অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
রাজস্থান হল হিন্দিতে যাকে বলে রেগিস্তান বা মরুভূমির দেশ-এই রকম একটা ধারণা নিয়েই রাজস্থানের এলাকায় ঢুকে পড়েছিলাম ৷ আগ্রা থেকে বাসে ফতেপুর সিক্রি দেখতে যাব, সেখান থেকে ভরতপুরে আমাদের নেবার জন্য জিপ আসবে ৷ আর ফতেপুর সিক্রি থেকে দু-পা এগোলেই তো রাজস্থান, অর্থাৎ কিনা রেগিস্তান, অর্থাৎ কিনা মরুভূমির দেশ ৷
কিন্তু কোথায় সে মরুভূমি! রাস্তার দুপাশে দিব্যি গাছপালা, জলাজমি, খেতে প্রচুর চাষবাস হচ্ছে ৷ ভরতপুরে গিয়ে পক্ষীনিবাসেও সেই জলাজমি আর অজস্র গাছ, সম্ভবত বাবলাজাতীয় গাছের সংখ্যাই বেশি ৷ এগোতে এগোতে জয়পুর উদয়পুর চিতোর বাড়মের হলদিঘাটি-কত কী দেখা হয়ে গেল, কিন্তু মরুভূমির সন্ধান আর পেলাম না ৷ বাড়মের যেতে বালিয়াড়ি পড়ল একটি দুটি, কিন্তু মরুভূমি কই? পাহাড় দেখলাম, আজমেরের দিকে মার্বল পাথরের কারখানা থেকে সাদা পাথরের গুঁড়োর স্তূপ দেখলাম, বাসের মধ্যে মেয়েদের হাতের প্রায় সর্বাঙ্গ ঢাকা রুপো আর প্লাস্টিকের বালার সারি দেখলাম, এমনকী একটি ‘ভূতে-পাওয়া’ বউ-ও দেখে ফেললাম ৷ তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে তার বাপের বাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছে, কারণ তাকে নাকি ‘দেওতা’-য় পেয়েছে ৷ সে বিষণ্ণমুখে বাসের জানলায় মাথা রেখে বসে ছিল ৷ কালিপড়া চোখে ক্লান্ত দৃষ্টি, আর আমাদের হঠাৎ হঠাৎ চমকে দিয়ে মাঝে মাঝে ‘হো-রে হো-রে’ করে দমকে দমকে চিৎকার করে উঠছিল, প্রায় চল্লিশ সেকেন্ডের একটানা চিৎকার ৷ তারপরে আবার সব শান্ত ৷ মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না আমরা ৷ তার ভেতরে যেন একটা মস্ত ভাঙচুর হয়ে গেছে, সে আর পুরোপুরি মানুষ নেই ৷
যাই হোক, এ দৃশ্য দেখতে তো আমরা রাজস্থানে আসিনি, এসেছি মরুভূমি দেখতে, ভূভারতে একমাত্র মরুভূমি এখন এখানেই সঞ্চিত আছে, আর কোথাও তাকে পাওয়া যাবে না ৷ তবে এমন নয় যে, আমরা একেবারে আলাভোলা বাবাজি হয়ে রাজস্থান দেখতে গেছি ৷ বাংলা ইংরিজিতে রাজস্থান ভ্রমণের যা কিছু পাঠ্যপুস্তক পাওয়া যায় বাড়িতে তার রীতিমতো চর্চা হয়েছে, তারপরে রাজস্থান ট্যুরিজমের রঙিন ছবিওয়ালা কাগজপত্রও বেশ কিছু জোগাড় হয়েছে, কাজেই আমরা জানতাম যে, ‘সোনার কেল্লা’র শহর জয়সলমিরে গেলে তবেই মরুভূমিতে যাবার একটা রাস্তা পাওয়া যাবে ৷ হ্যাঁ, জয়সলমিরে যাঁরা যাবেন তাঁদের আরও একটা কথা বলে রাখি ৷ তাঁরা যেন কেল্লায় গিয়ে ভুল করেও শৌখিন হিন্দির জ্ঞান দেখানোর জন্য ‘সোনে কা কিলা’ বা ওই ধরনের কিছু বলবেন না ৷ পরিষ্কার বাংলায় ‘সোনার কেল্লা’ বলবেন, সম্ভব হলে দন্ত্য-সটা ইংরিজি ‘এস’-এর মতো করে বলবেন ৷ অর্থাৎ বলতেই পারেন, ‘ক্যা ইয়ে সোনার কেল্লা হ্যায়?’ কিংবা ‘ইয়ে সোনার কেল্লা-মে অব কৌন রহতে হ্যায়?’ আমাদের গাইড আমাদের পইপই করে বলে দিয়েছিল যে, জয়সলমিরের অনেকটা আকাশ দখল করে দাঁড়িয়ে থাকা ওই সোনালি পাথরের দুর্গের নাম এখন সোনার কেল্লাই হয়ে গেছে সত্যজিৎ রায়ের ছবির কৃপায়, সোনে কা কিলা বললে ব্যাকরণ ভুল হবে ৷ ফলে সে আমাদের বিশেষ করে দেখাল কোনখানটায় মুকুল থাকত-যেটার নাম এখন ‘মুকুলবাড়ি’-ই হয়ে গেছে, কোনখান দিয়ে দৌড় দিয়েছিল, কোন সুড়ঙ্গে সে ঢুকে পড়েছিল ৷ এখানে গাইড খুব মনোবেদনার সঙ্গে জানাল যে, সুড়ঙ্গে সবাই বাড়ির আবর্জনা ফেলতে শুরু করায় সরকার এখন তার মুখটা ‘সিল’ করে দিয়েছে, ফলে সে আর আমাদের তার ভেতরে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারছে না ৷ আমরা মনে মনে ভাবলাম, রক্ষে করো বাবা, সুড়ঙ্গে ঢুকতে হলেই হয়েছিল আর কী ৷ কিন্তু সে প্রচুর দোকান-পাট মন্দির ইত্যাদি, গরু-বাছুর-ছাগল ভর্তি অলিগলি এইসব দেখাল ৷ সে সব দেখে আমরা খুশি হয়ে ফিরে এলেও মরুভূমি আমাদের অবিরত হাতছানি দিতে লাগল ৷
সত্যি বলতে কি, বাড়মের থেকে আমরা জয়সলমিরে এসেছি-তাতেও পথে মরুভূমির বিশেষ চিহ্ন নেই ৷ হ্যাঁ, কাছেপিঠে পাহাড়ও খুব একটা পেলাম না-সমতল মাটি ৷ কিন্তু সর্বত্রই নানা ধরনের বাবলা গাছের ঝাড়, রাজস্থানের অনেকটা অংশই এখন সবুজ ৷ জলসেচ-ব্যবস্থা খুব ভালো হয়েছে এখানে, তাই মরুভূমিও পিছু হটেছে ৷ এত গাছপালা দেখব বলে আশা করিনি ৷ গরম আছে, কিন্তু খুব দুঃসহ নয় ৷ সেটা অক্টোবরের গোড়ার দিকে, জয়সলমির তো আমাদের কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও উপহার দিল ৷ বোঝো ঠ্যালা, এসেছি মরুভূমির দেশ দেখব বলে, সেখানে কিনা বৃষ্টি! মরুভূমির মানসম্মান আর কিছু রইল না ৷
যাই হোক, ইশা মহম্মদ বলে একজন জিপের ড্রাইভার আমাদের দখল করল ৷ সে বিকেলবেলায় নিয়ে যাবে আমাদের সাম নামের সেই জায়গায়, যেটাকে আমেরিকার ওয়েস্টার্ন ছবির ভাষায় আউটপোস্ট-ই বলা চলে ৷ সেখানেই এসে থমকে দাঁড়িয়েছে বালুকার বিশাল বিশাল ঢেউ, তথাকথিত সাম স্যান্ড ডিউনস ৷ অথবা মানুষের জগৎ গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে বালুকা সমুদ্রের ধারে ৷ সেখানেই উঁচু টিলার ওপরে আছে রাজস্থান ট্যুরিজমের কটেজ-একটি গোল বাড়ির মধ্যে তিনটি ঘর ৷ চারপাশে আর কোনও আস্তানা নেই ৷ সেখানে আমরা একটা রাত থাকব, তারপর পরদিন ফিরে আসব ৷ টিলার নিচে যে পথটা জয়সলমির থেকে এসে মরুভূমির পাশ দিয়ে পশ্চিমে চলে গেছে, তার পাশে চুড়োর মতো চালায় ঢাকা গোল বেশ কিছু ঝুপড়ি ধরনের দোকান আছে বটে, কিন্তু সে সব দোকান সপরিবারে রাত কাটানোর মতো নয় ৷ শুধু বিকেলবেলায় ট্যুরিস্টরা আসার সময় সেগুলো জেগে জ্যান্ত হয়ে ওঠে, খুব চা তেলেভাজা ইত্যাদি বিক্রি হয় ৷ আবার যেই ট্যুরিস্টরা চলে যায় সেগুলো সার সার গোরস্থানের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ৷
কিন্তু আমি আগ বাড়িয়ে এসব কথা বলে ফেলছি কেন, এখনও তো সাম-এ পৌঁছই-নি আমরা ৷ ইশা মহম্মদের সঙ্গে দরদাম ঠিক হল-সে সামে নিয়ে যাবে, রাতে থাকবে সেখানে, পরদিন সকাল দশটা নাগাদ রওনা দিয়ে, আমাদের কোথাও খাইয়ে নিয়ে, একেবারে মালপত্রসুদ্ধ বাস টার্মিনাসে পৌঁছে দেবে ৷ নিজের গাড়ির মতোই প্রায় সুবিধা দিচ্ছে ৷ খাওয়াটা কোনও সমস্যা নয় ৷ রাজবাড়ির কাছে যে বাজারটা আছে তাতে সার সার খাবার দোকান, প্রত্যেকটার মাথার ওপরে সাইনবোর্ডে লেখা আছে যে সেখানে বঙ্গালী খানা, এমনকী আলুপোস্তও পাওয়া যাবে ৷ প্রত্যেকটাতেই লেখা আছে বাংলায় ৷ একে ‘সোনার কেল্লা’, তার ওপরে ‘আলুপোস্ত’-কোন বাঙালির না মাথা ঘুরে যাবে ৷ এসব দোকানে মাছ-মাংসের ব্যবস্থা নেই-এই যা অসুবিধা ৷ কিন্তু এমন অনেক বাঙালি আছেন যাঁরা আলুপোস্ত পেলে মাছ-মাংসের তোয়াক্কা করেন না, আলুপোস্ত দিয়েই এক-দু থালা ভাত উড়িয়ে দেন ৷ এজন্য কী কন্যাকুমারিকা, কী মাউন্ট আবু-সর্বত্রই বাংলায় ‘আলুপোস্ত’ লিখে বাঙালিদের পাগল করে দেবার চেষ্টা হয় ৷
ইশা মহম্মদ আমাদের বলল যে সে আটশো টাকা নিচ্ছে বটে, কিন্তু সরকারি ব্যবস্থার চেয়ে এ অনেক সস্তা, আর দ্বিতীয়ত, সে আরও দু-চারটে স্পট, যেমন অমর সাগর, লোধুর্বা আর ‘ডেজার্ট ভিলেজ’ দেখিয়ে নিয়ে যাবে-কোনও সরকারি ট্যুরে সেটি পাওয়া যাবে না ৷ তার কথা যাচাই করবার সুযোগ আমাদের নেই, আর তার ওপর তার কথায় সত্যি একটা আন্তরিক সৌজন্যের সুর ছিল ৷ ফলে আমরা বললাম, ঠিক আছে, তুমিই আমাদের ভবপারের কাণ্ডারি, তুমি কাল চলে এস ৷ ইশা বলল, ঠিক দুটোর সময় আপনারা তৈরি থাকবেন ৷
কয়েকশো কিলোমিটার বাবলা গাছের রাজত্ব দেখে এসে আর মাত্র বিয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে মরুভূমি দেখব, এ যেন কেমন বিশ্বাস হচ্ছিল না ৷ যাই হোক, দুটোর সময় যাত্রা শুরু হল ৷ পথে বিশাল বিশাল রাজকীয় এবং অত্যাধুনিক হোটেলের বাইরের দৃশ্য দর্শন করে ঢেউখেলানো মাঠের রাস্তা দিয়ে আমাদের জিপ প্রথমে অমর সাগরে এসে পৌঁছল ৷
বেড়ানোর বইয়ে বলে ‘লেক’, আমরা দেখলাম বড়সড় একটি দিঘির মতো ৷ পাশে একটি মন্দির, বাইরে থেকে সে মন্দিরের মাহাত্ম্য কিছু চোখে পড়ল না ৷ আমি নাস্তিক মানুষ, স্থাপত্য ভাস্কর্য ইত্যাদি আকর্ষণ না থাকলে মন্দিরে সাধারণত পা দিই না, কাজেই কয়েকটি গ্রাম্যবালক এসে মন্দির দর্শনের আমন্ত্রণ জানালেও সে আমন্ত্রণ তত বিচলিত করল না ৷ ওই দিঘিটি বেশ ভালো লাগল অবশ্য, অনেকটা জায়গা জুড়ে টলটলে জল ৷ চারপাশে জনবসতি হয়ে যাওয়ায় তার সীমানার সৌন্দর্য খানিকটা নষ্ট হয়েছে, কিন্তু এদিকটা খোলা ৷ একজন লোক গোটা তিনেক উট আর ঘোড়া নিয়ে এসে সেই লেকে জল খাওয়াচ্ছে, তাদের বোধহয় শরীরও ধুয়ে দিচ্ছে একটু-সেই দৃশ্যটা দেখে মন্দ লাগল না ৷ ঘোড়াদের দেখেই বুঝলাম এরা কলকাতার ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়া নয়, রীতিমতো দশাসই জোয়ান একেকজন, গায়ে জল পড়ার আরামে তারা মাথা ঝাঁকিয়ে নাক দিয়ে নানারকম সুখের শব্দ করছে ৷ উট চড়ে জয়সলমির থেকে সাম চলেছে সাহেব দম্পতি ৷ উঁচু-নিচু মাঠে ম্লান ঘাসের আস্তরণ, কিন্তু এখানে ওখানে, মাঠের মধ্যে মাঝখানে মাঝখানে জ্বলে ওঠা আগুনের মতো, ফণিমনসা ধরনের গাছের ঝাড় গজিয়েছে, সেগুলো দেখতে অদ্ভুত লাগল ৷ এ আগুন অবশ্য সবুজ আগুন, যেন একেকটা কুণ্ডে একাধিক সবুজ শিখা জ্বেলে জেগে উঠেছে ৷
আবার মাঠের ভেতর দিয়ে রাস্তা ৷ বিস্ময়ের কথা এই, ওই পথ দিয়ে জলের পাইপও চলেছে পাশাপাশি ৷ কোথাও কোথাও প্রচুর জল জমে আছে, খেতেও জল জমে আছে ৷ মরুভূমি দেখতে এসে এইসব হতাশাজনক দৃশ্য দেখব আশা করিনি ৷ যেতে যেতে আবার দূরে চোখে পড়ল বিশাল জলরাশি ছড়িয়ে আছে দূরে ৷ তা দেখেও মনটা বেশ দমে গেল ৷ মরুভূমির দেশে এসব কী কাণ্ড! যাই হোক, এঁকেবেঁকে পৌঁছে গেলাম প্রাচীন রাজধানী লোদুর্বাতে ৷ সেখানে টিলার ওপরে একটি জৈন মন্দিরের চত্বর পর্যন্ত উঠলাম, কিন্তু ভেতরে ঢুকলাম না ৷ তবে এর সন্ন্যাসীদের আস্তানা এবং প্রাঙ্গণটি বেশ বড়, আর এঁদের জলসত্রের ঠান্ডা জল খেয়ে বেশ শান্তি হল ৷
সেখান থেকে নেমে এবার সাম-এর পথ ধরব ৷ ইশা মহম্মদ বলল, ওই পথেই পড়বে ‘ডেজার্ট ভিলেজ’ ৷ ইশা ইংরিজিতেই নামটা বলল ৷ সেটা আসলে কী জিজ্ঞেস করায় সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি অন্য কোনও গ্রহ থেকে এসেছি, পৃথিবীর কোনও খবরই রাখি না ৷ আমার মেয়েরাও হাসতে লাগল ৷ তারপর বুঝলাম এই গ্রামটা তৈরি হয়েছিল কল্পনা লাজমির ‘রুদালি’ ছবির জন্য ৷ তাতে ডিম্পল কাপাডিয়া, রাজবব্বর, রাখী-এইসব সাঙ্ঘাতিক লোকেরা ছিলেন ৷ পুরো গ্রামটাই এখন রয়ে গেছে, তাতে লোকজনও এসে গেছে ৷ ফিল্ম-টিল্ম চুকে গেছে, ডিম্পলরা সব যে-যার ঘরে ফিরে গেছে, এখন পড়ে আছে উটের গাড়ি উঁচিয়ে রাখা, দেওয়ালে মই লাগানো পথের দুধারে সারি সারি মাটির ঘর, আর বালুময় পথ, আর জিপ দেখে দৌড়ে আসার মতো নানা বয়সের প্রচুর ছেলেমেয়ে ৷ মাঠের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমাদের জিপ গোঁত্তা খেয়ে সেই গ্রামে ঢুকে পড়ল ৷ একটা গোড়া-বাঁধানো তেঁতুল গাছের তলায় গিয়ে থমকে দাঁড়াল ৷
ও মা, দেখতে দেখতে একটি বালক-বালিকার দল জুটে গেল আমাদের জিপ ঘিরে ৷ আমরা নামতে-না-নামতেই তাদের সানুনয় ডাকাডাকি, চল আমাদের ঘর দেখবে ৷ আমাদের ঘর-গেরস্থালি দেখবে, রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর সব দেখবে, বারান্দায় বাচ্চাদের বুড়োদের দড়ির দোলনা দেখবে, সব দেখিয়ে দেব ৷ দশটা টাকা দেবে শুধু ৷ আমরা যখন তাদের ঘরকন্না দেখার আমন্ত্রণ অস্বীকার করলাম তখন তারা বলল, তাহলে আমাদের দুটো টাকা দাও-যেন এর মধ্যেই তারা আমাদের যথেষ্ট সার্ভিস দিয়েছে ৷ আমরা এবার একটু নিষ্ঠুর হয়ে বললাম, না টাকা দেব না ৷ তখন তারা মেয়েদের বলল, তোমাদের কাছে টফি নেই, ক্যাডবেরি নেই? আচ্ছা তোমাদের কপালের টিপ এক সেট দাও না আমাদের ৷ ফটো তোলো না আমাদের ৷ সবই মেয়েরা অস্বীকার করায় তারা খুব ক্ষুণ্ণ হল এবং চেঁচামেচির পরিমাণ একটু বাড়িয়ে দিল ৷
আমার গ্রামটাকে দেখে প্রথম থেকেই বেশ একটু খটকা লেগেছিল ৷ রাজস্থানের কোনও গ্রামে এত চওড়া রাস্তা থাকে না, দুপাশে ঘরবাড়ি এমন সাজানো থাকে না ৷ পুরনো দিনের হলিউডে ওয়েস্টার্ন ছবিতে যেরকম সীমান্ত শহর তৈরি করা হত-দুপাশে দোকান, বাড়ি, কোথাও একটা বার আর হোটেল, তার পাশে পুলিশের থানা-খানিকটা সেইরকম করে একটা আস্ত গ্রাম বানিয়ে তোলা হয়েছে, ফিল্মের ক্যামেরায় কী ভালো আসবে, কোন অ্যাঙ্গল থেকে তাকে ধরা যাবে, পুরোটা যাতে একটা ছবি-ছবি দেখায়-এসব লক্ষ করে ৷ যদিও শুনলাম গ্রামের ভেতরকার অংশটা আগেই ছিল, তবু মনে হল, ফলে এই গ্রামটা হঠাৎ যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে, মাটির ভেতরে তার শেকড় তৈরি করেনি ৷ এখানকার মানুষগুলোও যেন ফিল্মের দরকারেই এসে বসেছিল, এখন ফিল্মের ব্যাপারটা চলে যাওয়ায় তাদের আর কিছু করবার নেই ৷ বাচ্চাদের ওই ভিক্ষে করার ছবিটা আমাদের ভালো লাগেনি ৷ আমার মনে পড়ছিল রমাপদ চৌধুরির সেই গল্প ‘ভারতবর্ষ’ ৷ যাতে আমেরিকান মিলিটারিরা দু-আনার জিনিস দশ টাকায় কিনে একটা পুরো গ্রামকে ভিখারির গ্রামে পরিণত করেছিল ৷ বেশ মন খারাপ করে আমরা সেখান থেকে রওনা হলাম ৷
শিগগিরই জিপ সাম-এর মূল রাস্তায় এসে পড়ল ৷ এখানে ছোটখাটো পাহাড় পড়ছে, পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে রাস্তা ৷ চাষবাসও হচ্ছে, আবার বাঁদিকে হঠাৎ ভেসে উঠল রুপোলি জলের বিল ৷ আমার মনে পড়ে গেল প্রায় ত্রিশ বছর আগে আমেরিকার ইউটা রাজ্যে দেখা সেই বিশাল সল্ট লেকের কথা, যার নামে হয়েছে সল্ট লেক সিটি ৷ ইউটাও খানিকটা মরুভূমি অঞ্চল, তাতে বালুর সঙ্গে সোরা মিশে থাকে, রাস্তার ওপরে সেই সাদা বালু বাতাসে উড়ে উড়ে যায়, আর বাঁদিকে ভেসে থাকে সল্ট লেকের সেই মৃত জলরাশি, যেখানে কেউ ডুবতে পারে না, চেষ্টা করলেও না ৷ এও কি সেই রুপোলি সোরা মেশানো মৃত হ্রদ, নাকি এ মরীচিকা? এইরকম ভাবতে ভাবতে আমরা পেরিয়ে গেলাম ৷
একটু পর থেকেই দেখা গেল, দারুণ সাজগোজ করা সব উট নিয়ে, তার নাকে বাঁধা দড়ি টেনে চলেছে বিশাল রাজস্থানি পাগড়ি-বাঁধা সব মানুষ ৷ তাদের মুখে বেশ গালপাট্টাওয়ালা দাড়ি, কানে আংটির মতো বীরবৌলি, লম্বা হাতা জামার ওপরে জরির নকশা কাটা জ্যাকেট, আর পায়ে চমৎকার অলংকৃত নাগরা জুতো ৷ বৃদ্ধদের প্রায় সকলেরই মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ-যেন মনে হয় এরা সবাই সেই রানাদের আমলের লোক, সেই ইতিহাসের পৃথিবী থেকে এসে আমাদের সঙ্গ নিয়েছে ৷ ‘এত উট নিয়ে কোথায় চলেছে গো?’ ইশা মহম্মদকে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা ৷ ইশা বলল, সব চলেছে ওই সামে ৷ ওখানে বিকেলে একটু পরে ট্যুরিস্টদের মেলা শুরু হয়ে যাবে, তখন সবাই উটে চড়ে ওই মরু-বালিয়াড়ি বা স্যান্ড ডিউনস-এ বেড়াতে যাবে ৷ উট যে মরুভূমির জাহাজ সে তো বাবুসাব জানেনই ৷ আমরা বলি উট হল মরুভূমির জিপগাড়ি ৷ কীভাবে হেলতে-দুলতে জাবর কাটতে কাটতে উঁচু নিচু বালির পাহাড়ে উঠবে সে আপনারা নিজেদের চোখেই দেখবেন একটু পরে ৷
‘আচ্ছা, এই উট ভাড়া দেওয়াই কি এদের জীবিকা? কত পায় এরা মাসে? যে সময় ট্যুরিস্ট থাকে না সে সময় কী হয়?’-ইশাকে পরপর প্রশ্ন করলাম ৷
ইশা হেসে বলল, ‘না সাব, এদের সক্কলের খেতি-জমি আছে ৷ এরা সকলে বেশ ভালো অবস্থার লোক ৷ খেতি-জমির রোজগার খারাপ নয়, তার ওপর আছে এই উট ৷ উট তো সাহাব সবসময় কাজ করে ৷ উট খেতে লাঙল টানে, শহরে ফসল নিয়ে যাবার গাড়ি টানে, আবার ট্যুরিস্টদের পিঠে চড়ায় ৷ যার দু-তিনটি উট আছে তারা তো ‘রাজা’ ৷ আর তাছাড়া, ইশা একটু মৃদু হেসে বলল, এদিকে বেশ একটু এসমাগলিংও হয় সাব ৷ সেটাও এদের একটা বেওসা ৷’
এইসব কথা চলছিল, এমন সময় বিশাল সারেঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, ধবধবে ধুতি-জামা, পায়ে নাগরা আর মাথায় লাল পাগড়ি-পরা একটি লোক ইশারা করায় ইশা জিপ থামাল ৷ আমি জিপের সামনে ইশার পাশের সিটে বসেছিলাম, সে এসে কষ্টেসৃষ্টে আমার পাশে বসল ৷ ভাবলাম আমাদের সঙ্গে সাম পর্যন্ত যাবার জন্যই বুঝি উঠেছে, সেখানে গিয়ে পর্যটকদের গানবাজনা শুনিয়ে কিছু রোজগার করবে ৷ আমরা ভুল ভেবেছি দেখলাম ৷ জুত করে বসতে না বসতেই, ওই অসুবিধার মধ্যেই, সে সারেঙ্গি বাজিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় মিহি সুরে রাজস্থানি লোকসংগীত ধরল ৷ তার গলা যে খুব মধুর, তা নয় ৷ তবে সারেঙ্গির বাজনার সঙ্গে তার গান, চারপাশে উটের মিছিল, আর মরুভূমির ক্রমশ কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া বিশাল উজ্জ্বল আকাশ-সব মিলিয়ে একটা কাণ্ড তৈরি হল বটে ৷ ফলে সামে আমাদের জিপ থেকে যখন সে নেমে গেল তখন তাকে শিল্পীর সম্মান-দক্ষিণা দিতে আমাদের কোনও আপত্তি হল না ৷
কটেজে খুব জলদি করে সুটকেস টুটকেস রেখে আমরা দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম ৷ কটেজের সহায়ক রাজিন্দার গোটাচারেক গার্ডেন চেয়ার এনে পেতে দিল ৷ আমরা আরাম করে বসে দক্ষিণে তাকিয়েই দেখি, আরে বাঃ ৷ এই তো সেই মরুর সমুদ্র ৷ ঠিক পুরীর সমুদ্রের মতোই বিশাল বিশাল ঢেউ উঠেছে, শুধু এগুলো বালির ঢেউ, আর এগুলো উঠে নেমে এগিয়ে এসে কোথাও আছড়ে পড়ছে না ৷ স্তব্ধ হয়ে থেমে আছে, যেন কোনও অদৃশ্য ক্যানিউট রাজা লাঠি তুলে তাদের বলেছে, ‘ব্যস, এই পর্যন্ত! আরেকটু এগোলেই শাস্তি পাবে!’ বালিয়াড়ির ঢেউ চলে গেছে দিগন্ত পর্যন্ত, জানি না দিগন্তের ওপারে কী আছে ৷ সেই শান্ত অথচ উত্তাল সমুদ্রের ওপর রোদ ঝিলমিল করছে, আবার পুবদিকের ঢালগুলোতে জমে আছে ছায়া, সেই ছায়া আর আলোর নানা ভাঁজ ভঙ্গিমা দেখেই সারাদিন কাটানো যায় ৷ আমরা, আর কটেজের অন্য দুটি ঘরের আরও দুই পরিবার এইভাবে চেয়ার পেতে বসেছি ৷ একটি মারাঠি এবং একটি বাঙালি পরিবার ৷ দুটিই তিনজনের পরিবার-প্রথমটিতে আছে একটি বছর দুয়েকের শিশু, আর দ্বিতীয়টিতে আছে বছর সতেরো-আঠারোর একটি কিশোরী কন্যা ৷
আমাদের কটেজটি একটি টিলায় তা আগেই বলেছি ৷ টিলার নিচে উত্তর দিক থেকে এসে গাড়ির রাস্তা আমাদের টিলাকে ঘিরে আবার পশ্চিমে সোজা চলে গেছে ৷ তারই ধারে, এপারে বেশ কিছু ঝুপড়ি-ঘর, যেখানে পানমশলা থেকে শুরু করে ফুজি ফিল্ম পর্যন্ত বিক্রি হয় ৷ সেই ঘরগুলোর পিছনে খানিকটা খোলা জায়গা, যা শেষ হয়েছে আমাদের টিলার গোড়ায় এসে ৷ সেখানে দেখি এবার জমে গেছে একটা পুষ্কর মেলা ৷ প্রায় শ-খানেকের মতো উট এসে সার সার বসে গেছে, আরও উট আসছে, দুয়েকটি ছুটকো হয়ে বসে বসে কাঁটাগাছ চিবোচ্ছে-কিন্তু উটেরা যেন প্রতীক্ষা করছে সেজেগুজে, এবার তাদের গুণপনার পরীক্ষা হবে ৷ কী হয়, কী হয় গোছের ভাব একটা-সারা সাম উৎকণ্ঠ হয়ে আছে, জীবনানন্দের উটের গ্রীবার কথা মনে করে উদগ্রীবও বলা যায় ৷
যা ঘটবার সেটা ঘটল ৷ হঠাৎ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে এসে পড়ল ছ-সাতটা ঢাউস দেখতে ট্যুরিস্ট বাস, তাদের গর্ভ থেকে পিলপিল করে নেমে এল অসংখ্য ট্যুরিস্ট ৷ আর কী আশ্চর্য, তাঁরা প্রায় সবাই বাঙালি ৷ তাঁরা দ্রুত দৌড়ে এলেন উটগুলোর কাছে ৷ আমাদের টিলাতে এসে চড়লেন একটি দল ৷ নানা বয়সের ছেলেমেয়ে, স্কুলের কিশোর-কিশোরী থেকে তরুণী বউ, জিনস ও টি-শার্ট পরা তাঁদের স্বামী ও দেওরেরা, বৃদ্ধ বাবা-মা ৷ তাঁদের সঙ্গে এসে পৌঁছল ওই সারেঙ্গি, এমনকী হারমোনিয়াম ঝোলানো গায়কের দল ৷ গায়কটি আমাদের কাছাকাছি একটি জায়গায় বসতেই যাত্রীদের দল তাকে ঘিরে দাঁড়াল, আর ‘রুদালি’ ‘রুদালি’ বলে চিৎকার করতে লাগল ৷ গায়ক বেচারা যে ‘রুদালি’র গান জানে না, ‘রুদালি’ দেখেই-নি সে, সেটা অনেকের কাছে অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে হল ৷ তারা হয়তো জানেই না যে, ‘রুদালি’তে ভূপেন হাজারিকা সব রাজপুতানার সুর ব্যবহার করেননি, আসামের সুরও ছিল ৷ এ গায়ক বেচারা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বা গুরুর কাছ থেকে যেসব গান শুনে বা শিখে এসেছে তার সঙ্গে ‘রুদালি’র কোনও সম্পর্ক নেই ৷ সে রাজস্থানের লোকসঙ্গীত ধরল একটি ৷ তখন সেই ছন্দময় গানটির সঙ্গে তালে তালে হাততালি দিয়ে নাচবার জন্য তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা বেশ উৎসাহ জেগে উঠল, জিনস, ফ্রক, শালোয়ার কামিজ, শাড়ি, হাউস-কোট-সব হাততালি দিয়ে নাচতে লাগল-সে একটা দেখার মতো দৃশ্য হল বটে ৷ বিশেষ করে নাইট-গাউন শোভিতা বাঙালি বউরা এখন নানা জায়গায় দেখা দেন, তাতে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বাড়ে ৷ ওটা যে ঘরে পরে থাকার পোশাক, সেই পুরনো কুসংস্কারে কেউ আটকে থাকতে চান না, ফলে রেস্তোরাঁয়, বাজারে, পথে-ঘাটে-সর্বত্রই বেশ কিছু নাইট-গাউন দেখা যায় ৷ ছেলেরাও ঘুমের জামা-পাজামা পরে পথে বেরোয় ৷ অন্যরা একটু ভুরু কোঁচকায়, তাতে কী এসে যায় ৷ আমাদের প্রতিবেশী মারাঠি দম্পতিই এটা নিয়ে একটু মৃদু বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন আমাদের কাছে ৷ আর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বাঙালিরা এত জোরে জোরে কথা বলে কেন বলুন তো!
যাই হোক, এর মধ্যে উটের কলোনিতে কোলাহল পড়ে গেছে ৷ সেই ট্যুরিস্টরা সার বেঁধে উটে চড়ার জন্য দৌড়ে এসেছে, আমাদের ট্যুরিস্টরাও দুটো গান শোনার পর সেদিকে ধেয়ে গেল ৷ উটগুলো পিছনটা উঁচু আর সামনেটা নিচু করে একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসছে, আর দুজন দুজন করে উঠে যাচ্ছে উটে ৷ স্ত্রী পিছনে স্বামীর কোমর ধরে, ভাই-বোন, বন্ধুর দল এইভাবে হৈ হৈ করতে করতে উঠে যাচ্ছে ৷ কেউ অত্যন্ত স্মার্ট ভঙ্গিতে, কেউ পড়তে পড়তে হাউমাউ করতে করতে কোনওরকমে, তাদের মুখ পাংশু, মনে হয় চূড়ান্ত পেটব্যথা চেপে বসে আছে তারা, আবার অন্যরা বেশ বীরত্বপূর্ণ উজ্জ্বল উৎসুক মুখে উঠে যাচ্ছে ৷ উটগুলো এই নানাবিধ সওয়ার নিয়ে যখন দাঁড়াচ্ছে তখন আরেক প্রস্থ নার্ভাস হৈচৈ-‘এই, পড়ে যাব পড়ে যাব’ চিৎকার ৷ তারপর সার সার উট বালিয়াড়ির রাস্তা ধরে একেবারে ক্যারাভ্যানের মতো, আবার প্রচুর লোক হেঁটেই চলেছে, সেই মরুভূমি-খণ্ড দেখতে দেখতে জনসমুদ্রের চেহারা নিল ৷
বলা বাহুল্য, রোমে এলে রোমানদের রীতি মানতে হয়, তাই আমরাও উটে চড়ে বেরিয়ে পড়লাম ৷ এখানে উটওয়ালাদের ইউনিয়ন মতো কিছু একটা আছে বলে মনে হল ৷ সকলের খেপ-এর নম্বর নির্দিষ্ট, কার উট আগে যাবে, কারটা পরে, ক-বার করে উট ভাড়া দেওয়া যাবে, সবই নির্দিষ্ট ৷ তবে তারই মধ্যে ঝগড়াও হচ্ছে দেখলাম ৷ দুয়েকটি উট একটু দূরে পশ্চিমদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘাস ও কাঁটাগাছ খাচ্ছে, একজন বা বসেই আছে-তাদের দেখলাম এই তুমুল প্রতিযোগিতা, হুল্লোড় ও মানুষের প্রাণপণ মরুদর্শন সম্বন্ধে কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই ৷
আমরা উটে চড়ে বেশ খানিকটা গেলাম, তাদের বাঁধা রুটে ৷ একটিতে আমি, আরেকটিতে দুই মেয়ে ৷ সে এক মজার অভিযান ৷ ঝড়ের নদীতে নৌকোর মতো ক্ষণে ক্ষণে উঠছি নামছি, চোখের সামনে দিগন্তও উঠছে নামছে, উল্টোদিক থেকে উট এমনভাবে আসছে যে, এই মনে হচ্ছে গায়ে গায়ে লেগে একটা কলিশন হয়ে গেল, তারপরেই খুব দক্ষতায় উটের মালিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ৷ প্রচুর চেঁচামেচি হৈ-হট্টগোল, হাসি, ডাকাডাকি, পড়ন্ত আলোয় ঝিলিক ঝিলিক ছবির ফ্ল্যাশ-সে এক বিশাল উৎসবের মতো ৷
মনে হল, যেন খুব অবিশ্বাস্যভাবে এক সময় সেই উৎসব থেমে গেল ৷ সন্ধে নামল মরুভূমিতে, সব উট তার সওয়ারি নিয়ে ফিরে এল, অন্ধকারে পায়ে-হাঁটা মরুযাত্রীরাও ফিরল, বিচ্ছিন্ন ঝুপড়িগুলোতে ম্লান বাল্ব জ্বলতে লাগল ৷ কিছুক্ষণ বাসগুলো এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে রইল, জনতা দলে দলে ভাগ হয়ে হৈ হৈ চালাল ৷ মরুভূমি দেখা শেষ, মস্ত একটা কাজ করা হয়ে গেছে উটের পিঠে চড়ে-সেটা উদযাপন করা চলল কিছুক্ষণ ৷ তারপর সমস্ত বাস তাদের ট্যুরিস্ট-অভিবাসী নিয়ে একে একে স্টার্ট করে হেডলাইটের দুই বল্লম উঁচিয়ে চলে যেতে লাগল ৷ কোনও একটি ঝুপড়িতে একদল অতি-উৎসাহী খানিকক্ষণ ‘উই শ্যাল ওভার কাম’ ইত্যাদি গেয়ে খানিকক্ষণ শোরগোল জাগিয়ে রাখল ৷ তারপর পশ্চিমে কোথায় একটা হোটেলের পার্টি হচ্ছিল মরুভূমিতে, তার সাজানো আলো আর হৈ-হল্লা, মাইক-নিনাদিত গান-বাজনা চলল খানিকক্ষণ ৷ তারপর নেমে এল এক আশ্চর্য স্তব্ধতা ৷
আমরা ফিরে এসে ওই গার্ডেন চেয়ারেই বসেছিলাম আবার ৷ সেখানেই পশ্চিমের ধোঁয়া-ধোঁয়া আকাশে সূর্য ডুবতে দেখলাম ৷ চারপাশের কলরোল থামল, নৈঃশব্দ্য নেমে আসার পর অন্ধকার, আর ওই অন্ধকারে ওপরের দিকে যেই চোখ তুলেছি, দেখি লক্ষ লক্ষ তারা খুব উজ্জ্বল প্রসন্ন মুখে আমাদের দেখছে ৷ এত তারা জীবনে দেখেছি বলে মনে হয় না ৷ সন্ধে নামার পরেই সেই আশ্চর্য ঘটনাও ঘটেছে, ফোঁটা ফোঁটা একটু বৃষ্টিও হয়ে গেছে ৷ মরুভূমিতে বৃষ্টি-এ দেখার কপাল কজনের হয় জানি না ৷ কিন্তু তাতেই আকাশ একদম ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেল, আর নীলিমার অতল অন্ধকার সমুদ্রের তলদেশ থেকে ভেসে উঠল ঝাঁকে ঝাঁকে তারার দঙ্গল ৷
এই শান্তিটুকুর জন্যই প্রতীক্ষা ছিল আমাদের ৷ মরুভূমির ঊর্মিল বিস্তার আর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু একটা আভা জেগে আছে ৷ এইবার রাত এবং মরুভূমির মুখোমুখি বসে রইলাম আমরা ৷
পরদিন ভোরে উঠে দেখি একটি নিঃসঙ্গ কুকুর মরুভূমির ওপার থেকে দুলকি চালে মৃদু দৌড়ে এদিকে আসছে ৷ অনেকক্ষণ ধরে বালুর ঢেউয়ের পিঠ ধরে তার এগিয়ে আসা দেখলাম ৷ এই ছবিটি দেখেই, উটের অসংখ্য পদচিহ্ন ধরে রাখা, সেই অনেক কষ্টে প্রকৃতির জাদুঘরে বাঁচিয়ে রাখা, চিত্রিত মরুখণ্ডের কাছ থেকে আমরা বিদায় নিলাম ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন