অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
পাহাড়িয়া মানুষরা বিশ্বাস করে যে হিমালয় ডাক দিলে সাড়া দিতেই হয় ৷ আমার বেলা এই ডাক এসেছিল একবারেই হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধনের মতো ৷ স্বাস্থ্যের কারণে উচ্চতা আমার আওতার বাইরেই ছিল ৷ তাই মনের মধ্যে অঙ্কুরের মতো ইচ্ছে জাগলেও তাকে আমল দিইনি ৷ প্রতিবেশীরা ঠিক পুজোর আগে বাইরে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করছিলেন ৷ অনেকদিন ধরেই কেদার-বদ্রী যাওয়ার ইচ্ছে কিন্তু কিছুতেই হয়ে উঠছিল না ৷ এবার তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে দেবদর্শনে যাবেনই ৷ কেদার-বদ্রীর নাম শুনলে মন চঞ্চল হয় না এমন বাঙালি বোধ হয় খুব কমই আছে ৷ আমিও কোনও কিছু না ভেবেচিন্তে ঠিক করে ফেললাম, যাবই ৷ ডাক্তারের পরামর্শে আমার সঙ্গে যাবার জন্য সেই ছোটবেলার ফিরিওলার বাক্সের হরেকরকমবার মতো একটি ওষুধের বাক্স তৈরি হল ৷ সবকিছু বাঁধাছাদা, বাক্সে শুধু তালাচাবিটি পড়তে বাকি ৷ এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত ৷
যে ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে আমাদের যাবার কথা তারা যাত্রার আগের আগের দিন টেলিফোন করে জানাল যে রান্নার লোকেরা স্ট্রাইক করায় যাত্রা বাতিল ৷ খুবই দমে গেলাম ৷ বুঝলাম যে ডাকটা অবেলায় এসেছিল ৷ সব থেকে খারাপ লাগল আমার প্রতিবেশী বন্ধুদের জন্য ৷ তাঁরা খুবই ভেঙে পড়লেন ৷ নারায়ণ না ডাকলে নাকি এই ভাবেই সব কিছু পণ্ড হয়ে যায় ৷ তাঁদের চাঙ্গা করতেই আমি কথাচ্ছলে বললাম, ‘দরকার কি ওদের সঙ্গে যাবার ৷ আমরা তো তিনজনে মিলেই যেতে পারি ৷’ যেমন কথা তেমন কাজ ৷ প্রথমেই আমরা দিল্লির টিকিট কাটলাম কারণ দেরাদুন এক্সপ্রেসে জায়গা নেই ৷ এমনিতে এই ট্রেনে হরিদ্বার অবধি গিয়ে বাসে করে হৃষীকেশ যেতে হয় ৷ আবার দিল্লি থেকেও বাসে যাওয়া যায় ৷ তারপরেই আমরা গেলাম গাড়োয়াল বিকাশ নিগমের কলকাতা শাখায় ৷ বি বা দী বাগে জি পি ও ছাড়িয়ে আরেকটু গেলেই ওদের অফিস (মহাকরণের পিছনে) ৷ তাঁরা আমাদের আশ্বাসবাণী দিলেন যে হৃষীকেশ থেকেই আমরা পছন্দমতো ভ্রমণসূচি পেয়ে যাব ৷
ট্রেন যখন ছাড়ল তখনও হিমালয়ের ডাক সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না ৷ নয়াদিল্লি থেকে আমরা সোজা চলে গেলাম আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাসে ৷ চেপে বসলাম এক অতি লজঝড় বাসে ৷ পথে যেতে খালি মনে হচ্ছিল এই বুঝি বাস মুখ থুবড়ে পড়বে ৷ মীরাটে যখন থামল মনে হল হিমালয় অনেক দূরে ৷ এত নোংরা ও হতশ্রী শহর বড় একটা চোখে পড়ে না ৷ যাই হোক মীরাট ছাড়িয়ে যাবার পর জনবসতি কমতে লাগল ৷ দুধারে শুধু আখের খেত ৷ দুটি খেতের মাঝে সরু পায়ে চলার পথ ৷ রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছ ৷ বেশ কিছুক্ষণ ধরে খালি আখের খেত দেখতে দেখতে যখন একঘেয়ে লাগছে তখন হঠাৎই সবুজের গায়ে ঝলসে উঠল রঙের ছটা ৷ ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই নীল গলা তুলে রাজকীয় ঠাটে এক খেত থেকে আরেক খেতে ঢুকে পড়ল ময়ূর ৷ মনটা খারাপ হয়ে গেল ৷ ভালো করে দেখার আগেই সে চোখের আড়াল হয়ে গেল ৷ তখন কি জানি হিমালয়ের ডাক নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর পথের পাশ দিয়ে যাবে ৷ কি উজ্জ্বল মসৃণ তাদের রং ও পেখম ৷ মীরাট মুজফফরনগরের সব নোংরা ও কুশ্রীতা ঢাকা পড়ে গেল রঙের ছটায় ৷ বাসে ঘুমোতে পারি না বলে আমিই রয়ে গেলাম এই দৃশ্যের সাক্ষী ৷ বাদবাকিরা সবাই এক ঘুমে নিমগ্ন ৷
রুরকির পর পথের দুধারে দৃশ্য ক্রমশই ছবির মতো সুন্দর হতে লাগল ৷ দিনান্ত বেলার আলোয় দুপাশে খেত ও গাছপালা মোহময়ভাবে পাল্টে গেল ৷ হরিদ্বার আসার আগেই অন্ধকার নেমে এল ৷ পাহাড়ের দেশের বিকেলে একটা হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া ছিল ৷ যা দুপুরের গরমের পর খুবই মনোরম ৷ এখানে অন্ধকার ঝুপ করে আসে না ৷ শেষ বেলার আলো অনেকক্ষণ থাকে ৷ বাসের জানলা দিয়ে যখন হরিদ্বার (স্থানীয় লোকে কিন্তু হরদোয়ার বলে) শহরের আলোগুলো দেখলাম তখন আরেকবার হিমালয়ের ডাক শুনলাম ৷
হৃষীকেশ পৌঁছতে আমাদের আটটা বেজে গেল ৷ ছোট জায়গার পক্ষে বেশ রাত ৷ বাসস্ট্যান্ডের কাছেই হোটেল পাওয়া গেল, অবশ্য শুধু থাকার জন্য ৷ মোটামুটি পরিষ্কার ৷ তবে সে রাতে খুব খাওয়ার কষ্ট হয়েছিল ৷ কারণ কোথাও কিছু পাওয়া যায়নি শুকনো শক্ত রুটি ও ডাল ছাড়া ৷
আমরা সকালবেলাই ছুটলাম আসল কাজে ৷ গাড়োয়াল বিকাশের অনেক রকমের সফরসূচি আছে ৷ চার ধাম (কেদার-বদ্রী, গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী) দুই ধাম (কেদার-বদ্রী, গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী), পঞ্চকেদার (রুদ্রনাথ, তুঙ্গনাথ, মুক্তনাথ, ভৈরব ও কেদারনাথ) ৷ আমরা নিজেদের পছন্দের সফরটির টিকিট কেটে নিয়ে চলে গেলাম মুনি কি রেতিতে ঘর ঠিক করতে ৷ এই জায়গাটি হৃষীকেশের একটু বাইরে ৷ নিরালা পরিষ্কার ও ছবির মতো সুন্দর ৷ তখনও সেখানে অটোর ফটফটানি আরম্ভ হয়নি ৷ টাঙাই ভরসা ৷ বেশ মজা লাগে চড়তে ৷ ঘোড়ার কপকপ খুরের আওয়াজের একটা নিজস্ব ছন্দ আছে ৷
আমাদের যাত্রা শুক্লপক্ষে হওয়ায় চাঁদের আলো আমাদের রাতের সঙ্গী হয়েছিল ৷ মুনি কি রেতি থেকে কেদারনাথ পর্যন্ত যে জ্যোৎস্নালোক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তা কল্পনারও বাইরে, একমাত্র স্বপ্নেই সম্ভব ৷ মুনি কি রেতির বাংলোর সামনে রাস্তা একটি পাহাড় ঘিরে চলে গেছে ৷ কয়েক পা হাঁটলেই নদী ৷ ওপারে লছমন ঝুলা ৷ দশমীর জ্যোৎস্নায় আলোছায়া ঘেরা পরিবেশে একা হাঁটতে একটুও ভয় করে না ৷ পাহাড়িরা অপরাধপ্রবণ নয় ৷ যদিও স্থানীয় লোকেরা খুবই গরিব ৷ কিন্তু স্ত্রী পুরুষ উভয়েই পরিশ্রমী ৷
আমাদের সফরসূচি সাত দিনের ৷ মুনি কি রেতি থেকে সকাল সাতটায় যাত্রা আরম্ভ হল ৷ রীতি অনুযায়ী আগে কেদারদর্শন তার পরে বদ্রীনাথ ৷ দীর্ঘ চড়াই ভেঙে এক পর্বতমালার গা ঘেঁসে আরেক পর্বতমালার কাছাকাছি আসা ৷ পিছন ফিরে নিচের দিকে তাকালে চোখে পড়ে ফেলে আসা রাস্তা মোটা অজগরের মতো পড়ে আছে ৷ কেদার ও বদ্রীনাথের জয়ধ্বনি দিয়ে যে যাত্রার শুরু তা হিমালয়ের ডাকের মতো মনে হল ৷
যাত্রা পথের প্রথম বিরতি ব্যাসিতে ৷ জায়গাটি এমনিতে সুন্দর ৷ কিন্তু অমন সুন্দর জঙ্গল থেকে গাছপালার টাটকা নিজস্ব গন্ধের বদলে নাকে এল দুর্গন্ধ ৷ জঙ্গলই এখানে তীর্থযাত্রীদের শৌচাগার ৷ ব্যাসিতে ব্যাসদেবের একটি বড় মূর্তি আছে ৷ পাহাড়ের পথে জানলার ধারে বসাটাই বেড়ানোর অর্ধেক আনন্দ ৷ সমান্তরাল এক প্রবহমান জীবন যা আমাদের আগেও যারা এপথে গেছে দেখেছে যারা পরে আসবে তারাও দেখবে ৷ বড় বড় গাছে বাঁদরদের ঘরকন্না দেখার মতো ৷ কোথাও বা চলছে পরস্পরের গা থেকে উকুন বাছা, কোথাও বা মা পরিচর্যা করছে শিশুর ৷ তাকে গভীর মমতায় দুধ খাওয়াচ্ছে গা-হাত-পা পরিষ্কার করে দিচ্ছে ৷ কিছু বাঁদর দল বেঁধে ফলটা পাকুড়টা পেড়ে নিচে একটু বড় শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছে ৷ বিকট শব্দ করে তাদের পাশ দিয়ে বিশালকায় বাস, ট্রাক একের পর এক চলেছে তাদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই ৷ বাঁদরদের বাঁদরামিও যে কত মজার হতে পারে তা কি দেবপ্রয়াগের এই পথে না এলে জানা যেত?
পুণ্যার্থীদের কাছে দেবপ্রয়াগের মাহাত্ম্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ এখানে অলকানন্দার গর্জন এসে মিলে যায় ভাগীরথীর কলতানের সঙ্গে ৷ এই মিলিত যাত্রা সিতলে আসে হরিদ্বারে ৷ এখানে পূর্বপুরুষের তর্পণ করলে তাদের নাকি অনন্ত মোক্ষলাভ হয় ৷ অলকাপুরী হিমপ্রবাহের স্বচ্ছ জল নিয়ে প্রবাহিত অলকানন্দা মেশে গোমুখ থেকে উৎসারিত গঙ্গার গাঢ় খয়েরি জলের সঙ্গে ৷ আমরা ফিরে যাই রামায়ণের কালে ৷ এখানকার অতি প্রাচীন রামমন্দিরে রাম তপস্যা করেছিলেন ৷ ব্রহ্মহত্যার পাপস্খালনের জন্য ৷ অর্থাৎ রাবণ হত্যার জন্য ৷ স্থানীয় মানুষ এমনভাবে ‘রামজি’র কথা বলে যে মনে হয় যেন তিনি তাদের পরিবারের অতি ঘনিষ্ঠ ৷ এবং ঘটনাও যেন এই সেদিনকার ৷ দেবপ্রয়াগ থেকে আরম্ভ হয় নিরামিষ খাওয়া ৷ এর আগে হৃষীকেশে ডিমটা চলত ৷ কেদার-বদ্রী যাত্রায় আহার ভোজন বিলাসীদের পক্ষে দুঃস্বপ্ন ৷ অবশ্য রুদ্রপ্রয়াগের ভোরবেলায় চা ও জিলিপির স্বাদ বহুদিন স্মৃতিতে থাকে ৷ গাড়োয়ালের প্রাচীন রাজধানী শ্রীনগরের পথের ধারে ছোট্ট ভোজনালয়ের ডালের চাটনি তো অপূর্ব ৷ সেইসঙ্গে দোকানের পিছনে হাত ধুতে গিয়ে আদিগন্ত ধানের খেত ৷ শ্রীনগরের উচ্চতা ১,৭০০ ফুট ৷ এখানে কমলেশ্বরের মন্দিরেও ঘরের মানুষ ‘রামজি’র কথা শোনা গেল ৷ কমলেশ্বর মন্দিরে শিবের আশীর্বাদ প্রার্থী রাম তাঁকে বন্দনা করেন ১,০০০টি পদ্মফুল দিয়ে ৷ শিব যখন একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন তখন রাম ঘাটতি পূরণ করে তাঁর একটি চোখ দিয়ে ৷ কার্তিক মাসে এখানে বড়সড় মেলা বসে ৷
এরপরের দর্শনীয় স্থান রুদ্রপ্রয়াগ ৷ এখানেই প্রথম হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য চোখে পড়ে ৷ পাথুরে রুক্ষতার সঙ্গে শ্যামলিমার মেলবন্ধন ৷ আরেক মিলন স্থলের জন্যও জায়গাটি স্মরণীয়-স্বর্গের নদী মন্দাকিনী এখানেই মিলিত হয় অলকানন্দার সঙ্গে ৷ পাথরের আড়ালে আড়ালে ছোট ছোট পর্ণকুটিরের দরজায় দেখা যায় রংবেরঙের পোশাকে গাড়োয়ালি নারী ও শিশু ৷ হাত নাড়লে তারাও হেসে উত্তর দেয় ৷ নিচের দিকে তাকালে মন্দাকিনীকে একফালি সিল্কের মতো মনে হয় ৷ এখান থেকে রাস্তা কেদারনাথের দিকে ভাগ হয়ে যায় ৷ পথে পড়ে গুপ্তকাশী ৷ এখানেই আছে বিখ্যাত শিবের এবং অর্ধনারীশ্বরের মন্দির ৷ যখন পাণ্ডবরা জ্ঞাতি-হত্যার পাপ থেকে মুক্ত হবার জন্য শিবের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন তখন শিব এখানে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন ৷ ৪,৫০০ ফুট উচ্চতায় বাতাস কনকনে ঠান্ডা ৷ রোদে আসে উজ্জ্বলতা কিন্তু তাপবিহীন ৷ অসংখ্য পাহাড়ি ঝরনা কলকলিয়ে গিয়ে মন্দাকিনীতে বিলীন হয়ে যায় ৷ রং-বেরঙের নানা মাপের পাখি উড়তে উড়তে ঝরনার জলে তৃষ্ণা মিটিয়ে নেয় ৷ শোনপ্রয়াগে আবার দুই নদীর মিলন-শোনগঙ্গা হারিয়ে যায় মন্দাকিনীতে ৷ গেটবন্ধ হবার আগে গৌরীকুণ্ডে পৌঁছতে হয় ৷ কারণ রাস্তা খুবই সরু ৷ তার আগে পড়ে ত্রিযুগীনারায়ণের মন্দির ৷ এখানে শিব-পার্বতীর বিয়েতে পুরোহিত ছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা এবং সাক্ষী নারায়ণ ৷ যে অগ্নিসাক্ষী রেখে মহাদেব পার্বতীকে নিয়ে সাত পাক ঘুরিয়েছিলেন তার আগুন এখনও জ্বলছে ৷ কারণ প্রতি পুণ্যার্থী একটি করে কাঠ আগুনে নিক্ষেপ করেন ৷
দেহত্যাগ করে দক্ষকন্যা সতী হিমালয় ও মেনকার কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করেন ৷ উমা শিবকে স্বামী রূপে পাবার জন্য তপস্যায় বসার আগে মন্দাকিনীর জলে স্নান করেন শুদ্ধ হতে ৷ সেই জায়গাটিতে উমাদেবীর মন্দির আছে এবং পাশেই উষ্ণকুণ্ড ৷ ৫,৫০০ ফুট উচ্চতায় গৌরীকুণ্ড ঘিরে গভীর জঙ্গল ফার ও পাইনের ৷ শ্যামলিমা জায়গা ছাড়তে থাকে রুক্ষতাকে ৷ এখান থেকেই শুরু হয় ১৪ কিলোমিটার কেদারের পথ ৷
প্রথম পড়ে রামবাড়া ৷ এর পরে ক্রমশই পথ চড়তে থাকে ৷ বড় বড় ঝোপঝাড়ের কোণ ঘেঁসে ফুটে থাকে নাম না-জানা বনফুল বিভিন্ন রঙের সমারোহে ৷ হলদে, সবুজ, লাল, গোলাপি, বেগুনি, সাদা এবং নানা রঙের নীলের জটলায় চোখ মুগ্ধ হয়ে যায় ৷ এই ফুল হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে ভয় করে তোলা তো দূরের কথা ৷ মনে হয় পাহাড়ের জিনিস পাহাড়েই থাক ৷ পথে দেখা যায় ধবধবে সাদা ঘোড়ার বাচ্চা মাটিতে গড়িয়ে খেলা করছে ৷ বোধ হয় এরা পক্ষীরাজের ছানা ৷ কোথাও কোনও আওয়াজ নেই ৷ ঘোড়ার গলার ঘণ্টার টুং টুং ছাড়া, মাঝে মাঝে ভেসে আসে মেয়ে গলার গান দূরের পাহাড় থেকে ৷
আকাশ পরিষ্কার থাকলে গরুড়চটির বাঁক নিলেই দূরে কেদারনাথের মন্দির দেখা যায় ৷ বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর বাহন নাদেশ্বর ৷ পাণ্ডবদের চোখে ধুলো দিয়ে গুপ্তকাশী থেকে শিব এখানে মোষের ছদ্মবেশ ধরে লুকিয়ে পড়েন ৷ ভীম তাঁর চাতুরি ধরতে পেরে নিজেকে অনেকখানি বাড়িয়ে নিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়ান যাতে সব মোষকে তাঁর পায়ের ফাঁক দিয়ে যেতে হয় ৷ সব মোষই পার হল, একটি ছাড়া ৷ সেই মোষ লুকোবার জন্য পাতালে ঢুকতে গেলে ভীম তার পিছনের পা দুটি চেপে ধরেন ৷ তখন তাঁদের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব পাণ্ডবদের জ্ঞাতি-হত্যার পাপ থেকে মুক্ত করেন ৷ ১১,৬৭৩ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে কোনও ব্যবধান নেই ৷ হীরের নাকছাবি শোভিত গুজরাটি গিন্নি এবং রাজস্থান গুজরাটের গ্রামের দরিদ্র নারীপুরুষ সবাই লিঙ্গ স্পর্শ করে জীবন ধন্য করে ৷ পথশ্রমের কষ্ট তাদের সার্থক হয় ৷
কেদারে রাত্রিবাস অনন্য অভিজ্ঞতা ৷ গাড়োয়ালে লজ ও হোটেল হিমলোক মন্দিরের ঘিঞ্জি পরিবেশের বাইরে অবস্থিত ৷ মধ্যরাতে হাড়-কাঁপানো শীতকে জয় করে বাইরে এসে দাঁড়ালে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া মন্দির ও পরিবেশ মনে হয় এ জগতের নয় ৷ এই সৌন্দর্য রমণীয় নয় ৷ কিন্তু নৈঃশব্দ্যে ও গাম্ভীর্যে অসাধারণ ৷ পাহাড়ের সূর্য লুকোচুরি খেলতে ওস্তাদ ৷ চোখে চাঁদ নিয়ে আমরা শুতে গেলাম ৷ সকালে উঠে দেখি মুষলধারায় বৃষ্টি ৷ তারই মাঝখানে ছাতায় প্লাস্টিকে নিজেকে মুড়ে নিচে নামা খুবই কষ্টকর ৷ ভিজে কাক হয়ে বাধ্য হয়ে আমরা আশ্রয় নিলাম একটি ছোট চায়ের দোকানে ৷ আমাদের সঙ্গী হল বিরাটকায় পাহাড়ি কুকুর ৷ এদের আকারের সঙ্গে প্রকৃতির কোনও মিল নেই-এত নিরীহ আর শান্ত ৷
বৃষ্টির মধ্যেই আমরা রওনা হলাম ৷ রাত কাটবে শোনপ্রয়াগে তাঁবুতে মন্দাকিনীর ধারে ৷ সেখানে মস্তবড় রান্নাঘরের উনুনের গরমের আরামে দেখা পাওয়া গেল বাংলা বলা এক রাঁধুনির সঙ্গে ৷ সে চমৎকার খিচুড়ি রাঁধতে জানে ৷
সকালে আবার চারদিক রোদে ঝলমল ৷ বৃষ্টির কোনও চিহ্নই নেই ৷ এবার যাত্রাপথ বদ্রীনাথের দ্বারে ৷ পথে পড়ল কর্ণপ্রয়াগ ৷ এখানেই সূর্যদেব কর্ণকে কবচ ও কুণ্ডল দান করেছিলেন ৷ দুই নদীর সঙ্গমস্থল কর্ণপ্রয়াগ (২,২০০ ফুট) ৷ পিণ্ডারগঙ্গা ও অলকানন্দা নদীর এখানে ভয়ালরূপ ৷ বড় বড় পাথরের ওপর দিয়ে সগর্জনে ধেয়ে চলেছে ৷ ফেরার পথে এখানেই নদীর ধারে বাংলোয় রাতের ব্যবস্থা হয়েছিল ৷ আরেকটু উঁচুতে (২,৫০০ ফুট) নন্দপ্রয়াগ সমাহিত সুন্দর ৷ এক সাধক নন্দবাবার নামে জায়গার নাম ৷
বদ্রীনাথের ঠিক আগে রাতের জন্য আমরা থামলাম যোশিমঠে ৷ ৫,০০০ ফুট উঁচুতে এক বটবৃক্ষের নিচে বসে আদি শংকরাচার্য সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন ৷ বৃক্ষটিকে স্থানীয় মানুষ কল্পবৃক্ষ বলে ৷ শীতে যখন বদ্রীনাথে মন্দির বন্ধ হয়ে যায় তখন স্থানীয় নরসিং মন্দিরে তাঁর ঠাঁই হয় ৷ এখান থেকে রাস্তা চলে গেছে গোম কুণ্ডের দিকে ৷ এখানেও দুটি নদী বিষ্ণু ও ধৌলিগঙ্গা অলকানন্দায় আত্মসমর্পণ করে ৷ পথে পড়ে পাণ্ডুকেশ্বর, যেখানে পাণ্ডু তাঁর জীবনের শেষদিনগুলি কাটিয়েছিলেন ৷ এই পথ ধরেই পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানের পথে রওনা হয়েছিলেন ৷
বদ্রীনাথের উচ্চতা ১০,৪০০ ফুট ৷ মন্দিরটি পথের যেখান থেকে দেখা যায় সেই জায়গাটিকে বলে দেওদেখনি ৷ খাঁটি ভক্ত যিনি তিনি এখানে নেমে পড়ে বাকি পথটুকু হেঁটে যান ৷ অবশ্য ৩০/৩৫ বছর আগে পুরো পথই হেঁটে উঠতে হত ৷ সেই পাকদণ্ডীটি এখনও আছে ৷ হরিদ্বার থেকে কেদারের দূরত্ব ছিল ২৪৮ কিলোমিটার এবং বদ্রীনাথের ৩৩২ কিলোমিটার ৷ বদ্রীনাথের পথের দুপাশে সাদা না গলা বরফের টুকরোগুলিকে Ice Bridge বলা হয় ৷ স্থানীয় লোকেরা বলে ‘বুঢ়া বরফ’ ৷ দুপাশের ধস তাদের বর্ণনায় ‘পাহাড় গিরা হায়’ ৷ নরনারায়ণ পর্বতের গায়ে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা আদি শংকরাচার্য ৷ বিষ্ণু ধ্যানস্থ হলে লক্ষ্মী কুল বনের (বদ্রী) রূপ ধরে তাঁকে আড়াল করেন ৷ বদ্রীনাথেই আছে ব্রহ্মকুণ্ড ৷ এখানে স্নান করতেই হয় ৷
আমাদের সাতদিন প্রায় শেষ হবার মুখে ৷ এখানেও গাড়োয়ালের চমৎকার লজ ও হোটেল আছে-দেবলোক ৷ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ৷ পরের দিন সকালে রওনা হয়ে আমরা দুপুর নাগাদ যখন যোশিমঠে থামলাম এক পাহাড়ি শালওলা আমার পরনে তিব্বতি বাকু দেখে ছলছল চোখে তার ছেড়ে আসা দেশের কথা বলা ও আমায় অবিশ্বাস্য কম দামে শাল বিক্রি করল ৷ যোশিমঠের এক বাঁক থেকে শেষবারের মতো হিমালয় দেখে আমরা কর্ণপ্রয়াগ রওনা হলাম ৷ হিমালয় সবারই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে ৷ ভক্ত পায় তার দেবতাকে, ভ্রমণপিয়াসী উপভোগ করে নতুন জায়গা আর প্রকৃতিপ্রেমী হারিয়ে ফেলে নিজেকে ৷ এত প্রবাদ কিংবদন্তী গল্পকথা আর অন্য কোনও স্থানকে এইভাবে জড়িয়ে নেই ৷ আমাদের মহাকাব্য জীবন্ত হয়ে ওঠে ৷ পৌরাণিক চরিত্রও রক্তমাংসের রূপ পায় ৷ তাঁদের কথা স্থানীয় মানুষ এমনভাবে বলে যেন তাদের সঙ্গে ওদের ওঠাবসা আছে ৷ বিকেলবেলায় মুনি কি রেতিতে যখন এলাম মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল ৷ আবার কি হিমালয় ডাকবে?
ভ্রমণ শারদীয় সংকলন, ১৯৯২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন