অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
একাই চলেছি শোনপুরের মেলায় ৷ শীতের রাতের ট্রেন ৷ কম্পার্টমেন্টের অনেকই শুয়ে পড়েছেন ৷ কেউ কেউ শোবার ব্যবস্থা করছেন ৷ শুনেছি বহু মানুষ এই মেলায় যান ৷ তাই সারা কম্পার্টমেন্টটা খুঁজে এলাম যদি একজন বাঙালি পাই ৷ নিরাশ হয়ে এসে বসলাম নিজের জায়গায় ৷
এই মেলায় এমন সব জিনিস কেনাবেচা হয় শুনেছি যা অন্য কোনও মেলায় হয় না! এই মেলায় কোটি টাকার ব্যবসা হয় ৷ শুনেছি হাতি, ঘোড়া, উট, গরু ইত্যাদির সঙ্গে মানুষও নাকি বিক্রি হয়!
দশ-এগারো বছর আগে একজন নামকরা সাংবাদিক এই মেলা থেকেই তো একটি মেয়ে কিনে নিয়ে গিয়ে দিল্লিতে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ৷ পার্লামেন্টেও এ বিষয়ে কথা হয়েছে, তর্ক উঠেছে ৷ অবশ্য পরিণামে ওই সাংবাদিক ভদ্রলোককে অনেক বিপদে পড়তে হয়েছিল ৷ এবং হুবহু এই ঘটনা নিয়েই নাটক ও সিনেমাও হয়েছে ৷
ভোর হয়ে আসছে ৷ আজ রাস পূর্ণিমা ৷ ভোরের আকাশে পাখা মেলেছে অসংখ্য পাখি ৷ সূর্য উঠছে ৷ মাঠে মাঠে ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে এই সকালেই ৷ মাঠে মাঠে চলছে ধান ঝাড়াই ৷ আবার বাঁকে করে, গরুর গাড়িতে বোঝাই হয়ে পাকা ধানের বোঝা চলেছে গ্রামের পথে ৷ নবান্নের মাসের পূর্ণতা চারদিকে ৷
রাতে ট্রেন লেট চলছিল, এখন স্পীড ভালোই ৷ হাতিয়ারার ঠিক পরেই পেলাম লোহার বিশাল রেলব্রিজ ৷ প্রায় এক মাইল লম্বা ৷ তলায় কী নদী? সহযাত্রী বৃদ্ধ বললেন-গঙ্গা আর নারায়ণীর সঙ্গম ৷
সঙ্গম মানেই তো পুণ্যক্ষেত্র, আজ পুণ্যতিথিও বটে ৷ সুতরাং অসংখ্য মানুষ পুণ্যস্নান করছে ৷ বালির চড়ায় চলছে চড়ুইভাতির আয়োজন ৷ মানুষ পায়ে পায়ে পারাপার হচ্ছে ৷ বেশিটাই বালির চড়া ৷
ব্রিজ পেরিয়েই রাজেন্দ্রপুল ৷ সিমারিয়া, বারাউনি পেরলাম ৷ ডুবায় বৈশালী সুপারফাস্ট আমাদের থামিয়ে এগিয়ে গেল দুরন্ত গতিতে ৷
একসময় লক্ষ লোকের ভিড়ে পূর্ণ শোনপুর স্টেশনে নামলাম ৷ ওভারব্রিজ পেরিয়ে স্টেশনের বাইরে এলাম ৷ মানুষ আর মানুষ ৷ ধুলো-শব্দ-ব্যস্ততা ৷
বৃথাই এই ভিড় ঠেলে বোঝা বয়ে বেড়ালাম ৷ ভিড় ঠেলে এক-পা এক-পা করে হাঁটতে হচ্ছে ৷ মাইল দেড়েক অযথা হয়রানি হল ৷
শোনপুর স্টেশনের আগে অন্তত মাইল দুয়েক আগে থেকে চোখে পড়েছে মেলার বিশাল ব্যাপ্তি ৷
আমাকে দেখে মণি মহারাজজির (স্বামী সত্যেশ্বরানন্দ) কী আন্তরিক আপ্যায়ন! সন্ন্যাসীদের কাছে এমন ব্যবহার পেয়ে বিস্ময়ে আনন্দে মূক হতে হয় ৷ এসেছি মেলায় ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের চিকিৎসাকেন্দ্রে ৷
স্বামীজি তাঁর সেবক তপন নামে এক যুবককে বললেন রিকশার জন্য ৷ আর বললেন, রিকশা তো এতদূরে আসতে পারবে না, আমবাগানের মুখে রেখো ৷ আর এঁকে নিয়ে গিয়ে স্নানাহারের ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি ৷ তারপর একটু বিশ্রাম করেই নিয়ে চলে আসবে এখানে ৷ অভিজিৎকে বলে রেখেছি ওকে মেলাটা ঘুরিয়ে দেখাবে ৷
মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা ধরে রিকশা ছুটে চলেছে ৷ ঘোড়াপট্টি, সরকারি কিছু অফিস-কাছারির বন্ধ বাড়ি, মেলার জন্য বসানো বনদপ্তর, মেলাদপ্তর, ভলান্টিয়ার ও পুলিশদের বহু টেন্ট-বিশাল বিশাল আমগাছের ছায়ায় ছবির মতো লাগছে টেন্টগুলোর রংবাহার ৷
স্বামীজির আশ্রয়ে পৌঁছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্নানাহার শেষ করে বেরিয়ে পরলাম ৷ হাঁটাপথে পৌঁছলাম স্বামীজির দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্রে ৷ সময়মতোই অভিজিৎ এল আমার জন্য, সঙ্গে ওর বন্ধু অবোধ গুপ্তা ৷ পরিচয়পর্ব শেষে আমরা মিশে গেলাম মেলার ভিড়ে ৷
রাস্তার দুপাশে অসংখ্য দোকানপাট ৷ পুলিশ ভলান্টিয়াররা খুবই ব্যস্ত ভিড় সামলাতে ৷ খড়ের দোকান বোধহয় কয়েক একর জুড়ে ৷ সেইসঙ্গে ভুষি, খইল, গুড় আর মাটির বিশাল বিশাল ডাবা-যাতে গরু-মোষকে জাবনা দেওয়া হয় ৷ মাটির হাঁড়ি, কলসি, গ্লাস, থালা, হাতা ইত্যাদিরও প্রচুর দোকান ৷ গরিব মানুষরা মেলায় এসব কিনেই সাময়িক সংসার সামলাচ্ছে ৷ এরপরেই ছাতু, ছোলা, গুড়, চিঁড়ে, দইয়ের দোকান ৷ এবার গরু, বাছুর, মোষ, ছাগল, শুয়োর, মুরগি, হাঁসের বাজার ৷ গন্ধে টেকা দায় ৷ বাঁদিকে পাঞ্জাবি গরুর বাজার ৷ বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, তেমনই গরু-বাছুরগুলোর চেহারা-চোখ ফেরানো যায় না ৷
হাতিবাজার দুটি-সওদাগরি আর জমিদারি ৷ প্রথম বাজারের হাতি ভারি কাজের জন্য, দ্বিতীয়টি থেকে হাতি খরিদ করেন সম্পন্ন গৃহস্থ বা জমিদার শ্রেণীরা ৷ দুই বাজারেই হাতি এসেছে প্রচুর ৷ একটিও শিশু হাতির দর্শন পেলাম না ৷
এরপর মিনাবাজার, কালীমন্দির, কালীঘাট (মন্দিরসংলগ্ন ঘাট) ঘুরে ঘুরে এসে পৌঁছলাম হরিহরনাথজির মন্দিরের সামনে ৷ আটকে পড়েছি পুলিশের দড়ির ব্যারিকেডে ৷
তপনকে সঙ্গে নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু স্বামীজিই বলেছিলেন ‘আমরা এখানে এসেই মন্দির দর্শন ও মেলা দেখা সেরে নিয়েছি ৷’ সুতরাং আর বলতে পারিনি ৷ অবিবাহিত, সহজ, আন্তরিক যুবক তপন আশ্রমের কাজে সবসময়েই এক পায়ে খাড়া ৷ তাই স্বামীজির খুবই স্নেহের পাত্র ৷
লক্ষ মানুষের ভিড়, মাইকের বিভিন্ন বিচিত্র চিৎকার, মানুষের আনন্দ-বিষাদ, লাভ-লোকসানের হিসেব দেখতে দেখতে ভুলে গেলাম তপনের কথা ৷ কি বিশাল আয়তন মেলার!
এতক্ষণ আটকে থেকে অভিজিৎ বলল, এভাবে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে চলুন আমরা মেলার আরও কিছুটা দেখে নিই, ভিড় একটু কমুক ৷
আমার সামনে অভিজিৎ, পিছনে অবোধ ৷ পুরনো রেলব্রিজের তলা দিয়ে গঙ্গার পার ধরে মূল মেলার দিকে এগিয়ে চলেছি হাতিবাজার ডানদিকে ফেলে ৷ মেলায় জলের ব্যবস্থা, ব্লিচিং পাউডারের ব্যবহার দেখার মতো ৷ কিন্তু পয়ঃপ্রণালী এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা একেবারেই অপর্যাপ্ত ৷ ধুলো, ধোঁয়া, অসংখ্য মানুষের মিলিত কোলাহল, মাইকের চিৎকারে, কারুর কথাই কেউ শুনতে পাচ্ছি না ৷
নাটক, পুতুলনাচ, বাঈনাচের আসর, এছাড়াও আছে নানারকম ‘গানা’-‘বাজনা’-র আসর ৷ দরিদ্র, খঞ্জ, ভিখারি, লেংটিসর্বস্ব সাধুর যেন মিছিল এদিকটায় ৷ সেইসঙ্গে জটলা ৷ ফিসফাস কথা ৷ চোখে-মুখে সন্ত্রস্ত ভীতভাব ৷ তবে কি…
আমার প্রশ্নের উত্তরে সঙ্গীবন্ধুরা বলল, ‘না, এখন আর ঠিক এমন কিছু হয় না ৷ আগে হয়তো হত-’ ওদের কথার সুরে যেন একটু ক্ষোভের প্রকাশ পেলাম ৷
রাস্তার দুপাশ জুড়ে ময়লা ৷ অবোধ বলল-রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলুন, না হলে ময়লায় পা দিয়ে ফেলবেন ৷
আবার এক জায়গায় দেখলাম ওইরকমই জটলা ৷ গরিব কটি ছেলেমেয়ে কিশোরী বসে আছে খড়ের বিছানায় খোলা আকাশের নিচে ঝোপের পাশে, সকলেরই ম্নানমুখ ৷ সঙ্গের বয়স্ক মানুষরা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বাতচিত করছে ৷ আমাকে শিশুদের দিকে এগোতে দেখেই সঙ্গী দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল-ও কিছু না, মেলা দেখতে আসা দেহাতি মানুষ-হারিয়ে যাবার ভয়ে এক জায়গায় জড়সড় হয়ে রয়েছে ৷ দেখছেন তো এই শীতেও কিছু নেই ওদের গায়ে! চলুন, আমরা এবার মন্দিরের দিকে যাই-সন্ধ্যাপুজো দেখা যাবে ৷
পা এগোতে চায় না তবু এদের কথায় এগিয়ে চললাম ৷ অজানা থেকে গেল এই পর্বটা ৷ ওরা আমাকে থামতে বা কৌতূহলী হতে দিল না ৷ জিলাইবি পুরির দোকান থেকে দামি রেস্টুরেন্ট ৷ শয়ে শয়ে দোকান-খুন্তি থেকে তরোয়াল, শাল-শাড়ি-কম্বল-রেডিমেড পোশাক ৷ যাত্রা-থিয়েটারের রাজা-রানির রাজকীয় জরির পোশাক, বাঁশি থেকে মাদল, লোহার বেড়ি থেকে বর্শা, বল্লম, কাঠ আর স্টিলের আলমারি থেকে ভারি জমিদারি সিন্দুক ৷ কাচের চুড়ি থেকে রুপো, ঝুটো থেকে খাঁটি মুক্তো, হজমি গুলি থেকে বাত-ভালো, রামায়ণ-মহাভারত থেকে কামশাস্ত্র শিক্ষা, পুজোর বিশাল বিশাল বাসনকোসন, পুজোর সামগ্রী, খাট-পালঙ্ক, ছাতা-ছড়ি-লাঠি ৷ ভাত-মাছ-মাংস-রুটি-পরোটার দোকান ৷ ভিড়ে ভিড় ৷ ঠেলাঠেলি ৷ তরুণী বধূকে মেলা দেখতে আনা অতিরিক্ত স্মার্ট যুবক, কোলে-কাঁখে-হাতে সন্তান নিয়ে হতদরিদ্র মা ৷ পুলিশ ভলান্টিয়ারদের অপ্রয়োজনীয় ব্যস্ততা ৷ আবার পুলিশের দড়ির বেড়াজাল ৷ এবার মন্দিরের বাঁদিকের সরু রাস্তাটুকু দিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম মন্দির চত্বরে ৷ এদিকে পুজোর ভোগ এবং ফুল, ধূপ, বাতি ইত্যাদির দোকান ৷ অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ৷ এত বড় মেলা আর আয়োজন যাকে নিয়ে সেই হরিহরনাথজির মন্দিরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আর আলোকসজ্জাও খুবই নগণ্য ৷ আলো-ছায়া সমান সমান ৷
মাঝখানে মন্দির, মন্দিরের চারদিকে বাঁধানো উঠোন ৷ উঠোনের চারদিক ঘিরেই মন্দির কমিটির একতলা বাড়ি, অতিথিশালা ইত্যাদি ৷ একপাশে দোতলায় খানতিনেক ঘর-এগুলি মন্দিরের প্রধান মোহান্ত স্বামী অবোধ কিশোরজির গদি ৷ উঠোনের একপাশে পুলিশ ক্যাম্প ৷ উচ্চ পদাধিকারীরা এখন ক্যাম্পে আছেন ৷ মন্দির-বাড়ির ছাদেও সর্বত্র পুলিশ পাহারা ৷ দেখেশুনে মনে হচ্ছে যেন পুলিশেরই কোনও অনুষ্ঠানক্ষেত্র এটি ৷
অনুমতি নিয়ে ছাদে ওঠা গেল ৷ মন্দিরের কারুকার্য স্থাপত্য আর পাঁচটা মন্দিরের মতো হলেও চূড়ার দিকটা প্রথম দর্শনে মসজিদের মতোই লাগছে ৷ অবশ্য মন্দিরের চূড়ায় ত্রিশূল, মঙ্গলঘট ধর্মধ্বজা ইত্যাদি দেখে সে ভ্রম দূর হয় ৷ সুবেদার রাজা মান সিং একসময় ভগ্নপ্রায় এই মন্দিরের সংস্কার করিয়েছিলেন ৷ সেই সূত্রেই কি মুসলিম স্থাপত্যরীতির কিছুটা প্রভাব পড়েছিল!
পরবর্তীকালে অবশ্য বিহারের এক ধনী জমিদার রাজা রামনারায়ণও মন্দিরের সংস্কার সাধন করেছিলেন ৷ এবং ইদানীংকালে বিড়লারাও অনেক কিছু করেছেন ৷ তবু মন্দিরের আদলটি পূর্ণ হল না কেন!
কয়েকজন ভক্তপরিবৃত হয়ে মোহান্তজি কথাবার্তা বলছেন ৷ দীর্ঘ ঋজু চেহারা, মাঝারি রং, সুন্দর শান্ত চোখ-মুখ ৷ গায়ে খ্রিস্টান ফাদারের মতো আলখাল্লা-তবে ক্রিমরঙের ৷ গলায় ঝুলছে ছোট রুদ্রাক্ষের মালা ৷
অভিজিতের কথায় মোহান্তজি সানন্দে রাজি হলেন আমাকে কিছুটা সময় দিতে ৷ সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন ওঁর অতিথিশালায় ৷ চায়ের ব্যবস্থা করলেন ৷ হিন্দি-ইংরিজি মিশিয়ে কথা বলছেন ৷ বেশ আধুনিক শিক্ষিত এবং খোলা মনের মানুষ ৷
মোহান্তজি বেশ আন্তরিকভাবে কথা বলছেন, প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছেন ৷ বললেন, মেলা তো এখন পঁচিশ শতাংশ মাত্র বেঁচে আছে ৷
সবিস্ময়ে ভাবছি এই যদি মাত্র পঁচিশ ভাগ হয় তবে অতীতের সে সম্পূর্ণ মেলার বিস্তৃতি ও জাঁকজমক কেমন ছিল! অন্যান্য আড়ম্বর আয়োজনের সঙ্গে পরমাসুন্দরী সুকণ্ঠী বহু নামী বাঈজি যেমন আসত, তেমনই আসত রূপোপজীবিনীরা ৷ তখনকার দিনের ধনী শৌখিন ব্যক্তিদের মধ্যে পড়ে যেত এইসব মেয়েদের নিয়ে প্রতিযোগিতা ৷ সে প্রতিযোগিতায় কখনও কখনও বহু প্রাণ, সম্পদ, আভিজাত্য জ্বলে পুড়ে যেত ৷ যাইহোক, মোহান্তজির কাছ থেকে শোনপুরের মেলা তথা হরিহরনাথজির পৌরাণিক কাহিনী শুনতে চাইলাম ৷ মোহান্তজি সানন্দেই শোনালেন যতটা সম্ভব ৷
পুরাণে হরিহরক্ষেত্রকে ‘মহাক্ষেত্র’ বলা হয়েছে, কারণ এখানে ভগবান বিষ্ণু অর্থাৎ হরি এবং হর (শিব)-এর মূর্তি বিরাজ করছে ৷ হরি এবং হরের মিলনক্ষেত্র বলেই এই স্থানকে হরিহরক্ষেত্র বলা হয় ৷
শ্রীভগবানের লীলার সময় শ্রীহরি তাঁর গোধন নিয়ে এই পুণ্যক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন ৷ তাঁদের স্বর্গীয় মিলন হয়েছিল এই পরমস্থানে ৷ আর হরি এবং হরকে তো সকল দেবতারই প্রয়োজন! সুতরাং, সকল দেবতার উপস্থিতিতে এস্থান দেবময় হয়ে উঠেছিল ৷
হরিহরনাথজির মন্দির ছাড়া রাধাকৃষ্ণ মন্দির, শঙ্কর-উমার মন্দির ক্রমে ক্রমে স্থাপিত হয় ৷ পাশেই আছে চ্যবন কুণ্ড ৷ মহর্ষি চ্যবনের আশ্রম ছিল ৷ পুরাণে পাওয়া যায় যে, মহর্ষি বেদশিরাজি মহারাজ গঙ্গার তটে গভীর তপস্যায় মগ্ন ছিলেন ৷ মহর্ষির সে কঠিন তপস্যায় বজ্রধারী ইন্দ্রের আসনও টলে উঠেছিল ৷ তাই মহর্ষির তপস্যা ভঙ্গের জন্য মঞ্জুঘোষ নামে এক পরমাসুন্দরী অপ্সরাকে নিয়োগ করেন ইন্দ্র ৷ অপ্সরা নানাভাবে মহর্ষির তপস্যা বিনষ্ট করার চেষ্টায় বিফল হয় ৷ মহর্ষি প্রথমে হিমালয়ের মতো স্থির অটল শান্ত গম্ভীর থাকলেও অপ্সরার বারংবার চেষ্টায় অপ্সরা কিঞ্চিত সফল হয় তার উদ্দেশ্যে ৷ মহর্ষির ধ্যানভঙ্গ হলে মহর্ষি অপ্সরাকে অভিশাপ দিলেন-‘তুই তরঙ্গিনী হয়ে যা’ বলে ৷
অপ্সরা মহর্ষির অগ্নিমূর্তি দর্শনে এবং অভিশাপ শ্রবণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ৷ নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে ৷ মহর্ষি শেষপর্যন্ত কিছুটা সহানুভূতিশীল হয়ে বলেন, ‘অভিশাপ তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না ৷ তোমার তরঙ্গে বহু পবিত্রতার স্পর্শে তুমি ধন্য হবে ৷ তোমার গর্ভে (নদীগর্ভে) ভগবান বিষ্ণুর নিবাস হবে ৷ অর্থাৎ শালগ্রাম শিলার রূপে ভগবান বিষ্ণু তোমার উদরে উৎপন্ন হবেন এবং এইভাবে তুমি ‘শালিগ্রামী’ নামে অভিহিত হবে ৷’
এই শালিগ্রামীর উত্তরে এবং হিমালয়ের দক্ষিণ অংশ ‘মহাক্ষেত্র’ নামে খ্যাত ৷ হরিহরনাথজির মন্দির-সন্নিকটেই শালিগ্রামী পতিতপাবনী গঙ্গায় মিলিত হয়েছেন, ফলে এই স্থান পবিত্র সঙ্গমক্ষেত্রের বিশেষ মাহাত্ম্য প্রাপ্ত হয়েছে ৷
বরাহক্ষেত্র, কুষাবর্ত আদিতীর্থ, কুম্ভক্ষেত্র, কুরুক্ষেত্র, হরিহরক্ষেত্র প্রভৃতি স্থানে স্নান-দান পুজো-যজ্ঞ করলে পাপী পাপমুক্ত হয় ৷ হরিহরক্ষেত্র যে সকলপাপহারী এবং সর্বমনস্কামনা পূর্ণকারী তার অপর কারণ এই মন্দিরের নিকটেই শালিগ্রামের অপরপাড়ে ‘কোনহারা’ ঘাট আছে ৷ ওই স্থানে গজ এবং গ্রাহের (কুমির) প্রচণ্ড লড়াই হয়েছিল ৷ যে লড়াই থেকে গজকে রক্ষা করতে স্বয়ং বিষ্ণু এই স্থানে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ৷
গ্রাহা হলেন অভিশাপগ্রস্ত রাজা ইন্দ্রবদন ৷ একদা শ্বেতদ্বীপের এক মনোরম সরোবরে শ্রীদেবলমুনি স্নানরত ছিলেন ৷ তখন ‘হা হা’ নামে গন্ধর্ব ক্রীড়াচ্ছলে মুনির পদ বেষ্টন করে রাখে ৷ মুনি ত্রুব্ধ হয়ে গন্ধর্বকে অভিশাপ দেন-‘তুমি গ্রাহা (কুমির) হয়ে থাক ৷’
ওদিকে রাজা ইন্দ্রবদন তাঁর মন্ত্রীদের রাজ্যভার দিয়ে গিরিগুহায় মৌনভাবে তপস্যায় মগ্ন হন ৷ ভক্তরাজ ঋষিশ্বর শ্রীঅগস্ত্যজি মহারাজকে কৃপা করার জন্য ওই স্থানে উপস্থিত হন ৷ কিন্তু রাজা অতিথির যথাযোগ্য আপ্যায়নে বিফল হন ৷ ফলে মুনি ‘তু গজেন্দ্র হো যা’ বলে অভিশাপ দিলেন ৷ সেই থেকে তপোভ্রষ্ট রাজা গজেন্দ্ররূপে ওই মহাক্ষেত্রের অরণ্যে বিচরণ করতে থাকেন ৷ একদিন গঙ্গা গণ্ডকের সঙ্গমে পরিবার সহ জলপান ও স্নান-উদ্দেশে গমন করলে গ্রাহারূপী গন্ধর্ব গজের একটি পা কামড়ে ধরে গভীর জলে নিয়ে যেতে থাকে ৷ গজ জলের মধ্যে নিরুপায় ৷ তথাপি কথিত আছে, গজ এবং গ্রাহার এই যুদ্ধ সহস্র বৎসরব্যাপী সংঘটিত হয়েছিল ৷
গজের করুণ প্রার্থনায় ব্যাকুল শ্রীহরি তৎক্ষণাৎ তাঁর সুখশয্যা ত্যাগ করে ছুটে আসেন গজকে রক্ষার জন্য ৷ তিনি এমনই ব্যাকুল হয়েছিলেন যে, প্রিয়তমা লক্ষ্মীদেবীর দিকে দৃষ্টিপাত করেননি, লক্ষ করেননি তাঁর পার্ষদদিগকেও ৷ ভুলে গেছেন তাঁর ভূষণাদি সহ কৌস্তভমণি ধারণে ৷ ওই নিরাভরণ অবস্থায় তিনি গরুড়ের পৃষ্ঠে আরোহণ করে দ্রুতবেগে গজরাজের বিপদস্থলে উপনীত হন ৷ এবং ক্ষণকালের মধ্যে গ্রাহার প্রাণনাশ করে গজকে বিপন্মুক্ত করেন ৷ মন্দিরের বাঁদিকের দেওয়ালে এই চিত্র অঙ্কিত আছে ৷ শ্রীহরির কৃপাধন্য ‘কোনহারা’ ঘাট তাই খুবই পবিত্র ৷ এই ঘাটে স্নানান্তে গজ দর্শন করলে পুণ্যার্জন হয় ৷ কোনহারা ঘাট নামকরণের কারণ হল-জলাশয়ে গ্রাহা দেবলমুনির শ্রীপদে দংশন করলে তিনি ‘কৌন হ্যায় রে’ বলে চিৎকার করে ওঠেন ৷ তারই অপভ্রংশ এই ‘কোনহারা’ ৷ ওই ঘাটের কাছেই রামঘাট ৷ কথিত আছে, শ্রীরামচন্দ্র অনুজ লক্ষণণজি সহ মুনিবর বিশ্বামিত্র সমভিব্যাহারে এই ঘাটে নৌকা বেঁধেছিলেন ৷ এখান থেকে তাঁরা গিয়েছিলেন বৈশালীনগরে ৷ সেখানকার রাজা সুকৃতি এঁদের স্বাগত অভ্যর্থনা করেছিলেন ৷
এছাড়া বৌদ্ধসাহিত্যে আছে যে বুদ্ধদেব এখানে তাঁর চাতুর্মাস্য ব্রত পালন করেছিলেন ৷ ফলে ওই নির্দিষ্ট দিনে (সম্ভবত কার্তিক পূর্ণিমায়) বিশাল জনসমুদ্র এখানে মিলিত হত, ফলে সৃষ্টি হয়েছিল বিশাল মেলা ও উৎসবের ৷ আবার জৈনশাস্ত্রেও বর্ণনা আছে যে, জৈনধর্মের স্রষ্টা মহাবীর বর্ধমানের জন্মভূমিও ছিল বৈশালীতে ৷ বৈশালীর কাছাকাছি হাজিপুরে শ্রীরামচন্দ্রের মন্দির আছে-সেই মন্দিরে তাঁর পদচিহ্ন পূজিত হয় ৷ কথিত আছে যে এই পদচিহ্ন তাঁর জনকপুরে যাওয়ার সময়ের ৷ মন্দিরের নাম রামচৌরা (রামচূড়া) ৷ প্রতিবছর রামনবমীতে বিরাট মেলা হয় ৷
এতক্ষণে আমাদের খেয়াল হল যে বহু মানুষও এই পুরাণ কাহিনী শুনছিলেন আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে ৷ আশাতীত অনেকটা সময়ই পেয়েছি আমরা ৷ আমার পাশে পুলিশের এক বড়কর্তা দাঁড়িয়ে আছেন, অপেক্ষমাণ রয়েছেন মোহান্তজির ভক্তশিষ্যের দল ৷ খুবই লজ্জিত হলাম এতটা সময় ওঁকে আমাদের সঙ্গে ব্যস্ত রাখায় ৷ কৃতজ্ঞতা সহ প্রণাম জানিয়ে উঠে দাঁড়ালাম ৷ মোহান্তজি হাসিমুখে বললেন-একটু অপেক্ষা করলে দেবতার রাজবেশের সময় মন্দিরে গিয়ে পূজারতি দেখতে পাবেন-ফটোও তুলতে পারবেন ইচ্ছে হলে ৷ মোহান্তজির এমন সহৃদয়তায় অভিভূত হলাম ৷ প্রণাম করে তখনকার মতো বিদায় নিলাম আমরা ৷
অভিজিৎ বলল, রাজবেশের এখনও অনেক দেরি আছে ৷ ততক্ষণে কালীমন্দির, হরগৌরীর মন্দির, গঙ্গার ঘাট, বিখ্যাত বট, শিবমন্দির, মোহান্তজির আবাস ইত্যাদি ঘুরে আসা যায় ৷
সর্বত্রই মানুষের স্রোত ৷ সে স্রোত নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁশ আর শালখুঁটির শক্ত বেড়া যেদিকে তাকাই সেদিকেই ৷ আলোর ব্যবস্থা অপ্রতুল ৷ এতক্ষণে জ্যোৎস্না উঠেছে কিছুটা হেমন্তের মেঘলা আকাশ আর কুয়াশাকে ফাঁকি দিয়ে ৷ তাতেই আমরা পথ চলছি স্বচ্ছন্দে ৷ এদিকেও পুলিশ আর পুলিশ ক্যাম্প ৷ পথের পাশে পাশে এবং যেখানে যতটুকু ফাঁকা মাঠ আছে, সেখানেই গরিব মানুষরা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে নৌকার ছইয়ের মতো করে তার ওপরে সামান্য খড় বা ছেঁড়া চট, ছেঁড়া কাপড়, পলিথিন শীট যার যেমন জুটেছে তাই দিয়ে বানিয়ে নিয়েছে সাময়িক আশ্রয় ৷ কুয়াশা ভেজা হাড়কাঁপানো শীতের রাত কাটিয়ে মেলা দেখার এমন উৎসাহ-না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না ৷
সবই দেখা হল মোটামুটি ৷ তবে শোনপুরের মেলার সেই বিখ্যাত নৌকার পুল আর নেই ৷ ব্রিজ হওয়ার ফলে নৌকার পুলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে ৷ এপার থেকে ওপার পর্যন্ত গায়ে গায়ে বাঁধা থাকত অসংখ্য নৌকা ৷ তার ওপর দিয়ে হেঁটে চলত পারাপার ৷ কালীমন্দিরের ভাঙা পাড়ে তার চিহ্নটুকু রয়ে গেছে শুধু-কটি ভাঙা নৌকার কঙ্কাল নিয়ে ৷ এখন হালকা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে দূরে, দূরে দুয়েকটি নৌকা ৷ বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় কালীমন্দিরে ৷ ছোট মন্দির ৷ পুরনো বাড়ির অল্প পরিসরের একখানা ঘর বললেই ভালো হয় ৷ অত্যন্ত অল্প আলোয় কিছুই প্রায় বোঝা যায় না ৷ তবে নিতান্তই ছোট, মায়ের মূর্তিখানি বড়ই সুন্দর ৷ দেখা আর হাঁটার বিরাম নেই ৷ গরিব মানুষদের সেই ছইগুলি ঘিরে লোক জমেছে, আশপাশে কজন পুলিশও ঘোরাফেরা করছে ৷ ডানদিকে সামান্য তফাতে আবার রংমাখা মেয়েদের আস্তানা ৷ কী নেই এ মেলায়!
ভিড় ঠেলে এবার আমরা দ্রুতপায়ে সংক্ষেপ পথে মন্দিরে এসে পৌঁছলাম ৷ বিশাল লাইন পড়েছে ভক্তদের হরিহরনাথের রাজবেশ ও আরতি দেখার জন্য ৷
এই বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য নানা বাদ্যযন্ত্র সরব হয়েছে ৷ ধূপের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে যাচ্ছে, ধূপ ও ফুলের গন্ধে-বর্ণে সে এক অবর্ণনীয় পরিবেশ ৷ এমন সময় পাশেই পেলাম মোহান্তজিকে ৷ আন্তরিক হেসে বললেন-‘একটু অসুবিধে হল, না!’
না, না ৷ এখানে যে আসতে পেরেছি-এই তো পরম ভাগ্য স্বামীজি ৷
মন্দিরের পুরোহিত এলেন ৷ বয়স আশির কাছাকাছি, প্রকৃত গৌরবর্ণ না স্বর্ণকান্তি কী বলব! ঊর্ধ্বদেহে কোনও আবরণ নেই ৷ ধুতিখানি মালকোচা দিয়ে পরেছেন ৷ পাকানো শীর্ণ শরীরে শুভ্র উপবীত, মাথায় মানানসই শিখা ৷ প্রথমে একটি বিরাট শাঁখ নিয়ে শঙ্খধ্বনি করতে থাকলেন ৷ একেকবার সে সুর ধরে রাখছেন অনেকক্ষণ পর্যন্ত ৷ তারপর যুক্তকরে মন্ত্রপাঠ আরম্ভ করলেন, যা নানা বাদ্যধ্বনির জন্য শুনতে বা বুঝতে পারছি না ৷ কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি, মনে হয় এখানকার ক্ষমতাবান পুরুষ, তাঁরাও সশ্রদ্ধায় ছন্দে ছন্দে হাততালি দিয়ে মাথা দুলিয়ে পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন ৷ ছোট্ট মন্দিরের মধ্যে এখন শ্বাস টানার মতো অবস্থা নেই ৷ বৃদ্ধ পুরোহিত এবার মাটির দুটি বড় ধুনুচি তুলে নিয়ে আরতি আরম্ভ করলেন ৷ বাজনার ছন্দও পাল্টে গেছে ৷ দুপাশের মানুষ ওই ধুনুচি দুটিতে মুঠো মুঠো গুঁড়ো ধুনো ছড়িয়ে দিচ্ছেন-ধুনুচি জ্বলে উঠছে দাউ দাউ করে ৷ তবু পরিপূর্ণ নৃত্যশৈলী বজায় রেখে আরতি চলছে ৷
এত ঘুরেছি এই পাঁচ ঘণ্টায়, তবু যে পথেই যাই মনে হয় একই পথে যেন ভুলভুলাইয়ায় ঘুরছি ৷ আর যেমন ভিড়, তেমন ধোঁয়া, তেমনই শব্দ ৷ মেলায় আসা হাজার হাজার মানুষ ঘুঁটে, কাঠ, পাতা, খড় জ্বালিয়ে রাতের রসুই পাকাচ্ছে ৷ সেই ধোঁয়ায় চোখে অন্ধকার লাগছে, চোখ জ্বলছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে এমন অবস্থা ৷
হাতিবাজারের পাশ দিয়ে যখন আসছি, পথের পাশে সেই আবছা অন্ধকারে যে জিনিস লক্ষ করলাম তাতে অতীত সবকিছু মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়াও খুব সহজ নয় ৷ কোথায় যেন একটা জানা-অজানার, প্রকাশ-অপ্রকাশের বিরোধ চলেছেই ৷ অনেক অসহায় নির্বোধ ও দরিদ্রের কান্না ঢাকা পড়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের আনন্দ-কোলাহলের বন্যায় ৷
এদিকটায় প্রচুর মূল্যবান সামগ্রীর বাজার ৷ বেনারসী থেকে গহনা কী চাই! একজন রাজস্থানি হাতে ছোট্ট মাউথপিস নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে কবিরাজি জন্মনিয়ন্ত্রণ বটিকার ৷ একেবারে হাতে গরম বিক্রি হচ্ছে ৷
বড় বড় দোকানগুলোয় জ্বলছে পেট্রোম্যাক্স ৷ বিদ্যুৎ বোধহয় সবটুকুই বরাদ্দ হয়েছে বড় থিয়েটার কোম্পানি, সার্কাস, বিশাল নাগরদোলা, রইস আদমিদের মৌজের জায়গায় মিনাবাজারে ৷ প্রমাণ সাইজের মূর্তি দিয়ে রামায়ণ-মহাভারতের সচল প্রদর্শনী ৷
এখানকার নিঃশুল্ক চিকিৎসালয় চালানোর জন্য মেলার সময় কয়েকজন ডাক্তার নিয়ে আসেন মণি মহারাজ কলকাতা থেকে ৷ বৃদ্ধ সেই হিসেবেই এসেছেন ৷ স্বামীজিই সকলকে রান্না করে খাওয়ান ৷ সকাল-বিকেল মিলিয়ে স্বামীজি নিজে অন্তত আধঘণ্টা কেন্দ্রে বসেন ৷
পরদিন আমি চললাম এবার মেলার পথে একাই ৷ গঙ্গায় দুজায়গায় হাতি স্নান করানো হয়-আমার লক্ষ্য সেই দুটি স্নান সহ পুণ্যার্থীদের স্নানঘাট ৷ নতুন ব্রিজের তলায় এবং পুরনো ব্রিজের ডানদিকে বেশি মানুষ পুণ্যস্নান করেন ৷ তারপর স্নানের ভিড় হয় কালীঘাটে ৷ আমি চলেছি প্রথমে নতুন ব্রিজের দিকে ৷ অসংখ্য মানুষ প্রাতঃকৃত্য শেষ করছে উন্মুক্ত সীমাহীন ও আব্রুহীন মাঠে ৷ স্ত্রী-পুরুষ, কচিকাঁচা, যুবতী, কিশোরীর কোনও ভেদ নেই ৷ একেবারে আদিম অবস্থা ৷ কুয়াশাই যা এদের আব্রু রক্ষা করছে ৷
মেঘ-কুয়াশার বুক ভেদ করে দিনমণি উঁকি দিচ্ছেন ৷ সে ছায়া গঙ্গার বুকে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ৷ নৌকা চলছে যাত্রীবোঝাই ৷ যাক, হাতির স্নানপর্ব আরম্ভ হল ৷ তবে দল বেঁধে নয় ৷ একেকবার মাত্র একটি হাতিকেই জলে নামানো হচ্ছে ৷ খানিকক্ষণ জলে ভিজিয়ে তারপর ঝামা দিয়ে ঘষে ঘষে শুকনো চামড়ায় কিছুটা সতেজ ভাব ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে ৷ তারপর ডাঙায় তুলে তেল দিয়ে ভিজে শরীর দলাইমালাই করে চলছে বয়স কমানোর চেষ্টা ৷ এরপর ডোবায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে শুঁড়-কান-কপালে রং দিয়ে আঁকা হচ্ছে নানা নকশা ৷ কারুর কারুর পিঠে চাপানো হচ্ছে মখমলের ঝালর ৷ যেন কনে সাজানো! এবার প্রাতরাশ ৷ আয়োজন কম নয়-আখ, আধপাকা ধান সহ ধানের বোঝা, কলাগাছ, আম-বট ইত্যাদির পাতা ৷ প্রাতরাশের পর কনে দেখানোর পালা ৷ খরিদ্দারের সঙ্গে বাতচিত ৷ ক্রমে ভিড় বাড়ছে হাতিবাজারে ৷ কাছাকাছিই উটেরও বাজার ৷ হাতির তুলনায় উটগুলোর স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য বেশি ৷
আমবাগানে সারি সারি শৌখিন তাঁবু পড়েছে হাতিবিক্রেতাদের ৷ তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মারুতি, কন্টেসা, অ্যাম্বাসাডর, জিপ ইত্যাদি ৷ মালিকরাও বেশ সেজেছেন আধুনিক মূল্যবান পোশাকে ৷ কিং সাইজ দামি সিগারেট খাচ্ছেন অথবা ফরাসি নলে তামাকু সেবন করছেন ৷ দরদাম ঠিক হচ্ছে তাঁবুর ভেতরে ৷ কখনওই হাতির সামনে নয় ৷ কোনও কোনও হাতিকে আবার মেলা ঘুরিয়ে আনা হচ্ছে ক্রেতা আকর্ষণের জন্য ৷ এমনই একটি হাতি (এটিই এবার মেলার বৃহত্তম)-কে চার পায়ে শিকল পরিয়ে, দুপাশে শক্ত কাছি (জাহাজবাঁধা দড়ি)-তে চারজন লোক টেনে নিয়ে চলেছে ৷ সঙ্গে বল্লম হাতে দুজন পাহারাদার ৷ মাহুতের অঙ্কুশের আঘাতে কপাল, কান আর চোখের কোল বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে ৷ ফোটা বেয়ে নামছে চোখের জল ৷ মনটা কেমন বেদনার্ত হয়ে উঠল, তবু ছবি তোলার চেষ্টা করতেই কজন লোক চিৎকার করে উঠল-হঠ যাও-মার দেঙ্গে-পরে শুনেছি এটি মত্তহস্তি ৷ কিন্তু মালিক সাংঘাতিক চালাক ৷ বার বার ঘোষণা করতে থাকে যে-‘এ মেলায় এমন খরিদ্দার নেই যে এই বিশাল হাতি কেনে ৷’ একথা কানে যায় স্থানীয় এক মাফিয়ার ৷ সে সাত-পাঁচ বিবেচনা না করেই একদামে কিনে নিয়ে যায় হাতিটি নিজের অহংকার বজায় রাখতে ৷
মেলায় দেখছি নব্বই ভাগই গরিব অতি সাধারণ মানুষ ৷ অবিরাম চলছে সেই দরিদ্র মানুষের মিছিল পুব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে ৷ সম্পূর্ণ একেকটি পরিবারই যেন উপড়ে নিয়ে এসেছে গৃহকর্তারা এই মেলায় ৷
নার্সারি এলাকায় এলাম ঘুরতে ঘুরতে ৷ লিচু, আম, জাম, কাঁঠাল, লেবু, পেয়ারা, নারকেল, সুপুরি, কমলালেবু-বিভিন্ন গাছের একেকটা এলাকা ৷ টবে কমলালেবুর কলমের গাছ পাকালেবু সমেত শোভা পাচ্ছে ৷ ফুল গাছের তো কথাই নেই ৷ একা গোলাপই যে কত জাতের কত রঙের! সাইজও প্রদর্শনীতে দেবার মতো ৷ শীতের ফুলের যেন স্বর্গ! গন্ধে মাতাল চারদিক ৷ সবজির নানারকম গাছও টবে টবে সাজানো ফলন্ত অবস্থায়-ফুলকপি থেকে পটল, লঙ্কা থেকে ক্যাপসিকাম ৷ কাঁদিসুদ্ধ কলাগাছ পাঁচ-সাত রকমের ৷ বিস্কুট, কেক, মোগলাই, সাহি মিষ্টির একটা গ্রাম যেন-কত দোকান! বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর-এই এলাকার খুশবুই আলাদা ৷ এরপর কাঠের এলাকা ৷ কাঠের হাতা থেকে টেবিল, চেয়ার, সিন্দুক, পালঙ্ক থেকে লাঙলের কাঠ, দরজা-জানলা, বিশাল বিশাল কড়িকাঠ ৷ এতসব মেলায় বয়ে নিয়ে আসতেই তো খরচ হবে হাজার হাজার টাকা! কাঠও কত রকমের ৷ বিক্রিও হচ্ছে বেশ ৷ কিনে নিয়ে গিয়ে পছন্দমতো প্রয়োজনমতো সব কিছু করা যাবে ৷
চিড়িয়াবাজার এবং ছোট পশুর বাজার পাশাপাশি ৷ দর্শক এবং ক্রেতা প্রচুর ৷ জোগানও প্রচুর ৷ কী নেই! হনুমান, বাঁদর, বেজি, সাপ, মুরগি, চিনে মুরগি, অনেকরকম হাঁস, পায়রা, টিয়া, চন্দনা, ময়না, মুনিয়া, বাটর, কোকিল, শালিক, কাঠঠোকরা ৷ দুটি মাত্র কাকাতুয়া ৷ দাম নাকি দুহাজার টাকা করে ৷ ময়ূরের বাচ্চা আর কাকাতুয়া দুটিকে ঘিরে প্রচুর মানুষের ভিড় ৷
কুকুরও অনেক জাতের ৷ বিড়ালও বিক্রির তালিকায় রয়েছে ৷ ভারি সুন্দর দেখতে কিন্তু ৷ তবে সব বাজারেই দরাদরি হয় খুব ৷ যেমন দেড় হাজার টাকার অ্যালসেসিয়ান কুকুরের বাচ্চা বিক্রি হল তিনশো পঁচিশ টাকায় ৷
সারাদিন খোলা আছে জ্যান্ত পশুর জ্যান্ত চিড়িয়াখানা ৷ একঘণ্টার দেখাশোনা ৷ দর্শনী এক টাকা মাত্র ৷ হিন্দি ভাষায় চলছে জোর প্রচার ৷
স্বামীজির মুখে শুনেছি ১৯৩২ সালে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা গুরু মহারাজ শ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দজি এসেছিলেন এই শোনপুরের মেলায় ৷
মানুষের অসহায়তা দেখে খুবই বিচলিত হন গুরু মহারাজ ৷ এবং তখনই লেগে যান সেবাকাজে ৷
স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছেলে, এমনকী পাটনা থেকেও ভলান্টিয়ার জোগাড় করে কাজ শুরু হয় সুষ্ঠুভাবে ৷ তখন পাটনায় বহু প্রতিষ্ঠিত ‘ধনী বাঙালি’ ছিলেন ৷ যাদের মধ্যে ব্যারিস্টার, ডাক্তার, সরকারি উচ্চপদাধিকারী, উকিল, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী সব শ্রেণীর মানুষই ছিলেন ৷ তাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন ৷ গুরুদেবের ইচ্ছায় সবরকম সাহায্যই জুটে গেল অত্যল্প সময়ের মধ্যে ৷ খোলা হল সেবাদল, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকেন্দ্র ৷ সাধারণ মানুষ দারুণ উপকৃত হল, খুশি তো হলই ৷ লঙ্গরখানাও খোলা হল দরিদ্রনারায়ণের সেবায় ৷
আগে মেলা বসত হাজীপুরে ৷ ১৮৩৭ সালের গণ্ডকের বন্যায় পাটনার কাছাকাছি সাহেবদের ঘোড়দৌড়ের মাঠ বিলীন হয়ে গিয়েছিল ৷ ওই সময়ের আগে থেকেই নীলকর সাহেবরা বিহারের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল ৷ হাজীপুর-শোনপুর অঞ্চলের নীলকর সাহেবরা মিলে তৈরি করেছিল এই শোনপুরেই তাদের নাচঘর আর ঘোড়দৌড়ের মাঠ ৷
হরিহরনাথের মন্দিরেরও সংস্কার সাধন হল ৷ কেটে পরিষ্কার করা হল আশপাশের বনজঙ্গল ৷ ক্ষত্রিয়প্রধান এই অঞ্চলেই তারপর থেকে জমে উঠল মেলা ৷ সেই মেলাই এই আজকের মেলা ৷
কাছাকাছি দর্শনীয় স্থানের মধ্যে বাবা বালানন্দজির মন্দির ৷ হরিহরনাথজির মন্দিরের পশ্চিমদিকে তিন ফার্লং দূরে নদীর ধারে এই স্থান ৷ এখানে রাজা ঈক্ষবাকুর পুত্র রাজা নেমিও তপস্যা করেছিলেন ৷
বিজলপুর নদীর ধারে একটি বিরাটাকৃতি পাথর আছে-এটিই জড়ভরৎ নামে খ্যাত ৷ প্রচলিত বিশ্বাস, প্রচণ্ড দাবদাহের সময় পাথর নিজেই গঙ্গায় নেমে যান এবং নির্দিষ্ট সময়ের পরে আবার নিজেই স্বস্থানে ফিরে আসেন ৷
সারাদিন প্রায় একভাবেই কাটল ৷ অভিজিৎরা এল খবর নিতে ৷ নানারকম আলোচনা হল ৷ সন্ধ্যায় বেরোলাম ঠাকুরের নাম স্মরণ করে মেলার পথে ৷ শেষ পরিক্রমার উদ্দেশে ৷
ভ্রমণ জানুয়ারি, ১৯৯৪
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন