অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
আন্দামান পৌঁছনো থেকেই একটার পর একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হচ্ছিল অবিরাম ৷ নানান সব অদ্ভুত তথ্য জানতে পেরে জায়গাটা লাগছিল যতটা বিচিত্র ততটাই আবার মজার ৷
কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ার উড়োজাহাজে লাগে মাত্র দুঘণ্টা ৷ অথচ মস্ত জাহাজে কালাপানির সমুদ্র পেরিয়ে আন্দামান পৌঁছতে লাগে আস্ত চারটে দিন ৷ বিশাল সে জাহাজে কটা দিন কাটাবার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট রোমাঞ্চকর ৷ উড়োজাহাজের দৌলতে মস্ত জাহাজে চেপে বহুদিন ধরে সমুদ্র পেরিয়ে বিলেত যাবার দরকার এখন আর হয় না ৷ কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের চারদিনের জাহাজ যাত্রাই এখন ভারতবাসীর কাছে জাহাজে চাপার অভিনব অভিজ্ঞতা করার একমাত্র সুযোগ ৷
পোর্ট ব্লেয়ারের অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ি শহর ঘুরতেও ভালো লাগে যথেষ্ট ৷ গাছের আড়াল থেকে তীর ছোড়া কালো আন্দামানিজরা বিদেয় হয়েছে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে বহুদিন হল ৷ এখন এ শহর ঝকঝকে এক আধুনিকা ৷ মেনল্যাণ্ডের সমস্ত পণ্যই আজ শশরীরে হাজির শহরের সব ঝকমকে বিপণন দপ্তরে ৷ মাটিজ থেকে মার্সিডিজ-সবই ছুটছে এখন পোর্ট ব্লেয়ারের উঁচুনিচু রাস্তায় ৷
আবার ঢেউ খেলানো ধানখেতের মধ্য দিয়ে মসৃণ রাস্তা চলে যায় ওয়ান্ডুরের জেটির দিকে ৷ ওখান থেকে ছোট বোটে জলিবয়ের কোরাল দ্বীপে ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা তো ভোলা যায় না জীবনভর ৷ সে যেন জলের তলায় এক স্বপ্নের দেশ ৷ রংবাহারি কোরাল আর অদ্ভুত সব বাহারি মাছের সে যেন প্রকৃতির হাতে গড়া এক শখের বাগান ৷
আন্দামানের আধুনিক ইতিহাস বড়জোর দেড়শো বছরের পুরনো ৷ তার আগের ইতিহাস সবই একেবারে অন্ধকারে ঢাকা ৷ কালো কিছু জংলী মানুষ থাকে ঘন জঙ্গলে ভরা সে সব দ্বীপে, এই ছিল আন্দামান সম্বন্ধে ততদিন পর্যন্ত সভ্য মানুষের জ্ঞান ৷ বহুযুগ ধরে সভ্য দেশের নাবিকেরা আন্দামানের অন্ধকার যুগের সে সব কালো মানুষ দেখেছে দূর সমুদ্র থেকে ৷ সযত্নে তারা এড়িয়ে গেছে সে সব দ্বীপ প্রাণে মরার ভয়ে ৷ এমনকী আন্দামানের আদি মানবদের মানুষখেকো অপবাদ দিতেও তারা ছাড়েনি ৷ বিষমাখা তীর ছোড়ার গপ্পো তো খুবই চালু ৷ অথচ আদিম যুগের সে সব সরল মানুষ তীর ছুড়তে জানলেও বিষের ব্যবহার নাকি এখনও জানে না ৷ নানান কারণে কখনও কখনও মানুষ মারলেও মানুষখেকো অবশ্যই তারা ছিল না ৷ অন্তত এমন কোনও প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি ৷ কিন্তু কে শোনে কার কথা ৷ কত সব রোমাঞ্চকর মানুষ মারার কাহিনী প্রচলিত তাদের ঘিরে ৷ এমন সব গপ্পো নিয়ে সিনেমা বায়োস্কোপও হয়ে গেছে যথারীতি ৷ মোদ্দা কথা, আন্দামান সম্বন্ধে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায়, আস্ত এই আন্দামান ঘিরেই যেন রহস্যের এক মেঘ ৷
তবে মজার কথা হল, পোর্ট ব্লেয়ার থেকে সে সব আদিম জাতির মানুষ আন্দামানিজ আর জারোয়ারা চলে গেলেও জারোয়াদের এখনও দেখা পাওয়া যায় পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ঘণ্টা তিনেকের দূরত্বে ঝিরকাটাং আর বারাটাংয়ের জঙ্গলে ৷ জারোয়াদের জঙ্গল পেরিয়ে আন্দামানের উত্তরের দ্বীপ মায়াবন্দর যাবার পথে মিডল স্ট্রেটের জেটিতে দিব্যি মোলাকাত হয় প্রায়শই এক দল আদি মানব জারোয়ার সঙ্গে ৷ আধুনিক সভ্যতার লজ্জা নামক রোগটি তাদের ছুঁতে পারে না তেমন ৷ তবে সে জারোয়া রাজত্বে পর্যটকদের যাবার নানারকম বিধিনিষেধ এখন প্রয়োগ করা হয়েছে ৷
আন্দামানের এত বৈচিত্র্য থাকা সত্বেও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের যে সব বৃত্তান্ত আমায় সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তা হল নিকোবরের নানান সব অদ্ভুত কাহিনী ৷ পোর্ট ব্লেয়ারে বসেই শুনলাম নিকোবরে নাকি কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিল রানির রাজত্ব ৷ তবে রানির খবর আন্দামানের সবার জানা থাকলেও তার থেকে বেশি তাঁর সম্বন্ধে আর কিছুই জানা নেই আন্দামানের অনেকেরই ৷ রানির গপ্পো শুনে মজা পেলাম যথেষ্ট ৷ নিকোবর সম্বন্ধে শুনলাম আরও নানান সব অদ্ভুত কথা ৷ তবে যাবার ইচ্ছে হলেও নিকোবরের দ্বীপ ঘোরা মুখের কথা নয় ৷ যথেষ্ট রাস্তাঘাট আর বোটের বন্দোবস্ত থাকায় আন্দামানের অনেক জায়গা ঘোরা সম্ভব হলেও নিকোবরের নানান দ্বীপ ঘোরা নেহাতই কষ্টের ৷ সপ্তাহে একবার মাত্র জাহাজ যায় আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার থেকে নিকোবরে ৷ টেন ডিগ্রি চ্যানেলের উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে নিকোবরের জাহাজযাত্রা নেহাত কম কষ্টেরও নয় ৷ আবার অন্তত দিন পনেরো হাতে না থাকলে ও পথে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় ৷ তায় আবার নিকোবরের বারোটা জনবসতিপূর্ণ দ্বীপের এগারোটাই আদিবাসী অধ্যুষিত হওয়ায় পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ ৷ তার মানে এত কষ্টের পরেও নিকোবরের কেবল গ্রেট নিকোবর দ্বীপেই পর্যটকরা যেতে পারেন বিশেষ অনুমতি নিয়ে ৷
আন্দামানের দক্ষিণে অবস্থিত নিকোবরের দ্বীপপুঞ্জ ৷ আন্দামান ও নিকোবরের দ্বীপপুঞ্জকে আলাদা করে একশো পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত টেন ডিগ্রি চ্যানেলের সমুদ্র ৷ ভৌগোলিক কারণে প্রায় সারা বছর ধরেই টেন ডিগ্রি চ্যানেলের সমুদ্র থাকে উত্তাল ৷ বিশাল সব ঢেউয়ের মাথায় জাহাজ এখানে উথালিপাতালি নাচে সারাক্ষণ ৷ তাই টেন ডিগ্রি চ্যানেলের বেজায় বদনাম ৷
আন্দামানের দিক থেকে গেলে টেন ডিগ্রি চ্যানেলের সমুদ্র পার হতে প্রথমেই আসে নিকোবরের কার নিকোবর দ্বীপ ৷ নিকোবরের বাইশটা দ্বীপের বারোটা দ্বীপে মাত্র মানুষের বাস ৷ কোথাও দুশো-পাঁচশো আবার কোনও দ্বীপে হাজার-দুহাজার ৷ তার মধ্যে কেবল কার নিকোবর দ্বীপেই প্রচুর লোকের বাস ৷ প্রায় কুড়ি হাজার নিকোবরি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে অদ্ভুত সুন্দর কার নিকোবর দ্বীপের গোটা পনেরো গ্রামে ৷ নিকোবরের প্রধান দপ্তরও সব এই কার নিকোবর দ্বীপে ৷ তাই সভ্যতার ছোঁয়া কিছুটা হলেও-তাও পৌঁছয় এই কার নিকোবরে ৷ কিছুটা দেরিতে হলেও তাই কার নিকোবরের জীবনযাত্রা অনুসরণ করতে পারে আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের সমাজকে ৷ তবে নিকোবরের অন্য দ্বীপের সঙ্গে সভ্যতার সংস্পর্শ নেহাতই কম ৷ কালেভদ্রে সে সব নিকোবরি আসে পোর্ট ব্লেয়ারে ৷
কার নিকোবরে মোট পনেরোটা গ্রাম ৷ মুস, চুকচুষা, লাপাতি, কিমইউস-মজার সব নাম ৷ সমুদ্রের ধার বরাবর একটা পাকা রাস্তা আছে সারা দ্বীপটা জুড়ে চক্রাকারে ৷ সব গ্রামই ওই রাস্তার ওপরে ৷ দ্বীপের মাঝের অঞ্চলটা জুড়ে নারকোলের বাগান ৷ সব গ্রামেই পড়েছে আধুনিকতার ছাপ ৷ পুরনো নিকোবরি ধাঁচের বাড়ি এখন আর কার নিকোবরে তেমন দেখাই যায় না ৷ গ্রামের অর্ধেক বাড়িই পাকা ৷ মাথার ওপরে অন্তত শক্ত টিনের চাল ৷ বেশ কয়েকটা ঢালাই করা কলামের খোলে বানানো বাড়ি ৷ অথচ পুরনো ধাঁচের নিকোবরি হাটের গঠন ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ ৷ কার নিকোবরে তাদের বাকি আছে মাত্র কয়েকটা ৷ আরংয়ের গ্রামের মাঝে দেখেছিলাম একটা ৷ তবে দুর্গম সব দ্বীপে অমন বাড়ি এখনও যথেষ্ট আছে ৷ শক্তপোক্ত খুঁটির ওপর বানানো অর্ধ গোলাকার গঠন তার ৷ দূর থেকে দেখে মনে হয় বুঝি বা খড়ের চাল ৷ অথচ ধান তো নিকোবরে তেমন হয় না, খড় আসবে কোথা থেকে ৷ হবে হয়তো কোনও গাছের শুকনো পাতায় ছাওয়া ৷
প্রতিটা গ্রামেই আর আছে সুন্দর বড় স্কুল ৷ বিশাল সব মাঠ প্রায় প্রতিটা স্কুলের প্রাঙ্গণেই ৷ মুস গ্রামের চার্চ আবার সবচেয়ে বিখ্যাত ৷ ফাদার রিচার্ডসনের গ্রাম মুসের থেকে ক্রিশ্চান ধর্ম ছড়ায় সারা নিকোবরে ৷ ফাদার রিচার্ডসন নিকোবরের এক কিংবদন্তী পুরুষ ৷ তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে একদিকে যেমন নিকোবরে হয় শিক্ষার প্রসার-তেমনই আবার নিকোবরের সমস্ত দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে ক্রিশ্চান ধর্ম ৷ নিকোবরের নানান দ্বীপে ফাদার রিচার্ডসনের আমল থেকেই শিক্ষার এমনই প্রসার হয় যে নিকোবরিরা আন্দামানের অন্য সব উপজাতির থেকে এগিয়ে যায় অনেক ৷ আজ তারা পড়াশুনো শিখে একরকম সভ্য জগতের বাসিন্দা ৷ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারও হয়েছে কয়েকজন তাদের মধ্যে দিব্ব্যি ৷
সংসারের সবাই মিলে একসঙ্গে থাকাই নিকোবরি সমাজের রীতি ৷ তাদের সম্পত্তিও থাকে সব একসঙ্গে ৷ সারা পরিবারের শুয়োর, নারকোলের বাগান সবই থাকে একসঙ্গে ৷ আজও তারা পছন্দ করে না বাইরের লোকের তাদের দ্বীপে বিশেষ যাওয়া আসা ৷
কার নিকোবর দ্বীপ ছাড়িয়ে কিছুদূর যেতে ঘন নীল সমুদ্রের মাঝে আসে অপূর্ব সুন্দর চওড়া দ্বীপ ৷ সবুজ দ্বীপের চারদিকে ঘন নীল সমুদ্রের জল আছড়ে পড়ে গড়িয়ে যায়, সাদা ফেনা হয় ৷ সে কোরাল দ্বীপের সমুদ্রের রঙের বাহার সারা জীবনে ভোলার নয় ৷ সর্বসাকুল্যে হাজার খানেক লোকের বাস সে দ্বীপের ছড়িয়ে থাকা কটা গ্রামে ৷
আন্দামানে ভারতীয় পর্যটকদের যথেচ্ছ ঘোরার স্বাধীনতা থাকলেও নিকোবর প্রায় নিষিদ্ধ ৷ বিশেষ কারণ বিনা নিকোবরের দ্বীপগুলোয় এমনকী ভারতীয়দেরও অনুমতি ছাড়া যাওয়া মানা ৷ তবে নিকোবরের একমাত্র গ্রেট নিকোবর দ্বীপে পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় ৷ আসলে গ্রেট নিকোবরে কিছু প্রাক্তন সৈনিক সেটলার্সদের বসানো হয়েছে কিছুকাল হল ৷ নিকোবরের অন্যান্য দ্বীপে শুধুই নিকোবরি উপজাতীদের বাস ৷ তবে নিকোবরকে পর্যটকদের জন্য খুলে দেবার কথা ভাবা হচ্ছে কিছুদিন হল ৷
সহস্রাব্দের গোড়ায় নিকোবরের কাছাল দ্বীপের সূর্যোদয় হুলস্থূল ফেলে দিয়েছিল জগৎ জুড়ে ৷ পৃথিবীর যে কয়েকটা জায়গা থেকে সহস্রাব্দের প্রথম সূর্যোদয় দেখা গিয়েছিল তার মধ্যে সুদূর নিকোবরের অখ্যাত এই কাছাল দ্বীপও ছিল ৷ সেই সুবাদে কাছাল দ্বীপের পৃথিবীর পর্যটন মানচিত্রে জায়গা পাওয়া ৷ তবু তখনও পর্যটকদের কাছাল দ্বীপে নামতে দেওয়া হয়নি ৷ মস্ত স্বরাজ দ্বীপ থেকে জাহাজে করে পর্যটকদের কাছাল দ্বীপের কাছে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে রাখা হয় সমুদ্রের মাঝে ৷ ওখান থেকেই দেখেন তাঁরা বিখ্যাত সেই সূর্যোদয় ৷
চওরা ছাড়িয়ে টেরেসার লম্বা ঘাসবনে ভরা দ্বীপ পার হতেই আসে কাছাল দ্বীপ ৷ মিলেনিয়াম সান রাইজের আগে কখনও শুনিনি সে দুর্গম দ্বীপের কথা ৷ অথচ জাহাজ জেটিতে ভেড়ার আগেই মন ভরে যায় তার অপূর্ব সৌন্দর্যে ৷ দ্বীপের চারদিকেই জলের তলায় কোরালের বন ৷ দ্বীপের চারদিক জুড়ে বেশ কয়েকটা সোনালি বালির সৈকত ৷ নীল-সবুজ জল আছড়ে পড়ছে তারই আঁচলে ৷ প্রায় হাজার পাঁচেক নিকোবরি আদিবাসীর বাস এই কাছালের দ্বীপময় ছড়িয়ে থাকা নানান গ্রামে ৷
কাছাল দ্বীপের পূর্বে দেখা যায় বিশাল এক দ্বীপ ৷ অথচ আস্তে আস্তে তার কাছে গেলে বোঝা যায় ওখানে তিনটে দ্বীপ একসঙ্গে কাছাকাছি থাকায় অমন বড় দেখায় ৷ ওদেরই একসঙ্গে বলা হয় নানকৌড়ির দ্বীপ ৷ শুনেছি কিছুদিন আগে পর্যন্ত ওখানে ছিল নানকৌড়ির রানির রাজত্ব ৷ তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বীপটার নাম কামোর্তা, আর তার পূর্বে ট্রিনকেট ৷ কামোর্তার পশ্চিমে মাত্র মাইলখানেক দূরেই আরেকটা ছোট দ্বীপ ৷ হয়তো সেই দ্বীপেরই নাম একসময় ছিল নানকৌড়ি ৷ এখন স্থানীয় লোকেরা বলে চ্যাম্পিয়ন ৷ ওখানেই রানি পরিবারের বাড়ি ৷ অথচ অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না চ্যাম্পিয়ন দ্বীপের নাম ৷ ওখানকার তিনটে দ্বীপকে একসঙ্গে বলা হয় নানকৌড়ির দ্বীপ ৷
নানকৌড়ির রানি লছমির একসময় এ অঞ্চলে ছিল বেজায় প্রতিপত্তি ৷ এমনকী ভারতের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীরা আন্দামানে সফরে এলে-একবার অন্তত যেতেন নানকৌড়ির দ্বীপে রানি লছমির সঙ্গে দেখা করতে ৷ বছর দশেক আগে তাঁর মৃত্যুর পর এখন অবশ্য তাদের আর সে রমরমা নেই ৷
নানকৌড়ির দ্বীপ ছাড়াতেই এসে পড়ে জঙ্গলে ভরা লিটল নিকোবর দ্বীপ ৷ থাকে কিছু নিকোবরি অধিবাসী সে দুর্গম দ্বীপেও ৷ পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আসা জাহাজও ভেড়ে সেখানে মাসে দু-তিনবার ৷ জঙ্গল পাহাড়ের মধ্যে দিব্ব্যি আছে সুখী মানুষ সে সব গ্রামে ৷ আপন ছন্দে চলেছে তাদের জীবনযাত্রা ৷ আশপাশে আরও বেশ কয়েকটা দ্বীপ আছে সমুদ্রের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ৷ সুন্দর সোনালি সৈকত তাদের চারদিকে ৷ সে সব দ্বীপের নামও ভালো করে জানে না অনেকেই ৷ ম্যাপের থেকেও উদ্ধার করা তেমন সহজ নয় ৷ জনমানব থাকে না সেখানে ৷ হয়তো বা মিষ্টি জলের কোনও প্রস্রবণ না থাকায় ৷
অবশেষে জাহাজ ভেড়ে নিকোবরে তার অন্তিম গন্তব্য গ্রেট নিকোবর দ্বীপে ৷ বিশাল এই গ্রেট নিকোবর দ্বীপই ভারতের শেষ দ্বীপ ৷ গ্রেট নিকোবরের দক্ষিণতম অংশ বা পিগমেলিয়ান পয়েন্টই ভারতের দক্ষিণতম ভূখণ্ড ৷ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে এই অঞ্চলের নতুন নামকরণ হয়েছে ইন্দিরা পয়েন্ট ৷ কন্যাকুমারীর অনেক দক্ষিণে অবস্থিত এই অঞ্চল ৷ তাই কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রক ভারতের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণতম বিন্দু হলেও এই ইন্দিরা পয়েন্টই হল ভৌগোলিক ভাবে ভারতের দক্ষিণতম অঞ্চল ৷
গ্রেট নিকোবর দ্বীপের জেটি অঞ্চলের নাম ক্যাম্বেল-বে ৷ আন্দামানবাসীর কাছে তাই গ্রেট নিকোবর ক্যাম্বেল-বে নামেই পরিচিত ৷ সর্বসাকুল্যে হাজার সাতেক লোকের বাস এই দ্বীপে ৷ তার মধ্যে ক্যাম্বেল-বে’র লোকালয়েই থাকে হাজার চারেক মানুষ ৷ স্কুল, ছোট হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, অফিস-কাছারি মিলে ক্যাম্বেল-বে’ই গ্রেট নিকোবরের প্রাণকেন্দ্র ৷ দুটো পিচরাস্তা যায় ক্যাম্বেল-বে থেকে দুদিকে ৷ একটা যায় সমুদ্রের ধার বরাবর দক্ষিণে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে ইন্দিরা পয়েন্টে ৷ আর অন্যটা যায় জঙ্গল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে পশ্চিম উপকূলে নিকোবরি গ্রাম কোপেনহিটে ৷ ইন্দিরা পয়েন্টের রাস্তায় তাও কিছু লোকবসতি থাকায় গাড়ি-বাস যায় দিনের মধ্যে মাঝে মাঝে ৷ কোপেনহিটের রাস্তায় গাড়ি যায় নেহাতই কদাচিৎ ৷
ঊনসত্তর সালে কিছু প্রাক্তন সেনানীকে এনে বসানো হয় ভারতের দক্ষিণের শেষ দ্বীপ এই গ্রেট নিকোবরে ৷ পাঞ্জাব, কেরালা, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র থেকে আসা সেসব প্রাক্তন সেনানীদের সেটেলমেন্ট সমুদ্র বরাবর ইন্দিরা পয়েন্টের রাস্তায় ৷ প্রথম ক’বছর প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হলেও আজ তাঁরা যথেষ্ট সচ্ছল ৷ দেদার নারকোল আর সুপারি ফলে তাঁদের খেতে ৷ ভারতের মেনল্যান্ড থেকে ব্যবসায়ীরা এসে নিয়ে যায় তাঁদের ফসল ৷ ঘরে বসেই দিব্ব্যি বেচে দেন তাঁরা সারা বছরের ফসল ৷ বাসরাস্তার ওপর ছোট ছোট পাকা বাড়ির মাথায় ডিস অ্যান্টেনার বহর দেখলেই অনুমান করা যায় তাঁদের আজকের স্বচ্ছলতা ৷ তবে যাতায়াতের নেহাতই অসুবিধে সেই দুর্গম দ্বীপ থেকে ৷ মাসে সর্বসাকুল্যে তিনটে অথবা চারটে বোট যায় ক্যাম্বেল-বে থেকে পোর্ট ব্লেয়ারে ৷ পথের অন্যান্য দ্বীপ ছুঁয়ে সে জাহাজের পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে লাগে দিন তিনেক ৷ বড় হাসপাতাল, বাজার বলতে সবই পোর্ট ব্লেয়ারে ৷ এখন অবশ্য মাঝে মধ্যে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে চেন্নাই যাবার পথে দুয়েকটা বড় জাহাজ ছুঁয়ে যায় গ্রেট নিকোবরের ক্যাম্বেল-বের জেটি ৷ সহজেই তখন যাওয়া যায় মেনল্যান্ডের চেন্নাই শহরে মাত্র দুদিনে ৷
ইন্দিরা পয়েন্টের লাইটহাউসের মাথায় দাঁড়ালে দেখা যায় আরেক অপূর্ব দৃশ্য ৷ দক্ষিণের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলে মনে হয় ওই তো দেখা যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার দ্বীপ ৷ আসলে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের দূরত্ব ইন্দিরা পয়েন্ট থেকে মাত্র নব্বই মাইল ৷ ভারত স্বাধীন হবার আগে ওখান থেকেই দিশি নৌকা আসত নিকোবরের থেকে নারকোল নিয়ে যেতে ৷ নিকোবরের আদিবাসীরাও হয়তো এসেছে অমন ভাবে ৷ নিকোবরের দুটো উপজাতি নিকোবরি আর শম্পেনরা মঙ্গলয়েড শ্রেণীভুক্ত ৷ ধরা হয় মালয়, ইন্দোনেশিয়া আর বর্মার দিক থেকেই তাদের আবির্ভাব ৷ ওসব অঞ্চলের সঙ্গে নিকোবরের যোগসূত্র প্রাচীনকাল থেকেই ৷
ক্যাম্বেল-বে থেকে ইন্দিরা পয়েন্টের রাস্তার মাঝে পড়ে গ্যালাথিয়া জাতীয় উদ্যান ৷ গ্যালাথিয়া নদী এখানে সাউথ-বের সৈকতে গিয়ে মেশে সমুদ্রে ৷ গ্যালাথিয়া নদী বেয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে গা সিরসির করে ৷ বিশাল সব নোনা জলের কুমিরের বাস সে জলে ৷ আবার সাউথ-বে সৈকতে শীতের রাতে ডিম পাড়তে আসে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক কচ্ছপের দল ৷ বাহারি নাম তাদের জায়েন্ট লেদার ব্যাক টার্টল ৷ ওজনে তারা অনায়াসে একেকটা পাঁচশো-ছশো কেজি ৷ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির শীতের সময় মাঝরাতে ওঠে তারা সৈকতের বালিতে সন্তর্পণে ডিম পাড়তে ৷ রাত জেগে প্রকৃতির সে সব কাণ্ড কারখানা দেখতে মজা লাগে নিশ্চয়ই, তবে তার ঝক্কি কিছু কম নয় ৷ একে তো শীতের সময় পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ক্যাম্বেল-বে ঘুরে আসাই প্রায় দশ-পনেরো দিনের ধাক্কা ৷ তায় ক্যাম্বেল-বের হাতে গোনা তিন-চারটে গাড়ির মধ্যে বন্দোবস্ত করে রাত সৈকতে কাটিয়ে আসা মুখের কথা নয় ৷ নাছোড়বান্দা প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটকদের জন্য ক্যাম্বেল-বে যাবার অনুমতি দেওয়া হলেও ট্যুরিজম বন্দোবস্ত ওখানে একেবারেই নেই ৷ অবশ্য ক’ঘরের APWD বাংলো আছে একটা থাকার জন্য ৷
গ্রেট নিকোবরের জঙ্গলে থাকে শ’তিনেক শম্পেন আদিবাসী ৷ গ্যালাথিয়া নদীর দুদিকের ঘন জঙ্গলের মধ্যেই তাদের বাস ৷ চাষবাসের ধার ধারে না তারা ৷ জঙ্গলের ফল-মূল, মধু-সুপারিই তাদের খাদ্য ৷ আর আছে সমুদ্রের অফুরন্ত মাছ ৷ বহু বছর চেষ্টা করেও তাদের সভ্য জগতের মাঝে টেনে আনা যায়নি ৷ এমনকী বিপদে-আপদেও তারা ক্যাম্বেল-বের লোকালয়ে আসতে নারাজ ৷ কয়েকশো বছর ধরে সভ্য মানুষের কাছে থেকেও তারা পছন্দ করেছে জঙ্গলের আদিম জীবন ৷ হয়তো বা তথাকথিক সভ্য মানুষের অসভ্য আচরণে তারা ভরসা করতে পারে না তেমন ৷ ফিরে যায় তারা তাই প্রকৃতির কোলে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন