অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
আচমকাই শব্দহীন হয়ে গেল জিপটা ৷ নিঃশব্দ জঙ্গলে অন্যরকম শব্দের ঝঙ্কারে সচকিত হয় প্রকৃতি ৷ ঝিঁঝির একটানা ডাক, পাখিদের সমস্বর হৈচৈ, মর্কটকুলের বেখাপ্পা হঠাৎ চিৎকার-সব ছাপিয়ে ক্রমশ ঘনীভূত হয় গাছের ডাল ভাঙার মটাস মটাস আওয়াজ ৷ নিশ্বাস বন্ধ করে আমরা বসে থাকি, আগ্রহ আর আশঙ্কার দোলায় দুলতে দুলতে ৷
ধানগড়ি চেকপোস্ট পেরিয়ে কিছুক্ষণ হল প্রবেশ করেছি করবেট জাতীয় উদ্যানের অন্দরমহলে ৷ জঙ্গলের বুক চিরে কালো অ্যাসফল্টের রাস্তা ৷ অরণ্য কোথাও গভীর, সতর্ক দৃষ্টি হেনেও কিছুই নজরে পড়ে না এমনই ঠাসবুনোট ৷ আবার কোথাও শুদ্ধাচারী কতিপয় মহীরুহ অন্যের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রমাণে ক্রমশ দীর্ঘ হবার চেষ্টায় মগ্ন ৷ নতমুখী লতাগুল্ম যেন তাদের পা জড়িয়ে আছে ৷ বেশ চলেছিলাম ৷ কখনও মসৃণ গতিতে, কখনও শম্বুক লয়ে, কখনও বা লাফিয়ে লাফিয়ে ৷ মাঝে মাঝে রাস্তার অবস্থা বড়ই সঙ্গীন ৷ হঠাৎই ড্রাইভারের সশব্দ ব্রেক কষায় চমকে গেলাম ৷
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এক দঙ্গল হাতি, কাচ্চাবাচ্চা সহ, নির্বিচারে গাছের ডাল ভাঙতে ভাঙতে এসে দাঁড়াল ঠিক রাস্তার পাশটিতে ৷ আমাদের গাড়ি থেকে হাত কয়েক দূরে ৷ গনগনে বৈশাখের তীব্র তাপে পিচরাস্তার দুধারের মাটি ফুটিফাটা, ধুলোর পুরু চাদর বিছানো ৷ দলপতি হাতি শুঁড় দিয়ে সেই ধুলোকে বেশ করে উড়িয়ে দিয়ে তার ওপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়ল ৷ তারপর গা দুলিয়ে দুলিয়ে সে কী ধুলো মাখার ধুম ৷ পরপর লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সকলে ৷ একজন একজন করে বেশ ‘ধূলিধূসরিত নন্দদুলাল’ সেজে পরের জনকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে হেলতে দুলতে ঢুকে পড়ছে জঙ্গলের ভেতরে ৷ সম্ভবত রামগঙ্গায় গিয়ে স্নানটা সেরে নেবে ৷
এদিকে আমরা ন যযৌ ন তস্থৌ, আরও গোটা দুই গাড়ি এসে পড়ায় সাহস কিঞ্চিৎ বেড়েছে ৷ তাহলেও ঠিক নির্ভাবনায় আছি বলা যাবে না ৷ গাড়িটাকে নিয়ে কার যে কখন ফুটবল খেলতে ইচ্ছে হবে কে জানে? ধুলোকেলি তো চলছেই, চলছে মিছিলও ৷ সব থেকে ছোটটি চলার সময় মায়ের পেটের তলায় ঢুকে পড়ছে ৷ মা-ও শুঁড়ে করে ধুলো নিয়ে তার সন্তানকে স্নেহভরে মাখিয়ে দিচ্ছে ৷ ভারি দৃষ্টিনন্দন সে দৃশ্য ৷ পরে জেনেছিলাম এভাবে ধুলো ঘষে ঘষে হাতিরা তাদের শরীরের পোকা মারার চেষ্টা করে ৷
প্রায় মিনিট কুড়ি চলল এই শোভাযাত্রা ৷ বাকি পথটুকু উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে ফুটতে হাওয়ায় ভর দিয়ে ২০ কিলোমিটার পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ধিকালায় ৷
ধিকালা বন-আবাসটি করবেট ন্যাশনাল পার্কের ঠিক মধ্যস্থলে ৷ রামগঙ্গা জলাশয় পাশেই ৷ ১৩১৮ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত করবেট অভয়ারণ্যটি ৷ ধিকালা ছাড়া আরও কয়েকটি রাত্রিবাসের আস্তানা আছে-খিনানৌলি, সরাপদুলি, গৈরাল, বিজরানি, কান্দা ও সুলতানে ৷ স্থানমাহাত্ম্যে ধিকালার কৌলীন্য অনেক বেশি তাই বুকিং পাওয়া একটু কঠিনই হয় ৷ কলকাতা থেকে বুকিং আমরা পাইনি ৷ লখনউ থেকে বুকিং করতে হয়েছিল ৷ রামনগর থেকে বুকিং পাওয়া বরং বেশি সহজ ৷
করবেট ন্যাশনাল পার্কটি সংরক্ষিত হয় ১৯৩৬ সালে ৷ গভর্নর ম্যালকম হ্যালির নামানুসারে তখন এর নাম ছিল হ্যালি’স ন্যাশনাল পার্ক ৷ এটিই ভারতের প্রথম সংরক্ষিত বনভূমি ৷ তারপর স্বাধীনতার পরে নাম পাল্টে রাখা হয় রামগঙ্গা অভয়ারণ্য ৷ শেষমেষ প্রখ্যাত শিকারি জিম করবেটের নামানুসারে ১৯৫৭ সালে এর নতুন নাম হয় করবেট জাতীয় অরণ্য ৷ ১৯৭৩ সালে ব্যাঘ্রপ্রকল্প শুরু হলে এই অরণ্যটিই প্রথম সেই প্রকল্পের অন্তর্গত হয় ৷
শিবালিক হিমালয়ের তরাই বনাঞ্চল ঘিরেই মূলত করবেটের বিস্তৃতি ৷ তাই এখানে মাঝে মাঝেই উঁকিঝুঁকি দেয় সারি সারি পাহাড় ৷ উচ্চতা কোথাও হাজার মিটার আবার কোথাও মাত্রই ৩০০ মিটার ৷ বনের সর্বোচ্চ পাহাড় উত্তর-পশ্চিমে কান্দা পাহাড় ৷ বৃষ্টিপাত বেশ ভালো হয় বলে পার্ক সবসময়ই সবুজ ৷ শাল, শিশু, শিমুল, কুল জাতীয় গাছই বেশি ৷ বিশেষত এখানে ‘মোটা শাল’ বলে একধরনের শাল গাছ পাওয়া যায় যার গুঁড়িকে দশজন মিলেও ধরা যায় না ৷ দৈত্যাকৃতি এই গাছটি উচ্চতায় প্রায় ৩৩ মিটার ৷
ধিকালার পর্যটক আবাসগুলি প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য মেনে কুঁড়েঘরের মতো করে তৈরি করা হয়েছে ৷ মেটে রঙা দেওয়াল, লাল টালি বা সবুজ ছাদ ৷ কিন্তু ভেতরে আধুনিক জীবনযাত্রার প্রায় সব সরঞ্জামই মজুত ৷ টেলিভিশন বাদে ৷ আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে সেজন্য যারপরনাই কৃতজ্ঞ বোধ করেছি ৷ লোডশেডিংয়ের প্রকোপ খুব ৷ তাতে খুব একটা ক্ষতি হত না ৷ কারণ জঙ্গলে দুপুরের প্রখর সূর্যালোকের সময়টুকু ছাড়া গরম বিশেষ গায়ে লাগে না ৷ বরঞ্চ নিষ্প্রদীপ জঙ্গলে জ্যোৎস্নার হানাদারিতে রাত হয়ে উঠত মায়াবী ৷ বন্যপ্রাণী দেখতে পান আর নাই পান চাঁদনি রাতে করবেট অরণ্য দর্শনের অপার্থিব অভিজ্ঞতা হবে বিরল সঞ্চয় ৷
পার্কিং লটে সারি সারি গাড়ি ৷ হরেক রকমের ৷ টাটা সাফারি আর কালিস ৷ উত্তরপ্রদেশের সরকারি গাড়ির সংখ্যাধিক্য রীতিমতো চোখে পড়ার মতো ৷ ফি শনি-রবিবার করবেটে ছুটি কাটাতে আসেন সপারিষদ কোনও না কোনও বড় কর্তা ৷ তাই শনি-রবিতে বুকিং পাওয়া বেশ শক্ত ৷ চেষ্টা করবেন সোম-মঙ্গল বারের বুকিং পেতে ৷ এতে ভিড়টা কমও হবে ৷
গাড়ি থেকে নামামাত্র পাশ দিয়ে এক দাঁতাল শূকর ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে এগিয়ে গেল ৷ ভয়ে আবার লাফিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি ভ্রাম্যমাণ সিকিউরিটি জানাল, এটি এখানকার পোষা ৷ বছর কয়েক আগে বাঘের থাবায় আহত শিশু মিহিরকে সারিয়ে তোলেন এখানকার কর্মচারীরা ৷ সেই থেকে সে এখানেই রয়ে গেছে ৷ শুনলাম তার দেখাদেখি এবং খাদ্যের সহজলভ্যতার কারণে আরও দু-চারটি বুনো শুয়োর নিজেরাই স্বীকার করে নিয়েছে মানুষের বশ্যতা ৷ গৃহপালিত কুকুরের মতো তাদেরকে পায়ে পায়ে ঘুরতে দেখে মজাই পাবেন ৷ বিপত্তি বেধেছিল এক সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে মিহির ভেবে এব বন্য বরাহকে ক্যামেরা তাক করতে গিয়ে ৷ পার্কিং লটের বাঁহাতে ফরেস্ট রেঞ্জারের অফিস ছাড়িয়ে একটু এগোলেই এক ধাবা ৷ কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের রেস্তোরাঁর দাম কিঞ্চিৎ বেশি বলে অনেকেই এখানে ভিড় করেন ৷ খাবারের রকমফেরও এখানেই বেশি ৷ সবই নিরামিষ ৷ সম্প্রতি জঙ্গলে আমিষ আহার্য গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে ৷ যদিও ডিম পাওয়া যায় ৷ সেখানে বরাহ এসেছিল সম্ভবত খাদ্যের সন্ধানে ৷ আমরাও পিছু নিয়েছি ৷ ছবিও তুলেছি বেশ কিছু ৷ হঠাৎই পিছন থেকে সাবধানবাণী ‘আগে মৎ যাও, বরা হ্যায়’ ৷ তড়িঘড়ি পালিয়ে বাঁচি ৷ বন্য বরাহের রাগী মেজাজের কথা পুথিপত্তরে পড়েছি অনেক, সেরকম কিছু ঘটেনি বলে ভগবানকে ধন্যবাদ ৷
ধিকালার বন-আবাসগুলি মূলত দুধরনের-কেবিন কটেজ ও ডিলাক্স বেডরুম ৷ এছাড়া লগ হাটও রয়েছে ৷ এই ডর্মিটরিতে ২৪টি বেড আছে ৷ বেডিং পাওয়া যায় না ৷ তৈরি হয়েছে পাঁচতলা এক পর্যটক আবাস ৷ রোজ সন্ধেয় ডাইনিং হল সংলগ্ন চারদিক খোলা অডিটোরিয়ামে অরণ্য ও তার বনচারী সভ্যদের তথ্যচিত্র দেখানো হয় ৷ সংলগ্ন লাইব্রেরিতে বিভিন্ন অসাধারণ বইয়ের সংগ্রহ ৷ অলস মধ্যাহ্নে জঙ্গল যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন এই লাইব্রেরি হতে পারে আপনার সময় কাটানোর সঙ্গী ৷ অবশ্যই বন্ধ ও খোলার সময় আগেই দেখে নেবেন ৷ এটি পরিবর্তিত হয় মাঝে মাঝে ৷
করবেট অরণ্যে ঘোরবার জন্য ফরেস্টের কোনও গাড়ি নেই ৷ আসলে রামনগর থেকে ধিকালা আসতে হলে ভাড়ার গাড়িই একমাত্র বাহন বলে প্রত্যেকের সঙ্গেই গাড়ি থাকে এবং জঙ্গলে তাই নিয়েই ঘোরা যায় ৷ তবে গাইড নিতেই হবে সঙ্গে ৷ এছাড়া হাতি ভাড়া পাওয়া যায় জঙ্গলে ঘোরার জন্য ৷ এর বুকিং পাওয়া খুবই দুষ্কর ৷ সুতরাং পৌঁছেই প্রথম কর্তব্য রিশেপশন সেন্টারে হাতির জন্য নাম লেখানো ৷ আমরা ধিকালায় তিন রাত বাস করেছিলাম ৷ প্রচণ্ড ভিড় ছিল বলে তৃতীয়দিন সকালে হাতি পেয়েছিলাম ৷ অবশ্য তখন হাতিসুমারি চলছিল বলে গোটা দুই পোষ্য হাতি সেই কাজে ব্যস্ত ছিল ৷
ধিকালার সামনেটায় অনেকটা উন্মুক্ত চারণভূমি-শীতের শুরুতে ঘাস ছোট থাকে বলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় ৷ এপ্রিল-মে মাসে ঘাস প্রায় মানুষ-সমান উচ্চতায় পৌঁছে যায় ৷ তখন ছোটখাটো হরিণ জাতীয় জন্তু ঢাকা পড়ে যায় ঘাসের আড়ালে ৷ শুধু দলকে দল হাতির ঊর্ধ্বভাগ নজরে আসে ৷ এইসময় অবশ্য বাঘেদের শিকার করতে খুব সুবিধে ৷ ঘন ঘাসের জঙ্গলে সে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে, তারপর শিকারের দিকে আচমকাই লাফিয়ে পড়ে ৷ কপাল ভালো থাকলে এ হেন রোমহর্ষক দৃশ্যের সাক্ষী আপনিও হতে পারেন যেমনটি হয়েছেন ধিকালার প্রায় প্রতিটি কর্মচারী ও অসংখ্য পর্যটক ৷ করবেটে বাঘের প্রাচুর্য রীতিমতো উল্লেখযোগ্য ৷ গত বাঘসুমারিতে বাঘের সংখ্যা ছিল নব্বইটি ৷ বর্তমানে তা প্রায় দেড়শোর কাছাকাছি হবে এমনটি আশা করা হচ্ছে ৷ যদি ওয়াচটাওয়ারে গিয়ে ধৈর্য ধরে কাটাতে পারেন কয়েক ঘণ্টা তবে সন্ধের দিকে বাঘেদের জল খেতে আসার সময়ে তাদের দেখা পেতে পারেন ৷ আজকাল সন্ধের পর জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করতে দেয় না বিশেষ, তাই আগাম জিজ্ঞাসাবাদ করে নেবেন ৷
আমাদের কুঁড়েঘরটি ছিল একদম শেষে ৷ তারপরই জঙ্গল শুরু ৷ পাশ দিয়ে রামগঙ্গা চলছে নাচতে নাচতে পাথরে পাথরে নিক্কণ ধ্বনি তুলে ৷ বনভূমিকে বাঁচাতে তৈরি হয়েছে রামগঙ্গা লেক বা জলাধার যাতে বর্ষার জল ধরে রাখা যায় ৷ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অবশ্য জলাধারে মলমলি ঘাসের সবুজ আস্তরণ ৷ চিতল হরিণ আর হাতিরা পেটপুরে অহোরাত্র খেয়েই চলেছে ৷ হাতির দল ঘরে বসেই দেখতে পাবেন ৷ যত্রতত্র হাতিদের এমন যথেচ্ছাচারে ঘুরে বেড়াতে দেখে মনে হয় গোটা করবেট অরণ্যটাই যেন ওদের ব্যক্তিগত চারণভূমি ৷ তবে আমদান্ডা হয়ে বিজরানির দিক দিয়ে যাঁরা আসেন তাঁরা অতটা সৌভাগ্যবান নাও হতে পারেন ৷
সকাল বিকেলের জঙ্গল সফরটুকু বাদ দিয়ে ঘরের পিছনে চেয়ার পেতে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় দু-চারদিন ৷ অরণ্য তার রূপবৈচিত্র নিয়ে নিজেকে মেলে ধরবে ৷ ভোর হতে না হতেই শুরু হবে পাখিদের কিচিরমিচির ৷ তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি বেরিয়ে পড়বে তাদের দিন মজুরিতে ৷ শ্রম বলতে সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরা আর ভরপেট্টা খাওয়া ৷ সন্ধেয় আবার ঘরমুখো, কলতানে মুখরিত আকাশ ৷ সারারাত পাশের ঝোপে গাল ফুলিয়ে ঝগড়া ছাতারে আর প্যারাকিটদের ৷
রোজই দেখতাম একদল খ্যাঁকশিয়াল আমাদের ঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করে ৷ ঠিক বুঝতে পারতাম না ৷ পাশের ঝোপেই কিছু পক্ষিশাবক থাকত ৷ একদিন দেখি তারা কড়মড়িয়ে হাড় চিবোচ্ছে ৷ সেই থেকে লাঠি হাতে পক্ষিশাবক পাহারা দেওয়াটা হল আমার নিত্যকর্ম ৷ বাড়তি পাওনা হল পাখিদের ঘর-গেরস্থালি দেখা ৷ সাদাকালো হর্নবিলগুলোকে দেখতাম বড় উঁচু কোনও গাছের মগডালে বাসা বেঁধেছে ৷ এরা একটু নাক উঁচু গোছের ৷ কারও সঙ্গে মেশে না ৷ সোনালি কালো ঝুঁটির ওরিয়ল আর কুচকুচে কালো ফিঙের দোস্তি বোঝা যেত তাদের কাছাকাছি ঘুরতে দেখে ৷ প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার রাতদিন ঝাঁপাঝাঁপি করে পোকা মারায় ব্যস্ত ৷ রিং ডাভ আর স্পটেড ডাভ বা ঘুঘু প্রজাতি মাটির কাছাকাছি থাকতে বেশি পছন্দ করে ৷ সবুজ বী-ইটারগুলোই সব থেকে মজার ৷ এই অরণ্যে প্রায় ছশো প্রজাতির পাখি আছে ৷ পরিযায়ী পক্ষিকুলের সংখ্যাও কম নয় ৷
রামগঙ্গা জলাধারের কাছে গেলে আবার দেখা মেলে জলার পাখির ৷ হুইসলিং টিল বা সরাল তো অগুনতি ৷ লেজ উঁচিয়ে ল্যাপউইং এক্কা দোক্কা খেলেই চলেছে ৷ ক্যামেরার ছোট ফ্রেমের সাধ্য কি তাকে ধরে? বৃথা দৌড়োদৌড়িই সার ৷ বরং কোনও ঘাড় উঁচু প্রস্তরখণ্ডে মৌনী বাবা হয়ে বসে এদের লক্ষ করুন ৷ রঙের বৈচিত্রে নেশা ধরে যাবে ৷ সেলিম আলি সারাজীবন কেন যে এদের নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন তা খানিকটা অনুভূত হবে ৷
চারটে বাজতে না বাজতেই করবেটে সাজ সাজ রব পড়ে যায় ৷ একটার পর একটা গাড়ি করে পর্যটকের দল বেরিয়ে যাচ্ছে ৷ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০-৮০টা গাড়ি যায়, শনি-রবিবার সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে যায় ৷
অথচ জঙ্গলের ব্যাপ্তি ও ঘনত্ব এত গভীর যে সফর চলাকালীন আপনার সঙ্গে বিশেষ কারও দেখাই হবে না ৷ জঙ্গলের মধ্যে ঘোরার জন্য পাকা ও কাঁচা দুরকম রাস্তাই আছে ৷ রামগঙ্গা সরোবরকে এক পাক দিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলাম ৷ উন্মুক্ত আকাশের নিচে খোলা মাঠে অন্তত পাঁচশো হরিণের এক দল ৷ ঘন বাদামির ওপর হলুদ বুটিদার চাদর জড়ানো তাদের গায়ে, কাজল টানা গভীর দুচোখে অসীম সরলতা ৷ পুরুষের মাথায় অহংকারের ভারি মুকুট ৷ থেকে থেকে দাঁড়িয়ে আছে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ-মাটিতে রাগী পায়ের আছড়ানি, শিঙে শিঙে ঠকাঠক শব্দ ৷ পুরস্কার হিসেবে হয়তো বা পাওয়া যাবে কখনও তিলোত্তমা হরিণীর অনুগ্রহ যে এখন নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকায় ৷ একদল কোনও ঝুট ঝামেলায় না গিয়ে ঘাসের কার্পেটে শয্যা নিয়েছে, চর্বিত চর্বণ অবশ্য চলছেই ৷
একপাল হাতি হেলতে দুলতে এগিয়ে এল ৷ গাইড জানাল, আগে করবেটে হাতির সংখ্যা ছিল কম ৷ কালাগড়ে বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে ওঠায় ও রামগঙ্গা জলাশয় তৈরি হবার ফলে অরণ্যে জলের প্রাচুর্য বেড়েছে ৷ এরাও তাই অরণ্যের পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে গেছে ৷ এরা সর্বত্রই ঘুরে বেড়ায় তবে ধিকালার আশপাশেই এদের বেশি দেখা যায় ৷ তার কারণ হাতিরা স্নান করতে ও জলকেলি করতে খুব ভালোবাসে ৷ শুঁড়ে করে জল তুলে ফোয়ারার মতো ছিটিয়ে ধারাস্নান করা এদের প্রিয় খেলা ৷ আপনমনে ঘাস চিবোতে ব্যস্ত হাতির দলই খোঁচা খেলে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে ৷ সুতরাং এদের খুব কাছাকাছি না যাওয়াই ভালো ৷ সুদূর বরোদা থেকে আগত সঞ্জীব মেহেতা এদের আপাত নির্লিপ্ততাকে অনুধাবন করতে না পেরে ছবি তোলার জন্য একটু বেশিই কাছে চলে গিয়েছিলেন ৷ ফলে দাঁতাল হাতির হঠাৎ তেড়ে আসায় হতচকিত হয়ে তিনি পালাতে গিয়ে পাশের গাছেই মেরে দিলেন এক ধাক্কা ৷ ফলস্বরূপ তার নতুন গাড়িটির সম্মুখভাগ পুরো তুবড়ে ভেতরে চলে এল ৷ কোনওরকমে ইঞ্জিনটাই যা চালু রাখা যাচ্ছে ৷ বনবিভাগের কর্মীরা গিয়ে ভাঙা গাড়িসুদ্ধ আরোহীকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন ৷
তৃণভূমি ছেড়ে এবার বনভূমিতে প্রবেশ ৷ এতক্ষণের উন্মুক্ত আকাশ হঠাৎ পাতার আড়ালে মুখ লুকোল ৷ পাতার স্তর পেরিয়ে আলোর ক্ষীণ কয়েকটা রেখাই মাত্র ভেতরে প্রবেশ করতে পারে ৷ আলোআঁধারিতে ঘেরা এই রহস্যময়তাই অরণ্যভ্রমণের আসল মজা ৷ হয়তো চাক্ষুষ হবে না কিছুই কিন্তু আশা আর আশঙ্কায় দুলতে দুলতে উত্তেজনায় পিঠ টান করে বসতেই হবে আপনাকে ৷ তার ওপর গাইডের কেরামতি তো আছেই ৷ ধুলোমাটির ওপর কোনও পায়ের ছাপ দেখিয়ে বলবে ‘পাগমার্ক’ কিংবা কোনও দুলে ওঠা ঝোপ দেখিয়ে বলবে ‘শায়দ এহি থা’ আর আপনিও উৎকণ্ঠায় হৃৎপিণ্ড হাতে করে বসে থাকবেন ঠায় ৷ দ্রুতলয়ে বয়ে যাবে দু-চার ঘণ্টা ৷ গাছেদের মাথায় মাথায় কমলা রঙা রোদ্দুর ছড়িয়ে সূর্যদেব যখন পাড়ি দেন দিগন্তের ওপাড়ে, সফর শেষে যে যার ঘরে ফেরা ৷ অন্ধকারে ঝিকিয়ে ওঠে হরিণের চোখ-ঠিক জোনাকির মতো ৷
সকালের জঙ্গলের আবার অন্যরকম রূপ ৷ কুয়াশা ঢাকা ভোরে নির্জন অরণ্য বড় বেশি চুপচাপ ৷ পাতা খসার টুপটাপ আওয়াজও কানে আসে ৷ সারা রাতের ঘোরাঘুরির পর নিশাচরেরা সবেমাত্র ক্লান্ত শরীরে বিশ্রামে বসেছে ৷ উদ্বিগ্ন বিপন্নতার আরও একটি রাত কাটিয়ে তৃণভোজীর দল হয়তো বা এইমাত্র স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে জিরোতে গেছে ৷ পাখির দল শয্যা ত্যাগ করেনি ৷ অরণ্যের সঙ্গে গভীর মেলামেশার এটাই তো উপযুক্ত সময় ৷ খানিক পরে দূরের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে ঝুপ করে বেরিয়ে আসেন তরুণ তপন ৷ কচি সোনা রং গায়ে মেখে জঙ্গল তখন নিমেষে আনন্দ মুখর ৷ পাখি, হরিণ, হাতি, সম্বর, বরাহ, ঢোল সবাই মিলে যেন একইসঙ্গে জেগে ওঠে ৷ গোটাকয় ঢোল বা বুনো কুকুরকে একদল হরিণের পিছু নিতে দেখে গাইড জানাল, আজ তাদের হরিণের মাংস দিয়ে প্রাতরাশ সারার ইচ্ছে ৷ হরিণরা বাঘের চিন্তাতেই বড় বেশি ব্যস্ত থাকে বলে এই ঢোলদের শিকার করতে বিশেষ অসুবিধে হয় না ৷ তারা হরিণের সঙ্গে সঙ্গে একটু তফাত রেখে ঘুরতে ঘুরতে লক্ষ্যস্থির করে ফেলে ৷ তারপর চারপাশ দিয়ে তাকে ঘিরে ফেলে ৷ তাদের সাঁড়াশি আক্রমণে সহজেই বধ হয় হরিণ ৷
হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে জঙ্গল সফরের অভিজ্ঞতা আরেক ধরনের ৷ অরণ্যকে সরাসরি এফেঁাড় ওফেঁাড় করে ঝোপঝাড় আছড়ে চলে বাঘের সন্ধান পর্ব ৷ বাঘেদের আস্তানা অভিজ্ঞ মাহুতরা যত ভালো চেনে ততটা আর কেউ নয় ৷ ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাঘটিও সহজেই ধরা পড়ে যায় তার চিরুনিতল্লাশিতে ৷ হাতির পিঠে ভ্রমণকালে ডালের ঝাপটা থেকে হাতমুখ বাঁচাতে সব সময় সতর্ক থাকা উচিত ৷ হাতির সারাক্ষণ মুখ নাড়ার প্রবৃত্তি ৷ যা পাচ্ছে সামনে তাই ভেঙে নিয়ে চলেছে ৷ ঘাস বনে প্রচুর ভাং গাছ হয়েছে ৷ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম হস্তিসুন্দরী পাশের ঝোপঝাড় সাবাড় করলেও ভাং গাছগুলোকে ছুঁয়েও দেখছে না ৷
বনরাস্তা ছেড়ে এবার সটান সেঁদিয়ে গেলাম গহনে ৷ বন্য লতা আর বুনো ফুল দেখতে দেখতে হস্তিপৃষ্ঠে চড়াই ভাঙতে ভাঙতে চলেছি ৷ পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি ৷ শুকনো পাতায় হাতির পায়ের আওয়াজই নির্জন বনভূমিতে বড় বেশি কানে বাজছে ৷ আর একটু এগোতেই বাঁশ জাতীয় বৃক্ষের জমজমাট বসতি ৷ বাতাসে কেমন একটা থমথমে ভাব ৷ এগুলোই হচ্ছে বাঘের ‘ঠেক’ ৷ তবে দর্শন পাওয়া যাবে কিনা বলা ভারি শক্ত ৷
এক দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে ওয়াচটাওয়ারে গিয়ে বসেছি ৷ হঠাৎই আকাশ জুড়ে কালো মেঘের তাণ্ডব ৷ হুড়মুড়িয়ে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল ৷ ওয়াচটাওয়ারের ছাদ দিয়ে জল পড়ায় পুরো ভিজে গেছি ৷ রীতিমতো শীতে কাঁপছি ৷ এভাবেই চলল ঘণ্টা দুই ৷ ফেরার সময় আরেক মুশকিল ৷ কাঁচা মাটির রাস্তা ভেঙে তীব্র স্রোতে বইছে জলধারা ৷ শেষমেশ জুতো হাতে করে কাদামাটি মেখে ঘরে ফিরলাম ৷
নিকটবর্তী রেলস্টেশন রামনগর ৷ রামনগর সরাসরি পৌঁছনো যায় না ৷ মোরাদাবাদ হয়ে যেতে হয় ৷ মোরাদাবাদ থেকে রামনগর মাত্র আড়াই ঘণ্টা ৷ কলকাতা থেকে অমৃতসর মেলে মোরাদাবাদ আসুন ৷ সেখান থেকে জিপে কিংবা গাড়িতে কিংবা ট্রেনে রামনগর হয়ে ধিকালা ৷ মোরাদাবাদ থেকে রামনগর প্রায় দুশো কিলোমিটার ৷ রামনগর থেকে ধানগড়ি গেট ৫০ কিলোমিটার রাস্তা ৷ আমদান্ডা প্রবেশদ্বার দিয়ে করবেটে ঢুকলে দূরত্ব অনেকটা কম হবে ৷
নৈনিতাল কিংবা রানিখেত হয়েও করবেটে প্রবেশ করা যায় ৷ অনেকেই কুমায়ুন সফরকালে করবেটকেও জুড়ে নেন ৷ আগে থেকে বুকিং করা না থাকলে রামনগরে বনবিভাগের অফিস থেকে বুকিং করে নিতে পারেন ৷ জঙ্গলের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় থাকার ব্যবস্থা আছে ৷ যদি রাত্রিবাস করতে না পারেন তাহলে আমদান্ডা প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে বিজরানি পর্যন্ত ঘুরতে পারেন ৷ যদিও এটি দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর ব্যবস্থা ৷
ফরেস্ট বাংলো আছে ধিকালা, খিনানৌলি, সরাপদুলি, গৈরাল, বিজরানি, কান্দা ও সুলতানে ৷ এরমধ্যে ধিকালা ছাড়া অন্যগুলোতে রেস্তোরাঁ নেই ৷ রেশন নিজেদের আনতে হবে তবে রেস্টহাউসের কেয়ারটেকার রান্না করে দেবে ৷ ধিকালাতে কাবেরী রেস্তোরাঁতে সব ধরনেরই খাবার পাবেন-চাইনিজ, মোগলাই ইত্যাদি কিন্তু সবই নিরামিষ ৷ করবেটে প্রাণী ভোজন নিষিদ্ধ ৷ যদিও প্রাতরাশে ডিম পাওয়া যায় ৷
এছাড়া জঙ্গলের বাইরে বিলাসবহুল হোটেল আছে অনেক ৷ করবেট রিভারসাইড রিসর্ট, ক্লারিজেস হাইড অ্যাওয়ে, টাইগার টপস করবেট লজ, কোয়ালিটি ইন জাঙ্গল রিসর্টগুলি এককথায় চমৎকার ৷ কিন্তু অরণ্যে রাত্রিবাস না করতে পারলে আপনি করবেটের সৌন্দর্য সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন না ৷ কলকাতা থেকে ধিকালার বুকিং পাবার একমাত্র রাস্তা হাতে সময় নিয়ে সংলগ্ন ঠিকানায় চিঠি লেখা ৷ তারপর কনফার্মেশন পেলে টাকা পাঠাতে হয় ৷ লখনউ কিংবা রামনগরে কনফার্মেশন ঝালাই করে নেবেন ৷ অনেক সময় টাকা পাঠানোর পরেও কনফার্মেশন পাওয়া যায় না ৷ পোস্ট অফিসের ওপর দোষ পড়ে ৷ একবার বুকিং করে পরে যদি বুকিং বাতিল করেন তাহলে টাকা ফেরত পাবার সম্ভাবনা কম ৷
বনের মধ্যে ঘোরার জন্য ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কোনও গাড়ি নেই ৷ তাই নিজস্ব বাহন সঙ্গে রাখতে হবে ৷ সব থেকে ভালো উপায় হল কলকাতা থেকে ট্রেনে মোরাদাবাদ এসে গাড়ি ভাড়া করা ৷ বিমানে এলে পন্থনগর থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরের রামনগর থেকে গাড়ি ভাড়া করুন ৷ এখানে রেট বেশি বলে আপনি দিন হিসেবে ভাড়া নিতে পারেন ৷ রামনগর থেকে ভাড়া করলে ওরা করবেট যাতায়াতেই ১২০০-১৫০০ টাকা নেবে ৷ বনের মধ্যে ঘোরার জন্য আলাদা খরচ ৷ চেষ্টা করবেন আর্মাডা কিংবা জিপসি জাতীয় শক্তপোক্ত গাড়ি নিতে এবং সেটা যেন পেট্রোল কার হয় ৷ বনের মধ্যে ডিজেল গাড়ি নিষিদ্ধ ৷ পর্যাপ্ত তেল নিয়ে নেবেন ৷ ভেতরে কোনও পেট্রোল পাম্প নেই ৷
প্রয়োজনীয় ঠিকানা:
ফিল্ড ডিরেক্টর, প্রজেক্ট টাইগার
করবেট ন্যাশনাল পার্ক, রামনগর, নৈনিতাল-২৪৪ ৭১৫, উত্তরাঞ্চল
%(০৫৯৪৭) ৫১৪৮৯/৫১৩৬২/৫১৩৭৬
ডি এফ ও, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট, করবেট ন্যাশনাল পার্ক
রামনগর, নৈনিতাল-২৪৪ ৭১৫, উত্তরাঞ্চল
ভ্রমণ মার্চ, ২০০১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন