অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
সাউথে যাচ্ছ? শুধোয় লোকে ৷ ভূগোলে আমার মূর্খতা আকাশপ্রমাণ, কাজেই সম্মতি জানিয়েছিলাম ৷ সাউথ মানে যে আসলে কলকাতা থেকে জয়সলমির যেমন ‘নর্থ’, সেরকমই, সে কথা তো তখন বুঝিনি ৷ সাউথ ইন্ডিয়া বলতে মাথার মধ্যে একটা আবছা ব্যাপার ছিল যেখানে তাঞ্জোরের নটরাজ, কথাকলি আর মোহিনী অট্টমের ছন্দ, মাইসোর স্যান্ডাল উড, বেলুড়-হ্যালেবিদ আর কন্যাকুমারীর মন্দির মোটামুটি একসঙ্গে পিণ্ডি পাকানো আছে ৷ কোথায় কোথায় যাব ঠিক করতে ম্যাপ আর ব্র্যাডশ’ খুলে বসে চক্ষুস্থির ৷
শেষে তো এই ট্রেনে উঠে বসা ৷
রওনা হবার আগে বন্ধুসজ্জনরা বলেছিলেন দক্ষিণ ভারতে নাকি কেউই প্রায় হিন্দি বলে না কিন্তু সকলেই ইংরিজিতে সড়্গড় ৷ হায়, একথা কি বলেছিলেন যে এই মহামানবের সাগরতীরে তেলুগু ইংরিজি থেকে তামিল ইংরিজি আলাদা, কন্নড় ইংরিজি তামিল ইংরিজি থেকে আলাদা আর সর্বোপরি বাংলা ইংরিজি এই সবগুলো থেকেই আলাদা? বলেননি ৷ ফলে আমরা বেশ বুঝতে পারছি পুরুলিয়া বরাবাজার কিংবা বাঁকুড়ার ছাতনা থানার কোনও মাঠ থেকে উঠে আসা একজন মানুষ যখন ধর্মতলা থেকে বাস ধরে দক্ষিণেশ্বর যেতে চান তাঁর কীরকম অবস্থা হয় ৷
কাজেই বহু কষ্টে যখন বিজয়ওয়াড়া বাসস্ট্যান্ডে ‘সাগর’ লেখা টিকিটখুপরি খুঁজে পাই আর বুঝতে পারি যে ওটাই হল নাগার্জুনকোণ্ডার ডাকনাম, খুশিতে অন্তরাত্মা একেবারে উথলিয়ে উঠেছে ৷ কোনওমতে টাকা গুঁজে দিয়ে দুটো টিকিট পাওয়া গেল ৷ জানবার খুব চেষ্টা করি কটায় বাস কিন্তু সরকারি টিকিট কাউন্টার, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার কাজ নয় ৷ বহু ব্যাকুলতা প্রকাশের পর কাউন্টারের সামনের জটলা থেকে একজন বললেন, ‘ফোর ক্লক’ ৷ সঙ্গে হাতের চারটে আঙুল তুলে দেখিয়েও দিয়েছেন ৷ সন্তুষ্ট হয়ে চলে আসি ৷ যাক, উপায় একটা হল শেষকালে ৷
কী উপায় হল? কটায় বাস? বিজয় গর্বে বলি, চারটেয় (তবে নাকি আমি ভিড়ের ভেতরে ঢুকে টিকিট কাটতে পারব না!) ৷
চারটে মানে কি? ভোর চারটে না বিকেল চারটে? কি সর্বনাশ! তা তো জানা হয়নি? ফলে আবার সেই কসরত শুরু, জনে জনে ধরা আর-
প্লিজ-সাগর বাস-অ্যাট হোয়াট টাইম? প্লিজ-প্লিজ ইত্যাদি চলতে থাকে ৷
তবে কিনা ট্যুরিস্টদের ভগবান হলেন পাঁচ পাবলিক ৷ কে যেন কী উপায়ে সময়মতো তুলে বসিয়ে দেন বাসে ৷ প্রচুর ভিড়ের মধ্যেও জুটে যায় জানলার ধারে পাশাপাশি দুটো সিট ৷
বিকেল সাড়ে চারটেয় বিজয়ওয়াড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে পুলের ওপর দিয়ে রওনা হয় বাস ৷ নিচে কৃষ্ণার থোকা থোকা পাগল-পাগল জল ৷
এ সেই ঊনআশি সাল যখন আমরা বেড়াতে যেতাম এরকম এলোমেলো করতে করতেই ৷ কখনও দুজন, কখনও আড়াই জন ৷ একেকবার চিন্তাশঙ্কিত মনে আড়াইয়ের অর্ধাংশটুকুকে আটকে রাখতেন মা ৷ এবারও তাই হয়েছে ৷
গোড়ায় কাটা হয়েছিল করমণ্ডলে দুটো এ সি বার্থ রিজার্ভ করা টিকিট ৷ কিন্তু মনে অশেষ কষ্ট ৷ পথে ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় পড়বে নাগার্জুনকোণ্ডা ৷ স্বপন পেশায় বাস্তুবিদ্যার লোক হলে কী হবে, নেশায় তো পুরাতত্বের ছাত্র ৷ নাগার্জুনকোণ্ডা ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের এক স্বাভাবিক প্রত্নতাত্বিক জাদুঘর ৷ চলে যাব তার ওপর দিয়ে অথচ নামা হবে না ৷ মাদ্রাজ (এখনকার চেন্নাই) ঠিক এক রাতের দূরত্ব নাগার্জুনকোণ্ডা অর্থাৎ কিনা বিজয়ওয়াড়া থেকে ৷ ব্রেকজার্নি করে নেমে পড়লে টিকিট বজায় থাকবে বটে কিন্তু রিজার্ভেশন থাকবে না তো! তাহলে পুরো রাত যাব কী করে-ইত্যাকার নানা সমস্যায় পড়ে যাত্রা-শুরুতে আমরা মন শক্ত করেছিলাম ৷ নামা হবে না মাঝপথে ৷ দেখতে পাব না নাগাজুনকোণ্ডা ৷ কী আর করা!
কিন্তু বেলা আড়াইটেয় যে করমণ্ডল ছেড়েছিল পরদিন সকাল দশটায় সে গাড়ি অন্ধ্রপ্রদেশের এলুরু নামে ছোট শান্ত স্টেশনটিতে দাঁড়িয়ে পড়ে ৷ দাঁড়িয়েই থাকে, দাঁড়িয়েই থাকে যতক্ষণ না জানা যায় যে খানিক সামনে এক জায়গায় লাইনে মালগাড়ি উল্টে গিয়েছে সেটা না তোলা পর্যন্ত লাইন বন্ধ ৷ করমণ্ডল এক্সপ্রেসকে একটু এগিয়ে এনে বিজয়ওয়াড়াতে দাঁড় করানো হবে-যতক্ষণ না গাড়ি আবার চলাচল শুরু করতে পারে ৷ সেটা বিকেল চারটেও হতে পারে সন্ধে ছটাও হতে পারে, ঠিক নেই ৷ আমাদেরও মাথায় সিদ্ধান্ত নেবার দায় রইল না ৷ স্বয়ং নাগার্জুনই দেখা যাচ্ছে পথে এরকম একটা রক্তপাতবর্জিত নির্দোষ অ্যাক্সিডেন্ট বাধিয়ে ট্রেন আটকে আমাদের দুর্বল দ্বিধা কাটিয়ে দিয়েছেন ৷ সুতরাং বিজয়ওয়াড়া স্টেশনে নেমে পড়ে খুঁজে বার করেছি বাসস্ট্যান্ড ৷
বিকেল চারটেয় ছেড়ে সে বাস চলছে তো চলছেই, দুপাশে রুক্ষ মাঠ, গাছ বলতে কেবল বাবলা ৷ মাঝে মাঝে এক-আধটা গ্রাম ৷ পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘরের চালগুলো ঢালু হয়ে নেমেছে প্রায় মাটি পর্যন্ত ৷ তার তলায় কাদামাটি বা পাথরে তৈরি কোনও একটা ঘরের কাঠামো আছে কিনা তাও বোঝা যায় না সর্বদা ৷ বাসটা দাঁড়াচ্ছে না বিশেষ ৷ বেশ ভিড়, অনেক লোক দাঁড়িয়েও আছে ঠাসাঠাসি করে ৷ তবে তেমন গরম নেই, আজ দুর্গাপুজোর নবমী ৷
সহযাত্রীদের কারোরই একটা কথাও বুঝতে পারছি না ৷ কন্ডাক্টর টিকিট দেখল ৷ তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কখন পৌঁছবে সাগর, সে কোনও উত্তর না দিয়ে ভিড়ের মধ্যে অন্য লোকেদের টিকিট কাটতে লাগল ৷ হয়তো বুঝতে পারল না আমাদের প্রশ্নটা ৷ জানলার বাইরে একই রকম দৃশ্যপট-পাথুরে কাঁকরভরা জমি, মাঠের পর মাঠ ফসলখেতহীন ৷ দূরে দূরে এক-দুটো গ্রাম ৷ ছাগলের পাল কোথাও কোথাও ৷ পুরুলিয়ার বাগমুণ্ডি অঞ্চলের চেহারা যেন ৷ এই তাহলে স্কুলে কিরণ চৌধুরীর ইতিহাস বইয়ে পড়া ‘ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা’ ৷ সারা দেশের নানা জায়গার লোক একই রকম গরিব ৷
গুণ্টুর জেলার পালনাড তালুকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা ৷ অদেখা আশপাশে কোথাও দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণা ৷ এই কৃষ্ণারই দক্ষিণতীর ছিল নাগার্জুনকোণ্ডা (নাগার্জুনের পাহাড়) ৷ আশপাশের পাহাড়ের মাঝখানে কে জানে কত লক্ষ বছরের পলি মাটি বুলিয়ে বুলিয়ে কৃষ্ণা নদী তৈরি করেছিল এক বিস্তীর্ণ উপত্যকা ৷ সেইখানে, বুনো বাবলা আর দুরধিগম্য কাঁটাঝোপে ঢাকা সেই নাগার্জুনকোণ্ডায় ১৯২৩ সালে আবিষ্কৃত হয় এক প্রাচীন সভ্যতার অবশেষ ৷ সেই আবিষ্কার শুরুর গল্পটি আমাদের খুব পরিচিত ছকের ৷ ভারতবর্ষের বহু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন প্রথমে খুঁজে বার করেছেন খুব সাধারণ, গরিব এবং প্রায়ই গ্রামীণ লোকজনেরা ৷ জীবনধারণের প্রয়োজনে নিজেদের অঞ্চলের ঝোপজঙ্গলে, দুর্গম জায়গায় পুকুরে সর্বত্র ঘুরে বেড়ান এঁরা, খাওয়ার মতো কিছু সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকেন ৷ ফলে, সেসব জায়গাতে পড়ে থাকা, মাটিতে পুঁতে থাকা, পুকুরের জল থেকে ওঠা, কুয়োর গাঁথনিতে লেগে থাকা নানান ‘অন্যরকম’ জিনিস তাঁরা বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন আর নিজস্ব বিচিত্র সব পদ্ধতিতে রক্ষাও করেছেন সেগুলোকে ৷ কোথাও ‘ঢিবিতে শাবল ছোঁয়ালে মুখে রক্ত উঠে মরে যাবে’ ‘যক্ষের বাড়ি’ এরকম জনশ্রুতি তৈরি করে, কোথাও ‘পরীদের জায়গা, গেলে পাগল হয়ে যায়’ বলে, আরও নানারকমভাবে জেনে না-জেনে সাধারণ লোকেরা এরকম অঞ্চলগুলিকে এক ধরনের সুরক্ষা দিয়েছেন ৷ ধর্মঠাকুর, মা কালী বা শিব-বিষ্ণুর নামে যে বৌদ্ধ-জৈন ভাস্কর্যের কত নিদর্শন পুজোর সুরক্ষা পেয়ে চালান হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে তার সীমাসংখ্যা নেই ৷ নাগার্জুনকোণ্ডার ধ্বংসস্তূপও প্রথম খুঁজে পায় অন্ধ্রের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাখালছেলেরা ৷ ঝোপঝাড়ে ছাগল খুঁজতে গিয়ে তারা দেখেছিল সেই বিজনে পড়ে থাকা কিছু পাথরের স্তম্ভের টুকরো ৷ স্থানীয় স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে সেকথা জানায় তারা ৷ মাচেরলার বাসিন্দা সেই মাস্টারমশাই, শ্রীসুরাপারাজু ভেঙ্কটরামাইয়া, ছেলেদের সঙ্গে কাঁটাঝোপ ভেঙে খুব কষ্ট করে ওঠেন রহস্যময় নাগার্জুনের পাহাড়ে ৷ পাথরের স্তম্ভ, পোড়া ইটের স্তূপ দেখে, স্তম্ভের কোনও লিখন পড়তে না পেরে বিহ্বল হয়ে ফিরে আসেন তিনি ৷ একথা স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের মুখোমুখি হয়েছেন ওই জঙ্গলে ৷ দিনটা ছিল ১৯২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ৷ যা কিছু দেখেছেন তার যথাযথ অর্থ উদ্ধারে অক্ষম সুরাপারাজু সেগুলির বিষয়ে ছোট ছোট নিবন্ধ লেখেন স্থানীয় পত্রপত্রিকায় ৷ সমস্তটা জানান ওখানকার ডেপুটি ইনস্পেক্টর অব স্কুলসকে ৷ এইভাবে হালকা হালকা করে খবরটা ভারত সরকারের শিলালিপি বিভাগের তেলুগু-বিশেষজ্ঞ শ্রী রঙ্গস্বামী সরস্বতীর কানে যায় ৷ পরবর্তীতে ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগের তৎকালীন অধ্যক্ষ লং হার্স্টের নেতৃত্বে খননকার্য আরম্ভ হয় ১৯২৩ সালে ৷ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কাজ চলতে থাকে ৷
প্রথমে পাওয়া যায় মুনস্টোনে খোদাই করা অসাধারণ সুন্দর কিছু মূর্তি, শিলাপটে ও পাথরের স্তম্ভের ওপর খোদাই করা সামান্য কিছু লিপি ৷ এই লিপিগুলিতে ছিল সাতবাহন আর ইক্ষবাকু রাজবংশের নাম ৷ রামায়ণের দৌলতে এই দ্বিতীয় নামটি আবার আমাদের পরিচিত ৷ এইখানে কিছু কিছু খননকার্য হলে পাওয়া যায় বড় বড় বৌদ্ধবিহার চৈত্য স্তূপ ৷ হিন্দু সব দেবমন্দির, দেবমূর্তি ৷ মুদ্রা স্তম্ভ বিমান (মন্দিরচূড়া) মণ্ডপের ধ্বংসাবশেষ ৷ তারপর ছিল মাটি ৷ মনে হয়েছিল তার নিচে আর কিছু নেই ৷ তবু লং হার্স্টের আগ্রহে আরও কিছু কিছু অংশে খোঁড়ার কাজ হতে থাকে ৷ মাটির নিচ থেকে স্তরে স্তরে পাওয়া যায় ক্রমশ বেশি বেশি অতীতকালের সব জিনিস-হাড়ের পুঁতি, চিরুনি, পোড়া মাটির হাঁড়িকুড়ির টুকরো ৷ নানা আমলের মানুষদের নানা ধরনের সমাধিভূমি, প্রাচীন সব অস্থি-অবশেষ ৷ শেষ পর্যায়ে মানে সবচেয়ে নিচে পাওয়া যায় এমনকী প্রস্তরযুগের অস্ত্রশস্ত্র ৷ বলা বাহুল্য, কেবল নাগার্জুনকোণ্ডায় নয়, সংলগ্ন সমগ্র উপত্যকাটিতে ছড়ানো ছিল এসব নিদর্শন ৷ নাগার্জুনকোণ্ডা ছাড়াও উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্বদিকে ছড়ানো পাহাড়ের সারি-কুর্নুল জেলার নাল্লামালাই পর্বতামালা, আর দক্ষিণে স্বয়ং মহানদী কৃষ্ণা, এরই মাঝখানে প্রায় ২৩ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত উপত্যকা ৷ কে জানে কত বছর আগে আদি মানুষদের একটি দল এসে পৌঁছেছিল সুজলা সুফলা ওই পর্বতবেষ্টিত উপত্যকায় ৷ স্তরে স্তরে বিন্যস্ত জিনিসপত্র থেকে একটা কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে তিনদিকে পাহাড় আর চতুর্থ দিকে কৃষ্ণা নদীর এই সুরক্ষিত উর্বর এলাকায় মানব সভ্যতার একেবারে আদিম যুগ থেকে মানুষ বসবাস করেছে ৷ হয়তো কিছু সময় পর পর প্রলয়ঙ্কর বন্যা হয়েছে নদীতে, পলিতে চাপা পড়েছে বাসভূমি, ঘরবাড়ি ৷ মাটি নিজের নিয়মে ঢেকে রেখেছে মনুষ্যবসতির সে সকল চিহ্ন ৷ বছরের পর বছর গিয়েছে ৷ পুরু হয়ে জমে ওঠা উর্বর পলিমাটি আবার হাতছানি দিয়েছে ৷ ততদিনে কৃষিকাজ শিখে ফেলা, মৃৎপাত্র গড়তে সক্ষম মানুষের দলকে ৷ এমনই চলেছে বার বার, কে জানে কত হাজার বছর ধরে ৷ কৃষ্ণা স্থাপিত করেছে লালন করেছে বিনাশ করেছে ৷ তারও পর কি অদ্ভুত নিয়মে সেইসব বসতিচিহ্ন বুকে করে রক্ষা করেছে ৷ শেষতম, সবচেয়ে ওপরের অংশের ধ্বংস্তূপগুলি খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর ৷ বৌদ্ধ দার্শনিক, প্রচারক, শিক্ষক নাগার্জুনের নামধ্বজ সেই নাগার্জুনকোণ্ডার দিকে যাচ্ছি আমরা ৷
জানি, পুরাতত্ব বিভাগের সেই পরমাশ্চর্য আবিষ্কার আজকে আর চোখে দেখা যাবে না ৷ কৃষ্ণা নদীতে বিশাল বাঁধ দিয়ে জল জমা করা হয়েছে সেইখানে, যা ছিল কত না অদেখা মানুষের প্রাণচঞ্চল বাসভূমি ৷ কৃষ্ণা তাকে নিমজ্জিত করত প্রাকৃতিক নিয়মে আবার প্রকৃতির নিয়মেই প্রকাশ করত নরম পলির প্রসন্নতা মাখা নতুন ভূমি ৷ কিন্তু মানুষ, প্রযুক্তিমান মানুষ প্রকৃতির নিয়মকে ভেঙে চিরতরে ডুবিয়ে দিয়েছে ভারত ইতিহাসের এক জীবন্ত প্রত্নকীর্তিশালাকে ৷ যাক, আমরা নিতান্ত সাধারণ লোক, অনেক ওপরতলায় কোনও ভালোর বিবেচনায় কী কাজ হয় তার কীই বা বুঝি!
বাস এতক্ষণ চলে একবার দাঁড়াল ৷ তাও একটা শুকনো মতো চেহারার জায়গা ৷ কিছু লোক নেমে গেল, দু-চারজন উঠল ৷ ফলে ভেতরের ভিড়ের অবস্থা একই রকম ৷ চা-কফি খায় না এখানকার লোক? এত ভিড়, বাসস্ট্যান্ড জায়গা-খাবারের দোকান বলতে কিছু চোখে পড়ে না ৷ কেবল দু-তিনজন লোক সবুজ রঙের কাচের বোতল নিয়ে কী একটা ডেকে ডেকে বিক্রি করছে ৷ বোতলগুলোর মুখের ওপর একটা কাচের গুলি বসানো ৷ ‘খাব-খাব’ বলে উৎসাহী হচ্ছিলাম, স্বপন নিরস্ত করল ৷
ওগুলো সোডাওয়াটার, বিশ্রী খেতে ৷
তুমি কি করে জানলে?
আমাদের ওদিকেও আগে পাওয়া যেত ৷ ছোটবেলায় আমরা খুব লোভ করতাম ৷
বেশ, থাক তাহলে ৷ এই যে এতক্ষণে থালায় করে কি একটা বড়াভাজার মতো নিয়ে একজন এসেছে ৷ ‘রণ্ডভাজে’ ‘রণ্ডভাজে’ বলে ডাকছে ৷ তাকে ডাকা গেল জানলা দিয়ে ৷ তিনটে বড়ার দাম এক টাকা ৷ বাস ছাড়ল ৷ বড়াগুলো বেসনে ডোবানো লঙ্কার ৷ সুবিধা হল না কিন্তু একটা জ্ঞান লাভ হল, জানতে পারলাম তেলুগু ভাষায় রণ্ড মানে লঙ্কা ৷ ভুল জানলাম অবশ্য ৷ ‘রণ্ড’ মানে তিন-‘তেলুগু ভাষা শিক্ষা’র বইতে লেখা ছিল ৷
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আটটা বাজছে ৷ লোকালয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাস-একটার পর একটা গ্রাম পার হচ্ছে ৷ একটা মজার জিনিস দেখলাম, গ্রামের কাছাকাছি এসে বাসটা হর্ন দিতে থাকে আর অমনি রাস্তার দুপাশের মাটির কুঁড়েঘরগুলো থেকে বাচ্চারা মেয়েরা কচিকোলে তরুণী মা কিংবা বুড়ি মানুষরা বেরিয়ে এসে হাসিমুখে ড্রাইভারকে হাত নাড়ছে ৷ আমরা ড্রাইভারের মুখ দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু তার কেবিনের জানলার দিকে তুলে ধরা অজস্র হাসিমুখের এক বিরল দীপমালা দেখতে পাচ্ছি ৷ অবশ্য দীপমালা আক্ষরিক অর্থেও আছে কোথাও কোথাও-কোনও একটু বর্ধিষ্ণু জনপদ পার হবার সময় চোখে পড়ে নিকোনো দেওয়াল, ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করা রাস্তার দুপাশে কোথাও পাটকাঠি ধরনের কোনও সাদা কাঠি কোথাও বা চিলতে চিলতে মোমবাতিতে জ্বলছে আগুন ৷ যতটুকু ছোট আগুন-উৎসবের আলো হতে পারে, তেমন ছোট ৷ হঠাৎ করে মনে পড়ে যাচ্ছে আগামীকাল বিজয়া দশমী ৷ দশেরা উৎসবের শুরু ৷ এরকমই একটি গ্রাম পার হচ্ছিল বাস ৷ আলো জ্বলছে পথে, লোকেরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে ড্রাইভারকে ৷ হঠাৎ একটা চিৎকার, তারপর হৈ হৈ ৷ আমি চোখ বন্ধ করে ফেলেছি কেননা এই দিকেরই একটা মাটির ঘরের সামনে মায়ের হাঁটুর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটা এইটুকু, বোধহয় সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চা সটান দৌড় দিয়েছে বিশাল বাসটার তলায় ৷ জোর ঝাঁকুনি দিয়ে বাস থেমে গিয়েছে ৷ দুপাশের লোকজন ছুটে এসেছে ৷ কেবল সেই মা, আঠেরো-বিশের কালো মেয়েটি, নিজের জায়গা থেকে নড়েনি, কাঁদেনি, কিছু না ৷ একেবারে শূন্য চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বাসটার দিকে ৷ ড্রাইভার খালাসিও নেমে গিয়েছে ৷ একইরকম তাকিয়ে থাকে মা যখন লোকেরা বাসের তলা থেকে টলে মাটিতে পড়ে যাওয়া, অক্ষত বাচ্চাটাকে তার কোলে এনে দেয় ৷ তাকে প্রচণ্ড বকতে থাকে ড্রাইভার আর অন্যেরাও, বোধহয় খেয়ালশূন্য হয়ে বাচ্চার হাত ছেড়ে দেবার জন্য ৷ সে তাকিয়েই থাকে ৷ শেষে জড়ো হওয়া ভিড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে যায় এক সাদা চুলের পাকানো বুড়িমানুষ ৷ ঠাস করে একটা চড় কষায় মেয়েটার গালে, কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিতে যায় ৷ আর এতক্ষণে হাউমাউ করে জোরে কেঁদে ওঠে মা ৷ দুহাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাটাকে ৷ দৌড়ে ঘরে ঢুকে যায় ৷ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাস ছাড়ে ৷ রাত প্রায় সাড়ে নটা ৷
একটানা ঘন অন্ধকারের মধ্য দিয়ে চলেছে গাড়ি ৷ ভিড় কম ৷ দাঁড়ানো প্যাসেঞ্জার নেই আর ৷ তার মানে কাছাকাছি লোকালয়ও নেই বোধহয় ৷ চলছেও বেশ জোরে ৷ আর কতক্ষণ কে জানে নাগার্জুনসাগর? আন্দাজে বুঝতে পারছি রাস্তার দুপাশে জঙ্গল ৷ সাড়ে দশটায় হঠাৎ স্বপন ডানদিকে দেখায় ৷ অরনেকটা দূরে উঁচুতে আলোকিত কুয়াশার মতো কী যেন! অত উঁচুতে কী! ওটা কি আকাশে? বাস বাঁক নেয়, আবার সম্পূর্ণ অন্ধকার ৷ কিন্তু মিনিট পনেরো পর আবার দেখতে পাই, এবার একটু যেন স্পষ্ট ৷ মন দিয়ে তাকিয়ে থেকে বুঝতেও পারি ৷ নিচের কোন খাদ থেকে ছিটকে ওঠা জলের কণা যাকে বলে শীকর ৷ অনেকখানি ৷ আর তারই ওপরে পড়েছে বড় ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্পের আলো ৷ নাগার্জুনসাগর বাঁধ ৷ দূর পাহাড়ের অনেকখানি উঁচুতে ৷ আরও খানিক পর সারি বাঁধা বড় বড় ফ্লাডলাইটের দীর্ঘ সারিও বোঝা যায় স্পষ্ট ৷ সেই আলোরই আভায় আবছা দেখা যাচ্ছে বাসের দুপাশের জঙ্গলও ৷ স্বপন খুব আস্তে আস্তে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তোমার কি মনে হয় এই জঙ্গলে বাঘ থাকতে পারে?
এক মুহূর্ত চুপ করে করে থেকে আমি বলি, আমিও সেই কথাটাই ভাবছিলাম ৷
এবার দুজনেই হেসে ফেলি ৷ এতক্ষণ কেবল ভাবছিলাম কখন পৌঁছব নাগার্জুনকোণ্ডা ৷ এবার, চোখে দেখতে পাবার পর, মনে প্রশ্ন এসেছে যে খানিক পরে এই বাসখানি আমাদের প্রসব করে চলে গেলে তারপর কী করব ৷ জায়গাটা কি লোকালয় না জঙ্গল, থাকবার মতো কোনও জায়গা আছে না নেই-কিছুই জানি না ৷ ‘যাওয়া হবে না’ ভেবে আসবার আগে রুটচার্ট তৈরি করবার সময়ে এই বিষয়ে কোনও খোঁজখবর নেওয়া হয়নি ৷ না হলে এইসব ব্যাপারে স্বপন খুব পাকা গাইড ৷ তবে তখনও ভ্রমণ শুরু হয়নি বলে হাতের কাছে রেডি রেফারেন্স তেমন পাওয়া যেত না ৷ সুতরাং দুজনে একই কথা ভাবছিলাম-থাকবার কোনও জায়গা না থাকলে অন্তত ওই বাঁধের ওপরে তো থাকা যাবে রাতের বাকি ক’ঘণ্টা ৷ সেক্ষেত্রে ওই প্রশ্নটাই মনে আসবে-আশপাশের ঘন জঙ্গল থেকে বাঘ বেরিয়ে এসে দুই উৎসাহী প্রত্নপিপাসুকে খেয়ে যাবে কিনা ৷
কৃষ্ণা নদীর ওপরে আলো ঝলমল বাঁধ ৷ দীর্ঘ এবং বিশাল ৷ এমন উজ্জ্বল, অনেক উঁচু স্লুইস থেকে জল পড়ার শব্দে এমন মুখরিত যে শোনা যায় না ওই অনেক নিচে বহমান কৃষ্ণা কোনও দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিনা ৷ বাঁধ পার করে একটা ছোট মোড় ফিরে বাস দাঁড়াল এগারোটায় ৷ এখন দেখি বাসের অর্ধেক লোক নানাভাবে আমাদের অনেক কিছু বোঝাবার চেষ্টা করেন, কন্ডাক্টার দরজা খুলে ধরে প্রায় অবোধ স্কুলের বাচ্চা নামাবার মতো করে আমাদের নামিয়ে দেয় ৷ হাত দেখিয়ে অদূর নির্দেশ করে বলে নেহরু ইয়ুথ সেন্টার ৷ তারপর বাসে উঠে দরজা বন্ধ করে ৷ কী কাণ্ড! আর আমরা কিনা ভাবছিলাম বিদেশে, বি-ভাষার দেশে বাঘে খেয়ে ফেলবে কিনা সেটা আমাদেরই ভাবতে হবে ৷
দুখানা রুকস্যাক পিঠে গুটি গুটি পায়ে সেই ইয়ুথ সেন্টারের বাগান পার হয়ে বারান্দায় উঠি ৷ তার একপাশ ঘিরে রিসেপশন ৷ একটু ডাকাডাকি করতে এক যুবক বেরিয়ে এলেন ৷ রাতদুপুরে প্রাণী দুটিকে দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ ৷
সরি, নো রুম ৷ নো রুম ৷ অ্যাবসলুটলি ফুল ৷
প্রথমে তাঁকে ইংরিজিতে বোঝাবার চেষ্টা করি, লুক উই হ্যাভ কাম অল টু থাউজ্যান্ড মাইলস টু সি য়োর প্লেস, প্লিজ ডু সামথিং ইত্যাদি ৷ তাতেও যখন সে মানে না, মানে মানবার তার কোনও উপায় নেই, একথাই বোঝাতে চায় তখন আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে একেবারে স্পষ্ট বাংলাভাষায় বলি, বেশ, ঘর না দিলে তো নাই দিলে ৷ আমরা বাপু একেবারে আধমরা হয়ে গেছি ৷ চাদর পেতে এই খোলা বারান্দায় ঘুমব ৷ যা পার করো-সে আমার কথা বুঝুক না বুঝুক মরিয়াপনাটা বুঝতে পারে হয়তো, আর রুকস্যাক খুলে চাদর বার করাটা চোখেই দেখতে পায় ৷ এবারে একটু ব্যস্ত হয়ে স্বপনকে ডাকে, দ্যাখো ঘর একটা আছে বটে কিন্তু সেটা ভালো নয় তেমন ৷
পথে এসো, আমি মনে ভাবি ৷ স্বপন বলে, মাথার ওপর ছাদ আছে তো?
তা আছে ৷
দরজাটা বন্ধ করা যায়?
হ্যাঁ হ্যাঁ সেসব যায় ৷ একটু গুমোট বলে ব্যবহার করা হয় না ৷ মোটামুটি বারোটায় বিছানায় পড়েই ঘুমোই নাকি ঘুমিয়েই বিছানায় পড়ি বলা মুশকিল ৷
সকাল দশটায় আর বেলা একটায় লঞ্চ ছাড়বে বাঁধের গা থেকে ৷ নাগার্জুনকোণ্ডা মিউজিয়ামে যাবে ৷ এসে পড়েছি সকালেই ৷ কাল যাকে দেখেছিলাম আকাশে উড়ে পড়ছিল আলোর রেণু হয়ে আজ তাই ছটা খোলা স্লুইস গেট দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বন্দী নদীর ধারা জল ৷ বাকি স্লুইস বন্ধ ৷ অন্যধারে দিগন্ত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে জল ৷ স্থির বিশাল পূর্ণ জলাধার ৷ বাঁধের রিজার্ভার ৷ দূরে সেই জল ভেদ করে উঠেছে একেকটা পাহাড়চূড়া ৷ ওর মধ্যেই কোথাও আছে নাগার্জুনদুর্গম মিউজিয়াম ৷
বিশাল সেই জলরাশি ভেঙে লঞ্চ চলেছে ৷ মোটামুটি ভর্তি ৷ আমাদের দুজনের বসবার জায়গা একটু দূরে দূরে ৷ ফলে চুপ করে তাকিয়ে আছি জলের দিকে ৷ কত হাজার বছর ধরে বারে বারে সরে গিয়েছে, আবার ফিরে এসে এখানেই বাসভূমি গড়েছে মানুষ ৷ তার বসবাসের চিহ্ন জমা থেকেছে মাটির স্তরে স্তরে ৷ যেন নদী স্বয়ং নিজের সন্তানদের জীবনযাপনের অভিজ্ঞান লুকিয়ে রেখেছে মাটির নিচে ৷ শেষ পর্যন্ত, সবচেয়ে ওপরে ছিল তারাই সাম্রাজ্য যাতায়াতের ফাঁকে যারা সত্যি মানুষের সভ্যতায় স্থায়ী হয়ে থেকে যায়, রাখাল ছেলের দল আর তাদের ছোট ছোট গ্রাম ৷ কিন্তু সভ্যতার সেই ধারাবাহিক বিকাশের ছন্দ বজায় রাখল না বৃহৎ ক্ষমতা ৷ চাষের খেত, গো-চরের মাঠ, ছোট ছোট কুঁড়েঘর ডুবে আছে এই অতল জলের নিচে ৷ কে জানে কোথায় গেল সেই গ্রামের লোকেরা ৷
এসব কথা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছিলাম ৷ চোখে পড়ল লঞ্চের পাশে পাশে উড়ে চলেছে ছোট্ট সাদা প্রজাপতি ৷ বিস্তৃত গভীর সবুজাভ জলে ছায়া ফেলেছে তার ছোট দুটি কাঁপতে থাকা ডানা ৷ স্বপনের পাশে বসা এক ভদ্রলোক কথা বলছেন ওর সঙ্গে ৷ লঞ্চ চলেছে রিজার্ভারের অপেক্ষাকৃত বাঁদিক ঘেঁসে, সেদিকটা পাহাড় ৷ হিমালয়ের মতো নয়, ছোট ছোট পাহাড়চূড়া কিংবা একটু লম্বা পাহাড়ের দেওয়াল জেগে আছে জলের ওপর ৷ প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর লঞ্চ দাঁড়াল একটা দ্বীপ-পাহাড়ে ৷ এরই মাথায় আছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের মিউজিয়াম ৷ পুরো উপত্যকা থেকে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ সব প্রত্ন বস্তু তুলে ওই দ্বীপে আর মিউজিয়ামের ভেতরে সাজিয়ে রাখা আছে ৷
পাথরকাটা সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠছি আর অবাক হয়ে যাচ্ছি, আশপাশের প্রায় পুরো জায়গাটাই মিউজিয়ামের অংশ ৷ খোলা আকাশের নিচে অন্তত একটি চৈত্য, একটি স্তূপ সহ নয় খানা মডেল রয়েছে ৷ এসব পাওয়া গিয়েছিল এই উপত্যকার বিভিন্ন অংশে ৷ এত নিপুণভাবে মডেলগুলো তৈরি করা হয়েছে আর এত বড় সেগুলো যে মনেই হয় না এগুলো তৈরি করা জিনিস ৷ তৈরি না করাও আছে-খুঁড়ে আনা চোদ্দখানা বিরাট বড় বড় অংশ-দেওয়াল, মুনস্টোনের ওপর খোদাই করা সাতবাহন বংশের রাজারানির অসাধারণ প্যানেল, বৌদ্ধ পূর্ত শাস্ত্রানুযায়ী যক্ষ দ্বারপাল অপ্সরা ইত্যাদি ৷ আমার সাধারণ দর্শকের চোখে মনে হয় খুব মিল সেই কোন দূরের সাঁচির কাজের সঙ্গে, বিশেষত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংস্থাপনে এবং অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি কর্নাটকের বিখ্যাত বেলুড়-হ্যালেবিদ-সোমনাথপুরার সঙ্গে স্পষ্ট মিলহীনতা ৷ জানি না এটা কি শুধুমাত্র আলাদা আলাদা শিল্পধারার কারণে নাকি শরীর বিষয়ে বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাবও আছে ৷ ভাঙা অংশগুলোর মধ্যে বারে বারে চোখে পড়ছে জড়ানো প্যাঁচানো এক মাপের নকশা, রিলিফে খোদাই ৷ দেওয়ালের কোনও অংশে, ঘুলঘুলি কিংবা জানলার জাফরি হিসাবে, জল পড়ার নলের মুখের ঠিক ওপরে ৷ গাইড বললেন, এই মোটিফটা নাকি নাগার্জুনের চিহ্ন ৷ এই প্রত্নতাত্বিক চিহ্নগুলি নাগার্জুনকোণ্ডার পাহাড়ের মাথার ওপর বিস্তৃত বাগানের মধ্যে ইতস্তত সাজানো রয়েছে ৷ রয়েছে বিশাল মাপের সেইসব মডেলও ৷ এত সুন্দর স্পেসিং করে রাখা সব কিছু যে চোখকে একটুও ধাক্কা দেয় না, যে কোনও প্রত্নচিহ্নের মতোই এদেরও সামনে দাঁড়ালে উদাস বিধুর হয়ে যায় মন ৷ সমস্তটার আশপাশ জুড়ে ছড়ানো রয়েছে কোনও একটা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ৷
মিউজিয়ামের হলটাও মস্ত বড় ৷ তার বিভিন্ন অংশে সাজানো আছে নব্য প্রস্তর যুগের কিছু অস্ত্র, আরেকটু পরের সময়ে তৈরি ছোট বড় হাড়ের পুঁতি, পাথরে তৈরি তীর কি বল্লমের তীক্ষ্মফলা ৷ সভ্যতার সমবয়সীই কি সৌন্দর্যসাধন-ভাবি! সবচেয়ে অবাক করে, বিহ্বল করে দেয়, মাটির তৈজসপত্র ৷ হাঁড়ি, সরা, খুরি-ঠিক যেমনটি ব্যবহার করি আমরা এখনও ৷ সেই পেটমোটা গোলমুখ হাঁড়ি-কোনও কোনওটার তলায় কালির দাগ, তলাটা সরু ছড়ানো মুখ ছোট ছোট খুরি-কোনওটা বা আধভাঙা ৷ অদ্ভুত লাগে ৷ কারা ব্যবহার করেছিল এসব বাসন? কেমন ছিল তাদের চেহারা? কেমন ভাষা? কী নাম হত তাদের? কোথায় চলে গেছে সেসব মানুষ অথচ তাদের স্পষ্ট উত্তরচিহ্ন আজও ব্যবহার করে যাচ্ছি আমরা ৷ আবারও মনে হয় কী বিরাট এই দেশ, কী এক বিশাল মানবগোষ্ঠী হাজার হাজার বছর ধরে বাস করে আসছে এখানে ৷ বুক ভরে যায় ভালোবাসায় ৷ চিত্রিত সেইসব মৃৎপাত্র, ছোট ছোট খেলনা, লৌহ যুগের জিনিসপত্র, তারও অপেক্ষাকৃত পরের, অর্থাৎ বৌদ্ধযুগের নগর সভ্যতার সে সব নিদর্শন উঠে এসেছিল প্রত্নতাত্বিকদের সযত্ন খনিত্রের মুখে তার সবগুলিকে প্লাবন থেকে রক্ষা করবার জন্য তুলে আনা সম্ভব হয়নি ৷ কিন্তু এত যত্নে সেগুলির মিনিয়েচার তৈরি করা হয়েছে যে ভাবা যায় না ৷ ভিক্ষুদের একটি আবাস ৷ তার যে ইটের কোণটি ভাঙা ছিল, এক সেন্টিমিটার মাপের ইটের মডেলটির ঠিক সেই কোণটি ভাঙা ৷ কোথাও দুটো ইটের গায়ে কালির দাগ ছিল, হয়তো বা পঠনকালীন প্রদীপের সে কালি ৷ মডেলের ধানবীজ মাপের ইট দুটির গায়েও নিখুঁত সেই কালির দাগের অনুকরণ ৷ ১৯৫৩ সালে, দেশজোড়া দীর্ঘ তর্কবিতর্কের পর যখন নেহরু সরকার সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় সভ্যতার এই প্রাকৃতিক জাদুঘরকে ডুবিয়ে দিতেই হবে বাঁধ তৈরির প্রয়োজনে, ১৯৫৪র আগস্ট মাসে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন তাঁরা সমগ্র উপত্যকার যত বেশি সম্ভব অংশে দ্রুত ও ব্যাপক খননের কাজ চালাবেন ৷ এত আগ্রহ আর পরিশ্রমে আর কোথাও কাজ করেছেন কি আর্কিওজিক্যাল সার্ভে বিভাগ? আমি জানি না ৷ একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ ৷ এক অসম যুদ্ধেই রত হয়েছিলেন তাঁরা ৷ সময়ের সঙ্গে যুদ্ধে ৷ এ যুদ্ধে কেউ কখনও জেতে না কিন্তু প্রত্নতত্ব বিভাগের সাফল্য এই যে নিজেদের লড়াইয়ের চিহ্ন তাঁরা প্রগাঢ় মুদ্রিত করেছেন ৷ ভারতবর্ষের উত্তর-দক্ষিণে বেশ কিছু জায়গায় আমরা ঘুরেছি দেখেছি প্রত্নতত্ব বিভাগের আরও অনেকগুলি মিউজিয়াম-নিঃসন্দেহে বলা যায় এই মাত্রার কাজ আর কোথাও দেখিনি ৷ সত্যিই অভাবনীয়, হলের মাঝখানে গড়ে রাখা ডুবে যাওয়ার আগে যেমন ছিল, তিনদিকে পাহাড় ও চতুর্থ দিকে কৃষ্ণা নদী ঘেরা সেই সমগ্র উপত্যকাটির মডেল থেকে শুরু করে ওই যে বললাম, একেকটি ইট পর্যন্ত ৷
মডেলে গড়া ছিল, ফটোগ্রাফেও প্রদর্শিত ছিল নদীতে নেমে আসা একটি বিশাল ঘাট ৷ সাদা পাথরে তৈরি ৷ কয়েকটি করে ধাপ তারপর বিরাট চাতাল, আবার কয়েকটি ধাপ ৷ অনেক বড় জায়গা না নিয়েও সুকৌশলে সাজানো সিঁড়ির ধাপগুলো সমস্তটাকে এক বিস্তৃতি দিয়েছে ৷ খুব ছোট ছোট ধাপ ৷ প্রশস্ত কিন্তু উচ্চতায় খুব ছোট, যেমনটি শোভা পায় রাজকুমারীদের সৌকুমার্যে কিংবা দরকার হয় স্থবির জ্ঞানবৃদ্ধ কোনও আচার্যের প্রবীণতায় ৷ কারা নামতেন এই সিঁড়ি বেয়ে কৃষ্ণার জলে? কাকলিমুখর রাজগৃহবাসিনীর দল? নাকি স্তূপের কাছে মঠে বসবাসকারী বয়োবৃদ্ধ আচার্য আর তাঁদের ঘিরে তরুণ জ্ঞানপিপাসু সংসার ত্যাগী শিষ্যেরা? কোথায় থাকত গ্রামবাসীরা? সম্ভ্রম আর দূরত্ব নিয়ে কোথায় তারা স্নান করত? কেমন করে সেচ দিত নিজেদের ফসল খেতে? ফিরে আসবার পথে সবচেয়ে বেশি করে আমার মনে পড়তে থাকে এই ঘাটটার কথাই ৷
এপারে পৌঁছে দিল লঞ্চ ৷ ভালোলাগা না বিষণ্ণতা-নাকি দুটোয় মিলেই কেমন যেন ভার হয়ে থাকে মন ৷ ইয়ুথ সেন্টারে ফিরে স্নান করে খাবার টেবিলে আসি ৷ পাশে এক ভদ্রমহিলা আর তাঁর স্বামী ৷ লঞ্চেও ছিলেন এঁরা ৷ আমরা একসঙ্গেই ঘুরছিলাম নাগার্জুনদুর্গম মিউজিয়ামে ৷ বয়স্ক দম্পতি ৷ সৌম্য চেহারা, খুব স্নেহময় ব্যবহার ৷ মহিলা হায়দ্রাবাদের কোনও কলেজের অধ্যাপিকা ৷ ইংরিজি বলেন ৷ আমাদের গতকালকের অভিযানের কথা শুনে খুব হাসলেন দুজনেই, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, এখন এখান থেকে কোথায় যাবে তোমরা? বাস ধরে বিজয়ওয়াড়া গিয়ে সেখান থেকে আবার মাদ্রাজের ট্রেন ধরব শুনে বললেন, সেকি! এতদূর এসে সালার জং মিউজিয়াম না দেখে চলে যাবে?
কি করব! সব তো একেবারে হবে না ৷
না-না-এটা তো একেবারে এসেই পড়েছ ৷ যে বাস তোমাদের এখানে নামিয়ে দিয়েছে সেটাই তো সোজা হায়দ্রাবাদ যাচ্ছে ৷ ছ ঘণ্টার রাস্তা ৷ যতটা সময়ে বিজয়ওয়াড়ায় পৌঁছবে সেই একই সময়ে পৌঁছে যাবে হায়দ্রাবাদ ৷ তোমরা এত কাণ্ড করে নাগার্জুনকোণ্ডা দেখতে এসেছ, সালার জং দেখবে না? ইট ইজ আ রিয়াল এক্সপিরিয়েন্স-জানি তো সবই ৷ সালার জং দেখবার ইচ্ছা কি আমাদেরও কম? কিন্তু, এই কিন্তুর খুঁটিটা যেন একটু নড়বড়ে হয়ে পড়ছে ভদ্রমহিলার উৎসাহ সিঞ্চনে ৷ এত সহজ সালার জং যাওয়া! দুপুরবেলা বিজয়ওয়াড়ার বাস ধরার বদলে রাতে হায়দ্রাবাদের বাস ধরা? তাহলেই হায়দ্রাবাদ-তারপরই সেই ইসাবেল যার শ্বেতপাথরের ওড়না বাতাসে উড়ে শ্বেতপাথরের গালে লাগলেও চিবুকের ডৌলটি বোঝা যায়, একই কাঠে পিঠোপিঠি পরুষ আর লাবণ্য, শয়তান ও কুমারী, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ব্যান্ডপার্টি বেরিয়ে আসা ঘড়ি আরও হাজারটা আশ্চর্য জিনিস! কারিগরদের হুনর ৷ সেখান থেকে বিকেল সন্ধের কোনও একটা ট্রেন ধরে পরের ভোরে মাদ্রাজ ৷ কী আর এমন খারাপ? ব্রেক জার্নি তো হয়েইছে ৷ যতটা রাস্তা এসেছি তাতে কাল রাত পর্যন্ত আমাদের টিকিটের ভ্যালিডিটি রয়েই যায় ৷
তবে আর কী! তাই ঠিক হল ৷
বিকেলে আরেকবার গেলাম বাঁধের ওপর ৷ উত্তরদিকে, বাঁধের রিজার্ভারের পাশ ধরে বিরাট বড় ল্যান্ড ডাইক ৷ মাটির প্রাচীর ৷ তার ওপর ঘাসের সবুজ কেয়ারি দিয়ে নাগার্জুনসাগর লেখা ৷ এই ডাইকের ভার রিজার্ভারের বিপুল জলের চাপ সামলাচ্ছে ৷ ওপারে ছোট বড় অনেক পাহাড়ের চূড়া ৷ ওরই মধ্যে কোথায় আছে সেই নাগার্জুনদুর্গম ৷ থাকবারও দুটো জায়গা আছে সেখানে, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে মিউজিয়ামগুলোর যিনি অ্যাসিস্টেন্ট আর্কিওলজিস্ট তাঁর হাতে একটা ৷ সেটা বোধহয় মূলত সরকারি অফিসারদের জন্য, গুন্টুর জেলায় দক্ষিণ বিজয়াপুরি থেকে তার বুকিং হয় ৷ অন্যটা কিন্তু ভ্রামণিকদের জন্যই, সেটার ব্যবস্থা করে দেন নাগার্জুনকোণ্ডা বাঁধের জনসংযোগ আধিকারিক ৷ তাঁর অফিসের ঠিকানা লেখা আছে বিজয়াপুরী-উত্তর ৷ ও হরি! বিজয়াপুরী তাহলে এই জায়গাটাই! এপারটা নালগোণ্ডা জেলা, ওপারে গুন্টুর ৷ যেমন আমাদের ঘরের কাছের মাইথন, এপারে পশ্চিমবাংলা ওপারটা বিহার ৷
কিন্তু এসব কথা যদি কাল জানা থাকত! যদি কোনওরকমে ব্যবস্থা করে আসতাম ওই অতিথিশালায় রাত কাটানোর! ইস, ঘুম ভাঙলেই ‘জলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ প্রবাল দিয়ে ঘেরা’ ৷ থাক থাক বেশি লোভ করতে নেই, যা দেখেছি তাও তো পাবার কথা ছিল না ৷ ওই সাহসটুকু না করলে কী অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত থাকতাম ৷
রিজার্ভারের জলের ওপর লাল হয়ে পড়েছে অস্তসূর্যের আলো ৷ ওপাশে কৃষ্ণার বহমান জলে নেমে এসেছে অন্ধকার ৷ গতকাল এমনই সময়ে আমরা আশা করা অনিশ্চিতি নিয়ে ছুটন্ত বাসে বসেছিলাম ৷ আর আগামীকাল এমনই সময়ে আমরা সালার জং দেখে ফেলেছি ৷ যুবকেন্দ্রে ফেরবার মুখে কানে এল পাশের মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং ঢং ৷ মধুর গম্ভীর শব্দ যেন নিস্তব্ধতার ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে দূর পর্যন্ত চলে গেল ৷ সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে ৷
গেটের চৌকিদার মানুষটি বেশ ৷ ভাঙা ভাঙা ইংরিজি বলেন ৷ বললেন, কোনও চিন্তা নেই, তোমরা খেয়েদেয়ে আটটার সময়ে ঘুমিয়ে পড়, বারোটার সময়ে আমি ঠিক ডেকে দেব ৷ সাড়ে বারোটায় বাস ৷
জায়গা পাব বসার?
শোবার জায়গা পাবে ৷ বিলকুল খালি যায় ৷
আমাদের কি তেমন পুণ্য, আটটায় খেয়ে শুলেই ঘুমব? বৃদ্ধ ভালোমানুষটি সকলকে নিজের মতো পাপহীন ভেবেছেন ৷ আমরা সুতরাং, সে চেষ্টা না দিয়ে কফি খাওয়া, পিকচার কার্ড কেনা ইত্যাকার কাজে ব্যস্ত হলাম ৷ দশটায় শুয়েছি ঠিকই, ঘুম কি আসে! আর এগারোটায় চোখ লাগতেই সাড়ে এগারোটায় দরজায় ডাকাত পড়া ধাক্কা ৷
কি হয়েছে? কি হয়েছে?
ধড়মড় করে উঠে দরজা খুলি ৷ চৌকিদার ৷
সাড়ে বারোটায় তোমাদের বাস যে? তৈরি হয়ে নাও ৷ সে বেচারি তো ঠিকই করেছেন ৷ একঘণ্টা লাগে যদি-এত জোরে তা বলে? কী করা যাবে, মানুষটি নিজে একটু কানে খাটো ৷
সাড়ে বারোটায় ঝকঝকে স্টেট বাস এল, সত্যিই ফাঁকা ৷ কিন্তু ট্রেনের ফাঁকা বার্থ পেলেই যেমন শুয়ে পড়া যায় বাসে যে সেটা যায় না এটা শেখা হয়নি আগে ৷ লম্বা লম্বা রেক্সিনে মোড়া ফাঁকা সিট, গদি-আঁটা, দেখে কি খুশিই না হলাম, শোব আর ঘুমোব ৷ জেগে উঠলেই হায়দ্রাবাদ ৷ ‘আশার ছলনে ভুলি-’ সিন্থেটিক শাড়ি আর সিটের রেক্সিন যে মিলেমিশে ঘুমোনোর বদলে পরস্পরকে ঠেলতে থাকে ভাবিনি ৷ চলতে চলতে বাসের গতি যতবার একটু কম হয় কিংবা বাস ব্রেক কষে ততবার আমি পরশুরামের সেই বর্ণনার মতো ‘সড়াক করিয়া’ ভূতলে অবতীর্ণ হই ৷ উঁকি দিয়ে দেখলাম স্বপনের সিটে আরও একজন আছেন, দুজনে পরস্পরের ঘাড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে ৷ যাহোক উঠে বসে নানারকম কায়দায় ঘুম ও ঘুম-ভাঙা করতে করতে হায়দ্রাবাদ ৷ সকাল ছটা ৷
কালকের সেই ভদ্রমহিলা বলেছিলেন একটা হোটেলের নাম ৷ বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা রিকশা ধরে সেই হোটেলে গিয়ে হাজির ৷ একটা ঘর দিলেন ওঁরা, এও বলে দিলেন সন্ধ্যাবেলা এখান থেকে মাদ্রাজ যাবার ট্রেন আছে ৷ আমরা সাড়ে ছটায় ঘরে ঢুকেই ঘুম-রাতের শোধ তোলার চেষ্টায় ৷ পরপর দুরাতের অ্যাডভেঞ্চারে চোখ জ্বালা করছে ৷ গা-হাত-পায়ে ব্যথাও করছে খানিকটা তবে মনে খুব উৎসাহ ৷
দশটায় জলখাবার খেয়ে রিকশা নিয়ে সোজা সালার জংয়ের উদ্দেশে রওনা হলাম ৷ মহীশূরে আছে জগমোহন আর্ট গ্যালারি, সে নাকি মহীশূররাজের দেওয়ানের ব্যক্তিগত শিল্পসংগ্রহ ৷ বিশাল বড় নয় সত্যি কিন্তু অসাধারণ সংগ্রহ ৷ অতগুলো রঙিন গগনেন্দ্রনাথ আর কোনও সংগ্রহশালায় আছে কিনা জানি না ৷ তাছাড়াও ছবি আর ভাস্কর্যের মুগ্ধ করে ফেলা সম্ভার ৷ তিনদিন ধরে মহীশূরে আমরা কেবল জগমোহনই দেখেছিলাম ৷ মহীশূর প্যালেস আমার একটুও ভালো লাগেনি ৷ দুশো তিয়াত্তর মন সোনা দিয়ে তৈরি সিংহাসন, সোনার থাম রুপোর দরজা-খুব স্থুল দেখানেপনা মনে হয়েছিল ৷ কল্যাণমণ্ডপের দেওয়ালে কিছু ভালো পেইন্টিং আছে বটে কিন্তু একথা তা ভোলা যায় না যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়া টিপু সুলতান, হায়দার আলির মৃত্যুর পর যারা ক্ষমতা পেয়ে এই সোনা রুপোর সিল্ক ব্রোকেডের ছড়াছড়ি করেছিল সেই রাজবংশ ছিল আসলে ব্রিটিশের পেটোয়া! আনুগত্যের ইনাম হিসাবেই বিদেশি প্রভুদের কাছ থেকে তারা ওই রাজত্ব পেয়েছিল ৷ বিশেষত সে কারণেই ওই প্যালেসের থেকে জগমোহনের ছবি আর ভাস্কর্যের টান আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রবল ছিল ৷ আর সালার জং! বিশালতায়, বৈচিত্র্যে, খ্যাতিতে তার সঙ্গে জগমোহনের তুলনাই হয় না ৷
বাগানের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম ৷ শিকলে জড়ানো বড় বড় তিনখানা তালা ঝুলছে ৷ কী ব্যাপার? এগারোটাতেও মিউজিয়াম খোলেনি? দারোয়ান এগিয়ে আসেন, কোথা থেকে এসেছেন? বঙ্গাল থেকে? ও কালকে সাগরে ছিলেন? শুধু সালার জং দেখতেই এসেছেন? এ হে হে, বড়ি আফসোস কী বাত! এখন তিনদিন মিউজিয়াম বন্ধ ৷ আজকে দশেরার ছুটি, কালকে সোমবার, সেদিন ভারতবর্ষের সব মিউজিয়াম ছুটি থাকে, তারপর দিন মহরম ৷
একেবারে নিখাদ নির্ভেজাল ক্যাবলা হয়ে তালাগুলোর দিকে তাকিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি ৷
আবার হোটেলে ফেরা ৷ মুখ ব্যাজার হবার ইংরিজি যদি হয় ‘মুখ লম্বা হওয়া’ তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের মুখ আমাদের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হয়ে গিয়েছিল তখন ৷ হঠাৎ মনে হয় সাংঘাতিক রকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছি ৷ কিন্তু ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না ৷ আমাকে হোটেলের লাউঞ্জে বসিয়ে স্বপন যায় এধার ওধার একটু খোঁজখবর নিয়ে আসতে ৷ সন্ধের ট্রেনের রিজার্ভেশন হোটেল থেকেই হয়েছে ৷ এই তাহলে নিজামের হায়দ্রাবাদ, নিজামবিরোধী কৃষক আন্দোলনের জায়গা ৷ এখানেই তাহলে সেইসব বিখ্যাত নিজাম প্যালেস ইত্যাদি ৷ নানারকম শাহী তহজীব এখানকার লোকেরা এখনও অভ্যাস রেখেছেন ৷ তাছাড়া এখনও আছে হায়দ্রাবাদি গোস্ত, হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি ৷ শহরে একটা চক্কর লাগানো যাক, বলে আমরা একটা টাঙা নিয়ে বেরলাম ৷ শহর আসলে দুটো, হায়দ্রাবাদ আর সেকেন্দ্রাবাদ ৷ দুটোই বেশ ঘিঞ্জি মতো, পুরনো, অথচ কী একটা আকর্ষণ আছে ৷ সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজস (CIEFL)-এ গেলাম, অসামান্য সুন্দর ক্যাম্পাস ৷ এত গাছপালা, সাজানো বাগান, অগোছালো তৃণভূমি তার মধ্যে বাড়ি ৷ জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস দেখলাম বাইরে থেকে ৷ কী বিরাট, কত খোলা ছড়ানো গাছপালা ভর্তি! কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য মন খারাপ তো হবেই ৷ কিন্তু আমি দেখতে চাই পুরনো বাড়িঘর, সেসব টাঙাওয়ালা কিছুই দেখাচ্ছে না, বললে কেবল বলছে, পুরনো হাভেলি সব অনেক দূর দূর জায়গায় ৷ সেসব দেখতে সময় লাগবে ৷ শেষে নিয়ে গেল হুসেন সাগর দেখাতে ৷ বাহমনি আমলে এই বিশাল হ্রদ খোঁড়া হয়েছিল, সেসব বৃত্তান্ত ভ্রমণ-এর পাঠকরা বিলক্ষণ জানেন ৷ আমি কেবল মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম এর বিস্তার ৷ ওপারে হ্রদের গা ঘেঁসে রেললাইন ৷ কাছে দূরে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে ৷ একে যে হ্রদ, সরোবর এসব কিছু না বলে সাগর বলে তাতে খুব বেশি অত্যুক্তি নেই ৷ পাখি উড়ছে জলের কিনার ঘেঁসে ৷ কতদিন হয়ে গিয়েছে, কত মানুষের ব্যবহারের জল আর সৌন্দর্যের শান্তি দিয়েছে এই জলবিস্তার ৷
দুপুরের রোদ বেশ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে ৷ ফিরে হোটেলের দরজায় নেমেছি, চোখে পড়ল একটু দূরে লাল-সাদায় রং করা গম্বুজ তোলা কী একটা বাড়ি ৷ তখন থেকে পুরনো প্রাসাদ খুঁজছিলাম, শেষপর্যন্ত কাছাকাছির মধ্যেই একটা দেখা গেল যা হোক ৷ ছোট তো কি হয়েছে? একটু দেখে আসব চট করে? কী সুন্দর লাল-সাদা দুটো গম্বুজ দেখা যাচ্ছে! রিসেপশনের ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করি, কি প্রাসাদ ওটা?
প্যালেস? এখানে? কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে আসে সেই ফিটফাট ছেলে, আমার নির্দেশমতো ঝুঁকে দেখে সদর দরজার বাইরে ৷ তারপর ভেতরে এসে আমাকে বোধহয় আপাদমস্তক দেখে নিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় ৷ ইংরিজিতে যাকে বলে ইনডিগন্যান্ট সেরকম মুখ করে বলে, দ্যাটস কাচ্ছিগুডা রেলওয়ে স্টেশন ম্যাম, নো প্যালেস ৷
বেশ বেশ, তাতে কি হয়েছে? তোমাদেরই বা রেলস্টেশনে অত কায়দার বাড়ি বানানো দরকার কী!
সন্ধে সাতটায় ট্রেন ৷
অত কাণ্ড করে রিজার্ভেশন করানোর কোনও মানেই হল না, সবগুলো কোচই বেশ ফাঁকা ৷ আটটায় ট্রেন ছাড়ল ৷ দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম হুসেন সাগরের জলের ওপর ঘন অন্ধকার ৷
পরদিন সকালে মাদ্রাজ স্টেশনে ৷ ভাঙা যাত্রা শেষ হল ৷ আজ সন্ধ্যায় আগেকার কথামতোই চলে যাব ব্যাঙ্গালোর ৷ মাঝখানে রইল কৃষ্ণার বিপুল জলে ঘেরা, কৃষ্ণার জলে ডুবে যাওয়া নাগার্জুনসাগর ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন