অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়

বদ্রীনাথে প্রথম গিয়েছিলাম পঞ্চাশ বছর আগে ৷ তারপর আরও কয়েকবার বদ্রীনাথ গিয়েছি ৷ প্রথম যাত্রার কথা যেমন স্মৃতিতে উৎকীর্ণ হয়ে আছে, তেমন স্পষ্ট নয় পরের যাত্রার ঘটনাগুলি ৷

প্রথম যাত্রার কিছুদিন আগেই প্রবোধকুমার সান্যালের বিখ্যাত রচনা বেরিয়েছে-‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ৷ বিজ্ঞাপনের ভাষায় সাড়া জাগানো বই ৷ সবাই আকুল হয়ে পড়েছে ৷ রোমাঞ্চকর সে অভিজ্ঞতার বুঝি তুলনা ছিল না ৷ অবশ্যই আমরা জানতাম উত্তরে হিমালয়ের গভীরে, অগম্য উচ্চতায় শঙ্করাচার্যের প্রতিষ্ঠা করা সর্ব-তীর্থসার বদ্রীনাথের মন্দির ৷ কঠিন যাত্রা, অনেকেরই সাধ্যাতীত ৷ প্রবোধকুমার সান্যালের বইতে পথহীন পথ দিয়ে যাত্রার সেই রোমাঞ্চকর বর্ণনা তখনও আমাদের কল্পনার বাইরে ৷ এ তো জলধর সেনের ভ্রমণ বিবরণ হিমালয় নয়, এ হল ভ্রমণ-কাহিনী ৷ ভ্রমণ ও কাহিনীর মিলনে অনাস্বাদিত যৌগিক ফল ৷

প্রবোধকুমার সান্যাল নিজেকে বাস্তববাদী বলতেন ৷ সে বিষয়ে বিতর্কের স্থান নয় এই রচনা ৷ কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে প্রবোধবাবু আবেগ-আশ্রিত লেখায় অদ্বিতীয় ছিলেন ৷ তাঁর বর্ণনা কতটা বাস্তব-অনুরাগী, বদ্রীনাথ যাত্রার আগে জানতে পারিনি ৷

দূর এবং দুর্গমের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণ ৷ আশ্চর্য নয় যে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ পড়তে পড়তে ক্ষণে ক্ষণে রোমাঞ্চিত হই ৷ পর্বতগাত্রে পথ নেই, শুধু পথের চিহ্নটুকু ধরে চলেছে তীর্থযাত্রীরা ৷ তাঁরা তীর্থে চলেছেন, তাই কোনও বাধাই তাঁদের কাছে অনতিক্রম্য নয় ৷ বিশাল বনস্পতিরা অরণ্যপথ ঢেকে রেখেছে ৷ প্রায়ান্ধকার শ্বাপদসঙ্কুল অগম্যভূমিতে সন্তর্পণে পা ফেলে চলেছে তীর্থাকাঙ্ক্ষীরা ৷ কারণ, প্রত্যেকটি মুহূর্তই অনিশ্চিত ৷ প্রকৃতির আদিম চারণভূমির ওপর দিয়ে যাত্রা ৷ নিচে গভীর খাদ ৷ পদস্খলন হলেই জীবন-সংশয় ৷

বর্ণনা পড়তে পড়তে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হয়েছি ৷ ওই পরিবেশ রহস্যময়ী ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র আবির্ভাব আমাদের রোমাঞ্চিত করেছিল ৷

সেই সময় বিয়েবাড়িতে ফুলশয্যার উপহারে ডজনখানেক ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ পাওয়া যেত, যেমন সৌভাগ্য হয়েছিল কয়েক বছর পরে যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাতের’ ৷

ভালো করে কোনও খবর নেওয়া হয়নি ৷ রওনা হবার কদিন আগে গাড়োয়ালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে একটা চিঠি লিখেছিলাম ৷ আমি আর আমার বন্ধু বদ্রীনাথের পথে যাত্রা করছি ৷ তিনি কি পথের ডাকবাংলোয় রাত্রিবাসের জন্য ব্যবস্থা করতে পারবেন ৷ সদ্য দৈনিক কাগজের উচ্চপদে যোগ দিয়েছি ৷ নিজেকে নিয়ে কিঞ্চিৎ দম্ভ ছিল বৈকি ৷ তবু উত্তর পাব এমন বিশ্বাস ছিল না ৷ কিন্তু আশ্চর্য কদিনের মধ্যেই উত্তর এসে গেল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ৷ সাহেব অতিশয় ভদ্র ৷ খবরের কাগজের পদকে মর্যাদা দিয়েছেন ৷ লিখেছেন, আপনারা আসছেন জেনে আনন্দিত ৷ কিন্তু এখন আসবেন না ৷ প্রবল বর্ষায় মোটর গাড়ির রাস্তা বহু স্থানে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ৷ বদ্রীনাথ তো অনেক দূরের পথ, দু-দশ মাইল যাওয়াও প্রায় অসম্ভব ৷

ভদ্রলোকের চিঠি পড়ে আমি হতবাক ৷ আমার সঙ্গে যাবে আমার বন্ধু নীরেন যিনি উত্তরকালের প্রখ্যাত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ৷ দুজনে যাত্রার আয়োজন নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি ৷ হোল্ডল এবং প্রয়োজনীয় ক্যাম্বিশের জুতোও কেনা হয়ে গিয়েছে ৷ যাওয়া হবে না, এমন কথা আমার মন মানতে চায় না ৷ অথচ, হয়তো এখন যাওয়া আদৌ সমীচীন হবে না ৷ এত আলোচনা, এত মানসিক প্রস্তুতির পর থেমে যাওয়া অসম্ভব ৷

স্থির করলাম ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠির কথা নীরেনকে বলব না ৷ সে সংসারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ৷ এই খবরের পর কিছুতেই যেতে চাইবে না ৷ তাকে কিছু না বলাই ভালো ৷ তাছাড়া আমাদের কোটদ্বার পর্যন্ত যাবার টিকিট করাও হয়ে গিয়েছে ৷

প্রচলিত পথ হৃষীকেশ দিয়ে না গিয়ে কেন কোটদ্বার এবং শ্রীনগর হয়ে বদ্রীনাথ যাত্রায় গিয়েছিলাম, এখন আর মনে নেই ৷ কার বুদ্ধিতে আমরা হৃষীকেশ দেবপ্রয়াগ রুদ্রপ্রয়াগ বাদ দিয়ে সোজা শ্রীনগর চলেছি, বলতে পারব না ৷ হয়তো তখনও দেবপ্রয়াগ বদ্রীনাথ শ্রীনগর যাবার মোটর রাস্তা তৈরি হয়নি ৷

এক সন্ধ্যায় উৎফুল্ল নীরেনকে সঙ্গে নিয়ে দেরাদুন এক্সপ্রেসে উঠলাম ৷ নিরুদ্বিগ্ন নীরেনকে দেখে আমার অশান্তি আরও বাড়ছে ৷ কতদূর পর্যন্ত যেতে পারব জানি না, কোথা থেকে ফিরে আসতে হবে, নানা দুর্ভাবনায় আমি জর্জরিত ৷ তার ওপর নীরেনকে না বলে বন্ধুকৃত্যের অপলাপ করেছি, তার যন্ত্রণা ৷

আমাদের সঙ্গে মোটঘাট সামান্য ৷ দুটি হোল্ডল, তার মধ্যে বিছানা কম্বল তোয়ালে ইত্যাদি ৷ একটা মাঝারি মাপের টিনের তোরঙে আমাদের জামাকাপড় ৷ পথে কত ঠান্ডা হবে বুঝতে না পেরে সঙ্গে যথেষ্ট শীতবস্ত্র ৷ খাবার জিনিস সামান্যই নেওয়া হয়েছে ৷ সোনামুগের ডাল, এক শিশি গাওয়া ঘি, দু প্যাকেট বিস্কুট, সামান্য চা পাতা ও চিনি, গুটিকয় পাঁপড়, দু প্যাকেট চানাচুর ৷

শুনে এসেছি কোটদ্বার থেকে বাসে চড়ে আমরা পিপলকোঠি যাব ৷ সেখান থেকে মাইল চল্লিশ পথ পদব্রজে ৷ তাই মোটঘাট বেশি নিইনি ৷ একটি কুলিই যথেষ্ট হবে ৷ ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি পড়ে বুঝেছি আমাদের জন্য ডাকবাংলোর ব্যবস্থা করা হয়নি ৷ অর্থাৎ সাধারণ্যের সঙ্গে পথের ধারে চটিতে রাত্রি কাটাতে হবে ৷ এখনও সঠিক জানি না চটি বলতে কী বোঝায় ৷

সন্ধ্যার মুখে লখনউ-চারবাগ স্টেশনের মুসলিম রেস্টুরেন্ট থেকে রুটি গোস্ত কিনে আনা হল ৷ এমন অপূর্ব সুস্বাদ ছাগ মাংস পূর্বে কখনও খাইনি ৷ এরপর দশ-বারোদিন মৎস্য-মাংসাদি পাওয়া যাবে না ৷ আর এক পাত্র মাংস খেয়ে নিলে ভালো হত ৷ মনস্থির করবার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিল ৷

সূর্যোদয়ের আগে নাজিবাবাদ স্টেশনে নেমে পড়লাম ৷ প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে ৷ আমি আরও দমে গেলাম ৷ আমি তো জানতাম এমন হবে, তবু কেন এলাম, এ অনুশোচনা ঘোচাতে পারি না ৷ অন্যদিকে নীরেন পরম আনন্দের সঙ্গে বৃষ্টির তারিফ করছে ৷ এই নাকি শুভযাত্রার চিহ্ন ৷

অনেক বছর পরে নীরেন একটা কবিতা লিখেছিল ৷ আমার মনে হয়, আমার মনের কথা সেখানে ব্যক্ত করেছিল ৷ কবিরা নাকি মানুষের অন্তরের কথা জানতে পারেন ৷ লিখেছিল:

যাব আমায় যেতেই হবে পথের অতল খুঁজে খুঁজে

থাকব না এই ব্যর্থ ভালোবাসার বিবরে মুখ গুঁজে ৷

যাব আমার জীর্ণ মনোরথের রজু থরো থরো

যাব, আমায় যেতেই হবে পথের প্রদীপ তুলে ধরো ৷

ভাগ্যিস কবিতাটা তখন পড়িনি ৷ কে আমার জন্য পথের প্রদীপ তুলে ধরবে ৷ সেই মুহূর্তে আমার মনোরথের রজ্জুতেও আর টান নেই ৷ একটা ব্যর্থযাত্রা মাঝপথে শেষ করে ব্যর্থ দুই অভিযাত্রী ফিরে আসছি ভেবেই তখন আমার কষ্ট হচ্ছে ৷

নাজিবাবাদ থেকে কোটদ্বার প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠে পড়লাম ৷ ভালো মনে পড়ছে না, ঘণ্টাখানেকের রেলযাত্রা ছিল বোধহয় ৷ জানলা দিয়ে নীরেন বৃষ্টির ঝর ঝর দেখছে, আর আনন্দে উচ্ছ্বসিত হচ্ছে ৷ আর আমি শঙ্কিত মনে প্রত্যাবর্তনের দিন গুনছি ৷

কোটদ্বার আমাদের সঙ্গে অন্যান্য কামরা থেকে কিছু গোর্খা জওয়ান নামল ৷ হঠাৎ দেখি বৃষ্টি থেমে গেল ৷ মাথার ওপর পরিচ্ছন্ন আকাশ ৷ মনে হল এটাই সত্যিকার শুভ লক্ষণ ৷ পাশের প্ল্যাটফর্ম, যেখান থেকে বেরবার রাস্তা, দেখি গোর্খা সৈন্যে পূর্ণ, যেন যুদ্ধের প্রস্ততিতে হাজির হয়েছে ৷ এরা কোটদ্বারে কেন জানবার চেষ্টা করতেই আমাকে পুরো দমিয়ে দেবার খবর পেলাম ৷

প্রতিদিন দু-একশো গোর্খা সৈন্য ছুটিতে বাড়ি যাবার জন্য কোটদ্বার স্টেশনে নামে ৷ সেখান থেকে তারা বাসে উঠে গাড়োয়ালের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায় ৷ কিন্তু গত তিনদিনের প্রবল বর্ষায় রাস্তাঘাট ধুয়ে মুছে গেছে, নানা স্থানে পাহাড় ধসে পড়ে প্রকাণ্ড গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছে ৷ বাস চলাচল বন্ধ ৷ কয়েকটা বাস পথে আটকে পড়েছে ৷ তাই গাড়োয়ালের সৈন্যেরা এখানে প্ল্যাটফর্মে জমা হচ্ছে ৷ আর কোথায় যাবে?

সৈন্যেরা যেখানে সেখানে থাকতে পারে ৷ কিন্তু আমরা ক্ষীণজীবী মানুষ, আমরা কোথায় থাকব? কতদিন থাকব? বাস চলাচল শুরু হবে কি? কবে?

প্রশ্ন শুনে একজন সবজান্তা মানুষ বললেন, বাস এখন সপ্তাহখানেক চলবে না ৷ আগে রাস্তা মেরামত হোক, ধস নামা পাহাড়ে নতুন করে রাস্তা করা হোক, তবে তো?

নীরেনের পাংশু মুখ দেখে আমার মন অনুশোচনায় ভরে গেল ৷ একজন নিষ্পাপ নিরীহ মানুষকে প্রত্যাশিত বিপদের মধ্যে আনা উচিত হয়নি ৷

সবজান্তা ভদ্রলোক যখন জানলেন যে আমাদের অভীষ্ট বদ্রীনাথের মন্দির, বললেন, ওখানে যাবার আশা ছেড়ে দিন ৷ বদ্রীনাথজি ডাকলে তবেই তাঁর কাছে পৌঁছনো যায় ৷ আপনাদের ডাক আসেনি ৷

আরও বললেন, আপনারা এক কাজ করুন, এখান থেকে হরিদ্বার চলে যান, সেখানে হর-কি-পৌড়িতে ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন ৷ আর যদি আজই না ফিরে যেতে চান, তাহলে এখানে এক রাত্রি কাটাতে পারেন ৷ শিবের বিখ্যাত মন্দির আছে ৷ সেখানে পূজাপাঠ করতে পারেন, হোটেল ভালো কিছু নেই কোটদ্বারে ৷ ডাকবাংলোয় একটা রাত থাকতে পারেন ৷

আমরা স্টেশন ছেড়ে ডাকবাংলোর দিকে চললাম ৷ ডাকবাংলো অপ্রত্যাশিতভাবে শহরের মধ্যেই ৷ শুভযোগ বলতে হবে, সেখানে পৌঁছেই মালিকে পাওয়া গেল এবং সে বিনা প্রতিবাদে একটি ঘর আমাদের খুলে দিল ৷ দুই ব্যর্থ-মনোরথ অভিযাত্রী নীরবে স্নান করে তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্টের সন্ধানে বাংলো থেকে বেরলাম ৷ কাছেই বড় রাস্তার ওপরে একটি ব্যস্ত রেস্টুরেন্ট ৷ সামনে উঁচু, চওড়া দাওয়া ৷ সেখানে প্রথমে চা ও ওমলেট খাওয়া হল ৷ এই ভোজনশালা ওমলেট তৈরি করায় অত্যন্ত পটু ৷ পিঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা সহযোগে অসাধারণ একটি ডাবল ডিমের ওমলেট গ্রহণ করে দুঃখ ভোলবার চেষ্টা করেছিলাম ৷ রাস্তায় নানা কাজে নানা লোক চলেছে সারাদিন, আমরা উঁচু দাওয়ায় বসে মানুষের চলাচল দেখে দুপুর পার করে দিলাম ৷ ভাত, রুটি, রসুন দিয়ে সাঁতলানো ডাল, দুটো সবজি-এর থেকে ভালো কিছু আশা করিনি ৷

দুয়েকজন খদ্দেরের সঙ্গে কথা হচ্ছে ৷ কেউ আশার কথা বলছে না, আমাদের সমবেদনা জানাচ্ছে ৷ আমরা দুবার বাস অফিসে ঘুরে এলাম ৷ তালাবন্ধ ৷ খবর দেওয়ার কেউ নেই কোথাও ৷ বৈকালিক চা এবং নৈশভোজনও খুব সুখের হল ৷ দুঃখের মধ্যে ওইটুকু সান্ত্বনা ৷ এই ভোজনশালায় আমিষ বলতে ডিম, তার ওপরে কিছু নেই ৷ আমাদের দুজনের মধ্যে কথাবার্তা কমে গিয়েছে ৷ ভবিষ্যৎ চিন্তায় দুজনেই আকুল ৷

পরের সকালে স্নানাদির পর আমরা আবার আমাদের ভোজনশালায় পৌঁছলাম ৷ বুঝতে পারছি ফিরে যেতেই হবে ৷ ওমলেট আদেশ করেছি ৷ কলকাতায় স্কটিশের উল্টোদিকে কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের ওপর চিত্তবিশ্রাম নামে চা-টোস্ট-ডিমের একটি ক্ষুদ্র রেস্টুরেন্ট ছিল ৷ তাদের ওমলেট আমাকে বহুদিন আনন্দ দিয়েছে ৷ এখানের ওমলেট একেবারে সেই শ্রেণীর, অতি উত্তম ৷ এমন সময় এক খদ্দের ওমলেট আদেশ করে দাওয়ার ওপর আমাদের পাশে চেয়ার নিয়ে বসলেন ৷ বললেন, তোমাদের ওমলেট আমার মনোমত হয় না ৷ আজ আমি নিজে ওমলেট বানিয়ে তোমাদের দেখিয়ে দেব, ওমলেটে কত স্বাদ আনা যায় ৷

আমার বিস্ময়ের শেষ নেই ৷ বলেন কি এই ভদ্রলোকে ৷ এখানের ওমলেট খেয়ে আমরা বিমুগ্ধ ৷ এই ভদ্রলোকের কাছে সেটা নগণ্য ৷ আমরা উন্মুখ হয়ে তার ওমলেটের সৃষ্টি দেখতে লাগলাম ৷ ভদ্রলোক আমাদের কৌতূহল দেখে বললেন, আপনারা কলকাতার লোক আপনারাই ওমলেটের মর্যাদা জানেন ৷ এই পাহাড় দেশের মানুষরা কি ওমলেট বানাবে ৷ আমার তো কলকাতাতেই শেখা ৷ কিন্তু আমি কি কলকাতার ওমলেটের ধারে কাছে পৌঁছতে পারব ৷

অযাচিত অকারণ কত প্রশংসাই না পাওয়া যায় ৷ অত দুঃখের মধ্যেও একটু রোদের ঝিলিক দেখলাম ৷

এমন সময়ে খবর পাওয়া গেল যে গাড়োয়াল মোটর কোম্পানির একটা বাস কাল চামোলি যাবার চেষ্টা করবে ৷ সেই বাসে পোস্ট অফিসের জমে থাকা ডাকও যাবে ৷ রেস্টুরেন্টের মালিক বলল, এখনই টিকিট কাটবার চেষ্টা করুন ৷

অন্য অতিথির ওমলেট তৈরি করা দেখা হল না ৷ আমরা তৎক্ষণাৎ বাস অফিসে দৌড়লাম ৷ সবে ভিড় জমতে শুরু করেছে ৷ জানা গেল, বাসের যাবার কথা পিপলকোঠি কিন্তু যেতে পারবে না ৷ চামোলিতে যাত্রা শেষ ৷ মাঝরাস্তায় একটা বাস বুঝি খাদে উল্টে পড়েছে ৷ দুজনে টিকিট করে ফেললাম ৷ রিজার্ভেশন বলে কোনও পদার্থ নেই ৷ কাল এলেই যে জায়গা পাব তারই বা কি ঠিক ৷ বাস কখন ছাড়বে তাও কেউ বলতে পারল না ৷

আমরা পরদিন সকালে উঠে তড়িঘড়ি ছটার পরই বাক্স বিছানা নিয়েই বাসস্টেশনে পৌঁছে গেলাম ৷ তখনও কেউ আসেনি ৷ নৈশভোজনের সময় শুনেছিলাম যে বাস যাচ্ছে বটে চামোলি কিন্তু এই বাস যাবে না ৷ কিছুদূর গিয়ে গুমখাল ৷ যেখানে ধস নেমে বাসের রাস্তা মুছে গেছে সেখানে এটি থামবে ৷ আমাদের ধস পেরিয়ে গিয়ে ওপাশে আরেকটা বাস ধরতে হবে ৷ তখনও বুঝতে পারিনি কাজটা কত কঠিন ৷ এটুকু বুঝেছিলাম মালপত্র নিয়ে ওই ধস পার হতে পারব না ৷ কাজেই বাক্স বিছানা এখানেই ফেলে দিয়ে প্রয়োজনীয় কম্বল এবং কয়েকটা জামাকাপড় নিয়ে রওনা দেওয়া বুদ্ধির কাজ ৷ পরে ভাবলাম এখানে বাক্স বিছানা ফেলে যাওয়ার কি সুবিধা ৷ যেখানে আটকে যাব সেখানেই বাক্স বিছানা ফেলে যাব ৷

আমাদের নিয়ে বাস নটা নাগাদ রওনা দিল ৷ ক্রমশ উঁচুতে উঠতে লাগলাম ৷ দোগাড্ডা গিয়ে দেখি ডানদিকে ল্যান্সডাউন যাবার রাস্তাটা খুলে গিয়েছে ৷ বাঁদিকে পউরি শ্রীনগরের পথের সঙ্গীন অবস্থা ৷ বাস ড্রাইভার সবাইকে নেমে যেতে বলল ৷ সে খালি বাস নিয়ে ভাঙা জায়গাটা পার হলে তারপর আমরা উঠব ৷ এবারে বাস থামল গুমখালে ৷ দুদিকে উঁচু পাহাড় মাঝে একটা যোগসূত্র, একেই কি পর্বতশিরা বলে থাকে, ইংরিজিতে বলে স্যাডল ৷ সামনে প্রকাণ্ড ভাঙন ৷ পাহাড়ের গায়ে সিকি মাইল রাস্তা নিশ্চিহ্ন ৷ আমরা বাসযাত্রীরা ছাড়া আরও অনেক লোক জমে আছে ৷ একটা ছোট মেলার আকার ধারণ করেছে জায়গাটি ৷ একপাশে ভোজনশালার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল ৷ নদী থেকে মাছ ধরে সকলের জন্য রান্না করা হবে ৷ একজন বাস কোম্পানির কর্তা মতো লোককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল আমরা ওপারে গিয়ে আরেকটা বাস পাব ৷ আমরা এই টিকিট দেখিয়েই সেই বাসে উঠতে পারব ৷ আমরা স্যুটকেস বিছানা নিয়ে ভাবিত হয়েছি দেখে বলল, ডাক নিয়ে যাবার জন্য আমার কুলি আছে তারাই আপনার বিছানা নিয়ে যাবে ৷

একটি ব্রাহ্মণ ভোজনশালায় সদ্য ধরা মাছের ঝোল এবং তপ্ত ভাত দিয়ে নীরেনকে খুশি করা গেল ৷ আমি মৎসাশী নয় বলে আমাকে শুধু ঝোলেই সন্তুষ্ট থাকতে হল ৷

বড় বড় পাথর, পাহাড় প্রমাণ মাটির এপাশ ওপাশ দিয়ে বহু কষ্টে ভাঙনের ওপাশে পৌঁছলাম ৷ পোস্ট অফিসের কুলিরা ততক্ষণে আমাদের বাক্স বিছানা সেখানে নিয়ে এসেছে ৷

দীর্ঘক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম ৷ দুই ভাঙনের মাঝখানে একটা বাস এসে আমাদের এখান থেকে নিয়ে যাবে ৷ কিন্তু সেই বাস আর আসে না ৷ যাত্রীরা অধীর এবং বিরক্ত ৷ এমন সময় একটা ট্রাক এসে পৌঁছল ৷ বাস কোম্পানির সেই কর্তাব্যক্তি আমাদের সঙ্গে এসেছেন ৷ তিনি সবাইকে বললেন, আপনারা ট্রাকে চড়ে পরবর্তী ভাঙনের মুখে চলে যান ৷ সেই ধস পার হলে আবার ভালো বাস পাবেন ৷ বিরক্ত যাত্রীরা এবার ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, তারা পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেছে, তারা নোংরা মালবাহী ট্রাকে চড়তে নারাজ ৷ আমি আর নীরেন সবেতে রাজি, আমাদের গন্তব্যে পৌঁছনো নিয়ে কথা ৷ বাস কোম্পানির কর্তাব্যক্তি আমাদের ট্রাকে তুলে দিলেন ৷ দেখাদেখি আরও কয়েকজন ট্রাকে উঠল ৷ কর্তাব্যক্তি নিজেও উঠলেন ৷ পরবর্তী ধসের মুখে পৌঁছে দেখলাম এই ভাঙন দৈর্ঘ্যে কম ৷ ওপারে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে তাও দেখলাম ৷ সেই কর্তাব্যক্তি এবারে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করলেন ৷ তিনি বাস কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ৷ তার নাম বর্থওয়াল ৷ তিনি আমদের ব্যবহারে মুগ্ধ ৷ বললেন, আপনারা অতিশয় ভদ্রলোক ৷ আমাদের কোম্পানির বাসের ভাড়া নেওয়া শোভা পায় না ৷ আমাদের টিকিট দুটো ফেরত নিয়ে টাকাটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল ৷

বর্থওয়ালের লোকেরাই আমাদের মালপত্র ধসের ওপারে পৌঁছে দিল ৷ নতুন একটা বাসে উঠলাম ৷ ড্রাইভার বলল, এরপর আর ধস নেই ৷ রাস্তা খারাপ, তাই দ্রুত যাওয়া চলবে না ৷ পথে উল্লেখযোগ্য স্থান পউরি, জেলা শহর ৷ আকাশে তখন মেঘ নেই আমরা তখন শহরের ঠিক নিচে দিয়েই যাচ্ছি ৷ হঠাৎ সামনেই সমস্ত দিগন্ত জুড়ে বরফের চূড়া দেখতে পেলাম ৷ মনে হল ওই তো বদ্রীনাথ পৌঁছে গিয়েছি ৷ প্রাণে এত আনন্দের জোয়ার যে নীরেনকে বলেই ফেললাম যে তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ তঞ্চকতা করেছি ৷ সন্ধে হয়ে গেল ৷ আজ রাতে আমাদের থাকতে হবে শ্রীনগরে ৷ সেখানে পৌঁছতে রাত প্রায় নটা ৷ অন্য যাত্রীরা নেমে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল ৷ আমরা কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না, কোথায় আছি কোথায় থাকব ৷ বাস ড্রাইভারের সৌজন্যে আমরা বাস অফিসের বারান্দায় হোল্ডল বিছিয়ে শোবার জায়গা পেলাম ৷ সকালে শ্রীনগর থেকে বাস আবার রওনা হল ৷ চামোলি পৌঁছতে দ্বিপ্রহর ৷ পথে বর্ষার অত্যাচারের চিহ্ন, ভাঙা রাস্তায় ছোটখাটো ধস পার হয়ে বেলা একটা নাগাদ চামোলি পৌঁছলাম ৷ চামোলি অলকানন্দার ওপর ৷ নদীর ওপারে দেখলাম প্রকাণ্ড ধস নেমেছে ৷ আমাদের ঠিক ওখান দিয়ে পার হতে হবে না ৷ গাড়ির রাস্তাটা ঠিক কোথায় ছিল বুঝতে পারা গেল না ৷ বাস থামামাত্র একদল কুলি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ৷ তারা যাত্রীদের মোটঘাট বদ্রীনাথ নিয়ে যাবে ৷ কদিন কোনও কাজ পায়নি ৷ ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছে ৷ কিছু মানুষ, কিছু যাত্রী অবশ্য বর্ষার মধ্যেও এসেছে ৷ তারা তীর্থপদযাত্রা করছে, সবরকম কষ্ট সহ্য করে তারা চলেছে ৷ এদের কারও কুলির দরকার নেই, আর তাছাড়া যার দরকার সে আগেই বন্দোবস্ত করে চামোলি এসেছে ৷ কুলিদের দতিয়াল বলে ৷ এরা বুঝি নেপাল থেকে আসে তীর্থের মরসুমে ৷ মাস ৫ যাত্রীর মোট বয়ে তারপর দেশে ফিরে যায়, আবার পরের বছর আসে ৷ যে ছেলেটি আমাদের মোট নিয়ে যাবে বলল, আমাদের মোট ওজন করবার দরকার নেই ৷ সামনেই ওজন করবার বন্দোবস্ত রয়েছে ৷ এক মনের বেশি হলে কুলিরা বেশি টাকা পায় ৷ আমাদের সঙ্গে ৫০ টাকায় রফা হল ৷ ছেলেটার নাম রূপসা ৷ বলল যে ওই ৫০ টাকা ছাড়া আমাকে মকামে অর্থাৎ গন্তব্যস্থানে খাই খরচ দিতে হবে ৷ বদ্রীনাথে বুঝি খাওয়াদাওয়ার খরচ বেশি পড়ে ৷ তাই কুলিরা চায় খাওয়াদাওয়ার খরচ মালিকরা বহন করুক ৷ আমরা রাজি হয়ে গেলাম ৷ অনুমান করেছি আমাদের চামোলি ফিরে আসতে ৭ দিন বা ৮ দিন লাগবে ৷ রূপসা মোটঘাট পিঠে বেঁধে রওনা হল ৷ বলল আমি সব সময় আপনাদের সঙ্গে নাও থাকতে পারি ৷ পাকদণ্ডী এবং কঠিন পথ দিয়ে আমি যাব, যেখানে দূরত্ব কম হয় ৷ আপনাদের সঙ্গে পিপলকোঠির ঢোকবার মুখে দেখা হবে ৷

সামনে ১০ মাইল পথ ৷ কিছুই চিনি না ৷ বিশেষ লোকজনও দেখতে পেলাম না ৷ দুপুরে এই সময়টা রান্না করে এবং বিশ্রাম করে ৷ আমরা চামোলিতে পুরি তরকারি খেয়ে নিয়েছি ৷ নির্জন চড়াই উতরাই ভেঙে আমরা চলেছি ৷ এই মুহূর্তে মনে কোনও দুর্ভাবনা নেই ৷ আকাশ পরিষ্কার ৷ পিপলকোঠি থেকে বদ্রীনাথ ৪০ মাইল ৷ সে পথ অনায়াসে চলে যাওয়া যাবে ৷ আমাদের অধ্যবসায় দেখে বদ্রীনাথ নিশ্চয়ই আমাদের ডেকেছেন ৷ এই যে এতখানি পথ এসেছি সমস্তক্ষণ একটা যন্ত্রণা মনকে পীড়া দিচ্ছিল ৷ হয়তো পৌঁছতে পারব না ৷ ফিরে যেতে হবে ৷ এখন আর সে যন্ত্রণা নেই ৷ মনোরথ পূর্ণ হবার প্রত্যাশায় আমরা হাঁটছি ৷

প্রবোধকুমার সান্যালের ভয়ঙ্কর করালবদন পথ আমরা এখনও পেরোইনি ৷ গভীর অরণ্য দূরে থাক খুব বেশি গাছপালা দেখিনি ৷ অলকানন্দার বামতীর দিয়ে যেতে যেতে মনে হল আর কোনও ভীষণ ভয়ঙ্কর না থাকলেও যাত্রা বিপদসঙ্কুল ৷ পাহাড়ের গায়ে ক্ষীণ রেখার মতো সরু একটি পথ এঁকেবেঁকে চলেছে, পাঁচ-সাতশো ফুট নিচে নদী, পদস্খলন হলে মৃত্যু সুনিশ্চিত ৷ রূপসা একটু আগে সামনে ছিল ৷ এখন কোথায় হারিয়ে গেল ৷

কাউকে একটু জিজ্ঞাসা করব এমন মানুষ কোথাও নেই ৷ বিশাল এই পৃথিবীতে যেন আমরা দুটি মাত্র প্রাণী ৷ কখনও দেখি নদীর অপর পাড়ের পাহাড় গাছে ঢাকা আছে ৷ কিন্তু আমাদের দিকের পাহাড়ে গাছপালা অনেক কম ৷ কোনও বন্যজন্তু আছে বলে ভয় হল না ৷ এখানে পথ হারালে আমরা কাউকে খুঁজে পাব না ৷ আমাদেরও কেউ খুঁজে পাবে না ৷ কেমন যেন অসহায় নির্জনতা তার নীরবতার মধ্যে আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে ৷ এ পথে কত তীর্থযাত্রী হাজার বছর ধরে চলেছে ৷ কে যে কিসের আকাঙ্ক্ষায় যায়, কী প্রার্থনা করে সে কথা তাদের মনের গভীরে থাকে ৷ তাদের প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে কিনা জানা যায় না ৷ তবু হাজার বছর ধরে অবিরাম যাত্রা চলেছে এই পথ ধরে ৷

পাহাড়কে আঁকড়ে ধরে থাকা যে সংকীর্ণ পথ আমাদের অভীষ্টে পৌঁছে দেবে তাও মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ৷ বর্ষার প্রবল বর্ষণ ছোট বড় উঁচু নিচু কাউকে মার্জনা করে না ৷ অনেক নিচে অলকানন্দার ওপরে দড়ির পোল দেখা যায় মাঝে মাঝে ৷ এপার ওপারের সম্পর্ক ওই জীর্ণ দড়ির পোলের ওপর নির্ভর ৷ মানুষের বসতি কোথাও দেখছি না ৷ না এপারে না ওপারে ৷

আমাদের পথ যখন ক্ষণিক সমতলের মধ্য দিয়ে যায় তখন দূরে মানুষের বাসের দুয়েকটা চিহ্ন দেখেছি ৷ কতদূর এসেছি জানি না ৷ ঠিক পথে যাচ্ছি কিনা বলবার কেউ নেই ৷ প্রায় ৩ ঘণ্টা চলার পর দুয়েকটা মানুষ দেখা গেল ৷ তাদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পিপলকোঠি পৌঁছব ৷ পিপলকোঠি যে কত দূর তা অবশ্য বোঝা গেল না ৷ প্রায় জনহীন সেই পথ ধরে সূর্যাস্তের কিছু পরে একটি বড় জনপদে পৌঁছলাম ৷ পিপলকোঠি ৷

এবারে আমাদের পথ চলেছে গ্রামের মধ্য দিয়ে ৷ প্রথম যে মিষ্টান্নের দোকানটি পাওয়া গেল সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবার পর দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে থাকবার জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে আজকের রাত কাটানোর জন্য ৷ সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আমাদের রাত কাটানোর জায়গাটা ঠিক করা দরকার ৷

দিনেরবেলা গরম ছিল না ৷ এখন মনে হচ্ছে রাতটা ঠান্ডাও হতে পারে ৷ আরও দুয়েকজন খদ্দের ইতিমধ্যে পৌঁছেছে ৷ তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে হালুইকর বললেন, মুদির বাড়িতে জায়গা আছে ৷ সে যদি স্থান দেয় তাহলে সকলের সুবিধা হবে ৷

একটা ভিড় ইতিমধ্যে জমেছে ৷ তার মধ্যে একজন আমাদেরকে মুদির কাছে নিয়ে যেতে চায় ৷

মুদির দোকানটি ছোট ৷ দশ-বারোটি টিন সাজিয়ে বসে আছে ৷ আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল ৷ বায়নাদার ছোট ছেলের মতো বলল, আমি কিন্তু ৫ টাকা নেব ৷ আমরা মুখে ৫ টাকা অনেক বেশি বলতে থাকলেও রাজি হয়ে গেলাম ৷ ইতিমধ্যে অন্ধকার হয়ে এসেছে ৷ মুদির বাড়ির দোতলায় কাঠের ওপর খড় পেতে আমাদের শোবার জায়গা ৷ ইতিমধ্যে রূপসা এসে পৌঁছে ছিল মিঠাইয়ের দোকানে ৷ সে আমাদের হোল্ডল দুটো খড়ের ওপর বিছিয়ে দিল ৷

আমরা ক্লান্ত ৷ কিছু ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করা দরকার ৷ হালুইকরের দোকানে গিয়ে পুরি ভাজি চাইলাম ৷ আমাদের অনুরোধে সে গরম পুরি ভাজতে রাজি হল ৷ আরও ৫-৬ জন গ্রামবাসী এসে পৌঁছেছে ৷ হয়তো গল্প করতে অথবা অজানা অতিথিদের দেখবার জন্য ৷ কলকাতা তাদের কাছে মহা বিস্ময়ের জায়গা ৷ কখনও সেখানে যাবে বলে আশা করে না ৷ কিন্তু না জানি সে কোন স্বর্গদ্বার ৷ আমাদের দুর্বলতা আমাদের প্রথম সুযোগেই জানিয়ে দিলাম ৷ আমরা খবরের কাগজে কাজ করি ৷ গ্রামবাসীরা খুব উৎসাহিত হয়ে পড়ল ৷ নদীর ওপর একটা সরকারি দড়ির সেতু ছিল, কবে ছিঁড়ে গেছে ৷ বহু আবেদন নিবেদন করে আর সেতু তৈরি করেনি সরকার ৷ আমরা পত্রকারেরা যদি মন্ত্রীজিকে বলে দিই তাহলে হয়তো সুরাহা হতে পারে ৷ ইতিমধ্যে গ্রামের মোড়ল এসে গিয়েছেন ৷ তিনি বললেন, আপনারা একটা চিঠি লিখে দিন ৷ মন্ত্রীজিকে আপনারা নিশ্চয়ই চেনেন ৷

চিনি না একথা বলতে পারি না ৷ আবার চিনি বললেও আরও পীড়াপিড়ি হবে ৷ কেউ বলল তার থেকে টেলিগ্রাম লাইন চালু হলে আপনারা কাল একটা টেলিগ্রাম করে দিন ৷ টেলিগ্রাম করবার জন্য কাগজ ও কালি এসে গেল ৷ বহু কষ্টে সে রাতে উদ্ধার পেয়েছিলাম ৷ স্থির হল সকালে বসে টেলিগ্রাম মুসাবিদা করা হবে ৷ শয্যার আরামে নয়, আমাদের মনের আরামে সুখনিদ্রা নিশ্চিত ছিল ৷ কিন্তু টেলিগ্রাম করার কণ্টক আমাদের অতি প্রত্যুষে ঘুম ভাঙিয়ে দিল ৷ আমরা মুদিকে তার প্রাপ্য টাকা দিয়ে রূপসাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম ৷ মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখি কেউ আমাদের টেলিগ্রামের মুসাবিদা করবার জন্য কাগজ কালি নিয়ে অনুসরণ করছে কিনা ৷

সকালটা ভারি প্রসন্ন ছিল ৷ আকাশ নীল ৷ লঘু মেঘ ভাসছে ৷ আমরা প্রতি পদক্ষেপে বদ্রীনারায়ণের নিকটবর্তী হচ্ছি ৷ আবার তখনই এক পশলা বৃষ্টি হয় ৷ আমাদের বর্ষাতি নেই ৷ পথের ধারে পত্রবহুল গাছ পাওয়া যায় না ৷ আমরা নিরুপায় ভিজি ৷ কখনও আকাশ কালো হয়ে এসে আমাদের ভয় দেখায় ৷ আমরা দ্রুত যাওয়ার চেষ্টা করি ৷

দুপুর হওয়ামাত্র একটি চটিতে থেমে গেলাম ৷ এই চটির নাম মনে নেই ৷ চটি মানে পথের ধারে পাহাড়ের গায়ে গা লাগিয়ে একটা ওপরে ঢাকা বারান্দা মতো জায়গা ৷ তার তিনদিক খোলা ৷ পিছনে পাহাড় ৷ পাশে একটি ছোট ঘরে মুদির দোকান ৷ ওই ঢাকা বারান্দায় তীর্থযাত্রীদের ব্যবহারে পয়সা লাগে না ৷ বিনিময়ে যাত্রীকে কিনতে হয় তার খোরাকি মুদির কাছ থেকে ৷ বাসনপত্র নগণ্য ভাড়ায় তারই কাছ থেকে পাওয়া যায় ৷

আমরা হোল্ডল বিছিয়ে তার ওপর বিশ্রাম করতে লাগলাম ৷ রূপসা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বাসনপত্র পরিষ্কার করতে লাগল ৷ চটির সামনে জলের কল ৷ উঁচু কোনও ঝরনা থেকে পাইপে করে সরকারের ব্যবস্থা করা এই জল ৷ সব চটির সামনে এই ধরনের কল দেখেছি ৷ কোনও চটিতে একটার বেশি দোকান দেখিনি ৷ আমাদের চটিতে ৫-৬টি উনুনের মতো ছিল ৷ এইখানে আগুন জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করবে যাত্রীরা ৷ মুদির কাছ থেকে জ্বালানি কাঠ কেনা হয়েছিল ৷ রূপসা একটা উনুনে আগুন জ্বালিয়ে দিল ৷ প্রশিক্ষণহীন আমি সেই উনুনে হাঁড়ি চড়িয়ে খিচুড়ি রন্ধনে প্রবৃত্ত হলাম ৷ দোকানে ভালো চাল পাওয়া গিয়েছিল এবং আলু ৷ আমাদের আনা কপির এবং সোনামুগের ডাল সহযোগে খিচুড়ি তৈরি হল ৷ পরিমাণের জ্ঞান নেই ৷ তাই অনেক হয়ে গেল ৷ আমরা রূপসাকে যথেষ্ট খিচুড়ি দিলাম ৷ সে ভারি খুশি হয়ে খেল ৷ মোট জিনিসপত্রের দাম লেগেছিল এক টাকা ৷

রূপসা খুব তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিল ৷ আমাদের ক্ষুধা এবং ক্লান্তির মুখে নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল ৷ কারণ আমরা কোনও নিন্দা করিনি ৷ রূপসা বাসন মেজেও ফেলল ৷ নীরেন আমাদের থালা দুটি নিয়ে যাচ্ছিল ৷ রূপসা নিজে এসে সে দুটি নিয়ে গেল ৷

ভোজনের পরে বিশ্রামের প্রয়োজন ৷ সময় বেশি নেই ৷ ঘণ্টাখানেক বিশ্রামের পরে যাত্রা শুরু করতে হবে ৷ পরের চটিতে সন্ধ্যার পূর্বে পৌঁছতে হবে ৷

আবার সেই কঠিন যাত্রা ৷ আরোহণ অবরোহণের ক্লান্তি মাঝে মাঝে ছেঁকে ধরে ৷ পরের চটিতে পৌঁছবার আগেই হঠাৎ দেখি তুষারমণ্ডিত কয়েকটি শৃঙ্গ ৷ আবার উৎসাহী হয়ে চলতে থাকি ৷ এবারে যে চটিতে পৌঁছলাম তার নাম গুলাব চটি ৷ সেই একচালা বারান্দা, পাশে সেই মুদির দোকান ৷ সদ্য পরিচিত সেই আয়োজন ৷

গুলাব চটির মুদির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রান্নাবান্নার কাজ শুরু করা গেল ৷ ইতিমধ্যে মুদি তার দোকান বন্ধ করে পাহাড়ের ওপরে তার বাড়িতে চলে গেছে ৷ যাওয়ার আগে বলে গেল এটা নিরাপদ স্থান ৷ আমাদের ভয় পাবার কারণ নেই ৷ তবে হ্যাঁ, কাল সন্ধেবেলা নদীর অন্য তীরে একটা ভালুককে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিলাম ৷ চিতাবাঘও, আছে কিন্তু তারা বড় একটা আসে না ৷

এদিকে খিচুড়ি ফুটছে না-জানি-কতক্ষণ ৷ চাল সিদ্ধ হতে চায় না ৷ যখন আর অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই তখন কম সিদ্ধ খিচুড়ি পরিবেশন করে আমরা আহার শেষ করলাম ৷ নীরেন আবার দুটি থালা ধুতে চেয়েছিল ৷ রূপসা এগিয়ে এসে ধুয়ে দিল ৷ সঙ্গে পাঁপড় ছিল ৷ কিন্তু সেঁকবার ধৈর্য ছিল না ৷ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে পারলে হয় ৷ শোবার পর আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল ৷ মেঘের হাঁকডাকও শোনা গেল ৷ এই জনহীন নির্বান্ধবপুরীতে নীরেন আর আমার একমাত্র সহায় ও সাহস রূপসা ৷ ঘুম এসে গেল ৷

হঠাৎ নীরেনের একটা হাউমাউ শব্দে জেগে উঠলাম ৷ কোনও একটা জন্তু আমাদের বারান্দায় উঠেছে ৷ টর্চ জ্বেলে দেখি প্রচুর লোমওয়ালা একটা কুকুর ৷ নীরেনের ভালুকের গল্প শোনার পর লোমশ কুকুরকে ভালুক মনে করা অস্বাভাবিক নয় ৷ আবার ঘুমিয়ে পড়া গেল ৷ রাতে বৃষ্টি হয়েছে ৷ চালা থেকে মাঝে মাঝে গায়ের ওপর জল পড়েছিল ৷ বিছানা এদিক ওদিক সরিয়ে আত্মরক্ষা করেছি ৷

সকালে মুদি দোকান খুলেছে ৷ তার কাছে চা পাওয়া গেল ৷ পাওনাগণ্ডা আগেই মেটানো ছিল ৷ এখন বাসনপত্র বুঝিয়ে দিয়ে আমরা আবার রওনা হলাম ৷

সেদিন দুপুরে আমরা একটা অতি দীর্ঘ ধসের কাছে পৌঁছলাম ৷ এইখানে পাহাড় অর্ধচন্দ্রাকার ৷ মাঝখানে অনেকখানি ধসে গেছে ৷ আমাদের সঙ্গে যারা গিয়েছে তাদের পায়ে পায়ে একটা পথের ইশারা দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে ৷ নিচে ৫০০ ফুট গভীর খাদ ৷ ভাবিনি এই জায়গাটা পার হতে পারব ৷ বদ্রীনাথের কৃপায় ওপারে গিয়ে পৌঁছলাম ৷ তখনও আমি ভয়ে বিধ্বস্ত ৷ এই স্থানটির নাম পাতালগঙ্গা ৷ এখানে কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল ৷ তাদের একজন তিনবার এই যাত্রা করেছে ৷ সে বলল, এইখানে মাটিটা কাঁচা ৷ প্রতিবছরই এমনই ভেঙে যায় ৷ এবারে গতকাল একযাত্রী খাদে পড়ে গেছে ৷ তার মৃতদেহের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি ৷ মনে মনে ভাবলাম এই মানুষটির কী এমন প্রার্থনা যে বদ্রীনারায়ণের কাছে একে তিনবার আসতে হয়েছে ৷ আমার শরীর তখনও ভয়ে কাঁপছে ৷ ওই মরণফাঁদ পার হয়ে আসতে পেরেছি বিশ্বাস হয় না ৷

বদ্রীনাথের পথে পাহাড়গুলিতে বড় গাছ কম ৷ যে ধরনের অরণ্যের ভূমি দেখব বলে আশা করেছিলাম তেমন কিছু দেখতে পেলাম না ৷

মস্ত একটা চড়াই উঠতে হল যোশিমঠে ৷ আমরা মাঝে মাঝে চা পানের জন্য কিছুক্ষণ বিশ্রাম ছাড়া থামছি না ৷ অনেক উতরাইয়ের পর বিষ্ণুপ্রয়াগ ৷ দুপুরে কোথায় খিচুড়ি চড়িয়েছিলাম মনে নেই ৷ সন্ধ্যার পরে যে চটিতে থামলাম তার নাম বগোদর ৷ সেই একই রুটিনে এখানে রাত্রিযাপন হল ৷ সকালে আবার যাত্রা শুরু ৷ তখন আমাদের মন অধীর ৷ আজ বিকেলের আগেই পৌঁছে যাব আশা করছি ৷

মাঝে মাঝে কোনও যাত্রীদলকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি আবার কখনও কোনও যাত্রীদল আমাদের ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে ৷ ওদিক থেকেও কিছু যাত্রী আসছে ৷ সব দলের মুখে এক আওয়াজ ‘জয় বদ্রীবিশাল কী’ ৷

কোটদ্বার পৌঁছবার পর থেকে যে দুর্ভাবনা ও টেনশন শুরু হয়েছিল এখন হঠাৎ তার থেকে মুক্তি পেয়ে গিয়েছি ৷ আর কোনও বাধা আমাদের আটকাতে পারবে না ৷ অনিশ্চয়তার আশঙ্কা নেই, নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ মনে শেষের দশ মাইল পার হচ্ছি ৷ শুনেছিলাম পথে বরফ পাব ৷ কিন্তু প্রবল বর্ষণে রাস্তার ওপর থেকে বরফ ধুয়ে গিয়েছে ৷ পাহাড়ের ওপরে, আমাদের নিচে, নদীতে নামবার পথে এখনও বরফ জমে আছে ৷ ওপারের পাহাড়ের ওপর বরফ ছোট ছোট হিমবাহ তৈরি করেছে ৷ যাত্রীসংখ্যাও বেশি দেখছি এখানে ৷ সাধু-সন্ন্যাসী, ভিক্ষুকের সঙ্গে সাধারণ গৃহস্থ মানুষেরাও হেঁটে চলেছেন পাশাপাশি ৷ সবারই এক অভীষ্ট, বদ্রীনাথ ৷ মুখে জয় বদ্রীবিশাল কী ধ্বনি ৷ দুটি সম্পন্ন মারোয়াড়ি পরিবার চলেছেন দাস-দাসী সঙ্গে নিয়ে ৷ তাঁদের গৃহিণীরা ডুলিতে, পুরুষরা পদব্রজে, অল্পবয়সীরা টাট্টু নিয়েছে, শিশুরা দাসদাসীদের কোলে ৷ সবাইকে প্রফুল্ল দেখছি ৷ আশপাশে মানুষজন, প্রকৃতি-যা দেখছি সবার মধ্যেই প্রফুল্লতা সঞ্চারিত হয়েছে ৷ এমনই হয়, অনেক কষ্টের পর আকাঁ পূর্ণ হলে আনন্দের সীমা থাকে না ৷ সবাইকে সেই আনন্দের ভাগ দেবার ইচ্ছা হয় ৷

হনুমান চটি থেকে শেষ পাঁচ-ছ মাইল প্রচণ্ড চড়াই ৷ শরীরের কষ্ট হৃদয়ের আনন্দকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ৷ তবু কারও ক্লান্তি নেই, যত দ্রুত পারে হেঁটে চলেছে ৷

এখানে সূরজপ্রসাদের সঙ্গে দেখা হল ৷ সে বদ্রীনাথ মন্দিরের পাণ্ডা ৷ বদ্রীনাথ থেকে এতখানি এগিয়ে এসেছে যজমান ধরবার জন্য ৷ মানুষটি ভালো ৷ বলল, আপনাদের আর কিছু ভাবতে হবে না ৷ আমি আপনাদের ভার নিয়েছি, আপনাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেখা আমার কাজ ৷ আমরা পাঁচ পুরুষের পাণ্ডা ৷

সূরজপ্রসাদ আমাদের দেখভালের কোনও ত্রুটি রাখেনি ৷ তার বাড়িতেই আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করেছিল ৷ কিন্তু আমরা আরও ভালো জায়গা চাওয়াতে, সেই আমাদের অন্ধ্র ধর্মশালায় থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ৷ ব্রহ্মকুণ্ডের ঠিক ওপরেই এই বাড়িটি ৷ উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল মুনশিজির জন্য গত বছরই তৈরি হয়েছে ৷ দুটিমাত্র শয়নকক্ষ ৷ তারই একটায় আমরা উঠেছিলাম ৷

ঈশ্বর বোধহয় মানুষকে অনেক কষ্ট দেন, তার সুখের স্বাদ গভীর করবার জন্য ৷ আমরাও যখন আর চড়াই উঠতে পারছি না, তখন হঠাৎ দূরে, কিছু নিচে সবুজের ছোঁয়া মাখা উপত্যকার এক প্রান্তে আমাদের আরাধ্য দেখতে পেলাম ৷ সূরজপ্রসাদ বলল, এই স্থানটির নাম দেবদেখানি ৷ আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল ৷ তাহলে আমাদের প্রার্থনা পূর্ণ হল ৷ বিশ্বাস হতে চায় না, বরফমণ্ডিত দুই শিখরের নিচে, ছোট্ট মন্দিরটি বদ্রীনাথের ৷ হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের সব প্রান্ত থেকে যাত্রীরা এই মন্দিরে আসার জন্য প্রাণ বিপন্ন করতে দ্বিধা করে না, ভক্তির অমোঘ আকর্ষণ তাদের টেনে আনে ৷

সামনে সেই বদ্রীনাথের মন্দির ৷ সমস্ত অবসাদ যেন মুহূর্তে দূর হয়ে গেল ৷ দুপুরের সূর্য যেন আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে নীলকণ্ঠ পর্বতে ৷ তার নিচে বদ্রীনাথের সোনার চূড়া ৷

জয় বদ্রীবিশাল কী ৷

ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০২

স্বর্গের সিঁড়ি ভেঙে গেছে

অধ্যায় ১ / ১০৭

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন