অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
শিলংয়ে বদলি হয়ে এসে পর্যন্ত বারবার শুনেছি বালফাক্রামকে নিয়ে নানা উপাখ্যান, লোককথা আর অতুলনীয়প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ৷ এখন একটা বিশাল ঢেউ খেলানো মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি ৷ দম বন্ধ করে দেখছিলাম ৷ প্রায় দু-হাজার ফুটের খাড়া দেওয়াল সোজা নেমে গেছে মহাদেও নদীর খাতে ৷ লক্ষ করলে দেখা যায় দূরে একপাল হাতি ঘন জঙ্গলের মধ্যে চরে বেড়াচ্ছে ৷ বাঁদিকটায় গাঢ় সবুজের ক্যানভাসে সাদা ফিতের মতো একটা জলপ্রপাত ফেনা ছিটিয়ে পেঁজা মেঘের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ৷ ওপারের খাড়া পাহাড় ক্রমশ উঠে গেছে কৈলাস বা চুৎমাং শিখরের দিকে ৷
১৯৮৭ সালে এই বালফাক্রাম জঙ্গলকে জাতীয় উদ্যানের আখ্যা দেওয়ার পরও প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটকদের তেমন টানতে পারেনি ৷ প্রথমত প্রচারের অভাব তাছাড়া মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের দক্ষিণপ্রান্তে বাংলাদেশের গা ঘেঁসা এই জায়গাটার দুর্গমতা ৷ অবশ্য জাপানের এক টি ভি সংস্থা এই মহাদেও নদীর খাড়া গভীর গিরিখাতকে নাম দিয়ে গেছে দি মিনি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ৷ এখানকার ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, গাছপালা আর বন্যপ্রাণীর অতুলনীয় বৈচিত্র্য ভারতবর্ষের আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ ৷ আর আদিবাসী অধ্যুষিত এই জঙ্গলের গাছ-পাথর-নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন লোকগাথা ৷
শিলং থেকে নেমে সারারাত বাস চলেছে আসামের কালি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এ টি রোড ধরে ৷ সমতল রাস্তা ছেড়ে পশ্চিমমুখী বাসটা আবার বাঁদিকের পাহাড়ি রাস্তায় মোড় নেবার পর পুবদিকটা চাপা লাল হয়েছিল ৷ গৌহাটি থেকে ছেড়ে আসা অনেকগুলো নাইট সার্ভিস বাসও প্রায় একসঙ্গেই এসে পৌঁছে গেল পশ্চিম গারো পাহাড়ের ছোট্ট শহর তুরায় ৷ এখনও তেমন গোছানো জেল্লা নেই ৷ সবেমাত্র কয়েকটা চার-পাঁচতলা বাড়ি ৷ দু-তিনটে হোটেল, একটা সদ্য বানানো সুপারমার্কেট, একপাশে বাসস্ট্যান্ড, পোস্ট অফিস আর হাসপাতাল ৷ সেই অনেক দূরে পাহাড় শেষে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে বাংলাদেশ ৷ উল্টোদিকে খাড়া উঁচু নকরেক পাহাড়চুড়োয় দুয়েক টুকরো সাদা মেঘ তখন কালচে সবুজ জঙ্গলে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ৷
একটু খাটো কিন্তু মজবুত চেহারার এই গারো আদিবাসীরা কোনও এক অজানা কালে তিব্বত থেকে আসাম পেরিয়ে এসে বেছে নিয়েছিল এই মালভূমির আবাস ৷ মাতৃতান্ত্রিক সমাজের মহিলারা এখনও ধরে রেখেছে এদের নিজস্ব সাজ ৷ তাঁতে বোনা উজ্জ্বল রঙের একটা লুঙ্গির ওপরে একটা ব্লাউজের মতো জামা ৷ আর সময় বিশেষে একটা সুন্দর ওড়না বা চাদর ৷
দু-তিন দিনের মতো খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে পরদিন ভোর ছটার বাঘমারা যাবার সরকারি বাসটায় আমরাই একমাত্র পর্যটক দল ৷ গারো পাহাড়ের শীতঘুম ভেঙেছে সবে ৷ মার্চ মাসের মাঝামাঝি, ঝিরঝিরে হাওয়ায় এখন লাট্টু-পাইনের কোঁড় উড়ে আসে ৷ গারোরা অনেকেই বাংলা বলতে পারে ৷ এমনকী মিশ্র সংসার পাতানোও নতুন কিছু নয় ৷ গারোদের গ্রাম মেঘালয়ের পাহাড় ছাড়িয়ে উত্তরে আসাম আর দক্ষিণে বাংলাদেশের মধ্যেও বিস্তৃত ছিল ৷
দক্ষিণ-পশ্চিমমুখো একটা ঢালু রাস্তায় হুড়মুড় করে নেমে চলেছে বাসটা ৷ পাঁচমিশালি গাছের জঙ্গল আর মাঝে মাঝে ঝকঝকে বাঁশের বাড়ির কয়েকটা গ্রাম পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রায় সমতলে ৷ ঘণ্টাতিনেক পর বারেংগাপাড়ায় কিছুক্ষণ জলখাবারের বিরতি ৷ এদিকটায় অল্প সংখ্যায় রাভা ও কোচ আদিবাসীও চোখে পড়ে ৷ তবে মহিলাদের পোশাকের রকমফের দিয়ে তফাত বুঝে নিতে হবে ৷ তারপর বাসটা সোজা বাংলাদেশ সীমানার ধার দিয়ে পুবদিকে বাঁক নিল ৷ রাস্তার ডান পাশে ছোট ছোট সিমেন্টের পিরামিডের সারি ৷ এপারে ভারত ওপারে বাংলাদেশ ৷ মাঝখানের অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা ভেঙে হাল চালায় চাষীরা ৷ মাঝেমাঝে বি এস এফ পোস্ট ৷ ওদের কাজটা বড় কঠিন ৷ একটা হাঁড়ি থেকে আতপ আর সেদ্ধ চালের ভাত আলাদা করার মতো ৷ সবচেয়ে মুশকিল কাজ দলছুট গরুদের পাসপোর্ট চেক করা ৷
আবার পাহাড়ি রাস্তা ৷ এবারে বেশ সুন্দর জঙ্গল আর ছোট ছোট নদী ৷ বাসটা একদম নদীর ধার ঘেঁসে বাঘমারা বাজারে এসে দাঁড়াল ৷ আগাম পাঠানো টেলিগ্রাম নিরুদ্দেশ হলেও এস ডি এম সাহেবের সহৃদয়তায় ঘর মিলল এখানকার একমাত্র পর্যটকনিবাস সার্কিট হাউসে ৷ এই রাস্তায় এ বাংলোয় এক রাত না কাটালে যাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে ৷ রেশন পাওয়া যাবে বাঘমারা বাজারে ৷ সবচেয়ে জরুরি হল বালফাক্রাম জাতীয় উদ্যানের ছাড়পত্র নিতে হবে বাঘমারার ডি এফ ও (ওয়াইল্ড লাইফ) অফিস থেকে ৷
সার্কিট হাউসের দক্ষিণের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে দেখি সিমসাং নদীর দৃশ্য ৷ একটু পরেই বাংলাদেশে পৌঁছে নদীর নাম হয়ে যায় সোমেশ্বরী ৷ গারো পাহাড়ের জল এখান দিয়ে ময়মনসিংহে যায় ৷
পরদিন সার্কিট হাউসের নিচে নতুন ব্রিজটার মুখে বাসের প্রতীক্ষা শেষ হল, বেলা তখন একটা ৷ তুরা থেকে আসছে মহেশখোলার বাস ৷ মাঝপথে সিট পাবার আশা কম ৷ বাজারে গিয়ে বসার জন্য টিকিট কাটাও যায় ৷ নদী পেরিয়ে বাসটা আবার পাহাড়ে উঠল ৷ তখন ডানদিকের জানলায় চোখ জুড়নো বাংলাদেশের দৃশ্য ৷ কদিন আগে বৃষ্টি হয়েছে ৷ চুনাপাথরের ঢালে তাই রাস্তা যেন লাঙলচষা ৷ দম ফেলতে বাস দাঁড়াল রংরা গ্রামে নদীর ধারে, প্রায় ঘণ্টাদেড়েক চলার পর ৷ চায়ের দোকানে আলাপ হল মহম্মদ আনসারির সঙ্গে ৷ গত ত্রিশ বছর এখানে আছেন, তখন বাস রাস্তা ছিল না ৷ ওঁর জঙ্গলের নেশা থেকে পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিভিন্ন চিড়িয়াখানা আর সার্কাসে জীবজন্তু বিক্রি করা ৷ এখন একটা কবিরাজি গাছগাছড়ার দোকান দিয়েছেন রংরায় ৷
আবার চলা শুরু ৷ জঙ্গল আরও আদিম হয়েছে ৷ বাসের গতি আরও মন্থর ৷ দিনের আলোও কমে এসেছে ৷ দুপাশের ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে দলবদ্ধ উল্লুকের মাতামাতি শোনা যায় ৷ কানাই নদীর ছোট্ট কাঠের ব্রিজটা পেরোতে পেরোতে অন্ধকার হয়ে এল ৷ একটু পরে বাস আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল বিশাল এক বাঁশ জঙ্গলের ধারে ৷ বাঁদিকে একটা বোর্ড-বালফাক্রামে স্বাগত ৷ সঙ্গে সাবধান বাণী বৈদ্যুতিক তারের বেড়ার জন্য ৷ মহাদেও গ্রাম এখান থেকে আরও দু কিলোমিটার ৷ ফরেস্ট গেট দিয়ে ঢালু রাস্তার ধার দিয়ে কিছুটা হাঁটতেই রেঞ্জারের অফিস ৷ পারমিট দেখে চৌকিদার ছোট একটা বাংলো খুলে দিল ৷ বৈদ্যুতিক বেড়া দেওয়া নিরাপদ আশ্রয় ৷ তবে বাংলোতে জল ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই ৷ চৌকিদারের তৎপরতায় মাত্র ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই কয়েক বালতি জল ও গরম ভাত পাওয়া গেল ৷ রেঞ্জারবাবু পরদিন ভোরবেলায় আমাদের জঙ্গল অভিযানের সব ব্যবস্থা পাকা করলেন ৷ একজন বন্দুকধারী ফরেস্ট গার্ড থাকবেন সঙ্গে ৷ প্রধানত হাতিদের গুণ্ডামিতে এখানে সবাই তটস্থ ৷ কাছাকাছি একটা বড় হাতির দল ঘোরাঘুরি করছে ৷ জঙ্গলে বোধহয় জলের অভাব হয়েছে ওদের ৷ ভাগ্য ভালো, খ্যাপা হাতিটা এখন এদিকটায় নেই ৷
প্রায় দুশো কুড়ি বর্গকিলোমিটার জুড়ে থাকা এই জাতীয় উদ্যানের বিচিত্র এবং অসংখ্য বাসিন্দাদের সবার পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি ৷ প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী প্রায় দুশো চল্লিশ ধরনের গাছপালা চেনা গিয়েছে যার মধ্যে অনেকগুলোই দুষ্প্রাপ্য এবং ওষধিগুণসম্পন্ন ৷ দক্ষিণের সমতল থেকে খাড়া উঠে যাওয়া পাঁচিলের ওপর এই মালভূমির মাথাটা দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আঠেরোশো ফুট উঁচুতে ৷ প্রায় সমতল মালভূমির মাথায় ঘাস আর গুল্মই বেশি ৷ আর গভীর গিরিখাতগুলোর মধ্যে দুর্ভেদ্য রেন ফরেস্ট ৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত অঞ্চলের (মৌসিনরাম মাত্র শখানেক কিলোমিটার পুবে) অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছে ছ-সাত প্রজাতির ক্যাট ফ্যামিলির সদস্যরা ৷ ডোরাকাটা বাঘ থেকে ক্লাউডেড লেপার্ড পর্যন্ত ৷ এছাড়া লালপান্ডা সমেত প্রায় চল্লিশ জাতের স্তন্যপায়ীর দেখা পাওয়া যায় ৷ আরও আছে দশ-বারো রকমের সরীসৃপ এবং প্রায় ৯০ ধরনের পাখি ৷
রাতে বাংলোর বাগানে দাঁড়িয়ে টের পেলাম সামনে মহাদেও গ্রামে ঝুম খেতের আগুন আর জ্বলন্ত বাঁশের কটকাট আওয়াজ ৷
ভোর হল ৷ তখনও বেশ ঠান্ডা ৷ ক্যামেরা, সারাদিনের খাবার ও জলের বোতল নিয়ে দোনলা বন্দুকধারী বীরেন্দ্র সাংমার সঙ্গে চললাম জঙ্গলে ৷ কুয়াশার মধ্যেও পথের ওপর দেখা যায় বন্যপ্রাণীর সারিবদ্ধ পায়ের ছাপ ৷ হাতি, বাঘ, জংলী কুকুর, ভালুক, হরিণের পায়ের ছাপ নজরে পড়ল ৷ একটা বুনো শুয়োরও একপাশ দিয়ে হেঁটে গেছে ৷ বীরেন্দ্র এমনভাবে বোঝাচ্ছিল যেন ও সবাইকেই চেনে ৷ এ জায়গাটা এদের রোজকার যাতায়াতের পথ ৷ আবার ঠিক সন্ধ্যার মুখে এ পথ দিয়েই ওরা ফিরে যাবে যে যার আস্তানায় ৷ একজোড়া বনমোরগ আর একদল উল্লুক আমাদের এই প্রাতঃকালীন অনুপ্রবেশ লক্ষ করছিল ৷ ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর গার্ড দেখাল হাতিরা কীভাবে এই শুখা মরসুমে পাইপলাইন ভেঙে নিজেদের জলের ব্যবস্থা করে নিয়েছে ৷ সমস্ত অঞ্চলটায় তাই মানুষের জন্য জল সরবরাহ বন্ধ ৷ আরও ঘণ্টাখানেক পরে বেশ চড়াই উতরাই আরম্ভ হল ৷ এখানে জঙ্গল বেশ গভীর ৷ একসারি চুনাপাথরের গুহার চারপাশটা কীরকম অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ৷ এখানটা সাপেদের পাড়া ৷ শেষ চড়াইটুকু ভাঙতে ভাঙতে সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপর ৷ একটা সুন্দর সোনালি হনুমান একলাফে রাস্তা পেরোল ৷ এবার একটা গুহা বেশ বড়, দরকার হলে ওখানে রাত কাটানো যায়, বাইসন আর হাতিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আস্তানাও বটে ৷
বেলা প্রায় বারোটা ৷ এগারো কিলোমিটার হেঁটে এখন প্রায় মালভূমির মাথায় ৷ অনেকটা সমান জায়গা ৷ এখানেই হেলিপ্যাড বানানো হয়েছিল এই জাতীয় উদ্যানের উদ্বোধনের সময় ৷ হাতিরা চারপাশের বেড়া ভেঙে ফেলেছে অনেকদিন ৷ হেলিপ্যাডের উত্তরপ্রান্তে হঠাৎ মাঠটা শেষ ৷ নিচে প্রায় দুহাজার ফুটের ক্যানিয়ন বা গিরিখাত ৷ বীরেন্দ্র একটা পতঙ্গভোজী কলসপত্র গাছ এনে দেখাল ৷ লম্বাটে সবুজ কলসের মধ্যে কিছুটা জলের মতো পদার্থ ৷ কয়েকটা ছোট পোকার গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়েছে তাতেই ৷ এখানকার গ্রামবাসীরা ওই জলটুকু ওষুধ হিসাবে খায় ৷
আরও তিন-চার কিলোমিটার হাঁটলে চুৎমাং শিখরের কাছে মহাদেও নদীর উৎস ৷ এখানকার কোনও একটা গুহায় রাত কাটিয়ে পরদিন আরও ২০ কিলোমিটার হাঁটলে বালফাক্রামের অন্যপ্রান্তে পৌঁছনো যাবে ৷ সেখানে সিজুগ্রামে আছে গারো পাহাড়ের অন্যতম বড় একটি গুহা ৷ তবে ওই পথে উপযুক্ত পাথেয় এবং পথপ্রদর্শক সঙ্গে থাকা জরুরি ৷
খোলা জায়গাটার চারদিকে নানান বিচিত্র চেহারার পাথর ছড়িয়ে আছে ৷ কত অজানা ঘাসফুল দিয়ে সাজানো এই প্রাকৃতিক সংগ্রহশালা ৷ পাশের ক্যানিয়নের ভেতর থেকে শনশনে হাওয়া উঠে আসছে থেকে থেকে ৷ বীরেন্দ্র সাংমা তখন একটা বড় পাথরের সামনে হাত জোড় করে প্রার্থনা করছে ৷ পাশে বন্দুকটা শোয়ানো ৷ আমার কাছে এসে গভীর বিশ্বাস আর ভক্তি নিয়ে বলল, এই সেই হাওয়া -যার নাম বালফাক্রাম ৷
এই অদ্ভুত নামটা এসেছে দুটি গারো শব্দ থেকে ৷ বালোরা বা হাওয়া যেখানে অহরহ বয়ে যায় বা ফাক্রাম ৷ স্থানীয় বিশ্বাস এই হাওয়ার উৎপত্তি অসংখ্য আত্মার শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে ৷ গারোদের প্রাচীন লোককথা অনুযায়ী সমস্ত গারো মানুষকেই মৃত্যুর পর এই বালফাক্রামে অশরীরী হয়ে কাটাতে হয় কিছুদিন ৷ তাই এই জায়গাটা হল আসলে থেমাং আসেং অর্থাৎ আত্মার আবাসস্থল ৷ বিধির বিধান শোনার জন্য আত্মারা অপেক্ষা করে মিট্টে আদালতের আশপাশে ৷ প্রত্যেক আত্মাকেই এখানে আসবার সময় একটা করে স্বাস্থ্যবান গরু নিয়ে আসতে হয় বিচারকদের দক্ষিণা হিসেবে ৷ সেইসব গরু বাঁধা থাকে সামনের ওই বোলডাক গাছটার গোড়ায় ৷
অশরীরীদের এই ট্রানজিট ক্যাম্পে ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি নেই ৷ আছে দু-দুটো বাজার ৷ যাবতীয় মুদিখানার দ্রব্যাদি পাওয়া যায় থেমাং আন্তেতে ৷ আর একপাশে মাংসের বাজার মাচরু নি নিকেল ৷ দিশি সুরা তৈরি হয় একটা বিরাট চ্যাপ্টা পাথরের পাত্রে ৷ ভাটিখানার মালিকের নাম গিটিং ৷ তার একটা ছোট চায়ের দোকান আছে ৷ এমনকী প্রেতাত্মাদের মধ্যাহ্নভোজের জন্যও একটা বিশাল পাথরের টেবিল রাখা আছে ৷ আজও গারো চাষীদের কাছে থেবিট থেবা বা প্রেতাত্মার শস্যভাণ্ডার নামক একটা বিশাল পাথর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ৷ এই পাথরটার কোনদিক থেকে দানা খসে পড়ছে সেটা দেখে তারা বুঝে যায় সেই বছরে কোনদিকের গ্রামগুলোতে ভালো ফসল হবে ৷ এছাড়া অবিবাহিত এবং বিবাহিত আত্মাদের থাকার জন্য আলাদা পান্থশালা আছে ৷ আছে প্রয়োজনীয় জলের ব্যবস্থাও ৷ অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ সবকিছুই নানারকম পাথর, গাছপালা ইত্যাদির চেহারায় গারোদের প্রাচীন লোকগাথার মধ্যে রয়ে গেছে আজও ৷
কয়েকজন বিশিষ্ট আত্মা এই বালফাক্রামের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য চিরকালের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রয়ে গেছেন ৷ এঁদের মধ্যে সুপরিচিত এবং ত্রিকালদর্শী বীর যোদ্ধা দিক্কির নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে নেওয়া হয় ৷ দিক্কি মশাই তাঁর বৃদ্ধ মামা মাচরু এবং ছোট ভাই বান্দিকে নিয়ে বেশ রসেবশেই দিন কাটান ৷ গারো পাহাড়ের সর্বকালের সেরা দুই সুন্দরী সোরে এবং গিটিং দুই ভাইয়ের দুই উপপত্নী ৷ এদের রূপে-রসে-লাস্যে সারা বালফাক্রাম মেতে থাকে ৷
গার্ড সাংমা বেশ রসিয়ে গল্প করে এইসব অলৌকিক দ্রষ্টব্য দেখিয়ে দিচ্ছিল একে একে ৷ নিজে খ্রিস্টান হলেও এই প্রাচীন লোক সংস্কৃতিতে তার বিশ্বাস বেশ গভীর ৷ এই মার্চ-এপ্রিল মাসে শ্রীমান দিক্কির দেখা পাওয়া যায় পুরো বালফাক্রাম পাহাড়ে, সে এখন অপূর্ব সুন্দর এক ফুল হয়ে ফুটে আছে ৷ পালকের তৈরি ঝাড়নের মতো একটা ডাঁটাসমেত ফুল সোজা মাটি ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে শয়ে শয়ে ৷ প্রায় দেড়ফুট লম্বা ফুলগুলোর নিচের পাপড়ি নীলচে-লাল বর্ণ নিয়েছে ৷
চুনাপাথরের স্তর দিয়ে গড়া এই মালভূমির পাথরগুলি আবহাওয়াজনিত কারণে নানা বিচিত্র আকার নিয়েছে ৷ সহস্র বছরের লোকশ্রুতি আর বিশ্বাস প্রকৃতির এই বহুমূল্য শিল্পকলাকে আজও নষ্ট হতে দেয়নি ৷
সবসমেত প্রায় ১৬ কিলোমিটার হাঁটার পর ছোট্ট পুষ্করিণী চিদিমাকের স্বচ্ছ কালো জলে প্রকৃতির প্রহরী সেইসব মহান আত্মাদের অভিনন্দন জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম অন্য এক অনুভূতি নিয়ে ৷
গুয়াহাটি অথবা শিলং থেকে বাসে তুরা ৷ সরকারি ও বেসরকারি নানা শ্রেণীর বাসে অগ্রিম বুকিং পাওয়া যায় ৷ শুধুমাত্র গুয়াহাটি থেকে দিনেরবেলায়ও বাস চলে ৷ জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের অনুমতির জন্য যোগাযোগের ঠিকানা:
Chief Conservator of Forests
Meghalaya Forest Department, PO-Tura, Dist: West Garo Hills
এবং
DFO (Wild Life), Balpakram , PO-Baghmara, Dist -South Garo Hills, Meghalaya
প্রবেশমূল্য ২০ টাকা, স্থির ক্যামেরা ২৫ টাকা ৷
বাঘমারার সার্কিট হাউসে থাকতে চাইলে যোগাযোগ করুন:
Deputy Commissioner, Baghmara, Dist: South Garo Hills, Meghalaya.
ভাড়া ৪০ টাকা প্রতিশয্যা ৷
বেড়াবার সেরা সময় বর্ষাকাল বাদ দিয়ে নভেম্বর থেকে মার্চ ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন