অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
এবার কোথায় বেরোচ্ছেন? মলদভা ৷ কোথায়? আরে আমিই কি জানতাম যাওয়ার আগে! পূর্ব ইউরোপের একটি ছোট্ট দেশ ৷ সোভিয়েত ব্লক ভেঙে যাওয়ায় অধুনা স্বাধীন ৷ এক অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমস্যার সমাধান খুঁজে ফিরছে ৷ জাতীয় কমিশন ও ইউনেস্কো হাত মিলিয়ে একটি কর্মচক্রের আয়োজন করেছে উচ্চ শিক্ষা ও টেকনোলজি একসঙ্গে মিলিয়ে কাজ করে ব্যূহ ভেদের কোনও পথ খুঁজে পেতে পারে কি না ৷ সে দায়িত্ব পড়েছে ইউনেস্কোতে কর্মরত আমার স্বামী শ্রীযুক্ত সান্যালের ওপর ৷ আমি সঙ্গ নিলাম যথারীতি ৷
বেরোবার আগের দিন ইউনেস্কোর এক বন্ধু বললেন, ‘কিশিনো-আরে ও তো ধুরধুরে গ্রাম ৷ ওখানে তুমি একা একা কী করবে?’ সঙ্গী বলছেন, আর কিছু না হোক কয়েকদিনের বিশ্রাম তো হবেই ৷ কিছুই দেখার না থাকলে বই পড়ে কাটানো যাবে ভেবে বেশ কিছু বই নিয়ে চলেছি এয়ার ফ্রান্স বিমানে বুদাপেস্ট ৷ সেখানে বিমান বদল করে রাজধানী কিশিনো যেতে লাগবে তিন ঘণ্টা ৷ বুদাপেস্টে বসে আছি অপেক্ষায় ৷ সংযোগ বিমানটি পাব কিনা আসবার পথে এই নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিল ৷ এখন অনন্ত অপেক্ষা ৷ ইতালি থেকে উড়োজাহাজ এলে তবে যাওয়া যাবে মলদভা ৷ সন্ধে ঘনিয়ে আসছে ৷ পাশের কিশোর স্প্যানিশ ছেলেটি তার মোবাইল ফোনে একবার মা কখনও বালিকা বন্ধুর সঙ্গে বকবক করে চলেছে ৷ অধৈর্য অপেক্ষা ৷ শুধু একটি শিশুর কর্মতৎপরতা দেখে মুগ্ধ হয়ে সময় কাটানো ৷ সিঁড়ি দিয়ে তার অহরহ ওঠানামা, বেবি চেয়ার ঠেলে কতবার পার হয়ে যাচ্ছে প্রতীক্ষালয়ের সীমারেখা, যেন পৃথিবীটা ওইটুকু জায়গায় থেমে আছে আর সে ছুটছে হাতের মুঠোয় তাকে ধরবে বলে ৷ অনেকটা সময় কাটল ওকে দেখে ৷
অবশেষে ছোট্ট নীল রঙের মলদভিয়ান বিমান ৷ তিরিশজন বসতে পারে ৷ বুদাপেস্টের বিমানবন্দরের পেল্লাই উড়োজাহাজের মাঝখানে দাঁড়ানো খুদে বিমানটিতে উঠলাম ৷ প্রপেলারের গর্জন কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে ৷ কাটা স্লাভ মুখের বিমানসুন্দরী নিরাপত্তা নিয়ে যা যা করতে বলছেন-ভয় হচ্ছে পৌঁছব তো! দিগন্তে সূর্য ডুবছে ৷ ট্রেতে রকমারি ওয়াইন, আপেলরস, স্যান্ডউইচ ৷ নিচে অন্ধকার ৷ কিছুক্ষণ পর আলোর বিন্দুরেখা, স্বল্প আলোর ঝলকানি, এয়ারপোর্ট ৷ খুব সাধারণ, তবে পরিচ্ছন্ন ৷ প্লেন থেকে জাঁদরেল চেহারার দুজন সিকিউরিটি অফিসার এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে নিয়ে এল গাড়ি করে ৷ চিন্তা করছিলাম দেশটায় নিরাপত্তার অভাব নেই তো! অপেক্ষা করে ছিলেন দুজন সজ্জন মানুষ ৷ শ্রীযুক্ত চিয়োবানা ও রুসনা ৷ দুজনেই জাতীয় শিক্ষা পরিষদের কর্ণধার ৷ ন্যাশনাল কমিশনে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি ৷ ওঁদের বলিষ্ঠ হাতের করমর্দন ও সহজ ব্যবহার আমাদের খানিকটা আশ্বস্ত করল ৷
কনস্তানতিন রুসনার মার্সিডিজ গাড়ি চলেছে শহর কেটে ৷ রাস্তা বেশ চওড়া ও পরিচ্ছন্ন ৷ দুধারে সাজানো বাড়িগুলি বনেদি আভিজাত্যে দাঁড়ানো, মলিন ছাপ পড়েছে সংস্কারের অভাবে ৷ পথের দুধারে পপলারের সারি ৷ সুন্দর সবুজ পার্কের কাছে নতুন ঝকঝকে বহুতলার উঁচু হোটেল ৷ আমাদের ঘর দশতলায় ৷ ভাড়া ১৭০ ডলার ৷ দেশে নতুন ইকনমির ঢেউ ৷ ডলার প্রভুর দাপট ৷ এরকম ভাড়ায় তিন তারা হোটেলে থাকা যায় ৷ ঘর বেশ ছোট ৷ চান করার সময় প্রায়ই গরম জল আসে না ৷ শাওয়ারের নিচে যেতে হলে উঁচু একটা কাটা দেওয়ালের ধাপ পেরিয়ে যেতে হয়-প্রতি মুহূর্তে পতনের সম্ভাবনা ৷ তবে সকালে খাবারের টেবিলে গেলে মন ভালো হয়ে যায় ৷ গ্রাম থেকে আনা টাটকা স্যালাড, পনির, চাইলেই ডিমের হরেকরকম রান্না আর ফলের বাহার ৷ এখানকার জমি খুব উর্বর ৷ সার ব্যবহার করে না বললেই চলে ৷ ফলে খাবারের স্বাদই আলাদা ৷
সকাল দশটায় এল আদ্রিয়ানা ৷ কুড়ি বছরের তরুণী, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা নিয়ে কাজ করছে ৷ খুব ভালো ইংরিজি বলে ৷ ও আমাকে সাহচর্য দেবে এ কদিন ৷ একটু পরে আরেক সুন্দরী হাজির ৷ লিলিয়ান, গভীর নীল চোখের মেয়েটি ইউনেস্কোর হয়ে এখন কাজ করছে ৷ পড়াশোনা ফরাসি সাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক কাজ ৷ কবিতার মুক্ত আঙ্গিক ওর বিষয় ৷ দুই সঙ্গিনীর সঙ্গে দুই ভাষায় কথা বলতে বলতে চললাম হোটেলের সামনে সন্ত স্তেফান পার্কের দিকে ৷ জাতীয় কমিশন থেকে গাড়ি দিয়েছে ৷ অতএব শহর চষে ঘুরে বেড়ানো যাবে ৷ এই পার্কটি শহরের কেন্দ্রবিন্দু বললে অত্যুক্তি হবে না ৷ সবুজের সমারোহ ৷ রোদ চড়া ৷ বেশ গরম ৷ পপলারের সারির নিচে বনপথের দুধারে এদেশের লেখক, কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সঙ্গীতকার, নৃত্যশিল্পীদের আবক্ষ শ্বেতপাথরের মূর্তি সমীহ জাগায় ৷ দেশের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকিয়ে, এই প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে তাঁরা কি দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলবেন কপালে? ভাসিল আলেকসান্দ্রেই, মির্চা ইলিয়াদ, মিহাই এমিনেস্কু, ইওজেন ইউনেস্কো, গায়িকা মারিয়া বিয়েসু, ব্যালে নৃত্যশিল্পী মারিয়া সিবুতারি-আরও অনেক ইতিহাস পরিচিত মুখ ৷ পার্ক কেটে রাস্তা এসে পৌঁছেছে সন্ত স্তেফানের মূর্তির কাছে ৷ উঁচু মিনারের ওপর দাঁড়ানো শ্বেতশ্মশ্রু ঋষি লক্ষ রাখছেন দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে ৷ তাঁর নামেই চওড়া রাস্তা চলে গেছে প্যারিসের আর্ক দ্য ত্রিয়ম্ভের মিনি সংস্করণের দিকে ৷ সন্ত স্তেফান খুব জনপ্রিয়, জানাল দুজন সঙ্গিনী ৷ বিয়ের ঠিক আগে দম্পতিরা আসে আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে এখানে-রেখে যায় মিনারের নিচে ফুলের গোছা ৷ তোমরা রাখবে নাকি বিয়ে করলে? কলকণ্ঠে বলে উঠল, ‘নিশ্চয় অবশ্যই’ ৷ খুব চওড়া রাস্তা ধরে হাঁটছি আর ওদের মুখে শুনছি দেশটির জটিল ইতিহাস ৷ নাম বদলই কতবার ৷ আজকের মলদভা বা মলদভিয়া ১৯৪০ পর্যন্ত বেসারাবিয়া নামে পরিচিত ছিল ৷ দক্ষিণে ব্ল্যাক সি থেকে উত্তরে রুমানিয়ার প্রাক্তন প্রদেশ বুকোভিনা, পশ্চিমে সিরেট নদী আর পুবে নেস্টার নদী অবধি দেশটি ছড়ানো ছিল ৷ পনেরো শতকে তৈরি এই দেশে বারবার বিদেশি শক্তি হানা দিয়েছে ৷ ষোড়শ শতকে তুর্কি শাসন ৷ ১৮১২ থেকে ১৮৫৬ রাশিয়ান প্রভুদের হাতে দেশ ৷ নতুন নাম বেসারাবিয়া ৷ ১৮৭৮ সাল থেকে রুশি সাম্রাজ্যের প্রভুত্ব ৷ কিছু সময়ের জন্য চলে যায় রুমানিয়ার হাতে ৷ পরে নতুন গড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার হৃত রাজ্য দখল করার জন্য উঠে পড়ে লাগল ৷ দেশে রক্ত ঝরেছে অনেকবার, বিদেশি আক্রমণে, গৃহযুদ্ধে ৷ ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ছিল সোভিয়েতের প্রত্যন্ত প্রদেশ ৷ ১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট সরকার পাল্টে গেলে স্বাধীন মলদভা প্রজাতন্ত্র গড়ে উঠল ৷ দেশটার সংস্কৃতি, রুচি, সঙ্গীত, শিল্প, ভাষা এমনকী জীবনধারাতেও ইতিহাসের এইসব পরিবর্তনের ছাপ থেকে গেছে ৷ রাগে-অনুরাগে, ভালোবাসা-ঘৃণায়, পছন্দে-অপছন্দে দেশটির চরিত্রে ছাপ রাখছে কখনও রুমানিয়া কখনও রাশিয়া বা তুর্কি দেশও ৷
পার্কের ভেতর দিয়ে ফিরছি ৷ ফোয়ারা থেকে ওঠা জলের ধারায় সূর্যের আলো রামধনু রং এঁকে দিচ্ছে ৷ ফোয়ারা ঘিরে মানুষের ভিড় ৷ রাশিয়ার কবি পুশকিনের দ্বিশতবার্ষিক জন্মদিন ৷ পার্কের নাম পুশকিন পার্ক ৷ অনেকের হাতে ফুলের তোড়া ৷ কেউ আবার পার্ক থেকেই তুলেছে জুঁইয়ের লতা ৷ রোদ চড়া ৷ পুশকিন উৎসবে আমার সঙ্গিনীদের তেমন উৎসাহ দেখছি না ৷ রাশিয়ানদের ওপর রাগ বেশ ৷ ওই দেশ মলদভার সংস্কৃতি, ভাষা, লোকগাথা মুছে দিতে চেয়েছিল ৷ লিলিয়ান স্কুলে অনেকদিন পর্যন্ত ব্যবহার করেছে রুশি অভিধান ৷ দেশের সরকারি ভাষা এখন রুমানিয়ান ৷ এই পুশকিন উৎসব ওদের কথায় রাশিয়ানরা টাকা দিয়ে করাচ্ছে ৷ রংবাহারি পোশাকে যারা নাচছে তাদের ছবি তুলতে যাব, আদ্রিয়ানা আঙুল ছুঁয়ে বলল ফিসফিস করে, ‘ও মেয়েটি রাশিয়ান পোশাকে সেজেছে, সে ছবি তুলে কী হবে!’ মলদভার কস্টিউমে সাজা মেয়েটির ছবি জেদ করে তোলাল ৷ একটি কিশোরী মেয়ে পরিচ্ছন্ন গলায় উঁচু তারে পুশকিনের কবিতা আবৃত্তি করছে ৷ পার্ক পেরিয়ে তার সুরেলা গলা বাতাসে ভেসে গেল ৷ ঊনবিংশ শতকে রাশিয়ান জার প্রথম আলেকজান্ডার স্বাধীনচেতা কবিকে নির্বাসন দিলেন দেশের প্রত্যন্ত প্রদেশ মলদভায় ৷ ১৮২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি কিশিনো এলেন ৷ ক্ষোভ করে লিখেছিলেন, ‘তিনটি দীর্ঘ বছর কাটবে এই সংস্কৃতিশূন্য দেশে যা মরুভূমির মতো আমার কাছে ৷’ Eugene onegin বইয়ে লিখেছেন-
শহরের কঠিন মুঠি ছাড়িয়ে
তীক্ষ্ম বাস্তব পেরিয়ে
দূর দেশ মলদভা এক দুঃখী দেশ
তাঁবুর মতো বাড়িতে বেদুইনের মতো থাকা
বন্য ভালোবাসা ভুলিয়েছে ঈশ্বরের ভাষা
গেয়ে উঠতে হবে তরাইয়ের গান ৷
মস্কোর বিলাস আড়ম্বর ছেড়ে এসে পুরনো মলিন শহরে থাকতে তাঁর যে খুব খারাপ লাগত তা লেখায় ফুটে উঠেছে ৷ নানা দেশ থেকে আসা মানুষেরা শহরবাসী ৷ গ্রিক লাল ফেজের সঙ্গে মিশত তুর্কের বাহারি পাগড়ি, মলদভার ভেড়ার চামড়ার লম্বা টুপি ৷ রুশি সরকারি কর্মচারী, গ্রিক বুলগেরিয়ান, ইউক্রেনিয়ান, সার্বিয়ান, আর্মেনিয়ান, তুর্ক, জার্মান, ফরাসি, আলবেনিয়ান, ইতালিয়ান-আশ্চর্য ক্যালিওডোস্কোপের ছবিও পাওয়া যায় একই সঙ্গে লেখায় ৷ প্রেমে পড়েছিলেন কিশিনোর ভেনাস-কুমারী পুলহেরিতার ৷ তাকে নিয়ে কবিতার বই লিখলেন ‘কুমারী ঘুঘুর মতো চোখের কন্যা আমার প্রিয় সখি’ মলদভার জমিদার কন্যা সুন্দরী মারিয়া মারিওলার সঙ্গেও গভীর প্রেম ৷ জিপসি কাব্যগ্রন্থে মারিয়ার কথা এসেছে-‘বারবার ফিসফিস করে বলি সেই নাম মারিওলা মারিয়া মারিয়া’ ৷
সাহিত্যের ছাত্রী লিলিয়ান পার্কের উৎসবমুখর বনপথে চলতে চলতে এ সব কাহিনী যখন শোনাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল দেশটিতে রাশিয়া কত গভীরভাবে সাংস্কৃতিক ছাপ ফেলে গেছে ৷ এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তা মেনে নিতে পারছে না ঠিকই কিন্তু সত্য এড়িয়ে যাবে কী করে!
ওদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছিলাম দেশটা তত ভালো নেই ৷ অর্থাভাব বেশ ৷ বড়লোক আর গরিব, মাঝখানের মধ্যবিত্তরা কোথায় গেল? আদ্রিয়ানার কথায়, ওই প্রায় অদৃশ্য শ্রেণী হলাম আমরা-মধ্যবিত্তরা যাঁরা অধ্যাপনা করে বেতন পান মাসে নয় ডলার ৷ কালোবাজার চলছে জোর কদমে ৷ দ্রুত টাকা রোজগারের এক অশুভ খেলায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ছুটতে পারছেন না ৷ আদ্রিয়ানার সঙ্গে পরদিন সকালে শহর ঘুরতে বেরোলাম পায়ে হেঁটে ৷ গাড়ি নিইনি, শহরটা এত ছোট যে পায়ে হেঁটে ঘোরা যায় ৷ চল বইয়ের দোকানে ৷ রুমানিয়ান ভাষার বইয়ে ভর্তি ৷ রাস্তায় পুরনো বইয়ের পসরা ৷ অবাক লাগে অভাব আছে অথচ পরিচ্ছন্ন চারদিক ৷ রাস্তাঘাটে একটা কুটো পড়ে নেই ৷ মনে হচ্ছে এইমাত্র কেউ ঝাড়ু দিয়ে গেছে ৷ মানুষজনেরা দামি জামাকাপড় পরেনি কিন্তু সকলেরই মোটামুটি ভদ্র পোশাক ৷ দু-তিনজন বৃদ্ধা টুলে বসে ভিক্ষা চাইছেন নিঃশব্দ হাত বাড়ানো প্রার্থনার ভঙ্গি ৷ পথচারীই বেশি ৷ আছে কলকাতার মতো ভিড়ে ছয়লাপ বাস ৷ ছাত্রছাত্রীদের বাসের টিকিট ফ্রি ৷ শিক্ষাদপ্তর থেকে কার্ড দেয় ৷ তাই দিয়ে যেখানে খুশি যাও ৷ আদ্রিয়ানা বলল, চল আমাদের সবসেরা মিষ্টির দোকান দেখাই ৷ আসলে এক পেল্লাই চকোলেটের দোকান ৷ ওকে বললাম, যা পছন্দ তাই কেনো ৷ ছয় লেতে মাঝারি সাইজের চকোলেট কিনে বলল, বড্ড দাম! খুশিতে মুখটি যদিও চকচক করছে ৷ পুরনো বাজারের পথে হাঁটছি, মেয়েটি একটু একটু করে চকোলেটে কামড় দিচ্ছে কী তৃপ্তির সঙ্গে এখনও মনে পড়ে ৷ মা স্কুলে পড়ায় ৷ বেতন মাসিক নয় ডলার ৷ ভাইয়ের সঙ্গে দুশো লে ভাড়া ভাগ করে এক বাড়িতে থাকে ৷ ভাই বিয়ে করছে শীঘ্র ধনী বাড়িওয়ালা মেয়ের সঙ্গে ৷ আদ্রিয়ানা কি করবে তাই নিয়ে আকণ্ঠ দুশ্চিন্তা ৷ মাঝে মধ্যে ইংরিজি কোচিং দেয়, দুঘণ্টায় এক ডলার উপার্জন ৷ বাবা হাতের কাজে পটু ৷ নানা ধরনের কাজ করেন ৷ মাংস খাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না ৷ সব্জি, ফল, রুটিতেই থাকা ৷ গাঁয়ে ঘরে পশু জবাই হলে বাবা গ্রাম থেকে কম দামে কিনে আনে ৷ বাজারের সামনে দিয়ে হাঁটছি ৷ সিমেন্টের চত্বরে খোলা হাট বসেছে ৷ সব পেয়েছির দেশ যেন ৷ কী নেই ৷ দুধারে বাঁধানো বেদিতে শাক সব্জি ফল, জামাকাপড়, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি মনে হচ্ছে পুরনো জিনিস, চিলেকোঠা খালি করে আনা ৷ পাশেই ওজনযন্ত্র মাটিতে রেখে এক বৃদ্ধ এক লের বিনিময়ে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের ওজন দেখে দিচ্ছেন ৷
পরদিন সকালে কনস্তাতিন এলেন গাড়ি নিয়ে আমাদের দলনা দেখাবেন ৷ সঙ্গে চিয়োবানা মহাশয়, লিলিয়ান আছেন ৷ অন্য আরেকটি গাড়িতে তাঁদের কয়েকজন বন্ধু ৷ ১৮২১ সালে পুশকিন আসেন কিশিনো থেকে ষাট-সত্তর কিলোমিটার দূর দলনায় ৷ এই গ্রামে কবির নির্বাসন ভবন দেখতে চলেছি ৷ সুন্দর রাস্তা-দুধারে খেতে সবুজ ফসল, ফলে ভরা গাছ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় ৷ পিকনিকের খাবারদাবার রাস্তা থেকেই কেনা হল ৷ শহর ছাড়তেই পথের দুধারে লাল টুকটুকে টম্যাটো, চেরি, তরমুজের পসরা ৷ আমরা টিলার মাথায় উঠছি ৷ ঘন বন ঘিরে আছে আমাদের ৷ এরা বলে কদ্রি ৷ কদ্রি শুধু বনভূমি নয়-তার থেকে বেশি কিছু ৷ টিলার ওপরে ঘন জঙ্গল, নিচে উপত্যকায় ওক গাছের সারি, মোটা গুঁড়ি ঘিরে বনফুলের স্তবক, আঁকাবাঁকা পথ ডাক দিয়ে যায় আরও গহনে ডুব দেওয়ার ৷ ‘কত কাহিনী ও ইতিহাস এই কদ্রির বুকে লুকানো ৷ উর্বর জমির ফসল; আঙুর খেত, পুরনো গ্রাম আর মানুষের অতুলনীয় আতিথেয়তার জন্য বারবার এই বনে ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়’… চিয়োবানা গভীর ভালোবাসার গলায় বলছিলেন তাঁর ইচ্ছের কথা ৷ শেষ শয্যা যেন হয় এই বনে লুকানো তাঁর ছোট্ট গাঁ ত্রুশেনিতে ৷ একটি পুরনো বাড়ির মরচে ধরা গেটের সামনে গাড়ি থামল ৷ আমাদের অপেক্ষায় ছিল ভেতরের মানুষজন ৷ সুন্দর বাড়ি, ওপরে বারান্দায় ওকের রেলিংয়ে খোদাই কাজ! পুশকিনের অতিথি ভবনটি কিনে নিয়েছেন কনস্তাতিন রুসনারের বন্ধু সার্জ ৷ সে আর তার বৌ চমৎকার ফরাসি বলে, চোদ্দ বছরের কন্যা ডায়ানা কথা বলছিল ঝরঝরে ইংরিজিতে ৷ টেবিল পাতা হল বাগানে ৷ চটপটে হাতে ওরা সাজাল নানা ধরনের পনির, বিশাল বিশাল রুটি, টম্যাটো, টম্যাটোর মতো বড় বড় মুলো, সাদা মাছের মণ্ড আর হরিণের শুকনো মাংস ৷ ঠান্ডা জলের জালায় ডোবানো রুসনার বাগানের আঙুর পিষে নিজে হাতে তৈরি সাদা ওয়াইন আর লাল ক্যাভারনের বোতল খুলে চিজ রুটি মুড়ে হাতে নিয়ে বনভোজনের সূচনা ৷ এরপর আমরা পুশকিনের বাড়ি দেখতে চললাম ৷ ঘাসে পা ডুবে যাচ্ছে ৷ টিলার ওপর উঠছি ৷ পথে শিমুল তুলোর মতো সাদা পেঁজা ফুলের আঁশ পড়ে আছে ৷ পাখির ডাক ছাড়া কোনও শব্দ নেই ৷ রুসনা খুব নিচু গলায় কথা বলে চলেছেন ৷ উচ্চশিক্ষিত মানুষটি সুরকার, বাজান ক্ল্যারিয়নেটে ধ্রুপদী সুর ৷ একটি রেকর্ড বেরিয়েছে, উপহার দিয়েছেন আমাদের ৷ খুব টগবগে মানুষ ৷ ছেলেমেয়ে দুজনেই দেশের নামকরা বেহালাবাদক ৷ একটি নাতনি নয়নের তারা-মার্গারিতা ৷ বৌ ছিলেন লোকনৃত্য শিল্পী ৷ শরীর ভালো নেই তাই আসতে পারলেন না ৷ কোমরে ব্যথা সারাবার জন্য বোলতার কামড় চিকিৎসা করছেন, তার ফলে সাংঘাতিক অ্যালার্জি ৷ এই চিকিৎসার কথা প্রথম কানে এল তাই অবাক বিস্ময়ে পদ্ধতি জানতে চাইলাম ৷ কোমরের বিভিন্ন খাঁজে তিন-চারটি বোলতা বসিয়ে দেওয়া হয় ৷ ওদের হুল ফোটানোতে ব্যথা সারে ৷ এরা অনেক টোটকা চিকিৎসায় বিশ্বাস করে ৷ রুসনার বাবার কোমরে বীটরস ইঞ্জেকশন দিয়ে পিঠের ব্যথা সারানো হয়েছিল শুনলাম ৷ গল্প করতে করতে কবির বাড়ি পৌঁছে গেছি ৷ সামনে দাঁড়ানো ম্যানর হাউস ৷ বারান্দায় এক জিপসি দম্পতি আলু সেদ্ধ করে গোলমরিচ ছড়িয়ে খাচ্ছেন ৷ বারান্দা ভোজন ৷ বাড়িটি এখন মিউজিয়াম ৷ ভেতরে ভ্যাপসা গন্ধ ৷ দেওয়ালে কোঁকড়া চুলে কবির তেল রং ছবি, একটি পুরনো দিনের আসবাব-অর্থাভাবে মিউজিয়াম অবহেলিত ৷ তাই বলে এত দুরবস্থা! বাগানে জুঁই ফুলের সুগন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আছে ৷ কবির মূর্তিটি কালো পাথরে তৈরি ৷ পায়ের কাছে কয়েক গোছা ফুল ৷ ছবি তোলা হল ৷ রুসনা গাছের কচি সবুজ পাতা তুলে ঠোঁটে ছুঁইয়ে বাজাচ্ছেন আশ্চর্য সুর, পুশকিনের কবিতা সুরে, মোৎসার্ট, ভিভালদির চার ঋতু, এমনকী জন লেননের গান-পাতা থেকে এমন সুরের মূর্চ্ছনা ভাবাই যায় না ৷ সুর ওপরে উঠছে কখনও নিচু তারপর এক হারমনিতে মিশে আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে ৷ ফিরে আসছি বনভোজনের মাঠে ৷ সবকিছু ততক্ষণে প্রস্তুত ৷ শূলপক্ক মাংস, পিঁয়াজকলি, ছাগদুগ্ধের পনির, দূরে কাঠের আগুনে আরও মাংস পুড়ছে ৷ কাঁচা সব্জির কী টাটকা স্বাদ ৷ সার্জের পয়সাকড়ি আছে মনে হল ৷ ছিল ডাক্তার ৷ স্বপ্ন ছিল গড়ে তুলবে নিজের হাসপাতাল ৷ স্বাধীন, মুক্ত ও সুখী হবার স্বপ্ন এখন ৷ পুশকিনের অতিথি ভবন কিনেছে জমানো টাকা দিয়ে, একটি বেশ দামি গেস্টহাউস করতে চায় বিদেশি অতিথিদের জন্য ৷ চটজলদি টাকা করার রেসে দৌড় লাগিয়েছে ৷ আদ্রিয়ানার কাছে শুনেছি মাংসের দাম খুব ৷ চার-পাঁচ ডলার কিলো ৷ সবাই খেতে পারে না ৷ এখানে ছড়াছড়ি যাচ্ছে ৷ সার্জ আর আইওয়ানার একমাত্র মেয়ে ডায়ানা পনেরো বছরের কিশোরী ছিপছপে শরীর, নাভি খোলা জামা ৷ প্রাণপ্রাচুর্যে ঝলমল করছে ৷ হঠাৎ আমার কাছে এসে বলল, ‘আই ওয়ান্ট টু হ্যাভ ফান’-আমি প্রশ্ন করলাম, কী ধরনের? ইংরিজি ঝালাবে ৷ বই পড়? এই বয়সে পড়েছে শেক্সপিয়র! জ্যাক লন্ডন খুব প্রিয়, হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি পড়ে কেঁদেছিল ৷ আমি হাভানার রেস্তোরাঁয় ওল্ড ম্যান প্রেগরিওর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের কথা বললাম ৷ গল্প গল্প ৷ ছুটে ওপরের ঘর থেকে কবিতা নিয়ে এসে পড়ল, নিজের লেখা গান গাইল মৃদু গুঞ্জনে, সে গান ভবিষ্যতের মানুষকে নিয়ে ৷ সাফল্য নয়, প্রেম নয়, দুঃখ নয় মানুষকে নিয়ে ওর কবিতা ও গান ৷ আমি বাগানের সীমান্তে একটি নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চিতে বসে দূরের বন, নিচে আঙুর খেতের ফসল অলস চোখে দেখছি এমন সময় দূরে লাল টুকটুকে চেরির গোছা দুহাত ভরে ডায়ানা এগিয়ে আসছে দেখলাম ৷ পাশে চুপ করে বসল ৷ আমরা টকাটক চেরি খাচ্ছি আর কে কত দূর বিচি ছুড়ে ফেলতে পারি তার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছি ৷ খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে ঠোঁট ছুঁচল করে ছুড়ে দিচ্ছে অনেক দূরে ৷ আমরা এবার চলেছি ছোট্ট ঝরনার কাছে ৷ নাম জেমফিরা ৷ গাঁয়ের নাম ভারজারেস্তি ৷ পুশকিনের সময় সেখানে ছিল জিপসি বসতি ৷ ওদের নাচগানে কবি আকৃষ্ট হন, ভালোবাসলেন দলপতি বুলিবাসির মেয়ে জেমফিরাকে ৷ লম্বা চুলের দু বেণী, রঙিন ঘাগরা পরা সুন্দরী পাইপ টানছেন-ছবি দেখে এসেছি পুশকিন মিউজিয়ামে ৷ পুশকিন একমাস জিপসিদের তাঁবুতে ছিলেন জেমফিরার সঙ্গে ৷ গভীর বনে ঝরনার ধারে তাঁদের অভিসারের কথা সকলের মুখে মুখে ৷ ঘাসের ওপর অলস বিশ্রামে বনবালিকার সঙ্গে প্রেম কাহিনীর মতো ৷ হঠাৎ একদিন সুন্দরী উধাও এক তরুণ জিপসি সঙ্গীর হাত ধরে, ফেরার কোনও চিহ্ন না রেখে ৷ আর তার দেখা পাননি কবি ৷ নির্বাসন শেষে ওদেসায় বসে লেখা জিপসি কাব্যগ্রন্থে জেমফিরার কথা আর্তির মতো ফুটিয়ে তুলেছিলেন ৷ ঝরনার জলে হাত ডোবালাম ৷ স্ফটিকের মতো জল কী ঠান্ডা ৷ প্রেমিক প্রেমিকা এই জল পান করতেন নাকি ৷ ভালোবাসার উত্তাপে সবই সম্ভব হয় তো ৷ জেমফিরা ঝরনা, নুড়ির ওপর দিয়ে জিপসি গানের কলির মতো গুনগুন বয়ে যাচ্ছে, দুধারে কদ্রির জঙ্গল ঘন রহস্যে ঘোর ৷ হঠাৎ মেঘ করে এল পুশকিনের নির্বাসন জগতে ৷ ‘এমন নির্বাসনে যেতে অনেকেরই লোভ হবে’-রোমান্টিক গলায় চিয়োবানা বলে উঠলেন ৷ দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টি, ফেরার পালা ৷ আবার গাড়ি ৷ ঘন কালো মেঘ সবুজ উপত্যকার ওপর ঝুলে আছে ৷ পপলার গাছেরা দমকা হাওয়ায় পাতায় ঝালর তুলে যেন বলছে, বিদায় বিদায় ৷ গরুর গলার ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে ৷ দুজন জোয়ান প্রায় গোটা তিরিশেক গরু তাড়িয়ে বাড়ি ফিরছে ৷ রুসনা বললেন, সোভিয়েত আমলে তো সবই সমবায় পদ্ধতিতে চলত এখন গাঁয়ে-ঘরে সকলেরই একটা দুটো গাই গরু আছে ৷ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় কে কোনদিন গোকুল নিয়ে মাঠে যাবে ৷ খাওয়া পরার তো অসুবিধা নেই ৷ এখানকার কালো মাটি এত উর্বর যে প্রবাদ আছে শুকনো চেস্টনাটের ডাল পুঁতে দিলে তিনদিনের মধ্যে কচি পাতার শোভায় গাছ দেখা দেবে ৷ সবই আছে ৷ রাসায়নিক সার না ব্যবহার করা যব, ভুট্টার অকৃপণ ফসল, দুধ, ছানা, ডিম, ফল-অভাব হচ্ছে টাকার ৷ শিক্ষকেরা, সরকারি কর্মচারীরা ঠিকমতো মাসমাইনে পাচ্ছেন না ৷ সোভিয়েত ব্লক ভেঙে যাওয়ার পর যে পরিস্থিতি তার সঙ্গে তাল দিতে পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশের মতো মলদভাতে এ রকম নানা সমস্যা ৷ শুনেছি নিজের কাজ ছাড়াও জীবনধারণের জন্য প্রায় সকলকেই তিন-চারটি কাজ করতে হয় ৷ আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার বুঝতে পারছিলাম, এরা নিজেদের রুমানিয়ান মনে করে ৷ রাশিয়ানদের পছন্দ করে না ৷ সোভিয়েতের মুঠি থেকে বেরিয়ে দেশটা রুমানিয়ার দিকে ঝুঁকছে ৷ কিন্তু রুমানিয়া কতটা দিতে পারবে তা নিয়েও সন্দিগ্ধ ৷ তরুণেরা একটু গোলমালে পড়েছে ৷ একটা ছকে বাঁধা জীবন হঠাৎ উধাও ৷ বুড়োরা বলছেন, আগের আমলটাই ভালো ছিল ৷ এ প্রজন্ম অন্য পথের সন্ধানে ব্রতী ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে খুব জোর দেওয়া হচ্ছে ৷ ইংরিজি শেখার জন্য সকলেই তৎপর ৷ ফরাসিও ৷
এক জার্মান বন্ধুর কাছ থেকে রুসনা চোদ্দ বছর আগে বেশ কম দামে মার্সিডিজ গাড়িটি কিনেছিলেন ৷ এখন যা তেল খায় তা ওর এক মাসের মাইনে ৷ নিজে হাতে বাড়ি তৈরি করেছেন কিশোনোর যত পুরনো বাড়ি ভাঙা পাথর বসিয়ে ৷ ১৯০০ সালের মার্সেইয়ের লাল টালির ছাদ ৷ বাড়িতে ঢোকা হয়নি টাকার অভাবে ৷ ভাড়া দিয়েছেন আমেরিকানদের ৷ নিচতলায় পড়ে আছে তার স্বপ্নের পঞ্চাশ বর্গমিটার ঘর, যেখানে একদিন মিলিত হবে সাহিত্যিক, সুরশিল্পী, কবি-এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, ওদের ভবিষ্যত গড়ে তোলার মানেই তো দেশকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ৷
আজ সকালে কমিশন থেকে লারিসা সাক্ষাৎকার ঠিক করেছে কয়েকজন মহিলার সঙ্গে, তারা কেউ কবি, লেখক, সাংবাদিক ৷ মারি মাগদালেনা কবি ও লেখিকা ৷ কবিতা পড়লেন ৷ কবিতা লেখার সময় স্কেচ করেন আবার ৷ সাংবাদিকদের ভারতবর্ষ নিয়ে নানা প্রশ্ন ৷ আবার প্রাতরাশ ৷ গাড়ি অপেক্ষায় ছিল ৷ আমি, শ্রীযুক্ত রুসনা আর তাঁর যোগ্য সেক্রেটারি লারিসা যাব বার্দার গাঁয়ের একটি স্কুলে ৷ ইউনেস্কোর সহযোগিতায় সেখানে একটি ফরাসি স্কুল তৈরি হয়েছে তা দেখা, ইওজিন ইউনেস্কোর জন্মভূমি দেখা আর সবার ওপর একটি গ্রামের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ৷ পথ থেকে উঠলেন ফরাসি ভাষার অধ্যাপিকা তামারা ৷ সবুজের বন্যা দুধারে ৷ আজও রোদে ঝকমকে দিন ৷ কোথাও গির্জার চূড়া, হ্রদের নীল পেরিয়ে শস্য ভরা উপত্যকা, আঙুর খেত পেরিয়ে অনেকটা পথ এলাম ৷ স্কুলের সামনে কমবয়সী ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছে ৷ একটি যুদ্ধের স্মৃতিমিনার, মাঝখানে দৃপ্ত পুরুষ, একপাশে রমণী ও অন্য দিকে কিশোর পুত্র ৷ সাদা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলাম ৷ একসঙ্গে সকলে বলে উঠল ‘বঁজুর, সুপ্রভাত’ ৷ একটি ঘরে অপেক্ষা করছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা, সামনে রোগা একটি মহিলার বসে থাকার ভঙ্গিটি করুণ কোমল অথচ দৃপ্ত ৷ কথা বলতে গেলে সামনের দাঁতে একটু সোনা ঝিলিক দিচ্ছে ৷ হেলেনের দুই কিশোরী ছাত্রী কী সুন্দর উচ্চারণে ফরাসি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাল ৷ তারপর ওদের নাচগান ৷ হেলেনের মাতৃসমা দৃষ্টি ওদের দিকে ৷ এরপর গেলাম তাদের বসার ঘরে ৷ টেবিলে সাজানো ঘরে তৈরি খাবার, সোনালি ভদকা, সাদা ওয়াইন ৷ গোল হয়ে বসেছি ৷ ভারতীয় ছবি নিয়ে কথা শুরু ৷ অচ্ছুতকন্যা দেখে সেজকিন চোখের জল ফেলেছে জানাল ৷ রাজকাপুর এখনও হৃদয় দখল করে আছে এদের ৷ ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ গান আমরা একসঙ্গে গাইলাম ৷ এরপর মুড়মুড়কি গানের সুর ওদের গলায় অবাক করে দিয়েছিল ৷ ইউনেস্কোর কবিতা এক শিক্ষক গানে গেয়ে উঠলেন ৷ অপেরা গায়কের মতো গলা ৷ এক শিক্ষয়িত্রী গাইলেন ফরাসি গায়িকা এডিথ পিয়াফের বিখ্যাত গান, ‘যখন জড়াও বাহুর আলিঙ্গনে’ ৷ ‘বার্সি সেতুর ওপরে’ ৷ আমি শোনালাম রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘দেশে দেশে মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া’-কবির কাজের সঙ্গে এঁরা পরিচিত ৷
এখানকার মানুষেরা সংবেদনশীল, সাহিত্যপ্রেমী ৷ ওদের ছবিতে দেখা ভারতীয় রমণী ও আমাকে এক করে নিয়ে হেলেন কী সুন্দর বলেন, ছোটবেলায় দেখা আবেগধর্মী ভারতীয় ছবির কথা ৷ পারিবারিক সুখ-দুঃখ, কলহ, সংঘাত নিয়ে ছবি মেলোড্রামাটিক ছিল ঠিকই কিন্তু তার প্রভাব মাসখানেক ধরে ওর মধ্যে থেকে যেত ৷ ‘তোমাকে আমি দেখেছি বোধহয় অন্য এক জীবনে ৷ তোমার জন্য রইল প্রার্থনা ও ভালোবাসা ৷ মনে রেখো, কোনও সন্ধ্যায় আকাশে তাকিয়ে দূর দেশ মলদভার গাঁয়ে কেউ একজন তোমার কথা ভাবছে’ ৷ গাড়ি পর্যন্ত দলটি এগিয়ে এল ৷ বিদায় পর্ব ৷ জানলায় টোকা ৷ আবার হেলেন, সামনের সোনার দাঁতটি ঝলসে উঠল ৷ চোখের নীল নিষ্প্রভ মণিতে একটু আলো ৷ হাত মুঠি করে বিদায় জানাচ্ছে হেলেনের সঙ্গে পুরো গ্রামটাই ৷
পরদিন সকালে রাজধানী থেকে বেশ দূরের বুতুসেনি গাঁয়ে যাব ৷ সেখানে দেখব বিখ্যাত ঐতিহাসিক মধ্যযুগীয় মঠের প্রত্নতাত্বিক স্তূপ-Orheiul Vechi. দনা তাতিয়ানা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ৷ লাল টুকটুকে মুখ, চোখে কাজল আকর্ণ বিস্তৃত ৷ এত রং মাখা মুখ বেশি দেখিনি এখানে ৷ গাড়িতে বিশ বছরের দোভাষিণী রগিদা আর বুখারেস্টের মহিলা আনা কিয়োরতকা ৷ সের্গেই বলিষ্ঠ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে ৷ আপেল অর্চার্ড, আঙুর লতা, যবের খেত পেরিয়ে কদ্রির দিকে চলেছি ৷ মলদভার অনেকটা অংশই বনে ঢাকা ৷ সচরাচর গাছ কাটতে চায় না এরা ৷ সের্গেই বলে, ‘কুঠারের ঘা যেন বুকের পাঁজরে আঘাত’ ৷ তবু কাটা হয় ওক, বার্চ যার চাহিদা দেশের বাইরে ৷ আমরা বুতুসেনি গাঁয়ে ঢুকছি ৷ রাউত ও নিসত্রু নদীর মাঝখানে এ উপত্যকা পাথরের গায়ে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য নিয়ে দাঁড়ানো ৷ প্যালিওলিথিক, এনেওলিথিক (খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক) ভগ্নস্তূপের খনন কাজ চলছে ৷ প্রাগৈতিহাসিক যুগের ধ্বংস চিহ্ন নিয়ে প্রত্নতাত্বিকরা মাথা ঘামাচ্ছেন, আমরা দেখতে চলেছি মধ্যযুগের বুতুসেনি ও বসি খ্রিস্টীয় মঠগুলি ৷ গাড়ি থেকে দেখতে পাচ্ছি দূরে উঁচু টিলা দেওয়ালের মতো দাঁড়ানো, তার গায়ে মৌচাকের মতো বৃত্তাকার ছেঁদা ৷ আরও উঁচুতে পুরনো গির্জার গম্বুজ ৷ ছবি তুলব বলে গাড়ি থেকে নেমে এগোব, সের্গেইয়ের কঠিন মুঠির চাপে থেমে গেলাম ৷ একটি কুচকুচে কালো সাপ পাথরের ফাটল থেকে বেরিয়ে সরসর করে তৃণভূমির দিকে চলে গেল ৷ গাড়ি এবার ক্লান্ত মুখের যিশুর মূর্তি ফটকের গায়ে দাঁড়ানো এক চাষীর বাড়ির সামনে দাঁড়াল ৷ গৃহস্বামিনী সাদা লাল কাজ করা অ্যাপ্রন কোমরে জড়িয়ে আমাদের আপ্যায়ন জানালেন ৷ ভেতরে ঢুকেই কুয়ো ৷ ফলের বাগান, ফুলের বাগান আবার একটু দূরে খেতে চাষবাস হচ্ছে ৷ বাইরে টেবিলে ফুলতোলা জল তুলে পা ধুইয়ে দিল একটি কিশোরী ৷ ওদের রীতি নাকি! আমরা বাড়ির আরেকটি রমণীকে গাইড নিয়ে বেরলাম ৷ জীববিদ্যার অধ্যাপিকা ছিলেন ৷ কোথায় কাজ মিলবে এখন? তাই বাড়ির দেখাশোনা ও ট্যুরিস্টদের গাইড হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন ৷ তিন ছেলেমেয়ের মার সুঠাম শরীর দ্রুত উঠে যাচ্ছে উঁচু পাহাড়ের দিকে ৷ আমরা সন্তর্পণে তাঁকে অনুসরণ করছি ৷ ওপরে প্রাচীন মঠ পাথরের গুহার ভেতরে, তারও ওপরে ক্যাথিড্রাল ৷ পথে ছোট্ট কবরখানা ফুলে ভরে আছে ৷ কাঠের ফলকে ত্রুশবিদ্ধ যিশুর করুণ মুখ ৷ একটি কচি বাছুর এই গরমে খুঁটিতে বাঁধা ৷ করুণ হাম্বা রব, জল তেষ্টা পেয়েছে নিশ্চয় ৷ ওপরে গুহার মুখে লোহার দরজায় তালাচাবি দেওয়া ৷ দূরে নিচ থেকে উঠে আসছে হাতে চাবির গোছা নিয়ে সত্তর বছরের মহিলা ৷ তার ফোলা পায়ের পাতায় ক্লান্তি তবু আমাদের থেকে অনেক দ্রুত চলা দেখে অবাক মানি ৷ দরজা খুলে দিলেন ৷ পাথরের সুড়ঙ্গ ৷ ভেতরে আরামদায়ক ঠান্ডা ৷ এই পথ সোজা চলে গেছে মা মেরির পূজার বেদীর দিকে ৷ ছোট মন্দির ঘিরে গড়ে উঠেছিল যাজকদের মঠ ৷ পাথরের কোণে কোণে ঘরের আড়াল, পাথরের বিছানা ৷ দূর থেকে দেওয়ালে যে মৌচাকের মতো গর্ত দেখেছিলাম তা হল গবাক্ষ ৷ বাইরে পাথরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম ৷ পাহাড়ের দেওয়াল ঘিরে বয়ে যাচ্ছে রাউত নদী ৷ দুয়েকজন চাষী মাঠে লাঙল চষছে ৷ জিপসি মেয়েরা নিচু হয়ে ফসল পুঁতছে ৷ মনে হচ্ছিল বর্তমান সময় পেরিয়ে মধ্যযুগে চলে গেছি ৷ ভেড়ার চামড়ার টুপিতে মাথা ঢেকে আলখাল্লা পরা যাজকেরা মন্ত্রপাঠ করতে করতে যেন চক্রাকারে ঘুরে চলেছে মঠের সুড়ঙ্গ পথে ৷
গ্রামে ফিরে আসছি ৷ বাড়িগুলো সব পাথরে তৈরি ৷ বাড়িতেই ঢেলেছে যত ভালোবাসা ৷ দেওয়ালে রঙিন সেরামিকের কাজ-নীল, সবুজ, হলুদ, লাল, ফুল লতাপাতা, খ্রিস্টের মুখ, চাঁদ, সূর্য খোদাইয়ে ৷ প্রতিটি বাড়ির গায়ে রঙের আলপনা ৷ দরজা খুলে যাচ্ছে ৷ উৎসুক গ্রামীণ মুখের অভিবাদন, সমাদরের হাত নাড়া-কুয়োর ধারে গল্পগুজব করছে কয়েকজন ৷ একটি কিশোরী জল নিতে এসেছে ৷ সামনেই ওর বাগান ঘেরা বাড়িতে কী রঙের বাহার ৷ বাবা ঘোড়া টানা গাড়িতে খেত থেকে কাটা শস্যের বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন মধ্যাহ্নভোজনের জন্য ৷ কিশোরী স্কুলে যায়, কচি হাতে খেতে-বাড়িতে বাবা মাকে সাহায্য করে ৷
আমরা ফিরে এলাম চাষী বাড়িতে ৷ ততক্ষণে খাবারদাবার সাজানো হয়ে গেছে ৷ বাগানের শশা, টম্যাটো, সদ্য তৈরি রুটির গোছা, পিঁয়াজকলি সসেজ কত রকমের! ঘরে তৈরি মাংসের পুর দেওয়া পরটা-প্লাচিনতা, সারমালে-ভাত আর মাংস দিয়ে বাঁধাকপির পাতা সাজিয়ে রান্না, মামালিগা-কর্নফ্লাওয়ার পরিজ আর সোনালি রঙের বাড়িতে তৈরি ওয়াইন ৷ খাবারের স্বাদ জিভে লেগে আছে ৷ কড়া কফি, চড়া রোদ, আলসেমিতে ঢুলে পড়ব, দেখি লোকসংগীতের একটি দল বাহারি জামাকাপড়ে সেজে কুয়োতলা দিয়ে এগিয়ে আসছে ৷ দনা তাতিয়ানা ব্যবস্থা করেছেন ৷ লাইয়াতুরের দল ৷ অনেকটা আমাদের দেশের বাউলের মতো ৷ হাতে কোবজাটি যেন একতারা ৷ হাত ছোঁয়াল কি ছোঁয়াল না-কান্নার মতো বাজল সুর আর গান-‘মানোলে মানোলে, মাইমেপ মানোলে-’ লাইয়াতুর গাইল সেই নয়জন শিল্পীর কাহিনী যাঁরা রাজা নেগ্রুর আদেশে এক রমণীয় পাথরের মন্দির গড়ে তুলেছিলেন ৷ কোন অভিশাপে রাতে মাটিতে গুঁড়িয়ে ভাঙল ধুলো হয়ে ৷ দিনের পর দিন একই ঘটনা ৷ রাজমিস্ত্রি মানোলে স্বপ্নে দৈবাদেশ পেলেন, খুব ভোরে প্রথম যার দেখা তাঁরা পাবেন তাকে পাথরে পুঁতে উৎসর্গ করলে মন্দিরের ভিত শক্ত হবে ৷ পরদিন মানোলার সুন্দরী বৌ আন আসছে, দূরে পথে দেখা যাচ্ছে তাকে, যেন এক কৌতুকের খেলা এমনভাবে মানোলে মারলেন তাকে ৷ শুরু হওয়া দেওয়ালের গায়ে একটি পাথরের ইট, দুটি ইট, দেওয়াল উঠে দাড়াঁল ৷
‘সুন্দরী আন কোথায়?
অদৃশ্য তার কোমল পায়ের পাতা
সোনা রঙের ঊরু
ইটের নিচে পড়ে রইল ফেনার মতো শরীর…’
তৈরি হল নারীদেহ বলিদানের ওপরে নদীর ধারে আশ্চর্য এক মন্দির ৷ এর থেকে সুন্দর প্রাসাদ আর যাতে কেউ না গড়তে পারে রাজা ওই নয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে ৷ শিল্পীরা উড়ে পালাবার ডানা তৈরি করতে চাইলেন কিন্তু মরণই এল মুক্তি হয়ে ৷ মলদভার গাঁয়ে আজও এই গান শোনা যায়, যেন ওই নয়জন স্থাপত্য শিল্পীর আত্মা ঘুরে বেড়ায় অন্য শিল্পীদের গানে ৷
লাইয়াতুরেরা খেতে বসেছে ৷ রনদুনিয়া পাখিরা রুটির টুকরোর জন্য উড়ে উড়ে আসছে ৷ চড়ুইয়ের মতো দেখতে ৷ খুব দূরে কদ্রির বন থেকে শিস দিয়ে উঠল রোদিগো তোয়ারে-নাইটিঙ্গেল ৷ রগিদা বলে উঠল, জানো আমার ঠাকুমা আমাকে আদর করে ডাকে রদিগা তোয়ারে ৷ বিশ বছরের ভবিষ্যৎ চিন্তাক্লিষ্ট মুখটি এখন এই খোলা হাওয়ায় উজ্জ্বল রোদ্দুরে সোনার মতো ঝকমক করছে ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন