অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
বহু বছর পূর্বের এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা আজ লিপিবদ্ধ করছি ৷ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ভূগোলের অধ্যাপক আমাদের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন উত্তর বাংলার ভুটান সীমান্তে অবস্থিত কয়েকটি বিশেষ জায়গা দেখার জন্য ৷ তাঁরা জানিয়েছিলেন ১০ দিনের মধ্যেই এমন কয়েকটি স্থান নাকি দেখা যাবে যা অন্য কোথাও পাওয়া দুর্লভ ৷ এরমধ্যে জয়ন্তীর চুনাপাথরের গুহাগুলি নাকি অদ্ভুত ও ভৌগোলিক দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ৷ তবে উত্তর বাংলার কোনও স্থানেই বর্ষাকালে ভ্রমণ করা দুঃসাধ্য, তাই আমাদের এপ্রিল-মে মাসেই বিশেষভাবে যেতে বলেন ৷
কিন্তু এপ্রিল মাসে হল না-বর্ষা এসে যাওয়ায় ও অনেকদিন স্থায়ী হওয়াতে ৷ গতবছর পুজোর সময়ও যাওয়া হল না ৷ সুতরাং ডিসেম্বর মাসে যেভাবেই হোক যেতেই হবে-এই বলে রওনা দেওয়া গেল ৷ কথা হল, জয়ন্তী ভুটানের পারো ও থিম্পু এবং সময় হলে গারো পাহাড়ের তুরা এইসব অঞ্চলে যাওয়া হবে ৷
জয়ন্তী জলপাইগুড়ি-ভুটান সীমান্তে একটি স্থান, জয়ন্তী নামে ছোট একটি নদীর ধারে অবস্থিত ভারত সীমান্তের সর্বশেষ স্টেশন ৷ এই জয়ন্তী নদী ভুটানের পার্বত্য অঞ্চল থেকে এসে তোর্সার একটি উপনদী শির তোর্সাতে মিশেছে ৷ ছোট নদী হলে কী হয়, এর প্রতাপ অনেকখানি ৷ জয়ন্তী স্টেশনে যেতে হলে আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়া, বক্সার দুর্গ প্রভৃতি স্টেশন পার হয়ে যেতে হয় ৷ আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে সকালে ও বিকেলে ১টি করে ছোট লাইনের ট্রেন অরণ্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলে গেছে ৷ চুনাপাথর ও অন্যান্য প্রস্তর খণ্ডের জন্য কয়েকটি কোম্পানি জয়ন্তীতে আছে, বনাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের কাষ্ঠ ছেদনের জন্যই এই স্টেশনের গুরুত্ব ৷ স্থানীয় ভুটিয়া অধিবাসী ও রেলের লোকজন ছাড়া স্থানীয় বসতি অতি কম ৷ তবে স্থানটি অতি সুন্দর বলে আলিপুরদুয়ার থেকে বড়দিনে ও নববর্ষে বেশকিছু লোক সমাগম হয়ে থাকে পিকনিক ও বেড়াবার উদ্দেশে ৷
যাই হোক, শিলিগুড়িতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গিয়ে জানলাম, অধ্যাপকরা সকলেই প্রায় বিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দেবার জন্য চলে গেছেন ৷ তবে জয়ন্তীতে চুনাপাথরের ব্যবসায়ীদের ওখানে থাকবার ব্যবস্থা করে গেছেন ৷ অবশ্য নিউ জলপাইগুড়িতে আসবার সময় একজন রেল কর্মচারীর সঙ্গে আলাপ হওয়াতে তিনিও স্থানীয় রেল কর্মচারীদের উদ্দেশে একটি পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন ৷ আমি ও আমার বান্ধবী, দুজনেই যা থাকে কপালে বলে রওনা দিলাম ৷ প্রথমে বাসে শিলিগুড়ি থেকে মাল ও নিউ মাল স্টেশনে গেলাম ৷ জলপাইগুড়ি ও উত্তর বাংলায় এখন ‘নিউ’ বা নয়া স্টেশনের ছড়াছড়ি ৷ সমস্ত উত্তরবঙ্গের পরিবহন ব্যবস্থা এখন নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে ৷ মাল ও নিউ মাল স্টেশনগুলি সমস্ত অরণ্যের মধ্য দিয়ে, খেতের মধ্য দিয়ে, চা-বাগানের মধ্য দিয়ে চলে গেছে ৷ আলিপুরদুয়ারে সন্ধ্যাবেলা পৌঁছলাম ৷ রাত ৮টায় জয়ন্তীর ট্রেন ছাড়বে, সুতরাং ওইখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে ট্রেনে চড়লাম ৷ জয়ন্তীর যাত্রীসংখ্যা খুবই কম, মাল বহনের জন্য এই গাড়িগুলি প্রধানত ব্যবহৃত হয় ৷ পথেই শুনলাম, রাজাভাতখাওয়াতে একটি বাঘ গ্রামবাসীদের গরু, ছাগল মারতে শুরু করেছে এবং ভূতপূর্ব আই সি এস সত্যেন্দ্রনাথ রায় তাঁর কন্যা সহ সেদিন বাঘ মারার জন্য মাচা বেঁধে আছেন ৷ পরে জেনেছি বাঘটি গুলিবিদ্ধ হয়ে মরেছে ৷
রাত ৯টা নাগাদ জয়ন্তীতে এসে পৌঁছলাম ৷ গাড়ি এসেছে বনের মধ্য দিয়ে, চারদিক অন্ধকার ছিল ৷ স্টেশনও তদ্রূপ অন্ধকারাচ্ছন্ন ৷ স্টেশন মাস্টার একটি হ্যারিকেন নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন ৷ স্থানীয় কয়েকজন নেমে তো তাঁদের বাড়ির উদ্দেশে চলে গেলেন-আমরা কোথায় যাব? সেই রেল ইনস্পেক্টর যে পরিচিতিপত্রখানি দিয়েছিলেন তা নোটবই-এর মধ্যে ছিল এবং কোথায় তা পড়ে গেছে ৷ কিন্তু খানিক পর মাল তদারক করে স্টেশন মাস্টার বিনা জিজ্ঞাসাতেই বললেন-‘এত রাতে আর কোথায় যাবেন? আমার ঘরেই থাকুন বা গার্ডস অথবা রার্নিং রুমে ব্যবস্থা হতে পারে ৷’ আমরা অবশ্য তাঁর ঘরেই সে রাতে এবং পরদিন রইলাম ৷ ইনি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার, রাজাভাতখাওয়া ও জয়ন্তী দুই স্টেশনই দেখাশোানা করেন ৷ অতি সজ্জন ব্যক্তি, এঁর সাহায্য না পেলে আমাদের কতদূর যাওয়া হত তা বলা কঠিন ৷ শুধু ইনি নন, যেখানে গিয়েছি সমস্ত জায়গাতেই স্থানীয় লোকের সহৃদয়তা ও সহযোগিতা না পেলে আমাদের হয়তো গারো পাহাড় প্রভৃতি কঠিন ও দুরূহ অঞ্চলগুলি যাওয়াই হত না ৷ এই সাহায্য তাঁরা করেছেন এত স্বাভাবিকভাবে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অবকাশও দেননি ৷ পূর্ব বাংলা ও উত্তর বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশে) বহু অধিবাসী বর্তমানে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার প্রভৃতি স্থানে আছেন ৷
জয়ন্তীর প্রথম রাতের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল-রাতে একটি হাতির আগমন ৷ স্থানীয় লোকেরা একে গণেশ হাতি বলে অর্থাৎ এর একটি মাত্র দাঁত, তা বাঁদিকে ৷ কিছুদিন ধরে এ অঞ্চলে সে উৎপাত করছে ৷ হাতিটিকে গুলি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে বনবিভাগ থেকে ৷ তখনও অবধি কিছু হয়নি ৷ রাতের অন্ধকার ও শোরগোলে উঠে শুনি হাতিটি কলাগাছ খেতে প্রায়ই আসে লোকালয়ে ৷ আরও রোমাঞ্চকর ব্যাপার হল, জয়ন্তী নদীর চড়ায় পরদিন বহু পার্টি চড়ুইভাতি করতে এসেছিলেন, রান্না প্রায় শেষ, খেতে বসবেন এমন সময় বেলা তিনটে নাগাদ পাশের পাহাড় থেকে ১২টি হাতি বাচ্চা সহ সহসা তাঁদের কাছে এসে উপস্থিত আর সকলে রান্না ইত্যাদি ফেলে চম্পট ৷ বাংলোর লোকেরা হাতিগুলি গুনেছিলেন ৷ আমরা তখন ফিরেছি মাত্র ৷ দূর থেকে দেখে খুবই মজা লাগল ৷ জয়ন্তী যাবার পথেও বড় বড় হাতির পায়ের ছাপ দেখেছি ৷ নদীর ধারের লোনা মাটি ও জল খেতে আসে এরা ৷ তাদের পায়ের দাপটে একেক জায়গা নিচু হয়ে গেছে ৷ সেই দিনই রাতে আবার মালগাড়ির কাছে রাত ৯টায় গণেশ হাতির আগমন-বনবিভাগের অফিসার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলেন ৷ আমরা তাড়াতাড়ি বার হয়ে তাকে পালাতে দেখলাম ৷
এখন চিন্তা এবার জয়ন্তীর গুহাতে কী করে যাওয়া যায়? স্টেশন মাস্টার একজন গাইড দিয়ে দিলেন ৷ তার নাম চেংটু মহারাজ ৷ বছর কুড়ি একুশের একটি ছেলে ৷ এত গম্ভীর ছেলে যে আমরা অবাক হলাম ৷ স্থানীয় একটি খাবার দোকানের মালিকের ছেলে ৷ জীবন দর্শন তার গভীর ৷ অবশ্য তার সঙ্গে পথ চলতে চলতে এসব কথা জেনেছি ৷ মাস্টারমশাই জানালেন যে নদীতে এখনও সব জায়গায় পুল বাঁধা হয়নি, কয়েকদিন আগেও নাকি ভ্রমণকারী দল ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন ৷ আমরা তাতেও দমবার পাত্রী নই ৷ অধ্যাপকরা বর্ণনার সময় বলে দিয়েছিলেন, জয়ন্তী যাবার পথে কোথাও কোথাও শিকল ধরে যেতে হয়, এত দুর্গম চড়াই! এবং গুহাগুলি নাকি তিনতলা সমান উঁচু, মই বেয়ে উঠতে হয় ৷
বলতে বাধা নেই, সেগুলিই ছিল এপথের অন্যতম আকর্ষণ ৷ জয়ন্তীতে চুনাপাথরের কারখানা আছে, কমলালেবুও হয় যথেষ্ট, কিন্তু সেগুলি আমার কাছে তেমন আকর্ষণীয় নয় ৷ তবে এই গুহাগুলি ভৌগোলিক দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ ৷ ভারতে চেরাপুঞ্জি, অমরনাথ প্রভৃতি কয়েকটি স্থান ছাড়া এধরনের গুহা নেই ৷ চেরাপুঞ্জিতে লম্বা সুড়ঙ্গ চলে গেছে গুহাতে, কিন্তু এত ঝুলন্ত চুনাপাথর নাকি আর কোথাও নেই, অবশ্য স্থানীয় লোকেরা একে মহাকালের মন্দির বলে থাকেন ৷ ওপর থেকে বৃষ্টির ও ঝরনার জল পড়ে পড়ে পর্বতের অভ্যন্তর ক্ষয় হয়ে ওপরে লম্বমান শিলাস্তম্ভ (স্ট্যালাকটাইট) ও নিচে স্তরীভূত শিলাস্তূপ (স্ট্যালাগমাইট)-এর সৃষ্ট গুহাগুলি এদের মতে মহাকালের নিজের তৈরি ৷ আমরা লাভবান হলাম এইজন্য যে এসেছিলাম ভৌগোলিক দৃশ্য দেখতে, ভাগ্যে মহাকাল দর্শন হয়ে গেল ৷ সুতরাং প্রবল উৎসাহে ভোর ৬টায় চেংটু মহারাজকে নিয়ে রওনা হওয়া গেল ৷
সেদিন ছিল হাটবার, যতই জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করছি, ভুটিয়া বস্তির স্থানীয় লোকদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে ৷ বেশিরভাগেরই কাঁধে লম্বা ঝুড়িতে কমলালেবু ও কাঠ ৷ আমাদের গাইড একজন গাঁও-প্রধানকে জিজ্ঞেস করল পথ কীরকম, যাওয়া যাবে কি না ৷ সে তার ভাষায় ও ইশারা করে উত্তর দিল, সব পুল এখনও বাঁধা হয়নি, ২-৩টা বাকি আছে ৷ যেখানে গভীর জল ও স্রোত বেশি সেখানে শিগগির হবে এবং সেখানে বুক বা গলা অবধি জল ৷ আমরা কি যেতে পারব? কিন্তু ‘কুছ পরোয়া’ নেই ভাবে এগিয়ে চললাম ৷ জয়ন্তী পাহাড়ি নদী, বেশ উঁচু জায়গা থেকে আসছে, দুদিকেই পাহাড় মাঝে মাঝে বেশ উঁচু (৫০০০-৬০০০ ফুট) ৷ নদী বেশ গভীর স্থানে স্থানে, হঠাৎ পাহাড়ি ঢল নামলে জল বেড়ে যায় ৷ তাই বর্ষায় এখানে আসা মুস্কিল, পুল সব ভেঙে যায়, প্রতি বছর নতুন করে পুল বানাতে হয় ৷ স্থানীয় লোকেরাই সরস্বতী পুজোর আগে এসব শেষ করে রাখে ৷ শিবরাত্রির আগে ও পরে কয়েকদিন ধরে মেলা হয় ৷ গ্রামের ও ভুটানের লোকেরা ২-৩ দিন এই মহাকাল মন্দিরের আশপাশে থাকে ৷ মহাকাল খুব জাগ্রত দেবতা, বহু ধর্না দেওয়া হয় শিবের মন্দিরে ৷ অবশ্য পুল মানে বড় বড় কাঠের গুঁড়ি সিঁড়ির মতো ধাপ কেটে কেটে আড়াআড়ি বা উঁচু থেকে নিচে কিংবা সাধারণ বাঁশের অবলম্বন সহ নিয়মিত লতাপাতা দিয়ে পুল বাঁধা হয় ৷ তারই নিচে খরস্রোতা নদী বয়ে যাচ্ছে ৷ মাইল খানেক যাবার পর ভুটান রাজ্যের অধিকারে এসে গেলাম ৷ ৫-৬ মাইল যেতে হবে কিন্তু এখানে পথ বলে কোনও পদার্থ নেই ৷ কখনও নদীর স্রোতের ওপর বা প্রস্তর খণ্ডের ওপর লাফ দিয়ে, গাছ ধরে ওঠানামা করতে করতে যেতে হচ্ছে ৷
চারদিকে ফুলের সমারোহ, তবে কাঁটারও কমতি নেই ৷ আর ভয় হচ্ছে কখন হয়তো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হাতির পাল দেখতে পাব, যেতে যেতে তো অনেক পায়ের ছাপ দেখলাম কাদার ওপর, নদী খুব এঁকেবেঁকে চলেছে, পথও তদ্রূপ, সুতরাং খুব খাড়া চড়াই না হলেও যেতে বেশ দেরি হচ্ছে ৷ এমনভাবে যেতে যেতে ২-৩ মাইল দূরে একটা বাঁকে এসে পৌঁছলাম যেখানে নদী তিনটি জায়গায় বাঁক নিয়েছে ৷ খুব চওড়া এবং খরস্রোতা বলে এবছর এখনও পুল বাঁধা হয়নি ৷ কিন্তু আগেই বলেছি যে আমরা ফিরে যাব বলে আসিনি ৷ নদী যেখানে শান্ত প্রবাহিনী সেখান দিয়েই পার হতে হবে, কিন্তু গভীর জল ৷ পরিষ্কার-তলা অবধি দেখা যাচ্ছে ৷ আমরা কিছু কাপড় চোপড়, জুতো ছেড়ে, ডাল ভেঙে লাঠি তৈরি করে নিয়ে সেই গভীর জলের জায়গাটি প্রায় সাঁতরে পার হলাম, মাথার ওপরে শুকনো কাপড়চোপড় ও ক্যামেরাটি সাবধানে ধরে ৷ এর পরেই দুটি বাঁক, চওড়া কম হলেও সেখানে জলস্রোত ও আবর্ত এত বেশি যে স্থানীয় লোকেরা মোটা গাছের গুঁড়ি এপার ওপার ফেলে রেখেছে, তাকে অবলম্বন করে যাবার জন্য ৷ তাই ধরে কোনওমতে অগ্রসর হওয়া গেল ৷ নিচে স্রোতের টান এত বেশি যে একবার হাত ছাড়লেই ভেসে চলে যেতাম ৷ শীতকাল, জলও ঠান্ডা তারপর সেদিন ছিল খুব মেঘলা ৷ ওপারে পৌঁছে ভেজা কাপড়গুলি একটি বড় পাথরের নিচে লুকিয়ে রেখে শুকনো কাপড় পরে চললাম ৷ চেংটু মহারাজ ভরসা দিল ওই জঙ্গলে ‘মধুবাবা’ বলে একজন আছেন, তাঁর ধুণীতে চা খাওয়া যাবে ৷ এর পরেই পথের কাঠিন্য শুরু হল ৷ কত উঁচু হবে জানি না-তবে পাহাড় ৫-৬ হাজার ফুটের বেশি তো হবেই না, কিন্তু পথ খাড়া উঠে গেছে ৷ তাই কোনও পয়সাওয়ালা তীর্থযাত্রী দুটি পাশাপাশি লোহার সিঁড়ি বা মই স্থাপিত করেছেন ৷ সেইসব মই-এর পাশে লোহার শিকল আছে-তাছাড়া কোনও জায়গায় শুধু শিকল আছে ৷ এইসব মই ও শিকলের সাহায্যে চড়াইগুলি ওঠা গেল ৷ পা ক্ষতবিক্ষত, কারণ আমাদের গাইডের পরামর্শে জুতো নদীর পাড়ে পাথরের তলায় ছেড়ে এসেছি ৷ এইভাবে ক্রমশ উঠছি ৷ অরণ্য ক্রমশ ঘন ও নিশ্ছিদ্র হয়ে আসছে, তবু দৃশ্য মহান ৷ গম্ভীর মেঘলা দিন, বেলা ১২টা বাজে তবু অন্ধকার ৷ ক্রমশ উঠতে উঠতে সেই বিখ্যাত মহাকালের মন্দির বা চুনাপাথরের গুহাগুলি দেখা গেল ৷ প্রথমে খানিকটা চৌকো মাটির প্রাঙ্গণ আছে ৷ সেখানে অস্থায়ী কয়েকটি উনুন দেখা গেল ৷ কিন্তু নির্জনস্থানবাসী ‘মধুবাবা’ কোথাও নাই! চেংটু মহারাজ জানাল যে তিনি মাঝে মাঝে থাকেন, মাঝে মাঝে চলে যান ৷ সুতরাং অত পরিশ্রমের পর চা ইত্যাদি আর খাওয়া হল না, ধারেপাশে কোথাও লোকালয় নেই, সে সব দুধারের পাহাড়ের পিছনে বহু দূরে! সেই উচ্চস্থানে বসে নিচের নদীর বাঁকগুলি, তুমুল গর্জন ও ছোট ছোট জলপ্রপাত মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম ৷ কিন্তু তাড়া আছে ফেরবার, অল্প অল্প দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে ৷ একবার বৃষ্টি হওয়া শুরু হলে হঠাৎ যদি নদীতে জলস্ফীতি ঘটে যায়, তাহলে আর নদী পার হয়ে স্টেশনে যাওয়া যাবে না ৷ বাঁদিকে আবার সেই মই ও শিকল ৷ ওপর থেকে অনবরত কোন অদৃশ্য ঝরনা দিয়ে জল চুইয়ে পড়ছে ৷ সমস্ত জায়গাটা ভিজে, স্যাঁতসেঁতে ও মেঝেতে জমে থাকা জল মিলে এক অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ৷ এই জল ও বৃষ্টির জল চুনাপাথরের এলাকায় কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সাহায্যে শিলা ক্ষয় করে পথ নিয়েছে ৷ ক্ষয়ের ফলে গুহার সৃষ্টি হয়েছে ৷ এখানে প্রায় ছোট বড় চারটি গুহা আছে ৷ যে গুহাটি মহাকালের মন্দির বা শিবের মন্দির বলা হয় তার ভেতর ঘোরতর অন্ধকার ৷ সেখানে ভেতরে বেশ জায়গা আছে, ১০-১২ জন অনায়াসেই দাঁড়াতে পারে ৷ প্রবেশ করতে ভয় হল ৷ চেংটু মহারাজ বলল, সাপও থাকে, তবে কখনও কামড়ায় না ৷ শেষ পর্যন্ত ভেতরে কোনওমতে ঢুকে অস্পষ্ট আলোয় ৩টি বিভিন্ন শিলাস্তম্ভ দেখা গেল ৷ এঁরা হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ৷ মাঝেরটি দীর্ঘ, তিনিই মহেশ্বর ৷ আলোয় এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তুর সংমিশ্রণে কয়েকটি রঙের দ্যুতি দেখা গেল ৷ এর পরে বার হয়ে একটি বারান্দা দিয়ে বাঁপাশে মহাকালীর গুহা বা মন্দিরে গেলাম ৷ এখানে গুহামুখটি অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত ৷ এখানেও একটি শিলাস্তম্ভ আছে ৷ কিন্তু বারান্দা বা গুহা মন্দিরের বাইরে ঝোলানো শিলাস্তূপের চারদিকব্যাপী বিন্যাসে বাস্তবিকই মনে হয় মহাকালী তাঁর কালো কেশরাশি ছড়িয়ে দিয়ে ধ্বংসের আরাধনায় মত্ত ৷ মাস্টারমশাইয়ের বর্ণনাও তাই ছিল, গুহাগুলির চারপাশে শিবের জটা ও মহাকালীর কেশরাশি বিস্তৃত হয়ে রয়েছে-মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম ৷ কখনও জীবনে এমন দেখিনি ৷ কালীকে ভৈরবী বলে কেন তা এখন বুঝলাম ৷ ওপরে আকাশে মেঘের ঘনঘটা, নিচে এই ঝুলন্ত শিলাস্তূপের জটাজাল ৷ কিন্তু আলো নেই, ছবি নেওয়া গেল না ৷ এইসব গুহার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানি ৷ যদি প্রচুর পরিমাণে চুন মিশ্রিত জল চুয়ে পড়ে তবে গুহার ওপর থেকে নানা আকারের ঝুলন্ত শিলাস্তূপের সৃষ্টি হয়, ঝুলে থাকে বলে সেগুলি ক্রমশ সরু হয়ে যায়, ইংরিজিতে এদের বলে স্ট্যালাকটাইট ৷ যখন এই চুন মিশ্রিত জল গুহার মেঝেতে পড়ে, সেখানেও শিলাস্তম্ভের বা স্ট্যালাগমাইট-এর সৃষ্টি হয় ৷ কখনও ওপরের স্তম্ভের সঙ্গে নিচের স্তম্ভ মিলে যায় ৷ তাতে একটি দীর্ঘ থামের আকার দেখা যায় ৷ এখানে যে ঝুলন্ত শিলাস্তূপ আছে তার আকার নানারূপ ৷ চেংটু মহারাজ জানাল, যেসব স্কুলের ছেলেরা আসে তারা ঢিল ছুড়ে ভেঙে এসব শিলাস্তম্ভের নমুনা নিয়ে যায় ৷ তাতে তার খুব দুঃখ ৷ কারণ সে এবং স্থানীয় লোকেরা এই চুনাপাথরের অদ্ভুতাকৃতির স্তম্ভগুলিকে অতি পবিত্র মনে করে এবং যেভাবে অন্য জায়গার শালগ্রামকে পুজো করা হয়, সেভাবেই তারা এগুলিকে পুজো করে ৷ প্রত্যেকের বাড়িতে একটি করে অন্তত আছে ৷ এদের আরও বিশ্বাস মহাকালের এই ত্রিতল মন্দির অর্থাৎ তিনটি বিভিন্ন উচ্চতার গুহা অরণ্যের ওপর পর্বতে প্রকৃতির নিজের সৃষ্টি-মানুষের এখানে হাত পড়েনি ৷ তাই মানুষের এখানে হাত লাগানোই উচিত নয় ৷ এর পর পাগলাবাবার (শিব) গুহা-সেখানে প্রবেশপথটি এত ছোট ও নিচু যে হামাগুড়ি দিয়ে বা শুয়ে যেতে হয়-সুতরাং সেখানে ঢোকা আর সম্ভব হল না ৷ এখানে নিচের শিলাখণ্ডগুলি দেখবার সুযোগ ঘটল ৷ যেন কোনও সুদক্ষ শিল্পী নিপুণ হাতে আলপনা এঁকে দিয়ে স্থানটি অলংকৃত করেছেন ৷ কোথাও অর্ধচন্দ্রাকৃতি বেদীর ওপরে পদ্মের পাপড়ি বিছানো, কোথাও স্বাভাবিক বেদীর সৃষ্টি হয়েছে-শুধু জল চুয়ে পড়ে যে এত সুন্দর আকৃতি হতে পারে তা বিশ্বাস করা যায় না ৷ প্রকৃতির সৃষ্টির কাছে মানুষের কাজ কত নগণ্য!
এবার ফেরার পালা ৷ সামান্য কিছু খেয়ে রওনা দিলাম ৷ পা রক্তাক্ত হয়ে গেল কাঁটার দাপটে ৷ আকাশের অবস্থা ভালো নয় ৷ যে-কোনও সময়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হতে পারে ৷ আবার সাবধানে সেই জলে ভেজা পিছল পর্বত গুহা থেকে মই ও শিকলের সাহায্যে নামতে হল এবং অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়ি পথে এসে নামলাম ৷ মহাকালের গুহা কবে স্থাপিত হয়েছে বা পর্বতোপরি এই ত্রিতল গুহাগুলি কত উচ্চ তার সঠিক কোনও খবর নেই ৷ তবে গুহাগুলি ৩০০০-৪০০০ ফুটের মধ্যেই হবে বলে মনে হয় ৷ এই মন্দির নিয়মিত দেখাশুনো করা হয় না ৷ শিবরাত্রির আগে ভুটান সরকারের পুরোহিতরা আসেন এবং পুজোপাঠ করেন ও যা কিছু আয় হয় তা নিয়ে ভুটানে জমা দেন ৷ এ অঞ্চল ও আশপাশের অঞ্চল ভুটান সরকারের অধীন ৷ অবশ্য এতে স্থানীয় লোকের দুঃখ আছে ৷ কিন্তু এঁকে এরা সকলেই খুবই জাগ্রত দেবতা বলে মেনে থাকে ৷ সেখানে ভুটানি, পাহাড়ি, বাঙালি সকলেই একমত ৷ অবশেষে বেলা তিনটেয় ভেজা কাপড়ের বোঝা নিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে স্টেশনে ফিরলাম ৷
ভ্রমণ জুন, ২০০১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন