অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
ওদেশি বান্টু ভাষায় মোসি-ওয়া-তানিয়া ৷ শব্দটির অর্থ হল স্মোক দ্যাট থান্ডারস, বজ্র আরাবী ধূম্রপুঞ্জ ৷ অখ্যাত-নামা কোন সে কবি, কবে এই অত্যন্ত সমীচীন নামটি রেখেছিলেন-তার খবর আজ কেউ রাখে না ৷ তাই, বাকি পৃথিবীতে জাম্বেজি জলপ্রপাতের ভয়াল মহিমা পরিচিত হল অন্য এক নামে, সে নাম তখনকার রীতি অনুযায়ী লিভিং স্টোন দিয়েছিলেন তদানীন্তন ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার নামে ৷
মিশনারি পরিব্রাজক লিভিং স্টোনের মনে দুটি সাধ ছিল ৷ এক, আফ্রিকার ধর্মহীন (লিভিং স্টোনের মতে) মানুষগুলোকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করবেন ৷ দুই, নীলনদের উৎস খুঁজে বার করবেন ৷ দুটোর কোনওটাই মেটেনি ৷ সুদীর্ঘ কর্মজীবনে মাত্র একজন নেটিভকে তিনি নিজধর্মে দীক্ষিত করতে পেরেছিলেন ৷ এই লোকটি ছিল তাঁর খাস নফর ৷ এবং তাঁর মৃত্যুর পরেই নফরটি তার নিজধর্মে ফিরে যায় ৷ আর নীলনদের উৎস তাঁকে বারবার বিভ্রান্ত করে ৷ আসল উৎসে তিনি পৌঁছতে পারেননি ৷ তবুও জলপ্রপাতে নিবদ্ধ দৃষ্টি লিভিং স্টোনের সুবিশাল ব্রোঞ্জ মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে মনে হয় যে ওই অবিশ্রান্ত প্রবহমান জলধারার অবিরাম বজ্র নির্ঘোষে, ঊর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত শীকরকণায় প্রতিফলিত রামধনুতে তিনি তাঁর আবিষ্কারক জীবনের অন্যতম সার্থকতা লাভ করেছিলেন ৷
নায়াগ্রায় জলপ্রবাহ ভিক্টোরিয়া ফলস থেকে পাঁচগুণ বেশি ৷ ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সীমান্তে ইগুয়াসু ফলস বিস্তৃতিতে প্রায় তিনগুণ ৷ কিন্তু পতনের গভীরতায় এবং অবিচ্ছিন্ন ধারার প্রস্থে এরা কেউই ভিক্টোরিয়া ফলসের ধারে কাছে পৌঁছতে পারে না ৷ নাতিপ্রশস্ত খাদের এপারে দাঁড়িয়ে, ওপারের ১.৭ কিলোমিটার চওড়া মুক্তধারার ৯০ থেকে ১০৭ মিটার খাড়া পাহাড়ের নিচে লাফিয়ে পড়া দেখতে দেখতে মনে হয় যে, এ গম্ভীর সৌন্দর্য পৃথিবীতে অতুলনীয় ৷ ভাসারির বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে: সৌন্দর্য তাকেই বলব, যাতে কিছু যোগ করাও যায় না বা যা থেকে কিছু বাদ দেওয়াও চলে না ৷
উনিশ শতকের শেষ থেকেই ভিক্টোরিয়া ফলস-এ পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয় ৷ প্রথম স্যুভেনিরের দোকান খোলে ১৯০৩ সালে ৷ প্রায় সেই সময়েই এখানে বেড়াতে এসেছিলেন সম্রাট সপ্তম এডোয়ার্ড ৷ তাঁর জন্য ফলসের ধার ঘেঁসে তৈরি হয়েছিল সুবিখ্যাত ভিক্টোরিয়া ফলস হোটেল ৷ হোটেলটি আজও ভিক্টোরিয়া ফলস শহরের মধ্যমণি ৷ সুদূর কেপটাউন থেকে দু রাত তিনদিন ধরে ব্লু ট্রেন এসে থামত হোটেলের লাগোয়া স্টেশনে ৷ হোটেল থেকে ফলস পর্যন্ত ৩০০ মিটারের মতো রাস্তা হেঁটে যেতে রাজন্যবর্গের কষ্ট হবে বলে আলাদা একটি সরু রেললাইন বসানো হয়েছিল ৷ এই লাইনটি এখন নেই কিন্তু তার বদলে বড় লাইনের ট্রেনে চড়ে জাম্বেজির খাদ পেরিয়ে ওপারে জাম্বিয়া ঘুরে আসতে পারেন ৷ ওপারে প্রথম শহর এবং স্টেশনের নামও লিভিং স্টোন ৷ ১০ কিলোমিটারের মতো রাস্তা ৷
অধুনা আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্বে এবং উড়োজাহাজের উৎপাতে সেকালের নিয়মিত ব্লু ট্রেন বন্ধ হয়ে গেছে ৷ তবে লাইন পাতা আছে এবং তার ওপর দিয়ে অন্য লোকাল ট্রেন এবং মালগাড়ি যাতায়াত করে ৷ আর, কখনও কখনও ভ্রমণরসিকেরা কেপটাউন থেকে পুরো একটা ব্লু ট্রেন ভাড়া করে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখতে আসেন ৷
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কয়েকটি ট্যুরিস্ট বাস ছাড়া এখন প্রায় সব পর্যটকই উড়ে আসেন ৷ তবে এঁদের পর্যটক না বলে দর্শক বলাই ভালো ৷ মেয়াদ একদিন, বড় জোর দুদিন ৷ এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল ৷ সেইদিন সকালেই তিনি অকল্যান্ড থেকে উড়ে এসেছেন ৷ সন্ধ্যাবেলা অন্য প্লেন ধরে ইজিপ্টে আসোয়ানের পথে পাড়ি দেবেন ৷ লক্ষ আবু সিম্বেলের মন্দির ৷ আমরা হোয়াঙ্গো ন্যাশনাল পার্ক থেকে ৩৫ মিনিট উড়ে ভিক্টোরিয়া ফলস পৌঁছলাম এক দুপুরবেলায় ৷ আমাদের সময় তৃতীয়দিনের বিকেল পর্যন্ত ৷ এয়ারপোর্টের কোলাহল ছাড়িয়ে বেরোতেই কানে এল প্রত্যাশিত গুম গুম আওয়াজ ৷ গাছপালার আড়াল ফুঁড়ে চোখে পড়ল সেই বিখ্যাত পালকের ঝাড়, যেন আকাশের মেঘ নারদমুনির জটাজালের মতো চূড়ার আকৃতিতে মাটিতে নেমে এসেছে ৷ আসলে মেঘ নিচে নেমে আসেনি ৷ বরং প্রপাতের তলা থেকে জলকণাবাহী বাতাস মেঘের মতো আকাশে উঠে গেছে ৷ এই অদ্ভুত দর্শন মেঘ উচ্চতায় প্রায় ৫০০ মিটার ৷ ৬০ কিলোমিটার দূর থেকে এটা চোখে পড়ে ৷
আমাদের হোটেল ইলালা লজ, এয়ারপোর্ট থেকে পাঁচ-ছ কিলোমিটার ৷ প্রপাতের নিকটতম হোটেল এটা, যদিও গাছের বেড়া থাকার দরুন প্রপাত এখান থেকে দেখা যায় না ৷ হোটেলের পিছনে সবুজ লন-তার ওপারে ফুলের কেয়ারি, গুল্ম ঝোপের বেষ্টনী ৷ হোটেল চৌহদ্দির পরেই মুক্তভূমি ৷ ওদেশি ভাষায় বুশ ল্যান্ড, জাম্বেজি ন্যাশনাল পার্কের শুরু ৷ রিসেপশন থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে সারি সারি একতলার ঘর ৷ তার একটা আমাদের ৷ ঘরের পিছন দিকটা পুরো কাচের, ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর মতো ৷ এক পাল্লা স্লাইডিং দরজা খুলতেই লন-এ এসে দাঁড়ালাম ৷ তার আগে, স্নানাগারের দরজায় বিজ্ঞপ্তি দেখেছি:
স্লাইডিং দরজা সর্বদা বন্ধ রাখবেন ৷ বেবুনরা অত্যন্ত অনুসন্ধিৎসু প্রাণী ৷ আপনার অনুপস্থিতিতে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র তো হাঁটকাবেই -এমনকী ঘড়ি ক্যামেরা প্রভৃতি মহার্ঘ জিনিস চিবিয়ে দেখতে পারে ৷
স্লাইডিং দরজা টেনে দিয়ে একটা চেয়ার পেতে বসলাম ৷ প্রথমে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে এল একটা ওয়ার্ট হগ ৷ শুয়োরের মতো দেখতে এবং প্রায় ওই সাইজেরই জানোয়ার ৷ কেবল মুখটা একটু চ্যাটালো ৷ দুই কষে দুটি দাঁত বেরিয়ে আছে ৷ সারা মুখ ভর্তি বড় বড় আঁচিলের মতো ৷ কুৎসিত জন্তুটা হোঁদল কুতকুত-এর মতো মিষ্টি ৷ সে একটা চক্কর দিয়ে বেরিয়ে গেল, ঢুকল গোটা দুই বেজি ৷ সুট সাট করে এ কোণ ও কোণ দেখে, গোটা দুই ডিগবাজি খেয়ে তারা পালাল ৷ এবার বেবুনরা ৷ বাবা, কয়েকটি মা, কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে একটা দঙ্গল ৷ ওরা বেশ জম্পেশ হয়ে বসল ৷ এ গাছের পাতা, ও গাছের কুলের মতো ছোট ছোট ফল, মাটিতে কয়েকটা পোকামাকড়-মুখ চলছে তো চলছেই ৷ এছাড়া নানা রকমের পাখির কিচির মিচির তো আছেই ৷ ঘরে বসেই বেশ সময় কাটছিল কিন্তু ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি, আর দেরি করা যায় না ৷ তিনটের সময় ট্যুর কোম্পানির লোক আসবে আমাদের জাম্বেজি সানডাউনার ক্রুইজে নিয়ে যাবার জন্য ৷
এ হোটেল সে হোটেল থেকে যাত্রী তুলতে তুলতে নদীর ধারে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় পৌনে চারটে ৷ প্রপাতের কয়েক কিলোমিটার আগে কূলে কূলে ভরা জাম্বেজি এখানে প্রায় তিন কিলোমিটার চওড়া ৷ নদীর মধ্যে বড় বড় চর মাথা তুলেছে-আগাছা জঙ্গলে ভর্তি ৷ মানুষের বসতি নেই ৷ এপার ঘেঁসা চরগুলি জিম্বাবোয়ের, ওপারের চরের মালিকানা জাম্বিয়ার ৷ নদীর জলে গায়ে গা লাগিয়ে পাঁচ-ছটা মোটরলঞ্চ বাঁধা ৷ আকারে মোটামুটি এক ৷ কমবেশি বারো মিটার লম্বা, চার মিটার চওড়া-চ্যাপ্টা গোছের খোল যাতে অল্প জলে চলতে পারে ৷ জনা চল্লিশ যাত্রী নেয় ৷ মাল্লা লস্কর নিয়ে আরও পাঁচ-ছজন ৷ ওপরে ছাদ আছে বটে কিন্তু তার সব দিক খোলা, রেলিং দিয়ে ঘেরা ৷ একতলা লঞ্চের সব দিকেই অতিথিদের বসবার জায়গা, কেবল সামনে একটু জায়গা পাইলটের এবং পিছনে কয়েকটি সিন্দুক নিয়ে পানীয়ের বন্দোবস্ত ৷ লঞ্চের মাঝখানে দুটো টেবিলে সাজানো নানা রকম টুকটাক খাবার ৷ ইঞ্জিনটাকে ওরা খোলের ভেতর চাপা দিয়ে রেখেছে ৷
এতক্ষণে নৌকা বেশ ভরে উঠেছে ৷ পাঁচমিশালি দল ৷ তরুণ-তরুণী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত সব বয়সের এবং নানা দেশের লোক আছে ৷ পাঁচ-ছজনের একটা ছোট্ট দলকে মনে হল যে ওরা সবে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে ৷ ওদের প্রতাপ সকলের চেয়ে বেশি ৷ হাসি গল্প গান চেঁচামেচিতে স্টিমারের একটা কোণ মাতিয়ে রেখেছে ৷ কৃষ্ণকায় বলতে আমরা দুটি প্রাণী ৷ এ বদর বদরের দেশ নয় ৷ নদীতে ঝড় তুফানের ভয়ও নেই ৷ ঠং ঠং করে একটানা ঘণ্টা বাজল, দুজন মাল্লা কাছির বেড় খুলে স্টিমারে লাফিয়ে পড়লেন ৷ স্টিমার বুড়বুড়ি কেটে পিছু হটতে লাগল ৷ মোটামুটি পঞ্চাশ গজ ৷ তারপরই মুখ ঘুরিয়ে নাক বরাবর এগিয়ে চলল-এপারে জিম্বাবোয়ের কূল ঘেঁসে ৷ নদীর কিনারায় দুশো কোটি বছরের পুরনো লাভা ব্যাসাল্টের অগ্ন্যুৎগার, জলজ শৈবাল লতা গুল্মের আস্তরণে নিবিড় সবুজ, কিছুটা তৃণভূমি ৷ সেখান থেকে চোখ তুললেই, আকাশছেঁায়া বনস্পতির পাহারা ৷ নদীর জলধারায় এবং জলপ্রপাতের উৎক্ষিপ্ত জলকণায় এই লাভা ব্যাসাল্ট আগ্নেয় পাথরে খরার রাজ্যে একটি রেন ফরেস্ট গড়ে উঠেছে-ডুমুর, মেহগনি, মিল্কউড, এবোনি, ডেটপাম সুবিশাল মহীরুহ শ্রেণীর মাথায় মাথায় লিয়ানা, ল্যান্টানা লতাগ্রন্থীর জটাজাল ৷ নিচে ঝোপঝাড়, বাঁশ, ম্যানগ্রোভ -দিনমানেও অন্ধকার ৷ বনের প্রসার হয়তো নদীর ধারে ধারে এক বা দুই কিলোমিটার কিন্তু ভেতরে ঢুকে পড়লে মনে হবে দিকহারা কঙ্গোর বেসিনে ঘুরে বেড়াচ্ছি ৷ জন্তু-জানোয়ারও অঢেল ৷ হাতি, চিতা, মোষ, বেবুন তো আছেই, সিংহও কখনও কখনও এসে পড়ে ৷ এছাড়া নানা রকমের হরিণ, হায়না, বাঁদর, খেঁকশিয়ালের ছড়াছড়ি ৷ আর আছে নদীর জলে-ডাঙায় মুক্তদন্ত কুমিরের দল ৷
এতক্ষণে লঞ্চের ভেতরে হাসি গল্প গান আড্ডা জমে উঠেছে ৷ পিছনের দিকে ফটাফট বোতল খোলা হচ্ছে ৷ হাতে হাতে পানীয় সরবরাহ করছেন মাল্লার দল ৷ জিন বিয়ার অরেঞ্জ কোক যার যা চাই ৷ কোনও কার্পণ্য নেই -একটা গ্লাস খালি হতে না হতে, আরেকটি এসে যাচ্ছে ৷ পানীয়ের দাম টিকিটের সঙ্গেই ধরা আছে ৷ তারপর কে একটা পেল আর কে তিনটে পেল তার হিসেব আবার কে করে ৷ লঞ্চ অন্য পারে লিভিং স্টোন দ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে মাঝ নদীতে এসে পড়ল ৷ হঠাৎ সবাই হুড়মুড় করে একদিকে ভিড়ল ৷ কী, না-তিনটে জলহস্তী সন্ধ্যার ঝোঁকে নদী ছেড়ে হেলতে দুলতে ডাঙায় উঠল ৷ এখন সারা রাত ওরা চরের ঘাস গাছপালা খাবে ৷ ওপারে জাম্বিয়ার তটরেখায় তিনটে হাতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে জল খাচ্ছে, তার অনেকটা পিছনে পটে আঁকা ছবির মতো একটি জিরাফের কৌতূহলী উৎকণ্ঠিত মুখ, গ্রীবাভঙ্গি ৷ পানীয়ের সঙ্গে খাদ্যেরও সদ্ব্যবহার হচ্ছে ৷ বেশ জমে উঠেছে পার্টি ৷ চারদিকে নদীর জলে আরও অনেক স্টিমার, লঞ্চ, নৌকা ৷ একতলা দুতলা ৷ কখনও কখনও বাক্য ছোড়াছুড়ি, কুশল বিনিময়ও হচ্ছে ৷ বেপরোয়া একটা স্পিডবোট, সকলের পাশ দিয়ে এবং পাশ কাটিয়ে গোঁ করে বেরিয়ে গেল ৷ উন্মুক্ত দেহ ছেলেটির দৃঢ়বদ্ধ হাতে স্টীয়ারিং, মেয়েটি এবং তার চুল ছেলেটির গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে ৷
এবার ফেরার পালা ৷ মাঝ দরিয়ায় ঘুরে বোট মন্থর গতিতে চলেছে ৷ নিচে জলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি ৷ হৈ হুল্লোড় স্তিমিত ৷ পিছনে সমস্ত আকাশ জুড়ে সূর্য ডুবছে ৷ নিরক্ষরেখাস্থিত আফ্রিকার সন্ধ্যাকাশে উজ্জ্বল বলিষ্ঠ তুলির আঁচড়ে যে রং ফুটে ওঠে পৃথিবীতে কোথাও বুঝি তার তুলনা নেই ৷ আকাশের আলো দ্রুত কমে আসছে ৷ মনে হয় কেউ যেন স্লাইডিং সুইচ ঘুরিয়ে হাজার বাতির প্রভা কমিয়ে আনছে ৷ মৃদু থেকে মৃদুতর ৷ তবু আকাশে এখনও পাখিরা উড়ে যাচ্ছে নিজ নিজ আশ্রয়ে আর জলের ভেতর থেকে চলন্ত লাল পাথরের ঢিপির মতো জলহস্তীরা ডাঙায় উঠে আসছে ৷ জ্বলন্ত লোহার ভাঁটার মতো সূর্য নেমে এসেছে অরণ্য রেখায়-সবুজ গাছের মাথায় লাল আলো ছড়িয়ে পড়ল ৷ সূর্য নেমে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে বনানীর গভীরে, তবু ডালপালা পাতার ফাঁক দিয়ে খণ্ড খণ্ড সূর্য দেখছি-তার দীপ্তিতে ওই দিকটা এখনও ঝলমল করছে ৷ বাকি সব অন্ধকার ৷ দূরে ভিক্টোরিয়া ফলস শহরের আলোগুলো জ্বলে উঠল ৷
রাতের খাওয়াটা বেশ মজার হল ৷ আমাদের হোটেল সদ্য একটা ওপেন এয়ার রেস্টুরেন্ট খুলেছে ৷ খোলা আকাশের তলায় ছাঁটা গাছের বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গাটিতে সারি সারি টেবিল চেয়ার পাতা এবং তারই একটা কোণে রান্নার বন্দোবস্ত ৷ পাঁচ ফুট ব্যাস এবং এক ইঞ্চি পুরু একটি তাওয়া গ্যাস রিং-এর ওপরে বসানো আছে ৷ গোল টুপি পরা পাচক কাঠের খুন্তি হাতে সেখানে তৈরি ৷ তাওয়া থেকে অল্প দূরে দুটি কোণের দেওয়াল ঘেঁসে সারি সারি দেরাজ, শেলফ, আলমারি -কিছু খোলা আবার কোনওটা কাচের ঢাকার ভেতর ঠান্ডা রাখা ৷ এইগুলি হল কাঁচা খাবারের আধার ৷ তার মধ্যে নেই এমন জিনিস নেই ৷ মাছ, মাংস, সবজি, ন্যুডলস, নানা রকমের শাক, চিনাদের তোফু, শামুক, গেঁড়ি, গুগলি, স্কুইড -মানে দস্তুরমতো একটা সুপার বাজার ৷ খরিদ্দারদের হাতে একটা করে প্লাস্টিকের ডাব্বা এবং তাঁরা ঘুরে ঘুরে তাঁদের পছন্দমতো খাদ্যসামগ্রী ডাব্বাজাত করছেন ৷ তারপর ভর্তি ডাব্বাটি তাওয়ার পাশে পাচকের হাতে দিয়ে নিজের টেবিলে গিয়ে বসতে পারেন বা দাঁড়িয়ে দেখতে পারেন পাচক কী করে ৷ পাচক পুরো ডাব্বাটি গরম তাওয়ার একপাশে ঢেলে কাঠের খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করবেন, কখনও বা টিপে দেখবেন কতদূর এগোল, এমন ছয়-আটটি ডাব্বার মাল তিনি তাওয়ার চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাকাচ্ছেন ৷ তৈরি হলে সেটি প্লেটে করে পরিবেশন করা অন্য লোকের কাজ ৷ ব্যাপারটা দেখতে বেশ জাঁকালো হলেও, খেতে অতটা ভালো লাগল না ৷ তবে সেটা মূলত আমার দোষ ৷ কিসের সঙ্গে কী যায় এবং কোন জিনিস কতক্ষণ তাওয়ায় থাকলে আমার ভালো লাগবে -এসব বিষয়ে কোনও জ্ঞান না থাকায় আমি ঠিকমতো জোগান দিতে পারিনি ৷ অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা দেখলাম অনেক বিবেচনা করে জিনিস ডাব্বায় তুলছেন এবং কোন জিনিস কতক্ষণ পাক হবে তা নিয়ে পাচকের সঙ্গে বিদগ্ধ আলোচনা করছেন ৷ তাঁরা নিশ্চয় ভালোই খেলেন ৷ এই রান্নাটি কিন্তু জিম্বাবোয়ের নিজস্ব নয় ৷ পরে কেউ কেউ বলেছেন যে পদ্ধতিটি মঙ্গোলিয়ার আমদানি ৷ নাম মঙ্গোলিয়ান হটপট ৷ কোথায় মঙ্গোলিয়া আর কোথায় জিম্বাবোয়ে ৷ পৃথিবী যদি কখনও এক হয় তো, খাদ্যসূত্রেই হতে পারবে ৷
পরদিন সকালে জলপ্রপাত দেখতে যাওয়া ৷ ব্রেকফাস্ট শেষ করে নটা নাগাদ গাইডের সঙ্গে বেরোলাম ৷ এ বেড়ানোটা পুরোপুরিই পায়ে হেঁটে এবং গাইড না নিলেও চলে ৷ তবে গাইড থাকলে সে অবশ্য-দ্রষ্টব্যগুলি সহজে দেখিয়ে দেয় এবং পথ থেকে বিপথে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি রাখে ৷ ট্যুর শুরু হয় আমাদের হোটেল থেকে ৩০০ মিটারের মতো দূরে লিভিং স্টোনের স্ট্যাচুর তলা থেকে ৷ উল্টোদিকে খাদের ওপারে ডেভিলস ক্যাটারাক্ট সতেরশো মিটার চওড়া প্রপাতের পশ্চিমদিক এবং প্রপাতের নিম্নতম অংশ-উচ্চতা মোটে ৭০ মিটার ৷ পুবদিক ঘেঁসে উচ্চতম অংশ রেনবো পয়েন্টে প্রপাতের জল ১০৮ মিটার নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ৷ ডেভিলস ক্যাটারাক্ট নিচু হলেও এখানে মস্ত সুবিধা এই যে লিভিং স্টোনের স্ট্যাচুর পাশ দিয়ে সরু পাকদণ্ডীর মতো সিঁড়ি বেয়ে খাদের ভেতরে অনেক দূর নিচে নেমে যাওয়া যায় এবং সেখান থেকে ওপরে তাকিয়ে সেই সুবিপুল জলস্রোতের অবিশ্রান্ত সংঘাত বুকের ধুকধুকি দিয়ে উপলব্ধি করা যায় ৷ ডেভিলস ক্যাটারাক্টের পাশেই লিভিং স্টোন আইল্যান্ড-এখানে দাঁড়িয়ে লিভিং স্টোন প্রথম এই প্রপাত দেখেন এবং একটা বুলেটে সুতো বেঁধে খাদের গভীরতা মাপেন ৷ গাইড বলল, বিকেলবেলা এখানে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় এপার ওপার রামধনু ফুটে থাকে ৷
খাদ থেকে উঠে এসে খাদের ধারে ধারে পুবমুখো এগনো ৷ ডানদিকে গাছপালা জঙ্গল মহীরুহের দল, বাঁদিকে ৩০ থেকে ৬০ মিটার চওড়া খাদের ওপারে জাম্বেজির বিপুল জলধারা কোথাও কাচের মতো স্বচ্ছ হয়ে, কোথাও সাদা ফেনায় টগবগ করে খাদের গভীরে লাফিয়ে পড়ছে ৷ তার অবিরাম বজ্রনির্ঘোষ আর ঝাপটা হাওয়ায় জলকণা এসে কাপড়চোপড় ভিজিয়ে দেয় ৷ গাইড বলল, তবু তো এখন এই অক্টোবর মাসে নদীতে জল অর্ধেকেরও কম ৷ মে-জুন মাসে এলে ওয়াটারপ্রুফে সারা অঙ্গ না মুড়ে এরাস্তা দিয়ে চলতে পারতেন না ৷ অবশ্য এক হিসাবে অক্টোবর-নভেম্বর ভালো ৷ মে-জুন মাসে-প্রপাতের ওপরের মেঘ এত গভীর হয় যে অনেক সময়ে খাদের এপার থেকে ওপারে প্রপাতটাই দেখা যায় না ৷
এপথের সব জায়গা থেকেই জলপ্রপাত দেখা যায় এবং তার শব্দ শোনা যায় ৷ তবু যাত্রীদের সুবিধার্থে এবং হয়তো বা তাদের বোঝানোর জন্য সারা পথে পনেরোটি পয়েন্ট চিহ্নিত করা আছে ৷ লিভিং স্টোন স্ট্যাচু এক নম্বর, সিঁড়ির তলায় দুই আর এই যেখান থেকে বিকেলে রামধনু দেখা যায় সেটি তিন নম্বর ৷ তারপর চার পাঁচ ছয় সাত এমন কিছু ব্যাপার নয় কিন্তু আট নম্বরে একটু ঘুরে দাঁড়াতে হবে ৷ প্রপাতের প্রধান ধারার মুখোমুখি ৷ মনে মনে হৃষীকেশ স্বর্গদ্বারের গঙ্গার কথা ভাবুন ৷ ওই রকম তোড়েই জলস্রোত বেরিয়ে আসছে ৷ কিন্তু ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে জল গড়িয়ে চলছে না ৷ পাহাড়ের মাথা থেকে সমস্তটা ঝাঁপিয়ে পড়ছে নব্বই মিটার গভীর খাদে ৷ আর সেই জলের ওপর সূর্যের আলোয় কত রঙের খেলা ৷ এরপর ওপারের পাহাড় অর্ধবৃত্তাকারে একটু ভেতরে ঢুকে গেছে ৷ ১৪ নম্বর পয়েন্ট থেকে দেখতে হয় জলধারার ঘোড়ার খুরের মতো আকৃতি ৷ এবং এখান থেকেই দেখা যায় প্রপাতের গভীরতম অংশে (১০৮ মিটার) এপার ওপার জোড়া বিরাট চওড়া রামধনু ৷ রেনবো ফলস ৷ প্রপাতের জিম্বাবোয়ে অংশ শেষ হয়ে আসছে ৷ ১৫ নম্বর পয়েন্ট থেকে দেখা যাবে জাম্বিয়ায় প্রপাতের বাকি অংশটা ৷ ইস্টার্ন ক্যাটারাক্ট ৷ তবে বছরের এ সময়ে ওখানে জল নেই ৷ খাড়া পাহাড় নিরম্বু দাঁড়িয়ে আছে ৷ ১৫ নম্বর পয়েন্টের পাশেই বিপজ্জনক কোণ ৷ এখানে পাহাড় একটু এগিয়ে গিয়ে খোলা রকের মতো হয়েছে ৷ রেলিংয়ের বন্দোবস্ত নেই ৷ এপাথর ওপাথর ধরে রকের প্রান্তে গিয়ে নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যেতে পারে ৷ ১০৫ মিটার নিচে সরু নির্গমনের পথে জাম্বেজির জল মাথা কুটছে, ফুটছে ৷ নাম ফুটন্ত কড়াই ৷
এইখানেই আমরা প্রপাত দর্শন শেষ করে হোটেলের পথ ধরলাম ৷ গেট দিয়ে বেরোবার আগে গাইড আমাদের দেখাল যে অনেক নিচে নদীখাতের একটা মোড়ের মাথায় সারি সারি খেলনার মতো হাওয়া ভরা রবারের ডিঙি সাজানো আছে ৷ ওইখান থেকেই শুরু হয় ভিক্টোরিয়া ফলসের বিখ্যাত হোয়াইট ওয়াটার র্যাফটিং ৷ দুঃসাহসীদের দল ওইসব ভেলায় চড়ে প্রপাতোত্তর জাম্বেজির আটটা খাদ এবং উনিশটা র্যাপিড পেরিয়ে ভীমবেগে চলে যায় আঠারো থেকে বাইশ কিলোমিটার রাস্তা -যেখানে নদী আবার শান্ত হয়েছে ৷ এদের সঙ্গে অবশ্য অভিজ্ঞ গাইড থাকে কিন্তু তবুও ভেবে দেখুন তো দুধারে খাড়া পাহাড়ের সংকীর্ণ গভীরে জলে পাথরে লুটোপুটি খেতে খেতে হৃৎপিণ্ড কখনও কখনও কি গলার কাছে উঠে আসে না! র্যাপিডগুলোর নামও বড় মজার ৷ টার্মিনেটার, ঘোস্ট রাইডার, কমার্শিয়াল সুইসাইড, ডিপ থ্রোট ইত্যাদি ৷ এদের মধ্যে ৯ নম্বর র্যাপিড কমার্শিয়াল সুইসাইড সকলের চেয়ে কঠিন ৷ কেউ কেউ নৌকা কাঁধে করে ঘুরে যান ৷ সকাল আটটা নাগাদ শুরু করে বিকেল চারটের মধ্যে র্যাফটিং শেষ হবে ৷ মাঝখানে ঘণ্টা দুই দ্বিপ্রাহরিক আহার ও বিশ্রাম নদীর কূলে বসে ৷ পথে একজন র্যাফট গাইডকে বললাম, যে বড় ইচ্ছে করছে তোমাদের ভেলায় চড়তে ৷ সে আমাকে এক নজর দেখে বলল, তোমাকে চড়তে দেবে না ৷ মানে, বুড়ো মেরে কে খুনের দায়ে পড়তে চায়? প্রপাতের গণ্ডির মধ্যে আমরা ঢুকেছিলাম লিভিং স্টোনের পাশ দিয়ে ৷ বেরোলাম অন্যদিকে, প্রায় এক কিলোমিটার দূরে-গাইড আমাদের নিয়ে গেল ফলস ক্র্যাফট ভিলেজ দেখাতে ৷
ব্রিটিশ সাহেব সিরিল ফরেস্ট জিম্বাবোয়ের সরকারি ভ্রমণ সংস্থা ইউ টি সির কর্তা ছিলেন ৷ সে হল ১৯৭০ সাল ৷ তখন থেকেই তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মেরী দুজন মিলে আঞ্চলিক গাইয়ে বাজিয়েদের জোগাড় করে লোকসঙ্গীত নৃত্যাদির অনুষ্ঠান করতেন ৷ কয়েক বছর পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আফ্রিকার লোককৃষ্টি কলার চর্চাতেই পুরোপুরি সময় দিলেন এবং সেই সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ফলস শহরের মধ্যে একটি আদর্শ গ্রাম গড়ে তুললেন যেখানে সাদা মানুষ আসার আগেকার গ্রাম্যজীবন দেখানো হবে ৷ পরিতাপের বিষয় এই যে গ্রামটি তৈরি করার সময়ে ১৯৮২ সালে ফরেস্ট সাহেব বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান ৷ কিন্তু স্ত্রী মেরী ফরেস্টের হাতে তাঁর সৃষ্টি বেঁচে আছে ৷ আমরা যখন গ্রামে পৌঁছলাম তখন বেলা এগারোটা বেজে গেছে ৷ গ্রাম কর্মমুখর ৷ কোথাও হাতে ঘোরানো জাঁতায় গম ভাঙা হচ্ছে, কোথাও তাঁত বসেছে, বিরাট কমিউনিটি রান্নাঘরে রান্না হচ্ছে -একদিকে খোঁয়াড়ের মধ্যে কতকগুলো ছাগল ৷ একচালা কুঁড়ে ঘরগুলোর গোল ছাদ, কাঠের দেওয়াল ৷ একটা কুঁড়ে আবার খুঁটির ওপরে মাটি থেকে এক মাথা উঁচুতে ৷ বুনো জন্তুর ভয়ে গ্রামের লোকেরা এইরকম শূন্যে ঘর বাঁধত ৷ পুরুত, মুচি, নাপিত-গ্রামে সব আছে এমনকী একজন মেডিসিন ম্যান ও ফরচুন টেলার তাদের জন্য আলাদা করা কুঁড়েতে বসে আছে ৷ দশ জিম্বাবোয়েন ডলার মানে আমাদের পনেরো টাকার বিনিময়ে সে আমার সম্বন্ধে অনেক ভালো ভালো কথা বলল ৷ এর পদ্ধতিটি কিছু নতুন ৷ আপনার হাতের মুঠোয় আটটা চতুষ্কোণ কাঠের শলা ধরিয়ে দিয়ে বলবে শলাগুলোকে নিচে পশুচর্মের ওপর ঘুরিয়ে ফেলতে ৷ তারপর শলাগুলির অবস্থান অনুধাবন করে সে মিনিট তিনেক কিছু বলবে দুর্বোধ্য ইংরিজিতে ৷ প্রতিপ্রশ্ন করে লাভ নেই ৷ জবাব পাবেন না এবং ততক্ষণে আরেকজন অনুসন্ধিৎসু ঘরের দরজায় অপেক্ষা করছেন ৷
ক্র্যাফট ভিলেজের বেড়ার বাইরেই বেশ খানিকটা জায়গা ঘিরে লোকসঙ্গীত নৃত্য প্রদর্শনীর জায়গা ৷ কুশীলব ওই ভিলেজের লোকেরাই-তা প্রায় ৪০-৫০ জনের দল-ছেলেমেয়ে বুড়ো বাচ্চা মিলিয়ে ৷ সন্ধ্যাবেলা দেখতে গেলাম ৷ জোরালো আলোর তলায় তিন চতুর্থাংশ বৃত্তাকারে গ্যালারি ৷ চারশো লোক অক্লেশে বসতে পারে ৷ যাত্রার আসরের মতো ৷ স্টেজ নেই ৷ মাঝখানে সমান জমিতে আসর ৷ ট্যুরিস্ট ভোলানো এরকম শো পৃথিবীর নানা জায়গায় হয় ৷ কাজেই খুব একটা উৎসাহ নিয়ে দেখতে যাইনি ৷ কিন্তু শো আরম্ভ হতেই বুঝতে পারলাম যে এটা একটা জোড়াতাড়া দেওয়া হাতুড়ে জলসা নয় ৷ এর পিছনে অনেক প্রস্তুতি, অনেক পরিশ্রম এবং পেশাদার পরিচালনা আছে ৷ দেড় ঘণ্টা সময় যেন ফুঁ-এ উড়ে গেল ৷ কোথাও লয় ঢিলে হল না ৷ কোথাও মনে হল না, অনেক হয়েছে এবার থামলে হয় ৷ প্রোগ্রামগুলিকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায় ৷ নৃত্য ও গীত, কোরাস গান ও জিমন্যাস্টিক্স ৷ প্রতিটি অঙ্ক স্বয়ংসম্পূর্ণ ৷ নাচে সবাই মুখোশ পরা-মুখোশের মাধ্যমে বোঝা যায় যে সে মানুষ না দেবতা না ভূত ৷ আবার কচ্ছপ ও জেলের গল্পে মানুষটা পুরো একটা কচ্ছপের খোলা পরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল ৷ কোরাস গান সবই প্রায় মেয়েদের ৷ ঘরের নানা কাজ করতে করতে তারা গান গাইছে ৷ গানের ভাষা কিছুই বোঝা যায় না, কিন্তু ওদের হাত পায়ের ভঙ্গি থেকে বেশ বুঝতে পারলাম যে কুয়ো থেকে জল তুলছে বা বাড়ির পাশে পগার থেকে ছাঁকনি জালে মাছ ধরছে ৷ জিমন্যাস্টিক্সের মধ্যে লম্বা লম্বা রণপা চড়ে একটা দল এল, তাদের মুখে বীভৎস মুখোশ ৷ একটা ছেলে প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু একটা মাথা কাটা তালগাছের গুঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েকটা খেলা দেখাল ৷ আমি তো বলব কেবল ভিক্টোরিয়া ফলস টাউন কেন -আমাদের কলকাতা দিল্লিতেও এমন শো হলে দেখতে যেতাম ৷
পৃথিবীর সব মানুষকে চা অথবা কফিতে ভাগ করলে চায়ের দল অনেক ভারি হবে ৷ আবার চা খাবার চল পৃথিবীর প্রায় সব দেশে থাকলেও, দুটি মাত্র দেশ এই চা খাওয়াটিকে একটা অনুষ্ঠানে পরিণত করেছে ৷ ইংল্যান্ড এবং জাপান ৷ জাপানের অনুষ্ঠানটি আচারভিত্তিক-তার নিয়ম-কানুন বেশ কড়া ৷ ইংল্যান্ডে বৈকালিক চা পান একান্ত সামাজিক ব্যাপার ৷ লন থাকলে লনে, না হলে বাড়ির ভেতরেই চেয়ার টেবিল সাজিয়ে আরাম করে বসা-স্যান্ডউইচ, বিশেষ করে শশার স্যান্ডউইচ, কেক-বিস্কুট, মাফিন বা ফালা ফালা করে কাটা সেদ্ধ ডিম সহযোগে তারিয়ে তারিয়ে চা পান, গল্পগুজব আড্ডা ৷ আজকাল এই মনোহর প্রথাটি লোপ পেতে বসেছে, কিন্তু ভিক্টোরিয়া ফলস হোটেল এখনও তাদের হোটেলের পিছনে সুবিশাল লনে প্রতি বিকেলে এই চা পানের আয়োজন করে ৷ এখানে চা খেতে খেতে দেখা যায় বাষ্পোজ্জ্বল মেঘের ওপরে রামধনুর রং ৷ ছোট ছোট পাখিগুলো এ ঝোপ থেকে ও ঝোপে লাফালাফি করছে ৷ একটু অন্যমনস্ক হলে সামনে রাখা কেকের প্লেটেও একটা ঠোক্কর দিয়ে যাবে ৷ দু-চারটে কাঠবেড়ালির ব্যস্তসমস্ত আনাগোনা, রংবেরঙের প্রজাপতি ৷ ওদের যেন কোনও কাজ নেই ৷ মৌমাছিও দু-চারটে আছে ৷ চা খাওয়া শেষ হলে বাঁধানো রাস্তা ধরে চলুন প্রপাতের সামনে যেখানে অতিকায় ফড়িংয়ের মতো রেল ব্রিজটা এপার থেকে ওপারে পা ছড়িয়ে পড়ে আছে ৷ আর সেইখানেই দেখুন ১১১ মিটার উচ্চতা থেকে পৃথিবীর গভীরতম বুঙ্গি লাফ ৷
ব্রিজের ধার থেকে কোমর থেকে দু-পা পর্যন্ত পেঁচিয়ে বেঁধে এবং তাতে রবারের দড়ি লাগিয়ে দুঃসাহসীর দল লাফিয়ে পড়ে নিচে নদীর খাদ লক্ষ্য করে ৷ নদীতে পৌঁছবার আগেই স্থিতিস্থাপক রবারের দড়িতে টান পড়ে এবং কয়েক সেকেন্ডের জন্য মানুষটি ইয়ো ইয়োর মতো ওপর-নিচ করতে থাকে ৷ সে স্থির হলে তাকে কপিকলের সাহায্যে ব্রিজের গায়ে লাগানো প্ল্যাটফর্মে টেনে তোলা হয় ৷ ছেলেমেয়ে দু-দলই বুঙ্গি লাফ খেতে যায় ৷ কেউ কেউ তো ওপরে উঠে আরেকবার লাফায় ৷ এইখানে বলে রাখি যে আমি বুঙ্গি লাফ দেবার কথা ভাবিনি ৷
ভিক্টোরিয়া ফলসে দু-রাত কেটে গেল ৷ পরের দিন বিকেলে ঘরে ফেরা ৷ সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট খেয়ে শহরে ইতস্তত বেড়ালাম ৷ ক্র্যাফট ভিলেজের স্যুভেনিরের দোকানে হাবিজাবি কিছু কেনা হল ৷ তারপর হোটেলে ফিরে ওদের স্যুইমিং পুলের ধারে বসে ঠান্ডা হাওয়ায় খুব সস্তা ঠান্ডা বিয়ার খাওয়া গেল ৷ আর খেলাম ওদেশি খানা সাডজা-সাদা মকাই চূর্ণের মণ্ডর সঙ্গে চিকেন স্টু ৷ ওদের নুনে জারানো শুঁটকি মাংস বিলটং একটু চেখে দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পাওয়া গেল না ৷ ওইখানে বসেই আরেকটি দম্পতির সঙ্গে আলাপ হল-কে কী দেখেছে তাই নিয়ে গল্প ৷ বিকেলে চলে যাব শুনে ওরা বলল, তোমরা দেবদূতের পথে একবার উড়ে আসবে না ৷ ভিক্টোরিয়া ফলস দেখে লিভিং স্টোন নাকি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, এই অপূর্ব শোভা দেবদূতরাও নিশ্চয় উড়ে যাবার পথে চেয়ে দেখেন ৷
এই বাক্যটিকে কাজে লাগিয়ে এখানকার এক ভ্রমণ সংস্থা আকাশ থেকে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখার বন্দোবস্ত করেছেন ৷ নাম ফ্লাইট অব দ্য এঞ্জেলস ৷ প্রথমে ছোট প্লেন যাত্রীদের নিয়ে এক চক্কর উড়ে আসত ২৫ মিনিটে ৷ এখন হেলিকপ্টার আরও ভালো করে দেখায়, ১৫ মিনিট ৷ কিন্তু তখন বেলা প্রায় দুটো-আর আমাদের হোটেল থেকে চারটে-সাড়ে চারটের মধ্যে বেরোতে হবে ৷ এত তাড়াতাড়ি কী দেবদূতদের রাস্তায় বেড়ানোর বন্দোবস্ত করা যাবে! হোটেলকে বলতে ব্যবস্থা হয়ে গেল ৷ হোটেল থেকে হেলি-স্টেশন দশ মিনিটের রাস্তা এবং প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর হেলিকপ্টার নামছে এবং দশ মিনিটে যাত্রী বোঝাই করে আবার উড়ছে ৷ প্রতি খেপে সাতজন যাত্রী পাইলটকে নিয়ে ৷ একজন পাইলটের পাশে ৷ তিনজন তার পিছনের সারিতে ৷ তার পিছনে ২ জন ৷ পাইলটের পাশে জায়গা পেয়ে আমি খুব খুশি ৷ ঠিক যেন পুরনো বাড়ির জানলার ধাপিতে বসে আছি আর জানলাটা পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছে ৷
মহাকাশযানে চড়ে যাঁরা পৃথিবী পরিক্রমা করেন তাঁরা পৃথিবীর খুঁটিনাটি কিছুই দেখতে পান না-কিন্তু সমস্ত ভূমণ্ডলকে একসঙ্গে দেখার বিস্ময়ও কিছু কম নয় ৷ আমাদেরও সেই অবস্থা ৷ শূন্য থেকে প্রপাতের গাম্ভীর্য, ধ্বনি কিছুই বোঝা যায় না কিন্তু সমস্ত নদী এবং তার অববাহিকা যেন ছবির মতো চোখের সামনে বিছিয়ে আছে ৷ দেখছি কেমন করে তিন কিলোমিটারের চেয়ে বেশি চওড়া বিস্তৃত-অঞ্চলা নদীটা আস্তে আস্তে গাছকোমর বেঁধে দেড় কিলোমিটার প্রপাতের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ৷ তারপর খাদের পর খাদ ভেঙে সুদূর সমুদ্রযাত্রা ৷ জাম্বেজির খাদগুলো বড় মজার ৷ ভাঁজ করা জানলার মতো, প্রতিটি ভাঁজ পরের ভাঁজের সঙ্গে জোড়া, যার অতল গভীরে নদীর মুক্তধারা এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে ৷ পর পর আটটি ভাঁজ গুনে নেওয়া যায় ৷ নবম ভাঁজটি এখন তৈরি হচ্ছে লিভিং স্টোনের সামনে, যাকে ডেভিলস ক্যাটারাক্ট বলা হয় ৷ প্রপাতের ওপর দিয়ে ওড়বার সময় ছড়ানো পালকের ওপর রামধনু রঙের খেলা কাছ থেকে দেখলাম ৷ আরও লক্ষ করলাম যে মাটি থেকে যে মেঘের পুঞ্জ আকাশ ছোঁয়া মনে হয়, তার মাথা আর আকাশের মধ্যে অনেকটা ফাঁক আছে ৷ প্রপাত পেরিয়ে হেলিকপ্টার কিছুটা নেমে এল ৷ প্রাকপ্রপাত নদীর বিস্তৃতি, তার দুধারে বড় বড় গাছগুলো ৷ এক জায়গায় কয়েকটা হাতি জলে নেমেছে দেখতে দেখতে কপ্টার পাক খেয়ে ডেরার দিকে ফিরে চলল ৷
কপ্টার স্টেশন থেকে হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভ্যানের ড্রাইভারের কাছে দুঃখ করছিলাম যে দ্য বিগ ট্রি বা বৃহৎ গাছটি দেখা হল না ৷ ওদেশি ড্রাইভার বেশ মাই ডিয়ার লোক, বলল-সে কী! চলো এখনই দেখিয়ে আনি ৷ আমি বললাম, আর সময় কই ৷ আমাদের যে হোটেলে পৌঁছেই প্লেন ধরতে দৌড়াতে হবে-আরে যথেষ্ট সময় আছে ৷ আর আমিই তো তোমাদের এয়ারপোর্ট নিয়ে যাব ৷ তারপর জাম্বেজি ড্রাইভ ধরে দৌড় দৌড় দৌড় ৷ পাঁচ-ছ কিলোমিটারের মাথায় এই সুবিশাল বাওবাব গাছ যার গোড়ার বেড় কুড়ি মিটারের মতো ৷ বয়স আনুমানিক ১৫০০ বছর ৷ তবু বাওবাবদের কুলে এঁকে বড় জোর নব যুবক বলা যায়-কারণ কুলবৃদ্ধদের মধ্যে ৩০ মিটার বেড় এবং ৩০০০ বছর বয়সও পাওয়া যাবে ৷ এই গরমকালে রিক্তপত্র, গুঁড়ি গুঁড়ি ডালওয়ালা বাওবাব গাছ দেখলে মনে হয় যেন গাছটাকে কেউ উল্টো করে পুঁতে দিয়েছে-মূল কাণ্ডটি মাটির তলায়-আর শুকনো ধুলো রঙের শিকড়গুলো আকাশে আঁকুপাঁকু করছে ৷ এদেশে একটা গল্পও চলিত আছে যে বাওবাবদের আদি পুরুষের ওপর চটে গিয়ে বদরাগী কোনও দানো গাছটাকে মাটি থেকে উপড়ে তুলেছিল ৷ পরে রাগ পড়ে গেলে সে গাছটাকে আবার পুঁতে দেয় ৷ কিন্তু দানো হলেও ভূত তো ৷ গাছটাকে পোঁতে উল্টো করে ৷ ফলে ডালপালা যায় মাটির নিচে আর শিকড়গুলো ওপরে দুলতে থাকে ৷ যাক বিগ ট্রি দেখা হল ৷ জগদ্বিখ্যাত বাওবাব গাছও এই প্রথম দেখলাম ৷ জনান্তিকে জানিয়ে রাখি যে বাওবাব গাছ কলকাতার চিড়িয়াখানায় কয়েকটি আছে ৷ রবীন্দ্র সরোবরেও একটি আছে বলে শুনেছি ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন