ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার

জন্মেছিলাম উত্তর বাংলায়, বড় হয়েছি জলপাইগুড়ি শহরে ৷ কলেজে পড়ার সময় যখন জেলাটাকে চষে ফেলেছি তখন কোথাও রাত কাটাবার কথা হলে খোঁজ নিতাম পরিচিত কেউ আছেন কিনা ৷ না থাকলে পি ডাব্লু ডি বা ফরেস্ট বাংলোয় চলে যেতাম ৷ সাঁইত্রিশ বছর আগে ওই সব বাংলোয় গেলে দেখা যেত ঘর খালি পড়ে আছে ৷ ওপরে দুটো শোবার ঘর নিচে খাওয়া বসার জায়গা ৷ ভাড়া ঘরপিছু পাঁচ টাকা ৷ সর্বত্র যে এইসব বাংলো ছিল তা নয় কিন্তু উত্তর বাংলায়, শিলিগুড়িকে বাদ দিলে কোথাও রাত কাটাবার জন্য ভালো বা অল্প ভালো হোটেল ছিল না ৷ দার্জিলিংকে আমরা উত্তর বাংলার মধ্যে ধরতাম না ৷ কারণ তিনধারিয়াতে গেলেই যাঁদের দেখতে পেতাম তাঁদের সঙ্গে আমাদের কোনও মিল খুঁজে পেতাম না ৷

খোদ জলপাইগুড়ি শহরে তখন হোটেল বলতে ছিল দুটো, ওয়েসিস আর রুবি বোর্ডিং ৷ ওয়েসিসকে হোটেল বলতে অস্বস্তি হত, রুবি বোর্ডিং ছিল মধ্য বা নিম্নবিত্তের একমাত্র থাকার জায়গা ৷ পরে আরও কয়েকটি হোটেল হয়েছে কিন্তু তাদের শ্রীহীন চেহারা বড় বেদনাদায়ক ৷ খোদ শহরের যখন এই অবস্থা তখন ধুপগুড়ি ময়নাগুড়ি গয়েরকাটার অবস্থা কী তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে ৷

এর অন্যতম কারণ তখন জলপাইগুড়ি জেলা বা ডুয়ার্সে কোনও ট্যুরিস্ট হুট করে আসতেন না ৷ আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থাকলে তাঁদের দেখা যেত ৷ কলকাতার মানুষ শিলিগুড়ি হয়ে চলে যেতেন দার্জিলিং কালিম্পংয়ে ৷ গ্যাংটকের আকর্ষণ বেড়েছে বছর কুড়ি আগে ৷ শুধু প্রচারের অভাবে ডুয়ার্স এবং জলপাইগুড়ি ছিল অন্ধকারে ৷

তখন জলপাইগুড়ি শহরের গায়ে তিস্তা নদী প্রবল বেগে বয়ে যেত ৷ তার ওপর কোনও সেতু তৈরি হয়নি ৷ প্রতিবছর বন্যার সঙ্গে আমরা বন্ধুত্ব করতাম ৷ বর্ষায় তিস্তার মাইলখানেক দূরত্ব পারাপার করতে হত নৌকায় চেপে ৷ সমস্ত ডুয়ার্সের যাবতীয় বাস এসে দাঁড়াত দোমহনিতে, জলপাইগুড়ির উল্টোদিকে তিস্তার পাড়ে ৷ প্রচুর মানুষ নানান কারণে নৌকায় চেপে শহরে এসে সাততাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে সন্ধের মধ্যেই নদী পেরিয়ে আবার ওইসব বাসে উঠে পড়তেন ৷ শহরে থাকার সমস্যাটা এড়িয়ে যেতেন তাঁরা ৷ শীত পড়তে বালির চর জেগে উঠত মাঝে মাঝে ৷ সেখানে ছুটত পক্ষীরাজ ট্যাক্সি যার হর্নের প্রয়োজন হত না ৷ সেই সময় আমরা ডুয়ার্স দেখতে যেতাম ৷

দোমহনি থেকে প্রথমেই ময়নাগুড়িতে ৷ এখানে রাস্তা দুটো দিকে গেছে ৷ একটা লাটাগুড়ি হয়ে চালসা, দ্বিতীয়টা ধুপগুড়ি হয়ে গয়েরকাটা বীরপাড়া ৷ ময়নাগুড়ি মূলত গঞ্জ এলাকা ছিল ৷ নানা রকম ফসল বিক্রি হত ৷ গয়েরকাটার সতীমাস্টার ময়নাগুড়িতে চলে এসে বাচ্চাদের নিয়ে নানান কাণ্ড করেছিলেন ৷ সুকান্তর কবিতা থেকে ব্রতচারী, নাটক, কী না! আমরা চলে যেতাম লাটাগুড়ি ৷ কোনও যানবাহন নেই, হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গরুমারা ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছে যেতাম ৷ কেউ তেমন যায় না তাই কোনও কড়াকড়ি বা আইন ছিল না ৷ বাংলোটা কাঠের, পাশে কর্মচারীদের আস্তানা ৷ কিন্তু জঙ্গল ছিল ঘন ৷ হাঁটার সময় বুক ঢিপ ঢিপ করত ৷ মানুষের অস্তিত্ব যেহেতু নেই বললেই চলে তাই হাজারও নাম না-জানা পাখির গলা শোনা যেত ৷ দিনদুপুরে বাইসনের ঝাঁক দেখেছি নিচের তৃণভূমিতে ৷ হাতির জন্য আটকে গিয়ে লাটাগুড়ি ফিরেছি সন্ধে পেরিয়ে, যখন শেষ বাস চলে গিয়েছে ৷ ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই দেখে সরকারি অফিসের বারান্দায় রাত কাটিয়েছি মুড়ি খেয়ে ৷ ভাতের হোটেল ছিল না ৷

ময়নাগুড়ি থেকে অন্য রাস্তাটি ধরে কিছুদূর গেলেই ডানদিকের একটা রাস্তা ধরলে পৌঁছে যেতাম জল্পেশ মন্দিরে ৷ ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আচমকা এই শিবের মন্দিরের বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো ৷ অনেকে মনে করেন জলপাইগুড়ির নামকরণ এই জল্পেশ মন্দিরের জন্যই ৷ শিবচতুর্দশীর সময় জল্পেশের ওই নির্জনে লক্ষ লোকের মেলা বসে ৷ ওই মেলায় রাত কাটানোর বাসনা আমার পূর্ণ হয়নি ৷ তিস্তায় নৌকা পারাপার বন্ধ হওয়ার আগেই ফিরে আসা বাধ্যতামূলক ছিল ৷ পরে যখন স্বাধীনতা এল তখন মন থেকে ওই উত্তেজনা উধাও ৷

ময়নাগুড়ি ছাড়িয়ে মিনিট কুড়ি বাসযাত্রায় ধুপগুড়ি পৌঁছনো ৷ ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি ধুপগুড়িতে বিশাল হাট বসে ৷ রাজবংশী অধ্যুষিত এই এলাকার যাবতীয় ফসল তো বটেই শীতকালে কমলালেবুর পাহাড় তৈরি হয় দোকানে দোকানে ৷ তখন সেই ষাট সালে এক টাকায় আশিটা লেবু পাওয়া যেত ৷ দরদস্তুর হত ওই আশির হিসাবে ৷

ধুপগুড়ি ছাড়িয়ে মাইল চারেক গেলেই শুধু প্রকৃতি নয় মানুষও বদলে যেত এবং এখনও যায় ৷ দুপাশের চাষের খেতের বদলে সবুজ চায়ের বাগান, তার শেডট্রি চোখের আরাম এনে দেবে ৷ রাজবংশীদের বদলে মদেশিয়া ওঁরাও শ্রমিকদের এলাকা শুরু ৷ ডুয়ার্সের চা-বাগানের প্রথম বাগান এই রাস্তায় হল গয়েরকাটা ৷

গয়েরকাটায় ঢোকার আগেই জঙ্গল এবং চা-বাগানের মধ্যে বয়ে যাওয়া ডুডুয়া নদীর দুপাশের নিসর্গ আজও ভুলতে পারি না ৷ গয়েরকাটার শরীর জড়িয়ে বয়ে যাওয়া আংরাভাসা যার শুরু চিমাগুড়ি থেকে শেষ ডুডুয়ার বুকে, তা আমার কাছে স্বপ্নের নদী ৷ মাঝে মাঝে কোমর ছুঁলেও হাঁটুজলের ওই নদীকে দেখলেই আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে বলে মনে হত ৷ মদেশিয়া মেয়েরা তাদের সায়ার ওপর যে কালো কাপড়টি জড়িয়ে রাখত তাকে বলত আংরা ৷ নদী পার হওয়ার সময় সেই আংরার প্রান্ত জলের ওপর ভেসে থাকত বলেই বোধহয় নাম হয়েছিল আংরাভাসা ৷

গয়েরকাটার দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে খুঁটিমারির জঙ্গল ৷ তখন ছিল কাজ চলে যাওয়ার মতো একটা কাঠের বাংলো ৷ লোকজন কালেভদ্রে যেত ৷ আর একটু দূরে নাথুয়া ৷ এই নাথুয়ার কাছে ডায়না নদী আর জলঢাকার মিলন হয়েছে, যেখানে দাঁড়ালে পৃথিবীতে চিরকাল থেকে যেতে ইচ্ছে করবে ৷

গয়েরকাটা চৌমাথা থেকে একটা রাস্তা গেছে বানারহাট ছাড়িয়ে ভুটানের সামচির দিকে, অন্যটি বীরপাড়া হয়ে আলিপুরদুয়ার অথবা হাসিমারার দিকে ৷ ওই রাস্তার একপাশে জলদাপাড়া অভয়ারণ্য সে সময় মোটেই প্রচারিত নয় ৷ হাসিমারা হয়ে ফুন্টশোলিং যেত খুব কম মানুষ ৷ হাসিমারা থেকে জয়ন্তীতে যাওয়া যেত ৷ জয়ন্তীকে পশ্চিমবাংলার অন্যতম সুন্দর জায়গা বললে ভুল বলা হবে না ৷ আগে আলিপুরদুয়ার থেকে বক্সাদুয়ার হয়ে জয়ন্তীতে যাওয়ার একটা ট্রেন লাইন ছিল ৷ এখন নেই ৷ জয়ন্তী নদীর চেহারা যথেষ্ট বুনো ৷ ওপাশে ডলোমাইটের পাহাড় ৷ নির্জনতম সৌন্দর্য কাকে বলে তা এখানে এসে বোঝা যায় ৷ এক সময় ইংরেজরা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের ধরে বক্সার দুর্গে এনে রাখত ৷ জয়ন্তীর কাছেই বিখ্যাত মহাকালের মন্দির ৷ পাথর আর পাথর দিয়ে তৈরি রাস্তায় হাঁটলে শুধু পাহাড়ি নদীর গর্জন শোনা যাবে ৷ ছয়-সাতবার নদী পেরিয়ে দুর্গম রাস্তায় হেঁটে শেষপর্যন্ত পৌঁছতাম মহাকালের মন্দিরে ৷ অনেক উঁচুতে সেই গুহার অবস্থান ৷ মাথার ওপরে মহাকালের জটার মতো পাক খাওয়া পাথর ৷ পাশেই সিঁড়ি ৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠে গুহার মধ্যে ঢুকতে হয় মহাকাল দর্শনের জন্য ৷

মহাকালের মন্দিরের কথা মনে আসতেই মনে এল মাকড়াপাড়ার কাকিবাড়ির কথা ৷ ভুটান সীমান্তের গভীর অরণ্যের ভেতর এই মন্দিরটি ৷ এখানে যেতে হয় রামঝোরা চা-বাগান হয়ে ৷

জলপাইগুড়িতে চা-বাগানের পত্তন করেন ব্রুহাম নামক এক ইংরেজ ৷ সেটা আঠারোশো চুয়াত্তর সাল ৷ তার পঁয়ত্রিশ বছর আগে আসামে চা-বাগানের শুরু ৷ জলপাইগুড়িতে দেরি হওয়ার কারণ এখানকার ডুয়ার্স তখন ছিল ভুটান রাজার অধীনে ৷ অজস্র জঙ্গল আর নদীঘেরা ওই অঞ্চলে বর্ষাকালে যাওয়া অসম্ভব মনে হত ৷ ইংরেজ পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন, ‘জায়গাটা এত দরিদ্র যে ওটাকে জয় করার কোনও প্রয়োজন নেই ৷ তাছাড়া জয় করলেও শাসন করা যাবে কিনা সন্দেহ ৷’ তবু আঠারোশো চৌষট্টি সালে ভুটানরাজকে হারিয়ে ইংরেজরা ডুয়ার্সের মালিকানা পায় ৷ তার পাঁচ বছর পরে জলপাইগুড়ি জেলার পত্তন হয় ৷ কিন্তু চা-বাগানে শ্রমিকের কাজ করার জন্য কৃষিজীবী রাজবংশীরা এগিয়ে এলেন না ৷ ফলে আড়কাটির হাত ধরে ছোটনাগপুরের দরিদ্র মানুষেরা চলে এল ডুয়ার্সে ভাগ্যান্বেষণে ৷ আজ তারাই সংখ্যায় লক্ষ লক্ষ ৷ ইংরেজরা অবশ্য তাদের খ্রিস্টান না করে চাকরি দেয়নি ৷

তরুণ বয়সে জলপাইগুড়ির আনাচকানাচে ঘুরে বেড়ানো একটা নেশার মতো ছিল ৷ থাকার জায়গা একটা পেলেই তো হয়ে গেল ৷ সেই সময় ডুয়ার্সের স্থানীয় মানুষ রাজবংশীদের কিছু দেবদেবীর কথা জেনেছিলাম ৷ যেটুকু মনে আছে তাতে দশজন লৌকিক দেবদেবীর নাম মনে পড়ছে ৷ বিষ্টু ঠাকুর (বৈশাখ এবং ভাদ্রমাসে পুজো হয়), বিষহরি ঠাকুরানী, বর্ষা ঠাকুর (আগুনের দেবতা), বপন ঠাকুর (ঝড়জলের দেবতা), বসুমতী ঠাকুর (সন্তুষ্ট হলে দুর্ভিক্ষ হবে না), চণ্ডী ঠাকুর (কলেরা হবে না), মহাকল ঠাকুর (হিংস্র জন্তুর হাত থেকে রক্ষা করেন), কালী ঠাকুরানী, গ্রামঠাকুর, ধরমঠাকুর ৷ মুশকিল হল এই বিরাট জনগোষ্ঠী থাকত অনেক নম্রভাবে ৷ তাদের সঙ্গে মদেশিয়ারা দূরের কথা পূর্ব বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বাঙালিদের সম্পর্ক আমাদের তরুণ বয়স পর্যন্ত তৈরি হয়নি ৷ হ্যাঁ, তবে রায়কত বা প্রদ্যোত বর্মণের মতো সঙ্গীতে পণ্ডিত মানুষের কথা আলাদা অথবা উপেন্দ্র বর্মণের মতো মানুষের সংখ্যা খুব কম ৷ এর পরিণতি যে কোনদিকে এগোল তা সত্তর সাল পর্যন্ত কেউ চিন্তা করেনি ৷

তিস্তা নদীর ওপর তৃতীয় সেতু তৈরি হয়ে গেল ৷ প্রথমটি যদি তিস্তাবাজারে ধরা হয়, দ্বিতীয়টা সেবকে, তৃতীয়টি জলপাইগুড়ি শহরের পাশে ৷ সেতু চালু হতেই সেই পক্ষীরাজ ট্যাক্সি যেমন উধাও তেমনই নৌকাগুলোও যে কোথায় চলে গেল!

গত মাসে জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলাম ৷ দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে কলকাতায় রয়েছি ৷ বছরে এক-আধবার মায়ের কাছে যাই, শহরের বাইরে যাওয়া যায় না ৷ এবার ইচ্ছে হল ছেলেবেলার সেই জায়গাগুলো দেখে আসার ৷

প্রথমে শহরটা ৷ দেখা গেল রুবি বোর্ডিং আছে এবং তার চেহারা একটু আধুনিক হয়েছে ৷ তবে তা মীর্জাপুর স্ট্রীটের হোটেলগুলোর মতো ৷ ওয়েসিস উঠে গেছে ৷ কদমতকার মোড়ের আশপাশে কয়েকটা হোটেল হলেও তার মান বেশ সাধারণ ৷ অথচ জলপাইগুড়িতে অনেক লড়াইয়ের পরে হাইকোর্টের ডিভিশনাল বেঞ্চ বসছে ৷ হৈ হৈ ব্যাপার ৷ কিন্তু কোনও মাঝারি মানের হোটেল নেই? বন্ধুরা বললেন, তিস্তাভবনের গেস্টহাউস বা সার্কিট হাউস ছাড়া রাজবাড়ির রাস্তায় একটা চমৎকার হোটেল হয়েছে ৷ হোটেল না বলে পর্যটননিবাস বলাই ভালো ৷ গিয়ে দেখলাম কথাটা সত্যি ৷ এখনও শহরের হোটেলে দুশো টাকায় ঘর পাওয়া গেলেও এখানে সাত-আটশো থেকে বারোশো, ব্যবস্থাও টাকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছে ৷ এককালে ভাবতেই পারতাম না ৷ তিস্তা সেতু পেরিয়ে কিছুটা যেতেই গাড়ি বাঁদিকের রাস্তা ধরল ৷ শুনলাম লাটাগুড়িতে যাওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছে ময়নাগুড়িকে এড়িয়ে ৷ মনে পড়ল দোমহনি থেকে ট্রেন যেত ৷ ড্রাইভার জানাল এখনও যায় ৷ একটি কামরাকে টেনে নিয়ে যায় ইঞ্জিন, দিনে দুবার ৷ স্টেশন মাস্টার বাকিটা সময় অন্য কাজ করেন ৷ দোমহনি থেকে মালবাজার সেই ট্রেন যায় বনজঙ্গল পেরিয়ে ৷ যাত্রীদের প্রয়োজন হলে ড্রাইভার দয়া করে ট্রেন থামিয়ে দেন ৷ এরকম যাত্রা বেশ লোভনীয় ৷

রাস্তার স্বাস্থ্য বেশ ভালো ৷ আমরা লাটাগুড়িতে চলে এলাম ৷ জানলাম হুটহাট জঙ্গলে ঢোকা যাবে না ৷ বনবিভাগের অনুমতিপত্র দরকার ৷ এটি আগে ছিল না ৷ মুড়ি খেয়ে এখানেই একদা রাত কাটিয়েছিলাম বারান্দায় শুয়ে, এখন দেখতে পাচ্ছি ট্যুরিস্টদের জন্য কয়েকটা প্রাইভেট হোটেল হয়েছে ৷ অনুমতিপত্র নিয়ে গরুমারা ফরেস্টে ঢুকতে গিয়েই চেকপোস্টের মুখোমুখি ৷ ছাড় মিলতে জঙ্গলে ঢুকলাম ৷ কীরকম ফাঁকা ফাঁকা লাগল ৷ সেইসব পাখিদের অনেকের গলাই পেলাম না ৷ গরুমারা বাংলোটি এখন যথেষ্ট সাজানো ৷ সামনের তৃণভূমিও বেশ চোখ টানে ৷ চমৎকার জায়গা ৷ কিন্তু এখন বোধহয় বনজপ্রাণীদের দেখতে ধৈর্যের দরকার হবে ৷ সময় বড় নিষ্ঠুর ৷

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আরেকটু এগোতেই ডানদিকের রাস্তায় ঢুকল গাড়ি ৷ জঙ্গুলে এলাকার পর গ্রাম ৷ গ্রামের শেষে জঙ্গলের মুখেই বাঁদিকে সেই বাংলোটি ৷ এর বয়স খুব বেশি নয় ৷ আমাদের দেখার সময় তো অস্তিত্বই ছিল না ৷ মূর্তি নদীর গায়ে এমন সুন্দর দোতলা এবং বিশাল বাংলো, পাশে হনিমুন কটেজের সারি দেখে সত্যি মুগ্ধ হলাম ৷ বাংলোর পিছনে বাঁক নিয়ে তীব্র স্রোতের মূর্তি নদী বয়ে যাচ্ছে ৷ পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি ৷ এত নরম অনুভূতি কোথাও হয়নি ৷ বাংলোয় থাকার ভাড়াও যথেষ্ট বেশি ৷ নিশ্চয়ই কারণ আছে ৷ এ সি রুম পাওয়া যাচ্ছে, এ তো আমার কল্পনার বাইরে ৷

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে চলে আসতেই জানলাম আধা পাহাড়ের ওপরে সিনক্লেয়ার গোষ্ঠী রিসর্ট করেছে ৷ গিয়ে দেখলাম অত্যাধুনিক ব্যবস্থা ৷ সামনের পৃথিবীটা এখানে পায়ের নিচে, রিসর্টের চার্জ বড় হোটেলের সঙ্গে তুলনীয় ৷ কিন্তু তাই বলে ঘর খালি থাকে না ৷

শুনলাম এই বেল্টটায় এখন প্রায়ই শ্যুটিং হয় ৷ তার দৌলতে স্থানীয় মানুষ জয়া বচ্চন, মিঠুন চক্রবতী এবং অপর্ণা সেনকে দেখেছে ৷ তাঁদের তোলা ছবিতে নিসর্গ দেখে বহু লোক চলে আসছেন এদিকে ৷ ট্যুরিস্টদের সংখ্যা যত বাড়ছে তত ব্যবসার গন্ধ পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা ৷ ভালো থাকা এবং খাওয়ার বদলে টাকা দিতে কেউ পিছপা নন ৷ এই পরিবর্তনের হাওয়া এখন সারা ডুয়ার্সে ৷ রাতটা কোথায় কাটাব তা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে না ৷ ঘুরতে ঘুরতে নাথুয়ার রাস্তায় গিয়ে দেখলাম খুঁটিমারি জঙ্গলের সেই বাংলোটার চেহারাও বদলে গেছে ৷ এক বুক বাগান নিয়ে আধুনিক আরামের ব্যবস্থা সেখানে ৷ নাথুয়ায় পৌঁছে ডায়না আর জলঢাকার মিলনস্থলে গিয়ে দেখলাম আমাদের সেই অভিজ্ঞতার কোনও বদল হয়নি ৷ না হোটেল না বাংলো ৷ চোখের আড়ালে যেসব সৌন্দর্য এখনও ডুয়ার্সে পড়ে আছে তা চোখের সামনে আসা উচিত ৷

এ ব্যাপারে জলপাইগুড়ির জেলা সমাহর্তা সুব্রত গুপ্ত সচেষ্ট ৷ যদি কাজ করতে চাওয়া ছেলের দল একত্রিত হয়ে নির্জনে মোটেল বানাতে আগ্রহী হয় তিনি তাদের সাহায্য করবেন ৷ আমার বিশ্বাস ডুয়ার্সে মোটেল ব্যবসা খুব সফল হবে ৷

মহাভারতের আমলে ডুয়ার্স ছিল পাণ্ডববর্জিত ৷ অর্জুন মণিপুরে গিয়েছিলেন কিন্তু এখানে আসেননি ৷ ইংরেজ শাসনের আদিপর্বে ডুয়ার্স ছিল ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর এবং হিংস্র জন্তুর এলাকা ৷ আর এখন শুধু চা-বাগান নয়, প্রকৃতি তার অঢেল সম্পদ নিয়ে যেন এতকাল পর্দানসীন ছিল, এবার পর্দা খসিয়ে বাইরে পা দিয়েছে দর্শকদের অপেক্ষায় ৷

ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০২

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন