অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
সেদিন আশ্চর্য একটা খবর আবিষ্কার করেছি-এই খবরটি জেনে অবধি আমার উত্তেজনার শেষ নেই! আমি তো জানতাম বিলেতে প্রথম ভদ্রলোক ভারতীয় ভ্রমণকারীর নাম রাজা রামমোহন রায় ৷ তার আগে আগে যাঁরা গেছেন তাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে যাননি ৷ তাঁরা গিয়েছেন লস্কর হয়ে, বিদেশি জাহাজের সঙ্গে, পর্তুগিজ, ফরাসিদের কর্মচারী হয়ে ৷ স্বাধীন ভ্রমণকারীর পরিচিতি তাঁদের ছিল না ৷
কিন্তু এই বইটা হাতে পড়ল, সদ্য বেরিয়েছে-আর আমার সব ধারণা পাল্টে গেল ৷ রাজা রামমোহন তো গেছেন ১৮৩১ থেকে ১৮৩৩; তাঁর অনেক বছর আগেই আরও একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ এই বঙ্গদেশ থেকেই ইংল্যান্ডে এবং ইউরোপে পদার্পণ করেছিলেন সেই ১৭৬৬তে! এক নয়, দুই নয়, প্রায় তিন বছর ধরে তিনি ইউরোপ, ইংল্যান্ড ঘুরে বেড়িয়েছেন-প্রাণ ভরে বিদেশি সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, বিজ্ঞান-সব কিছুই বুঝতে, জানতে চেষ্টা করেছেন ৷ সবার ওপরে, সেদেশের মানুষদের সঙ্গে হার্দিক সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন তিনি-শুধু বৌদ্ধিক পরিদর্শনেই শেষ হয়ে যায়নি তাঁর ভ্রমণ ৷ এবং ফিরে এসে একটি চমৎকার বই লিখেছিলেন ফারসি ভাষায় ৷ আমাদের জন্য-‘বিলায়েতনামা’ ৷ সেই বইয়ের সরল ইংরিজি অনুবাদ হয়েছে এতদিনে-ভাগ্যিস, তাই তো আমরা জানতে পারলাম যে নদীয়া জেলার পাঁচনূর গ্রামের তাজুদ্দিনের পুত্র ইতেসামুদ্দিন ‘মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিন’ হয়ে উঠেছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে নানা ধরনের দায়িত্বপূর্ণ পদে তিনি অধিষ্ঠিত থেকেছেন সারা জীবন ৷ এবং সসম্মানে সে সকল দায়িত্ব পালনও করেছেন ৷ কেবল একটি কাজেই তিনি সাফল্য অর্জন করতে পারেননি! এবং সেজন্য তাঁর হৃদয়ে ক্ষোভের অন্ত ছিল না ৷ যদিও এই না-পারার দায়িত্ব ছিল সম্পূর্ণই লর্ড ক্লাইভের ৷
ভারতের মুঘল বাদশা শাহ আলম লর্ড ক্লাইভের কাছে সৈন্য ধার চেয়েছিলেন তাঁর রাজ্য শাসনে নানা বিঘ্ন ঘটছিল বলে ৷ ক্লাইভ বললেন, সৈন্য সাহায্য করবার ক্ষমতা তো তাঁর নেই ৷ সেটা শুধু ইংল্যান্ডের রাজার আছে ৷ তিনি ভাবেননি বাদশার পক্ষে রাজার কাছে আবেদন পাঠানোর কথা ভাবা অসম্ভব নয় ৷ বাদশা স্থির করলেন আবেদনপত্র পাঠাবেন এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা ভেট সহ রাজা তৃতীয় জর্জের দরবারে ৷ রবার্ট ক্লাইভ ক্যাপ্টেন সুইনটনকে তাঁর সঙ্গী করে দিলেন-দুজনে মিলে রওনা হলেন রাজা তৃতীয় জর্জের উদ্দেশে ৷ কিন্তু বিলেতে পৌঁছেও উদ্দিষ্ট কাজ তিনি করতে পারেননি ৷ লর্ড ক্লাইভ তাঁদের শেষ মুহূর্তে জানালেন, আবেদনপত্রটি পেলেও টাকাটা হাতে আসেনি ৷ তাই টাকাটা পাওয়া গেলে তিনি স্বয়ং আবেদনপত্র সমেত ইংল্যান্ডে যাবেন এবং ওঁদের সেগুলি অর্পণ করবেন ৷ বাদশার খাজাঞ্চিখানা থেকে ইতেসামুদ্দিনকে চার হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল এই যাতায়াতের খরচ বাবদ ৷ অথচ যে জন্য যাত্রা, সেই কাজই হল না ৷ ক্লাইভ পরে এসেছিলেন কিন্তু আবেদনপত্রটি আনেননি ৷ এবং এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা বাদশার নামটি না-করে নিজের পক্ষ থেকেই ভেট দিয়েছিলেন ৷
এই ঘটনায় ইতেসামুদ্দিন যারপরনাই বিচলিত বোধ করেছিলেন এবং মনোদুঃখে ইচ্ছে করে এক বর্ণও ইংরিজি ভাষা শেখেননি ৷ অক্ষরজ্ঞানও অর্জন করেননি ৷ স্বদেশে ফেরার পরে এই নিয়ে তাঁকে কম গঞ্জনা শুনতে হয়নি! এত বড় সুযোগ কেউ ছেড়ে দেয়? অতদিন ওদেশে থাকলে, এত ভালো ভাষাটা শিখে এলে না? কত সুবিধা হত!
ক্লাইভের কূটচালে তিনি মনোবেদনা পেয়েছিলেন ৷ আসলে ক্লাইভের ইচ্ছে ছিল না কোনও মতেই ইংল্যান্ডের রাজার সঙ্গে ভারতের মুঘল বাদশার কোনও যোগাযোগ স্থাপিত হোক! তাই তিনি আবেদনপত্রটি স্রেফ চেপে গিয়েছিলেন ৷ তৃতীয় জর্জকে লিখিত শাহ আলমের সেই না-দেওয়া চিঠিটি এখনও সযত্নে সংরক্ষিত আছে ৷
ক্লাইভের নীচতা ও শঠতায় বিড়ম্বিত বোধ করলেও ইতেসামুদ্দিন সাধারণভাবে ইংরেজ জনসাধারণের আচার ব্যবহার, সৌজন্য-সহৃদয়তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ৷ বইটি পড়তে পড়তে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল কোনও অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় ভ্রমণ কথা পড়ছি ৷ ওই যুগটি ছিল ভ্রমণের ৷ নিত্যনতুন সংস্কৃতি, নিত্যনতুন শিল্পজগৎ আবিষ্কারের-পৃথিবী প্রত্যেক দিন বড় হয়ে উঠছিল ৷ ইউরোপীয় বণিকরা সেই ১৫-১৬ শতক থেকে নতুন নতুন দেশে যাচ্ছেন, নতুন মানুষ, নতুন জীবনপদ্ধতি শিখছেন-এ নিয়ে প্রচুর বইপত্র পড়েছি ৷ কোনও ভারতীয়ের লেখা এ ধরনের বই কিন্তু আমার চোখে পড়ল এই প্রথম!
লেখকের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী চোখ, উদার মনোভঙ্গি, সব কিছু নতুনকে বুদ্ধি দিয়ে যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখা, কুসংস্কারের পিছনে লুকোতে চেষ্টা না করা-এগুলি আমাকে মোহিত করেছে ৷ এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও খ্রিস্টধর্ম বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান রয়েছে তাঁর ৷ ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম নিয়ে বিশেষত নারী বিষয়ে ইসলামি মতামত নিয়ে ইতেসামুদ্দিন চমৎকার আধুনিকমনস্ক আলোচনা করেছেন ৷ সে সব কথা অন্যত্র বলা যাবে, আজ কেবল তাঁর সমুদ্রযাত্রাটুকুনি! আমরা তো বিহারীলাল দত্তের সমুদ্রযাত্রার কাহিনী পড়েই মুগ্ধ হয়েছি, এ আরেক রকমের ৷
১৭৬৬ জানুয়ারি মাসে হুগলি নদী থেকেই তাঁদের পালতোলা জাহাজটি ছেড়েছিল ৷ চারদিন পরে গিয়ে পৌঁছল সাগরে ৷ মোহনার তীরের কাছের জল নোনা-মিষ্টি মেশানো, যত দূরে যাওয়া যায়, জল তত নোনা, আর নীল ৷ রাতে ঢেউয়ের মাথায় ফেনা ঠিক যেন প্রদীপের মতো জ্বলে ৷ ইতেসামুদ্দিন লিখছেন, ‘জ্ঞানীরা বলেন পৃথিবীকে ঘিরে আছে ককেশাস নামে উজ্জ্বল নীল রঙের সুউচ্চ পর্বতমালা, আকাশের নীল রংটি তাদের শিখরের কাছেই ধার নেওয়া, নইলে আকাশ মূলত কাচের মতো স্বচ্ছ ৷ আর সমুদ্রের নীল তো আকাশেরই প্রতিবিম্ব মাত্র ৷’-তার প্রমাণ? অঞ্জলিতে যদি সমুদ্রের জল কোষ করে ধরা যায় তখন দেখব জলের কোনও রং নেই ৷ আর সমুদ্রের যে লবণ স্বাদ? সেটা সমুদ্রগর্ভ থেকেই আসে ৷ ইতেসামুদ্দিন লিখছেন, সমুদ্রের বাতাস সুস্থ লোকের পক্ষেও ভালো, অসুস্থের পক্ষেও ৷ তারপর বলছেন নিজের কথা ৷ জাহাজে ওঁর কোনওই অসুখ-বিসুখ করেনি, একবারই শুধু পৈটিক গোলযোগ দেখা দিয়েছিল ৷ সেটা কেবল ইসবগুলের শরবৎ খেয়েই ঠিক হয়ে গেছিল ৷ তারপর পাঠকের মঙ্গল কামনায় ইসবগুলের শরবৎ প্রস্তুত প্রণালীটাও জানিয়েছেন ৷ (ওই আমরা যে প্রণালীটি জানি, সেটাই ৷ কোনও বাদশাহী অভিনবত্ব নেই বা হেকিমি কায়দা!)
সমুদ্রের নীল রং নিয়ে আমারও খুব কৌতূহল ছিল-খুবই অবাক লেগেছিল, প্রথম যখন সমুদ্রকে দেখি ৷ অবিকল ইতেসামুদ্দিনের মতোই দুহাতের অঞ্জলিতে সমুদ্র নিয়ে, দেখেছিলাম তার জলও কলের জলের মতোই স্বচ্ছ, নিরঙা ৷ এটা সমুদ্রের বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে হয়েছিল আমার ৷
‘-এ মা! নীল রঙের জল নয়, এমনি-ই?’ মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল ৷ আমি তখন চার বছরের ৷ আর সমুদ্দুরটা ছিল মাদ্রাজের ৷ সাদা ফেনাভর্তি ঢেউগুলো ঠিক যেন এক সারি সাদা তুলতুলে কুকুর ছানার মতো আমার পায়ে এসে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে মাথা ঘষছিল বালির ওপরে ৷ আমার প্রথম সমুদ্র দর্শনের স্মৃতিচিত্র, অভিজ্ঞতা এই রকম ৷
আর ইতেসামুদ্দিনের?
সমুদ্রের বিপুল বিস্তার, তার তলহীন গভীরতা, ইতেসামুদ্দিনের কাছে মনে হয়েছিল দৈব রহস্যের আধার ৷ আল্লার অসীম সৃজনীশক্তিরই পরিচয় সমুদ্রের অনির্বাণ প্রাণশক্তিতে ৷ এই সমুদ্রের কোলে পৃথিবী ভাসছে, যেন ছোট্ট একটি ডিমের মতো ৷ মহা উৎসাহে তিনি জানিয়েছেন কম্পাস কী বস্তু, কীভাবে প্রস্তুত করা হয়, নাবিকদের তাতে কত সুবিধা হয়েছে, আলেকজান্ডারের সময়ে কম্পাস ছিল না বলে তাঁদের কত বেশি ঝুঁকি ছিল ৷ জাহাজ কতরকমের হয়? তাদের কী কী নাম? (প্রসঙ্গত জেনে রাখুন এক-মাস্তুল, দুই-মাস্তুল এবং তিন-মাস্তুল-এই তিন রকমের নৌকো হয় ৷ তিন-মাস্তুলটিকেই বলে জাহাজ!) ৷ বিভিন্ন বাতাসগুলি কোনটি কেমনভাবে বয়, নাবিকরা কীভাবে সেই বাতাসদের ওপরে নির্ভর করে জাহাজ চালনা করেন ৷ তাঁদের কী কী ধরনের সমস্যা হয় ৷ জাহাজ ঝড়বাদলে পড়লে অবস্থা কত ভয়াবহ হতে পারে ৷ সব কিছুরই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন তিনি ৷ এবং পশ্চিমী মানুষের নৌবিদ্যার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ৷ তাঁদের অভিযানপ্রিয়তা ও দুঃসাহস তাঁকে মুগ্ধ করেছিল ৷ মাঝে মাঝে হাওয়া বন্ধ হয়ে স্রোত স্তব্ধ হয়ে যায় ৷ তখন দু-তিন সপ্তাহ জাহাজ নড়ে না ৷ শান্ত, স্থির হলে স্থবির হয়ে বন্দী থাকে ৷ একবার এরকম হতে, ইতেসামুদ্দিন খুব ভয় পেয়েছিলেন, জাহাজের নট নড়ন-চড়নে ৷ আর খুব অবাক হয়েছিলেন জাহাজের যাত্রীদের নির্ভাবনায় হৈ চৈ করা এবং মেয়েদের নিয়ে নাচগান হুল্লোড় দেখে ৷ তাঁর মনে ভীতি ঢুকেছিল, ওইখানেই বুঝি বাকি জীবনটা কাটবে ৷ আস্তে আস্তে জল, খাদ্য ফুরিয়ে যাবে ৷ আর বুঝি কোনওদিনই দেশে ফেরা হবে না ৷ কিন্তু সারেংদের, আর বাকি যাত্রীদের হাসিখুশি মনোভাব তাঁর মনে বল জুগিয়েছিল ৷ এই দুঃসময় স্থায়ী হবে না হয়তো! মনে হয়েছিল ৷
ইতেসামুদ্দিনের সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা পড়তে পড়তে আমারও বালিকা বয়সে ইউরোপ ভ্রমণের ঘটনাগুলো স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে যাচ্ছে ৷ তাঁর চেয়ে প্রায় দুশো বছর পরে আমার সেই যাত্রা ৷ অনেক বদল হয়েছে পৃথিবীর-তবু অনেক দিক থেকে অপরিবর্তিত রয়েছেন ধরিত্রীও ৷ এবং মানুষ, এবং জীবজগৎ ৷
অনেক ধরনের সামুদ্রিক জলজন্তু, মাছের কথা লিখেছেন ইতেসামুদ্দিন ৷ উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক এদিক থেকে লাফিয়ে জাহাজের ওদিকে পড়ছে, শীলমাছের দল নেচেকুঁদে জাহাজকে তাড়া করে সঙ্গে সঙ্গে আসছে একশো মাইল পথ ৷ দুটো হাতির মতো বিশালবপু তিমি মাছ, তাদের নাক থেকে ফোয়ারা দিয়ে জলের ধারা আকাশে ঠিকরে উঠছে, একেকটা খেজুর গাছের মতো উঁচু হয়ে-কখনও জাহাজের আশপাশে কখনও জাহাজের তলা দিয়ে তিমি মাছেরা সাঁতরে যাচ্ছে-সেই সব গল্প পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ছিল ১৯৫০-এ স্কুলছাত্রী আমার বাবা মায়ের সঙ্গে প্রথম সমুদ্রযাত্রার কথা ৷ উড়ুক্কু মাছ দেখে সেই প্রবল বিস্ময়-সত্যি সত্যি একঝাঁক মাছ আকাশে উড়ছে-জল থেকে উঠে উড়তে উড়তে আকাশ দিয়ে, আমাদের মাথার ওপর দিয়ে, উড়ে গিয়ে খানিক দূরে আবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, উড়ুক্কু মাছের কথা শুনেছিলাম, ভেবেছিলাম কিংবদন্তি ৷ কিন্তু এই দৃশ্য তো সত্যিকারের ম্যাজিক! আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি জলের মাছ আকাশে উড়ছে, জলপরীদের মতোই ডানাওলা কোনও ম্যাজিক মাছ, আমাদের দেখবে বলেই ওরা কৌতূহলে জাহাজের এদিক ওদিকে ওড়াউড়ি করছে নিশ্চয়!
আর ইতেসামুদ্দিন কী লিখলেন সেই আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে? তাঁর মতে, মাছগুলি নিশ্চয় ‘ওড়ে’ না, কোনওভাবে জলের কাঁপনে ভয় পেয়ে জাহাজের গতিপথ থেকে সরে যাবার জন্য শূন্যে লাফিয়ে ওঠে, ঝাঁক বেঁধে আত্মরক্ষার চেষ্টায় ৷ কানকো দিয়ে বাতাস কাটে! ওঁর চোখ বুদ্ধিমান শিক্ষিত মানুষের চোখ-আমার ছিল শিশুর কল্পনা ৷
আর যে শূকরমুখো শীলমাছেদের কথা উনি লিখেছেন, যারা জাহাজকে তাড়া করে যেত আশি মাইল, একশো মাইল, তাদেরও দেখেছি আমি ৷ তারা অবশ্য শীল মাছ নয়, ডলফিন ৷ জাহাজের দুই পাশে এবং পিছন পিছন তারা ঝাঁক বেঁধে সাঁতরে চলে-ঠিক রাস্তায় মোটর গাড়িকে যেমন ধাওয়া করে কুকুরের পাল, তেমনই! শূকরমুখো শীলমাছদের আচরণে তাদের ডলফিন বলেই মনে হয় কেননা শীলমাছদের স্বভাব অন্য রকম ৷ আমি তো শীলমাছও কম দেখিনি? ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্রতীরে সেই বিখ্যাত ‘সতেরো মাইল ড্রাইভ’ আছে ‘এল বামিনো রেয়াল’ হাইওয়ের একটি অংশে-সেখানে দেখেছি শয়ে শয়ে শীলমাছ তীরে জড়ো হয়ে ভীষণ ঘেউ ঘেউ করছে, অবিকল কুকুরের মতো ডাক! ১৯৬৪তে সেই দৃশ্য প্রথম দেখি ৷ জানি না এখনও ঠিক তেমনই আছে কিনা সেই নিশ্চিন্ত শীলমাছদের কলোনিটা ৷
আরেকবার আরেক রকমের অবস্থা দেখেছিলাম শীলমাছেদের-আলাস্কায় সমুদ্রভ্রমণ করবার সময়ে ১৯৮৬তে ৷ চারদিকে তুষারগিরি ভেসে আছে, গ্লেসিয়ারের পর গ্লেসিয়ার পেরোচ্ছি-এক জায়গায় দেখি বরফের দ্বীপপুঞ্জ ভাসছে-আর সেই দ্বীপপুঞ্জে গুচ্ছে গুচ্ছে মায়েরা অলস দ্বিপ্রহরে বাচ্চাদের স্তন্যপান করাচ্ছেন! হ্যাঁ, সত্যি কথা ৷ শুধু সেই মায়েরা সবাই শীলমাছ-মা ৷ তারা নিয়মিত ওই বরফের দ্বীপে উঠে এসে সন্তানপ্রসব করে ৷-ঝাঁকে ঝাঁকে মা, ঝাঁকে ঝাঁকে শিশু, সকলেই খুব ব্যস্ত স্তন্যদানে ও স্তন্যপানে ৷ আর এদিক-ওদিকে কিছু বিশাল ঈগলপাখি উড়ছে ৷ তারা সেই আলাস্কার বিখ্যাত টেকো-ঈগল, যাদের মাথার মাঝখানটা সাদা, বাকিটা কালচে-খয়েরি ৷ ঈগলপাখিরা এখানে কেন? ওরা কি তবে শীল-বাচ্চা খেতে এসেছে?
না, বাচ্চা খেতে নয়, ওরা খাচ্ছে প্রসূতির দেহনির্গত অন্যান্য আবর্জনা যত, প্লাসেন্টা ইত্যাদি ৷ এ হচ্ছে প্রসূতি মায়ের গৃহিণীপনা-জায়গাটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে তো? খাদ্যও জুটবে ঈগলদের ৷ সেই শীলমাছেদের আঁতুড় ঘরের অপরূপ দৃশ্য আমি জীবনে ভুলিনি!
ইতেসামুদ্দিনের বর্ণনার তিমি মাছেরাও এখনও তেমনই আছে ৷ যদিও শুনি জাপান, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে তিমি শিকার করে তিমির স্টেক খাওয়ার প্রচলন তাদের পক্ষে খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ৷ তিমি শিকার যদিও আইনত নিষিদ্ধ, তবু চোরাশিকারিরা আছেই ৷ ক্রেতারও অভাব নেই ৷
আলাস্কার সাগরে দেখেছিলাম (কিলার হোয়েল) খুনি-তিমিদের ৷ তাদের পেটটা সাদা, পিঠটা কালো, শরীরটা অন্য তিমির তুলনায় ছোট লম্বাটে নয়, গোলগাল গড়ন, আর খুবই হাসিখুশি, আমুদে মনে হল তাদের ৷ অনবরত বিপুল ডিগবাজি খাচ্ছে জাহাজের আশপাশে, সার্কাস দেখাচ্ছে যেন আমাদের ৷ জাহাজ দেখে ভয়ের চিহ্ন নেই ৷ বরং দেখানে-পনা দিব্যি আছে! নাম কিন্তু খুনি-তিমি ৷
আর বিরাট দীর্ঘদেহী সৌম্য শান্ত-স্বভাব তিমিরাজদের দেখেছিলাম আটলান্টিকে-ফোয়ারার জল ফিনকি দিয়ে শূন্যে তুলছে নাক দিয়ে ৷ সেবার টুম্পার সঙ্গে জাহাজে করে বস্টন হারবার থেকে তিমি-সন্দর্শনে গিয়েছিলাম ৷ সে অন্য গল্প ৷ তিমি দেখতেই সেই যাত্রা ৷ ইতেসামুদ্দিন তো তা নয় ৷ আলাস্কাতেও আমার উদ্দেশ্য ওটা ছিল না-যাচ্ছি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ৷ তিমিদের পাড়া দিয়েই যাওয়া ৷ শীলমাছদের অঞ্চলটাকেও কিঞ্চিৎ ছুঁয়ে যাওয়া-এই!
তুলনা চলবে না, ইতেসামুদ্দিনের মতো অ্যাডভেঞ্চার তো আমাদের পক্ষে সম্ভবই নয় ৷ তখনও বিজ্ঞান এরকম সর্ব-খর্ব করে দেয়নি, কলাজগতের বেশ মৌরসীপাট্টা ছিল জীবনে ৷
নতুন নতুন দ্বীপের দিকে যাচ্ছিলেন ইতেসামুদ্দিন, আর সারেংদের মুখে শুনছিলেন নতুন নতুন গল্প ৷ এও যেন সেই ইউলিসিসের জলযাত্রা! কত কি ভয়াবহ বিঘ্ন ছিল ওঁদের জলপথে! সাইরেনরা ছিল ৷ দানবরা ছিল ৷
মরিশাস, পেগু, মালাক্কা-এসব দ্বীপের কথা লিখতে গিয়ে লিখেছেন নরখাদক জংলীদের কথা-এরা ছিল মালাক্কায় ৷ তাদের পরনে পশুচর্ম, তারা নানারকম জড়িবুটির চিকিৎসা জানত, রক্তপাত বন্ধ করার, ক্ষতস্থান সুস্থ করে তোলার ৷ কিন্তু জ্বর হলেই মুশকিল ৷ অমনি তার পড়শিরা নাচ-গান সহকারে তাকে খতম করে ৷ তার মাংসের অতি উপাদেয় কাবাব বানিয়ে গ্রামসুদ্ধু সবাই মিলে ফিস্টি করে ৷ তার বাড়ির লোকেরাও নাকি তাতে যোগ দেয় ৷ কী ভয়ানক!
আর মরিশাসে তিনি প্রচুর এন আর আইদের দেখেছিলেন ৷ ওই ডিগ্রিটা তখনও তাদের ছিল না বটে, কিন্তু তারাই বোধহয় জগতের প্রথম এন আর আই-অভিবাসী ভারতীয় ৷ আঠারো শতকে যেমন ওলন্দাজদের কল্যাণে সুরিনাম দ্বীপেও প্রচুর ভারতীয় অভিবাসীর সৃষ্টি হয়েছিল ৷ প্রভূত সংখ্যক ভারতীয় বিভিন্ন বিদেশি জাহাজে লস্করের কাজ নিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন এবং তাঁদেরই একটি দল ফরাসি বণিকদের যুবতী ক্রীতদাসীদের বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন মরিশাসে ৷ দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনাও ছিল না তাঁদের-কেননা স্ত্রীরা তো আর কোনওদিন মুক্তি পাবেন না! এঁদের দেখে ইতেসামুদ্দিনের খুব মন খারাপ হয়েছিল, যদিও তাঁরা নিজেরা দিব্যি ভালোই ছিলেন ৷ কোনও অভিযোগ ছিল না তাঁদের ৷ এই মুসলমান সারেং ও লস্করেরা গিয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৷ মুঙ্গের, ভেলোর, নদীয়া, শাহপুর এবং চট্টগ্রামের মোট সাতজন সারেঙের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হয়েছিল ইতেসামুদ্দিনের ৷
এই চট্টগ্রামের সারেঙের কথা শুনেই আমার মনে পড়ে গেল, আমার জীবনের প্রথম সমুদ্রযাত্রাতে উড়ুক্কু মাছই শুধু নয়, এক চট্টগ্রামের সারেঙের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল আমার ৷
পি অ্যান্ড ও কোম্পানির জাহাজে বাবা-মার সঙ্গে বম্বে থেকে রওনা হয়েছি, জুন মাস, সাল ১৯৫০ ৷ আরবসাগরে প্রবল ঢেউয়ে জাহাজ মোচার খোলার মতো নাচছে ৷ বাবা দিব্যি সুস্থ, ডেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সমুদ্রের ভয়ঙ্কর শোভা সন্দর্শন করছেন ৷ আমি আর মা আমাদেরা কেবিনে শুয়ে শুয়ে প্রবল বমি করছি ৷ মাথা ঘুরছে ৷ সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছি না ৷ খাওয়া-দাওয়া তো দূরস্থান! শুনছি অধিকাংশ যাত্রীরই সেই দুর্গতি হয়েছে! অনশন দু-তিনদিন চলবার পরে বাবা কেবিনে একজনকে ধরে আনলেন ৷ তিনি ওই জাহাজেরই সারেং ৷ বয়স্ক বাঙালি, চট্টগ্রামের মানুষ ৷ মাকে তিনি বললেন, মা কুনোও চিন্তা নেই, শুধু আমি যা দেই, খায়েন! তারপর খুব ঝাল ঝাল লাল লাল গরগরে শুটকি মাছের তরকারি আর ভাত এনে দিলেন আমাদের ৷ তাঁদের নিজেদের রান্না, নিজেদের খাদ্য ৷ সেই পথ্য খেয়েই আমাদের সি-সিকনেস সেরে গেল-সত্যি সত্যি! জীবনে আর কখনও ওরকম সুস্বাদু রান্না খাইনি ৷ সেই চাচা আমাকে ঝাল ঝাল লেবুর আচার আর নোনতা বিস্কুট দিয়েছিলেন, যখনই একটু গা গুলোবে, খেতে বলেছিলেন ৷ যাত্রার শেষাংশে বে অব বিস্কেতে জাহাজ যখন আবার নাচছে, তখন সেই আচার আর বিস্কুট আমাকে বাঁচিয়েছিল ৷ চট্টগ্রামের সারেং শুনলেই তাই আমার বুকের মধ্যে নরম, উষ্ণ কৃতজ্ঞতার স্রোত বইতে থাকে ৷ ইতেসামুদ্দিন সি-সিকনেসের কথা কিন্তু বলেননি ৷
এ গল্প শেষ করি ইতেসামুদ্দিনের বলা গল্প দিয়েই ৷ ‘নরখাদকের দ্বীপ’ বলে তিনি যে দ্বীপটির গল্প বলেছেন, এখন ম্যাপ দেখে মনে হয় সেটি ম্যাডাগাস্কার ৷ সেখানে সোনার খনি ছিল ৷ আর সেই দ্বীপবাসীরা নাকি বিদেশি জাহাজের নাবিকদের ভুলিয়ে এনে, জাহাজটি ধ্বংস করে, নাবিকদের ভোজন করে মহফুর্তি করত ৷ কিন্তু সোনা আছে বলে, স্বর্ণলোভী কিছু সাহেব ব্যবসায়ী ইউরোপ থেকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সমেত ওই দ্বীপে যেত এবং দণ্ডিত মানুষদের বিনিময়ে সোনার তাল নিয়ে ইউরোপে ফিরত ৷
ইতেসামুদ্দিন উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে ঘুরে ফ্রান্সের বন্দরে পৌঁছেছিলেন ৷ পথে ২৬ দিন ধরে প্রবল ঝড়ের মতো বাতাসে উন্মত্ত দোল খেয়েছিল তাঁদের জাহাজ ৷ ফেরার পথে কেপটাউনে থেমেছিলেন, দুসপ্তাহের জন্য ‘হাবসীদের দেশে’ বাসও করেছিলেন ৷ তিনি লিখেছেন ওলন্দাজদের আসার আগে সেই দেশে শুধু বন্য কালো মানুষরা স্বাধীনভাবে বসবাস করত ৷ ক্রীতদাস ব্যবস্থার নিন্দে করেছেন ইতেসামুদ্দিন এই হাবসীদের প্রসঙ্গে ৷
সাইরেনের গল্প দিয়েই শেষ করি বরং ৷ ইতেসামুদ্দিন লিখেছেন ভয়ঙ্কর জলকন্যাদের কথা, যারা আশ্চর্য সুর শুনিয়ে নাবিকদের ভোলায় ৷ তারপর নিশি ডাকের মতো তাদের নাম ধরে ধরে ডেকে নেয় ৷ একবার ডাকে, দুবার ডাকে, তিনবার ৷ ব্যস, তৃতীয় ডাকের পরে জলে ঝাঁপ দেবেই সেই চিহ্নিত নাবিক ৷ যদিও কেউ ফিরে আসে তো সে জন্মের শোধ বোবা হয়ে আসে ৷ মৎস্যকন্যাদের স্বভাবই যুবক, সমর্থ নাবিকদের নিয়ে নির্জন দ্বীপে সংসার করা ৷ তারপর তাদের মূক করে দেওয়া হয় ৷ যদি বা তারা কোনও দিন ফিরেও যায়, কোনও গল্প করতে পারবে না মৎস্যকন্যাদের বিষয়ে ৷ তারা অর্ধনারী, অর্ধ মাছ ৷ ইতেসামুদ্দিন তাদের দেখা পাননি ভাগ্যিস! পেলে আর তাঁকে ফিরে এসে বিলায়েতনামা লিখতে হত না ৷
আমিও মৎস্যকুমারী দেখিনি-সেই ডেনমার্কের সমুদ্রতীরের মূর্তিটি ছাড়া ৷ ইতেসামুদ্দিনের সময়ে সে ছিল না ৷ পৃথিবীর আধখানা প্রদক্ষিণ করে সাত সমুদ্দুর পার হয়ে অবশেষে হুগলি নদীর থেকে রওনা হওয়া তিন-মাস্তুলের পালতোলা জাহাজখানি গিয়ে ভিড়ল ফ্রান্সের বন্দরে, ভূমধ্যসাগরের পাড়ে ৷ ছ মাস জলযাত্রার অন্তে জাহাজে ফেরিওয়ালারা ভিড় করে এল ভালো ভালো খাবারদাবার, টাটকা রুটি, চিজ, মাখন, ফলমূল, বিস্কুট নিয়ে, নাবিকদের দল তো আনন্দে উৎসব জুড়ে দিল ৷ কতদিন ধরে তারা তাজা টাটকা খাদ্য পায়নি ৷ ইউরোপীয়রা স্বভাবতই উল্লসিত, তারা স্বদেশের মাটিতে পা দিয়েছে ৷ আর ইতেসামুদ্দিনও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, মাটিতে তো পা দিয়েছেন ৷ ‘-ছ মাস ধরে কেবলই সমুদ্র আর কেবলই আকাশ-এছাড়া প্রায় কিছুই চোখে দেখিনি ৷ পিঞ্জরে বন্দী পাখির মতোই আমি বসে কেবল জাহাজের পাটাতনে কাঠের তক্তাগুলো গুনে গুনে সময় কাটাতাম ৷ অবশেষে মানুষের ঘরবাড়ি, অবশেষে শুকনো ডাঙা-আমাকে যেন নবজন্ম দিল!’
বিদেশ দেখে তিনি যত খুশি, তাঁকে দেখেও বিদেশিরা তেমনই আহ্লাদিত হয়েছিল ৷ নতুন দেশে ইতেসামুদ্দিনের বিশেষ আনন্দের আরও একটি কারণ ঘটল ৷ সেদেশের নারী-পুরুষ সকলেই তাঁকে দেখে যারপরনাই কৌতূহল বোধ করছিলেন এবং অনাবিল মুগ্ধতা প্রকাশ করছিলেন ৷ বিশেষত নারীরা ৷ ভারতীয় অভিজাতবংশীয় মানুষ বিদেশিরা দেখেননি, তাঁরা ওঁকে রাজাবাদশা মনে করে নিয়ে খুবই মানসম্ভ্রম দিচ্ছিলেন ৷ নিজের পরনের পোশাকের বর্ণনাও দিয়েছেন ইতেসামুদ্দিন, সত্যি রাজাবাদশাদের মতোই, এমনকী কোমরে তলোয়ারটি সুদ্ধু কোমরবন্ধে গোঁজা ৷ মাথায় উষ্ণীষ, গায়ে আচকান দামি শাল, গলায় রত্নহার ৷ পায়ে জুতো ৷
ইউরোপের রাজা-প্রীতি সহজে যাবার নয় ৷ ওঁর দুশো বছর পরে আমরা যখন গেলাম বাবার পরনে তো এসব ছিল না ৷ ছিল কালো গলাবন্ধ প্রিন্সকোট এবং কালো ট্রাউজাস ৷ ছ ফুট দৈর্ঘ্য আর বিপুল গুম্ভরাজি-সঙ্গে সিল্কের শাড়ি আর আটপৌরে সোনার গয়না পরা আমার সুন্দরী মা, আর ফ্রক পরা লিকলিকে আমি ৷ (তখনও লিকলিকে!)-বাবাকেও ইউরোপে কিন্তু অনবরতই রাস্তার মানুষে ভারতীয় রাজা মহারাজা ভাবত!
১৯৫০, তখনও ভারতীয় ভ্রমণবিলাসীদের সঙ্গে দেখাই হয়নি ইউরোপের ৷ যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে সদ্য গা-ঝাড়া দিয়ে উঠছে পশ্চিম ইউরোপ এবং ইংল্যান্ড ৷ ইংল্যান্ডে ‘ভারতীয়’ খুব স্বাভাবিক দৃশ্য ছিল, কেউই অবাক হত না আমাদের দেখে ৷ কিন্তু ভারতীয় পুরুষ মানুষরা তখন স্যুট পরতেন বিলেতে গেলে ৷ বাবা জীবনে কোনওদিন স্যুট পরেননি ৷ প্রিন্সকোট তখনও প্রিন্সদের পোশাক ছিল ৷ ‘প্রিন্সকোট’ তখনও এভাবে চালু হয়নি ভারতীয় পুরুষের ‘ফর্ম্যালওয়্যার’ হিসাবে ৷ বাবার চেহারাটাও তো রাজকীয় ছিল (নামও নরেন্দ্র) আর রানির মতোই অভিজাত মা-টিও ছিলেন আমার, যদিও বেশ গরিব মানুষ আমরা ৷ বাবা যখনই বলতেন, না না, আমরা রাজা-রানি নই, আমরা কবি, দুজনেই কবি, কৌতূহলী মানুষের চোখে মুখে সেই হতাশা দপ করে লোডশেডিং হয়ে যাবার মতো ফুটে উঠত ৷
এই তো? অথচ আমাকে ভুলেও কেউ কোনওদিন রাজকন্যা ভাবেনি ৷ আয়রনি এটাই ৷ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেই আমি বলে দিতাম-‘হ্যাঁ’ ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন