পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

এবছর জুন মাসের এক সন্ধ্যায় চড়ে বসলাম কালকা যাওয়ার ট্রেনে ৷ আমাদের অভিযানের লক্ষ্য স্পিতি উপত্যকার পারাংলা অতিক্রম করে লাদাখের স্বপ্নের হ্রদ সো মোরিরি ৷ এই অভিযানের উদ্যোগ ও আয়োজন শুরু হয় প্রায় আট-নয় মাস আগে ৷ উদ্যোক্তা হিমালয়ান গিল্ড ৷ মোট অভিযাত্রী নয়জন ৷ সাতজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা ৷ জুন মাসে কোনও ট্রেকার এর আগে এ পথে অভিযান করেননি ৷ উপরন্তু আমাদের সঙ্গে রয়েছেন দুইজন মহিলা ৷ যাঁরা এত উচ্চতায় (১৮,৩০০ ফুট) কখনও ওঠেননি ৷

আমাদের ট্রেন সিমলা পৌঁছতেই ছুটে গেলাম বাসের টিকিটের জন্য ৷ ম্যালের বাঁ-ধারে হিমাচল পর্যটনের অফিসের পাশেই টিকিট কাউন্টার ৷ এখান থেকেই কিন্নর ও স্পিতি যাওয়ার বাসগুলির টিকিট পাওয়া যায় ৷

পরদিন ভোরে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যেই চড়ে বসলাম রেকং পিও-র বাসে ৷ সিমলা থেকে দূরত্ব প্রায় ২৬১ কিলোমিটার ৷ বাসভাড়া ১২৫ টাকা ৷ নারকান্ডা, রামপুর, ওয়াংটু, টাপরি, করছাম হয়ে রেকং পিও পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল ৷ শহরের বাসস্ট্যান্ডের আশপাশেই রয়েছে কয়েকটি সাধারণ মানের হোটেল ৷ সেখানেই দুই রাত্রির বিশ্রাম ৷

ভোরবেলা কিন্নর-কিন্নরী দেখার আশায় বেরিয়ে পড়লাম স্বর্গের খুব কাছের শহর কল্পার পথে ৷ এখান থেকে কল্পার দূরত্ব মাত্র ১৩ কিলোমিটার ৷ জিপসি, মারুতি, জিপে মাথাপিছু ভাড়া ১০ টাকা ৷

শোনা যায়, যে সমস্ত অপ্সরারা দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভায় নাচের আসর মাতিয়ে রাখতেন, তাঁরা ছিলেন এই কিন্নর দেশেরই বাসিন্দা ৷ তাই স্থানীয় লোকেরা এখনও নিজেদের দেবতার প্রতিবেশী বলেই মনে করেন ৷

ছোট্ট পাহাড়ি শহর কল্পা ৷ একদা এই কল্পাই ছিল কিন্নরের জেলা সদর ৷ এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভোলার নয় ৷ সবুজ খেত ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে ৷ আর শতদ্রু নদীর অপর পারেই রয়েছে সাদা বরফে ঢাকা কিন্নর কৈলাস ৷ হঠাৎই চোখে পড়ল একটা সবুজ আপেল বাগানের মাঝে নানা রংবেরঙের কাগজ ও কাপড় দিয়ে সাজানো এক দোতলা বাড়ি ৷ দূর থেকে ভেসে আসছে হালকা মাদলের আওয়াজ ৷

সময় নষ্ট না করে ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছে গেলাম ওই বাড়ির দোরগোড়ায় ৷ সামনেই সাজানো রয়েছে সূক্ষ্ম কারুকার্য করা আখরোট কাঠের সোফা, খাট, আলমারি ও টেবিল ৷ এর সঙ্গে রয়েছে পেতলের বড় বড় ডেকচি, হাঁড়ি ও রান্নার নানা সরঞ্জাম ৷ আবার পাশেই রয়েছে কয়েকটা কুড়ুল ও কাস্তে ৷ পরে জেনেছিলাম এগুলি মেয়ের বাড়ির যৌতুক ৷ সামনের এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন আজ তাঁর বোনের বিয়ে ৷ কিন্নরী বিয়ের অনুষ্ঠান দেখা এবং ছবি তোলার লোভ সামলাতে না পেরে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করব বলে এগিয়েছি ৷ তার আগেই ভদ্রলোক তাঁর বোনকে ডেকে আনলেন দরজার সামনে এবং উভয়ে আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন ৷ সিঁড়ি বেয়ে আমরা উঠে এলাম অন্দরমহলের দোতলার একটা বড় ঘরে ৷ সেখানে প্রায় ১৫-২০ জন কিন্নরী একে অপরের হাত ধরে একটা গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচে চলেছে ৷ আমরাও যোগ দিলাম সেই আনন্দনৃত্যে ৷

বাড়ির লাগোয়া বাগানে শামিয়ানার তলায় চলছে রান্নার আয়োজন ৷ কোথাও বড় বড় ডেকচিতে বসেছে ভেড়ার মাংস, কোথাও ভাজা হচ্ছে পনির, আবার কোথাও বা কিন্নর-রমণীরা রুটি তৈরিতে ব্যস্ত ৷ সেখানে যাওয়া মাত্রই এক কিন্নরী একটা বড় কেটলি নিয়ে হাজির, আমাদের মাখন চা খাওয়াবে ৷

বাড়ির স্বল্প দূরে একটা সুন্দর গোলাকার মাঠের মধ্যে আবার নাচ শুরু হয় ৷ প্রথমে কনে ও কন্যাযাত্রীরা ও পরে বর ও বরযাত্রীরা এসে যোগ দেয় ওই দলে ৷ শুরু হয় নাচের প্রতিযোগিতা ৷ মিহি বাঁশির সুর ৷ কিন্নরীদের সুমিষ্ট সুর আর মাদলের তালে তালে নাচ সমস্ত আকাশ-বাতাসকে মুখর করে তোলে ৷ নাচের গতি ক্রমশ উদ্দাম হতে লাগল ৷

এর মধ্যেই ভোজনের নিমন্ত্রণ পেলাম ৷ আমরা না খেলে বিয়েবাড়ির অমঙ্গল ৷ স্ত্রী এবং পুরুষদের জন্য দুটি পৃথক ঘরে খাবার আয়োজন করা হয়েছে ৷ কুশাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গেই দুই হাস্যময়ী কিন্নরী এগিয়ে এলেন ৷ একজনের হাতে তোয়ালে, সাবান ও পিতলের জলের জগ, অপরজনের হাতে একটা সূক্ষ্ম কারুকার্য করা সোনালি রঙের পাত্র ৷ অতি যত্নসহকারে প্রত্যেক অতিথির হাত ধুইয়ে দিলেন ৷ এই ভোজনের প্রধান খাবার হল রুটি, ভাত আর ভেড়ার মাংসের ঝোল ৷ পুরুষদের জন্য আলাদা একটা উপকরণ আছে, নাম ছাং ৷ এটি একপ্রকার দেশি মদ ৷ ভোজনের শেষে অনুষ্ঠানে পৌঁছে দেখি তখন আশীর্বাদ ও যৌতুক প্রদানের পর্ব চলছে ৷ বরের ডানপাশে বসে রয়েছেন মা-বাবা ও ভাই এবং বাঁপাশে বসে আছেন কনে ও কনের বোন ৷ বাড়ির লাগোয়া বিশাল জায়গাটা যেন অপ্সরাদের ভিড়ে ঠাসা ৷

বেলা প্রায় শেষ, ফেরার পালা ৷ বিদায় জানাতে এগিয়ে এলেন কনের এক আত্মীয় ৷ ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে একটা ফাঁকা বাসে চড়ে রেকং পিও-র মূল বাসস্ট্যান্ডে ফিরে এলাম কাজা যাওয়ার বাসের আগাম টিকিট কাটব বলে ৷ কিন্তু টিকিটদাতা জানালেন, সিমলা থেকে রাতে ছেড়ে এখানে ভোররাতে পৌঁছনোর পর খালি সিট অনুযায়ী টিকিট দেওয়া হয় লাইনের মাধ্যমে ৷ তিনি আমাদের পরদিন ভোর পাঁচটা-ছটা নাগাদ ওখানে লাইন দেওয়ার উপদেশ দিলেন ৷

পরদিন টিকিট সংগ্রহ করে কাজার ভিড়-বাসে পাড়ি দিলাম ৷ শতদ্রু নদীকে ডানধারে রেখে হিন্দুস্থান টিবেট হাইওয়ে ধরে গাড়ি রুক্ষ্ম পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল ৷ পুহ (২,৮৩৭ মিটার) ছাড়িয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম শতদ্রু ও স্পিতি নদীর সঙ্গমস্থল খাব-এ ৷ এখান থেকে একটা পায়ে-হাঁটা পথ ভারত-তিব্বত সীমান্তে শিপকি-লার দিকে চলে গেছে ৷ কাংথাং-এ (৩,৮০০ মিটার) দুপুরের আহার সেরে ফেলি ৷ গাড়ি আবার চলতে থাকে ৷ সামদো থেকে মূল হাইওয়ে চলল কৌরিক সীমান্তে আর স্পিতি নদীকে অনুসরণ করে গাড়ি কাজার পথ ধরল ৷ এখানে ডানদিক থেকে পারে-চু নদী এসে মিশেছে স্পিতি নদীর সঙ্গে ৷ পথে পড়ে টাবো ও ডানকার নামে দুটি অতি প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ভা ৷ ১৫৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সন্ধে নাগাদ এসে পৌঁছলাম কাজায় (৩,৬০০ মিটার) ৷ আশ্রয় নিলাম বাসস্ট্যান্ডের গায়েই এক হোটেলে ৷

কাজা স্পিতির সদর শহর ৷ রুক্ষ পাহাড়ের মধ্যে বিশাল সবুজ খেত ৷ চোখ জুড়িয়ে যায় ৷ কাজায় বেশ কয়েকটা ভালো হোটেল আছে, বাজারটাও বড় ৷ মনোহারী দোকানগুলো দেখার মতো, আধুনিক উপকরণের প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায় ৷ পরদিন সকালে ইনারলাইন পারমিটের জন্য সাব ডিভিশনাল ম্যানেজারের অফিসে হাজির হলাম ৷ ছবি সহ প্রত্যেকের আবেদন তৈরিই ছিল ৷ আর ছিল পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং আই এম এফ-এর চিঠি ৷ কিন্তু তা সত্বেও সেখান থেকে আমাদের পাঠানো হল স্থানীয় থানায় ৷ পারমিট পেতে প্রায় চারটে বেজে গেল ৷

পরদিন ভোরে মালপত্র নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি, কোনও বাসের চিহ্ন নেই ৷ কাজা থেকে কিব্বের একদিন অন্তর বাস যায়, ওইদিন বাস যাওয়ার কথা ৷ অগত্যা দুটি জিপ নিয়ে কিব্বের রওনা দিলাম ৷ দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার, ভাড়া ৮০০ টাকা ৷ কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম স্পিতি নদীর ওপর একটা ব্রিজ ৷ ট্যাক্সিচালক জানাল, ওই পথ লোসার (৪,০৭৯ মিটার), কুনজুমলা (৪,৫৫১ মিটার), গ্রাম্ভু হয়ে চলে গেছে মানালি ৷ এই রাস্তা দিয়ে কেলংও যাওয়া যায় ৷ ৭ কিলোমিটার দূরে রয়েছে স্পিতি উপত্যকার বিখ্যাত গুম্ভা র্কি (৪,১১৬ মিটার) ৷ কিব্বেরের রাস্তা ছেড়ে ডানধারে প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার ওপরে এর অবস্থিতি ৷ ওপরে পৌঁছে দেখলাম নতুন একটা পূজাগৃহ তৈরি হচ্ছে ৷ একটা বড় লম্বা করিডোরের মধ্য দিয়ে হাজির হলাম মন্দির প্রাঙ্গণে ৷ বাঁ-ধারে তখন ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম’, ধ্বনির সঙ্গে ধর্মচক্র ঘুরে চলেছে ৷ এখানে এক অভিজ্ঞ লামা জানান, এই গুম্ভা প্রায় সাতশো বছরের পুরনো ৷ গুরু পদ্মসম্ভবের এক শিষ্য এই গুম্ভার প্রতিষ্ঠাতা ৷ এখন গুম্ভার প্রধান লামা মারা গেছেন নতুন প্রধান লামা হিসাবে পাঁচ-ছয় বছরের একটি শিশুর সন্ধান চলছে ৷ গুম্ভার ছাদ থেকে স্পিতি উপত্যকাকে অপরূপ লাগে ৷ চারধারে অজস্র রুক্ষ পাহাড় ৷ তাদের অধিকাংশই ঢেকে রয়েছে সাদা বরফে ৷ বিশাল রুক্ষতার মাঝে ছোট ছোট সবুজের ছোঁয়া ৷ বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ এসে পৌঁছই কিব্বেতে (১৪,৪৬০ ফুট) ৷ বাসরাস্তার ওপর ভারত তথা এশিয়ার সর্বোচ্চ গ্রাম ৷

বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ গাড়ি এসে পৌঁছল বাসরাস্তার শেষপ্রান্তে ৷ সামনেই একটা ধ্বংসপ্রায় চোর্তেন, তারই মাঝে ছোট একটা হলুদ বোর্ডে কালো কালি দিয়ে লেখা কিব্বের, উচ্চতা ১৪,৪৬০ ফুট ৷ আমরা পৌঁছলাম বাসরাস্তার ওপর অবস্থিত ভারতের তথা এশিয়ার সর্বোচ্চ গ্রামে ৷ এখান থেকে পুরো গ্রামটা লক্ষ করা যায় ৷ একটা অর্ধগোলাকৃতি রুক্ষ পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে দুই-তিনতলাবিশিষ্ট অনেকগুলি ঘরবাড়ি ৷ তার পিছনেই প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে বরফে ঢাকা পাহাড়ের সারি ৷ গ্রামের ঠিক অপরপারেই রয়েছে একটা বড় সবুজ খেত ৷ ঘন নীল আকাশের নিচে এই সবুজের ছোঁয়া কিব্বেরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে ৷ বর্তমানে এখানে বিদেশিদের আনাগোনার ফলে তিনটি হোটেল গড়ে উঠেছে ৷ বাসস্ট্যান্ডের সামনেই হিলটপ আর গ্রামের মাঝে রয়েছে পারাংলা গেস্টহাউস ও হোটেল রেইনবো ৷ শেষেরটিকেই আমাদের কদিনের বাসস্থান হিসাবে বেছে নিই ৷ ঘরভাড়া ১০০ টাকা ৷

পরদিন বেরিয়ে পড়লাম গ্রামটা ঘুরে দেখব বলে ৷ পাশেই কিব্বের সরকারি হাই স্কুল ৷ শিক্ষার মাধ্যম হিন্দি ৷ সেকেন্ডারি স্কুল ৷

হাজির হলাম কিব্বেরের স্কুল প্রাঙ্গণে ৷ তখন ছাত্রছাত্রীরা সবে প্রার্থনা সঙ্গীত শুরু করেছে ৷ সুর শুনে অবাক ৷ তারা গেয়ে চলেছে ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে………’ ৷ পরিচয় হয় স্কুলের শিক্ষক মদনজিৎ সিংয়ের সঙ্গে ৷ ইনি সমতলের লোক ৷ চাকরির খাতিরে এখানে এসেছেন ৷ তাঁর কাছেই জানা গেল, স্কুলের মোট ছাত্রের সংখ্যা ৩১ এবং ছাত্রীর সংখ্যা ২২ ৷ তিনি জানালেন যে শীতে সমস্ত গ্রামটা যখন বরফে ঢেকে থাকে, তখনও স্কুল খোলা থাকে, তবে ক্লাসঘরকে গরম রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয় ৷ এখানে শিক্ষার মাধ্যম হিন্দি ৷ গ্রামের উত্তরের প্রায় শেষপ্রান্তে উঁচু পাহাড়ের ঢালে রয়েছে আরেকটি প্রাথমিক স্কুল ৷

হোটেলেই পরিচয় হয় তেনজিং সেরিংয়ের সঙ্গে ৷ পেশীবহুল চেহারা, চোখে কালো চশমা, মাথায় খয়েরি রঙের টুপি ৷ সে একজন ঘোড়া ব্যবসায়ী এবং প্রায় বারো বছর ধরে সে ঘোড়া নিয়ে পারাংলা, রূপসু উপত্যকায় যাচ্ছে ৷ তাই পারাংলার পথ তার মুখস্থ ৷ তার পেশীবহুল চেহারা এবং সুন্দর হিন্দি বলার ভঙ্গিমা আমাদের মুগ্ধ করে এবং তখনই ঠিক করে ফেলি তেনজিং রাজি হলে আমরা তাকেই আমাদের গাইড হিসাবে সঙ্গে নেব ৷ মনের কথাটা তাকে জানাতে সে রাজি হল বটে, তবে পারাংলা গিরিবর্ত্ম পার করে সে আবার ফিরে আসবে, বাকি পথটা আমাদের গাইড হিসাবে কাজ করবে তারই খুব পরিচিত দুইজন মিউলম্যান ৷

পরদিন সকালে তেনজিংকে সঙ্গে নিয়ে চিচেম গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম ৷ গ্রামটা পশ্চিমপ্রান্তে ৷ পথ চলার ফাঁকে তেনজিংয়ের সঙ্গে নানা আলোচনা চলল ৷ বুঝতে পারলাম সে শুধু একজন ধনী ব্যবসায়ী নয়, শিক্ষিতও বটে ৷ তার কাছে জানতে পারি স্পিতিবাসীরা ধর্মে বৌদ্ধ ৷ তবে তাদের মধ্যে জাত-পাতের পার্থক্য আছে ৷ তাই এক জাতের সঙ্গে ভিন্ন জাতের বিবাহ সম্পর্ক গড়ে ওঠে না ৷ এছাড়া তাদের সমাজব্যবস্থায় একমাত্র বড়ছেলেই পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী হয় ৷ তাই ছেলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মা আলাদা হয়ে যান ৷ কেবল মেজছেলে তার সঙ্গে থাকতে পারে ৷ ছোটছেলেকে গুম্ভায় গিয়ে লামা হতে হয় ৷ পড়াশোনা ও খাওয়ানোর দায়দায়িত্ব গুম্ভার ৷ পুত্রহীন অবস্থায় যদি বড়ছেলে মারা যায় তখন মেজছেলেই ওই সম্পত্তির মালিক হয় ৷ আবার বাবা-মা-র মৃত্যু হলে সেই সম্পত্তি পায় বড় ছেলে ৷ এই প্রথার নাম খাং চেন ৷ পারিলুম্বি নালা পেরিয়ে একটা বিশাল চড়াই ভেঙে সবুজ খেতের মধ্য দিয়ে এসে পৌঁছলাম চিচেম গ্রামে ৷ কিব্বেরের সম-উচ্চতায় অবস্থিত একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ৷ এখানের লোকসংখ্যা প্রায় ৩০০ জন, তিনটি স্কুল আছে ৷

এই গ্রামের শেষপ্রান্তে তেনজিংয়ের বন্ধু লবসাং গিয়ালজেনের বাড়ি ৷ সেও একজন ঘোড়া ব্যবসায়ী এবং প্রতিবছর রূপসুতে ঘোড়া বিক্রি করতে যায় ৷ বর্তমানে সে খুবই দুঃখের মধ্যে আছে, কারণ তার দুই স্ত্রীর একজন মারা গেছে এবং অন্যজন তাকে ত্যাগ করেছে ৷ তেনজিং আমাদের সেখানে নিয়ে গেল ৷ তেনজিং জানাল যে, ওখান থেকে দুমলা গ্রাম হয়ে কিব্বের ফিরব ৷ জানতে হবে, কোনও চাংপার দল রূপসু থেকে ভেড়ার পাল নিয়ে পারাংলা পেরিয়ে এখানে এসেছে কিনা, যদি এসে থাকে, তবে জানব আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ৷ কারণ, কয়েকশো ভেড়া একসঙ্গে চলার ফলে বরফের ওপর একটা পথ তৈরি হয়, ফলে ট্রেকারদের কাছে ওই পথটা হয় অনেক সহজ ও মসৃণ ৷ দুমলায় কোনও চাংপা বা ভেড়ার দল চোখে পড়ল না ৷ কয়েকজন মহিলা খেতের কাজে ব্যস্ত ৷ কয়েকদিনের মধ্যে চাংপারা এখানে এসেছে বলে তাদের জানা নেই ৷ একটু দুশ্চিন্তা নিয়ে ফিরে এলাম কিব্বেরে ৷ সন্ধ্যায় তেনজিংয়ের বাড়িতে তিব্বতি নুন-চা খেলাম ৷ ইয়াকের দুধের মাখন ও নুন দিয়ে তৈরি এই চা-কে ছ্যাজা বলে ৷ ঠিক হল পাঁচটা গাধা (ভাড়া ১০০ টাকা প্রতিদিন) ও দুজন মিউলম্যান (পারিশ্রমিক ২২৫ টাকা প্রতিদিন) আমাদের মাল বয়ে নিয়ে যাবে, আর তেনজিং পারাংলা অবধি গাইডের কাজ করবে ৷

পরদিন ভোরবেলা শুরু হয় আমাদের মূল ট্রেকিং ৷ প্রথমদিন মালপত্র ঠিকমতো গুছিয়ে বের হতে প্রায় সাড়ে সাতটা হয়ে গেল ৷ কিব্বের গ্রামের সবুজ খেত পেরিয়ে একটানা উতরাই পথে নেমে এলাম পারিলুম্বি নালায় ৷ নুড়ি পাথরের দেওয়াল আর কাঠের পাটাতন বিছানো একটা নড়বড়ে ব্রিজ পেরিয়ে সোজা চড়াই পথে উঠতে লাগলাম ৷ বেশ কিছুটা চলার পর আবার উতরাই ৷ সামনেই সবুজ খেত ৷ জায়গাটার নাম দুমল, স্থানীয় ভাষায় একে বলে দুগরি অর্থাৎ গ্রীষ্মকালীন আবাস ৷ বিশাল খেতের আশপাশে তিন-চারটে বাড়ি ৷ তেনজিং জানায়, রূপসুতে যাওয়ার আগের রাতে তারা এখানে নাচ-গানের আসর বসায় ৷ কিছুক্ষণের বিশ্রাম ও দুপুরের আহার সেরে আবার হাঁটা শুরু করি ৷ থালডক অবধি সমস্তটাই প্রায় চড়াই ৷ একে প্রথমদিন, তার ওপর এই প্রচণ্ড চড়াই ৷ মহিলা অভিযাত্রী দুজন বেশ কাহিল হয়ে পড়েন ৷ ফলে থালডক পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে যায় ৷ থালডক একটা পাহাড়ি ঢালের মাঝে স্বল্প পরিসর সমতলভূমি ৷ এর বেশিরভাগটাই ছোট ছোট কাঁটা-ঝোপে ভরা ৷

দ্বিতীয়দিন খুব ভোরে আমরা থালডক (১৫,০০০ ফুট) থেকে পোরোচেনের (১৭,০০০ ফুট) উদ্দেশে রওনা হই ৷ কিছুটা চলার পর দুটো পাহাড়ের খাঁজে এসে পৌঁছলাম ৷ এখান থেকে পথটা ভীষণ খাড়াইভাবে নেমে গেছে পারিলুম্বি নালা পর্যন্ত ৷ তবে পথের চিহ্নমাত্র নেই, কারণ এখনও লোকের যাতায়াত শুরু হয়নি ৷ একটা সরু ঝরনার ধারাকে কখনও বাঁয়ে, কখনও বা ডাইনে রেখে খুব সাবধানে নিচে নামতে লাগলাম ৷ নামা আর নামা-প্রায় ১,০০০ ফুট নেমে এলাম ৷ পথটা পারিলুম্বি নালার বাঁ-তীর ধরে উত্তরে সোজা এগিয়ে গেছে ৷ কিছুটা যাওয়ার পর একটা সেতু ৷ কিন্তু তার অবস্থা খুবই সঙ্গীন ৷ যে-কোনও সময় ওই খরস্রোতা নদীতে ভেসে যেতে পারে ৷ কিন্তু উপায় নেই ৷ ওই সেতুই তখন আমাদের একমাত্র অবলম্বন ৷ ফলে ভয়ে ভয়ে একে একে সেতুর বাঁ-ধার ধরে নদীর অপর পারে এলাম ৷ এখান থেকে শুরু হল ছোট ছোট স্লেটপাথর আর ঝুরো মাটির প্রাণান্তকর রাস্তা ৷ মাঝে মাঝে রাস্তা এতই সরু যে একটা পায়ের পাতা রাখার জায়গা নেই ৷ তার ওপর ঝুরো মাটি ৷ পা হড়কালেই সোজা নদীতে ৷ এই কঠিন পথ পেরিয়ে যখন আমরা যুগথার তলায় এসে পৌঁছলাম তখন বেলা বেশ গড়িয়ে গেছে ৷ অগত্যা যুগথার নিচেই তাঁবু পাতা হল ৷

পরদিন সকালে তখনও অন্ধকার কাটেনি, ইন্দ্রদার চেঁচামেচিতে ঘুম থেকে উঠে দেখি তেনজিংয়ের তাঁবুটা জলে ভেসে গেছে, ভেতরের মালপত্রগুলো ধরাধরি করে বার করা হচ্ছে ৷ অবাক কাণ্ড ৷ পাহাড়ের গা দিয়ে এভাবে যে জল আসতে পারে, তা আমরা আগের দিন ভাবতেই পারিনি ৷ ভালোই হল ৷ তাড়াতাড়ি মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম ৷ পুরো পথটাই চড়াই এবং রূপসু যাওয়ার পথে এটাই দীর্ঘতম চড়াই ৷ ১৪,৩০০ থেকে উঠতে হবে ১৮,৩০০ ফুট পর্যন্ত একটানা ৷ বড় বড় বোল্ডার আর ছোট ছোট স্লেটপাথরের পথ পেরিয়ে প্রায় ঘণ্টা দু-আড়াই পরে এসে পৌঁছই যুগথায় (১৫,০০০ ফুট) ৷ এখান থেকে পথটা ডাইনে বেঁকে ধীরে ধীরে পোরোচেনের দিকে উঠে গেছে ৷ ঝুরো মাটি আর পাথরের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে থমকে দাঁড়ালাম ৷ পথ বন্ধ ৷ বিশাল গ্লেসিয়ার আমাদের পথ আটকে ৷ তেনজিংও অবাক হয়ে জানাল, আগে কখনও ওই জায়গায় এত বরফ দেখেনি ৷ ফলে আইস-এক্স দিয়ে বরফ কেটে রাস্তা করা হল ৷ এইভাবে কয়েকটা ছোট-বড় গ্লেসিয়ার ডিঙিয়ে, একটা বিশাল চড়াই পেরিয়ে পোরোচেনের মাঠে উঠে এলাম ৷ সূর্যের পড়ন্ত আলোর আভায় চারদিকের সোনালি পাহাড়গুলি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ৷ এই পোরোচেনেই (১৭,০০০ ফুট) আমরা তৃতীয় ক্যাম্প করি ৷

পরদিন ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ অল্প আলো-আঁধারির মধ্যে যাত্রা শুরু করলাম ৷ অবশ্য স্বপন তার স্ত্রী ও ইন্দ্রদার স্ত্রীকে নিয়ে আগেই রওনা দিয়েছে ৷ মাত্র ১৫ মিনিট হাঁটার পরই আমরা বরফের রাজ্যে ঢুকে পড়লাম ৷ তখনও রৌদ্রের আলো এসে পৌঁছায়নি ৷ ফলে প্রচণ্ড ঠান্ডা, তীব্র হাওয়া আর বরফের ফাটল এড়িয়ে পথ চলতে চলতে আমরা প্রায়ই ক্লান্ত হয়ে পড়তে লাগলাম ৷ মন্থর গতিতে চলতে চলতে যখন আমরা পারাংলা গিরিবর্ত্মের গোড়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, তখন সূর্যের প্রখর তাপ অনেক বেড়ে গেছে ৷ ফলে বরফও ভেতরে ভেতরে গলতে শুরু করেছে ৷ তেনজিং ও দুই মিউলম্যান পাঁচটা গাধা নিয়ে আগে আগে চলল, আমরা তাদের অনুসরণ করতে লাগলাম ৷

সামান্য চলার পরই দেখা গেল গাধারা আর এগোতে নারাজ ৷ যখন চলতে বাধ্য করা হল, তখন দেখা গেল গাধাগুলোর বুক অবধি বরফে ঢুকে যাচ্ছে ৷ তেনজিং জানাল, এই অবস্থায় মাল নিয়ে গাধা ওপরে উঠতে পারবে না ৷ সুতরাং গাধার পিঠ থেকে মাল নামিয়ে হালকা করা হল ৷ কিন্তু তাও গাধার পা বরফে গেঁথে যেতে লাগল ৷ বুঝতে পারলাম কাল সকালের আগে এই গাধাদের ওপরে তোলা যাবে না ৷ কিন্তু ওই জায়গাতে আমাদের থাকাও সম্ভব নয়, কারণ প্রথমত, জায়গাটা এতই ঢালু যে তাঁবু খাটানো সম্ভব নয়, দ্বিতীয়ত, চারধারে বরফ ৷ তেনজিংকে দুটি তাঁবু আর কিছু শুকনো খাবার পারাংলায় পৌঁছে দিতে বললাম এবং আমরা বরফ এড়িয়ে ঝুরঝুরে পাথরের পথ পেরিয়ে উঠে এলাম পারাংলার মাথায় ৷ চারধারে বরাফাচ্ছাদিত বিশাল বিশাল পাহাড়, তারা যেন আকাশকে স্পর্শ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে, ঘন নীল আকাশ, তারই মাঝে তুলোর মতো ভেসে চলেছে সাদা সাদা মেঘ, একদিকে রূপসু আর অপর দিকে বড়া শিগরি অঞ্চলের অসংখ্য পর্বতমালা ৷ পাশেই একটা চোর্তেন ৷ তার মাথায় ছোট ছোট কয়েকটা কাপড়ের পতাকা উড়ছে ৷ সবই সাদা রঙের ৷ মনে হয় গত বছরের স্পিতি ও পিন উপত্যকার লোকজনের সঙ্গে রূপসু ও চাংথাং উপত্যকার লোকজনদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক লেনদেনের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এই গিরিবর্ত্মকে কেন্দ্র করেই ৷ গ্রেট হিমালয়ান বিভাজিকার ওপর তাই পারাংলা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে ৷ ১৮,৩০০ ফুট উঁচু পারাংলার মাথায় রাত কাটাব বলে স্থির করি ৷ কারণ আমাদের গাইড, পোর্টার, মালপত্র সবই নিচে রয়ে গেছে ৷ তাছাড়া শেষবেলায় পারাংলার এই বিশাল তুষারক্ষেত্র পার হওয়া খুবই বিপজ্জনক ৷ বেলা বেড়ে চলেছে ৷ আলো থাকতে থাকতেই তাঁবু খাটানো দরকার ৷ চারধার ছোট-বড় উঁচু-নিচু পাথরে ভর্তি ৷ কোথাও এক টুকরো সমতল জায়গা চোখে পড়ল না ৷ অগত্যা আমরা চোর্তেনের উত্তরপ্রান্তে পাহাড়ের ঢালে এবড়ো-খেবড়ো পাথরের ওপর তাঁবু টাঙাতে শুরু করলাম ৷ কিন্তু তীব্র হাওয়ায় তাঁবু খাটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল ৷ ইন্দ্রদা একজন অভিজ্ঞ পর্বতারোহী ৷ তাঁর উপদেশমতো কয়েকজন অভিযাত্রীকে তাঁবুর ভেতর ঢোকানো হল আর আমরা কয়েকজন বাইরে থেকে তাঁবুর পোলের দড়িগুলোকে বড় বড় পাথরে বেঁধে কোনওরকমে তাঁবুকে দাঁড় করালাম ৷ এবার প্রয়োজন হল জলের ৷ কিছুক্ষণ আগে ইন্দ্রদা গিরিবর্ত্মের পশ্চিমপ্রান্তে একটা সরু জলের ধারা দেখে এসেছেন ৷ ছুটলাম সেখানে ৷ কিন্তু সেই জল তখন বরফের রূপ নিয়েছে ৷ বরফ গলিয়েও জল করা যায় ৷ কিন্তু স্টোভ তো নিচে রয়ে গেছে ৷ হঠাৎ দেখি ইন্দ্রদা একটা খুবই ছোট গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে হাজির ৷ তিনি জানালেন, হঠাৎ প্রয়োজনের জন্য এটা তাঁর রুকস্যাকেই রাখা ছিল ৷ ওই গ্যাস জ্বালিয়েই বরফ গলিয়ে পেলাম জল, তৈরি হল চিকেন স্যুপ ৷ তাঁবুর বাইরে তখন প্রচণ্ড ঠান্ডা, সূর্য অস্তগামী ৷ কানাংমো পাহাড়ের চূড়ায় পড়েছে সূর্যাস্তের রক্তিমচ্ছটা ৷ সামনের বিশাল তুষারক্ষেত্রটার শুভ্রতা রাঙা আভা ঢেকে ফেলেছে ৷

রাতে একটা সমস্যা দেখা দিল ৷ একটা চারজনের তাঁবুতে সাতজন ঢুকে পড়েছে ৷ বাকি দুজনের জায়গা ভেতরে কিছুতেই হচ্ছে না ৷ ইন্দ্রদা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বাইরেই রাত কাটাবার প্রস্তাব দেন ৷ এতে আমরা অনেকেই বেঁকে বসি ৷ কিন্তু তাঁর অসীম সাহস আর দুর্জয় মানসিকতার কাছে আমরা হার মানি ৷ অর্ধেক উঁচু-নিচু পাথর আর অর্ধেক বরফের ওপর ম্যাট্রেস পেতে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে পড়েন প্রচণ্ড ঠান্ডা ও তীব্র হাওয়ার মধ্যেই ফাঁকা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে দেন ৷ সকালবেলা উঠে দেখি ইন্দ্রদারা তখনও ঘুমিয়ে রয়েছেন আর তাঁদের স্লিপিং ব্যাগ দুটো ঢেকে রয়েছে সাদা হালকা বরফে ৷ মালপত্র গুছিয়ে আমরা তেনজিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম ৷ খুব ভোরে গাধাদের নিয়ে তার এখানে পৌঁছনোর কথা ৷ কিছুক্ষণ পর দেখি তারা তিনজনে গাধাদের নিয়ে উঠে আসছে ৷ কিন্তু গাধার পিঠে কোনও মাল নেই ৷ ব্যাপার কী? তেনজিং জানাল, প্রচুর বরফের মধ্যে গাধারা মাল নিয়ে চড়াইয়ে উঠতে পারছে না ৷ তাই মালপত্র সব নিচেই ফেলে এসেছে ৷ পরে ফেরি করে ওগুলো ওপরে তুলবে ৷ আর ওখানে আমাদের থাকা সম্ভব নয় ৷ ফলে তার সঙ্গে কথা হয়, আমরা আজ পারাংলা অতিক্রম করে নিচে নেমে কাছাকাছি কোথাও অপেক্ষা করব ৷ আর তেনজিংরা আগামীকাল ভোরে গাধা ও মালপত্র নিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছবে ৷

বরফের ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম ৷ কিছুদূর যাওয়ার পরই পিছনের স্পিতি উপত্যকা অদৃশ্য হয়ে গেল ৷ চারধারে শুধু বরফ আর বরফ ৷ কোথাও বরফের শক্ত আস্তরণ, আবার কোথাও বরফ এতই নরম যে হাঁটু পর্যন্ত পা ঢুকে যাচ্ছে ৷ হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল, চাপা পড়ে গেল চারধারের অনুপম সৌন্দর্য, শুরু হল তুষারপাত, ঠান্ডাও বেড়ে গেল কিন্তু হাঁটার গতি বাড়াবার উপায় নেই ৷ কারণ পথে রয়েছে বেশ কিছু বরফের ফাটল ৷ অবশেষে বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ চার কিলোমিটার লম্বা এই হিমবাহকে পেরিয়ে আমরা পারে চু নদীর উৎসমুখে নেমে এলাম ৷ এখানেই আমাদের পঞ্চম রাত্রিবাস ৷

পরদিন সকালে তেনজিং গাধাদের নিয়ে হাজির ৷ সঙ্গে মালপত্র ৷ এখান থেকে সে আমাদের বিদায় জানিয়ে ফিরে চলল কিব্বের গ্রামের উদ্দেশে ৷ এখন থেকে একজন মিউলম্যান, ছোট তেনজিং আমাদের গাইড হিসাবে পথ দেখাবে ৷

পারে চু নদী পেরিয়ে তার বাঁ-তীর ধরে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে ৷ কিছুটা চলার পর পারে চু উপত্যকার বিস্তৃতি বাড়তে লাগল ৷ এই নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছই খারসা কোংমায় ৷ অল্প নরম ঘাসে ঢাকা একটা বড় মাঠ ৷ এখান থেকেই আবার নদী পার হতে হল ৷ নদী এখানে অজস্র ধারায় বিভক্ত হয়ে বয়ে চলেছে ৷ তুষারশীতল জলের দশ-বারোটা ধারা পেরিয়ে আমরা উঠে এলাম নদীর অপর পাড়ে ৷ এখান থেকে পারে চু উপত্যকা ডান ধারে বাঁক নিয়েছে ৷ সমস্ত পথটাই প্রায় সমতল ৷ চারধারের রুক্ষ পাহাড়ের বিচিত্র রূপ দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছই দাটাং ইয়োংমাতে ৷ উচ্চতা ১৬,৫০০ ফুট ৷

পরদিন জুনিপারে ছাওয়া একটা বিশাল মাঠ পেরিয়ে পারে চু নদীর মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকি ৷ এখান থেকে নদীর বাঁদিক দিয়ে তাকলিংলা যাওয়ার পথ আছে ৷ নদীর ডান তীর ধরে চলতে চলতে এক জায়গায় থমকে দাঁড়ালাম ৷ দেখি অসংখ্য মাটি ও দানাপাথরের স্তম্ভ দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ গাইড জানাল, জায়গাটার নাম খটপা ভৌজে ৷ এর মানে পোকায় খাওয়া জায়গা ৷ নদী থেকে কিছুটা ওপরে পাহাড়ের ঢালে একটা সুন্দর ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড ৷ ফালোং পড়াং ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে কিছুটা আগে ৷ ওখানেই রাতটা কাটাব ঠিক করি ৷

আজকের লক্ষ্য নরবো সুমদো ৷ পথটা নদীবক্ষ ধরেই এগিয়ে গেছে ৷ কিন্তু নদীতে প্রচুর জল ৷ ফলে ডান তীরের পাহাড়ি ঢালের সরু বিপজ্জনক পথটাই বেছে নিতে হয় ৷ কয়েকটা ছোট ছোট চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নদীবক্ষের জলকাদা ভেঙে আমরা এসে পৌঁছলাম নরবো সুমদোর অপর পারে ৷ এখান থেকে নরবো-সুমদো পর্যন্ত পারে চু নদী প্রায় দেড় কিলোমিটার চওড়া এবং অসংখ্য ধারায় বিভক্ত ৷ এর মধ্যে মূলধারা চারটি ৷ প্রথমে গাইড ও তার সঙ্গী গাধাদের নিয়ে জলে নেমে পড়ল ৷ দূর থেকেই দেখে বুঝলাম প্রচণ্ড জলের গতি ৷ একেক সময় জল গাধাদের বুক অবধি উঠে পড়ছে ৷ ভয় হচ্ছে, এই বুঝি ভেসে যাবে ৷ ছোট তেনজিংরা ফিরে এল ওপারে গাধাদের রেখে ৷ এবার আমাদের পালা ৷ আমাদের চার অভিযাত্রী এখনও এসে পৌঁছয়নি ৷ অগত্যা আমরা পাঁচজনই তেনজিংদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে জলে নেমে পড়লাম ৷ তুষারশীতল জলে পা দুটো সঙ্গে সঙ্গে অসাড় হয়ে গেল ৷ দুটি স্রোত পার হয়ে, তৃতীয় স্রোতের মাঝে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম এখানে নদী ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে ৷ যতই এগোই জল ততই বাড়তে থাকে ৷ এক সময় সেই জল প্রায় কোমরে পৌঁছে গেল ৷ আর সেই সঙ্গে জলের প্রবল গতি ৷ এক পা এগোচ্ছি তো দুপা পিছোচ্ছি ৷ একেক সময় মনে হচ্ছে পারে চুর ধারার সঙ্গেই হারিয়ে যাব ৷ এইভাবে আরও দুটো কঠিন স্রোতের ধারা পেরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এলাম নদীর অপর পারে ৷ অপর চার সঙ্গীও তেনজিংয়ের সাহায্যে নদীর এপারে এসে পৌঁছল ৷ কিছুক্ষণের বিশ্রাম ৷ উঠে এলাম নরবো সুমদোর উঁচু সমতলভূমিতে ৷ একটা পাথরের দেওয়াল দেওয়া ভাঙা ঘর ৷ তেনজিং জানাল, নরবো সুমদো নদী প্রাচীন কালে লাদাখ এবং স্পিতি রাজ্যের সীমানা ছিল ৷ তাই লাদাখরাজ সেনজে নামগিয়াল দক্ষিণের শেষপ্রান্তে এই প্রহরী চৌকি নির্মাণ করেন ৷ নরবো সুমদোয় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম ৷ এখানে কঠিন পাথর আর রুক্ষতার ছোঁয়া নেই ৷ আছে সবুজ ঘাসে ঢাকা এক বিরাট প্রান্তর, একটা বিশাল জলাভূমি ৷

কিছুটা চলার পর নন্দিতা বৌদির কথায় আজকের মতো চলার ইতি ঘোষণা করতে হল ৷ সামনেই চাংপাদের কয়েকটা তাঁবু ৷ তেনজিংকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম চাংপাদের আড্ডায় ৷ কয়েকজন চাংপা তখন ভেড়ার লোম কাটতে ব্যস্ত ৷ হাতে তাদের কাঁচির মতো একটা অস্ত্র ৷ ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে ওই অস্ত্র দিয়ে তারা একেকটা ভেড়ার লোমের ওপরের আস্তরণ কেটে ফেলছে ৷ দেখলে মনে হয়, ভেড়ার গা থেকে একটা পশমের কোট খোলা হচ্ছে ৷ তেনজিং জানাল, এগুলো পশমিনা ৷ খুব দামি ৷ চাংপারা লোমগুলো বস্তায় পুরে পাঠিয়ে দেয় করজোক গ্রামে ৷ সেখান থেকে যায় শ্রীনগরে ৷ আবার কখনও কখনও ভেড়ার দল নিয়ে এরা কিব্বের বা কাজায় যায় ৷ সেখানে লোম বিক্রি করে পরিবর্তে নানা উপকরণ সঙ্গে নিয়ে আসে ৷ তাঁবুতে ফিরে ক্যামেরা গোছগাছ করছি হঠাৎ দেখি এক চাংপা মহিলা, সঙ্গে দুই ছোট ছোট মেয়েকে নিয়ে আমাদের তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে ৷ রমণীর হাতে একটা বড় লাদাখি কেটলি, দুজনের হাতে দুটো থালা ৷ মহিলার কথা বুঝতে না পেরে আমরা তেনজিংয়ের শরণাপন্ন হলাম ৷ তেনজিং জানাল, এই মাঠে চাংপাদের কাছে আজ আমরা অতিথি ৷ তাই ওরা এসেছে আমাদের চা খাওয়াতে ৷ সঙ্গে এনেছে একথালা পনির, যবের ছাতু ও এক বোতল দুধের ঘোল ৷ তাদের সহজ সরল ব্যবহার এবং অকৃত্রিম আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম ৷

পরদিন চাংপাদের বিদায় জানিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যখন এগিয়ে চলেছি, পাহাড়ের গায়ে কয়েকটা খরগোশ আমাদের দেখে গর্তে ঢুকে পড়ল ৷ বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সবুজ জলাভূমি ছেড়ে এসে পৌঁছই এক বিশাল রুক্ষ প্রান্তরে ৷ এখান থেকেই রূপসুর মূল উপত্যকা শুরু ৷ জম্মু-কাশ্মীরের লাদাখ জেলার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এই রূপসু কিছুদিন আগে পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে অজ্ঞাত ছিল ৷ কারণ ১৯৯৫ সালের আগে ওখানে সাধারণ ভ্রমণার্থী বা ট্রেকারের প্রবেশের অধিকার ছিল না ৷ প্রবেশের জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রকের অনুমতি লাগত ৷ ফলে রূপসুর অনিন্দ্যসুন্দর রূপের কথা এখনও অনেকের অজানা ৷ এই উপত্যকায় প্রবেশের বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় পথ আছে, উত্তরে তাংলাংলা হয়ে লে উপত্যকা ও মাহে উপত্যকার নাম সাংলা, পূর্বে লেনাক লা, পশ্চিমে লাচুংলা ও লানিয়ের লা এবং দক্ষিণে পারাংলা ও তাকলিংলা ৷ আমরা পারাংলার পথেই এখানে এসে পৌঁছেছি ৷ ফিরসে ফু নদীর অসংখ্য ধারাকে পার হয়ে সবুজ ঘাসের জলাভূমির ওপর দ্রুত এগিয়ে চললাম একটা অজানা আকর্ষণে ৷ কয়েক পা হাঁটার পরই মাথা তুলে দেখি আস্তে আস্তে সো মোরিরির নীলরেখাটা ঘন ও মোটা হতে লাগল ৷ অবশেষে এসে পৌঁছলাম গল্পে শোনা, স্বপ্নে দেখা সো মোরিরির তীরে ৷ সরোবর নয়নাভিরাম দৃশ্য ৷ রুক্ষ পাহাড়ে ঘেরা বিশাল সরোবরকে সাগর বলেই ভ্রম হয় ৷ নীল আকাশ ৷ তার মাঝে ছোট ছোট মেঘের আনাগোনা ৷ নিচে সো মোরিরির বিশাল জলরাশির তুঁতে রং সূর্যের আলোয় এবং মেঘের ছায়ায় কখনও হালকা কখনও গাঢ় হচ্ছে ৷ বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরের নরম সবুজ ঘাসের ওপর ৷ দূরে মনের আনন্দে ভেসে চলেছে সারি সারি হাঁসের দল ৷ হঠাৎই অচেনা লোকজন দেখে যাযাবর পাখির দল সরোবরের তীর থেকে পাড়ি দিল অনেক দূরে ৷

আস্তে আস্তে সূর্য পশ্চিম প্রান্তে ঢলে পড়ল ৷ আর জলের অপার্থিব রং-পরিবর্তন ৷ সত্যি এ যেন এক স্বপ্নের দৃশ্য ৷ এখান থেকে ঘণ্টাদেড়েক হেঁটে সরোবরের একটা বাঁকে আমরা সেদিনের জন্য তাঁবু খাটাই ৷ এখান থেকে সূর্যাস্তের যে রূপ দেখেছি, তা প্রকাশের কোনও ভাষা নেই ৷

রূপসুর প্রধান আকর্ষণ এই সো মোরিরি ৷ ১৫,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই সরোবর উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৫ থেকে ১২ কিলোমিটার চওড়া ৷ এই লেকের চারধারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা পর্বত ৷ পূর্বে থালদা কুরমি (২১,৮৭০ ফুট), পশ্চিমে মাতা (২০,৮০০ ফুট) ও একটি অনামা শৃঙ্গ, উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে রূপসু আইসক্যাম্প ৷ হিমালয়ের কোলে অতি উচ্চতায় অবস্থিত লেকগুলির মধ্যে সো মোরিরি ভারতের সর্বোচ্চ হ্রদ ৷ এই উপত্যকার তাপমাত্রার পরিসংখ্যান বড় বিচিত্র ৷ শীতে সমস্ত জায়গাই ঢেকে যায় কঠিন বরফে ৷ তখন তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের অনেক নিচে ৷ গ্রীষ্মে, মাত্র তিন-চার মাস এই মরুপ্রকৃতির তাপমাত্রা দিনেরবেলায় ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ৷ আবার রাতে কমতে করতে কখনও নেমে যায় শূন্যের নিচে ৷

পরদিন সো মোরিরির রূপ আবার ভিন্ন ৷ ভোরের সূর্যোদয়ের হালকা আলো এসে পড়েছে সরোবরের জলে ৷ জলের স্বচ্ছতা এত বেশি যে, জলের গভীরে থাকা নুড়িগুলোও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ৷ সরোবরের পশ্চিম তীর ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি সরোবরের রং পাল্টে গেছে ৷ হালকা তুঁতে রঙের জলরাশি নীল রঙে রূপান্তরিত হয়েছে ৷ সূর্যের প্রখরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই নীল গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগল ৷ সরোবরের অপর পারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাম না-জানা অসংখ্য পর্বতশ্রেণী ৷ তারই মাথায় ঘন নীল আকাশের বুকে তুলোর মতো ভেসে চলেছে অজস্র সাদা মেঘের রাশি ৷ দূরে একধারে গিয়া অপর ধারে মাতা শৃঙ্গ ৷ পথে পড়ে পাথরের ওপর পাথর চড়ানো কিছু উঁচু ঢিবি ৷ প্রত্যেকটা পাথরের গায়ে লেখা রয়েছে বুদ্ধের নানা বাণী ৷ এগুলোও একধরনের চোর্তেন ৷ দুপুর দুটো-আড়াইটে নাগাদ কোরজোক গ্রামে পৌঁছে অবাক হয়ে গেলাম ৷ সমস্ত গ্রামটা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ৷ সমস্ত ঘরবাড়ি বন্ধ, কোনও লোকজনের দেখা নেই ৷ হঠাৎ এক লামাকে দেখে জিজ্ঞাসা করি, ব্যাপার কী ৷ তিনি জানান, নিয়মায় উৎসব চলছে ৷ স্বয়ং দলাই লামা সেখানে এসেছেন ৷ তাই গ্রামের লোকেরা তাঁর বাণী শুনতে সেখানে গেছে ৷ ফিরবে কয়েকদিন পরে ৷ কোরজোকে পৌঁছে স্কুলবাড়ি ও তার সংলগ্ন লনে আমরা আশ্রয় নিই ৷ সো মোরিরির কোলে অবস্থিত এই কোরজোক গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই মনোরম ৷ এটি চাংপাদের শীতকালীন আবাস ৷ গ্রাম থেকে বার্লি ও যবের একটা বিশাল সবুজ খেত নেমে গেছে সরোবর অবধি ৷ পাহাড়ের ঢালে একটু উঁচুতে একটা গুম্ভা ৷ তার আশপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কতকগুলো একতলা-দোতলা বাড়ি ৷ গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে সরোবরের কোল ঘেঁসে আরও একটা নতুন গুম্ভা তৈরি হচ্ছে ৷ সরোবরের একেবারে তীরে একটা সরকারি বিশ্রামাগারও তৈরি হয়েছে ৷ আমরা জানতাম, চাল-ডাল ও কিছু কাঁচা তরিতরকারি এই গ্রামে পাওয়া যায় ৷ তবে দামটা একটু বেশি ৷ আমাদের আনা রসদ চাল-ডাল-আটা শেষ ৷ কারণ তেনজিং আমাদের না জানিয়েই পাসের মাথায় থাকাকালীন চাল-ডাল গাধাদের খাইয়েছে ৷ দোকানগুলোও বন্ধ ৷ ফলে আমরা খুবই অসহায় হয়ে পড়লাম ৷ সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে আমাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন প্যারা মিলিটারি ফোর্সের প্রধান নামগিয়াল ৷ স্কুলবাড়ির পাশেই তাঁর অস্থায়ী তাঁবু ৷ রাতে তিনি আমাদের একটা ভালোই ভূরিভোজের ব্যবস্থা করলেন ৷ পরদিনও তিনি আমাদের প্রাতঃভোজনের ব্যবস্থা করেন ৷ চালের খোঁজে গুম্ভার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছি, এমন সময় পরিচয় হয় কোরজোকের স্কুলের এক শিক্ষকের সঙ্গে ৷ তিনিই কয়েকজনের ঘর থেকে চাল সংগ্রহ করে আমাদের কাছে পৌঁছে দেন ৷

৪ ও ৫ জুলাই হেমিস উৎসব ৷ ৪ জুলাইয়ের অর্ধেক দিন প্রায় কেটে গেছে ৷ বাকি আছে কালকের দিনটা ৷ আজ লে পৌঁছতেই হবে ৷ কিন্তু তখনও কোনও গাড়ির চিহ্ন নেই ৷ আশা প্রায় যখন ছেড়ে দিয়েছি, হঠাৎ একটা ট্রাক এসে হাজির ৷ ট্রাক মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, সঙ্গের মালপত্র নামিয়েই সে আজই আবার ফিরে যাবে লে ৷ তাকে অনুরোধ করতে সে আমাদের পৌঁছে দেবার আশ্বাস দেয় ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রাকে চড়ে রওনা দিই লে-র পথে ৷ রাত ১১টার সময় লে পৌঁছে আশ্রয় নিই ওল্ড লে রোডের ওপর একটা সুন্দর হোটেলে ৷

ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন