অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
জয়সলমির থেকে ট্রেকিং শুরু হবে থর মরুভূমির অভ্যন্তরে ৷ পুরোটাই হেঁটে যাব, উটও অবশ্য থাকবে-মালপত্র বওয়া আর পথ দেখানোর জন্য ৷
থর মরুভূমির সব মানুষই জাঠ ৷ লোকসংখ্যা খুবই কম, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ছজন ৷ গ্রেট গ্লোবাল ডেজার্ট বেল্টের মধ্যেই এই থর ৷ আয়তন ২,১৩,০০০ বর্গ কিলোমিটার ৷ ভৌগোলিক দিক থেকে যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনই ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী এই থর মরুভূমি ৷
নানারকম ভয় আর ভাবনা আমাদের ছিল ৷ ফেব্রুয়ারি মাসেও দিনে প্রচণ্ড গরম ৷ আর রাতে তেমনই ঠান্ডা ৷ সূর্যের তাপ ফেব্রুয়ারিতে মাঝে মধ্যে দেখায় ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত ৷ রাতে শূন্য ডিগ্রির নিচে ৷ তাপমাত্রার এত হেরফের শরীরে সহ্য হবে কিনা এই ভাবনা ভীষণভাবে ছিল ৷ শেষে সানস্ট্রোক হবে না তো ৷ মরুভূমির ভেতর একরকম সাপ আছে ৷ ডেজার্ট স্নেক ৷ হলুদ রঙের দেখতে ৷ বালির মধ্যে লুকিয়ে থাকে শুধু মুখটা বাড়িয়ে ৷ খুব বিষাক্ত ৷ আর শিকার পেলেই লাফিয়ে আক্রমণ করে ৷ ওদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে ৷ আছে জলের সমস্যা ৷ মরুভূমিতে যে জল সহজলভ্য হবে না সে কথা জানাই ছিল ৷ আছে বালির ঝড় ৷ একবার ভালোভাবে উঠলেই সর্বনাশ ৷ উটকে ধরে জড়িয়ে বসে থাকা ৷ আর যদি উড়িয়ে নিয়ে যায় তাহলে নিশ্চিতভাবেই ফেরা সম্ভব নয় ৷ অচেনা অজানা মোহময়ী প্রকৃতি ৷ পথে পার হতে হবে বিশাল বিশাল বালিয়াড়ি ৷ স্যান্ড ডিউনস ৷ আর এইসব বালিয়াড়িতে বরফের মতো ফাটল (Crevasse) আছে ৷ একবার যদি চোরাবালিতে ঢুকে যাই তবে এ যাত্রা শেষ ৷ আছে চোরাচালানকারীর দল ৷ সীমান্ত লাগোয়া ৷ আর আছে ডাকাত ৷ কিন্তু এত ভাবলে তো চলবে না ৷
ট্রেনে দিল্লি এসে যোধপুর না গিয়ে গেলাম বিকানির ৷ ওখান থেকে রাতের বাসে চেপে জয়সলমির ৷ দূরত্ব ৩২৮ কিলোমিটার ৷ জয়সলমির যখন এলাম তখন ভোর হচ্ছে ৷ বিশাল হলুদ এক ভূখণ্ড ৷ বালির ঢিপি পাহাড় ৷ কাঁটাগাছের মরুঝোপ ৷ থর মরুভূমির পুরনো মরূদ্যান নগরী জয়সলমির ৷ ১৫৫৬ সালে ভাটিবংশের বংশধর রাজা রাওয়াল জয়সওয়াল এই নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ৷ ত্রিকূট বেলে পাহাড়ে পাথরের দুর্গ, প্রাসাদ ৷ বাড়িঘরদোর সবই হলুদ ৷ বিদেশি ট্যুরিস্টদের ভীষণ পছন্দ এই মরুশহরকে ৷ জয়সলমিরে প্রচুর হাভেলি আছে ৷ আর এই হাভেলি দেখার মতো ৷ বেনারসের মতো সব গলি ৷ তারই মাঝে অকল্পনীয় কারুকার্য করা সব হাভেলি ৷ পাঁচতলা অপূর্ব জাফরির কাজ করা পাটোয়া কি হাভেলি ৷ সালিম সিংহ কি হাভেলি ৷ নাথমলজি কি হাভেলি ৷ ভেতরের দেওয়ালে সব মিনিয়েচারের ছবি ভর্তি ৷ তার মাঝে মাঝে রাস্তার ফাঁক দিয়ে অতন্ত্রপ্রহরী কেল্লার দিকে নজর ৷ ত্রিকূট বেলে পাহাড়ের ৭৬ মিটার উঁচুতে এই দুর্গ নির্মিত ৷ দুর্গটি প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীরে ঘেরা ৷ ভেতরে অসংখ্য মানুষের বাস আর দ্রষ্টব্য স্থান ৷ আছে রাজস্থানিদের রংচঙে জামাকাপড়, শাড়ির দোকান ৷ হস্তশিল্পের দোকান ৷ মনিহারীর দোকান ৷ ওপর থেকে শহরটা দেখতে বেশ মজাই লাগে ৷ সবই হলুদ ৷ আর ঘিঞ্জিও বটে ৷
জয়সলমিরের কালেক্টরের সঙ্গে দেখা করে আমরা ট্রেকিং রুটের অনুমতিপত্র নিলাম ৷ জয়সলমিরের মরুতে ট্রেকিং করতে গেলে অনুমতি নেওয়া এই কারণে প্রয়োজন যে, এটা সীমান্ত এলাকা ৷ পাকিস্তানি বর্ডার খুব বেশি দূরে নয় ৷ তাই সব মিলিয়ে মিলিটারি তৎপরতা এর আশপাশে প্রায়শই দেখা যায় ৷ আর কালেক্টর সাহেব জানালেন, আপনারা সাবধানে চলাফেরা করবেন ৷ আর উটওয়ালাদের কথা শুনবেন ৷
পরদিন দুপুরের পর উটওয়ালারা এল ৷ একজনের নাম আকবর আরেকজনের মহম্মদ ৷ মালপত্র সব উটের পিঠে চড়ানো হল ৷ উটরা নিজেরা ৮০ কেজি করে দানা নিয়েছে নিজেদের জন্য ৷ মহম্মদ আর আকবর টেন্টে শোবে না ৷ উটওয়ালারা নাকি কেউই টেন্টে শোয় না ৷ উট নাকি খুব চুরি হয় ৷ তাই উটকে পাহারা দিতে হয় ৷ ঠান্ডার মধ্যে খোলা আকাশে শোবার সরঞ্জাম-তাই বেশ বেশি ৷ ৫-৭ খানা করে লেপ আর কম্বল ৷ টেন্ট আর কাঁচাবাজার তুলতেই পিঠ ভর্তি ৷ বাসনপত্র আছে ৷ অন্যান্য খাবারদাবারও রয়েছে ৷ শেষে অতিকষ্টে সব তোলা হল ৷ আমার নিজের ইচ্ছে ছিল মাঝেমধ্যে উটের পিঠে উঠব ৷ তার কী হবে? একে তো দোতলার মতো উঁচু, তার ওপর মালপত্তর ৷ যাইহোক, ওদের সঙ্গে আগে আলাপ হোক ৷ কয়েকদিন চলি ৷ পরে দেখা যাবে কী করা হবে ৷
ডাকবাংলো আর সোনার কেল্লা পিছনে ফেলে কালো পিচঢালা রাস্তা দিয়ে প্রথমে আমাদের যাত্রা শুরু ৷ কিছুক্ষণ হাঁটার পর রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়লাম একরাশ জমাট শক্ত বালির মধ্যে ৷ আমরা যাব কুলধেরা ৷ রাস্তা প্রায় ১৮ কিলোমিটার ৷ কুলধেরা হল একটা পুরনো ধ্বংসাবশেষ নগরী ৷ মৃণাল সেন তাঁর ‘জেনেসিস’ ছবির শ্যুটিং এখানে করেছিলেন ৷ কুলধেরার একটু দূরেই মূলসাগর ৷ অবশ্য তখন সেখানে জল নেই ৷ আস্তে আস্তেই আমরা চলেছি ৷ পাহাড়ি রাস্তা ৷ একপাশে একটু খাদও আছে ৷ শক্ত পাথুরে জমি ৷ সন্ধ্যা নামল ৷ কিন্তু টর্চের প্রয়োজন হল না ৷ চারপাশ যেন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে ৷ আমাদের তিনটে উট ৷ এরমধ্যেই ওদের নাম জেনে গেছি ৷ কালা, ধলা আর মরু ৷ দিকনির্ণয় করা বেশ মুশকিল ৷ সেই অর্থে কোনও রাস্তা নেই ৷ কিন্তু উটওয়ালারা ঠিক চিনতে পারে ৷ দিনের পর দিন রুক্ষ মরুভূমিতে পথ চিনে চলতে ওদের কোনও অসুবিধা হয় না ৷ ওরা জানে কোথায় জল, কোথায় উটের খাবার, কোথায় থামতে হবে ৷ এই উটওয়ালাদের এখানে বলা হয় রাইকা ৷ রাজস্থানি লোকগীতিতে প্রায়শই রাইকাদের কথা শোনা যায় ৷ মরুভূমিতে এদের দেবদূত হিসাবে মনে করা হয় ৷ আমাদের রাইকা মহম্মদ আর আকবর ৷ সবাই গল্প করতে করতে চলেছি ৷ শুধু একবার ওরা বলল, তোমাদের হেঁটে চলার অভ্যাস নেই ৷ তাই কত সময় লাগবে বুঝতে পারছি না ৷ তোমরা উটের পিঠে না চড়ে হেঁটে যাচ্ছ কেন? আরও দুটি নিলে ভালো হত ৷ তাহলে বেশ তাড়াতাড়ি চলা যেত ৷ এ কেন-র উত্তর আমাদের জানা ছিল না ৷ তাড়াতাড়িই বা চাই না কেন তাও জানি না বলতে ওদের কী হাসি ৷ জায়গার নাম মনপিয়া ৷ বেশ মিষ্টি নাম ৷ এখন রাত ৯টা ৷ আর ২ কিলোমিটার দূরে কুলধেরা ৷ হঠাৎ মহম্মদ জানায়, এখানে জল আছে ৷ কুলধেরা যাব না ৷ ওখানে জল পাওয়া মুশকিল ৷ যদিও আমরা জেনেছিলাম কুলধেরাতে একটা পরিবার থাকে ৷ জলও আছে ৷ কিন্তু কিছু বলার আগেই ওরা মালপত্র নামিয়ে ফেলল ৷ অগত্যা ৷ একবার মনে হয়, পথে কোনও গোলমাল নেই তো! ফাঁকা মাঠে টেন্ট ৷ ফাটাফুটি জমি ৷ সাপের ভয় আছে ৷ তাই ভালো করে কার্বোলিক অ্যাসিড টেন্টের পাশে ছড়িয়ে দিয়ে রাত কাটানো ৷ রাতে বেশ ঠান্ডা ৷ এমনিতে মরুভূমিতে সকাল বেশ দেরিতে হয় ৷ ৭টার পর সূর্য উঠল ৷ রেডি হয়ে বেরোতে বেরোতে ৯টা ৷ রোদের তাপ এর মধ্যে বেশ গরম ৷ এল কুলধেরা ৷ একটা ফ্যামিলি ওই ধ্বংসাবশেষ নগরীর মধ্যে রয়েছে ৷ জলও আছে ৷ কেন রাতে ওরা এখানে এল না বুঝলাম না তখন ৷ বেশ কিছুক্ষণ ওই খণ্ডহরের মধ্যে ঘুরে আবার পথ চলা ৷ চারদিকে অন্তহীন বালির সমুদ্র ৷ প্রাণের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই ৷ শুধু কিছু কাঁটাঝোপ ৷ নিঃস্তব্ধ চারপাশে ৷ কুলধেরা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে বজরা কি ধানি ৷ ধানি অর্থে খুব ছোট্ট গ্রাম ৷ ওর ১ কিলোমিটার আগে এক গাছতলায় থামা হল ৷ দুপুরের বিশ্রাম ৷ রান্না করা ৷ রোদের তাপ একটু কমলে পথ চলা শুরু আবার ৷ যাব ৮ কিলোমিটার আরও ৷ যাত্রা শেষ সততা গ্রামে ৷ সততার কিছু আগে উটওয়ালাদের রাত্রিকালীন এক থামার জায়গায় আকবর থেমে গেল ৷ এখানে জলও আছে ৷ সুতরাং আজ এখানেই বিরতি ৷ আর তাছাড়া গ্রামে রাতে গেলে কোথায় থাকব ঠিক নেই ৷ উটও চুরি যেতে পারে ৷ প্রতিদিনই এরকম হত ৷ প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি ৷ শেষে বুঝেছিলাম ওই গ্রামগুলো হিন্দু গ্রাম ৷ ওরা মুসলমান ৷ তাই যেতে চায়নি ৷ এ এক গেরো ৷ কিন্তু কিছু করার নেই ৷ তবে উট চুরির ঘটনা সত্য ৷ আর এখন ফিরে এসে মনে হয়েছে একপক্ষে ভালোই হয়েছে ৷ নিরালায় থাকা গেছে ৷
রাতে ভালোই ঠান্ডা ছিল ৷ সকালে ২ কিলোমিটার হাঁটার পর এল সততা গ্রাম ৷ ছোট্ট ৷ ছবির মতো রংচঙে সাজানো গ্রাম ৷ নানা রঙিন নকশা আঁকা ঘরদোরগুলোতে ৷ মরুভূমির ভেতর এত সুন্দর বাড়ি দেখে রাস্তা ছেড়ে গ্রামের দিকে পা বাড়াই ৷ দেখি একদল মেয়ে প্রজাপতির মতো নানা রঙের শাড়ি-জামাকাপড় পরে জল আনছিল ৷ সারা মরুভূমিতে দেখেছি মেয়েদের এটাই একমাত্র কাজ ৷ জল আনা ৷ কতদূর থেকে যে জল আনতে হয় কী বলব ৷ আর জল তোলার সময়ে গল্প করা ৷ মেয়েগুলোকে সুন্দর দেখতে ৷ কিন্তু হঠাৎ আমাদের দেখতে পেয়ে কলসি রেখে ভাগো বলে পালাল ৷ মাথাতে কিছুই এল না ৷ আমরা কি চোরডাকাত ৷ পরে শুনেছিলাম ওরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল ৷
আস্তে আস্তে গ্রামে গিয়ে বসলাম ৷ জল খেলাম ৷ পরিস্থিতি একটু সহজ হল ৷ একজন বয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞাসা করলাম, মরুতে আমরা জানি তো সাদা জামাকাড় পরতে হয় ৷ তো তোমরা এত রঙিন জামাকাপড় পরো কেন ৷ উত্তরে তিনি বললেন, হারিয়ে যাবার ভয় থাকে তো ৷ তাই উজ্জ্বল জামাকাপড় মেয়েরা পরে ৷ যাতে দূর থেকে বোঝা যায় ৷ তার সবচেয়ে বড় কারণ হল, এখানে তো শুধু বালি হলদে ৷ ফ্যাকাসে ৷ চোখে হলুদের ঘোর লাগে ৷ গ্রাম ছেড়ে তো কেউই বড় একটা বেরোয় না ৷ দুয়েকজন ছাড়া ৷ তাই রঙের অন্ধতায় সবাই ভোগে ৷ এইসব লাল-নীল-সবুজ দেখে ওরা রং চেনে ৷ জানে পৃথিবীটা শুধুই হলুদ নয় ৷ সাত রঙে উজ্জ্বল ৷ আর উজ্জ্বলতার প্রতীক হিসাবে আমরা রং পছন্দ করি ৷ ঘরদোর থেকে নিজেদের সবাই সাজিয়ে রাখতে তাই ভালোবাসি ৷ বিবর্ণ প্রকৃতিকে আমরা পোশাকের উজ্জ্বল রঙে সাজিয়ে তুলি ৷ এমনকী আমাদের পাগড়িও উজ্জ্বল রঙের ৷ এই যে পাগড়ি এর আবার বাঁধার রকমফের আছে কিন্তু ৷ সাধারণ ৮ মিটার দৈর্ঘ্যের কাপড় হয় পাগড়ির ৷ পাগড়ি বাঁধার স্টাইল দেখে বোঝা যায় লোকটি কোন জেলার ৷ কী জাত ৷ সমাজে তার অবস্থান ৷ সব কিছু ৷ বেশ মজার লাগছিল কথা বলতে ৷ অনেক কিছু জানা গেল ৷
বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা শুরু ৷ রোদ্দুরে সব যেন জ্বলে যাচ্ছে ৷ ৬ কিলোমিটার পর এল জিরাজে কি ধানি বলে এক জায়গা ৷ বিশ্রাম ৷ খিচুড়ি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন ৷ প্রচুর পেঁয়াজ খাওয়া ৷ পেঁয়াজ খেলে শরীর ঠান্ডা করে ৷ আর চিনি দিয়ে নুন জল ৷ তবে জল খাওয়া উচিত সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিয়ে ৷ একটু হেরফের করলে সানস্ট্রোক ৷ বা মাথাঘোরা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া ৷
খাওয়া সেরে আবার হাঁটা ৷ যাব খুরি ৷ খুরিতে প্রচুর লোকসংস্কৃতির মানুষ আছে ৷ স্যান্ড ডিউনস এলাকা ৷ হিন্দি সিনেমার শ্যুটিং এখানে মাঝেমধ্যে হয় ৷ তাই হোটেল আছে দুয়েকটা ৷ বিদেশিরাও আসে ৷ তবে অন্য পথে ৷ গাড়ি যাবার রাস্তা আছে ৷ আমাদের পা বালিতে বসে যাচ্ছে ৷ প্রচণ্ড দম লাগে ৷ বেশ কষ্টের ৷ পুরীর সমুদ্রতটে গরম দুপুর রোদ্দুরে একটু স্বর্গদ্বার থেকে চক্রতীর্থ শুকনো বালির মধ্যে হেঁটে দেখলেই আর আমার লিখে বোঝানোর প্রয়োজন হবে না ৷
এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধে হল ৷ সন্ধের মুখে ওই বালিয়াড়িই হয়ে উঠল নন্দনকানন ৷ আকাশের রং সূর্যাস্তের জন্য লাল ও বেগুনি, না সব মিলিয়ে অন্য কিছু, কিছুই বলতে পারব না ৷ অপূর্ব ৷ মরুভূমিতে সূর্যাস্তের কথা অনেক শুনেছি ৷ এই প্রথম দেখলাম বালিয়াড়ির ওপর ৷ ভাষা নেই তা প্রকাশের, নিরালা নিঃঝুম চারপাশ ৷ শুধু উটের পায়ের পদধ্বনিতে ছন্দ ৷
খুরি ১২ কিলোমিটার ৷ শেষপর্যন্ত খুরি এল না ৷ অনেক রাত হয়ে গেছে ৷ খুরির কিছু আগে এক জলের জায়গায় হল রাত্রিকালীন বিরতি ৷ সকালে কিছুক্ষণ হাঁটার পরই এল খুরি ৷ বেশ গ্রামটা ৷ কিছুক্ষণ গ্রাম দেখে আবার বেরিয়ে পড়া ৷ আজ আমাদের পথ ১৬ কিলোমিটার ৷ সুদাসরি ৷ ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্ক ৷ রোদ্দুরের মধ্যে ভারনা হয়ে সুদাসরি যখন এল তখন প্রায় সন্ধে ৷ আজ ছিল বীভৎস গরম ৷ লু-র চোটে শরীর বেশ কাহিল ৷ কিন্তু সুদাসরি হল ন্যাশনাল পার্ক ৷ তাই মাটির ট্যুরিস্ট ঘর আছে ৷ আমরা জয়সলমির থেকে পার্কে প্রবেশের অনুমতিপত্র নিয়ে এসেছি ৷ তাই আজ আর টেন্টে নয়, বাংলোতে থাকব ৷
৩,০২৫ স্কোয়্যার কিলোমিটার এরিয়া নিয়ে এই ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্ক ৷ এই ন্যাশনাল পার্কের সঙ্গে অন্য কোনও ন্যাশনাল পার্কের মিল নেই ৷ মরুভূমির মধ্যে এর মেজাজটাই আলাদা ৷ সকালবেলায় আমরা প্রথমেই দেখলাম সেই বিখ্যাত পাখি গ্রেট ইন্ডিয়ান বার্স্টাড ৷ স্থানীয় নাম গোরানা ৷ এখন এই পাখি প্রায় নিশ্চিহ্ন ৷ কারণ জ্যান্ত এই পাখির দাম বিদেশে প্রচুর ৷ চোরাগোপ্তা প্রায় সব বিক্রি হয়ে যায় ৷ এখন WWF আর ভারত সরকার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে যেটুকু রয়েছে তাকে বাঁচানোর ৷ দূর থেকে অনেকটা ঈগলের মতো দেখতে ৷ ভীষণ সুন্দর ৷ উচ্চতা প্রায় ৭৫ সেন্টিমিটার ৷ আর ওজন ১৪-১৫ কেজি ৷
গ্রেট ইন্ডিয়ান বার্স্টাড ছাড়া দেখলাম চিংকারা ৷ একধরনের হরিণ ৷ কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আর কিছু মিলল না ৷ ডেজার্ট নেকড়ে, শিয়াল ও নানা প্রজাতির পাখি নাকি এখানে আছে ৷
যাই হোক, আজ আমরা যাব সামে ৷ এখান থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার ৷ বেশি বেলা করে আজ আমরা বেরিয়েছি ৷ কারণ সকালে ন্যাশনাল পার্ক ঘুরতে বেরিয়েছিলাম ৷ তাই ঠিক হয়েছে আজ দুপুরে বিশ্রাম নয় ৷ টানা হাঁটা ৷ কারণ সাম স্যান্ড ডিউনসে আজ পৌঁছতেই হবে ৷ কাল পূর্ণিমা ৷ আর কাল সাম স্যান্ড ডিউনসে মরু উৎসব বা ডেজার্ট ফেস্টিভ্যাল ৷ আজ পথে কাঁকড়াবিছা চোখে পড়ল ৷ তবে ট্রেকিংয়ের সময় এসব কিছু লক্ষ থাকে না ৷ শুধুই চলা ৷
গঙ্গা নামে এক গ্রাম পেরিয়ে বিকেলের মধ্যে এল সাম ৷ মানে সামের স্যান্ড ডিউনস ৷ দারুণ ৷ মরুভূমির ভেতর এরকম মরুরূপ দেখেই তো সম্পূর্ণ হয় মরু ট্রেকিং ৷ দিগন্ত বিস্তৃত বালিয়াড়ি ৷ বিশাল বিশাল বালির টিলা ৷ সাম স্যান্ড ডিউনস এরিয়া প্রায় ৩ কিলোমিটার ৷ সবাই বাচ্চাদের মতো ওই বালিতে ছোটাছুটি করলাম ৷ কাল এখানেই মরু উৎসব শুরু হবে ৷ তারই প্রস্তুতি চলছে চারদিকে ৷ অস্থায়ী থাকার জন্য ট্যুরিজম থেকে তাঁবু ফেলা হয়েছে ৷ একটা হোটেলও আছে এখানে ৷
জয়সলমির থেকে সামের দূরত্ব মাত্র ৪২ কিলোমিটার টানা পথে ৷ তাই একটা কথা এখানে বলি, জয়সলমির বেড়াতে গেলে কখনওই সাম বাদ দেওয়া উচিত নয় ৷ অবশ্যই দ্রষ্টব্য ৷ আমরা সরকারি তাঁবু ছাড়িয়ে বেশ কিছু দূরে আমাদের তাঁবু ফেলি ৷ সেখানে কোনও শোরগোল নেই ৷ আজ সবাই খুশিতে ভরপুর ৷ কারণ কাল আমাদের বিশ্রাম ৷ সারাদিন সামে থাকা ৷ আর সন্ধের পর উৎসব দেখা ৷
আজ সাম স্যান্ড ডিউনস-এ প্রচণ্ড ভিড় ৷ আজ পূর্ণিমা ৷ আজই মরু উৎসব ৷ ১৯৭৯ সাল থেকে এই উৎসব শুরু হয়েছে ৷ সাধারণত শীতের সময়েই এই উৎসব হয় ৷ জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে ৷ দুদিন জয়সলমিরে আর শেষ সামের স্যান্ড ডিউনস-এর জ্যোৎস্না রাতে ৷ গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির আসরই মরু উৎসব নামে পরিচিত এখন ৷ বারমের, পোখরান এইসব জায়গা থেকে নানা লোকসংস্কৃতির লোকজন আসে ৷ এইসব অখ্যাত শিল্পীদের পেশাগত নৈপুণ্য না থাকলেও সারল্যের রঙে রসে মাধুর্যে তা মানুষকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে ৷ স্থানীয় মানুষরাও এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আনন্দে মেতে ওঠে ৷ আর বিদেশিদের খুব পছন্দ এই উৎসব ৷ মূলত ওদের জন্যই এখন ট্যুরিজম থেকে হয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা ৷ নাচ-গান, রাজপুতদের উত্থান-পতনের নানা আখ্যান আর সাজপোশাকের যেন হোলিখেলা ৷ আছে নানাধরনের বাদ্যযন্ত্র ৷ মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেসব শুনতে হয় ৷ নড়বাঁশি, আলগোছা এ হল জোড়া বাঁশি ৷ আছে সারেঙ্গির মতো সিরিমণ্ডল, কায়ামাচা নানা কিছু ৷ হয় নানাধরনের হস্তশিল্প প্রদর্শনী ৷ ছাপা শাড়ি, কাঠের কাজ করা সামগ্রী, বারমেরের কার্পেটের কদর তো পৃথিবীব্যাপী ৷ বিদেশিদের সঙ্গে টাগ-অব-ওয়ার, উটের রেস, উটের পোলো খেলা ৷ শেষে শুধুই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ৷ যা আজ সামে হবে ৷ সারাদিন বেশ মজা হল ৷ যেন হঠাৎই এক মেলাতে এসেছি ৷ তবে সবচেয়ে ভালো লাগল মুক্ত আকাশে আতসবাজি ৷ দেখার মতো ৷ রাতে যখন ঘুমোতে গেলাম তখন অনেক রাত ৷ আর তেমনই ঠান্ডা ৷
আজ সাম আবার সেই পুরনো সাম ৷ সবাই দেখি রাতে চলে গেছে ৷ দোকানপত্তর উঠে গেছে ৷ একেবারে ফাঁকা ৷ শুধু আছে বালিয়াড়ির মধ্যে অজস্র পায়ের ছাপ ৷ বালিয়াড়ির বালির স্তরের নকশা কে যেন অদৃশ্য হাতে একদিনেই বদলে দিয়েছে ৷
একদিন বিশ্রাম হয়েছে ৷ তাই আজ আমাদের প্রচুর হাঁটা ৷ ২৪ কিলোমিটার দূরে ছত্রেল গ্রামে ৷ ৫ কিলোমিটার বালিয়াড়ির পথ ধরে কানোই ৷ ওখান থেকে আরও ৬ কিলোমিটার হাঁটার পর বিশ্রাম ৷ খাওয়া, তারপর আবার পথ চলা ৷ এবার শুরু হল পাথুরে এলাকা ৷ রুক্ষ ৷ শক্ত বালির সঙ্গে নুড়িপাথর ৷ একটা মজা হল, সমস্ত নুড়িই যেন খোদাই করা ভাস্কর্য ৷ পথে যেন পড়ে আছে ছোট ছোট পাথরের মূর্তি ৷ ওদের মাড়িয়ে পথ ৷ একটু নজর দিলেই মনে হচ্ছে তুলে নিই ৷
এদিকে অনেক রাত হয়ে গেল ৷ ছত্রেল শেষপর্যন্ত এল না ৷ জল নেই ৷ তবুও থামতে হল ৷ জেরিক্যানে যা জল আছে তাই দিয়েই রাতটা চালাতে হবে ৷ রাত কাটিয়ে সকালে ছত্রেল এলাম ৷ খুব বেশি আর বাকি ছিল না ৷ ওখানেই চা-জলখাবার খাওয়া ৷ লোকসঙ্গীতের বেশ কিছু মানুষ এখানে থাকে ৷ তারা এল আলাপ জমাতে ৷ শোনাল প্রাচীন কিছু লোকগীতি ৷ অচেনা পরিবেশ নিমেষে যেন চেনা হয়ে গেল ৷
ছত্রেল ছেড়ে চললাম লোদুর্ভার পথে ৷ প্রায় ৭ কিলোমিটার ৷ লোদুর্ভা হল একদা থরের রাজধানী ৷ পথের ল্যান্ডস্কেপ দারুণ ৷ টিপিক্যাল মরুপ্রান্তর ৷ প্রচুর গুল্মজাতীয় গাছ ৷ লোদুর্ভাতে একটা জৈন মন্দির আছে ৷ ভেতরের কাজ অনুপম সৃষ্টিনৈপুণ্যে ভরা ৷ ওখানেই দুপুরের খাওয়া ৷ খাওয়া সেরে ওই দুপুরেই পথচলা আজ ৷ ৪-৫ কিলোমিটার পরে এল রূপসী গ্রাম ৷ পাহাড় আর হালকা সবুজের সমারোহ রূপসী ৷ অপরূপ গ্রাম ৷ প্রচুর ময়ূর আছে ৷ পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুরে রূপসীর মায়া ছাড়াতে ইচ্ছে করছিল না ৷ তবুও চলা ৷ কয়েক কিলোমিটার পরে এল রামকুণ্ড ৷ এখানে একটা মন্দির আছে ৷ আজকের মতো বিরতি ৷ কিন্তু মন একটু খারাপ ৷ আগামীকালই মরু ট্রেকিং শেষ ৷
খুব ভোরে আজ সবাই উঠি ৷ বেশ গরম ৷ কিন্তু আজ আমরা সবটুকু রাস্তা হাঁটব না ৷ হেঁটে প্রতিদিনই চলেছি ৷ উট আমাদের নিজেদের ৷ উটের পিঠে খাবারদাবার সব কমে গেছে ৷ তাই আজ পালা করে ক্যামেল সাফারি ৷ উটের পিঠে প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হচ্ছিল ৷ ক্যামেরা, রুকস্যাক সব নিয়েই উঠেছি ৷ পরে উটের দড়ির কন্ট্রোল রপ্ত করে ভীষণ মজাই লাগছিল ৷ কখনও জোরে চলছে ৷ কখনও আস্তে ৷ কখনও সবাই চলে গেছে ও একটা কাঁটা গাছ খাচ্ছে ৷ তাড়া দিলেও চলে না ৷ ওদের চলার ছন্দে এলাম বড়াবাগ ৷ হলুদের মধ্যে অনুপম সবুজ ৷ নরম ধানখেত ৷ কতদিন ভালো করে সবুজ দেখিনি ৷ ধানখেত সংলগ্ন বড়াবাগ ৷ শিল্পনৈপুণ্যে ভরপুর ৷ জয়সলমিরে উট এজেন্সির মালিক বলেছিল, ট্রেকিংয়ের শেষে বড়াবাগ হল মিষ্টি শরবৎ ৷ সত্যিই তাই ৷ বড়াবাগ ট্যুরিস্ট স্পট ৷ প্রচুর বিদেশি এসেছে ৷ রামকুণ্ড থেকে বড়াবাগ ৭ কিলোমিটার ৷ বড়াবাগ থেকে জয়সলমির আরও ৭ কিলোমিটার ৷ বড়াবাগে পাথরের মূর্তি, নকশার কাজ দেখলাম ৷ ওখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে এবার ফেরার পালা ৷ সন্ধের রাঙা সোনালি সূর্যের আলোতে সোনার কেল্লার প্রবেশদ্বারে ফিরে এলাম ৷ ট্রেকিং শেষ ৷ স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে রইল থর মরুভূমির বিশালতা, রঙিন সাজ-পোশাক, নাচ-গান ৷
দুয়েকটি তথ্য
সাধারণত শীতকালেই ডেজার্ট ট্রেকিং করা চলে ৷ ছোট-বড় নানা ধরনের ট্রেকিং রুট আছে ৷ জয়সলমিরের ট্যুরিস্ট লজ মুমল থেকে উট এজেন্সির খোঁজ পাওয়া যাবে ৷ উটের ভাড়া ৭৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা প্রতিদিন ৷ গ্রাম থাকলেও জরুরি প্রয়োজনের জন্য টেন্ট দরকার ৷ বাসনপত্র, স্টোভ, জলের জন্য দুয়েকটি বড় জেরিক্যান নিতে হবে ৷
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন