অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
জাঁসকার উপত্যকার সদর পদুম থেকে শুরু হবে আমাদের এই পর্বের পদযাত্রা অভিযান ৷ এখান থেকে লে যাব ৷ পদুম থেকে হাঁটাপথে লে যাবার প্রচলিত পথ হল লামায়ুরু হয়ে ৷ লামায়ুরু পর্যন্ত হাঁটাপথ ৷ তারপর লে যেতে হয় গাড়ি চেপে ৷ এপথে বহু বিদেশি অভিযাত্রীদের যাতায়াত আছে ৷ এছাড়াও পদুম থেকে সরাসরি পায়ে হেঁটে লে যাবার আরও একটি পথ আছে ৷ যে পথে বছরে দু-তিনটির বেশি অভিযান সংগঠিত হয় না ৷ আঞ্চলিক লোকজনের চলাফেরাও কদাচিৎ ৷ দুটি গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে পৌঁছতে হবে মারখা উপত্যকায় ৷ তারপর মারখা থেকে প্রচলিত পথে লে পৌঁছে যাওয়া ৷ জাংলা থেকে মারখা পর্যন্ত কোথাও কোনও বসতি নেই ৷ তবে এপথটি মোটেই দুর্গম নয়, নদী পারাপারই হল দুর্গমতার কারণ ৷ হিমশীতল জলে পা ডুবিয়ে ১১৮ বার খরস্রোতা নদীনালা পেরোতে হবে ৷ লাফিয়ে পেরোতে হবে আরও বহু নালা ৷ কোথাও পুল নেই ৷ কোথাও নদী পেরোতে হবে এক কোমর জল ভেঙে ৷ বিশেষ করে খুরনা নদীর গভীরতা ও খরস্রোত ফিরিয়ে দেয় বহু অভিযাত্রীকে ৷ গিরিখাত গভীরে প্রবাহিত নদীনালা ধরেই চলার পথ ৷ আকাশচুম্বি রুক্ষ খাড়া-পাহাড়ের গভীরে এ এক বৈচিত্র্যময় ও রোমাঞ্চকর পদযাত্রা ৷ এ পথের বিবরণ পেয়েছি সামান্য কিছু লেখায় ৷ এক অন্য স্বাদের ট্রেকিং করার জন্য এই টুকরো টুকরো বিবরণই আমাকে উৎসাহিত করেছিল ৷ এককথায় বলা যায়, এই অভিযানটি হল গভীর গিরিখাতের মাঝে জলে জলে পথ চলা ৷
আমরা পদুমে পৌঁছেছি লাহুলের মায়ার উপত্যকা থেকে ৷ উদয়পুর থেকে গ্রেট হিমালয় বিভাজিকা গিরিশিরার ওপর অবস্থিত কাংলা পেরিয়ে ৯ দিনের হাঁটাপথে এখানে এসেছি ৷ মানালি থেকে লে ও কারগিল হয়ে বাসে পদুম আসা যায় ৷ আবার শ্রীনগর থেকেও কারগিল হয়ে এখানে আসা যায় ৷ পদুম থেকে মালপত্র বইবার জন্য ঘোড়া চাই ৷ আর চাই পথ দেখাবার জন্য অভিজ্ঞ ঘোড়াওয়ালা ৷ পদুমে ঘোড়া-ওয়ালাদের আড্ডায় পৌঁছে যাই ৷ কারগিল সহ কাশ্মীরে জঙ্গি তৎপরতার জন্য পদুমে খুবই কম পর্যটক এসেছে ৷ অনেক ঘোড়াওয়ালাই সঙ্গী হতে রাজি ৷ কিন্তু ওই পথে লে যেতে রাজি নয় ৷ সকলের ভয় হল নদীর জল ৷ কেউ বলে বড় নদীতে জলের গভীরতা কোমর পর্যন্ত ৷ আবার কেউ জানাল কোমর নয়, নদীর গভীরতা, এক বুক ৷ শোনাল কয়েকটি দুর্ঘটনার কথা ৷ ঘোড়া-ওয়ালাদের খোঁজ করতে করতে এগিয়ে চলি মসজিদের দিকে ৷ পথে দেখা হল লামজুমের সঙ্গে ৷ ওর বাড়ি পিদমো গ্রামে ৷ ঘোড়া নিয়ে ফিরে চলেছে গ্রামের পথে ৷ বহু বছর আগে ও একবার এপথে গিয়েছিল ৷ যাই হোক পথ চিনতে ওর কোনও অসুবিধা হবে না ৷ সকলে জলের ভয় দেখালেও ও রাজি হয়ে যায় ৷ দুটো শর্ত রাখল ৷ প্রথমত, এক কোমরের বেশি জল হলে ফিরে আসবে ৷ দ্বিতীয়ত, এখন ঘোড়ার ভাড়া প্রতিদিনের জন্য ২০০ টাকা হলেও এই অপ্রচলিত ও বিপজ্জনক পথে ওকে দিতে হবে ৩০০ টাকা করে ৷ আমরা এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম ৷ ওরা যাবে দুজন ৷ লামজুম তাসি ও আনচু লামা ৷ ওদের তাঁবু, পথের খাবার ও অন্যান্য মালপত্র বইবার জন্য ওরা সঙ্গে নেবে আরও একটি ঘোড়া ৷ পদুম থেকে প্রয়োজনীয় মালপত্র কেনা হল ৷ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই এখানে পাওয়া যায় ৷ যদিও জিনিসপত্রের দাম বড্ড বেশি ৷
পরদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় রওনা হলাম ৷ চারদিকটা মেঘে ঢাকা ৷ পাহাড়ের রঙ বড্ড ধূসর ৷ পদুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট ছোট বসতি ৷ তোনডে হয়ে অর্থাৎ জাঁসকার নদীর জনতট ধরে জাংলা পর্যন্ত গাড়িপথ আছে ৷ কারসা হয়েও গাড়ি চলে যায় রিনামা পর্যন্ত ৷ আমরা যাব হাঁটাপথে ৷ আনচুর বাড়ি পিসু গ্রামে ৷ তাই তোনডে হয়ে জাংলা নয় ৷ ওরা পিসু হয়ে জাংলা যাবে ৷ এপথে দূরত্ব কম ৷ পুতুল পুতুল চেহারা নিয়ে শিশুরা পথের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে ৷ লজেন্স দিতেই খুব খুশি ৷ সমতল পথ ধরে চলে এলাম জাঁসকার বা স্টুড নদীর ধারে ৷ আজ ১৫ আগস্ট, ২০০০ ৷ গোলমালের আশঙ্কায় গোটা পদুম জুড়ে রয়েছে চরম সতর্কতা ৷ সদাসর্তক জওয়ানরা স্টেনগান উঁচিয়ে পাহারা দিচ্ছে ৷ নদীর বামতটে একটু দূরে পাহাড়ের ঢালে সাদা রঙের বহু ঘরবাড়ি নিয়ে প্রসিদ্ধ কারসা গুম্ভা ৷ জাঁসকায় উপত্যকায় গেলুক পা গোষ্ঠীর বৌদ্ধদের এটাই সবচেয়ে বড় গুম্ভা ৷ করেসাকে বাঁদিকে রেখে সমতল ধূসর পথে এগিয়ে চলি ৷ পথে ওঠানামা খুবই কম ৷ ধু-ধু প্রান্তর ৷ এপথেই লামায়ুরু যাওয়া যায় ৷ পথে দেখা হল কয়েকজন বিদেশি পদযাত্রীর সঙ্গে ৷ নেপালে এমনই কোনও পদযাত্রী দলের সঙ্গে দেখা হলে সকলেই বলে ওঠে ‘নমস্তে’ ৷ এখানে সেটা পালটে যায় ৷ একটু মুচকি হেসে বলে ‘জুলে’ ৷ দুপুরে পৌঁছলাম রিনামা গ্রামে ৷ ঘরবাড়ি ও খেত নদীর ধারে ৷ পথের বামপাশের পাহাড়টি অসাধারণ ৷ ভাঁজে ভাঁজে পাথর সাজিয়ে খাড়া পাহাড়টি দাঁড়িয়ে আছে ৷ একই ধরনের পথ ধরে নদীকে ডানপাশে রেখে এগিয়ে চলি ৷ জাঁসকার নদী বয়ে চলেছে উত্তরদিকে ৷ এ নদী আরও উত্তরে এক গভীর গিরিখাতের মধ্য দিয়ে চুলুং হয়ে নিমোর কাছে মিলিত হয়েছে সিন্ধুনদের সঙ্গে ৷ জাঁসকার উপত্যকায় সংগৃহীত সব জলই এ নদী পৌঁছে দেয় সিন্ধু নদে ৷ উঠে এলাম এক ধূসর সমতল প্রান্তরে ৷ দূরে নদীর ওপারে দেখা যায় তোনডে ও জাংলা জনপদ ৷ সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরে পরপর চোর্তেন রয়েছে ৷ পদুম থেকে গাড়িপথে তোনডে হয়ে জাংলার দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার ৷ আর এপথে পদুম থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পিসু পৌঁছুতেই সন্ধ্যা নেমে এল ৷ আনচুর বাড়িতেই ঢুকে পড়লাম ৷ দোতলা বাড়ি ৷ সব ঘরই দোতলায় ৷ মাথা নিচু করে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম আধো অন্ধকারের মাঝে, খাঁজকাটা কাঠের সাহায্যে দোতলায় উঠে পড়লাম ৷ আনচুর বাবা পিসু গুম্ভার প্রধান লামা ৷ নিয়ামা পা গোষ্ঠীর বৌদ্ধদের এই গুম্ভাটি চোমো অর্থাৎ মেয়ে সন্ন্যাসীদের জন্য ৷ দেশের নানা প্রান্তে যাবার সুযোগ হয়েছে ওর বাবার ৷ চিন যখন লাসার পোতালা গুম্ভা ও প্রাসাদ আক্রমণ করেছিল তখন দলাই লামাকে রক্ষা করার জন্য উনি লড়াই করেছিলেন ৷ উনুনের পাশেই বসে পড়লাম সকলে ৷ ওদের রাতের খাবার হল নমকিন চা, সাম্পা ছাতু ও আটার গোলা সেদ্ধ অর্থাৎ থুপ্পা ৷ একসঙ্গে পান করে পরপর কয়েক কাপ চা ৷
পরদিন বেরনোর তাড়া নেই ৷ নদীর ওপারে জাংলা গ্রাম খুব বেশি দূরে নয় ৷ এক রুক্ষ পাহাড়ের কোলে পিসু গ্রাম ৷ গ্রামে অল্প কয়েকটি পরিবারের বসবাস ৷ নদীর ধারে অনেকটা এলাকা জুড়ে গ্রামের খেত ৷ পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা নালায় জল খুবই কম ৷ তাই চাষবাসও ভালো হচ্ছে না ৷ গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের চোর্তেনটিকে ডানদিকে রেখে নেমে এলাম খেতের মাঝে ৷ হাল্কা সোনালি সবুজ রঙের খেত ৷ জাংলা গ্রামটি সরাসরি পিসুর উলটো দিকে অর্থাৎ নদীর ওপারে ৷ কিন্তু নদীর ওপরে ব্রিজে অনেকটা ঘুরপথে পৌঁছতে হবে ৷ জাঁসকার নদীর ওপর পুল পেরিয়ে উঠে এলাম মোটর পথের ওপর ৷ চওড়া রাস্তা ধরে উত্তরদিকে এগিয়ে চলি ৷ নদীতটে সুন্দর জলাভূমি ৷ ওখানকার ঘন ঘাসের মাঝে চরছে গাধা বা খোতের দল ৷ ডানদিক থেকে নেমে এসেছে জুমলাং নালা ৷ নালাটি পেরিয়ে কয়েক পা উঠতেই দেখা গেল জাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ৷ নদী থেকে অনেকটা সরে এসেছি ৷ পরপর কয়েকটি চোর্তেন পেরিয়ে উঠে এলাম জাংলা গ্রামে (৪৪৬১ মিটার) ৷ ডানদিকে একটা পাহাড়ের ওপরে রয়েছে প্রাচীন রাজপ্রাসাদ ৷ গ্রামের মাঝে আছে বড় বড় উইলো ও পপলার গাছ ৷ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ৭০টি ঘরবাড়ি ৷ লোকজন খুবই কম ৷ অনেকেই গিয়েছে খেতে কাজ করতে ৷ গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে পি ডাব্লু ডি বিশ্রামগৃহ ৷ তারই পাশে ছোট্ট এক গুম্ভায় বসবাস করছেন কয়েকজন লামা ৷ জাংলার উত্তর প্রান্তে রয়েছে আরও একটি মেয়েদের গুম্ভা ৷ আমরা এগিয়ে চলি গ্রামের মধ্য দিয়ে ৷ গ্রামের মাঝখানে রাজবাড়ি ৷ খুবই সাদামাটা একটা বড় বাড়ি ৷ বাড়িতে এখনও রাজবংশের লোকজনেরা বসবাস করছেন ৷ বাড়ির সামনে প্রাচীরে ঘেরা খানিকটা ফাঁকা জায়গা ৷ এখানে পূর্বে বিচারসভা বসত ৷ আমরা এখানেই তাঁবু টাঙালাম ৷ জাংলাকে ভালো করে দেখা ও জানার কৌতূহল বহুদিনের ৷ রাজবাড়ি শুনসান ৷ বিকেলে উঠে এলাম উত্তরদিকের গুম্ভার ৷ গুম্ভায় ২০ জন চোমো বা মেয়ে সন্ন্যাসীর বসবাস ৷ প্রায় সকলেই জাংলা বা কাছাকাছি গ্রামের মেয়ে ৷ ৮ বছরের বালিকা থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও রয়েছেন ৷ দুজন চোমো আমাদের নিয়ে এল গুম্ভার দোতলার একটা ঘরে ৷ বসতে দিল মোটা কার্পেটের ওপরে ৷ সামনে নিচু জলচৌকি ৷ কাপে কাপে নমকিন চা এল ৷ আদর আপ্যায়নে কোনও ঘাটতি নেই ৷ ঘুরে ঘুরে গুম্ভাটি দেখাল ৷ পুরনো অর্থাৎ মূল গুম্ভাটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ৷ কিন্তু নতুন বাড়িটি কাচে ঘেরা ৷ সবার মাঝে অবলোকেশ্বরের মূর্তি ৷ এই ছোট্ট বৌদ্ধ মন্দিরটিকে ঘিরে চোমোদের থাকার জন্য কয়েকটি ঘর রয়েছে ৷ গুম্ভার ওপর থেকে জাংলা গ্রামটিকে দারুণ লাগল ৷ দেখা যায় জাঁসকার নদীর প্রবাহ সহ বিস্তীর্ণ এলাকা ৷ গেলুক পা গোষ্ঠীর গুম্ভাবাসিনীদের মাসে একবার করে ন্যাড়া হতে হয় ৷ সেদিন চলেছে সেই চুল কাটার পালা ৷ একে অপরের চুল কেটে দিচ্ছে ৷ গ্রামে বাড়ির সঙ্গে ওদের যোগাযোগ আছে ৷ তবে থাকা খাওয়া এখানেই ৷ বাবা-মা বৃদ্ধ হলে এবং যদি অন্যান্য সন্তানরা কাছে না থাকে তখন এরাই বাবা-মার পাশে দাঁড়ায় ৷ জাংলা ও পিসু ছাড়াও জাঁসকার উপত্যকায় চোমোদের জন্য আরও কয়েকটি গুম্ভা আছে ৷ ফিরে চলি গ্রামের পথে ৷ সঙ্গে চলেছে দুটি চোমো মেয়ে ৷
তাঁবুতে ফিরে এলাম ৷ ততক্ষণে রানি খামারবাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন ৷ রানি পদ্মা পরমাসুন্দরী ৷ সুন্দর বেশভূষা ৷ ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে নারাজ ৷ রাজবাড়ির লোকজনেরা আমাদের দূর থেকে দেখে ৷ ছাদের ওপরে পায়চারি করছেন রাজার বোন ৷ সন্ধ্যার পর আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল স্কুলশিক্ষক চিলিং পানচেকে ৷ জাংলা সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানলাম ওর সঙ্গে গল্প করে ৷ জাংলা একসময় আলাদা স্বাধীন দেশ ছিল ৷ এর অধীনে ছিল আরও চারটি গ্রাম পিসু, পিদমো, ছাজার ও হানামুর ৷ এই দেশটি কখনও স্বতন্ত্র, কখনও পদুমের সঙ্গে, আবার কখনও ছিল লাদাখের অধীনে ৷ এই ছোট্ট স্বাধীন রাজ্যের সঙ্গে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িয়ে আছে ৷ বালতিস্থানের আক্রমণ, তিব্বতীদের আক্রমণ, মগ ও মোগলদের অনুপ্রবেশ, ডোডরাদের অধীনে যাওয়া ও সর্বোপরি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া লাদাখের এই শত শত বছরের পালাবদলের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জাংলার ইতিহাসও ৷
গ্রামের দক্ষিণদিকে টিলা পাহাড়টির শীর্ষে ছিল মূল রাজপ্রাসাদ ৷ তারই নিচে ছিল পরপর দুটি প্রাচীর ৷ প্রাচীরের দরজা বন্ধ করলে বাইরের সঙ্গে এদের কোনও যোগাযোগ থাকত না ৷ দুশো বছর আগে জলের অভাবে ওই পাহাড় থেকে সকলে নেমে এসেছিল পাহাড়ের ঢালে ৷ বর্তমানের রাজবাড়িটির বয়স প্রায় দুশো বছর ৷ প্রজারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করল ৷ শুরু হল চাষবাস ৷ রাজার কোনও সৈন্য ছিল না তবুও প্রজারা রাজাকে ভয় ও শ্রদ্ধা করত ৷ টিলা পাহাড়টির ওপরে পুরনো রাজপ্রাসাদটির কিছুটা অংশ বর্তমান ৷ ওখানে পূজার্চনা করার জন্য বৌদ্ধ পুরোহিত থাকতেন ৷ এখনও ওখানে প্রতিদিন পূজার্চনা হয় ৷ তবে কেউই থাকে না ৷
এখনকার অবস্থা অন্যরকম ৷ গ্রামে তিনবর্ণের লোকজনের বসবাস ৷ রাজবংশ উচ্চবর্ণ, লোহার নিম্নবর্ণ আর বাকিরা সকলে মধ্যবর্ণ আমজনতা ৷ রাজপরিবারের সকলকে এখনও গ্রামের সকলে শ্রদ্ধা করে ৷ এখনও সমাজের উচ্চ আসনে বসায় ৷ কিন্তু রাজবংশের হাতে এখন কোনও ক্ষমতা নেই ৷ গ্রামপ্রধান অর্থাৎ নাম্বারদারই গ্রামের কর্তা ৷ এখনও রাজা ও রানি আছেন ৷ বর্তমান রাজা নিমা নরবু উচ্চশিক্ষিত ও লে শহরে কর্মরত সরকারি অফিসার ৷ ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে লে শহরে ৷ রানি পদ্মা ছোট মেয়েকে নিয়ে এখানেই রয়েছেন ৷ গ্রামের খেতখামার দেখাশোনা করেন ৷ ফসল কাটার মরসুম ৷ তাই প্রতিদিনই যেতে হয় খামার-বাড়িতে ৷ রাজবাড়ির দুটি ভাগ ৷ এক অংশে থাকেন রাজা নরবু আরেক অংশে বসবাস করছেন রাজার বোন ৷ বোনের বিয়ে হয়েছে পদুমের রাজা রিং জাং দাওয়ার সঙ্গে ৷ বোন থাকে এখানে ৷ আর পদুম রাজা থাকেন পদুমে ৷ এরা গেলুক পা কিন্তু পদুম রাজা ড্রুগ পার গোষ্ঠীর ৷
এখন জাংলার সব গ্রামই জাঁসকার মহকুমা ও কারগিল জেলার অন্তর্গত ৷ এখানে সরকারি স্কুল আছে ৷ সরকারি স্কুলে লেখাপড়ার মাধ্যম উর্দু ৷ ওদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান বিষয়ও পড়তে হয় উর্দুতে ৷ পাঁচ হাজার বর্গ কিলোমিটার পরিমিত জাঁসকার উপত্যকার সদর পদুম ছাড়া জাঁসকার উপত্যকার অবশিষ্ট ২৪টি গ্রামের প্রায় সকলেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ৷ বৌদ্ধরা চাইছে কারগিল জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাদাখ হিল কাউন্সিলের অধীনে যেতে ৷ এরা এদের শিক্ষার মাধ্যম চায় হিন্দি ৷ একটা রাস্তা তৈরি হচ্ছে পদুম থেকে জাংলা, দুমদাং ও চুলুং হয়ে লে পর্যন্ত ৷ এই পথটি জাঁসকার নদীর ধারে ধারে পৌঁছে যাবে নিমোর কাছে ৷ পদুম থেকে দুমদাং এবং লে থেকে চুলুং পর্যন্ত রাস্তার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে কিন্তু দুমদাং থেকে চুলুং জাঁসকারের অন্তর্গত এই ৬০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ এখনও শুরু হয়নি ৷ লে থেকে চুলুং পর্যন্ত বাস যাতায়াত করে ৷ কিন্তু পদুম থেকে দুমদাং পর্যন্ত বাস চলে না ৷ প্রাইভেট গাড়ি করে ওপথে যাওয়া যায় ৷ এ রাস্তাটি সম্পূর্ণ হলে মাত্র দেড়শো কিলোমিটার পথে কোনও গিরিবর্ত্ম অতিক্রম না করেই সহজে পদুম থেকে লে একদিনে পৌঁছনো যাবে ৷ সারা বছরই এপথে গাড়ি চলাচল করতে পারবে ৷ এখন পদুম থেকে লে যেতে হয় কারগিল হয়ে ৪৭৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ৷ অতিক্রম করতে হয় পেনজি লা, নামিক লা ও কেটু লা গিরিবর্ত্ম ৷ শীতকালে এপথে গাড়ি চলাচল করে না ৷ তাই জাঁসকারের স্বার্থে এই সবকটি পথ তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ হোক এখানকার অধিবাসীদের এটাই দাবি ৷ লে জেলা তার অংশ সম্পূর্ণ করলেও কারগিল জেলা তার অংশে কাজ করছে খুবই ঢিমেতালে ৷
ভোর হতেই রাজবাড়ির উঠোনে রোদ পোয়াতে এসেছে শিশুর দল ৷ ওদের লজেন্স চাই ৷ রাজবাড়ির ঝুল বারান্দায় শিশু রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে ৷ ওর নিচে নামা বারণ ৷ ওখান থেকে হাত পাতে লজেন্সের জন্য ৷ রানি ভোরে চলে গেছেন খামারবাড়িতে ৷ শিশুদেরকে তুষ্ট করে ১৭ আগস্ট জাংলা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম ৷ গ্রামের ঘরবাড়ি ও গুম্ভা ছাড়িয়ে উঠে এলাম রাজপ্রাসাদের কাছে ৷ ডানদিকে পড়ে রইল অক্ষত দেবালয় নিয়ে ভগ্নপ্রায় রাজপ্রাসাদ ৷ উঠে এলাম জুমলাং চু-র ডানপাশের পাহাড়ের ঢালে ৷ নালাটি নেমে এসেছে এক গভীর গিরিখাতের মধ্য দিয়ে ৷ প্রথমদিনই নদী পেরোতে হবে প্রায় ২৫ বার ৷ নেমে এলাম নদীর ধারে ৷ ঢুকে পড়েছি গিরিখাতের মাঝে ৷ দুপাশে রুক্ষ খাড়া পাহাড় ৷ কোথাও পাহাড় ঝুঁকে পড়েছে নদীর ওপরে ৷ নদী নেমে আসে আঁকাবাঁকা পথে ৷ নালাটি কখনও স্পর্শ করে ডানদিকের খাড়া পাহাড়কে ৷ আবার পরক্ষণেই ধাক্কা খায় বাঁদিকের পাহাড়ে ৷ শুরু হল কাকচক্ষু ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বারবার নদী পেরিয়ে পথ চলা ৷ গিরিখাতের মাঝে নদীতটে অল্প অল্প ঝোপঝাড় ৷ এই সব গাছের সরু ডাল সংগ্রহ করছিল দুটি ছেলে ৷ বনমধ্যে হঠাৎ-ই দেখা হয়ে যায় ৷ লাঠির মতো এই ডালগুলি প্রচণ্ড শক্ত ৷ জাঁসকার উপত্যকায় প্রায় সব বাড়ির সমতল ছাদ তৈরি হয় মাটি পাথর দিয়ে ৷ সেই পুরু মাটি পাথরের নিচে এগুলিকে গায়ে গায়ে সাজিয়ে দেওয়া হয় বড় বড় কিছু কড়ি-বরগার ওপরে ৷ চলার পথ কখনও পাহাড়ের ঢালে সংকীর্ণ পথ ধরে ৷ কখনও নদীতটে নুড়ির মাঝে আবার কখনও নদীর জলে জলে ৷ ক্রমে উপত্যকাটি প্রসারিত হয় ৷ রুক্ষ ন্যাড়া পাহাড়ে ঘেরা প্রসারিত উপত্যকার নদীতট গাছপালায় পরিপূর্ণ ৷ দুটি নালার মিলন হয়েছে এখানে ৷ জায়গাটির নাম সামদো ৷ মূল নালাটি এসেছে ডানদিক থেকে ৷ আমাদের পথ বাঁদিকে ৷ দেখা হল তিনজন বিদেশি অভিযাত্রীর সঙ্গে ৷ ওরা এসেছে জার্মান থেকে ৷ ওরা ফিরে চলেছে জাংলা অভিমুখে ৷ ওদের এপথে লে যাবার পরিকল্পনা ছিল ৷ বহু চেষ্টা করেও খুরনা নদীর কাছে পৌঁছতে পারেনি ৷ তিলুত সামদোর কাছাকাছি পৌঁছে জুমলিং চু পেরোতে পারেনি ৷ প্রবল খরস্রোত ও এক কোমর জলের গভীরতা ওদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছে ৷ ওদের এক কোমরের অর্থ আমারতো আরও বেশি ৷ কয়েকদিন আগে একই কারণে ফিরে এসেছে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি দল ৷ আমরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম ৷ তবে কি আমাদেরও খুরনা চু ফিরিয়ে দেবে ৷ লামজুম ভরসা দেয় ৷ ও জানাল, আগামী দুদিন যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবেই নদী অতিক্রম সম্ভব হবে ৷ পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে ভালো আবহাওয়াই আমাদের কাম্য থাকে ৷ আর এখানে আমাদের কাম্য হবে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ৷ এই মরু পাহাড়ের দেশে রোদের তাপমাত্রা বড্ড বেশি ৷ রোদের তাপেই বরফ গলে ৷ বাড়ে নদীর জল ৷ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে বরফ কম গলবে আর নদীতে জলও থাকবে কম ৷ জার্মান দলটিকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চলি ৷ মনে সবসময় একটা সংশয় রয়েছে ৷ জানি না যে শেষ পর্যন্ত এপথে পৌঁছতে পারব কিনা ৷ ছোট্ট এক নালা ধরে ঝোপজঙ্গলের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যাই লারসা ৷ পরদিন অতিক্রম করতে হবে দারছার লা ৷ এখানে একটা ঘর আছে ৷ দারছার পর্যন্ত পরবর্তী পথে কোথাও জল নেই ৷ ঘোড়ার জন্য ঘাসও পাওয়া যাবে না ৷ তাই এখানেই সেদিনের চলার বিরতি ৷ নালাটির দুপাশে ঘন গাছপালা ৷ ১৫-২০ ফুট উঁচু গাছও এখানে দেখা যায় ৷ এই অঞ্চলে আইবেক্স ও তুষারচিতা আছে ৷ আইবেক্স দেখতে পেলেও তুষারচিতা দেখার সৌভাগ্য হল না ৷
পরদিন সাতসকালেই দারছার লার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম ৷ একটা শুকিয়ে যাওয়া নালা ধরে ওঠার পথ ৷ পাথরের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে চলেছি ৷ উঠতে হবে অনেকটা উঁচুতে ৷ ঝুরঝুরে পাথরে পরিপূর্ণ পাহাড়ের ঢাল ধরে উঠে এলাম খাড়া পাহাড়ের ঢালে ৷ পাথরের দেওয়ালে ছোট ছোট পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ৷ ঢালটি যথেষ্ট বিপজ্জনক ৷ সংকীর্ণ পথে পা রাখতে হয় সন্তর্পণে ৷ এভাবেই উঠে এলাম দারছার লার ওপরে (উচ্চতা ৫২০০ মিটার) ৷ চোর্তেনের ওপর উড়ছে নানা রঙের কাপড়ের টুকরো ৷ প্রবল বেগে হাওয়া বইছে ৷ যেন ঝড় উঠেছে পাহাড়ের মাথায় ৷ বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায় ৷ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম দিকে দেখা যায় একের পর এক গিরিশ্রেণী, এদের পিছনে একসারি তুষারাবৃত পর্বতমালা ৷ পূর্বদিকে ডানদিকের পাহাড়ের মাথায় বরফ ৷ ওখান থেকে একটা নালা নেমেছে ৷ নালাটি ঢুকে পড়েছে রুক্ষ গিরিখাতের মধ্যে ৷ উত্তরদিকে প্রবাহিত ওই নালাটি ধরেই আমাদের নেমে যেতে হবে ৷ ট্রান্স হিমালয়ের মাঝে তিব্বতীয় মালভূমির ওপর এমনই কোনও গিরিবর্ত্মের ওপর দাঁড়িয়ে সর্বদাই মনে হয় যেন পৃথিবীর ছাদে পৌঁছে গেছি ৷ ঢাল বেয়ে সরাসরি নেমে চলি সেই নালা অভিমুখে ৷ মাঝে মাঝে একরাশ ঝুরো পাথর নিয়ে নেমে যেতে হয় অনেকটা নিচে ৷ জনমানবহীন প্রান্তর ৷ কোথাও কোনও গাছপালা নেই ৷ জুমলিং চু নালাটি ধরে ক্রমে ঢুকে পড়লাম গিরিখাতের গভীরে ৷ লাফিয়ে লাফিয়ে নালা পেরিয়ে পথ চলি ৷ নদীতটে নুড়ির ওপর দিয়ে পথ চলায় কোনও কষ্ট নেই ৷ স্বচ্ছ জলরাশি নিয়ে কুলকুল শব্দে নালাটি বয়ে চলেছে ৷ জলের নিচে নানা রঙের নুড়ি পাথর ৷ হঠাৎ-ই নালাটি লুকিয়ে পড়ল নুড়ির মাঝে ৷ নানা আকৃতি নিয়ে আকাশচুম্বি রুক্ষ পাহাড় হেলে আছে নালার ওপরে ৷ অন্তর্হিত নালাটি আবার বেরিয়ে পড়ল ৷ এ বড় মজার ব্যাপার ৷ এই আছে এই নেই ৷ নালাটি বয়ে চলে আঁকাবাঁকা পথে ৷ ডানদিক থেকে নেমে এসেছে আরও দুটি জলধারা ৷ জল বাড়ল মূল নালাটির ৷ তখন পা ভিজিয়ে নদী পেরোতে হয় বারবার ৷ একসময় নালাটির ধারে চলার মতো আর কোনও জায়গা নেই ৷ বামদিকের পাহাড়ের ঢালে অস্পষ্ট পথরেখা দেখা যায় ৷ খাড়া পাহাড়ের ঢালে ধসের মধ্য দিয়ে চার হাত-পায়ে চলতে হল ৷ এপথে সারা বছরে অল্প কয়েকজন লোক চলাচল করে ৷ আঞ্চলিক লোকজন এপথে লে যায় কদাচিৎ ৷ ওরা যায় অক্টোবর মাসে বা শীতকালে ৷ অক্টোবর মাসে জল খুবই কম থাকে কিন্তু খুব ঠান্ডা ৷ শীতকালই স্থানীয়দের কাছে আদর্শ সময় ৷ নদীর জল তখন শক্ত বরফ ৷ আর সেই বরফের ওপর দিয়ে স্থানীয়রা সহজে এপথে জাংলা থেকে তিনদিনে লে পৌঁছে যায় ৷ তখন এখানকার তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের অনেক অনেক নিচে ৷ ধারাবাহিক রুক্ষতার মাঝে হঠাৎ-ই দেখতে পাই কিছু বেগুনি রঙের ডেলকেনিয়াম ফুল ৷ নেমে এলাম নদীতটের নুড়িপাথরের মাঝে ৷ প্রায়শই পা ভিজিয়ে পথ চলা ৷ তবুও ভালো লাগে ৷ চুপচাকে মালপত্র ও ঘোড়া রেখে উঠে এসেছে লামজুম ও আনচু ৷ ওরা আমাদের নিয়ে যেতে এসেছে ৷ এখনও যেতে হবে অনেকটা পথ ৷ ওদের সঙ্গে চলতে থাকি ৷ ওদেরকে পেয়ে নির্জন গিরিখাতের মাঝে ভরসা পাই ৷ সামনে নদীর দুধারে পথ আগলে দুটি খাড়া পাহাড় ৷ পাথরের রং গেরুয়া ৷ দুটি পাহাড়ের মাঝে ব্যবধান মাত্র ৫-৭ ফুট ৷ ওপরের দিকে আরও কাছাকাছি ৷ খাড়া দেওয়ালে পা রাখার জায়গা নেই ৷ নালার ধারে চলার মতো জায়গা নেই ৷ ভাবি এর মধ্য দিয়ে যাব কীভাবে ৷ যেতে হবে জলে জলে ৷ জলে নেমে পড়লাম ৷ হিমশীতল জলের প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত নামতে থাকি ৷ অসহনীয় ঠান্ডায় পা জমে যাবার উপক্রম ৷ দুদিকে আকাশচুম্বি দেওয়াল ৷ যেন একটা টানেলের মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়েছি ৷ আধো অন্ধকার টানেলের মধ্যে আমাদের চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয় ৷ প্রায় ৫০ মিটার এভাবে চলার পর জল থেকে উঠে এলাম ৷ আরও খানিকটা এগিয়ে উপত্যকাটি চওড়া ৷ বদ্ধ গিরিখাতের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলাম এক উন্মুক্ত প্রান্তে ৷ বাঁদিক থেকে নেমেছে আরও একটি নালা ৷ সঙ্গমস্থলের পাশে অনেকটা এলাকা জুড়ে ঘাসে ঢাকা ময়দান ৷ এখানে মিলিত হয়েছে দুটি উপত্যকা ৷ আমাদের দেখতে পেয়ে দলে দলে আইবেক্স দ্রুত উঠে যায় দূরে পাহাড়ের ঢালে ৷ সেই সবুজ গালিচার ওপর আমাদের তাঁবু পড়ল ৷ সামনে এক অদ্ভুত আকারের সুচালো পাহাড় ৷ সন্ধ্যার পর হিমেল হাওয়া বইতে থাকে ৷ এমনই এক নির্জন প্রান্তে আকাশভরা তারার মাঝে আমরা কজন ৷ জায়গাটির নাম চুপচাক ৷
চুপচাকের সকালটা বিকেলের মতোই সুন্দর ৷ তীব্র ঠান্ডায় শরীরের আড়ষ্টতা কাটিয়ে বেরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল ৷ ঢুকে পড়লাম গিরিখাতের মাঝে ৷ দুপাশের পাহাড় ভেঙে ভেঙে পাথর জমেছে নদীর ধারে ৷ আকাশচুম্বি পাহাড়গুলি দেখে মনে হয় এখনই ভেঙে ঘাড়ে পড়বে ৷ বড় বড় পাথরের মধ্য দিয়ে জুমলিং নালা তার পথ করে বয়ে চলেছে প্রবল হর্ষে ৷ সকালে নদীর জল অপেক্ষাকৃত কম ৷ কিন্তু অনেক বেশি ঠান্ডা ৷ ট্রান্স হিমালয় এবং ইনার হিমালয়ের মাঝে রুক্ষ মরু পাহাড়ের দেশে বহু পথ পেরিয়েছি কিন্তু এমনটি কখনও পাইনি ৷ পথের দুর্গমতা, গভীর গিরিখাত, নানা রঙের সুউচ্চ পাহাড়-এ যেন অন্য জগত ৷ ক্রমে ডানদিকে বাঁক নিতেই আরও একটি খরস্রোতা নালা ৷ দুয়ে মিলে বাড়ে জুমলিং নালার জল, বাড়ে নদীগহ্বরের প্রসারতা ৷ ওপরে পর্বতগাত্র রুক্ষ কিন্তু খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ ৷ তারই পদতলে নদীতটে প্রচুর গাছপালা জন্মেছে ৷ যতই নেমে চলেছি ততই গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের ঘনত্ব বাড়তে থাকে ৷ পথ কোথাও স্পষ্ট আবার কোথাও অস্পষ্ট ৷ কখনও সেই সহজ ও স্পষ্ট পথ ধরে যেতে যেতে পথ যায় হারিয়ে ৷ তখনই নেমে আসি জলের পাশে ৷ লামজুমরা ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে গেছে ৷ ভেজা বালিতে ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখে পথ খুঁজি ৷ বেলা বাড়তেই বেড়ে যায় নদীর জল ৷ এখন আর একা একা নদী পেরনো যাচ্ছে না ৷ পেরোতে হয় একসঙ্গে ৷ বারবার নদী পেরনোর জন্য চলার গতিও কমে যায় ৷ নদীর পাড়ে ঘন ঝোপজঙ্গল ৷ গাছের ডালপালায় বারবার পিঠের ব্যাগ আটকে যায় ৷ দ্রুত নামার চেষ্টা করেও চলার গতি বাড়ে না ৷ লামজুম বলে দিয়েছিল যে ওরা অপেক্ষা করবে খুরনা নদীর ধারে ৷ আজই খুরনা চু একবার পেরিয়ে পৌঁছতে হবে তিলুত সামদো ৷ জল ও ক্যাম্প করার জায়গা সর্বত্রই পাওয়া যায় কিন্তু একমাত্র তিলুত সামদোতেই ঘোড়ার জন্য সামান্য ঘাস পাওয়া যাবে ৷ দুপুর গড়িয়ে গেল ৷ বাড়তে থাকে নদীর জল ৷ বিকেলে কীভাবে খুরনা চু পার হব সেই দুশ্চিন্তাই বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ৷
হাত ধরাধরি করে বারবার নদী পেরিয়ে নুড়ি পাথর ও ঝোপজঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলি ৷ সবে বিকেল তিনটে ৷ দেখি আনচু ও লামজুম রয়েছে আমাদের অপেক্ষায় ৷ লামজুম জানাল যে খুরনা নদীর পাশে পৌঁছতে আরও ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে ৷ বিকেলে খুরনা চু পেরনো সম্ভব হবে না ৷ এখানে সামান্য ঘাস পাওয়া গেছে ৷ ওরা এখানে থাকতে চায় ৷ ওর মতে মত দিলাম ৷ লামজুম খুবই বিচক্ষণ ৷ নদীপাড়ে বনমধ্যে তাঁবু টাঙানো হল ৷ এরই মধ্যে লামজুমের সঙ্গে আনচুর প্রচণ্ড তর্ক বেধেছে ৷ আনচু লামা পরিবারের ছেলে ৷ ও জীব হত্যাকে মেনে নিতে পারছে না ৷ এ অঞ্চলে প্রচুর বনমুরগি বিচরণ করছে ৷ লামজুমের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও নিশানাও অব্যর্থ ৷ এরই মধ্যে একটা বনমুরগি মেরেছে ৷ আরও মারতে চাইছে ৷ সন্ধ্যার সময় নালার জল পান করে ওরা দ্রুত পালাতে পারছে না ৷ কিন্তু আনচু মারতে দেবে না ৷ ওর যুক্তি হল ‘এই বনের প্রাণীদের জীবনধারণের জন্য আমরা তো কিছুই করিনি তবে ওকে মারার অধিকার আমাদের কখনই জন্মায় না ৷ আর ওরা তো আমাদের কোনও অপকার করছে না ৷’ লামজুম মুরগি মারা থেকে বিরত হয় ৷ বনের শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে দীপঙ্কর ও শান্তি আলুর পরোটা বানাচ্ছে ৷ এতদিন হাঁটার পরও দলে রান্না খাওয়ার পরিপাটিতে কোনও ভাটা পরেনি ৷ সন্ধ্যার পর জুমলিং চু হল আরও খরস্রোতা ৷ আমরা ঘুরে বেড়াই নদীর ধারে ধারে ৷
২০ আগস্ট খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লাম ৷ জলে পা রাখতেই তীব্র ঠান্ডায় পা কেটে যাবার উপক্রম ৷ যথারীতি নদী পেরোতে হয় বারবার ৷ নুড়ি ও ঝোপজঙ্গলের মধ্য দিয়ে দ্রুত চলেছি ৷ বাঁদিকে পাশাপাশি কয়েকটা গুহা রয়েছে ৷ এ জায়গাটির নাম সাংকোংমা ৷ বাঁদিকে পরপর কয়েকটি আকাশচুম্বি পাহাড় ৷ ওদের মাথায় এখনও ভোরের আলোর ছোঁয়া লাগেনি ৷ রোদ পড়েছে ওদের পিছনে আর একটি পাহাড়ের শীর্ষে ৷ দূর থেকে মনে হয় অন্ধকারের মাঝে একটা মশাল জ্বলছে ৷ দাঁড়িয়ে পড়ল লামজুমরা ৷ ডানপাশে খাড়া পাহাড়ের ঢালে একটা গুহা দেখতে পেলাম ৷ ওটাই লিঙ্গম গুহা ৷ লামজুম সেই খাড়া দেওয়াল বেয়ে ওখানে উঠে পড়ল গিরগিটির মতো ৷ আনচু পাড়ল না ৷ গুহামধ্যে আছে প্রায় ৭ ফুট উঁচু শিবলিঙ্গ পাথর ৷ দড়ির সাহায্য ছাড়া আমাদের পক্ষে ওখানে পৌঁছনো সম্ভব নয় ৷ এ এক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ৷ ওখানে যাবার ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হল না ৷ তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে খুরনা নদীর ধারে ৷ বেলা বাড়লেই বেড়ে যাবে নদীর জল ৷ দূর থেকে প্রণাম করে দ্রুত নামতে থাকি ৷ ডানদিক থেকে নেমেছে আরও একটি নালা ৷ হিমবাহ থেকে এই ধারাটি নেমেছে প্রচুর ঘোলাটে জল নিয়ে ৷ এর দুপাশে পরপর অদ্ভুত আকারের খাড়া পাহাড় ৷ দারছার লার পর জুমলিং চু আমাদের সঙ্গী ছিল ৷ প্রাণচঞ্চলা নদী আমাদের পথ দেখিয়েছে ৷ হিমবাহ থেকে নেমে আসা ঘোলা জলে রং পাল্টাল জুমলিংয়ের ৷ নদী হল প্রচণ্ড খরস্রোতা ৷ স্রোতের তোড়ে জলের সঙ্গে নেমে আসে ছোট ছোট পাথর ৷ জুমলিং চু এখন ভয়ংকর ৷ এখান থেকেই ফিরে গিয়েছে জার্মান অভিযাত্রী দলটি ৷ ফিরে গিয়েছে সামরিক বাহিনীর দলটিও ৷ পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে আরাধ্য দেবতার নাম স্মরণ করে জলে নেমে পড়লাম ৷ দীপঙ্কর উচ্চস্বরে দেবদেবীর নামে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করল ৷ সেই সমবেত চিৎকারে নিস্তব্ধ পাহাড় জেগে উঠেছে ৷ তীব্র খরস্রোতের মাঝে জলের গভীরতাও হাঁটু ছাড়িয়ে যায় ৷ পার হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরি ৷ আমরা নিশ্চয়ই খুরনা চুয়ের ধারে পৌঁছতে পারব ৷ আমাদের আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গেল ৷ নুড়ি ও বেলাভূমির মধ্য দিয়ে চলতে থাকি ৷ জুমলিং শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পড়েছে ৷ পর পর আরও কয়েকবার এ নদী পেরোতে হল ৷ এক সময় বেরিয়ে এলাম জুমলিং উপত্যকা থেকে ৷ দুটো খাড়া পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নেমেছে ঝরনা ধারায় ৷ যেন একটা ফটক ৷ জুমলিং চু নেমে গেছে বাঁদিকে ৷ এ নদী মিলিত হয়েছে খুরনা চুয়ের সঙ্গে ৷ ডানদিকে বয়ে চলেছে প্রশস্ত নদী খুরনা চু ৷ এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় নদী এটাই ৷ দূরে একটা উঁচু জায়গা থেকে চিৎকার করে উঠল আনচু ও লামজুম ৷ ওরা নদীর ওপারে ৷ মনের মধ্যে এক দারুণ উত্তেজনা ৷ মালপত্র ও ঘোড়া রেখে ওরা নদীর জলে নেমে পড়ল ৷ জলের স্রোতে নিজেদেরকে সামলাতে রীতিমতো হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে ৷ নদী পেরিয়ে ওরা এল আমাদের সাহায্য করতে ৷ দুপাশে ওরা দুজন আর মাঝে আমরা পাঁচজন ৷ সকলে সকলের হাত ধরলাম শক্ত করে ৷ আগে পিছনে নয় ৷ পাশাপাশি জলে নেমে পড়লাম ৷ বহুদূর থেকে অসংখ্য ছোটবড় নদীনালাকে সঙ্গে নিয়ে নেমে এসেছে এই নদী ৷ দীপঙ্করের জয়ধ্বনির সঙ্গে গলা মেলাই আমরা সকলে ৷ জনমানবহীন নির্জনতার মাঝে সমবেত জয়ধ্বনির রোল উঠল ৷ জল ঠান্ডা হলেও হিমশীতল নয় ৷ তাই অনেকক্ষণ জলে থাকলেও অসুবিধা হল না ৷ তাছাড়া গত কয়েকদিন পায়ের সহনশীলতাও বেড়ে গেছে ৷ তীব্র স্রোতের মুখে গুটি গুটি এগিয়ে চলি ৷ জল ক্রমে হাঁটু পেরিয়ে আমার কোমর ছুঁইছুই ৷ দলে অন্য সকলের তুলনায় আমিই দুর্বল ৷ ওরা আমায় রেখেছে মাঝখানে ৷ উঠে এলাম খুরনা চুয়ের ডানপাশে তিলুত সামদোয় ৷ সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত এখানে সবচেয়ে জল কম থাকে ৷ তাই আজ আরও কয়েকবার এ নদী অতিক্রম করতে হবে ৷ তিলুত সামদো পৌঁছে সকলেই আনন্দিত ৷ আমরা খুরনা চু অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছি ৷ নদীর উজানে যেতে হবে ৷ চলার দিক পরিবর্তন ৷ পূর্বমুখী পথ ছেড়ে চলি দক্ষিণদিকে ৷ ডানতটের পাহাড়ের ঢালে একটা পথ ছিল ৷ সে পথ নেমে গেছে নদীগর্ভে ৷ নেমে পড়লাম নদীতটে ৷ জলে জলে খানিকটা এগিয়ে উঠে এলাম পাহাড়ের ঢালে ৷ পাথরের ঢালে ছোট ছোট পাথর গড়াচ্ছে অনবরত ৷ তারই মধ্য দিয়ে সামনে না এগিয়ে পাথরের সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলাম নদীর ধারে ৷ কোথাও কোনও পথ নেই ৷ তাই যেনতেনপ্রকারে এগিয়ে চলা ৷ নদীভীতি অনেকটাই কেটে গেছে ৷ এরই মধ্যে খুরনা নদীকে পাঁচবার পেরিয়েছি ৷ দুপুর একটার মধ্যেই চলার বিরতি ৷ নদীতটে একটুকরো বেলাভূমির ওপরে আমাদের তাঁবু পড়ল ৷ দেখতে দেখতে নদীর জল বাড়ল অনেকটা ৷ পরদিন কমপক্ষে আরও চারবার খুরনা চু পার হতে পারলেই আমাদের মুক্তি ৷ লামজুম শোনাল কয়েক বছর আগের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা ৷ খুরনা চু পেরিয়ে এমনই এক জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল দুজন নেপালি মালবাহক ৷ ওরা যাচ্ছিল লে ৷ এখানকার পথের ভয়াবয়তা সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা ছিল না ৷ বৃষ্টি শুরু হল ৷ কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নদীর জল অসম্ভবভাবে বেড়ে গিয়েছিল ৷ ডাইনে, বাঁয়ে ও পিছনে খাড়া পাহাড় ও সামনে ভয়ংকর নদী তখন ফুঁসছিল ৷ একসময় তীব্র ঠান্ডায় ও অনাহারে ওরা মারা গিয়েছিল ৷
পরদিন ভোরে গত বিকেলের তুলনায় নদীতে জল অনেকটাই কমেছে ৷ সেই সঙ্গে কমেছে জলের তাপমাত্রা ৷ হাঁটার শুরুতেই ঠাণ্ডা জলে নেমে পড়লাম ৷ নদী পেরিয়ে নুড়ির ওপর দিয়ে কয়েক পা এগিয়েই আটকে যাই ৷ নদীর প্রবাহ ধাক্কা খেয়েছে কাড়া পাহাড়ের গায়ে ৷ আমরাও নিরুপায় হয়ে নেমে পড়লাম বরফগলা জলে ৷ এমন ঠান্ডা জলে চওড়া নদী পেরনো এক অসহনীয় কষ্ট ৷ বার তিনেক পেরনোর পর একটা পথের হদিশ পেলাম ৷ উঠে এলাম অনেকটা উঁচুতে ৷ ওপর থেকে গিরিখাতের গভীরে প্রবাহিত খুরচা চু-কে দারুণ লাগে ৷ রুক্ষ পাহাড় কেটে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে খুরনা চু ৷ নেমে আসতে হল নদীর ধারে ৷ যথারীতি হাত ধরাধরি করে পৌঁছে গেলাম নদীর ডানতটে ৷ লামজুম জানাল, এ নদীকে আর পেরোতে হবে না ৷ এ তো বড় আনন্দের খবর ৷ খুরনা নদীকে মোট নয়বার পেরোতে হল ৷ এখানে একটা চোর্তেন আছে ৷ জায়গাটির নাম খুরনা সামদো ৷ ছোট্ট এক নালা মিশেছে খুরনা চুয়ের সঙ্গে ৷ খুরনা নদী নেমে এসেছে দক্ষিণপূর্ব দিক থেকে ৷ এ নদী ধরে একটা পথ আছে ৷ ওপথে লে-মানালি হাইওয়ের ওপরে অবস্থিত সারচু অথবা পাং পৌঁছনো যায় ৷ ওপথেও খুরনা চু-সহ নদীনালা পেরোতে হবে বহুবার ৷
খুরনা সামদো থেকে আমরা চলি উত্তর দিকে ৷ গিরিখাতের গভীরে প্রশস্ত নদীতট ৷ নুড়ি, বেলাভূমি ও ঝোপঝাড়ের মাঝে এঁকেবেঁকে নেমে এসেছে এক ছোট্ট জলধারা ৷ দুপাশে বিচিত্র আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নানা রঙের পাহাড় ৷ কোথাও সেইসব রুক্ষ পাহাড়গুলির রূপ খুবই ভয়ংকর ৷ প্রতিনিয়ত পাথর ভেঙে পড়ছে নদীগর্ভে ৷ এরই মধ্য দিয়ে যেতে হয় সাবধানে ৷ নালার পাশে ভিজে বালির ওপর সর্বত্রই রয়েছে অসংখ্য জীবজন্তুর পায়ের ছাপ ৷ আইবেক্স ও তুষারচিতার পায়ের ছাপই বেশি ৷ প্রশস্ত নদীগর্ভের দুপাশের পাহাড় দূরে চলে যায় ৷ প্রসারিত হয় উপত্যাকাটি ৷ বহুপথ পেরিয়ে ধীরে ধীরে আমরা উঠে এলাম অনেকটা ওপরে ৷ ডানদিকে হাতের নাগালে রয়েছে দুটি তুষারাবৃত পর্বতচূড়া ৷ নদী সংলগ্ন পাহাড়ের ঢাল সবুজ ঘাসে ঢেকে আছে ৷ এক-দেড় ফুট উঁচু ঘাস ও গুল্মে ছেয়ে আছে বিস্তীর্ণ এলাকা ৷ আমরা সেই সবুজ গালিচার ওপর তাঁবু টাঙালাম ৷ এ জায়গাটির নাম রুবরাং ৷ ঘোড়া তিনটে মহানন্দে ঘাস খেতে খেতে পৌঁছে গেছে দূরে পাহাড়ের ঢালে ৷ জাঁসকার উপত্যকায় এর আগেও দুবার এসেছি ৷ পৌঁছেছিলাম এর প্রত্যন্ত প্রান্তরে ৷ কিন্তু কোথাও এত সুন্দর চারণভূমি দেখিনি ৷ রুবরাং লা অতিক্রমের জন্য এখানে মূল শিবির স্থাপন করতে হবে ৷ আবার এটাই জালুং লার মূলশিবির ৷ রুবরাং লা অতিক্রম করে পৌঁছনো যায় মারখা গ্রামে ও জালুং লা (৫ উচ্চতা ৫১৯৮ মিটার) পেরিয়ে লাংটাং চু ধরে নিমালিং হয়ে পৌঁছনো যায় হেমিস গুম্ভায় ৷
পরদিন এক সুন্দর সকালে হাঁটা শুরু হল চারণভূমির মধ্য দিয়ে ৷ খানিকটা এগিয়ে শুরু হল রুক্ষ পাহাড়, ডানদিকে নদীগর্ভ পেরিয়ে একটা পথ উঠে গেছে জালুং গিরিবর্ত্ম অভিমুখে ৷ আমরা চলি বাঁদিকে ৷ মাটি পাথরের রুক্ষ পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য ছোট ছোট গর্ত ৷ এই অঞ্চলে প্রচুর পায়রা আছে ৷ সরাসরি বাঁদিকে বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়লাম একটা শুকনো নালার মাঝে ৷ দুপাশ থেকে একই ধরনের শুকনো নালা মিশেছে এর সঙ্গে ৷ ডানদিক, বাঁদিক ও সামনে কিছুই দেখা যায় না ৷ এলাম রুবরাং লার শীর্ষে (উচ্চতা ৫০২০ মিটার) ৷ উঠে এসেছি জাঁসকার গিরিশিরার ওপরে ৷ সামনে মারখা উপত্যকা ৷ দূরে দেখা যায় স্টক-মাসো গিরিশ্রেণীর ওপরে কয়েকটি তুষারাবৃত পর্বতচূড়া ৷
নীল আকাশের বুকে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে ধূসর পাহাড়ের মধ্য দিয়ে দ্রুত নামতে থাকি ৷ নেমে এলাম একটা নালার ধারে ৷ ছোট্ট সেই নালা ধরেই চলার পথ ৷ দুপাশের রুক্ষ খাড়া পাহাড়গুলি খুব বেশি উঁচু নয় ৷ জলধারাটি হঠাৎ-ই লুকিয়ে পড়ল ৷ সেই শুকনো বেলাভূমি ও নুড়ি প্রান্তরের মধ্য দিয়ে দ্রুত নামতে থাকি ৷ চারচাম চু নদীগর্ভের পাশে এমন কিছু খাড়া পাহাড় দেখা যায় যেগুলিকে দেখে মনে হয় এগুলি নদীবক্ষ থেকে সরাসরি উঠেছে আলাদাভাবে ৷ এগুলিকে বলা হয় স্তূপ পাহাড় ৷ আর এই উপত্যকাটি হল গ্রস্ত উপত্যকা ৷ ক্রমে বালি ও নুড়ি পরিপূর্ণ নদীখাত আরও বেশি চওড়া হয় ৷ সামনে পোড়ামাটি রঙের বিশালাকার পাহাড় দেখে দাঁড়িয়ে পড়তে হল ৷ নদীতট থেকে এর উচ্চতা হাজার ফুট ছাড়িয়ে যাবে ৷ সকলেই সেদিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি ৷ খাড়া দেওয়ালের গায়ের পাথরে নানা কারুকার্য ৷ মনে হয় পাহাড় বেয়ে উঠছে ডাইনোসর কিংবা রাজা বসেছেন রাজ সিংহাসনে ৷ এ পাহাড়টি এক বিস্ময়কর সৃষ্টি ৷ কখনও মনে হয় আমরা হেঁটে চলেছি চিনের প্রাচীরের পাশে পাশে ৷ এর পাশে পাশে প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর পাহাড়টি শেষ হল ৷ বহু পথ পেরিয়েও হিমালুংয়ের দেখা নেই ৷ মনে হচ্ছে উত্তরমুখী এই উপত্যকাটি ধাক্কা খেয়েছে উত্তর দিকে একটা পাহাড়ের গায়ে ৷ ওখানেই আছে মারখা নদী ৷ বাঁদিক থেকে নেমে এসেছে একটা নালা ৷ ঘণ্টা চারেক হাঁটার পর জল পাওয়া গেল ৷ নদীগহ্বর ক্রমে ছোট হয়ে এল ৷ দুপাশের দুটি উঁচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছলাম হিমালুং ৷ পথের পাশে এক প্রকাণ্ড পাথরের ওপর প্রার্থনা পতাকা বলে দেয় আমরা ঢুকে পড়েছি মারখা উপত্যকায় ৷ সামনে মারখা নদী ৷ ওপারে মারখা উপত্যকার মাঝে প্রচলিত ট্রেকিং পথ ৷ জাংলা থেকে অপ্রচলিত জনমানবহীন পথে যে পদযাত্রা শুরু করেছিলাম ছয় দিনের সেই পথ চলা এখানে শেষ হল ৷
পশ্চিমদিকে মারখা গ্রাম ৷ গ্রামের খেত ও লোকজনের চলাফেরা দেখা যায় ৷ আমরা চলেছি লোকালয়ের মাঝে ৷ নেমে এলাম নদীর ধারে ৷ নদীর পাশে পৌঁছে আরেক বিপত্তি ৷ নদীর ওপরের পুলটি ভেসে গেছে ৷ ভেবেছিলাম আর বোধহয় জলে নামতে হবে না ৷ আবার হাত ধরাধরি করে জলে নেমে পড়লাম ৷ তীব্র খরস্রোত, এবড়োখেবড়ো পাথর ও জলের গভীরতা কোমর ছুঁইছুঁই ৷ নদী পেরোতে রীতিমতো হিমসিম খেতে হল ৷ কিন্তু শেষ রক্ষা হল না ৷ শক্ত সমর্থ ধনঞ্জয় জলে পড়ে গলে ৷ সর্বস্ব ভিজিয়ে উঠে এল জল থেকে ৷ প্রসারিত উপত্যকা ৷ পরপর কয়েকটি চোর্তেন পেরিয়ে গ্রামের শুরু ৷ চারদিকে রুক্ষ বাদামি রঙের পাহাড় আর নদীতীরে গ্রামের মাঝে সবুজের সমারোহ ৷ গ্রামের আগেই একটা সুন্দর মাঠ ৷ সেই ঘন ঘাসে ঢাকা মাঠে আমাদের তাঁবু পড়ল ৷
মারখা গ্রামের (উচ্চতা ৩৮১৩ মিটার) উত্তর দিকে স্টক পর্বতশ্রেণী ৷ এখান থেকে নেমে এসেছে গেনেপা চু ৷ মিশেছে মারখা নদীর সঙ্গে ৷ সমতল ছাদবিশিষ্ট প্রায় একই ধরনের দোতলা ঘরবাড়ি ৷ নালাটির দুপাশে যবখেতে ঘন সবুজের ছোঁয়া ৷ শস্যশ্যামলা মারখা গ্রাম ৷ মারখা গুম্ভাটি গ্রামের ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে অনেকটা ওপরে ৷ লে-স্থিত স্পিতুক গুম্ভা থেকে মারখা উপত্যকা হয়ে হেমিস গুম্ভা পর্যন্ত এই ট্রেকরুটটি বহুল প্রচলিত পথ ৷ বহু বিদেশি পদযাত্রীরা এপথে ট্রেক করেন ৷ পরদিন গ্রামের খেত ও ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে নেমে এলাম নদীর ধারে ৷ পশ্চিমমুখী নদীর ধারে রয়েছে সুন্দর ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড ৷ কিছুদিন আগে লে সহ এই অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৷ বেড়ে গিয়েছিল নদীর জল ৷ তখন মারখা নদীর ওপর বহু ব্রিজ ভেসে যায় ৷ যথারীতি নদীর জলে নেমে পড়লাম ৷ নদী পেরিয়ে একটা সুন্দর বনাঞ্চলকে বাঁদিকে রেখে জলকাদার মাঝে এগিয়ে চলি ৷ আরও একবার নদী পেরিয়ে উঠে এলাম এক গুম্ভার কাছে ৷ ছালাক গ্রামের মাঝে সুন্দর খেত ৷ কিন্তু গ্রামে কোথাও কোনও লোকজনের দেখা নেই ৷ পথে বহু বিদেশি পদযাত্রীর দেখা পেলাম ৷ মালপত্রসমেত দলে দলে ঘোড়া ও খচ্চর চলেছে ৷ লে, মানালি, কাঠমান্ডু ও দিল্লিস্থিত এজেন্সির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এই ট্রেকিং প্রোগ্রাম ৷ নদীতটে প্রায় সর্বত্রই সরকারি প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে সুন্দর বনানী ৷ সেই বনের মাঝে চলার পথ ৷ এপথে চলতে দারুণ লাগে ৷ বনমধ্যে পাখির কলরব শুনি ৷ গাছের ছায়া পড়েছে নদীর জলে ৷ পথের ডানপাশে পাহাড়ের ঢাল রুক্ষ ধূসরবর্ণ আর বাঁদিকে গভীর বন ৷ জাঁসকার গিরিশিরা ও স্টক মাসো গিরিশিরার মাঝে অবস্থিত মারখা উপত্যকাটি ৷ প্রচুর গাছপালা এই আপাত রুক্ষ মারখা উপত্যকাকে পালটে দিয়েছে ৷ দেখতে পাই অসংখ্য চির ফেজেন্ট পাখি ৷ এইসব দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই স্কিউ গ্রামে ৷ গ্রামের খেত, ঘরবাড়ি ও সারি সারি পপলার গাছ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ৷ শস্যশ্যামলা গ্রামের মাঝে বহু লম্বা গাছও দেখা যায় ৷ দেড়-দুই ফুট ব্যাসের গুঁড়িযুক্ত গাছ মারখা উপত্যকায় এখন আর কোনও আশ্চর্য ব্যাপার নয় ৷ গ্রামের কোনও বাড়িতেই লোকজন নেই ৷ অনেকটা এলাকা জুড়ে স্কিউ গ্রাম ৷ গ্রামের পূর্বপ্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছতেই আধঘণ্টা সময় লাগল ৷ পশ্চিমপ্রান্তে রয়েছে কয়েকটি বাড়ি, হোটেল, ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড ও গুম্ভা ৷ পশ্চিমমুখী মূল পথটি ধরে মারখা নদীর ধারে ধারে পৌঁছনো যায় লামায়ুরু হয়ে চুলুং ৷ একদিনের হাঁটাপথ ৷ চুলুং থেকে লে বাসপথ ৷ এপথে প্রতি রবিবার বাস পাওয়া যায় ৷ আমরা উত্তরমুখী চড়াই পথে ঢুকে পড়লাম গিরিখাতের মাঝে ৷ সিংড়ি নালা ধরে অল্প অল্প চড়াই পথ ৷ নালার দুপাশে প্রচুর গাছপালা ৷ সিংগা গ্রামের কাছেই এক জলাভূমির ধারে আমাদের তাঁবু পড়ল ৷ মারখা থেকে প্রায় ১০ ঘণ্টা হেঁটে অনেকটা পথ পেরিয়েছি ৷
সারারাত ঝোড়ো হাওয়ার পর সকালটা শান্ত ৷ ভোর হতেই গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়লাম ৷ একটা খাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁসে কয়েকটি সুন্দর ঘরবাড়ি ৷ পথের পাশে সাদাকাপড়ে তৈরি তাঁবু টাঙিয়ে বসেছে খাবারের দোকান ৷ চা, চার্ড, ঠান্ডা পানীয় ও বিয়ার পাওয়া যায় সর্বত্রই ৷ অল্প অল্প চড়াই পথ ৷ অনেকটা দূর থেকেই গানজা লাকে দেখা যায় ৷ উল্টোদিক থেকে আগত পদযাত্রীরা দলে দলে গিরিবর্ত্মটি অতিক্রম করে দ্রুত নেমে আসছে ৷ ওরা ওপারের মূল শিবির ইউরুচে থেকে বেরিয়েছি ভোররাতে ৷ আমরা ঘণ্টা চারেক ওঠার পর পাসের ওপর (উচ্চতা ৪৯৪০ মিটার) পৌঁছে যাই ৷ স্টক গিরিশ্রেণীর ওপরে গানজা লার অবস্থান ৷ দক্ষিণদিকে দেখা যায় মারখা উপত্যকা সহ জাঁসকার গিরিশ্রেণী আর উত্তরদিকে রয়েছে মধ্য সিন্ধু উপত্যকা সহ লাদাখ গিরিশ্রেণী ৷ উত্তর-পূর্বদিকে স্টক গিরিশ্রেণীর ওপরে দেখতে পাই কয়েকটি তুষারাবৃত পর্বতচূড়া ৷
গানজা লা থেকে নেমে যেতে হবে সিন্ধু নদের ধারে ৷ আমাদের চলার শব্দে ছুটে পালায় মারমটের দল, দ্রুত লুকিয়ে পড়ে গর্তের মধ্যে ৷ খাড়া উতরাই পথ ধরে নেমে এলাম ইউরুচে ৷ গিরিখাতের মাঝে সোনালি সবুজ যব খেতের মাঝে দুটো সুন্দর বাড়ি নিয়ে একটা ছোট্ট গ্রাম ৷ পুল পেরিয়ে চলে এলাম নালাটির ডানতটে ৷ শস্যশ্যামলা রুমবক গ্রাম ৷ এখানে ঘোড়ার জন্য ঘাস পাওয়া যাবে ৷ তাই আমাদের তাঁবু পড়ল রুমবক নালার পাশে ৷ গ্রামের ঘরবাড়ি অনেকটা ভেতরে ৷ লে থেকে গাড়িপথে স্টক গ্রামে আসা যায় ৷ আর সেই স্টক গ্রাম থেকে নামলিং লা (৪৫৭০ মিটার) পেরিয়ে একটি ট্রেক রুট পরচা কাংরি শৃঙ্গটিকে বাঁদিকে রেখে নেমে এসেছে রুমবক গ্রামে ৷ দিনের শেষে আকাশের বুকে টুকরো টুকরো মেঘে দারুণ রং ধরেছে ৷
পরদিন হাঁটা শুরু করে চলে এলাম নালার পাশে ৷ বার দুয়েক নালাটিকে পেরোতে হল পা ভিজিয়ে ৷ দ্রুত নেমে এলাম জিনচেন গ্রামে ৷ নদীতটে বড় বড় পপলার গাছ, সবুজ ঘাস ও ছোট এক জলধারা নিয়ে জিনচেনের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডটি অপূর্ব ৷ তারই পাশে শস্যশ্যামলা খেত ৷ গ্রাম ছাড়িয়ে নেমে এলাম মোটরপথে ৷ এপথে গাড়ি চলাচল এখনও শুরু হয়নি ৷ সেই মোটরপথ ধরে উত্তরদিকে বেশ খানিকটা চলার পর পশ্চিমগামী নদী দেখতে পেয়ে বুঝতে কোনও অসুবিধে হল না যে এরই নাম সিন্ধু নদ বা সিংঘে চু ৷ সিন্ধু দর্শনে সমস্ত শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায় ৷ প্রচুর জল নিয়ে গিরিখাতের মাঝে সিন্ধু এখানে বয়ে চলেছে পাকিস্তানের দিকে ৷ পথ পূর্বদিকে বাঁক নেয় ৷ ধূসর রুক্ষ প্রান্তরের মাঝে পথ চলা ৷ নদীর ওপারে পাকাসড়ক, ঘন পপলার গাছে সাজানো ঘরবাড়ি ও জওয়ানদের ছাউনি দেখতে পাই ৷ এখানে নদীর ওপরে কোনও পুল নেই ৷ যেতে হবে ফাং বা স্পিতুক ৷ আমরা যাব স্পিতুক (উচ্চতা ৩২৮৪ মিটার) ৷ পথে জলের অভাবে আরও বেশি কষ্ট দেয় ৷ নদীর ধারে গ্রামের মাঝে মেঠো পথ ধরে দুপুরের পর পৌঁছে যাই সিন্ধুর ধারে ৷ ওপারে অল্প দূরে স্পিতুক গুম্ভা ৷ অনেকটা বিস্তার নিয়ে সিন্ধু বয়ে চলেছে ৷ পদুম থেকে ১৫ আগস্ট যে হাঁটা শুরু করেছিলাম ১১ দিন পর সেই পথ চলা এখানে শেষ হল ৷ লে থেকে মানালি হয়ে ফিরে এলাম কলকাতায় ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন