জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

‘চিরকালের ইচ্ছে’ বলে একটা কথা আছে না? আমার তেমনই একটা চিরকালের ইচ্ছে ছিল ৷ মা বলতেন, প্রাণপণে যদি ঈশ্বরের কাছে কিছু চাওয়া যায়, সেটা শেষপর্যন্ত তিনি দিয়ে দেন ৷ তবে ছোট জিনিস চাইতে নেই ৷ অন্যের ক্ষতি চাইতে নেই ৷ এমন কয়েকটা নিয়মকানুনও আছে বৈকি চাইবার ৷ জীবনভর তো আমি নিয়ম মেনে কিছুই ঠিকঠাক করে উঠতে পারলাম না ৷ হঠাৎ ঈশ্বরের কাছে চাওয়ার বেলাতেই বা পারব কেন? তবে এই ‘চিরকালের ইচ্ছে’-টা আমার ‘ছোট জিনিস’ না ‘বড় জিনিস’ তা আমি নিজেই জানি না ৷ ইচ্ছেটা হল, ‘জলের ধারে ঘর’ ৷ শহরের মেয়ে আমি, হিন্দুস্থান পার্কে ‘ভালো-বাসা’ বাড়ির তিনতলায় জন্মেছি ৷ আমার ছোটবেলাতে কেয়াতলার অস্তিত্ব ছিল না ৷ বারান্দা থেকে লেকের জল, লেকের ওপারের কু ঝিক ঝিক ট্রেন দেখা যেত ৷ লেক হাসপাতালের মাথার ওপর দিয়ে ৷ লেকের জলের দূরবর্তী ক্ষীণ রুপোলিতে আমার মন ভরত না ৷ কেবল মনে হত এই বাড়িটা কেন এক লাফে ওই জলটার ধারে চলে যেতে পারে না? গাছপালা, মাটি, জল আমি ছোট থেকে ভালোবাসি ৷ খুব ইচ্ছে ছিল গঙ্গার তীরে একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকব ৷ কিংবা যে কোনও জলের ধারে ৷ বারবার চেষ্টা করেছি, গত বিশ বছর ধরে ৷ কোন্নগরে, বারাকপুরে, শান্তিনিকেতনে তালতোড় বাঁধের ধারে, কোপাইয়ের ধারে-কোথাও হয়নি ৷ প্রত্যেকটা চেষ্টা বিফল হয়েছে ৷

কিন্তু ঈশ্বর করুণাময় ৷ তিনি জলের ধারের নিজস্ব বাসাটি বাঁধতে কোনওদিনই দেবেন কিনা জানি না বটে কিন্তু জলের ধারে বাস করার আকাঙ্ক্ষা বারবার পূর্ণ করেছেন ৷

দিল্লির মডেলটাউনে আমাদের ছোট্ট ভাড়াটে বাড়ি ছিল হ্রদের ওপরেই ৷ সামনে আবার একটা ছোট্ট দ্বীপ ৷ ভোরবেলা তা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যেত ৷ আর সন্ধেবেলা কিচিরমিচির ডাকে পাড়া মাতিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ফিরত ৷ সারাদিন সূর্যের সঙ্গে খেলা চলত জলের-কতরকমই যে রং বদল হত ৷ বন্ধুরা বলেছিল, ‘সারাদিন তো আমি তোর এই বারান্দাতেই বসে থাকতে পারি রে! এতরকম রং! তুমি কাজকম্মো করো কী করে?’ সেই বাড়িতে বছর দেড়েক ৷ রাস্তা পেরলেই জল ৷

আবার জলের ধারের বাসায় থাকা হল ছোট মেয়ের কাছে বেড়াতে গিয়ে ৷ কেম্ব্রিজ মাসাচুসেটসে-চার্লস নদীর তীরেই তার চারতলার ফ্ল্যাট-নদীর সুন্দর দুটি বাঁকের মাঝখানে এক-এক ঋতুতে নদীর একেকটা রূপ ৷ দুধারের গাছের সারির রূপ বদল হয়, রং বদল হয়, নদীর জলেরও চেহারা পাল্টে যায় ৷ হেমন্তের লাল-হলুদ পাতার ছায়া বুকে নিয়ে তার রং লাল-সোনালি ৷ শীতের সময় তো চার্লস নদীর বুকে বরফের স্থির চাদর ঢাকা পড়ে, যেন আয়না ৷ বুকে আকাশটা ধরে রাখে ৷ মাঝে মাঝে জলের ঝিরঝিরে কাঁপনের টুকরোতে বন্দী হাঁসেরা আশ্রয় নেয় ৷ নৌকাবাইচ বন্ধ থাকে ৷ পুরোটা নদী, তার ওপারে বোস্টন শহর দেখা যায়, গাছেরা তখন নগ্ন, আকাশ তখন উন্মুক্ত ৷ আবার বসন্তে কচিপাতার সময়ে, বরফ গলে গিয়ে নদীর যেন নবীন প্রাণ আসে ৷ আয়নার স্থির অংশটা ক্রমশ কমতে থাকে ৷ ঝিরঝিরে জলের ফিতেটা বাড়তে থাকে ৷ আর গাছে যত পাতা ঝরে, নদী ততই ঢাকা পড়তে থাকে সবুজ পর্দার আড়ালে ৷ একসময়ে গ্রীষ্ম আসে, জলে নৌকাবাইচের ভিড় জমে, ভ্রমণকারীদের স্টীমার চলে, জলের রং ছায়াঘন সবুজ হয়ে যায় গাছের ছায়া বুকে নিয়ে ৷ হাঁসেরা আবার মুক্ত! বোস্টনও লুকিয়ে পড়ে ৷ ওই বারান্দাটা ‘আমার স্বপ্নের বারান্দা, সেই আমার ‘চিরকালের ইচ্ছে’র বারান্দা ৷ চারতলা নেমে, রাস্তা পেরিয়ে গেলেই নদীর তীর ৷ ওটা আমার আস্তানা নয় বটে, ওখানে আমার চিরকালের ঠিকানা নেই, তবু যতটুকু সময় থাকি খুব আহ্লাদে কাটে নদীর ধারের বাসা! ঈশ্বর অল্প-অল্প করে কিস্তিতে ইচ্ছেপূরণ করেন ৷ সেই ভালো ৷ একসঙ্গে নাইবা হল ৷ আমার নিজস্ব বলে সত্যি তো জগতে কিছু নেই ৷ নাইবা থাকল জলের ধারে নিজস্ব বাসা ৷ জলের ধারে বাস করার শখটা তো মিটিয়ে দিচ্ছেন!

ভিলাসের বেলোনিতে পাঁচ সপ্তাহের রাকফেলার রেসিডেন্ট ফেলো হয়ে গিয়েছিলাম গত বসন্তকালে ৷ বেলাজিও গ্রামটি কোমো হ্রদের তীরে ৷ লেক কোমোর পাড়াটাই সারা ইতালিতে বিখ্যাত অঞ্চল, লম্বার্ডির সেরা জায়গা, ইউরোপের ধনীদের সামার প্যালেসে ভর্তি, সেই মধ্যযুগ থেকে ৷ এমনকী আরও আগে, রোমান যুগ থেকেই লেক কোমোর তীরে বিলাসী মানুষের বাগানবাড়ির শখ ছিল ৷ প্লিনির দু-দুটো বাড়ি ছিল এদিকে ৷ প্লিনি থেকে এই সেদিনের মুসোলিনি পর্যন্ত-পণ্ডিত থেকে সৈনিক সকলেরই স্বপ্নের পাড়া ছিল এটা ৷ নেপোলিয়নও এসেছেন, আবার লংফেলোও এসেছেন ৷ লেক কোমোর জলের ধারে ধারে মধ্যযুগীয় গ্রামের ফাঁকে ফাঁকে বিশাল বিলাসবহুল প্রাসাদ, আর প্রাসাদ মানেই তো বাগান! আগে বাগান, তারপরে বাড়ি ৷ বাগান নেমে আসে জল অবধি ৷

এই ভিলা সেরবেলোনিও তেমনই ইতিহাসে নামলেখানো প্রাসাদ ৷ এর অবস্থিতি পাহাড়ের চুড়োয় ৷ একটা ছোটখাটো নিজস্ব পাহাড়ের চুড়োয় ৷ টিলাও বলতে পারা হয়তো যেত, তবে হাঁপানিরোগীর কাছে পাহাড়ই ৷ কলকাতার লোকের কাছেও পাহাড় বটে! ষাট একর বাগানের একটা দিক নেমে এসেছে নিজস্ব সৈকতের ধারে ৷ সেখানে ভিলার নিজস্ব সাঁতারের জায়গা, নৌকা বাঁধার ঘাট রয়েছে ৷ কিন্তু গ্রামে যেতে হলে অন্য পথ ধরতে হবে ৷ সেই পথে নেমে গেলে, হাট-বাজার, পোস্ট অফিস ৷ এবং ফেরিঘাট!

এখানে দুটো ঘর আমার, একটা পড়ার ঘর, একটা শোবার ঘর (রাজকীয় ব্যবস্থা, বলাই বাহুল্য, বাড়িটা যখন প্রাসাদ!) একসঙ্গে লাগোয়া-আর বিলাসবহুল ঘরও নিজস্ব ৷ আমার ঘরগুলোতে তিনটে আশ্চর্য সুন্দর জানলা আছে ৷ ফ্রেঞ্চ উইনডোর মতোই বিশাল মেঝে থেকে দরজার সমান উন্মুক্ত জানলা, কিন্তু তাতে বারান্দার মতো কোমর পর্যন্ত রেলিং দেওয়া ৷ যেন তিনটি ব্যালকনি কেউ আমার ঘরের মধ্যে ভরে দিয়েছে ৷ আর জানলা দিয়ে সামনে সমুদ্দুরের মতো লেক কোমো ৷ লেক কোমোর ধারে এই প্রাসাদ, অনেক উঁচু না হলেও বেশ উঁচুতে ৷ যখন-তখন ছুট্টে জলের ধারে চলে যাওয়া যায় না ৷ দিনে একবারও যেতে পারব কিনা, প্রথমে ভাবতে পারিনি ৷ কিন্তু জল আমাকে ডাকে ৷

১৯৮৮-তে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে ‘ইন্টারন্যাশনাল সামার ইনস্টিটিউট অব সোমিওটিক অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল স্টাডিজ’-এ গিয়েছিলাম যখন, সেখানেও তাদের সেই নকল দুর্গের মতো হস্টেলে আমাকে দুটি ঘরের যে অ্যাপার্টমেন্টটি দিয়েছিল, ছ-সপ্তাহের জন্য-এমনই বিশাল সমুদ্র-পাহাড়ের স্বপ্নদৃশ্যে আঁকা পিকচার-উইনডো ছিল তাতেও ৷ শুধু তফাত এই, সে-জানলা জানলাই ৷ সে কাচগুলো খোলে না ৷ আর সেই যে আশ্চর্য নীল সমুদ্র, আর ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার বিখ্যাত ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ভরা সবুজ দ্বীপপুঞ্জ ৷ আর দূরে ভেসে যাওয়া জাহাজ-অতখানি আকাশ, অতটা জল, সবই যেন সিনেমার মতো দেখাত ৷ কেমন যেন সুদূর, অবাস্তব, আমার সঙ্গে অসংযুক্ত ৷ জানলাই খোলা যেত না, সমুদ্রের বাতাস বইত না ঘরে, আর ঘর থেকে বেরিয়ে জলের কাছে যাওয়াও সম্ভব ছিল না ৷ যদি টিলটিলরা গাড়ি নিয়ে এসে কোনওদিন বেড়াতে নিয়ে যেত, তবেই ৷ সমুদ্র, দ্বীপ, আকাশ সবই জানলার মধ্যে বাঁধা পড়লেও নাগালের মধ্যে ছিল না ৷ তবু, সেইবারও আমার চোখের তৃষ্ণা মিটেছিল বৈকি-সারাদিনে সমুদ্রটা নীল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে গোলাপি, সোনালি, বেগুনি হয়ে যেত সূর্যের সঙ্গে জোড় মিলিয়ে ৷ আর তারপর কালো ৷ শুধু অজস্র জাহাজের আলোকবিন্দু রাতভর ভেসে যেত ৷ দূরে একটা লাইটহাউসের অদৃশ্য আলোর ছন্দ থেকে থেকে ঝলসে উঠত ৷ তাই জানি, সমুদ্রটা আছে ৷

লেক কোমোতে তা নয় ৷ সারা রাত সেখানে আলোর মেলা বসে ৷ এ তো অকূল সমুদ্র নয় ৷ পাড়ে ঘেরা হ্রদ ৷ চারদিকে গ্রামভর্তি রাস্তার আলো সারারাত জ্বলে ৷ আর হ্রদের জলে তাদের লম্বা লম্বা রঙিন ছায়া সারারাত কাঁপে ৷ আমি যখন নৈশ আড্ডার পরে ঘরে ঢুকি, তিনটে খোলা জানলা দিয়ে রঙিন আলোর উৎসব আমাকে একসঙ্গে অভ্যর্থনা করে ৷ প্রত্যেক রাতেই আমার হঠাৎ মনটা খুশি হয়ে ওঠে ৷ ‘একলা আছি’ এমনটি মনেই হয় না ৷ ‘এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে, কী উৎসবের লগনে/সব আলোটি ফেল আমার মুখের পরে/তুমি আপনি থাকো আলোর পিছনে ৷’-একলা কোথায়? একমনে চাইলে সবই পাওয়া যায় ৷ অল্পদিনের জন্য পেলেই বরং বেশি ভালো ৷ তার দামটা বেড়ে যায় ৷ বুকের মধ্যেটা বেশি করে ভরে ওঠে ৷ আবার যখন ফুরোয়, বুকের মধ্যেটা বেশি করে ফাঁকা হয়ে যায় ৷ আমার তাতে আপত্তি নেই ৷ এটাই তো আমাদের হওয়ার কথা ৷ চিরকাল তো কেউই থাকে না, কিছুই থাকে না ৷ না প্রেম, না ঘৃণা ৷ জলের ধারের ঘরই বা চিরকাল থাকবে কেন? মাঝে মাঝে যে আসে, আমাকে ভরে দিয়ে যায়, এই তো যথেষ্ট ৷ ‘চিরকালের ইচ্ছে’ তাই চিরকাল ধরেই রয়ে যায় ৷ এই তো ভালো!

জলের ধারে আরেকবার ঘর বেঁধেছিলাম-দুদিনের জন্য ৷ ভূপালে গিয়ে একবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তখন ছিলাম একটি গেস্টহাউসে ৷ গেস্টহাউসটি ঠিক বড়া তালাওয়ের ওপরে, এক টিলার মাথায় ৷ আমার ঘর থেকেই দিনভর জলে রঙের খেলা দেখতাম, রাতে ঠিক এমনই দীর্ঘ রঙিন আলোর রেখা ভাসত বড়া তালাওয়ের অন্য পারের জলে ৷ ওপারে রাস্তা, ওপারে নগরী ৷ আর এপারে? ঠিক আমার বারান্দার নিচে ছিল জেলেদের গাঁ, জাল বোনার ৷ আর জাল শুকুতে দেওয়ার ছবি ৷ ছোট্ট ছোট্ট জেলে নৌকাগুলি ছাড়ত সারাদিন ৷ ভ্রমণকারীদের প্রশ্নই নেই! সরু রাস্তা দিয়ে কলসি মাথায় রঙিন মেয়েরা হেঁটে যেত ৷ সাইকেলে তিনজন বসে মাথায় বড় খাট নিয়ে যেত ৷ আর আমার ঝুলবারান্দার ঠিক বাইরে এক জোড়া কালো নাম না-জানা ছোট পাখি ঝগড়া করতে-করতে উড়ে বেড়াত ৷ বোধহয় বাসা বেঁধেছিল বারান্দার আলসেতে ৷ সবচেয়ে আশ্চর্য ছিল ওই বড়া তালাওয়ের বুকে প্রত্যেকটি সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত ৷ সূর্যের মতিগতি বোঝার জন্য আবার একটা আশ্চর্য নৈসর্গিক ব্যবস্থাও ছিল ৷ একটি নিঃশব্দ সবুজ দ্বীপ ৷ তাতে জেলেরাও যায় না ৷ দ্বীপটি ভোরের আলোর সঙ্গেই ভেসে উঠত যেন সূর্যিঠাকুর বসবেন বলে আসন পেতে দিচ্ছে ৷ আর সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মতো হতে হতে মিলিয়ে যেত ৷ যেন সেও জলে ডুবে গেল ৷ একটিও আলো ছিল না তাতে ৷ সূর্যই তার অস্তিত্বের পরিচয়বাহক ৷ এই লেক কোমোতেও একটি দ্বীপ আছে ৷ ইসোলা কোমাচিনা ৷ সেটি এখান থেকে দেখা যায় না ৷ কিন্তু তার ইতিহাস জানি ৷

লেক কোমোর ধারে ধারে যেমন প্রাসাদের সারি, তেমনই প্রাসাদের আশপাশে ছোট্ট-ছোট্ট খুব পুরনোদিনের গ্রামও আছে ৷ আর সেইসব গ্রামের অনেকগুলি এখনও মধ্যযুগীয় চেহারাতে রয়ে গেছে ৷ জল থেকে সোজা পাহাড়ের গায়ে তাদের পথগুলি উঠে গেছে খাড়া সিঁড়ির মতো, গাড়িটাড়ি চলবে না ৷ শুধুই পায়ে চলার পথ ৷ এই সিঁড়িপথের দুধারে দোতলা বাড়ি-হলুদ আর মেরুন রঙের দেওয়াল, প্রায় প্রত্যেক বাড়ির জানলা-দরজার তিনধারে আলপনার মতো কী সুন্দর ছবি আঁকা ৷ গাড়িটাড়ি নেই ৷ সাইকেলও চলে না ৷ আজকাল এইসব গ্রামেও একটা করে বড় রাস্তা হয়েছে-ফেরিঘাট থেকে খানিক দূরে যায়-যেখানে ট্যুরিস্টদের যাবার কথা, সাধারণত সেখান পর্যন্ত ৷ কেননা সব ট্যুরিস্ট তো হাঁটতে চায় না! ফেরি-নৌকাতে তাদের গাড়ি, কিম্বা সাইকেল চাপিয়ে নিয়ে আসে তারা ৷ এই অঞ্চলটা গরিব নয়, কিন্তু ভ্রমণকারীদের ওপরে নির্ভর করে আছে সেই মধ্যযুগ থেকেই ৷ প্রধানত জেলেদের গ্রাম, কিছু গ্রামে মদ তৈরি হয় ৷ কিছু গ্রামে মদের পিপে, জেলেদের নৌকা (এখন আবার আসবাবপত্তরও), আর এখানকার প্রসিদ্ধ রোদে-শুকোনো মাছ ৷ আমার ভিলা সেরবেলোনির ঘর থেকে বাঁয়ে ফেরিঘাটটা দেখা যায়, আর ডাইনে বেলাজিও গ্রামের গির্জার গোল চুড়ো ৷ নীল রং তার ৷ এখানে সমস্ত গির্জার ঘণ্টাগুলো সুরে বাঁধা, সেই ঘণ্টা বাজানো শিখতে হয় অন্যসব বাদ্যযন্ত্রের মতো ৷ সারাদিন কী যে সুন্দর বাজনা বাজে এখানে ঘণ্টায়, আধ ঘণ্টায় ৷ রাতে বন্ধ ৷ জলে নৌকা নিঃশব্দে ভেসে যায় ৷ গাড়ির শব্দ আসে না ৷ (কটাই বা গাড়ি বেলাজিওতে?), মাঝে মাঝে অবশ্য প্রচণ্ড ভটভট শব্দে স্পোটর্স মোটরবোট নিয়ে লেক কোমোর জল তোলপাড় করে রেসিং প্র্যাকটিস করে কেউ-কেউ ৷ আকাশ-বাতাস মনপ্রাণ যেন ছিঁড়েখুঁড়ে একশা করে দেয় ৷ মানায় না, মানায় না, তোমাকে একদম মানায় না হে এখানে ৷ কোথা থেকে যে তেতে আসো তুমি, এই শান্ত ঘুমন্ত গ্রামগুলোকে মনে মনে বিধ্বস্ত করে দিয়ে যাও ৷ জানি না একটাই মোটরবোট, না অনেকের-পাঁচ সপ্তাহে হয়তো তিনদিন এসেছে ৷ কিন্তু অসহ্য কষ্ট দিয়েছে ৷ যেমন ওই যখন খুশি জলে নেমে পড়তে পারা, তলপেটে নৌকা আঁটা হেলিকপ্টারগুলো যখন উড়ে যায়, অদ্ভুতদর্শন কোনও প্রাগৈতিহাসিক ফড়িংয়ের মতো ৷ গুনগুন শব্দই করে, কিন্তু সেটা গুঞ্জন নয়, গর্জন ৷ এ পাড়ায় গর্জন একদম বেমানান ৷ এখানে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে কেবল অশ্রুত এক গুঞ্জন ধ্বনিত হচ্ছে, ইতিহাসের সঙ্গে নিসর্গ এখানে হাত মিলিয়েছে ৷ আর তার সঙ্গে, অন্তত আমার ক্ষেত্রে, ঈশ্বরের করুণা ৷ নইলে আজ আমি এলাম কেমন করে? ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সমুদ্র, দ্বীপ, আকাশ, জাহাজ, পাহাড়, বনমালা-দূর থেকে দেখেও ঠিক মনে হয়েছিল অহৈতুকী কৃপা ৷ টুম্পার বারান্দায় বসেও মনে হয় এ কী করুণা ৷ আর এই ভিলা সেরবেলোনিতে তো প্রতিটি বাসিন্দাই সর্বক্ষণ মুখে উচ্চারণ করছেন, ‘কী সৌভাগ্য! আমি কি এর যোগ্য?’ আস্তিক-নাস্তিকে এখানে ভেদ নেই, মনের কথাটা একই, সেখানে শুধু পৌঁছনোর পথ দুটো আলাদা ৷ একটা যুক্তির, আরেকটি ভক্তির ৷ এখানে যে জনা বিশেক আমন্ত্রিত অতিথি আছি-কেউ বৈজ্ঞানিক, কেউ সঙ্গীতজ্ঞ, কেউ আইনজ্ঞ, কেউ চিত্রকর, কেউ বা কবি-সকলেই স্পষ্টত কৃতার্থ বোধ করছি ৷ কোনও ‘যেন’-র প্রশ্ন নেই ৷

জলের ধারে ঘর ৷ ঘরের মধ্যে ব্যালকনি ৷ ব্যালকনিতে লেক কোমো ৷ আর অজস্র ফেরিনৌকা খেয়া পারাপার করছে ৷ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাবার তো এটাই রাস্তা ৷ যেমন শুনেছি বরিশালের নদীতে নদীতে ৷ যেমন দেখেছি ভেনিসে ৷ এখানে কেবল নদীও নয়, নালাও নয় ৷ একটিই বিস্তৃত জলরাশি-লেক কোমো ৷ হ্রদটি অবশ্য খুব চওড়া নয় ৷ সবদিক থেকেই তো পাহাড়ঘেরা ৷ পাহাড়গুলি আবার ফার, পাইন, জুনিপার গাছের বনে সবুজ ৷ সেইসব পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে ছোট ছোট, যেন পুতুলখেলার বাড়ি ৷ সে বাড়ির জানলায় আর কাঠের বারান্দায় ফুলগাছের টবে রঙিন ফুল উপচে পড়ছে ৷ পাহাড়টাকে বলে Pre-Alps, কিন্তু বাড়িগুলি দিব্যি Alpine Cottageই ৷ যদিও জলের ধারের বাড়ির চরিত্র একেবারেই আলাদা পাহাড়ি বাড়ির চেয়ে ৷ পাহাড়ের গা বেয়ে সরু সরু পায়ে-হাঁটাপথ আছে, আর সেইসব পথ উঠে যায় পাকদণ্ডীর মতো আশ্চর্য সব মধ্যযুগীয় পাথরের গির্জায় অথবা দুর্গে ৷ দুর্গের চৌকো মিনারে, আর গির্জার ঘণ্টাবাঁধা রঙিন মিনারে পাহাড়ের ঢালু গা যেন গয়না পরে আছে ৷ যে দুটি শক্তি মধ্যযুগের ইতিহাস, রাষ্ট্র এবং ধর্ম এখানে তা প্রত্যক্ষ দৃশ্যমান ৷ ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই এতসব দেখা যায়, যেমন দেখা যায় আকাশে রোদ-মেঘের খেলা ৷ এখন এখানে ক্ষণে রোদ ক্ষণে বৃষ্টি; এই বসন্তকালের এটাই বৈশিষ্ট্য ৷

আমার জানলার সামনে একসারি জারুলগাছ ফুলে ফুলে ছাওয়া ৷ নাম ইন্ডিয়ান চেস্টনাট ৷ সত্যিই জারুল কিনা জানি না বাপু ৷ আমি তো বটানিস্ট নই, তবে ঠিক জারুলের মতোই মঞ্জরি ৷ জানলার নিচের রাস্তাটার একদিকে আমাদের বাড়ি, অন্যদিকে জারুলবীথি ৷ আরেকদিকে, ঠিক আমার জানলার তলায় দুটি ঘনশ্যাম গুল্ম ৷ লালচে-সবুজ পাতা-কী গাছ? আমার চেনা গাছ নয় তো? মালির সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেছে-কানের দুল পড়ে গিয়েছিল বাগানে ৷ ষাট একর জমির ওপর বাগান ৷ সেখান থেকে সোনার মাকড়ি খুঁজে এনে দিয়েছে মালি পাওলো ৷ পাওলোর কাছে নাম জানা গেল ৷ (দোভাষীর মাধ্যমে পাওলো বাংলা বলে না, আমিও ইতালীয় বলি না ৷ সে ইংরিজিও বলে না!) লরেল ৷ যে লরেলপাতার মালা পরিয়ে ‘পোয়েট লরিয়েট’ হয়? সেই লরেল ৷ যে ঘন লরেল ঝোপের ছায়া দেখলে পেত্রার্কের মন কেমন করে উঠত লরা’-র জন্য, সেই লরেল ৷ সেই ‘মহান লরেল’ ৷ লরেল আবার দুরকমের হয় ৷ সহাম এবং হীন ৷ হীন লরেলের নাম বে-লীফ ৷ ভালগার লরেল ৷ বে-লরেলও বলে ৷ এখানেও রান্নাবান্নায় কাজে লাগে ৷ বাংলা দেশেও তাই ৷ তেজপাতা আর কি! মহান লরেলের মতো রহস্যময় নয় তার রূপ ৷ হালকা সবুজ, সাধারণ চেহারা ৷ এ পাড়ায় বেড়া দেওয়া হয় বে-লরেলে ৷ গিন্নি বেড়া থেকেই তেজপাতা ছিঁড়ে রান্নায় ফোড়ন দেন ৷

এ অঞ্চলে অলিভ বাগানও কম নয় ৷ আমাদের এই ভিলাতেই আছে অলিভবাগান, নিজস্ব অলিভ অয়েল তৈরি হয় ৷ ইতালীয় রান্নার গুণ তো অলিভ তেলেই ৷ ভিলার বাগানে আছে দ্রাক্ষাকুঞ্জও ৷ নিজস্ব ওয়াইনও তৈরি করে এই ভিলা সেরবেলোনি ৷ এ এক আশ্চর্য ঠাঁই ৷ এখানে ছোট্ট একটা মধ্যযুগীয় গির্জা আছে বাগানের মধ্যে, সেটা এখন আর কাজে লাগে না ৷ মধ্যযুগীয়ও নেই ৷ যুগে যুগে তাতে ভেঙে নতুন করে গড়া হয়েছে ৷ সতেরো শতকের বেশ কজন পাদ্রীকে কবর দেওয়া হয়েছে তার ‘ক্রিপ্ট’-এর দেওয়ালে ৷ তাঁদের নাম, সাল-তারিখ সমেত ৷ শুধু ক্লয়েস্টারটি এখনও আছে মধ্যযুগীয় চেহারার-আর বাইরের দেওয়ালে সূর্যঘড়ির চিহ্ন ৷ ওপরে যেখানে কামরায় কামরায় পাদ্রীরা বসবাস করতেন সেখানে এখন বাস করেন ভিলা সেরেবেলোনির কর্মীরা ৷ এতবড় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন দুজন ৷ শ্রীমতী জিয়ানা চেল্লি থাকেন এখানেই ৷ আর শ্রী পাসকোয়ালে পেসকে থাকেন অন্য একটি ছোট বাড়িতে, সেই বাড়ির হলুদ দেওয়াল বেয়ে উঠেছে রকমারি গোলাপি-সোনালি-লাল-হলুদ-কমলা রঙের গোলাপের লতা ৷ বড় বড় গোলাপগুলি প্রস্ফুটিত হয়ে আছে, যেন পদ্মফুল ৷ আর যেখানেই দাঁড়াই, জল দেখতে পাব ৷ সামনে তাকালেই লেক কোমো ৷ নীলে নীল ৷ জলের ধারের ঘরে থাকার সাধ আমার বারে বারেই মিটিয়ে দেন তিনি ৷ মানুষের সব সাধ পূরণ করা যাঁর হাতে ৷

বাগানের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয় এঁদের ৷ পাহাড় কেটে বাগান তো? ইতালীয়ান ফরমাল গার্ডেন-সেই যার কথা বোকাচ্চিওর ডেকামেরনে পড়েছি ৷ যেরকম ভিলাতে ডেকামেরনের গল্প সাজিয়েছেন বোকাচ্চিও এ যেন ঠিক তেমনই, পাহাড়ের ওপরে ধনীর বাগানবাড়ি ৷ উদ্যানবাটিকা ৷ সাজানো বাগান ৷ আর মর্মর প্রাসাদ ৷ আর ঠিক ঘণ্টা ধরে, নিয়মমাফিক দিনযাপন ৷

এরই ফাঁকে ফাঁকে জল ৷ আর আকাশ ৷ বাগানের অনেকখানি জংলা রাখা আছে ইচ্ছে করে-সেখানে জংলী ফুল ফুটে আলো করে আছে ৷ পাহাড়ি অংশটাতে যেখান দিয়ে উঠে গেলে দুর্গ প্রাচীর-এই বেলাজিওতে ভিলা সেরবেলোনির পাহাড়ের চুড়োতে দুর্গ ছিল ৷ এর আরেকটি জোড়া দুর্গ আছে ভারেন্না গ্রামে ৷ ভারেন্না গ্রামের দুর্গটি এখনও অক্ষত, সম্পূর্ণ, মধ্যযুগীয় অহংকারে অবস্থান করছে পাহাড়চুড়োতে ৷ বেলাজিওর দুর্গ ভেঙে গেছে ৷ চুড়োতে ছোট্ট সবুজ লন, সেখানে নিয়মিত ঘাস কাটা হয় ৷ কেমন করে লন মোওয়ার নিয়ে যাওয়া হয় সেই পাহাড়চুড়োয়, সেটা আমার কাছে রহস্যই থেকে গেছে ৷ যেখানে আমি কষ্ট করে পাকদণ্ডীর মতো পথ দিয়ে উঠি, পাওলোরা সেই পথে অত ভারি যন্ত্র ঘাড়ে করে ওঠে ৷ একবার শিখরে উঠে এলে কিন্তু আশ্চর্য দৃশ্য ৷ সিন্ধুসারসের বাসা পাহাড়ের গায়ে গায়ে, গাছের ডালে ৷ ডিম দেওয়ার সময় এটা ৷ পাখিরা বাসার কাছাকাছি উড়ছে ৷ আর লেক কোমো তো দুইভাগে ভাগ হয়ে যায় ঠিক এই বেলাজিও থেকেই ৷ একটা দিক যায় কোমো শহরের দিকে অন্যটি লেক্কো শহরের দিকে, অনেকটা নীল একটা পাজামার মতো দেখতে লেকটার মানচিত্র ৷ এখান থেকে সেটা স্পষ্ট দেখা যায় ৷ দুদিকই দেখতে পাওয়া যায় ৷ সেজন্য এখানে দুর্গ তৈরি করা খুবই স্বাভাবিক ছিল ৷ ভারেন্নার দুর্গের সঙ্গে বেলাজিওর দুর্গের সংকেত বিনিময় হত এককালে ৷ ভারেন্নায় এখনও দুর্গটি রয়ে গিয়েছে এবং ভারেন্না নিজেও এখনও রয়ে গেছে শান্ত, মধ্যযুগীয় গ্রাম হিসেবে ৷ ভিলার মধ্যে, পাহাড়ি পথের মধ্যে কত গুহা, ছোট ছোট ঝরনা (আবার নকল গুহাও আছে, নকল ঝরনাও!) যাকে ‘গ্রোটো’ বলে, ইতালীয়দের অতি প্রিয় সেই গুহা বাগানের শোভা বাড়াচ্ছে ইতি-উতি ৷ আছে টানেল, পঞ্চমুখী সুড়ঙ্গ ৷ কী নেই? মাঝে মাঝে কুঞ্জবন, ফোয়ারা, পাথরের বেঞ্চি ৷ কমলার গাছে কমলালেবু ফলে আছে, গাছে যেন আলো জ্বলছে দিনেরবেলায় ৷ ছোট ছোট পাথরের চৌবাচ্চা, যেন জলকুণ্ড পাহাড়ের গায়ে ৷ তাতে লাল মাছেরা আনন্দে সাঁতার কাটছে বলেই বুঝতে পারি জলকুণ্ড নয়, চৌবাচ্চা ৷ ছোট ছোট নিরীহ বন্যপ্রাণীও ঢের আছে ৷ যা নিরীহ নয়, তা একমাত্র এই আমরাই ৷ পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে পড়ি, শরীর ভালো লাগলে নেমে যাই, সোজা ফেরিঘাটে ৷ একটা টিকিট কেটে উঠে বসি-খোলা ডেকের বেঞ্চিতে ৷ ওঠার আগে হ্রদের পাড়ের যে-কোনও একটা গ্রামের নাম বলি, সেই নামটা পাঞ্চ করে দেয়, নইলে সর্বত্রই একই দাম টিকিটের ৷ আট হাজার দুশো লিরা ৷ যদি না বড় নৌকায় চড়ো-যা উড়িয়ে নিয়ে যাবে, ময়ুরপঙ্খী নাও ৷ তার ভাড়া তিনগুণ ৷

এই অঞ্চলটা মধ্যযুগের এবং রেনেসাঁসের ইতালির সমস্ত রং-রস ইতিহাস নিয়ে জেগে বসে আছে ৷ এই সব প্রাসাদ সেই সময়কার সাক্ষী, সেইসব পারিবারিক শত্রুতার আর কলঙ্কের, অবৈধ, উন্মত্ত প্রণয়ের ৷ আর ধনৈশ্বর্যের প্রতিযোগিতার যথেচ্ছ লুঠতরাজ আর হিংস্র অত্যাচারের, দম্ভের আর দারিদ্র্যের ৷ ইসোলা কোমাচিনা যখন আক্রান্ত হয়েছিল সেই ভীত, দারিদ্র, উদ্বাস্তু মানুষগুলি এসে গড়েছিল ছোট ভারেন্না গ্রাম, জলের ধারেই ঘর বেঁধেছিল আবার ৷ দ্বাদশ শতকে তৈরি এই গ্রামটির বাড়িগুলির তাই একই চেহারা ৷ গলির ভেতরদিকে তিনটে করে জানলা, লেকের দিকে দুটো ৷ গায়ে গায়ে লাগা দোতলাবাড়ির সারি ৷ শুনতে যেমন বোরিং, দেখতে কিন্তু তেমন নয় ৷ আজকের আকাশচুম্বী যত মৌচাকে বাসা বাঁধা শহুরে মানুষের চোখে ভারেন্নার এই ছোট ছোট বাড়ি, তথাকথিত দারিদ্র্যের সাক্ষী নয়, শান্তির ছবি ৷

একদিন চলেই গেলাম ভারেন্নায় ৷ বেলাজিওর মতো দোকানদারের হই-হট্টগোল নেই ৷ জল থেকে গ্রামে সরু সরু ‘সালিতো’ খাড়া সিঁড়ি-গলি উঠে গেছে ৷ বাড়িগুলো পরস্পরের গায়ে গা এলিয়েই শুধু নেই, ঘন লতায়-পাতায় ফুলে-সুবাসে পরস্পরকে জড়িয়ে আছে ৷ বাড়িতে-বাড়িতে মাঝে মাঝে ছোট্ট সেতু, সিঁড়িপথের মাথার ওপরে ৷ তোরণের মতো দেখায় ৷ সেগুলো কখনওবা খুব ছোট সরু প্রায় গোপন সুড়ঙ্গের মতো সমান্তরাল গলিপথ ৷ আর কী সব বেড়াল এখানে! কুকুর দেখি না কোথাও ৷ শুধু আহ্লাদী, লোমফোলানো বেড়াল রাজকীয় চালে পাঁচিলে হাঁটছে ৷

ফেরি-নৌকা নিয়ে হঠাৎ ভারেন্নায় চলে এসেছি, ফেরার তাড়া আছে আজ-অথচ এত সুন্দর গ্রামে কি আমি আগে কোনওদিন গেছি? মনে তো পড়ে না ৷ বেগুনি, ফুল্ল-কুসুমিত উইস্টেরিয়ায় ঢেকে আছে বাড়িঘর, পথ, রেলিং ৷ হ্রদের ধারে ধারে চলেছে একটি রট আয়রনের কারুকার্যকরা রেলিং ঘেরা পুরনো পায়ে হাঁটার পথ ৷ সন্ধ্যাবেলায় বেড়ানোর রাস্তা-প্রসেনাদ ৷ এ রাস্তা ভেঙে যায় মাঝে মাঝেই ৷ সৈকতে, সিঁড়িতে, নৌকাবাঁধা ছোট ছোট ঘাটে ৷ ঘাটলা বলাই ভালো ৷ জলের ধারে ছোট ছোট কাফে ৷ নুড়িবিছানো একটুখানি ছোট বেলাভূমিতে রঙিন রঙিন নৌকা উল্টোনো ৷ তাদের নামই কত রকমের ৷ কিছু ইতালীয়, কিছু ফরাসি, কিছু বা মার্কিনি ৷ রেসের ঘোড়াদের যেমন নাম থাকে, এই নৌকাদের নামের চরিত্রও অনেকটা তেমনই চমকিলী ৷ আমি হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ি ৷ নামগুলোর ম্যাজিকে আটকে থাকি খানিকক্ষণ ৷ কখনওবা উইস্টেরিয়ার গন্ধে মাতাল হয়ে প্রাণ ভরিয়ে শ্বাস টানি, সৌরভ আমার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে, নেশা ধরায় ৷ এক জায়গায় একটা তীব্র, অতি পরিচিত গন্ধ পেয়ে খুঁজে দেখি, গলির মধ্যে ছোট এক টুকরো বাগানে যুঁইলতা ৷ যুঁইফুলের মতো দেখতে নয়, মালতীর মতো দেখতে, কিন্তু সুবাসটি যুঁইয়ের ৷ কী নাম? কী নাম? জাসমিন ৷ বলেন টুলে বসে নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে খবরের কাগজ-পড়ুয়া বৃদ্ধ ৷

ভারেন্না গ্রামের মাঝখানে সবচেয়ে পুরনো অঞ্চলে গ্রামের চক, তার দুদিকে দুটো প্রাচীন গির্জা ৷ একটা গোল, পুরোপুরিই রোমানেস্ক, দ্বাদশ শতাব্দীর ৷ অন্যটিতে এতবার হাত পড়েছে যে, তার নিজস্ব আরও কোনও চরিত্র নেই ৷ খানিক রোমানেস্ক, খানিক গথিক, দেওয়ালে (বাইরের) যিশুর ফ্রেস্কোতেও নানা যুগের রং ৷ মার্বেল, ইট, কাঠ, নানা উপকরণের মেলা ৷ সদ্য এখানে একটা বিয়ে হয়েছে ৷ মনে হয়-তাজা ফুলে ফুলে সাজানো এখনও বেদিগুলো ৷ গ্রামের পথের ধারে ধারে জলসত্রের ব্যবস্থা ৷ পাথরের বেসিন আর নল থেকে জল পড়ছে ৷ বেসিনের গায়ে দাতার নাম আর বছরটি খোদাই করা ৷ বেশি পুরনো নয় ৷ এই আঠারো শতক-উনিশ শতক ৷

আমি হাঁটতে হাঁটতে থামি ৷ অঞ্জলি পাতি, জলপান করি ৷ পাহাড়ের জল ৷ ঠান্ডা ৷ তেষ্টা মেটে ৷ একজনকে জিজ্ঞেস করি, রোমানেস্ক গির্জাতে চাবি দেওয়া কেন? এটা একটা কাঠের কারখানা, যাঁকে জিজ্ঞেস করি তিনি কলের করাত চালাচ্ছেন ৷ বললেন, ‘ওই বড় গির্জার বেল বাজাও, চাবি খুলে দেবে ৷’ না ৷ ভাঙা ইংরিজিতে নয়, অঙ্গভঙ্গির ভাষাতে ৷ আমিও সেইভাবেই প্রশ্ন করেছি ৷ বেল বাজাই ৷ কেউ দরজাই খোলে না ৷ হঠাৎ দেখি একজন স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির নামলেখা গাড়িতে উঠছেন-দৌড়ে গিয়ে তাঁকে ধরি ৷ তিনি ইংরিজি জানেন কিনা বোঝা গেল না ৷ কিন্তু গাড়িতে না উঠে, কোথাও চলে গেলেন, আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ৷ একটু বাদেই চাবি নিয়ে ফিরে এলেন ৷ এবং গির্জা খুলে দিলেন ৷ আমি ঘুরে ঘুরে দেখলাম-ভেতরে গির্জার ইতিহাস ৪টে ভাষায় লেখা আছে ছোট করে ৷ প্রচুর ফ্রেস্কো আছে অক্ষত অবস্থায় ৷ রাজবেশী যিশুর ছবিটিই প্রধান ৷ ১২ শতকে তৈরি, ১৪ শতকে একবার সারানো হয়েছিল, ১৭ শতকে আরেকবার ৷ এই ইতিহাসও তখনকার তারিখেই লেখা ৷ ভালো করে দেখা হল না গ্রামটা, ছুটে পালাতে হল ৷ ফেরি-নৌকার সময় হয়ে যাচ্ছে, দে দৌড় ঘাটের দিকে ৷ এখনও মস্ত মস্ত না দেখা বাগানে অজস্র সৌরভ অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য, আর অনেক মূর্তি ৷ এখানে কি কেবল উদ্ভিদেরই উদ্যান? মর্মর মূর্তিরও উদ্যান আছে না? আবার ফিরে আসতেই হবে এই জলের ধারের গ্রামে, এই সুন্দরী ভারেন্নায় ৷ ফেরি-নৌকো বাঁক নিল ৷ তৃপ্তি হল না ৷ আসব, আবার ফিরে আসব, ভারেন্না, তোমার জলের ধারের ঘর দেখতে ৷

ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৩

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন