অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
আগে বলতুম পারস্য, এখন বলি ইরান ৷ সাইরাস, দারায়ুসের রাজত্ব ছিল পারস-এ ৷ তাই থেকে পারস্য ৷ তারপর ইরান ৷ ইরানি তরুণীর চোখে বাঁকা বিদ্যুতের কথা আমরা অনেকদিন থেকেই বাংলা কবিতা মারফত জানি ৷ ওদেশের গোলাপ ফুল তো আমাদের অতি প্রিয় ৷
সেই পারস্য বা ইরানে আমি গিয়েছিলাম ১৯৭৫ সালে ৷ সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা ৷ শেষ রাত্তিরে দিল্লি থেকে প্লেনে চড়ে ভোরে ভোরে তেহরান বিমানবন্দরে পৌঁছেছিলাম ৷ কাছেই পাহাড় আল-বুরুজ ৷ তার ফাঁক দিয়ে সেদিন সকালবেলা লাল সুরুজের আবির্ভাব অসাধারণ লেগেছিল ৷
ইরান দেশের কাজি-র গান যতই আমরা গাই না কেন, ইরানি বুলবুল বলে কারও গানের সমঝদারি যতই করি না কেন, ওই দেশটি সম্পর্কে আমাদের যতই কৌতূহল থাকুক না কেন, আমরা কিন্তু দেশটি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না, জানি শুধু ইরানের শাহ, খোমেইনি মোসাদেক প্রভৃতি রাষ্ট্র নেতাদের নাম ৷ না, অজান্তে আমরা কথ্য বাংলায় ব্যবহার করি অসংখ্য ফার্সি শব্দ ৷ প্রমথ চৌধুরী মশাই বলেছিলেন, আরবি-ফার্সি বাদ দিলে বাংলা বলে কোনও ভাষাই থাকে না ৷ ঠিক কথা ৷ ভারতচন্দ্র বলেছিলেন, ‘অতএব কহি ভাষা, যাবনী মিশাল ৷’ এই যাবনী মিশাল না হলে আমাদের কথাবার্তা হত যাচ্ছেতাই ৷ বিশেষ করে ফার্সি যাঁদের মুখের ভাষা, তাঁরা তো আমাদের দেশে রাজত্ব করেছে সাতশো বছর ৷
সে যাক গে, এবার স্রেফ ফার্সি মুলুক অর্থাৎ ইরান দেশে হাজির হই ৷ বহু বছর আগে ইরান থেকে এসেছিলেন বহু লোক ওই খাইবার-পাস দিয়ে ৷ তৈরি হল ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষা গোষ্ঠী ৷ তারপর নবাবের পর নবাব বাদশাহের পর বাদশাহ ৷ দিল্লির তখত তাঁদের হল একচেটিয়া ৷ আমাদের দেশে সরকারি ভাষা হয়ে গেল ফার্সি ৷ নাদির শাহ জবরদস্তি করে নিয়ে গেলেন দিল্লির ময়ূর সিংহাসন ৷ -দিল্লি থেকে তেহরান যেতে যেতে এইসব নানা চিন্তা আমার মাথায় ভিড় করে আসছিল ৷
আমি চলেছি ইউ এন ও আয়োজিত হ্যাবিটাট কনফারেন্সে ৷ আমাদের দলনেতা অধ্যাপক বি ডি নাগচৌধুরি ৷ আর আছেন জগমোহন, জগন্নাথন, আশিস বসু প্রভৃতি নামীদামি লোক ৷ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের প্রতিনিধিই আছেন ৷ এমনকী পাপুয়া-নিউগিনি থেকেও ৷ পাপুয়ার প্রতিনিধি চেনে আমাদের শান্তিনিকেতনের বন্ধু, পাপুয়ায় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পৃথ্বীন্দ্র চক্রবর্তীকে ৷ আর কেনিয়া থেকে যিনি এসেছেন, তাঁর চেনা আমার শান্তিনিকেতনের রুমমেট জোমো কোনিয়াট্টার সচিব টমাস ওকেলোকে ৷ আমি কুচকুচে কালো ওকেলোকে ডাকতাম ও-কেলো ৷ ওকেলো ভালো ফুটবল খেলত খালি পায়ে ৷ আর একজন শান্তিনিকেতনের আফ্রিকান ছাত্র এডওয়ার্ড কুফুর এখন ঘানার প্রেসিডেন্ট ৷
সে যাই হোক, তেহরান এয়ারপোর্টে ভোরবেলা নেমে আমার চক্ষু চড়কগাছ ৷ রোদে আকাশ তামাটে, সবুজ আর নীলের দেখা মেলে কদাচিৎ ৷ গায়ে লাগা আল-বুরুজ পাহাড়টাও তাই ৷ কাস্টমস ভিসা পাসপোর্টের ঝামেলা চুকিয়ে সামনে এগোতেই দেখি ওয়াকি-টকি হাতে বেশকিছু ইরানি তরুণ ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷ তাদের বুকে লেবেল আঁটা-‘হ্যাবিটাট সেভেন্টি ফাইভ ৷’ ইংরিজি আর ফার্সিতে ৷ ‘হ্যাবিটাট’ কথাটা লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের কথা ৷ অর্থাৎ ‘আবাসন’ নিয়ে কথাবার্তা হবে এই আলোচনাচক্রে ৷
একটু এগিয়ে জনৈক ইরানি তরুণকে পাকড়াও করতেই সে কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে ভাঙা ইংরিজিতে বলল-‘ও, আপনি চউধারি, আপনার ব্যবস্থা হয়েছে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে, ওই লিমুজিন নিয়ে চলে যান ৷’ আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, নামের তালিকায় ‘চৌধুরির’ আগে ‘এ’ নেই, আছে ‘বি ডি এন’ ৷ আমার সন্দেহ হল, কিন্তু ভদ্রলোক আমাকে ঠেলে পাঠাবেই ৷ যত বলি আমার নাম এ চৌধুরি, ভদ্রলোক ততই বলেন-দ্যাটস অল রাইট দ্যাটস অল রাইট ৷ কিন্তু আমার সংশয় যায় না ৷ গাইডটি যে আমাকে বি ডি নাগ চৌধুরী ভেবেছে, তাতে ভুল নেই ৷ তাছাড়া ওরা না জানে ইংরিজি, আমি না জানি ফার্সি ৷ কাঁহাতক আর হাত নেড়ে তর্ক করা যায় ৷
অগত্যা লিমুজিন চেপে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে হাজির, পেল্লাই হোটেল ৷ তেহরানের সেরা ৷ যেমন হাঁকডাক, তেমনই জাঁকজমক ৷ এখানে থিতু হলে থাকতেই লাগবে রোজ আটচল্লিশ মার্কিন ডলার ৷ আর আমি ইউ এন কর্তাদের কাছে পাব রোজ সাঁইত্রিশ ডলার ৷ কর্তাদের তো পাত্তাই নেই ৷ ভয়ে ভয়ে হোটেলে ঢুকলুম ৷ আমার জন্য আলাদা একটি ঘরেরও ব্যবস্থা হয়ে গেল ৷ কিন্তু সইসাবুদ করেও আমি ঘরে যাই না ৷ লাউঞ্জে বসে এদিক ওদিক তাকাই, আর ফোন করার চেষ্টা করি নিমন্ত্রণকর্তা কাউকে, কিন্তু টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে নম্বর বের করা কি সোজা কাজ -সব যে ফার্সিতে লেখা ৷
রিসেপশন কাউন্টারে ইংরিজি জানা একজনের সঙ্গে ভাব জমালুম ৷ মাই ডিয়ার লোক, কিন্তু আমি যত বলি, আমাকে বরাদ্দ ঘরের রোজ ভাড়া কত, ততই সে জানতে চায় ভারতে ‘ব্রাহ্মণ’ কাদের বলে? বললুম, তোমাদের পূর্বপুরুষদের ৷ এই ইরান থেকে যেসব আগন্তুক ভারতে গিয়ে আস্তানা গাড়ে, ভাষাও অনেকটা নিয়ে যায়, তারাই নিজেদের উঁচু জাত বলে মনে করত নিজেকে ‘ব্রাহ্মণ’ বলে পরিচয় দিত ৷ উত্তর ভারতীয়র ভাষা ইন্দো-ইরানিয়ান গ্রুপের ৷
সে যাক গে, ওদিকে আমি যে টাকার দুঃখে মরি ৷ আমি পাব কুললে সাঁইত্রিশ ডলার, তাই দিয়ে থাকা খাওয়া ঘোরাফেরা সব কিছু ৷ এই হোটেলে থাকতে হলে কমসে কম ষাট ডলার চাই ৷ আমি রিসেপশন কাউন্টারের সেই ভদ্রলোককে সব কথা খুলে বললুম ৷ সে বললে, ‘আর, কোথায় যাবে ৷ এই নাও চাবি, তোমার জন্য আটতলার এই ঘরটি বরাদ্দ করলুম ৷ অনেক সস্তা, আর শোনো, রাতে তোমার ঘরে খুবসুরৎ মেয়ে পাঠিয়ে দেব ৷ বিউটিফুল গার্লস! ওই যে লাউঞ্জের কোণে কফি পার্লার দেখছ, সেখানে সন্ধেবেলা যে-কটি মেয়ে এসে বসে সবাই হোটেল-অতিথিদের সন্ধ্যা-সঙ্গিনী হতে চায়, তোমার জন্য একটা পাঠিয়ে দেব ৷’
মাথা খারাপ! আমি মরছি ডলারের চিন্তায়, আর উনি দেখাচ্ছেন মেয়েমানুষ ৷ কিন্তু এদিকে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায় ৷ ইনফরমেশন বিভাগের কেউ জানে না ইংরিজি, আমি জানি না ফার্সি, কথা আর এগোয় না, শেষমেষ ‘রেগেমেগে’ স্যুটকেস হাতে ঢুকে পড়লুম আটতলার সেই ঘরে ৷ চমৎকার ঘর ৷ জানলা দিয়ে তেহরান শহরটা দেখা যায় ৷ কী চমৎকারই না লাগছিল ৷ স্নান করলুম, জামাকাপড় পাল্টালুম, ছেলেকে একখানি চিঠি লিখলুম এবং তারপর ফিটফাট সেজে আবার নামলুম নিচে, রিসেপশন কাউন্টারে ৷
কিঞ্চিৎ ইংরিজি-জানা সেই ভদ্রলোককে বললুম, ভাইরে, ফোনে হ্যাবিটাটের কাউকে ধরে দিন ৷ তিনি তখনও রঙ্গরসে ভরপুর ৷ বললেন, ‘দূর, কোথায় যাবে, তোমাকে আরও পাঁচ ডলার কনসেশন করে দিচ্ছি, এখানেই রাত কাটাও-‘বিউটিফুল নাইট, বিউটিফুল গার্লস ৷’
নিকুচি করেছে বিউটিফুল গার্লস, হঠাৎ মাথায় এক বুদ্ধি এল, আমার কাছে ইউনাইটেড নেশনস থেকে পাঠানো নিমন্ত্রণপত্র রয়েছে ৷ দেখি তো, তাতে ফোন নম্বর আছে কিনা, ঠিক তাই-আছে, আছে আছে-হ্যাবিটাট কনফারেন্সের পি আর ও-র নাম ও তেহরানের ফোন নম্বর আছে ৷ এবং কী বরাত আমার, শেষমেষ তাঁকে হিলটন হোটেলে পেয়ে গেলুম ৷ ওপার থেকে তাঁর মার্কিনি গলা-মিস্টার চৌধুরি, হোয়্যার আর ইউ? আপনার জন্য হোটেল কমোডোরে ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওখান থেকেই বলছেন তো?
আমি আমার অসহায় অবস্থা জানাতেই তিনি চিৎকার পাড়লেন-ননসেন্স! দ্যাট ইরানিয়ান ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট ইজ রিয়েলি ওয়ার্থলেস ৷ প্লিজ মুভ টু হোটেল কমোডোর, দ্য রুম ইন ইন্টারকন্টিনেন্টাল ইজ বুকড ফর মিস্টার নাগচৌধুরী ৷ হি ইজ কামিং বাই টুমোরোজ ফ্লাইট ৷ ও কে-বাই বাই ৷’
ব্যস, আমাকে আর পায় কে ৷ রিসিভার রেখে উঠে গেলাম আটতলার সেই ঘরে ৷ সেখান থেকে মালপত্র নামিয়ে এনে কাউন্টারে বললুম-ভাইরে, তোমাদের ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের জন্য আমার এই ফ্যাসাদ ৷ এবার আমাকে বাঁচাও ৷ আমি তো আধঘণ্টাটাক হোটেলের ঘরে ছিলুম ৷ কোনও চার্জ টার্জ করো না ৷ আর হোটেল কমোডোরে কী করে যেতে হয়, তার রাস্তাটা বাৎলে দাও ৷
ভদ্রলোক, সত্যি ভদ্রলোক ৷ সদাশয় ব্যক্তি ৷ তাঁর ওপরওয়ালার সঙ্গে ফার্সিতে কী সব কথাবার্তা বলে আমাকে ওই টাকার দায় থেকে রেহাই দিলেন এবং হোটেল কমোডোরের ঠিকানা দিলেন ৷ ভাঙা ইংরিজিতে জানালেন, আমাকে যেতে হবে তখৎ-ই-জামসিদ অ্যাভেনিউয়ে ৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হলুদ রঙের ট্যাক্সি দেখতে পেলেই হাত দেখাবেন, তুলে নিয়ে যাবে ৷
তাই হল, আমি শত কোটি সালাম জানিয়ে স্যুটকেস হাতে সোজা বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালুম এবং একটি হলুদ ট্যাক্সি ধরে চলে এলুম সোজা হোটেল কমোডোরে ৷ ফোর স্টার হোটেল ৷ সেখানে এক ঘরে ঠাঁই হয়েছে আমার আর ব্যাংককের প্রতিনিধি অনুস্মরণ নামে এক থাই যুবকের ৷ বাঁচলুম ৷
তেহরান ইদানীং নিউ ইয়র্ক, টোকিওকে টেক্কা দিয়েছে ৷ আমাদের দৈনিক বরাদ্দ নিউ ইয়র্কের হিসেবে ৷ তেহরান নিউ ইয়র্কের বাড়া, তা ছাড়া জিনিসপত্রের দামও বাড়া ৷ আর শহর? তুলনা নেই ৷ আমার আজ কাজ নেই তেমন ৷ তাই লাগোয়া এক ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ভেড়ার মাংসের ঝোল আর ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়লুম রাস্তায় ৷ চমৎকার রাস্তা ৷ এবং এত বিশাল রাস্তা ৷ রাজপথ না বলে বলা উচিত মহারাজপথ ৷ নাকি শাহী রাস্তা?
রাস্তায় আমার সঙ্গী অনুস্মরণ ৷ দেখি প্রথমে দোকানের সারি, আলো ছাড়াই ঝলমল করছে ৷ পসরা আর সুন্দরী তরুণীদের জন্য ৷ দোকানের গায়ে ফুটপাত ৷ তারপর গাছের সারি ৷ গায়ে লাগা জলের ধারা ৷ সরু নালা বয়ে চলে যাচ্ছে ৷ আবার গাছের সারি ৷ আবার ফুটপাত ৷ আবার গাছের সারি ৷ তারপর দশ লেনের বিরাট ঝকঝকে বড় রাস্তা ৷ অন্যদিকেও সেই একইভাবে ৷ দোকান-পাট, ফুটপাত, গাছ নালা গাছ ফুটপাত আর গাছ ইত্যাদি ৷ নিউ ইয়র্ক ওয়াশিংটন, প্যারিস বার্লিন লন্ডন রোম আগে দেখেছি, কিন্তু এমন নয়ন মনোহর রাস্তা আর কোথাও দেখিনি ৷
ঘুরতে ঘুরতে যাই তেহরান জাদুঘরে ৷ শাহ বাড়ির মণিমাণিক্য দেখে আমার চোখ ঝলসাল, টাওয়ার অব লন্ডনে যেমন বার্কিংহাম প্যালেসের সব রত্ন থাকে সাজানো, তেমনই এই জাদুঘরে ইরানি বাদশাহের যাবতীয় ধনরত্ন সাজানো রয়েছে ৷ লন্ডনে যেমন কোহিনূর দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তেমনই তেহরানের এই জাদুঘরে নয়ন সার্থক করলুম ময়ূর সিংহাসন দেখে ৷ নাদির শাহর ভারত থেকে লুঠ করে আনা এই রত্নখচিত অপরূপ সিংহাসনটি ঝলমল করছে একটা উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর ৷ আমার সঙ্গী ছিল সৈয়দ মুজতবা আলির ভাইপো সৈয়দ মুস্তাফা আলি, যার ডাকনাম খসরু, ‘খসরু বাবাজীবনকে’ লেখা মুজতবা আলির একটি দীর্ঘ কবিতা পড়ে আনন্দ পেয়েছিলাম, এবার তার সঙ্গ পেয়ে আরও ভালো লাগল ৷ চমৎকার ভদ্রলোক ৷ সে ছিল ম্যানিলায় প্রেস ফাউন্ডেশন অব এশিয়ার বড় কর্তা ৷ বছর কয়েক হল সে আর আমাদের মধ্যে নেই ৷ আমার সঙ্গী সেদিন আরেকজন ছিলেন ৷ তিনি হলেন রাওয়ালপিন্ডির ‘ডন’ কাগজের চিফ মনসুরি ৷ তিনি আমার বয়সী ৷ আগে ছিলেন জাকির হোসেন প্রতিষ্ঠিত জামিয়া মিলিয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ৷ কী চমৎকার বন্ধু-বৎসল লোক ৷ পাকিস্তান থেকে এসেছেন আরও দুজন ৷ অতি সজ্জন ওঁরা ৷ বাংলাদেশ থেকে তিনজন ৷ তাছাড়া পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আরও অনেকে ৷ দিল্লি থেকে এসেছেন আরও একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি-অধ্যাপক আশিস বসু; শিলচরের বিখ্যাত চন্দ-ভ্রাতাদের ভাগ্নে ৷ আমি তাঁর বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ ৷ বেস্ট স্পিকার ৷ আর ভালো লাগল জোসো কেনিয়াট্টার জামাই, কেনিয়ার দলনেতার-নামটা ভুলে গেছি-বক্তৃতা ৷
আরেকটি জায়গায় গিয়েছিলাম বেড়াতে ৷ তোরণের পর তোরণ সেখানে ৷ লিফট দিয়ে তরতর ওপরে ওঠা যায় ৷ সেখানে-সেই বিরাট প্রদর্শশালায়-ইরানের রাজবংশের কীর্তিকাহিনী চলচ্চিত্রায়িত ৷ সাইরাস ও দারায়ুস থেকে বর্তমান আর্যমিহির শাহেন শাহ পর্যন্ত ৷ আশ্চর্য, প্রাচীন পারস সাম্রাজ্যের সঙ্গে বর্তমান অধীশ্বরের কী সম্পর্ক ৷ সাধারণ এক সেনার পুত্র, দৈবক্রমে বর্তমানে রাজা, অথচ দেখানো হয়েছে প্রাচীন পারস সাম্রাজ্যের রাজা বাদশাহের সঙ্গে বর্তমান শাহ-র নাড়ির সম্পর্ক, ইতিহাসের বিকৃতি আর কাকে বলে!
বিদেশে গেলেই আমার গণ্ডগোল বাধে খাওয়াদাওয়া নিয়ে ৷ আগেই বলেছি, তেহরানে সে গণ্ডগোল নেই ৷ গরম ভাত, ভেড়ার মাংস আর চাটনি-আর কী চাই ৷ আর ইরানের হাউজিং মিনিস্টার যেদিন পার্টি দিলেন, সেদিন মেনু দেখে আমি মূর্ছা যাই আর কী, আমাদের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত রাম শাঠেও শামিয়ানা টাঙিয়ে উত্তম একটি পার্টি দিয়েছিলেন ৷
তবে আমি বিপদে পড়েছিলাম হিলটন হোটেলে, কলম্বিয়ার কৃষিমন্ত্রী মিঃ পেনেলোজার লাঞ্চ পার্টিতে ৷ চমৎকার পানাহারের ব্যবস্থা-বেস্ট ওয়াইন, বেস্ট ফুড ৷ খেতে খেতে আমার ছোট বাথরুম পেল, আমি ছুটলাম লাগোয়া বাথরুমে ৷ কাজ সেরে বেরোতে যাব, কিন্তু ভীষণ বিপদ, দরজা আর খোলে না ৷ এটা টিপি, ওটা টানি, কিন্তু দরজা নড়েও না, চড়েও না ৷ কী করি ৷ দরজার খিল কোনটা? উঁহু, কিছুতেই খোলে না ৷ ইয়া আল্লা ৷ আমি কি এই বাথরুম বা রেস্টরুমে বন্দী অবস্থাতেই প্রাণত্যাগ করব? আমার কালঘাম বেরোতে লাগল ৷ সেকেন্ড যায়, মিনিট যায়, আমি তাহলে আর বেরোতে পারব না এই বন্ধকূপ থেকে? এই ‘বন্ধকূপ হত্যা’র জন্য আমি নিজেই তাহলে দায়ী থাকব ৷ শেষমেশ দরজার খিল ছেড়ে আমি কমোডের ওপর উঠে ছোট্ট জানলা দিয়ে বেরোবার চেষ্টা করলাম ৷ ওমা জানলার বাইরে টুকরো টুকরো কাচের ছড়াছড়ি ৷ না, ওখান দিয়ে লাফাতে পারব না ৷ কী করি-চিৎকার পাড়লেও বাইরে থেকে কেউ শুনবে না ৷ যদি অন্য কেউ এই ছোট্ট ঘরে আসার তাগিদ অনুভব করে, তাহলে বেঁচে যেতেও পারি ৷ শেষমেশ মরিয়া হয়ে আবার ছিটকিনিতে জোরে টান দিলাম এবং কী আশ্চর্য, দরজা এবার খুলে গেল, আমি তাহলে বেঁচে গেলাম ৷ বেরোলাম ৷ এই দশ মিনিট মনে হল দশঘণ্টা, নাকি দশদিন ৷ বেরিয়ে কাউকে কিছু বললাম না, আবার শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলাম ৷
তেহরান থেকে কাবুল ৷ দেখলাম সৈয়দ মুজতবা আলির ‘দেশে বিদেশে’ পড়া বিখ্যাত বাজার ৷ দেখলাম বাবরের সমাধি এবং আধঘণ্টার প্লেন জার্নিতে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি-যা আজ আর নেই ৷ কিন্তু সে অন্য কাহিনী ৷ কাবুল থেকে দিল্লি ৷ দিল্লি থেকে কলকাতা ৷ আবার সেই পরিচিত পরিবেশ ৷ আঃ, কী আরাম!
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন