অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
পৃথিবীর প্রাচীন ও অবলুপ্ত সভ্যতার তালিকায় দক্ষিণ আমেরিকার ইঙ্কা সভ্যতার নাম পড়েছিলাম ৷ গত নভেম্বরে সেই সভ্যতার অবশেষ দেখবার সুযোগ হল ৷ প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দক্ষিণ আমেরিকার যে রাষ্ট্রের নাম পেরু, তার অনেকাংশ জুড়ে একদা ইঙ্কাদের সাম্রাজ্য ছিল ৷ যদিও তাদের রাজত্বের কাল দীর্ঘ নয়-ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী মাত্র ৷ তাদের স্থাপত্যের বহু নিদর্শন এখনও দেখতে পাওয়া যায় পেরুর নানা স্থানে ৷
ইঙ্কাদের রাজধানী ছিল কুজকো ৷ আন্ডিস পর্বতমালার দুর্গম অভ্যন্তরে ৩,৬০০ মিটার (১১,২০০ ফুট) উচ্চতায় কুজকোর অবস্থান ৷ কুজকো শহর আজও আছে ৷ পেরুতে ভ্রমণার্থীদের দ্রষ্টব্যের তালিকায় কুজকোর মর্যাদার স্থান ৷ এখান থেকেই যেতে হয় মাচুপিচু ৷ ইঙ্কাদের তৈরি সৌধপ্রাসাদ মানুষের অবহেলা এবং কালের তাড়না সহ্য করে এখনও অনেকাংশে অবিকৃত আছে মাচুপিচুতে ৷ আমরাও মাচুপিচু যাব ৷
মাচুপিচু যাওয়া সহজ নয় ৷ আমরা প্রথম পৌঁছলাম পেরুর রাজধানী লিমা ৷ লিমা থেকে অতি প্রত্যূষে বিমানে কুজকো যাত্রা ৷ ভ্রমণসংক্রান্ত বিবিধ নির্দেশিকায় পড়েছিলাম, লিমার মানুষেরাও বললেন, লিমার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুঘণ্টায় কুজকোর এগারো-বারো হাজার ফুটে উঠে শরীরে খুব অস্বস্তি হয় ৷ আমাদের শরীর এই আকস্মিক পরিবর্তন সহজে সইতে পারে না ৷ অধিক উচ্চতায় বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম, তাই নিশ্বাসের কষ্ট হয়, প্রথম দিনটা শরীরকে সইয়ে নিতেই কেটে যায় ৷
লিমা থেকে প্লেন সকাল ছটায় ৷ এখন নভেম্বর মাস, দক্ষিণ আমেরিকায় গ্রীষ্মের শুরু ৷ বিষুবরেখার দক্ষিণে বলে এদেশের আবহাওয়া উত্তরমণ্ডলের, আমাদের বিপরীত ৷ আন্ডিস পর্বতশ্রেণীর ওপর দিয়ে উড়তে থাকলাম ৷ তৃণপত্রহীন গ্র্যানাইট পাহাড় নিষ্ঠুর রুক্ষ ভয়ঙ্কর মনে হয় ৷ মাঝে মাঝে ছোট লেক, উঁচু পাহাড়ে বরফ জমে রয়েছে ৷ ঘণ্টা দুয়েকের যাত্রা ৷ একটি সমতল জায়গায় নামলাম, কুজকো ৷ আন্ডিসের ওপর বেশ বড় অধিত্যকা ৷ আমরা খুব চিন্তিত হয়ে কুজকোতে পৌঁছলাম ৷ থাকব তো মাত্র তিনদিন, তার একটা দিন যদি নিশ্চল থাকতে হয়, তাহলে এত দূরে আসা বৃথা যাবে না তো?
আমাদের কুজকো মাচুপিচু ভ্রমণের সব আয়োজন লিমার এক ট্র্যাভেল এজেন্টকে দিয়ে করিয়েছিলাম ৷ তাদের প্রতিনিধি কুজকো এয়ারপোর্টে উপস্থিত ছিলেন ৷ কতটা ইংরিজি বোঝেন ধরা গেল না, কারণ তিনি ইংরিজি আদৌ বলেন না ৷ আমাদের বর্ণের জন্য তিনি অনেক যাত্রীর মধ্যে আমাদের অভ্রান্ত চিনে ফেললেন ৷ সিনর কুমার? বলে হাত ধরে বাইরে একটা গাড়িতে আমাদের বসিয়ে দিলেন ৷ আমার মধ্য নাম কী কারণে তাঁর কাছে প্রধান হয়ে উঠল জানবার চেষ্টা করিনি ৷ তাঁর নাম মারিয়া, স্প্যানিশ বলেন ৷ পরে দেখেছি এই অঞ্চলের ভাষা কুয়েচুয়া অনর্গল বলেন ৷ সুগৌর, দশাসই চেহারা ৷ আদি অধিবাসী ইন্ডিয়ানদের রক্ত মিশেছে তাঁর পরিবারে ৷ তিনি মূলত ইন্ডিয়ান, না স্প্যানিশ বুঝতে পারিনি ৷ ভাষার অন্তরায় যে কত কঠিন হতে পারে মর্মে মর্মে বুঝেছিলাম ৷ তিনি এবং তাঁর ড্রাইভার আমাদের মোটঘাট নিয়ে এলেন ৷
কুজকো ছোট শহর ৷ তাপমাত্রা কোনও সময়েই হিমাঙ্ক ছোঁয় না ৷ যে পথে পুরনো শহরে ঢুকলাম সেটি বেশ প্রশস্ত ৷ দুপাশে ছোট ছোট বাড়ি ৷ দোতলা বেশি নেই বললেই চলে ৷ অল্প সময়ে হোটেলে পৌঁছলাম ৷ কাউন্টারে আগমনের কার্ড সই করে ঘরের চাবি নেবার জন্য দাঁড়িয়েছি, মারিয়া আমার হাত ধরে টানতে লাগলেন ৷ কী বলেন কিছু বুঝি না ৷ শুধু বুঝলাম, কোকা টি ৷ মারিয়ার সঙ্গে হোটেলের ভোজনকক্ষে যেতে হল ৷ প্লেনে প্রাতরাশ হয়ে গিয়েছে ৷ আবার কেন? কাকে সে কথা বোঝাব?
একটু পরেই বড় বড় পেয়ালায় চা এল, দুধ-চিনি ছাড়া ৷ চুমুক দিয়ে বুঝলাম, কোকো নয়, চা-ও নয় ৷ স্বাদহীন আর কোনও পানীয় ৷ পরিচারকের সাহায্যে জানা গেল কোকা টি, মানে চা-এর বদলে গরম জলে কোকেন পাতা ৷ এই অঞ্চলের প্রাচীন অধিবাসীরা, কলম্বাস যাদের নাম দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান, অনেকদিন আগেই জেনে গিয়েছিল, কোকেন অল্প মাত্রায় সেবন করলে এনার্জি বাড়ে, এই উচ্চতায় সুস্থ থাকা যায় ৷ ইঙ্কারা কোকেন সেবন করতেন, এখনও তাদের বংশধরেরা কোকেন পাতা চর্বণ করে এবং তাদের অনেকেই কোকেনে আসক্ত হয়ে যায় ৷ পেরুতে কোকেনের গাছ সহজেই বৃদ্ধি পায় ৷ বস্তুত, পেরুর অন্যতম রপ্তানির বস্তু কোকেন ৷
কোকা টির জন্য কিনা বলতে পারব না ৷ তবে যে তিনদিন কুজকোতে ছিলাম, আমাদের আদৌ অস্বস্তি হয়নি ৷ কুজকোতে নামার অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা কুজকোর দ্রষ্টব্য দেখতে বেরিয়ে পড়েছিলাম ৷ কোনও কষ্ট হল না ৷
হোটেলটি ছোট হলেও বেশ ভালো ৷ ডাইনিং হল আছে, তবে কাউকে লাঞ্চ-ডিনার করতে দেখিনি ৷ সকালে প্রত্যহ ব্রেকফাস্ট রুমে মামুলি ব্রেকফাস্ট পাওয়া যায় ৷ একজন এসে ডিম কেমন চাই জিজ্ঞাসা করে যেত ৷ দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম, যে ছেলেটি সন্ধ্যায় রিসেপশন কাউন্টারে বসেছিল, সকালে দেখি সে-ই ব্রেকফাস্ট রান্না করছে ৷ টোস্ট এনে দিল যে মেয়েটি সে-ই কাল আমাদের মোটঘাট দোতলায় তুলেছিল ৷ হোটেলে লিফট নেই ৷ দোতলাই শেষ ৷ আমাদের ঘরে কার্পেট থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত কাচের জানলা ৷ ঝলমলে দিনে দেখলাম প্লাজা আরমাস-এর একাংশ, সাধারণ টালির ছাদ দেওয়া বাড়িঘর, তাদের পিছনে উঁচু পাহাড় ৷ তারও পিছনে আর একসারি পাহাড়, তার এক পাশে বরফ পড়ে আছে ৷ আমাদের ঘর থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখতে হয় ৷
আমাদের ট্যুর শুরু হবে বেলা আড়াইটেয় ৷ মারিয়া বলে গিয়েছেন আমাদের নিতে গাড়ি আসবে, আমরা যেন তৈরি হয়ে লাউঞ্জে উপস্থিত থাকি ৷
হোটেলের সামনে উঁচুনিচু অসমান পাথর বাঁধানো রাস্তা বেশি চওড়া নয় ৷ তার ওপর দিয়ে ট্যুর কোম্পানির বাস দ্রুত দৌড়াদৌড়ি করছে ৷ তিন চারটি এয়ারলাইন্সের প্লেন দিনে একাধিকবার যাত্রী নিয়ে আসে ৷ তাদের জন্য বাসগুলি বিভিন্ন হোটেলে যাচ্ছে, আবার সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে দ্রষ্টব্যস্থানে যাত্রা ৷
কুজকোতে অনেক হোটেল ৷ আসলে, কুজকোর প্রধান ব্যবসা হল হোটেল আর ট্যুর ৷ আমাদের হোটেল থেকে বেরিয়ে পরপর চার পাঁচটা রেস্টুরেন্ট ৷ বাইরে বোর্ডে খাদ্যবস্তু ও তার দাম লেখা আছে ৷ কোনও স্থানীয় খাদ্যের অপরিচিত নাম দেখলাম না ৷ অনেক ভেবে চিন্তে আমরা এক চিনা ভোজনশালায় ঢুকলাম ৷ পৃথিবীর যেখানেই যাই, চিনা ভোজনশালা থাকবেই ৷ সাধারণ ভোজন হল, অবশ্য অতৃপ্তির ছিল না ৷ দাম সহনযোগ্য ৷
যথাসময়ে ট্যুরের কোচ এসেছিল ৷ আমাদের দলে জনা পঁচিশ যাত্রী ৷ সঙ্গের দোভাষী ইংরিজি এবং স্প্যানিশ বলে ৷
কুজকো ছোট এবং সেই জন্যই অন্তরঙ্গ শহর ৷ মানুষগুলি ভালো, ইংরিজি বুঝতে বা বলতে অসুবিধা হয় বলে লজ্জা পায় ৷ মনে হল ইংরিজিভাষী পর্যটকের সংখ্যাই বেশি ৷ নানা দেশ থেকে পর্যটক আসে এখানে ৷ নিশ্চয় সবকটি প্রধান ভাষার দোভাষীর আয়োজন আছে ৷ ভারতবর্ষে যেমন যেখানেই বেড়াতে যান, দুচারজন বাঙালি পর্যটক থাকবেই, বিদেশে তেমনই কিছু জাপানি থাকবেই সব ট্যুরে ৷ তারা ইংরিজি ভালো বলতে না পারলেও, বুঝতে পারে ৷
কুজকো শহর প্রত্নতাত্বিক গুরুত্বে সামান্য নয় ৷ কুজকো প্রায় তিনশো বছর ইঙ্কা রাজাদের রাজধানী ছিল ৷ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এই ইন্ডিয়ান উপজাতি স্থানীয় অধিবাসীদের পরাভূত করে কুজকোতে বাস করতে শুরু করে ৷ স্থানটি তাদের পছন্দ হয়েছিল ৷ বিশাল মালভূমি, চাষবাসের ক্ষেত্র পর্যাপ্ত ৷ দুশো বছর কুজকোতে বাস করবার পর, তাদের রাজারা সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেন ৷ ক্রমশ তাঁদের অধিকার প্রসারিত করেছিলেন কয়েক প্রজন্ম ধরে ৷ ১৫৩৩ সালে স্প্যানিশ আক্রমণকারীরা কুজকো জয় করে ৷ ইঙ্কাদের নির্মিত বিশিষ্ট প্রাসাদ, মন্দির সব নির্মমভাবে ধূলিসাৎ করে দেয় ৷
এই কাহিনী বলছিল আমাদের যুবক গাইড ৷ সে ইঙ্কা বংশোদ্ভূত ৷ ইংরিজি ও স্প্যানিশ দুটোই অনর্গল বলতে পারে ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, পরীক্ষা পাস করে গাইড হয়েছে ৷ ইঙ্কা সভ্যতা ও ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব তার কথায় ফুটে ওঠে ৷ তার ইঙ্কা নাম বলেছিল আমাদের ৷ উচ্চারণ সহজ নয় বলে সে নিজেই বলল, আমাকে আপনারা ডেভিড বলে ডাকবেন ৷ স্প্যানিশদের ওপর তার ক্রোধ ও ঘৃণা আদৌ চেপে রাখবার চেষ্টা করে না ৷ বলল, স্প্যানিশ আক্রমণকারীরা যখন এসে পৌঁছল কুজকোতে, তার আগে তারা এত সুন্দর স্থাপত্য দেখেনি ৷ এখানকার মতো এত সোনার ব্যবহারও তাদের অবাক করে দিয়েছিল ৷ তারা দেশের স্বর্ণভাণ্ডার নিঃশেষে লুট করল, তারপর ইঙ্কাদের স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শনগুলি ভাঙতে শুরু করে ৷
তাই কুজকো শহরে আজ আর ইঙ্কাদের কোনও সৌধ, প্রাসাদ বা বাড়িঘর দেখতে পাওয়া যায় না ৷ তবে স্প্যানিশদের স্বপক্ষে শুধু এইটুকু বলা যায় ১৫৩৪ সালের প্রচণ্ড ভূমিকম্প কুজকোর তাবৎ বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল ৷
আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি, সেইখানে ইঙ্কাদের কোনও ইমারত ছিল ৷ সেই বনেদের ওপর স্প্যানিশ গভর্নর কুমারীদের বাসস্থান তৈরি করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীতে ৷ কনভেন্টো ডমিনিকান ডেল পেরু, কয়েক স্থানে এখনও পুরাতন দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন গাঁথনি করে বাড়ানো হয়েছে দেখতে পাওয়া যায় ৷ আমাদের গাইড একটি কক্ষে আমাদের নিয়ে গিয়ে দেখাল ঘরের দেওয়ালের নিম্নাংশ বড় বড় পাথরের, তার ওপর ছোট পাথরের নতুন নির্মাণ ৷ বিশেষত্ব এই, গাইড বলল, ইঙ্কাদের নির্মাণকার্যে কোনও বালি-সিমেন্টের বা সুরকির মশলা দরকার হত না ৷ নতুন নির্মাণে দুই পাথরের মাঝখান, পাশে মশলা দিতে হয়েছে ৷
অতঃপর গাইড আমাদের ইঙ্কাদের স্থাপত্য কৌশল বোঝাতে লাগল ৷ যে ধরনের মানুষের যে দলের সঙ্গে এসেছি আমরা, তারা সবাই সূক্ষ্ম বিষয়ে আগ্রহী নয় ৷ তারা বেড়াতে বেরিয়েছে, ইতিহাস, বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির পাঠ নিতে নয় ৷ তারা ক্রমশই অধৈর্য হয়ে পড়ছিল ৷
গাইড আমাদের বোঝাল নিখুঁত মাপের মসৃণ করা পাথরের ওপর পাথর চাপাবার পূর্বে নিচের পাথরে সামান্য একটা খাঁজ থাকত, ওপরের পাথরে উঁচু করে রাখা একটা অংশ নিখুঁতভাবে তারই ওপর বসত, তাই মশলার দরকার হত না ৷ এটাই ইঙ্কা স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য ৷
গাইড সহজে থামতে চায় না, স্বভাবতই পূর্বপুরুষের গুণকীর্তনে তার আনন্দ, কিন্তু দলের সবাই অধৈর্য হয়ে পড়ছে, এর পরের গন্তব্যে গেলে হয় না? গাইড বলে চলেছে, আরও আশ্চর্য কী জানেন, ইঙ্কাদের কোনও লিখিত ভাষা ছিল না, তবুও তারা কেমন অবিশ্বাস্য অব্যর্থভাবে তাদের নির্দেশ দূরের মানুষকে পাঠাতে পারত ৷ সত্যই আশ্চর্য ঘটনা ৷ পৃথিবীর সব সভ্যতায় অন্যতম সংযোগের বাহন ছিল লিপি ৷ অথচ এই সেদিন, মাত্র সাড়ে চারশো বছর আগেও একটা বিশাল রাজত্ব চলেছিল লেখার অক্ষরমালা ছাড়া ৷
আমাদের মধ্যে অনেকেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল, তাই হঠাৎ শুনলাম এক মহিলা অবান্তর প্রশ্ন করলেন, যদি লিপি ছিল না, তাহলে ইঙ্কারা বই পড়ত কী করে? আরেকজন জিজ্ঞাসা করলেন, চিঠি লিখত কী করে ইঙ্কারা?
কনভেন্টোটি বেশ বড় ৷ কক্ষের পর কক্ষ ৷ দেখতে দেখতে আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি ৷ কনভেন্টো থেকে বেরিয়ে মস্ত চত্বর ৷ ইঙ্কারা নাম দিয়েছিল ক্যুরি কুয়েকা-সোনার উঠান ৷ পাঁচ মন্দির ছিল এখানে ৷ ইঙ্কাদের আরাধ্য সূর্য, চন্দ্র, তারামণ্ডল, বিদ্যুৎ ও বৃষ্টি পাঁচ মন্দিরের অধিষ্ঠাতা ৷ চত্বরে সোনার ফোয়ারা, চারপাশে কৃত্রিম কৃষিক্ষেত্র, সোনার তৈরি লামা-রা চরছে সেখানে ৷ সঙ্গে মেষপালকের স্বর্ণমূর্তি ৷ সে সবের কিছুই নেই এখন ৷ গাইডের কথায় আক্ষেপ ঝরে পড়ল ৷ স্প্যানিশ দস্যুরা কুজকোর সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিয়েছে ৷
স্প্যানিশরা যেমন একদিকে কুজকোর ইঙ্কা সভ্যতার চিহ্ন নির্মমভাবে ধ্বংস করেছিল, তেমনই পরম অনুরাগের সঙ্গে তৎকালীন স্প্যানিশ শৈলীর গির্জা ও সৌধাদি নির্মাণ করে শহরটাকে অলঙ্কৃত করেছিল ৷ তার সুন্দরতম নিদর্শন কুজকোর ক্যাথিড্রাল ৷ ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল ৷ প্লাজা দ আরমাস-মস্ত বড় চত্বর, প্রায় ফুটবল মাঠের সমান, তারই একদিক জুড়ে ওই গির্জা ৷ ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপীয় স্থাপত্য ধারায় সমৃদ্ধ এই প্রকাণ্ড গির্জাটির ভক্তদের বসবার সার সার বেঞ্চির ওপর আমরা সবাই প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে পড়লাম ৷ সবাই অত্যন্ত ক্লান্ত, এতক্ষণে বসবার সুযোগ পেয়ে আর কেউ উঠতে চায় না ৷ গাইড সুউচ্চ গির্জার খিলানগুলির নির্মাণপদ্ধতি বোঝাতে লাগল ৷ একধারে কাঠের অপরূপ মূর্তিগুলি দেখে আমরা চমৎকৃত ৷ কে কত শুনছে, গাইডের খেয়ালও নেই ৷ ক্যাথিড্রালের অবস্থান শহরের কেন্দ্রে ৷ প্লাজার অপর তিনদিকে নানা দোকানপাট ৷ কুজকো এবং পেরুর অন্যান্য স্থানে তৈরি বহু সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে ৷ ক্যাথিড্রালের প্রশস্ত সিঁড়ির ধাপে ফেরিওয়ালারা তাদের জিনিসপত্র বিক্রির জন্য পর্যটকদের ব্যতিব্যস্ত করছে ৷ পুঁতির মালা থেকে মূল্যবান কার্পেট, জামাকাপড়, মহামূল্যবান ভিকুনার তৈরি ক্ষুদ্র বহির্বাস ৷ ভিকুনার পশমের তৈরি মেয়েদের কোট, কোটের কলার ইত্যাদির চাহিদা সারা ইউরোপ ও আমেরিকায় ৷ অনেকটা ভেড়ার ধরনের এই প্রাণীটির বাস আন্ডিসের বারো-তেরো হাজার ফুট উচ্চতায় ৷ অপেক্ষাকৃত নিচের দিকে পাওয়া আরেকটি প্রাণী, আলপাকা ৷ আরও নিচের স্তরে বাস করে লামা ৷ ইংরিজি বানানটা বিচিত্র, Llama ৷ আলপাকা আর লামা এক জাতের প্রাণী ৷ লামার পশমের চেয়ে আলপাকার পশমের আদর বেশি ৷ লামা যেন একটা ভেড়া উট হবার চেষ্টায় বেশি এগোতে পারেনি ৷ তার গলা খানিক লম্বা হয়ে থেমে গিয়েছে ৷ বলতে পারি বেমানান চেহারা ৷ লামা এখন পর্বতাঞ্চলের গৃহপালিত পশু ৷ এই অঞ্চলের একমাত্র ভারবাহী জন্তু ৷ পাহাড়ে ঘোড়া, বলদ, গাধা নেই ৷ কিন্তু লামার ভার বহনের ক্ষমতা খুব সীমিত ৷ দশ-পনেরো কেজির বেশি বইতে পারে না ৷ আমাদের গাইড বলেছিল, লামারা বড় চতুর প্রাণী, ভার বেশি হলেই বসে পড়বে ৷ ভার না কমালে তাকে কিছুতেই নড়ানো যায় না ৷ লামার মাংসও এখানের মানুষের খাদ্য ৷ আমরা ল্যাম বলে যা খেয়েছি পেরুতে, হয়তো সবই লামার মাংস ৷
আমাদের হোটেল থেকে যাতায়াতের পথে, ইন্ডিয়ান বর্ণময় পোশাক পরে মেয়েরা ছোটবড় পসরা নিয়ে পর্যটকের পিছনে দৌড়াদৌড়ি করত ৷ সামান্য ইংরিজি বলত, ভেরি বিগ, হাউ মাচ, অলরাইট টুমরো, বাই ফ্রম মি ওনলি ইত্যাদি ৷ বাচ্চা মেয়েদের মা বা অভিভাবককে ফুটপাতের একধারে স্টক নিয়ে বসে থাকতে দেখেছি ৷ তার পাশে একটা দুটো লামা লম্বা ঘাড় উঁচিয়ে কেমন বোকা বোকা চোখে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকবে ৷ লামাই এই পর্বতাঞ্চলের একমাত্র প্রাণী ৷ যে উচ্চতায় ভিকুনা বা আলপাকা থাকে সেখানে মানুষের বাস নেই ৷
আরমাস-এর মতো বড় নয়, শহরে আরও দুটি সুন্দর স্কোয়্যার বা প্লাজা দেখলাম ৷ দুটিকে ঘিরেই দোকানপাট, ভোজনশালা ৷ কুজকোর শেষ প্রান্তে নাতিউচ্চ পাহাড়ের ওপর সাকসেওয়ামান, একদা ইঙ্কাদের দুর্গ ছিল, শহরের প্রহরীও ৷ এখন ইতস্তত কয়েকটি বিশাল পাথর পড়ে আছে ৷ দুর্গপ্রাকারের একাংশ, সামান্যই, দাঁড়িয়ে আছে ৷ সেখানে একের ওপর আরেক পাথর বসানো ইঙ্কা স্থাপত্যের চিহ্ন দেখা যায় ৷ পাথরগুলি বিশাল ৷ কুড়ি টন ওজনের পাথরখণ্ড অনেক ৷ কী করে এই পাথরগুলি পাহাড়ের মাথায় আনা হয়েছিল, কত দূরত্ব থেকে, তার কোনও লিখিত ইতিহাস নেই ৷ প্রত্নতাত্বিকেরা অবশ্য আশ্চর্য হন না ৷ দূর থেকে বড় পাথর এনে ওপরে তোলার চূড়ান্ত নিদর্শন তো মিশরের পিরামিড ৷ কাইরোর সন্নিকট, গিজা পিরামিড গোষ্ঠীর সর্ববৃহতের নাম খুফু পিরামিড ৷ সেখানেও দু-দশ টনের পাথর অনেক দূর থেকে আনা হয়েছিল ৷ আর, সে পিরামিডের উচ্চতা ১৪০ মিটার, কুজকোর দুর্গপ্রাকারের কয়েক গুণ ৷ তাছাড়া, পিরামিডের নির্মাণকাল খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর ৷ অর্থাৎ কুজকোর চার হাজার বছর পূর্বে পিরামিড নির্মিত হয়েছিল ৷
আন্ডিস পর্বতের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এবং তার ইতিহাস সমানভাবে পর্যটককে মোহিত করে ৷ ইঙ্কাদের কীর্তিমান রাজাদের মধ্যে পাচাকুটি ইঙ্কা উল্লেখযোগ্য ৷ আসলে তাঁর নাম থেকেই সমস্ত উপজাতির নাম হয়ে গিয়েছে ইঙ্কা ৷
কুজকো শহরের নানাস্থানে ইঙ্কাদের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে ৷ তিন-চারদিন অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায় ৷ কুজকোর অন্তরঙ্গতা আমাদের মুগ্ধ করেছিল ৷ যে রাস্তায় আমাদের হোটেল, সেই রাস্তার ওপর একটি ভোজনশালায় আমরা দুরাত্রি ভোজন করেছিলাম ৷ পরিচারকের একজন ইংরিজি বলতে পারে, তাই কোনও অসুবিধা হয়নি ৷ সারাদিন মাচুপিচুতে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে সে রাতে আমার স্ত্রী ক্লান্ত হয়ে ডিনারের জন্য বেরতে চাইলেন না ৷ আমি পরিচিত ভোজনশালাটিতে খাবার আনতে গেলাম ৷ হোটেলের ঘরে বসে নিশ্চিন্তে ভোজন করা যাবে ৷ আহার্য আদেশ করে বসতে যাচ্ছি, পরিচারক বলল, খাবার নিয়ে যাবার জন্য আপনাকে বসতে হবে না, আপনারা তো পাশের হোটেলে আছেন, আমরা খাবার পাঠিয়ে দেব ৷ আপনার ঘরের নাম্বার কত?
নিচে দুটি পিসকো সাওয়ারের আদেশ দিয়ে ঘরে বসতে না বসতেই খাবার পৌঁছে গেল ৷ পরিপাটি সাজিয়ে এনেছে, ছুরি কাঁটা যন্ত্রাদি তো বটেই, সঙ্গে নুন মরিচের দুটি সুদৃশ্য কৌটো ৷ যে খাবার এনেছিল, সে ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বলল, এই ক্রুয়েট সেটটা যেন ফেরত দিই ৷ হোটেলকে পরদিন সকালে বেরবার আগে বলেছিলাম, কিন্তু ফেরত দিয়েছিল কিনা খোঁজ নেওয়া হয়নি ৷
ইন্ডিয়ান বাজার, অর্থাৎ স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের বাজার দেখতে গিয়েছিলাম পুকাপুকারা ৷ কুজকো থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ ৷ আমাদের যে কোনও বড় গ্রামের হাটের মতো ৷ ইন্ডিয়ান ক্রেতা ও বিক্রেতারা তাদের নিজস্ব পোশাকে রঙের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল ৷ তরিতরকারি, মাছ-মাংস, ফল, জামাকাপড়, বাক্স, বিছানা, হাতের কাজ, প্রয়োজনের সবকিছুই পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা বসেছিল ৷ এক জায়গায় দেখলাম মাছভাজা বিক্রি হচ্ছে ৷ ভুট্টা-সিদ্ধ বিক্রি করার স্টল একাধিক ৷ সামলাতে পারলাম না, দুটো সদ্য-সিদ্ধ করা, তখনও গরম সুবৃহৎ দানার ভুট্টা মুখে দিয়ে আমরা চমৎকৃত ৷ অত্যন্ত সুস্বাদ ৷ পরে শুনেছি, ভুট্টা আসলে আন্ডিসের ফসল ৷ পেরুতে ষাট সত্তর প্রজাতির ভুট্টা পাওয়া যায় ৷ কৃষি বিজ্ঞানের এক অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল লিমাতে ৷ তিনি বললেন, ভুট্টার আদি জন্মস্থান মেক্সিকো, পেরু নয় ৷ খাদ্য জগতে পেরুর অবদান আলু ৷ পেরুতে ষাট-সত্তর রকমের আলুর চাষ হয় ৷ তাতেও বুঝি এদেশের মানুষের মন ওঠে না ৷ বাজারে কুচকুচে কালো রঙের শুকনো আলু বিক্রি হচ্ছে ৷ শুনলাম অতি সুস্বাদু ৷ পেরু থেকে আলু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে ৷ পুকাপুকারার ইন্ডিয়ান বাজারে ঘুরে বেড়াতেই আনন্দ ৷ দিনটা নির্মল ছিল, গরম নেই, চারপাশে মানুষের বর্ণময় সমারোহ, তার মাঝে আমরা, পর্যটকেরা মূর্তিমান রসভঙ্গের মতো ৷ জোর কেনাবেচা চলছিল ৷ দেখলাম দরদাম করা যায় ৷ পূর্ব এশীয় দেশের মতো নয় ৷ পশমের তৈরি একটা ঝোলা, দাম চেয়েছিল কুড়ি পেসো, ষোলোতে সওদা হল ৷ কিছু মাটির এবং পোর্সিলিনের হাতের কাজ কেনা হল ৷ কেনা গেল না লামা এবং আলপাকার লোমের তৈরি পোশাক ৷ ভালো কার্পেট বিক্রি হচ্ছিল, নকশাগুলি যেন ভিন্ন জগতের, কাশ্মীরি নামদার ধরনে মোটা হাতের কাজের ছোট রাগ-ও দেখলাম ৷ দাম কিছু বেশিই ৷
সেদিনটা আমাদের পরিশ্রমের দিন ছিল ৷ আমরা নেমে এসেছি দু-তিন হাজার ফুট নিচে উরুবাম্বা নদীর উপত্যকায় ৷ নদীর দুপাশে উর্বর জমিতে চাষ হয়েছে ৷ পাশের পাহাড়েও ধাপ কেটে চাষ দেখা যায় ৷ ছোট গ্রাম, দু-চারটে নিঃসঙ্গ বাড়ি, মসৃণ রাস্তা দিয়ে আমাদের কোচ চলেছে ৷
পাড় ছুঁই-ছুঁই উরুবাম্বা নদীকে বাঁপাশে রেখে আমরা চলেছি ৷ এক জায়গায় থেমে মধ্যাহ্নভোজন হল ৷ স্থানটি পর্যটকদের জন্যই তৈরি হয়েছে, পরের পর কোচ এসে থামছে, আর দলে দলে যাত্রী নেমে বাথরুম এবং ভোজনস্থলের দিকে দৌড়চ্ছে ৷ আমাদের কুপন দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৷ কুপনের বিনিময়ে বুফে লাঞ্চের জন্য প্লেট পাওয়া গেল ৷ বহু পদ ছিল, নির্বাচন কঠিনই হয়েছিল ৷ আমরা প্রথমেই ভুট্টা-সিদ্ধ নিয়েছিলাম ৷ আর সব চেনা পদ, পেরুভিয়ান কিছু নেই বলেই মনে হয়েছে ৷
নানা দেশের নানা বর্ণের পর্যটক, নানা অশ্রুত ভাষায় কথা শুনছি, যেন একটা উদ্যানের মধ্যে আন্তর্জাতিক কোনও মেলা বসেছে ৷ বেশিক্ষণ নয় আবার কোচে উঠে পড়তে হল ৷ এখনও আর তিনটি দ্রষ্টব্যস্থানে যাব ৷
আন্ডিস পাহাড়ের ওপর উরুবাম্বা নদী যেন প্রকৃতির অলঙ্কার ৷ আমরা কখনও নদীর পাশ দিয়ে চলেছি, কখনও নদী অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ৷ আমরা যাব চিনচেরো, সেখানেও কিছু ইঙ্কা নিদর্শনের অবশেষ পড়ে আছে, কোথাও শুধুই ইতস্তত ছড়ানো ইঙ্কা আমলের ছোটবড় পাথর ৷ চিনচেরোর গির্জাটি দর্শনীয় ৷ স্থানীয় কারিগর দিয়ে পর্তুগিজ শৈলীর এই গির্জাটি তৈরি করানো হয়েছিল ৷ তাই সর্বত্র দুই শৈলীর ছাপ স্পষ্ট ৷ ইঙ্কাদের আঁকা কিছু ছবি, কাঠের কাজ এবং অলঙ্করণে গির্জাটি সমৃদ্ধ ৷
ওলানতেটাম্বোতে যখন পৌঁছলাম আমরা, তখন আমাদের সামর্থ্যের শেষ ধাপে পৌঁছে গিয়েছি ৷ পাহাড়ের গায়ে পঞ্চাশ-ষাট ফুট চওড়া ধাপ-কাটা ৷ শ-দেড়েক ধাপ ওপরে উঠে আবার ইঙ্কাদের কোনও কীর্তির ধ্বংসাবশেষ ৷ অনেক কোচ এসেছে, অনেক পর্যটক পাহাড়ে উঠছেনও, কিন্তু আমার মতো পরিশ্রান্ত অনেকে নিচে একটু ছায়ার সন্ধানে ঘুরছেন ৷ শেষ বিকেলের গুমোট গরম ছিল, আমাদের কষ্ট আরও বেড়ে গিয়েছিল ৷ দুটি ছোট দলে তিন-চারজন করে কুয়েচুয়া স্ত্রী-পুরুষ বালক-বালিকা স্থির হয়ে বসেছিল এক পাশে ৷ তাদের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী কয়েকটি লামা ৷ এরা যেন মডেল, এদের পরনে বর্ণাঢ্য ইন্ডিয়ান পোশাক ৷ ছবি তুললে পয়সা আশা করে, না দিলেও কিছু বলছে না, লামাগুলির মতোই স্থির চোখে নিশ্চল মানুষগুলি বসে আছে ৷ পর্যটকের সুবিধার জন্য এমন আয়োজন আরও কয়েক জায়গায় দেখেছি ৷ যেমন দেখেছি ফেরিওয়ালা স্থানীয় হাতের কাজ বিক্রির চেষ্টা করছে ৷
কুজকোর আশপাশে প্রত্ন-সম্পদের ছড়াছড়ি ৷ পথে পাহাড়ের ছবি ঘনঘন বদলাতে থাকে, কোথাও থাকে থাকে পাহাড়ের শস্যক্ষেত্র উরুবাম্বা নদী পর্যন্ত নেমে এসেছে, কোথাও তৃণগুল্মহীন নির্দয় পাথর ভ্রূকুটির মতো দাঁড়িয়ে আছে ৷ উরুবাম্বা উপত্যকাটি নিসর্গে বড় মনোরম ৷ এই অঞ্চলকে বলা হয় সেকরেড ভ্যালি অব দি ইঙ্কাস ৷ ইঙ্কাদের পবিত্র উপত্যকা ৷
প্রত্নতাত্বিক সমারোহের মধ্যমণি হল মাচুপিচু ৷ আন্ডিস পর্বতের মধ্য দিয়ে ট্রেন নিচে নামতে থাকে ৷ ভোরবেলা কুজকোর সান পেড্রো স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ল ৷ দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেনের মতো ৷ নেমে এলাম ঘুরে, গড়্গড়িয়ে, ভাবনা হয় উঠতে পারবে তো এই ট্রেন ৷ কুজকো শহরের কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে ছোট ট্রেন, বসতি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে, কখনও পাশ কাটিয়ে পঞ্চাশ মাইল অতিক্রম করবে প্রায় চার ঘণ্টায় ৷ পথে স্টেশনও পড়ল কয়েকটি ৷ যেখানে যথারীতি স্থানীয় হাতের কাজ নিয়ে আশপাশের গ্রামের মানুষ ৷ ট্রেনে স্প্রিং-এর কমতি ছিল ৷ খুব ঝাঁকানি দিয়ে চলে ৷ দাঁড়ালেই পড়ে যাবার ভয় ৷ তিন শ্রেণী ৷ আমরা মধ্যবর্তী শ্রেণীতে উঠেছি ৷ আসন সংরক্ষিত ৷ ট্রেনে ব্রেকফাস্ট পরিবেশন হল ৷ মাচুপিচুর ভিডিও ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে গাড়ির ভেতর ৷ ইন্ডিয়ান গানের ক্যাসেটও ছিল ৷ প্রত্যেক কামরায় টেলিভিশন স্ক্রিনে মাচুপিচুর ভিডিও দেখতে দেখতে চলেছি ৷ আমরা উরুবাম্বা উপত্যকার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, কখনও নদীর অত্যন্ত কাছাকাছি, কখনও দূরে সরে যাচ্ছি, প্রকৃতির চেহারাও ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে ৷ এক জায়গায় নদী হঠাৎ বড় বড় পাথরের ওপর দিয়ে দ্রুত চলেছে, ফেনায় স্থানটা ভরে রয়েছে, পাহাড়ি র্যাপিডস-এর মতো ৷
দু-আড়াই হাজার ফুট নেমে উপত্যকা অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে এসেছে ৷ দুপাশে খাড়া পাহাড় ঘন সবুজ ৷ ট্রেনের দৌড় এই পর্যন্ত ৷ পুন্টেস রুইনাস স্টেশন ৷ একটু এধারে সারি সারি কোচ দাঁড়িয়ে আছে ৷ আমাদের জন্য নির্দিষ্ট কোচে উঠে পড়লাম ৷ উরুবাম্বা এখানে ক্ষীণকায় ৷ পোল পার হয়ে নদীর অপর পার থেকে আবার চড়াই আরম্ভ হল ৷ হাজার ফুট ওপরে উঠব ৷ আধঘণ্টার যাত্রা ৷ ওপরে আরও অনেক কোচ ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে ৷ আমাদের পরে আরও আসছে ৷ পাহাড়ের ওপরে একটা মালভূমির মতো জায়গায় এসেছি, মাচুপিচু ৷
এখন মাচুপিচু ন্যাশনাল পার্ক ৷ সংরক্ষিত স্থান ৷ ভারতীয় একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হল ৷ সে বলল, পার্কের গেট ওই সামনে ৷ প্রবেশের আগে আপনার ব্রিফকেস, খাবারের ঝুলি, মায় জলের বোতল সব জমা রেখে যেতে হবে ৷ মেয়েটি অস্ট্রেলিয়ায় থাকে ৷ ওই দেশি ছেলেকে বিয়ে করেছে ৷ উপদেশ দিল, একটু জিরিয়ে নিয়ে জল খেয়ে যান ৷ ভেতরে তৃষ্ণায় এবং গরমে কষ্ট পাবেন ৷ অক্ষরে অক্ষরে ফলল তার কথা ৷ দ্বিপ্রহরের সূর্য মাথার ওপর ৷ স্থানে স্থানে কোনও বড় গাছ নেই, ছায়া বিরল ৷ তবু দু-দশজন নিয়ম অগ্রাহ্য করে বিদেশি জলের বোতল নিয়ে ঢুকেছিলেন ৷ আমরা সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থাকলাম ৷
পাঁচ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে মাচুপিচু মালভূমি ৷ ১৯১১ সাল পর্যন্ত কেউ এই স্থানটির অস্তিত্ব জানত না ৷ ওই বছর আমেরিকার প্রত্নতত্বের অধ্যাপক হিরাম বিংহাম মাচুপিচু আবিষ্কার করেন ৷ তারপর থেকে সারা পৃথিবীর পর্যটক ইঙ্কা সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশের রূপ দেখতে মাচুপিচু আসেন ৷
ফটক পার হয়ে, পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা উঁচুনিচু একটা সরু পথ ধরে আমরা এগোতে লাগলাম ৷ হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরে মাচুপিচুর সিংহাবলোকন হল ৷ সেকালের ইঙ্কাদের বাড়িঘর, মন্দির ইত্যাদি প্রায় অবিকৃত অবস্থায় দেখা যায় ৷
আমাদের দলে কুড়িজন পর্যটক ৷ নানা দেশের মানুষ সে দলে ৷ ভারতীয় বলতে আমরা দুজন ৷ পেরুর ভ্রমণে আমরা অস্ট্রেলিয়ার ভারতীয় মেয়েটি ছাড়া বম্বের এক গুজরাটি ভদ্রলোককে দেখেছিলাম ৷ তাঁর মেয়ে আমেরিকাতে থাকে ৷ তাকে সঙ্গে নিয়ে কুজকো এসেছিলেন ৷ তারপর অন্য দলে চলে গেছেন ৷
আমাদের গাইড যুবকটিও কুয়েচুয়া ইন্ডিয়ান ৷ ইঙ্কাদের সম্বন্ধে বলতে তারও অদম্য উৎসাহ ৷ বড় কাগজের ওপর ছবি এঁকে আমাদের বোঝাল ইঙ্কা স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য কোথায় ৷ ইঙ্কাদের কোনও কক্ষের জানলা চৌকো বা রেকটাঙ্গেল (আয়তক্ষেত্র) নয় ৷ সব ট্র্যাপিজয়েড, যেখানে জানলাগুলির ধার সমান্তরাল নয় ৷ এই নকশায় ভার বহনের ক্ষমতা বাড়ে, ভারসাম্য ঠিক থাকে ৷ জানলাগুলির অবস্থানও যে সূর্যের গতিপথের হিসেব করে এবং এসব যে ইঙ্কাদের জ্যোতির্বিদ্যার প্রভূত উন্নতির জন্য হয়েছে, তাও শুনলাম ৷ প্রথমেই আমরা গিয়েছিলাম সূর্য মন্দির ৷ ইঙ্কাদের দেবতা সূর্য ৷ সত্যিই ইঙ্কারা জ্যোতির্বিদ্যায় কত উন্নত ছিল আমার জানা নেই, তবে তারা বছর শুরু করত মকর সংক্রান্তির দিন, ২২ বা ২৩ ডিসেম্বর থেকে, যেদিন সব থেকে ছোট দিন, তারপর দিন দীর্ঘ হতে শুরু করে ৷ ৩৬৫ দিনের বছর ছিল তাদের এবং বারোটি মাস ৷ অনুমান করতে বাধা নেই যে ইঙ্কাদের অন্য কোনও সভ্যতার সঙ্গে যোগ অথবা পরিচয় ছিল না, এই প্রমাণিত ধারণাগুলিতে তারা নিজেরাই পৌঁছেছিল ৷
একটি গোল বাড়িতে গেলাম ৷ বাড়ি বলতে একটি বড় কক্ষ ৷ এখানে সেই এক ধরনের কাজ ৷ বিশাল আকারের পাথর দু ফুট থেকে চার ফুট চওড়া, উঁচু দু-তিন ফুট, গভীরতা এক-দেড় ফুট ৷ পরের পর সাজিয়ে গাঁথা ৷ ছাদ কোথাও নেই, পাতার বা রিডের ছাদ হত ৷ দ্বিতল করবারও নিদর্শন দেখলাম ৷ অজস্র সিঁড়ি ভাঙতে হচ্ছিল ৷ বড় একটা খোলা জায়গায় বিভিন্ন স্তরে নির্মাণকার্য হয়েছিল ৷
গাইড বলল, সম্ভবত এটা ইঙ্কাদের মন্দির শহর ছিল ৷ অন্তত দুশো পরিবারের আবাসের ইঙ্গিত রয়েছে ৷ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের বাসস্থান ৷ রাজারানির বাসকক্ষও দেখলাম ৷
ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন, দ্বাদশ শতাব্দীর কোনও সময়ে এই শহরের পত্তন হয়েছিল ৷ অনেকের মতে, সম্রাট ইঙ্কা পাচাকুটি মাচুপিচুর স্থাপন করেছিলেন ৷ পাচাকুটি মারা গিয়েছিলেন ১৪৭১ সালে, তার মানে মাচুপিচুর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মধ্য পঞ্চদশ শতাব্দীতে ৷ চারদিকে পাহাড়ঘেরা লোকচক্ষুর অন্তরালে ৷ স্প্যানিশরা ষোড়শ শতাব্দীতে কুজকো এবং আশপাশের জনপদ দখল করেও মাচুপিচুর সন্ধান পায়নি ৷ তাই জায়গাটা অক্ষত আছে ৷ অধিবাসীরা স্প্যানিশ আক্রমণের আশঙ্কায় অথবা অন্য কোনও কারণে মাচুপিচু পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায় ৷ সাড়ে তিনশো বছর পরে হিরাম বিংহাম মাচুপিচু আবিষ্কার করেন, একথা আগেই বলেছি ৷ তাঁর আগে কেউ মাচুপিচুর খবরই জানত না ৷
খবর না জানার প্রধান কারণ, ইঙ্কাদের লিখিত ভাষা না থাকার জন্য কোনও রেকর্ড রাখা সম্ভব হয়নি ৷ আমার মনে প্রশ্ন হচ্ছিল ইঙ্কারা তো দূরত্ব জয় করতে কার্পণ্য করেনি, মধ্য চিলি থেকে ইকুয়েডর পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল ৷ ইঙ্কার রাজারা তথ্য ইতিহাস ইত্যাদি ধরে রাখবার জন্য এবং দূরে কোনও খবর পাঠাবার জন্য স্মৃতিধর মানুষ নিয়োগ করতেন ৷ তাঁরাই ইঙ্কাদের ঐতিহ্যের কথা জানতেন ৷ অর্থাৎ কমিউনিকেশন সিস্টেমটা তাঁরা চালাতেন ৷ স্প্যানিশরা ইঙ্কা রাজত্ব ধ্বংস করলেও, তাঁদের জন্যই আজ আমরা ইঙ্কাদের সভ্যতার কিছু বর্ণনা পাই ৷ স্প্যানিশ আক্রমণের সময় যে স্মৃতিধরেরা জীবিত ছিলেন এবং মুখে মুখে যে কাহিনী ও কথার প্রচার ছিল, সমসাময়িক স্প্যানিশ লেখক, ঐতিহাসিক তার বর্ণনা লিখে গিয়েছেন ৷ ইঙ্কাদের সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানের সূত্র তাঁরা ৷ তাই আমরা জানতে পেরেছি ইঙ্কারা চাকার ব্যবহার জানত না ৷ খনি থেকে সোনা রুপো নিষ্কাশনের পদ্ধতি ইঙ্কাদের আয়ত্তে ছিল ৷ ধাতুর নানা বিচিত্র অলঙ্কার উদ্ধার করেছেন প্রত্নতাত্বিকেরা ৷ রাজ্য শাসনের জন্য ইঙ্কারা কুজকো থেকে মধ্য ইকুয়েডর পর্যন্ত চব্বিশ ফুট চওড়া রাস্তা তৈরি করেছিল দুর্গম আন্ডিস পর্বতমালার ওপর দিয়ে, প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার ৷ আরও একটা উপকূলবর্তী রাস্তা তারা তৈরি করেছিল আন্ডিসের পাদদেশে, সেটিও সমান দীর্ঘ, মধ্য চিলি থেকে ইকুয়েডরের শেষ পর্যন্ত ৷ অথচ তারা লোহার ব্যবহার জানত না ৷ ব্রোঞ্জ, তামা, পাথরের খনিত্র তার সাক্ষ্য দেয় ৷ ইঙ্কাদের কোনও ভারবাহী বা দ্রুতগতি পালিত প্রাণী ছিল না ৷ তবুও মাত্র একশো বছরের মধ্যে বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল, রাজ্য শাসনও করেছিল দক্ষতার সঙ্গে ৷ কোনও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ঘটেনি ৷ সাম্রাজ্যের মানুষের সংখ্যা সওয়া কোটি, তারা অন্তত কুড়িটি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে ৷
গাইড বলেছিল, ইঙ্কারা হিসাবপত্র রাখার একটা উপায় প্রবর্তন করেছিল ৷ তার নাম কিউপু ৷ একটা ছোট লাঠিতে বাঁধা বিভিন্ন রঙের সুতো ঝোলানো থাকে, তাতে গেরো বেঁধে বেঁধে জটিল পদ্ধতিতে নির্ভুল হিসাব রাখা যেত ৷ যা কিছু পাওয়া গিয়েছে তার পাঠোদ্ধার সহজ নয় ৷ কিউপুতে নাকি কিছু তথ্যও রাখা যেত, কিন্তু পাঠোদ্ধার ইঙ্কা শ্রুতিধর ছাড়া করা সম্ভব হয়নি ৷
ঘোরা যেত আরও অনেক ৷ বহু পর্যটক ইঙ্কা ট্রেল ধরে তিন-চারদিনের যাত্রা করেন পায়ে হেঁটে ৷ যে অঞ্চল দিয়ে গিয়ে ইঙ্কা ট্রেল ধরতে হয়, তাকে বলা হয় সেকরেড ভ্যালি, পুণ্যভূমি ৷
রৌদ্র প্রখর ছিল, জলপানের উপায় নেই ৷ সূর্য মধ্যগগনে বলে কোনও দেওয়ালের আড়ালেও ছায়া নেই ৷ আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি ৷ গাইড আমাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যাচ্ছে, তার ক্লান্তি নেই ৷ উঠতে নামতেও হচ্ছে ৷
একটি বৃত্তাকার কক্ষে গেলাম ৷ নিয়ে গেল তিন জানলা-বিশিষ্ট আরেকটি কক্ষে ৷ অন্য এক কক্ষের ভেতর দিয়ে একটু নিচে নামলে অন্ধকার একটি প্রকোষ্ঠ ৷ এখানে সূর্য দেবতার পূজায় প্রাণী বলি দেওয়া হত ৷ নরবলিও দেওয়া হত বলে ষোড়শ শতাব্দীর ঐতিহাসিকেরা উল্লেখ করেছেন ৷ ইঙ্কারা প্রথম দুশো-আড়াইশো বছর কুজকো এবং তার কাছাকাছি জায়গায় পুরনো অধিবাসীদের পর্যুদস্ত করে রাজত্ব করেছে ৷ পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যিনি রাজা হলেন পাচাকুটি ইঙ্কা, সমর্থ উচ্চাভিলাষী পুরুষ, তিনি মন দিলেন সাম্রাজ্য বিস্তারে ৷ পাচাকুটির মৃত্যু হয় ১৪৭১ সালে ৷ তারপরও সাম্রাজ্য বিস্তার চলেছিল ৷ স্প্যানিশরা এসে যখন ইঙ্কা রাজধানী অধিকার করল, তখন সাম্রাজ্যের বিস্তার উত্তর ইকুয়েডর থেকে সম্পূর্ণ পেরু পার হয়ে মধ্য চিলি পর্যন্ত ৷ দুহাজার কিলোমিটারের অধিক ৷ ইঙ্কাদের সমাজব্যবস্থা, রাজ্য শাসনের ধারা সবই গড়ে উঠেছিল লিখিত ভাষা ছাড়া ৷ কেমন করে নির্দেশ পাঠানো হত এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, শ্রুতিধর দূত কতখানি নির্ভরযোগ্য ছিল, আজও তার গবেষণা হচ্ছে ৷
স্পেনের রাজা পঞ্চম কার্লোসের অনুগ্রহে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন পিজারো তিনটি জাহাজে একশো আশি জন সৈন্য ও সাতাশটি ঘোড়া নিয়ে পেরুর উপকূলে পৌঁছলেন ৷ সময়টা ইঙ্কা রাজা আতাউয়ালপার ভালো যাচ্ছিল না তখন ৷ দেশে ইতস্তত বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে ৷ কুজকো থেকে তিনি কায়ামার্কাতে নেমে এলেন ৷ সঙ্গে পঞ্চাশ হাজার যোদ্ধা ৷ তাঁর ভাই উয়াসকারকে যোগ্য শাস্তি দেবার জন্য এগোচ্ছেন, এমন সময় খবর পেলেন, কোনও বিদেশি দল পেরুর উপকূলে নেমেছে ৷ রাজার কিছু সৈন্য খবর নিতে গিয়ে স্তম্ভিত ৷ যারা এসেছে তারা নিশ্চয় ভগবানের কাছের মানুষ ৷ চুল সোনালি, সুগৌর বর্ণ, নীলাভ চোখ ৷ এমন সুন্দর মানুষ তারা কখনও দেখেনি, আগন্তুক রাজার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করায় রাজসৈন্যেরা দেবদূতদের অভ্যর্থনা করে সানন্দে রাজার কাছে নিয়ে চলল ৷
পিজারোর সৈন্যেরা রাজার কাছে পৌঁছে রাজার দুহাজার দেহরক্ষীকে নৃশংসভাবে হত্যা করল ৷ সেই সৈনিকদের বন্দুক গুলি কামান নেই, তারা সহজেই পরাজিত হয়ে প্রাণ দিল ৷ ঐতিহাসিকেরা বলেন, কায়ামার্কায় রাজার পঞ্চাশ হাজার সশস্ত্র সৈনিক সে খবর পেল না ৷ পিজারো রাজা আতাউয়ালপাকে সহজেই বন্দি করলেন ৷ তারপর মুক্তিপণ চাইলেন যে কক্ষে রাজা বন্দি, সেই কক্ষ ভরে সোনা ৷ আতাউয়ালপা সরল বিশ্বাসে পিজারোকে ঘর ভরে সোনা দিলেন, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক পিজারো অকস্মাৎ যখের ধন পাবার পর আতাউয়ালপাকে হত্যা করেছিলেন ৷
কুজকোয় যখন সে খবর পৌঁছল, সিংহাসনে বসলেন মাঙ্কো ইঙ্কা ৷ ধনরত্নের সন্ধানে পিজারো দিগবিদিকে তাঁর সৈন্যদের পাঠাচ্ছেন ৷ এক দল সৈন্য কুজকো আসছে খবর পেয়ে মাঙ্কো ইঙ্কা ১৫৩৫ সালে কুজকো পরিত্যাগ করে পলায়ন করলেন ৷ স্প্যানিশরা কুজকোও দখল করল বিনা যুদ্ধে ৷ মাঙ্কো ইঙ্কা ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেলেন ৷ তার পরের অধ্যায় আমাদের জানা, লুণ্ঠন ও ধ্বংস ৷ মাচুপিচুর খবর পায়নি স্প্যানিশরা ৷ মাচুপিচু তাই আজও অক্ষত ৷
পার্ক থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে দেখি একটি বড় পাথরের ছায়ায় এক জাপানি ভদ্রলোক বসে ৷ কাছে আসতেই তাঁর মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল ৷ আমরা কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হয়েছিলাম ৷ আমরা এমন দলছাড়া জাপানি পর্যটক দেখিনি ৷ দেখেছি জাপানিরা ছোট বড় দলে একসঙ্গে ঘোরে ৷ কারও সঙ্গে বিশেষ আলাপ করে না, হয়তো তাদের ইংরিজি বলার আড়ষ্টতার জন্য ৷ আমরাও পাথরের ছায়ার আশ্রয় নিলাম ৷ জাপানি ভদ্রলোক ভালো ইংরিজি বলেন ৷ কাজেই আলাপের অসুবিধা ছিল না ৷ তিনি ওসাকার এক বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ৷ প্রত্যেক ছুটিতে তিনি অন্তত দিন পনেরোর জন্য কুজকো আসেন এবং সেখান থেকে মাচুপিচু তিন-চারদিন ৷ আমরা আজই ফিরে যাচ্ছি শুনে হতাশ গলায় বললেন, আমি কয়েক বছর ধরে মাচুপিচুতে আসছি, দেখার শেষ নেই ৷ কাল সকালে আমাদের সামনের ওই পাহাড়ে উঠব, প্রতিবছরই উঠি ৷ পাহাড়ের নাম হুয়েনাপিচু, গভীর সবুজ বৃক্ষলতায় মোড়া, দুপুরের রৌদ্রে মরকতের মতো জ্বলছে ৷ ভদ্রলোক বললেন, তাছাড়া রাতে যদি পার্কের কাছে পেরু হোটেলে না থাকলেন, সকালের প্রথম রোদ মাচুপিচুর ওপর পড়তে না দেখলেন, তাহলে কি মাচুপিচু দেখা হল?
মাচুপিচুর মায়াবদ্ধ মানুষটির কাছে বিদায় নিয়ে আমরা পার্কের বাইরে ভোজনস্থলে যাব ৷ এলাহি আয়োজন ৷ আমাদের কুপন দেওয়া ছিল, তার বিনিময়ে খাবার পাওয়া গেল ৷ বহু পদের আয়োজন, সিদ্ধ ভুট্টাও অব্যর্থ ছিল ৷ পরিপাটি ভোজন হল ৷ এবার ফেরা ৷ প্রথমে কোচ, তারপর পুন্টেস রুইনাস স্টেশন ৷ স্টেশনের কাছে আমাদের দেশের মতো ছোট ছোট অস্থায়ী স্টল ৷ টুকিটাকি জিনিস থেকে, উচ্চমূল্য কার্পেট, ভিকুনার জামা, লামার পশমে বোনা সোয়েটার ৷
আমাদের ট্রেন অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল ৷ ট্রেনের স্বল্প আলোয় ইঙ্কা সভ্যতার অসাধারণ উন্নতির কথা ভাবতে ভাবতে সাড়ে নটা নাগাদ কুজকো পৌঁছলাম ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন