অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
আটটা নাগাদ যখন বালি ব্রিজ পেরোলাম, কুয়াশার আড়ালে সূর্য তখনও ম্রিয়মাণ ৷ বেলুড়ের মন্দির দেখা গেল না ৷ নিচে গঙ্গার জলে নৌকা সন্ধানী বকের মতো ইতস্তত ঘুরছে ৷ নদীর প্রায় মাঝখানে এক দল ছোট স্টিম বা মোটর লঞ্চ ৷ উড়ন্ত মিলিটারি জেটের মতো সংগঠন করে এগোচ্ছে ঠিক যেন একটা তীরের ফলা ৷ ওরা বেড়া জাল পাতছে বা ওঠাচ্ছে ৷ ব্রিজের ওপরে রাস্তা ফাঁকা, হাওয়া মোলায়েম ৷ ব্রিজ থেকে নেমেই গাড়ি যেন গাড্ডায় পড়ল এবং সে গাড্ডা পূর্বগামিনী ছায়ার মতো আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলল সেই আরামবাগ পর্যন্ত ৷ প্রায় আশি কিলোমিটার রাস্তা ৷ সে কী রাস্তার অবস্থা! মনে হয় যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনও হিংস্র দানব আকাশ ফাটানো আক্রোশে লোহার নখ দিয়ে রাস্তার বুক-পেট চিরে নাড়িভুঁড়িগুলো ছড়িয়ে রেখে চলে গেছে ৷ তার ভারি পায়ের গর্তে কাদা জল জমে রয়েছে ৷ সেই রাস্তায় থ্যাঁতলাতে থ্যাঁতলাতে, হোঁচট খেতে খেতে এগোতে লাগলাম আর দেখলাম আমাদের দেশের মানুষ কী পরিমাণ সর্বসহ ৷ আমরা তো তবু গদি মোড়া স্প্রিং লাগানো কোচে বসে আছি আর এরা যাচ্ছে ট্রেকারে বেঞ্চি পেতে, টেম্পোতে গাদাগাদি করে, লজঝড় বাসের মাথায় মালপত্র নিয়ে বাবু হয়ে বসে, ধুলায়, রোদে, ঝাঁকানিতে বিপর্যস্ত হয়ে ৷ তবু কোনও প্রশ্ন নেই, প্রতিবাদ নেই ৷ সরকার যে চলবার জন্য রাস্তা আর চড়বার জন্য গাড়ি দিয়েছে তাতেই এরা তুষ্ট ৷
মৃগোলা, কামারকুণ্ডু, ঝুপিঝুপি গ্রাম ফুঁড়ে রাস্তা চলেছে ৷ দুদিকে খড়ের চাল, খোলার চাল-কখনওবা একটা আস্ত পাকা বাড়ি, দোকান বাজার, রূপা টি হাউস, রাধাকৃষ্ণ বস্ত্রালয়, ভাইপোর তেলেভাজার দোকান-এই সব পেরিয়ে গাড়ি ঝাঁপিয়ে পড়ল দুদিকে আকাশ ছোঁয়া মাঠের মধ্যে ৷ আলু, আলু আর আলু ৷ আলুর খেত ৷ মাঠের ওপরে আলু শাকের সবুজ বাহার, আসল সম্পদ মাটির নিচে ৷ মাঝে মাঝে নাবাল জমিতে ধানের চাষও আছে ৷ কাদা জলে দাঁড়িয়ে, কোমর ভাঁজ করে স্ত্রী পুরুষ মিলে ধান রোয়ার কাজ করছে ৷ ছোট ছোট ডোবার ধারে বক বসে আছে ৷ খুদে ছেলেমেয়েগুলো ছাঁকনি জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে ৷ কেউ বা ডোবার কাদা ঘেঁটে গেঁড়ি, গুগলি তুলে পাশে ভাসানো হাঁড়িতে রাখছে ৷ একটু নুন হলুদ লঙ্কা আর এক পলা তেল দিলে চমৎকার ঝাল হবে ৷ হঠাৎ এই একান্ত গ্রাম্য পরিবেশের মধ্যে বিরাট এক সৌধ ৷ পাথরে গড়া দুর্গের মতো বোবা, অন্ধ ৷ দরজা-জানলাহীন দেওয়াল খাড়াই ত্রিশ চল্লিশ ফুট উঠে গেছে ৷ হিমঘর ৷ পৃথিবী জোড়া আলু খেতের মাঝখানে অতি বেমানান হলেও, প্রয়োজনীয় আলু সংরক্ষণের জায়গা ৷ হিমঘর ছাড়া চারদিকের অন্যান্য দৃশ্য যতই মনোহারী হোক না কেন, রাস্তা আগের মতোই কদর্য, অপরিসর ৷ ট্রাফিক যথেষ্ট এবং যখনই দুই বিপরীতমুখী গাড়ি মুখোমুখি হয় দুজনকেই প্রায় রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে অপরকে জায়গা দিতে হয় ৷ রাস্তার সাইনবোর্ড দেখছি ৷ সিয়াখালা ৷ হাওড়া-সিয়াখালা একটা লাইট রেলওয়ে ছিল কি? হরিপাল ৷ শরৎচন্দ্রের অরক্ষণীয়া ৷ বাসদেওপুর, তারকেশ্বর ৷ থামবার উপায় নেই ৷ যে শম্বুকগতিতে এগোচ্ছি তাতে সন্ধ্যার আগে মুকুটমণিপুর পৌঁছতে পারব না ৷ বাবার উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে চলা ৷ চাঁপাডাঙা, হরিণখোলা-কেমন মজার নামগুলি ৷ এর পরে মুণ্ডেশ্বরী নদীর ওপরে টোল ব্রিজ ৷ নদীতে জলের চেয়ে বালি বেশি ৷ পাশে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া আছে-নদী থেকে বালি অনুমতি বিনা তুলিবেন না ৷ ব্রিজের ক্ষতি হতে পারে ৷
ইতিমধ্যে চলন্ত গাড়িতেই আমাদের সকালের জলখাবার পর্ব শেষ হয়েছে ৷ পৌঁছে গেলাম মায়াপুর (সে মায়াপুর নয়) ৷ এরপর ও অঞ্চলের বিখ্যাত শহর আরামবাগ ৷ আরামবাগ হ্যাচারির খাতিরে আরামবাগের নাম সবাই জানেন ৷ আমি কিন্তু আরামবাগের প্রশস্তি শুনেছিলাম অন্য ব্যাপারে ৷ প্রথমত, প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের বাড়ি ৷ আর দ্বিতীয়ত, ওখানকার মিষ্টান্ন ৷ দ্বিতীয়টির ওপরে আমার লোভ ছিল ৷ চলতি বাস থেকে বাজারের যে কটি মিষ্টান্ন বিক্রেতার সাইনবোর্ডে চোখে পড়ল তাদের প্রত্যেকটিতেই ফলাও করে লেখা আছে যে তাঁরা হলেন কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান ৷ আরামবাগ (৯৬ কিলোমিটার) যখন পৌঁছলাম, তখন বেলা সাড়ে এগারোটা ৷ বিষ্ণুপুর আরও দুঘণ্টা ৷ সেখান থেকে মুকুটমণিপুর দুই থেকে আড়াইঘণ্টা ৷ অতএব, আরামবাগে নামা হল না ৷
আরামবাগের পরেই বাঁকুড়া জেলার প্রধান নদী দ্বারকেশ্বরের ওপর ব্রিজ ৷ এ নদীতে জল বালি দুইই আছে ৷ কোথাও দল বেঁধে লোক স্নান করছে ৷ ধোপা কাপড় কেচে বালির ওপর মেলে দিয়েছে ৷
তবুও এ সে দ্বারকেশ্বর নয়, যার কূলে কূলে একদা তরঙ্গ বইত ৷ বহু পালতোলা দাঁড় বাওয়া মহাজনি নৌকা সমুদ্রকূলে তাম্রলিপ্ত থেকে রূপনারায়ণ বেয়ে দ্বারকেশ্বরের মধ্য দিয়ে চলে যেত মল্লভূমে, বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত প্রদেশে ৷ এই নদীপথেই এদেশে এসেছিলেন জৈনদের শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর ৷ সে হল খ্রিস্টজন্মেরও পাঁচশো বছর আগেকার কথা ৷ সহায় সম্বলহীন সাধুকে তখনকার আরণ্যক আদিবাসীরা ভালো চোখে দেখেনি ৷ ঢিল ছুড়ে মেরেছিল, কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল কিন্তু সাধু তাঁর নিজের চরিত্রমাধুর্যে সমস্ত বিদ্বেষ জয় করে অহিংস জৈনধর্মের যে ভিত্তি এখানে স্থাপন করেছিলেন তা পরবর্তী পনেরোশো বছর ধরে অটুট ছিল ৷ এর নিদর্শন এখনও ছড়ানো আছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মন্দিরে, দের্বাচনায় ৷ দ্বারকেশ্বর পেরিয়ে সামান্য দূরে আমরা হুগলি জেলা ছেড়ে বাঁকুড়ায় ঢুকলাম ৷ বাঁকুড়ার প্রথম বড় গ্রাম কোতুলপুর ৷ কোতুল কথাটা কি কোতল থেকে এসেছিল? তা আসুক আর না আসুক, কোতুলপুর মুসলমান প্রধান গ্রাম, যেটা বাঁকুড়া জেলায় সচরাচর দেখা যায় না ৷ তার পরের গ্রাম রায়বাঘিনী পেরোলেই জয়পুরের জঙ্গল শুরু হল ৷ ছোট্ট জঙ্গল ১০-১২ কিলোমিটার হবে ৷ শালগাছই বেশি ৷ এখন শীতের শেষে গেরুয়া মাটিতে, হালকা খয়েরি পাতায় জঙ্গল সন্ন্যাসিনীর বেশ ধরেছে ৷ শুকনো শালপাতা পুরু হয়ে পড়ে আছে জমি জুড়ে ৷ শালপাতার বোঝা নিয়ে চলেছে গরুর গাড়ি, মোটর ট্রাক ৷ মানুষের মাথাতেও শালপাতার বোঝা ৷ জঙ্গলে কোনও জন্তু চোখে পড়ল না ৷ অবশ্য দুপুর রোদে, ঊর্ধ্বশ্বাস বাস, মোটর, ট্রাকের আনাগোনায় রাস্তার ত্রিসীমানার মধ্যে কোনও জন্তু থাকার কথাও নয় ৷
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে দেখতে দেখতে কোচ বিষ্ণুপুর বাইপাসের মোহানায় থামল ৷ বাঁদিকে শহরে ঢোকবার রাস্তার ধারে লাল পাথরের ফলক-মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছে ৷ আমরা ডানদিক ঘেঁসে বেরিয়ে গেলাম বাঁকুড়ার দিকে কিন্তু তার আগে আমাদের চালক এবং তাঁর সহকর্মী এখানের চালাঘর ভোজনশালায় তাঁদের দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষ করলেন ৷ আরও আধঘণ্টা গেল ৷ তখন প্রায় দুটো ৷ মুকুটমণিপুর এখনও আশি কিলোমিটার ৷ তবে রাস্তা আগের চেয়ে অনেক ভালো, প্রশস্ত এবং ট্র্যাফিক কম ৷ দুদিকের দৃশ্য ইতিমধ্যে পাল্টে গেছে ৷ খানা, ডোবা, আলু ও ধানের খেত-এসবের জায়গা নিয়েছে রাঢ়ের আকাশ জোড়া মাঠ ৷ গেরুয়া রঙের কাঁকুরে পাথুরে মাটি-ঢেউ খেলানো উঁচু নিচু খোয়া-যার বুক চিরে চলে গেছে শীর্ণ জলধারা ৷ আর মাঝে মাঝে এই নিঃসঙ্গতার মধ্যে বড় বড় গাছে ঘেরা উঁচু পাড়ওলা বিরাট দিঘিগুলি ৷ এইরকম এক ডাকাতে কালীদিঘির পাড়েই কি ইন্দিরার কপাল ভেঙেছিল? ওঁদা গ্রাম পার হয়ে আরও ১৫ কিলোমিটার পরে বড় রাস্তার মোড় ৷ সোজা সামনে বাঁকুড়া ৷ আমরা বাঁদিকে ঘুরলাম খাতরা হয়ে মুকুটমণিপুর যাব বলে ৷ এখনও পঞ্চাশ কিলোমিটার ৷ কিন্তু মধ্যাহ্নের সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ আমরা বেলাবেলি পৌঁছে যাব ৷
তালগাছ, তালগাছ আর তালগাছ ৷ ঝাঁকে ঝাঁকে তালগাছ ৷ আর তাদের কি সুপুষ্ট কৃষ্ণচিক্কণ চেহারা ৷ তমাল গাছ দেখিনি কিন্তু আকাশ থেকে এ ভূমি যে তালীবনরাজিনিলা দেখাবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ৷ পরে শুনেছিলাম এই সব তালগাছ এদেশের সম্পদ ৷ এদের সম্পত্তি ৷ এখানকার লোক তালের বাগান করে ৷ যত্ন করে ৷ দেখাশোনা করে ৷ শহর খাতড়া পেরোল ৷ কিন্তু কোথায় সেই মুকুটমণিপুর-কংসাবতী-কুমারী নদীর সঙ্গম ৷ ১১ কিলোমিটার লম্বা, ৩৮ মিটার উঁচু বাঁধ, যার ওপরে পশ্চিমে আকাশ ছোঁয়া জল চাঁদের আলোয় চিকমিক করবে ৷ সেদিন আবার বুদ্ধপূর্ণিমা ৷ তার বদলে আমরা দেখছি নিচু খোয়াপাহাড়ের বেড়া, গাড়ি তার একদিক দিয়ে চলছে ৷ আসলে বাঁধ এবং জল রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে ৷ মাঝখানে কয়েকটা ঢিপি ঢিপি পাহাড় ৷ ফলে রাস্তা থেকে বাঁধের সমগ্রতা চোখে পড়ে না ৷ বাঁদিকে পড়ে রইল মুকুটমণিপুরের সামান্য লোকালয়, দোকান বাজার ৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিস্ট লজটিও এখানে ৷ আমরা লকগেটের ওপরের রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে বাধা পেলাম দ্বাররক্ষকের কাছে ৷ আমাদের কোচ ওই রাস্তায় নিয়ে যেতে হলে সরকারি অনুমতি লাগবে ৷ তখন বেলা সাড়ে চারটে ৷ ক্যানাল অফিস তখনও খোলা ছিল, অনুমতি পাওয়াও গেল, কিন্তু অফিস টাইমের বাইরে পৌঁছলে ঝামেলা একটু বেশি হতে পারে ৷ মোটর, জিপ বা এইরকম কোনও হালকা গাড়ির অনুমতি লাগবে না কিন্তু মোটর কোচ বা বাসে যাঁরা যাবেন এবং পিয়ারলেসের নিশ্চিন্তাবাসে যাঁরা থাকবেন তাঁরা এই অনুমতির জন্য অগ্রিম বন্দোবস্ত করে নেবেন ৷ পিয়ারলেসের কলকাতা অফিসই সে বন্দোবস্ত করে দেবেন ৷ অন্য কোথাও থাকলে এ অনুমতির প্রয়োজন হবে না ৷
লকগেট থেকে প্রায় দু কিলোমিটার দূরে কংসাবতী জলাশয়ের একটা ধার জুড়ে বেশ কয়েক একর জমি নিয়ে পিয়ারলেসের নিশ্চিন্তাবাস ৷ চারটে করে ঘরের তিনটি ইউনিট তিন জায়গায় ৷ বেশ প্রমাণ সাইজের ঘর, বাথরুম সমেত ৷ এছাড়াও একটি দোতলা ডর্মিটরি আছে ৷ মস্ত লনে ফুল গাছের কেয়ারি ৷ সবুজ ঘাসের আস্তরণে আঁকা লাল সুরকির রাস্তা ৷ সামনে পশ্চিমদিকে জলের ওপারে প্রথমে কিছুদূর বাঁধের পাঁচিল ৷ তারপর সমস্ত উত্তর পশ্চিম দিক জুড়ে দূরের পাহাড় পর্যন্ত বাঁধের জল টলমল করছে ৷ জঙ্গল, পাহাড় জল দিয়ে ঘেরা পিয়ারলেসের আবাসটি মনোরম ৷ বিলাস বাহুল্য নেই, কিন্তু পরিচ্ছন্ন, আরামপ্রদ ৷ ঘরে ঘরে গরম জলের ব্যবস্থা আছে ৷ খাদ্যতালিকা সীমাবদ্ধ ৷ পাঁউরুটি পাওয়া যায় না ৷ লুচি, আলু চচ্চড়ির বন্দোবস্ত আছে ৷ বাঙালি তথা ভারতীয়দের খাবার অসুবিধা হবে না ৷ মশা আছে, আবাসে মশারির বন্দোবস্ত আছে ৷ গুডনাইটও জ্বালাতে পারেন ৷ লোডশেডিং হলেও ভয় নেই ৷ আবাসের নিজস্ব জেনারেটর আছে ৷ দু-তিন দিন যদি কেউ নিরুদ্বেগ আলস্যে বাঁধের জল দেখে কাটাতে চান, মুকুটমণিপুর আদর্শ জায়গা ৷ লেখক বা লেখার বোঝা মাথায় নিয়ে আরও কদিন থাকতে পারেন ৷ তবে লেখার সব সরঞ্জাম মায় অভিধান কোষগ্রস্থ সব সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে ৷ ওখানে কিছু পাবেন না ৷
সময় থাকলে মুকুটমণিপুরের অদূরে অম্বিকানগরে অম্বিকা দেবী দর্শন করে আসতে পারেন ৷ বিরাট পাথরের চত্বরের ওপর আধুনিক যে দালান মন্দিরে দেবী এখন পূজিত হচ্ছেন সেটি যে হালে তৈরি, তা দেখেই বোঝা যায় ৷ পুরনো মন্দিরটি এর ঠিক পিছনে ৷ একাদশ শতকে তৈরি-কেউ কেউ বলেন, আরও আগেকার ৷ মাত্র পনেরো ফুট উঁচু ভগ্নশিখর ছোট মন্দির ৷ পাথরে তৈরি প্রাক-মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন ৷ মন্দিরের গর্ভগৃহে অম্বিকা দেবীর ভৈরব বলে যে মূর্তিটি পুজো পাচ্ছেন তিনি খুব সম্ভব আদিতে কোনও জৈন তীর্থঙ্কর রূপে প্রকট হয়েছিলেন ৷ মন্দিরের বাইরে দুটি দ্বারপাল, একটি মা ষষ্টি অন্যটি গণেশ ৷ তাতে কোনও ক্ষোভ নেই ৷ যুগে যুগে মানুষ পালটায়, মানুষের দেবতাও পালটায় কিন্তু ভক্তের ভক্তি অচলা থাকে ৷ খোদ অম্বিকা দেবীর মূর্তিটি আগাগোড়া লাল কাপড়ে মোড়া ৷ উজ্জ্বল দুটি চক্ষু ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না ৷ দেবী দর্শন সেরে এসে মুকুটমণিপুর বাজারে একটু ঘুরলাম ৷ বাঁধের রাস্তার দুধারে সারি সারি স্টল ৷ টুকিটাকি সেই সব জিনিস যা ট্যুরিস্টরা বেড়াতে এসে আগ্রহ করে কেনে এবং বাড়ি ফিরে গিয়ে সেগুলো নিয়ে কী করবে ভেবে পায় না ৷ শুশুনিয়া পাহাড়ের সাদা পাথরের জিনিস (শ্বেত পাথর নয়) যদি কিছু পান তো কিনতে পারেন ৷ মুকুটমণিপুরের আরেকটি বিলাস বাঁধের জলে নৌকাবিহার ৷ এমনই এক ঘণ্টা-দুঘণ্টা বেড়ানো ছাড়াও কেউ কেউ মাঝখানের কোনও দ্বীপে ডিয়ার পার্কে যায় ৷ যেতে আসতে তিন চার ঘণ্টা লাগে ৷ কেউ বা কংসাবতী ও কুমারী নদীর সঙ্গমস্থানে পাহাড় জঙ্গল দেখতে যায় ৷ আমরা সন্ধেবেলা ঘণ্টাখানেক বাঁধের জলে বেড়িয়ে, নিয়ম রক্ষা করলাম ৷ বেশ লাগল ৷
মুকুটমণিপুরের পালা শেষ হল ৷ এবার বিষ্ণুপুর ৷ পথে ওঁদা গ্রাম থেকে রেললাইনের ওপারে এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে প্রায় চার কিলোমিটার গিয়ে বহুলাড়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরটি দেখে এলাম ৷ দশ বা এগারো শতকে নির্মিত ৷ মন্দিরটির নির্মাতা কে তা জানা যায় না, তবে আনুষঙ্গিক অলংকরণ থেকে মনে হয় যে পার্শ্বনাথের মন্দির হিসাবেই এটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ৷ পরে এসব অঞ্চলে জৈন ধর্মের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে, মন্দিরটি হিন্দু তীর্থে পরিণত হয় এবং স্বয়ং পার্শ্বনাথ শিব হিসাবে পুজো পেতে থাকেন ৷ ভগ্নশিখর পঞ্চরথ মন্দিরটির এখনকার উচ্চতা কুড়ি মিটারের মতো ৷ শিখরসমেত হয়তো পঁচিশ মিটার ছিল ৷ পুরোপুরি ওড়িয়া শৈলীতে তৈরি রেখদেউল, কিন্তু পাথরের নয় ৷ বাংলার একান্ত নিজস্ব জিনিস, পোড়ামাটিই এর উপাদান ৷ মন্দিরের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে চেয়ে অবাক হতে হয় সেই স্থপতিদের কথা ভেবে যারা ভঙ্গুর পোড়ামাটির ইট একের পর এক সাজিয়ে এই সুউচ্চ মন্দির গড়ে তুলেছিলেন ৷ কোন কুমোরের পোনে এসব ইট পোড়ানো হয়েছিল যা এই এক হাজার বছরেও নোনা লেগে নষ্ট হয়নি! পলেস্তারার বিশেষ কিছুই আর অবশিষ্ট নেই কিন্তু ইট বার করা দেওয়ালগুলি এখনও অটুট ৷ আর তার সঙ্গে সাঁটা আছে আধো রিলিফের ছবি আঁকা অনবদ্য পোড়ামাটির টালিগুলি ৷ নানা রকম জ্যামিতিক নকসা, ফুল লতা পাতার মধ্যে নৃত্যরত মূর্তি ৷ এসব দাঁড়িয়ে দেখতে হয় ৷
সিদ্ধেশ্বরের মন্দির দেখে বিষ্ণুপুর পৌঁছতে বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা হল ৷ পুরনো ঘিঞ্জি শহরের সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে বাজার ঘুরে যখন বাসস্ট্যান্ডের কাছে ট্যুরিস্ট লজে পৌঁছলাম তখন একটা বেজে গেছে ৷ ওইখানেই খাওয়াদাওয়া করে, যথাসম্ভব সত্বর আমরা দল বেঁধে দুটি সাইকেল রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বিষ্ণুপুর মন্দির পরিক্রমায় ৷ প্রথমে ছিন্নমস্তার মন্দির ৷ মাত্র ১৯৭৩ সালে তৈরি মন্দিরটির এমন কোনও উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব নেই ৷ আরাধ্য দেবীই হলেন প্রধান বৈশিষ্ট্য ৷ ছিন্নমস্তার মন্দির সচরাচর দেখা যায় না ৷ শহর বাজার অঞ্চলে তো নয়ই ৷ দেবীর মূর্তি পুরাণোক্ত মতেই লাল পাথর কুঁদে তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর ছিন্নমস্তক মুখে বা মুণ্ডহীন শরীরের ভঙ্গিতে কোথাও সেই খর্পরধারিণী লোলজিহ্বা রক্তপিপাসা ফুটে ওঠেনি ৷ প্রণাম করে উঠে মনে হল কোমলাঙ্গী দেবী যেন সর্বমঙ্গলা ৷ আশীর্বাদের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন ৷ এই হল বাঙালির দেবতা ৷ তিনি ঈশ্বর নন, পরম ব্রহ্ম নন অবাংমনসগোচর নন, আবার রক্তচক্ষু, রাজদণ্ডধারী শাসকও নন-তিনি গোপাল হয়ে ঘরে অঙ্গনে খেলে বেড়াচ্ছেন, কন্যারূপে ছেলেমেয়ের হাত ধরে বাপের বাড়ি আসছেন-করালবদনী কালীর চোখে তাই করুণা ৷ ত্রিকালেশ্বর শিব তাই দুটি অন্নের প্রত্যাশী ৷ বাঙালির দেবতা, বড় ঘরের জিনিস, বড় কাছের জিনিস এবং এই ভাবনাচিন্তা বাঙালির স্থাপত্যকেও প্রবাবিত করেছে ৷ সে কথায় পরে আসব ৷
ছিন্নমস্তার পরে রাসমঞ্চ ৷ আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপুর মল্লরাজ বংশের প্রখ্যাততম রাজা বীর হাম্বির এটি তৈরি করান ৷ রাসমঞ্চটি সত্যিই মঞ্চ, মন্দির নয় ৷ মল্লরাজাদের আমলে রাস পূর্ণিমার দিন বিষ্ণুপুরের যাবতীয় রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহকে এখানে এনে আলোয়, ফুলে, বিভূতিতে সাজানো হত জনসাধারণের দর্শনের জন্য ৷প্রায় দেড় মিটার উঁচু এবং পঁচিশ মিটার সমচতুর্ভুজ বিশাল পাথরের বেদীর ওপর বসানো মঞ্চটি সারি সারি ইটের থাম এবং খিলান দিয়ে ঘেরা ৷ মাথার ওপর স্টেপ পিরামিড আকৃতির ছাদ ধাপে ধাপে উঠে গেছে আরও দশ মিটার ৷ আশ্চর্য এই ইমারতটি ৷ এর তুলনা দুই বঙ্গের কোথাও নেই ৷ ভাবতে অবাক লাগে যে যুগপৎ ওড়িয়া এবং বঙ্গ স্থাপত্যের সংস্কার বঞ্চিত সৌধটি বিষ্ণুপুরের মতো প্রত্যন্ত প্রদেশে কারা তৈরি করেছিল ৷ রাসমঞ্চ থেকে বেরিয়ে রিকশাবাহিনী গড় অভিমুখে চলল ৷ ফোর্ট উইলিয়ামের মতো উঁচু মাটির বাঁধ আর পরিখা দিয়ে ঘেরা গড়ের চৌহদ্দি এখনও বেশ বোঝা যায়-ছোট, বড় দুটো পাথরের গেটও পেরতে হয় ৷ গেটদুটি বিশেষ করে বড় গেটটি, পুরনো দিল্লির গেটগুলির কথা মনে করিয়ে দেয় ৷ গড়ের ভেতরের জমি বেশ ফাঁকা ৷ রাজপ্রাসাদ অট্টালিকাগুলি ভেঙে পড়েছে ৷ অক্ষত আছে কেবল দুটি দেবস্থল-শ্যাম রায়ের মন্দির আর জোড় বাংলো ৷
আগেই বলেছি যে বাঙালির দেবতা ঘরের লোক ৷ তার জন্য অভ্রভেদী মন্দির মহিমার দরকার নেই ৷ বাঙালির নিজস্ব মন্দির তাই গ্রাম বাংলার খড়ের চালের অনুকৃতিতে গড়ে উঠেছিল ৷ ওই রকমই একচালা, দুচালা, চারচালা, আটচালা কুটিরের মতো দেবতার আবাসগৃহ ৷ ওই রকমই চালাগুলি কোণ থেকে কোণ পর্যন্ত বাঁকানো-দুই বা চার চালের মাঝখানে আড়ার বাঁধুনি ৷ তফাৎ শুধু এই যে কুটিরের খড়ের চালাকে মন্দিরে পাকা গাঁথুনি করা হয়েছে ৷ একচালা বা দুচালা মন্দিরের সংখ্যা নগণ্য ৷ বেশিরভাগই চারচালা বা আটচালা, সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি যেমন হয়ে থাকে ৷ আটচালা আর কিছুই নয় ৷ চারচালার চারটি চালের শেষের দিকে দেওয়াল তুলে আরও চারটি চাল বসান ৷ এ পদ্ধতিতে মন্দিরের উচ্চতা কিছুটা বাড়ানো যায় ৷ তারও ওপরে দেবালয়ের চারচালা বা আটচালার মধ্যিখানে একটি করে গম্বুজ বসানো হয় যাতে মন্দিরের উচ্চতা আরেক মাথা বাড়ে ৷ গম্বুজের ওপরে ওড়ে দেবতার নিশান-ধ্বজবজ্রাংকুশ ৷ কলকাতার কালীঘাট মন্দির এইরকমই আটচালা ৷ চারচালার বড় মন্দিরে অনেক সময় চার কোনায় চারটে ছোট গম্বুজ দেওয়া হয় ৷ যাদের বলে পঞ্চরত্ন মন্দির ৷ একটি চূড়া থাকলে একরত্ন ৷ মন্দিরের প্রবেশদ্বারটি দেখবার মতো ৷ সাধারণত মাঝখানের দটি থাম এবং শেষের দুটি থামাংশ নিয়ে তিনটি খিলান, খিলানের তলায় হ্রস্ব থামগুলি লক্ষ করবেন ৷ নিচে দুফুট পরিধির থামগুলি ক্রমশ সরু হয়ে মাঝখানে ১৫-১৮ ইঞ্চি আবার বেড়ে বেড়ে ওপরে দুফুট ৷ ডম্বরু আকৃতি এমন থাম অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না ৷ এও কি বাংলা স্থাপত্য শৈলীর বৈশিষ্ট্য?
শ্যাম রায় ৷ ১৬৪৩ সালে বীর হাম্বিরের প্রপৌত্র, দ্বিতীয় রঘুনাথ রাধাকৃষ্ণের প্রীতার্থে মন্দিরটি স্থাপন করেন ৷ চারচালা পঞ্চরত্ন মন্দিরটি কি স্থাপত্যে কি ভাস্কর্যে শুধু বিষ্ণুপুর কেন সারা বাংলার গৌরব ৷ মন্দিরের মূল রত্নটি গোল নয়, আটকোনা ৷ আর মন্দিরের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ ফুট ৷ ওসারে সমস্ত অন্ত ও বহিঃপ্রাচীর জুড়ে পোড়ামাটির যে রিলিফ চিত্রগুলি আছে, দেহ ভঙ্গি এবং ভাবের ব্যঞ্জনায় তারা খাজুরাহোর প্রাচীর চিত্রের সঙ্গে সমান তুলনীয় ৷ খাজুরাহোর মতো স্ত্রী-পুরুষের অঙ্গ মিলনের লীলারঙ্গ এখানে নেই কিন্তু আছে রাসনৃত্যপরা রাধা সখীদের ছবিগুলি ৷ তাদের আকুল নয়ন শ্রীকৃষ্ণের মুখ চন্দ্রিমায় নিবদ্ধ, সেই শ্যাম অঙ্গ স্পর্শ করার জন্য তাদের আকুতি দর্শকের মনকে নাড়া দেয় ৷ রাসনৃত্য ছাড়াও আরও কত রকমের ছবি, পুরাণ কাহিনী-ফুলকারির লতাপাতা কাটা-মহাভারতের যুদ্ধ দৃশ্য ৷ হস্তীর বৃংহিতে, অশ্বের হ্রেষায় জায়গাটা মুখর হয়ে উঠেছে ৷ দৃপ্ত অশ্বপদতলে দলিত শত্রুর কাতর মুখচ্ছবি-ঠিক যেন ম্যাজিক ল্যান্টার্নের মতো দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজানো রয়েছে ৷ মনে পড়ল অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা ৷ এইসব দৃশ্যের আলোকচিত্র তুলে অ্যালবাম করা যায় না ৷ ভারতের আরও অনেক পুরাকীর্তির সম্বন্ধে যেন কফি টেবিল বই হয়েছে, বিষ্ণুপুর তাদের থেকে কোনও অংশে কম নয়, কেবল প্রচার আবশ্যক ৷ শ্যাম রায়ের মন্দির যাঁরা দেখতে যাবেন তাঁদের জন্যে একটা সতর্কবাণী ৷ মন্দিরের ভেতরে আলোর বন্দোবস্ত নেই ৷ কাজেই নিজেরা আলো না নিয়ে গেলে অন্তঃপ্রাচীরের ছবিগুলি দেখতে পাবেন না ৷
শ্যাম রায়ের পাশেই আর দুটি মন্দির জোড় বাংলো এবং রাধাশ্যাম ৷ স্থাপত্য রীতিতে জোড় বাংলো অন্য সব মন্দির থেকে আলাদা ৷ দুটি দোচলা মন্দিরকে পাশাপাশি রেখে, চালাদুটির মাঝখানে ইংরিজি ভি আকারে একটি ব্রিজ করা হয়েছে ৷ মন্দিরের একটি চারকোনা চারচালা শিখর বসানো হয়েছে এই ব্রিজের ওপরে ৷ এই মন্দিরও মহারাজ দ্বিতীয় রঘুনাথের কীর্তি ৷ এখানেও সমস্ত দেওয়াল জুড়ে অনবদ্য পোড়ামাটির অলংকরণ ৷ জোড় বাংলোর অনতিদূরে রাধাশ্যাম মন্দিরটিও দেখবেন ৷ মল্লবংশের শেষ রাজা চৈতন্য সিংহ বানিয়েছিলেন পলাশীর যুদ্ধের ঠিক এক বছর পরে ৷ চারচালার এক রত্ন মন্দির ৷ পোড়ামাটির নয় ৷ মাকড়া পাথরে (Laterite) তৈরি ৷ মাকড়া হালকা বাজে পাথর ৷ পালিশ নেয় না ৷ তবু এই পাথর কুঁদে কত রকম চিত্র-বিচিত্র কাজ করে তার ওপরে পঙ্খের আস্তরণ দেওয়া হয়েছিল ৷ এখন সে আস্তরণ বহু জায়গায় উঠে গিয়ে পান খাওয়া দাঁতের মতো লালচে কালো পাথর বেরিয়ে পড়েছে কিন্তু ওপরে ঝোলানো কার্নিশের তলায় যেখানে পঙ্খলেপ এখনও অক্ষত আছে ৷ সেখানে পড়ন্ত সূর্যের আলো আয়নার মতো ঝকমক করছে ৷ ভাবতে ভালো লাগে যে আড়াইশো বছর আগে পঙ্খের পলেস্তারা ঢাকা মন্দিরটি প্রভাত সূর্যের আলোয় কেমন জ্যোতিষ্কের মতো জ্বলন্ত ৷ মন্দিরনগর বিষ্ণুপুরে মন্দির দেখে শেষ করা যায় না-তবু রাধাশ্যাম মন্দিরের কাছেই পাঁচিল ঘেরা লালজি মন্দিরটি দেখে যাবেন ৷ আর দেখবেন একেবারে অন্য পাড়ায় মদনমোহন মন্দির ৷ মল্লরাজ দুর্জন সিংহ (নাম যাই হোক তিনি লোক ভালো ছিলেন) ১৯৬৪ সালে চারচালা একরত্ন পোড়ামাটির মন্দিরটি তৈরি করান ৷ এর গায়ে ও সামনের পাঁচিল জুড়ে চৌখুপি কাটা টালির মধ্যে নানা অলংকরণ লক্ষ করবেন ৷ সময় থাকলে বিষ্ণুপুর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে ধরাপাটের পরিত্যক্ত মন্দিরটি দেখে আসবেন ৷ পঙ্খের পলেস্তারা ঢাকা মাকড়া পাথরের রেখদেউল ৷ আমাদের এটি দেখা হয়নি ৷
মন্দির পরিক্রমা শেষ করে এবার লালবাঁধের ধারে গিয়ে দাঁড়ান, এখানেও বেশ কয়েকটি মন্দির আছে ৷ কিন্তু মন্দির আর নয় ৷ তার চেয়ে বাঁধের নিস্তরঙ্গ জলে অতীতের ছবি দেখুন ৷ মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ এবং মুসলমানি লালবাইয়ের প্রেমকাহিনী ৷ নর্তকীর নূপুর নিক্কণে, কুহুতানে, অলসে হেলায় কাটানো বিলাসের মনোরম সন্ধ্যাগুলি এবং তার ভয়ংকর পরিণাম ৷ প্রজার ধর্মরক্ষার জন্য পাটরানি শিরোমণি দেবীর প্ররোচনায়, আততায়ীর হস্তে নিহত রঘুনাথ ৷ স্বামীর চিতায় আত্মবিসর্জন দিলেন শিরোমণি ৷ ক্রোধান্ধ প্রজারা উন্মত্ত বৃষদলের মতো লালবাইয়ের প্রাসাদ ভেঙে তছনছ করল আর লালবাইকে জীবন্ত সমাধি দিল ওই লালবাঁধের জলে ৷ বিষ্ণুপুরে আরও অনেকগুলি বাঁধ আছে ৷ সব ঘুরে ঘুরে দেখবার দরকার নেই ৷ খরাপীড়িত রাঢ়ভূমে প্রজার এবং জমির তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নিচু বাঁধে বর্ষার জল ধরে মল্লরাজারা এই জলাশয়গুলি বসিয়েছিলেন ৷
ইতিবৃত্ত বলে মল্লরাজারা সেই হর্ষবিজেতা শশাঙ্কর আমল থেকে ব্রিটিশ অভ্যুদয় পর্যন্ত প্রায় আঠেরোশো বছর একনাগাড়ে রাজত্ব করেছিলেন ৷ এত বছরের হিসাবে আমাদের কাজ নেই ৷ কিন্তু মোটামুটি ষষ্ঠদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত মল্লরাজ্যের এই দুশো বছরের স্বর্ণযুগে, বিষ্ণুপুর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও সংস্কৃতির যে ছাপ রেখে গেছে তার কিঞ্চিৎ স্পর্শ নিয়ে আসবেন ৷ রাস্তায় যেতে রিকশাওয়ালা আপনাকে দলমাদল কামান দেখাবে ৷ এই সুবৃহৎ কামানটি বিষ্ণুপুরের অস্ত্রশালাতেই তৈরি হয়েছিল এবং তার জন্য লোহাও বাইরের থেকে আনতে হয়নি ৷ বিষ্ণুপুরেই ছিল সেই কর্মীরা যারা মাকড়া পাথর গলিয়ে লোহা বার করত ৷ বিষ্ণুপুরের কাঁসারিরাও সমান বিখ্যাত ৷ আর বস্ত্রশিল্প ৷ বালুচরী শাড়ির কথা সবাই জানেন ৷ স্থাপত্য, প্রাচীর চিত্রের কথা আগেই বলেছি ৷ এ ক্ষেত্র থেকে উৎপন্ন হয়েছেন যামিনী রায় বা রামকিংকর বেজের মতো ৷ শিল্পী ৷ সাহিত্য ক্ষেত্রেও বিষ্ণুপুর পিছিয়ে পড়েনি ৷ বড়ু চণ্ডীদাস, শূন্য পুরাণের রামাই পণ্ডিত এই অঞ্চলের লোক ৷ আমাদের বয়সে যাঁরা পৌঁছেছেন তাঁদের মধ্যে কেউ হয়তো গুরুমশায়ের পাঠশালে শুভঙ্করের আর্যা মুখস্থ করেছেন-মণ প্রতি যত তঙ্কা হইবেক দর ৷ শুভঙ্কর বিষ্ণুপুর রাজের কর্মচারী ছিলেন ৷ বিষ্ণুপুরে উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রচলন করেছিলেন মল্লরাজ বীর হাম্বির ৷ তানসেনের ঘরানার ধ্রুপদী বাহাদুর খানকে তিনি দিল্লি থেকে বিষ্ণুপুরে টেনে এনেছিলেন ৷ তারপর ধীরে ধীরে বিষ্ণুপুরেই গড়ে উঠল বিষ্ণুপুর ঘরানা ৷ যদুভট্ট, অনন্ত চক্রবর্তী, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞান গোস্বামী, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গীত নায়কদের শোভাযাত্রা ৷ ভারতীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিষ্ণুপুরের অলঙ্কার বর্জিত শুদ্ধ গায়কী ঢংয়ের স্বীকৃতি আছে ৷ সরোদিয়া রাধিকামোহন মৈত্রও বিষ্ণুপুরের লোক ৷
এইবার একটি তাস খেলা দিয়ে বিষ্ণুপুর প্রসঙ্গ শেষ করব ৷ দশাবতার তাস ৷ কেউ বলে এ খেলা মল্লরাজ বীর হাম্বির চালু করেছিলেন আকবরের রাজা উজির তাস খেলার অনুকরণে ৷ কেউ বলে এ খেলা বাংলার নিজস্ব জিনিস-পাল রাজাদের আমল থেকে চলে আসছে ৷ আমাদের এত ঝামেলার মধ্যে যাবার দরকার নেই ৷ কিন্তু যাঁরা তাসাডু তাঁদের হয়তো এই বিষ্ণুপুরি তাসের কথা ভালো লাগবে ৷ তাস দশটি শ্রেণীতে বিভক্ত ৷ প্রতি শ্রেণীতে বারোটি করে তাস থাকে ৷ প্রতি শ্রেণীর নায়ক একজন করে অবতার ৷ মৎস্য, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি ৷ নায়কের পরে উপনায়ক এবং তাঁরাও ওই একই অবতার, তবে অলংকরণে নায়ক এবং উপনায়কে তফাৎ থাকে ৷ অভিজ্ঞ চোখ এক নজরেই বুঝতে পারে নায়ক এবং কে উপনায়ক ৷ আমাদের তাসে সায়েব আর গোলাম যেমন ৷ নায়ক এবং উপনায়কের পরে বাকি দশটি তাসে তাদের শ্রেণীর প্রতীক এবং প্রতীকের সংখ্যা আঁকা থাকে ৷ যেমন এক্কায় প্রতীক চিহ্ন একটি, দোক্কায় দুটি ইত্যাদি ৷ একশো কুড়িটি তাস খেলেন পাঁচজনে ৷ কেউ কারুর খেঁড়ি নয় ৷ প্রত্যেকে নিজের হাতের চব্বিশটি তাস খেলে জেতেন বা হারেন ৷ খেলা কীভাবে হয় তা বোঝানোর জায়গা এখানে নেই এবং খেলা শিখে লাভও নেই ৷ যাঁরা এ খেলা খেলতেন তাঁদের প্রায় সবাই ভবের খেলা সাঙ্গ করে গেছেন ৷ তবে খেলতে পারুন বা না পারুন বিষ্ণুপুর গেলে মদনমোহন মন্দিরের কাছে ফৌজদারদের পাড়ায় তাসগুলি দেখতে যাবেন ৷ দেখবার জিনিস ৷ তেঁতুল বিচি পিষে তার সঙ্গে চকখড়ির মিহি গুঁড়ো মিশিয়ে কাই মতো করা হয় ৷ সেই কাই পরিষ্কার সাদা কাপড়ের ওপর মাখিয়ে এবং রোদে শুকিয়ে তৈরি হয় তাসের কাগজ ৷ তারপর কাগজগুলি আন্দাজ সাড়ে চার ইঞ্চি ব্যাসের পরিধিতে গোল করে কাটা হয় ৷ এই গোল তাসের ওপর শুরু হয় ছবি আঁকার কাজ-অবতারদের বহুরঙা মূর্তি, অলংকরণ, প্রতীক চিহ্ন ৷ এক প্যাকেট তাস বা অন্তত দশটি নায়ক বা উপনায়ক তাস যদি আনতে পারেন, ফ্রেমে বাঁধিয়ে সাজিয়ে রাখতে পারবেন ৷ এক্কার ছবিগুলোও মনোজ্ঞ ৷
বিষ্ণুপুর থেকে ফেরার সময় আমরা জয়রামবাটি, কামারপুকুর, তারকেশ্বর দেখে এলাম কিন্তু সে অন্য গল্প ৷ আরামবাগে দুপুরের খাওয়ার সময় ধরে প্রায় দশ ঘণ্টা লাগল ৷ একটা কথা, জয়রামবাটি এবং কামারপুকুর দুজায়গাতেই সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত মন্দির বন্ধ থাকে ৷ কাজেই বিষ্ণুপুর থেকে সকাল সকাল-সাতটার আগে বেরোলে ভালো হয় ৷
বিষ্ণুপুর-১৫০ কিলোমিটার ৷ টানা মোটরে গেলে চার-সাড়ে চার ঘণ্টা, বাসে ছয় ঘণ্টা ৷ অনেক বাস আছে ৷ ট্রেনে ২০০ কিলোমিটার ৷ সবচেয়ে ভালো ট্রেন পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ৷ হাওড়া থেকে ছাড়ে বিকেল ৪ টা ৪০ মিনিটে, পৌঁছয় সন্ধ্যা ৮টা ৩০ মিনিটে ৷ বিষ্ণুপুর থেকে ছাড়ে সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে, পৌঁছয় দুপুর ১২টা ০৫ মিনিটে ৷ এই ট্রেনে এ সি চেয়ারকার আছে ৷ ভাড়া একপিঠের ১৯৭ টাকা ৷ সেকেন্ড ক্লাসে ৭৪ টাকা ৷
মুকুটমণিপুর-২৩৫ কিলোমিটার ৷ কলকাতা থেকে সোজা রকেট বাসে যাওয়া যায় ৷ দশ ঘণ্টার রাস্তা ৷ এছাড়া বিষ্ণুপুর (৮২ কিলোমিটার) বা দুর্গাপুর (৯২ কিলোমিটার) থেকে বাসে বা ট্যাক্সিতে যাওয়া যায় ৷
বিষ্ণুপুর-ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ট্যুরিস্ট লজ সব চেয়ে ভালো জায়গা, তবে এটাও খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয় ৷ ডবলরুমের ভাড়া পড়ে দুশো থেকে আড়াইশো টাকা ৷ এ সি ডবলরুমের ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা ৷ ভাড়া প্রতি রাত্রি দুজনের জন্য ৷ খাওয়া আলাদা ৷ ট্যুরিস্ট লজে খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে ৷ ট্যুরিস্ট লজ ছাড়া অন্য হোটেলও আছে ৷ ওখানে গিয়ে খুঁজে নিতে পারেন ৷
মুকুটমণিপুর-রাজ্য সরকারের ট্যুরিস্ট লজ আছে ৷ ভাড়া ডবলরুম ৫০ টাকা প্রতি রাত ৷ খাওয়া আলাদা ৷ পিয়ারলেসের সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রিসর্ট আছে ৷ ডবলরুমে ভাড়া প্রতি রাত ৩৫০ টাকা থেকে ৩৭৫ টাকা ৷ খাওয়া আলাদা ৷ এছাড়া আছে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব আবাস কংসাবতী ভবন ৷ বড় সুন্দর জায়গায় এই ভবনটি অবস্থিত ৷
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন