অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
পশ্চিমের বিহার থেকে ভাসতে ভাসতে পুরুলিয়া জেলায় ঢুকে এসেছে কিছুটা পাহাড়ের ঢেউ ৷ তারই জঙ্গলে আদিবাসীদের শিকার উৎসবের পুণ্যভূমি অযোধ্যাবুরু ৷ হাজার দুয়েক ফুট উঁচু সেই পাহাড়ের ওপরটা প্রায় সমতল ৷ হালকা ঢেউ খেলানো সবুজ ঘাসের মাঠ, শস্যখেত, মাঝে মাঝে কয়েক ঘর কুটির নিয়ে ছোট ছোট গ্রাম, আর এদিকে ওদিকে আরও উঁচু কয়েকটা পাহাড়চুড়ো ৷ থাকার জন্য পর্যটন বিভাগের লজ আছে সেখানে ৷ আগে কেবল ডর্মিটরি প্রথায় থাকার ব্যবস্থা ছিল ৷ হাঁটাপথে পাহাড়ে চড়ে রাত কাটাতে যেতেন অভিযানপ্রিয় তরুণদের দল ৷ এখন মাত্র ৫০ টাকা ভাড়ায় দুজন করে থাকার জন্য কটেজ হয়েছে ৷ আরও ভালো ব্যবস্থায় থাকার মতো বাংলো করেছেন এরিয়া ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ৷ বাসও গিয়ে পৌঁছচ্ছে এখন পাহাড়ের ওপরে ৷ পুরুলিয়া শহর থেকে বাসে চড়ে বা জিপ ভাড়া করে নির্জন পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আজকাল অযোধ্যাবুরু যাচ্ছেন শৌখিন পর্যটকেরাও ৷ এক দম্পতিকে দেখলাম মোটর সাইকেল নিয়েই পাহাড়ে উঠেছেন ৷
সকালটা ময়ূর পাহাড়ে কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলেছি ফুলডি গ্রামের দিকে ৷ ময়ূর পাহাড় মাত্র পনেরো মিনিট লাগে হেঁটে উঠতে ৷ ওপর থেকে ভারি সুন্দর দেখায় দূরের পাহাড়ের সারি, নিচের সবুজ শস্যখেতের মধ্যে লাল টালির চালের ঘরবাড়ি ৷ আর কিছুটা হেঁটে চাডড়ি পাহাড়েও ওঠার ইচ্ছা ছিল ৷ কিন্তু সাপারমবেড়া গ্রামের লোকেরা জুতো পায়ে দিয়ে চাডড়িতে যেতে নিষেধ করলেন ৷ সেই পাহাড়কে দেবতা বলে পুজো করেন তাঁরা ৷
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বামনি ফলস দেখতে যাবার কথা ৷ বামনি ঝরনা ট্যুরিস্ট লজ থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার ৷ গ্রাম ছাড়িয়ে মাঠ পেরিয়ে শর্টকাটে হেঁটে ঘণ্টা খানেকে পৌঁছনো যায় সেখানে ৷ তবে লোকালয়ের বাইরে সেদিকটা নাকি বিকেলের পর বিপজ্জনক হতে পারে ৷ যাওয়া ভালো সকালবেলাতে ৷ কিন্তু ট্যুরিস্ট লজের ডর্মিটরির ছেলেদের দলটা ঝরনা দেখতে রওনা দিল দুপুরের পরেই ৷ বলে গেল-জঙ্গলই নেই, তো জংলি জানোয়ার আসবে কোথা থেকে!
জঙ্গল নেই এটা ঠিক নয় ৷ আগের তুলনায় গাছ কমে গেছে অনেক ৷ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, পথঘাট, পাহাড়ের নিচে বিশাল অঞ্চল জুড়ে অফিস আর প্রোজেক্টের স্টাফ কোয়ার্টার্স তৈরি করতে গাছ কাটা হয়েছে প্রচুর ৷ গরিব মানুষও অভাবের তাড়নায় গাছ কেটে ফেলেন রুজি জোগাড়ের চেষ্টায় ৷ ফলে গাছ কমছে নানাভাবেই ৷ আবার নতুন গাছও লাগানো হয়েছে ৷ বেশ ঘন জঙ্গলই রয়েছে পাহাড়ের ঢালে দিকে দিকে ৷ দেখা যায় নিচ থেকে ওপরে উঠে আসার পথে ৷ শাল, সেগুন, মহুয়া, শিমুল, কুসুম, পলাশ গাছ রয়েছে অজস্র ৷ বসন্তে পলাশ ফুল লাল করে তোলে সমস্ত অঞ্চল ৷ বন্যপ্রাণীও কম নয় ৷ পাখি আর সরীসৃপ অসংখ্য ৷ হরিণ, খরগোশ, সজারু, হনুমান বিপজ্জনক নয় কিন্তু নিরালা অরণ্যে ভয়ের কারণ হাতি, ভাল্লুক, বুনোশুয়োর ৷ চিতাবাঘও আছে কাছাকাছি জঙ্গলে ৷ বুনো হাতির জন্যই বেশি চিন্তা ৷ আগের দিনই শুনে এসেছি পাহাড় থেকে হাতির পাল নামছে নিচের লহরিয়া, কুদনা গ্রামে ৷ পাহাড়ের ওপরের ধানখেতগুলোতেও গাছের ওপর মাচাবাঁধা হয়েছে রাতের পাহারার জন্য ৷ সন্ধের অন্ধকারে গ্রামের পথে যেতে বড় গাছের ছায়া দেখে হঠাৎ চমকে উঠছে লোকে হাতি দাঁড়িয়ে আছে ভেবে ৷
দলমা থেকে এদিকের পাহাড়তলির সমস্ত গ্রামেই ধানপাকার সময় হাতি নেমে আসা প্রতিবছরের সমস্যা ৷ ভালুক চলে আসে পথের ধারে মহুয়া গাছ থেকে ঝরে পড়া মহুয়া খেতে ৷ তীরধনুক, বল্লম, টাঙ্গি এদিকের বাসিন্দাদের চিরকালের অস্ত্র ৷ বন্দুকও রাখা হয় এখন অনেক গ্রামে ৷ খেতের পাশে উঁচু মাচা বেঁধে রাতের দিকে পাহারায় বসে গ্রামের লোক ৷ দূর থেকে হাতি আসতে দেখলে ঢোল-ধামসা বাজিয়ে হইচই করে চেষ্টা করে জঙ্গলে ফিরিয়ে দিতে ৷ বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজও করা হয় ৷ তবে অনেক সময়ই যথেষ্ট হয় না পাহারা ব্যবস্থা ৷ হাতি এসে লণ্ডভণ্ড করে যায়, এমনকী বাড়ির কলাবাগানও ৷
বন্যপ্রাণী-শিকার আইন করে বন্ধ করা হয়েছে ৷ যদিও বৈশাখ মাসে বুদ্ধপূর্ণিমার রাতে আদিবাসীদের শিকার উৎসবে প্রাণী-হত্যায় বাধা নেই ৷ অন্য সময়ে শিকার হয় লুকিয়ে চুরিয়ে ৷ খরগোশ, সজারু ছাড়াও মাংসের জন্য মারা হয় হরিণ, বুনোশুয়োর ৷ আমলকী, বহেরা খেতে ভালোবাসে হরিণ ৷ জঙ্গলে গাছের নিচে ঝরে পড়া বহেরা খেতে হরিণ আসবেই, তখন ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থেকে তীরধনুক নিয়ে হরিণ শিকার রোমাঞ্চকর বলে জানালেন গ্রামের যুবক ৷ শিকার উৎসবে তিনি প্রতিবছরই কিছু না কিছু শিকার পেয়ে আসছেন ৷ আদিজনের সমাজে এটা অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা ৷ উৎসবের রাতে চাঁদের আলোয় শিকারের আশায় ধনুক-কুঠার-বল্লম হাতে পাহাড়ে ছুটে বেড়ায় হাজার হাজার মানুষ ৷ বাংলা-বিহারের দূরদূরান্তের গ্রামগুলো থেকে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে আদিবাসী তরুণরা জমা হয় দলে দলে ৷ এমনকী দলবেঁধে তরুণরা আসেন দূর মেদিনীপুরের গ্রামগুলো থেকেও ৷ শিকার উৎসবে যোগ না দিলে ছেলে সাবালক হয় না বলে মনে করে আদিবাসী সমাজ ৷ সারাবছর তারা অপেক্ষায় থাকে বছরের সেই সময়টার জন্য ৷
ভাবছিলাম শিকার উৎসবের সময় একবার অযোধ্যায় আসব ৷ আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন স্থানীয় যাঁদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে তাঁরা প্রত্যেকেই ৷ অজিত মাহাতো নিজে শিকার না করলেও দেখতে যান প্রত্যেকবারই ৷ বলছিলেন সারা রাত ধরে শিকারের পিছনে ছোটার উন্মাদনার গল্প ৷ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কীভাবে জাল পেতে জঙ্গল ঘিরে শিকার তাড়িয়ে নিয়ে আসা হয় ৷ পাহাড় জুড়ে সেই উন্মাদনার ছবি তুলে রাখতে পারলে খুবই আকর্ষণীয় হবে ৷ যদি আমি আসতে রাজি থাকি তবে আমার জন্য অস্ত্র জোগাড় করে রাখবেন বলে জানালেন অজিত ৷ অস্ত্র দিয়ে কী হবে! আমি তো শিকার করতে যাব না, যাব ক্যামেরা নিয়ে! কথা শুনে অজিত অবাক ৷ শিকার উৎসবে কেউ অস্ত্র ছাড়া যায় না কি! একটা জানোয়ার তাড়া করলে নিজেকে বাঁচাতে তো হবে ৷ আর, সারা পাহাড় যখন মাতাল হয়ে শিকারের পিছনে ছুটছে তখন একজন লোক খালি হাতে ঘুরছে এটা দেখাবেই বা কেমন!
সন্দেহ নেই সেটা খুবই বাজে দেখাবে ৷ আপনি যে দেখতে যান সে কি অস্ত্র হাতে নিয়ে, জিজ্ঞেস করলাম অজিতকে ৷ সে তো বটেই ৷ খাটের নিচ থেকে একটা প্রকাণ্ড কুঠার টেনে বের করল অজিত ৷ এছাড়া আরও আছে ৷ কিছু না কিছু সঙ্গে রাখতেই হয় ৷ প্রয়োজনে ঘাও মারতে হয় তা দিয়ে ৷ তাড়া খাওয়া বুনোশুয়োর বড় ভয়ংকর ৷ সোজা ছুটে এসে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় ভারি শরীর দিয়ে ৷ তারপর কামড়ে হাঁটু গুঁড়ো করে দেয় ৷ শুয়োর কামড়ায় বলে কখনও শুনিনি ৷ দুপাশের ধারাল দাঁত দিয়ে পেট ফুটো করে দেয় বলেই জানতাম ৷ তাও করে, বলল অজিত ৷ সঙ্গে কামড়ও দেবেই ৷ আর সেটা সবসময়ই হাঁটু বা কনুইয়ের জোড়া হাড়ে ৷ একটা কামড়ে ধরাশায়ী প্রতিপক্ষের হাঁটু পুরোপুরি গুঁড়ো করে দিয়ে চলে যায় ৷ আর সারিয়ে তোলা যায় না ৷
এবছর বুদ্ধপূর্ণিমার দিন কয়েক আগেই অযোধ্যা পাহাড়ের ওপরের হাসপাতালে ডাক্তারের পদের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন কাজল রায় ৷ বলছিলেন শিকার উৎসবের আগে তাঁর আতঙ্কে দিন কাটানোর গল্প ৷ আতঙ্ক কীসের, বুঝতে পারছিলাম না আমি ৷ হাসলেন কাজলবাবু ৷ তেমন কিছু নেই ঠিকই ৷ কিন্তু শহর ছেড়ে পাহাড়ের অপরিচিত পরিবেশে নতুন এসে একটু ভয় লাগে ৷ প্রথমদিন এসে পৌঁছেছিলাম বিকেলবেলা ৷ হাসপাতালের বিশাল কোয়ার্টার ৷ একটা ঘর ঝেড়ে মুছে রাত কাটানোর মতো করে তুললাম ৷ বাথরুমটা খুলতেই ভেঙে পড়ল বেসিন আর আয়না ৷ সারারাত অন্ধকারে খুটখাট শব্দ ৷ টর্চ জ্বেলে কখনও দেখছি বাইরে দিয়ে কুকুর চলে যাচ্ছে, কখনওবা জানালার কাচে গঙ্গাফোড়িং ফর ফর করছে ৷ মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবীতে মানুষ আমি একা ৷ কখন ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না ৷ ভোরবেলা উঠে দেখি চারদিক সবুজে সবুজ ৷ আস্তে আস্তে ভালো লাগল জায়গাটাকে ৷ তবে শিকার উৎসবের সম্বন্ধে শুনেছিলাম রাতভর মহুয়া হাড়িয়া খেয়ে সবাই শিকারের পিছনে ছোটে ৷ অন্ধকারে হঠাৎ ছুড়ে দেওয়া তীর-বল্লমে বা শিকার ভাগাভাগির সময় নিজেদেরই অস্ত্রে আহত হয়ে যায় শিকারীরা ৷ ভাবছিলাম রাতে মুমূর্ষু রোগী নিয়ে যদি হাসপাতালে চড়াও হয় দলে দলে লোক, সামলাতে পারব তো সব দিক! স্থানীয় মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল না বলেই আতঙ্কিত হয়ে ছিলাম প্রথম প্রথম, বললেন ডাক্তার ৷ এখন সবকিছু স্বাভাবিক মনে হয় ৷
পাহাড়ের হাসপাতালে ডাক্তারবাবু থিতু হয়েছেন এটা নিশ্চয়ই আনন্দের কথা ৷ প্রায় হাজার কুড়ি লোক নির্ভর করে সেই হাসপাতালের ওপর ৷ এবং ওষুধপত্রও রয়েছে যথেষ্ট বলে জানালেন কাজল রায় ৷ সমস্যা শুধু কাজের পরে সময় কাটানো ৷ ভ্রমণকারীরা আসলে ভালো লাগে ৷ খাবারের হোটেলে আড্ডা জমে তাদের সঙ্গে ৷ আরেকটা সুখবর, এবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ আশা করা যায় চালু হয়ে যাবে অযোধ্যা পাহাড়ের ওপরে টাউন লাইব্রেরি ৷ পত্রপত্রিকা রাখা হবে নানারকম ৷ স্থানীয়দের তো বটেই, ভ্রমণকারীদেরও অবসর কাটানোর জন্য ব্যবস্থা হল একটা, ডাক্তারবাবু বললেন ৷
অযোধ্যা পাহাড়ে কয়েক দিনের জন্য এলে সবটাই নিশ্চিন্ত অবসর ৷ খাওয়া-দাওয়া রাস্তার ধারে হোটেলে ৷ ট্যুরিস্ট লজে খাবারের ব্যবস্থা নেই ৷ মিনিটখানেক হাঁটলেই পথের পাশে সাধারণ মানের দুটো হোটেল ৷ একটু ভেতরে রয়েছে আরেকটা ৷ তারই কোনও একটা পছন্দ করে নিচ্ছেন পর্যটকরা ৷ দুপুরে সন্ধ্যায় সেখানেও একদলের সঙ্গে অন্য দলের আড্ডা ৷ হিল টপ রেস্টুরেন্টের মালিক অখিল সিং সর্দারকে সবাই ডাকে উকিল সিং বলে ৷ দিনে দিনে অযোধ্যা পাহাড়ে পর্যটক বাড়ছে বলে জানালেন উকিল সিং ৷ ইলেক্ট্রিক লাইট না থাকার জন্য আগে একটু অসুবিধাজনক ছিল ৷ ট্যুরিস্ট লজে সোলার লাইট থাকলেও সবসময় জ্বলত না ৷ এখন ইলেক্ট্রিক লাইন এসে গেছে ৷ এ সি রুমেরও ব্যবস্থা করেছেন কম্প্রিহেনসিভ এরিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি তাদের নীহারিকা লজে ৷ এছাড়া বীরবিরশা ক্লাবের ঘরেও থাকে অনেক পর্যটক দল ৷ সম্প্রতি কৃত্তিবাস মাহাতো তাঁর আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করেছেন ৷ সি এ ডি এ-র লজের পিছনের রাস্তায় ছোট্ট সেই আশ্রমের ঘরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভগবতী মূর্তি ৷ তার পাশে ধ্যানকক্ষ ৷ ঢোকার মুখে লেখা রয়েছে ‘অযোধ্যা বিশ্বাশ্রম প্রারম্ভ পরিশ্রম’ ৷ উঠোনের একদিকে খড়ের ছাউনির মাটির ঘরে কাঠের বাঙ্ক করে থাকার ব্যবস্থা ৷ পরিচ্ছন্ন উঠোনে গাছের ছায়ায় পরিবেশ সুন্দর ৷ ইলেক্ট্রিক লাইটও রয়েছে আশ্রমে ৷ পিছন দিকে ছাউনি দেওয়া সিমেন্টের মঞ্চে বসার জন্য বেঞ্চ পাতা আছে ৷ চারপাশে স্তূপ করে রাখা নানা বনজ ছত্রাক ৷ ঘর সাজানোর জন্য জঙ্গল খুঁজে সংগ্রহ করা হয় সেসব ৷ সোনালি রঙের ফুলের মতো দেখতে বুড়ি লাটের ছাতি জাপানে চালান যায় গোল্ডেন মাশরুম নামে ৷ কাঠের বাড়ির কড়িকাঠের শোভা বাড়ায় তারা ৷ এছাড়া স্পঞ্জ মাশরুম কাঠছাতি, শুকনো পদ্ম পরাগ, আসন ফল, ভালুকশুক্তির বীজ, আমড়ার আঁটিও চালান যাচ্ছে শহরে ৷ কলকাতার দুর্গাপুজো প্যান্ডেল সাজানোতেও তাদের চাহিদা আছে বলে জানালেন কৃত্তিবাসবাবু ৷
বিশ্বাশ্রম ছাড়াও ভারত সেবাশ্রম সংঘের আশ্রম আছে অযোধ্যা পাহাড়ে ৷ সংঘের ঘনিষ্ঠ না হলে সাধারণত থাকার জায়গা পাওয়া যায় না সেখানে ৷ হয়েছে নতুন রামমন্দিরও ৷ খুশি খুশি মুখে সেদিক থেকে বেড়িয়ে ফিরছে পর্যটকের দল ৷ তবে জঙ্গলের মধ্যে থাকার ইচ্ছে নিয়ে যাঁরা ট্যুরিস্ট লজে এসেছিলেন তাঁরা কিছুটা নিরাশ ৷ দিব্যি জঙ্গল ছিল আসার পথে সিরকাবাদে, পাহাড়ের ওপরে উঠতেই জঙ্গল উধাও-দুঃখ জানাল একটা দল ৷ বলল, ফরেস্ট লজের দিকটায় তবু জঙ্গল জঙ্গল ভাব আছে ৷
ফরেস্ট লজ আছে পাহাড়ে, আর নিচের সিরকাবাদে ৷ পুরুলিয়া ফরেস্ট অফিস থেকে বুক করে এলে থাকা যায় সেখানে ৷ তবে থাকা-খাওয়ার সুবিধার জন্য আর নিরাপদ পরিবেশে থেকে কাছাকাছি জঙ্গল ঘুরে দেখার জন্য পাহাড়ের ওপরটাই ভালো ৷ ট্রেক করে যাঁরা পাহাড়ে উঠতে চান তাঁদেরও ওপরে জায়গা পাওয়া দরকার ৷ মালভূমির মতো পাহাড়ের ওপরটায় জঙ্গল না থাকলেও সবুজের অভাব নেই ৷ তারমধ্যে লালমাটির পথের ধারে লাল রঙের কুটিরে গ্রামগুলোও আকর্ষণীয় ৷
টালিতে ছাওয়া মাটির বাড়িগুলোকে রং করা শুরু হয় বর্ষার পরে দুর্গাপুজোর সময়ে ৷ দেওয়ালের নিচের দিকে সাধারণত লেপে দেওয়া হয় লাল মাটি ৷ ওপরের অর্ধেকে হলুদ, নীলচে বা সাদা খড়িমাটি বুলিয়ে দুই রঙে ভাগ করে ফেলা হয় বাইরের দেওয়ালগুলোকে ৷ কালো রংও ব্যবহার করেন অনেকে ৷ ওপরের অংশে নুইয়ে পড়া ধানের ছড়ার মতো গোল গোল টানে রং বুলিয়ে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে কোনও কোনও বাড়িতে ৷ কালীপুজোর মধ্যে রং দেওয়া শেষ করা নিয়ম ৷ তারপরেই আদিবাসীদের বাঁধনা উৎসব ৷ সে সময় গিয়ে দেখি রং মেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে গ্রামের প্রতিটা বাড়ি ৷ সবুজ ধানখেতের পাশে গাছপালায় ঘেরা গ্রামে নিকনো উঠোনের বাড়িগুলোতে এমন শান্তিময় পরিচ্ছন্নভাব যে দেখে পবিত্রতা শব্দটা মনে পড়ে যায় ৷
নতুন ফসলের সঙ্গে এসে পড়ে একের পর এক লোক উৎসবের পালা ৷ কালীপুজোর দুদিন পরে বাঁধনা উৎসব ৷ পাহাড়ের নিচে কিশোরভারতী আশ্রম-বিদ্যালয়ে দেখা হল বাঁধনা পরবের অহীরা গানের ওস্তাদ আমিন মাহাতোর সঙ্গে ৷ একই নামে গ্রামে আরেকজন আছেন বলে সবাই ছোট আমিন বলে ডাকে তাঁকে ৷ সেদিন কালীপুজোর রাতে তাঁদের গান গেয়ে গরু-মহিষকে জাগানোর অনুষ্ঠান ৷ সারা রাত ধরে মাদল-ধামসা নিয়ে গান গেয়ে গেয়ে ঘোরা হবে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে, জানালেন ছোট আমিন ৷ সকাল থেকে গরুদের স্নান করিয়ে পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে ৷ সন্ধ্যার আগে তেল মাখানো হচ্ছে শিঙে ৷ শুকনো খড়বিচালির সঙ্গে গরুকে আজ অন্তত একমুঠো কচি ঘাস খেতে দিতেই হবে ৷ ভগবান আজ দেখতে আসেন সারা বছর খাটালেও ঠিকমতো যত্ন করা হচ্ছে কিনা গরুদের ৷ সূর্যাস্তে তাদের গোয়ালে তোলার সময় কাঁচিদুয়ারি অনুষ্ঠান ৷ দরজার দুপাশে মরদা ঘাসের গাছি বেঁধে সাজানো হয়েছে গোয়াল ৷ আলপনা দেওয়া হয়েছে উঠোনে ৷ চালের গুঁড়ো মেখে চ্যাপটা করে তৈরি হয়েছে প্রদীপ ৷ শালপাতার ওপর সেই প্রদীপ সাজিয়ে দেওয়া হয় দরজার দুপাশে ৷ গোয়ালে আজ প্রদীপ জ্বলবে সারা রাত ৷ অহীরা গায়কের দল গেলে পিঠে খাইয়ে দক্ষিণা দিয়ে আপ্যায়ন করবেন গৃহস্বামী ৷ নাচ-গান হই-হুল্লোড়ে ঘুম থেকে জাগানো হবে গরুদের ৷ পরদিন অমাবস্যা ছাড়ার পর গোবর্ধন পুজো শুরু ৷ পুজো হবে গড়য়া-শালুক ফুল দিয়ে ৷ মুরগি-ছাগলও কাটা হয় সেই উপলক্ষে ৷ আর তারপর দিন বাঁধনা উৎসবের তুমুল হুল্লোড় ৷ গরুদের সেদিন সাজানো হয় গায়ে চিত্র-বিচিত্র রং মাখিয়ে ৷ মাথায় জড়িয়ে দেওয়া হয় সুন্দর ঘাসের মালা ৷ রঙিন ফিতে বেলুন ঝুলিয়েও সাজানো হয় আজকাল ৷ তারপর গরুকে খুঁটিতে বেঁধে চারপাশ থেকে মাদল-ধামসা বাজিয়ে হইচই করে খেপিয়ে তোলা হবে তাকে ৷ প্রচণ্ড রেগে শিং বাগিয়ে তেড়ে আসবে গরু ৷ কিন্তু খুঁটিতে বাঁধা বলে পালাতে পারবে না ৷ ঘিরে ধরে নেচে নেচে সমানে বিরক্ত করা হবে তাকে, কিন্তু বারে বারে তেড়ে এসেও সে গুঁতো দিতে পারবে না ৷ উল্লাসে ফেটে পড়বে দর্শকদল ৷ দেখ, কেমন বেঁধেছি তোকে, কেমন বশ মানিয়েছি ৷
সহজ সরল লোক-উৎসবগুলোতে যোগ দেয় সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৷ অভাব অনটনে নিত্যদিনের দুর্দশাময় জীবনে গ্রামীণ পরব বয়ে আনে নির্মল আনন্দ ৷ ফসল ভালো হলে উৎসব আরও বর্ণাঢ্য ৷ চড়া রঙের ব্যবহার তাদের বেশভূষায়, উৎসবের উপকরণ সজ্জায় ৷ আর নানা চাপের মধ্যে থেকেও তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নাচ, গান আজও সজীব ৷ কিছুদিন পরেই পৌষসংক্রান্তির দিন পাহাড়ের নিচে টুর্গা বাঁধের ধারে বসবে টুসু মেলা ৷ ফসলের দেবতা টুসু ৷ উর্বরতার আশায়, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় সেদিন মেয়েরা টুসু গান গেয়ে রঙিন চৌডাল ভাসায় জলে ৷ পাহাড়ের ওপরে থেকে টুর্গা বাঁধে ভাসান দেখে ফিরতে হলে সঙ্গে জিপ থাকা দরকার ৷ নিচে কাছাকাছি থাকার জায়গা বাগমুণ্ডিতে, অযোধ্যা মোড়ের কাছে সেচ দপ্তরের বাংলো ৷ আগে পুরুলিয়া থেকে বুকিং করা থাকলে সেখানে থাকা যেতে পারে দুয়েক রাত ৷ তাহলে দেখে নেওয়া যায় বাগমুণ্ডি মোড় থেকে ২ কিলোমিটার দূরে মুখোশ শিল্পের জন্য বিখ্যাত চড়িদা গ্রামটাও ৷ পুরুলিয়ার জনপ্রিয় ছো-নাচের জন্য প্রথম পদ্মশ্রী পাওয়া শিল্পী গম্ভীর সিং মুড়ার বাড়ি এই গ্রামে ৷ ছো-নাচের মুখোশ শিল্পের জন্যও নানা খেতাব পেয়েছেন গ্রামের অনেক শিল্পী ৷ মুখোশ কিনে নিয়ে যাওয়া যায় স্মারক হিসেবে ৷ সেই সঙ্গে দেখে নেওয়া যেতে পারে পৌষসংক্রান্তির পরদিন মাঠাপাহাড়ে মারাংবুরু বাবার পুজোর উৎসব ৷ বাবার থানে বলি দেওয়া হয় অসংখ্য ছাগল পাঁঠা পায়রা ৷ মেলা বসে পাহাড়ের নিচে ৷ সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের স্রোতে ঝুমুর গান আর ধামসা-মাদলের সঙ্গে সাঁওতালি নাচে মেলা হয়ে ওঠে সরগরম ৷
মাঘ মাসের প্রথমদিনে উৎসবের সময় ছাড়া মাঠাপাহাড় কোলাহল শূন্য ৷ স্থানীয় কাঠুরে ছাড়া কদাচিৎ চোখে পড়ে বাবার থানে বা পাশের কালীমন্দিরে পুজো দিতে যাওয়া দুয়েকজন পদযাত্রীকে ৷ খুবই কঠিন চড়াই পেরিয়ে পৌঁছতে হয় পাহাড়ের ওপরে মন্দিরে ৷ সময় লাগে ঘণ্টা দেড়েক ৷ অভিযান প্রিয় তরুণরা চলেন পথ ছেড়ে পাহাড় বেয়ে ৷ বাঁকুড়ার শুশুনিয়ার মতো এই পাহাড়ও পর্বতারোহণ শিক্ষার জন্য জনপ্রিয় হয়েছে ৷ পুরুলিয়া থেকে বাগমুণ্ডি যেতে ১০ কিলোমিটার আগে মাঠা মোড় ৷ থাকার জন্য মোড় থেকে আধ কিলোমিটার দূরে রাস্তার ধারে ফরেস্ট লজ আছে ৷ বুকিং হয় পুরুলিয়া থেকে ৷ গ্রামের বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়েও থাকেন অনেকে ৷ খাওয়া-দাওয়া আর থাকার ব্যবস্থার জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে মাঠা মোড়ের কাছে ত্রিপুরারি দাসের চায়ের দোকানে ৷
পুরুলিয়ার ছো-নাচ দেখতে হলে যেতে হবে চৈত্র মাসে গাজনের পরে ৷ অযোধ্যা পাহাড়ের নিচে লহরিয়া বাবার মন্দিরের কাছেও চৈত্রসংক্রান্তিতে বসে জাঁকালো গাজনের মেলা ৷ পুরুলিয়ার পাথুরে মাটিতে তখন আগুনের হলকা ৷ সে কারণে পাহাড় জঙ্গল ঘুরে দেখতে আগ্রহীরা পছন্দ করেন শীতকালটাই ৷
কাছাকাছি তৈরি হয়ে উঠছে আরেক দ্রষ্টব্য, পাখি পাহাড় ৷ মাঠার কাছে এক ন্যাড়া পাহাড়ের গায়ে উড়ন্ত পাখির ঝাঁক খোদাই করে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন শিল্পী চিত্ত দে ৷ বনদপ্তর থেকে অনুমতি পাওয়ার পর তৈরি হয়েছে ফাউন্ডেশন-ফ্লাইট টু হারমনি ৷ কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের ছাত্র চিত্ত দে-র ছবি ‘ফ্লাইট টু হারমনি’ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের অ্যানুয়াল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল ১৯৯০-৯১ সালে ৷ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির শুভেচ্ছায় শিল্পী পাহাড়ে খোদাই কাজ শুরু করেছেন বছর দুয়েক আগে ৷ পাহাড়ের নিচে তাঁর ক্যাম্পে কাজ শিখে দড়িতে ঝুলে পাহাড় কাটছেন কাছাকাছি গ্রামের বেশ কিছু তরুণ ৷ আলাপ হল ঈশ্বরচন্দ্র, আশুতোষ, সনাতন, উপেনচন্দ্র মাহাতোদের সঙ্গে ৷ এমন ৩০-৩২ জন ছেলে কাজ করছে বলে জানালেন শিল্পী ৷ কোনওদিন ছেনি হাতুড়ি ধরার অভিজ্ঞতা ছিল না তাদের ৷ এখন ক্রমশই পাথর খোদাইতে দক্ষ হয়ে উঠছে তারা ৷ পাহাড়ের গায়ে ফুটে উঠছে একের পর এক পাখির প্রতিকৃতি ৷ সবে প্রথম পর্যায়ের কাজ চলছে ৷ রেখাচিত্রের মতো ফুটে উঠেছে কিছু উড়ন্ত পাখি ৷ ৪০-৫০ ফুট ডানামেলা বিশাল পাখিগুলোকে ছোট ছোট দেখায় নিচ থেকে ৷ পাহাড় জুড়ে এমনই অসংখ্য পাখির মিলিত ঝাঁক খোদাই হয়ে থাকবে ঐক্যের প্রতীক হয়ে ৷ শিল্পীর স্বপ্ন স্থায়ী হবে পাহাড়ে ৷
দীর্ঘ কুড়ি বছরের পরিকল্পনা ৷ তবে কাজ চলছে পুরোদমে ৷ রোমান্টিক যে-কোনও পর্যটককে আলোড়িত করবে এই অভিযান ৷ পুরুলিয়া থেকে বাগমুণ্ডি যেতে মাঠার ৩ কিলোমিটার আগে ভুচুংডি মোড়ে বাস থেকে নেমে মাত্র ১ কিলোমিটার হাঁটাপথে যাওয়া যায় পাখি পাহাড়ে ৷ গাড়ি চলে যেতে পারে পাহাড়ের নিচে ক্যাম্প পর্যন্তই ৷ তবে শাল সেগুন পলাশের বনের পাশ দিয়ে লাল মাটির পথ ধরে পাহাড় লক্ষ করে হেঁটে চলাও মনোরম ৷ ডানদিকে খেত পার হয়ে গ্রাম ৷ আর সামনে দেখা যায় পাহাড়ের নিচে হলুদ রঙের বাড়ি, শিল্পীর আস্তানা ৷
অযোধ্যা পাহাড়ে গেলে দেখে আসা যায় কাছাকাছি এসব জায়গাও ৷ তবে বাসে বাসে ঘুরে দেখতে চাইলে যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে হাতে সময় থাকা চাই কয়েকটা দিন ৷ দুদিক দিয়ে ওঠা যায় অযোধ্যা পাহাড়ে ৷ পুবদিক থেকে পথ এসেছে সিরকাবাদ হয়ে ৷ আর পশ্চিমে পথ এসেছে বাগমুণ্ডি থেকে ৷ পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন বিকেল তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ পথিক আর তুষার নামে দুটো বাস যায় সিরকাবাদ হয়ে অযোধ্যা পাহাড় ৷ পৌঁছতে সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক ৷ দুটো বাসই রাতে পাহাড়ে থেকে পরদিন সকালে সাড়ে সাতটা থেকে নটার মধ্যে রওনা হয়ে ফিরে আসে সিরকাবাদ দিয়েই পুরুলিয়াতে ৷ বাগমুণ্ডির দিক দিয়ে পাহাড়ে বাস সার্ভিস নেই ৷ তবে পুরুলিয়া থেকে বলরামপুর হয়ে বাগমুণ্ডি যাচ্ছে বাস দুই-আড়াই ঘণ্টায় ৷ সেখান থেকে হাঁটাপথে বা জিপ ভাড়া করে ১৪ কিলোমিটার পথে উঠে আসা যায় পাহাড়ে ৷
কলকাতা থেকে সাউথ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাস ছাড়া কয়েকটা প্রাইভেট বাস যাচ্ছে সারা রাতের জার্নিতে পুরুলিয়া ৷ তবে হাওড়া থেকে রাতের ট্রেন আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারই সুবিধাজনক ৷ সেই ট্রেনে পুরুলিয়া বা আরও এগিয়ে বলরামপুরে নেমে বাস ধরে চলে আসা যায় বাগমুণ্ডি ৷ বাগমুণ্ডি থেকে পাহাড়ে উঠতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে জিপ ভাড়া করা যায় ৷ ৪৫০-৫০০ টাকায় বলরামপুর থেকেই জিপ নিয়ে নিলে আসার পথে দেখে নেওয়া যায় পাখি পাহাড় আর চড়িদা গ্রাম ৷ বাসে এলে বলরামপুর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ভুচুংডি মোড়ে নেমে হেঁটে পাখি পাহাড় দেখে ভুচুংডি থেকে ৩ কিলোমিটার এগিয়ে মাঠা বনবাংলোতে এক রাত থেকে যেতে পারলে ভালো হয় ৷ মাঠা পাহাড়ের ওপরে উঠতে চাইলে আরও এক রাত থেকে যেতে হতে পারে ৷ পরদিন সকালে বাগমুণ্ডি ছাড়িয়ে চড়িদায় নেমে মুখোশ শিল্প দেখে আবার বাগমুণ্ডিতে এসে যাওয়া যায় অযোধ্যা পাহাড়ে ৷
বাগমুণ্ডির ১ কিলোমিটার আগে অযোধ্যা মোড় থেকে সেচ বাংলো পার হয়ে পথ চলেছে পাহাড়ের দিকে ৷ কিশোরভারতী আশ্রম-বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে প্রোজেক্ট এরিয়ার মধ্য দিয়ে পাহাড়ে চড়া শুরু ৷ নিচে দেখা যায় পাহাড়-ঘেরা টুরগা ড্যাম ৷ তারপর পথের পাশে তুন্ড্রা ঝরনা ৷ আরও দেড় কিলোমিটার পরে পথের ডানদিকে নেমে বামনি ঝরনা ৷ ঝরনার আগে ওয়াচ টাওয়ারও হয়েছে সেখানে ৷ অযোধ্যার ২ কিলোমিটার আগে জামঘটুতে রেশম চাষ হচ্ছে ৷ চলার পথে দেখে নেওয়া যায় সেই সেরিকালচার ফার্মও ৷ আর তারপর অযোধ্যায় রাত কাটিয়ে সকালের বাস ধরে সিরকাবাদ হয়ে ফিরে আসা যায় পুরুলিয়ায় ৷
পুরুলিয়া থেকে সরাসরি কলকাতা ফেরার ট্রেন আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার বা সাউথ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাস, প্রাইভেট বাস, সবই ছাড়ে রাতে ৷ দিনেরবেলা ট্রেন বদল করে দুর্গাপুর, বর্ধমান হয়ে ফিরে আসা যেতে পারে সেই রাতেই ৷ বাস বদল করে করে বাঁকুড়া, দুর্গাপুর হয়েও আসা যায় ৷ একই যাত্রায় জুড়ে নেওয়া যেতে পারে বাঁকুড়ার খাতরা থেকে ঝিলিমিলি হয়ে মুকুটমণিপুর ভ্রমণও ৷
অথবা যাওয়ার সময় সিরকাবাদ দিয়ে পাহাড়ে উঠে ফেরা যায় বাগমুণ্ডি হয়েও ৷ পুরুলিয়া থেকে সে পথে বাস যাচ্ছে বিকেলে ৷ জিপ ভাড়া করা যায় শ-চারেক টাকায় ৷ সেক্ষেত্রে সঙ্গে মালপত্র কম থাকলে ফেরার সময় পায়ে হেঁটে বাগমুণ্ডি নেমে আসা যায় শর্টকাটে ঘণ্টা দুয়েকে ৷ পথ দেখানোর জন্য গাইড পাওয়া যায় অযোধ্যা পাহাড়ে ৪০-৫০ টাকায় ৷ এর আগে ময়ূর পাহাড়, চাডড়ি পাহাড় বেড়াবার জন্য গাইড নিয়ে থাকলে, ফেরার জন্য বলে রাখা যায় তাকেই ৷ শর্টকাটে বাগমুণ্ডি চলার সময় সে দেখিয়ে দেবে সীতার বুরবুরি, শালগাছে সীতার চুল, বনবাসকালে সীতা বিশ্রাম নিয়েছিলেন যে পাথরে বসে, আর সীতার তৃষ্ণা মেটাতে তীর মেরে ভূমিভেদ করে রামচন্দ্র যেখানে জল বের করেছিলেন, সেই সীতাকুণ্ড ৷ তারপর আরও এগিয়ে বামনি আর তুন্ড্রা ঝরনা ৷ কিন্তু ঝরনায় বেশিক্ষণ সময় কাটানো উচিত হবে না, কারণ বাগমুণ্ডি থেকে পুরুলিয়া ফেরার বাস কমে যেতে থাকে দুপুরের পর থেকে ৷ সকাল থেকে বারোটা পর্যন্ত মোটামুটি ৪০ মিনিট পর পর পাওয়া যায় বাস ৷ শেষ বাস যায় সাধারণত বিকেল চারটে নাগাদ ৷ ফেরার পথে হাওড়া আসার জন্য আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ধরা যেতে পারে বলরামপুর থেকে ৷ সুইসা গিয়ে ধরা যেতে পারে রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস ৷ অথবা বলরামপুর থেকে ট্রেনে বা বাসে জামসেদপুর গিয়ে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া ফিরে আসা যেতে পারে সেই রাতেই ৷
থাকার জায়গা
ট্যুরিস্ট হস্টেল
ট্যুরিজম সেন্টার, ৩/২, বি বা দী বাগ, কলকাতা-৭০০ ০০১
%২২৪৮-৮২৭১
নীহারিকা লজে (পুলিশ ক্যাম্পের পাশে) স্পট বুকিং হয় ৷ যোগাযোগ:
প্রোজেক্ট ডাইরেক্টর, ডব্লু বি সি এ ডি সি
অযোধ্যা হিলস প্রোজেক্ট, ভিলেজ ১
পোস্ট: অযোধ্যা, ডিস্ট্রিক্ট: পুরুলিয়া
অথবা,
৬এ, রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যার, কলকাতা-৭০০ ০১৩
কৃত্তিবাস মাহাতোর আশ্রমে ৪টে ঘরে ১৫টা বাঙ্ক আছে (নির্দিষ্ট ভাড়া নেই ৷ স্বেচ্ছায় আশ্রমে কিছু দান করা নিয়ম) ৷
ভ্রমণ জানুয়ারি, ১৯৯৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন