মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার

ভ্রমণকাহিনীর শিরোনাম ‘মিয়ানমার’ দিয়েই মনে হল, আমি কি পাগল, সাতদিনে একটা দেশ দেখা যায় নাকি? হয় পাগল, না হয় প্রতারক-পাঠককে সম্পূর্ণ ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছি যে দেখো, কেমন দিব্যি একটা দেশ দেখে এলাম ৷ এই কথা লিখতে লিখতে মনে পড়ল, আরে! আমাদের জীবনপঞ্জিতেও তো আমরা এভাবে প্রতারণা করি, আর লোকে সেটা মেনেও নেয় ৷ সেখানে ‘আদার কান্ট্রিজ ভিজিটেড’ বলে একটা সূত্র থাকে, তাতে আমরা কেউ লিখি ষোল-সতেরোটা দেশের নাম, আমাদের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম ভাই হয়তো লেখেন বাহাত্তরটা দেশের নাম ৷ তাঁর মতো বিশ্বপথিক মানুষ পশ্চিমবাংলায় আছে কি না সন্দেহ ৷ কাজেই ঠিক আছে, মিয়ানমারই থাকবে এ লেখার শিরোনাম ৷ তবে ‘ইরাবতীর সঙ্গে’ কথাটা জুড়ে দিয়ে একটু বিনয়ের সুযোগ রাখছি ৷

আসলে ঘটনাটা ঘটেছে ৪ থেকে ১১ জুলাই, ২০০১ সালে ৷ কিন্তু প্রায় ছ মাস আগে থেকে আমাদের ‘বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বঙ্গীয় উদ্যোগ’ সভার সভাপতি শ্রীঅমিয় গুপ্ত বলেছিলেন, তৈরি হোন, মিয়ানমারে (মায়ানমার নয়, ওরা নিজেরা মিয়ানমারই বলে) যেতে হবে ৷ যা আগে ছিল ব্রহ্মদেশ বা বার্মা তা-ই যে ১৯৮৯ সালে ওখানকার সামরিক শাসকেরা মিয়ানমার নাম দিয়েছে তা আমরা জানি ৷ বাঙালিদের সঙ্গে চাকরি ও ব্যবসাসূত্রে ব্রিটিশ আমলে (১৮৮৫-১৯৪৭) বার্মার একটা গভীর যোগ গড়ে উঠেছিল, আমরা যারা শরৎচন্দ্র পড়েছি, কিংবা হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ও উপন্যাস-তারা সবাই জানি ৷ ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি তারিখে বার্মা স্বাধীন হল ৷ তারপর থেকে দফায় দফায় বাঙালিদের চলে আসতে হয়েছে-সে ইতিহাসে আর যাব না ৷ কিন্তু এ দেশে যেতে হবে, সেটা ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চ হল ৷ এর আগে ১৯৯৯-এর মে মাসে ওই অমিয়দার উদ্যোগেই গিয়েছিলাম পাকিস্তান-সেও কম রোমাঞ্চকর ব্যাপার নয় ৷ ‘ভ্রমণ’-এর পাঠকদের সে কথা জানানো হয়নি ৷ আর জানাতে পারব বলে মনে হয় না ৷ স্মৃতিতে, মানে টাকমাথা ও পাকা চুলের দুর্বল হয়ে আসা স্মৃতিতে, অনেক ফাঁকফোকর ও ফুটো তৈরি হয়ে গেছে, তা লিখতে গেলে বেশ জল মেশাতে হবে ৷ দরকার নেই, এরকম অনেক ভ্রমণকাহিনী আমার লেখা হয় না ৷ তবে একেবারে না লিখে পার পাব-‘ভ্রমণ’-সম্পাদকের কাছ থেকে সে-ভরসা এখনও পাইনি ৷ যাই হোক, মিয়ানমারের কথাও লেখা হত না, যদি না আমার অর্ধাঙ্গিনী (এবং এ যাত্রায় ভ্রমণসঙ্গিনী) শ্রীমতী মৈত্রেয়ী সরকার তাঁর বার্মামুলুকের ফাইল-ফোল্ডারটা এগিয়ে দিতেন ৷ তাতে তাঁর নিজের নোট, বিশ্বকোষ থেকে জেরক্স করে আনা মিয়ানমারের বিবরণ, ম্যাপ, ছবি-কার্ড, পর্যটন-কোম্পানির নানা বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি হাতের কাজে সাজিয়ে দিতেন ৷ ফলে এ ভ্রমণবৃত্তান্ত কিছুটা তাঁরও লেখা বলে ধরতে হবে ৷

দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের আই সি ৭২৭ বিমান উড়ল বেলা পৌনে দুটোয় ৷ তার আগে ভিসা-পাসপোর্ট চেক-ইন এবং কাস্টমস-ইমিগ্রেশন পর্ব অত্যন্ত মসৃণভাবে সমাধা হয়ে গেছে ৷ অমিয়দা কোনও একটি ইওরোপীয় দেশের সাম্মানিক বাণিজ্যদূত বা কনসাল, ফলে একজন বিশাল গুম্ভধারী (এরকম পুরুষ্টু এবং বক্র-প্রলম্বিত অভিজাত গোঁফ বাঙালিদের মধ্যে আজকাল দেখি না, সে বড় দুঃখের কথা) এসে সমস্ত প্রক্রিয়াটা নিমেষের মধ্যে সেরে দিলেন, আমাদের লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার মতো সুখকর কাজগুলি করতে হল না ৷ এমনিতেই জুলাইয়ের ভ্যাপসা গরম, দমদমের বাতানুকূল ব্যবস্থা এমন কিছু দাপটে চলছিল না ৷ এর মধ্যে যে কেচ্ছাটা হল তা আমাদের পারিবারিক সংকট ৷ শেষ মুহূর্তে দেখি হাতের ছোট ক্যামেরার ব্যাটারি প্রাণত্যাগ করেছে ৷ আমারই দোষ, যথেষ্ট আগে এসব খেয়াল করা আমার অভ্যেসে নেই ৷ আমি বাড়ির ভদ্রমহিলাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম যে, দমদমে কিনে নেব ৷ কিন্তু দমদমে কাস্টমস পেরিয়ে যে দোকান পেলাম তাতে সবই ডলারে কিনতে হয়, আর তার চাইতেও বড় কথা, তাতে ব্যাটারি বিক্রি হয় না, আস্ত ক্যামেরা আছে ৷ দুটোর কোনওটাই আমার অনুকূলে গেল না ৷ আমার একটা পুরনো আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরা সঙ্গে আছে বটে, কিন্তু সেটাও আয়ুর শেষে এসে পৌঁছেছে, সব সময় হুকুম মতো কাজ করে না ৷ ফলে একটু মনোকষ্ট নিয়ে প্লেনে উঠতে হল ৷

তবে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন অনেক বাঘা বাঘা লোক ৷ তাঁদের মধ্যে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও হৃদয়ের কাটা-ছেঁড়ায় সুদক্ষ ডাঃ শৈবাল গুপ্ত ক্যামেরা নিপুণও বটে, তিনি নিশ্চয় আমাদেরও দুয়েকটা ছবি তুলবেন দলের মধ্যে ৷ যাচ্ছেন মিহিজামের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাঃ প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁরও কাঁধে ক্যামেরা দেখে আশান্বিত হলাম ৷ দুজনেই সস্ত্রীক যাচ্ছেন ৷ অমিয়দা আর অলকা বউদি তো আছেনই ৷ যাচ্ছেন শিল্পী শুভাপ্রসন্ন, যিনি আগের দিনই মার্কিন দেশ থেকে ভারতের মাটিতে পা ছুঁইয়েছেন, চোখ থেকে এখনও পৃথিবীর ও প্রান্তের ঘুম কাটেনি ৷ আছেন বিখ্যাত অপরাধ-মামলার আইনজীবী সুশান্ত দত্ত আর তাঁর স্ত্রী শিবানী-যে আমার যাদবপুরের ছাত্রী ছিল ৷ সুশান্ত নিজেকে ‘ক্রিমিনাল ল-ইয়ার’ কথাটা বলে ‘ক্রিমিনাল’ কথাটার ওপর জোর দেন, অর্থাৎ তিনিই যে অপরাধী সেটা বলবার চেষ্টা করেন ৷ সৌগত রায়, যাঁর পরিচয় দেবার দরকার আছে বলে মনে করি না ৷ শিল্পপতি সমীর ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা ৷ বিস্ক ফার্ম-এর ভারি হাসিখুশি মালিক কে ডি পাল ৷ নিক্কো করপোরেশনের সহ চেয়ারম্যান ডঃ অভিজিৎ সেন ৷ বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য বন্ধুবর দিলীপ সিংহ ৷ সাংসদ ও দুঁদে ব্যারিস্টার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ শকুন্তলা-আর কত নাম করব ৷ এইসব সাংঘাতিক লোকদের মাঝখানে গেলে আমারই মাথা তাজঝিম মাজঝিম করতে থাকে, পাঠকদের কথা তো ছেড়েই দিলাম ৷

প্রশ্ন উঠতে পারে, এরা হঠাৎ মিয়ানমার অভিযানে কেন? ‘বঙ্গীয় উদ্যোগ’-এর বিষয়টা তাহলে পাঠকদের একটু বলি ৷ দেশে দেশে নেতারা যান, আমলারা যান-তাদের করমর্দন হয়, বিমানবন্দরে গার্ড অব অনার হয়, লিমুজিনে চড়ে তাঁরা গাড়ির মিছিল পিছনে লেজুড় করে বেরিয়ে যান-সে এক রকমের যাওয়া ৷ সে এক রকমের কূটনীতি, তার নাম ট্র্যাক ওয়ান ডিপ্লোমেসি ৷ আর আমাদের মতো সাধারণ লোকের কিছু ভি আই পি (তার মধ্যে আমার মতো ওঁছারাও আছে) অন্য দেশে গিয়ে বুদ্ধিজীবী নেতা, সাংস্কৃতিক লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করে এক ধরনের জনতা-জনতায় বন্ধুত্ব করবার চেষ্টা করে, তার নাম ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি ৷ আমরা মানুষজনের সঙ্গে মিশি, তাদের কথা শুনি, ফলে দেশটার ভেতরকার কণ্ঠস্বর একটু শুনতে পাই ৷ ‘বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ’ এই কাজটা দু-তিন বছর হল শুরু করেছে ৷ এই কর্মেই আমরা পাকিস্তান গিয়েছিলাম, আবার এই লক্ষ্যেই মিয়ানমার ৷ পাকিস্তান যাওয়ার ব্যাপারটা চেপে যেতে চাই আরও একটা কারণে-আমরা ফেরার পরেই কারগিলের যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল ৷ সেবার নওয়াজ শরিফ ইসলামাবাদে প্রধানমন্ত্রীর আবাসে বসে ঝাড়া দেড়ঘণ্টা আমাদের সঙ্গে গল্প করলেন, আমার ধুতি-পাঞ্জাবির (তাই পরে গিয়েছিলাম) প্রশংসা করলেন ৷ বললেন, যুদ্ধ চালালে দুটো দেশই একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে ৷ পাকিস্তান একটু আগে, কারণ পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়; আর ভারত কিছুটা পরে, কারণ ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তি এখনও অনেক শক্তসমর্থ ৷ ফলে শান্তির দিকে ভারত যদি এক পা এগোয় তো পাকিস্তান-অর্থাৎ নওয়াজ শরিফ তিন পা এগিয়ে যাবে ৷ ও মা, যখন নওয়াজ শরিফ এসব কথা বলছেন তখন তিনি জানেনই না যে তাঁর সেনাপতিরা তাঁকে কিছু না জানিয়ে কারগিলের মহড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে ৷ ও সব লাহোর চুক্তি-টুক্তি গোল্লায় দেওয়ার পাকা ব্যবস্থা করছে ৷

বুড়ো বয়সের এই হল সমস্যা ৷ মিয়ানমারের প্লেনে উঠেছি, হঠাৎ পাকিস্তানের কথা বকতে শুরু করলাম ৷ নাঃ, দীর্ঘশ্বাস চেপে বর্তমানে ফিরে আসি ৷ রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গন আর কতই বা দূরে, দেড়ঘণ্টার রাস্তা ৷ বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশি পেরিয়ে প্লেন যখন কোনাকুনি মিয়ানমারের সীমানায় ঢুকল, তখন একটু-আধটু পাহাড়ি এলাকা দ্রুত পেরিয়ে মাটির চেহারা যা চোখে পড়ল তার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গ বা বাংলাদেশের বিশেষ অমিল নেই ৷

কিন্তু মাটির আগে আকাশের কথা একটু বলি ৷ প্লেন থেকে আকাশ ছাড়া আর কীই-বা তেমন করে দেখা যায়? অনেকেই মনে করে আকাশে অত কী দেখার আছে, আকাশ তো সেই একঘেয়ে নীল, আর মাঝে মাঝে ওই মেঘ, যার মধ্যে প্লেন ঢুকে পড়লে মাঝে-মধ্যে তাকে লাফঝাঁপ করতে হয়, আমাদের প্রাণে প্রচুর ধুকপুকুনি জাগিয়ে ৷ তা নয়, মেঘ আর নীল আকাশের কত খেলা দেখা যায় ওই ওপরে উঠলে ৷ পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রচুর খোপ কাটা কাটা জলে ডোবা ধানখেত, মাঝে মাঝে ঘন সবুজ দ্বীপের মতো গাছপালা ঘেরা গ্রামের গুচ্ছ ৷ কখনও মেঘের প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে, কখনও সাদা মেঘের মধ্যে নীল আকাশের হ্রদ, কখনও ভেড়ার পাল বা উড়ন্ত হাঁসের দলের মতো মেঘ, কখনও ছায়াপথের মতো, তা দেখেই সময় কেটে যায় ৷ ইয়াঙ্গনের কাছাকাছি জমি বাংলাদেশের মতোই সমতল, ধানখেত পরিকীর্ণ, বর্ষায় জল ধরে রেখেছে তারা, তারপরেই কে একজন বলল, ‘ওই দেখা যায় ইরাবতী!’

হ্যাঁ, তাই তো বটে ৷ ওই তো দেখি মিয়ানমারের সেই প্রাণধারা, ভারতের যেমন গঙ্গা, কিংবা তার চেয়েও বেশি ৷ দেশের একেবারে উত্তরপ্রান্ত থেকে উৎপন্ন হয়ে দেশটাকে প্রায় সমান দুভাগে ভাগ করে ইয়াঙ্গনের কিছু দূরে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে ওই নদী ৷ ক্রমশ প্রশস্ত হয়েছে, নানা শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে ৷ সমুদ্রের মুখে তৈরি করেছে অসংখ্য ব-দ্বীপ ৷ প্লেন থেকে সেগুলোকে দেখলে মনে হয় কত সব প্রাগৈতিহাসিক জন্তু জলে শুধু চোখমুখ ভাসিয়ে শুয়ে আছে ৷ ইরাবতীকে ওরা বলে ‘অইয়্যরাওয়াডি’ বা ওইরকম কিছু, কিন্তু আমরা ওরকম ভয়ঙ্কর নামে তাকে ডাকতে চাই না ৷ প্লেন ক্রমশ নামছে, নদীর জল কখনও সূর্যের ছিন্ন আলোয় ঝলসে উঠছে কখনও বা তাতে মেঘের ছায়া, এবং একটু পরেই প্লেন প্রায় নির্জন ইয়াঙ্গন বন্দরে নেমে টারম্যাকে দৌড় শুরু করল ৷ আমরা পেরিয়ে গেলাম শোয়েডাগন প্যাগোডার সোনালি তোরণের মতো মস্ত তোরণ, তাই যেন মিয়ানমারে আমাদের অভ্যর্থনার প্রতীক ৷ ঘুরে-ফিরে একটু হাওয়া খেয়ে প্লেন ওই তোরণের সামনেই এসে থামল ৷

অবাক কাণ্ড, প্লেনে আমাদের দলটা ছাড়া নামল খুব কম যাত্রী ৷ অথচ প্লেনভর্তি ছিল ভারতীয় ৷ না, তারা সব ব্যাংকক যাবে, বোঝা গেল ৷ মিয়ানমারে খুব কম যায় ৷ কেন যায় না জানি না, অথচ এখানে দেখার জিনিস খুব কম নেই ৷ হয়তো মিলিটারি শাসনের ব্যাপারটাতে একটু ভয় পায়, কিংবা ভিসা-টিসার ব্যাপারে ঝামেলা আছে-দিল্লিতে পাঠাতে হয় পাসপোর্ট ৷ কিন্তু আজকাল তো ট্র্যাভেল এজেন্টরাই সব করে দেয় ৷

এত বড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এয়ারপোর্ট, একপাশে সুন্দর সাজানো দোকানে লুঙ্গি ও ব্লাউজ বা শার্ট পরা সুবেশা মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ক্রেতা নেই ৷ আমাদের একটু দেরি হল, কারণ আমাদের বিদেশি ডলারের বদলে এফ ই সি অর্থাৎ ফরেন এক্সচেঞ্জ কারেন্সি নিতে হল-এক ডলার হল এক এফ ই সি; না হলে মিয়ানমারে ঢোকা যাবে না, অন্তত দুশো এফ ই সি নিতেই হবে ৷ এর মধ্যে ‘ট্যুর মান্দালয়’ কোম্পানির প্রতিনিধি আমাদের সঙ্গে কথা বলে সব নির্দেশ দিয়েছে, তারাই আমাদের মিয়ানমার ভ্রমণের দায়িত্বে ৷ তারাই আমাদের মালপত্র গুছিয়ে বিনা ঝামেলায় কাস্টমস ইমিগ্রেশন পার করে নিয়ে চমৎকার এক বিশাল এয়ারকন্ডিশন্ড বাসে তুলে দিল ৷

বাস থেকে ইয়াঙ্গন একনজরে দেখে বেশ ভালোই তো লাগল ৷ দুপাশে প্রচুর গাছপালা, চওড়া রাস্তা, রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড় কলকাতার তুলনায় যথেষ্ট কম ৷ গাছপালার আড়ালে শহরের দারিদ্র্যের চেহারা চোখে পড়ে না, মনে হয় সবই বেশ সাজানো গোছানো ৷ ‘জো’, আসলে বোধহয় ‘চো’, সে আমাদের গাইড, বাসের মধ্যেই মিয়ানমারের সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্বন্ধে বেশ একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলল ৷ বলল, ‘দেখো আমরা দুটো প্রাচীন আর মস্ত দেশ চিন আর ভারতের সভ্যতা-সংস্কৃতির মাঝখানে স্যান্ডউইচের মতো পড়েছি, ফলে আমাদের সংস্কৃতি দুয়ের মিশ্রণ ৷ আমরা ধর্ম নিয়েছি ভারত থেকে, সেইসঙ্গে আরও অনেক কিছু-আমাদের নাচগান ইত্যাদির সঙ্গেও ভারতীয় নাচগানের মিল আছে ৷ খাবারদাবারও অনেকটা ভারতীয় ৷’

আমাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তোমরা যে ‘ঙাপ্পি’ না ‘নাপ্পি’ কী খাও, সেটা কী জিনিস?’ তাঁর নিশ্চয়ই সুকুমার রায়ের ‘খাই খাই’-এ ‘বার্মার নাপ্পিতে বাপ রে কী গন্ধ’ লাইনটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল ৷

জো একটু হেসে বলল, ‘তোমরা শুঁটকি মাছ খাও তো-এও একরকমের শুঁটকি মাছের ব্যঞ্জন, মূলত চিংড়ি মাছের ৷ তবে এটাকে একেবারে আঠা ধরনের করে ফেলা হয়, যাতে মাখনের মতো পাউরুটি ইত্যাদিতে লাগিয়ে খাওয়া যায় ৷

এটা শুনে আমাদের মধ্যে অনেকে আতঙ্কে শিউরে উঠলেন, আবার কেউ কেউ আনন্দে খুব আশান্বিত হয়ে উঠলেন ৷ এই শেষ দলের মধ্যে, বলতে লজ্জা নেই, এই লেখকও ছিল ৷

যাই হোক জো বলে চলল, ‘আর চিনাদের কাছ থেকে আমরা নিয়েছি পোশাক ৷ শরীরের ওপরের দিকে আমরা একটা খাটো কলারের শার্ট পরি ৷ এটা ব্রিটিশ শাসনের ‘দান’ বলতে পার ৷ তারা পরবে পুরো কলারের শার্ট, আমরা পরাধীন প্রজারা পরব আধা কলারের শার্ট-এই ছিল অনুশাসন ৷ তার ওপরে যে অনেকগুলো বোতামওয়ালা জ্যাকেট, তা চিনাদের মতো ৷ তলায় পরার লোঞ্জি (আমরা বাংলায় যেটাকে লুঙ্গি করে নিয়েছি)-সম্ভবত ভারত থেকেই, বৌদ্ধ শ্রমণদের পোশাক থেকে ৷ তবে আমাদের স্থাপত্যে, বিশেষত মন্দিরস্থাপত্যে, চিনা প্রভাব প্রচুর-সে তোমাদের সব জায়গায় চোখে পড়বে ৷’

এয়ারপোর্ট শহরের উত্তরে, আমাদের গন্তব্য সামিট পার্ক ভিউ হোটেল শহরের দক্ষিণে, কিন্তু শহরকেন্দ্রের ঠিক উত্তরে ৷ ফলে অনেকটাই রাস্তা ৷ যেতে যেতে বাঁদিকে অনেকক্ষণ ধরে চলল ইনইয়া লেক, জো সেটা আমাদের দেখাল ৷ শহরের একেবারে মাঝখানে এতবড় লেক খুব কম আছে ৷ অবশ্য ইয়াঙ্গন শহরটা নানাভাবে জলধারার প্রসাদপুষ্ট ৷ অন্তত চার-পাঁচটি উপনদী-শাখানদী তাকে ঘিরে রেখেছে ৷ মূল নদী ইয়াঙ্গন, তাতে এসে মিশেছে হ্লাং আর পান হ্লাং নদী, ইয়াঙ্গন নদী গিয়ে মিশেছে বাগো নদীতে, তাতে মিশেছে পাজুন দাউং খাল-কী নেই ৷ আরও লেক আছে শহরের মধ্যে ৷ খানিক পরেই বাঁদিকে এসে গেল বড় প্রাঙ্গণ, তার মাঝখান দিয়ে উঠে গেছে শোয়েডাগন প্যাগোডায় যাবার প্রশস্ত সিঁড়িপথ, আর প্রখর উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত শোয়েডাগন প্যাগোডা তার স্বর্ণিল মহিমা নিয়ে আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷

এইসব দেখতে দেখতে হোটেলে এসে গেলাম ৷ দিব্যি হোটেল, অর্থাৎ বিদেশি পাঁচতারা হোটেল যেমন হয় ৷ বিশাল লবি, তাতে দারুণ সোফা-সন্নিবেশ, গাছপালা, এক জায়গায় উঁচু জায়গায় বসে এক শিল্পী মস্ত একটা জলতরঙ্গ বাজাচ্ছে, এক কোণে বর্মি হস্তশিল্পী কাপড় বুনছে, মণিমুক্তো হিরে-জহরতের দোকান (যা আমাদের বাইরে থেকে দেখেই সুখ), বিশাল রেস্তোরাঁ ইত্যাদি ৷ এসব দেখার বিশেষ সময় ছিল না, কারণ ওদেশের ডেপুটি বিদেশমন্ত্রী মহোদয় শ্রী খিন মাউং উইন আমাদের ডিনারে নিমন্ত্রণ করেছেন, সাতটা নাগাদ তৈরি হয়ে আমাদের নিচে নামতে হবে ৷ আমরা ‘শুভেচ্ছা সফর’-এ এসেছি, ফলে এসব আমাদের কপালে জুটবেই ৷

নেমন্তন্নটা ছিল একটা অদ্ভুত জায়গায় ৷ আগে সেটা ছিল রাজপ্রাসাদ, নাম কারাওয়েইক প্রাসাদ, কিন্তু এখন সেটাকে মস্ত একটা হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়েছে ৷ সে হতেই পারে, আমাদের দেশেও জয়পুরে উদয়পুরে তা হয়েছে ৷ কিন্তু এ প্রাসাদটির নির্মাণকলা বড় বিচিত্র ৷ যেন দুটি দৃঢ়সংকল্প হাঁস পাশাপাশি সাঁতার দিচ্ছে-পুরো প্রাসাদটা মস্ত একটা প্যাগোডার ধরনে তাদের পিঠের ওপর স্থাপিত, আসলে আরও দক্ষিণে কান দ জি লেকের ওপরে তৈরি এই হংসপ্রাসাদ, যেন দুটি ‘হংসপঙ্খী’ নৌকোর ওপরে ৷ সওয়া সাতটা নাগাদ আমরা যখন পৌঁছলাম তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে ৷ কিন্তু মস্ত মস্ত ছাতা নিয়ে প্রহরীরা সব তৈরি ছিল, আমাদের নিরাপদে একটি চিনা স্থাপত্যে নির্মিত হলে তারা পৌঁছে দিল ৷ ডেপুটি বিদেশমন্ত্রী, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের সহকর্মীরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করে অভ্যর্থনা করলেন ৷ সেটাই এখানকার প্রথা, ভারি সুন্দর প্রথা ৷ হলের প্রান্তে স্টেজ, সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে ৷ ফলে সাজানো আসনে আমরা বসে গেলাম, মুখরোচক স্ন্যাক্স ও পানীয় নিয়ে পরিবেশকরা ঘোরাফেরা করতে লাগল ৷ অভ্যর্থনাসূচক বক্তৃতার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল ৷

মিয়ানমারের নাচ কিছুটা মণিপুরীর মতো, কিছুটা তাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার নাচের শৈলী মিলিয়ে তৈরি ৷ ঢিলে ও লম্বা হাতা জামা পুরুষ ও নারী উভয়েই পরে, নিচে লুঙ্গি ৷ কিন্তু মেয়েদের লুঙ্গি (আমার স্ত্রীর কথায় ‘মেখলা’) থেকে একটা লম্বা কাপড়ের trail বা ল্যাজের মতো বেরিয়ে থাকে, সেটা পা দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে বলিদ্বীপের ধরনেই চমৎকার কমনীয় নাচ নাচে, চোখমুখের চমৎকার ভঙ্গি করে ৷ আখ্যান মূলত ভারতীয়, রাবণের (এরা বলে দশগিরি) সীতাকে ভোলানোর চেষ্টা এবং সীতার প্রত্যাখ্যান ৷ তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজপুত্রের প্রেমিকার কাছে প্রত্যাবর্তন দেখানো হল দুটি নাচে ৷ দেখলাম মিয়ানমারের চমৎকার পুতুলনাচ, তার ঠিক পাশে মানুষের নাচ, পুতুলের সমস্ত অঙ্গভঙ্গি নকল করে ৷ দুটি লোকনৃত্যও ছিল, একটি কায়িন উপজাতির ৷ আরেকটিতে নারীসঙ্গবিলাসী গুম্ভধারী এক রসিকের চমৎকার হাস্যোদ্রেকী কুশলী নাচ দেখলাম, যাতে ছাতা নিয়ে নানারকম কসরত ছিল ৷ সবই হৃদ্য ও উপভোগ্য ৷ বড় করতাল, গলায় ঝোলানো ছোট ধামসার মতো বাদ্যযন্ত্র, হার্প জাতীয় বীণা, মৃদঙ্গ, মাদলের মতো দেখতে ঢোল, সানাই, কর্নেট এবং শিঙা ধরনের যন্ত্র, কাঠের (বাঁশের) টুকরো দিয়ে তৈরি বড় জাইলোফোন-কী ছিল না সে নাচে? মৈত্রেয়ী লক্ষ্য করেছেন, জাইলোফোনে প্রথম যে সুরটি বাজানো হল তা অনেকটা আমাদের ভূপালি ঠাটের ৷

দর্শক আসনের পিছনে সাজানো ছিল খাবার জন্য চেয়ার, মাঝখানে ফুল সাজানো সাদা চাদরে ঢাকা বড় বড় গোল টেবিল ৷ প্রত্যেকের নাম লেখা ছোট টিকিট ছিল সামনে, ফলে কে কোথায় বসবে সব নির্দিষ্ট ছিল ৷ সমস্ত পদ টেবিলে সাজানো ৷ শুধু সাদা বাসমতীর সুগন্ধি ধোঁয়া-ওঠা ভাত ৷ পরিবেশকেরা প্লেটে পরিবেশন করেই দিচ্ছিল ৷ দুরকম স্যালাড, একটা চিংড়ির সঙ্গে আধসেদ্ধ সবজির ৷ সুপ এল, আমাদের মশলা দেওয়া দিশি সম্বরের মতোই লাগল তা ৷ এখানেও চিকেন, বালাচাও নামে চিংড়ির শুঁটকি, প্রজাপতির মতো করে কাটা চিংড়ি, ম্যাকারেল মাছ (আমার পাশের এক মিয়ানমারি অধ্যাপক সেটা আমাকে ইলিশ বলে ভজাবার চেষ্টা করেছিলেন), তারপরে এই সময়ের নানা ফলের-পেঁপে, তরমুজ, খরমুজা, আমের ডেসার্ট ৷ প্রচুর খাওয়া, শেষে আবার সেই লাইনবন্দী করমর্দন এবং নিরতিশয় তৃপ্ত, আনন্দিত ও ক্লান্ত হয়ে হোটেলে এসে ঘুমোনো ৷ প্রথমদিনটা এভাবেই গেল ৷

দ্বিতীয়দিন বিকেল থেকে যা শুরু হল তা ঠিক ভ্রমণকাহিনীর অংশ নয়-ওই ‘ট্র্যাক টু’ কূটনীতির অংশ ৷ কিন্তু সকালের কথাটা তো বলে নিতেই হবে, কারণ তার কেন্দ্রে আছে শোয়েডাগন প্যাগোডা ৷ হোটেল থেকে মাত্র দু ব্লকের মতো সেই সোনালি দৈবী প্রসাদ, কিন্তু ট্যুর মান্দালয় কোম্পানির বাতানুকূলিত বাস থাকতে আমরা হাঁটতে যাব কোন দুঃখে ৷ সোনালি-সবুজ ত্রিকোণাকার চিনা ধরনের অলংকৃত গেটে আমাদের সিঁড়ি ঠেঙিয়েও উঠতে হল না ৷ বাস গিয়ে দাঁড়াল এমন এক বাড়ির সামনে যেখানে স্বয়ং প্রধান পুরোহিত এসে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন, একটা বসবার ঘরে নিয়ে সোফায় বসালেন যত্ন করে ৷ সেখানে জুতো-চটি চপ্পল রেখে যেতে হবে ৷ তাঁকে অনুসরণ করে বারান্দার দুপাশে সাজানো স্যুভেনিরের দোকানকে এড়িয়ে আমরা একটা বিশাল লিফটে উঠলাম-তা আমাদের প্রায় তিনতলা উঁচুতে মন্দিরের সমতলে নিয়ে পৌঁছে দিল ৷

তারপর যাতে ঢুকলাম তাকে একটা বেষ্টিত প্যাগোডা-নগরী বলা চলে ৷ মাঝখানে বিশাল শোয়েডাগন ৷ চারপাশে আরও অনেক ছোট বড় প্যাগোডা, অজস্র বুদ্ধমূর্তি সাজানো ৷ খানিকটা দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের ধরনে পরিক্রমা করার প্রশস্ত প্রাঙ্গণ ৷ সব দিকেই একটি করে তোরণ, তাতে আবার নতুন নতুন বুদ্ধ ৷ এক মন্দিরে একটি জেড পাথরের এক মস্ত বুদ্ধকে দেখলাম ৷ আরও অজস্র বুদ্ধ প্যাগোডার গায়ে গায়ে বসানো, তার পাশেই নলমুখ থেকে জলের ধারা ঝরে পড়ছে, আর মিয়ানমারি মহিলারা অনবরত সেই খুদে বুদ্ধের মাথায় জল ঢালছে ৷ একেক বুদ্ধ একেক বারের-কেউ সোমবারের, কেউ অন্য কোনও বারের ৷ যার যে বারে জন্মদিন, সে সেইবারের বুদ্ধের মাথায় জল ঢালবে ৷ বুধবারের নাকি আবার দুটি বুদ্ধ আছে, বেলা বারোটার আগেকার একজন, পরের একজন ৷ বুঝুন ঠ্যালা ৷ বুধবারের এই স্পেশ্যাল সম্মান কেন, তা আর জেনে নেওয়া হয়নি ৷

সমস্ত প্যাগোডাগুলি-অতিকায় শোয়েডাগন এবং তার বহুতর সন্তানসন্ততি-সবই সোনায় সোনাকার যাকে বলে, তারা মস্ত এক আকাশখণ্ডকে স্বর্ণিল করে রেখেছে ৷ হবে না কেন, ‘শোয়ে’ মানেই তো সোনা ৷ ‘ডাগন’ অবশ্য ইয়াঙ্গনের পুরনো নাম ৷ এতে নাকি গৌতম বুদ্ধের চারটি দেহচিহ্ন আছে ৷ শোয়েডাগন বলতে আমরা যে মস্ত বিরাট প্যাগোডাকে বুঝি, তার উচ্চতা ৩২৬ ফুট, তার গায়ে নাকি ৩৫০০০ সোনার পাত লাগানো আছে সাড়ে সাত টন মোট সোনা আছে তাতে ৷ সে কত শত কোটি টাকার ব্যাপার আপনারা হিসাব করুন গিয়ে ৷

এখানেই একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম ৷ মেয়েরা, বিশেষত অল্পবয়সীরা, গালে কী একটা গুঁড়ো মতো প্রলেপ লাগিয়েছে ৷ পুরো গাল ঢেকে নয়, খানিকটা অংশ মাত্র ৷ এ কি চন্দনের তিলকজাতীয় কিছু নাকি? না, পুরোহিত বললেন, ও এক ধরনের সোনাঝুরি কাঠের গুঁড়ো, রোদের জন্য মেয়েরা গালে মাখে ৷ একথা শুনে আমাদের কয়েকজন আস্ত আস্ত সোনাঝুরির চ্যালাকাঠ কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ৷ অনেক কষ্টে তাদের নিরস্ত করা গেছে ৷

আমি নিজে যে খুব ভক্তিপ্রাণ লোক তা নই, এটা আমার বন্ধুরা জানেন ৷ কিন্তু হাজার হাজার মানুষের এই বিনম্র ভক্তির মধ্যে একটা সৌন্দর্য আছে তা আমি প্রায়ই অনুভব করি ৷ আবার কখনও কখনও ভয়ও পাই, কারণ এই ভক্তি কখনও কখনও ভয়ঙ্কর হয়ে আঘাত করতে পারে ৷ তবু বুদ্ধদেব আমার কাছে বিশেষ শ্রদ্ধেয়, কারণ পৃথিবীতে ইনিই একমাত্র ধর্মগুরু যিনি ঈশ্বরহীন এক সদ্ধর্ম প্রচার করেন, ঈশ্বরের স্থানচ্যুতি ঘটান ‘নির্বাণে’র লক্ষ্য দিয়ে ৷ এ ধর্মের আরাধ্য ওই ‘নির্বাণ’, কোনও ঈশ্বর নন ৷ মিয়ানমারের বৌদ্ধরা থেরবাদী বৌদ্ধ, তা হীনযানের একটা রূপ ৷ ফলে এখানকার ধর্ম নানা উটকো দেবদেবীর ভিড়ে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি ৷ বুদ্ধই সর্বত্র মহিমময় হয়ে বিরাজ করছেন ৷

পরে এদেশের প্রাচীন রাজধানী বাগান-এ আমাদের গাইড প্যাগোডা আর মন্দির বা টেম্পলের মধ্যে তফাত কী, তা বুঝিয়ে দিয়েছিল ৷ প্যাগোডা আসলে স্তূপ, তা এক কঠিন ছিদ্রহীন স্থাপত্য ৷ নিচে কয়েকটি নীরন্ধ্র গোল চাতাল যেন একটির পর আরেকটি বসানো, ক্রমশ ছোট হয়ে উঠেছে ৷ গাইডের মতে, তা আমাদের ছটি রিপুর প্রতীক ৷ তার ওপরে যেন একটি মস্ত ঘণ্টা উপুড় করে বসানো ৷ ঘণ্টার হাতলটা যেন মিনারের চুড়োর মতো আকাশ ফুঁড়ে উঠছে ৷ মন্দির হল যাতে গর্ভগৃহ, দেবতা, ঢোকবার বেরোবার রাস্তা সবই আছে ৷

শোয়েডাগনের সেই প্যাগোডা শহর পরিক্রমা করতে করতে আমাদের দলটা থেকে আমরা দুয়েকজন ছিটকে গিয়েছিলাম বলে বেশ একটু অস্থায়ী উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল ৷ যাই হোক, শোয়েডাগন দেখে মিয়ানমারের অর্ধেকটা দেখা হয়ে গেল বলে মনে হল ৷ অবশ্য এ যে কী বিষম ভ্রান্তি, তা দুদিন পরেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে ৷ এখন তার কথা বলছি না ৷

প্যাগোডা-পরিক্রমার পর জাতীয় জাদুঘর, তাও আমাদের হোটেলের খুব কাছেই ৷ ভালো লাগল দেখে যে, জাদুঘরের প্রদর্শিকা মেয়েরা মাথায় পরে ছিল নাগকেশরের ফুল ৷ জাতীয় জাদুঘরে আবার মিয়ানমারের ইতিহাসের নানা অধ্যায় আমাদের চোখের সামনে খণ্ড খণ্ডভাবে উদ্ভাসিত হল ৷ মান্দালয়ের যে রাজপ্রাসাদ জাপানি বোমায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তার দুটি সোনার অলংকরণ করা বিশাল দরজা আছে একেবারে একতলাতেই, আছে সোনার সিংহাসন,-সত্যি সিংহচিহ্নিত আসন, আছে রাজা ও রানিদের, মন্ত্রীদের মূর্তি, আছে রাজারানিদের রুপোর খাট, রুপোর মাদুর, পালকি, আসবাব ৷ দেখে মনে হল এদের আরামের ধারণাটা আমাদের চেয়ে একটু অন্যরকম ছিল, তা সত্বেও মোটামুটি সুখেই ছিল এরা ৷ আমার বেইজিংয়ের রাজপ্রাসাদের কথা মনে পড়ছিল ৷ মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে তার কম্পাউন্ডের ধারে স্যুভেনিরের দোকানে বেশ কিছু কেনাকাটা করল আমাদের দল ৷

তিনটে নাগাদ বিদেশমন্ত্রকে যাবার কথা ছিল, মিয়ানমারের বিদেশ মন্ত্রীর আমন্ত্রণে ৷ সে মন্ত্রকে তাঁরা ভিডিও প্রদর্শনে তাঁদের দেশের ড্রাগ ও উপজাতি সমস্যার কথা বললেন, বললেন কীভাবে তাঁরা (সামরিক শাসকেরা) সাফল্য লাভ করেছেন ৷ সে তো তাঁরা বলবেনই ৷ সাফল্য যে তাঁরা লাভ করেননি তাও তো নয় ৷ বাইরে থেকে মিয়ানমারের শহর-বাজার বেশ ঝকঝকেই দেখায় ৷ তবু আমাদের বাসের গাইডের কথাবার্তায় একটু জ্বালা বেরিয়ে আসে ৷ যেভাবে ১৯৮৯-এ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নেত্রী সু চি (মিয়ানমারের সর্বশ্রদ্ধেয় নেতা জেনারেল আউং সানের মেয়ে) ও তাঁর দলের সাফল্যকে উড়িয়ে দিয়ে সামরিক শাসকেরা ‘স্টেট ল অ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল’ বা SLORC নাম দিয়ে প্রশাসন দখল করেছিল তা মিয়ানমারের বহু গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ মেনে নিতে পারেনি ৷ সু চি-র দল NLD বা ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি সে নির্বাচনে একাই শতকরা ৬০ ভাগ ভোট পেয়েছিল ৷ কিন্তু তার পরেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায় ৷ তার পিছনে কাদের হাত ছিল সেটা অনুমান করা কঠিন নয় ৷ যাই হোক, এই সামরিক শাসকেরা তা দমন করে খুবই কৃতিত্ব দেখায় ৷ এঁদের আরও কৃতিত্ব এঁরা দাবি করেন ড্রাগ উৎপাদন আর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ আর উপজাতি বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে ৷ তা প্রশংসাও পেয়েছে, ড্রাগ মাফিয়াদের সর্দার খুন সা এঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে ৷ ইউনেস্কোর টাকায় এরা একটি বিশাল ড্রাগ নিয়ন্ত্রণের প্রদর্শশালাও বানিয়েছে ৷ সেটি দেখারও আমন্ত্রণ ছিল, কিন্তু আমি তাতে যাবার উৎসাহ পাইনি ৷ সামরিক শাসক গোষ্ঠী এখন নিজেদের SLORC নাম বদলে SPDC অর্থাৎ স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল নাম নিয়েছে ৷ এই নামকরণ সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ কী ভাবছে তা জানি না ৷

বস্তুত পক্ষে আমাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের খোলাখুলি আলোচনার কোনও বড় সুযোগ ছিল না ৷ এখানে একটা আশ্চর্য ব্যাপার শুনলাম জো-র মুখে ৷ মোবাইল টেলিফোন সেনাদলের লোকেরাই বিক্রি করে, একেকটার জন্য পনেরো-ষোল হাজার ‘চাৎ’ (মিয়ানমারের মুদ্রা, ইংরিজি বানান Kyat) দাম নেয় ৷ প্রায় আমাদের টাকারই মতো তার দাম ৷ আর তাতে বিদেশের লাইন পাওয়া যায় না, কোনও মিয়ানমারের নাগরিক সোজাসুজি বিদেশে টেলিফোন করতে পারে না, এইরকমই একটা ধারণা দিল সে ৷ আর রাস্তাতেও আমাদের দেশের মতো কোনও STD/PCO বুথ নেই ৷ আমরা দেশে যে কটা ফোন করেছি সব হোটেল থেকে, ডলারে, প্রচুর বেশি খরচ দিয়ে ৷ চার্জ দু ডলার সত্তর সেন্ট উঠল তো হোটেল বলল তিন ডলার দাও ৷ ওদিকে প্রচুর কম্পিউটারের ব্যবহার চালু হয়েছে, কিন্তু ইন্টারনেট ও ই-মেলের সুযোগ খুবই সীমাবদ্ধ ৷

যাই হোক বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকা সামরিক প্রশাসক জানালেন, তাঁরা ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বাড়াতে খুবই আগ্রহী ৷ তাঁরা আমাদের আপ্যায়নের ত্রুটি রাখেননি, তাঁদের সৌজন্য ও আতিথেয়তারও কোনও তুলনা নেই ৷ কিন্তু যখন জানি যে জননেত্রী সু চি-কে তাঁরা ইয়াঙ্গনের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ইউনিভার্সিটি অ্যাভেনিউর বাড়িতে গৃহবন্দী করে রেখেছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমরা আর এঁদের ‘অতিথি’ এবং ‘বন্ধু’ থাকব না তখন মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতি থেকেই যায় ৷

পাঁচই শিক্ষা দপ্তরে যাই আমরা, আর ছ তারিখে আমাদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার ছিল শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ৷ তাঁর অফিস সংগতভাবেই আকাদেমি অব মিউজিক অ্যান্ড ডান্সের প্রাঙ্গণে, সেগুন কাঠে তৈরি একটি প্রাচীন প্রাসাদে ৷ মন্ত্রীমশাইয়ের নাম হলোর সিত্থু, জানি না এর মানে কী ৷ তাঁর ঘরে ভারি সুন্দর ছবি আছে প্রাচীন রাজধানী বাগানের, আর সিংহের মুখওয়ালা চারটি পায়ার স্ট্যান্ডে রাখা আছে একটি ছোট সিঁদুরে রঙের নৌকো, তা আসলে একটি অর্ধচন্দ্রাকার চিনা হার্প ৷ মন্ত্রীমশাই প্রখ্যাত কবি এবং লেখক, বয়স সত্তরের ওপরে ৷ তিনি মিয়ানমারের ইতিহাসের ওপর প্রায় একটি ক্লাস লেকচার দিলেন আমাদের সুবোধ্য ছাত্রছাত্রী পেয়ে, খাওয়াদাওয়া এবং চিনা চায়ের সুন্দর আতিথ্যও ছিল ৷ ইংরিজিতে দোভাষীর সাহায্য নিতে হল তাঁকে ৷ দোভাষী তাঁর দীর্ঘ বায়োডাটাও জানালেন আমাদের, এবং কোথায় কোন পুরস্কার পেয়েছেন তা বারবার করে শোনালেন ৷ আন্তর্জাতিক নানা তুচ্ছ পুরস্কার, যা ‘তুমি আমাকে একটা পুরস্কার দাও, আমি তার বদলে তোমাকে একটা দেব’-এই শর্তে দেওয়া হয়ে থাকে, তার উল্লেখ বারবার করাতে আমাদের একটু হাসি পাচ্ছিল ৷

তবে মিয়ানমারের মানুষের শতকরা ৮৫ ভাগ সাক্ষর-সে একটা কৃতিত্বের কথা বৈকি, যেখানে আমাদের হার ৬৪ শতাংশ! আর ও দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই সরকারি, সে অর্থে কোনও প্রাইভেট স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় নেই ৷ সবই সরকারি সাহায্যের শিক্ষালয় ৷ স্কুলে ছেলেমেয়েরা পড়ে মোট ১২ বছর, প্রাথমিকে পাঁচ, মধ্য স্কুলে চার, আর উঁচু স্কুলে তিন ৷ তার পর জাতীয় স্তরে একটা প্রবেশিকা পরীক্ষা পেরিয়ে, ছাত্রছাত্রীরা ১২৫টা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢোকে ৷ সাধারণ স্কুলের সংখ্যা ৩৮,০০০, তার অর্ধেকই হাই স্কুল ৷ প্রায় প্রত্যেক স্কুলেই কম্পিউটার আছে, তা প্রতিবেশীরাই দেয় ৷ তারপর অবশ্য জানা গেল কোথাও কোথাও প্রাইভেট মানবসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র হয়েছে, তার প্রচুর মাইনে ৷ তবে তারা ডিগ্রি দেয় না, ডিপ্লোমা আর ‘বাখালারিয়াত’ প্রোগ্রাম চালায় ৷ প্রচুর, প্রায় পঞ্চাশ ভাগ ছেলেমেয়ে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ৷ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা চুক্তি আছে, চুক্তি আছে আমাদের ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও ৷ ইংরিজি কিন্ডারগার্টেন স্তর থেকেই পড়ানো হয়, কিন্তু সাধারণ লোক ইংরিজি তেমন ব্যবহার করেন না, শিক্ষামন্ত্রী নিজেও করলেন না ৷

আমার স্ত্রীর নোটে দেখেছি পাঁচ জুলাই গুরুপূর্ণিমা ছিল ৷ আসলে বর্ষা আমাদের তাড়া করছে, ফলে আকাশের দিকে অভিমানে তাকাতে ইচ্ছে হয় না ৷ কিন্তু হঠাৎ চোখ পড়লে মেঘ-পালানো নীল শূন্য সমুদ্রে সেই সোনালি উপগ্রহকে দেখে চমক লেগে যায় ৷ যাই হোক, সে সব দেখে বিকেলে আমরা গেলাম স্থানীয় বাঙালি দুর্গাবাড়িতে ৷ এখানে একাধিক বিগ্রহ আছে ৷ কিন্তু বাড়িটি খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়, আলোও কম ৷ আমাদের মধ্যে যাঁরা ভক্তিপ্রাণ তাঁরা পুজো এবং দক্ষিণা দিলেন ৷ দুর্গাবাড়ির পুরুতঠাকুর সম্ভবত নোয়াখালি অঞ্চলের লোক ৷ তিনি এতগুলি বাঙালিকে দেখে খুব খুশি হলেন বলাই বাহুল্য ৷ বললেন, এখনও ইয়াঙ্গনে প্রায় তিনশো ঘর বাঙালি থাকেন, বেশিরভাগই দীর্ঘদিন ধরে আছেন ৷ দুয়েকটি মিয়ানমারি মহিলাকেও এসে পুজো দিতে দেখলাম ৷ পুরুতমশাই জানালেন, তাঁরাও প্রচুর সংখ্যায় আসেন-মূল মন্দিরের পাশের একটি কুলুঙ্গিতে বুদ্ধমূর্তিও পূজা পান ৷

সেখান থেকে রামকৃষ্ণ মিশনে ৷ সেখানে ছাদের ওপর রামকৃষ্ণ-সরদার মন্দির ৷ বেশ কিছু ভক্ত এসেছেন সন্ধ্যার আরতি ও উপাসনার জন্য ৷ সেখানেই শুনলাম আজ গুরুপূর্ণিমা ৷ পূর্ণিমা ব্যাপারটা প্রাকৃতিক, আর তার আগের গুরু বিশেষণটা সাংস্কৃতিক ৷ এইভাবেই প্রকৃতিকে আমরা সংস্কৃতির মধ্যে নিয়ে আসি ৷ সেদিন হালুয়া, খিচুড়ি আর পায়েস প্রসাদ হয়েছিল ৷ সন্ন্যাসীদের ঘণ্টাবাদ্য সহকারে রামকৃষ্ণ-বন্দনাগানে আমাদের অনেকেই গলা মেলালেন ৷ এখানেও পাশের একটি ঘরে বুদ্ধমূর্তি ফুল দিয়ে সাজানো, নিত্যপূজা হয় বোঝাই গেল ৷

তারপর ইয়াঙ্গন বন্দরে, ইংরিজিতে যাকে বলে ‘ওয়াটারফ্রন্ট’ ৷ এখানে আসার পথে মৈত্রেয়ী এক মহিলার কাছ থেকে কিনেছেন সোনালি দোলনচাঁপার সুগন্ধি কয়েকটি মালা, তা মুহূর্তেই কয়েকজনের খোঁপায় গিয়ে শোভা পেতে লাগল ৷ প্রচুর নদী-সমুদ্রের বাতাস, পূর্ণিমা-উদ্ভাসিত সন্ধ্যা, প্রশস্ত জেটির ওপর দাঁড়িয়ে আমরা কজন হাওয়া আর জ্যোৎস্নায় ভাসছি, নদীতে অজস্র নৌকো, মোটরবোট, লঞ্চ, ছোট জাহাজ নানা গতিতে চলাফেরা করছে, ওপারের আলো দেখছি, পাশের সাদা রঙের মস্ত রেস্তোরাঁয় উজ্জ্বল দোতলায় ক্ষুধাতৃষ্ণাময় জনতার ভিড়, তার মধ্যে দলের অনুরোধে গলা থেকে গান বেরিয়ে এল ‘সন্ধ্যা হল গো মা’, আর ‘ও অকূলের কূল ৷’

এভাবেই পূর্ণিমার দিনটা শেষ হল বলতে পারলে বেশ রোম্যান্টিক হত ৷ কিন্তু আরও কিছু ঘটনা বাকি ছিল ৷

আমাদের বাস আমাদের নামিয়ে দিল ‘ওরিয়েন্টাল হোটেলে’-সেই চাইনিজ রেস্তোরাঁয় আমরা ক-জন ডিনার খাব ঠিক ছিল ৷ ডঃ পি ব্যানার্জি ও বউদি, ডঃ অভিজিৎ সেন, মালহোত্রা দম্পতি (মিঃ মালহোত্রা বিড়লাদের প্রতিষ্ঠানে আছেন), শকুন্তলা আর আমরা দুজন ৷ খাওয়া-দাওয়া, চিনে চা এইসব দিয়ে চমৎকার উদযাপন হল, কিন্তু শুরু হল তুমুল বৃষ্টি ৷ হোটেল খুব দূরে নয়, দু ব্লকের মতো, কিন্তু ও বৃষ্টিতে এক-পা এগোলেই হাড় অব্দি ভিজে যাব ৷ বৃষ্টি থামবার কোনও লক্ষণ নেই, হোটেলে ফিরব কী করে? হোটেলের একজন বয়কে দুটো ট্যাক্সি ধরতে বললাম ৷ সে দৌড়ে ছাতা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াল ৷ তার পরে সে যা কাণ্ড করতে লাগল তাতে আমরা তাজ্জব ৷ প্রথমে এসে বলল, ট্যাক্সি ৫০০ চাৎ চাইছে, তার পরে আবার ঘুরে এসে বলল, না ৭০০ চাতের কমে যাবে না, আবার ঘুরে এসে বলল, স্যার এ ৮০০ চাৎ ছাড়া কিছুতেই যাবে না ৷ শুনে রেগেমেগে হোটেলে ফোন করলাম, তারা তৎক্ষণাৎ একটা ছোট বাস পাঠিয়ে আমাদের তুলে নিয়ে গেল ৷ ট্যাক্সির নিলাম-ডাকার ফাঁদে আর পড়তে হল না ৷

হোটেলও অবশ্য বিনি-মাঙনায় আমাদের উবগার করেনি, তারাও ৮০০ চাৎ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিয়েছিল ৷ তাতে আমরা একটু মনে দুঃখ পেয়েছিলাম ৷

সব বড় বিদেশি হোটেলের মতোই এখানেও বুফে ব্রেকফাস্ট-প্রচুর পদ, রুটি, ফলপাকুড়, ভাত মাংস, ওমলেট পোচ, ফলের রস, দুধ দই-কী নেই ৷ যে যত খুশি, যতবার পার নাও আর খাও ৷ তারপর চা কফি ৷

৬ জুলাই ব্রেকফাস্টের পরে পুরুষদের দলটা গেলাম মিয়ানমারি চেম্বার অব কমার্সে ৷ সেখানে প্রথাগত অভ্যর্থনা বক্তৃতা, শুভেচ্ছা বিনিময়, উপহার আদানপ্রদান (এসব ব্যাপারে অমিয়দার খুব নজর) ৷ এসবের পর ডঃ অভিজিৎ সেন মিয়ানমার ও ভারতের বাণিজ্য সম্বন্ধে চমৎকার একটি বক্তৃতা দিলেন, ওভারহেড প্রজেক্টর ব্যবহার করে ৷ কীভাবে কত দিকে দু দেশের বাণিজ্য বাড়তে পারে তার সুন্দর একটি রূপরেখা তৈরি করে দিলেন তিনি ৷

ওদিকে মেয়েরা গিয়েছিল কমিটি অব উইমেনস অ্যাফেয়ার্সে অর্থাৎ বলতে পারি নারী মন্ত্রকে ৷ সেখানে মিয়ানমারের সমাজে আগের মতোই নারীদের প্রাধান্য আছে কিনা প্রশ্ন করা হয়েছিল ৷ মৈত্রেয়ীর এই প্রশ্নের জবাবে তাঁরা জানালেন, ঘরে হাট-বাজারে এখনও তাই ৷ আমরাও তা দেখলাম ৷ স্কটস মার্কেট নামে যে বিখ্যাত বাজারে আমাদের প্রায়ই যেতে হয়েছে তাতে অধিকাংশ দোকানি মহিলা, না হয় পুরুষের সঙ্গে মহিলারাও আছে ৷ তার পাশে রাস্তার ফুটপাথে মহিলারাই নানা সবজি আর শাক নিয়ে বসেছে, নিম্নাঙ্গে পোশাকহীন শিশুপুত্র তাদের পাশে খেলা করে বেড়াচ্ছে ৷ এ ব্যাপারে মণিপুরের সঙ্গে মিয়ানমারের মিল আছে, স্কটস মার্কেট দেখলে ইম্ভলের ‘ইমা মার্কেটের’ কথা মনে পড়ে ৷ যদিও প্রথমটা অনেক সমৃদ্ধ, সংগঠিত ও সাজানো ৷ কিন্তু এও বোঝা গেল যে, সামরিক প্রশাসনে মেয়েদের ভূমিকা তত ব্যাপক নয়, তা হওয়া সম্ভবও নয় ৷ তবে শিশুর স্বাভাবিক অভিভাবক মা-বাবা দুজনেই ৷ এখন পরিবারে পুরুষ-মহিলা সমান কাজ করে ৷ আগে পুরুষদের অলস বলে অখ্যাতি ছিল ৷

সাত তারিখ সকালে দলের আগ্রহী অংশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ দেখতে গেল-সেটা ইয়াঙ্গনের শহরতলির মধ্যে পড়ে ৷ মহিলারা আবার গেলেন স্কটস মার্কেটে ৷ সেখানে শুঁটকি মাছ থেকে সোনাদানা, রুবি (চুনি), স্যাফায়ার (নীলা), হিরে, জেডপাথর, জামাকাপড়, রঙিন পাথরের গুঁড়ো বসিয়ে তারই রঙে তৈরি ছবি, টি-শার্ট-সবই পাওয়া যায় ৷ আমরা ছিলাম দরিদ্রতম দম্পতি, ফলে আমাদের কেনার সুখের চেয়ে দেখার সুখটাই মূলত বেছে নিতে হয়েছিল ৷

বিকেলে আমন্ত্রণ ছিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মিউজিয়ামে ৷ সেখানে ওখানকার ফিল্মের জনপ্রিয় পুরস্কারধন্য নায়ক-নায়িকারা আমাদের অভ্যর্থনা করলেন দু পাশে দাঁড়িয়ে, সেটা একটা বলবার মতো ব্যাপার ৷ তবে একগাদা বক্তৃতায় জ্ঞানলাভ ও জ্ঞানদানের পর দেখা গেল এরা কেউ সত্যজিৎ রায়ের নাম শোনেনি, তিনি কী ধরনের ছবি করতেন তাও জানে না ৷ মিয়ানমারের ছবি একটা যুগের সোভিয়েত ছবির মতো খুব বীরত্বপূর্ণ ও নাটকীয় হয় তা বোঝা গেল, স্বদেশের আর সমাজের জন্য সবাই প্রাণ দেয়, প্রেমিকা প্রেমিককে ‘যাও বীর, অনন্তধামে যাও’ বলে চোখের জলে বিদায় দিয়ে নিজে নার্স হয়ে দেশের কাজে নেমে পড়ে-এই নিয়ে সব গল্প ৷ তবে মিউজিয়ামটি দেখে ভালো লাগল ৷ পুরনো দিনের নানা ক্যামেরা, এডিটিংয়ের যন্ত্রপাতি, রিফ্লেক্টর এবং সাদা-কালো ও রঙিন অজস্র স্টিল ছবি দেখে ভালো লাগল ৷

রাতে ছিল জম্পেশ খাওয়াদাওয়া-ভারতীয় দূতাবাসে ৷ পুরনো রাষ্ট্রদূত সবে অন্যত্র বদলি হয়েছেন ৷ শার্জ দ’ ফেয়ার অশোক তোমর এবং তার স্ত্রী শ্রীমতী মুক্তা ডি তোমর আমাদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন ৷ মুক্তা ডি যে একেবারে উল্টোডাঙা অঞ্চলের বাঙালি মেয়ে লোরেটো কলেজে পড়া মুক্তা দত্ত সেটা আবিষ্কার করে বেশ ভালো লাগল ৷ স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সুদর্শন ৷ পরে তোমর সাহেব কথাপ্রসঙ্গে নিজেকে নিয়ে চমৎকার ঠাট্টা করলেন, বললেন, মুক্তা আই এফ এস (ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস) করে যখন দিল্লিতে চাণক্যপুরীর বিদেশ মন্ত্রকে যোগ দেয় এবং বছরখানেকের মধ্যে তোমর তাকে বিবাহ প্রস্তাব দেন তখন সবাই তাকে ‘বেবি-স্ন্যাচার’ অর্থাৎ ‘বাচ্চা মেয়ে লুট করা ডাকাত’ জাতীয় কিছু একটা বলেছিল ৷ আমাদের মনে হল রূপে গুণে আর হৃদ্য জনসংযোগে এরা পরস্পরের যোগ্য অংশীদার ৷

বুফে টেবিল উপাদেয় নানা ব্যঞ্জনে সাজানো ৷ নারকোল-ছোলার ডাল, আলু-তরকারি, বিনসের একটা ভাজা ধরনের তরকারি, ডিমের ডালনা, গা-মাখা ঝোল সহ মাংসের কিমা, মুরগির ঝোল, বাসমতী (হায় বাসমতী, তুমি এখন কাদের? আমাদের না আমেরিকার?) ভাত আর নান, সেইসঙ্গে মাশরুম, পনির আর নানা সবজির একটা স্বাদু তরকারি, চাটনি, পায়েস ৷

প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে খেতে খেতে ভারতীয়, মিয়ানমারি-নানা মানুষের সঙ্গে আলাপ হল ৷ আগে আলাপ হওয়া ইয়াঙ্গন বিশ্ববিদালয়ের দুজন অধ্যাপক, একজন বর্ষীয়ান মিয়ানমারি, যিনি রাষ্ট্রদূত হিসাবেও কাজ করেছেন, জানালেন তিনি শিবপুর বি ই কলেজের ছাত্র ছিলেন ৷ বর্মি পোশাক পরে কালো কোট গায়ে এসেছেন বাঙালি অ্যাডভোকেট দাশগুপ্ত ৷ তাঁর গল্পটা দুঃখের এবং মজার ৷ এখানকার নাগরিক তিনি, কিন্তু নাগরিকত্ব দেবার আগে এখানকার সরকার তাকে হুকুম দেয়, ‘তোমার নাম বদলাতে হবে ৷ ভারতীয় হিন্দু নাম বদলে মিয়ানমারি নাম নিতে হবে ৷’

দাশগুপ্ত সরকারকে খুব একটা উকিলি প্যাঁচে ফেলে বললেন, ‘আমার নাম তো বদলাতেই পারি, কিন্তু আমার বাবার নাম তো বদলাতে পারব না ৷ আর বাবা দাশগুপ্ত, আর ছেলের নাম ‘মং থাই’ বা ওইরকম কিছু-এ ব্যাখ্যা করতে করতে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাবে, তোমাদের নথিপত্রেও তালগোল পাকিয়ে যাবে ৷ কাজেই বাপু, এ নিয়ে বেশি পীড়াপীড়ি করো না ৷’

সরকার বেকায়দায় পড়ে চুপ করে গেল ৷

হাসি-গল্পে রাত হয়ে যাচ্ছিল ৷ কিন্তু পরদিন ভোরে বাগান রওনা হতে হবে, তাই নটা নাগাদ সকলে বিদায় নিলাম ৷

বাগান যে আমরা আদৌ গিয়ে উঠতে পারব সেটা আগে ভাবা যায়নি ৷ আমাদের মূল ভ্রমণসূচিতে তা ছিল না, মিয়ানমার সরকার আমাদের ইয়াঙ্গন আর মান্দালয় সফরই অনুমোদন করেছিলেন ৷ ব্যাপারটা যে হয়ে গেল তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব সৌগত রায়ের ৷ সৌগত ডাকাবুকো ছেলে, চমৎকার কথা বলে তার ওপর-সে পাঁচ তারিখে বিদেশ মন্ত্রকের বৈঠকে বলেই বসল, ‘ইয়োর এক্সসেলেন্সি, আমরা অনেক আশা নিয়ে এসেছি, যদি আপনি দয়া করে আমাদের বাগান দেখার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব ৷’ ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আবেদন মঞ্জুর ৷ এর আগে পাকিস্তানেও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবদার করে সে আমাদের মারি হিল স্টেশন বেড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ৷

ফলে সকাল আটটায় আমরা এয়ার মান্দালয়ের ছোট্ট প্লেনে চড়ে বসলাম ইয়াঙ্গন এয়ারপোর্ট থেকে ৷ প্রায় পঞ্চাশজনের মতো যাত্রী নেয়, খানিকটা রেলগাড়ির একটা এ সি কামরার মতো, নাকি তার চেয়েও ছোট ৷ বাগানে যেতে মাত্র আধঘণ্টা লাগল ৷ একটু পরেই ছোট্ট বাগান বিমানবন্দরে এসে নামলাম ৷ প্রচুর হাওয়া সেই বন্দরে, নামতে গিয়ে সৌগতর নতুন কেনা ঘাসের টুপি উড়ে গেল, বিমানের একজন স্টুয়ার্ড পড়িমড়ি করে দৌড়ে গিয়ে টারম্যাক থেকে সেটি কুড়িয়ে আনলেন ৷ আমরা কাজুবাদাম গাছের সারির মধ্য দিয়ে টার্মিনালে পৌঁছলাম, আবার টার্মিনাল থেকে বেরলাম রক্তকরবী গাছের সারির মধ্য দিয়ে ৷ এখানেও সেই একইরকম এ সি বাস অপেক্ষা করছিল ৷

বাগান (আগের নাম পাগান) একটা আশ্চর্য জায়গা ৷ প্রাক্তন বার্মার ঐতিহাসিক রাজধানী ৷ ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে নর্মান আক্রমণের আগেই-অনুব্রত (Anawrahta) নামে রাজা ইরাবতীর ধারে এই সুন্দর নগরীতে রাজ্য স্থাপন করে, উপজাতি-বিভক্ত ব্রহ্মদেশে ঐক্য স্থাপন করেন ৷ তিনি ছিলেন বর্মি, কারণ বর্মিরাই প্রায় ৭০ শতাংশ ৷ সে রাজবংশ প্রায় ২৫০ বছর ধরে চলে ৷ এ শহর যা আমরা দেখলাম তা পুরনো বাগান বটে, আবার নতুন বাগানও ৷ নতুন বাগান মানে কী?

নতুন বাগান মানে হল পুরনো বাগান থেকে ইউনেস্কো সমস্ত জনবসতি উঠিয়ে দিয়ে অন্য একটা এলাকায় তাদের বসিয়েছে, ফলে পুরনো বাগানে আর জনবসতি নেই, যদিও চাষবাসের কিছু খেত রয়েছে সেখানে দিশি লাঙল-বলদ নিয়ে চাষবাসও হচ্ছে দেখা গেল ৷ আছে নদীর ধারে কয়েকটি অত্যাধুনিক রিসর্ট এবং রেস্তোরাঁ ৷ কিন্তু মানুষের ঘরবাড়ি নেই ৷ যে দিকে তাকান, বিশাল সবুজ প্রান্তর জুড়ে শুধু মন্দির আর প্যাগোডা ৷ প্যাগোডা হল গোলাকৃতি, ক্রমশ সরু হয়ে ওপরে উঠে-যাওয়া একেবারে নীরন্ধ্র নিশ্ছিদ্র স্তূপ, আর মন্দিরগুলি আরেকটু কারুকার্যময়, তাদের একাধিক চুড়ো, আর তাদের ভেতরে বুদ্ধ ও অন্যদের মূর্তি আছে, দরজা দিয়ে ঢোকা এবং বেরনো যায় ৷ প্যাগোডার ভেতরে ঢোকার প্রশ্নই নেই ৷ তবে প্রায়ই প্যাগোডার সামনে বা চারদিকে একাধিক মন্দির খাড়া করে তাতে বুদ্ধের মূর্তি পূজা করা হয়, কিন্তু মূল প্যাগোডা তা থেকে বিচ্ছিন্ন ৷ শ্রেণির প্যাগোডাকে থাই ভাষায় বলে সিডি (চৈত্য), বর্মি ভাষায় সেডি ৷ ঘণীভূত প্যাগোডা মূলত পরিক্রমা করতে হয়, মন্দিরে তোরণ দিয়ে খানিকটা ঢুকে বৃত্তাকার চত্বরে পৌঁছতে হয় ৷ তবে চত্বরের বাইরে ভেতরে দুজায়গাতেই প্রচুর দোকান বসে যায় ৷

হোটেলে যাবার পথে একটি বড়সড় প্যাগোডা আর বুদ্ধশিষ্য আনন্দের নামে চিহ্নিত একটি বড় মন্দির দেখা হল ৷ তারপরে হোটেলে যাবার পথে শুধুই প্যাগোডা আর মন্দির ৷ বিয়াল্লিশ বর্গ কিলোমিটার সবুজ অঞ্চল পুষ্ট হয়েছে ইরাবতীর জলধারায়, সেই অঞ্চলের বুক জুড়ে প্রায় চারশো নির্মাণ ৷ যদিও লোকমুখে ‘চল্লিশ লক্ষ প্যাগোডা’র শহর, এবং পৃথিবীর অন্যতম ‘আশ্চর্য’ বলে এ শহর বিখ্যাত ৷ প্যাগোডা ও মন্দিরগুলির কোনওটি প্রাচীন জীর্ণতা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোনওটির, বিশেষত মন্দিরের মধ্যে নতুন রং ও কারিগরি জুড়েছে, যার ফল খুব ভালো দাঁড়িয়েছে বলে মনে হল না ৷ কিন্তু ইরাবতীর পারে এই বিশাল শ্যামল ক্ষেত্রে এত প্যাগোডা ও মন্দিরের উপস্থিতি, এবং জনবসতির সম্পূর্ণ অভাব আমাদের এরকমই মনে করতে বাধ্য করে যে, আমরা ঠিক মানুষের পৃথিবীতে নেই, অন্য কোনও জগতে, হয়তো অন্য কোনও গ্রহে এসে পড়েছি ৷ দূরে পাহাড়ের সীমানা দেখছি বটে, কিন্তু এ প্রান্তরে শুধুই অতীতের সাক্ষ্য, বর্তমান যেন থেকেও নেই ৷ হ্যাঁ, আছে বটে রক্তকরবী গাছের সার দেওয়া পিচের রাস্তা, আছে মাঝে মধ্যে এয়ারকন্ডিশন্ড বাস, টাটা সুমো ধরনের ভ্যান আর সাধারণ গাড়ির যাতায়াত ৷ সেই সঙ্গে টাঙা ধরনের গাড়িও চলছে, তা এই অতীতপুরীর অতীত-চেহারাটাকে আরেকটু বর্ণাঢ্য করছে, এছাড়া আছে সমস্ত ধর্মস্থানে অনিবার্য নানা কাঠ পাথর ইত্যাদির কারুকার্যময় সামগ্রীর দোকান, তাতে সাজানো শিল্পীদের আঁকা প্যাগোডা-মন্দিরের ছবি, স্থানীয় প্যাগোডার ছাপ লাগানো টি শার্ট ৷ এখানকার একটা বৈশিষ্ট্য হল, প্রচুর শিল্পী নিজেদের আঁকা ওই ধরনের ছবি সাজিয়ে বসে যায় জনপ্রিয় প্যাগোডা বা মন্দিরের সামনে, বলে আমার নিজস্ব ছবি কেনো, বাগানের একটা শ্রেষ্ঠ স্মৃতি নিয়ে যাও তোমার বাড়িতে ৷ কিছু ছেলে-ছোকরা পাশে এসে গোপন কথা বলার ধরনে ফিসফিস করে খবরের কাগজে মোড়া নানা পাথরের মূর্তি খুলে দেখায়, সেগুলি মঙ্গোলীয় ধরনের বুদ্ধ, বা হাতি ইত্যাদির মূর্তি ৷ অবশ্য বুদ্ধ সম্ভবত মূলত মঙ্গোলীয়ই ছিলেন, নেপালে তাঁর জন্ম ৷ আর সেসব দোকানে সাজানো আছে প্রচুর গালা বা ল্যাকারের তৈরি বাটি বাক্স চা-কোস্টার কৌটো ইত্যাদি ৷ কিছু ভিক্ষার্থী ছেলেমেয়েও জুটে যায়, আমাদের মতো গরিব দেশে এ তো স্বাভাবিক, কিন্তু তারা তুলনায় ভদ্র ৷

দুপুরে খাওয়া হল ইরাবতীর ধারে চমৎকার একটি চিনা রেস্তোরাঁয় ৷ তাতে খাওয়া উত্তম ছিল (কিন্তু কী কারণে জানি না, পরে সেদিন দুয়েকজনের পেট বিদ্রোহ করেছিল), তবে ইরাবতীর একেবারে ধারে, একদিকে সবুজ অরণ্যশোভাতে হাওয়ার দুলুনি আর অন্যদিকে সাজানো বাগানের মাঝখানে, চারদিক খোলা মস্ত খড়ের চালাঘরের নিচে লম্বা কাঠের টেবিলে বসে খাওয়ার অভিজ্ঞতা বেশ ভালোই লেগেছিল আমার ৷

আমাদের হোটেলটিও (বাগান থান্দে হোটেল) ছিল রিসর্ট ধরনের, অসংখ্য ছোট ছোট কটেজে সাজানো এবং প্রত্যেকটি কুটিরে এয়ারকন্ডিশনিং সহ একেবারে পাঁচতারা ব্যবস্থা ৷ কয়েকটি ছিল একেবারে ইরাবতীর ধারে, বারান্দায় চেয়ার পেতে বসলেই সামনে উঠোনের তলায় ইরাবতীর ঢেউ এসে ভাঙছে ৷ উঠোনটা যেন একটা বাঁধের মতো-আর প্রশস্ত ইরাবতী বর্ষার বিপুল ঘোলাজল নিয়ে দ্রুত ছুটে চলেছে, ওপারে ছায়াময় পাহাড়ের কোলে জনবসতির ছড়ানো-ছিটানো চিহ্ন ৷ লঞ্চ, মোটরবোট, নৌকো চলেছে, কোনও নৌকোয় পুরুষ হাল ধরে, তার স্ত্রী তিনকোনা পালের প্রান্ত ধরে বাতাসের গতি সামলে নৌকোর অগ্রগতি বজায় রাখার চেষ্টা করছে ৷ ইরাবতীর ধারের কটেজ আমরা পাইনি, কিন্তু সাজানো দোলনাওয়ালা লন ও ফুলবাগানের মধ্যে আমাদের ছোট্ট কটেজটিও বেশ মনোরম ছিল ৷

বিকেলে আবার বেরনো হল ৷ গাইড প্রথমে নিয়ে গেল গালার জিনিসপত্র তৈরির দোকানে ৷ সেখানে কারখানায় কারিগররা বসে একেবারে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত গালার জিনিসপত্র কীভাবে তৈরি হয় তা দেখাবার ব্যবস্থা রেখেছে, খানিকটা আধুনিক কারখানার অ্যাসেমব্লি লাইনের ধরনে ৷ আমি এ পর্যন্ত জানতাম যে, গালার পাত্রগুলির ভিত্তি হল কাঠ বা ‘পাপিয়ের মাশে’ বা কাগজমণ্ড ৷ কিন্তু এখানে এসে আমার এই জ্ঞান হল যে, অতি পাতলা করে ছিলে নেওয়া বাঁশের ফিতে জুড়ে বা পেঁচিয়ে বাক্স, কৌটো সবই তৈরি হচ্ছে, আর তারই ওপর থাকছে গালার চমৎকার সব কারুকৃতি ৷ দেখে অবাক হতে হয় ৷ বাগানের গালার কাজ খুবই বিখ্যাত ৷ তাই এখানকার গালার জিনিস একেবারে ‘আসল’ বলে গণ্য ৷ আমরা অবশ্য বাইরে থেকে আসল-নকল কিছুই ধরতে পারব না ৷

যাই হোক, এদের কারখানার লাগোয়াই মস্ত দোকান-তাতে সেলফে সেলফে অজস্র নানা সাইজের ল্যাকারের দ্রব্য সাজানো, গরিবের ছোট বাটি আর টি-কোস্টার থেকে বড়লোকের সিন্দুক বা ভাঁজ করা স্ক্রিন পর্যন্ত আছে ৷ সেখানে আমরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, আমরা গরিবের এলাকায় ঘোরাঘুরি করছি, অন্যরা উদ্দাম টানাপোড়েনে ব্যস্ত ৷ শুভাপ্রসন্ন একটা আস্ত তোরঙ্গ কিনে ফেললেন ৷ তাঁর দেখার চোখ আছে, আরেকটা জিনিস পছন্দ হলে তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেও তা কেনা থেকে আটকানো যাবে না ৷ এ আমরা পাকিস্তানেও দেখেছি ৷ অবশ্যই তিনি যা কেনেন তা কেনবারই মতো ৷

এর মধ্যে ছায়া নামছে দেখে কেনাকাটার উৎসাহ আপাতত স্থগিত রেখে, কিন্তু প্রচুর প্যাকেট বগলদাবা করে আমাদের দলটা আবার বাগান দেখতে বেরিয়ে পড়ল ৷ দোকানে এসেছিলাম ‘নিউ বাগানে’, আর ফিরে যাচ্ছি প্রাচীন বাগানে ৷ সেখানে একটি উঁচু প্যাগোডার বড় বড় সিঁড়ি ঠেঙিয়ে চারতলায় উঠে অসামান্য এক সূর্যাস্ত দেখলাম ৷ মেঘলা মেঘলা আকাশ, তার মধ্য থেকে ধূসর উজ্জ্বল সূর্যের আলো নানা ভাগে ও স্তরে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে বাগানের দিগন্তে এসে পড়ছে, অন্যদিকে ম্লানমন্থর ইরাবতীর বুকে গিয়ে তার শেষ আভাটুকু আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল ৷ এইরকম দৃশ্য যে কোনওদিন দেখতে পাব তা জন্মকাল থেকে ভাবা যায়নি, দেখতে পেলাম বলে জীবনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকি ৷

সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে ইরাবতীর ধারে হোটেলেরই একটা চেয়ার সাজানো পার্কে বসে রাত পর্যন্ত নদীর ছলাৎ ছলাৎ শুনলাম ৷ রাতে ডিনারের সময় ডাইনিং হলেই একপাশে স্টেজ করে আমাদের নানা পুতুলনাচ দেখানো হল ৷ বর্মি পুতুলনাচও খুব বিখ্যাত ৷

বাগান থেকে মান্দালয়ও আধঘণ্টার উড়ান ৷ পরদিন সকাল আটটার ফ্লাইটে, ওই একই ধরনের প্লেনে, আমরা মান্দালয় গিয়ে নামলাম ৷ ওরা অনেকে বলে মান্দালে ৷ মান্দালয় এয়ারপোর্ট থেকে শহর অনেকটা দূর ৷ যেতে যেতে প্রচুর ধানখেত ছাড়িয়ে গেলাম, ছোট ছোট জনবসতি, আর তাতে একাধিক প্যাগোডা ৷ একটি-দুটি তো দিগন্তে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ৷ এয়ারপোর্টের রাস্তা থেকে মান্দালয়-ইয়াঙ্গন হাইওয়েতে পড়লাম ৷ তখন গাইড বলল, বাসে ইয়াঙ্গন থেকে আসতে লাগে পনেরো-ষোল ঘণ্টা, ট্রেনেও প্রায় তাই ৷ যেতে যেতে আমরা রেললাইনও পেরিয়ে গেলাম ৷ একটু ডাইনে স্টেশন দেখা গেল ৷ তার একপাশে অসংখ্য বিশাল সেগুন কাঠের গুঁড়ি ফেলে রাখা আছে ৷ সেগুলি ট্রেনে ইয়াঙ্গন যাবে, সেখান থেকে বিদেশে ৷ বার্মা ‘টিক’ বা মিয়ানমারের সেগুনকাঠের গুণ কে না জানে ৷ এ লাইনটা লিখতে লিখতেই মনে পড়ে গেল বুদ্ধদেব বসুর মজার কবিতায় ঢাকা শহরের বর্ণনার একটা লাইন-‘ফাগুনের গুণে সেগুনবাগানে আগুনে বেগুন পোড়ে ৷’ দেখুন, এতে ‘বাগান’ও আছে, সেগুনও আছে ৷ কিন্তু বুদ্ধদেব মিয়ানমারের কথা ঠিক তখন ভেবেছিলেন বলে মনে হয় না ৷

বুদ্ধদেব থেকে বৌদ্ধদের কথায় চলে আসা সহজ ৷ বাসের জানলা দিয়ে আরেকটা জিনিস চোখে পড়ল, যা ইয়াঙ্গনে তেমনভাবে দেখিনি ৷ সকালের রোদের মধ্যে লাইন করে গাঢ় লাল/ মেরুন পট্টবস্ত্র পরা অজস্র খুদে খুদে ন্যাড়া মাথা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বেরিয়েছে ৷ তাদের প্রত্যেকের কোলে একটা হাতল-লাগানো চকচকে পালিশ করা কাঠের হাঁড়ি ৷ তারা ‘মাধুকরী’তে বেরিয়েছে ৷ ইয়াঙ্গনে আমাদের গাইড বলেছিল, প্রতিটি মিয়ানমারি ছেলেকে জীবনে অন্তত সাতদিনের জন্য বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হতে হয় ৷ কেউ কেউ একাধিকবার এবং বেশি দিনের জন্যও হতে পারে ৷ সেখানে তারা পঞ্চবুদ্ধের উপাসনা করতে শেখে ৷ পঞ্চবুদ্ধ হলেন মা-বাবা, শিক্ষক, শ্রমণ, ধর্মগ্রন্থ এবং স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ ৷ সন্ন্যাসী তখন তারা কোনও-না-কোনও প্যাগোডার আশ্রমে চলে আসে, মস্তক মুণ্ডন করে, এবং রোজ সকালে ভিক্ষে করে সেদিনকার খাদ্য সংগ্রহ করে ৷ অনেক গৃহস্থ এদের জন্য আলাদা করে রান্না করে রাখে, ভাত ও অন্যান্য তরকারি ৷ এরা এলে কোলের এই পাত্রে তা ঢেলে দেয় ৷ এটা বিশ্বাসী গৃহস্থদের কাছে একটা পরম পুণ্যের কাজ ৷ সকালের উজ্জ্বল রৌদ্রস্নাত রাস্তায় এই বালক সন্ন্যাসীরা তাদের পোশকের গাঢ় রঙের ঢেউ খেলিয়ে চলেছে, অনেকের মুখের দুষ্টুমি ধর্মের শাসনে ঢাকা পড়েনি, কেউ সামনের জনকে ঠেলা দিচ্ছে, লাইন ভেঙে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, সঙ্গে মঠের প্রবীণ সন্ন্যাসী এসব দেখেও দেখছেন না ৷

মান্দালয়ে এসে প্রথমে যে বড় কাজ হল, সেটা খাওয়াদাওয়া ৷ আবার এক চিনা রেস্তোরাঁয়, নাম ‘গোল্ডেন ডাক’ ৷ এটি রাজপ্রাসাদ-পরিখার একেবারে ধারেই ৷ তিনতলায় কাচে ঘেরা ডাইনিং হলে বসে পুরো রাজপ্রাসাদের মুখোমুখি হয়ে খাওয়াদাওয়া ভালোই হল ৷ খাদ্যবস্তুর বর্ণনা করে আর পাঠকদের জিভে জল আনতে চাই না ৷ তারপর বিদেশি মুদ্রা-বিনিময় হল একটা ব্যাঙ্কে গিয়ে ৷

মিয়ানমারে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম এই মুদ্রাবিনিময়ের ব্যাপারে ৷ ইয়াঙ্গনে দশ ডলার বা দশ এফ ই সি-র বদলে আমরা পেয়েছিলাম ৫০০ চাৎ ৷ বাগানে হঠাৎ থান্দে হোটেল ৪০০ দিতে চাইল, অনেক দরাদরি করে ৪৫০তে উঠল ৷ মান্দালয়ে ৪৫০-এর বেশি পাওয়া গেল না ৷ একই দেশে নানা জায়গায় ডলার বা এফ ই সি-র নানারকম দর দেখে বোঝা গেল সামরিক প্রশাসনের শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ সব জায়গায় সমানভাবে পৌঁছয় না ৷ আরও একটা জিনিস দেখলাম ৷ আমাদের যা কিছু বিনিময় হয়েছে সবই কাগজের মুদ্রায় ৷ ধাতুর কোনও মুদ্রা আমাদের হাতে আসেনি ৷

মান্দালয়ের হোটেলটিও বেশ ভালো, নাম ‘সোয়ান হোটেল’ ৷ সেখানে এসে দুপুরে একটু বিশ্রামের পর বিকেলে বেরিয়ে পড়া গেল ৷ প্রথমে যাবার কথা ছিল মণিমুক্তোর দোকানে, কিন্তু প্রাসাদ বন্ধ হয়ে যাবে বলে তাদের বলা হল আমরা ফেরার সময় আসব ৷ ‘আমরা’ কথাটা গৌরবার্থে, এক্ষেত্রে অন্যদের আগ্রহ আর সামর্থ্যের সঙ্গে আমাদের ওসবের তুলনাই হয় না ৷

মান্দালয়ের রাজপ্রাসাদটি প্রায় চার বর্গমাইল এক বর্গক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত ৷ তাকে চারদিকে ঘিরে আছে ছোট্ট নদীর মতো স্বচ্ছ জলের একটি পরিখা ৷ চিনদেশে, এমনকী মণিপুরে (ইম্ভলে) এ ধরনের প্রাসাদ পরিকল্পনা আমরা দেখেছি ৷ মূল প্রাসাদটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানি বোমায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় ৷ ইউনেস্কোর সহায়তায় এই নতুন সোনালি প্রাসাদ আবার তৈরি হয়েছে, আকাশ ফুঁড়ে সূর্যকে বলবার চেষ্টা করছে, ‘দেখো, আমিও তোমার চেয়ে কম উজ্জ্বল নই ৷’ প্রাসাদটি অনেকটা চিনা প্যাভেলিয়নের ধরনে পরপর কয়েকটি প্যাগোডা জুড়ে তৈরি ৷ কিন্তু এ প্যাগোডা বাটি ওল্টানো কঠিন স্তূপ নয়, বরং পাইন গাছের ছড়ানো ডালের মতো একাধিক কাঠের ছাদ জুড়ে তৈরি ৷ তাদের সোনালি শীর্ষ আকাশে সদর্পে মাথা তুলেছে ৷ প্রথমটিতে ছিল সেই বিখ্যাত সোনার দরজাওয়ালা সিংহাসন, যেটি আমরা ইয়াঙ্গনের জাদুঘরে দেখেছি ৷ এখানে তার একটি অনুরূপ তৈরি করা হয়েছে, সেটিও সোনার রঙে ঝলমল করছে ৷ প্রথম প্যাগোডাটিতে রাজা দরবার বসাতেন ৷ তারপর দু-তিনটি প্যাগোডা পার হয়ে সেই বিখ্যাত আরশি প্রাসাদ বা Glass Palace, অমিতাভ ঘোষের ইংরিজি উপন্যাসে যার বিবরণ আছে ৷ গ্লাস প্যালেস মানে কাঠের জাফরি ও অন্যান্য আসবাবের গায়ে অসংখ্য আয়নার টুকরো লাগানো, মোগলদের শিশমহলের মতো ৷ কাঠের জাফরির খাটো বেড়া দেওয়া থামওয়ালা হলঘর, শেষদিকে আবার রাজসিংহাসন ৷ কিন্তু সবই শূন্য ৷ রাজারা উধাও হয়ে গেছে, প্রাসাদে তাদের কোনও জীবিত স্মৃতি নেই-এ শুধু ট্যুরিস্টদের জন্য সাজিয়ে রাখা খেলনা-প্রাসাদ ৷ আমরা ঘোরাঘুরি করলাম, লনে দাঁড়িয়ে নানাভাবে প্যাগোডা-শীর্ষ আর নিজেদের ছবি তুললাম, কিন্তু মন ভরল না ৷

এই প্রাসাদের বিশাল সীমানার এক কোণে ইংরেজরা বানিয়েছিল মান্দালয়ের বিখ্যাত জেলখানা, যেখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র কিছুদিন বন্দী ছিলেন ৷ প্রাসাদ থেকে সেটা দেখা গেল না, কিন্তু বিকেলে মান্দালয় পাহাড়ে উঠে তার জরাজীর্ণ টিনের ছাদ দূর থেকে দূরবীন দিয়ে দেখেছি ৷ এখন অবশ্য সম্পূর্ণ অন্যদিকে বিশাল কংক্রিট কারাগার তৈরি হয়েছে, পুরনো জেলখানা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত ৷

এরপর আমরা গেলাম এক বৌদ্ধ মঠে যার নাম ইনকম্প্যারেবল মনাস্ট্রি বা অতুলনীয় সংঘারাম ৷ এখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে প্রায় চারশো ভিক্ষু শিক্ষাদীক্ষা নেয়, রাষ্ট্র তাদের সাহায্য করে ৷ তার পাশেই গোল্ড প্যালেস মিউজিয়াম-প্রাচীন রাজধানী থেকে এই কাঠের খোদাই করা আসল প্রাসাদটি এখানে তুলে এনে রাখা হয়েছিল ৷ প্রাসাদটি দোতলা, কিন্তু একতলা মূলত ভিত, থাম বসানো ৷ আমাদের জুতো খুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হল ৷ অসামান্য সব কাঠের প্যানেল ও কারুকার্য ৷ তার কিছু কিছু ক্ষয় হয়ে এসেছে, মনে হল নতুন যুগের প্যানেলও কিছু বসেছে ৷ এই প্রাসাদ ও মঠ সংঘারামগুলিতে চিনা স্থাপত্যকলার প্রভাব সবচেয়ে বেশি ৷ তবু কোনও কোনও ছোট প্যানেলে হাতি বা হাঁসের ডিজাইন দেখে অজন্তার কথা মনে পড়ছিল ৷

সেখান থেকে মান্দালয়ের বিখ্যাত মহামুনি প্যাগোডায় যাবার পথে বাস আমাদের এমন এক পাড়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেল যেখানে শ্বেতপাথরে শুধু মূর্তি খোদা হয়, মূলত বুদ্ধমূর্তি ৷ সে এক বিশাল পাড়া ৷ রাস্তার দুধারে নানা আয়তন ও আকারের বুদ্ধ বসে আছেন, সকলেরই ঘাড় খাটো, মুখটা একটু মঙ্গোলীয় ধরনের-অর্থাৎ নাকের তলার দিকটা চওড়া, চোখদুটি ছোট ও বাঁকা, সেই অবস্থায় অর্ধনিমীলিত, কিন্তু মুখে আশ্চর্য প্রশান্তি ৷ কোনও বিশাল বুদ্ধকে কাঠের খাঁচায় বন্দী করা হয়েছে, জাহাজে দূর দেশে কোথাও পাঠানো হবে ৷ এখান থেকে চিন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-সমস্ত পৃথিবীতেই বুদ্ধমূর্তি যায় ৷ আমার নিজের অবশ্য এখানকার মূর্তিকলা শিল্প হিসাবে খুব একটা আহামরি লাগল না ৷ খানিকটা চিৎপুরের জয়পুরী কারিগরদের শ্বেতপাথরের মূর্তিকলার কথা মনে পড়ছিল ৷

মহা মিয়াৎ মুনি প্যাগোডা দক্ষিণ মান্দালয়ের বিশাল তীর্থস্থান-গেটটিই প্যাগোডার মতো, তার বাইরে মস্ত নীল জলের সরোবর, সেটি আবার দুদিকে ছোট ছোট প্যাগোডা দিয়ে ঘেরা ৷ এসব দেখে আমাদের বাগানের সেই গাইডটির কথা মনে পড়ছিল-‘ওনলি প্যাগোডা, প্যাগোডা, প্যাগোডা!’ প্যাগোডার ভেতরেও প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, তার সঙ্গে লাগানো বুদ্ধের বিশাল ব্রোঞ্জের মূর্তি-আরাকান থেকে আনা ৷ আরাকানের নাম এখন রাখিন ৷ মূর্তি ব্রোঞ্জের হলে কী হবে, ভক্ত আর পুণ্যার্থীদের দেওয়া ছোট ছোট সোনার পাতা গায়ে চেপে লাগিয়ে দেওয়ার ফলে সে মূর্তির মূল সৌন্দর্য আর নেই, তাঁর হাত বুক ইত্যাদি বেঢপ দেখায়, মনে হয় তাঁর কোনও বিশ্রী অঙ্গবিকৃতির অসুখ হয়েছে ৷ সোনার পাতায় মুড়ে বুদ্ধের মূল্য বেড়েছে কি না জানি না, কিন্তু সৌন্দর্য বেশ নষ্ট হয়েছে ৷ এ হল ভক্তের স্বার্থপর ভক্তির অত্যাচার, যা প্রায়ই আরাধ্য দেবতাকে অসুবিধায় ফেলে ৷

এর আগেই বোধহয় আমরা গিয়েছিলাম একটি লোকশিল্পের কারখানায়, যেখানে পুতুলনাচের পুতুল থেকে আরম্ভ করে কাঠের কাজ, দামি পাথরের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি ছবি, গালার জিনিস-আরও অজস্র দ্রষ্টব্য (এবং ক্রেতব্য) সাজানো ছিল ৷ যাঁরা কেনবার তাঁরা কিনলেন, আমরা দেখে তৃপ্ত বা অতৃপ্ত হলাম ৷ সোক্রাতেসের মতো যে বলব ‘দেখো, কত জিনিস ছাড়াই আমার দিব্যি চলে যাচ্ছে’-এই অহংকার করার মতো সাহস নেই ৷ এই ভোগবাদের দিনে মনে হয় আমাদের জন্য না হোক, সন্তানদের জন্য দুটো-একটা দ্রব্য নিতে পারলে হত ৷ কিন্তু এ প্রসঙ্গ থাক ৷ পরে সিল্ক বোনবার কারখানায় গিয়েও এমন কথাই মনে হয়েছিল ৷ সেখানে লম্বা হলঘরে অসংখ্য তাঁত সাজানো, তাতে নানা রঙের সুতো, সুতোয় রং করার সরঞ্জাম, কীভাবে সে সুতো গেঁথে অসাধারণ নকশার মসৃণ কাপড় তৈরি হচ্ছে সবই দেখা গেল ৷ তবে কারখানা-ঘরের প্রান্তে দোকানে গিয়েই আবার ‘এসবে কী হবে, এ জীবন কি শুধু ভোগের জন্য’-এইসব দার্শনিকতায় ডুবে যেতে হল ৷ অবশ্য একেবারে কিছুই কিনিনি তা বললে মিথ্যে কথা বলা হবে ৷ নিজের জন্য একটা সুতির বর্মি জ্যাকেট সঙ্গী ভদ্রমহিলা জোর করে কিনতে বাধ্য করলেন ৷

সবচেয়ে ভালো লাগল মান্দালয় পাহাড়ে চড়ে ৷ দিনের শেষে ছিল সেই যাত্রা ৷ পাদদেশে দুটি বিশাল সাদা চিনা ধরনের সিংহের কাছে আমাদের বড় বাস গিয়ে থামল ৷ এরপর ছোট বাসে পাহাড়ে উঠব ৷ নাহলে দুই সিংহের মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে, সে প্রায় সতেরোশো ধাপ ৷ আমার মতো পেসমেকার বসানো লোকের পক্ষে উচিত নয় অত সিঁড়ি ভাঙা ৷

কিন্তু বাস গিয়ে যেখানে শেষ দাঁড়াল সেটা পাহাড়ের আরেকটা ধাপ ৷ সেখান থেকে উঠতে হবে এসকেলেটর বা চলন্ত সিঁড়িতে ৷ আমরা তথাকথিত ‘ভি আই পি’ বলে সামরিক শাসকেরা আমাদের জন্য সেটি চালু রেখেছিলেন, ফলে মস্ত উঁচু পাহাড়শীর্ষে আমরা প্রায় এক নিমেষে উঠে গেলাম ৷ এখানে শ্বেতবস্ত্রধারী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এসে আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা করে মন্দিরে নিয়ে গেলেন ৷ সেখানে আমাদের দল কিছু অর্ঘ্য দিল, বুদ্ধমূর্তির সামনে সাজানো শূন্য ফুলদানিতে ফুলের তোড়াগুলি সাজিয়ে রাখা হল-সেই পুষ্পস্তবকে পামের পাতার সঙ্গে দোলনচাঁপার ডাল ও স্তবকও ছিল-সেগুলো আমাদের প্রত্যেকের হাতে সন্ন্যাসীরা একটা করে দিয়েছিলেন ৷ সৌগত রায় আমাদের সকলের পক্ষ থেকে বৌদ্ধমন্দিরে কিছু প্রণামী দিলেন, আর আমরা-ভিক্ষু সন্ন্যাসী এবং ছাপোষা গৃহস্থরা একসঙ্গে সমস্বরে প্রার্থনা করলাম ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি’ ৷ মুহূর্তের জন্য হলেও একটা শান্তির পরিবেশ তৈরি হল ৷ মূল মন্দিরের বাইরে-শোয়েডাগনে প্রথম দেখা, সাতটি ‘বারের’ প্রতীকী মূর্তি (বুদ্ধের মতোই)-বুধবারের দুবেলার জন্য আবার দুটি, অর্থাৎ মোট আটটি মূর্তি ৷ আমাদের মহিলারা এবং অধিকাংশ ছেলেরাও মূর্তির মাথায় জল ঢাললেন ৷ তবে কেবল নিজের ‘জন্মবারে’র উদ্দেশ্যে নয়, সব‘বার’ সন্তুষ্ট করা হল ৷ তারপর মন্দির প্রদক্ষিণ, এবং সবশেষে প্রশস্ত বারান্দায় সোফায় বসিয়ে সবাইকে খাদ্য ও (নির্দোষ) পানীয় দিয়ে অভ্যর্থনা (এটা সামরিক শাসনকর্তাদের তরফে আয়োজিত) ৷ স্বাগত ও ধন্যবাদসূচক বক্তৃতা-সবই চমৎকার হল ৷

কিন্তু আমাদের সবচেয়ে ভালো লাগল এই স্বর্গলোক থেকে পুরো মান্দালয়, আর দূরে পশ্চিমে বন্যা জলে বন্ধ বিস্তারিত ইরাবতীকে দেখতে ৷ এখানেও বিকেল হয়ে আসছে, আকাশে ধূসর মেঘের নানা পরত, তারই মধ্যে অনুজ্জ্বল সূর্যালোক খানিকটা নিস্তেজ হয়ে নিভে আসছে, আর ইরাবতী তার নানা ডালপালা নিয়ে নীল পাহাড়ের কোল ঘেঁসে বহু জনপদ এই বর্ষায় প্লাবিত করে বয়ে চলেছে ৷ কত হাজার বছর ধরে সে এমনভাবে বইছে কে জানে? আমাদের সামনে ছড়ানো পুরো মান্দালয় শহর ৷ ওই যে দূরে প্রাসাদ, তার উত্তর-পশ্চিম কোণেই সম্ভবত পুরনো জেলখানার লম্বা টিনের চালা দেখা যাচ্ছে ৷ ডানদিকে নতুন জেলখানা গড়ে উঠেছে তাও দেখালেন এক সন্ন্যাসী ৷ এ শহরে বেশি হাইরাইজ বাড়ি নেই, প্রচুর গাছপালা, আমার খানিকটা জাপানের কিয়োতো শহরের কথা মনে এল ৷

এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না ৷ আবার এসকেলেটর ধরে নেমে, আরও প্যাগোডা, তার একটাতে তো সাতশো পঁয়ত্রিশটা মন্দির ৷ তার প্রত্যেকটার প্রাঙ্গণে বৌদ্ধ ত্রিপিটকের একটা করে পাতা লেখা আছে পালি ভাষায়, কিন্তু বর্মি অক্ষরে ৷ ওরা বলে ‘পৃথিবীর বৃহত্তম পুথি’ এটা ৷ মনে পড়ল কোরিয়ার বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দিরেও এই ত্রিপিটক ছিল কাঠের ফলকে খোদাই ৷

সেই যে মণিমুক্তা এবং উপহার সামগ্রীর দোকান-তারা আমাদের ফিরতে দেরি দেখে হতাশ হয়ে দোকানে প্রায় তালা লাগাতে যাচ্ছিল ৷ আমাদের বাস গিয়ে দাঁড়াতেই আবার হৈ হৈ করে মেয়েরা তালা খুলে আলো জ্বালিয়ে দোকান জমজমাট করে ফেলল ৷ এতে যে তাদের প্রতীক্ষা আর পরিশ্রম বৃথা হয়েছিল তা বলা যাবে না ৷ বিক্রিবাটা ভালোই হল ৷

পরদিন আবার সেই ছোট প্লেনে ইয়াঙ্গন ৷ এবারও একটু সকাল সকাল, যাতে একটা পুরো দিন ইয়াঙ্গনে পাই ৷ সাক্ষাৎকার আছে সামরিক প্রশাসনের সবচেয়ে শক্তিমান সেনাপতি জেনারেল আবেলের সঙ্গে ৷ সেইসঙ্গে ইয়াঙ্গন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সেখানকার শিক্ষক-প্রক্ষিণের কাণ্ড কারখানা দেখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্কুলে ইউনিফর্ম পরা ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে ঢুকে তাদের সন্ত্রস্ত মুখ-টেপা হাসি ও সৌজন্য দেখে গবেষণাকেন্দ্রে পদার্পণ ও প্রদক্ষিণ এসব ছিল ৷ সবই হল ৷ এসব নিছক সরকারি দায়, তবে তারই মধ্যে ইয়াঙ্গন বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছপালা আর বাগান সাজানো সবুজ প্রাঙ্গণে তুমুল বৃষ্টি নেমে আমাদের অভিজ্ঞতায় একটু বৈচিত্র্য এনেছিল ৷ সামরিক প্রশাসনের ভবনে জেনারেল আবেলও খুব খাতির করলেন, বললেন ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বাড়াতে তিনিও খুব আগ্রহী ৷ তারপরে আরেকবার সেই স্কট মার্কেটে যাওয়া হল, অনেকে হুমড়ি খেয়ে সোনার গয়না, কারুময় স্ক্রিন, পাথরের গাছ, চুনিপাথর, টি-শার্ট থেকে চিংড়ি-শুঁটকির প্যাকেট ইত্যাদি কিনলেন, আমরাও তলার দিকে যোগ দিলাম ৷

১০ জুলাই তারিখে দুটি বাঙালি ছেলে, শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায় আর দেবাশিস ঘোষ আমাদের সেই হংসপ্রাসাদের কাছে রয়্যাল প্যালেস হোটেল নামে একটি বিখ্যাত চিনা রেস্তোরাঁয় অসাধারণ একটি লাঞ্চ খাইয়েছিল, সে কথা না বললে অকৃতজ্ঞতা হবে ৷ বিদেশে এমন আন্তরিকতা দুর্লভ ৷ ছেলেদুটি মনেপ্রাণে বাঙালি, এত উঁচু পদে আছে তবু তাদের মমতা ও বিনয় দেখবার মতো ৷

রাতে ছিল ইয়াঙ্গনের ভারতীয় গোষ্ঠীর ডিনার, আমাদের সেই সামিট পার্ক ভিউ হোটেলেই ৷ প্রায় তিনশো ভারতীয়, শার্জ দ’ ফেয়ার আর তার স্ত্রী মুক্তা, আরও প্রচুর বাঙালি-দেবাশিস তার স্ত্রী ও শিশুপুত্র সহ-সবাই এসে হোটেলের টেবিল-চেয়ার সাজানো হলঘর জমজমাট করে তুলল ৷ ভারতীয় গোষ্ঠীর সংগঠক নরেশকুমার দিনোদিয়া সবাইকে অভ্যর্থনা জানালেন, বক্তৃতা প্রতি-বক্তৃতা হল, এমনকী একটি বিদেশি লোকসংগীতও হল ৷

আর খাবারদাবারের বিবরণ দিয়ে পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না ৷ ফেরার আগের দিন মিয়ানমারের ভারতীয়দের এই বিদায় ভোজ আমাদের সকলেরই মনকে ছুঁয়ে গেল ৷

ফেরার দিন সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু আকাশে মেঘ দেখে ফিরে এলাম ৷ হোটেলের বাগানে নাগকেশর (স্থানীয় নাম ‘কাঙ্কা’) গাছে সবুজ পাতার ওপরে সরু নতুন লালপাতার আস্তরণ পড়েছে, এক গাছের চুড়োয় যেন গজিয়ে গেছে অন্য একটা ফুল গাছ ৷ এইসব দেখে ঘরে ফিরে টিভিতে ইভানোসেভিচ ও র্যাফটারের পুরনো উইম্বলডন ফাইন্যাল দেখছি ৷ আজ বিকেলে ফেরার ফ্লাইট ৷ এখান থেকে ওই একই ফ্লাইট ব্যাংকক যাবে, তারপর সধে কলকাতা ফিরবে ৷ এ যেন তালতলা দিয়ে খোদার হাট ৷

সে যা হয় হবে ৷ আমাদের বাক্স-প্যাঁটরা গোছানো শেষ ৷ এবার আমরা একটু কফি খাব ৷

ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০১

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন