ৷ উলঙ্গ হয়ে নির্মল নেমে পড়ল হিম শীতল জলে ৷ মাথায় তুলে নেয় প্লাস্টিকের চাদরে মোড়া স্লিপিং ব্যাগ, আর পরনের বেশভূষা ৷ কোমরে বাঁধা দড়িটা ধরে রাখে অলোক ৷ কিছুটা হেঁটে আর বাকিটা সাঁতার কেটে দ্রুত পার হয় নির্মল ৷ এবার অলোকের পালা ৷ অলোক অনেকটা সময় স্রোতের মধ্যে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারল না ৷ নির্মল ওকে টেনে তুলল দড়ির সাহায্যে ৷ বেশ কিছুক্ষণের জন্য ওদের শরীরে কোনও সাড় ছিল না ৷ এবার পূর্বদিকে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা ৷ বিকেল নাগাদ পৌঁছে যায় একটা রাস্তায় ৷ বুঝতে পারে ওরা চলেছে রামথাং গ্রামে নয় ৷ ওরা চলেছে ইয়াকসামের দিকে ৷ থানা আর স্থানীয়দের ঘটনার বিবরণ দিয়ে পৌঁছে যায় হাসপাতালে ৷ এরইমধ্যে নির্মলের মাথার আঘাতটা পচতে শুরু করেছে ৷ মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই নির্মল ব্যস্ত হয়ে পড়ল উদ্ধারকারীদল তৈরি করতে ৷ আর ১২ তারিখ সকালে ওদের পাঠিয়ে দেয় আমাদের উদ্ধার করতে ৷

১৪ তারিখ সকালে ঘণ্টাতিনেকের মধ্যে গাছ কেটে তৈরি হল শক্তসমর্থ একটা পুল ৷ আমাদের ধরাধরি করে নিয়ে চলেছে সেই পুলের দিকে ৷ অজস্র গাছ কেটে তৈরি হল একটা পথ ৷ পুল পেরিয়ে রাথাং চু-এর বাঁদিকে উঠে এলাম একটা হুমড়ি খাওয়া প্রকাণ্ড পাথরের কাছে ৷ উদ্ধারকারীদলে সর্দার উগেন তেন্বা ভুটিয়া সঙ্গে একজনকে নিয়ে নদীটির ডানদিক ধরে এগিয়ে চলল মালপত্র উদ্ধার করতে ৷ আমরা পাথরটার নিচেই সেদিনকার মতো জায়গা করে নিলাম ৷ বিকেলে নদীর ধার থেকে উঠে এল অনেক লোকজন ৷ ১২ জনের আরেকটি উদ্ধারকারীদল ৷ পুলিশ, বনদপ্তর ও ইয়াকসামের যুবক সংঘ সমন্বয়ে গঠিত এই দলটি ১৪ তারিখ সকালে বেরিয়েছে ইয়াকসাম থেকে ৷ ওরা আরও একটা পুল তৈরি করে পৌঁছে গিয়েছিল আমাদের গতকালের আস্তানায় ৷ বুঝতে পারে আমরা এখন নিরাপদে ৷ আমাদের খবর নিয়ে ওরা ইয়াকসামের দিকে রওনা হল ৷ এদিকে উগেন তেন্বা অনেকটা পথ করেও পৌঁছতে পারল না আমাদের সেই ফেলে আসা তাঁবু পর্যন্ত ৷ ফিরতে ওদের অনেক রাত হল ৷ পথে ওদের ভাল্লুকের সামনাসামনি পড়তে হয়েছিল ৷

পরদিন সারাদিনের চেষ্টায় সব মালপত্র উদ্ধার হয় ৷ ভাবতে কষ্ট হয় যে তিনটে লোকের প্রাণ বাঁচাতে এই রাথাং চু অববাহিকার জঙ্গলে কাটা পড়ল শয়ে শয়ে গাছ ৷ ১৬ নভেম্বর বেরিয়ে পরলাম ইয়াকসামের উদ্দেশে ৷ তখন একমাত্র আশঙ্কা কতক্ষণে দেখা হবে নির্মল আর অলোকের সঙ্গে ৷ একটা গভীর উৎকণ্ঠার মধ্যে উদ্ধারকারীদলের সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে উঠে এলাম বাকিম বিশ্রামগৃহে আর ইয়াকসাম পৌঁছলাম বিকেলে ৷ গিয়ে দেখি নির্মল হোটেলের সামনে আমাদের অপেক্ষায় ৷

ভ্রমণ মে, ১৯৯৬

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন