অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
একটা সম্মিলিত হর্ষধ্বনি, তারপর সব চুপচাপ ৷ শুধু হাজারখানেক মানুষের নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই ৷ জাপানি যে দলগুলো এতক্ষণ কিচিরমিচির করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল তারাও বাকহীন হয়ে পড়েছে ৷ সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই বরফ, কোথাও তুষার-ধবল শৃঙ্গের আকারে, কোথাও তা বরফের নদী হয়ে বয়ে চলেছে, কোথাও মাখন-মসৃণ বরফের প্রান্তর, কোথাও ঢেউ খেলানো সমুদ্র ৷ ঘাড় ঘুরিয়ে যেদিকেই তাকান না কেন শুধু বরফ রাশি রাশি, পুরো দিগন্তব্যাপী এই সাম্রাজ্য বিস্তার দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হওয়ারই কথা!
আমরা এসেছি ইয়ুংফ্রাউ ৷ আল্পসের অন্যতম বিখ্যাত পর্বতশৃঙ্গ ৷ সেন্ট্রাল সুইজারল্যান্ড বা বার্নিস ওবারল্যান্ড রিজিয়নে রয়েছে তিন বিখ্যাত পর্বতশৃঙ্গ আইগার, মঞ্চ ও ইয়ুংফ্রাউ ৷ এই ত্রিমূর্তি তাদের সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে যুগ যুগ ধরে পর্বতারোহী ও প্রকৃতিপ্রেমিকদের আকর্ষণ করে চলেছে ৷ এতটাই প্রবল তার আকর্ষণ-শক্তি যে ৩৪৫৪ মিটার উচ্চতাকে তুচ্ছ করে এখানে তৈরি হয়েছে ইউরোপের সর্বোচ্চ রেলস্টেশনটি, পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় সামলানোর জন্য ৷ এই যাত্রাপথও অতীব সুন্দর, তবে তা পরের কথা ৷ এখন শুধু দেখার পালা-সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করার পালা ৷
ঝকঝকে নীল আকাশ! এত পরিষ্কার ঘন নীল রং দেখিনি কোনওদিন ৷ আর শুভ্রতার এই ঝলক! রোদ্দুর পড়ে যেন আগুন জ্বলছে! বিস্ময়ের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এবার মুহুর্মুহু শাটার টিপে চলেছি সবাই ৷ বিশেষণেও প্রকাশ করা যাবে না এর রূপকথা ৷ এ যে বর্ণনারও অতীত ৷ তবু সাহস করে কলম ধরেছি যাতে ভ্রমণ-এর পাঠক-পাঠিকাদের মানসভ্রমণের রসদ জোগাতে পারি ৷
গতকাল এসে পৌঁছেছি ইন্টারলাকেন ৷ তারও বহু আগে সফর শুরু ৷ কলকাতা থেকে মুম্বই হয়ে লন্ডন ঘুরে জুরিখ, জুরিখ থেকে বার্ন ৷ বার্ন থেকে ট্রেন পাল্টিয়ে ইন্টারলাকেন পৌঁছেছি ৪টে নাগাদ ৷
জুরিখ থেকে ট্রেন ধরেছি সকাল ১০টা নাগাদ ৷ সারা রাস্তায় প্রকৃতির নজরকাড়া রূপ দেখতে দেখতে ইন্টারলাকেনে এসে মোহিত হয়ে গেছি ৷ ইন্টারলাকেন নামের তাৎপর্যই হল দুটো লেকের মধ্যবর্তী অংশ ৷ এর এক পাশে টুনার সি আরেক দিকে ব্রায়েনজার সি, সি মানে এখানে হ্রদ ৷ মাঝখান দিয়ে ছোট্ট একটা খাল বয়ে চলেছে যা সংযোগ স্থাপন করেছে দুপাশে ৷ আর ইন্টারলাকেনের ছোট্ট শান্ত জনপদটি গড়ে উঠেছে এই সংযোগস্থাপনকারী খালটির দুপাশে ৷ ইন্টারলাকেন ওয়েস্ট আর ইন্টারলাকেন ইস্ট (সুইস ভাষায় অস্ট)-এর দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার ৷ হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে ভারি মজা লাগে ৷
আকাশ পরিষ্কার থাকলে ইন্টারলাকেন থেকেই দেখা যায় আইগার, মঞ্চ আর ইয়ুংফ্রাউ ৷ ইন্টারলাকেন থেকে অনেকগুলো মাউন্টেন রেঞ্জে যাওয়া যায় ৷ প্রত্যেকটিই ছবির মতো সুন্দর তাই ইউরোপের প্রতিটি বড় শহর থেকে এখানে রেলপথে আসা যায় ৷
ইন্টারলাকেন পৌঁছনোর কিছু আগে থেকেই টুনার সি আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে ৷ লেকের পাল তোলা নৌকাগুলো তর তর করে এগিয়ে চলেছে ৷ ধবধবে সাদা রাজহংসীরা দাঁড়িয়ে রয়েছে লেকের পাড়ে ৷ সন্ধে হব-হব ৷ এবার তাদের ঘরে ফেরার পালা ৷ দূরে বহু দূরে লেকের কিনার ঘেঁসে সবজে-নীল পাহাড়েরা দাঁড়িয়ে ৷
ট্রেন চলেছে লেকের একেবারে পাশ দিয়ে ৷ লেককে অনেকটা বেড় দিয়ে তবে স্টেশন ৷ আমরা তাই প্রাণভরে উপভোগ করছি এই রেলভ্রমণ ৷ এবারে একপাশে সবুজ মখমল ঘাসের উপত্যকা ৷ তাতে ইতস্তত তৃণভোজনরত গাভীর দল ৷ গলায় তাদের বিশাল কাঠের ঘণ্টা, নড়াচড়াতে আওয়াজ উঠছে ঠুন, ঠুন, ঠুন ৷ পরে জেনেছি, এই ঘণ্টার আওয়াজেই মেষপালকরা তাদের দলছুটকে খুঁজে পায় সহজেই ৷
ট্রেনের জানলাগুলো পুরো কাচের ৷ শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ৷ ভাবলাম কাচের মধ্যে দিয়ে কেন, প্রকৃতির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হোক সরাসরি ৷ ভাবামাত্র কাচ নামানো, ঠান্ডা হাওয়া অকল্পনীয় সূঁচ ফুটিয়ে দিল শরীরে ৷
স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে কুয়াশা নেমে এল ৷ পাহাড়ি জায়গার এটাই মজা, এই রোদ তো এই বৃষ্টি, এই ঝকঝকে নীল আকাশ তো এই কুয়াশার আঁধার ৷ যাই হোক কাঁপতে কাঁপতে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়েছি ৷ সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট চাপালাম তড়িঘড়ি ৷ তারপর স্যুটকেশ টানতে টানতে এগোচ্ছি দুপাশে নজরদারি করতে করতে ৷
মালপত্র বেশিরভাগই জুরিখ স্টেশনের লকারে রেখে এসেছি ৷ হালকা ছোট্ট দুটো ক্যারিব্যাগ আরেকটা চাকাওয়ালা স্যুটকেশ সঙ্গে ৷ তাই নিশ্চিন্তে হাঁটছি আর পছন্দসই হোটেল দেখে বেড়াচ্ছি ৷ শুধুমাত্র রাত কাটানোর জন্য ৬০-৭০ পাউন্ড খরচ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না ৷ আমরা খুঁজছি ৫০ পাউন্ডের নিচের দিকে ৷
ঝাঁ চকচকে রাস্তা, অসম্ভব সাজানো গোছানো বিশাল বিশাল কাচের দেওয়ালওলা দোকানপাট, মাঝে মাঝেই সুন্দর সুন্দর পার্ক, দেখতে দেখতে চলছি বলে ক্লান্তি লাগছে না একটুও ৷
একটা মোড় ঘুরতেই দেখি হোটেল ইনফরমেশনের বোর্ড লাগানো রয়েছে ৷ একটা বড় বোর্ডে সেই এলাকার সমস্ত হোটেলগুলোর নাম ও তাদের সুযোগ-সুবিধা বোঝানো থাকে, পাশে একটা কোড নাম্বার ৷ একটা ছোট স্ক্রিনে সেই নাম্বারটা টাইপ করলে বর্তমান অবস্থান থেকে সেই হোটেলের দূরত্ব ও রোড ম্যাপ পাওয়া যায় ৷ চাইলে কোড নাম্বার দিয়ে সংলগ্ন ফোন থেকে সরাসরি হোটেলের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া যায় ৷
আমরা একটা হোটেল পছন্দ করে সরাসরি ফোনে কথা বলে জেনে নিলাম বুকিং পাব কি না ৷ তারপর নির্দেশমতো চলতে শুরু করলাম ৷ চলতে চলতে পুরো ইন্টারলাকেন পেরিয়ে ইস্ট সাইডে গিয়ে রেললাইন পেরিয়ে, ব্রিজ পেরিয়ে, তবে পৌঁছলাম গন্তব্যে ৷
তারপর ইন্টারকম বাজিয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম ৷ আসছি বলে মেমসায়েব আর আসেই না ৷ এলেন অবশ্য বেশ দেরিতে ৷ পরে দেখলাম জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ-অর্থাৎ ব্রেকফাস্ট বানানো থেকে হোটেল পরিষ্কার করা সবই তিনি একাই সামলান, তার ফলে মাঝে মাঝে দেরি হয় ৷ কিন্তু তাঁর মধুর হাসি সহ ক্ষমাপ্রার্থনায় আমরা কিছুই মনে করতাম না ৷ এত কাজ একা করতে দেখে বরং শ্রদ্ধাই হত ৷
ছোট্ট হোটেল ৷ তাই দামে সস্তা ৷ মাত্র ৭০ সুইস ফ্রাঁ ব্রেকফাস্ট সহ ৷ ব্রেকফাস্ট বলতে দু-পিস ব্রেড আর ধূমায়িত এক মগ কফি ৷ ঘরটা ছোট হলেও ভালো ৷ রুম হিটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে ৷ আমরা পয়সা বাঁচানোর জন্য সর্বত্র কমন টয়লেট নিতাম কিন্তু তা এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল যে আমাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি কোথাও ৷
একা মেমসায়েব সামলান বলে এই হোটেলে কয়েকটা মজার ব্যবস্থা আছে ৷ একটা ম্যাগনেটিক চাবি তার একদিক দরজায় লাগালে বন্ধ হয়ে যায় আর উল্টোদিক লাগালে খোলে ৷ সামনের প্যাসেজওয়ের আলো, যখন কেউ দরজার কাছাকাছি আসে তখন জ্বলে নিজে থেকেই আবার দূরে চলে গেলেই বন্ধ হয়ে যায় ৷
শুনলাম ইন্টারলাকেন ইয়ুংফ্রাউ রিজিয়নের ক্যাপিটাল শহর ৷ উচ্চতা মাত্র ৫৬৭ মিটার ৷ অবশ্য এটাকে উপত্যকা বলাই ভালো ৷ দিবালোকে নাকি এর সবুজ উপত্যকায় হেঁটে বেড়াতে ভারি ভালো লাগে ৷ গ্রীষ্মে তো বটেই সারা শীতকাল জুড়ে এখানে বসে আরামের আসর ৷ আর শীতকাল তো ইউরোপের ধনীদের আগমনের সময় ৷ তারা স্কি করে, বরফে লুটোপুটি করে, শপিং করে, ক্যাসিনোয় হুল্লোড় করে সময় কাটায় ৷ এখানে তাই এত নামী কোম্পানির ডিপার্টমেন্ট স্টোর ৷ রাস্তাঘাট তাই এত চকচকে সবসময় ৷ এ শহর নিজেকে সবসময় সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে যাতে দেখলেই মনে ধরে যায় ৷
আল্পাইন রেঞ্জের বেস বলে এখানে জনসমাগম প্রচুর হয় ৷ হোটেলের সংখ্যাও প্রায় ৩০০ ৷ বড়, ছোট, মাঝারি সবরকম মানের হোটেল রয়েছে ৷ হাজারও রকমের রেস্টুরেন্টও রয়েছে-চাইনিজ, সুইস, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান, থাই ৷ তবে ভারতীয় কোনও রেস্টুরেন্ট চোখে পড়েনি ৷
হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন পৌঁছে গেছি ৷ বেঞ্চিতে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে পাশের স্ট্যান্ড থেকে পয়সা ফেলে সংগৃহীত কোক খাচ্ছি ৷ খানিক পরে এক চিনে রেস্তোরাঁয় নৈশাহার সেরে গভীর রাতে হোটেলে ফিরলাম ৷
সকালে উঠতে কিঞ্চিৎ দেরি হয়ে গেল ৷ গরম জলে স্নান করে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম ৷ গন্তব্য ইয়ুংফ্রাউ-ইউরোপের সর্বোচ্চ রেলস্টেশনটি এখানেই ৷
ইন্টারলাকেন অস্ট স্টেশন থেকেই ট্রেন ধরতে হবে ৷ এটা আমাদের হোটেল থেকে মাত্র ৫ মিনিটের পথ ৷ ৯টার মধ্যেই তাই স্টেশনে পৌঁছলাম ৷ তখনও কুয়াশার ঘেরাটোপ থেকে শহর জেগে ওঠেনি পুরোপুরি ৷ এক-আধটা দোকান খুলেছে তাতে ঝাঁটপাট, ধূপ-ধুনো দেওয়া হচ্ছে ৷ স্যান্ডউইচ শপের কাউন্টার তো পুরোই খালি ৷ সবে পাউরুটির গাড়ি এসে দাঁড়াল ৷ রাস্তাঘাট পরিষ্কার চলছে জোরকদমে ৷ একটা অদ্ভুত-দর্শন গাড়ি, তলায় রাবার প্যাড লাগানো, তার সামনের বিশাল হাঁ-তে সে নিমেষে টেনে নিচ্ছে সব কাগজপত্র, নোংরা যার সংখ্যা নেহাতই কম কারণ রাস্তায় কাগজ ফেলে না প্রায় কেউই, আর রাবার প্যাড দিয়ে রাস্তাগুলো মোছা হয়ে যাচ্ছে ৷ ময়লা ফেলার গাড়িতে বোঝাই করা হচ্ছে রাস্তার সমস্ত ডাস্টবিনের গার্বেজ ৷ কালো প্লাস্টিকের বিশাল বস্তা সরিয়ে নতুন প্যাকেট লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ৷ এসব দেখতে দেখতেই ট্রেন এসে গেল ৷
এবারে আমরা যাব ছোট লাইনের মাউন্টেন ট্রেনে ৷
লাল রঙের ছোট ট্রেন ৷ মাত্র ৪-৫টা কামরা তাতে ৷ আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী ৷ কী সুন্দর গদি আঁটা লাল, নীল, সবুজ ছাপা চেয়ার ৷ স্মোকিং, নন স্মোকিং জোন আলাদা করা যাতে কারও কোনও অসুবিধে না হয় ৷ পুরো ট্রেনটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ৷
ট্রেন চলেছে তীব্র গতিতে ৷ মুহুর্মুহু বদলে যাচ্ছে প্রেক্ষাপট ৷ এই সবুজ উপত্যকা তো এই একমুঠো বসতবাটী ৷ পাহাড় ঢালে চরে বেড়াচ্ছে এক পাল গরু-ভেড়া ৷ এত সবুজ চারণভূমি আছে বলেই না সুইস চকোলেটের এত খ্যাতি ৷ দূরের জঙ্গল এখনও জাগেনি ৷ শীতের প্রারম্ভে এদিকে সব পাতা প্রথমে লাল হয়, তারপর হলুদ হয়ে বিবর্ণ হতে হতে ঝরে পড়ে ৷ প্রায় সব গাছেই লেগেছে লালের ছোঁয়া ৷ কোনও কোনও গাছ তো সম্পূর্ণ লাল হয়ে গেছে ৷ এত অন্যরকম এ দৃশ্য যে না দেখলে বিশ্বাসই হয় না ৷
হুইল্ডার্স হুইল পেরনোর পর থেকেই ক্রমশ পাকদণ্ডী বেয়ে ওপরে উঠছে ট্রেন ৷ লাশ্চিন নদী নাচতে নাচতে, সঙ্গে চলেছে ৷ কত ঝরনা চারদিক দিয়ে এসে মিশেছে এর গতিপথে ৷ মোট ৭২টি ঝরনা, লিফলেটে দেখেছি ৷ তবে এতগুলো আমরা দেখতে পাইনি ৷ অনেকগুলোয় জল ছিল না ৷
একটা বাঁক পেরতেই সামনে নগাধিরাজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ৷ কুয়াশার আঁধারের বুক চিরে একফালি আলোর রেখা পড়েছে তার বুকে ৷ দীপ্যমান তপস্বীর মতো আপন দীপ্তিতে ভুবন ভরিয়ে দিয়েছে সে ৷ খানিকক্ষণ নয়নসুখ গ্রহণের সুযোগ দিয়ে সে আবার হারিয়ে গেল গাছের আড়ালে ৷ এবারের বৃক্ষরাজি চিরহরিৎ শ্রেণীর, ফার ও বার্চ জাতীয় বৃক্ষই বেশি ৷ এরপর বেশ খানিকটা সময় ধরে চলল বন, গাছ, বাড়ি ও তুষারশৃঙ্গের এই লুকোচুরি খেলা ৷ লাউটরিব্রুনেনের পর থেকে অবশ্য সে আর বঞ্চিত করেনি আমাদের ৷ আমরাও চোখের আড়াল হতে দিইনি তাকে ৷
ইয়ুংফ্রাউ, ছবির মতো সুন্দর এই দেশটির ততোধিক সুন্দর, এক জায়গা ৷ তাই এ পথে চলে অনেকগুলো ট্রেন-গ্রীষ্মে চলে প্যানোরামিক এক্সপ্রেস ৷ জুরিখ থেকে কুর-এ ট্রেন পাল্টিয়ে এ পথে আরেকটি ট্রেনও চলে, সম্ভবত গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস তার নাম ৷ তবে অফ সিজনে সেরকম কোনও ট্রেন না চললেও আমাদের মতো একই রুটে ট্রেন পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে যাওয়া যায় ৷
আধঘণ্টা পর পর ট্রেন ৷ ইচ্ছে হলে কোনও স্টেশনে দুদণ্ড জিরিয়ে নিয়ে চলা যায়, সেই টিকিটেই ৷ আমরা লাউটরিব্রুনেনে নেমে দু-কাপ কফি নিয়ে বেঞ্চিতে বসে আল্পসের দিকে তাকিয়ে থাকলাম ৷ সবুজ উপত্যকা সিধে গিয়ে আল্পসের পায়ে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছে ৷ আর মহারাজ সটান বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ৷ তার উন্নত শির সোজা গিয়ে ঠেকেছে আকাশের পিঠে ৷
নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি পুরো ইন্টারলাকেন শহরটাই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে ৷ কী দুর্ভেদ্য তার আবরণ, এক চিলতেও ফাঁক নেই কোথাও ৷ শুধু ঘন কালো মেঘের রাজত্ব ৷
এখানে ট্রেন পাল্টিয়ে পরের গন্তব্য ক্লাইন সেইডেগ যেতে হবে ৷ প্রত্যেক ট্রেনের রং আলাদা, যাতে চিনতে অসুবিধে না হয় ৷
এবারে রাস্তা ক্রমশ সরু ও বন্ধুর হয়ে আসছে ৷ যদিও ট্রেনে বসে তা বোঝা যাচ্ছে না ৷ কোনও কোনও জায়গায় রাস্তা এত সরু যে তলায় লোহার লম্বা লম্বা রড লাগিয়ে তার ওপর ঠেকনা দিতে হয়েছে ৷ কোথাও ধসের ক্রমাগত প্রকোপ থেকে বাঁচতে ট্রেন লাইনের ওপর ছাদ তৈরি হয়েছে পাথর ও গাছপালা দিয়ে ৷ কোথাও লোহার দড়ি দিয়ে রাস্তাকে বাঁধা হয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে, যাতে কোনও পতন না ঘটে ৷
একপাশে আল্পাইন রেঞ্জের বরফ ঢাকা পাহাড় আর একদিকে ঘন সবুজ আল্পাইন উপত্যকা, মাঝখান দিয়ে ট্রেন চলছে ৷
ক্লাইনেশেইডেগ থেকে পরবর্তী যাত্রা টানেল এর মধ্য দিয়ে ৷ এই শেষ পর্বের ১২ কিলোমিটারের মধ্যে সাত কিলোমিটার প্রায় টানেল ৷ প্রায় ৪০ মিনিট ধরে এই টানেল পার হতে হয় ৷ মাঝে দুজায়গায় ট্রেন থামিয়ে টানেলের এক পাশের দেওয়ালে কাচ লাগিয়ে চারপাশের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে ৷
আমরা চলেছি আইগার ও মঞ্চ-এর পেটের মধ্য দিয়ে ৷ টানেলের জানলায় তাকালে তাই দেখতে পাচ্ছি চতুর্দিকে বরফ আর বরফ ৷ যদিও এমনিতে টানেলের ভেতরে আলোর ব্যবস্থা রয়েছে ৷
ট্রেন এসে থামল ইয়ুংফ্রাউ হয়ক, উচ্চতা ৩৪৫৪ মিটার ৷ ইউরোপে এর থেকে উঁচুতে কোথাও রেললাইন নেই ৷ এটা সুইসদের খুবই গর্বের বিষয় ৷ স্টেশনের পাশে একটি ফলকে উৎকীর্ণ করা হয়েছে রেললাইন স্থাপনের আদিকথা ৷
এক সুইস শিল্পপতির নেশা ছিল আল্পসের শিখরে শিখরে ঘুরে বেড়ানোর ৷ অ্যাডল্ফ গায়ের জেলার, সেই শিল্পপতি ১৮৯৩ সালে আইগার, মঞ্চ ও ইয়ুংফ্রাউয়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঠিক করেন রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করে সেই সব লোকদের আল্পস এর মহান সৌন্দর্য দেখার সুযোগ দেবেন যারা ট্রেকিং করতে পেরে ওঠে না ৷
কাজ শুরু হল ১৮৯৬-এ ৷ কারণ ৩ বৎসর ধরে প্রচুর গবেষণা করা হয়েছিল কীভাবে একটা পুরো বরফের পাহাড় ফুঁড়ে রেললাইন পাতা যায় যাতে কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না সেই পাহাড়ের শারীরিক বা চারিত্রিক গঠনে ৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে সুদীর্ঘ ১৬ বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯০২ সালে এই রেলপথ চালু হয় ৷ খরচ হয় ১৫ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ ৷ এখনও এই রেলপথ রক্ষা করতে খরচ হয় কয়েক মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ ৷ পানীয় জল বহন করতে হয় ক্লাইন সেইডেগ থেকে ৷
এবারে বিশাল এক লিফটে চেপে বসলাম ৷ এর ধারণক্ষমতা ১ ঘণ্টায় ১২০০ জন ৷ ১০৮ মিটার পথ অনায়াসে অতিক্রম করে ২৫ সেকেন্ডে ৷ ঘটনার অস্বাভাবিকতার আঁচ একটা তখন থেকেই পাচ্ছিলাম ৷ এখন সাঁ সাঁ করে ওপরে এসে এই স্ফিংক্স অবজারভেটরির লোহার ঘেরাটোপের মাঝে দাঁড়িয়ে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি ৷
এখানে মাইলের পর মাইলব্যাপী তুষারশৃঙ্গ আর তুষারতরঙ্গের শুভ্র অভিঘাতে মনের সব কালিমা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল ৷ এই শুচিশুভ্র সৌন্দর্য নিমেষে ভুলিয়ে দিল মনের যত সংকীর্ণতা, ক্ষুদ্রতা ৷ আমরা বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও ধর্মের এই যে এক দল লোক এখানে জড়ো হয়েছি তারা হঠাৎ ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে একে অপরকে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধে ফেললাম ৷ বৃহতের এটাই লক্ষণ যে ক্ষুদ্রকেও তার সঙ্কীর্ণতার গণ্ডি অতিক্রম করতে সাহায্য করে ৷
প্রাথমিক আবেগের উচ্ছ্বাস সামলিয়ে এবার অবজারভেটরি থেকে নেমে এলাম নিচের বরফে ৷ মাইলের পর মাইল গ্লেসিয়ার ঘুমিয়ে রয়েছে, কখন যে ঘুম ভেঙে চলতে শুরু করে দেবে তার ঠিক নেই ৷ বরফে মার্কিং করা রয়েছে, তার মধ্যে ঘোরাফেরা করাই ভালো ৷ তার বাইরে ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই ৷ কোথায় তলায় গভীর খাদ রয়েছে কে জানে ৷
কনকনে হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে ৷ সোয়েটার, জ্যাকেটের পুরু আস্তরণ ভেদ করে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে ৷ তাতে বিন্দুমাত্র না দমে বরফে ছোটাছুটি শুরু করে দিলাম ৷ গ্লাভস খুলে এক মুঠো বরফ তুলে নিলাম হাতে, হাত যেন জমে গেল ৷ তবু তার স্পর্শসুখ থেকে বঞ্চিত করতে চাইলাম না নিজেকে ৷
মিনিট কুড়ি পরে কান-মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হতে ছুটে চলে এলাম ভেতরে ৷ অবজারভেটরির নিচের তলাগুলোতে রয়েছে ৫টি রেস্তোরাঁ, স্যুভেনির শপ, পোস্ট অফিস, কনফারেন্স রুম যাতে অডিওভিস্যুয়াল শো’র ব্যবস্থা করা যায় ৷
রেস্তোরাঁয় হাজারও জিনিস সাজানো কিন্তু নামগুলো সব জার্মান ভাষায় লেখা ৷ না পারছি বুঝতে, কাউন্টারের লোকেরাও বোঝাতে পারছে না ৷ দুজনেই তিতিবিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে এক কাপ করে চা ও একটা করে কেক দিয়ে লাঞ্চ সারলাম ৷ কাতারে কাতারে জাপানি ট্যুরিস্ট দেখছি ৷ স্যুভেনির শপে উপচে পড়া ভিড় ৷ অসম্ভব দাম! এত উঁচুতে সব কিছু কত কষ্ট করেই না আনতে হয় সুতরাং সহজবোধ্য কারণেই দাম বেশি! আমার রেস্তোর জোর কম তাই সন্তর্পণে এড়িয়ে চলেছি কেনাকাটার পাট ৷ পোস্ট অফিস থেকে শুধু কনসেশনে একটা চিঠি পোস্ট করেছিলাম দেশে ৷
কাচের জানলার পাশে বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে জমে থাকা শরীরে সাড় ফিরে পাচ্ছি বেশ ৷ একমাত্র আমরাই চা-পায়ী বাকিরা মৌজ করে চুমুক দিচ্ছেন লাল, সাদা তরল পানীয়তে ৷ প্রায় ৬০-৭০ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার এক দল ঢুকল গাইড সহ ৷ একেকজন তো বার্ধ্যকের শেষ সীমায় বলেই মনে হল ৷ এখানে তো শারীরিক কোনও পরিশ্রম নেই, শুধু অর্থ থাকলেই হল ৷ এমনকী প্রতিবন্ধীদের জন্যও ট্রেনে লিফটে ওঠার ব্যবস্থা আছে, তাই তারাও দুচোখ ভরে দেখতে পায় বহির্জগতকে ৷ হিমালয়কে দেখতে হয় দূর থেকে ৷ তার বিরাটত্ব মনে ভক্তির উদ্রেক করে, আল্পস তুলনায় অনেক নিকট ৷ ইউরোপীয়দের কাছে তো পাশের বাড়ি বেড়াতে যাবার মতোই ব্যাপার ৷ রাতের ট্রেনে সকালে ইন্টারলাকেন এসে সারাদিন আল্পস ভ্রমণ করে আবার রাতের ট্রেনেই ফেরা যায় ৷ উপরন্তু হিমালয়ের সাত-আট হাজার ফুটের নিচে বরফই জমে না ৷ নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী অঞ্চল বলে ভারতে সূর্যের তাপ প্রখর ৷ উত্তর গোলার্ধে হওয়ায় ইউরোপে সূর্যের তাপ কম ৷ শীতে তো শহরেও বরফ পড়ে ৷ তাই খুব কম উচ্চতা, মাত্র তিন হাজার ফুট উঠলেই বরফ দেখা যায় ৷
শুনলাম এখানে বরফ কেটে তৈরি হয়েছে এক অনবদ্য গুহা ৷ দিকনির্দেশ জেনে নিয়ে ঢুকে তো পড়লাম ৷ হালকা নীল রঙা আলোয় গুহার ভেতরটা মায়াবী হয়ে আছে ৷ দুপাশে রেলিং চলে গেছে ৷ প্রথমটা বুঝিনি, কিন্তু পা পিছলে পড়ো-পড়ো হতে বোধগম্য হল রেলিংয়ের প্রয়োজনীয়তা ৷ জমাট বরফে পা পিছলে যাচ্ছে বার বার, বহু কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ৷ সামনে পিছনে ধপাস ধপাস আওয়াজ পাচ্ছি ৷ বুঝতে পারছি উৎসাহীদের পদস্খলন ঘটছে ৷ ভয়ে আর হাত ছেড়ে দিয়ে ছবি তোলার সাহসই পাই না ৷
বরফ গুহার ভেতরে বরফ কেটে কেটে কি সুন্দর সুন্দর সব মূর্তি বানানো হয়েছে-ডানা মেলা পাখি, মাছ, নানারকমের জন্তু জানোয়ার ৷ এত বিচিত্র ও বিভিন্ন বিস্ময়কর বস্তু দেখতে দেখতে শেষে বিস্মিত হওয়াই ভুলে গেলাম ৷ সবই মনে হচ্ছে সম্ভব, অসম্ভব বলে কোনও কিছুই নেই এদের অভিধানে ৷
আবারও বেরিয়ে এলাম বাইরে ৷ সূর্য তখন মধ্যগগনে ৷ বরফে আলো ঠিকরে ঝলসে যাচ্ছে চোখ ৷ সানগ্লাস চোখ থেকে খোলাই যাচ্ছে না ৷ তবু চশমার আড়াল সরিয়ে সাদার ঔজ্জ্বল্য পরখ করলাম, চোখ ধাঁধিয়ে গেল ৷ মাঝে মাঝে দুয়েকটা পাহাড় দেখছি যার কালো মসৃণ গ্র্যানাইট গাত্রে বরফ দানা বাঁধেনি ৷ সাদার পূর্ণতায় মাঝে মাঝে ছেদ পড়েছে তাদেরই জন্য ৷ এক গুচ্ছ মেঘ জমে আছে ইয়ুংফ্রাউয়ের ঠিক নিচটাতে, লম্বা গ্লেসিয়ারের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে ৷ আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না কাউকেই ৷ আল্পসের বিখ্যাত অ্যালেশ্চ গ্লেসিয়ার দেখতে পাওয়া যায় এখানেই ৷
এবার ফেরার পালা ৷ দুচোখ ভরে শেষ বারের মতো দেখে নেমে এলাম নিচের স্টেশনে ৷ অবশ্য আল্পস দূর থেকে পুরো ফিরতি পথটাই সঙ্গ দিয়ে গেছে আমাদের ৷
ফেরা সেই একই পথে ৷ পাহাড়ি উপত্যকার মধ্য দিয়ে নদী, পাহাড়, জঙ্গলের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ৷ গ্রীষ্মে উপত্যকায় ফুলের হাট বসে যায়, শীতে দুচারটে নাম না-জানা ফুল ফুটে রয়েছে ইতিউতি ৷
ইন্টারলাকেন পৌঁছে দেখি শহর এখনও ঢাকা পড়ে আছে কুয়াশায় ৷ ঝির ঝির করে বৃষ্টি ঝরে পড়ছে ৷ স্টেশনে বসে ঠিক করলাম এবার আর আল্পস বা সুইজারল্যান্ড নয়, এখান থেকেই কানেক্টিং ট্রেন ধরে চলে যাব ভেনিস ৷ রিসেপশনিস্ট সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের খবরাখবর দিয়ে দিলেন ৷ রাত ১১টায় ট্রেন ধরে বার্ন তারপর সেখান থেকে মিলান হয়ে ভেনিস যেতে হবে ৷
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন