অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
গতবছর জুলাইয়ের গোড়ায় গিয়েছিলাম কাম্বোডিয়ার আঙ্কোর ভাট মন্দির দেখতে ৷ মন্দিরটি ইউনেক্সোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় স্থান পেয়েছে ৷ ভগ্নস্তূপ সংস্কার করে অতীতের গৌরবময় রূপ ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা এই বিশ্বসংস্থার দায়িত্বে ৷ এই উদ্দেশ্যে আঙ্কোর ভাটে ইউনেক্সোর পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে ৷ অন্যতম প্রতিনিধি ডাঃ বিকাশ সান্যাল ৷ এবার তাঁর আমন্ত্রণ এল সস্ত্রীক ৷ আঙ্কোরের ওপর লেখা ফরাসি পর্যটকদের বই পড়ে অধীর অপেক্ষায় প্রস্তুত হয়ে রইলাম ৷
কাম্বোডিয়ার Khmer ভাষায় নাম কাম্পুচিয়া ৷ এদেশের রাজা প্রিন্স সিহানুক, যিনি আজও জাতির পিতা, জাতীয় সংহতির প্রতীক বলে স্বীকৃত, বলেছিলেন, এ দেশের নাম এসেছে সংস্কৃত শব্দ কাম্বুজা থেকে ৷ উত্তর ভারতের এক উপজাতির নাম ছিল কাম্বু স্বয়ম্ভু ৷ তাদেরই এক রাজকুমার কাম্বু এদেশে এসেছিলেন ৷ নামের সঙ্গে যুক্ত হল জা, সংস্কৃত অর্থ জাত ৷ কাম্বোডিয়ার অধিবাসী Khmerরা ওই রাজকুমারের উত্তরসূরী ৷ ইংরিজিতে দেশটিকে ডাকা হয় কাম্বোডিয়া, ফরাসি ভাষায় কাম্বোজ ৷ এর উত্তরে থাইল্যান্ড ও লাওস, পুব আর দক্ষিণে ভিয়েতনাম, দক্ষিণ পশ্চিমে সিয়াম উপসাগর ও থাইল্যান্ড ৷
ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্টে রয়্যাল কাম্বোজ প্লেন ধরে কাম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন-এ যাচ্ছি ৷ উড়োজাহাজ যখন পোচনটং এয়ারপোর্টে নামছে নিচে দেখতে পাচ্ছিলাম মেকং, বাসাক, টনলেসাপ নদী ৷ ধানের খেত ৷ খড়ের চালা ৷ পরে শহরে দেখেছি প্রাচীন স্থাপত্যে তৈরি প্রাসাদ, সিলভার প্যাগোডা, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, চাতোমুখ হল, ফরাসি ঔপনিবেশিক বাড়ি, আধুনিক ছিমছাম অফিস বাড়িঘর ৷ নমপেন এয়ারপোর্টের দরজার ওপরে সাতমাথার ফণাতোলা নাগরাজ, কাঠের খোদাইয়ে ৷ রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে বেঁকে গাড়ি অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল ৷ এই রাজপ্রাসাদের পিছনের বাগানে মাত্র এক সপ্তাহ আগে মিনি যুদ্ধ হয়ে গেছে প্রথম প্রধানমন্ত্রী নরোদম রণরিধ আর দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হুনসেনের দেহরক্ষীদের সঙ্গে ৷ অফিসের দোতলার জানলা থেকে দেখছি বাইরে রাজপথ সিহানুক রোডে রোদ্দুর ঝলসাচ্ছে ৷ পথঘাট নির্জন ৷ মাঝে মাঝে দুয়েকটি মোটরবাইক আর সৈন্য ভর্তি জিপ গাড়ি চলে যাচ্ছে ৷ দূরে প্রাসাদের বাগানে সবুজের সমারোহ ৷ এককোণে পবিত্র বটগাছের নিচে বেদিতে শান্ত সমাহিত বুদ্ধমূর্তি, থেরাবাদা বৌদ্ধধর্মের বোধিসত্ব ৷ কিছুক্ষণ পর রামা ইন হোটেলে যাওয়ার পথে দেখি খাকি পোশাকে সঙ্গিন উদ্যত করে চলে যাচ্ছে সৈন্যবাহিনী ৷ অথচ এখানকার মানুষের মুখে কী কোমল লাবণ্য ৷ মেয়েদের মসৃণ ত্বক, কলুষহীন মুখ ৷
সমপত ছিল আমাদের গাড়ির চালক কাম গাইড ৷ খুব ভাঙা ইংরিজিতে অনেক কিছু জানাবার চেষ্টা করত ৷ শহর দেখাত ৷ বিকেলে গেলাম খেলার মাঠে ৷ সেখানে ছেলেমেয়েরা খেলছে ছা ওল ছুয়ং ৷ গামছার মতো কাপড় জড়িয়ে নারকোল সাইজের বল তৈরি করেছে, এক টুকরো কাপড় দড়ির মতো ঝুলে আছে ৷ এর নাম হল ছুয়ং ৷ বল ছুড়ে দিচ্ছে ছেলেদের দল থেকে একজন বিরোধীপক্ষের মেয়েদের দলটির দিকে ৷ ছেলেটি ছুয়ং ছুড়তেই অন্য দলের মেয়েটি ধরে ফেলে আর ছুড়ে দেয় তার পছন্দের ছেলেটির দিকে ৷ যাকে লক্ষ করে ছোড়া হল সে যদি ধরতে না পারে তা হলে তাকে মেয়েদের দলে গিয়ে গান গাইতে হবে ৷ অনেক লোক জমেছে ওদের ঘিরে মজার মজার গান শোনার জন্য ৷ সমপত একটি পুরনো গান অনুবাদে শোনাল-
ছুয়ং দিলাম ছুড়ে, ওগো আমার সখী,
সাবধান যেন ছোঁয় না কো সে মাটি ৷
যদি মাটি ছোঁয় ভাবছ কেন কন্যে
গান গাইব শুধু তোমার জন্যে ৷
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে গানের উত্তর প্রত্যুত্তর শুনলাম, যদিও ভাষা অজানা ৷ সকলের গলায় ক্র্যামা, চেক কাটা স্কার্ফের মতো ৷ সুতি অথবা রেশমে বোনা ৷ আমাদের দেশের গামছার মতো এর ব্যবহার ৷ রোদ্দুর থেকে মাথা বাঁচানো, মুখ ঢেকে ধুলো বাতাসের হাত এড়ানো, মাথায় পাগড়ির মতো জড়িয়ে মাল বওয়া ৷ সারং অর্থাৎ স্কার্ট, সামপত মানে লুঙ্গি, কখনও অ্যাপ্রন, কখনও হাফপ্যান্ট ৷ মেয়েরা ক্র্যামায় শিশুকে জড়িয়ে পথ হাঁটছে ৷ গিঁট দিয়ে থলি বানিয়ে বাজার করে আনছে ৷ দুপুরে গাছের তলায় রিকশাচালক হ্যান্ডেলে জড়িয়ে বালিশের মতো মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে ৷ ক্র্যামা যেন এদেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ ৷ প্রতিটি প্রদেশের নকশা আলাদা ৷ খেলার দলের ছেলেমেয়েদের গলায় নানা রঙের নানা ডিজাইনের ক্র্যামা জড়ানো ৷
এর পরদিন গেলাম নমপেন শহর থেকে একটু দূরে রেশম শিল্পের জন্য খ্যাত কাম্পং চং গ্রামে ৷ ঘরে ঘরে তাঁত ৷ মেয়েরা রঙিন সুতোয় ফুটিয়ে তুলছে অসাধারণ নকশা ৷ সোনারুপোর সুতোয় বোনা আনালুহ জরির ঘেরে কখনও বা দীর্ঘ রেখায় বাইয়ন মন্দিরের দেবরাজের মুখ, অপ্সরাদের নাচের ভঙ্গিমা ৷ ভেষজ রঙে রাঙানো রেশমের কাপড়ের ওপর আঙ্কোর ভাট মন্দির থেকে নেওয়া ডিজাইন-ফুল ময়ূর কেয়ূর কঙ্কন শঙ্খ পদ্ম অপ্সরা, উদ্যত-ফণা জোড়া সাপ, যূথবদ্ধ হাতি, যুঁই কনকচাঁপা ৷ রেশমশিল্পীদের মুখও যেন অপ্সরাদের মতো ৷ রেশমশিল্পী থিলকা সানের নির্দেশে তারা পুরনো এক গান শোনাল অতিথিদের-
পুরনো কালের মতো সাজো, সুখ খুঁজে পাবে ৷
রবিবারে লাল রং, সোমবার গভীর হলুদ
মঙ্গলে বেগুনী আর বুধবার তামাটে সবুজ,
বৃহস্পতিবার পরো হালকা সবুজ
শুক্রবার গাঢ় নীল রং
শনিবারে উদ্ধত গোলাপি ৷
সঙ্গে জলতরঙ্গের মতো বাজনা বাজাচ্ছিল আরেকজন তরুণী শিল্পী কনিয়্যা সান ৷
সন্ধেয় বাসাক নদীর ওপর জাপানিদের উপহার কাম্বোডিয়ার শান্তির ব্রিজ পেরিয়ে পরপর দুসন্ধ্যায় গিয়েছি আমাদের বন্ধু ডাঃ সুপথের সঙ্গে নৈশভোজের এক আশ্চর্য জগতে ৷ রেস্তোরাঁর স্বর্গভূমি ৷ কী ভিড়! গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়াই মুশকিল ৷ একটি রেস্তোরাঁয় নদীর ধারে টেবিল নিলাম আমরা ৷ যেন উৎসব হচ্ছে এখানে ৷ আলোর মালায় লোকজনের হৈচৈয়ে মনেই হচ্ছে না, দিনে এই শহরেই বলয়িত হচ্ছে অসন্তোষের ধোঁয়া যা ছড়িয়ে যাবে সাতদিনের মধ্যে গোটা দেশে ৷
মাছ খেলাম ৷ ত্রে দামরেই ৷ হস্তীমৎস্য ৷ কাম্বোডিয়ার আদি জাতি নাগেরা এই মাছের পুজো করত বলে এখনও প্রাচীন-প্রাচীনারা এই মাছ ছোঁন না ৷ পঞ্চাশ বছর আগে বিজয়ী ভিয়েতনামীরা খেতে শুরু করে ৷ সেই থেকে চালু ৷ এরপর এল মিষ্টি জলের গলদা চিংড়ি ৷ এ রকম সুস্বাদু চিংড়ি বহুদিন খাইনি ৷ সঙ্গে কাঁচা আম কু রিয়ে সস ৷ তারপর কাঁঠালের কোয়া লিচু আনারস ৷ অপ্সরার মতো সুন্দরী কমবয়সী মেয়েরা কাজ করছে, টেবিলে অভ্যর্থনা করে বসাচ্ছে, পরিবেশন করছে ৷ বয়স সতেরো আঠারোর বেশি হবে না ৷ এরা রাতে কাজ করে কিন্তু নটায় বাড়িতে ফিরতেই হবে ৷ রেস্তোরাঁর গাড়ি এদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেয় ৷ পোশাকে আশ্চর্য শালীনতা, ব্যবহার স্নিগ্ধ ৷ হাত জোড় করে নমস্কারের নম্রতায় ঝুঁকে দাঁড়ানো সবখানেই ৷ বৌদ্ধধর্মের প্রভাব দেশে ৷ চল্লিশের ওপর যাদের বয়স তাদের অনেকেই গ্রামে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে লেখাপড়া শিখেছেন ৷ ডাঃ সুপথের বাল্য ও কৈশোর এভাবে কেটেছে ৷ শিখতে হয়েছে আচার ব্যবহার সহিষ্ণুতা ও নম্রতা ৷ অথচ এ দেশেই বারবার বয়ে গেছে রক্তের নদী ৷
পরের সন্ধ্যায় নাচের প্রোগ্রাম দেখতে গিয়ে একই কথা মনে হয়েছে ৷ বড় উঁচু কাঠের মঞ্চে কাম্বোডিয়া জাতীয় নৃত্যসংস্থা থেকে ছেলেমেয়েরা এসেছে নৃত্যপরিবেশনে ৷ বাঁ পাশে অর্কেস্ট্রায় ৷ জলতরঙ্গের মতো কাঠের বাজনায় টুংটাং বাঁশের বাঁশি আর ঢাক ৷ সুর একই, অপরিবর্তিত হয়ে ফিরে ফিরে আসছে ৷ নাচের মূল বক্তব্য রামায়ণের কাহিনী ঘিরে ৷ রাম সীতার বিয়ে, সীতাহরণ, রাম-রাবণের যুদ্ধ, বালী সুগ্রীবের লড়াই ৷ আবার মাঝে মাঝে প্রাত্যহিক জীবনের ছোট ছোট ছবিও নাচের ছন্দে ৷ নায়ক নায়িকার মান অভিমান ধানকাটা মাছধরা চাষবাস সব কিছুই ৷ নর্তকীদের মুখ ও দেহভঙ্গি আঙ্কোরের মন্দিরের গায়ে খোদাই অপ্সরার মতো ৷ এদের লাবণ্যময় মুখ আর তন্বী শরীর আশ্চর্য করে ৷ ১৯০৬ সালে, প্যারিসের ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে এই নাচ দেখে শিল্পী রদাঁ মুগ্ধ হয়ে যান ৷ বলেছিলেন, ওরা যেন স্বপ্ন জগতের নারী ৷ জগতের অনুপম সৌন্দর্যের পশরা নিয়ে ওরা চলে যায় নাচের শেষে সব শূন্য করে ৷ এদের নাচের প্রতিটি ভঙ্গিই যেন পূজার প্রণতি ৷
আজ সকালে নমপেনের কাম্বোডিয়ানা সোফিতেল হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি ৷ সামনে মেকং নদী ৷ আগামীকাল সিয়েমরিপে যাওয়ার কথা ৷ স্বপ্নের ভগ্নস্তূপ আঙ্কোর ভাট দেখার স্বপ্ন চোখে ৷ কাল রাতে ফরাসি পর্যটক অঁরি মুয়তের লেখা ‘আঙ্কোর মন্দির আবিষ্কার’ ডায়েরি পড়ছিলাম-এই নদীর জল আকণ্ঠ পান করেছি ৷ এর কোলে কখনও দোল খাওয়া কখনও আমার ধৈর্যের পরীক্ষা ৷ মেকং প্রান্তিকে পাহাড় রেখে রাজমহিমায় বয়ে যায় যেন এক অকূলের নদী ৷ কখনও সে কাদায় হলুদ ৷ অতি কদাকার ভয়ংকর তার রূপ ৷ প্রকৃতিবিজ্ঞানী মসিয়ঁ্য মুয়ৎ, ১৮৬০ সালে আঙ্কোর ভাট মন্দির আবিষ্কার করেন ৷ তাঁর ডায়েরি থেকে ইউরোপ জানতে পারে গভীর জঙ্গলে ঢাকা রহস্যময় গম্ভীর সৌন্দর্যের মন্দিরের কথা ৷ মেকং নদীর উত্তরমুখী উৎসধারা খুঁজতে গিয়ে নদীর ধারে জঙ্গলে মুয়ৎ মারা যান ৷ মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ডায়েরিতে এই কথাগুলি লেখেন ৷ কাম্বোডিয়া ভিয়েতনাম লাওস এসব দেশের ইতিহাস যুদ্ধের ইতিহাস, প্রাণক্ষয় রক্তসংগ্রাম মৃত্যুর ইতিহাস ৷ এইসব দেশগুলির মধ্য দিয়ে সততই বয়ে চলেছে চার হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘ নদী মেকং ৷
সিয়েমরিপ ছোট্ট এয়ারপোর্ট ৷ খুব একটা ভিড় নেই ৷ বছর ত্রিশ বয়সের ছিপছিপে যুবক থল এসেছে ড্রাইভারের সঙ্গে ৷ এ কদিন থলই আমাদের আঙ্কোর মন্দির দেখাবে ৷ মোটামুটি ইংরিজি বলতে পারে ৷ গাড়ি চলেছে সিয়েমরিপের রাস্তা দিয়ে ৷ গ্রামই বলা যায় ৷ ধানের খেত, নারকেল, তাল গাছের সারি, চায়ের দোকান, দুঃখী বাজার, হোটেল ট্যুরিস্ট ৷ গোল্ডেন আঙ্কোর ভিলেজ হোটেলে এলাম ৷ শাড়ি-পরা বলে এত উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম কি না কে জানে ৷ ভারতবর্ষ কাম্বোডিয়ান জীবনে এমন ভাবে জড়ানো, হতেও পারে ৷ মালিকের বৌ সিতা সানের বাচ্চা হবে ৷ কী সুন্দর নিচু হয়ে নমস্কারের অভ্যর্থনা! মুখের হাসিটি উজ্জ্বল ৷ দুতিনটি কিশোরী পরিচারিকাও নমস্কার জানাল ৷ প্রতিনমস্কার আমাদের তরফ থেকেও ৷ পরিচ্ছন্ন হোটেল ৷ বাইরে বাগান ৷ সেখানে, ছোট্ট মন্দিরের ভেতর গেরুয়া বসনে দুই দেবী মূর্তি ৷ বুদ্ধের মতো মুখ ৷ ধূপ জ্বলছে ৷ দেবীদ্বয়ের গলায় যুঁইয়ের মালা ৷ পায়ের কাছে পদ্মের গোছা ৷ হোটেল থেকে বেরোতেই দেখি, সিয়েমরিপ নদী একটু দূরে খালের মতো তিরতির বয়ে যাচ্ছে ৷ দুধারে জঙ্গল, দীর্ঘ গাছের সারি ৷ Khmer বাড়িগুলি কাঠের থামের ওপর দোতলায় ৷ বাইরে পেঁপে গাছে প্রচুর পেঁপে ৷
সিয়েমরিপ কথাটায় অর্থ পরাজিত শ্যামদেশ ৷ বিক্রমশালী রাজার হাতে প্রাচীন কালে, থাই সৈন্যরা এখানে পরাজিত হয়েছিল ৷ এখান থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে আঙ্কোরের মন্দির ৷ প্রাচীন ইতিহাসে, আঙ্কোরের নাম ছিল নাখন ৷ সংস্কৃত শব্দ নগর থেকে এসেছে ৷ আঙ্কোর সভ্যতার ভাষা ছিল সংস্কৃত ৷
কাল আঙ্কোর ভাট দেখতে যাব ভোরবেলায় ৷ দ্বাদশ শতকের আঙ্কোর ভাটে পৃথিবীর বিষ্ণুমন্দিরটি বৃহত্তম হিন্দুমন্দির ৷ কাম্বোডিয়ার প্রতিটি অফিসে, বাড়িতে, রাস্তার স্মৃতিস্তম্ভে, জাতীয় পতাকায়, জাতীয় প্রতীকে সবসময় আঙ্কোর ভাট মন্দিরের চূড়াগুলির ছবি ৷ আমাদের ড্রাইভার হিরোহিমা আর গাইড থল বিকেলে এল সিয়েমরিপে দুটি মন্দির দেখাতে ৷ গ্রামের পথ ধরে এলাম রয়্যাল ক্রুসেড ফর ইনডিপেন্ডেস-এর বাগানে ৷ বড় খুকি আর ছোট খুকির মন্দিরে উজ্জ্বল কালোরঙের মূর্তিদুটির পায়ের তলায়, পদ্ম-যুঁই-চাঁপার অঞ্জলি ৷ ধূপ মোমবাতি জ্বলছে ৷ প্রতিদিনের মতো আজও এসেছে ভক্তরা ৷ সন্ন্যাসী, ভিক্ষু সাধারণ মানুষ ৷ সারা কাম্বোডিয়ায় এঁদের পুজো হয় ৷ এঁদের দৈব ক্ষমতায় মানুষের অগাধ বিশ্বাস ৷ মূর্তিদুটি ব্রোঞ্জের তৈরি ৷ আশ্চর্য লাবণ্যময় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো-করতলের রেখায়, প্রাচীন দেবনাগরী অক্ষর আর রেখাচিত্র ৷ গেরুয়া-পরা দেবীদের মুখে অবলোকিতেশ্বরের শান্ত ছাপ ৷ দূর দূর থেকে মানুষ আসে আরোগ্য প্রার্থনায়, দুর্ভাগ্যের কালোছায়া ঘেরা জীবনে সৌভাগ্যের কামনায় ৷ আনে উপচার, জল দিয়ে ধোয়ায় দেবীদের করতল ৷ থল আমার হাতে একমুঠো কনকচাঁপা ফুল দিল ৷ দেবীদের পায়ের কাছে রেখে দেশটির সৌভাগ্যের আশীর্বাদ চাইলাম ৷ আর যেন রক্ত না ঝরে, আর যেন প্রাণক্ষয় না হয় ৷ থল ও হিরোহিমা সমবেত প্রার্থনায় মগ্ন ৷ ওদের চোখে জল ৷
হোটেলে ফিরে এলাম সন্ধে নামতে ৷ গর্ভবতী সিতা, মধুর হাসিতে আপ্যায়ন করল ৷ সবসময় সে কিছু না কিছু খাচ্ছে লক্ষ করেছি ৷ খাবারের থালা হাতে থাকে দিনেরাতে ৷ সকালে দেখেছি, মোড়ায় বসে একথালা ভাজাভুজি খেতে ৷ ইঙ্গিতে প্রশ্ন করেছিলাম, খাবারটি কী? মনে হল কুচো চিংড়িভাজা ৷ বেশ লোভনীয় লেগেছিল ৷ এই সন্ধেয় দেখি, করিডরে প্রশস্ত বারান্দায় লাফাচ্ছে বিশাল বিশাল আরশোলার মতো পতঙ্গ ৷ এত পরিচ্ছন্ন হোটেল, এত আধুনিক, সব গোলমাল করে দিল ওই উড্ডীন পতঙ্গের দল ৷ থল বলে উঠল, সকালে সিতা সানকে যা খেতে দেখে তোমার জিভে জল এসেছিল এই সেই আরশোলা ৷ ওর বর ঝাঁটা দিয়ে সংগ্রহ করছে ৷ একটা বালতিতে রাখবে, তারপর ডানা ছিঁড়ে পেট পরিষ্কার করে গরম তেলে পেঁয়াজ রসুন দিয়ে ভাজা হবে ৷
পরদিন ভোরে উঠে আঙ্কোর ভাটের দিকে যাচ্ছি ৷ দুধারে জঙ্গল ৷ শিমুল, পিপুল, জাকারান্ডা, বট, তেঁতুল, ডুমুর গাছের সারি ৷ জঙ্গল ঘন হয়ে আসছে ৷ মাঝে মাঝে চাঁপা গাছ থেকে ঝরে পড়ছে সাদা ফুল ৷ ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ, কুবো পাখির ডাকের মতো এক অচেনা পাখি ডেকে চলেছে বনে ৷ ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে ৷ থল বলল রমদুয়ল ফুলের সুবাস ৷ গাড়ি মোড় ঘুরে দাঁড়াল এক বিশাল জলাশয়ের সামনে ৷ দিঘি এত দীর্ঘ যে নদী মনে হচ্ছে ৷ দূরে ছাইরঙা এক প্রাসাদের ভগ্নস্তূপ ভোরের আকাশে পাঁচটি দীর্ঘ চূড়া বিদ্ধ করে দাঁড়ানো ৷ থল বলে উঠল, Naghon Wat ৷ আমরা আঙ্কোর ভাট প্রাসাদের সামনে দিঘির ধারে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের ভগ্নস্তূপের দিকে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম ৷ সকালের সূর্য ততক্ষণে পড়েছে প্রাসাদ চূড়ায় ৷ আঙ্কোর ভাট জাগছে ৷ ছোট ছোট বাচ্চারা ছুটে এসে পাখার হাওয়া দিচ্ছে, বিদেশি অতিথির গরম লাগতে পারে ৷ ওদের কচি হাতে তালপাতার পাখা, বিক্রির জন্য ৷ বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে চার বছরের বাচ্চাটি, ভাঙা ইংরিজিতে বিক্রি করতে চাইছে বাঁশের বাঁশি ৷ কেউ বা পিকচার-পোস্টকার্ড ৷ প্রাসাদ-মন্দিরের সৌন্দর্য যেমন সময়ে মলিন, তেমনই ম্লান বর্তমান সময় ৷ এরা সব দুঃখের সংসার থেকে উঠে আসা শিশু ৷ সারাদিন ট্যুরিস্টদের পিছনে পয়সা রোজগারের ধান্দায় ৷ ছেঁড়া হাফপ্যান্ট, উদোম গা ৷ তবে ভিক্ষা চাইতে দেখিনি একজনকেও ৷ দূরে এক বৃদ্ধ এসরাজের মতো যন্ত্রে ছড়ি চালিয়ে করুণ সুর বাজাচ্ছেন ৷ সাত আট বছরের রুক্ষ চুলের চার বালিকা নেচে চলেছে অপ্সরার নাচ ৷
দিঘির পাশ দিয়ে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলেছি ৷ প্রাসাদ-মন্দির; এক জটিল রহস্যপূর্ণ সৃষ্টিসম্ভারের ঐশ্বর্য চোখের সামনে দাঁড়ানো ৷ একশো কুড়ি বর্গমাইল জুড়ে মন্দির ৷ শুধুমাত্র ত্রিশটি ঘুরে দেখা যায় ৷ মন্দিরের গায়ে শ্যাওলা, গাছের ডাল দেওয়ালে ৷ বাকি জঙ্গলের আগ্রাসী কবলে চোখের আড়ালে ৷ স্থাপত্যশিল্পের অনুপম সৌন্দর্যের কাছে মাথা নত হয়ে যায় ৷ এই ভগ্ন মন্দিরে তীর্থযাত্রীরা এসেছে, প্রার্থনা করেছে বৌদ্ধভিক্ষু, সাধারণ মানুষ ৷ বিষ্ণু, লক্ষ্মী, দুর্গা, রামচন্দ্র, ব্রহ্মা, বোধিসত্বের পায়ে আজও রাখে পুষ্পার্ঘ্য ৷ পূজা হয় ধূপ জ্বালিয়ে প্রদীপের আরতিতে, ভগ্নস্তূপের লুকনো মন্দিরে ৷ আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ৷
এদেশের বৃহত্তম হ্রদ টনলেসাপ আর কুলেন পর্বতমালার মাঝখানে, এক উর্বর মাটিতে নবম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত সময়ে, প্রাচীন Khmer রাজারা এক বিশাল রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন ৷ শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, ওই প্রাচীন সভ্যতার পরিশীলিত অভিব্যক্তি আঙ্কোরের প্রাসাদ-মন্দির সৃষ্টির শিল্পে ৷ এই নগর, প্রাচীন মন্দির, রাজপথ, তীক্ষ্ণ দুর্গচূড়ায়, প্রাকারে, কারুকার্যময় প্রবেশদ্বারে, সে যুগে, কী অসামান্য দক্ষতার পরিচয় ফুটেছিল তাই ভাবছি ৷ আঙ্কোর ভাটের মন্দির তৈরি হয়েছিল দ্বাদশ শতকে, রাজা সূর্যবর্মণের সময় ৷ বিষ্ণুর উপাসক রাজা ৷ প্রাসাদচূড়ার ঘরে পূজার বেদীতে বিষ্ণু মহিমময় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো ৷ এই মন্দিরগুলির স্থাপত্য এবং অলংকরণ দাঁড়িয়ে আছে হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের ওপর ৷ হিন্দু পুরাণ, সৌরজগতের ঐশ্বর্য, আচার বিধি পালনের রীতিনীতি, সবই শিল্পে উৎকীর্ণ ৷ এক পবিত্র ধর্মের আদর্শ ও চিন্তাধারায় যুক্ত মন্দিরটি যেন এক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক ৷ যখন, প্রাসাদের একতলা থেকে ধীরে ধীরে এক এক তলায় উঠি, মনে হয় এই পার্থিব জগৎ থেকে এক ঊর্ধ্বলোকের দিকে যাত্রা ৷ যেন মানুষের আর দেবতার জগতের মধ্যে এক সেতু বাঁধা ৷
পশ্চিম দরজা দিয়ে ওপরে উঠছি ৷ দুটি পাথরের বিশাল সিংহমূর্তি পাহারায় ৷ পনেরোশো অপ্সরা দেওয়ালে খোদিত ৷ এদের কবরীসজ্জা, অলঙ্কারের শিল্পসুষমা, দেহের বঙ্কিম ভঙ্গি আর স্মিত রহস্যময় হাসির অধর দেখে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ৷ স্বর্গের আলোর পরীর দল প্রস্তরীভূতা ৷ এরপর রামায়ণ মহাভারতের গ্যালারি ৷ দুই মহাকাব্যের কাহিনী দেওয়ালে ৷ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ-কৌরব ও পাণ্ডবদল ৷ ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত ৷ নিকটে পঞ্চপাণ্ডব জোড়হাত প্রার্থনায় নতজানু ৷ দ্রোণাচার্য তীরধনুক হাতে দাঁড়ানো ৷ কর্ণ মাটিতে প্রোথিত চাকা টেনে তোলার ব্যর্থ প্রয়াসে ক্লান্তমুখ ৷ রথের সারথি কৃষ্ণ, অর্জুন জ্যা তুলে ধরেছেন ৷ তূরী, ভেরী, শঙ্খ বাজানো দুদলের সৈন্য এগিয়ে আসছে ৷ আরেক দেওয়ালে রামায়ণ ৷ সীতার স্বয়ম্বরসভা, অগ্নিপরীক্ষা, স্বর্ণমৃগের দিকে রামচন্দ্র তীর ছুড়ছেন ৷ হনুমান, বালী, সুগ্রীব, তারা, মন্দোদরী, লঙ্কার যুদ্ধ, কৈলাস পর্বত কাঁধে নিয়ে দাঁড়ানো রাবণ-কী নেই! পাথরে খোদাইয়ের সূক্ষ্ম কাজে, প্রতিটি কাহিনী সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ৷
পুব গ্যালারিতে, ভাগবত পুরাণ থেকে নেওয়া সমুদ্র-মন্থন কাহিনী ৷ দেবতা ও দানবের মন্থনে উঠবে অমৃত ৷ তিনভাগে দৃশ্যটি ধরা হয়েছে ৷ নিচে সামুদ্রিক জীবেদের খেলা ৷ তারা কখনও বাস্তব কখনও পৌরাণিক, রূপক মূর্তিতে ৷ সর্পদেবতা ঘিরে আছে তাদের ৷ মাঝের অংশে, বিরানব্বইজন স্ফীতচক্ষু হেলমেটের মতো শিরস্ত্রাণ পরা দানবেরা, অপর দিকে আয়তচক্ষু শঙ্খের মুকুট পরা দেবতারা ৷ রূপসী অপ্সরাদের বিস্ময়-চকিত দৃষ্টি ৷ ক্ষীর সমুদ্রে, মন্দার পর্বতে বাসুকীনাগকে জড়িয়ে অমৃতমন্থনের জন্য দুদিকেই প্রবল টান ৷ লক্ষ্মী উঠে আসছেন অমৃতকুম্ভ হাতে ৷ তৃতীয় ধাপে বিষ্ণু নানা অবতারে খোদিত ৷ দীর্ঘ দেওয়াল জুড়ে বহুবার শোনা পৌরাণিক কাহিনীটি কী অসামান্য শিল্প-লাবণ্যে খোদাই করা আছে!
থলকে কথা বলতে বারণ করলাম ৷ এখন মন দিয়ে দেখা, প্রাণ দিয়ে উপলব্ধি ৷ দূরে অলিন্দের কোণে একজন কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে ৷ Khmer বাঁশির সেই উদাস সুর প্রাচীরের ঐশ্বর্যসম্ভারকে ঘিরে আমাদেরও ছুঁয়ে যাচ্ছে ৷ প্রতি কোণেই অপ্সরাদের দাঁড়িয়ে থাকা নৃত্যভঙ্গিমা চেয়ে দেখার মতো ৷ অলিন্দের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো চিকরি কাটা হয়ে বারান্দায় ৷ বিষ্ণুমূর্তি ঘিরে পুজো হচ্ছে ৷ এক বৃদ্ধা হাত জোড় করে বসে কী এক মন্ত্র গাইছেন, প্রাণ ছুঁয়ে যায় ৷
এরপর গেলাম বাইয়ন মন্দির দেখতে ৷ দ্বাদশ শতকে, সপ্তম জয়বর্মণ এই মন্দির তৈরি করেছিলেন বোধিসত্ব অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে ৷ আঙ্কোরের মন্দির থেকে একটু দূরে নির্জন বাইয়ন মন্দিরের সৌন্দর্য বিস্ময়ে অভিভূত করে ৷ স্থাপত্য-শিল্প মৌচাকের মতো দাঁড়ানো ৷ শিল্পকাজ প্রতিটি কোণে ৷ একটার মাথার ওপর আরেকটা ৷ সব মিলিয়ে শিল্পের ভিড় বলা যায় ৷ তিনতলার মন্দির ৷ পুব দিক দিয়ে ঢুকতেই দেখি সৌন্দর্যের পশরা সাজানো অপ্সরাদের দেহভঙ্গিমায় ৷ দেওয়ালে পদ্মপাতা ফুল বাহারি নকশা খোদাই করা চারদিকে ৷ এখানে পৌরাণিক কাহিনীগুলি উৎকীর্ণ আছে আঙ্কোর ভাটের মতোই ৷ কিন্তু অনেক বেশি প্রাত্যহিক জীবনের ছবি দেখতে পাচ্ছি ৷ মাছ ধরা, বাজারহাটে বিকিকিনি, মোরগ লড়াই, যাদুকরের যাদুখেলা দেখতে লোক জমেছে ৷ নারকেল গাছে বাঁদরেরা বসে আছে ৷ কোথাও খোদিত নৌকা, দেওয়াল ঘিরে বেঁকে গেছে নদীর স্রোতের সঙ্গেই যেন ৷ একটি মেয়ে বসে আরেকজনের মাথার উকুন বাছছে, মা খেলছে শিশুদের সঙ্গে; প্রসবের যন্ত্রণামুখে নারী শিশুর জন্ম দিচ্ছে, হাসপাতালে রোগীর করুণ মুখ, শিকারি, সামনে বিশাল প্রাণীটিকে তীরবিদ্ধ করতে ধনুকে জ্যা পরাচ্ছে ৷ পাথরে খোদাই বনজঙ্গল ৷ ধান গুঁড়ো করছে মেয়েরা, কুলোয় ঝাড়া হচ্ছে, বাঘের ভয়ে দৌড়ে গাছে উঠছে মন্দিরের পুরোহিত ৷ সার্কাস হচ্ছে, কুস্তি হচ্ছে, বাঁশি ভেঁপু ঢাক বাজিয়ে শোভাযাত্রা রাজপথে ৷ শিব দশহাতে দাঁড়ানো ৷ পাশে নন্দী ৷ কামদেব শিবের দিকে গাছের আড়াল থেকে শর নিক্ষেপ করছেন; পার্বতীও আছেন ৷ উড়ন্ত অপ্সরা পাখিদের সঙ্গে আকাশে ৷ জীবনের ছন্দসুষমা পাথরে কথা বলছে ৷ অনন্ত শয়নে শায়িত বুদ্ধমূর্তিটি কী শান্ত! কেউ এইমাত্র ধূপদীপ জ্বালিয়ে গেছে; পদ্মের ডালি ৷ তার নিচের ধাপের দেওয়ালেই আবার রাজা জয়বর্মণের সঙ্গে চম্পাসৈন্যদের যুদ্ধ, মৃত্যুর বীভৎস রূপ খোদাই করা ৷ আর আছে, চুয়ান্নটি চূড়ায় দুশো খোদিত মুখ; তাদের ঠোঁটে এক আশ্চর্য রহস্যময় হাসি ৷ চতুর্মুখের বোধিসত্ব অবলোকিতেশ্বর ৷ ঠোঁট ঈষৎ বঙ্কিম, চোখের পাতা নিচু হয়ে মুখে একটা ছায়া ফেলছে, যেন কিছু বলতে চায় ৷ চওড়া কপাল, স্ফুরিত নাসা, পুরু ঠোঁট ঈষৎ হাসিতে দুধারে কুঞ্চিত-সব মিলিয়ে আঙ্কোরের রহস্যময় হাসি ৷ গভীর জঙ্গলের মধ্যে এই প্রাসাদ-মন্দির প্রথম খুঁজে পান ফরাসি লেখক পীয়ের লতি ৷ তাঁর ভাষায়-চলে যাওয়ার আগে চোখ তুলে ওপরের মন্দির-প্রাসাদের চূড়াগুলির দিকে তাকাতেই গা শিউরে উঠল ৷ গোধূলি আকাশ ৷ জঙ্গলে অন্ধকার নামছে ৷ ঈষৎ আলোয় দেখি, একটি মুখ বিস্তৃত হাসি ঠোঁটে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ স্থির হাসি ৷ তারপর আরেকটি মুখ-তিনটি, চারটি, অজস্র মুখ সবখানে ৷ এই রহস্যময় হাসি আমাকে কিছু বলতে চায়? তারা চারদিক থেকে আমাকে দেখছে ৷ যেন শূন্যে ভেসে থাকা মুখ ৷ এমনই বিশাল মহিমময় যে একটু সময় লাগে বুঝতে ওরা পাথরে খোদাই করা মুখ ৷ এই অনুধাবনের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ওদের দিকে তাকালে মেরুদণ্ডে শিহরন বয়ে যায় ৷ চারদিকে গড়া অজস্র মন্দিরের মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে দাঁড়িয়ে থাকা বাইয়ন মন্দির পীয়ের লতির মতো অনেককেই অভিভূত করে ৷
দুপুরের রোদ চড়া হয়ে উঠছে ৷ আঙ্কোর দিঘি পেরিয়ে, তা প্রম ভগ্নস্তূপ দেখতে চলেছি ৷ (Ta Prohm) ৷ তা প্রমকে গাছের মন্দির বলে ডাকা যায় ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আবিষ্কৃত এই মন্দিরে যেন এক ঐশ্বরিক উপস্থিতি ৷ ডুমুর, পিপুল, বট গাছের দীর্ঘ শিকড় পাথরে ছড়িয়ে আছে কত যুগ থেকে; জড়িয়ে রেখেছে মন্দিরের চূড়াগুলি আর দেওয়াল ৷ একটি পাথরে দেবনাগরী লিপি খোদাই করা আছে ৷ গাছেরা এমনই আড়াল দিয়ে রেখেছে এগনোই কঠিন ৷ মাঝে মাঝে অন্ধকার অলিন্দ ৷ থলের ইশারায় পথ চলা ৷ মন্দিরটি রাজা তাঁর মাকে উৎসর্গ করেছিলেন ৷ এখন চারদিকে, মোটামোটা শেকড় নামিয়েছে বিশাল বিশাল গাছ ৷ পাথরের উদ্ধত সিংহের মাথা মাটিতে লুটানো ৷ পৌরাণিক চরিত্রের মূর্তিগুলো ভেঙে পড়ে আছে এখানে ওখানে ৷ কোথাও কোনও মূর্তির পায়ের তলায় মুখে নরম সবুজ শ্যাওলা জমে আছে ৷
টনলেসাপ হ্রদের দিকে চলেছি ৷ পৃথিবীর এক আশ্চর্য হ্রদ ৷ এখানে, প্রতি বর্ষায়, মেকং, টনলেসাপ আর সিয়েমরিপ নদীর জল একটি নদীর স্রোত অন্য দিকে ঘোরায় ৷ টনলেসাপ নদী, ফুলে ফেঁপে বিপরীতমুখী হয়ে বয় ৷ মেকংয়ে না পড়ে হ্রদের জলে এসে মেশে ৷ সবথেকে বড় মিষ্টি জলের হ্রদ ৷ বন্যার জল ছড়ায় বনে জঙ্গলে ৷ মাটি উর্বর হয়ে ওঠে ৷ পলিমাটিতে ফলে সোনার ফসল ৷ আঙ্কোর সভ্যতা দাঁড়িয়ে ছিল এই উপচে পড়া ঐশ্বর্যের ওপর ৷ বন্যার জল থেকে দেশকে রক্ষা করা আর খরার সময় দিঘি পরিখা কেটে জল সঞ্চিত করে খেত মাটি সিঞ্চিত করার অভিনব কৌশল আঙ্কোরের রাজারা আয়ত্ত করেছিলেন ৷
গ্রামের পথ ধরে গাড়ি চলছে ৷ ট্রাক ভর্তি সৈন্যরা উদ্যত সঙ্গিনে চলে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে ৷ পরপর চারটি কনভয় গেল ৷ থলকে জিজ্ঞেস করলাম, বিপদের অশুভ ইঙ্গিত নয় তো! রহস্যপূর্ণ হাসিতে মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর দিল ৷ চোখে ভয়ের ছাপ দেখলাম ৷ থলের অভিজ্ঞতা আছে সময়ে ঝড়ের সঙ্কেত দেখতে পাওয়ার ৷ Khmer Rouge-এর নিষ্ঠুরতায় দেশে যখন রক্ত ঝরেছে থল তখন কিশোর ৷ থলের চোখের সামনে মারা গেছে ওর প্রিয়জন, বুলেটের আঘাতে, অনাহারে ৷ কাম্বোডিয়ার টরচার মিউজিয়ামে দেখেছি, বুদ্ধিজীবীদের ওপর কী ভাবে অত্যাচার চালিয়েছিল পলপট সরকার! সেই দিনের ছায়া নামবে আবার এদেশে? থল গুনগুন করে এ সব বলে চলেছে ৷ পথের দুদিকে দিঘিতে, পদ্মফুল ফুটে আলো হয়ে আছে ৷ ধানের খেত যেন ছাঁটা লন ৷ পথে একটি পাহাড়ের চূড়ায় কামান রাখা আছে; সেখানেও সৈন্যদের জিপ দাঁড়ানো ৷ এই কামান থেকেই পলপটের সময় আগুন ঝরেছিল? থলের দিকে প্রশ্নের দৃষ্টি ফেলতে গিয়ে দেখি সে আমার ক্যামেরায় মন দিয়ে দূরে কুলেন পাহাড়ের ছবি তুলতে ব্যস্ত ৷ মাঝে মাঝেই সৈন্যরা গাড়ি থামাচ্ছিল ৷ ইউনেস্কোর পতাকা দেখে ছেড়ে দিচ্ছিল ঠিকই; কিন্তু চোখে, সন্দেহের ছায়া ঝিলিক দিয়ে উঠতে দেখেছি অনেকবার ৷ টনলেসাপ হ্রদের ধারে মাছের ভেড়ি ৷ মাচা পেতে মাছের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে পসারিনী ৷ বেশ নোংরা আর দুঃখী জায়গা ৷ কেনাবেচা চলছে ৷ থল নামতে বারণ করল ৷ গাড়ি থেকেই ওই অকূলের হ্রদ আর জীবনের কোলাহল মুখরিত বন্দর দেখে হোটেলে ফিরছি ৷ পথে খোলা বাজার বসেছে ৷ পদ্মবীচি, কাঁঠাল, লিচু বিক্রি হচ্ছে ৷ পাশেই মাচার ওপর ঝিকমিক করছে সোনার অলংকার, রুবি, নীলা, রত্নখোচিত গয়না ৷ সন্ধে হয়ে এসেছে ৷ হোটেলের উঠোনে দেবীদেউলে ধূপ জ্বলছে ৷ কাল এখানে শেষ দিন ৷ খুব ভোরে যাব আঙ্কোরে Phnom Bakhen মন্দির দেখতে ৷
ভোরে ড্রাইভার আর থল এল ৷ আবার আঙ্কোরের পথে ৷ প্রায় অন্ধকার রাস্তা ৷ অত ভোরেও সৈন্যরা দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ তখনও জানি না এই সিয়েমরিপেই দুদিন পর দুর্যোগের ঝড় নামবে ৷ গা ছমছম করছিল ৷ আঙ্কোর ভাটের উত্তরে এই শিবের মন্দির ৷ দশম শতকে এই মন্দির তৈরি করেন রাজা যশোবর্মণ ৷ এখান থেকে আঙ্কোর ভাটের পাঁচটি চূড়া দেখা যায় ৷ আঙ্কোরের নির্জনতম জায়গা ৷ ভোর পাঁচটা ৷ তখনও আঙ্কোর ভাটের সামনে দিঘির ওপর কুয়াশা ৷ সোজা রাস্তা অনেকটা উঁচুতে, জঙ্গল বিদ্ধ করে উঠে গেছে আকাশের দিকে ৷ যেন এক তীর্থযাত্রা ৷ বেশ কষ্ট হচ্ছিল উঠতে ৷ কিন্তু সব পরিশ্রম সার্থক হল ওপরে উঠে ৷ সময় যেন এখানে থেমে আছে ৷ শূন্যে আকাশে ভাসমান এক পৃথিবীর ছাদে দাঁড়িয়ে আছি মনে হচ্ছে ৷ কী শান্ত চারদিক ৷
হঠাৎ দেখি অন্ধকার কেটে আলো ফুটছে ৷ মন্দিরের চূড়ায়, বেদীতে, খোলা চত্বরে, শিবলিঙ্গে আলোর ছটা ৷ যেন ইন্দ্রজালের মায়া ৷ অনেক নিচে পড়ে আছে Khmer সাম্রাজ্য তার পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে ৷ খুব মন দিয়ে দেখলে, দূরে দুর্গম মন্দির Prha Vihear দেখা যায় ৷ দক্ষিণ-পূর্বে আঙ্কোর ভাটের সুতীক্ষ্ণ চূড়াগুলি আবছা দেখা যাচ্ছে ৷ বেলা বাড়ছে ৷ পাল্টে গেল আকাশের রং ৷ কমলা, হলুদ, লাল, গোলাপি, সোনালি ৷ ঝলমল করছে আঙ্কোর ভাট ৷ দিঘির জলেও সেই রঙের খেলা ৷
নামবার পথ খুব সরু ৷ কোনও রাস্তাই নেই ৷ মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে পাহাড়ের পাথর ভেঙে অনেক নিচুতে রাস্তা পড়ে আছে ৷ পাথরের খাঁজে পা দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ একাগ্রতায় আমরা নামতে শুরু করলাম ৷
ট্রপিকাল জঙ্গলে শেকড় ও গাছের ডালপালায় আবদ্ধ মন্দিরে কাজ চলছে ৷ মন্দির তৈরিতে পাথর জোড়া দেওয়া হয়নি ৷ স্তরে স্তরে, পাথর কেটে সাজিয়ে চূড়ার মতো প্রাসাদগুলি উঠে গেছে ৷ গাছে শেকড় এই দেওয়ালে বহুদিন ধরে এমন ভাবে প্রোথিত যেন যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে কারুকার্যখচিত তোরণ, বুদ্ধের যুক্তপাণি, অপ্সরার কবরীসজ্জা ৷ এই ভগ্নস্তূপ আজ মানুষের ইতিহাসে, এক বিশেষ উত্তরাধিকার তালিকায় ভুক্ত ৷ জঙ্গল যেমন মন্দিরে আপন প্রতাপ ছড়িয়েছে, মানুষের হাতও কম ক্ষতি করেনি ৷ কত মূর্তি চুরি হয়ে গেছে ৷ বিক্রি হয়ে চলে গেছে বিদেশি সংগ্রাহকদের হাতে ৷ তবে কঠিন শত্রু হল নিচে বয়ে যাওয়া জল ৷ শ্যাওলা আবদ্ধ জল আগের মতো বয়ে যেতে পারছে না ৷ তাতেও পাথরে ঘুণ ধরছে ৷ চেষ্টা চলছে নানাভাবে এই ঐতিহাসিক প্রাসাদ-মন্দিরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার ৷ ১৯৮৬ সালে, ভারত ছয় বছরের পরিকল্পনায় রক্ষণকাজে হাত দিয়েছিল ৷ ফরাসিদের কুশলী দলটিও কাজ করেছে ৷ বর্তমানে, ইউনেস্কোর World Monument Fund ও অন্যান্য আরও সংস্থা এই রক্ষা পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ৷ নাম অপ্সরা পরিকল্পনা ৷
পাঁচশো বছর ধরে, আঙ্কোর এবং সমগ্র দেশটিই প্রাচীন Khmer-দের এক অসাধারণ কীর্তি স্বাক্ষর-স্মৃতি বহন করে ৷ ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে এলাম ৷ মন্দিরের চাতালে, সৈন্যরা দাঁড়ানো ৷ কোন দলের? একই তো পোশাক! কারা প্রথম প্রধানমন্ত্রীর সৈন্য, কারা দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রীর, বোঝা যাচ্ছে না ৷ একই পোশাকের সৈন্যরা রাইফেল নিয়ে ঘুরছে ৷ ওদের পায়ের বুটের শব্দ, মন্দিরের দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে ৷ তবু এখনও ঝিঁঝির ডাক, কোকিলের কুহুধ্বনি, কুবো পাখির ডাক নিয়ে শান্ত সৌন্দর্যে দাঁড়ানো আঙ্কোর ৷ বেশিদিন এই শান্তি থাকবে না বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না ৷ হোটেলে ফিরে এলাম ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে সিয়েমরিপ ছাড়ব ৷ বাক্স গোছাচ্ছি ৷ সিতা সানের পিতামহ বাইরে রোদে বেতের চেয়ারে বসে থাকেন প্রায় সময় ৷ সারাদিন এই হোটেলের সামনে দিয়ে মার্চ করে গেছে বন্দুকধারী সৈন্যরা ৷ অভিজ্ঞ বৃদ্ধকে প্রশ্ন করলাম থলের মাধ্যমে, ভবিষ্যৎ বিপদের কোনও অশুভ ইঙ্গিত পাচ্ছেন কি না ৷ বললেন, অনেক যুদ্ধ দেখলাম ৷ লন নলের সঙ্গে পলপটের যুদ্ধ, সিহানুকের সঙ্গে আমেরিকার, ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিরোধী সংগ্রাম, আমেরিকার লড়াই পলপটের সঙ্গে, পলপটের যুদ্ধ ভিয়েতনামের সঙ্গে ৷ আটাত্তর বছর বয়স হল; সব কি আর মনে আছে? আরেকটা যুদ্ধও আসবে, আর কী! বেশি দিন বেঁচে থাকলে সহ্য করতে হয় অনেক কিছু ৷ ক্র্যামার খুঁটে, চোখ মুছলেন ৷ সিতা সানকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলাম ৷ Joom reap leah বিদায় বিদায়, আবার দেখা হবে ৷ করজোড়ে নমস্কার জানাল সবাই ৷ থলের চোখে আশঙ্কা দেখে মন খারাপ করে উঠল ৷ আঙ্কোরকে যেমন বিদায় জানানো যায় না, এ কদিনের সঙ্গীদেরও যেন বিদায় বলতে পারলাম না গাঢ় বিশ্বাসে ৷
ব্যাঙ্ককে ফিরে এলাম ৷ পরদিন হোটেলে সন্ধেবেলায় টেলিভিশন খুলতেই খবর পেলাম কাম্বোডিয়ায় কু দে তা হয়েছে ৷ ৪ জুলাই, হুনসেনের সৈন্যরা রাজধানী দখল করেছে ৷ প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাসনে ৷
থল আঙ্কোরের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের শোনাত পলপটের সময়কার রক্তমাখা কাম্বোডিয়ার ইতিহাস ৷ বাবা মায়ের সঙ্গে মাঠে সারাদিন পরিশ্রমী ধান চাষ ৷ ডুমুরের পাতা সেদ্ধ খেয়ে থাকা ৷ মাসে একবার মাত্র ভাত খেয়েছে কি না সন্দেহ ৷ সেই দুঃসময় আর নয় ৷ আঙ্কোরে পরিকল্পিত বিশ্ববিদ্যালয়টি শেষ হলেই সে পড়তে যাবে ৷ তিনবছর পড়ার পর গাইডের ডিপ্লোমা অর্জন করবে ৷
এসব গত বছরের কথা ৷ যুদ্ধও এখন অতীতের ঘটনা ৷ পর্যটকদের জন্য কাম্বোডিয়া আবার দরজা খুলেছে ৷ আঙ্কোর ভাটের মন্দির আজকাল ব্যাঙ্কক থেকে কন্ডাক্টেড ট্যুরেও দেখে আসা যায় ৷
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন