অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
গানতোক না গ্যাংটক? সিকিমে দেখলাম দুই নামই চলছে পাশাপাশি ৷ কথাবার্তায় সকলেই বলে গ্যাংটক, কিন্তু লেখায়, বিশেষ করে দেবনাগরী হরফে লেখায় সচরাচর গানতোকই থাকছে ৷ তোক মানে সিকিমের ভাষায় পাহাড়চূড়া, আর গানতোক হল সবচেয়ে উঁচু পাহাড়চূড়া ৷
আমার গানতোক নামটাই পছন্দ ৷ গানতোক যাওয়া হল এবার, কিন্তু গানতোকের জন্য নয়, আমাদের লক্ষ্য ছিল ইয়ুমথাং ৷ দল মাত্র দুজনের-আমি আর দিদি ৷ দিদি দুবছর আগে, ঠিক এই সময়েই-মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘুরে এসেছে ইয়ুমথাং ৷ সেখানকার ফুলের সমারোহ দেখে থেকে তার ফুল-পাগল বোনকেও দেখাতে ইচ্ছে হয়েছিল ৷ এবারে তার সেই শখ-মেটানো ৷
ইয়ুমথাং যেতে হলে আমাদের মতো ছোট দলের বেশ অসুবিধে ৷ বড় দল হলে ভালো ৷ নিজেরা গোটা একটা গাড়ি নেওয়া যায়, ইচ্ছেমতো বেড়ানো যায় ৷ তবে অবশ্য কোনও-না-কোনও ট্র্যাভেল এজেন্সির সঙ্গে ৷ খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা তারাই করে দেয় কি না ৷ হয়তো অল্পদিন পরে ট্র্যাভেল এজেন্সির আর দরকার হবে না, ভ্রমণেচ্ছুরা সরাসরি চলে যাবে লাচুং, লাচুং থেকে ইয়ুমথাং, এমন সব হোটেল থাকবে সেসব জায়গায় যারা সকালবেলার চা থেকে রাতের খাবার সবই জোগাবে ৷ হয়তো সবই হবে একদিন, কিন্তু আমাদের তো ট্র্যাভেল-এজেন্সির কাছেই ধর্না দিয়ে বসে থাকতেই হল!
গানতোকে পৌঁছবার আগে, কালিম্পং থেকেই টেলিফোনে আমরা একটি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম ৷ তারা আশ্বাসও দিয়েছিল, বলেছিল কলকাতা থেকে একটি দল আসছে, আমরা তাদের সঙ্গেই যেতে পারব ৷ কিন্তু গানতোকে তাদের দপ্তরে পৌঁছে দেখি কোথায় কী! ঘণ্টাদুয়েক অফিসে বসিয়ে রেখে এজেন্সি জানাল-কলকাতার দল পুরো গাড়ি রিজার্ভ করেছে, তারা বাইরের লোক নেবে না ৷ আর তাদের কাছে আর কোনও ভ্রমণেচ্ছু দলও সে সময় আসেনি, যাদের সঙ্গ নিতে পারি আমরা ৷ সুতরাং, দুঃখিত, তারা আমাদের জন্য কিছুই করতে পারছে না, আমরা অন্য কোনও ট্র্যাভেল এজেন্সির কাছে গিয়ে দেখতে পারি! কিন্তু আমরা তো আর কারোর নাম জানি না, দিদি এদেরই সঙ্গে আগে গিয়েছিল ৷ ওই দপ্তরে উপস্থিত একজন ভদ্রলোক তখন অন্য একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে ফোন করলেন ৷ জানা গেল, তাদের একটি দল পরদিনই রওনা হচ্ছে ইয়ুমথাং, দলে আছেন তিনজন, আমাদের দুজনের জায়গা হয়ে যাবে ৷ কিন্তু এই তিনজন চেয়েছেন একরাতের ট্রিপ ৷ আমরা চেয়েছিলাম দুরাতের বেড়ানো, সে আর হল না!
পরদিন সকাল নটায় গাড়ি আসবার কথা, তৈরি হয়ে বসে থাকলাম, গাড়ি এল বেলা এগারোটায় ৷ তিনজন বাঙালি ভদ্রলোকের একটি দল রয়েছে গাড়িতে, আর তিনজন আছে ট্র্যাভেল এজেন্সির তরফের-তিনজনেরই বয়স হবে কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে ৷ সরল সুন্দর অনভিজ্ঞ তিনটি মুখ ৷ এইখানেই গানতোকের গোলমাল ৷ রাশি রাশি ট্র্যাভেল এজেন্সি রয়েছে শহরে, কিন্তু অভিজ্ঞ কর্মী সম্ভবত তত নেই ৷ আর তাই ইয়ুমথাং বেড়ানো আমাদের মসৃণ হল না ৷ তাই বলে যে খারাপ হল তাও নয় ৷ এও তো আরেকরকমের অভিজ্ঞতা ৷
আমাদের প্রথম গন্তব্য লাচুং ৷ সেখানে বিকেলে পৌঁছে যাবার কথা ৷ পথের এখানে-সেখানে অসাধারণ সব জলপ্রপাত! হিমালয়ের পথে আরও তো ঘুরেছি, দেখেছি অনেক প্রপাতধারা ৷ কিন্তু উত্তর-সিকিমের পথের প্রপাত-সৌন্দর্য যেন সকলের ওপরে! পৌঁছলাম মঙ্গন, সেখানে অনেকক্ষণ গাড়ি দাঁড়াল, আমাদের লাঞ্চ প্যাকেট দেওয়া হল, চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেলাম ৷ এসব সারা হবার পরও বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল গাড়ি ৷ কেন জানি না ৷ সেখান থেকে একঘণ্টা পরে একটা চেকপোস্টের সামনে এসে পৌঁছলাম, জায়গাটার নাম টোং ৷ রাস্তা আটকানো, পাশে পুলিশ-গুমটি ৷ পুলিশ পারমিট পরখ করে তবে গাড়ি যেতে দেবে ৷ ড্রাইভার আর ম্যানেজার গেল গুমটিতে ৷ পারমিটের কাগজ হাতে নিয়ে অফিসার কী বলছেন তাদের, আমরা গাড়ি থেকে কিছুই বুঝছি না ৷ শুধু দেখছি-একের পর এক গাড়ি আসছে, চলে যাচ্ছে, শুধু বসে আছি আমরা ৷ আধঘণ্টা কেটে যাবার পর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সান্ত্রীটিকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল গোলমাল কোথায়! আমাদের পারমিটে নাকি অফিসারের সই পড়েনি! গানতোকে প্রতিদিন ছাঙ্গু আর ইয়ুমথাঙের যাত্রীদের রাশি রাশি পারমিট তৈরি হয়, সবারই খুব তাড়া, এই পরিস্থিতে পারমিট বার হয়ে এসেছে অফিসারের সই-ছাড়াই! তাহলে কী হবে? আমাদের যাওয়া কি হবে না? -ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি সান্ত্রীটিকে ৷ সে জানায়, আবার মঙ্গনে গিয়ে সেখানকার পুলিশ-অফিস থেকে সই করিয়ে আনতে হবে পারমিট ৷ তার মানে আরও দুঘণ্টা দেরি হবে লাচুং পৌঁছতে! পাঁচজনের দলের প্রত্যেকেই আমরা নানাভাবে উষ্মা প্রকাশ করতে লাগলাম, ট্র্যাভেল এজেন্সির অপদার্থতা বিষয়ে সকলেই ক্ষুব্ধ ৷ তার ওপর ড্রাইভার বলল, আমাদের এখানে নামিয়ে রেখে খালি গাড়ি নিয়ে সে মঙ্গন ঘুরে আসবে, তাহলে সময় কিছুটা বাঁচবে ৷ জিপের মাথায় বাঁধা-ছাঁদা মালপত্তর, সেগুলোও কি নামানো হবে? না, সেসব অমনিই থাকবে ৷ অর্থাৎ, আমাদের ফেলে রেখে আমাদের মালপত্তর নিয়ে গাড়ি চলে যাবে মঙ্গন ৷ তারপর, যদি মঙ্গন থেকে গাড়ি না ফেরে, যদি চলে যায় গানতোক? তাহলে কী হবে আমাদের? এসব আশঙ্কা মনের মধ্যে রেখে গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ-অফিসের লাগোয়া একটা অন্ধকার ঘরে গিয়ে বসলাম সবাই ৷ ঘরটিতে বসেছিলেন একজন বাঙালি মিলিটারি অফিসার ৷ তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম কাছে-পিঠে কোথাও চায়ের দোকান আছে কি না ৷ তিনি জানালেন, না, কোনও দোকান নেই ৷ জানতে চাইলাম তাঁরা চা কোথায় খান ৷ তিনি বললেন তাঁর কোয়ার্টার পাশেই, সেখানে একজন এসে তাঁর রান্না করে দিয়ে যায়, কিন্তু আজ সে এখনও আসেনি ৷ বুঝলাম চা পাবার কোনও আশাই নেই! সেই অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে বিরক্ত লাগছিল খুব, দিদিকে বলে বাইরে হাঁটতে বেরলাম ৷
পুলিশ-গুমটির পরে আর বাড়িঘর নেই, দু-পা এগিয়েই চমৎকৃত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম-গর্জন করে বয়ে চলেছে তিস্তার পান্না-গলানো স্রোত, পিছনে বনভূমি-ছাওয়া গম্ভীর পর্বতশ্রেণী ৷ আশ্চর্য, এতক্ষণ জানতেই পারিনি এত কাছে, ঠিক পাশটিতেই রয়েছে তিস্তা, পুলিশ-মিলিটারির বাড়িঘর আড়াল করে রেখেছিল ৷ সেই নির্জন শ্যামল বনভূমির স্তব্ধতার বিপরীতে দুরন্ত তিস্তার কলস্বরা জলরাশি-এমন ছবিটি তো এখানে না দাঁড়ালে দেখতেই পেতাম না! তিস্তার স্রোতের পাশাপাশি হেঁটে চলেছি, এমন সময় পিছন থেকে দিদির ডাক-সেই মিলিটারি ভদ্রলোক, যাঁর নাম স্বপন মুখোপাধ্যায়, তিনি তাঁর কোয়ার্টারে আমাদের চা খেতে ডেকেছেন ৷
সেখানে গিয়ে দেখি, বেশ পরিষ্কার তকতকে বড় একটি ঘর ৷ মিলিটারি আরেকজন অফিসার রয়েছেন, তাঁর নাম গণেশ ছেত্রী -তাঁর বাড়ি আসামে, যদিও তিনি নেপালি ৷ স্বপনবাবু নিজে হাতেই স্টোভ জ্বেলে সকলের জন্য চা তৈরি করছেন ৷ আমাদের দলের সবারই দেখি রাগ বিরক্তি সব কোথায় চলে গেছে! চা খেতে খেতে গল্পগুজব চলছে ৷ দলের একজন বললেন, ভাগ্যিস এই পারমিটের গোলমালটা হল, না হলে তো আপনাদের সঙ্গে আলাপই হত না ৷ দিদি দার্জিলিংয়ে থাকে বলে নেপালি ভাষায় খুব ভালো কথা বলতে পারে ৷ গণেশবাবুর সঙ্গে নেপালিতে আলাপ চালাচ্ছিল সে ৷ একটি নেপালি কমবয়সী বধূ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিল, দিদিকে নেপালি বলতে শুনে সে এসে দিদির সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল ৷ দিদি আর আমি তার সঙ্গে তার বাসা দেখতে গেলাম ৷ দিদি বলল গাড়িটা যদি রাত করে ফিরতে, তাহলে একটা রাত আমরা এই বোনটির কাছে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারি ৷ কিন্তু তার দরকার হল না, একটু পরেই আমাদের গাড়ি এল, রওনা দিলাম আমরা ৷ কিন্তু স্বপনবাবু, গণেশবাবু আর হাসিমুখ মিষ্টি বধূটিকে আর কোনওদিন দেখব না ভেবে মনটা একটু খারাপই লাগছিল তখন ৷
লাচুং পৌঁছতে সাতটা বেজে গেল ৷ এখানকার হোটেলগুলিতে কেবল থাকার ব্যবস্থা আছে ৷ কিচেন আছে, সেখানে রান্নাবান্না করে ট্র্যাভেল এজেন্সির লোকজন ৷ সেই তিনটি তরুণ-তরুণী মহা উৎসাহে কাজে নেমে পড়ল ৷ প্রথমে চা, তারপর রাতের খাবার ৷ যেখানে খাবার ব্যবস্থা, আমাদের মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা কিন্তু সেখানে হয়নি, যেতে হবে অনেক নিচের অন্য একটি হোটেলে ৷ সারাদিনের ক্লান্তির পর আবার হেঁটে নামতে হবে অনেকটা -ভাবতে ভালো লাগছিল না মোটেই ৷ কিন্তু, খাওয়া-দাওয়া সারা হলে, রাত সাড়ে এগারোটা বেজে যাবার পর গুঁড়ি গুঁড়ি হিম আর ছমছমে অন্ধকারের মধ্যে পথ হাঁটতে মন্দও লাগল না ৷ আমাদের হোটেলের কাছাকাছি এসে শুনতে পেলাম জলের গভীর গর্জন, কিন্তু অন্ধকারে দেখা গেল না কিছু ৷ খুব ভোরে উঠে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালাম ৷ কী গম্ভীর সুন্দর দৃশ্য! সামনে দিয়ে কলস্বরে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি এক নদী, আর আমাদের হোটেলের পাশ দিয়ে এক প্রপাত ধারা ঝাঁপিয়ে এসে পড়ছে সেই নদীর ওপর ৷ পিছনের কত উঁচু এক পাহাড়ের মাথা থেকে নামছে সেই প্রপাত! তাই না এত গর্জন! কাল ভাগ্যে ওপরের হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল না ৷ নিচে ছিলাম বলেই না নদী আর প্রপাতের সঙ্গমস্থানটির পাশে দাঁড়াবার সুযোগ হল!
লাচুং যেন মনে পড়িয়ে দিল অনেকদিন আগে দেখা পহেলগাঁও! পহেলগাঁওতে যেমন লিডারের দুটি ধারা, এখানেও তেমনই দুদিক থেকে দুটি ধারা এসে মিলেছে ৷ জলের কলধ্বনি এমনই শুনেছিলাম পহেলগাঁওতে ৷ তবে পহেলগাঁওতে তুষার-ছাওয়া পাহাড়মালা অনেক দূরে, লাচুংয়ে সেগুলি কাছে অনেক ৷ ওপরের হোটেলে, যেখানে দলের আর সকলে আছেন, সেখানে এসে দেখলাম সম্পূর্ণ লাচুংয়ের দৃশ্য-কত বিচিত্র ধরনের ছোট-বড় পাহাড়ে ঘেরা সবুজ একটি উপত্যকা, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে নদী, একপাশে পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে প্রপাত, কোথাও ছোট ছোট ঘরবাড়ি, কোথাও বা একলা একটি গাছ ৷ চুপ করে এই দৃশ্য দেখেই তো কাটিয়ে দেওয়া যায় কয়েকদিন ৷ ভাবাই যায় না কলকাতার এত কাছে আছে এমন সর্বসুন্দর ছবি ৷ ইয়ুমথাঙের কথা শুনে দেখতে এসেছি, কিন্তু লাচুং যে এমন মন কাড়বে তা তো জানা ছিল না! অন্তত আরেকটা রাত যদি থাকা যেত এখানে!
কিন্তু না, এখনই তো রওনা দিতে হবে ইয়ুমথাঙের দিকে ৷ ফিরে এসে আজই যে আবার গানতোকে নামা ৷ লাচুং থেকে ওপরে উঠতে শুরু করল গাড়ি ৷ বেশ কিছুটা ওঠার পর ফুল দেখা শুরু হল ৷ পথের পাশে ছোট ছোট পাহাড়ের ঢাল ভরে আছে বামন রডোডেনড্রনের থোকা থোকা সাদা ফুলে ৷ তারপর এল টগর গাছের মাপের রডোডেনড্রন-বেগুনি আর গোলাপি, হালকা আর গাঢ়-কত বিচিত্র রঙের রডোডেনড্রন, তার সঙ্গে ধবধবে সাদা আর টুকটুকে লাল তো আছেই ৷ একদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে তলা পর্যন্ত গড়িয়ে এসেছে পুরু বরফের স্তর, সেই বরফেরই আশপাশে নানা রঙের ফুলের মেলা ৷ রাস্তা চলেছে কোথাও বা হালকা পাতার রক্তিম রডোডেনড্রনের ঘন বনের বুক চিরে, কখনও বা পুরু পাতার গোলাপি রডোডেনড্রনের পাশ কাটিয়ে ৷ ইয়ুমথাং নদীর ধারে পৌঁছতে পৌঁছতে বৃষ্টি নামল ৷ গাড়ির ভেতর থেকেই দেখলাম নদীর ওপারে প্রিমুলা ফুল মাটির ওপর ঘন হয়ে ফুটে যেন বেগুনি রঙের গালচে পেতে দিয়েছে! তার ওপারে ঘন বন, তারও পরে গম্ভীর পর্বতমালা! এপারে আমাদের আশপাশেও ফুটেছে প্রিমুলা, কিন্তু আমাদের মতো দর্শকদের পায়ের চাপেই বোধহয় তারা অবচ্ছিন্ন, সংখ্যাতেও কম! নদীর ধারে রডোডেনড্রন বনও রয়েছে, কিন্তু ফুলন্ত নয়, গাছে কুঁড়ি এসেছে যদিও অনেক ৷
ইয়ুমথাং নদীর পাশে এক জায়গায় একটি গরমজলের কুণ্ড আছে, বরফের রাজ্যে গরমজল! ইচ্ছে করলে স্নানও করা যায় ৷ সেখানে যেতে গিয়ে আমাদের দলের সমরবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন ৷ ওইরকম ঠান্ডা জায়গাতেও তাঁর গরম লাগছে! তিনি তো খুবই ভয় পেয়েছেন, আমারও যে ভয় লাগছিল না তা নয় ৷ গানতোক থেকে সারা পথ যে মানুষটি প্রবল আগ্রহ নিয়ে পথের সৌন্দর্য দেখেছেন আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন নানা ভাবে, সেই মানুষটি হঠাৎ একেবারে চুপচাপ হয়ে গেলেন ৷ বারবার কেবল একটাই তাঁর অনুরোধ-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গানতোক পৌঁছতে হবে আমাদের ৷ দিদি বুঝতে পারছিল ওঁর অসুস্থতার কারণ আকস্মিক এতটা উঁচুতে আসা, এছাড়া আর কিছু নয় ৷ ও বারোবার অমরনাথ গেছে, অভিজ্ঞতা অনেক ৷ লাচুংয়ে পৌঁছে ও ব্র্যান্ডি কিনে এনে খাইয়ে দিল সমরবাবুকে, তার প্রতিক্রিয়ায় অনেকটা সুস্থ বোধ করলেন ভদ্রলোক ৷ তবু কিন্তু তাঁর ভয় আর যায় না, তিনি ধরেই নিয়েছেন হার্ট-অ্যাটাকই হয়েছে তাঁর, গানতোক না পৌঁছনো অবধি তাঁর শান্তি নেই ৷
এদিকে বৃষ্টি বাড়ছে, আমরা ভাবছি এখনই খেয়ে নিয়ে গানতোকের দিকে রওনা দেব ৷ এমন সময়ে, তরুণ ম্যানেজারটি জানালেন, এইবার রান্না চাপাবার আয়োজন শুরু হবে ৷ তখন বেলা সাড়ে বারোটা ৷ রান্না করার জন্য যে ছেলেটি এসেছিল, সে আমাদের সঙ্গে ইয়ুমথাঙে বেড়াতে গেল দেখে আমরা ধরে নিয়েছিলাম রান্নার দায়িত্ব হয়তো আর কারুকে দিয়েছে ওরা ৷ কমবয়সী ছেলেমেয়ে তিনটি, নিজেদের বোধবুদ্ধি অনুসারে ঠিক করে নিয়েছে রান্না পরে করলেও হবে, আগে তো একসঙ্গে বেড়ানো যাক! বৃষ্টির বহর দেখে ড্রাইভার কিন্তু রান্নার জন্য আর সময় দিতে নারাজ, এসব রাস্তায় ধস নামে যখন তখন ৷ সমরবাবুরও ফেরার তাড়া ৷ কাজেই ম্যানেজারকে বলা হল, আমরা ভাত খাব না, এখনই বেরিয়ে পড়ব ৷ ম্যানেজার ক্ষুব্ধ, দায়িত্ব তো তার, আমরা কেন নিজেরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি! তাকে বোঝানো যাচ্ছে না এরপর রান্না শুরু করে খাওয়া-শেষে সব গুছিয়ে তুলতে বেলা দুটো বেজে যাবেই আর দুটোর পর পাহাড়ি আবহাওয়া খারাপের দিকে যেতে থাকে ৷ মঙ্গনে পৌঁছে আমরা চায়ের সঙ্গে পাউরুটি খেলাম ৷ ম্যানেজার যে ছেলেটি, সেও আমাদের সঙ্গে খেল ৷ কিন্তু অন্য ছেলেমেয়ে দুটি কিছু খেল না ৷ বুঝলাম, ওদের খারাপ লাগছে খুব, হয়তো মালিকের কাছে ওরা বকুনিও খাবে ৷ কিন্তু দোষ কি মালিকের নয়? এত কমবয়সী তিনটি ছেলেমেয়ে, যাদের একজনেরও কোনও অভিজ্ঞতা নেই, তাদের এভাবে দায়িত্ব দেওয়াটাই তো অন্যায় ৷ সমরবাবুদের দলের একজন বলছিলেন, আমরা ভাত খেতে পেলাম না, কাজেই আমাদের দেয় টাকা কমাতে হবে ৷ সেটা উচিত-কথা বলে মনে হল না ৷ ওরা তো খাওয়াতেই চেয়েছিল ৷ একবেলা ভাত না-খাওয়ার জন্য আমাদের তত কিছু অসুবিধে লাগেনি, বরং ছেলেমেয়ে দুটি কিছু খেল না বলেই খারাপ লাগছিল ৷ গানতোকে পৌঁছে বিদায় নেবার সময় ছেলেমেয়ে তিনটির হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানালাম, বিনা ভাষায়, জানি না ওরা বুঝল কি না!
এই যে একটু-আধটু গোলমাল-এতে বেড়ানোর ব্যাপারে তেমন কিছু ক্ষতি হয় না ৷ তবু পরামর্শ দেব-ইয়ুমথাঙে যাঁরা বেড়াতে যাবেন, তাঁরা পারমিটটা নিজেরা দেখে নেবেন, আর ট্র্যাভেল এজেন্সি সম্বন্ধে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে রাখবেন ৷
প্রয়োজনীয় তথ্য
ইয়ুমথাং বেড়াতে গেলে সবচেয়ে ভালো হয় যদি বেশ বড় দল থাকে ৷ ১৬ জনের দল হলে দুই রাত তিনদিনের প্যাকেজে মাথাপিছু ১,৭৫০-১,৮০০ টাকায় বেড়ানো সম্ভব ৷ তবে দল ছোট হলে মাথাপিছু খরচ বাড়ে ৷ তাছাড়া, বিলাসবহুল রিসর্টে থাকলে খরচ সামান্য বেশি পড়ে ৷ শুধু দুজনের দল বিলাসবহুল রিসর্টে থাকলে খরচ হয় মাথাপিছু ৩,৫০০-৪,৫০০ টাকা ৷
ইয়ুমথাঙে থাকার জায়গা আছে বেশ কিছু ৷ ইয়াকশে রিসর্ট, ডাবলা ইন, স্নো লায়ন, অ্যাপল ভ্যালি ইন, অ্যালপাইন ইন, লালি গুরাস, ব্লু খাং ইত্যাদি ৷ এছাড়াও বেশ কিছু ছোটখাটো হোটেল আছে ৷
ভ্রমণ মে, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন