অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
আমি, শিপ্রা আর আমার বন্ধু মারী ক্রিস্টিন টেলিফোনে অনেকক্ষণ আপনার কথা বলাবলি করেছি, সামনের শনিবার আমরা নৈশভোজেও মিলিত হব ৷
আমার বাড়িতে থাকার ব্যাপারে আপনি একেবারেই ভাববেন না, কেননা সবকিছুই আপনার জন্য একদম ঠিকঠাক থাকবে ৷ এক শয্যার ঘর, সহজ স্বাভাবিক খাবার, শান্ত ফ্ল্যাট, মেট্রোর কাছেই ৷ আমরা, মানে আমার দুই ছেলে (২০ এবং ২২) আর আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছি ৷ -শ্রদ্ধা সহ, মোনিক ত্রুফের
প্যারিসের লাগোয়া শহর লোভালোয়া থেকে ফ্যাক্সে পাঠানো এই চিঠির লেখিকা মোনিক ত্রুফের মারী ক্রিস্টিনের বন্ধু, মারী ক্রিস্টিন শিপ্রা ঘোষের বন্ধু, শিপ্রা ঘোষ আমার মেয়ে মৈত্রেয়ীর ‘মাদাম ঘোষ’ ৷ তাঁর উদ্যোগেই আমার এই থাকার ব্যবস্থা ৷
মৈত্রেয়ী ফরাসি ভাষায় কী একটা বাহাদুরি দেখিয়ে আলিয়াঁস ফ্রঁসেজ আর এয়ার ফ্রান্সের নেমন্তন্নে প্যারিস গিয়েছিল, সেই সূত্রে মালাকফের মাদাম ঘোষের সঙ্গে তার দহরম মহরম ৷ এবার মৈত্রেয়ীর সূত্রে, আমি প্যারিস যাচ্ছি শুনে তিনি আমাকে তাঁর মালাকফের বাড়িতে প্রথম দিনই ডালভাতের নেমন্তন্ন করে দিলেন ৷ মালাকফ থেকে মঁপারনাসে এসে আমাকে মালাকফে নিয়ে যাবেন ৷ সেখানে মধ্যাহ্নভোজের পর আমাকে পৌঁছে দেবেন লোভালোয়ায় মোনিকের বাড়িতে ৷ ভোজনের চেয়েও ভোজনান্তের এই দক্ষিণাটিতেই আমার বেশি লোভ ছিল ৷ কেননা কোথায় মালাকফ, কোথায় লোভালোয়া, কোথায় বা লোভালোয়ায় ত্রুফেরের নিবাস, সে-বিষয়ে আমি বেশ ধন্দে ছিলাম ৷
চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্ট থেকে এয়ার ফ্রান্সের বাসে মঁপারনাস পৌঁছে বাসস্টপে একমাত্র বাঙালি মহিলা দেখে মালাকফের মাদাম ঘোষকে আমার আর খুঁজে ফিরতে হল না ৷
আমি এর আগে কখনও প্যারিসের বাইরে কোথাও যাইনি ৷ যতবারই শিল্প-সাহিত্য-স্বাধীনতার এই দেশে এসেছি, প্রত্যেকবারই শুধু প্যারিসেই ঘুরেছি, তাও আবার দিনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে লা ফিগারো, ল্য মঁদ, ল্য পারিসিয়ঁ প্রভৃতি খবরের কাগজের অফিসে, কখনও-বা সংবাদপত্রের আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দপ্তর-তখনকার International Federation of Newspaper Publishers, সংক্ষেপে FIEJ বা এখনকার World Association of Newspapers, সংক্ষেপে WAN-এ ৷ যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ ৷
মালাকফে এসে প্রথমেই আমার ভালো লাগল, এখানে প্যারিসের মতো লোকজন গাড়ি-ঘোড়া দোকান-বাজারের ভিড় নেই! অথচ মঁপারনাস থেকে মাত্রই আধ ঘণ্টার রাস্তা ৷
মাদাম ঘোষের বাড়ি যেতে বাসরাস্তা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসতে হয় সরু মতো ছোট একটা বাঁধানো পথে, সেই পথের ওপরেই বাড়ির গেট, পথটি যেন একটা ব্যক্তিগত চিঠির মতো নির্জন ৷
মাদাম ঘোষ বাগানমুখী একটা ঘর দেখিয়ে আমাকে বললেন, এই আপনার শোবার ঘর, একটু অসুবিধা হয়তো হবে, কিন্তু জানলা দিয়ে চাঁদ দেখতে পাবেন ৷
ওই জানলা দিয়েই বাগান দেখিয়ে বললেন, ওখানে বেড়াবেন, চেয়ার-টেবিল পাতা আছে, যত খুশি বই পড়বেন, যখন ইচ্ছে লিখবেন ৷
আমার পাশের ঘরেই থাকেন বিশালকায় এক মার্কিন মহিলা ৷ সদ্য ইস্তাম্বুল থেকে ঘুরে এসেছেন ৷
বাগানটা বাড়িটার মতোই চওড়া, কিন্তু লম্বায় চার-পাঁচ গুণ বড় ৷ লেটুস লঙ্কা আলু পেঁয়াজের সবুজ পাতায় স্নিগ্ধ হয়ে আছে ৷ এত লেটুস গাছ এর আগে কখনও দেখিনি ৷ আরেকটি সতেজ সবুজ বড় বড় পাতার গাছও খুব হয়েছে, কাঁচা কুমড়োর মতো ফসল ফলে আছে, শুনলাম এগুলো আমাদের কুমড়োরই খানিকটা ফরাসি সংস্করণ ৷ নাম কুর্জেৎ ৷ ফলের গাছও অনেক ৷ একটা ন্যাসপাতি গাছ কচি কচি ন্যাসপাতিতে ভরা ৷ আগস্টের শেষে পাকবে ৷
বাগানের অর্ধেক মাদাম ঘোষের, বাকি অর্ধেক নিচতলার ফরাসি দম্পতির ৷ এত রকম সবজি, এত ফল, খাবার লোক কই? তার ওপর, নিচের দম্পতিটি আগামী সপ্তাহে তাঁদের দুটি পুত্র-কন্যা সহ দেশের বাড়ি যাচ্ছেন নিজেদের শুভ বিবাহ সম্পন্ন করতে ৷ ফিরতে মাস পাঁচেক দেরি হবে ৷ ওই সময় তাঁদের পরিবারে একটি নতুন সদস্য আসবার কথা, বর-কনের ইচ্ছে সেটিকে একেবারে কোলে নিয়ে ফেরেন ৷
ফলে আমি রোজই প্রচুর পরিমাণে লেটুস বা স্যালাদ পাতা খেতাম ৷ ছড়ানো বাঁধাকপির মতো, বড় বড় পাতার আস্ত একেকটা গাছ গোড়াসুদ্ধ উপড়ে রান্নাঘরের সিঙ্কে কল খুলে রেখে দিলে সব মাটি ধুয়ে যায় ৷ এমন বাগান-তাজা স্যালাদ পাতা প্রবাসে আমার ভাগ্যে ছিল আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ৷ তার ওপর কুচো চিংড়ি দিয়ে কুর্জেতের তরকারি!
আমার যেদিন এখানে আসবার কথা ছিল, আমি এসেছি তার দুসপ্তাহ পরে ৷ মোনিক ইতিমধ্যে বাইরে গেছেন ৷ ফিরবেন আগামী সপ্তাহে ৷ অতএব এই এক সপ্তাহ এখানেই নাকি আমার থাকার ব্যবস্থা ৷
এমনও হয় নাকি? তাছাড়া আমি এখানে থাকব কী হিসাবে?
‘আমাদের সম্মানিত অতিথি হিসাবে ৷’
মাদাম ঘোষের এই চটজলদি উত্তরে সম্মতি জানানো আমার পক্ষে কঠিন, অসম্মত হওয়া আরও কঠিন ৷ আতিথ্য ও সম্মান এভাবে দায়ে পড়েও জোটে কে জানত!
যে দেশেই যাই, সেখানকার গ্রাম আর হাটবাজারে না ঘুরলে আমার মন ভরে না ৷ শুনে মাদাম ঘোষ প্রথমেই আমাকে নিয়ে গেলেন কাছেই একটা মার্শে বা বাজারে ৷ মাছ-মাংস, শাক-সবজি, মশলা-মনোহারী, ফুল-ফল, জামা-কাপড়, ঘর-গৃহস্থালির যাবতীয় জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে ৷ সবই ঢাকা বাজারে আলাদা আলাদা স্টলে ৷ মাছের স্টলের পাশেই বইয়ের স্টল ৷ আর মেছুনির কথা আর কী বলব, মনে হয় রোজই একবার মাছ কিনতে যাই ৷
কুড়ি-পঁচিশটা সার্ডিন মাছের ভাগা ১০ ফ্রাঁ, আমি একটু এগোতেই পরমাসুন্দরী মৎস্যকন্যা বলল, দুভাগাই নিয়ে যান না, দাম কম দেবেন ৷
এই মার্শে সকাল আটটায় বসে, ভাঙে দুপুর একটায় ৷ বেলা যত বাড়ে জিনিসপত্রের দামও তত কমতে থাকে ৷ অবিক্রিত জিনিস ফেরত নিয়ে যাওয়ার চেয়ে বেচে দিয়ে যা পাওয়া যায় তাই লাভ ৷ একদিন তো হাট ভাঙার মুখে ফরাসি ১০ টাকায় চোদ্দটা দেড়বিঘতি সোনার বরণ কলা পাওয়া গেল ৷ এক ঝুড়ি ক্যাপসিকামই হোক কিংবা গরুর শিঙের মতো এক ঝুড়ি প্যাপরিকা বা ঝুড়িভর্তি চকচকে বেগুন-সবই লোকেরা কিনে নিয়ে যাচ্ছে দশ-দশ টাকায় ৷ এ যেন যা নেবে তা দশ টাকা! আভোকাডো, ফরাসিতে আভোকা (Avocat) অনেকটা ছোট আকারের মেটে আলুর মতো, কাঁচা খেতে হয়, কালো রঙের খোসা ছাড়িয়ে নিলেই মাখনের মতো নরম পদার্থটি আলাদা বা স্যালাদের সঙ্গে অতি সুস্বাদু, ঢেলে বিক্রি হচ্ছে ৷
সপ্তাহে দুদিন হাট ৷ রবিবার আর বুধবার ৷ যে কদিন গেছি, রোজই দেখেছি, হাটে ঢোকবার মুখে কয়েকজন আফ্রিকান মেয়ে-পুরুষ তাঁদের দেশের হস্তশিল্প নিয়ে বসে আছেন ৷ কুচকুচে কালো ওইসব দারুমূর্তি দেখতে দেখতে চোখে ঘোর লেগে যায় ৷
এক রবিবার আরও অবাক ব্যাপার ৷ মূর্তি দেখে, রাস্তায় বেরিয়ে এসে দেখি কনের সাজে এক অপরূপ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দীর্ঘকায় নারী, তার পাশেই আরেক অপরূপ শ্বেতাঙ্গিনী, এঁরও কনের সাজ ৷ দুজনের সঙ্গে অল্প কয়েকজন আত্মীয়স্বজন, মনে হয় সকলেই সামনের গির্জা থেকে বেরিয়ে গাড়ির অপেক্ষা করছেন ৷ আমার সঙ্গে সেদিন ক্যামেরা ছিল না বলে মানবসমাজের একটা আশ্চর্য সুন্দর ছবি আমি চিরকালের মতো হারালাম ৷
গ্রামটির নামই ‘বনের ধারে’ (La Lisi’ere des bois) ৷ গার দ্য লেস্ত (Gare De L’est) বা পুবের ইস্টিশন থেকে সকাল ৮-২৮-এর ট্রেনে গেলাম থ্রোয়া (Throyes), প্যারিস থেকে ১৭০ কিলোমিটার ৷ কথামতো স্টেশনে হাজির জিল আর তার বড় মেয়ে, তাঁদের গাড়ি নিয়ে ৷ জিল প্যারিসের কাছেই একটা স্কুলে ইতিহাস পড়ান, প্যারিসেও তাঁদের বাড়ি আছে-পোঁ দ্য স্যাংক্লু (Pont De St. Cloud) অর্থাৎ সাধু মেঘের জায়গায় ৷
জিলের বউ রোজি বাংলাদেশী মেয়ে ৷ নদীর দেশের শ্যামলা মেয়ে ফরাসি স্বামী শাশুড়ি নিয়ে দিব্যি সুখে ঘরকন্যা করছেন ৷ ছেলেমেয়েরাও ভাষায় চেহারায় ফরাসি, শুধু বড় মেয়ে বাঙালি, রোজির প্রথম পক্ষের সন্তান ৷
থ্রোয়া থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ‘বনের ধারে’ গ্রামে জিল-রোজিদের খামার বাড়ি ৷ জিল আর রোজি তাঁদের ছটি ছেলেমেয়ে আর ছেলেমেয়েদের ৮২ বছর বয়স্কা ঠাকুমাকে নিয়ে এখন মাসদুয়েক এখানে থাকবেন ৷ আমি এঁদের অতিথি ৷ আজকের দিনটা এঁদের সঙ্গে কাটাব ৷
প্রথমে হাটদর্শন, তারপরই এই শ্যাম্পেন অঞ্চলের গ্রামে জিল-রোজিদের আতিথ্য-বলাবাহুল্য এ-ও মাদাম ঘোষের উদ্যোগে ৷
জিলের বড় মেয়ে সবে স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিয়েছে, সে আর তার বাবা আমাকে থ্রোয়ায় দ্বাদশ শতকের একটা সুন্দর গির্জায় নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠাভরে তার স্থাপত্য ভাস্কর্য ইতিহাস ও ধর্মতত্ব শোনাল ৷ এটি থ্রোয়ার সবচেয়ে প্রাচীন গির্জা, নাম ম্যাদলিনের গির্জা ৷ এখান থেকে বেরিয়ে ক্রমে গোটা থ্রোয়া শহরটা ঘুরে দেখাল ৷ ভারি নিরিবিলি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, অথচ প্রাচীনতার ঘ্রাণটিও মুছে যায়নি ৷
জিলদের গ্রামের বাড়ি অনেকটা জায়গা নিয়ে, বেশ ছড়ানো-ছিটানো ৷ বড় বাগান, ছোট সবজি খেত, তারপর খোলা প্রান্তর, গাছপালা ও গভীর বন ৷ আদিতে এটা ছিল একটা আস্তাবল ৷ জিলের ঠাকুরদা এটা কিনে বাসগৃহে রূপান্তর করেন ৷ ঠাকুরদার পর বাবা, বাবার পর জিল নিজেও সেই রূপান্তরের কাজ করে চলেছে ৷
জিলের মা এই বয়সেও নিজের হাতে খেত পরিচর্যা করেন ৷ আমাকে তাঁর সবজি খেতে ডেকে নিয়ে নানারকম শাক-সবজি ফলানোর কথা শোনাতে লাগলেন ৷ তাঁর কোদাল ও নিড়ানি চালানো দেখে আমি হতবাক ৷ আমিও শেষ পর্যন্ত হাত না লাগিয়ে পারলাম না ৷
আলু গাছের গোড়ার মাটি আলগা করতে করতে বললেন, শীতকালে সব যখন বরফে ঢেকে যায়, ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি সবাই যখন প্যারিসে, এত বড় বাড়িতে তখন আমি একাই থাকি ৷ অবশ্য আমার ছোট ছেলে এখানেই থাকে, তার আবার থ্রোয়াতে দোকান, থ্রোয়ার নিজস্ব জিনিসপত্র কেনাবেচা করে ৷ এই বাড়ির ওই দিকটায় সে থাকে ৷
ঠাকুমা কথা বলছিলেন ফরাসিতে, কোথাও কোথাও আমি বুঝতে পারছি না দেখে ঠাকুমার বড় নাতনি আমাকে বাংলায় বুঝিয়ে দিচ্ছিল ৷
বাড়ি দেখে মুগ্ধ তো হয়েই ছিলাম, তার ওপর এঁদের আদর-আপ্যায়নের যেন সীমা নেই ৷ চারদিকে গাছপালা, বাড়ির কোনও কোনও ঘর আস্তাবলের আদলেই সাজানো, অবিভক্ত বাংলার গ্রামের বাড়ির উত্তরের ভিটে দক্ষিণের ভিটের মতো ছড়ানো বাড়ি, মস্ত উঠোন, তার মধ্যেই টেবিল চেয়ার সাজিয়ে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা ৷
খাওয়ার পর ফলন্ত পীচগাছের তলায় রঙিন খাটিয়া পেতে আমার বিশ্রামের আয়োজন করা হয়েছে ৷ চিত হয়ে শুয়ে গাছের পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে টলটলে নীল আকাশ দেখতে দেখতে ভাবি, আকাশ যেমন সব দেশের ওপরেই আকাশ, মানুষের হৃদয়-মনও তেমনই সব দেশেই এক ৷ তা না হলে গতকালও যাঁদের চিনতাম না, আজ তাঁদের বাড়িতে এমন আনন্দে আমার কাটছে কীভাবে?
সবচেয়ে ছোট ছেলেটা ভেবেছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, খাটিয়ার তলায় ঢুকে সে তার ছোট্ট মাথা দিয়ে আমার পিঠে ঢুঁ মারছে ৷ একেক বার ঢুঁ দিচ্ছে আর খানিকক্ষণ অপেক্ষা করছে, বোধহয় ভাবছে আমি চমকে লাফিয়ে উঠব ৷ আসলে সারাদিন সংকোচে দূরে থেকেছে, অন্যান্য ভাইবোনদের মতো আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি, এখন আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাবার চেষ্টা ৷
বিকেলে জিল আমাদের গাড়ি করে ছেড়ে এল বনে ঢোকবার মুখে ৷ রাস্তায় খেলাধুলা করে খালি গায়ে ঘরে ফিরছে গাঁয়ের মানুষ ৷ আরেক দল যুবক ও মাঝবয়সী পুরুষ লোহার বল ছুড়ে ছুড়ে খেলছে ৷
ছোট দুই মেয়ে আর সবচেয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে রোজি চলেছে আমাকে বন দেখাতে ৷
ঘণ্টাখানেক বাদেই সেই আদি-অন্তহীন অরণ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেললাম ৷ যাই হোক বার কতক দিক বদলে শেষ পর্যন্ত আমরা সেই লোহার বল খেলার জায়গায় ফিরে এলাম, জিল এখানেই গাড়ি নিয়ে ফিরে এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ৷
শেষ বেলার ভূরিভোজনের পর আবার সন্ধের মুখে নৈশাহার ৷ এবেলা বাড়ির বাগানে গর্ত করে উনুন বানিয়ে কাঠের আগুনে রান্না, আমি তবু নিরুপায়, কিন্তু না খেলে নাকি চলবেই না ৷ এখনই খিদে না হলে, বেশ তো, আজকের রাতটা এখানে থেকে গেলেই মুশকিল আসান!
তাছাড়া রোজি শাদা ঘোড়া, হীরু ডাকাত, পাখির খাতার লেখককে এভাবে যেতে দেবেই বা কেন? এসব বই রোজির অনেকবার করে পড়া ৷
আমি তো একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম ৷ এত দূরের দেশে এসব অকিঞ্চিৎকর বই আসবে কোত্থেকে, পড়বেই বা কে?
এও সেই মালাকফের মাদাম ঘোষের কারসাজি ৷ তিনিই রোজিকে বই দিয়েছেন ৷ রোজি এমনিতেও বাংলা সাহিত্যের মনোযোগী পাঠিকা, সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ তার সবচেয়ে প্রিয় বাংলা উপন্যাস ৷
থ্রোয়া থেকে ‘বনের ধারে’ গাঁয়ে যাবার সময় সূর্যমুখী খেত চোখ জুড়িয়ে দিয়েছিল ৷ মাঝে মাঝেই গম খেত, তার মধ্যেই হঠাৎ ল্যাভেন্ডারের খেত ৷
যাবার সময় দেখতে দেখতে গেছি, ফেরার পথেও চোখ সরাতে পারি না ৷ জিল বেশ জোরেই গাড়ি চালাচ্ছে, ট্রেন ধরাতে হবে, যদিও নিতান্ত অনিচ্ছায় ৷ ঘড়িতে বোধহয় রাত আটটা, আকাশে তখনও আলো, সূর্যমুখী ল্যাভেন্ডার তেমনই আনন্দের রঙে রাঙা, এবার একটু যেন বিষাদও মিশে আছে ৷
শুনলাম অপেরার কাছেই একটা ব্যাঙ্কে ট্র্যাভেলার্স চেক ভাঙালে একটু বেশি ফ্রাঁ পাওয়া যায় ৷
চেক ভাঙিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়েই আনন্দে মন ভরে গেল ৷ ফ্রাঁ কম পেলাম, না বেশি পেলাম, আমার মন তখন সে হিসাব মেলাতে রাজি নয় ৷
ব্যাঙ্কের সামনেই বিখ্যাত অপেরা, সিঁড়ির ধাপে ধাপে বসে আছে এই দুনিয়ার প্রায় সব দেশের জনমানব ৷ অপেরার সামনে রাস্তা ছোঁয়া সুদীর্ঘ কাফে দ্য লা পে (Cafe De la Paix) বা শান্তির কফিখানা ৷ ফুটপাতেই একটা টেবিল দখল করে এক কাপ কফি নিয়ে বসলাম ৷ সামনে দিয়ে যাচ্ছে আসছে দেশ-দেশান্তরের, ধর্ম-ধর্মান্তরের, ভাষা-ভাষান্তরের, পোশাক-পোশাকান্তরের শুধু মানুষ আর মানুষ ৷ ছোট্ট এক পেয়ালা কফির দাম ২০-২৫ ফ্রাঁ, আমাদের পক্ষে বেশ দামিই, কিন্তু সামনের চলমান মানবমেলার ছবিটি আরও মূল্যবান ৷
একদিন শাঁজে লিঁজে থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম প্লাস দ্য লা কনকর্দ ৷ আরও খানিকটা এগিয়ে গেলে পালে রইয়াল ম্যুজে দ্যু লুভর, অর্থাৎ রাজপ্রাসাদের লুভর মিউজিয়াম ৷ প্লাস দ্য লা কনকর্দে ওবেলিস্ক বা মিশরী মিনারের নিচেই গিলোটিনে শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল ষোড়শ লুই আর তাঁর রানি মারী আঁতোয়ানেতের ৷
প্যারিস এমনই একটা শহর যেখানে দিনের পর দিন একা একা ঘুরে বেড়ালেও শহর কখনও শেষ হয়ে যায় না, বরং যেন পরতে পরতে আরও খুলে যায় ৷ আমি তাই কাজে-অকাজে পথে পথে ঘুরে বেড়াই ৷ রাতে মোনিকের বাড়িতে, আমার ঘরের বইয়ের সংগ্রহ থেকে বেছে বেছে ইংরিজি বইগুলো পড়ি ৷
মাদাম ঘোষ একদিন দুপুরে আমাকে নিয়ে গেলেন মঁমার্ত্র, বাজিলিক দ্য সাক্রে-ক্যর অর্থাৎ পবিত্র হৃদয় গির্জায় ৷ তার কাছেই সালভাদোর দালির মিউজিয়াম-এসপাস মঁমার্ত্র ৷ দালির মূল ছবি ও ভাস্কর্য দেখে সারা বেলা কাটাতে চাইলেও সেটা এখানে আর কিছুমাত্র অসম্ভব নয় ৷
পরদিন নিজের কাজকর্ম শিকেয় তুলে মেট্রোর লাইন বদলে বদলে আমাকে প্রায় পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন ত্রোকাদেরো (Trocadero), পাসি (Passy) হয়ে বির হাকিম (Bir Hakeim)-এ ৷ এই মেট্রো স্টেশন থেকে সামান্য হাঁটলেই আইফেল টাওয়ার ৷ চত্বরে মানুষের মেলা বসেছে, বলা যায় যৌবনের মেলা ৷
বেলারুশের সারসতুল্য একদল বালিকাকে দেখে তাদের ছবি তোলবার জন্য ভাব জমাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তার দরকার হল না, তাছাড়া আমার স্বনিযুক্তা দোভাষীর ফরাসি এদের কাছে অচল, এদের রুশ ভাষাও আমাদের অবোধ্য ৷
ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলার ভঙ্গি করতেই মেয়েরা পরমানন্দে সারি দিয়ে বসল, দাঁড়াল, নাচের ভঙ্গিতে দুজন দুদিকে পেখমের মতো পোশাকের প্রান্ত মেলে ধরল ৷ আমরাও তাদের সঙ্গে ছবি তোলালাম ৷ অনেক চেষ্টায় একটি মেয়ের ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বুঝলাম এরা সবাই সামারে প্যারিসে বেড়াতে এসেছে, কালই দেশে ফিরে যাবে ৷
তুর ইফেল বা আইফেল টাওয়ারেরও ছবি তুললাম ৷ টাওয়ারের গায়ে বড় বড় আলোর অক্ষরে প্রতিদিন লিখে দেওয়া হয় ২০০০ সালের ঠিক কতদিন আর বাকি ৷
ফেরার পথে আবার সেই বির হাকিম, পাসি, ত্রোকাদেরো ৷ ঠিক করলাম, একদিন পাসিতে নেমে বালজাকের বাড়ি যাব ৷
মাদাম ঘোষ ফরাসিদের কাউকে ইংরিজি, কাউকে হিন্দি, কাউকে ওড়িয়া শেখান ৷ ফরাসিদের বাড়িতে সারাদিন বেবি সিটিং করেন ৷ নিজের বাড়িতে বিদেশিনীদের ভারতীয় রান্নার ক্লাস নেন ৷ ক্লাসের শেষে সারা দিনের পক্ব অর্ধপক্ব সুপক্ব ব্যঞ্জন সকলে মিলে আস্বাদ করেন, সেটাই শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের সেদিনের মধ্যাহ্নভোজ ৷
এরকম একটি মধ্যাহ্নভোজে আমারও নিমন্ত্রণ মেলে ৷ ততদিনে আমি লোভালোয়ায় উঠে গেছি ৷
সেদিন আমার অফিসের কাজে সারাদিন প্যারিসেই কাটল ৷ মালাকফে পৌঁছলাম সন্ধে ছটা নাগাদ ৷ ঘরে ঢুকে শুনলাম আমার জন্য সবাই অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সবে খেয়ে উঠেছেন ৷
তবে আমার জন্যও খাবার রাখা আছে, কেবল বেগুন ভাজা আর চাটনি বাদে ৷ ও দুটি পদ রান্নার ছাত্রীরা অমৃতজ্ঞানে নিঃশেষ করেছেন ৷
এঁদের সবাই ফরাসি, একজন শুধু আফগানিস্তানি, সেই কাবুলি মহিলার স্বামী অবশ্য ফরাসি ৷
অম্বিকা বলে একটি মেয়েকে দেখলাম, তার পূর্বজীবনের নাম মেরী, নিজেই ভারতীয় নাম নিয়েছে, মেয়েটি ভারতীয় রান্না শেখে, হিন্দি শেখে, আঠেরো বছর ভরতনাট্যম শিখেছে ৷ একদিন প্যারিসে তার নাচ দেখে অবাক হয়েছি ৷ আরও অবাক ব্যাপার, এঁরা সবাই প্রবল ভারতভক্ত!
পরেও অনেক ফরাসি ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে যাঁরা ভারতীয় ভাষা, ভারতীয় সঙ্গীত, ভারতীয় রান্না শিখছেন, ভারতে আসবার জন্য ব্যাকুল, ভারত যেন তাঁদের নতুন কোনও পথ দেখাবে!
জুন মাসের ২৭ তারিখে, শনিবার সন্ধ্যায় গেলাম ফরাসিদের গলায় বাংলা হিন্দি গান শুনতে ৷ প্যারিসের বাঙালি শিল্পী ও সফল ব্যবসায়ী সম্বিত সেনগুপ্তের স্ত্রী, সুগায়িকা ও সঙ্গীতশিক্ষয়িত্রী কাকলির পরিচালনায় এই অনুষ্ঠান হয়েছিল প্যারিসের আফগানিস্তান কেন্দ্রে, ঠিকানাটি বাংলা করলে দাঁড়ায় ১৬ নম্বর সোনার হাতের পথ, প্যারিস-৭৫০১১ ৷ কাকলি ও তাঁর বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা ও হিন্দি গান শুনে সহসা মনে বিভ্রম জাগে-প্যারিসেই আছি তো!
ভরতনাট্যমের অম্বিকা গাইল-কাঁহা ছুপে ঘনশ্যাম-শ্যাম রে! তবলায় তারই প্রাক্তন স্বামী ৷ আরেকটি মেয়ে গাইল-রিনিঝিনি রিনিঝিনি নূপুর বাজে ৷ মেয়েটির নাম সাবিন ৷ স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ, সুরে বসানো গলা ৷ শুনলাম আট বছর গান শিখছে কাকলির কাছে ৷ একটি ছেলে গাইল নজরুলগীতি-গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা… ৷ খোদ প্যারিসে গুরু ও শিষ্য-শিষ্যাদের সমবেত কণ্ঠে তা তা থৈ থৈ শুনতে শুনতে সুদূর প্রবাসে আমারও মন নেচে ওঠে ৷ কাকলির এই কৃতিত্ব স্বচক্ষে দেখা ও স্বকর্ণে শোনা আমার এবারের প্যারিস ভ্রমণের একটা বড় অভিজ্ঞতা ৷
মোনিকের বাড়িতে ডিনারে আলাপ হয়েছিল মোনিকের বন্ধু মারী ক্রিস্টিনের সঙ্গে ৷ ইনি মাদাম ঘোষেরও বন্ধু ৷ প্রথম আলাপেই আমাকে বললেন, আমাকে মারী ক্রিস্টিন না বলে মারী কৃষ্ণও বলতে পারেন ৷ বছরে একবার অন্তত মাস দুয়েকের জন্য ইনি ত্রিচুর আসেন কথাকলি শিখতে ৷
ভরতনাট্যমের অম্বিকা হিন্দি শেখার সময় কোনও শব্দে হ থাকলে, বার কতক হরিনাম নিয়ে জিভটা শানিয়ে নেয় ৷
লোভালোয়ায় সেই ডিনারেই মোনিকের আরেক বন্ধু এক ফরাসি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি বিশেষ করে আমার জন্যই একটি নিরামিষ ফরাসি পদ রেঁধেছিলেন ৷ তাঁর ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে তিনি আমাকে ভারত সম্পর্কে তাঁর নানা অভিজ্ঞতা ও আগ্রহের কথা শোনালেন ৷
পরদিন সাত সকালেই তাঁর টেলিফোন ৷ কী ব্যাপার, না দুপুরে তার বাড়িতে আমার মধ্যাহ্নভোজের নেমন্তন্ন ৷ এরকম ব্যাকুল নিমন্ত্রণের উদ্দেশ্য? আরও ভারতকথা শোনা ও শোনানো ৷ ছেলেটা ভারত বলতে পাগল! এটা মোনিকের টীকা, তাঁরই ভাষ্য ৷
তবে লোভালোয়ার কথায় প্রথমেই বলতে হয় লোভালোয়ায় আমার প্রথম রাতটির কথা ৷
আজ লোভালোয়া যাব, টেলিফোনে ট্যাক্সি ডাকা হয়েছে ৷ মোনিকের সঙ্গেও ফোনে কথা হয়েছে-রাত নটায় সে নিজে বা তার ছেলে বাড়ির সামনের রাস্তায় নেমে এসে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে ৷
ট্যাক্সি এল প্রায় আধ ঘণ্টা দেরিতে, তখন নটা বাজতে অল্পই বাকি ৷ ট্যাক্সি বলতে ঝকঝকে মার্সিডিজ বেঞ্জ ৷ ড্রাইভার দরজা খুলে বেরিয়ে এল, কৃষ্ণবর্ণ দশাসই চেহারা, হেসে হেসে দেরি হওয়ার কৈফিয়ৎ দিচ্ছে, বাপরে, তারই কী আওয়াজ!
মিটারে এখনই ৭৭ ফ্রাঁ উঠে গেছে, তা বাড়ি খুঁজে না পেলে গাড়ি তো আর বিনা তেলে বিনা মিটারে বাড়ি খুঁজতে পারে না! গলার আওয়াজ শুনি আর মনে হয় সে তো ঠিকই, কিন্তু মাদাম ঘোষ সেকথা শুনবেন না ৷ ড্রাইভারকে ফরাসিতে প্রচুর বকাবকি করে তাকে দিয়ে কড়ার করিয়ে নিলেন, লোভালোয়ায় পৌঁছে মিটারে যত ফ্রাঁ উঠবে তার থেকে সে ৪০ ফ্রাঁ কম নেবে ৷
মাদাম ঘোষ আর আমার সঙ্গে এলেন না, তাঁর ফিরে আসতে রাত হয়ে যাবে, কোরন্ত্যাঁ সেলতোঁ থেকে মালাকফের ক্লো মোন্তোলো আসার বাসও বন্ধ হয়ে যাবে, তাছাড়া তার দরকারও নেই, ভয়ের তো কিছু নেই-ই, মোনিকও আমাকে স্বাগত জানাতে নিচে নেমে এসে বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবেন!
এগারোটা নাগাদ সম্পূর্ণ জনহীন একটা রাস্তায় মস্ত এক বহুতল বাড়ির সামনে আমাকে ও আমার বাক্সটি নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার সামনে এসে বলল, এবার অনুগ্রহ করে টাকাটা দিয়ে দিন মসিয় ৷
মিটারে ১৬০ ফ্রাঁ উঠেছে, তার মানে দিতে হবে ১২০ ফ্রাঁ ৷ রাস্তার আবছা আলোয় টাকা গুনছি, হঠাৎ দেখি লোকটা ঝুঁকে পড়ে ফ্রাঁর নোটগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে ৷ চোখে চোখ পড়তেই লোকটা বলল, তুমি ভাবছ তোমার ফ্রাঁ আমি গিলে খেয়ে নেব, আমি দেখছি ১৬০ ফ্রাঁ গুনতে তোমার কতক্ষণ লাগে! স্কুলে অঙ্কে তো বেশ কাঁচাই ছিলে মনে হয় ৷ আচ্ছা এই নাও, ঘুরে দাঁড়াচ্ছি! বলে সে সত্যিই ছোটদের খেলার ভঙ্গিতে আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল ৷ আমি ১২০ ফ্রাঁ গুনে লোকটার হাতে দিতেই টাকাটা পার্সে পুরে ‘বননুই’ (Bonne nuit) বা গুড নাইট বলে প্রায় চোখের পলকে চলে গেল ৷
মোনিকের বাড়ি এখানে কোথায়? কোনও বাড়ির সামনেই কেউ দাঁড়িয়ে নেই! এই রাস্তাটাই কি রু্য মরিস রাভেল? দু-নম্বরটাই বা কোথায়?
আমাকে নামিয়েছে রাস্তার এক মাথায়, সেখান থেকে রাস্তার ওমাথা পর্যন্ত চোখ বুলোই, ফুটপাত ঘেঁসে শুধু পর পর গাড়ি পার্ক করা, কোথাও একটা লোকও চোখে পড়ল না ৷
সামনেই একটা সতেরো তলা বাড়ি, কিন্তু খোঁজখবর নেবার উপায় নেই, বাড়িটি সবদিক দিয়েই রুদ্ধ, রাস্তাটিও যেন বোবা ও কালা, সম্পূর্ণ স্তব্ধ ও জনহীন ৷ ভাগ্যক্রমে কাউকে যদি এ-বাড়িতে ঢুকতে বা বেরতে দেখা যায়, বা রাস্তায় কোনও গাড়ি থামে কিংবা পথিকের উদয় হয়-এইসব ভেবে নিষ্ফল প্রতীক্ষা করতে থাকি ৷ আমার আর কোনও সন্দেহ রইল না যে দৈত্যাকার ড্রাইভার ভাড়া কেটে নেওয়ার শোধ তুলতে আমাকে ভুল জায়গায় নামিয়ে দিয়ে গেছে!
হঠাৎই গাড়ির মৃদু শব্দ, গাড়িটা আমার সামনে দিয়ে চলে গেল ৷ ভাগ্য ভালো, খানিকদূর গিয়ে গাড়িটা থামল, দূর থেকে রাস্তার আবছা আলোয় মনে হল, গাড়ির চালক খুব সম্ভব গাড়িটা পার্ক করছেন ৷ অগত্যা নির্জন ফুটপাতে বাক্সটা ফেলে রেখেই আমি দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাই, ভদ্রলোক ততক্ষণে গাড়ি পার্ক করে যেদিক দিয়ে এসেছেন তার উল্টো দিকে চলে যাচ্ছেন ৷ গাড়ি যখন এখানে লাগিয়েছেন তখন এপাড়ার বাসিন্দা না হয়েই যান না! আমি দৌড়ে গিয়ে তাঁকে ধরে ফেলে সিল ভু প্লে, এক্সক্যুজে মোয়া ইত্যাদি বলে আমার সমস্যাটা বিবৃত করলাম ৷
মোনিকের ঠিকানাটা রাস্তার প্রয়োজনে আলাদা একটা কাগজেও লিখে রেখেছিলাম, ভাগ্যিস ট্যাক্সিওয়ালার কাছ থেকে ফেরত নিয়েছি, সেটাই এখন এই ভদ্রলোকের সামনে মেলে ধরলাম ৷ পকেট থেকে লাইটার বের করে তার আলোয় ঠিকানাটা দেখে নিয়ে ভদ্রলোক কিছুটা এগিয়ে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বোধহয় বাড়ির নম্বর দেখলেন ৷ এভাবে একেকটা বাড়ির সামনে গিয়ে কী দেখেন আর আরও এগিয়ে যান ৷ শেষ পর্যন্ত রাস্তার ওমাথা পর্যন্ত গিয়ে সোজা আমার কাছে ফিরে এসে এই প্রথম আমার সঙ্গে কথা বললেন, গলার স্বর একেবারে নিস্তরঙ্গ, বললেন, এই নম্বরের বাড়ি এই রাস্তায় নেই, যদিও রাস্তার নামটা ঠিক আছে ৷
দিন কখন শেষ হয়ে গেছে, এখন আর বোঁ জুর (Bon jour) বলা যায় না, হাতঘড়িতে রাত সওয়া এগারোটা ৷ বোঁ সোয়ার (Bon soir) বলব, না বননুই-মাথায় আসছে না, বোধহয় দুটোই বললাম, এমনকী মেরসি বকু (Merci Beaucoup), ওরভোয়ার (Au revoir), আ-বিয়াঁতো (A\ bien-tôt) বলছি শুনতে পেলাম, যার অর্থ আবার দেখা হবে অথবা বিদায়, তদবধি অনেক ধন্যবাদ, ইত্যাদি ৷ ভদ্রলোক আরও এগিয়ে বাঁদিকে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন ৷
একটা দোকান বা টেলিফোন বুথ বা একজন লোক এখানে স্বপ্নের অতীত, মাদাম ঘোষ কেন যে ৪০ ফ্রাঁ বাঁচাতে গেলেন! সামান্য কটা ফ্রাঁয়ের মূল্য আমাকে এভাবে দিতে হবে কে ভেবেছিল!
হঠাৎ দেখি ভদ্রলোক ফিরে আসছেন, হ্যাঁ তিনিই ৷ কিন্তু আমাকে কিছু না বলে আমার সামনের সতেরো তলা বাড়িটার গায়ে ঝুঁকে কী দেখলেন, তারপর আমার কাছে এসে বিনা বাক্যে আমার বিরাট বাক্সটা এক হাতে তুলে নিয়ে বাড়িটার ভারি কাচের পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন এবং আমার প্রতি তাঁর দ্বিতীয় বাক্য-আমি খুবই দুঃখিত, এই সারির এক নম্বর বাড়িটার নম্বরই কী করে দুই হল কে জানে! বলে মোনিকের ফ্ল্যাটের বোধহয় ইন্টারকমের বোতাম টিপে দিতেই অলক্ষ কোনও স্পিকারে শুনলাম-নিশ্চয়ই মিঃ চক্রবর্তী?
আমিও একটা অদৃশ্য, আনুমানিক স্পিকারের দিকে ঝুঁকে বললাম, হ্যাঁ, একটু বেশি রাত হয়ে গেল ৷
‘নো প্রবলেম, তোমার সামনের দরজাটা খুলে দিচ্ছি, ভেতরে ঢুকে লিফটের সামনে অপেক্ষা করো, গ্রেগোয়া যাচ্ছে ৷’
বলা মাত্রই খটাং করে সামনের কাচের পাল্লাটি নিজে থেকেই খুলে গেল ৷
মোনিকের ফ্ল্যাট চার তলায়, তার ছোট ছেলে এসে আমাকে নিয়ে গেল ৷ বেশ রোগাই বলা যায়, ফর্সা মুখে ব্রণর দাগ, ভারি শান্ত, কথাও বলে খুব কম ৷ পরে দেখেছি মা যখন এক-আধ গ্লাস ওয়াইন খেয়ে যে কোনও সামান্য কথাতেই হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার জোগাড়, তখন গ্রেগোয়া আস্তে করে উঠে গিয়ে মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে দুহাতের তালু দিয়ে মায়ের গালে আলতো চাটি মারতে মারতে বলে-‘মা, ওমা, এবার একটু হাসি থামাও দেখি, একটু শান্ত হও, আরে, হাসতে হাসতে পড়ে যাবে যে, মা, ওমা-৷’
গ্রেগোয়া চায় তার দাদাও এসে তার সঙ্গে হাত মেলাক ৷ জঁ য়্যুগো (Jean Hugo) ভাইয়ের থেকে লম্বা, মজবুত স্বাস্থ্য, দুহাতে সস্নেহে সকৌতুকে মাকে জাপটে ধরে, ব্যস, ব্যস, এবার একটু থামো দেখি ৷
মোনিক একদিন এরকম বাঁধভাঙা হাসির মধ্যেই কোনওক্রমে বলল, আমি আবার-দাঁড়া, দ্যাখ, আর-একটা, আবার একটা বিয়ে আমি করবই, তখন দেখিস তোদের কী হয়?
‘শান্ত হও, শান্ত হও, হাসিটা থামাও, এত হাসলে বিয়ে করবে কী করে?’
এবার দ্বিগুণ বেগে হাসি, হাসতে হাসতে মোনিকের চোখে জল, দুহাতে পেট টিপে ধরেছে ৷
গ্রেগোয়াকে দেখতে পাচ্ছি না, আমাকে পৌঁছে দিয়ে বোধহয় ওর ঘরে সেঁধিয়েছে, জঁ য়্যুগোকে তো দেখিইনি ৷ মোনিক আমাকে আমার পরিপাটি সাজানো-গোছানো ঘরটি দেখিয়ে তারপর দরজা খুলে বাইরে এসে দরজার বাইরেই একটি সাদা ও একটি ভীমদর্শন কালো বিড়াল চকিতে চোখের কোনা দিয়ে নির্দেশ করে খুব নিচু স্বরে বলল, তোমার ঘরের দরজা কিন্তু সবসময় বন্ধ রাখবে, না হলে বিড়াল দুটো ঢুকে পড়বেই ৷ ধানের ছড়াগুলোর ওপর ও-দুটোর বড্ড লোভ ৷
লেখার টেবিলে মাটির সরায় প্রায় প্রাগৈতিহাসিক কয়েকটা ধানের ছড়া কেন অত যত্ন করে রাখা আছে জিজ্ঞেস করা হল না ৷
মোনিক খুব কথা বলে, কাজও করে দ্রুত হাতে, আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে সকালের চা ও ব্রেকফাস্টের সাজ-সরঞ্জাম কোনটা কোথায় আছে, চা-কফি জ্যাম-পাউরুটি কোথায় কী পাব, সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরামর্শ দিল ৷ আমি বাঙালিসুলভ কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আরেক ছেলেকে দেখছি না তো, সে কোথায়?
‘কেউ জানে না! বেঁচে আছে কি না তাও বলা যায় না ৷ আজই আমি একটা গাড়ি কিনেছি, ডেলিভারি নেওয়া পর্যন্ত আমি গাড়িটা দেখেছি, তারপরই জঁ য়্যুগো গাড়ি নিয়ে চরতে বেরিয়েছে ৷ প্যারিসে আছে না অন্য কোথাও চলে গেছে, নাকি হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে পড়ে আছে সেটা শুধু সে-ই বলতে পারে ৷’
ডোরবেল বাজল ৷ মোনিক দরজা খুলে দিতেই ভেতরে এল সুদর্শন এক তরুণ, তার নীল চোখ, এ-ই জঁ য়্যুগো ৷
মোনিক প্রথমে খুব একদফা ছেলেকে বকল, তারপর বলল, চাবি তুলে রাখছ কেন, চলো অমরকে নিয়ে এক চক্কর প্যারিস ঘুরিয়ে আনি ৷
অমরেন্দ্র উচ্চারণের অসুবিধা বলে আমাকে অমর বলে ডাকা হবে! সেকথা ছেলেকে ও আমাকে জানিয়ে দিয়ে মোনিক এবার আমাকেই বলল, তুমি আমাদের পক্ষে খুব লাকি, আজই তুমি এলে আর আজই আমাদের নতুন গাড়ি হল ৷ চলো, অন্তত ত্যুর ইফেল দেখে আসবে! রাত তো মোটে ১টা!
রান্নাঘরের বারান্দা থেকে মোনিকই একটু আগে অনেক দূরে আলোয় সাজানো আইফেল টাওয়ার দেখিয়েছিল আমাকে ৷ এখন রাতদুপুরে এই ফরাসি পরিবারের সঙ্গে একেবারে কাছে গিয়ে আইফেল টাওয়ার দেখার কথা ভেবে মন বেশ চাঙা হয়ে উঠল, লোভালোয়ায় প্রথম পদক্ষেপের ঝিম ধরা অভিজ্ঞতার পর এই নিমন্ত্রণের বোধহয় দরকারও ছিল ৷
পরে বুঝেছিলাম, এ হল মোনিকের পরার্থপরতার একটি ধরন ৷ কারও মনে কোনও কারণে বা অকারণে কোনওরকম ভার জমলে মোনিক তার মুখ দেখে তা টের পাবে, আর এই টের পাওয়াটা সে তাকে একেবারেই জানতে দেবে না, তার বদলে আহত বা বিষণ্ণজনের মনোভাব লাঘব করতে কিছু করবার চেষ্টা করবে ৷
জঁ য়্যুগো গাড়ি চালাচ্ছে, তার পাশে বসেছি আমি, মোনিক পিছনে ৷ গ্রেগোয়া বাড়ি আছে না বেরিয়েছে জানি না ৷
রাতের আলো, ঝলমল প্যারিস এভাবে আগে কখনও ঘুরে দেখিনি, এত রাতেও প্রচুর গাড়ির ভিড়ে আইফেল টাওয়ারের খুব একটা কাছে ঘেঁসা গেল না ৷
এর কয়েকদিন পরে আরও আলো, আরও ভিড়, আরও উল্লাস দেখেছি প্যারিসে, সেদিন রাতে আমরা মোনিকের বাড়ি থেকে হেঁটে গিয়েছিলাম শাঁজেলিজে, পুরো ফরাসি জাতটাই সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিল মনে হয়, তারিখটা ছিল ১২ জুলাই, সেদিনই ফ্রান্স ফুটবলে বিশ্বকাপ জিতেছে!
১২ জুলাই সন্ধেয় বাড়ি ফিরে দেখি আমার ঘরের কার্পেট, বিছানা সব ঝকঝক তকতক করছে ৷ বিছানার ওপর আমার একটা হাতাকাটা সাদা গেঞ্জি, একটা ফুলহাতা নীল গেঞ্জি আর বোধহয় মোনিকেরই একটা লাল শিফন জাতীয় কাপড় পেতে ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা করে রেখেছে ৷ আরেকটা শক্ত কাগজ গোল করে কাটা, তাতে লেখা Coupe du Monde. Football Juillet ’98.
ফ্রান্স ব্রাজিলকে এক গোল দিতেই গ্রেগোয়ার ঘর থেকে আর্তনাদের মতো চিৎকার ভেসে এল, সে ঘরে গ্রেগোয়া তার এক বন্ধুকে নিয়ে খেলা দেখছিল ৷ আমি জঁ য়্যুগোর ঘরে আলাদা টিভির সামনে বসে আছি, বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখবার জন্য জঁ য়্যুগো আজ তার ঘরটা বড় টিভি সুদ্ধ আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছে, সে গেছে তার বন্ধুদের সঙ্গে, গ্রেগোয়ার আর্তনাদ শুনে ভাবলাম তবে কি আমারই চোখের ভুল, গোলটা আসলে ফ্রান্সই খেয়েছে?
দ্বিতীয় গোলে আরও উচ্চ আর্তনাদ শুনে নিশ্চিন্ত হলাম, এ তাহলে গ্রেগোয়ার বিজয় উল্লাস!
তৃতীয় গোলের সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি, আশপাশের সব বহুতল বাড়িতে সকলেই ফ্ল্যাট থেকে ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে থালা বাটি কুকার কাঁটা-চামচ ফ্রাই প্যানের কাঁসরঘণ্টা বাজাচ্ছে!
গ্রেগোয়া সবান্ধব সচিৎকার লাফিয়ে উঠল, মোনিক চিলচিৎকার সহ লাফাচ্ছে, এক দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে খানিকটা টুথপেস্ট দুগালে লাগিয়ে এল, তারপর তার শোয়ার-বসার ঘর থেকে লাল লিপস্টিক নিয়ে সাদা টুথপেস্টের পাশে ভালো করে ঘসে দিল তারপর গালে নীল নেল পালিশ লাগিয়ে দুগালেই ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা এঁকে ফেলল ৷ তারপর জোড় পায়ে আরেকবার লাফিয়ে উঠে বলল-চলো শাঁজেলিজে!
এ তো পায়ে হেঁটে চলা নয়, রাস্তার জনস্রোতে ভেসে যাওয়া ৷ স্রোতের কুটোর মতো হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম শাঁজেলিজে ৷ আর্ক দ্য ত্রিওম্ভ ছাড়িয়ে ৷ কান ফাটানো মুহুর্মুহু গাড়ির হর্ন, প্রত্যেক ছুটন্ত গাড়ির দুপাশের জানলা দিয়ে কোমর থেকে বুক-মাথা বের করে রেখেছে ছেলেমেয়েরা, গাড়ির ভেতরে শুধু পা থেকে কোমর পর্যন্ত ৷
চলছে নাচ গান দৌড়াদৌড়ি, রাস্তায় রাস্তায় জনতার ঢল, আনন্দের বন্যা ৷ ফুটপাতে গাছের নিচে, বেঞ্চে শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ৷ ওরই মধ্যে মোনিক একবার আমার কানে প্রায় মুখ লাগিয়ে বলল, ফুটবল আমার একদম ভালো লাগে না!
আমি তো অবাক! এত আনন্দ, এত লম্ভঝম্প কেন তাহলে! রাত দুপুরে হেঁটে হেঁটে শাঁজেলিজে যাওয়াই বা কেন? এতটা রাস্তা ফিরতেও হবে হেঁটে, আমার তো এখনই পা ব্যথা করছে!
গাড়ির হর্ন, লোকের উল্লাস, চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে কথা শোনা যায় না ৷ মোনিক তবু গ্রেগোয়ার কান বাঁচিয়ে আমার কানের কাছে চেঁচিয়ে বলল, আনন্দ করছি কাল অফিস ছুটি পাওয়া যাবে বলে!
তারপর বাড়ি ফিরে বলল, কাল ছুটি, পরশু ছুটি, পরশু ১৪ জুলাই আমাদের জুর নাশিয়নাল (Jour National), আর ১৫ই-তোমার মনে আছে তো? ঠিক বেলা পাঁচটায় বেরব, প্যারিস থেকে একশো কিলোমিটার যেতে হবে, তুমি গ্রাম ভালোবাসো, গ্রামের মধ্যে চাইলে কাছাকাছি ঘুরে বেড়াবে, আমি আর জঁ য়্যুগো ততক্ষণ বাচ্চাটার নানা অভ্যাসের বিষয়ে যত পারি শুনে নেব ৷ তারপর, উঃ, কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার! ল্যাব্রাডর গোল্ডেন রিট্রিভার! ভাবো তো! প্রেসিডেন্ট মিতেরোঁরও ছিল এই ল্যাব্রাডর! গোল্ডেন রিট্রিভার! সবে দুমাস ছাড়িয়েছে, এতদিন নিয়ে আসিনি কেন বলো তো! দুমাস পর্যন্ত এরা মায়ের দুধ খায় ৷
মোনিকের টেবিলে ল্যাব্রাডরের ওপর দুখানা মোটামোটা বই দেখেছি, অফিস থেকে ফিরে যখনই একটু ফাঁক পায়, পড়ে ৷
ফ্রান্সের জাতীয় দিবসে মোনিক আর জঁ য়্যুগো নিজেদের গাড়িতে আমাকে শার্ত্র (Chartre) নিয়ে গেল ৷ প্যারিস থেকে দূরত্ব একশো কিলোমিটার, কিন্তু আমাদের সেদিনের সঙ্গী মোনিকের এক প্রতিবেশিনীর নির্দেশমতো চলতে গিয়ে জঁ য়্যুগো রাস্তা ভুল করে সম্পূর্ণ অন্যদিকে গিয়ে যাওয়া-আসায় প্রায় আরও একশো কিলোমিটার ঘুরিয়ে আনল, প্যারিস শহরের বাইরে টানা নীল আর সবুজের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে আমার ভালোই লাগল ৷
স্থাপত্য-ভাস্কর্য-ধর্মতত্ব-ইতিহাস ও নিসর্গ-গুণে শার্ত্র একটি বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা ৷ দ্বাদশ শতাব্দীর এই বিরাট ক্যাথিড্রাল সারা দিন ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মতো ৷ ভেতর থেকে, বাইরে থেকে, ধর্মতত্ব ও তার ইতিহাসের দিক থেকে, তাছাড়া স্থাপত্য আর ভাস্কর্যের তো একেবারে ভূরিভোজ! পুরো জায়গাটিই ভারি সুন্দর ৷
শুধু ফ্রান্স নয়, পৃথিবীর নানা দেশের পর্যটকদের দেখলাম ভারি নিঃশব্দে খুব আগ্রহ নিয়ে ভক্তিভরে ঘুরে ঘুরে দেখছেন ৷ ক্যাথিড্রাল চত্বর ছাড়িয়ে প্রাচীন এই অঞ্চলের সেকেলে অলিগলিতে পর্যটকদের জন্য অনেকগুলো রেস্তোরাঁও রমরম করে চলছে ৷ তারই একটাতে আমাদের মধ্যাহ্নভোজ সারা হল ৷
জাতীয় দিবস উপলক্ষে সকালের আকাশে ঝাঁকঝাঁক বিমানের কসরত দেখতে দেখতে গেছি, রাতে লোভালোয়া ফিরে এখানকার মেরি (Mairie) বা মিউনিসিপ্যালিটি প্রাঙ্গণে দেখলাম বাজি পোড়ানো ৷ আকাশভরা আলোর খেলা ৷
কাল বিকেল পাঁচটায় মোনিকরা যাবে কুকুরছানা আনতে ৷ আমাকে সঙ্গে যেতেই হবে ৷ মনে আছে তো? তোমার বাপু সময়ের বোধটা একটু কম, ঠিক সাড়ে চারটেয় ফিরে আসা চাই ৷ মনে থাকে যেন ৷ কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় রওনা ৷ ওর কী নাম রেখেছি জানো? ওসলো ৷
ফ্রান্সে প্রতি বছর কুকুরের নামের আদ্য অক্ষর বদলায় ৷ ৯৮-এ আদ্য অক্ষর ধার্য হয়েছে ‘ও’ ৷
ওসলো খুবই চেনা নাম, ও হো, মনে পড়েছে-নরওয়ের রাজধানী ৷
একদিন মোনিক তার বোন ক্যারলের বাড়ি ডিনারের নেমন্তন্নে নিয়ে গেল আমাকে ৷ সেই তাদের নতুন গাড়িতে, গাড়ি চালাচ্ছেও যথারীতি জঁ য়্যুগো, তার পাশে বসেছে তার ছোট ভাই গ্রেগোয়া ৷ এদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক বাংলার গ্রামে ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্পর্কের মতো ৷
ক্যারলদের বাড়ি শোয়েজি লো বোয়াতে ৷ লোভালোয়া থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার ৷ রাস্তার নাম প্রথম অ্যালবার্ট সরবনি ৷ ক্যারল আর তার স্বামী জ্যাক সোলেবু, তাদের দুই মেয়ে এমোলিন আর অ্যানায়েল-এই হল মোনিকের বোনের সংসার, য়্যুগো-গ্রেগোয়াদের মাসির বাড়ি ৷ অনেকদিন পর বোধহয় চার ভাই-বোন একসঙ্গে হয়েছে, ফলে পরস্পরের গালে চুমুর খুব ঘটা! কথারও খই ফুটছে ৷
একে তো গ্রামীণ পরিবেশ, তার ওপর এমোলিন আর অ্যানায়েলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল ৷ এরা যে অনেকক্ষণ ধরে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল সেটা কেউ না বলে দিলেও বোঝা যায় ৷ মুখে আনন্দের ভাব আর এদের আন্তরিক ব্যবহারই সব কথা বলে দেয়!
অ্যানায়েলের বয়েস সাত-আট বছর ৷ সে তার মাসির কাছে শুনেছে একজন কবিকে নাকি মাসি আজ তাদের বাড়িতে নিয়ে আসছেন, সম্মিলিত প্রথম আলাপের পর প্রথম সুযোগেই সে তাই আমাকে তার পড়ার ঘরে টেনে নিয়ে গেল ৷ তারপর তার খাতা খুলে চারটে কবিতা শুনিয়ে দিল, সবই সদ্য রচিত ৷ ক্ষুদে এই ফরাসি কবির সঙ্গে ইংরিজি-ফরাসি জগাখিচুড়ি ভাষায় বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা দিতে পেরে আনন্দ হল ৷ সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল-এর কয়েকটি ছড়াও তাকে ভাঙা ফরাসিতে শুনিয়ে দিলাম ৷
কোনও ঘর নিচুতে, কোনও ঘর উঁচুতে, সিঁড়ি বেয়ে এই উঠছি, এই নামছি, এক জায়গায় সরু একটা মই লাগানো, তার মাথায় নতুন একটা মস্ত বড় ঘর ৷ দেওয়ালের গায়ে সদ্য ফোটানো জানলা দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত বনজঙ্গল দেখা যায় ৷ অ্যানায়েলের সঙ্গে আমার চুক্তি হল, শীতকালে এ ঘরে বসে আমি অনেক কবিতা লিখব ৷ ও-ও লিখবে ৷ আমরা দুজনে মিলেই কবিতা লিখব ৷
এর সঙ্গে আমি যোগ করলাম-কবিতা লিখব আর জানলা দিয়ে নীল আকাশ আর সবুজ বন দেখব ৷
অ্যানায়েল সামান্য ভুরু কুঁচকে বলল, শীতকালে তো নীল আকাশ পাবে না, আর সবকিছু বরফে ঢাকা পড়ে যাবে ৷
পুরো বাড়িটাই প্রায় দেখা হয়ে গেল, কিন্তু জ্যাক অর্থাৎ সোলেবু সাহেব কোথায়? তাকে তো দেখছি না!
ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পিছন দিকে, খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, এখানেই আজ ডিনারের টেবিল সাজানো হয়েছে ৷ মোনিক যেরকম উচ্ছ্বাস নিয়ে ডিনারের কথা বলেছিল, আমি ভেবেছিলাম অনেক লোকজন থাকবে, এখন দেখছি অতিথি বলতে, মোনিকরা ছাড়া, শুধু আমি!
একটু দূরে পায়ের কাছে বড় একটা কাঠের পাটাতন নড়তে শুরু করেছে ৷ কী ব্যাপার, একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে আছি ৷
আস্তে আস্তে পাটাতনের একদিক উঁচু হল আর সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল মানুষের একটা মাথা, ক্রমে গোটা একটা মানুষ ৷ তার দুহাতে দুটি ওয়াইনের বোতল, অতি সন্তর্পণে ধরা ৷ এভাবেই ভূগর্ভ থেকে আবির্ভূত হলেন গৃহকর্তা জ্যাক ৷ অতিথির জন্য ভূগর্ভ থেকে অনেক দিনের পুরনো মদ সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন তিনি ৷
ক্যারলদের বাড়িতে কয়েক রকম চিজের মধ্যে একটি চিজ আমার খুব ভালো লেগেছে শুনে য়্যুগো আমার প্লেটে ওই চিজ অনেকটা তুলে দিল ৷ দেশে ফেরার সময় যাতে নিয়ে যেতে পারি সেজন্য নামটাও আমাকে লিখে দিয়েছে ৷ চিজটার নাম ক্যামেঁবে (Camenbert), একটা ওয়াইনের নামও লিখে দিয়েছে-কালভাদো (Calvados), এটা ওই চিজটার সঙ্গেই গ্রহণীয়, না যে সুরাটি ওর মেসো ভূগর্ভ থেকে বের করেছিলেন, তারই নাম, ভুলে গেছি ৷
খাওয়াদাওয়ার পর জ্যাক বাজাল বেহালা আর সেই বাজনার সঙ্গে মোনিক আর ক্যারল দুই বোন হাত ধরে কোমর ধরে একটার পর একটা নাচল ৷ এর কয়েকটি নাচ বেশ লম্ভঝম্ভময় ৷ বড় মেয়ের বয়স সতেরো, বাবার বেহালার পর সে পিয়ানো বাজাল ৷
হঠাৎ দেখি, জ্যাকের কনুইয়ে রং লেগে আছে, কনুইয়েও জাতীয় পতাকা এঁকেছিল নাকি?
আসলে তা নয়, সে নাকি সারা দুপুর বাড়ির এখানে-ওখানে রং করছিল, বাড়িটা বহু দিনের পুরনো, প্রায় একশো বছর হতে চলল, বাড়ির মেরামতি, অদলবদল, রং করারও তাই শেষ নেই, সে নিজে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছর এই কাজ করছে, কাজটা সে কখনও মিস্ত্রির হাতে ছাড়ে না, একে তো শতাব্দী-প্রাচীন বাড়ি, তার ওপর এটা আবার ছিল ডাকাতদের শুঁড়িখানা, খুব নামকরা ডাকাতের দল ছিল এই অঞ্চলে, এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে, তারা ডাকাতি করতে যাবার আগে এই শুঁড়িখানায় বসে নেশা করত ৷
মাত্র একশো বছরের ব্যবধানে সেই বাড়িতেই একটি ফরাসি বালিকা আমাকে স্বরচিত কবিতা শোনাল ৷ ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ ইতিহাসে এই ঘটনাটি উল্লিখিত হোক বা না হোক, আমার কাছে এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ৷
চা কফি দুধ চিনি কোনটা কোথায় থাকে, মরক্কোর মধু, ইস্তাম্বুলের আচার, আফগানিস্তানের মেওয়া, আফ্রিকার অমুক, বাগদাদের তমুক, কোথাকার মুখশুদ্ধি-কাবার্ড, ফ্রিজ খুলে খুলে মোনিক আমাকে প্রথম রাতেই সব দেখিয়ে দিয়েছিল ৷ ক্যাবিনেটের কোন তাকে বাসনপত্র, কোথায় কাঁটা-চামচ সবই বুঝিয়ে দিয়েছিল ৷
সকাল আটটায় মোনিক অফিসে যায়, ফেরে রাত আটটায়, আমার ব্রেকফাস্টের যাতে কোনওরকম অসুবিধা না হয় সেজন্যই তার এই শিক্ষকতা ৷
সকালে দরজায় মৃদু টোকার শব্দে ঘুম ভাঙল ৷ দরজা খুলে দেখি সেই কালো বিড়াল, ভেতরে ঢোকবার জন্য মুখিয়ে আছে! এ যে মানুষের মতো বন্ধ দরজায় মৃদু করাঘাত করে, মোনিক সেকথা আমাকে কাল বলেনি তো!
দরজা যতটুকু খুলেছিলাম সেই ফাঁক দিয়েই বিড়াল প্রায় আমার পায়ে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে পড়ল ৷ প্রথম সুযোগেই এক লাফে সোজা টেবিলের ওপর! মোনিকের ধানের ছড়া লুট হয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে আমি বুক দিয়ে সেই কবেকার কোন দেশের মৃত্তিকাস্মৃতিবহ ধান রক্ষা করলাম ৷
বাঘের ক্ষিপ্রতা আর শিয়ালের ধূর্ততা মিলিয়ে বোধহয় বিধাতা বিড়াল সৃষ্টি করেন ৷ আমি যত তাকে ঘর থেকে বের করতে চাই, সে ততই খাটের নিচে, আলমারির মাথায় বা আর কোনও দুর্গম কোণে পালিয়ে যায় ৷
অগত্যা ভব্যতা বিসর্জন দিয়ে সাহায্যের জন্য আমি গলা তুলে মোনিক, গ্রেগোয়া, জঁ য়্যুগোর নাম ধরে ডাকতে থাকি ৷ তিনজনের একজনও সাড়া দিল না, তার মানে তিনজনই বেরিয়ে গেছে ৷
গৃহকর্ত্রীর আদরের ধান বাঁচাতে তারই আদরের বিড়ালের সঙ্গে গলদঘর্ম লড়াই মোটেই কিছু বীরত্বব্যঞ্জক ব্যাপার নয়, বেশ বিরক্তিকর ৷ শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়ে, চায়ের জন্য তৃষিত হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ইলেক্ট্রিক কেটলিতে জল ভরে স্যুইচ অন করে দিই ৷ ড্রয়ারে অনেকরকম টি ব্যাগ ৷ ইংল্যান্ডেরই দুরকম-একটা সুগন্ধী মশলাদার, অন্যটা লেমন ৷ কানাডার না অস্ট্রেলিয়ার পিপারমেন্ট চা, চিন বা জাপানের হার্বাল টি, একটা কৌটোয় দেখলাম খোলা চা পাতা, যেন কাকের বাসা সামান্য গুঁড়ো করা ৷ আরেকটা নকশাদার কৌটোয় কোন এক দেশের শুকনো শিকড়-বাকড়, বেশ জট পাকানো, গন্ধটা চেনা-চেনা, তবু চিনতে পারলাম না ৷
জল ফুটে গেছে, আমিও তৈরি, কিন্তু পেয়ালা কোথায়? কোন কাবার্ডের কোন তাকে থাকে কাপ-ডিশ? বাইরে থেকে সব একইরকম পালিশ করা! আন্দাজে আন্দাজে, আশায় আশায় অনেক খুঁজলাম কিন্তু পেয়ালা অধরাই রয়ে গেল ৷ কাজ চালানোর মতো একটা বাটি বা গেলাসও পাওয়া গেল না ৷
রান্নাঘরেই ছোট একটা পাথরের টেবিলে রোজকার খাওয়ার ব্যবস্থা ৷ টেবিলের ওপর দেওয়াল ঘেঁসে রাখা আছে লাঠির মতো লম্বা ও শক্ত পাউরুটি, এদেশে বলে বাগেট ৷ মরক্কো বা মেক্সিকোর মধু বা ইথিওপিয়া কি ইন্দোনেশিয়ার জ্যাম-জেলি যা পাই তাই মাখিয়ে দুয়েক টুকরো বাগেট দিয়ে বিনা চায়েই প্রাতরাশ সারব ভেবে ফ্রিজ খুলে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে সুদৃশ্য একটা কৌটো চোখে পড়ল ৷ জ্যাম বা জেলি হলে আজকের মতো এটা দিয়েই ব্রেকফাস্ট করা যাবে ৷ কৌটোটা বাইরে এনে দেখি তার গায়ে হৃষ্টপুষ্ট ভারি সুন্দর একটা বিড়ালের ছবি ৷ ফরাসি ভাষার কিঞ্চিৎ পাঠোদ্ধারেই বোঝা গেল এটা বিড়ালের একটি সুষম খাদ্য, এমন সুস্বাদু যে দেওয়া মাত্র খেয়ে নেবে, আর তেমনই স্বাস্থ্যকর ৷
একটা পাত্রে মধু পেলাম, বালির মতো দানা দানা ৷ এত গাঢ় যে চামচে করে তুলতে সামান্য জোর খাটাতে হয় ৷
মধু নিয়ে টেবিলে ফিরে এসে দেখি বাগেটের গা ঘেঁসে সাদা বিড়ালটি থাবা বাড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, তার চমৎকার লেজটি একবার বাঁয়ে টেবিলের ওপর আরেকবার ডাইনে পাউরুটির ওপর আলতোভাবে পড়ছে উঠছে, তার চোখদুটি সোজা আমার দুচোখে ৷
আমি মধুর পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে পড়েছি, বিড়ালটা একবার মাত্র কথা বলল, একটি মাত্র শব্দ-ম্যাঁও!
সকলের বসবার ও মোনিকের শোয়া-বসার ঘরের টেবিলে মোনিকের একটা চিরকুট পেলাম, তাতে প্রথমে আমার নাম লেখা তারপর লোভালোয়া থেকে মেট্রোর বিভিন্ন লাইন ও বাসের নম্বর লেখা ৷ সবশেষে রাতে ডিনারে দেখা হবার আশা প্রকাশ ৷ সঙ্গে লোভালোয়ার একটা ছাপানো ম্যাপ জেমস ক্লিপ দিয়ে সাঁটা ৷
নির্জন নিঃস্তব্ধ বাড়িতে নির্বাক সময় কাটাতে কাটাতে মনের মধ্যে আত্মমগ্নতা আসে, হঠাৎ ডোর বেল শুনে চমকে উঠি ৷ প্রথমে সাড়া দিই না, একটু পরে আবার বেল বাজতে গলা বেশ চড়িয়ে বলি, এখন দরজা খোলা যাবে না, আপনি যেই হোন, রাত আটটার পরে আসুন ৷
দরজার বাইরে থেকে কিছুটা রাগী গলায় লম্বা লম্বা ফরাসি বাক্য বর্ষিত হল, আমার সামান্য ফরাসি জ্ঞানে আমি তার কোনও অর্থই করতে পারলাম না ৷
রাতে জানা গেল রান্নাঘরে জলের লাইনে কিছু মেরামতি করতে এসেছিল, তার আসার কথাও ছিল, একটা কাগজে এসব কথা লিখে লেটার বক্সে রেখে গেছে, তাতেই সব জানা গেল ৷
চান-টান করে বাথটব ধুয়ে দিয়ে, পেপার ন্যাপকিন দিয়ে বেসিন শুকনো করে মুছে, নিজে তৈরি হয়ে একই সঙ্গে আচমকা ঠান্ডা হাওয়া ও আকস্মিক বৃষ্টি ঠেকাতে জ্যাকেট চড়িয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি প্রাতরাশ বা মধ্যাহ্নভোজের সন্ধানে ৷
রাতে মোনিককে বাড়িতে ফোন করে বললাম, বোঁ সোয়ার, আমার জন্য আজ আর ডিনার রেখো না, আমি বাইরে থেকে খেয়ে ফিরব ৷ মেরসি বকু, ওরভোয়ার, আ বিয়াঁতো ৷
‘না, না, না, সে হয় না, জঁ য়্যুগো তোমার জন্য আজ একটা ভারতীয় পদ রেঁধেছে, মাছের কারি ৷ নটার মধ্যে চলে এসো, আমি তোমার জন্য একটা ওয়াইন এনেছি-ঠিক নটায়, ভুলো না যেন!’
প্যারিসে ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের বিশেষ উপদেষ্টা বিকাশচন্দ্র সান্যাল ও তাঁর স্ত্রী লেখিকা প্রীতি সান্যাল একদিন নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করলেন ৷ ডান হাতের ব্যাপার ছাড়াও সেদিনের বড় আকর্ষণ ছিল তাঁদের কম্বোজ ভ্রমণ তথা আঙ্কোরভাট দর্শনের টাটকা অভিজ্ঞতা শোনা ৷
কৈশোরে প্রবোধ বাগচীর আঙ্কোরভাট দর্শনের, অথবা প্রায় আবিষ্কারের, বিবরণ পড়ে মোহিত হয়েছিলাম, তারপর গত বছর অমিতাভ ঘোষের নতুন বইয়ে কম্বোডিয়ার পুরনো দিনের কথা, এমনকী ১৯০৬ সালে কম্বোডিয়ার রাজার রাজনর্তকী গোষ্ঠী নিয়ে প্যারিসে যাওয়ার বিবরণ পড়ে কম্বোডিয়া বা আমাদের কম্বোজ ও সেখানকার আঙ্কোরভাট মন্দিরের বিষয়ে আমার খুবই কৌতূহল ছিল ৷ অতএব নিমন্ত্রণ নির্দ্বিধায় গৃহীত হল এবং সেদিন সন্ধ্যার আহার, পানীয়, শ্রবণীয়-সবই অতি উচ্চাঙ্গের হয়েছিল ৷
প্রীতি সান্যাল গাড়ি যত ভালো চালান, রাস্তা বোধহয় তত ভালো চেনেন না ৷ অথবা গাড়ি চালাতে চালাতে কবিতা বলেন বলে রাস্তা ভুল হয়ে যায় ৷ তাড়া না থাকলে তাতে বেশ মজাই হয় ৷ সেদিন লোভালোয়ায় মরিস রাভেল সাহেবের রাস্তা যখন খুঁজে পাওয়া গেল তখন বোধহয় রাত বারোটা ৷ তখনই ঠিক হল, তিনি আমাকে রবিবার সকালে বুলঙের বন দেখতে নিয়ে যাবেন ৷
বোয়া দ্য বুলং (Bois De Boulong) বা প্রচলিত উচ্চারণে বোয়াদ্বুলং, বাংলায় বুলঙের বন বা বুলংবন ৷ প্যারিস শহরের কাছেই ওরকম সাজানো গোছানো অরণ্য, হ্রদ, ওরকম বিরাট এলাকা জুড়ে অনাবিল অক্ষুণ্ণ প্রকৃতি-ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে দেখতে দেখতে আমি মনে মনে মেনে নিলাম যে ঠিক এরকমটা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাই কঠিন, সামর্থ্যের কথা আর তুললাম না ৷ জনসাধারণের দৈনন্দিন বেড়াবার জায়গা অথচ যেন কণ্বমুনি-শকুন্তলার তপোবন ৷ তপোবনের হরিণের মতোই কয়েকটা ময়ূর আমার একেবারে সামনে চলে এল ৷ আমি তাদের আরও কাছে ডাকতে তারা একেবারে আমার বাড়ানো হাতের আঙুল ছুঁয়ে দেয় আর কি!
ভারতে ও নেপালে খ্যাত-অখ্যাত নানা অরণ্যে প্রান্তরে আমি অনেক বনময়ূর দেখেছি, কিন্তু মানুষের এত কাছে, প্রায় আলিঙ্গনের মধ্যে অন্য কোনও ময়ূরকে আমি কখনও দেখিনি ৷ ক্যামেরার ক্লিক শব্দে পিছন ফিরে দেখি প্রীতি ছবি তুলেছেন, তার মুখে উত্তেজনা ৷ বললেন, একটা মহা মুহূর্তের দারুণ ছবি হবে! ছবিটা-কে জানে, হয়তো দারুণই হত, সারা দিন বুলংবনের আরও অনেক ছবিই তিনি তুলেছেন, কিন্তু যতই ছবি তোলা হোক ফিল্ম আর ফুরোয় না, কী ব্যাপার? দেখতে গিয়ে দেখা গেল, ফিল্ম একবারও ঘোরেইনি, তার মানে ঠিকমতো লোড করাই হয়নি ৷
সেদিন আমিও ক্যামেরা নিয়ে বেরইনি, পরে আরেকদিন ক্যামেরা কাঁধে বুলংবনে সারা দিন ঘুরলাম, ঝোপ থেকে চুপি চুপি, কিছুটা সন্ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে এল খরগোশ, জল ছেড়ে গাছের নিচে উঠে এসে ডানা ঝাড়ল কালো হাঁসের দল, আশ্চর্য সব রঙের পাখিরা এক গাছের আড়াল থেকে আরেক গাছের আড়ালে উড়ে গেল, কিন্তু সেদিনের সেই ময়ূরদের কাউকে কোথাও দেখা গেল না ৷
কয়েক দিন পর একদিন সকালে গেলাম ফনতেন ব্লো ৷ প্যারিস থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ফনতেন ব্লোতে ফ্রান্সসম্রাট প্রথম ফ্রান্সিসের বিশাল রাজপ্রাসাদটি নেপোলিয়ানের স্মৃতিপ্রাসাদ হিসাবেই বেশি পরিচিত ৷ একদিকে ঘরে ঘরে সেই ইতিহাসচিহ্ন, আরেক দিকে প্রাসাদসংলগ্ন, জলাশয়স্নিগ্ধ, অরণ্যবেষ্টিত উদ্যান ৷ সেদিন আবার মুহুর্মুহু মৃদুমন্দ বৃষ্টির দিন ৷ সেদিন ইতিহাসে-প্রকৃতিতে একাকার একটি দিনযাপনের স্মৃতি নিয়ে লোভালোয়ায় ফিরে এসেছিলাম ৷ সেদিনও সাথী ও সারথী ছিলেন প্রীতি ৷
মাদাম ঘোষের বড় ছেলে সমুদ্রবিদ, গোয়ায় তার সামুদ্রিক চাকরি ৷ মেজ ছেলে আমেরিকায়, একমাত্র মেয়ে সুইজারল্যান্ডে পি এইচ ডি করছে, ছোট ছেলে বুডঢা হঠাৎ আমেরিকায় চাকরি পেয়েছে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই নিউ ইয়র্কে যাবে, মা যাবেন তাকে লন্ডনের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসতে ৷ সেখান থেকেই যাবে নিউইয়র্ক ৷
বুডঢা ভারি বন্ধুবৎসল ৷ কয়েকদিন আগে বন্ধুদের সঙ্গে কোন একটা দ্বীপ থেকে ঘুরে এল ৷ বাড়িতে সর্বদাই বন্ধুসমাগম ৷ রাতে কখনও কখনও মেঝের ওপর বিয়ে বাড়ির মতো লম্বা টানা বিছানা পড়ে ৷
যাবার আগে এক বোতল ওয়াইন আর সালমন মাছের ঝোল-ভাত দিয়ে আমরা বিদায়ভোজ সারলাম ৷
একবার প্যারিসে একটা কম্পিউটার সংস্থায় চাকরি করার সময় বুডঢা ও তার বস নিজেদের কর্মস্থলে একদল ডাকাতের হাতে বন্দী হয় ৷ দুজনের হাত পা মুখ বেঁধে ডাকাতরা টাকাপয়সা ও অনেকগুলো কম্পিউটার নিয়ে চলে যায় ৷ বসই কারখানার মালিক, জাতে তুর্কি, পৈতৃক বাড়ি ইস্তাম্বুলে ৷ এই ডাকাতির পর কারখানা বেচে দিয়ে দেশে চলে যায় ৷ এখনও প্রতি বছর প্যারিসে এলে সেই তুর্কি ছেলেটি আর তার মা বুডঢাদের ইস্তাম্বুলে যাবার নেমন্তন্ন করে ৷
মাদাম ঘোষ সম্ভবত আমার সম্পর্কেও ওদের কাছে সাতকাহন বলে থাকবেন ৷ আমি কলকাতায় ফিরে আসার অনেকদিন পরে, এই তো গত মাসেই একদিন মালাকফ থেকে টেলিফোন এল-এখনই প্যারিসে যেতে হবে, কেননা এ সপ্তাহেই ইস্তাম্বুল না গেলেই নয়, তার কারণ ইস্তাম্বুলিরা গত সপ্তাহে প্যারিসে এসেছেন, এ সপ্তাহেই ফিরে যাবেন, আমাদেরও সেখানে নেমন্তন্ন, ইস্তাম্বুলে এঁদের মস্ত বড় বাড়ি, যতদিন খুশি থাকা যাবে, কাল রাতে খুব করে বলেছে, আমাদেরও বলতে বলেছে, সেইজন্যই এই ফোন, অতএব প্যারিসে এক্ষুনি চলে আসছি নিশ্চয়ই?
খোদ প্যারিসে ফরাসি পরিবারে বেবি সীটিং করে আর ফরাসিদের ইংরিজি হিন্দি ওড়িয়ার শিক্ষকতা করে মাদাম ঘোষের এরকম অনেক বন্ধুবান্ধব লাভ হয়েছে ৷ অতীতে তিনি দার্জিলিং আর কাশ্মীরের স্কুলেও পড়িয়েছেন দীর্ঘকাল ৷ ফলে বছরের নানা সময় নানা জায়গায় তাঁর বেড়িয়ে যাবার নেমন্তন্ন মেলে, তার দুয়েকটি আমাকেও তিনি দিতে চান ৷ ইস্তাম্বুলের আমন্ত্রণ এইরকমই একটি ৷
উঠল বাই তো তুর্কি যাই! এরকম পক্ষীজীবন কে না চায়? কিন্তু পাই কী করে?
ছেলেকে গার দু নর বা উত্তরের স্টেশন থেকে লন্ডনের ট্রেনে তুলে দিয়ে সেই যে মুখ ফেরালেন, আর পিছনে তাকালেন না, চোখে এক ফোঁটা জল নেই, যেন নীরব কান্নার প্রস্তুরমূর্তি ৷
পরদিন আমাকে নিয়ে গেলেন প্যারিসের একটা অসামান্য নার্সারিতে ৷ বিচিত্র সব লতাগুল্ম আর পত্রপুষ্প চিরকালই আমার কাছে এক বিস্ময় ৷ এখানেই আমি প্রথম পতঙ্গভুক উদ্ভিদ দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি ৷
আরেকদিন মাদাম ঘোষ নিয়ে গেলেন প্যারিসের একটি পটারি প্রদর্শনীতে ৷ চোখ জুড়িয়ে গেল ৷ ঘুরে ঘুরে একেকটি পাত্রের আকার দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই কোন ছেলেবেলায় জয়নগর-মজিলপুরের প্রত্নতাত্বিক কালিদাস দত্তের বাড়িতে মৌর্যযুগের পটারির সৌন্দর্য আর জ্যামিতিক শুদ্ধতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম ৷
প্যারিসে দু-দশদিনের জন্য এসে ভিনদেশী কেউ এ শহরের সব মিউজিয়াম আর এক্সিবিশন দেখে শেষ করেছে এরকম কারও দেখা পাওয়া বোধহয় সম্ভবই নয় ৷ কত যে মিউজিয়াম আর কত যে প্রদর্শনী আর কত যে অনুষ্ঠান-তার যেন আর লেখা-জোখা নেই, সব নিয়ে প্যারিস সব সময় জেগে আছে ৷
আরও কদিন পর মাদাম ঘোষ নিজেই লন্ডনে যাবার তোড়জোড় করতে লাগলেন ৷ মেজ ছেলে অফিসের কাজে লন্ডনে আসছে, সময় কম, ফলে এবার আর প্যারিসে আসা হবে না, অতএব ছেলে বউ নাতিকে দেখতে তাঁকেই লন্ডনে যেতে হবে ৷
কিছুদিন পর মাদাম ঘোষের ফেরার সময় হয়েছে অনুমান করে আমি ফোন করতেই জানা গেল ভিসার গোলমালে তাঁর লন্ডনে যাওয়াই হয়নি ৷ মন তাই খুবই খারাপ ৷ তবে খুশির খবর, কটক থেকে তাঁর ভাই ও ভ্রাতৃবধূ এসেছেন ৷
রবিবার মোনিকের পুরোপুরি গৃহকর্মের দিন ৷ কাচাকাচি ধোয়া-মোছা ধুলো ঝাড়া ইস্তিরি করা সাপ্তাহিক বাজার করা-সব সময় একটা না একটা চলছেই ৷ তারই মধ্যে চলছে উজবেকিস্তান, উরুগুয়ে, আরব, আফ্রিকা, আমাজন, আন্দালুশিয়া বা আর কোনও দেশ বা প্রদেশের লোকসঙ্গীত ৷ কাজে মগ্ন, আবার গানও শুনছে মন দিয়ে, গান থেমে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে এসে ক্যাসেট বদলে দিয়ে যায় ৷ এত দেশের এত রকম জাতি-উপজাতির এত রকম ভাষা ও সুরের লোকসঙ্গীত শুনতে শুনতে মনে হয় এতদিন এই পৃথিবীর এইসব মনুষ্যগোষ্ঠীর এমন প্রাণের গান না শুনে জীবন আমার কাটছিল কীভাবে?
মোনিক আমার ঘর থেকে আমার বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, হাত-মোছা মাথা-মোছা ও স্নানের তোয়ালে ও টার্কিশের দস্তানা বা গঁ (Gant) নিয়ে যায়, ছাড়া কাপড়ের বাক্স থেকে তুলে নেয় আমার জামা-কাপড় ৷
আমার প্রতিবারের আপত্তি সত্বেও আমার সারা সপ্তাহের রুমাল, মোজা ও অন্যান্য অন্তর্বাসও সে কাচতে নিয়ে যায় ৷ আমি যতই কেন আপত্তি করি, যতই বলি এগুলো আমি নিজেই কেচে নিতে পারব, তার একই উত্তর-ওতে আমার কাজের ব্যাঘাত হবে ৷
কাচার পরে এর প্রত্যেকটি জিনিস মোনিক নিজের হাতে ইস্তিরি করে ৷ তার মধ্যে হঠাৎ কখনও পিয়ানোয় বসে ৷ তার কাজে সশ্রম নিষ্ঠা আর সঙ্গীতে সক্রিয় অনুরাগ রীতিমতো শ্রদ্ধার বস্তু ৷
সে তুলনায় মোনিকের রান্নাঘর আমার কাছে বেশ বিভ্রান্তিকর ৷ খাবার-দাবার কোনটা কোথায় গৃহকর্ত্রীর স্নেহে যত্নে আত্মগোপন করে আছে আমার পক্ষে তার হদিশ পাওয়া কঠিন ৷
একদিন এরকম অনাহারে দুপুর তিনটে বাজিয়ে অন্নসূত্র আবিষ্কারের নিষ্ফল সাধনা ভঙ্গ করে আমি পথে বেরই ৷ রেস্তোরাঁর মধ্যাহ্নভোজের সময় পার, অতএব বাড়ি থেকে বেরিয়ে সবচেয়ে কাছের চিনে দোকানেই ঢুকে পড়ি ৷
মেনু চিনে ভাষায়, ওয়েটাররাও চিনে ভাষী, আমার পক্ষে সঠিক খাদ্য নির্বাচন করা ভারি শক্ত হয়ে দাঁড়াল, যদি বা আন্দাজে কোনও পদ ভাবি সেটা ভাষায় প্রকাশ করার সব চেষ্টাই বিফলে যায় ৷
রেস্তোরাঁ দুপুরের মতো বন্ধ হবার মুখে, সব টেবিল খালি ৷ কেবল আমার দুটি টেবিল পরে একটি টেবিলে একজন মহিলা বসে আইসক্রিম খাচ্ছেন ৷ তিনি হঠাৎ আমার টেবিলের সামনে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বললেন, আপনি কোনটা চাইছেন আমাকে বলুন, আমি এদের বুঝিয়ে দিচ্ছি ৷
কোনটা চাই তাই কি জানি? যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই এমনও তো হতে পারে ৷ আমার সমস্যা শুনে মহিলা মেনুর দুয়েকটি পদ আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন ৷ তার মধ্যে একটা রাইস সস সহযোগে মাছ ৷ রাইসের ছোঁয়া যখন আছে, সঙ্গে আবার মাছ, আর কিছু না ভেবে আমি ওই পদটিই বাছলাম ৷
এক দানা ভাতও নেই, শুধু একটা জলীয় পদার্থ, সেটাই নিশ্চয় রাইস সস, তার মধ্যে বড় একটা মাছের টুকরো-এই হল ৪৮ ফ্রাঁ মূল্যের একটি চিনা ব্যঞ্জন ৷
খিদের মুখে এক টুকরো মুখে দিয়েই হাতের আড়াল দিয়ে কাগজের ন্যাপকিনে ফেলে দিতে হল-নিমপাতার মতো তেতো ৷
আমার দুর্দশায় আমার চেয়ে সেই পরোপকারী মহিলাই বোধহয় বেশি দুঃখ পেয়েছেন, আমি আইসক্রিম খাই না শুনে আরও দুঃখিত হলেন, অগত্যা এক কাপ কফির নিমন্ত্রণ আমাকে স্বীকার করতেই হল ৷
কফি খেতে খেতেই তিনি আমাকে, আমি ভারত থেকে এসেছি শুনে, বললেন, আপনি পর্তুগিজ নাচ ভালোবাসেন? আজ সন্ধ্যায় আসুন না-এটা শুধুই পর্তুগিজ নাচের আসর! এই লোভালোয়াতেই!
আমি বললাম, আমার বোধহয় সন্ধেবেলা একটা কাজ আছে ৷ কটার সময় আপনাদের অনুষ্ঠান?
একটা কাগজে নিজের টেলিফোন নম্বর লিখে দিয়ে বললেন, রাত নটা থেকে শুরু ৷ আমাকে আটটার মধ্যে ফোনে জানিয়ে দিলেই হবে ৷ আমি পর্তুগিজ নাচ খুব ভালোবাসি ৷ আপনারও হয়তো ভালো লাগবে, চলে আসুন ৷ আমার নাম মারিয়া জোসে ৷
প্যারিসের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত থেকে লোভালোয়া-পেরে (Levallois-Perret)-র শুরু ৷ মোনিকদের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে সোজা নিচের দিকে তাকালেই একটা রাস্তা, তার ওপারে প্যারিস, এপারে লোভালোয়া ৷ এখানকার মেট্রো স্টেশনের নাম পর্ত দ্য শামপেরে (Porte De Champeret), বাংলায় বলা যায় শামপেরের দরজা ৷ মোনিকদের বাড়ি থেকে মেট্রোর দিকে যেতে পথে বড় একটা গির্জা পড়ে, ফেরার সময় মেট্রো স্টেশন থেকে ওপরে উঠেই সেই গির্জা ৷ গির্জার সামনের রাস্তার নাম দেখে আমার বুক জুড়িয়ে গেল-অ্যাভেনিউ স্তেফান মালার্মে (Ste’phane Mallarme’) ৷ মালার্মের নামের নিচেই লেখা Poet 1842-1898 ৷
আমাদের বাড়ির কাছাকাছি ৯৪ নম্বর বাসের টার্মিনাস ৷ তার কিছু আগে একটা রাস্তায় আমি অনেকদিন অকারণ হেঁটেছি, তার কারণ রাস্তাটার নাম রু্য ভিকতর য়্যুগো (Rue Victor Hugo) ৷
জোসে মারিয়াকে কফির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ভিকতর য়্যুগো সরণিতে মনে মনে ‘লে মিজারেবল’ (Les Mise’ rables)-এর কথা নাড়াচাড়া করতে করতে ৯৪ নম্বর বাসের টার্মিনাসে এসে দেখি মারিয়া আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ৷ এই বাস টার্মিনাস সেই চিনা রেস্তোরাঁ থেকে মাত্রই কয়েক কদম ৷ আমি সময় কাটাবার জন্য, আর সামান্য কিছু খাদ্যের সন্ধানে, অভ্যাসবশত ভিকতর য়্যুগো সরণি ঘুরে এখানে এসেছি ৷ মুখোমুখি হতে দুজনেই হাসলাম, কেননা হাসতেই হয় ৷ বাস আসতে উঠেও পড়লাম ৷ কথায় কথায় জানা গেল, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মেক-আপের সাজ-সরঞ্জামের দোকানে যাচ্ছে মারিয়া, খুব পুরনো আর বড় সেই দোকান, মেক-আপের জিনিসপত্র কিনতে মারিয়া সেখানে নিয়মিত যায়, শিল্পীদের মেক-আপ লাগানোই তার পেশা ৷ আমি চাইলে তার সঙ্গে যেতে পারি, দোকানটা বহুকালের পুরনো, ফরাসি বিপ্লবেরও আগেকার ৷
গেট দিয়ে ঢুকে, উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির উঠোনের মতো একটা মস্ত বড় চত্বর পেরিয়ে একটা হলঘরে এসে পৌঁছলাম ৷ সামান্য স্যাঁতসেতে, লম্বা টানা কাউন্টারের ওপারে কয়েকজন পুরুষ-মহিলা বিক্রয়কর্মী তুলি হাতে কাউন্টারের এপারের কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ কয়েকজন সদ্য ও মধ্য তরুণীর মুখে কুমোরটুলির চক্ষুদানরত শিল্পীদের মতো অত্যন্ত সন্তর্পণে তুলি বুলোচ্ছে, কোথাও একটা তিল পতনের শব্দও নেই ৷
একেকটা নতুন নতুন বা আগের চেয়ে উন্নত প্রসাধন সামগ্রীর প্রয়োগ ও সুফল গালে গলায় কপালে নাকের ডগায় যাচাই করে মারিয়া বেশ কয়েকটি জিনিস কিনে নিল ৷ তারপর আমাকে মেয়েদের একটা চমৎকার ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা তোমার স্ত্রীকে আমার উপহার ৷
আমার নিরবচ্ছিন্ন না-না, সে হয় না ইত্যাদি শুনে মারিয়া বলল, এটা একটা সামান্য জিনিস, মেয়েদের একটা ছোট ব্যাগ ছাড়া কিছু নয়, এটা নিয়ে আবার কথা হয় নাকি!
অগত্যা ব্যাগের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে পর্তুগিজ নাচে যোগ দিচ্ছি কিনা তা ফোনে জানাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি উল্টো দিকে রওনা হলাম ৷ আমার ফোন পেলে মারিয়া আমাকে রাস্তা বুঝিয়ে দেবে ৷
সন্ধেবেলা গেলাম প্লাস দিতালি (Place d’Italie)-তে বাংলাদেশের প্যারিস প্রবাসী শিল্পী সাহাবুদ্দিনের বাড়ি ৷ সেখানে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ ৷ ফরাসি টিভিতে সেদিন বিশ্বকাপ ফুটবলে নাইজেরিয়া-ডেনমার্কের খেলা চলছিল ৷ সাহাবুদ্দিন মনে হয় পারলে শুধু শুভকামনা আর শুদ্ধ উত্তেজনা দিয়েই কালোদের জিতিয়ে দেন ৷ কখন নাইজেরিয়ার গোল দেবার সম্ভাবনা, কখন-বা তাদের গোল খাবার আশঙ্কা, টিভির পর্দায় না তাকিয়ে শুধু সাহাবুদ্দিনের মুখ চোখ দেখেই বলে দেওয়া যায় ৷ এমনকী সম্ভাবনাটা ক্ষীণ না প্রবল, আশঙ্কা সামান্য না সীমাহীন তাও শিল্পীর মুখের রংবদল থেকে বোঝা যায় ৷ কিছুক্ষণ পর আমিও কেন জানি না নাইজেরিয়ার দলেই ভিড়ে গেলাম ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাইজেরিয়াকে বাঁচানো গেল না ৷
শিল্পী সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে অকাল-প্রয়াত শিল্পী, আমাদের দুজনেরই প্রিয়, পূর্ণেন্দু পত্রীর স্মৃতিচারণা করে মন ভরে উঠল ৷
খেলার মাঠে পরাজয়ের দুঃখও ভুলে গেলাম সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী আনার হাতের অতি সুস্বাদু রান্না খেয়ে ৷ তাঁদের মেয়েদুটির সঙ্গেও চমৎকার সময় কাটল তাদের ছবি দেখে ৷ রাতে আরেকদিনের নিমন্ত্রণ স্বীকার করে বিদায় নিলাম ৷
একদিন গেলাম বাস্তিই (Bastille) ৷ রাস্তার মাঝখানে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের জুলাইমিনার (Colonne de Juillet), বাস্তিই দুর্গ পতনের স্মরণস্তম্ভ ৷ তার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ৷ স্তম্ভের গায়ে-লেখা নামগুলি শুনলাম ফরাসি বিপ্লবের স্মরণীয়দের নাম ৷ কাছেই বাস্তিইয়ের অপেরা, প্যারিসের অপেরা হাউসের চেয়ে ছোট, প্রাচীনের পাশে আধুনিক স্থাপত্যের সংযোজন ৷
রোজই ঘুম থেকে উঠে ভাবি, ভের্সাই (Versailles) যাব ৷ মঁপারনাস (Montparnasse) থেকে ট্রেনে ঘণ্টা খানেকের পথ, খুব সকালে বেরিয়ে সারাদিন ধরে রাজপ্রাসাদ, রাজার মহল, রানির মহল দেখে সন্ধ্যায় সুরধ্বনিময় জলের ফোয়ারা, আলোর আলপনা উপভোগ করে রাতে ফিরে আসব ৷ ফ্রান্সের রাজা-রানি, বিশেষ করে রাজা ষোড়শ লুই আর রানি আঁতোয়ানেতের ভের্সাইয়ের বাসগৃহ দেখার আগ্রহ আমার অনেকদিনের ৷ বছর বারো আগে রাশিয়ায় রুশ সম্রাটদের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে ঘুরতে ঘুরতে আমার হঠাৎ ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুই আর রানি আঁতোয়ানেতের কথা মনে পড়েছিল ৷
ভের্সাইয়ে যাবার কথা ভাবতাম আরও একটি বড় আকর্ষণে ৷ আমাদের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্যারিস থেকে ভের্সাইয়ে এসে বসবাস করতে থাকেন ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৷ এখানে কবির জীবনের একটি প্রবল পর্ব কাটে ৷ আমার মনের কোণে সঙ্গোপনে মহাকবির স্মৃতিচিহ্নময় বাড়িটি দেখার খুব ইচ্ছা ৷ কৈশোরে অনেকদিন ভেবেছি, ভের্সাইয়ের যে বাড়িতে বসে মাইকেল কবিতা লিখতেন, বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখতেন, সেই বাড়িতে আমি একদিন সারাদিন শুধু চুপ করে বসে থাকব ৷ মনে মনে ভয়ও আছে, হয়তো তাঁর অনেক স্মৃতিই মুছে গেছে, সেখানকার লোকেরা হয়তো এই বাঙালি কবির নামও শোনেনি ৷ বছর দশেক আগে একবার জার্মানির মারবুর্গে বিশ্ববিখ্যাত রূপকথাকার গ্রিম ভাইদের এক অস্থায়ী আবাস খুঁজতে গিয়ে হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম, স্থানীয় বাসিন্দারা কেউই জানে না কোন বাড়িতে গ্রিম ভাইয়েরা ছিলেন ৷ শেষ পর্যন্ত এক সুবেশ দম্পতিকে যখন এ-বিষয়ে জিজ্ঞেস করছি ও যথারীতি তাদের অজ্ঞতার কথা শুনছি তখন হঠাৎই তাদের মাথার ওপর দিয়ে রাস্তার গায়েই একটা পুরানো দোতলা বাড়ির দেওয়ালে আমার চোখ আটকে গেল ৷ সেখানে স্পষ্ট অক্ষরে গ্রিমদের নাম লেখা আছে ৷ যে বছরটি তাঁরা এখানে ছিলেন সেই বছরটির উল্লেখ করে লেখা আছে-হিয়ার লিভড গ্রিম ব্রাদার্স, অথচ ওখানকার লোকেরা কেউ তা জানে না ৷ শুধু পথচারীরাই নয়, স্থানীয় দোকানদাররাও কেউ জানে না ৷
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে এক-দেড়শো কিলোমিটার দূরে অজানা শহরে গ্রিম ভাইদের স্মৃতিচিহ্ন যেমন খুঁজে খুঁজে উদ্ধার করেছিলাম, তেমনই হয়তো মাইকেলের মর্মস্পর্শী প্রবাসজীবনের স্মৃতিজড়িত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, কফিখানা, পানশালা খুঁজে বার করতে পারব ৷
ভের্সাই শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হল না ৷ যাওয়া হল না আরও অনেক জায়গায় ৷ দুবছর আগে সদা-ভ্রমণোন্মুখ, আজকাল পত্রিকার প্রধান সম্পাদক প্রতাপকুমার রায়ের সঙ্গে যখন লুভর (Louvre) মিউজিয়ামে শিল্পের ইতিহাস আর ইতিহাসের শিল্প দেখে বেড়াচ্ছিলাম, তখন অনেক অদেখার দুঃখেও মনকে শান্ত করেছিলাম এই বলে যে পরে যদি আবার এই ইউরোপীয় শিল্পের মহাতীর্থে আসবার সুযোগ পাই, দর্শন শুরু করব আরও সকালে এবং পরপর কয়েকটা দিন শুধু লুভর দেখেই কাটাব ৷ এবার সেই লুভরও যাওয়া হল না ৷ পরে কলকাতায় ফিরে মৈত্রেয়ীর মুখে যখন শুনলাম খুব সস্তায় একটা টিকিট কাটা যায় যা দিয়ে প্যারিসের সব কটি যাদুঘরে যতবার খুশি যাওয়া যায়, তখন আমার দুঃখ আরও বেড়ে গেল ৷ মৈত্রেয়ী দিনের পর দিন ওইসব মিউজিয়ামে ঘুরে ঘুরে দুচোখ ভরে দেখেছে আর খাতার পাতা ভরে নোট করেছে, কলকাতায় ফিরেই ওকে যেতে হয়েছিল হায়দ্রাবাদে ফরাসি লেখাপড়ার কাজে, ফিরে এসে খাতাটি আর খুঁজে পায়নি ৷
ভের্সাই বা লুভর বা আরও অনেক বিখ্যাত দ্রষ্টব্য বা গন্তব্য এযাত্রা বাদ গেল তার কারণ দিনের কাজকর্ম মিটিয়ে খালি হতে হতে দিনও শেষ হয়ে যায়, তখন কোথাও আর যাত্রা শুরু বা দর্শন আরম্ভ করার সময় থাকে না ৷ এইসব দিনে আমি সন্ধেবেলা শাঁজেলিজে (Champs-Elyse’ es) গিয়ে ফুটপাতের কাফেতে এক কাপ কফি বা এক গ্লাস ওয়াইন নিয়ে বসে থাকি ৷ বিশ্বকাপের খেলায় যেদিন যে দেশ জেতে সেদিন সে দেশের মানুষ ফুটপাত জয়োল্লাসে ভাসিয়ে, স্বদেশী গান-বাজনায় পুরো রাস্তা মাতিয়ে আমার সামনে দিয়ে চলে যায়, সে এক ভারি আনন্দের দৃশ্য ৷ কখনও আবার তারা কাফেতেই বসে পড়ে, বসে-দাঁড়িয়ে চলতে থাকে গান-বাজনা, সমবেত নাচ ৷ বিশ্বকাপ ফুটবলের দৌলতে শাঁজেলিজেতে বসেই আমার অনেক দেশের গান-বাজনা শোনা হয়ে গেল ৷
এরমধ্যে একদিন, যখন মালাকফে ছিলাম, টেলিফোনে আমাকে নেমন্তন্ন করলেন দীর্ঘদিনের ফরাসিদেশপ্রবাসী অসীম রায় ও তাঁর বন্ধু ও বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ৷ এঁরা দুজন এবং এঁদের আরেক বন্ধু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আবাল্য সুহৃদ ভাস্কর দত্ত গাড়িতে ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে সবে অসীম রায়ের গৃহে ফিরেছেন, ভাস্কর সেদিনই লন্ডন চলে যাবেন, তিন বন্ধুর জমাটি আড্ডা চলছে, সেখানে সামিল হবার ডাক পেয়ে আমার খুবই আনন্দ হল, কিন্তু আমার সেদিন মালাকফ ছেড়ে যাবার উপায় নেই, ফ্রান্সের এক গ্রামে এক মেষপালকের বাড়িতে আমার কিছুদিন থাকার কথা, তাদের গ্রামে তাদের মতোই জীবনযাপন করব, ব্যবস্থা করে দেবে ওই বাড়িরই একটি মেয়ে, সে ওই মেষপালক ছেলেটির দিদি, মেয়েটির সঙ্গে মাদাম ঘোষের অনেকদিনের চেনাশোনা, সে প্যারিসের হাসপাতালে নার্সের চাকরি করে, আজ আসবে কতদূর কী হল জানাতে ৷
আমি তাই নিরুপায় হয়ে যেতে পারছি না, ফোনেই সবিনয়ে জানাই, ওঁদের পক্ষে যদি এখানে আসা সম্ভব হয় তাহলে এই বাগানে বসে দুয়েক গ্লাস ফরাসি ওয়াইন ও দুয়েক ঘণ্টা বাঙালি আড্ডা চলতে পারে ৷
অসীম রায় বললেন, বাগান তো আমার বাড়িতেও আছে, চলে আসুন, বেশ বড় বাগান ৷
হঠাৎ ভাস্কর দত্তের গলা-চলে আসুন তো, কেন এত হেনস্থা করছেন ভাই?
এর ঠিক আট মাস পরে বন্ধুদের সবাইকে চরম হেনস্থা করে ভাস্কর তাঁর দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু সুনীল ও অসীমের সঙ্গে মানালিতে বেড়াতে গিয়ে প্রায় চোখের পলকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ৷
তিন বন্ধুর আড্ডায় আমার যাওয়া হল না, প্যারিসের কত কী আমার দেখা হল না, এদিকে নিস (Nice) যাবার সময় হয়ে গেল ৷
ওসলো আসার পর থেকেই বিড়াল দুটি সর্বদাই টেবিলের ওপর, আলমারির মাথায় উঠে বসে থাকে, ওসলোর ভয়ে নিতান্ত দায়ে না পড়লে নিচে নামে না ৷ এদের মধ্যে কালো বার্মিজ বিড়াল ইয়োফি (Yofi, হিব্রু শব্দ, অর্থ O.K., well, good) খুব বুদ্ধিমান, উঁচু থেকেই ওসলোর ঘুমের গভীরতা যাচাই করে, নিশ্চিন্ত হলে তবেই খেতে-টেতে নামে ৷ শ্বেতাঙ্গটির নাম ফাফা (Fafa), যার অর্থ ‘কিছুই না’ ৷ নামের মানেটি যেমন, বুদ্ধিতেও তেমনই, ফাঁপা, সে প্রথম প্রথম বেশ কয়েকবার ওসলোর তাড়া খেয়েছে ৷
অনেক সময়ই বাড়িতে আমার সঙ্গী বলতে এই ওসলো, ইয়োফি আর ফাফা ৷
নিস যাবার দিন, নিসের বিমান ধরব বলে খুব নিঃশব্দে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোচ্ছি, হঠাৎ ওসলো টের পেয়ে গেল ৷ ধন্য এদের কান আর নাক! দৌড়ে এসে আমার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, জুতো কামড়ে, ব্যাগ ধরে টানাটানি করে, সে এক মর্মান্তিক অবস্থা ৷ কিছুতেই তাকে আর থামাতে পারি না, অবিশ্রাম লম্ভঝম্ভ আর তর্জন গর্জন, মাঝে মাঝে কুঁই কুঁই করে কান্না ৷
এদিকে প্লেনের সময় হয়ে যাচ্ছে, আমি যতবারই দরজা খুলতে যাই, সেই ছ-ইঞ্চি ফাঁকে ওসলো তার মাথা গলিয়ে দেয়, সে আমার সঙ্গেই বেরোবে, কাঁধে ও হাতে ব্যাগ নিয়ে আমি যতদূর পারি তাকে টেনে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে আনি ৷ আবার বেরব বলে যেই দরজা খুলতে যাই সেও অমনি আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায়, দরজার ফাঁকে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে তার মাথাটা গলিয়ে দেয়, এটা যে তার পক্ষে কত বিপজ্জনক তা যেন তার জানবার বা দেখবার কথাই না, বা সে সময় তার নেই ৷
গ্রেগোয়া, জাঁ য়্যুগো, মোনিক যে যার কর্মস্থলে, এদিকে ওসলো যেন তার সর্বশক্তি দিয়ে সর্বস্ব পণ করে আমার সঙ্গে আসবেই, কখনও আমাকে সগর্জনে বকছে, কখনও কুঁই কুঁই করে কাঁদছে, কিছুতেই আমাকে ছেড়ে থাকবে না!
অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে এক ফাঁকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই ওসলো দরজার ফাঁকে গলা বাড়িয়ে দিল ৷ করিডরের আলোর সুইচ তখনও টিপতে পারিনি, দরজার ফাঁকে ওসলোর গলা, কিছুতেই সে গলা ভেতরে নেবে না, শেষ পর্যন্ত ব্যাগ নামিয়ে রেখে এক হাতে খুব জোরে বিদ্যুৎগতিতে তার মুখ ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আরেক হাতে নিমেষে দরজা টেনে দিলাম ৷
প্লেন থেকে নিচে ঝাপসা স্থলভূমি ও তার ওপরে হালকা মেঘের আস্তরণের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বার বার মনে পড়ছিল একটি স্বর্ণবর্ণ অবোধ শিশুর মুখ, যে আমাকে ছেড়ে থাকতে চায়নি ৷ একটু পরেই নিচে ভূমধ্যসাগরের নীল আর তার কিনার জুড়ে নিস দেখতে পেলাম ৷
ফ্রান্সের বিখ্যাত দক্ষিণদেশ কোৎ দাজুর (Côte d’Azur)-এর মাঝামাঝি জায়গায় সুন্দর সমুদ্রশহর নিস প্রধানত পর্যটকদের জন্যই, ফলে প্রচুর হোটেল ৷ একশো-দেড়শো ফ্রাঁ থেকে এক-দেড় হাজার ফ্রাঁ-সব রকম দামের ঘর পাওয়া যায় ৷ ট্যুরিস্ট আসারও যেন বিরাম নেই ৷ সকাল থেকে রাত সারা পৃথিবী থেকেই লোকে বেড়াতে আসছে ৷ তবে দক্ষিণ ফ্রান্সের এই সৈকতাঞ্চল পৃথিবীর ধনীদের বা ধনিকশ্রেষ্ঠদের আরাম আয়েসের জায়গা হিসাবেই বেশি পরিচিত ৷ ইউরোপের একটা ভ্রমণগাইড বইয়ে পর্যটকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে-৩৭ নম্বর প্রমনাদ দে আঙ্গলে (Promenade des Anglais)-তে বিখ্যাত নেগ্রেসকো (Hôtel Negresco) হোটেলে এক কাপ কফি খাওয়ার জন্য একবার যাওয়া উচিত, ওটি অন্তত চোখের দেখাও দেখা দরকার ৷ রানি এলিজাবেথ, ওয়াল্ট ডিজনি প্রমুখ মহামানুষেরা নিসে এলে এই হোটেলেই থেকেছেন ৷ এখানকার একটা ডিলাক্স ডাবলরুমের ভাড়া সাড়ে তিনশো মার্কিন ডলার ৷ এটা ৯৪ সালের হিসেব ৷
নিসের সমুদ্রতীরে বালুকার বদলে নুড়িপাথর ৷ সেখানে শয়ে শয়ে শায়িত নরনারী, অধিকাংশই নারী, সকলেই রৌদ্রস্নানরত ৷ মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে সমুদ্রস্নান করছে ৷ পরমুহূর্তেই চিৎ বা উপুড় হয়ে সমবেত রৌদ্রস্নান ৷ লোকালয়ে এরকম দৃশ্য দেখা যায় না বলে হঠাৎ মনে হয়, কোনও অলৌকিক জগতে এসে পড়েছি! ওই তো, জগৎপারাবারের তীরে শিশুরা করে খেলা!
রৌদ্রস্নানার্থীদের পোশাকের সামান্য দুয়েকটি টুকরোর বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই, কেননা পুরো পোশাকটির আশ্চর্য বাহার বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই ৷ ওই আশ্চর্য পোশাক পৃথিবীর কোনও ডিজাইনার বা দর্জি-ই বানাতে পারবে না, এ পারে শুধু মহাবিশ্বের কবি ও ঈশ্বর, আমাদের বাউলগানের সেই একজনা, মনুষ্যের জন্মমুহূর্তে ৷
সৈকতের সমান্তরাল বাঁধানো উঁচু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখি, এক জায়গায় বেশ খানিকটা জায়গায় বালির গদি, চারপাশ রেলিং দিয়ে ঘেরা, সেখানে লেখা আছে-এটা শুধুই ছোটদের জন্য ৷
বহু বিখ্যাত লেখক-শিল্পীদের নিসের প্রতি আসক্তি ও অনুরাগের কথা অনেকেই জানেন ৷ পিকাসো, মাতিস, শাগাল তো কোৎ দাজুরে বসবাসও করেছেন ৷ এঁদের মিউজিয়ামগুলি এখানকার আদরের ধন ৷
ছোট্ট স্বাধীন রাষ্ট্র মোনাকো নিস থেকে ২২ কিলোমিটার ৷ নিসে এলে মোনাকো মন্টিকার্লো আসাই যেন নিয়ম ৷ মোনাকোয় প্রিন্সের প্রাসাদে রোজ দুপুর বারোটায় আনুষ্ঠানিক প্রহরী পরিবর্তন দেখতে প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে ৷ মোনাকোর প্রিন্সের নাম রেনোয়া ৷ রাজতন্ত্র নয়, গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্রও নয়, মোনাকোয় আছে প্রিন্সিপ্যালিটি ৷
নিস থেকে সকাল নটায় বেরিয়ে একবেলার একটি প্যাকেজ ট্যুরে মোনাকো মন্টিকার্লো ছাড়াও ঘুরে এলাম এজে (Eze) নামে প্রাচীন একটি গ্রাম ৷ এজের বিখ্যাত পারফিউম কারখানায় নানা সুগন্ধীর ইতিহাস শুনে, সুগন্ধী তৈরির পদ্ধতি দেখে, গন্ধ বিচার করে সম্পূর্ণ নিখরচায় প্রায় এক ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়, আবার সামান্য বা অসামান্য খরচে বিখ্যাত গন্ধদ্রব্য সংগ্রহও করা যায় ৷ এক ইতালীয় ভদ্রলোককে দেখলাম সঙ্গের দুই কিশোরী কন্যার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করে বহু সুগন্ধী ক্রয় করলেন ৷ মনে হয়, ভদ্রলোক বিপত্নীক অথবা অতি সম্প্রতি স্ত্রী এঁকে ছেড়ে গিয়েছেন, এখন দুই কন্যার মন মায়ের দিক থেকে ফিরিয়ে আনতে তাদের প্রভূত গন্ধ উপহার দিচ্ছেন ৷
একটা বই পড়ে ভেবে রেখেছিলাম নিস থেকে ট্রেনে এদিক ওদিক ঘুরব ৷ হয়তো কান (Cannes) চলে যাব, মোনাকো-মন্টিকার্লোও ট্রেনেই যাব ৷ শেষ পর্যন্ত ট্রেনে চড়াই হল না, একবেলার প্যাকেজ ট্যুরের শেষ গন্তব্য মন্টিকার্লো দেখে বেলাবেলি নিসে ফিরে এলাম ৷ মন্টিকার্লো দুপুরের চেয়ে রাতে এবং আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চেয়ে ধনী ও বিলাসী ও জুয়াড়িদের পক্ষে অধিক রোমাঞ্চকর ৷
রাত দশটা নাগাদ নিসে হোটেলের ছোট লাউঞ্জে বসে রাস্তার লোক দেখতে দেখতে ভাবছি এবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লে হয়, রিসেপশানের লোকটি বলল, আমার দেশ যে শ্রীলঙ্কায় সে আমার মুখ দেখেই তা বুঝেছে ৷ তার বাবা অনেকদিন শ্রীলঙ্কায় ছিলেন ৷ তাঁর ছিল সেমি প্রেশাস স্টোন কেনাবেচার ব্যবসা, সে নিজেও একবার বাবার সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় গেছে, সে খুব অবাক হয়ে গেছে-আমি এই চমৎকার সন্ধ্যায় ডিসকোথেকে না গিয়ে হোটেলে বসে আছি! মাত্র তিন মিনিট হেঁটে গেলেই একটা খুব ভালো ডিসকোথেক ৷ কোনও এন্ট্রি ফিও নেই ৷ যান না, এক প্রস্থ নেচে আসুন, ভালো ঘুম হবে ৷
ঘুমের আশায় নয়, এমনিই চলে গেলাম সেই ডিসকোথেকে ৷ এন্ট্রি ফি না থাকলেও কুড়ি ফ্রাঁ দিতে হল, বিনিময়ে নাকি এক গ্লাস ওয়াইন দেবে ৷
ভেতরে ঢুকে দেখি মস্ত বড় জায়গা ৷ কমবয়েসী ছেলেমেয়ে গিজগিজ করছে ৷ একজায়গায় দেখলাম পাঁচ-ছটি ছেলেমেয়ে হাতে-মুখে রং লাগাচ্ছে ৷ একটি ছেলে আমাকে বসতে দিয়ে বলল, তোমার মুখে রং লাগিয়ে দেব?
আমি মৃদু হেসে জানালাম, রং দেখতে ভালোবাসি, মাখতে নয় ৷
তাহলে আমার মুখে রং দিয়ে কিছু এঁকে দাও ৷ বলে একটা আঠেরো-কুড়ি বছরের মেয়ে তার মুখ আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ৷
আমি অন্যদের দেখাদেখি প্রথমে তার একটা হাতে ও পরে গালে ও কপালে টিউব বদলে বদলে কয়েকটা রং লাগিয়ে কিছু একটা আঁকতে চেষ্টা করলাম ৷ হঠাৎ ভাবনা হল, আঁকাটা একেবারে বিদঘুটে হয়ে যাচ্ছে না তো?
ক্রমেই আরও ছেলেমেয়ে ঢুকছে, একটু পরে কান ফাটানো বুক কাঁপানো বাজনা আর আলোর কুহেলি শুরু হতেই হলভর্তি ছেলেমেয়ে নাচতে শুরু করল, আমার মনে হল হয়তো সাত-আটশো ছেলেমেয়ে এখানে নাচছে ৷ যারা রং দিয়ে সেজেছে, তারা টেবিল ছেড়ে নাচতে যাবার সময় আমাকেও নাচের নিমন্ত্রণ জানাল ৷ আমি ধন্যবাদ জানিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলের ব্যথার কথা বললাম ৷
বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর দিন দশেক আগে আমার হাত ফসকে আমারই ভারি স্যুটকেস পড়ে আঙুলটা বিষিয়ে গেছে, পুরো নখটাই একেবারে নীল হয়ে আছে ৷ আমার এক সময়ের প্রিয় কবি স্যাঁ জাঁ পার্সের ‘আনাবেজ’ (Anabase) কবিতায় একটা লাইন পড়েছিলাম, আমার দুর্বল বাংলায় সেটা এইরকম-এক টুকরো আকাশ নীল হয়ে ওঠে আমাদের নখের ঢালুতে (Un peu de ciel blueit au versant de nos ongles) ৷ নোবেলজয়ী ফরাসি কবির সেই পংক্তিটি ফরাসি দেশে এসে আমারই জীবনে ফলে গেল!
যাই হোক ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে বসে বসে ঘণ্টাখানেক ছেলেমেয়েদের উদ্দাম নাচ দেখে হোটেলে ফিরে এলাম ৷
পরদিন নিসকে বিদায় জানালাম ৷ সমুদ্রশহর নিসের বিমানবন্দরটিও সমুদ্রের গায়েই ৷ প্লেন ওপরে উঠতেই নীল সমুদ্রও ক্রমে মিলিয়ে গেল ৷ যেন সমুদ্র নেই, পৃথিবী নেই, মর্ত*্যলোক সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেছে, শুধু মহাশূন্যে উড়ে যাচ্ছি ৷ তারই মধ্যে প্রথম মেঘের টুকরো দেখেই মনে পড়ল একটু পরেই ওসলোর সঙ্গে দেখা হবে ৷
লোভালোয়ায় পৌঁছলাম বিকেল পাঁচটা নাগাদ, তখন নীল আকাশে ঝকমকে রোদ, এদেশে যাকে বলে রৌদ্রঝলমল সুন্দর একটি দিন ৷
দুপ্রস্থ দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকে একটু অবাকই হলাম, কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই ৷ তবে কি ওসলো হাসপাতালে, নাকি ওকে আর সামলাতে না পেরে ওর গ্রামে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে! অথবা, কিছুদিন ধরেই যেমন কথা হচ্ছিল, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট কোনও ল্যাব্রাডর-প্রেমিককে সারমেয় সম্প্রদান করা হয়ে গেছে! কুকুর পোষার জন্য পাগল হয়েছিল, কুকুর পুষতে গিয়ে কদিনেই পাগল মোনিক রাগের মাথায় এসব বললেও সে প্রাণে ধরে তার ওসলোকে ত্যাগ করতে পারবে বলে মনে হয় না ৷ তিতিবিরক্ত হয়ে যদি বা সে-চেষ্টা করেও, জাঁ য়্যুগো থাকতে তা নিশ্চয় হবার নয় ৷ জাঁ য়্যুগো মাকে শাসিয়ে রেখেছে, ওসলোকে এবাড়ি থেকে কেউ তাড়াবার চেষ্টা করলে সে নিজেই গৃহত্যাগ করে ওসলোকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকবে ৷
আমার ঘরের দরজায় চাবি থাকে না, খোলা-বন্ধের সময় শুধু একটা শব্দ হয় ৷ দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে গেছি, হঠাৎ জাঁ য়্যুগোর ঘরে কিসের শব্দ, কেউ যেন জিনিসপত্র আনাড়ি হাতে নাড়াচাড়া করছে ৷ আজ শনিবার, ছুটির দিন, হয়তো য়্যুগোই এখনও ঘরে বসে আছে, দিনের আলো নিভলে নাচতে যাবে, আমি একটু গলা তুলে বললাম, নিস জায়গাটা ভারি চমৎকার জাঁ য়্যুগো! আমাদের ভুটানের মতো, ছোট্ট অথচ স্বাধীন দেশ! তবে ভুটান হল পাহাড়ের গায়ে আর নিস সমুদ্রের ধারে ৷
য়্যুগোর ঘরের দরজা খোলা কিন্তু কোনও উত্তর নেই, শুধু সেই জিনিসপত্র নাড়াচাড়ার শব্দ ৷
এগিয়ে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি-ওসলো ৷ তার মানে আমি যে ফিরেছি সে জানে, শব্দ করে আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে, তবু নিজে থেকে কাছে আসবে না!
যে ওসলো আমাকে এক-আধবেলা না দেখলে বাড়িফেরা মাত্র আমার গায়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একসা করে, আনন্দে উল্লাসে লম্ভঝম্ভ করে ঝড় বইয়ে দেয়, সেই ওসলো আমি তিনদিন পর বাড়ি ফেরা সত্বেও একবারও কাছে এল না, একবার ডাকল না পর্যন্ত! তবে কি খুব বেশি অসুস্থ? মেঝেতে পেট বুক গলা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে ৷ চোখ বুজে ছিল, আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে, চোখ খুলতেই আমার সঙ্গে খুব শান্ত চোখাচোখি হল ৷ আমি তার মাথায় হাত বোলাতে গেছি, হঠাৎ সে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাতে আমাকে আঁকড়ে, ল্যাজ নাড়িয়ে যা শুরু করল তাকে ভালোবাসার বসন্তোৎসব বলব, নাকি কালবৈশাখী বলাই উচিত, বুঝতে পারলাম না ৷ ওসলোকে নিয়ে আমার ঘরে ফিরে এলাম, এতক্ষণে চোখে পড়ল দরজায় বড় বড় অক্ষরে লেখা-
Welcome Amar!
I’m absent till about 7.00 pm.
Help yourself in Fridge:
– Apple Juice
– Libanon Food
et….
See you
Monique
এই ঘটনার পর ওসলোর সঙ্গে আমার সখ্য এমনই পর্যায়ে পৌঁছল যে আমাকে আমার ঘরের বাইরে পেলে আর ছাড়তে চায় না ৷ একদিন সকালে, তখনও কলকাতায় আমাদের অফিস খোলেনি, আমি টেলিফোনে বাড়িতে আমার সহকারী সম্পাদক মহাশ্বেতাকে শারদীয় ‘ভ্রমণ’-এর ক্রোড়পত্র বিষয়ে দুয়েকটি পরিকল্পনার কথা বলছি, ভারতে টেলি ধর্মঘটের জন্য আগের দিন সারাদিন প্যারিসের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত ছোট বড় নানা পোস্ট অফিস থেকে ফ্যাক্স পাঠাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আজ ফোনে কাজ সারছি, কখনও আমার পায়ের কাছে লেপটে থাকা, কখনও আমার কোমর পর্যন্ত আঁকড়ে ধরায় ব্যস্ত ওসলোর নিজের প্রতি সেই অমনোযোগ সহ্য হচ্ছিল না, সে অর্ধেক গুটনো নখে ও দুয়েকটি কচি দাঁতে আলতোভাবে আমাকে আঁচড়ে কামড়ে অস্থির করে তুলল ৷ আমি ফোনে কথা বলতে বলতেই ‘উঃ আ! আঁচড়াসনি কামড়াসনি’, করছি শুনে মহাশ্বেতা বেশ অবাক হয়ে বলল, কুকুর কামড়াচ্ছে কলকাতায়, আমাকে, আর তুমি প্যারিসে বসে উঃ আঃ করছ, কী ব্যাপার!
তার মানে? কুকুর তো আমাকেই কামড়াচ্ছে, প্যারিসের কুকুর প্যারিসেই কামড়াচ্ছে, উঃ আঃ তাই প্যারিসে বসেই করছি!
জানা গেল, আমাদের বাড়িতেও একটা সারমেয় শাবক এসেছে ৷
শুনে মোনিকের খুব আনন্দ ৷ এক পাক ঘুরে নিয়ে বলল, তুমি ফিরে গিয়ে ওসলোকে ভুলে যেও না, ওদের দুজনের ব্যাপারে আমরা খুব ঘন ঘন ফ্যাক্স বিনিময় করব ৷
কলকাতায় ফিরে, ছ মাস পর, মোনিকের ফ্যাক্স পেলাম-
আমার প্রতিদিনের জীবনটা কেমন তুমি জানো, তার আর কোথাও কোনও বদল নেই ৷ সব সময়ই আমি খুব বেশি ব্যস্ত ৷ তোমাদের ল্যাব্রাডর কেমন আছে? ওসলো ভারি সুন্দর হয়েছে ৷ মাঝে মাঝে দুয়েকটা খারাপ কাজ করে, কার্পেট চেয়ার টেবিল সোফা খেয়ে ফেলে ৷ কিন্তু যাই বলো, আমরা তাকে ভালোবাসি ৷
শতাব্দীর শেষ বছরটি তোমার ও বাড়ির সকলের খুব সুখে কাটুক ৷
ইতি
মোনিক
এদিকে আমার বার্লিন যাবার সময় হয়ে গেছে ৷ মোনিকেরা তিনজন অফিসে ৷ ঘরের তিনজন, ওসলো, ইয়োফি আর ফাফার কাছে বিদায় নেওয়া দরকার ৷ মাদাম ঘোষ কলকাতা অথবা কটকে ৷ সঙ্গে নিয়ে গেছেন তাঁর বন্ধু সোলভেগকে, ইনি লুক্সেমবুর্গ বাগানে (Jardin du Luxembourg) সেনেটে কাজ করেন, নিস থেকে লোভালোয়ায় ফিরে কলকাতার টেলিফোনে শুনলাম এঁরা কলকাতায় আমাদের বাড়িতে কয়েকদিন ছিলেন ৷ তারপর কলকাতায় কটকে ছুটি কাটিয়ে ফ্রান্সে ফিরে আসার আগে আরেকবার যখন আমাদের বাড়িতে এলেন আমি ততদিনে বার্লিন মিউনিখ ভিয়েনা হয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছি, মাদাম ঘোষের সঙ্গে আপাতত শেষবার আর সোলভেগের সঙ্গে সেই প্রথমবার আমার দেখা হল, আমাদের খাবারের টেবিলে ৷ সোলভেগ শুনলাম আগেও অনেকবার ভারতে ঘুরে গেছেন, কেদার-বদ্রী গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী লাদাখ হিমাচল তাঁর ঘোরা হয়ে গেছে ৷ ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক খেতে খেতে তিনি তাঁর ভারতভ্রমণের আরও নানা উচ্চাশার কথা শোনালেন ৷
ওসলো, ইয়োফি, ফাফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বার্লিনের প্লেন ধরতে আমি শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্টে যাবার জন্য এয়ার ফ্রাঁসের বাসে চড়ে বসলাম ৷
তখন কি আর জানতাম, বার্লিনে মিউনিখে আমার ভবিষ্যতের অনেক বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে ৷
ভ্রমণ এপ্রিল থেকে জুন, ১৯৯৯
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন