আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

নিমন্ত্রণের ইতিকথা

ছেলেবেলায় ভূগোল বইয়ে পৃথিবীর কোথায় না কোথায় কত অদ্ভুত অদ্ভুত সব জায়গার নাম দেখেছি, সেসব জায়গা কখনও দেখাই হয়নি, কীভাবে সেখানে যেতে হয় তাও জানি না ৷ অথচ যুগ যুগ ধরে সেইসব অজ্ঞাত দেশ তাদের নিজস্ব ভূগোল-ইতিহাস নিয়ে বিরাজমান ৷

ব্রাজিলের আমাজন থেকে ফিরে এসে, এবার চলেছি তেমনই একটা দেশে ৷ নাম তার জর্জিয়া ৷ অচেনা দেশ মাত্রই আমাকে টানে, তার ওপর জর্জিয়া অতি প্রাচীন দেশ আর জর্জিয়ানরা পৃথিবীর প্রাচীনতম মানব-গোষ্ঠীগুলির একটি ৷ বইয়ে পড়েছি, ককেশাসে, বিশেষ করে জর্জিয়ার অংশে প্যালিওলিথিক যুগের আদি মানবের চিহ্ন পাওয়া গেছে ৷ পঁয়ত্রিশ হাজার থেকে এক লক্ষ বছর আগে জর্জিয়ায় কৃষ্ণসাগরের উপকূলে আর রিওনি-কিউভিরিলা নদী-দুটির অববাহিকায় মানুষের বসতির কথাও শোনা যায় ৷

দুয়েকটি প্রাগৈতিহাসিক দাগ আমি নিজেই দেখেছি ৷

জর্জিয়ার উত্তর দক্ষিণ পূর্ব ঘিরে ককেশাস পর্বতমালা ৷ তিনদিকের চার দেশ থেকে ছোট্ট এই দেশটাকে ককেশাস তার পার্বত্যপ্রাচীর তুলে আলাদা করে রেখেছে ৷ উত্তরে রাশিয়া, পুবে আজারবাইজান, দক্ষিণে আর্মেনিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিমে তুর্কি ৷ বহু যুগের বহু জয়-পরাজয়, ভাঙা-জোড়া, ক্ষতি-বৃদ্ধির স্মৃতি বয়ে মিশ্র-অমিশ্র অন্তর্লীন সংস্কৃতি নিয়ে আমার ভালোবাসার এই দেশটি শেষবারের মতো তার স্বাধীনতা হারায় ১৯২১ সালে, আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের ফলে ফিরেও পায় ১৯৯১-এ ৷ এ পাওয়া চিরকালের মতো, নাকি ক্ষণকালীন, আমি জানি না ৷ দেশটির বৈষয়িক সামাজিক সমৃদ্ধির জন্য এখনকার এই স্বাধীনতাই ভালো, না তখনকার সেই সংযুক্তি, আমি জানি না ৷

জর্জিয়ায় আমি দেখলাম মানুষের হাসিমুখ, আনন্দমুখ, দেখলাম তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মসুখ-এ হল নতুন স্বাধীনতার আনন্দ; আর দেখলাম দিন গুজরানোর কষ্ট, পথে পথে, শহরে গ্রামে, লোকের বাড়িতে চাপা ব্যথা, অনিশ্চয়তার কালো মেঘ-এ হল স্বাধীনতার মূল্য ৷

জর্জিয়ার তিনদিকে পাহাড় আর পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর ৷ আসমুদ্রককেশাস এই প্রাচীন দেশ আমাদের পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও ছোট, মোটে ৬৯,৫০০ বর্গকিলোমিটার, লোকসংখ্যা ৬০ লক্ষেরও কম, তার অধিকাংশই জর্জিয়ান, অল্পসংখ্যক আবখাজিয়ানসহ, আবখাজিয়ানরাও তো জর্জিয়ান ৷ জর্জিয়ানদের ছোট্ট একটা গোষ্ঠী সীমান্তবাসী এই আবখাজিয়ানরা এখন আবখাজিয়ায় আলাদা স্বায়ত্তশাসন চালু করেছে ৷ একালের ‘রিপাবলিক অব জর্জিয়া’ বলতে এই আবখাজিয়ান অটোনমাস রিপাবলিক আর আচারান অটোনমাস রিপাবলিক ধরেই ৷ জর্জিয়ান ছাড়া জর্জিয়ায় আর্মেনিয়ান, আজারবাইজানিয়ান, রাশিয়ান, গ্রিক, তুর্কি, কুর্দ, হিব্রু প্রভৃতি অন্যান্য দেশ ও ভাষার মানুষও দেখা যায় ৷ তবে এরা সংখ্যায় খুব বেশি নয়, যদিও এইসব জাতির লোকেরা বহু প্রাচীনকাল থেকে জর্জিয়ায় বাসা বেঁধেছে ৷ ইহুদিরা এদেশে প্রথম বসতি করে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে ৷

এশিয়া আর ইউরোপ-এই দুটি মহাদেশের মাঝের দরজা জর্জিয়া ৷ সেইজন্যই বোধহয় মেয়েদের ইউরোপীয় পোশাকের সঙ্গে অনেকের গায়েই আমাদের মতো শাল দেখলাম ৷ পুরুষদের পোশাক আজকাল সব দেশেই প্রায় এক, মেয়েদের পোশাকে এখনও কিছুটা হয়তো সে দেশের চিরাচরিত ধারার পরিচয় পাওয়া যায় ৷ শুধু পোশাক-পরিচ্ছদই না, জর্জিয়ার রাস্তায় বাজারে, লোকের বাড়িতে, সর্বত্রই না-পুরোপুরি ইউরোপ না-পুরোপুরি এশীয়, কিংবা যেন কিছুটা এশীয় কিছুটা ইউরোপীয় ভাব ও রীতি দেখেছি ৷ পারিবারিক বন্ধনও একালের ইউরোপের মতো অতটা ঢিলেঢালা হয়ে যায়নি, কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা অনেকটাই বরং আমাদের দেশের মতো তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেই লেখাপড়া কি চাকরি-বাকরির চেষ্টা করে ৷ ইউরোপের শহর-জীবনের মতো কিশোরী বা সদ্য তরুণীদের পারিবারিক স্নেহসম্পর্কহীন সম্পূর্ণ বেপরোয়া উদ্দাম জীবনযাপন এখানে দেখিনি ৷ আরও একটা ভারতীয় ভাব আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে ৷ তা হল জর্জিয়ার মানুষের আন্তরিক অতিথিপরায়ণতা ৷ জর্জিয়া ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে আমার জন্য নির্ধারিত রাইটার্স ইউনিয়নের ঘরোয়া সভায় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট লেখক সমালোচক তামাজ ৎসিভৎসিভাদজে এই বলে আমার সঙ্গে পানীয় ‘টোস্ট’ করেছিলেন, ‘প্রাচীন সভ্যতা ও সুগভীর দর্শনের মহান দেশ ভারত থেকে আপনি এসেছেন আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির ছোট্ট দেশ জর্জিয়ায় ৷ আপনি আমাদের অতিথি, আপনাকে আমরা হৃদয়ের গভীর থেকে স্বাগত জানাই ৷ আমরা বিশ্বাস করি অতিথি আসেন স্বর্গ থেকে ৷’

কথা বলছিলেন জর্জিয়ান ভাষায়, সঙ্গে সঙ্গে ইংরিজি করে দিচ্ছেন আমার জর্জিয়ান বন্ধু মানানা দুমবাদজে ৷

সেদিন ভেবেছিলাম, এ হয়তো সৌজন্য, নিছক আলঙ্কারিক ভাষণ ৷

পরে জেনেছি জর্জিয়ার মানুষের এ হৃদয়ের ভাষা ৷ এ তাঁদের সামাজিক রীতি ৷ এ-ই তাঁদের স্বভাব ৷ শুধু রাজধানী ৎবিলিসিতেই নয়, পূর্ব জর্জিয়া, পশ্চিম জর্জিয়া, দক্ষিণ জর্জিয়া-যখন যেখানেই গেছি, আপ্যায়নে আতিথ্যে মুগ্ধ হয়েছি, বাংলাদেশের ঢাকা নারায়ণগঞ্জের কথা আমার মনে পড়ে গেছে ৷ আঠেরো দিনের জর্জিয়া ভ্রমণে ৎবিলিসি থেকে কখনও গেছি আখালসিখে, কখনও কাখেতিয়া, কখনও কুতাইসি, কখনও কৃষ্ণসাগরের তীরে, ফিরে আসার সময় সর্বত্র দেখেছি-আদর করে অনুনয় করে বলে, আজই যেও না ৷

যদি বলি, আজ রাতে ৎবিলিসি না ফিরলেই নয়, তখনই তাঁরা আমার জর্জিয়ার বন্ধু, নিমন্ত্রণকর্ত্রী, সফরসঙ্গী ও দোভাষী মানানাকে ধরবে, তুমি ওর কালকের ৎবিলিসির প্রোগ্রাম একদিন পিছিয়ে দাও, আজকের দিনটা ও আমাদের মধ্যে থাকুক ৷

মানানার পুরো নাম মানানা দুমবাদজে ৷ জর্জিয়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক, ফুলব্রাইট স্কলার ৷ বিখ্যাত জর্জিয়ান সাহিত্যিক নোদার দুমবাদজের কন্যা ৷ নোদার দুমবাদজে অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক, শিশুদের মস্ত বড় একটা পার্কে তাঁর মূর্তি আছে, পার্কটার পরিকল্পনাও তাঁর ৷ তাঁর মৃত্যুর পর জর্জিয়ার প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে ও সরকারি অর্থে প্রয়াত দেশপ্রিয় লেখকের কল্পনা অনুযায়ী পার্কটি তৈরি হয় ৷

নোদারের মেয়ে মানানার সঙ্গে আমার আলাপ জুরিখে, বিশ্ব সম্পাদক সম্মেলনে ৷ এইসব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সাধারণত দুটি অধিবেশনের মাঝখানে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা থাকে ৷ প্রত্যেক টেবিলে চার-পাঁচজনের চেয়ার ৷ আমি যে টেবিলে বসেছিলাম সেই টেবিলের অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে খেতে খেতে পরিচয় হল ৷ তাঁদের একজন জর্জিয়া থেকে এসেছেন, নাম মানানা দুমবাদজে ৷

জর্জিয়া শুনেই আমি লাফিয়ে উঠি, আমি কতকাল ধরে ভাবছি জর্জিয়া আমাকে যেতেই হবে ৷ মানানা কাঁটা-চামচ নামিয়ে রেখে আমার বিজনেস কার্ড দেখে তাঁর কার্ড আমাকে দিয়ে বললেন, আপনি আমাকে জর্জিয়া ভ্রমণের ইচ্ছে জানিয়ে চিঠি লিখবেন, আমি গভর্নমেন্টকে সেটা ফরওয়ার্ড করে দেব, আমাদের সরকার আপনাকে জর্জিয়া ভ্রমণের নিমন্ত্রণ করবেন ৷

পরের কদিন এতই ব্যস্ততার মধ্যে কাটল যে চলে আসার আগে মানানার সঙ্গে দ্বিতীয়বার আর দেখাই হল না ৷

কলকাতায় ফিরে কর্মচক্রে বাঁধা পড়ে গেলাম, সব চাপা পড়ে গেল ৷

গত বছর জুন মাসে রিও ডি জেনেরোয় জর্জিয়ার একজন প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপ হওয়া মাত্রই আমার জর্জিয়া ভ্রমণের ইচ্ছা মনে পড়ে গেল, আমি তাঁকে একটু বিস্তারিত করে আমার মনের কথাটা বললাম ৷

মহিলাটি চুপ করে সব শুনলেন ৷ আমার কথা শেষ হতে বললেন, আপনি আমাকে জুরিখে ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন, কিন্তু ভারতে ফিরে কথামতো চিঠি আপনি পাঠাননি ৷

তক্ষুনি চিনতে পারলাম-আরে এ তো সেই মানানা দুমবাদজে!

আবার নতুন করে কথা হল এবার দেশে ফিরেই চিঠি লিখব, মানানা সে চিঠি তাঁর সরকারকে দেবেন, তাঁরাই সব ব্যবস্থা করবেন ৷

পরদিন লাঞ্চে আমাকে ডেকে নিল চিন, জাপান ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিরা ৷ ফলে লাঞ্চের পরে দ্বিতীয় অধিবেশনে নোট লেখার ফাঁকে ফাঁকেই ঠিক হল সরকারি নিমন্ত্রণ ছাড়াও জর্জিয়ার সংবাদপত্রও আমাকে নিমন্ত্রণ করতে পারে ৷ গতবারেই নাকি এ নিয়ে কথা হয়েছে, ৎবিলিসির ‘দিলিস গাজেতি’ আমাকে জর্জিয়ায় তাদের দেশ দেখবার নিমন্ত্রণ জানাতে খুবই আগ্রহী ৷

বিদেশে সরকারি নিমন্ত্রণে গেলে ঘোরাঘুরি অনেক সহজ হয়ে যায় ৷ তাছাড়া অতিথির জন্য হয়তো বিশেষ কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা কোনও দুর্গম গন্তব্য বা এই ধরনের দুর্লভ কোনও আয়োজনও হতে পারে ৷ আমি জর্জিয়া নিয়ে আবার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম ৷

মানানাও আমার মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, সরকার থেকেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে, দেশে ফিরেই চিঠিটা পাঠান, ফ্যাক্সে বা ই-মেলে ৷ মানানার মুখটা গোলগাল, ভারি সুশ্রী, কিন্তু ওপরের সারির দাঁতগুলো দুয়েক জায়গায় ফাঁক-ফাঁক ৷ বয়স কত? আমার মাথায় তখন অন্য সংশয় ৷ বললাম, তোমাদের দেশে রিটায়ারমেন্টের বয়স কত?

‘৫৮ ৷’

‘যদি কিছু মনে না করো, তোমার এখন কত বয়স?’

‘৫৮ ৷’

‘তাহলে তুমি দেশে ফিরে কবে আর সরকারের কাছে আমার চিঠি ফরওয়ার্ড করবে?’

‘কেন, অসুবিধা কোথায়?’

‘তুমি তো শিগগিরই রিটায়ার করে যাবে ৷ তোমাদের তো ৫৮য় রিটায়ারমেন্ট ৷’

মানানা গম্ভীর থমথমে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ডু আই লুক লাইক ফিফটি এইট?’

‘আপনিই তো বললেন!’

‘আমি বলেছি, আই ওয়াস বর্ন ইন ১৯৫৮ ৷’

একেই সৌজন্যের সব সংজ্ঞা ভেঙে মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করেছি, তার ওপর ৪০-বছরের মহিলাকে ৫৮ বলেছি, কৃষ্ণসাগরের তীরে এসেও নির্ঘাৎ আমার তরী ডুবল!

কলকাতায় ফিরে চিঠি লিখে কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর পেলাম-

হ্যালো প্রিয় শ্রী অমরেন্দ্র চক্রবর্তী,

আপনার চিঠি পেয়ে খুব খুশি ৷ আপনি দেখছি খুবই আশ্চর্য, আগ্রহান্বিত, ব্যস্ত ও ফলপ্রসূ সময় কাটিয়েছেন ৷

রিওতে যেমন কথা দিয়েছি, জর্জিয়ায় আপনাকে আনবই, যাতে আমার দেশের অনেকটাই আপনি দেখতে পান ও সেই দেখা ভ্রমণ-এ লিখতে পারেন ৷

-মানানা দুমবাদজে

উপ-প্রধান সম্পাদক, দিলিস গাজেতি

দ্বিতীয় চিঠি প্রধান সম্পাদকের কাছ থেকে:

প্রিয় শ্রী চক্রবর্তী,

জর্জিয়ান দৈনিক সংবাদপত্র ‘দিলিস গাজেতি’ আপনাকে আনন্দের সঙ্গে জর্জিয়ায় অক্টোবরের ৭ থেকে ২৪ পর্যন্ত ভ্রমণের নিমন্ত্রণ করছেন ৷ আমাদের দেশে নিমন্ত্রিত ভ্রমণ-লেখক হিসেবে আপনাকে পেতে চাইছি ৷

আমাদের দেশ, দেশের মানুষ, আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি গভীরভাবে উপলব্ধি করার আপনার যে আগ্রহ তা খুবই প্রশংসাযোগ্য ৷ আমরা আশা করি আপনার জর্জিয়া ভ্রমণ আমাদের দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন আরও দৃঢ় করবে এবং ভবিষ্যতে আরও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার প্রসার ঘটাবে ৷

‘দিলিস গাজেতি’ অক্টোবরের ৭ থেকে ২৪ পর্যন্ত জর্জিয়ায় আপনার থাকা খাওয়া ঘোরাঘুরি ও সারা দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও বহু বিশিষ্ট শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিকের সঙ্গে আপনার মিটিংয়ের ব্যবস্থা করবে’ ৷

-মানানা কারতোজিয়া

প্রধান সম্পাদক, দিলিস গাজেতি

ৎবিলিসি, জর্জিয়া

তৃতীয় চিঠি:

আপনার সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা হবে ৷ জর্জিয়ায় এখন যতদূর সম্ভব, ঠিক ততটাই চিত্তাকর্ষক হবে আপনার সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ৷

‘দিলিস গাজেতি’ আপনাকে আতিথ্য দানের জন্য খুবই আগ্রহী হয়ে আছে ৷ আমরা আপনার জর্জিয়া ভ্রমণ নিয়ে লিখব ও আপনার সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে ৷ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে ৷ কিন্তু যেহেতু আপনি আসছেন অক্টোবরের গোড়ায়, প্রথমেই আমি আপনাকে নিয়ে যেতে চাই সমুদ্র-উপকূলবর্তী গ্রাম গ্রিগোলেতিতে ৷ অক্টোবরে জর্জিয়ান ব্ল্যাক সি কোস্ট সোনালি আর উষ্ণ, কিন্তু অক্টোবরের গোড়াতেই শুধু এমন মনোরম থাকে ৷ সেইজন্যই আমরা পশ্চিম জর্জিয়া থেকে ভ্রমণ শুরু করব, যাব গুরিয়াতেও, জর্জিয়ার এক অতি সুন্দর আর খুবই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চল এই গুরিয়া ৷ দুঃখের কথা, আপনি ৎবিলিসি নগরোৎসব দেখতে পাবেন না, কেননা প্রতি বছর এই উৎসবের তারিখ পড়ে অক্টোবরের শেষ রবিবার, এবছর সেটা ২৯ তারিখ ৷ অবশ্য ভাববার কিছু নেই, আমরা অন্য কয়েকটা জায়গায় যাব, ভালো ভালো প্রদর্শনী দেখব, গ্রামেও ঘুরব ৷ ৎবিলিসি টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি স্কুল অব জার্নালিজম-এ আপনার জন্য সভার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে আপনাকে ভ্রমণ-সাংবাদিকতা, আপনার ‘ভ্রমণ’ পত্রিকা, আপনার নিজের কথা ও আজকের ভারত বিষয়ে বক্তৃতা বক্তৃতাকরতে হবে ৷ জর্জিয়ার পর্যটন উন্নয়ন যাঁদের জন্য সম্ভব হচ্ছে তেমন কয়েকজন প্রথম সারির ব্যক্তির সঙ্গেও আপনার মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করছি ৷ জর্জিয়ার লোকসংগীত, লোকনৃত্য, লোকসংস্কৃতিও আপনার ভ্রমণসূচিতে থাকছে ৷

আমি এখনও ভেবে যাচ্ছি আরও কী কী যোগ করা যায় ৷ কার কার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আপনার ভালো লাগবে ৷ এসব চূড়ান্ত হওয়া মাত্র আমি আপনাকে ই-মেল করব ৷

অক্টোবরে এখানে কিছুটা গরম আবার হঠাৎ হঠাৎ ঠান্ডাও পড়ে যায় ৷ হাল্কা পশমের পোশাক আর একটা চামড়ার জ্যাকেট হলেই চলবে ৷ ভারি উলের পোশাক আনবেন না ৷ একটা হাল্কা রেইনকোট অথবা ছাতা আনতে পারেন ৷ আপনার ভারত ছাড়বার মুহূর্তে জর্জিয়ার আবহাওয়া ঠিক কীরকম হবে তাও তখন জানিয়ে দেব ৷

আপনার চিঠির আশায় রইলাম ৷ আপনার আর কোনও প্রশ্ন থাকলে, কোনওরকম দ্বিধা বা সংকোচ করবেন না, আমাকে লিখুন ৷ -মানানা দুমবাদজে

চতুর্থ চিঠি:

আশাকরি আমার ১২ সেপ্টেম্বরের ই-মেল পেয়েছেন, এই চিঠির নিচে আবার পাঠালাম ৷ পেয়ে থাকলে উত্তর দিলেন না কেন? জর্জিয়ায় আসার ব্যাপারে এবং কবে আসছেন সে বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত আমার জানা খুব দরকার ৷ কেননা এখানে আপনার ভিসার ব্যাপারে আমাকে লাগতে হবে ৷

ভারতীয় নাগরিকদের জন্য ভিসার ব্যাপারে আমি এখানে সব তথ্য ও নিয়মকানুন দেখে নিয়েছি ৷ মনে হয় সামান্য জটিলতা রয়েছে, আশাকরি তার মীমাংসা করা যাবে ৷

আপনাকে শুধু আপনার বায়োডাটা, পাসপোর্ট নম্বর সহ এখনই ই-মেল বা ফ্যাক্স করতে হবে ৷ তা নিয়ে আমি আমাদের বিদেশমন্ত্রকে যাব, তারাই আপনাকে জর্জিয়ায় প্রবেশের ভিসা সাপোর্ট দেবার ব্যবস্থা করবেন ৷ ফলে আপনি ৎবিলিসি এয়ারপোর্টে হাতে হাতে ভিসা পেয়ে যাবেন ৷ -মানানা দুমবাদজে

এর আগে কবে যেন একটা ই-মেলে মানানা জানালেন আমার ভ্রমণসূচি ক্রমশই আরও পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠছে, এই কাজে তিনি নিজে ও দিলিস গাজেতির প্রধান সম্পাদক মানানা কারতোজিয়া নানা সংস্থা ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন ৷ আমার বিমানের টিকিট পাঠাতে একটু দেরি হচ্ছে বলে দুমবাদজে খুবই দুঃখিত ৷

ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল ৷ প্যারিসের ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অফ নিউজ পেপার্স ও সংবাদপত্র প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইফরা (IFRA) থেকে প্যারিসে যাবার নিমন্ত্রণপত্র পেলাম ৷ মাস কয়েক আগে প্রথম এই নিমন্ত্রণ পেয়ে সময়াভাবে যেতে পারব না জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি দিয়েছিলাম ৷ তারপর এই দ্বিতীয়বার একই নিমন্ত্রণ ৷ লিখেছেন বেঙ্গট ব্রাউন, প্রেসিডেন্ট, ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পেপার্স ও মারডক ম্যাকলেনান, প্রেসিডেন্ট, ইফরা ৷

মানানা দুমবাদজের টিকিট পাঠানোয় বিলম্বের কথা পড়ে আমি তাঁদের আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলাম, আমাকে WAN ও IFRAর একটা নিমন্ত্রণে ২৮ সেপ্টেম্বর প্যারিস যেতে হচ্ছে, সেখান থেকেই সোজা জর্জিয়ায় চলে যাব, ফলে কলকাতা-মস্কো-জর্জিয়া-মস্কো-কলকাতার টিকিট পাঠাবার দরকার নেই, ৫-৬ দিনের জন্য আমি প্যারিসের কাজ সেরে জর্জিয়া চলে যাব ৷

৫ অক্টোবর প্যারিসের ‘সিতে ইউনিভারসিতে’র (ইউনিভার্সিটি সিটি) মেজোঁ দ্য ল্যাঁদ-এর ডিরেক্টর আমার অগ্রজ বন্ধু ডক্টর বিকাশ সান্যালের কম্পিউটার থেকে আমার জর্জিয়া যাত্রার খবর দিয়ে ই-মেল পাঠালাম-

আমার এখানকার কাজ শেষ ৷ এবার আপনাদের আশ্চর্য দেশ দেখবার অপেক্ষা ৷ আমি ৮ অক্টোবর ভিয়েনা থেকে রওনা হয়ে ৎবিলিসি পৌঁছব জর্জিয়ান সময় সন্ধে ৬টা ২০ মিনিটে ৷ ফ্লাইট নম্বর OS 682 (অথবা, হয়তো, A9 682) ৷

৬ অক্টোবর প্যারিসের ঠিকানায় জর্জিয়ার পঞ্চম চিঠি পেলাম:

আমরা আপনার আগমনের অপেক্ষায় রয়েছি ৷ মনে হয় জর্জিয়ায় আপনার দিনগুলো আনন্দের হবে ৷ নানা অঞ্চলে আপনার বেড়াবার ব্যবস্থা হয়েছে, লেখক, সাংবাদিক, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ছাত্রদের সঙ্গে আপনার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ আপনাকে তাঁদের জন্য কিছু বলতে হবে ৷ টিভির পর্দায় আপনাকে জর্জিয়ার জনসাধারণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে ৷ শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে আপনি আমাদের ঘরোয়া অ্যাপার্টমেন্টে থাকবেন, হোটেলে থাকার চেয়ে সেটাই আপনার বেশি ভালো লাগবে ৷

আমি ও দিলিস গাজেতির কয়েকজন আপনাকে আনতে এয়ারপোর্টে যাব ৷ জর্জিয়ায় আপনার আগমন নিয়ে পরদিনই, সোমবার, সকালের সংবাদপত্রে লেখা হবে ৷

এই বার আমি সত্যিই একটু ঘাবড়ে গেলাম ৷ এঁরা আমাকে ভুল করে কী ভেবে নিয়েছেন কে জানে!

২. ৎবিলিসির অতিথি

অক্টোবরের ৮ তারিখে আমার জর্জিয়ার রাজধানী ৎবিলিসিতে পৌঁছবার কথা, ফ্রান্সের শার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টের ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যে গ্রিজি-অঁ-ফ্রাঁসে আমার দুদিন ধরে সেমিনার ও দু-বেলা ওয়ার্কশপ শেষ করে হাতে তখনও পাঁচ-ছদিন সময়, কী করি কী করি করতে করতে প্যারিসের গার দু নর স্টেশনে গিয়ে একটা ট্রেনে চড়ে চলে গেলাম লাঁও, সেখান থেকে সোয়াশেঁা ৷ মধ্য যুগের এই দুটি দুর্গশহর অনেকটা যেন স্বপ্নে বা সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো ৷ সোয়াশেঁা ফ্রান্সের প্রথম রাজধানী ৷

যাইহোক ফ্রান্সের অতীতের রাজধানী থেকে বর্তমানের রাজধানীতে ফিরে প্যারিসের ‘সিতে ইউনিভারসিতে’র ভারত ভবনে বাঙালিদের দুর্গাপুজোর ঢালাও নিমন্ত্রণে ধূপধুনো ঢাকঢোল যজ্ঞ আরতি দেখে, দুবেলা প্রসাদ ও ভোগ খেয়ে ৮ তারিখ সাতসকালে শার্লস দ্য গল এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠলাম ৷ যাব ভিয়েনায় ৷ ভিয়েনা থেকে ৎবিলিসির বিমান আকাশে উঠবে ভিয়েনার স্থানীয় সময় দুপুর বারোটায় ৷

ভিয়েনা এয়ারপোর্টে চেক-ইন ও সিকিউরিটি সেরে ৎবিলিসি যাবার গেটের সামনে লাউঞ্জে বসে প্রথমেই নজরে পড়ে অপেক্ষমাণ পুরুষ-মহিলা যাত্রীদের কালো চুল ও মুখের কিছুটা অন্যরকম বৈশিষ্ট্য ৷ নৃতত্বে আমূল আনাড়ি চোখেও আমার মনে হল, এদের মুখ যেন ইরানের আমে আর রাশিয়ার দুধে মেশানো ৷ এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে জীবনে প্রথম একসঙ্গে এতজন জর্জিয়ানকে দেখে খুবই ভাসাভাসা একটা ধারণা দেবার জন্য আমার এই অনধিকার চর্চা ৷ আমি ছাড়া এখানে সবাই মনে হয় জর্জিয়ার লোক ৷

ৎবিলিসি এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমেই আমার বুক থেকে একটা আনন্দশ্বাস বেরিয়ে এল-আ, আমি এখন জর্জিয়ায়! স্থানীয় সময় তখন সন্ধে সাতটা ৷

পুলিশের কাউন্টারে পাসপোর্ট দেখাতেই একটা ফরম পেলাম, পূরণ করে ফেরত দিতেই পুলিশ অফিসারটি তার ওপর সই করে ছাপ মেরে কাগজটা নিয়ে সামনেই আরেকটা কাউন্টারে যেতে বললেন ৷ সেখানে ৪০ মার্কিন ডলার দিয়ে ভিসা পেয়ে গেলাম ৷

ভিসা নিয়ে চলে আসছি, কাউন্টারের ভেতর থেকে একজন কর্মচারী বললেন, আপনার কাছে কি দশ ডলার আছে?

খুচরো দশ ডলার? না তো!

পাঁচ?

না ৷ আমার কাছে ভিসা বাবদ খুচরো ওই চল্লিশ ডলারই ছিল ৷

ঠিক আছে, কিছু মনে করবেন না ৷ ওয়েল কাম টু জর্জিয়া ৷ উইশ ইউ এ নাইস স্টে ইন জর্জিয়া ৷

এরকম ভদ্র নম্র ঘুষ প্রার্থনা আগে কোথাও দেখিনি ৷

ব্যাগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ভাবছি মানানা তবে কি বাইরে অপেক্ষা করছে, হঠাৎ দেখি সদলবলে হাজির ৷ মানানার সঙ্গে একটি যুবক, একজন ফটোগ্রাফার ও এক যুবতী ৷ যুবকের কোলে একটি শিশু ৷

মানানা ও অন্য মহিলাটি দুজনে মিলে ধরাধরি করে আমাকে একটি বাঁধানো পেইনটিং উপহার দিয়ে এয়ারপোর্টেই স্বাগত জানাল ৷ মানানার সঙ্গের মেয়েটি ৎবিলিসির দৈনিক সংবাদপত্র, আমার নিমন্ত্রণকর্তা ‘দিলিস গাজেতি’র রিপোর্টার, ফটোগ্রাফারও দিলিস গাজেতির, শিশু কোলে তরুণ মানানার ছেলে, শিশুটি তার নাতি! আরও একজন স্যুটেড বুটেড ভদ্রলোক এসেছিলেন, আমি ভেবেছিলাম ইনি হয়তো দিলিস গাজেতির ম্যানেজার বা ওই ধরনের কেউ, মানানা আর সকলের মতো এর সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিল-‘দিলিস গাজেতি’র ড্রাইভার ৷ তিনি আমার সঙ্গে করমর্দন করে আমার বাক্সটির টানা-ফিতেটি ধরে বাক্সটি টেনে নিয়ে চললেন ৷

মানানা একটা খবরের কাগজ খুলে আমার সামনে মেলে ধরল, জর্জিয়ান ভাষায় আধপাতা জোড়া একটা লেখার সঙ্গে আমার ছবি ৷ সেইসঙ্গে আমার My White Horse ও ইংরিজি ভ্রমণ-এর মলাটের ছবি দেখে বুঝলাম লেখাটা আমার সম্পর্কে ৷ ভাষা তো আর জানি না, দেখতে অনেকটা যেন ওড়িয়া বা তেলুগুর মতো ৷ মানানা বলল, এটাই ‘দিলিস গাজেতি’ ৷

সন্ধে হয়ে গেছে ৷ গাড়ি থেকে রাস্তার দুধারে ঘরবাড়ি লোকজন দেখতে দেখতে চলেছি, কেমন যেন আমাদের চন্দননগর বা বহরমপুর বা বাগবাজারের মতো পুরনো চেহারা, তফাৎ বলতে ক্বচিৎ-কখনও দুয়েকটি স্থাপত্যগর্বিত, শতাব্দীপ্রাচীন ও প্রাচীনতর অট্টালিকা ৷ কোথাও কোনও জাঁকজমক চোখে পড়ল না ৷ রাস্তায় বড় কোনও আলোঝলমল দোকান বা উৎসবমুখর মানুষের জটলাও দেখলাম না ৷ দিনটা রবিবার বলেই কি?

মানানার বাড়ি যেখানে সে এলাকাটা যেন আরও স্তিমিত ৷ বড় রাস্তার কাছেই বাড়ি, মলিন, মেরামতিহীন বহুতল বাড়ির কয়েকটি ব্লক, ব্লকগুলির মাঝখানে বদ্বীপের মতো বড় খোলা জায়গাটাও তেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয় ৷ রাস্তার ধারেই বহুতলবাসীদের টুকটাক প্রয়োজন মেটাতে ছোট্ট খুপরির মতো একটা দোকান, দুয়েকটি কাঁচা সবজি, দুয়েকটি ফলটল পাওয়া যায় ৷ একটু দূরে আরেকটি দোকানে চোখে পড়ল তিন-চার রকম মাছ চিজ ফল সব্জি রুটি ইত্যাদি নানা সামগ্রী ৷ রাস্তার ওপারে অসমাপ্ত একটি বহুতল, আয়তন দেখে মনে হয় অনেক উচ্চাশা নিয়েই বাড়িটি তৈরি হচ্ছিল, কোনও কারণে শেষ রক্ষা হয়নি ৷

মানানা আমার চোখের কৌতূহল বুঝতে পেরে বলল, সরকারি উদ্যোগে বাড়িটা তৈরি হচ্ছিল, অর্থাভাবে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে ৷ যাঁরা আগাম টাকা দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট বুক করেছিল, সরকার এখন তাদের বলছে, যে যার অংশ নিজেরাই তৈরি করে নাও ৷

মানানার বহুতলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে, চারধাপ সিঁড়ি ভেঙে লিফটে চড়ে পাঁচতলায় তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে আনন্দে গা শিরশির করে উঠল-আমি একটা জর্জিয়ান সংসারে একেবারে অন্দরমহলে চলে এসেছি ৷ প্রথমেই অভর্থনা করল একটি বিড়াল ৷ তার বিলম্বিত লয়ের ম্যাঁও শুনে মানানা আমাকে বলল, বিড়ালে তোমার অসুবিধা হয় না তো?

একেবারেই নয় ৷

ছাতা জুতো জ্যাকেট রাখবার ছোট প্যাসেজ ছেড়ে মস্ত বড় বসবার-খাবার ঘরে খাবার টেবিলের সামনে আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে গিয়ে মানানা বলল, এসো, বসে যাও ৷ খেতে খেতে কথা হবে ৷ আমাদের চিফ এডিটর মানানা কারতোজিয়া ও তাঁর স্বামীও তোমার সম্মানে ডিনারে আসবেন কথা ছিল ৷ তোমার ডিলেইড ফ্লাইটের জন্য সেটা আর হল না ৷

জর্জিয়ান শ্যাম্পেন দিয়ে আমাকে স্বাগত জানানো হল ৷ টেবিলে ‘ভারতীয় অতিথি’ ছাড়া আর আছেন মানানা, তার ছেলে, তার ছেলের ছেলে, ‘দিলিস গাজেতি’র রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার, ‘দিলিস গাজেতি’র গাড়ির ড্রাইভার ৷ এঁর পোশাকের রুচি ও পারিপাট্য তারিফ করার মতো ৷ যখনই এরপর ৎবিলিসির বাইরে কোথাও গেছি এই ভদ্রলোকই আমাদের সারথী হয়েছেন ৷

পুরো টেবিল ভরা খাবার ৷ সবই জর্জিয়ার নিজস্ব ব্যঞ্জন ৷ আমি দুয়েকটি পদ পরখ করছিলাম ৷ মানানা আমার দ্বিধান্বিত ধীরগতি ছুরি-কাঁটা সঞ্চালন দেখে পরপর কয়েকটা পাত্রে ছাগখণ্ড মেষখণ্ড গোখণ্ড ও অখণ্ড কুক্কুটের প্রতি আমার মনোযোগ আকর্ষণের বৃথা চেষ্টা করে অবশেষে একটা পাত্র থেকে সরু ডাঁটা বা শেকড়সদৃশ এক গুচ্ছ গুল্মজাতীয় কিছু আমার প্লেটে ঢেলে দিলেন ৷ এটা নাকি জর্জিয়ার আবহমান কালের একটা সর্বজনপ্রিয় আচার জাতীয় খাদ্য, আমারও নাকি ভালো লাগতে বাধ্য ৷ ডিনারের সঙ্গে জর্জিয়ার জগদ্বিখ্যাত রেড ওয়াইন দিতে না পেরে তার আপসোসেরও শেষ নেই ৷ গত কয়েকদিন তার অস্বাভাবিক কর্মব্যস্ততাতেই ঘরে রেড ওয়াইন এনে রাখতে ভুল হয়ে গেছে ৷

শেকড়জাতীয় আচার মুখে দিয়ে দেখি টকটক খেতে ৷ যুগ যুগ ধরে জর্জিয়ানদের এত প্রিয়, জিনিসটা ঠিক কী? শুনলাম এর নাম জঞ্জলি, কচি আখের ডগা বা ওইরকমই কিছুর না-রাঁধা চচ্চড়ি, তবে সঙ্গে ভিনিগার ও আরও দুয়েকটা উপাদান মেশানো ৷

সাংবাদিক মেয়েটি চটপট খাওয়া শেষ করে আমাকে বললেন, কিছু যদি মনে না করেন, আমি এসেছি আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে, কাল সকালের কাগজে বেরবে ৷ আমি কি এখনই আপনাকে প্রশ্ন করতে পারি? খেতে খেতেই আপনি উত্তর দেবেন ৷

মানানা আপত্তি করতে যাচ্ছিল, আমি তাকে বাধা দিয়ে মেয়েটিকে বললাম, শুরু করুন ৷

মেয়েটি একটু কঠিন-কঠিন দর্শন-ঘেঁষা প্রশ্ন করছিলেন, আমি কথা বলছিলাম মানুষে-মানুষে সহজ, স্বাভাবিক ভাব-ভালোবাসার প্রতি আমার আজন্ম বিশ্বাস ও নিজের গভীর হৃদয়ানুভূতি থেকে ৷ কিন্তু নানারকম সুখাদ্যের সুগন্ধে ব্যাকুল মানানার বিড়ালের ঘন ঘন ম্যাঁও-ম্যাঁও আর নতুন লোক পেয়ে মানানার দু-আড়াই বছরের নাতির নানা বক্তব্যে প্রশ্নকর্ত্রীর দর্শন ও উত্তরদাতার মানবপ্রেম বারবার বাধা পাচ্ছে দেখে আমাদের দুজনকেই পাশের ঘরে গিয়ে সাক্ষাৎকার শেষ করতে হল ৷

পরদিন সকালে মানানা সেই সাক্ষাৎকার পড়ে আমার তারিফ করায় বুঝলাম যে আমি কোনওক্রমে উতরে দিয়েছি, অন্তত খুব একটা সাপ-ব্যাঙ কিছু বলিনি ৷

মানানার বাবার নাম নোদার, ছেলের নামও নোদার ৷ নাতির নামও নোদার কি না তা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি ৷ ছেলে নাতি দুজনেই মানানাকে নাম ধরে ডাকে ৷ তার ফলে, জর্জিয়ান ভাষায় মা যে ‘তেদা’, ঠাকুমা-দিদিমা ‘বেবো’ সেকথা একজন জর্জিয়ান মা-দিদিমার সংসারে অতিথি হয়েও প্রথম দিন আমার জানার সুযোগ হল না ৷ জর্জিয়ায় বাবাকে বলে ‘মামা’ ৷ আবার, মানানার বাবার এবং জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট শেভারনাদজের জন্মগ্রাম গুরিয়ায় ‘বাবা’কে অবিকল আমাদের মতো ‘বাবা’ই বলে ৷

পরে এরকম আরও কিছু জর্জিয়ান শব্দ আমাকে শিখতে হয়েছিল, দুয়েক টুকরো জর্জিয়ান বাক্যও মুখস্থ করেছিলাম ৷ তবে, ছোট্ট ও প্রাচীন এই দেশটি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বারবারই আমার মনে হয়েছে এদেশের ভাষাটা যদি কিছুটাও শিখে আসতে পারতাম!

আমার শোবার ঘরের দেওয়ালে দেখলাম পুরনো দিনের একটা বন্দুক ৷ আমাকে কৌতূহলী দেখে নোদার সবিস্তারে যোদ্ধা জর্জিয়ানদের ঐতিহ্যের কথা শোনাল ৷

নতুন দেশে প্রথম রাতটা আমার ঘুম আসতে চায় না, অথবা ঘুমোতে ইচ্ছে হয় না ৷ অনেকক্ষণ ধরে বুক সেলফগুলোর বই দেখলাম, বেশিরভাগই জর্জিয়ান ভাষায়, কয়েকটা ইংরিজি বই নাড়াচাড়া করলাম, বন্ধ জানলার কাচের পাল্লা দিয়ে চোখে পড়ল সামনের বেশিরভাগ ফ্ল্যাটেরই আলো নিভে গেছে, আমিও এক সময় শুয়ে শুয়ে দেশটার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়বার মুখে হঠাৎ মনে হল-নোদারের স্ত্রীকে আর মানানার স্বামীকে দেখলাম না তো! বাড়িতে শুধু মা ছেলে নাতি আর একটা বিড়াল!

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ফেরিওলার ডাকে ৷ মেয়েলি গলার অনভ্যস্ত, কাঁপা কাঁপা ডাক ৷ কী ফিরি করছে, ভাষা জানি না বলে বুঝতে পারছি না, কিন্তু তার কণ্ঠের ক্লেশ স্পষ্টই কানে বাজছে ৷

আমার ঘর থেকে বেরিয়ে, মাঝের খালি ঘরটি পেরিয়ে, বসবার-খাবার বড় ঘরটার ভেতর দিয়ে বাথরুমে যাবার সময় দেখলাম মানানারা আমার আগেই উঠে পড়েছে ৷ বড় ঘরটার আরেকদিকে আরেকটা ঘর ৷ নোদার আমাকে দেখেই বলল, কামারজোবা!

তখন সকাল আটটা ৷ আমি আন্দাজে বুঝলাম এ হল গিয়ে ইংরিজি গুড মর্নিং, ফরাসি বোঁ জুর, জার্মান গুটেন টাগ, স্প্যানিশ বুয়েনস দিয়াস-এরই জর্জিয়ান সংস্করণ ৷ তাই আমিও পর পর তিনজনকেই তিনবার ‘কামারজোবা’ বলে দিলাম ৷

পনেরো মিনিটের মধ্যেই ব্রেকফাস্টের ডাক পড়ল ৷ গত রাতের সেই মোটা মোটা জর্জিয়ান রুটি, জঞ্জলি, মাখন, চিজ, ডিম আর চা বা কফি ৷

রান্নাঘরের ছোট্ট টেবিলে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে আমার আজকের কর্মসূচি শুনে নিলাম ৷ মানানা আর পনেরো মিনিটে অফিসে রওনা হয়ে যাবে ৷ নোদার তার ছেলেকে নিয়ে নিজের বাড়ি যাবে ৷ সেখান থেকে বেলা এগারোটায়, তার একটা খুব পুরনো গাড়ি আছে, সেই গাড়ি নিয়ে এসে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবে, বাড়ি দেখাবে ৷ তারপর লাঞ্চের সময় মানানার অফিসে নামিয়ে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টে চলে যাবে, সেখানে সে বিচারকের কীরকম যেন সহকারী ৷

সবাই বেরিয়ে গেলে আমি বড়ঘরের লাগোয়া আরেকটি ঘরের দরজা খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম ৷ ফিরিউলির ডাক শুনে নিচে তাকিয়ে দেখলাম মেঘলায় ঠান্ডায় মধ্যবয়সী একজন মহিলা কাপড়ের পুটলিতে বাঁধা কিছু একটা বিক্রি করার জন্য কাঁপা গলায় মৃদু হাঁক পাড়ছেন ৷ ওপর থেকে মহিলার মুখ দেখেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা ৷ রাস্তার জিনিস ফিরি করার অভ্যাস বা অভিজ্ঞতা তাঁর নেই, খুব সদ্য একাজে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছে ৷ একটা দেশের রাজনৈতিক অদল-বদলে সে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম, বৃহৎ থেকে বৃহত্তম কত যে দুঃখ-দুর্দশা, ক্ষয়ক্ষতি ঘটে যায়, কত ভাঙন, কত ভেসে যাওয়া-জনপ্রতি সেই মর্মযন্ত্রণার হিসেব কেউ কোনওদিন করে না!

ককেশাস-কৃষ্ণসাগরে বাঁধা জর্জিয়া নামের এই দেশ দেখতে এসে আমি বোধহয় এই প্রথম টের পেলাম, পাহাড় নদী সমুদ্র দেশের সৌন্দর্যচ্ছবির ফ্রেম মাত্র, দেখবার আসল ছবি হল মানুষ ৷

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘলা সকালের হতাশামাখা আলোয় মানানাদের সারিসারি আবাসনগুচ্ছ ভালো করে দেখলাম ৷ আমার সামনের দিকের বড় রাস্তা থেকে এই হাউসিং কমপ্লেক্সে আসবার দুটি পথ ৷ একটি আমার বাঁয়ে, অন্যটি ডাইনে ৷ মাঝখানে চৌকো আকারের অপরিচ্ছন্ন অপরিকল্পিত খোলা জায়গার চারপাশে একেক দিকে একটানা বহুতল বাড়ি ৷ সেই বহুতলের পাদমূলে ঘুরে ঘুরে জিনিস ফিরি করছে একদা-মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নারী ও পুরুষ ৷

নোদার তার নড়বড়ে রাশিয়ান গাড়ি নিয়ে এগারোটাতেই এসে গেল ৷ তার বাড়ি মানে তার পৈত্রিক বাড়ি, জর্জিয়ার একসময়ের অভিজাত আবাসিক এলাকায় পুরনো তেতলা বাড়ি ৷

ছেলেটি প্রায় মিউজিয়াম দেখানোর মতো করে আমাকে তার মায়ামেদুর, স্মৃতিবিধুর পৈতৃক বাড়ি দেখাল ৷ বাড়ির প্রত্যেকটি ঘরে নিয়ে গেল ৷ পিতামহ-প্রপিতামহের বহু পুরনো আসবাবপত্র, পুরনো যুগের পেয়ালা-পিরিচ, পানপাত্র, ছবি মূর্তি সবই ভারি যত্ন সহকারে দেখাল ৷ আলমারি খুলে সন্তর্পণে বের করে আনল নেপোলিয়নের রাশিয়ার যুদ্ধে পরাজয় উপলক্ষে রুশসম্রাটের কী একটা স্মারক চিত্রলিপি ৷ প্রাচীন ও প্রায়-জীর্ণ বইপত্রের মধ্যে একটা বড় মাপের মোটা বাঁধানো বই দেখে আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম ৷ জর্জিয়ার জাতীয় কবি সোতা রুসতাভেলির মহাকাব্য ‘The Knight in the Tiger’s Skin’ (বাঘের চামড়া ঢাকা নাইট) ৷ ছেলেবেলায় ‘দ নাইট ইন দ প্যান্থার্স স্কিন’ নামে এ-বইয়ের একটি ইংরিজি গদ্য-অনুবাদ আধাআধি পড়ে বিশেষ কিছু না বুঝেও গল্পটার মধ্যের বীরত্ব ও বেদনা আমাকে আলোড়িত করেছিল মনে আছে ৷ বিশেষ করে এক অপরূপ নারীর ব্যাকুল অথচ বীর হৃদয় গ্রামবাংলার এক কল্পনাপ্রবণ কিশোরকে খুব নাড়া দিয়েছিল ৷ এই সেই বই! খোদ মহাকবির দেশে, প্রায় একশো বছর আগের ইংরিজি অনুবাদে সম্পূর্ণ মহাকাব্যটি! আমি নোদারের কাছ থেকে বইটি ধার নিলাম, কথা হল, জর্জিয়ায় যতদিন থাকব, বইটি আমার শয্যাসঙ্গী হবে ৷

নোদার আমাকে বইটি সহ মানানার অফিসে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ৷ রাতে দেখা হবে নিশ্চয়ই? মা-ছেলে দুজনেই জানাল, আজ আর দেখা হবার সম্ভাবনা নেই ৷ কেননা ছেলে মায়ের বাড়িতে থাকে না, থাকে বাপের বাড়িতে ৷ আমি তো ধন্দে পড়ে গেলাম-ছেলের আবার মায়ের বাড়ি বাপের বাড়ি কী? তবে কি বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?

নোদারের বাবা, মানানার প্রথম স্বামী বছর কুড়ি আগে মোটর দুর্ঘটনায় মারা যায় ৷ নোদার তার মাকে খুবই ভালোবাসে, মায়ের বাড়িতে থাকতেও তার ভালো লাগে (বাড়িটা মায়ের বাবা প্রয়াত লেখক নোদার দুমবাদজে তাঁর বড় মেয়েকে দিয়েছেন) ৷ কিন্তু বাবার ওই গত যুগের মহিমাচিহ্নিত বাড়িটা সে প্রাণে ধরে বিক্রি করতে পারবে না বলেই ওই বাড়িতে পড়ে আছে ৷

প্রথম স্বামী, বলে কী? তাহলে দ্বিতীয় স্বামী কোথায়? এমনিতে এইসব সাংসারিক জটিলতা আমার বিশেষ নজরে পড়ে না ৷ অনেক সময় কারও সঙ্গে অনেক দিনের বন্ধুত্বের পরও খেয়াল হয় না ৷ দশ-বারো বছর ধরে যাঁকে কফি হাউসে দেখেছি, কখনও এক টেবিলে বসে আড্ডাও দিয়েছি, তিনিই যে সর্বজনপরিচিত স্বনামধন্য অমুক চন্দ্র তমুক তা আমি হঠাৎ জানতে পারি অনেক কাল পরে একদিন টিভিতে সেই মানুষটিকে ও তাঁর চলচ্ছবির নিচে লেখা তাঁর নামটি দেখে ৷ আনন্দও পাই এই ভেবে যে-ও, ইনিই তাহলে ওই বিখ্যাত লোক! আমি তো এঁকে চিনি!

নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধির কথাটা তুলতে হল, কেননা মায়ের বাড়ি বাপের বাড়ির রহস্য ভেদ হতে না হতে প্রথম স্বামী দ্বিতীয় স্বামীর প্রসঙ্গে কেমন ধন্দে পড়েছি তার একটা ধারণা করা যাবে ৷

নোদার তার গাড়ি নিয়ে চলে গেছে, মানানার অফিসের গাড়ি কোথায় কী একটা কাজে আটকে আছে, অতএব মানানার সঙ্গে ৎবিলিসির কিছুটা নিরিবিলি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চলেছি মধ্যাহ্নভোজ সারতে ৷

হাতে সময় কম, লাঞ্চের পরই যাব ভাকে ডিস্ট্রিক্টে চাভচাভাদজে স্ট্রীটে নোদার দুমবাদজে মিউজিয়ামে ৷ সেখানে থেকে যাবার কথা ‘জিউরি’ শিশু উদ্যানে ৷

হাঁটতে হাঁটতে স্বামী-সমস্যার সমাধান শোনা গেল ৷ মানানার দ্বিতীয় স্বামী ভাদিক গেছেন রাশিয়ায়, সেদেশের মস্ত বড় পর্যটনমেলায় ৷ ভাদিকের ধ্যানজ্ঞান বেলুনে চড়ে সিল্করুট অভিযান ৷ সেকালের সিল্করুটকে ওদিকে জাপান আর এদিকে জর্জিয়া পর্যন্ত প্রসারিত করে এই অভিযান হবে জাপান থেকে জর্জিয়া ৷ মস্কোর পর্যটনমেলায় বেলুন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তাঁর জরুরি কাজ আছে ৷

মানানার উপসংহার-ভাদিককে তোমার খুবই ভালো লাগবে ৷ ও হচ্ছে স্পোর্টসম্যান, সোভিয়েত আমলে খুব ভালো চাকরি করত, সাবমেরিনের কম্পিউটার প্রয়োগ বা চালনা বা ওইরকমই কিছু ওরই উদ্ভাবনা ৷

চটপট লাঞ্চ সারতে প্রেস হাউস কাফে উপযুক্ত জায়গা ৷ কাচে ঢাকা বেশ কয়েক রকম পদ বা পুরো ‘মিল’ থেকে যেটা খুশি বেছে পয়সা দিয়ে কুপন কেটে টেবিলে এসে বসে পড়লেই হল ৷ পছন্দের খাবার তক্ষুণি গরম করে দেবে ৷ দামেও সস্তা ৷

মানানা অফিসে লাঞ্চ করে, ফলে শুধু আমার জন্য নেওয়া হল আস্ত একটা মাছ (জর্জিয়ান ভাষায় এই সুস্বাদু মাছটার নাম সিগা), পাপরিকা, রসুনকুচি দিয়ে এক প্লেট বেগুনভাজা, গত রাতের মতো জঞ্জলি, আর জর্জিয়ান মোটা গোলাকার রুটি ৷ আশপাশের টেবিলে অন্যদের প্লেট দেখে মনে হল, একজনের পক্ষে একসঙ্গে এত রকম পদ একটু বেশিই ৷ তা সত্বেও দাম মাত্র ৩ ডলার, জর্জিয়ান মুদ্রায় ৬ লারি ৷

প্রেস হাউস কাফে থেকে বেরিয়ে রুসতাভেলি অ্যাভেনিউ ধরে হাঁটতে হাঁটতে, ছোট একটা রাস্তায় পড়লাম, রাস্তাটার নাম দেখলাম পেরোভস্কায়া স্ট্রিট, এটাকে আমাদের পার্ক স্ট্রীটের মতো রেস্তোরাঁ সরণি বললেই ঠিক হয়, নানা দেশের রেস্তোরাঁ আছে এখানে ৷ একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁও দেখলাম, তার চেয়ে বেশি নজর কাড়ল একটি ভারতীয় দোকান ৷ দোকান না বলে মণ্ডপ বা প্রদর্শনীকক্ষ বললেই ঠিক হয় ৷ এর মালিক জর্জিয়ার এক মহিলা শিল্পী ৷ বয়েস ষাট বা সত্তর বা পচাঁত্তর হবে হয়তো, কানে গলায় হাতে মোটা মোটা রাজস্থানি গুজরাটি লাদাখি অলংকার ৷ মহিলাটি মানানার বহুদিনের বন্ধু ৷ আমাকে জর্জিয়ান ভাষায় মিঠে গলায় বললেন (মানানা ইংরিজি করে দিল), আমরা ভারতকে ভালোবাসি ৷ ভারতীয়দের আমরা অনেকদিন আগেই মন সঁপে দিয়েছি ৷

এঁরা আমাদের দার্জিলিং চা খাওয়াতে চাইলেন ৷ আজ সময়াভাব তাই বিনা চায়েই বেরিয়ে পড়লাম ৷ পরে আরেকদিন এখানে এসে চমৎকার দার্জিলিং চা খেয়ে গেছি ৷

মানানা আমাকে নিয়ে গেল কোস্তাভা পার্কে ৷ ৎবিলিসিতে আট আসনের ছোট ছোট একরকম বাস চলে, সোজা রাস্তায় যত দূরেই যান নামবার সময় চালককে আধ লারি ভাড়া দিতে হয় ৷ এভাবেই আমরা পৌঁছে গেলাম কোস্তাভা পার্কে ৷ সেখানে পাশাপাশি দুটি প্রাচীন গির্জা, এক উদ্ভট সহাবস্থান, ধর্মে চরম উদাসীনেরও চোখে পড়বে ৷ একটা গির্জা রাশিয়ান, আরেকটা জর্জিয়ান ৷ রাশিয়ান গির্জাটি একেবারে সাদামাটা, আগাপাস্তালা এমনভাবে চুনকাম করা যে চোখের পীড়া হয়, তার ঠিক পাশেই জর্জিয়ান গির্জাটির জরা ও জীর্ণতা, স্থানে স্থানে ইট বের করা প্রাচীনতা দেখে চোখ জুড়োয় ৷ গির্জার ভেতরে ঢালাও সূক্ষ্ম দেওয়ালচিত্র কিন্তু ঢেকে দেওয়া হয়েছে ৷ তার আশ্চর্য রং রেখা রাশিয়ান চুনকাম ফুঁড়ে খুব সামান্যই ফুটে আছে ৷

কোস্তাভা পার্কে, জোড়া গির্জার পথে দেখলাম বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ ভিক্ষা চাইছে ৷ ভিক্ষা চাইবার ধরনেই বোঝা যায় এরা ভিক্ষুক নয়, পেশাদারি ভিখিরি তো নয়ই, এ কাজে এরা এতটাই আনাড়ি যে ভিক্ষে না দিলে এদের কেউ কেউ প্রায় দাবি জানানোর মতো বলে, তুমি আমাকে একটা লারিও দিতে পারছ না কেন? তবু না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলে বলে, তুমি এত কঞ্জুষ!

একটা বুড়ি হাত নেড়ে নেড়ে, আকাশে মুখ তুলে কথা বলছে দেখে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম ৷ ভিক্ষে চাইছে না, আপনমনে কাউকে কিছু বলছে!

আমি মানানাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও কী বলছে, একটু অনুবাদ করে দেবে? মানানা মন দিয়ে শুনে ইংরিজিতে বলল, এই বৃদ্ধা কী বলছে শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে ৷ বৃদ্ধা বলছে-যে জর্জিয়া আমি রেখে গিয়েছিলাম, এ জর্জিয়া সে জর্জিয়া নয় ৷ যেমনটি দেখে গিয়েছিলাম, তুমি আর তেমনটি নেই, আমি তোমাকে চিনতে পারছি না, জর্জিয়া ৷ জানো, এর কথাগুলো অনেকটা গানের মতো শোনাচ্ছে ৷ জর্জিয়ায় এরকম কোনও গান আছে বলে আমি শুনিনি ৷

চাকভাঙা ভদকা

বিখ্যাত বা কুখ্যাত রাশিয়ান ভদকার কথা সবাই শুনেছেন, রাশিয়ার সমাজজীবনে ভদকার সর্বনেশে বাড়াবাড়ি বা সরকারি কড়াকড়ি নিয়ে ভালো-মন্দ নানা কাহিনী-কিংবদন্তীও অনেক জানেন, সোভিয়েতভাঙা জর্জিয়াতেও ভদকাচ্ছন্ন পথচারী দুর্লভ নয় ৷ তবে জর্জিয়ানদের নিজস্ব ও প্রাচীন পানীয় জর্জিয়ার ওয়াইন, স্বদেশের সুরা নিয়ে তাঁদের গর্বের শেষ নেই ৷

জর্জিয়ায় আমার অন্যতম নিমন্ত্রণকর্ত্রী মানানা দুমবাদজের মা নানুলি আমাকে তাঁর জন্মগ্রাম ‘গুরিয়া’র গর্ব ‘গুরিয়া ভদকা’ দিয়ে আপ্যায়ন করলেন ৷ নানুলির স্বামী প্রয়াত সাহিত্যিক নোদার দুমবাদজের জন্মও ওই গুরিয়ায় ৷ অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ বিদেশমন্ত্রী, দুই জার্মানির মিলনে মধ্যস্থতা করেও যিনি বিখ্যাত, স্বাধীন জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট শেভারনাদজের জন্মও গুরিয়ায় ৷ এ ভদকা শুধু সেই গুরিয়াতেই হয় ৷ তৈরি হয় মৌচাক থেকে ৷ বড় করে শ্বাস নিলে নাকি মৌচাকের ঘ্রাণও পাওয়া যায় ৷

জিভের ডগায় তৃণশীর্ষে শিশিরবিন্দুপরিমাণ ভদকাস্পর্শ নিতে নিতে নানুলির জর্জিয়ানে, মানানার ইংরিজিতে এই যাদু-ভদকার মহিমা কানে যত শুনছি, প্রাণে তত বুঝছি না ৷ কিন্তু মানানার মায়ের স্নিগ্ধ সস্নেহ স্বভাবটি বিনাভাষ্যে তাঁর ভারতীয় অতিথিকে মুগ্ধ করে ৷ তাঁর ঘরোয়া আপ্যায়ন হয়ে ওঠে আমার প্রাণের আরাম ৷ কথা বলতে বলতে একেকবার উঠে যাচ্ছেন আর ফিরে আসছেন ঘরে তৈরি কেক, পেস্ট্রি বা রান্না করা কোনও না কোনও ব্যঞ্জন হাতে নিয়ে ৷

এই ফ্ল্যাটেরই একটি বেশ বড় হলঘরে নোদার দুমবাদজে মিউজিয়াম ৷ বই, ফটো, পাণ্ডুলিপি ইত্যাদিতে সাজানো একজন লেখকের জীবনকথা ৷ আমার কাছে শুধুই তথ্য, কেবলই ছবি, আমার সঙ্গী দুজনের কাছে তার চেয়ে বেশি, জীবন্ত স্মৃতি ৷

নোদার (১৯২৮-৮৪) জর্জিয়ার অতি জনপ্রিয় লেখক ৷ তাঁর গল্প, উপন্যাস, ছোটদের ছড়া, কবিতা ঘরে ঘরে পড়া হয় ৷ আরও শুনলাম, তাঁর সব উপন্যাস নিয়েই সিনেমা হয়েছে ৷ ইনিই রাশিয়ার বাইরে লেনিন পুরস্কারে সম্মানিত একমাত্র লেখক ৷

জর্জিয়ায় এখন কে কী লিখছেন, বড় কবি ও লেখক কারা আমরা কিছুই জানি না ৷ ফলে পরদিন ৯ অক্টোবর রাইটার্স ইউনিয়নে যাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় হল তাঁরা যে সকলেই বড় কবি লেখক সমালোচক, তাঁদের কেউ রাগী লেখক, কেউ তীক্ষ্ণ আধুনিক কবি, কেউ বিখ্যাত গল্পকার, কেউ গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক, কেউ ধূমায়িত আরখাজিয়ার যন্ত্রণাক্লিষ্ট কবি, মানানার দোভাষিত্বে এসব জেনে মন হায়-হায় করতে লাগল-এঁদের কোনও লেখা আমি পড়িনি! তবু, কোনওদিন এঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল শুধু সেই কথাটা মনে রাখবার জন্য আমি কয়েকজন লেখকের নাম লিখে রাখলাম-রেজো চেইসভিলি (Rezo Cheishvili), টামাস সিবৎসিভাদজে (Tamaz Tsivivadze), কেনো কালানদিয়া (Geno Kalandia), জাউর কালানদিয়া (Zaur Kalandia), মুরমান জগুবুরিয়া (Murman Zguburia), লেভান মালাজোনিয়া (Levan Malazonia) ৷

এখানেই আলাপ হল ভারতীয় সাহিত্যের পণ্ডিত নিকো কেনচোশভিসের সঙ্গে ৷ ভারতীয় অতিথিকে ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের প্রথানুগ অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের পর ভারতবিদ নিকো হঠাৎ হিন্দিতে স্বাগত জানিয়ে, হিন্দিতেই কুশলপ্রশ্ন করে আমাকে প্রায় চমকে দিয়েছিলেন ৷ তিনি নাকি সকাল থেকে শুধু আমার জন্যই এখানে এসে বসে আছেন ৷

ভারতে লেখকদের বইয়ের বিক্রি, প্রকাশনাব্যবস্থা, লেখকদের সামাজিক সম্মান, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে জর্জিয়ান লেখকদের নানা প্রশ্নের বিশদ উত্তর দিতে হল আমাকে ৷ প্রবল বন্যার সময় কুঁড়ের চালে, গাছের ডালে আশ্রয় পাওয়া মানুষ যেমন ব্যাকুল হয়ে দূর নিরাপদ দেশের মানুষের ঘরবাড়ির ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চায়, সদ্য-পরিচিত এইসব কবি-লেখকদের প্রশ্নে আমি সেই আকুলতা অনুভব করলাম ৷ দূর বিদেশে এসে বিষাদে আমার মন ভরে যায় ৷

এর পরেও অনেক বিখ্যাত কবি-লেখকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে গত দু-তিন বছরে নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে মনোনীত কয়েকজন কবি ও লেখকও আছেন, এঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার খুব মনে হয়েছে যদি বাংলা-জর্জিয়ান দ্বিভাষিক পত্রিকা বার করে বাছাইকরা জর্জিয়ান গল্প-উপন্যাস অনুবাদের ব্যবস্থা করা যেত! এভাবে সবিনয়ে এঁদের সামান্য কিছু বাড়তি অর্থোপার্জনের ব্যবস্থা করা খুব কি অসম্ভব, বা অবাস্তব?

৩. তুর্কি সীমান্তে

পরদিন সকালে চললাম জর্জিয়া-তুর্কি সীমান্তে দক্ষিণ জর্জিয়ার প্রাচীন শহর আখালসিখে ৷ আখালসিখে নামকরণ হয়েছে দ্বাদশ শতকে, নামটির অর্থ শুনলাম নতুন দুর্গ ৷ এ শহর দেড় হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ৷ খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকে জায়গাটার নাম ছিল সোমসিয়া ৷ কাছেই, আখালসিখে থেকে পনেরো-ষোল কিলোমিটারের মধ্যে রুশতাভি শহরে জর্জিয়ার মহাকবি সোতা রুসতাভেলির জন্ম ৷

আখালসিখেতে আমরা যে বাড়িতে উঠলাম, সেখান থেকে দক্ষিণে আর পনেরো কিলোমিটার গেলে জর্জিয়ার শেষ, তুর্কির শুরু ৷ আখালসিখে নানা সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত হয়েছে ৷ তুর্কিরা বারবার হানা দিয়েছে ৷ ইতিহাস বা তার সত্য-মিথ্যা মেলাইনি, শুনলাম অতীতে তৈমুর লং, চেঙ্গিস খানের মতো প্রবলপ্রতাপ যুদ্ধবাজদের বিধ্বংসী আক্রমণে দক্ষিণ জর্জিয়া কয়েকবার প্রায় গুঁড়িয়ে গেছে ৷ আখালসিখেতে অর্ধেক জর্জিয়ান, অর্ধেক আর্মেনিয়ানদের বাস ৷

ৎবিলিসি থেকে দুপুর একটায় রওনা হয়ে আখালসিখে পৌঁছতে বেলা প্রায় শেষ ৷ ৎবিলিসি থেকে এসেছি আমি আর মানানা আর সেই দিলিস গাজেতি বা ডেইলি গেজেটের সুবেশ ড্রাইভার ৷ আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এথেরির বাড়িতে ৷ এথেরির বয়স ৬০, কিন্ডার গার্ডেনের শিক্ষিকা, তাঁর মেয়ে মায়িয়া পশুচিকিৎসক, তাছাড়া স্কুলে বায়োলজি পড়ান ৷ সেখানে মাইনে দেয় না, যাতায়াতের খরচটুকুও দিতে পারে না, ফলে পশুচিকিৎসাই তার সামান্য আয়ের একমাত্র উপায় ৷ মায়িয়া রাশিয়ার খিরোভ-র কৃষি ও পশুচিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন ১৯৮২তে ৷

এক্ষুনি সন্ধে হয়ে যাবে, ফলে চট করে কিছু মুখে দিয়ে ছুটলাম আখালসিখে মিউজিয়াম দেখতে ৷ প্রতিবেশী দুটি তরুণ তাদের গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল, তারাই আমাদের মিউজিয়ামে নিয়ে গেল ৷

সেখানে দক্ষিণ জর্জিয়ার সভ্যতার ইতিহাস ও প্রাক-ইতিহাস দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে গেল ৷ আখালসিখের প্রাচীনতা এখানে যেন গায়ের ওপর নিশ্বাস ফেলে!

আজকের যা ভ্রমণসূচি তা মানতে গেলে সেটা আর দেশ দেখে বেড়ানো থাকে না, হয়ে যায় দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো ৷ সেভাবেই আমি বহু প্রাচীন কালের একটা গ্রামে গিয়েও দু-দণ্ড বসবার সময় পেলাম না ৷ প্রাচীনতা ছাড়াও এ গ্রামের আরেকটি বৈশিষ্ট্য আদ্যিকাল থেকেই গ্রামবাসীরা সবাই এক বংশের ৷ সকলের পদবিই নেবাদজে ৷ গ্রামটির নাম খ্রেলি বা হ্রেলি ৷ আমি তো চার, নাকি পাঁচ পুরুষের আবালবৃদ্ধবনিতাকে একসঙ্গে পেয়ে ফট করে ক্যামেরা টিপে দিলাম ৷ আরেক পুরুষ গাছে আপেল পাড়ছিল, ডালপালা ফল-পাতার আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে দেখে সেখানেই ক্যামেরা তাক করলাম ৷ মানানার মাধ্যমে আমার ভারতীয় পরিচয় পেয়ে তাদের উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল আপেল দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করার মধ্যে ৷ আমাদের প্রত্যেককেই দুহাত ভরে সদ্য গাছপাড়া আপেল নিতে হল ৷ আমাদের দলে আমি মানানা আর স্থানীয় দুজন তরুণ ছাড়াও ছিল মায়িয়া আর তিনা ৷ তিনা মায়িয়ার মামাতো বোন, পিসির বাড়িতে থেকে কলেজে পড়ে ৷

গাড়িতে ঠাসাঠাসি হয়ে বসে আপেল কামড়াতে কামড়াতে আমরা পৌঁছে গেলাম জঙ্গল পাহাড়ের মধ্যে ছড়ানো ছেটানো প্রাচীন সাফারা অর্থাৎ মনাস্ট্রি বা গুম্ভায় ৷ পথে দেখা হল এক বুড়ো রাখালের সঙ্গে, গরুর পাল নিয়ে গ্রামে ফিরছে ৷ কুঠার কাঁধে ঘরে ফিরছে কাঠুরে ৷ কাঠ কাঁধে মেয়ে-পুরুষ ৷ এরাও নিশ্চয়ই সকলেই ‘নেদাবজে’ ৷

খ্রেলি থেকে রাস্তাটা খানাখন্দে ভরা ৷ এত দুলুনি আর ঝাঁকুনি যে মনে হয় যেন হাতির পিঠে চড়েছি ৷ বছর ছয়েক আগে একবার নেপালে এক-শিংওলা গণ্ডারের খোঁজে হাতির পিঠে ভয়ানক ঝাঁকুনি খেতে খেতে বিশাল গাছের ডালে আচমকা মাথা ঠুকে চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম, গাড়িতে সেই গল্পটা ও সেই সূত্রে হাতির সাংঘাতিক দুলকি চালের কথা শুনে আরোহীদের মধ্যে হাসির হুল্লোড় পড়ে দিল ৷

জর্জিয়ার মানুষ ধর্মানুরাগী ৷ এঁরা অর্থডক্স খ্রিস্টান ৷ নিজেদের ধর্মকে বড় ভালোবাসেন ৷ এদেশে রাজা-রাজড়াও অনেক গির্জা মনাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করেছেন ৷

আখালসিখের ধর্মপ্রাণ জমিদার বেখাজাকেলি দশম শতকে এই সাফারা প্রতিষ্ঠা করেন ৷ বেশ কয়েকটা পাহাড়ের বিস্তারে চূড়ার খাঁজে গুহায় ছড়ানো এই মনাস্ট্রি ৷ গ্রামের চেয়ে পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে দেরিতে, এখানকার পাহাড়ে জঙ্গলে তখন সবে সন্ধ্যা নামছে, তার মধ্যেই দূর থেকে দেখলাম দুজন সুদর্শন গুম্ভশ্মশ্রুময় তরুণ সন্ন্যাসী গুহার দিকে ফিরছেন, সামনাসামনি এসে তাঁদের একজন আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন, অন্যজন কোনও দিকে না তাকিয়ে নিজের পথে ঘন জঙ্গলে ঘেরা গুহার দিকে এগিয়ে গেলেন ৷ আমার সামনের সন্ন্যাসীকে মানানা জর্জিয়ান ভাষায় আমার সম্পর্কে কিছু বলল, তার উত্তরে সন্ন্যাসীও কিছু বললেন, মানানা অনুবাদ করে দিল-সন্ন্যাসী বলছে আমার মতো মানুষকে তাঁদের দরকার ৷ আমার দিকে তাকিয়ে চমৎকার হেসে আরও যা বললেন, তার অর্থ-ধর্ম আমার মতো লোককেই চায় ৷

মানানার উত্তর, এর তো নিজস্ব একটা ধর্ম আছে ৷ সন্ন্যাসী ভারি সুন্দর হেসে বললেন, এ ধর্মহীন ৷ এরকম লোককেই ব্যাপটাইজ করা উচিত ৷ হবে নাকি?

শেষের প্রশ্নটি আমার উদ্দেশে ৷ তার অর্থও তাঁর গভীর ও স্নিগ্ধ দৃষ্টি আর নির্মল হাসিতে মানানার মধ্যস্থতা ছাড়াই আন্দাজ করে নিলাম ৷

জর্জিয়া-তুর্কির জনহীন সীমান্তে, মানুষের সমাজ-সংসার থেকে দূরে আদিম অরণ্য-পাহাড়-আবৃত এরকম একটা আশ্চর্য অচেনা সন্ধ্যায় সন্ন্যাসীর অদ্ভুত প্রশ্নে মনে আমার চকিতে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল-সন্ন্যাসী হয়ে স্থায়ীভাবে এখানে থেকে গেলে কেমন হয়!

একটাই রক্ষা, মানুষের জীবনে এরকম অত্যুচ্চ অদ্ভুত কিছু ভাব বা তার আনন্দ-বিষাদ বুদ্বুদের মতো আসে, আবার চলেও যায় ৷

ৎবিলিসি থেকে সারথী সহ আমরা তিনজন এসেছি, আখালসিখেতে এসে দেখলাম আরও তিনজন আগেই এসেছে ৷ একটি যুবকের নাম মিন্দিয়া ৷ অন্য দুজন মেয়ে ৷ পরে বুঝলাম, আখালসিখেতে মানানারা নিজেদের অফিসের কাজে এসেছে, সেই সুযোগে আমাকে নিয়ে এসেছে আখালসিখে দেখাতে ৷ মায়িয়ার মা এথেরির বাড়িতে সব ঘরেই দু-তিনজনের থাকার ব্যবস্থা, তার মধ্যেই আমাকে আলাদা একটা ঘর দিয়েছে ৷ জর্জিয়া বছর দশেক আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে নানা অসুবিধার মধ্য দিয়ে চলেছে ৷ বিদ্যুৎ সংকট তার অন্যতম ৷ আখালসিখেতে দিনেরবেলা বিদ্যুৎ দেওয়াই হয় না ৷ সাধারণত সন্ধে ৮টায় আলো আসে ৷

আটটার আগেই বাড়ি ফিরে বন্ধ টিভির সামনে খাবার টেবিল ঘিরে সকলে মিলে আড্ডা দিচ্ছি, তিনা দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে ৷ বাথরুমের সামনে আরেকটা মোমবাতি ৷ বাথরুমে ড্রামে বালতিতে গামলায় জল ধরা আছে, এমনকী ছোট বাথটবেও জল ধরে রেখেছে ৷ সাবান দিয়ে হাত ধোবার সময় যতই কেন না-না করি, প্রতিবারই তিনা এসে মগে করে জল নিয়ে দুহাতের পাতায় ঢেলে দেবে ৷ এর মধ্যেই তিনা আর মায়িয়া মিলে টেবিলে ডিনার দিয়ে গেছে ৷ মায়িয়ার মা স্যুপ পাঠিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছেন ৷ মিন্দিয়া বোধহয় এদের কিছুটা ঘনিষ্ঠ, সে উঠে গিয়ে অন্ধকারেই দুবোতল ওয়াইন নিয়ে এসে গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে দিল ৷ তিনার যাতায়াত খুবই নিঃশব্দ, শুধু বার বার এঘর ওঘর রান্নাঘর করে অতিথিদের সব রকম প্রয়োজন মেটাচ্ছে ৷

স্বাদে ও উপকরণে অবিকল তিব্বতি মোমোর মতো একটা জর্জিয়ান খাবার আছে, ভেতরে শুয়োরের মাংসের পুর দেওয়া, দেখতে বাংলার সুচারু সন্দেশের মতো গোলাকার ও নকশা কাটা ৷ দোকানে বাজারে সর্বত্র পাওয়া যায়, বাড়িতে এনে শুধু জলে সেদ্ধ করে নিলেই হল ৷ তিনা দুহাতে দু প্লেট এই জর্জিয়ান মোমো টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, কফি দেব, না চা?

মেয়েটির বাড়ি বোরজোনেতে, আখালসিখে আসবার সময় বোরজোনে পথে পড়েছিল, ওখানকার মিনারেল ওয়াটার খুবই বিখ্যাত ৷ বোতলবন্দী সেই ঝরনার জলের নামও বোরজোনে, ফ্রান্সের এভিয়াঁর জলের নাম যেমন ‘এভিয়াঁ’ ৷ ‘বোরজোনে’ ‘এভিয়াঁ’র মতো জর্জিয়ার সেরা প্রাকৃতিক মিনারেল ওয়াটার, তবে এদের টেকনোলজির অভাবে ও রপ্তানির নিরুদ্যোগে ‘বোরজোনে’ ‘এভিয়াঁর’ মতো জগদ্বিখ্যাত নয় মোটেই ৷

তিনা বোরজোনে-এর মেয়ে বলেই বোধহয় বোরজোনে-জল নিয়ে তার এত উচ্ছ্বাস ৷ এই জলের স্বাদ-গন্ধের বেশিষ্ট্য বুঝিয়ে দিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে এর আরেকটা গুণ শোনাল-খুব বেশি মদ খেয়ে কারও হ্যাং ওভার হলে নাকি বোতল-বোতল বোরজোনে খাইয়ে তার হ্যাং ওভার কাটানো হয় ৷

আমি গ্লাসে বোরজোনে ঢেলে নিয়ে ঘুমের ওষুধ খেতে যাচ্ছি দেখে তিনা বলল, মিনারেল ওয়াটার দিয়ে ওষুধ খাওয়া ঠিক নয় ৷ ওষুধে অনেক রাসায়নিক জিনিস থাকে, সবই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে থাকে, খনিজ জলেও নানারকম রাসায়নিক থাকে ৷ আমাদের ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসরের মুখে আমি এটা শুনেছি ৷

তিনা আখালসিখের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ে, চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী, আর একবছর পরে আইনের স্নাতক হবে ৷ বোরজোনেতে তার মা-বাবা আছে, তাদের বাড়ির ঠিক পিছনেই বোরজোনে ন্যাশনাল পার্ক, সেখানেই ঝরনা থেকে বোতলবন্দী করা হয় ‘বোরজোনে’ ৷

বোরজোনে আর আখালসিখের মধ্যে দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার ৷ কিন্তু তিনার মতে দুটি জায়গার মধ্যে তফাত অনেক ৷ প্রথমত, একই ভাষা হওয়া সত্বেও উচ্চারণের পার্থক্য ৷ বোরজোনেতে ঠান্ডা বেশি, আখালসিখেতে অনেক কম ৷ তিনা ইংরিজি উচ্চারণে ‘টিনা’, জর্জিয়ানে থিনা, তিনার মা ডাকেন থাতো ৷ তার মায়ের নামও মানানা ৷

আলো এল রাত প্রায় সাড়ে নটায় ৷ টিভিতে জর্জিয়া-ইতালির বিশ্বকাপের ফুটবল খেলা চলছে ৷ দুবছর আগে, ফ্রান্সের লোভালোয়ায় একটি ফরাসি পরিবারে টিভিতে ফ্রান্স-ব্রাজিলের ওয়ার্ল্ড কাপের ফাইনাল দেখেছিলাম ৷ ফ্রান্স সেবছর ওয়ার্ল্ড কাপ জিতে নেয় ৷ ফুটবলের দেশ ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ৷ আমার গৃহকর্ত্রীর মতে, আমার উপস্থিতির জন্যই হয়তো ফ্রান্স জিতেছে ৷ আখালসিখেতে আমার উপস্থিতিতেই ইতালি প্রথম গোল দিল ৷ আমি শুতে চলে গেলাম ৷ পরদিন সকালে উঠে শুনি জর্জিয়া ২-০ গোলে হেরেছে ৷ একমাত্র সান্ত্বনা, দ্বিতীয় গোলটিও প্রথমটির মতো পেনাল্টি কিকে ৷

একটু পরেই দুটি ছেলে এল, ২২-২৪ বছরের ৷ একজন তিনার দাদা, আরেকজন নিজেই নিজের পরিচয় দিল-তিনার ব্রাদার-ইন-ল ৷ শুনে তিনা বলল, ও একটা পাগল, ও আমার কাজিন ৷

পরে জানলাম এতজন অতিথির থাকার ব্যবস্থা করতে কুমারী তিনার ‘এই স্বঘোষিত দেওরটি’ কাল নিজের ঘর ভারতীয় অতিথির জন্য ছেড়ে দিয়ে বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল ৷ আরও পরে মানানার কাছে শুনেছি অফিসের কাজে যখনই তাদের আখালসিখেতে আসতে হয় এই বাড়িতে ওঠে, পেয়িংগেস্ট হিসেবে ৷ থাকা-খাওয়ার সব দায়িত্ব এথেরিদের ৷

একটু পরে আমাকে জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাবার দায়িত্ব মায়িয়া আর তিনার ঘাড়ে চাপিয়ে মানানা, মিন্দিয়া ও অন্য দুজন নিজেদের কাজে বেরিয়ে গেল ৷ শুরু হল আমাদের পায়ে হেঁটে শহর পরিক্রমা ৷ কথা হয়েছে দুপুরের খাওয়ার পর মানানারা এসে আমাকে নিয়ে যাবে দূর পাহাড়ের ওপর দারুণ একটা জায়গায় (যাওয়া হয়নি তাই নামটাও লেখা হয়নি) ৷

আখালসিখের বাজারে আমাকে যে দেখে সেই এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে ৷ কেউ খেতে দেয় ঘন মধু, কেউ দেয় আঙুরের থোকা, কেউ দিচ্ছে মুলো গাজর ওলকপি ৷ আমি, বলতে কী, বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি ৷ সকলেই দেখছি মায়িয়া আর তিনার কাছে আমার ভারতীয় পরিচয় জেনে আমার সম্পর্কে নানা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে ৷ ভাষা তো বুঝছি না, কিন্তু হৃদয়ের ভাব আসলে রঙের মতো, পৃথিবীর সব দেশেই তা এক ৷

এত আন্তরিকতা, এমন আপ্যায়নের রহস্য ভেদ করল মায়িয়া ৷ আসলে হয়েছে কী, অখণ্ড সোভিয়েতে যেমন খণ্ড জর্জিয়ায়ও তেমনই সবাই রাজকাপুরের অন্ধ ভক্ত ৷ বহুকাল আগে রাজকাপুর জর্জিয়ায় এসেছিলেন, তাঁর অনেক সিনেমা এদের মুখস্থ, আমি সেই রাজকাপুরের দেশের লোক, বোধহয় স্বাধীন জর্জিয়ায় প্রথম ভারতীয় অতিথি, আমি তাদের আপনজন হব না তো কে হবে? বাজারের মধ্যে আমার জন্য তো তারা কিছুই করতে পারছে না ৷

তারা মুলোটা কলাটা কপিটা দিচ্ছে, দুহাতে কত আর নেওয়া যায়-তিনা-মায়িয়ার হাতে আর ধরছে না ৷ মায়িয়া কোত্থেকে একটা প্লাস্টিকের বড় ব্যাগ জোগাড় করে ফেলল ৷ এর পর যে-ই কিছু দিতে চাইছে, মায়িয়া ব্যাগটার মুখ ফাঁক করে তার দিকে বাড়িয়ে ধরছে, দাতাও আশ মিটিয়ে তার দানসামগ্রী সরাসরি ব্যাগে ফেলে দিচ্ছে ৷

কী ধরনের খাবার আমার পছন্দ তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও গবেষণার পর ঠিক হল একটা কোনও কাফেতে শুকনো সামান্য কিছু খেতে পেলেই আমি খুশি হব ৷ রাস্তার ধারে একটা কাফেতে বসে মায়িয়ার জর্জিয়ানে আর তিনার তাৎক্ষণিক ইংরিজি অনুবাদে প্রশ্ন হল- হাজাপুরি আমার পছন্দ কি না ৷ জর্জিয়ার সর্বজনপ্রিয় এই হাজাপুরি নানা ধরনের হয় ৷ আমিই চাররকম ‘হাজাপুরি’র কথা জানি ৷ তবে হাজাপুরির প্রধান উপকরণ মাখন আর চিজ ৷ থান ইটের মতো আকার, মাখনে চুবচুব করে ভাজা একেকটা পরোটার ওপর পুরু চিজের আস্তরণ ৷ তারপর আবার পরোটা, আবার চিজ ৷ আবার পরোটা, আবার চিজ-সে এক ভয়াবহ ব্যাপার ৷ নৌকোর আকারে অন্য ধরনের হাজাপুরিও আছে ৷ যাইহোক হাজাপুরিতে আমার ইতস্তত ভাব দেখে তিনা টেবিলের মেনু থেকে দুয়েকটি পদ ইংরিজি করে দিল ৷ তার থেকে চিজ মাখন ছাড়া একটা শুকনো পরোটা জাতীয় খাবার বাছলাম ৷ ইতিমধ্যে মায়িয়া তার বাজারের ব্যাগ নিয়ে উঠে গিয়েছিল ৷ একটু পরে ফিরে এল, তার পিছনে একজন পরিচারিকা (ইনিই এই কাফের মালকিন), বাজারের সেই গাজর মুলো ওলকপি কেটে প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে ৷ সব্জিগুলোর সজীব লাবণ্যে মুগ্ধ হই ৷

খেতে খেতে মায়িয়ার গল্প শুনি ৷ কিছুটা মায়িয়ার মুখে, বেশিটাই তিনার মুখে ৷

মায়িয়া যখন রাশিয়ায় পশুচিকিৎসার ছাত্রী, তখন একজন সিনিয়র রুশ ডাক্তারি ছাত্রের সঙ্গে তার গভীর ভালোবাসা হয় ৷ গোল্ড মেডেল পেয়ে ডাক্তারি পাশ করে ছেলেটির বড় ডাক্তার হবার ব্যস্ততায় বছরের পর বছর তাদের বিয়েটা কেবল পিছতেই থাকে ৷ ওদিকে লেখাপড়া শেষ করে মায়িয়াকে জর্জিয়ায় তার বাড়িতে ফিরে আসতে হয় ৷ সেখান থেকেই মায়িয়ার বহু চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত যখন শুভদিন স্থির হল, আখালসিখেতে তার বিয়ের পোশাকও তৈরি হয়ে গেছে, ঠিক তখনই রাশিয়া জর্জিয়া দুটো আলাদা দেশ হয়ে গেল ৷ মায়িয়াকে বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হল তার জন্মভূমি জর্জিয়ায় ৷ ছেলেটিও কিছুতেই তার দেশ ছাড়বে না ৷ তিনা যোগ করল, কাল ডিনারের আগে তুমি সেই ছেলেটির ছবি দেখেছ মনে আছে?

মনে পড়ল, মোমের আলোয় একটা অ্যালবামে মায়িয়া তার নিজের, সেই ডাক্তারের ও একসঙ্গে দুজনের অনেক ছবি দেখিয়েছিল ৷

মায়িয়া-তিনা বাড়ি গিয়ে খাবে, শুধু আমাকে খাওয়াবার জন্য এখানে এসেছে ৷

চিজ-মাখনহীন গরম পুরু পরোটাও এসে গেল ৷ ভেতরে ছুরি চালাতেই প্লেটই বুঝি ভেসে যায়! গলানো মাখন নাকি? তিনা সান্ত্বনা দেয়, মাখনও নয়, চিজও না, পরোটার পেটে ভরা আছে গরুর চর্বি, চারদিক থেকে পরোটার দেওয়াল দিয়ে এটা আটকানো ছিল, ছুরি চালালে গলানো চর্বি তো জলের মতো বেরিয়ে আসবেই, খেয়ে দেখো, চমৎকার! এটা চমৎকার সে বিষয়ে সামান্যতম সংশয় প্রকাশ না করে শুধু জানালাম বাজারের লোকের ভালোবাসার উপহার তো আর নষ্ট করা যায় না, সেগুলো খেয়ে এটা আর খেতে পারব না ৷ সুস্বাদু গাজর মুলো ওলকপি দিয়ে ভারি তৃপ্তি করেই মধ্যাহ্নভোজ সারা হল ৷ মায়িয়া গেল মানানার খোঁজে ৷ তিনা আমাকে নিয়ে শহরের রাস্তায় পার্কে ঘুরে বেড়াতে লাগল ৷

রাস্তায় মাঝেমাঝেই চোখে পড়ছে তরুণীরা তিনাকে কখনও পষ্টাপষ্টি, কখনও আড়চোখে দেখছে ৷ এভাবে তাকে দেখার কারণ কী? আমি তিনাকে কথাটা বলতেই তার চটজলদি উত্তর-ওরা আমাকে দেখছে না, মাই ডিয়ার, ওরা দেখছে তোমাকে!

নির্দিষ্ট জায়গাতেই মানানাদের সঙ্গে দেখা হল ৷ রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ, অতএব দূর পাহাড়ে যাওয়া হবে না ৷ শুনলাম তার বদলে আমার জন্য আখালসিখেতেই একটা বড় রেস্তোরাঁয় ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে ৷

মায়িয়া আর তিনার হেফাজত থেকে আমাকে ফেরত নিয়ে সবাই মিলে গাড়িতে উঠে পড়া হল ৷ তিনা বাড়ি যাবার সময় বলল, আলো থাকতে থাকতে ফিরে এসো, তোমার সঙ্গে আমার একটা ফটো তুলতে চাই ৷

তোমার কয়েকটা ছবি তো তুলেছি ৷ এক মিনিট দাঁড়াও, আরেকটা তুলে দিচ্ছি ৷

তোমার সঙ্গে তুলতে চাই ৷

মিন্দিয়াকে বলছি, ও ছবি তোলে, এখনই তুলে দেবে ৷

বাড়ি গিয়ে পোশাক বদলাব, সেই পোশাকে ছবি তুলব ৷

এখানে অনেক সময় ডিনার দিনের আলো থাকতে থাকতেই হয়ে যায় ৷ সেকথা ভেবে তিনাকে আমি অভয় দিলাম ৷

কাল যখন এখানে আসি, তখন কথা ছিল আজই ৎবিলিসি ফিরব, কাল বিকেলে ৎবিলিসি টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতাদেবার কথা ৷ আজ সকালে মানানা জানাল, আজ ফেরা সম্ভব হবে না, কাল সকাল সকাল বেরিয়ে সোজা টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে যাব ৷

ডিনারের পর যখন মায়িয়াদের বাড়ি পৌঁছলাম, তখন আলো একেবারে মুছে যায়নি ৷ কিন্তু পথেই ঠিক হয়েছে আজই আমাদের ৎবিলিসি ফিরতে হবে ৷ ফলে ঘরে ঢুকেই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে আসছি, কোনও ঘরেই তিনাকে দেখলাম না ৷ চলে আসার সময় বলে আসাও হল না ৷ সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখি তিনা ভারি সুন্দর পোশাকে সেজে বাড়ির সামনে গোধূলির আলোয় দাঁড়িয়ে আছে ৷ মানানারা তাড়া দিল, খুবই দেরি হয়ে গেছে, পথও কম নয় ৷

হঠাৎ এথেরি এসে বললেন, তোমার আজ যাওয়া চলবে না, দুটো দিন থেকে যেতে হবে ৷

মানানা কাল ৎবিলিসিতে আমার কর্মসূচির কথা বলতে এথেরির উত্তর-তুমি গিয়ে সেটা দুদিন পিছিয়ে দাও ৷

তিনা এগিয়ে এসে হেসে বলল, তুমি থেকে যাও ৷ তোমাকে আমি আখালসিখের ইতিহাস শোনাব ৷

আমারও ইচ্ছা, থেকে যাই, মানানার মত কী? মানানার সম্পূর্ণ অমত ৷ আরও কে কে নাকি আজ মানানার মোবাইল ফোনে আমার সঙ্গে দেখা করবার সময় চেয়েছেন ৷ মানানা তাঁদের সময় দিয়েছে ৷ এখন আর তা বাদ দেওয়া যায় না!

গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, মায়িয়া প্রায় দৌড়ে এসে আমাকে কাগজে-মোড়া কী একটা দিয়ে বলল-এটা তোমাকে আমাদের উপহার ৷ তারপর জর্জিয়ান ভাষায় রুসতাভেলির একটা বহুমূল্যবান রাজ-সংস্করণ দেখিয়ে বলল, এটা তুমি নিলে আমি আনন্দ পাব ৷

বইটা জর্জিয়ান ভাষায় বলে নিলাম না ৷ ৎবিলিসিতে ফিরে কাগজে মোড়া উপহার খুলে দেখি নকশা-কাটা ভারি রুপোর চামচ! মানানা বলল, জর্জিয়ানরা বিশিষ্ট অতিথিকে এরকম রুপোর চামচ উপহার দেয় ৷ এ আমাদের বহু প্রাচীন রীতি!

৪. ইউক্রেনের নুন

বাড়ি ফিরে দেখা হল মানানার স্বামী ভাদিকের সঙ্গে ৷ দরজা খুলেই মানানাকে শশব্যস্ত আলিঙ্গনে চুমু খেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে এক গালে চুমু দিল ৷ জর্জিয়ায় ইউরোপের মতো দুগালের বদলে এক গালে চুমু দেওয়াই রীতি ৷ আমিও ভাদিকের গাঢ় বলিরেখা আঁকা গালে অনভ্যস্ত চুমু দিলাম ৷ ও আজই রাশিয়া থেকে ফিরেছে ৷ ভাদিকের স্বপ্ন বেলুনে চড়ে সিল্ক রুট অভিযান ৷ মস্কোর পর্যটন মেলায় গিয়েছিল বেলুনের কলকৌশল বুঝতে ৷

ডিনার টেবিলে ম্যাপ খুলে ভাদিক আমাকে তার স্বপ্নে ওড়ার আকাশপথ দেখাতে ব্যগ্র হয়ে পড়ল ৷ বছর পাঁচ-ছয় আগে মধ্য এশিয়ার সিল্ক রুট ধরে কষ্টসাধ্য অভিযানের সঙ্গী হয়েছিলেন চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ, তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা ও ছবি তখন ‘ভ্রমণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, পুরো অভিযান নিয়ে তাঁর পাঁচ ঘণ্টার তথ্যচিত্র ‘ডিসকভারি’ চ্যানেলে দেখানোও হয়েছিল ৷ ফলে ভাদিকের সঙ্গে তার স্বপ্নের অভিযানে আমি সহজেই সামিল হয়ে গেলাম ৷

সেটা একদিক থেকে ভালোই হল, কেননা ডিনার বলতে সেই প্রথম সন্ধ্যার ডিনারের ভুক্তাবশিষ্ট, যদিও পরিমাণে কম নয় ৷ অতএব, আমার ভাগেই বলি আর ভাগ্যেই বলি সেদিনের সেই জঞ্জলি চিবনো ৷

আমার দুর্দশা গৃহকর্ত্রীর দৃষ্টি এড়ায়নি, কিন্তু এত রাতে, এত পথের ক্লান্তিতে তিনিই বা কী করবেন!

বোধহয় রাতের সেই ক্ষতি পূরণ করতেই পরদিন সকালে মানানা পেঁয়াজ-টোমাটো-চিজ দিয়ে স্টাফড ওমলেট বানিয়ে প্রথমদিনের জর্জিয়ান রুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে দিয়েছে ৷ বলল, সে এই স্পেশ্যাল ওমলেট বানিয়েছে ইউক্রেন থেকে ভাদিকের আনা কালকের স্পেশাল নুন দিয়ে ৷ খিদে ভালোই পেয়েছিল, ওমলেট এক টুকরো মুখে দিয়ে মনে হল ইউক্রেনের নুনে নোনা স্বাদটা যেন নেই-ই, মুখে শুধু মিহি বালি টের পাচ্ছি ৷ খুবই বিশেষ ধরনের লবণ সন্দেহ নেই, হয়তো মানানার হাই ব্লাড প্রেসারের পক্ষে উপকারী, হয়তো খুবই দুর্লভ, জোর করেই তিন-চার টুকরো ওমলেট খেয়ে ফেললাম ৷ নোনতা স্বাদ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে এরকম আশ্চর্য লবণের কথা আগে কোথাও শুনিনি বা পড়িনি ৷

আমার মুখের চেহারা ঠিক কীরকম হয়েছিল জানি না, মানানার চোখ পড়তেই কাছে এসে কাঁটায় বিঁধে এক টুকরো ওমলেট মুখে দিয়ে এক লাফে সিঙ্কের কাছে গিয়ে থু থু করতে লাগল ও বার বার জল মুখে নিয়ে কুলকুচি করে মুখ পরিষ্কার করতে করতে বলল, তুমি কি পাগল? এতক্ষণ এই বালিভরা ওমলেট খেয়ে যাচ্ছ?

তারপর চেঁচিয়ে ডেকে ভাদিককে এই মারে তো সেই মারে! ইউক্রেন থেকে শিশি ভরে বালি বয়ে এনেছ কেন?

ভাদিক গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে যা বলে গেল তার অর্থ-সে যখন কিয়েভ থেকে ট্রেনে উঠছে, তার দাদা স্টেশনে এসেছিল তাকে বিদায় জানাতে ৷ দাদাই তাকে এই ইউক্রেনের নুন দিয়েছে ৷ ভাদিক তো নুনই শুনেছে ৷ বালি হতে যাবে কেন? তার দাদাই বা খামোখা কেন তাকে বালি দেবে? নুন ছাড়া এ আর অন্য কিছু হতেই পারে না ৷

মানানা শিশি উল্টে সবটা টেবিলে ঢেলে দেখাল-বিশুদ্ধ সাদা বালি!

মানানার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, ড্রাইভার নিচে গাড়িতে বসেই মোবাইলে জানিয়েছে সে যথাসময়ে এসে গেছে, ফলে আমার খাওয়া হল না বলে মানানা খুব দুঃখ করল ও ভাদিককে আদেশ ও নির্দেশ দিল, আমাকে সে যেন আজ ৎবিলিসি ঘুরিয়ে দেখায় ও ভালো কোনও রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করায় ৷

আমাকে বলে গেল, ভাদিকের দেশ ইউক্রেন হলে কী হবে, জর্জিয়া সম্পর্কে ওর জ্ঞান আমার চেয়ে অনেক বেশি ৷ তাছাড়া ও খুব ভালো গাইড ৷

ভাদিক সারা দুপুর আমাকে ভারি যত্নে ও আগ্রহে ৎবিলিসির নানা দ্রষ্টব্য দেখিয়ে বেড়াল ৷ প্রথমেই তার সঙ্গে একটি প্রশস্ত দোকানে ঢুকে জর্জিয়ার বহুকালের প্রচলিত নিজস্ব মিষ্টি পানীয় এক গ্লাস খেয়ে আমার প্রাণ জুড়ল ৷ আর চোখ জুড়ল দোকানের দেওয়াল ও সিলিংয়ের দুর্দান্ত রঙিন মোজাইক আর ধবধবে সাদা ইউনিফর্ম পরিহিতা বিক্রয়মহিলার সুশ্রী হাসিমাখা মুখ দেখে ৷

দিদি মাদলোবা

মানানার স্বামীর পুরো নাম ভvাদিমির মালোভিচকো, ডাকনাম-রুশ উচ্চারণে ভাদিক, জর্জিয়ান জিভে ভাজিক ৷ পেশাদার গাইডের মতো সে আমাকে নতুন-পুরনো ৎবিলিসি তন্নতন্ন করে ঘুরিয়ে দেখায় ৷ এই শহরে সোভিয়েত আমলের ভালোমন্দ, সোভিয়েত ভাঙনের সুখ দুঃখ শোনায় ৷

সবশেষে নিয়ে গেল বাজারে ৷ এখানেও ভারত থেকে এসেছি শুনে মধু ও খাবার বিক্রেতারা একটার পর একটা শিশি থেকে মস্ত বড় ছুরির ডগায় মধু তুলে আমার হাতের চেটোয় মাখিয়ে দিচ্ছে চাখবার জন্য ৷ নানারকম চিজ আর সসেজ মোটা রুটি দিয়ে মুড়ে নিজেরাও খাচ্ছে, ছুরি দিয়ে কেটে আমাকেও খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করছে ৷ আখালসিখে-এর বাজারে অনেক দোকানির অনেক খাবারের অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছি ৷ এখানে আমাকে শেষ পর্যন্ত রুটিতে মধু ঢেলে খেতেই হল ৷ এরকম সুস্বাদু সুঘ্রাণ চাকসুদ্ধ মধু এর আগে আর কোথাও খাইনি ৷ চাকও চিবিয়ে খাওয়ার কে জানত! এদের অবুঝ পীড়াপীড়িতে এত খেয়ে ফেললাম যে সেদিন মানানার নির্দেশমতো ভালো রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্নভোজের আর চেষ্টাই করা গেল না ৷ যদিও মানানা এজন্য ভাজিকের পকেটে বেশকিছু ‘লারি’ গুঁজে দিয়েছিল ৷

বাজার দেখে চলে আসার সময় সকলেরই এক কথা-ভারত থেকে কেউ আর আসে না, তুমি বারবার জর্জিয়ায় এসো ৷ ইংরিজি করে দিল ভাজিক ৷ জর্জিয়াকে ওরা বলে শাখার্ৎবেলো ৷

মাদলোবা, দিদি মাদলোবা ৷ নাখোয়ামদিস! (ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ ৷ বিদায়!)

কথাটা মুখস্থ বললেও, বলি আসলে অন্তর থেকে ৷

আমি দেখেছি যেসব দেশে চাষবাস আর পশুপালন প্রধান জীবিকা সেসব দেশের মানুষ বানিয়ে কথা বলতে পারে না, তাদের মনে যা, মুখেও তাই ৷ এরকম মনের মানুষ আমি বড়ই ভালোবাসি ৷

শাখার্ৎবেলোর সংকটে

এই পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কোন তিনটি জিনিস আমি সর্বদা অক্ষত দেখতে চাইব? সবুজ অরণ্য, সুনীল আকাশ আর মানুষের সোনালি হৃদয় ৷ ৎবিলিসি টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীদের একটি প্রশ্নের এই নাকি ছিল আমার চটজলদি উত্তর ৷

আমার সেদিনকার বক্তৃতাও বক্তৃতা-পরবর্তী প্রশ্নোত্তর জর্জিয়ান দৈনিক সাপ্তাহিক থেকে মানানা ইংরিজি করে দিয়েছিল, পড়ে আমি অবাক হয়েছিলাম বক্তব্যের গুরুত্বে না, দৈর্ঘ্যে ৷

অতক্ষণ ধরে অতরকম কথা কী করে বলতে পেরেছিলাম জানি না ৷ হয়তো শ্রোতাদের ভিড় ও মুগ্ধতাই তার কারণ ৷ বক্তৃতার শুরুতেই আমার মুখে ‘মেগো ব্রেবো, কামারজোবা!’ (বন্ধুগণ, জয় হোক!) শুনে হল-ভর্তি শ্রোতাদের আচমকা প্রবল হাততালিতে আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেছি ৷ কাগজে সেদিনের বক্তৃতার লম্বা বিবরণ বেরিয়েছিল, একটা সাপ্তাহিকের সাক্ষাৎকারে এই মুখবন্ধও ছিল যে ‘ভারতীয় এই লেখক-সাংবাদিক-ভ্রামণিক আমাজনের তীর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তার কিছুদিন পরেই এসেছেন জর্জিয়ায়, এখন জর্জিয়ার নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে এ-দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সমাজ দেখে বেড়াচ্ছেন ৷ এই মুহূর্তে মানানা দুমবাদজের দোভাষিত্বে আমরা ভারত ও জর্জিয়ার নানা প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথা বলছি ৷’

ঘণ্টাখানেকের বক্তৃতার পর প্রশ্নোত্তরের পালা ৷ সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম, কারগিল, পোখরান, প্রধানমন্ত্রী কেন বিয়ে করেননি ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন ৷ দুঘণ্টা ধরে প্রশ্নোত্তরের মধ্যে একটা প্রশ্ন আমার মনে দাগ কেটেছিল-জর্জিয়ার প্রবল এই সংকটের দিনে কী করে নিজেদের সাহিত্য সংস্কৃতি ঐতিহ্য ধরে রাখবে তরুণ সম্প্রদায়?

দেশে যেকথা মুখ ফুটে বলতে পারতাম না, বিদেশে ফট করে সেকথা বলে দিলাম-আপনাদের স্বপ্নশক্তি আর সংকল্পশক্তি দিয়ে ৷ আমার কানে গেল, আমি আরও বললাম-পৃথিবীতে এমন কোন দেশ আছে যেখানে কোনও সমস্যা নেই, এমন কোন যুগ গেছে যেখানে কোনও সংকট ছিল না? শাখার্ৎবেলো নিয়ে আপনাদের স্বপ্ন আর তার ঐতিহ্যে আপনাদের অনুরাগ আঁকড়ে থাকুন, একদিন নিজেদের আবার ফিরে পাবেনই ৷

টিভির খবরেও এটা দেখানো হল ৷

অচিন দেশে বেড়াতে এসে এমন অপ্রাপ্য প্রচারে যত না সঙ্কোচ, তার চেয়ে বেশি রোমাঞ্চ হয় ৷ সমগ্র জর্জিয়াভ্রমণেই এরকম কাগজে টিভিতে সংবাদে-সাক্ষাৎকারে বার বার প্রদর্শিত হয়েছি ৷ হয়তো আমাকে ভুল করে ভারতের বড় কোনও লেখক-টেখক ভেবেছে, অথবা হয়তো দেশটা ছোট বলে ছোট মাপের কাউকেও এরা ছোট মনে করে না, অতিথি মাত্রই তো এদেশে বরণীয়! তবে এসবের পিছনে মানানার কারসাজিও থাকতে পারে ৷

রেজোর ঠাকুমার বাড়ি

ইউনিভার্সিটিতে আমার বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছিলেন নাট্যকার রেজো ক্লদিয়াশভিলি ৷ এমন স্বভাবপরোপকারী ভালো মানুষ আজকাল চট করে দেখা যায় না ৷ আমার সঙ্গে দুদিনেই তাঁর গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল ৷ প্রথমদিন মানানার মধ্যস্থতায়, পরে তার ইংরিজিনবিশ মেয়ের দোভাষিত্বে ৷

রেজো আমাকে একদিন ট্যাক্সিতে, একদিন বন্ধুর গাড়ি ধার করে ৎবিলিসি ঘোরাল ৷ এবছর তিবিলিসোবা বা ৎবিলিসি উৎসবের দিন পড়েছে ২৯ অক্টোবর, অক্টোবরের শেষ রবিবারই প্রতিবার এই উৎসব হয়, আমি চলে যাব ২৭ অক্টোবর, ফলে শহরের মধ্যেই আলাদা একটা গ্রামের মতো জায়গায় রেজো আমাকে নিয়ে গেল, এখানেই ৎবিলিসি উৎসব হয়, এখানে জর্জিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের রীতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আলাদা আলাদা বাড়ি ও প্রাঙ্গণ তৈরি করা রয়েছে ৷ রেজো নিয়ে গেল তার ঠাকুমার তৈরি তাদের অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বাড়িতে ৷ উঠোনে রাবণের রান্নাঘরের উপযুক্ত মাটির হাঁড়ি গামলা পড়ে থেকে থেকে মাটিতে আংশিক বসে গেছে ৷ এসবই রেজোদের গ্রামের রীতি অনুযায়ী মদ তৈরির সরঞ্জাম ৷ আঙুরের রস নিংড়োবার বহুদিনের পুরনো কাঠের পেষাই পাত্রও পড়ে আছে ৷

খোদ রাজধানীতে শহরের মধ্যে বা এক ধারে এতখানি জায়গা নিয়ে এমন বিস্তীর্ণ গ্রামীণ পরিবেশ, সারা দেশেরই একটি ছোট্ট প্রতিরূপ এক জায়গায়-দেখে ভালো লাগল ৷

রেজো আমাকে নিয়ে জরাজীর্ণ সিঁড়ি ভেঙে তার ঠাকুমার তৈরি জীর্ণ বাড়িতে ভ্যাপসা গন্ধওলা একটা ঘরে ঢুকে নিজের মনের কথা খুলে বলল ৷ দুবছরের মধ্যে পুরো বাড়িটি সংস্কার করে সে এখানে একটা সাহিত্য সম্মেলন করবে ৷ দেশের কবি লেখক নাট্যকারদের এক জায়গায় জড়ো করবে ৷ আমাকে তো আসতে হবেই ৷ তবে অন্তত দুসপ্তাহ থাকতে হবে ৷

এর মধ্যে একদিন এক ফাঁকে টিভির দুটি ছেলেমেয়ে ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে এসে আমার একটা ইন্টারভিউ নিয়ে গেল ৷ বোধহয় রেজোরই উদ্যোগে ৷ রেজোও সেদিন আমার অনেকগুলো ছবি তুলল ৷ ঘরের দেওয়ালে দু-তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অনেকগুলো করে ছবি দিয়ে চমৎকার কোলাজ করেছে রেজো ৷ মেয়ের তর্জমায় বুঝলাম, ও বলছে, আমার ছবিও নাকি দেওয়ালে ওইরকম কোলাজ করে রেখে দেবে ৷ শুনে, কেন জানি না, আমার মোটেই ভালো লাগল না ৷ রেজো ইংরিজি এক অক্ষরও বোঝে না, ফলে মেয়ের ভাষান্তরে ওকে একাজে নিরুৎসাহ করতে আমি আর উৎসাহ পেলাম না ৷

টিভির সাক্ষাৎকারে দোভাষীর কাজ করেছে মানানা, জর্জিয়াভ্রমণে সর্বদা সর্বত্র সভায়-সাক্ষাৎকারে, ভোজসভায়, আলাপ-আলোচনায় মানানার মতো বিখ্যাত লেখক ও বিশেষজ্ঞ সাংবাদিককে দোভাষী হিসেবে পাওয়া আমার পক্ষে মস্ত সৌভাগ্যের কথা ৷ তার দোভাষিত্ব ছাড়া জর্জিয়ার এত গভীরে আমি যেতে পারতাম না ৷

টিভির ইন্টারভিউ শেষ করেই খুব জরুরি কী একটা কাজে মানানাকে চলে যেতে হয়েছে, রেজো আমাকে নিয়ে পুরনো ৎবিলিসির ইহুদি ও তুর্কিদের মিশ্র পাড়ায় নিয়ে গেল ৷ সেখানে রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে একটা তুর্কি হামামে স্নানব্যবস্থা দেখলাম ৷ রেজোকে হামামের পুরুষ-মহিলা কর্মীরা সবাই দেখলাম চেনে, আমি ভারতীয় শুনে রেজোকে জিজ্ঞাসা করল, আমি চান করতে চাই কিনা ৷ রেজো আমার দিকে তাকাল, মহিলা ভাঙা ইংরিজিতে এবার আমাকেই প্রশ্নটা শোনালেন ৷ প্রাচীন এই তুর্কি স্নানব্যবস্থা চেখে দেখার ইচ্ছে ছিল না তা নয়, কিন্তু অচেনা এই পরিবেশে স্নান করতে মন সায় দিল না ৷

রেজো আমাকে নিয়ে কাছেই ছোট্ট একটা দোতলা বাড়িতে গেল ৷ বহুকালের পুরনো বাড়ি ৷ ভেতরটা অদ্ভুত ধরনের ৷ ছোট্ট ঘরে, প্যাসেজের দেওয়ালে পুতুলনাচের পুতুল সাঁটা ৷ মাথা বাঁচিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখি মাঝারি মাপের একটা ঘরে একদিকে পুরনো কয়েকটা টুলে ও মোড়ায় বসার ব্যবস্থা, সামনে একটু উঁচু খানিকটা মঞ্চের মতো, ওপরের দেওয়ালের ধার ঘেঁসে অনেকরকম অনেকগুলো লাইট ৷ কয়েকজন লোক সেগুলো ঠিক করছে ৷ সিড়িঙ্গে চেহারার একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে রেজো বিশুদ্ধ জর্জিয়ান ভাষায় কিছু বলল, সেই রোগা চেহারার ভদ্রলোকই সেটা ইংরিজিতে বুঝিয়ে দিলেন-তিনি রেজোর বন্ধু, এই মিনি থিয়েটার হলের মালিক ও নাট্যপরিচালক, শুধু নতুন নিরীক্ষামূলক নাটকই তাঁরা এখানে মঞ্চস্থ করেন ৷ সব সময়ে তো আর সেধরনের নাটক পাওয়া যায় না, বা করাও যায় না, সেইসব সময় এটা ভাড়া দেওয়া হয় টিভির শুটিংয়ের জন্য ৷

সামনের শনিবার এখানে এঁদের নিজস্ব নাটক হবে ৷ তারপর কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে নতুন নাটক, রেজোর লেখা ৷ আজ সন্ধেবেলা টিভির শুটিং ৷ সেইজন্যই আলো-টালো ঠিক করা হচ্ছে ৷ টিভি শুটিংয়ের পক্ষে হয়তো এই স্বল্পপরিসর ঠিকই আছে, কিন্তু এই এক চিলতে ঘরে নাট্যাভিনয় কীভাবে হয় ভেবে কূল-কিনারা পেলাম না ৷ কুশীলবরাই বা কজন হবেন, শ্রোতার সংখ্যাই বা কত হতে পারে?

ভদ্রলোক থামতেই রেজো আমার সম্পর্কে একটানা কী বলে গেল, আমি শুধু সেই অদ্ভুত উচ্চারণে আমার নাম আর ‘ইন্দোয়িথি’ শব্দটা চিনতে পারলাম ৷ ‘ইন্দোয়িথি’ মানে ইন্ডিয়ান ৷

যাইহোক, পরিচয় শুনেই নাট্যপরিচালক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, জিজ্ঞেস করলেন-বিজয় তেন্ডুলকর কেমন আছেন? সুদূর জর্জিয়ায় ভারতের আধুনিক নাট্যকারের নামও পৌঁছে গেছে দেখে ভারি আনন্দ হল ৷ দু-তিন বছর আগে তেন্ডুলকর সরস্বতী সম্মান পেয়েছিলেন সেকথা জানালাম ৷

রাজকাপুর বনাম রবীন্দ্রনাথ

সন্ধেবেলা রেজো আমাকে মানানার বাড়িতে পৌঁছে দিতে এলে দেখা গেল, মানানা তখনও ফেরেনি ৷ সামনের ফ্ল্যাটে মানানার চাবি রাখা থাকে, রেজো জানত ৷ ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলে গেল, একটা ছোট ছেলে রেজোকে দেখে আমাদের ভেতরে আসতে বলল ৷ আমি দ্বিধা করছি দেখে এক মহিলা, বোধহয় ছেলেটির মা, এসে আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলেন ৷ আমরা সরু প্যাসেজ পেরিয়ে বসবার ঘরের দিকে এগোচ্ছি, এক সুদর্শন প্রৌঢ় এসে আমাকে অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে বসালেন ৷ ছোট ছেলেটির মা ততক্ষণে দ্রুত হাতে টেবিল থেকে ছেলের বইখাতা নামিয়ে টেবিলটাকে পরিষ্কার করে ফেলেছেন ৷

জর্জিয়ার সর্বত্র দেখেছি রাজকাপুরের নামে মানুষের মুখে খুশি খেলে, মনে আলো জ্বলে ৷ এই অপরিচিত সংসারে, অচেনা ভদ্রলোকের সামনে চুপচাপ ৷ বসে থেকে কী বলি কী বলি করতে করতে আমি হঠাৎ বললাম, আপনি রাজকাপুরকে দেখেছেন?

ভদ্রলোক প্রায় ছিটকে উঠে কোথায় চলে গেলেন ৷ একটু পরেই ফিরে এলেন দুহাতে সাত-আটখানা সুন্দর বাঁধানো বই নিয়ে ৷ সব কটার প্রচ্ছদেই দেখলাম Tagore লেখা আছে ৷ তাঁর শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় বিনা ভাষাতেই বুঝিয়ে দিলেন, ভারত বলতে তিনি কী বোঝেন ৷

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমিও কৈফিয়তের সুরে বললাম, এখানে রাজকাপুরের তুমুল জনপ্রিয়তা দেখেই আমি ওঁর কথা তুলেছি, এমনিতে শিক্ষিত বাঙালিরা বাজারচলতি হিন্দি ছবির খুব একটা ভক্ত নয় ৷ কথাবার্তা হচ্ছে ভদ্রলোকের কিশোরী কন্যার ধীর গতি ইংরিজি অনুবাদে ৷

মানানাকে ঘরে ঢুকতে দেখে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ৷ রীতিমতো উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ভাগ্যিস, আজ আমার ফিরতে দেরি হল ৷ তুমি জানো ইনি কে? তারিয়েল চানতুরিয়া-অত্যন্ত শক্তিশালী কবি ৷ বলতে পারো জর্জিয়ার শ্রেষ্ঠ জীবিত কবিদের একজন ৷ সেদিন তুমি যাঁর একটা কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলে সেটা এঁরই লেখা ৷ কতদিন ভেবেছি, তোমাকে আলাপ করিয়ে দেব-

‘তারিয়েল’ শুনেই মনে পড়ে গেল, জর্জিয়ার জাতীয় কবি রুসতাভেলির মহাকাব্যের একটা প্রধান চরিত্রের নাম তারিয়েল! কবিতার নামটাও বেশ অসাধারণ-‘একটা হতাশ চিন্তা’ ৷ A Dissapointed Thought, প্রায় ৫০ লাইনের কবিতা, তার প্রথম চার লাইন এইরকম, একবার পড়েই মুখস্থ হয়ে যায়:

A poem needs a heart

A poem needs a liver

A poem needs a tear

And plenty of your blood.

আমাদের বাংলা কবিতা, এখনকার কবিদের কথা, খুব নতুন রকম কবিতা কী লেখা হচ্ছে, এইসব বিষয়ে তারিয়েলের তীক্ষ্ণ সব প্রশ্নের উত্তরে আমার সামান্য জ্ঞান বিশ্বাসমতো দু-চার কথা বলতে হল ৷ সব শুনে তারিয়েল হঠাৎ বললেন, শ-পাঁচেক পংক্তি নতুন কবিতা পাঠাতে পারেন? আমি জর্জিয়ানে অনুবাদ করে দেখতাম ৷ সেটাই হবে জর্জিয়ানে প্রথম বাংলা কবিতাবই ৷

যিনি দরজা থেকে ভেতরে ডেকে এনেছিলেন সেই মহিলা কবির পুত্রবধূ ৷ এঁকে আমি পরেও মাঝে মাঝে দেখেছি, রাতে ডিনারের পর আমাদের বাড়ি, মানে মানানাদের ড্রয়িং রুমে আসতেন সিগারেট খেতে ৷

আমরা চা-টা খেয়ে উঠে পড়লাম ৷ পরদিন জর্জিয়ার প্রাচীন রাজধানী থেতা (Mtskheta)-য় খুব বড় ধর্মীয় উৎসব-থেতোবা (Mtskhetoba), বাংলায় থেতা উৎসব ৷ ‘দিলিস গাজেতি’ আমাকে এই উৎসব দেখাবে এবং আমার সম্মানে থেতাতেই ডিনারের আয়োজন করেছে ৷ নৈশভোজসভা বসবে ডেইলি গেজেট-এর থেতাবাসী একজন কর্মীর বাড়িতে ৷

সাদা নদী কালো নদী

ঠিক হল কাল সকাল আটটায় আমরা বেরব, কেননা নটার আগে পুলিশচৌকি পেরিয়ে না গেলে পরে আর উৎসবের জায়গা পর্যন্ত কোনও গাড়ি যেতে দেবে না ৷ তখন অনেকটা রাস্তা আমাদের হাঁটতে হবে ৷ উৎসবে অস্বাভাবিক ভিড় হয়, একটু বেলা হলেই উৎসবমুখী রাস্তায় মানুষের ঢল নামে, তার আগেই সব গাড়ি রুখে দেওয়া হয় ৷

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি চারদিক স্যাঁতসেঁতে, আকাশ-বাতাস কালো হয়ে আছে, তার মধ্যেই ঝিপঝিপে বৃষ্টি ৷

লেপ না সরিয়ে শুধু একটু মাথা তুলে একটুখানি জানলা ফাঁক করেছি, ঠান্ডা হাওয়া আর বৃষ্টির ছাটে মুখ-কপাল সব হিম হয়ে গেল ৷ ঘড়িতে তখন পৌনে আটটা ৷ এই অবস্থায় আমাদের থেতা উৎসবে যাওয়া হবে কি?

বাথরুমের পথে দেখা হল ভাজিকের সঙ্গে, জগিং সেরে এসে জুতোর জলকাদা সাফ করছে ৷ ও জগিং করতে যায় পাহাড়ের নিচে মস্ত বড় ফাঁকা জায়গায় ৷ আমাকেও রোজ ডেকে নিয়ে যায়, আজ যাব না সেকথা কালই জানিয়ে রেখেছি ৷ তাছাড়া ভাজিকের মতে ওই পাহাড়টা ককেশাস, এমনকী লিটল ককেশাসও নয় শুনে মর্নিং ওয়াকে আমার উৎসাহেও কিছু ভাঁটা পড়েছে ৷ মানানার দাবি ওটা ককেশাসেরই একটা শাখা, তবে ‘রাশিয়ান, থুরি, উইক্রেনিয়ান হলেও জর্জিয়ার ভূগোল আমার চেয়ে ভাজিকই ভালো জানে ৷’

খোলা দরজা দিয়ে চোখে পড়ল মানানা গভীর ঘুমে ৷ এমন বিশ্রী মেঘবৃষ্টির দিন, বেরবার সময় হয়ে গেছে, গৃহকর্ত্রী তখনও নিদ্রামগ্ন, ভাজিকও কী একটা রুশ প্রবাদ আউরে চোখ মটকে তার অর্থ করে দিল-এরকম আবহাওয়ায় দিন শুরু করতে হয় ভদকা দিয়ে, শেষও করতে হয় ভদকা দিয়ে, আর মাঝের সময়টাও ভাসিয়ে দিতে হয় ভদকায় ৷ শুনে আমি একশো ভাগ নিশ্চিন্ত হয়ে লেপের নিচে ফিরে গেলাম ৷

বোধহয় দশ মিনিটও হয়নি, কোন বিদেশে কাদের সঙ্গে কেমন একাত্ম হয়ে আছি ভাবতে ভাবতে সবে আরামে আমার দু-চোখ জড়িয়ে এসেছে, হঠাৎ আমার নাম ধরে মানানার চিৎকারে লেপ ফেলে দৌড়ে যাই ৷

ভুরু কুঁচকে বেশ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, এ কী! তুমি তৈরি হওনি?

ঘড়িতে দেখলাম ঠিক আটটা ৷ মানানা বেরবার জন্য একেবারে তৈরি ৷

আমার জন্যই আমাদের বেরতে একটু দেরি হয়ে গেল ৷ ভাজিক অবশ্য এল না, তার নাকি ভেরি মেনি ওয়ার্কস আছে ৷ আমি একবার অনুরোধ করতে যাচ্ছিলাম, মানানা চাপা ব্যঙ্গের সুরে বলল, রোজই ওর ‘ভেরি মেনি’ ওয়ার্কস থাকে তুমি জানো না? ‘থেতোবা’র দিনেও ৷ যেদিন সবার ছুটি, ওর কি কাজ না করলে চলে নাকি?

লিফট বন্ধ, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মানানা বলল, গত বছর মেতেছিল ৎবিলিসির পার্কে অ্যাকোরিয়াম করতে, এবার ক্ষেপেছে বেলুনে বিশ্বজয় না করে ছাড়বে না!

বেলুনে চড়ে সিল্ক রুট অভিযান-শুনতে পাগলামি মনে হলেও ভাজিকের কাছে মস্ত বড় ব্যাপার ৷ এ তার জীবনের স্বপ্ন, সর্বক্ষণের ধ্যানজ্ঞান ৷ এই অসাধ্য সাধনে সবরকম সহযোগিতা চেয়ে সে দেশের রাষ্ট্রপতির কাছে তার আর্জি জানিয়েছে ৷ প্রেসিডেন্টও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন ৷ জর্জিয়ান ভাষায় টাইপ করা সেই দরখাস্তের ওপর প্রেসিডেন্টের সেই মন্তব্য ও স্বাক্ষর ভাজিক আমাকে দেখিয়েছে ৷ মানানাকে দিয়ে ইংরিজিও করিয়ে দিয়েছে ৷ এই অভিযান নিয়ে আমার সঙ্গে ভাজিকের জল্পনা-কল্পনার যেন শেষ নেই ৷ আমাকেও কথা দিতে হয়েছে যে পুরো পথটা যদি নাও পারি, অন্তত কিছুদূর পর্যন্ত আমাকে অভিযানে যেতেই হবে, এজন্য সে আমাকে এখন থেকেই নেমন্তন্ন করে রেখেছে ৷

মানানার আশংকাই সত্যি হল ৷ কিছুদূর যাবার পর পুলিশ আমাদের গাড়ি আটকে দিল ৷ এখানে নামলে অনেকটা হাঁটতে হবে, অতএব গাড়ি ঘুরিয়ে পাশের রাস্তা ধরে অন্য একটা রাস্তায় পড়ে আমরা প্রথমে গেলাম ছুয়ারি বা জুয়ারি ৷ জর্জিয়ার সবচেয়ে উঁচুতে এই প্রাচীন গির্জা, জায়গাটা বোধহয় ১২,০০০ ফুট উঁচু, আর তেমনই হাওয়ার দাপট, মনে হয় বড় বড় বরফের চাঁই সোজা হাড়ের ওপর কেউ ঘষে দিচ্ছে ৷ তাড়াহুড়োয় ভারি গরমের জামাকাপড়ও বেশি কিছু চড়ানো হয়নি ৷ আমার দাঁতে দাঁতে খটখটি শুনে মানানা অপ্রস্তুতের একশেষ, তার নিজের গায়ে বোধহয় সাইবেরিয়ার গরম পোশাক! ওপরে উঠছি তো উঠছিই, গাড়ি থেকে নেমেও আরও খানিকটা উঠে ষষ্ঠ শতাব্দীর গির্জার সামনে পৌঁছলাম ৷

মস্ত উঁচু কাঠের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে শীতের কামড় থেকে শুধু রক্ষাই পেলাম না, অদ্ভুত আরামে উষ্ণতায় মোমের আলোয়-গন্ধে দেহ যেন ধন্য হল ৷

মানানা, ডেইলি গেজেটের ফটোগ্রাফার, গাড়ির ড্রাইভার-সকলেই যখন উপস্থিত অসংখ্য জনের সঙ্গে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করছে আমি তখন ঘুরে ঘুরে দেওয়ালে সিলিংয়ে মেঝেয় রঙিন চিত্র দেখে বেড়াচ্ছি ৷

বাইরে আসতেই আবার সেই শীতের ঝাপট ৷ ঘুরতে ঘুরতে আরও উঁচু, রেলিং ঘেরা একটা জায়গায় পৌঁছলাম ৷ নিচে চেয়ে দেখি দুদিক থেকে দুটি নদী এসে আরেকটা নদীর সঙ্গে মিলেছে ৷ দুই নদীর নাম থেৎরি (সাদা) আরাগ্রি আর শাবি (কালো) আরাগ্রি, এরা এখানে এসে মিলেছে দকুবারি (তুর্কি ভাষায় ‘কুরা’) আরাগ্রিতে ৷ আরাগ্রি মানে নদী ৷ কুরা নদী তুর্কি থেকে এসে জর্জিয়া হয়ে আজারবাইজানে কাস্পিয়ান সাগরে গিয়ে পড়েছে ৷ মাস তিনেক আগে আমাজনে দেখেছি নিগ্রো (কালো) আর সোলিময়েস (হলদে) নদী মিশেছে আমাজন নদীতে, জর্জিয়ায় দেখলাম সাদা আর কালো নদী-থেৎরি আর শাবি ৷

থেতা উৎসব

জুয়ারি থেকে নেমে অনেকটা রাস্তা উজিয়ে ফিরে এলাম থেতার পথে ৷ এবারও পুলিশ পথ আটকাল ৷ এবারে পুলিশ আরও বেশি কড়া, কেননা এখান থেকেই রাস্তায় প্রচুর ভিড় দেখা যাচ্ছে ৷ শেষ পর্যন্ত হেঁটেই যাব, না এখান থেকেই ফিরে যাব তাই নিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে মানানার আলোচনা চলছে, হঠাৎ দীর্ঘনাসা দীর্ঘদেহী মুণ্ডিতমস্তক ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক গাড়ির দরজা খুলে নেমে গিয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে কী বললেন, পুলিশ অফিসারটি ঝুঁকে জানলা দিয়ে মানানাকে দেখে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল ৷ কী ব্যাপার? নোদার দুমবাদজের মেয়ে মানানা দুমবাদজে সত্যিই এই গাড়িতে যাচ্ছেন কিনা পুলিশ অফিসার শুধু সেটুকু দেখে নিলেন ৷ সাহিত্যের প্রতি সাধারণের এই অনুরাগ, সাহিত্যিকের প্রতি রাস্তাঘাটেও এই সম্মান জর্জিয়ার প্রতি আমার ভালোবাসা আরও বাড়িয়ে দিল ৷

থেতায় পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে দেখি ক্যাথিড্রালের পথে মানুষের ঢল নেমেছে ৷ ভিড়ে এগনো অসম্ভব, হাঁটাই দায়! তার ওপর প্রেসিডেন্ট এসেছেন, তাঁকেও দেখলাম ভিড়ে ধীরগতি ৷ মানুষের মিছিল এগোচ্ছে শামুকের মতো, মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যাবে ৷ রাস্তার ধারে নানারকম ভিখিরি ও মোমবাতি বিক্রেতা, খাবারের পসরা নিয়ে বসেছে অনেকে ৷ ভিড়ে আটকে পড়া মানুষের রাগ-বিরক্তিও কানে আসছে, মানানার তাৎক্ষণিক তর্জমায় সব কথাই বুঝতে পারছি ৷

পরদিনের ‘দিলিস গাজেতি’ কাগজে ‘ইন্ডিয়ান উইসডম অ্যান্ড লাভ ফর জর্জিয়া’ শিরোনামে আমার এই থেতা উৎসব দেখার খবরে লেখা হল-

জর্জিয়ান খ্রিস্টানদের এই থেতা উৎসবে হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছিলেন ৷ ক্যাথিড্রালের সামনে বিরাট ভিড় ৷ অমরেন্দ্র চক্রবর্তী মন দিয়ে সেই ভিড়ের নানা কথা শুনছিলেন, ভিড়ের মধ্যে লোকেরা তাদের দুঃসহ দারিদ্র আর দুর্বহ জীবনযাপনের জন্য ক্ষোভ জানাচ্ছিল, মানানা দুমবাদজে প্রত্যেকটি শব্দ চক্রবর্তীকে ইংরিজিতে অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন ৷ অনেকক্ষণ শোনার পর চক্রবর্তী বললেন, মানুষ সারা পৃথিবীতেই এক ৷ সুখ-দুঃখের আসল কারণগুলোও একই ৷

অনুষ্ঠানের পর দিলিস গাজেতির কর্মীবৃন্দ আয়োজিত এক ঐতিহ্যপূর্ণ জর্জিয়ান নৈশভোজে চক্রবর্তীকে আপ্যায়ন করা হয় ৷ ভোজসভার টেবিলে গৃহকর্তার পরিবারের তিন পুরুষকে উপস্থিত দেখে তিনি খুব খুশি হলেন কেননা ভারতেও এরকমটা দেখা যায় ৷ আধুনিক ভঙ্গুর সমাজে তিনি এটাকে সভ্যতার সবচেয়ে সুন্দর বিলাসিতা বলে উল্লেখ করেন ৷ তিনি বলেন, এটা খুবই দুঃখের যে আজ আর আমরা এটা বুঝতে পারি না ৷ সম্পর্কের বিস্তার ও গভীরতাকে তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব বলে মনে করেন ৷

ডিনার যখন শেষ হল, আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছ থেকে এবং সকলেই তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি, তখন এই ভারতীয় লেখক-পর্যটক এক গর্ভবতী মহিলাকে দেখে বলেন, আমার বিশ্বাস এই শিশুটি বড় দার্শনিক হবে এবং জর্জিয়ার সংকটে পথ দেখাবে ৷ তাঁর এই বিশ্বাস ও কল্পনা আমাদের সকলেরই ভালো লাগল ৷ চক্রবর্তীর সবচেয়ে বড় ব্যাপার এটাই যে তিনি মানুষের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ককে অন্তর থেকে মানেন ও মূল্য দেন ৷ তিনি বলেন, সর্বত্র এই সম্পর্ককে সযত্নে লালন করা দরকার ৷

খবরের কাগজে ছাপা না হলে, এসব তুচ্ছ কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ত না ৷ অথচ সেদিনের ডিনারের অন্য অনেক মজার স্মৃতিও ভোলবার নয় ৷

সবচেয়ে বেশি মনে আছে পাঁচ ঘণ্টার রাজকীয় ভোজনের আগে প্রায় দশ ঘণ্টার উপবাসের বেদনা ৷

সকালে বেরবার আগে তাড়াহুড়োয় ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করা যায়নি, রাস্তায় যেতে যেতে হয়তো খানিকটা অপরাধ বোধ থেকে মানানা মাঝে মাঝেই শোনাচ্ছে-থেতায় আজ তোমার সম্মানে ডিনার! জর্জিয়ার সর্বোচ্চ জায়গায় শীতে যখন শরীরের হাড়ে হাড়ে বাজছে স্পেনদেশীয় ফ্লামেঙ্কো নাচের দ্রুত তালের কাঠ-খটখটি বাজনা, দুপাটি দন্ত মাধ্যমে তা শোনাও যাচ্ছে, তখনও মানানা আমার দিকে সকরুণ চেয়ে থেকে জর্জিয়ার ঐতিহ্যপূর্ণ ডিনারের সংবাদ দিয়েছে ৷

আমি ভেবেছিলাম অনেকে ভুল করে লাঞ্চ ডিনার গুলিয়ে ফেলে, এও নিশ্চয় তা-ই, তা না হলে সকালে ব্রেকফাস্ট হয়নি, দুপুরে লাঞ্চের ব্যবস্থা শোনা যাচ্ছে না, সোজা একেবারে ডিনার?

উৎসব শেষে যখন ডিনারস্থলে পৌঁছলাম, তখন দুপুর ৩টে ৷ মুখ তেতো, খিদেয় পেটে যেন হোয়াইট ওয়াটার র্যাফটিং চলছে, হঠাৎ গেট দিয়ে ঢুকেই মাথার ওপরে থোকা থোকা কালো আঙুর ঝুলছে দেখে ভারি শান্তি বোধ হল ৷ গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রী দুজনেই এগিয়ে এসে একে একে মানানার সঙ্গে এক গালে চুম্বনবিনিময় করলেন, কর্ত্রী ঠাকরুন এসে ডান হাতে আমার পিঠ জড়িয়ে ধরে সাদরে ভেতরে নিয়ে চললেন ৷ দোতলায় নিয়ে আমাদের যেখানে বসালেন, সেখানে নিচু টেবিলে প্রচুর বই ও কয়েকটা পেইন্টিংয়ের অ্যালবাম ৷

বইয়ের মধ্যে যে কোনও জর্জিয়ান পরিবারে রুসতাভেলির ‘ব্যাঘ্র চর্মাবৃত নাইট’ থাকবেই, আর যদি একজন চিত্রশিল্পীও থাকেন, তিনি ফিরোসমানি ৷

অনেকক্ষণ ধরে মুগ্ধ হৃদয়ে জর্জিয়ার এই জাতীয়-শিল্পীর ছবি দেখছি, চোখের সামনে দিয়ে নানা বয়সের মহিলারা বড় বড় সব কাঠের পাত্রে, সেরামিক ও রুপোর পাত্রে গন্ধে আকুল করা সুখাদ্য আমার পাশের বড় একটা ঘরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ৷ মনে মৃদু আশা, একটু দেরি হয়ে গেলেও এ নিশ্চয় মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন! এই ডাক পড়ল বলে!

আরও দু-তিনটে বই নাড়াচাড়া করার পরেও যখন চোখের সামনে দিয়ে শুধু নানা আকারের কারুকার্যময় সুগন্ধ পাত্র হাতে পাত্রীদের ঘরের মধ্যে চলে যেতে দেখছি তখন আর সন্দেহ রইল না যে খাবারের এখনও ঢের দেরি, এ তো ডিনারই!

বিকেল পাঁচটায় গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী এসে আমাদের মস্ত বড় খাবার ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন ৷ বিশাল টেবিলে পাত্র-পাত্রী খাবার পানীয়ের বৈচিত্র্যে প্রাচুর্যে সাজসজ্জায় এতক্ষণের খিদেও অতি তুচ্ছ মনে হল ৷

এইরকম আনুষ্ঠানিক ভোজসভায় অতিথির উদ্দেশে পানীয় ‘টোস্ট’ করা একটা দেখবার মতো ব্যাপার বটে! আমার উদ্দেশে একটু পর পর একেক জনের দীর্ঘ বাগবিস্তারের সঙ্গে মস্ত বড় ওয়াইন গ্লাস হাতে দীর্ঘ ‘টোস্ট’-এর ধকলে আমার তো ভিরমি খাবার জোগাড়!

টোস্ট করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কেউ বিড়বিড় করে, কেউ স্পষ্ট গলায় আমার উদ্দেশে নানা সুবাক্য ব’লে, কখনও আমার প্রশস্তি ও কুশল-কামনা ক’রে, কখনও মহান ভারতীয় অতিথিকে নানা বিশেষণে ভূষিত ক’রে বা দুই দেশের মৈত্রী-প্রীতির বিকাশ ও স্থায়িত্ব চেয়ে এক চুমুকে লম্বা গ্লাসের সবটুকু মদ শেষ করে ৷ মানানা তার আগেই প্রায় ঝড়ের গতিতে টোস্টের বাণী বা বক্তব্যের অংশ আমার জন্য ইংরিজি করে দেয় ৷ উত্তরে আমাকেও কিছু বলতে হয়, মানানা জর্জিয়ানে তার অনুবাদ করে ৷

নতুন কোনও কথা মনে উদয় হওয়ায় কেউ কেউ আবার উঠে দাঁড়িয়ে নতুন বাক্যরাজি বলে এক চুমুকে পূর্ণ গেলাস শূন্য করে দেয় ৷ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এরকম বার কতক গ্লাস শেষ করতে দেখে ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যায় ৷ নিয়ম হচ্ছে, যার উদ্দেশে এতসব শুভেচ্ছাবাণী তাকেও একই সঙ্গে এক চুমুকে সুরাপাত্র খালি করে দিতে হয় ৷ প্রথম প্রথম এঁরা আমার উদ্দেশে কে কী বলছেন, তার ইংরিজি অনুবাদে মন দিতে গিয়ে আমি গেলাসে পাল্টা চুমুক দিতে ভুলে যাই, মানানার খোঁচা খেয়ে খেয়াল হতে আমি বুদ্ধি করে বড় গ্লাস রেখে ভোজনান্তের লিকিয়্যরের ছোট্ট গ্লাস হাতে নিয়ে টোস্টযুদ্ধে অবতীর্ণ হই ৷

ভোজসভায় নিমন্ত্রিত বা নিমন্ত্রণের ব্যবস্থাপকরা সবাই সংবাদপত্রের কর্মী, ফলে যাঁর যখন কাজ শেষ হচ্ছে তিনি তখনই ভোজসভায় যোগ দিচ্ছেন এবং এসেই তাঁর প্রথম কর্তব্য আজকের ‘মহান অতিথি’র সঙ্গে পানীয় টোস্ট করা ৷ সেই বিরাট গ্লাস, সেই বাগবিস্তার, সেই এক চুমুকে পাত্র খালি করা ৷

টেবিলে যেমন বড় বড় জাগ ভরা পানীয়, পাত্রের পর পাত্র ভরা তেমনই নানা ব্যঞ্জন ৷ স্বাদ গন্ধ বর্ণ ছাড়াও শুধু বৈচিত্র্যে ও সংখ্যাধিক্যেই চোখে ধাঁধা লাগে ৷ এই টেবিল ভরা আহার্য-পানীয় সাজাতে এক-দেড়ঘণ্টা সময় লেগেছিল, ভোজের সেটা ছিল মাত্রই শুরু ৷ এরপর পুরনো পাত্র কতবার পূর্ণ হল, কত নতুন পাত্র, নতুন পদ যুক্ত হল, তার আর হিসেব নেই ৷

৫. আলাজানি, মুকুজানি

জর্জিয়ায় দেখতে দেখতে দুসপ্তাহ কেটে গেল ৷ আজ ২২ অক্টোবর ৷ ৎবিলিসি থেকে বাসভর্তি জর্জিয়ার কবি লেখক নাট্যকারের সঙ্গে চলেছি কাকেথি অঞ্চলে, সেখানে তেলাভির ইকালথো-তে মহাকবি সোতা রুসতাভেলি উৎসব ৷

কাকেথি পূর্ব জর্জিয়ায় ৷ প্রাচীন কাল থেকে কাকেথি সুরা অঞ্চল হিসেবে বিখ্যাত ৷ পথে পড়ছে আলাজানি নদীর গায়ে আলাজানি উপত্যকা, ইওরি নদীর ইওরি উপত্যকা, পেরিয়ে যাচ্ছি একের পর এক আঙুরগ্রাম, মাইলের পর মাইল দ্রাক্ষাকুঞ্জবতী গ্রামগুলোর নামেও মধু ৷ কোনও গ্রামের নাম শিনানদালি, কোনওটির নাম মুকুজানি, কোনওটির আবার গুর্জানি ৷ এইসব গ্রামের দ্রাক্ষা থেকে এখানেই তৈরি হচ্ছে বিখ্যাত জর্জিয়ান ওয়াইন ৷ গ্রামের নামেই সুরারও নাম আলাজানি, মুকুজানি, গুর্জানি ইত্যাদি ৷

আমাদের দেশে বাল্মীকি উৎসব বা ব্যাসোৎসব বা কৃত্তিবাস উৎসবে আমরা অভ্যস্ত নই বলেই হয়তো রাজধানী থেকে দেড়-দুশো কিলোমিটার দূরে প্রায় হাজার বছর আগের একজন কবির বাল্যশিক্ষার গ্রামে কবি-লেখকদের জড়ো হওয়া দেখে আমি রীতিমতো অভিভূত ৷ তাছাড়া আশপাশের গ্রামের নানা বয়সের সাধারণ মানুষের ভিড় থেকেও জর্জিয়ানদের সাহিত্য-অনুরাগের আঁচ পাচ্ছি ৷ পাঁচিলের ওপর, গাছের মাথায় দুচারজন অত্যুৎসাহী শ্রোতা-দর্শক দেখা গেল, আমাদের দেশে এ শুধু এখন খেলার মাঠেই সম্ভব ৷

এপর্যন্ত সব বেশ ভালোই চলছিল, আমিও যথাসম্ভব গাম্ভীর্য সহকারে দূর বিদেশের মহাকবি-উৎসব প্রত্যক্ষ করছি, হঠাৎ মাইকে জর্জিয়ান উচ্চারণে ইন্দোয়েথী অ্যাম্যারেনদ্র ইত্যাদি শুনে শংকিত হই ৷ মানানা আমার কানে কানে শোনাল, তোমাকে কিছু বলতে বলা হচ্ছে, চলো-

একটা মাইকের সামনে আমাকে ও আরেকটির সামনে মানানাকে এগিয়ে যেতে হল ৷

প্রথমেই আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল-আমি বাক্যহারা, আমি অভিভূত! কারণ? মহাকবির নিজের দেশে এসে তাঁকে এভাবে নমস্কার জানাবার সুযোগ পাব কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি ৷ জর্জিয়ায় আমার আসা সার্থক হয়েছে, তাছাড়া আমিও বিশ্ববন্দিত দুই মহাকবির দেশ ভারত থেকে এসেছি-

বিড়ম্বনা আর কাকে বলে! তখনও জানি না, বিড়ম্বনার এ সবে সন্ধে!

একটু পরই বিরাট হলঘরে একসঙ্গে দেড়-দুশো সাহিত্যিক আর স্থানীয় বহু বিশিষ্টজনের সঙ্গে সে এক মহা মধ্যাহ্নভোজ ৷ স্কুলের ক্লাসঘরের মতো বসবার বেঞ্চ ও হাইবেঞ্চ পেতে ঢালাও আহার-পানীয়ের আয়োজন ৷ একে একমাত্র ভারতীয় অতিথি, তায় তাঁদের মহাকাব্য থেকে দুচার লাইন বলতে পেরেছি, অতএব কাছাকাছি বেঞ্চগুলো থেকে আমার উদ্দেশে টোস্ট করা তো ছিলই, হল-এর দূর দূর প্রান্ত থেকেও অনেকে পানীয় ভরা গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়িয়ে টোস্ট করতে লাগল ৷ একজন কবি তো বেঞ্চে ঝুঁকে একটা কাগজে কী সব লিখে নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে জর্জিয়ান ভাষায় আমাকেই শোনাতে লাগলেন ৷ মানানা বলে দিল, ইনি একজন কবি, তোমার জন্যই এই কবিতাটা লিখেছেন, তোমাকে দিতে চান ৷

কবিতা শেষ করে ‘মহাকাব্যের দুই দেশের কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক, কবিরাই সরকার গড়ুক’ বলতে বলতে সেই কবি ‘গাউমারজোস’ বলে এক হুঙ্কার ছেড়ে একটি লম্বা চুমুকে হাতের দেড় লিটার গ্লাসটি নিঃশেষ করে নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন ৷ গাউমারজোস কথাটার আক্ষরিক অর্থ ‘আমাদের জয় হোক’ ৷

এরকম আরও অনেক প্রীতি শুভেচ্ছা উচ্চাশা ভালোবাসার যেন ঢেউ বয়ে যাচ্ছে ৷ এখানে লিকিয়্যর পানের ছোট্ট গ্লাস দেয়নি, বড় গ্লাস সামান্য খালি হওয়া মাত্রই কেউ না কেউ আবার পুরো করে দেয় ৷ যতই নানা কৌশলে গলায় কম সুরা ঢালি, আলাজানি মুকুজানি গুর্জানি শিনানদালির দেশে ওই চালাকির দ্বারা খুব একটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না ৷ ফলে আতিথ্যে আপ্যায়নে বশীভূত হয়ে আমিও একসময় গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়িয়ে যথাসম্ভব উচ্চকণ্ঠে বলে উঠি-সাদারি সোয়াগান আসেথি লামাজি শাখার্ৎবেলো! এটা আসলে জর্জিয়ানদের প্রিয় গান ৷ কথাগুলোর মানে, জর্জিয়ার মতো এমন সুন্দর দেশ আর কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!

সবাই খুব চমকে উঠে প্রথমে খুব একচোট হাততালি দিলেন, পর মুহূর্তেই অনেকে মিলে লাইনটি গেয়ে উঠলেন ৷ তারপরই আমার উদ্দেশে ‘টোস্ট’ অর্থাৎ দেড় লিটার গ্লাস একচুমুকে শেষ ৷

আমি আবার বললাম, এবার ইংরিজিতে, এই সুন্দর শাখার্ৎবেলো সোতা রুসতাভেলির, এই মহাকবি সোতা রুসতাভেলি শাখার্ৎবেলোর ৷ মানানার অনুবাদ শেষ হওয়া মাত্র আরেক প্রস্থ হাততালির মধ্যেই আমি উচ্চকণ্ঠে বললাম-সাদারি সোয়াগান আসেথি সুইডোবা (Mshvidoba)! সুইডোবা মানে শান্তি ৷ গানের মুখস্থ লাইনটিতে ‘সুন্দর শাখার্ৎবেলো’র জায়গায় চটজলদি সুইডোবা বসিয়ে আমি যে একটা নতুন কথা শোনাব তা বোধহয় কেউ ভাবেনি, মানানাও দেখলাম আমার দিকে চেয়ে আছে! সদ্য স্বরচিত এই পদটির মানে-এমন শান্তি আর কোথায় আছে?

হাততালি, আলিঙ্গন, ‘টোস্ট’-এর যেন আর বিরাম নেই ৷ কে বলবে, এই দেশ, এই ভাষা, এই মানুষজন দুসপ্তাহ আগেও ছিল আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত!

শাসকনিক্ষেপকারী লেখক

লেখকদের কথায় দুজন লেখকের নাম না বললেই নয় ৷ একজনের নাম ছাবুয়া আমুরেদজিবি; লম্বা ছিপছিপে চেহারা, লতায়-পাতায় জর্জিয়ার রাজবংশের অর্থাৎ নীলরক্তবান পুরুষ, বয়স নাকি আশি! জর্জিয়ায় এসেই একদিন আলাপ হয়েছিল, তারপর গতকাল রাইটার্স ইউনিয়নের বার্ষিক সভায় অনেক কথা হল ৷ তাঁর নামের কার্ডটি দুভাঁজ করা, সই করে তারিখ বসিয়ে আমাকে দিলেন ৷ এক দিকে জর্জিয়ান, আরেক দিকে ইংরিজি ৷ নাম-ঠিকানা ছাড়াও ভেতর পিঠে বাঁদিকে লেখা আছে-

শাসকনিক্ষেপকারী

সর্বকালের সব মানুষের

সবচেয়ে চড়া সুরের গায়ক

ডানদিকের পাতায় লেখা-

গৃহহীন কুকুরদের পৃষ্ঠপোষক

১ লিটার (মদ্য) পানে সমর্থ

‘রেড বুক’-এর বাসিন্দা

শুনলাম দু-তিন বছর আগে, জার্মান সাহিত্যিক গ্রুন্টের গ্রাস যে বছর নোবেল পুরস্কার পান, সেবছর গ্রুন্টের গ্রাসের সঙ্গে ছাবুয়াও মনোনীত পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় ছিলেন ৷ গলায় ক্যান্সার, কয়েক বছর আগে অপারেশন করা হয়েছে, বেশ জোর দিয়ে কথা বললেও মনে হয় ফিসফিস করে বলছেন, এদিকে দিনে এখনও দিব্যি দশ-পনেরোটা সিগারেট খান ৷ ষোল বছর আত্মগোপন করে ছিলেন ৷ ছাবুয়া একবার কলকাতায় এসেছিলেন, ১৯৯০-এ ৷ পার্ক সার্কাসের দিকে কোথাও কলকাতাবাসী রুশ শিল্পী বেরিখের বাড়িতে উঠেছিলেন ৷ আমরা কেউ খবর পাইনি শুনে বললেন, ইচ্ছে ছিল কলকাতার লেখকদের সঙ্গে আড্ডা হবে, তা তেমন কাউকে কোনও খবর দেওয়া যায়নি ৷

আমি আর মানানা কথা বলে রাইটার্স ইউনিয়ন থেকে চলে আসছি, ছাবুয়া আমাদের এগিয়ে দিতে সঙ্গে আসছেন, হঠাৎ সিঁড়ির মুখে আমাকে থামিয়ে এক মহিলার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি আনা কালান্দাজে ৷ মানানা জানাল, আনা কালান্দাজে জর্জিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ৷ ২০০০ সালে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনয়ন তালিকায় এঁর নাম উঠেছিল ৷

বিদেশে আমার এই এক যন্ত্রণা ৷ সে দেশের বড় কবি বা গদ্যলেখক কী লিখছেন, তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ে তিনি এই জীবন জগতের কথা কী লিখেছেন, তাঁর ভাষা না জানায়-আমি কিছুই জানতে পারি না ৷

ৎবিলিসি ফিরে ভাজিকের কাছে জর্জিয়ার ম্যাপ খুলে বসে কাকেথি অঞ্চলের দ্রাক্ষাকুঞ্জবতী গ্রামগুলোর বিষয়ে নানা গুণগান শুনছি, হঠাৎ সে ম্যাপের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, পূর্ব জর্জিয়ায় এই কাকেথি অঞ্চলে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম-এর অনেক সুযোগ রয়েছে ৷ আর উত্তর জর্জিয়ায় গুদায়ুরি তো স্কিয়িংয়ের স্বর্গ ৷ গুদায়ুরিতে আমি নিজেই এপর্যন্ত দেড় হাজার ছেলেমেয়েকে স্কিয়িং শিখিয়েছি ৷ বছরে দুবার যাই, জানুয়ারি আর মার্চে ৷ দুসপ্তাহ ওদের সঙ্গে থাকি ৷ স্কি শেখানো হয়, আবার একসঙ্গে থাকতে থাকতে নানান গল্পও হয় ৷ ছোটদের সঙ্গে গল্প করে তুমি ওদের অনেক কিছু শেখাতে পারবে, নিজেও অনেক কিছু শিখতে পারবে ৷

ম্যাপ গোটাতে গোটাতে ভাজিকের প্রশ্ন-‘ভারত আর জর্জিয়ার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা দুসপ্তাহের জন্য পরস্পরের দেশ বেড়িয়ে যেতে পারে না? স্কি শিখবে, রোমাঞ্চ ভ্রমণ করবে, দেশ দেখবে-এমনটা করা যায় না?

কুতাইসির কথা

ৎবিলিসির অনেক পশ্চিমে, কিছুটা উত্তরে কুতাইসি ৷ ইমেরেথি রিজিয়নের রাজধানী কুতাইসির রান্নার খুব নামডাক ৷ দুপুরের সামান্য ফলাহারের পর সন্ধ্যায় দুঘণ্টার ডিনারেই তা টের পাওয়া গেল ৷ শুধু ঘরে তৈরি টাটকা চিজের কথাই বলি, চাররকম চিজের চাররকম স্বাদ তো হবেই, কিন্তু একটির স্বাদ মনে হয় এ পৃথিবীর নয় ৷ কথায় ব্যাখ্যা করা যাবে না ৷ আমি চিজভক্ত নই, তেমন ভোজনরসিকও নই, তা সত্বেও কুতাইসির রন্ধনশিল্প আমার রসনায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে ৷ আহার-পানীয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলল কুতাইসির ইতিহাস, ভাস্কর্য, সাহিত্য ৷

আমার নিমন্ত্রণ ছিল জর্জিয়ার রাইটার্স ইউনিয়নের কুতাইসি রিজিওন্যাল ডিপার্টমেন্টে ৷ ৎবিলিসি থেকে দুপুরে সেখানে পৌঁছতেই স্বাগত জানালেন কুতাইসি আঞ্চলিক বিভাগের চেয়ারম্যান, জর্জিয়ার প্রখ্যাত ও পুরস্কৃত লেখক তেইমুরাজ লাঞ্চাভা ৷ একটু পরেই কুতাইসির দৈনিক পত্রিকার দুটি মেয়ে এসে আমার সাক্ষাৎকার নিলেন ৷

দুপুরে রাইটার্স ইউনিয়নে ফলাহারের পর আমাদের কুতাইসি দর্শনে নিয়ে গেলেন তেইমুরাজ লাঞ্চাভা ৷ মোমের তৈরি মূর্তির মিউজিয়ামে দেখা হল স্তালিন হিটলার নেপোলিয়নের সঙ্গে ৷ বাগরাথির গুম্ভা ও দুর্গ আর গেলাতির গুম্ভা ও অ্যাকাডেমি দেখলাম কুতাইসির ইতিহাস শুনতে শুনতে ৷

সেদিন ডিনারের পর কুতাইসির একটা পারিবারিক হোটেলে উঠলাম, আমাদের তিনজনের জন্য তিনটে ঘর আগে থেকেই বুক করা ছিল ৷

ছোট হোটেল, স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে চালান ৷ শোবার বিছানা, ঘুমের আগে পড়বার বই ও পত্র-পত্রিকা, পরদিন ব্রেকফাস্টে কর্তাগিন্নির দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করা, সব কিছুতেই গার্হস্থ্য স্বাদ ৷ সবই খুব সুন্দর ঘরোয়া ও পরিপাটি, শুধু বাথরুম শোবার ঘরের বাইরে, এই যা ৷

এখান থেকে যাব কৃষ্ণসাগরের তীরে গ্রিগোলোটিতে ৷ পথে সাতাপ্লিয়ায় দেখব ডাইনোসরের পায়ের ছাপ আর যাব প্রাগৈতিহাসিক গুহায় ৷

৬. কুতাইসি থেকে কৃষ্ণসাগরে যাবার কথায় পরে আসছি ৷ তার আগে ৎবিলিসিতে আমার দুদিনের সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাতের কথা বলি ৷

ককেশাসের বন্দী

আজ অনেক দিন পর চমৎকার রোদ উঠেছে, আকাশ ঝকঝকে নীল ৷ মানানা সকাল থেকেই বাড়ি নেই, সে গেছে তার ছেলে নোদারের কাকার অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে ৷ নোদারের এই কাকা খুব ডাকসাঁইটে মাফিয়া, বাসস্থান রাশিয়ায়, কর্মস্থান উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, রাশিয়া, বেলারুশ ইত্যাদি দেশ-দেশান্তরে ছড়ানো বিরাট এলাকা জুড়ে ৷ ওইসব দেশের বাঘাবাঘা মাফিয়ারা তার চেলা ৷ তারা তাদের নেতার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার মরদেহ তার জন্মভূমি জর্জিয়ায় কবরস্থ করতে বিশেষ বিমানে ৎবিলিসিতে নিয়ে এসেছে ৷ সরকার তাদের গ্রেপ্তার করবে না এবং মস্কো থেকে তাদের বিনা বাধায় বিমানে উঠতে দেবে এই শর্তে এই মাফিয়াবাহিনী নাকি রুশ নিরাপত্তা-বাহিনীকে মস্কো বিমানবন্দরে বহু সহস্র ডলার উপঢৌকন দিয়েছে ৷ একইভাবে জর্জিয়ান পুলিশ-গোয়েন্দাদের ঝুলিতে তারা নাকি প্রচুর ডলার ঢেলেছে, চুক্তি হয়েছে ৎবিলিসিতে তাদের নিরাপদে নামতে ও নেতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করতে দেওয়া হবে ৷

মানানা আমাদের বলে গেছে, ফিউনারেল পর্ব দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে, ফিরে এসে আজ লাঞ্চের জন্য সে একটা বিশেষ পদ রাঁধবে ৷

দুপুর দুটো বেজে গেল, মানানার দেখা নেই ৷ বেশ কয়েকদিন বাজার-টাজারও কেউ করেনি, ফলে আধশিশি মধু আর এক বাটি সেই জঞ্জলি ছাড়া ফ্রিজেও কিছু পাওয়া গেল না ৷

ভাজিক কোনও কিছুতে হতাশ হয় না ৷ সে প্রায়ই বলে, হতাশ হলে কি এখন জর্জিয়ায় থাকা যায়!

একদিন শুধু বলে ফেলেছিল, সোভিয়েত ভেঙে যাবার পর গত দশ বছরে জর্জিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছে, আগামী দশ বছরে সবাইকে চমকে দেবার মতো ভালো কিছু ঘটবার সম্ভাবনাও নেই ৷ তাই ভাবি, আমার এই বেলুনে চড়ে সিল্ক রোড অভিযানের স্বপ্ন যদি সফল না হয় তাহলে এই বয়সে আমি আর কী নিয়ে বাঁচব!

যাই হোক, ভাজিক আমাকে তৈরি হতে বলে নিজেও চট করে একটা জ্যাকেট চড়িয়ে নিল ৷ রাস্তায় দেখলাম এক মহিলা দু হাতে দু গোছা ঘরে তৈরি রুটি নিয়ে চলেছে ৷ বড় বড়, গোল, মোটা রুটি, একেবারে খোলা অবস্থায় হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে কিছুটা অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে ৷ রুটিগুলোর ঠিক মাঝখানে বড় মাপের গোলাকার ছিদ্র ৷ ভাজিককে জিজ্ঞেস করে জানলাম এই ছিদ্রযুক্ত রুটি আসলে গ্রিক রুটি ৷ বাড়িতে তৈরি করে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে বিক্রি করতে ৷

পথের ধারেও নানারকম খাবার জিনিস বিক্রি হচ্ছে ৷ তার মধ্যে তেঁতুলের মতো দেখতে, কিন্তু এক-দেড় হাত লম্বা, ভেতরে গাঁটে গাঁটে বাদাম-অনেকেই দুয়েক ছড়া কিনে নিয়ে খেতে খেতে চলেছে ৷

আমরা শেষমেশ এক জোড়া কলা কিনলাম ৷ দাম আমাদের ২৫ টাকার মতো ৷

ভাজিক আমাকে একটা ওয়াইন তৈরির দোকানে নিয়ে গেল ৷ নিছক দোকান না বলে জর্জিয়ান ওয়াইনের কুটিরশিল্প বললেই বোধহয় ঠিক হয় ৷ আমাদের সিকিম বা দার্জিলিংয়ের মতো রাস্তা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নেমে একটা অপরিসর খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে বুঝলাম এটা দোকানও বটে, দোকানের মালকিনের বাসগৃহও বটে ৷ টেবিলে বেশ কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট কাচের গ্লাস, দেওয়াল ঘেঁসে অনেকগুলো পিপে, বড় বড় প্লাস্টিকের জার, ভেতরে রেড বা হোয়াইট ওয়াইন ৷

নোদার একদিন আমাকে বলেছিল, এইসব ঘরে তৈরি ওয়াইন খুব সস্তা ৷ এক লারিতে এক লিটার ৷ এখানে শুনলাম দুই-তিন লারিতে খুব ভালো ওয়াইন পাওয়া যায় ৷

ভাজিক আমাকে একটা ছোট গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে নিজে একটা নিল ৷ দোকানের মধ্যবয়সী মালকিন হাতায় করে একেকটা পিপে থেকে মদ তুলে আমাদের গ্লাসে ঢেলে দেয় আর ভাজিক ছোট্ট ছোট্ট চুমুক দিয়ে, কখনও জিভে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে মদটির বর্ণগন্ধস্বাদ যাচাই করে ৷

আমাকেও মতামত দিতে হয়, আমি রায় দিই শুধু শুঁকে ৷ কেননা টেবিলের ওপর পড়ে থাকা গ্লাসগুলোর কিনারে দুয়েকটি মাছি ও গ্লাসের নিচে দু-দশ ফোঁটা পানাবশিষ্ট মদ আমার চোখে পড়েছিল ৷ যত বার মদ চাখতে দিল আমিও ততবার গ্লাস বদলালাম ৷ সব গ্লাসের তলদেশেই পূর্বসূরির পানাবশেষ!

ভাজিক শেষ পর্যন্ত দু বোতল রেড ওয়াইন কিনল ৷ বোতল বলতে দুটো ‘বোরজোনে’ মিনারেল ওয়াটারের খালি বোতল বের করে ভেতরের ঘর থেকে মদ ভরে আনল ৷ উঁকি দিয়ে দেখি ভেতরে বেশ বড় ঘর ৷ বড় বড় জার, পিপে, খাবার টেবিল, শোবার খাট নিয়ে খুবই অগোছাল, অপরিচ্ছন্ন ঘর ৷ একপাশে মোমের আলোয় একটি কিশোরী বই পড়ছে, বোধহয় মালকিনের মেয়ে ৷

রাস্তা থেকে দুটো গ্রিক রুটি ও দুটো জর্জিয়ান রুটি (গ্রিক রুটির মতোই, মাঝখানের শূন্যটি শুধু নেই), চিজ, সসেজ কিনে আমরা ফিরে এসে লাঞ্চের তোড়জোড় করতে শুরু করলাম ৷ মানানা তখনও আসেনি ৷

চমৎকার দুটি ওয়াইন গ্লাস বের করে ভাজিক ওয়াইন ঢেলে দিল ৷ গ্লাস ও বোতল দুটিই ফেনায় ভরা ৷ গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে ‘গাউমারজোস’ বলে ছোট্ট চুমুক দিয়ে দেখি মধুর মতো মিষ্টি ৷

কিন্তু গাঁজলা দেখে আমি আর দ্বিতীয় চুমুক দিচ্ছি না লক্ষ্য করে ভাজিক ঠিক এই ধরনের মদের কী একটা নাম বলল ৷ এ মদ নাকি এখনও কিছুটা কাঁচা, এর আঁধারবাসের মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি ৷ এরকম গাঁজলাসুদ্ধ মদ ভাজিকের নাকি খুব পছন্দ ৷

দু-তিন গ্লাসের পর থেকেই ভাজিক বেলুনে সিল্ক রোড পাড়ির বিশদ পরিকল্পনা আমাকে বোঝাতে লাগল ৷ জর্জিয়ার প্রেসিডেন্টের সহযোগিতা চেয়ে তারা যে অনুরোধপত্র পাঠিয়েছে এবং সেটা পড়ে রাষ্ট্রপতি তাঁর লেটার হেডে মন্ত্রিসভার সদস্যদের প্রতি যে নোট দিয়েছেন -সবই জর্জিয়ান ভাষা থেকে আমার জন্য ইংরিজিতে অনুবাদ করে কলকাতায় অবশ্যই পাঠাবে, কিছুতেই ভুল হবে না, একথাও শোনাল ৷ আর আমাকে তো এই বেলুন অভিযানে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে আসতেই হবে, অন্তত ওসাকা-ৎবিলিসির শেষ অর্ধেক পথ ভাজিকের সঙ্গে এক বেলুনে থাকতেই হবে, এবিষয়ে বরাবরের মতো আজও সে আমার কথা আদায় না করে ছাড়ল না ৷

রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের সহযোগিতা প্রার্থনা বাংলায় মোটামুটি এইরকম:

প্রিয় প্রেসিডেন্ট,

একথা আজ সবাই জানে যে ঐতিহাসিক সিল্ক রোড পুনরায় চালু করার ব্যাপারে আপনি খুবই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন ৷ আপনিই লিখেছেন যে, ‘বুদ্ধের পথ, ইহুদীর পথ, ইসলামের পথ ও যীশুখ্রিস্টের পথের মিলন ঘটিয়েছে এই রাস্তা ৷ মানুষের সহ্যগুণের মিলন ঘটেছে এই পথে ৷’

বিখ্যাত সিল্ক রোড সম্বন্ধে বহু ধারণাই রয়েছে ৷ আমরাও তারই মধ্যে নিজেদের জায়গা খুঁজে নিয়েছি ৷ আমাদের প্রাথমিক কার্যকরী দল ‘সিল্ক এয়ার রোড’ ২০০০ সালের গোড়া থেকেই ‘এয়ার বেলুনে চড়ে সিল্ক রোড পাড়ি’ প্রকল্পে কাজ শুরু করে দিয়েছেন ৷ এই অভিযানের লক্ষ্য যন্ত্রচালিত বেলুনে করে এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের ওপর দিয়ে জাপান থেকে স্পেনে পাড়ি দেওয়া ৷

গ্রেট সিল্ক রোড অভিযান জাপানের ওসাকা থেকে শুরু হয়ে কোরিয়া, চিন, মধ্য এশিয়ার দেশগুলি পার হয়ে, কাস্পিয়ান সাগরের ওপর দিয়ে গিয়ে প্রবেশ করবে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ায় ৷

তারপর অভিযাত্রীরা কৃষ্ণসাগর পার করে ইউরোপীয় দেশগুলির ওপর দিয়ে গিয়ে স্পেনে পৌঁছবে ৷ অভিযানের শেষে অংশগ্রহণকারীরা ৎবিলিসিতে মিলিত হবেন বিশিষ্ট অতিথি ও উৎসাহী ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ৷ এখানে তাঁদের যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আলোচনা হবে ৷ বিভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধনে পরিণত হবে এই আলোচনা ৷

আমাদের দলে রয়েছেন সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি জগতের বিশেষজ্ঞরা ৷

আমরা এই অভিযানে আপনার সহযোগিতা কামনা করি এবং অনুরোধ করব অন্যান্য যে দেশগুলির মধ্য দিয়ে আমাদের অভিযান চলবে সেই দেশগুলিও যাতে আমাদের সাহায্য করে সে বিষয়েও আপনি আমাদের সহায়তা করেন ৷ আমরা নিশ্চিত যে আপনার জগৎজোড়া খ্যাতি ও যশ অভিযানের পথে পড়া দেশগুলির কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে ও জাপান থেকে স্পেন অবধি বন্ধুত্বপূর্ণ বাতাবরণ তৈরি করবে, যা আমাদের যাত্রাপথকে সুগম করার পাশাপাশি আমাদের অভিযানকেও আরও পরিচিতি এনে দেবে ৷

আমাদের অভিযান নিয়ে একটি তথ্যচিত্র ও বাস্তবধর্মী ফিচার ফিল্ম করার ইচ্ছা রয়েছে ৷ তাছাড়া একটি ফটো অ্যালবাম তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে যেখানে আমাদের যাত্রাপথের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ছবি থাকবে ৷

অভিযানের খরচ সামলাতে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার দান, বিজ্ঞাপন, বিদেশি সদস্য, স্পনসরশিপ এবং অন্যান্য দানের ওপর নির্ভর করা হবে ৷

যে সমস্ত দেশের ওপর দিয়ে আমাদের অভিযান চলবে তাঁদের কাছ থেকে ভিসা, বায়ুপথে চলার সুরক্ষা এবং দেশভিত্তিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সাহায্য আশা করি ৷

আমরা মনে করি যে অভিযানভিত্তিক ফিল্ম, ফটো অ্যালবাম, টিভি রিপোর্ট আমাদের লাভজনক অবস্থায় এনে দেবে ৷

আমরা আপনার সবরকম সাহায্যের আশা রাখি ৷

চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন জর্জিয়ান জিওগ্র্যাফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি জাজা আবজিয়ানিদজে, জর্জিয়ান মাউন্টেন অ্যামেচার ইউনিয়নের সহ সভাপতি ভ্লাদিমির মালো-ভিচকো ও আরও কয়েকজন ৷

ভাজিকের ভালো নাম ভ্লাদিমির মালোভিচকো ৷

রাষ্ট্রপতি তাঁর বিদেশমন্ত্রী, পর্যটন দপ্তরের প্রধান, ক্রীড়া দপ্তরের প্রধান, সংস্কৃতিমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রীকে নোট দিয়েছেন-

এটা একটা ইন্টারেস্টিং উদ্যোগ ৷ অনুগ্রহ করে এঁদের যথাসাধ্য সাহায্য করুন ৷ দয়া করে সব খুঁটিনাটি বিষয় বিবেচনা করবেন ৷

এঁদের সিল্ক রোডের ধারণাটি বেশ ব্যাপক ৷ প্রস্তাবিত এই বেলুন অভিযান সম্পর্কে কৌতূহলী পাঠকের জন্য জর্জিয়ার ইংরিজি দৈনিক The Georgia Times থেকে ৮ ডিসেম্বর, ২০০০ তারিখের একটি প্রতিবেদন এখানে অনুবাদ করে দেওয়া হল:

হট এয়ার বেলুনে চেপে গ্রেট সিল্ক রোড পাড়ি

জর্জিয়ার রাষ্ট্রপতি এডওয়ার্ড শেভারনাদজের আক্ষরিক উচ্চারণ অনুযায়ী ‘গ্রেট সিল্ক রোড বৌদ্ধ, হিন্দু, ইসলাম ও খ্রিস্টের পথের মিলন ঘটিয়েছে ৷ এই পথ বিশ্বের মানুষের মিলন পথ ৷’

মুখ্যত জর্জিয়ার প্রেসিডেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় ৎবিলিসির ‘গ্রেট সিল্ক রোড অ্যারোনটস অ্যাসোসিয়েশন’ একটি অভিযানের আয়োজন করেছে ৷ এই অভিযানের নাম ‘হট এয়ার বেলুনে চড়ে সিল্ক রোড পাড়ি’ ৷

এই অভিযান সংক্রান্ত কাজকর্ম জানুয়ারি ২০০০ সাল থেকে শুরু হয়ে গেছে এবং আগস্ট ২০০১ সালে অভিযান শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত চলবে ৷ দুটি আড়াআড়ি ভ্রমণপথ নির্ধারিত হয়েছে-একটি শুরু হবে ওসাকা (জাপান) থেকে এবং অন্যটি একই সময়ে শুরু হবে লন্ডন (ইংল্যান্ড) থেকে ৷ এই পথ দুটি যথাক্রমে এশিয়া ও ইউরোপের ওপর দিয়ে যাবে ৷

এশিয়া অংশে উড়ানপথটি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চিন, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান হয়ে শেষ হবে জর্জিয়ায় রাজধানী ৎবিলিসিতে ৷

ইউরোপীয় অংশে উড়ানপথ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, ইউক্রেন, রাশিয়া, আর্মেনিয়া হয়ে ৎবিলিসিতেই শেষ হবে ৷

যেহেতু বেলুনের সঙ্গে সঙ্গে সড়কপথেও একটি গাড়ি একই পথ ধরে চলবে তাই এটি গ্রেট সিল্ক রোডের ওপর একটি মোটর-অভিযান হিসেবেও ধরা যেতে পারে ৷

সংবাদসংস্থা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে এই ঘটনাবহুল অভিযান দেখানো হবে ৷ ফটো অ্যালবাম ও ফিল্ম তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে ৷ বেলুনের গায়ে থাকবে বিজ্ঞাপন যা এই অভিযানের দরুন আধখানা বিশ্বের মানুষ দেখতে পাবেন ৷ এই অভিযানটিকে অনেকেই আখ্যা দিয়েছেন-‘একবিংশ শতাব্দীর সুপার প্রজেক্ট’ হিসেবে ৷ এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যেন সেই কথাটিই প্রমাণিত হতে চলেছে ৷

এশিয়া ও ইউরোপের সন্ধিস্থলে ককেশাস অঞ্চলের মধ্যভাগে অবস্থিত জর্জিয়ায় ৎবিলিসিতে এসে মিলবে দুটি উড়ানপথ ৷

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহান্তে পালিত ‘তিবিলিসোবা’ উৎসবের সময়েই এখানে বেলুন অভিযানের সমাপ্তি ঘটবে ৷ ছুটির দিনগুলিতে অভিযাত্রীরা দিনে ও রাতে বেলুন প্রদর্শনীর আয়োজন করবেন ৷

শহরের ব্যক্তিবর্গ যাঁরা এই অভিযানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তাঁদের এবং অভিযাত্রীদের মেমোরিয়াল মেডেল, স্যুভেনির এবং ডিপ্লোমা প্রদান করা হবে ৷

এই অভিযানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যতে এই পথের কিছু পরিমার্জন করে নিয়মিত ভ্রমণপথ হিসেবেও গড়ে তোলা যেতে পারে-এশিয়া অংশে ভারত ও ইরান যুক্ত হতে পারে, ইউরোপীয় অংশে যুগোস্লাভিয়া ও গ্রিস যুক্ত হতে পারে, এমনকী উত্তর আফ্রিকার রাজ্যগুলিও যুক্ত হতে পারে ৷

যাঁরা এই ২০০১ সালের অভিযানে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাঁরা গ্রেট সিল্ক রোড অ্যারোনটস অ্যাসোসিয়েশনের কাছে আবেদন করতে পারেন ৷

সেদিন অভিযানের জল্পনায় মশগুল ভাজিক চিজ-সসেজে আমার অনিচ্ছা দেখে তার নিজের ভাগের কলাটি আমাকে গছিয়ে নিজে চিজ সসেজ রুটি দিয়ে লাঞ্চ সারল ৷ দুটি কলা ও আধখানা গ্রিক রুটিতে আমার মধ্যাহ্নভোজনও, আমার মতে, কিছু কম হল না ৷ যদিও ভাজিক তা মানতে রাজি নয় ৷

একে তো এরকম একটা সূর্যকরোজ্জ্বল দিনে কোথাও যাওয়া হল না, তার ওপর লাঞ্চের ওই অবস্থা ৷ ভাজিক বোধহয় আমার দুর্দশায় কিছুটা বিব্রত হয়েই বলল, তুমি রাশিয়ায় যাবে? ককেশাস পেরিয়ে চেচনিয়া দিয়ে আমি তোমাকে বাই রোড রাশিয়ায় নিতে যেতে পারি ৷ পথের সৌন্দর্যে তুমি মুগ্ধ হয়ে যাবে!

কালই যেভাবে গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারে বলল তাতে মনে হল সে হয়তো নিছক কথার কথা বলছে না ৷

সত্যি বলতে কী, ককেশাস পর্বতমালা পার হয়ে যেতে হবে, একথা শোনামাত্র অজানা সেই পথের টানে আমার মনে যেন আনন্দের জোয়ার খেলে গেল ৷ ছেলেবেলায় রুদ্ধশ্বাসে পড়া তলস্তয়ের ‘ককেশাসের বন্দী’র পাহাড়-প্রান্তর যেন চোখের সামনে ছবির মতো দেখতে পেলাম ৷

সমস্যা হল আমার রাশিয়া যাবার ভিসা নেই ৷ ভাজিকের বিশ্বাস, সীমান্তে তাদের চেনাজানা অফিসার ধরে দু-তিনদিনের সাময়িক একটা ভিসার ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে ৷

এভাবে যাওয়াটা একটু বেশি দুঃসাহসিক হয়ে যাবে কি না, তাছাড়া আমার পক্ষে অনিশ্চিত ভিসার ভরসায় বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করা আদৌ উচিত হবে কি না এইসব ভেবে মন ক্রমশই দমে যেতে লাগল ৷ আরেকটা কথা মনে পড়ায় আমি সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে গেলাম ৷

ঠিক হয়েছিল, জর্জিয়ার রাইটার্স ইউনিয়নের বার্ষিক সভায় দেশের রাষ্ট্রপতি শেভারনাদজে আসবেন, তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবেন ইউনিয়নের সভাপতি, সভার দিন রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে খবর এল, চেচনিয়ার দুজন গেরিলা যোদ্ধা রুশ সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে সীমান্ত পেরিয়ে জর্জিয়ায় ঢুকে পড়েছে, রাশিয়ান সরকার এতে জর্জিয়ার ওপর বিরক্ত ও ত্রুদ্ধ, ফলে পলাতক গেরিলা যোদ্ধা দুজনকে গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে এক্ষুনি ব্যবস্থা করা দরকার ৷ দেশের এই সংকটে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ব্যস্ততার জন্য তিনি আসতে পারলেন না ৷

ককেশাস পেরিয়েই সেই চেচনিয়া! সেখানে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলছে, খবরের কাগজে তার বহু বিবরণ পড়েছি ৷ বেড়াবার নেশায় সেই দুর্যোগের মধ্যে গিয়ে পড়া কি ঠিক হবে?

মানানা এল সন্ধের মুখে ৷ সঙ্গে নোদার ৷ দুজনেরই মলিন, ক্লান্ত, উপোসচিহ্নিত মুখ ৷ কী ব্যাপার? এত দেরিই বা হল কেন?

নোদারের কথা থেকে জানা গেল, জর্জিয়ান পুলিশ চুক্তিমতো ডলার পেয়েও মাফিয়া নেতার মরদেহ কবরস্থ করার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে নানাভাবে বাধা দিয়েছে, সারাদিন ধরেই নানান বিধিনিষেধ জারি করেছে, ফলে পুরো কাজ শেষ হতে এত বিলম্ব ৷ সারাদিন খাওয়া হয়নি বলে নয়, নোদারের রাগ জর্জিয়ানদের আবহমানকালের রীতি অনুযায়ী অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠান করতে বাধা দেওয়ায় ৷ ক্রোধ আর ক্ষোভ মিশিয়েই নোদার বলল, প্রত্যেক জাতির নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন, আচার অনুষ্ঠান থাকে, তাতে বাধা দেওয়ার কোনও অধিকারই কারও থাকা উচিত নয় ৷

নোদার আজ আর থামতে চায় না ৷ ভাজিকের দেওয়া দুপুরের কেনা ওয়াইনে চুমুক দিয়ে বলল, আমার কাকা পাঁচ দেশের সরকারের কাছে মাফিয়া ডন হতে পারে, কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে কত দেশের কত লোক আজ কাঁদছে! তাঁর দলের লোকদের তো চোখে জল নিয়েই পুলিশের নতুন দর কষাকষি সামলাতে হল ৷

বিদেশে বেড়াতে এসে সেদেশের এত দূর পরিচয় পাব ভাবিনি ৷

নোদারের জাত্যাভিমান একটু বেশিই ৷ প্রথম রাতেই আমার শোবার ঘরে দেওয়ালের ঢাল-তলোয়ার প্রসঙ্গে জর্জিয়ানদের বীরত্ব নিয়ে তার গর্ব আমার মনে আছে ৷ জাতীয়তা নিয়ে এই গর্ব বা গৌরবের জন্যই হয়তো সে তার ৎবিলিসির প্রাচীন বনেদি এলাকায় তার পিতৃপুরুষের প্রায়-জীর্ণ বাড়ি ছেড়ে মায়ের নতুন বাড়িতে এসে থাকতে চায় না ৷ তার মায়ের নতুন স্বামীও তো ইউক্রেনিয়ান!

ৎবিলিসিতে শিল্পসন্ধ্যা

পরদিন আমার জন্য একটা বড় চমক অপেক্ষা করে ছিল ৷

শহরের এক ধারে, ভিড় কোলাহল ছাড়িয়ে মানানা আমাকে একটা বিশাল উদ্যানের রাজকীয় গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে দারোয়ানকে কিছু বলবার আগেই দুজন যুবক ভেতর থেকে প্রায় দৌড়ে এসে দারোয়ানকে দরজা খুলে দিতে বলল ৷ তারা মানানাকে ও আমাকে রীতিমতো অভ্যর্থনা করে উদ্যান-মধ্যবর্তী এক বিরাট অট্টালিকার ভেতরে নিয়ে গিয়ে বিশাল সুসজ্জিত একটি বসবার ঘরে বসাল ৷ একটু পরেই সে ঘরে এলেন এক দীর্ঘদেহী সুদর্শন বৃদ্ধ, জর্জিয়ার সমকালীন শ্রেষ্ঠ ভাস্কর মেরাব বের্দজেনিশভিলি ৷ ৎবিলিসি শহরে পার্কে স্কোয়্যারে যত বিশিষ্ট ভাস্কর্য দেখা যায় তার অধিকাংশই এই শিল্পীর গড়া ৷ সেদিক থেকে পুরো শহরটাই তাঁর নিজস্ব গ্যালারি ৷ তাঁর সব সৃষ্টির স্থায়ী প্রদর্শনী অবশ্য তাঁর বাড়িতেই ৷ একটি বিশাল কক্ষ ছাড়াও বাড়ির অন্যান্য জায়গায়ও মূর্তিগুলি সাজানো আছে ৷ শুধু এই নয়, বাড়ির বাইরে খোলা আকাশের নিচে উদ্যানের নানা অংশে হঠাৎ হঠাৎ একেকটি মূর্তি ৷ বিখ্যাত এই ভাস্কর, মানানার পিতৃবন্ধু, পার্কে মানানার বাবার মূর্তি এঁরই করা, ঘরে ঢুকেই মানানাকে বুকে জড়িয়ে ধরে গাল চুম্বন করলেন ৷ তারপর আমার সঙ্গেও আলিঙ্গন সেরে আমরা পাশাপাশি বসে মানানার দক্ষ দোভাষিত্বে নানা বিষয়ে বাক্যালাপ করতে লাগলাম ৷ ইতিমধ্যে এক যুবক এসে জর্জিয়ান ব্র্যান্ডি আর নানারকম ফলের একটা সুদৃশ্য ঝুড়ি দিয়ে গেছে ৷

আগে ঠিক ছিল আমরা বেলাবেলি আসব, মানানাও সেইমতো ভাস্করকে বলে রেখেছিল, কিন্তু আমার দোষেই আমাদের এখানে আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে ৷ আমি আজ দকুবারি নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফেরার পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম ৷ এই দকুবারি বা দকোয়ারি বা কুরা নদী জর্জিয়ানদের খুব প্রিয় নদী ৷ আমি অনেক তরুণ ও তরুণীকে তাদের প্রিয় তিনটি জিনিসের নাম জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেয়েছি-মহাকবি সোতা রুসতাভেলি, উনিশ শতকের চিত্রশিল্পী ফিরোসমানি আর এই দকুবারি ৷

দেরিতে আসায় তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে আসছে ৷ সমস্যা হল, ফ্ল্যাশ দিয়ে ভাস্কর্যের ছবি তোলা সম্পূর্ণ অনুচিত ৷ সেইজন্যই সংক্ষেপে আলোচনাপর্ব সেরে আমরা বাড়ির ভেতরে ও উদ্যানে ভাস্কর্যগুলি দেখতে লাগলাম ৷ ভেতরের মূর্তিগুলির ছবি তোলবার সময় নিজের দোষে নিরুপায় হয়ে ফ্ল্যাশ ব্যবহার করতেই হল, সেইসব আশ্চর্য মূর্তির অন্যায় ছায়াকে ছবিতে ডেকে আনছি জেনেও ৷

আমি কখনও এত বড় মাপের ভাস্করের সঙ্গে তাঁর সৃষ্টিকর্ম এভাবে দেখিনি, মন উপভোগের আনন্দে টইটম্বুর, চলে আসবার সময় শিল্পীর সহৃদয় সৌজন্যও আমাকে পিছু টানতে লাগল ৷

নির্জন শহরপ্রান্ত ছেড়ে ৎবিলিসির পুরনো এলাকায় এলাম এক তরুণ ভাস্করের প্রদর্শনী দেখতে ৷ ২৮ বছর বয়সী এই জর্জিয়ান ভাস্করের কাজে আমাদের বস্তারের ও বাঁকুড়ার ঢোকরা লোকশিল্পের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখে আমার ভারি ভালো লাগল ৷ সজ্ঞান প্রভাব যদি নাও হয়, আমাদের ঢোকরা শিল্পের সঙ্গে তাঁর এই মিশ্রধাতুর ঢালাই কাজের খুবই মিল ৷ আমার তো প্রিয় ভাস্কর ঢোকরা লোকশিল্পরীতির আধুনিক কবি বা কারিগর মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাজগুলির কথা খুব মনে পড়ছিল ৷ জর্জিয়ান এই ভাস্করের নাম ইরাক্লি সুলাদজে ৷

ভাস্কর্য প্রদর্শনী দেখে ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম পুরনো ৎবিলিসির ‘খুদে গ্যালারি’তে ৷ সেখানে ছোট পরিসরে নতুন শিল্পীদের একত্র বা একক প্রদর্শনী হয় ৷ আজ একটি তরুণী শিল্পীর প্রদর্শনী চলছে ৷ আমরা ছবিও দেখলাম, নতুন প্রজন্মের জর্জিয়ান শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে তাঁর চিত্র-ভাবনাও কিছুটা শুনলাম ৷

দুপুরে নদী, গোধূলিতে ভাস্কর্য ৷ সন্ধ্যারাতে চিত্রপ্রদর্শনী দেখে আমরা চলে এলাম ৎবিলিসি সেন্ট্রাল ফিলারমোনিয়ায় ৷ সেখানেও চার রাস্তার মোড়ে বের্দজেনিশভিলির বিশাল ভাস্কর্য-ম্যুজে ৷ ফিলারমোনিয়ার অলিন্দে দেখা হল ম্যানেজার সোক্রাট সালুকভাদজের সঙ্গে ৷ শুনে অবাক হলাম, আমি প্রথম যেদিন এই ফিলারমোনিয়ায় জর্জিয়ান লোকনৃত্যগীতের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিলাম, সেদিনের পর থেকে জর্জিয়ার ফার্মাকোলজির ইতিহাসের গবেষক এই ম্যানেজার মশাই ওষুধ আবিষ্কারে জর্জিয়ার কৃতিত্ব ও প্রাচীনত্ব বিষয়ে তাঁর গবেষণার খেরোর খাতা নিয়ে রোজই এই রাস্তামুখী অলিন্দে আমার অপেক্ষায় পায়চারি করেন ৷ তেত্রিশশো বছর আগে জর্জিয়ায় ওষধি লতাগুল্ম চাষের তথ্যপ্রমাণও নাকি তাঁর হাতের মুঠোয় ৷

সোক্রাট সালুকভাদজে তাঁর গবেষণার সারসংক্ষেপ (তাও ১৫-২০ পাতা) আমার হাতে তুলে দিয়ে আমার এক হাত তাঁর দুহাতে ধরে অনুরোধ জানালেন ওষুধের ইতিহাসে জর্জিয়ার গৌরবান্বিত প্রাচীনতার কথা আমি যেন ‘ভ্রমণ’ পত্রিকায় লিখি ৷ মানানা বাংলা ‘ভ্রমণ’-এর সঙ্গে একটা ইংরিজি ‘ভ্রমণ’ও সোক্রাটকে আগেই দেখিয়েছিল ৷

সোক্রাটকে কথা না দিয়ে চলে আসা চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা হত ৷ সোক্রাট আমার হাত আর ছাড়ে না ৷ তাঁর দ্বিতীয় অনুরোধ-ভারতে ফিরে যাবার আগে আবার একদিন যেন ফিলারমোনিয়ায় জর্জিয়ান লোকনৃত্যগীত দেখে যাই ৷ প্রত্যেক কথায় তাঁর প্রবল জাত্যানুরাগ-‘এমন প্রাণোচ্ছল নাচ গান বাজনা তুমি আর কোথাও দেখতে পাবে না ৷ রাশিয়ায় তো নয়ই ৷ অবশ্য ভারতের লোকনৃত্যগীত আমি দেখিনি ৷’

জর্জিয়ান লোকনৃত্যগীত সত্যিই অপরূপ, এখনও আমার চোখ-কান-মনে লেগে আছে ৷

ভাজিক আজ আমাদের ডিনার খাওয়াবে, সে সকাল থেকেই তার বেলুনে সিল্ক রোড অভিযানের ‘ভেরি মেনি ওয়ার্কস’ নিয়ে বেরিয়েছে ৷ কথা আছে, আমরা সেই রেস্তোরাঁ সরণিতে একটা নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁয় যাব, সেখানেই সে আমাদের অপেক্ষায় থাকবে ৷

আমরা যখন পৌঁছলাম, ভাজিকের তখন কয়েক বোতল শেষ, বোধহয় হিসাব রাখতে টেবিলে খালি বোতল রেখে দিয়েছে ৷ মানানা তাদের ভারতীয় অতিথিকে নিয়ে আসবে বলে রেস্তোরাঁর মালিক সবচেয়ে ভালো কোণটিতে একটি টেবিল পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছেন ৷

আমি আর মানানা পৌঁছনোমাত্র মালিক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করে চেয়ার টেনে আমাকে ও মানানাকে বসালেন ৷ মালিক ভদ্রলোক ভাজিকের বহুদিনের বন্ধু ৷

ভাজিকের একটা গুণ দেখেছি, যতই মদ্যপান করুক, সে কখনও বেহেড মাতাল হয় না ৷

বাইরে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে ৷ অনেক রাত পর্যন্ত পানাহার, গল্প, দুই দেশ নিয়ে নানান আলোচনা শেষ করে বাড়ি ফিরে ভাজিক-মানানার দ্বৈতসংগীত শুরু হল ৷ তাদের অনেক অনুরোধেও আমি তাদের সুরে সুর মেলাতে পারলাম না, কেননা আমার কানে সুরের প্রবল তৃষ্ণা থাকলেও গলায় শুধুই অসুর ৷

নিজের ঘরে ঢুকে যখন বই পড়বার চেষ্টা করছি তখনও ভাজিক-মানানার দ্বৈতসংগীত, যখন শুয়ে পড়বার উদ্যোগ করছি তখনও তাদের সুরের আগুন বাড়িময় খেলে বেড়াচ্ছে ৷

৭. ডাইনোসরের পায়ের ছাপ

পশ্চিম জর্জিয়ায় ইমেরেথি রিজিয়নের রাজধানী কুতাইসি থেকে চলেছি কৃষ্ণসাগরের তীরে, গ্রিগোলেথিতে ৷ পথে সাতাপ্লিয়ার জঙ্গলে জীবনে প্রথম ডাইনোসরের পায়ের ছাপ দেখলাম ৷ যতই দেখি, বিস্ময় যেন আর শেষ হয় না ৷ পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত বিরাটাকার এই প্রাণী কত লক্ষ বছর আগে ঠিক এইখানে, এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত, জঙ্গলও তখন কী বিশাল আর কী গভীর ছিল ভেবে কূল-কিনারা পাই না ৷ কেমন ছিল সেই প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবী?

জঙ্গলের আরও ভেতরে লক্ষ কোটি বছরের প্রাচীন গুহা ৷ অন্ধ্রপ্রদেশের বোরাগুহার মতো, তবে-তার চেয়ে অনেক বড় ৷ টিমটিমে বৈদ্যুতিক আলোয়, বিরাট বিরাট অদ্ভুত সব প্রাকৃতিক ভাস্কর্য, অনেক জায়গায় রীতিমতো জলের ধারার ওপর দাঁড়িয়ে দেখতে হয় ৷

ঘণ্টাখানেক পর গুহা থেকে উঠে এসে দেখি সামনেই একটা পুলিশের গাড়ি, গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন পুলিশ অফিসার ৷ যেন আমাদেরই অপেক্ষায় ৷ ভঙ্গি দেখে মনে হল গ্রেপ্তার করবে না কি?

আজ সাপ্তাহিক বন্ধের দিন গুহায় ঢোকা নিষেধ ৷ প্রহরীর কাছে বাধা পেয়ে আমরা ফিরেই যাচ্ছিলাম, পথে দেখা হয়ে গেল গুহা রক্ষণাবেক্ষণ অফিসেরই উচ্চপদস্থ কর্মচারীর সঙ্গে ৷ তাঁরই হস্তক্ষেপে নিয়ম ভেঙে আমাদের গুহা দর্শনের অনুমতি দেওয়া হল, বিদ্যুৎ সংকট সত্বেও গুহার আলোও জ্বালানো হল, সবই সাহিত্যিকের প্রতি জর্জিয়ানদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার প্রকাশ, অত বড় লেখক নোদার দুমবাদজের মেয়ে স্বয়ং এসেছেন, সঙ্গে আবার ভারতীয় অতিথি, গুহা না দেখেই তাঁরা ফিরে যাবেন?

এপর্যন্ত ভালোই ছিল, কিন্তু নিষিদ্ধ গুহাপ্রবেশ হয়তো পুলিশের মনঃপূত নয়, যে-কোনও ভাবেই হোক তাঁরা খবর পেয়ে এখানে চলে এসেছেন! যেখানে এখনও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের পায়ের ছাপ ছুঁয়ে দেখা যায়, আদিম কালের গুহায় কোটি কোটি বছরের প্রাচীন প্রাকৃতিক ভাস্কর্য চাক্ষুষ করে এলাম, মনে এখনও তার রেশ কাটেনি, সেখানে হঠাৎ পুলিশের আবির্ভাব! মানানাও মনে হয় একটু দমে গেছে ৷

পুলিশ অফিসার দুজন দ্রুত এগিয়ে এসে আমাকে সহাস্য স্বাগত জানালেন ৷ আমাকে তাঁরা টিভিতে দেখেছেন, কে একজন জর্জিয়ান সাংবাদিক আমাকে তাঁদের দেশ দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন, মানানাই কি সেই জর্জিয়ান সাংবাদিক?

মানানা পুলিশের কথাগুলো ইংরিজি করতে করতেই হেসে বলল, ‘তোমাকে দেখেই চিনেছে, আমিও তোমার সব টিভি প্রোগ্রামেই ছিলাম, আমাকে চিনতে পারল না ৷’

‘তার কারণ একটাই ৷ রোজই টিভিতে অসংখ্য জর্জিয়ান মহিলাকে দেখা যায়, আর ভারতীয় বলতে শুধুই আমি ৷ মনে তো থাকবেই ৷’

যাইহোক, পুলিশের আগমনের কারণ জেনে আমি তো হতভম্ব, এপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, আমি এখানে এসেছি শুনেই চলে এসেছেন আমাকে দেখতে!

কৃষ্ণসাগরের তীরে

সাতাপ্লিয়া থেকে দুপুরে বেরিয়ে সন্ধেবেলা জনমানবহীন একটা রাস্তায় ড্রাইভার জানাল, গ্রিগোলেথির রাস্তা সে হারিয়ে ফেলেছে ৷

এরপর কয়েক ঘণ্টা শুধু ভয়ে ভাবনায় দিশেহারা অবস্থা ৷ একবার একটা রাস্তায় পঞ্চাশ-একশো কিলোমিটার এগিয়ে রাস্তা না পেয়ে আবার ফিরে এসে অন্য রাস্তা ধরা, সেখানেও চেনা রাস্তার সন্ধান মেলে না, আবার অন্য রাস্তা ৷ কাছাকাছি মানুষের ঘরবাড়িও নেই ৷ তা সত্বেও মাঝেমাঝেই ড্রাইভার গাড়ির হর্ন বাজিয়ে, মুখের সামনে দুহাতের তালু দিয়ে ঘিরে গলার জোরে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে যাচ্ছে ৷ আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম ৷ এসব জায়গায় আজকাল নাকি দেশের প্রবল অর্থসংকটের ফলে খুব ডাকাতিও হচ্ছে ৷ মানানা বোধহয় উদ্বেগ আর সহ্য করতে পারছিল না, তার মোবাইল এখানে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় দেখেও মাঝে মাঝেই সে নানারকম নম্বর ডায়াল করে যাচ্ছে ৷

শেষ পর্যন্ত মধ্যরাতে কৃষ্ণসাগরের তীরে পৌঁছে খুবই হতাশ হলাম ৷ সাগরসৈকত ও তার ধারের রিসর্ট এলাকা অন্ধকারে ডুবে আছে ৷ এখন অফ সিজন, তার ওপর এনার্জি ক্রাইসিস, জেনারেটর একেবারেই চালানো হয় না ৷ মানানা আর ড্রাইভার অনেক চেষ্টায় রিসর্টের অফিসের দুজন মহিলা কর্মচারীকে জাগিয়ে আধঘণ্টার জন্য জেনারেটর চালাবার ব্যবস্থা করল ৷ গাছপালার মধ্যে তাঁবুর আকারে একটু দূরে দূরে পর পর বেশ কয়েকটা কাঠের ঘর ৷ তারই একটা ঘর খুলে ড্রাইভার আমার স্যুটকেসটা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল ৷ মানানা আরেকটা ঘরে বাক্স রেখে এসে আমাকে পথকষ্টের জন্য সহানুভূতি ও রাতের জন্য ঘরে শুয়েই কৃষ্ণসাগরের সংগীত শোনার নিশ্চয়তা জানিয়ে বাইরের অন্ধকারে হারিয়ে গেল ৷

শোবার জন্য তৈরি হতে হতেই জেনারেটরের মেয়াদ শেষ ৷ অন্ধকারে কাঠের দেওয়াল থেকে মাথা বাঁচাতে শুধু হাত দিয়ে দিয়ে দেওয়ালের ত্রিভুজ সামলে কোনক্রমে শয্যাগ্রহণ করা গেল ৷

পরদিন ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে কোথাও কারও সাড়া শব্দ না পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণসাগরের বালুকাবেলায় গিয়ে দাঁড়াই ৷ হাওয়ায় গায়ের শার্ট, কাঁধের ক্যামেরা উড়িয়ে নিয়ে যাবে মনে হল ৷

প্রায় টলতে টলতে এগিয়ে গেলাম সুপসা নদীর মোহনা দেখতে ৷ এখানে আসবার পথেই গুরিয়ায় পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে সুপসা নদীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, বেশ অনেকটা সময়, তখনই শুনে এসেছি সুপসা গ্রিগোলেথিতে গিয়ে কৃষ্ণসাগরে পড়েছে ৷

দেখে মন খারাপ হয়ে গেল ৷ এই সেই আমাদের বাল্যের ভূগোলবই-বিখ্যাত কৃষ্ণসাগর, এই নাকি একটা নদীর মোহনা!

এখানেই দেখা হল মানানা আর তার ড্রাইভারের সঙ্গে ৷ শুনলাম, আমি দেরি করে এসেছি বলে সমুদ্রের ভোরের সৌন্দর্য দেখা হল না ৷ যদিও কৃষ্ণসাগরের সেরা সৈকতও নাকি এটা নয় ৷ তবে আমরা এত কষ্ট করে এখানে এলাম কেন? মানানার অকপট উত্তর-এখানে আমার একটা নিজস্ব রিসর্ট আছে, সারি সারি কাঠের তাঁবুর মতো যেগুলো দেখলে, তারই একটা ৷ চলো তোমাকে দেখাব ৷

মানানা কাল রাতে সেখানেই ছিল ৷ দরজা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল ৷ দেড়তলা কাঠের কুঁড়ে ৷ মানানা বলল, এটা আমার নিজের কেনা না ৷ বছর দুয়েক আগে বাবার ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে বাবার লেখার একজন ভক্ত, তিনিই এইসব কটেজের মালিক, আমাকে এইটা দান করেছেন ৷ এমনিতে আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত, সমুদ্রসৈকতে ছুটি কাটানোর সামর্থ কই?

গুরিয়ার আরাচা পাহাড়ের জঙ্গল আর নদী ছাড়াও সেখানকার সরল সুন্দর সাধারণ মানুষজন আমার মনকে বড্ড স্পর্শ করেছিল ৷ ওই পাহাড়িয়া গ্রামের ছোটদের মুখগুলো তো আমার মনে আঁকা হয়ে আছে ৷ আহারে, আর কখনও ওদের সঙ্গে আমার দেখা হবে না! সেখানে জঙ্গলের মধ্যে, দূর সমুদ্রের একলা দ্বীপের মতো একটা প্রাচীন গির্জারও যেন হৃদয় আছে ৷ নির্জন জঙ্গলে এ যেন কাঠ-পাথরের তৈরি একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর ৷

গুরিয়ায় বহু প্রাচীন ও বিখ্যাত একটি স্কুলের এক ইংরিজি জানা অল্পবয়সী শিক্ষক আমাকে গুরিয়ার কথা শোনাচ্ছিলেন, তার সঙ্গে ছিলেন ওই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক, গুরিয়ার ইতিহাস তাঁর নখদর্পণে, কিন্তু ইংরিজিটা ভালো জানেন না বলে ইংরিজি জানা সহশিক্ষকের মাধ্যমে আমাকে গুরিয়ার পাঠ দিচ্ছিলেন ৷ প্রাচীন গির্জাটি নাকি ষষ্ঠ শতাব্দীর ৷ এটি গুরিয়ার বিখ্যাত সেমকস্মোদি চার্চ ৷

গুরিয়ার তোরণে বাবার কবিতার উদ্ধৃতি দেখে মানানা আমাকে তার ইংরিজি শোনাল, বাংলা করলে এইরকম হবে-‘‘আমার ছোট্ট গুরিয়া দেবতাদের জন্মভূমি ৷’’

আরেকটা তোরণে আনা কালান্দাজের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি খোদাই করা ৷ আমাদের বাংলার গ্রামে শহরে এরকম করা যায় না?

কৃষ্ণসাগরের উড়ন্ত চুমু

বিদায় নেবার দিন যত ঘনিয়ে আসছে, মনের মধ্যে ততই যেন ব্যথা বাজে ৷ কৃষ্ণসাগরের শ্রেষ্ঠ সৈকতভূমি বাতুমি দেখা হল না, তা নিয়ে আর আপসোস নেই ৷ ককেশাস পর্বতমালার শ্বাসরোধী সৌন্দর্যের বাসভূমি গুদায়ুরিতে যাওয়া হল না, তা নিয়েও কোনও দুঃখ নেই, দুঃখ শুধু, ছেড়ে যাবার দিন আসন্ন ৷

কৃষ্ণসাগর থেকে সেদিন সকালেই ফেরার পথে অদ্ভুত একখানা ব্রেকফাস্ট হল ৷ রাস্তার ধারে পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে সাগরের মাছ ধরে এনে বিক্রি করছে মেয়েরা, আমাদের দেখেই হই হই করে এগিয়ে এল, সবাই মানানাকে চেনে ৷ সঙ্গের এই পরদেশী অতিথিটি ভারতীয় জেনে এবার তাদের আনন্দ আর ধরে না ৷ একটি মেয়ে বার কতক চেষ্টা করে আমার নামের উচ্চারণও রপ্ত করে ফেলল ৷ ঠিক হল এখান থেকে মাছ কিনে রাস্তার উল্টোদিকের ছোট্ট খাওয়ার দোকান থেকে সেই মাছ ভাজিয়ে সেখানে বসেই সকালের জলখাবার সারা হবে ৷ কয়েকটা মাছ মানানা বাছল, ওরাও কয়েকটা বেছে দিল ৷ ছোট ছোট ট্রাউট, এক ধরনের পমফ্রেট বা ওই জাতীয় মাছ, আরও দুয়েকটা কী যেন ৷ সেগুলো কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করে ওরাই দোকানে পৌঁছে দিল ৷

দোকান চালায় দুই প্রৌঢ়া, ভারি যত্ন করে প্লেটে স্যালাদ, চিজ, সস, বেতের টুকরিতে জর্জিয়ার রুটি, পাউরুটি সাজিয়ে টেবিলে রেখে গেল ৷ তারপর একে একে এল আস্ত আস্ত ট্রাউট মাছ ভাজা, পমফ্রেট ভাজা, আরও দুয়েকটা কুচো মাছ ৷ তিনজনের পক্ষে খুবই বেশি ৷ যাইহোক, কফি দিয়ে প্রাতরাশ শেষ হল ৷

মানানা বাড়ির জন্যও আরও কিছু মাছ কিনে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে, তার পিছনে আমি, পিছন থেকে হঠাৎ একটা মেয়ে আমার নাম ধরে ডেকে উঠল, ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, তার এক হাতে একটা মাছ, আরেক হাতে আমার উদ্দেশে তার চুমু উড়িয়ে দিল, মুখের হাসির মধ্যে মনের প্রীতি ছড়ানো ৷

এপথেই এযাত্রায় খুব ভালো একজন বন্ধু পেয়েছিলাম, ভদ্রলোকের কার্ড হারিয়ে ফেলেছি, নামও লিখে রাখা হয়নি ভেবে এখন খারাপ লাগে ৷

বোধহয় আধঘণ্টা পর পর মানানাকে ফোন করে জানতে চাইছেন আমরা এখন ঠিক কোন পর্যন্ত এসেছি, সেইমতো হিসাব করে ভদ্রলোক ঠিক সময়ে হাসুরিতে চার রাস্তার মোড়ে পৌঁছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন যাতে সেখান থেকে ৎরোমি-তে সপ্তম শতাব্দীর একটা বিখ্যাত গির্জায় যেতে আমাদের রাস্তা খোঁজাখুঁজি করতে না হয় ৷ ভদ্রলোক হাসুরির একটি সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক, আজ মধ্যাহ্নভোজে আমরা তাঁর অতিথি ৷

চার রাস্তার মোড়ে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল মানানা ৷ ভদ্রলোক আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলে নিয়ে সেই প্রাচীন গির্জা, একদা সমৃদ্ধ ৎরোমি ও হাসুরির নানা কথা শোনাতে শোনাতে গাড়ি চালাচ্ছেন ৷ পিছনে মানানার গাড়ি ৷

গির্জায় পৌঁছে দেখা গেল গির্জা বন্ধ ৷ অনেকটা এলাকা নিয়ে বেশ বড় গির্জা ৷ বন্ধ দরজার সামনে একটা পাগলী গান গাইছিল, আমাদের দেখে এগিয়ে এসে হাসিতে ভেঙে পড়ল ৷ কিছুতেই তার হাসি আর থামে না ৷ তার মধ্যেই সে কোনওক্রমে যা জানাল, সম্পাদকমশাইয়ের ইংরিজি অনুবাদে তার সারসংক্ষেপ এই যে, আজ অন্য কী একটা গ্রামের গির্জায় নেমন্তন্ন, সেখানে বাদ্যিবাজনা পান-ভোজনের ঢালাও আয়োজন, এখানকার সবাই তাই এই গির্জা বন্ধ করে সেখানে গেছে ৷

গাড়ি ঘুরিয়ে শহরের একটা চমৎকার রেস্তোরাঁয় এলাম ৷ ভেতরে ঢুকে আরও দুজনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল ৷ এঁরাও এই পত্রিকার সাংবাদিক ৷ দলের মধ্যে মহিলা বলতে একা মানানা ৷ মোট ছজনের জন্য বিরাট টেবিল সাজানো হয়েছে ৷ ড্রাইভার সহ আমরা তিনজন, প্রধান সম্পাদক সদলে তিনজন ৷

নানারকম ভোজ্য-পানীয় আসতে লাগল ৷ দেখলাম কাউকে কিছু আদেশ করতে হচ্ছে না, একের পর এক সব আপনা থেকেই টেবিলে পরিবেশন করে যাচ্ছে ৷ তার মানে আগে থেকে সব ঠিক করা আছে ৷

গলায় গিটার ঝুলিয়ে একজন এসে গানও শোনাতে লাগল ৷ একটু পরে প্রধান সম্পাদক গিটারটি চেয়ে নিয়ে নিজেই একটা গান ধরলেন, ভদ্রলোক অতি সুদর্শন, প্রথম আলাপেই তাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা বোঝা যায়, কী খাচ্ছি, কী খাচ্ছি না সে বিষয়ে তাঁর সযত্ন নজর দেখেও আমি তো অবাক ৷ তার ওপর তাঁর ভরাট সুরেলা গলার গান শুনে ভারি আনন্দ হল-ভ্রমণপথে এমন বন্ধুও তবে মেলে! এমন আকস্মিক!

এরপর তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনায় গাল-গল্পে একেবারে জমে গেলাম ৷ মধ্যাহ্নভোজন গড়িয়ে গেল নৈশভোজের দিকে ৷ অথবা এটাও হয়তো আদপে নৈশভোজনেরই নিমন্ত্রণ! জর্জিয়ায় এর আগেও যেমন হয়েছে ৷

বন্ধু হঠাৎ বললেন, মানানা, অমরেন্দ্রর সঙ্গে আগে কেন আমার আলাপ করাওনি? আজ তোমরা যেতে পারবে না ৷

মানানা তাঁর অনেক দিনের বন্ধু ৷

এরপর মাতৃভাষায় মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে প্রায় দু-তিন মিনিট কথা বলে আমাকে বললেন, আমার স্ত্রী তোমার জন্য আমাদের সবচেয়ে সুন্দর ঘরটা সাজিয়ে রাখছেন-৷

আজ রাতেই ৎবিলিসি পৌঁছতে হবে, কাল বিকেলে জর্জিয়া থেকে বিদায়, একথা আমি ও মানানা প্রায় একসঙ্গে জানাতে আমার বন্ধুর চটজলদি মীমাংসা-কাল আমি নিজে তোমাদের সোজা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেব ৷ ৎবিলিসি এখান থেকে দেড়শো কিলোমিটারের বেশি নয় ৷

আমার বইপত্র? জামাকাপড়?

মানানাদের বাড়ি হয়ে যাব, পনেরো মিনিটে সব গুছিয়ে নেবে ৷ আজ রাতে, চলো, আমরা জর্জিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের স্বপ্নের কথা বলব ৷ ইংরিজিতেও তিনি জর্জিয়ার বদলে ‘শাখার্ৎবেলো’ বললেন ৷

এর কী উত্তর? আমি তাঁর একটা হাত মুঠোয় নিয়ে বলি, এত কষ্ট, এত দারিদ্রের মধ্যে কতদিন তোমাদের স্বপ্ন বেঁচে থাকবে জানি না!

দারিদ্রের আলোচনা আজ করব না ৷ এ দেশের দারিদ্রের চেয়েও বড় শত্রু কী জানো? আমাদের দুর্নীতি! প্রশাসনের সর্বত্র লাগামছাড়া দুর্নীতি ৷ চলো, আজ আমরা ডেভিডের কথা বলব, কুইন ঠামারের গান গাইব, সোতা রুসতাভেলির কবিতা পড়ব ৷ আজ তোমাকে ছাড়ছি না ৷

কুইন ঠামারকে জর্জিয়ার মানুষ বলে কিং ঠামার ৷ দ্বাদশ শতাব্দীর রানি ঠামারের শাসনে জর্জিয়া হয়ে উঠেছিল এক অতি সমৃদ্ধ দেশ ৷ জর্জিয়ার মহাকবি সোতা রুসতাভেলিও ছিলেন এই সময়কার ৷ মহাকবির সঙ্গে মহারানির গভীর বন্ধুত্বও এক গৌরবজনক ইতিহাস ৷

ৎবিলিসি পৌঁছলাম মধ্যরাতে ৷

ভাজিক জেগে ছিল, দরজা খুলে দিয়েই বলল, শুতে যাবার আগে তোমার এয়ার টিকিটটা আমাকে দিয়ে যেও, কাল সকালেই আমি তারিখ বদলিয়ে আনব ৷ নভেম্বর তিন বা চার তারিখে গেলে চলবে না?

কী ব্যাপার? না দুদিন পরই ৎবিলিসি উৎসব-তিবিলিসোবা ৷ তাছাড়া জর্জিয়া এসে গুদায়ুরি আর বাতুমি না দেখে ফিরে যাওয়া-সে শুধু মানানাই ভাবতে পারে!

মানানা তার বিড়ালের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত, ভাজিকের খোঁচা বোধহয় শুনতে পায়নি, একবার মুখ তুলে শুধু বলল, কাল তোমার জন্য ‘উখা’ করব ৷ উখা কী জানো? বিখ্যাত রাশিয়ান স্যুপ ৷ এটা আসলে জেলেদের স্যুপ (ফিশারমেন’স স্যুপ) ৷ ব্ল্যাক সির মাছ তো সেইজন্যই এনেছি ৷

গোছগাছ শেষ করে শুতে গিয়ে আর ঘুম আসে না ৷ সকালে অনভ্যস্ত, অভিজাত নারীকণ্ঠে ফেরিওলার ডাক শুনে জেগে উঠে বুঝি একসময় নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ৷

জর্জিয়ায় আমার প্রথম রাতের ঘুমও ভেঙে ছিল এই ক্লান্ত বিষণ্ণ ক্লিষ্ট নারীকণ্ঠের জিনিস ফিরি করার ডাকে ৷

এ যেন এক করুণ বাঁশির সুর ৷ সমস্ত জর্জিয়ার কষ্ট ও অভিমান এর মধ্যে জড়িয়ে আছে ৷ এদের শিল্পসাহিত্য, গর্ব-গৌরব, সাধ-আহ্লাদ, ঐতিহ্য অঙ্গীকার নিয়ে এরা আবার কবে রানি ঠামারের আমলের সুখ-সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছবে জানি না ৷ বিদায় বেলায় ভেবে পাই না, এই ছোট্ট দেশটা আমার সমস্ত হৃদয়ের শিরা-উপশিরা ধরে এমন টান দিচ্ছে কেন ৷

ভ্রমণ মার্চ থেকে অক্টোবর, ২০০১

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন