চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

রোটাং পাসে বরফের ছিটেফোঁটা নেই ৷ যারা মানালি থেকে রোটাংয়ে বরফ দেখতে গেছে তারা ঘোড়ার পিঠে চেপে আরও এগিয়ে চলেছে কিছুটা দূরে পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা বরফের সন্ধানে ৷ আমাদের গন্তব্য চাঁদের দেশ লাদাখ ৷ মানালি দিয়ে প্রবেশ ও শ্রীনগর দিয়ে প্রস্থানের পরিকল্পনা ৷

সকালের ঝকঝকে আলোয় ভেড়ার পাল চলেছে রাস্তার ওপর দিয়ে ৷ পিছনে বরফের একটি শৃঙ্গ অসাধারণ লাগছে ৷ ভেড়ার পালকে পাশ কাটিয়ে নামতে থাকি ৷ তলা দিয়ে রুপোলি ফিতের মতো বয়ে চলেছে চন্দ্রা নদী ৷ পৌঁছে যাই গ্রামফুতে ৷ এখান থেকে পূর্বদিকে চন্দ্রা নদীর ধার দিয়ে চলে গেছে কুনজুম পাস হয়ে কাজা যাওয়ার রাস্তা ৷ লাদাখের সঙ্গে ভৌগোলিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে লাহুল ও স্পিতির অনেক মিল রয়েছে ৷ তাই এই অঞ্চল হিমাচলের লাদাখ নামে খ্যাত ৷ চন্দ্রার তীর ধরে চলেছি ৷ টান্ডিতে পৌঁছে দেখি চন্দ্রায় এসে মিশেছে ভাগা নদী ৷ তারপর চন্দ্রভাগা নাম নিয়ে পশ্চিমে বয়ে চলেছে ৷ আমরা চলেছি উত্তর-পূর্বে ৷ চন্দ্রভাগার তীর ধরে চলেছে উদেপুর যাওয়ার পথ ৷

ঘরবাড়ি খেতখামার গ্রামজীবন ছাড়িয়ে পৌঁছে গেলাম লাহুলের সদর শহর কেলং ৷ এখানে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে আবার চলার শুরু ৷ জেসপা ছেড়ে পৌঁছে গেলাম দারচা ৷ হোটেলে রাত্রিবাস ৷ এরপর মানালি-লে পথে অস্থায়ী তাঁবুতে রাত কাটাতে হয় সারচু অথবা পাং-এ ৷ আর এপথের শেষ গ্রাম রঙ্গিত ৷ তারপর আর মানুষের বসতি নেই লে-র সাতচল্লিশ কিলোমিটার আগে উপসি ছাড়া ৷ রঙ্গিতের পর থেকেই শুরু হল রুক্ষ পাহাড়, পথঘাট ৷ কিন্তু তারই মধ্যে স্ফটিক স্বচ্ছ টলটলে জলে পাহাড়, নীলাকাশের প্রতিচ্ছবি-সুরজতালে ৷ কিন্তু সে দৃশ্য উপভোগ করার মতো সময় নেই আমাদের ৷ পেরোতে হবে এপথের দ্বিতীয় গিরিবর্ত্ম বারালাচালা ৷ উচ্চতা ১৬,০২২ ফুট ৷ অল্পক্ষণের মধ্যে পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে এলাম ৷ নীল আকাশের নিচে চারদিকে সারি সারি বরফ ঢাকা চূড়াগুলোর মাথা ছুঁয়ে চলেছি ৷ কিন্তু এই উচ্চতায় বেশিক্ষণ থাকা যায় না, শ্বাসকষ্ট হয় ৷ শুরু হল নামার পালা ৷ সারচু পেরিয়ে চলি পাংয়ের দিকে ৷ যদি হিমাচল পর্যটনের বাসে যান তাহলে মানালি-লে ৪৭২ কিলোমিটার লম্বা এই হাইওয়েতে রাত্রিবাস করতে হয় সারচুতে ৷ ছোটগাড়ির ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে পাংয়ে রাত্রিবাস করা সম্ভব ৷ তাই আমরা এগিয়ে চলেছি ৷ আমাদের পূর্বদিকে রূপসু উপত্যকা ও পশ্চিমে জাঁসকার উপত্যকা ৷ গ্রেট হিমালয় গিরিশিরা, বারালাচা পেরিয়ে এসে পড়েছি ট্রান্স-হিমালয়ে ৷ সারচু পেরিয়ে আমাদের গাড়ি যেখানে থামল, সেই জায়গাটির নাম ব্রান্ডিনালা ৷ অস্থায়ী ক্যাম্প হোটেল ৷ বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বেশি ৷ একটি লাদাখি তরুণী দৌড়ে এসে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে তাদের তাঁবুতে রাত্রিবাসের জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল ৷ অবশেষে তার কাছ থেকে চা-পান করে তবেই নিস্তার পাওয়া গেল ৷ প্রতিবছর জুনের শুরুতে বরফ গলে পথ চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাদাখিরা তাঁবুর হোটেল মেলে বসে অক্টোবরের শুরু পর্যন্ত ৷ তারপর গ্রামে ফিরে যায় ৷ এই সময়ে গদ্দিরাও ভেড়া-ছাগলের পাল নিয়ে ওপর থেকে নেমে গ্রামে ফেরে ৷ এটাই তাদের সারাবছরে আয়ের একমাত্র রাস্তা ৷ যত দূর চোখ যায় অনুর্বর শুষ্ক-রুক্ষ পাহাড়-পর্বত, উপত্যকা ৷

কিছুটা পথ চলার পর হাজির হলাম গাটালুপের কাছে ৷ খাড়া চড়াইপথ সতর্কতার সঙ্গে পার করে আমাদের লাদাখি ড্রাইভার জানাল, আমরা পৌঁছে গেছি আইবেক্সের চারণভূমিতে ৷ ভাগ্য সহায় হলে দেখা মিলবেই ৷ সমতলে ছোট ছোট ঢিপির ওপরে ঘাসের চাপড়া সাজানো ৷ হিমবাহিত ড্রামলিনে গঠিত ৷ ভারতের আর কোথাও এই ভূমিরূপ দেখা যায় না ৷ হঠাৎ আমাদের গাড়ি থেমে গেল ৷ দেখি দুটি বাচ্চা সহ দুটি পূর্ণবয়স্ক আইবেক্স আমাদের দিকে সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে খাওয়া ছেড়ে ৷ হালকা খয়েরি ও ছাই রঙা শরীর ৷ মাথার শিং দুটি সবচেয়ে নজরকাড়া ৷ গাড়ির শব্দ হতেই তারা দূরে সরে গেল ৷ আমরা এগিয়ে চলি লাচুলুং গিরিবর্ত্মের দিকে ৷ উচ্চতা ১৫,৩০২ ফুট ৷ ধীরে ধীরে উঠে এলাম লাচুলুং গিরিবর্ত্মের মাথায় ৷ এখান থেকে জাঁসকার ও লাদাখ গিরিশিরা ও ট্রান্স হিমালয়কে বোঝা যায় ৷ লালচে, খয়েরি, হলদে, কালচে, সবুজ শেডের পাহাড়ের মাথায় শুভ্র তুষার মুকুটে পড়ন্ত বিকেলের আলো লালচে হয়ে উঠেছে ৷ সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখে ধীরে ধীরে নেমে আসি ৷ অবশেষে দেখলাম কাংলাপাল শৃঙ্গকে ৷ তীক্ষ্ণ বর্শাফলকের মতো ৷ আজও অজেয় এই শৃঙ্গ ৷ অবশেষে রাতের গন্তব্য পাংয়ে পৌঁছই ৷ ইতিমধ্যে ঠান্ডা বাতাসের প্রকোপ বেড়েই চলেছে ৷ শরীরে উচ্চতাজনিত আলস্য ও শিথিলতা দেখা দিয়েছে ৷

পরদিন সকালে মাখন ও লবণ মেশানো চা-পান করে চাঙা হয়ে উঠি ৷ এই চা গুরগুর নামে পরিচিত ৷ প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়ি ৷ প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার বুগিয়ালের মধ্য দিয়ে পথ চলেছে ৷ দুপাশে দেড়-দু কিলোমিটার দূরে সরে গেছে পাহাড় ৷ এখান থেকে পূর্বে পথ গিয়েছে রূপসু উপত্যকার মানালি-লে হাইওয়ের রোকচেন থেকে সো-বার সরোবর হয়ে সোম ৷ এই অপূর্ব প্রান্তরের নাম জাগচুদং ৷ এখানে প্রথম দেখা মিলল গর্ত থেকে বেরিয়ে দুপায়ে দাঁড়িয়ে পড়া মারমটদের ৷ এদের আঞ্চলিক নাম টাব ৷ এক গদ্দি পরিবারের কিছু সদস্য ছুটে এল আমাদের থেকে পানীয় জল নেওয়ার জন্য ৷ আমরা এগিয়ে চলি ৷ তারা হাত নেড়ে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানায় ৷ সমতল ছেড়ে উঠতে থাকি দ্বিতীয় উচ্চতম মোটরমার্গ তাংলাংলা গিরিবর্ত্মে ৷ মানালি-লে পথের সর্বোচ্চ এই গিরিবর্ত্ম লাদাখ গিরিশিরার ওপর অবস্থিত ৷ উচ্চতা ১৭,৩৯২ ফুট ৷ তাংলাংলার মাথায় গাড়ি থেকে নেমে পড়ি ৷ অক্সিজেনের স্বল্পতায় সামান্য শ্বাসকষ্ট হয় ৷ দূরে সিন্ধু উপত্যকা আর কারাকোরাম শৃঙ্গশ্রেণীর অসাধারণ রূপ দেখা যায় ৷ এখানে তাংলাং বাবার মন্দিরে ড্রাইভার প্রণামী দিয়ে এসে গাড়ি ছাড়ল ৷ নেমে এলাম সিন্ধু নদের ধারে ৷ পথে পড়ল রঙ্গিতের পর প্রথম গ্রাম গিয়াও মিরু ৷ উপসিতে সিন্ধু নদ পেরিয়ে চলি লে-র পথে ৷ দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার ৷ বাঁদিক দিয়ে বয়ে চলেছে মহাসিন্ধু ৷ সিন্ধু নদের ধার ধরে দক্ষিণ-পূর্বে আরেক পথ চলেছে রূপসু উপত্যকায় ৷ আমরা চলেছি জাঁসকার ও লাদাখ দুই গিরিশিরার মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে ৷ লে পৌঁছে যাই দুপুর একটায় ৷ ১১,৪৮৩ ফুট উচ্চতায় লাদাখের প্রাণকেন্দ্র ৷ বহুদূর থেকে নজর কেড়ে নেয় পাহাড়ের ওপর লে প্রাসাদ ৷ শহর ছেড়ে লে-শ্রীনগর জাতীয় সড়ক ১-এর ৪ কিলোমিটার দূরে এয়ারপোর্টের কাছে মুনল্যান্ড ট্যুরিস্ট হাটে উঠি ৷ অল্পক্ষণের মধ্যে হাটের কেয়ারটেকারের সঙ্গে আমাদের ভাব জমে ওঠে ৷ বিকেলে ওঁর বাড়িতে গেলাম ৷ ১ কিলোমিটার পথ অলিগলি বাগানের মধ্য দিয়ে ৷ ওংচুকের কিশোরী কন্যা আমাদের নিয়ে গেল বাগানে ৷ গাছের ডালে চড়ে আপেল, খুবানি পেড়ে দিল ৷ গাছ ভর্তি টকটকে লাল আপেল বাগান আলো করে আছে ৷ কাশ্মীরি আপেলের থেকে ছোট কিন্তু মিষ্টি ৷ বাগান থেকে গেলাম বৈঠকখানায় ৷ এটাই ওঁদের রান্নাঘর ৷ শীতে ঘর গরম রাখার জন্য এই ব্যবস্থা সব লাদাখি বাড়িতেই ৷ মেঝে জুড়ে সুদৃশ্য পুরু কার্পেট ৷ ছোট ফোল্ডিং কাঠের টেবিলে ড্রাগন ও বৌদ্ধ শিল্পরীতির সুদৃশ্য নকশা ৷ নাম চোগতে সে ৷ জাপানিদের মতো লাদাখিদেরও চা-পানের একটা রীতি আছে ৷ মোমো ও চা দেওয়া হল আমাদের ৷ সেই মাখন দেওয়া গুরগুর চা ৷

পরদিন লে-র ডিসি অফিস থেকে লাদাখের সীমান্তবর্তী দ্রষ্টব্যগুলো দেখার জন্য ইনারলাইন পারমিট জোগাড় করে বেরিয়ে পড়ি হেমিসের উদ্দেশে ৷ লে-মানালির পথে সিন্ধু নদ পেরিয়ে ডানদিকে এক পাহাড়চূড়ায় হেমিস ৷ দূরত্ব ৪৩ কিলোমিটার ৷ লাদাখের সর্ববৃহৎ এবং ধনাঢ্য এই গুম্ভাটি রাজা সেনগে নামগিয়াল ১৬৩০ সালে নির্মাণ করান ৷ গুম্ভাটি দুভাগে বিভক্ত ৷ একাংশে জনসমাগমের জন্য বিশাল হল, অন্য অংশটিতে বৌদ্ধমন্দির ৷ আমরা মন্দিরে প্রবেশ করি বিশাল দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে ৷ দুপাশ জুড়ে লামারা তখন বসেছে প্রার্থনায় ৷ আমাদের ইশারা করে বসতে বলা হল ৷ প্রার্থনা শেষে আমাদের সেই গুম্ভার অন্দর ও ছাদ ঘুরিয়ে দেখালেন এক লামা ৷ ফেরার পথে গেলাম লাদাখের সবচেয়ে কারুকার্যময় থিকসে গুম্ভায় ৷ লে থেকে দূরত্ব ২০ কিলোমিটার ৷ পাহাড়ের মাথায় দূর থেকে দেখতে দারুণ সুন্দর লাগে ৷ গুম্ভার দুটি তল জুড়ে রয়েছে বিশাল পদ্মাসনে বসা বুদ্ধমূর্তি ৷ মুকুটে নানা দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে ৷ এছাড়া এখানে অন্যান্য মন্দিরগুলোর মধ্যে একটি কালীমন্দিরও রয়েছে ৷ ফেরার পথে শ্যে প্রাসাদের গুম্ভার ২৫ ফুট উচ্চ বুদ্ধমূর্তিটিও দেখে নিই ৫ কিলোমিটার পথ এসে ৷

পরদিন সকালে পাড়ি দিই নুব্রা উপত্যকায় ৷ বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটরমার্গ খারদুং গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করার রোমাঞ্চই আলাদা ৷ যত ওপরে উঠতে থাকি লে শহরকে তত অপূর্ব দেখায় ৷ সকালের আলোয় ক্রমশ অবগুণ্ঠন খুলে দেখা দেয় জাঁসকার পর্বতশ্রেণী ৷ বাঁদিকে একটি রাস্তা চলে গেছে ১২,৫০০ ফুট উচ্চতায় লে-র সর্বোচ্চ গ্রাম গংলাসে ৷ এখানেই রয়েছে লে শহরের পানীয় জল সরবরাহের রিজার্ভার; পাহাড় কেটে গেটের মতো জায়গায় লেখা আছে গেটওয়ে অব নুব্রা ৷ লে থেকে টানা ৪৫ কিলোমিটার পথ এসে গাড়ি থামল খারদুংলার ওপর ৷ গাড়ি থেকে নামতেই হিমশীতল বাতাসের দাপটে কাঁপুনি ধরে গেল ৷ বাতাসে অক্সিজেনের অভাব বেশ টের পেলাম ৷ একটি ফলকে চোখ আটকে যায়, ইংরিজিতে লেখা, আপনি এখানে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন ৷ এই পরিবেশে এটাই যেন বাস্তব মনে হয় ৷ পাশের একটি নীল রঙের থামে ও ডানদিকে একটা হলুদ ফলকে লেখা: প্রজেক্ট হিমাঙ্ক; হাইয়েস্ট মোটরেবল রোড অব দি ওয়ার্ল্ড, হাইট ১৮,৩৮০ ফুট ৷ আবহাওয়া ভালো থাকায় দক্ষিণে জাঁসকার পর্বতশ্রেণী ও উত্তরে কারাকোরাম পর্বতশ্রেণীর খ্যাত-অখ্যাত অসংখ্য শৃঙ্গ দেখার সৌভাগ্য হল ৷ এবার পাকদণ্ডী বেয়ে কয়েক হাজার ফুট নেমে এসে দেখা হল সাইয়ক নদীর সঙ্গে ৷ পান্না রঙের নদীর জল বয়ে চলেছে বিক্ষিপ্তভাবে চড়া সৃষ্টি করে ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে এলাম সাইয়কের তীরে ৷ দুদিকে পাহাড় ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে ৷ সাইয়ক নদী উপত্যকা ধরে চলেছি ৷ এখান দিয়েই ছিল প্রাচীন রেশমপথ ৷ তখন এই রাস্তাকে বলা হত খোটান রোড ৷ আর লে-কে বলা হত গেটওয়ে অব সেন্ট্রাল এশিয়া ৷ এ পথেই বণিকরা কারাকোরাম গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করে চিনের সিংকিয়াংয়ের মধ্য দিয়ে কাশগার ইয়ারখন্দ মধ্য এশিয়া যেত মাসের পর মাস ধরে উট, ঘোড়া, গাধা, ইয়াকের পিঠে মাল চাপিয়ে ৷

প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর পৌঁছলাম নুব্রা উপত্যকার বৃহত্তম জনপদ ও মহকুমা শহর দেসকিটে ৷ লে থেকে নিচু ৷ ৮,৫০০ ফুট উচ্চতায় বাজার, দোকান, স্কুল, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক সবই রয়েছে ৷ আবহাওয়া ভালো থাকায় প্রথমেই গেলাম দেসকিট মনাস্ট্রিতে ৷ এই মনাস্ট্রির বারান্দা থেকে নুব্রা নদীর ওপারে সাসের কাংড়ি পর্বতমালা ছাড়াও দেখা গেল মাসের ব্রুম (২৫,৬৬০ ফুট), গোল্ডেন থ্রোন (২৩,৯৯০ ফুট), গ্রাসের ব্রুম-১-২-৩, ব্রড পিক এবং আরও অনেক বিখ্যাত পর্বতশৃঙ্গের মধ্যমণি হয়ে থাকা বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কে-২ বা গডউইন অস্টিন ৷ মনাস্ট্রি দেখে হুন্ডারের পথে রওনা দিলাম ৷ আড়াই কিলোমিটার পথ পেরোতেই বালিয়াড়ি শুরু হল ৷ তারই প্রান্তভাগে হেঁটে চলেছে দু-কুঁজের ব্যাক্ট্রীয় উট ৷ অবশেষে পৌঁছে গেলাম হুন্ডার ট্যুরিস্ট বাংলোতে ৷ চারটি উট এসেছে সেই মরু সফরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৷ উটের পিঠে সওয়ার হয়ে একটি কুঁজে হেলান দিয়ে অন্য কুঁজটি ধরে বসলাম ৷

সকাল দশটায় উট সফরের গায়ে ব্যথা কমাতে চললাম উষ্ণপ্রস্রবণে স্নান করতে ৷ প্যানমিকের এই উষ্ণপ্রস্রবণ যেন শীতলমরুর মধ্যে প্রকৃতির এক বিস্ময় ৷ এ পথটি চলে গেছে কারাকোরাম গিরিবর্ত্ম হয়ে মধ্য এশিয়া ৷ কিন্তু এপথ আজ বন্ধ ৷ তাই প্যানমিক ছাড়িয়ে আর যাওয়া গেল না ৷ হুন্ডারে ফিরে বিকেলে হুন্ডার গ্রাম দেখতে গেলাম ৷

পরদিন সকালে দেসকিটের ক্যামেল ব্রিডিং ফার্ম দেখে লে ফিরে এলাম ৷ বিকেলে লে প্রাসাদ, শঙ্কর গুম্ভা, শান্তিস্তূপ দেখে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল ৷

সকালে ঘুম ভাঙল গাড়ির হর্নে ৷ রাতে সব গোছানোই ছিল ৷ ভোর চারটেয় বেরিয়ে পড়লাম প্যাংগং সরোবরের পথে ৷ তখনও লে শহর জাগেনি ৷ আমরা কারু থেকে বাঁদিকের পথে রওনা দিলাম ৷ এপথে দেখা পেলাম পাটকেল রঙের খরগোশ, মারমটের দল ছাড়াও অসংখ্য পাখির ৷ চেকপোস্ট পেরিয়ে আমরা ক্রমশ পাকদণ্ডী বেয়ে ওপরে উঠতে থাকলাম ৷ এক সময় পৌঁছে গেলাম লাদাখের তৃতীয় উচ্চ গিরিবর্ত্ম চাংলা ৷ উচ্চতা ১৭,৩৫০ ফুট ৷ এখানে রয়েছে একটি শিবমন্দির ৷ চাংলা বাবা নামে তিনি জনপ্রিয় ৷ চাংলা থেকে ক্রমশ উতরাই পথে এসে পড়ি কয়েক হাজার ফুট নিচে ৷ চলে আসি অপূর্ব এক সরোবরের তীরে ৷ সেই সরোবর আলথাক সরোবর নামেই খ্যাত ৷ এখানে প্রাতরাশ সেরে আবার চলা শুরু হল ৷ দুরবুক নালা ছাড়িয়ে পৌঁছলাম তাংসে ৷ সুন্দর গ্রাম ৷ আরও ১৫ কিলোমিটার দূরে মুগলিব গ্রাম ৷ গ্রামের সবাই যাযাবর চাংপা উপজাতির মানুষ ৷ পশুচারণ তাদের একমাত্র জীবিকা ৷ খানিকক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাই লুকুং চেকপোস্টে ৷ পারমিট দেখিয়ে কিছুদূর চলার পর দেখা গেল ওপর থেকে প্যাংগং সরোবর ৷ অবশেষে পৌঁছে যাই ১৪,৪৫০ ফুট উচ্চতায় এশিয়ার বৃহত্তম নোনতা জলের সরোবরে ৷ প্যাংগং ও চ্যাংচেনমো পর্বতশ্রেণীর মাঝে এর অবস্থান ৷ ১৩৫ কিলোমিটার লম্বা এই সরোবরের মাত্র ৪৫ কিলোমিটার রয়েছে ভারতে, বাকিটা রয়েছে তিব্বতে ৷ এই বিশাল সরোবরের তীরে পৌঁছে নির্বাক ৷ তীর ছুঁয়ে পান্না সবুজ জল, মধ্যে ময়ূরকণ্ঠী নীল, পাহাড় ঘেঁসা অংশে লালচে থেকে বাদামি বা খয়েরি ৷ তারই সঙ্গে আকাশের মেঘের প্রতিফলনে রুপোলি প্রলেপ ঢেউয়ের খাঁজে ৷ সূর্যের অবস্থানের পরিবর্তনে সরোবরে চলেছে রঙের খেলা ৷ এগিয়ে চলি তীর বরাবর আরও পুবে ৷ একেবারে জলের ধারে কোথাও জলের কিনারে পাখির দল ৷ জলে ভেসে বেড়াচ্ছে পিনটেল, ব্রাহ্মণী হাঁস ৷ কখনও উড়ে এসে বসছে জলে সিগাল ৷ ছবি তুলে আশ মেটে না ৷ সকাল সাড়ে নটা থেকে পুরো দুপুরটা কাটিয়ে বিকেল তিনটেয় লে ফেরার পথে রওনা দিই ৷ সাড়ে আটায় পৌঁছই লে ৷

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য দক্ষিণ-পূর্বাংশের সোমোরিরি সরোবর ৷ বেরিয়ে পড়ি সকাল ছটায় ৷ গ্রেট হিমালয় বিভাজিকা ও সিন্ধু উপত্যকার মধ্যবর্তী অংশে রূপসু উপত্যকায় এই সরোবরের অবস্থান ৷ দুপথেই সোমোরিরি যাওয়া যায় ৷ আমরা স্থির করলাম তাংলাংলা দিয়ে প্রবেশ করে সো-বার, সোমোরিরি দেখে প্রস্থান করব পুগা, চুমাথাং হয়ে সিন্ধু নদের ধার দিয়ে ৷ সেইমতো তাংলাংলার পথে ১৫৪ কিলোমিটার এসে পৌঁছই সো-বার সরোবরের তীরে ৷ এখানে পাশাপাশি দুটি সরোবর রয়েছে ৷ বাঁয়ে সো-বার, ডাইনে তাগসাবুক-সো ৷ দুটি সরোবরের মধ্যে রয়েছে একটি সংযোগকারী সরু নদী ৷ যা পেরিয়ে যেতে হবে সোমোরিরি ৷

অতীতে দুটি সরোবর এক ছিল ৷ সরোবরের তীরে সাদা নুনের মোটা স্তর জমে রয়েছে ৷ জানা গেল, জলে এপসাম জাতীয় নুন ছাড়াও বোরাক্স রয়েছে ৷ স্থানীয় মানুষজন এই নুন সংগ্রহ করে ৷ আগে এই নুন লাদাখ ও তিব্বত যেত ৷ নদী পেরিয়ে এসে পড়ি বিশাল এক রুক্ষ সমতলভূমিতে ৷ পাহাড় সরে গেছে দূরে ৷ কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের গাড়ি থামল ৷ দেখি চারটি তিব্বতি বন্য গাধা চরে বেড়াচ্ছে ৷ কমলা বাদামি রঙের মসৃণ লোমে ঢাকা ঘোড়ার মতো বিশাল চোহারা ৷ লাদাখে কিয়াং নামে বেশি পরিচিত ৷ আমরা যত এগোই কিয়াং ততই দূরে সরে যায় ৷ এখানে রাস্তা বলে কিছুই নেই ৷ গাড়ির চাকার দাগ দেখে জনমানব শূন্য এপথে আমরা চলেছি ৷ কিছুদূর যাওয়ার পর যাযাবর চাংপা দলের সঙ্গে দেখা হল ৷ তারা জলের পাত্র নিয়ে এগিয়ে এল ৷ আমাদের থেকে পানীয় জল নিয়ে হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় জানাল ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে পোলোগোংকালা হয়ে সুমদো গ্রামে পৌঁছলাম ৷ এখান থেকে কোরজোক ১৩ কিলোমিটার ৷ কিছুক্ষণ চলার পর দেখা মেলে থাজাংকুরু-সো বা সরোবরের ৷ আকারে ছোট, সৌন্দর্যে অতুলনীয় ৷ ঘননীল জলে পরিপূর্ণ ৷ অল্পক্ষণের মধ্যে সোমোরিরির তীর ধরে পৌঁছে যাই কোরজোক গ্রামে ৷ গোধূলির আলোয় সিঁদুরে রাঙা মেঘের নিচে সোমোরিরি সরোবর হয়ে উঠেছে অনন্য ৷ আজ পূর্ণিমা ৷ পূর্বাকাশে বিশাল চাঁদ উঠল ৷ কিছুক্ষণের মধ্যে তার আলোয় ভেসে গেল বিশ্ব চরাচর ৷ সরোবরের জলে চাঁদের আলোয় অসংখ্য ঢেউয়ের মাথায় রৌপ্য মুদ্রার মতো ঝিলিক খেলে যায় ৷

পরদিন সকালে সরোবরের পুবদিকে লামসের কাংরি ও চামসের কাংরি শৃঙ্গদ্বয়ের মধ্য দিয়ে আসা সূর্যালোকে সরোবরের জল ধূসর রং থেকে ক্রমশ গোলাপি, গোলাপি থেকে লাল, তারপর সোনালি হয়ে ওঠে, তারপর রং বদলে নীল থেকে গাঢ়তর নীলে রূপান্তরের ম্যাজিক দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়! কোরজোক গ্রামের বাসিন্দারা তিব্বতি যাযাবর চাংপা উপজাতির ৷ এই কোরজোক গ্রামে রয়েছে একটি গুম্ভা ৷ ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি দর্শন করে কোরজোক চু বা নদীর ধার দিয়ে সকালে আমরা রওনা দিলাম কোরজোক প্রান্তরে ৷ এখানে চাংপাদের অস্থায়ী তাঁবুর বসতি রয়েছে ৷ ইয়াকের চামড়া দিয়ে তৈরি তাঁবুতেই এদের ঘরসংসার ৷ ভেড়া, অ্যাঙ্গোরা, ইয়াক, কুকুর, ঘোড়া, গাধা নিয়ে এক চারণক্ষেত্র থেকে অন্য চারণক্ষেত্র ঘুরে বেড়ায় ৷ তুষার চিতা, নেকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব পালন করে চাংপাদের পোষা কুকুরগুলো ৷

পরদিন সকালে লে অভিমুখে রওনা দিই চুমাথাংয়ের পথে সিন্ধু নদের ধার দিয়ে প্রায় সমতল পথে ৷ আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সিন্ধু নদের তীরে আর্যগ্রাম-দা, হানু ৷ লে শ্রীনগর জাতীয় সড়ক ১-এ ধরে ৯৭ কিলোমিটার চলার পর খালসে থেকে উত্তর-পশ্চিম পথে সিন্ধু নদ ধরে এগিয়ে চলি আরও ৬২ কিলোমিটার ৷ বিমা গ্রামে আমাদের গাড়ি থামল ৷ কিন্তু আমরা থাকব আর্যদের গ্রামের মধ্যেই ৷ তাই আমরা আরও ৪ কিলোমিটার পথ গিয়ে দাগ্রামে দ্রোকপা যুবক সোনমের বাড়ির গেস্টহাউসে উঠলাম ৷ গাড়ি থেকে খেতখামার-বাগানের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পথে দ্রোকপা মহিলাদের দেখা গেল খেতের কাজে ব্যস্ত ৷ আয়ত চোখ, উন্নত নাক, পুরু রক্তবর্ণ ঠোঁট, চোয়াল ও চিবুকের সুন্দর গড়ন, সুশ্রী মুখমণ্ডল ৷ ফর্সা, দীর্ঘাকৃতি ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ৷ ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় সবুজের ছায়ায় ঘেরা সিন্ধু নদের কোলে আর্যদের ঘর-সংসার ৷ এদের ধমনীতে বইছে খাঁটি আর্য রক্ত ৷ সোনম আমাদের তার গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে গেল ৷ সিন্ধু নদের ধারে গ্রামের একপ্রান্ত জুড়ে রয়েছে এদের খেতখামার, ফলের বাগান ৷ আপেল, ন্যাসপাতি, আখরোট, আঙুর, খুবানি আর আলু, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, গাজর ইত্যাদি সবজিখেতের মধ্যে সর্বত্র নানান ফুলের বাগান ৷ আসলে দ্রোকপারা ফুল খুব ভালোবাসে ৷ মহিলারা সর্বদাই সুন্দর অলঙ্কার ও ফুল দিয়ে সাজানো টুপি ব্যবহার করে ৷ তবে গ্রামের কেউ মারা গেলে মাথা থেকে ফুলের টুপি নামিয়ে রাখে ৷

দ্রোকপাদের পারিবারিক উৎসবের মধ্যে বিয়ে হয় বেশ জাঁকজমক করে ৷ পাত্রের কোনও বন্ধু ছাং নিয়ে পাত্রীর বাড়ি যায় ৷ সেই ছাং নিয়ে আলোচনায় বসে পাত্রীর বাড়ির লোকজন ৷ সকলের মতামত সন্তোষজনক হলে তবেই সকলে মিলে সেই ছাং পান করবে ৷ অর্থাৎ তারা এই বিয়েতে রাজি ৷ আর সম্মত না হলে ছাং ফিরিয়ে দেয় ৷ এই বিয়ে তাদের নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ৷ দ্রোকপাদের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘বনো-না’ ৷ আগস্ট মাসের শেষের দিকে হয় ৷ পাঁচদিন ধরে চলে ৷ এছাড়া ‘না’ এবং লোসার উৎসব হয় যথাক্রমে সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ৷

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সুরু উপত্যকা ৷ পরদিন সকালে দা থেকে বেরিয়ে খালসে ফিরে লে-শ্রীনগর জাতীয় সড়ক ধরে কারগিলের পথে রওনা দিলাম ৷ কিছুক্ষণ চলার পর পাকদণ্ডী পথে উঠে আসি ফাতুলা ৷ তারপর নামার পথে পৌঁছে যাই চাঁদের দেশে ৷ পাহাড়ের মাঝে এমন হলুদ খোয়াইয়ের দৃশ্য বিশ্বের আর কোথাও মেলে না ৷ পাশের বোর্ডে লেখা ‘দি গ্র্যান্ড ভিউ অব মুনল্যান্ড ৷’ একটু চলার পর পৌঁছে গেলাম লাদাখের প্রাচীন জনপদ ও গুম্ভা, লামায়ুরুতে ৷ পাহাড়ের মাথায় ছবির মতো সুন্দর গুম্ভা ৷ ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ দর্শন করে আবার শুরু হয় পথচলা ৷ নামিকা-লা গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করে এসে পৌঁছই কারগিলের ৪৫ কিলোমিটার আগে জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত মুলবেক চাম্বায় ৷ আফগানিস্থানের বামিয়ানের সেই বিখ্যাত বৌদ্ধমূর্তিটি ধ্বংস হওয়ার পর মুলবেকের পাহাড়ের দেওয়ালে খোদিত কুষাণযুগের ৯ মিটার সুবিশাল চতুর্ভুজ মৈত্রেয় বুদ্ধ আজ সর্বোচ্চ বৌদ্ধমূর্তি ৷ অবশেষে সুরু উপত্যকায় পৌঁছলাম বিকেলবেলায় ৷ মধ্যযুগের বিখ্যাত শহর কারগিল সুরু উপত্যকার প্রাণকেন্দ্র ৷ মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে কারগিল একটি অন্যতম স্থান দখল করে আছে ৷ তখন কারগিলের বালতি বাজারে রেশমপথের মাধ্যমে চিন, তিব্বত, ভারত ও মধ্য এশিয়ার নানান দেশের পণ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় চলত ৷ ১৯৭৪ সাল থেকে বাণিজ্যকেন্দ্রের পরিবর্তে কারগিল হয়ে ওঠে শ্রীনগর, লে ও জাঁসকার উপত্যকার সংযোগকারী পর্যটনকেন্দ্র ৷

জাঁসকারের পাদুম যাওয়ার পথে সুরু উপত্যকার প্রায় সব দ্রষ্টব্যস্থান দেখা হয়ে যায় ৷ তাই পরদিন ভোরবেলায় রওনা দিই ৷ পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সুরু নদী ৷ পানিখারে পৌঁছে সকালের আলোয় সুরু উপত্যকার অন্যতম আকর্ষণ দুই বিখ্যাত যমজ শৃঙ্গ নুন ও কুন দেখে বিস্মিত হই ৷ নুন বরফের চাদরে মোড়া আর কুনের গায়ে কোনও বরফ নেই ৷ যদিও দুজনেরই উচ্চতা প্রায় সমান ৷ এই পানিখার জনপদের ওপর বেশ কয়েকটি ট্রেকিং রুট রয়েছে ৷ ডানদিকে একটা বড় হিমবাহ পড়ল, নাম পেনসিলুঙ্গুলা ৷ এখান থেকে সুরু নদীর উৎপত্তি ৷ আরও এগিয়ে চলার পর পাহাড়িপথ ছেড়ে প্রায় সমতলে নেমে আসতেই নজর পড়ল একটি পাহাড়ের মাথায় ছবির মতো রংদুম গুম্ভা ৷ গুম্ভা দর্শন করে কিছুটা চলার পর শুরু হল চড়াই ৷ উঠে আসি পেন্সি গিরিবর্ত্মে ৷ একটি পাথরের ফলক চোখ পড়ল, পেন্সিলা, ১৪,৪৩০ ফুট, হায়েস্ট পয়েন্ট অব কারগিল-পাদম রোড ৷ এরপর নামার পালা ৷ পৌঁছলাম জাঁসকারের অনন্য সুন্দর দ্রুং-দ্রাং হিমবাহ ৷ সিকলমুন পাহাড়ের চুড়ো বেয়ে আঁকাবাঁকা পথে এক বিশাল বরফের নদী নেমে এসেছে ৷ কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হল না ৷ হিমালয়কে উত্তরদিক থেকে দেখার সুযোগ হল এপথে ৷ সম্মুখে কুথাল ও চাপড়া পর্বতশৃঙ্গ ৷ তার পিছনে ব্রহ্মা শৃঙ্গ, উচ্চতা ২০,১০১ ফুট এবং ব্রহ্মার স্ত্রী, উচ্চতা ২১,১২১ ফুট ৷ অবশেষে সন্ধেয় পৌঁছলাম পাদম ৷ কারগিল থেকে ২৪২ কিলোমিটার ভাঙা পথঘাট পেরিয়ে এসে ক্লান্তিতে শরীর আচ্ছন্ন হয়ে পড়ায় খাওয়া সেরেই শুয়ে পড়ি ৷

পরদিন সকালে পূর্ণিসেতু পেরিয়ে পাদম-দরচা ট্রেকরুটে ৭ কিলোমিটার দূরে ফুগতাল গুম্ভা দেখতে গেলাম ৷ পাহাড়ের গুহার অভ্যন্তর খুবই সুন্দর ৷ তারপর ঝুংকুল ও কারসা গুম্ভা দেখে রওনা দিলাম কারগিলের পথে, রাত ১০টায় ৷ কিন্তু কারগিল থেকে রাত ২টোয় আবার আমাদের গাড়ি ছাড়তে হল, সকালের মধ্যেই জোজিলা গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে যেতে হবে ৷ সেনাবাহিনীর কনভয় শুরু হয় তারপর ৷ সকাল ৫টায় ঘুম ভেঙে দেখি জোজিলার ওপর পৌঁছে গেছি ৷ বাঁদিকে দুটি পাহাড়চূড়ার মধ্যে অমরগঙ্গার ধার দিয়ে অমরনাথ যাওয়ার পথ দেখা গেল ৷ অল্পক্ষণের মধ্যে শোনমার্গ পৌঁছে গেলাম ৷ এখান থেকে শ্রীনগর মাত্র ৮৩ কিলোমিটার ৷ শোনমার্গে প্রাতরাশ সেরে ফের চলতে শুরু করি ৷ অবশেষে কারগিল থেকে ২৩০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে শ্রীনগর পৌঁছই সকাল ৯টায়, ডাল লেকের হাউসবোটে ৷ পরদিন শ্রীনগর থেকে জম্মু হয়ে কলকাতা ফিরি ৷

ভ্রমণ জুন, ২০০২

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন