অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
কোঙ্কন রেলপথের সিন্ধুদুর্গ স্টেশনে যখন নামলাম তখন বৃষ্টি থেমেছে ৷ আকাশে মেঘ, তবু বিকেলের আলোয় চারদিক উজ্জ্বল ৷ ঝকঝক করছে নতুন তৈরি স্টেশনঘরের সামনে নির্জন প্ল্যাটফর্ম ৷ লাইনের ওপারে জঙ্গল ৷ এপাশে দূরে পাহাড়ের রেখা ৷ পিছনের কামরা থেকে দুজন যাত্রী নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল প্ল্যাটফর্ম ধরে ৷ লোকালয়ের চিহ্ন নেই ধারেকাছে ৷ শহরে যেতে হবে রাতে থাকার হোটেলের জন্য ৷
হাওয়ায় ভিজে ভিজে ভাব ৷ আগে চা খেয়ে তারপর দেখা যাবে যানবাহন কী পাওয়া যায় ৷ একপাশে রয়েছে স্ন্যাকস কাউন্টার ৷ একা বসে বোধহয় বোর হচ্ছিলেন দোকানদার ৷ দেখামাত্র তৎপর হয়ে উঠলেন ৷ শহরের কথা বলাতে জানতে চাইলেন কোন শহরে যেতে চাই ৷
যেতে চাই সিন্ধুদুর্গতে ৷ কিন্তু সেই নামে নাকি কোনও শহরই নেই ৷ সিন্ধুদুর্গ তো একটা জেলা ৷ সেখানে আমি এসে গেছি ৷ সেই জেলার কোন শহরে যেতে চাই, আবার জিজ্ঞেস করলেন দোকানদার ৷ আগন্তুকের পক্ষে বেশ কঠিন প্রশ্ন ৷ কাছাকাছি কোনও দুর্গ আছে কি? সেটা কোন শহরে? এবার বুঝে গেছি, ভদ্রলোক বললেন ৷ আপনাকে মালবণ যেতে হবে ৷ বেশি নয়, এক-দেড় ঘণ্টার পথ ৷ স্টেশনের সামনে বাস পাওয়া যাবে সন্ধে নাগাদ ৷ আর লাইন ধরে শর্টকাটে একটু হেঁটে ব্রিজের কাছ থেকে বাঁদিকের রাস্তায় চলে গেলে বাস পাওয়া যাবে তার আগেই ৷
রেললাইনের পাশ দিয়ে টিলার কোল ঘেঁসে এগিয়েছে পিচরাস্তা ৷ সামনের ব্রিজ পার হয়ে চলে গেছে বাঁদিকে ৷ লাইন ধরে মিনিট তিনেক হেঁটে ওঠা গেল ব্রিজের কাছে ৷ পিছনে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট দুর্গের মতো করে তৈরি স্টেশনের সাদা বাড়িটাকে ৷ চারদিক সবুজে সবুজ ৷ ছায়া ছায়া বিকেলে জায়গাটাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে মনে হল ভাগ্যিস নেমেছিলাম এখানে ট্রেন থেকে! ব্রিজ পার হয়ে আবার গাছপালার মধ্য দিয়ে বাঁক নিয়ে এগিয়েছে রাস্তা ৷ দুপাশে ঘন সবুজে বেশ জঙ্গল জঙ্গল ভাব ৷ একটা লোকেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না পথে ৷ ঠিক দিকে যাচ্ছি কিনা ভাবতে ভাবতে আরও প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে মোড়ের কাছে এসে দেখা গেল দুজনকে ৷ ট্রেন থেকে নেমে আমার আগেই এসে পাথরে বসে আছেন তাঁরা ৷
বাস এল কণকবলী থেকে ৷ বম্বে-গোয়া রেলপথে সিন্ধুদুর্গের আগের স্টেশন কণকবলী ৷ সেই স্টেশনে নেমে গেলে ফাঁকা বাস ধরতে পারতাম টার্মিনাসেই ৷ সিন্ধুদুর্গের পরের স্টেশন কুডাল থেকেও ছাড়ে মালবণ যাওয়ার বাস ৷ তবে কোঙ্কন রেলপথে স্টেশন থেকে শহরের বাসস্ট্যান্ড সাধারণত কিছুটা দূরে, আর খুব বেশি ভিড়ও হয়নি বাসে ৷ একটা সিট খালি হতেই ট্রেনের সঙ্গী দুজন বসতে দিলেন আমাকে ৷ বাইরে থেকে এসেছি বলে আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন অনেকেই, পরামর্শ দিচ্ছিলেন নানারকম ৷ সুদূর কলকাতার লোক সিন্ধুদুর্গের নাম জেনে গেছে দেখে সবাই খুশি ৷ বললেন, নির্ভয়ে ঘোরাঘুরি করা যেতে পারে কোঙ্কন উপকূলের যে কোনও জায়গায় ৷ আর সিন্ধুদুর্গের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করবেই ৷ নীল সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপের মধ্যে শিবাজি তৈরি করেছিলেন সেই দুর্গ ৷ মালবণের জেটি থেকে যেতে হবে নৌকায় ৷
মুম্বই থেকে ট্যুরিস্ট বাস আসে মালবণে, জানালেন একজন ৷ বিকেলে ছেড়ে এসে পৌঁছয় ভোরবেলায় ৷ আবার মালবণ থেকে বিকেলে রওনা হয়ে ভোরে ফিরে যায় মুম্বইতে ৷ রিটার্ন টিকিটও নিয়ে আসা যায় মুম্বইয়ের এম টি ডি সি কাউন্টার থেকে ৷ ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্ট বাস চালু করার পর ছুটির দিনগুলোতে আজকাল অনেক লোক আসে কেল্লায় বেড়াতে ৷ কাছাকাছি তারকর্লি বিচে টেন্ট রিসর্টও হয়েছে পর্যটকদের থাকার জন্য ৷
তারকর্লি মালবণ থেকে অটোরিকশায় পনেরো মিনিটের পথ ৷ বাস থেকে নেমে চলে যেতে পারতাম সেখানে ৷ কিন্তু সহযাত্রীদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় তখন মালবণ শহরটাকেও ভালো লাগতে শুরু করেছে ৷ সেদিন দুর্গাপুজোর রাত ৷ শহরে উৎসব ৷ একটা রাত শহরে থেকে, মালবণী খাজা খেয়ে, কেল্লা বেড়িয়ে, তারপর তারকর্লি সৈকতে যেতে অনুরোধ করলেন সবাই ৷ তাদের কথা না শুনে যদি চলে যেতাম, তাহলে পরদিন ঘুরতে এসে মালবণী খাজার স্বাদ যদি বা নিতে পারতাম, দূরে থেকে মালবণ শহরের স্বাদটা হয়তো বুঝতেই পারতাম না ৷
অত্যন্ত আকর্ষণীয় কোঙ্কন উপকূলের নির্জন সমুদ্রসৈকত ৷ এখনও বাইরের পর্যটকদের কাছে প্রায় অপরিচিত মহারাষ্ট্রের আশ্চর্য সুন্দর নানা সৈকতভূমি ৷ তটরেখা ধরে ছড়িয়ে থাকা নানা ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যের মধ্যে ছত্রপতি শিবাজির রাজত্বকালে তৈরি দুর্গগুলো খুঁজে বের করাও খুবই রোমাঞ্চকর ৷ আর তেমনই আকর্ষণীয় কোঙ্কনী মানুষজন, তাঁদের গ্রাম আর পুরনো শহরগুলো ৷ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, আধুনিক সংস্কৃতি পৌঁছে গেছে সবজায়গাতেই ৷ তবু তারমধ্যেও এখনও টিকে আছে কোঙ্কনের নানা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ৷ তাই তারকর্লি বিচ আর সমুদ্রের বুকে সিন্ধুদুর্গের মতোই আকৃষ্ট করে মালবণ শহরের পথঘাট-দোকানপাটও ৷ ভারতের পুবতট থেকে পশ্চিমতটের শহরে পৌঁছে অনেক কিছুই মনে হয় বিচিত্র, অপরিচিত ৷
দশেরার সন্ধ্যায় ঠাকুর বেরিয়েছে মালবণের রাস্তায় ৷ হাতেটানা গাড়ি টানতে টানতে চলেছেন ভক্তরা ৷ একবার দড়িতে হাত লাগানোর জন্য ভক্তদের হুড়োহুড়ি ৷ গাড়ি ঘিরে ভিড় করে চলেছে জনস্রোত ৷ কিছুটা দূর থেকে পাহারা দিয়ে ধীরে ধীরে পিছনে চলেছে পুলিশের ওয়ারলেস জিপ ৷ দোকান-বাজারের মধ্যে সরু গলিপথে সেই ভিড় পার হয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই ৷ জনস্রোতের মাথা ছাড়িয়ে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে দেবীর প্রশান্ত মুখ ৷ ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখি দেবীর আট হাত ৷ সকালে চার হাতের মূর্তি দেখে এসেছি রত্নাগিরিতে ৷ দুর্গার হাত কটা থাকে, জিজ্ঞেস করলাম একজনকে ৷ এই ঠাকুরের আটটা আছে ৷ দুটোও থাকতে পারে, জানালেন তিনি ৷ ‘ইচ্ছেমতো বানানো যেতে পারে, কোনও নিয়ম নেই!’ ‘নিয়ম তো নিশ্চয়ই আছে’, ভদ্রলোক বললেন, ‘তিনটে তো আর বানায় না কেউ ৷ বিজোড় চলবে না ৷ একপাশে দুটো আরেক পাশে একটা হলে নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না! দুর্গার হাত হবে সবসময়ই দুটো বা চারটে, কিংবা ছটা, আটটা ৷ এমনকী বারোটাও বানায় কেউ কেউ’ ৷ ‘দশটা হয় না?’ ‘না, দশটা হতে পারে না’, একটু চিন্তা করে বললেন তিনি, ‘দুপাশে পাঁচটা পাঁচটা হলে তো বিজোড়ই হয়ে যাবে’ ৷ এটা কোনও যুক্তিই নয় ৷ ছ-হাতের দুর্গা হলেও একপাশে তিনটে হাত থাকছে ৷ শুনে একটু বিরক্ত হলেন ভদ্রলোক ৷ বললেন ‘দশ হাতের দুর্গা তো হয় না কখনও’ ৷ দেবী তুলজা ভবানী বর দিয়েছিলেন শিবাজিকে ৷ দুর্গার সেই রূপ ব্যাঘ্রবাহিনী, হাতে তলোয়ার, চতুর্ভুজা ৷ কিন্তু দশভুজা দুর্গার কথা শুনেছে এমন ব্যক্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না সেদিন রাতে ৷ ‘দশ হাত কখনওই হতে পারে না, কারণ শাস্ত্রেই নেই’, জানিয়ে দিলেন একজন ৷
হোটেলে ঘর নিয়ে স্নান করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে রাস্তায় বেরিয়েছি খাবারের খোঁজে ৷ সিন্ধুদুর্গ শোভা লজে সেদিন রান্নার ব্যবস্থা নেই ৷ পুজোর জন্য ছুটিতে আছেন কর্মচারীরা ৷ ম্যানেজার বললেন, প্রায় সব লজেই সেদিন রান্না বন্ধ ৷ কাছেই ভালো খাবার পাওয়া যায় ময়ূর লজের রেস্টুরেন্টে ৷ না হলে যেতে হবে বাজারের চৈতন্য হোটেলে ৷ ময়ূর লজের নাম শুনেছিলাম বাসে ৷ সহযাত্রীরা সেখানেই থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন ৷ গিয়ে দেখি পুরনো বনেদী বাড়ির দোতলার কয়েকটা ঘর নিয়ে লজ হয়েছে ৷ ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন সম্ভ্রান্ত চেহারার সুদর্শন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ৷ দুঃখ জানিয়ে বললেন, তাঁর কর্মচারীরাও সেদিন ছুটিতে ৷ পিছনের গলিতে আর যে দুটো খাবারের হোটেল আছে সেসবও সেদিন বন্ধ ৷ যেতে হবে বাজারে ৷ কথা বলে ভালো লাগছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে ৷ ভালো লাগছিল বাড়িটাকেও ৷ উঁচু ছাদের খোলামেলা ঘরে কাঠের কড়িবরগা নিয়ে এইরকম পুরনো বাড়িগুলোতে এক ধরনের রহস্যময়তা থাকে ৷ রাস্তার দিকের ঘরটাই পছন্দ হচ্ছিল ৷ ভাড়া কিছু কমই হত এই লজে থাকলে ৷ আর মানানসইও হত মালবণ শহরের মেজাজের সঙ্গে ৷
পরদিন দুপুরে খেতে আসব জানিয়ে বিদায় নিয়ে চললাম বাজারের দিকে ৷ রাস্তায় তখন সেজেগুজে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছেন অনেক লোক ৷ উচ্ছল মেয়েরা চলেছে দলবেঁধে ৷ নানা সাজসজ্জার মধ্যে নজরে পড়ছে মেয়েদের মাথার পিছনে চুলে ঘাসের সাজ ৷ দোকানে দোকানে ভিড় খুব ৷ দুপাশে পর পর মালবণী খাজা আর কাজুবাদামের দোকান ৷ সাইনবোর্ডগুলো পড়া যাচ্ছে কারণ মারাঠি ভাষার হরফ দেবনাগরী ৷ হাঁটতে হাঁটতে পাওয়া গেল চৈতন্য হোটেলটাকে ৷ নিরামিষ খাবার নয় তো, আশংকা ছিল মনে মনে ৷ ম্যানেজার অভয় দিলেন, নাম চৈতন্য হলেও মাছ পাওয়া যাবে সেখানে ৷ কী মাছ আছে? সুরু আর বাংলা, বললেন ম্যানেজার ৷ এতদূর এসে বাংলা মাছ খাওয়ার মানে হয় না ৷ সুরুই দিতে বললাম ৷
সুরু-মিল অর্ডার চলে গেল কিচেনে ৷ পাশের টেবিলে বসেছিলেন শিশুকন্যা কোলে নিয়ে এক মারাঠি দম্পতি ৷ দেখলাম আশ্চর্য দুটো থালা নিয়ে আসা হচ্ছে তাদের জন্য ৷ মিলের অর্ডার ছিল বোধহয় ৷ বিশাল থালার একপাশে ভাঁজ করে দেওয়া হয়েছে ঘি মাখানো রুটি ৷ তারপর গোল করে থালার ধার দিয়ে সাজানো রয়েছে ছোট ছোট একগাদা বাটিতে তরকারি, ভাজা, আচার, দই ৷ আর থালার ঠিক মাঝখানে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা করে বড়সড় কাটলেট ৷ রুটি-তরকারির সঙ্গে কাটলেটের কম্বিনেশন আগে কখনও শুনিনি ৷ ভাব দেখে মনে হল কাটলেটের সাইজ দেখে খুবই উৎসাহিত হয়েছেন মারাঠি দম্পতি ৷ অবাক হওয়ার তখনও কিছু বাকি ছিল ৷ কারণ একটু পরেই আমার জন্যও উপস্থিত একই রকমের একটা থালা ৷
মাঝখানের জিনিসটা কাটলেট নয় ৷ বুঝতে পেরেছি ততক্ষণে ৷ একটা বড় মাছকে আড়াআড়ি কেটে ভেজে দেওয়া হয়েছে এক ফালি ৷ এভাবে কাটলে মাঝখানে যে ফুটো থাকে সেটাও বুজে গেছে পুরোপুরি ৷ তার ওপরে ছড়ানো রয়েছে পোস্তদানার মতো কোনও কিছু ৷ দেখাচ্ছে অবিকল কাটলেটের মতো ৷ ‘খেতে পারছেন না মনে হচ্ছে?’ ম্যানেজার এগিয়ে এলেন, ‘রুটি শেষ হলে ভাত দেওয়া হয় ৷ আগেই দিতে বলব কি?’ ‘রুটিটা সমস্যা নয় ৷ সবকিছুতে এত টক দিয়েছেন কেন?’ ‘টক নয়, আমসোল দেওয়া হয়েছে ৷’ ম্যানেজার রান্নাঘর থেকে একটা শুকনো ফল এনে দেখালেন ৷ এই আমসোল শুকিয়ে রেখে সারা বছর রান্নার সময় কারি বা আমবাটিতে দেওয়া হয় ৷ আর এটা কী, লাল রঙের দই কেন? জানা গেল সেটা দই নয়, সোলকড়ি ৷ নারকোলের রসের মধ্যে দেওয়া হয়েছে কোকুম ফলের লাল রস ৷ ‘আর এ বাটিতে কী আছে?’ ওটা মাছের কারি ৷ নারকোল পেষা আর পাউডার মশলার জন্য ঘন দেখাচ্ছে ৷ নিচে মাছ আছে ৷ ‘আর তার পাশে?’ ওটাও মাছের মাথার কারি ৷ নারকোলের কারিতে ঢাকা পড়ে গেছে ৷ ‘কী মুশকিল, মাছের-মিল অর্ডার দিয়েছি বলে সবটাই মাছ দিয়েছেন না কি?’ প্রবল আপত্তি জানালেন ম্যানেজার ৷ এই তো রয়েছে আমবাটি ৷ অর্থাৎ ডাল ৷ তারপাশে লোনচেবাটি ৷ অর্থাৎ আচার ৷ ‘কাটলেটের ওপর কী ছড়ানো হয়েছে?’ ‘কাটলেট কোথায়, ওটা সুরমাই মাছ ৷ ওপরে চালের গুঁড়ো দিয়ে ভাজা’ ৷ সুরমাই মাছের নাম তো জানি ৷ তাকেই ডাক নামে সুরু বলা হচ্ছিল এতক্ষণ! ‘আর বাংলা মাছটা কী?’ বাংলা নয়, সেটা বাংরা মাছ ৷ ম্যানেজার খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন ৷ কোথা থেকে আসা হয়েছে জানতে চাইলেন ৷ ‘এসেছি কলকাতা থেকে ৷ আপনি শিগগিরি একটা বাংরা মাছ নিয়ে আসুন ৷ খেয়ে দেখব সেটাও ৷’ চটপট এসে গেল আরেকটা প্লেট ৷ চালের গুঁড়ো মাখা হৃষ্টপুষ্ট বাংরাভাজার মাথা আর লেজ বেরিয়ে আছে প্লেট ছাড়িয়ে ৷
অজস্র মাছ পাওয়া যায় কোঙ্কন উপকূলে ৷ পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতে দেখি সার বেঁধে জেলে নৌকা দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের কিনারে ৷ হোটেলটা যে সমুদ্রের কাছে সেটা জেনেই ঘর নিয়েছিলাম, কিন্তু রাতের অন্ধকারে বুঝতে পারিনি যে একেবারে ঘরের জানলার নিচ থেকেই শুরু হয়েছে বালির তট ৷ জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাঁধানো পাড়ের কাছে জল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে এক সারি নারকোল গাছ ৷ আর তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বন্দরে ছোট বড় নানা আকারের রংবেরঙের নৌকা ৷ মাথায় পতাকা লাগিয়ে নৌকাগুলো এক এক জায়গায় ঝাঁক বেঁধে জলে দাঁড়িয়ে দোল খাচ্ছে হালকা ঢেউয়ে ৷ আরও কিছুটা দূরে জলের বুকে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট দুটো দ্বীপ ৷ তারই একটাতে রয়েছে সিন্ধুদুর্গ ৷
ভোরের আলোয় সমস্ত দৃশ্যটাতে এমন স্নিগ্ধভাব যে দেখামাত্র মন ভালো হয়ে যায় ৷ তখনই বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম জেটিতে ৷ সিন্ধুদুর্গে যাওয়ার জন্য তার আগেই অপেক্ষা করছিলেন দু-চারজন ৷ মাঝি জানালেন আর কয়েকজন যাত্রী হলে নৌকা রওনা হবে কেল্লার দিকে ৷
সচরাচর যে রকম দুর্গ দেখা যায় সিন্ধুদুর্গকে তেমন দেখাচ্ছিল না দূর থেকে ৷ সমতল দেখাচ্ছে পাথরের পাহাড়ের ওপরটা ৷ কালো পাথরের একটা পাত্র যেন জলের মধ্যে রাখা হয়েছে উল্টো করে ৷ পাড়ে দাঁড়িয়ে যতটা বড় মনে হচ্ছিল জায়গাটাকে, নৌকায় যেতে যেতে বুঝতে পারছিলাম তার চেয়ে অনেক বড় দুর্গ অঞ্চল ৷ মাঝি বললেন, গ্রামও রয়েছে দুর্গের ভেতরে ৷ ঢেউ কম এদিকের সমুদ্রে ৷ তবু ডিঙি নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেওয়া রোমাঞ্চকর ৷ বিশেষ করে দুর্গের জেটিতে পৌঁছনোর পর ঢেউয়ের দুলুনির মধ্যে নৌকা থেকে পাড়ে উঠতে যাত্রীরা হিমশিম ৷ ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের তালে তালে শিশুদের চিৎকার পুরুষদের সাবধানবাণী মেয়েদের হাসাহাসি হইচইয়ের মধ্যে অনভ্যস্ত পর্যটকদের ধরে ধরে ওপরে তুললেন মাঝিরা ৷ বলে গেলেন ঘণ্টাখানেক পরে এসে ফেরত নিয়ে যাবেন মালবণে ৷ মাথাপিছু মাত্র কুড়ি টাকার যাতায়াত ৷ একটা নৌকা ছেড়ে ফেরা যেতে পারে পরের নৌকাতেও ৷
জলের মাঝখানে এরকম একটা দুর্গ সত্যিই বিস্ময়কর ৷ পাথর আর চুনের তৈরি দুর্গে ঢোকার মুখে আঁকা আছে শিবাজির হাত আর পায়ের ছাপ ৷ ভেতরে রয়েছে শিবাজি মহারাজের মন্দির ৷ ভেঙে পড়েছে কেল্লার এক অংশ ৷ তবে কোনও কোনও জায়গায় এখনও লোকে বসবাস করে বংশপরম্পরায় ৷ চারদিক লবণজলে ঘেরা হলেও দুর্গে রয়েছে মিষ্টি জলের কুয়ো ৷ শিবমন্দির, রামমন্দির, দুর্গামন্দির রয়েছে কেল্লাতে ৷ দিগন্তবিস্তৃত সাগরের সামনে কেল্লার নিচে রয়েছে ছোট্ট সৈকত, রানিচি বাগ ৷ জেলেদের গ্রাম আছে সেদিকে সমুদ্রের ধারে ৷
কেল্লার ওপর থেকে দেখা যায় চারদিকের ঘন নীল আরব সাগর ৷ দেখা যায় বহুদূর সমুদ্রে নৌ-চলাচল ৷ সার্থক নাম হয়েছিল সিন্ধুদুর্গ ৷ পিছনে মালবণ বন্দর ৷ বোঝা যায় উপকূল রক্ষার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই দুর্গ ৷ এর পাহারায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পেরেছিল মালবণ শহর ৷ দুর্গের ওপরের অংশে না উঠলে দেখা যায় না মালবণের দিকটা ৷ সমুদ্রেঘেরা দুর্গ অঞ্চল মনে হয় অন্য জগৎ ৷ সময় যেখানে পিছিয়ে আছে বেশ কয়েক যুগ ৷ সকালবেলার নরম রোদে পর্যটকদের অসুবিধে হয় না সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে, একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরে বেড়াতে ৷ দুই শাখাওয়ালা এক নারকোল গাছের ছবি তোলেন প্রত্যেকেই ৷ ঘুরে বেড়ান নির্জন সমুদ্রসৈকতে ৷ খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে এসে সারাটা দিন এখানে কাটিয়ে বিকেলের দিকে মালবণ ফেরেন অনেকে ৷ তবে মালবণের কাছাকাছি বেড়ানোর জায়গা আছে আরও কিছু ৷ ৫ কিলোমিটার দূরে তারকর্লি বিচ ছাড়াও ৪ কিলোমিটার দূরে ওঝর আশ্রমে আছে ব্রহ্মানন্দ স্বামীর সমাধিক্ষেত্র ৷ ১৮ কিলোমিটার দূরে ধামাপুর তালাব দেখতে যাওয়া যেতে পারে বাসে বা অটোরিকশা ভাড়া করে ৷ রোজারিও চার্চ রয়েছে মালবণ শহরের মধ্যেই হাঁটা দূরত্বে ৷ বাজার ছাড়িয়ে শহরের সেই দিকটা বেশ নিরিবিলি ৷ সেদিক দিয়েও হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাওয়া যায় মালবণের সমুদ্রসৈকতে ৷ অনেকগুলো গলিপথ চলে গেছে শহর থেকে সমুদ্রের দিকে ৷ পথের পাশে গাছপালায় ছাওয়া কোঙ্কনি কুটিরে শহরের নিরালা গলিপথগুলোও খুবই আকর্ষণীয় ৷ ঠিক শহর বলে মনে হয় না তখন মালবণকে ৷ গ্রাম্য পরিবেশের আমেজ মিশে থাকে চারপাশে ৷ যেতে যেতে হঠাৎ কোনও জায়গায় দেখা যায় নৌকা সারাইয়ের ব্যস্ততা ৷ পাশেই বিশাল বজরা ঢাকা রয়েছে খড়ের ছইয়ে ৷ বোঝা যায় আবার অন্যপথে এসে পড়া গেছে সমুদ্রের ধারে ৷ একটু এগোতেই বালির তটে এসে এবার দেখা যায় পরপর ছইয়ে ঢাকা বজরার সারি ৷ সামনে রঙিন ছোট নৌকাগুলো যেন জিরিয়ে নিচ্ছে জলকেলির ফাঁকে ৷ ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না ৷ গাছের ছায়ায় ছায়ায় এপথে সেপথে ঘুরেই কেটে যায় সারাবেলা ৷ জেলেদের গ্রামের দিকে গিয়ে পড়লে অনেক সময় অবাক হয় স্থানীয়রা ৷ হয়তো কুটির থেকে বেরিয়ে আসে কোনও জেলের মেয়ে, ‘কৌন পাইজে?’ জিজ্ঞেস করে সুরেলা গলায় ৷ মানে হয়তো, কাকে খুঁজছেন? নির্দিষ্ট কিছু যদি না খোঁজে কোনও ভবঘুরে পর্যটক, কোঙ্কনের সিন্ধুসৈকতে মনে হবে যা আকাঙ্ক্ষিত ছিল তা পাওয়া গেছে ৷
মুম্বই থেকে সিজনে মহারাষ্ট্র পর্যটনের লাক্সারি বাস যায় মালবণ ৷ মুম্বইয়ের নরিম্যান পয়েন্ট থেকে ছাড়ে বিকেল চারটেয় ৷ দাদারে প্রীতম হোটেলের কাছ থেকে ছাড়ে বিকেল পৌনে পাঁচটায় ৷ ভাড়া ২৫০ টাকা ৷ মালবণ থেকে মুম্বই ফেরার বাস ছাড়ে পিম পালপার থেকে ৷ বিকেল তিনটেয় ৷
হোটেল সিন্ধুদুর্গশোভা (এম টি ডি সি অনুমোদিত)
মালবণ, সিন্ধুদুর্গ-৪১৬ ৬০৬ % (০২৩৬৫) ৫২২৬৪
মুম্বই % ৮৩৬৯১৫৫-৮২১৯৬২৬
ভাড়া: ডাবল বেডেড রুম ২৫০ টাকা, ফোর বেডেড রুম ৩০০ টাকা, থ্রি বেডেড রুম ৩৫০ টাকা ৷
ময়ূর লজ
ভাড়া: কমনবাথ থ্রি বেডেড রুম ১০৫ টাকা, ডর্মিটরি ৩৫ টাকা ৷
এছাড়াও হোটেল রয়েছে ওম শ্রদ্ধা লজ, স্বস্তিক প্যালেস, সাহেবা, অঞ্জলি, সেবাঙ্গল, ট্যুরিস্ট, বিনায়ক লজ ৷
তারকর্লি সমুদ্রসৈকতে
এম টি ডি সি টেন্ট রিসর্ট
ডিস্ট্রিক্ট: সিন্ধুদুর্গ, মহারাষ্ট্র % (০২৩৬৫)৫২৩৯০
ভাড়া: ডাবলবেডেড টেন্ট ১৭৫ টাকা, ফোর বেডেড টেন্ট ২৫০ টাকা, এক্সট্রা বেড ২৫ টাকা ৷
ভ্রমণ ডিসেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন