অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
মেঘালয়ে খাসি পাহাড়ের একদম দক্ষিণপ্রান্তে দাউকির কাছে বাংলাদেশ সীমান্তের চেকপোস্ট তামাবিল ৷ একটা পূর্তবিভাগের বাংলো আছে আর আছে একটা গা এলানো নদী ৷ শিলং পাহাড়ের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে কদিন আদিগন্ত সবুজ সমতল দেখা যাবে ৷ উপরি পাওনা হতে পারে টাটকা মাছ কিংবা বিখ্যাত কমলালেবু-সময় অনুসারে ৷
ফেব্রুয়ারির ঠান্ডা ভোরে সোজা শিলংয়ের বড়বাজার অঞ্চলে চেরাপুঞ্জি বাসস্ট্যান্ডে ৷ ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাউকির মিনিবাস ছাড়ে ৷ তাছাড়া আছে ছোট গাড়ি-শেয়ারে দশ-বারোজন ৷ পাঁচ-ছ জনের দল হলে একটা ট্যাক্সি নেওয়া ভালো ৷ মাথাপিছু ৬০ থেকে ৮০ টাকা পড়বে ৷
প্রথমটা সেই চেনা চেরাপুঞ্জির রাস্তা ৷ আসলে এটাই দাউকি রোড বা শিলহেট রোড অর্থাৎ চল্লিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ৷ খাসি জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক রক্তক্ষয়ী স্বদেশী অধ্যায়ের স্বাক্ষর ৷ ব্রিটিশদের পছন্দ করা শিলং শহর এবং আরও উত্তরের সুফলা আসামের সঙ্গে বাংলার শ্রীহট্ট বা শিলহেট শহরকে সড়কপথে জোড়ার প্রয়োজন হয়েছিল রাজ্য বিস্তারের জন্যই ৷ বাধ সাধলেন তখনকার খাসি নেতা উ তিরৎ সিং ৷ শেষপর্যন্ত রক্ত ঝরিয়ে বাধ্য হয়ে শর্তসাপেক্ষে সড়কটি বানাবার চুক্তি হয়ে গেল ৷ সেটা মোটামুটি ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ ৷ তৈরি হল উত্তরপূর্ব ভারতের প্রথম এই রাজপথটি ৷ এখন আর গুয়াহাটি থেকে সরাসরি কোনও যাত্রীবাহন চলে না ৷ শিলং থেকে দাউকি ৮৩ কিলোমিটার রাস্তা ৷ শিলহেট শহর কেটে গিয়ে পড়েছে ওপারে ৷
প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার চলার পর চেরাপুঞ্জির রাস্তা ছেড়ে গাড়িটা বাঁদিকে মোড় নিয়ে উঠে পড়ল একটা সাবেকী লোহার ব্রিজে ৷ এরপর আরও কিছুটা চড়াই ভাঙা ৷ কিছুটা রাস্তা বেশ বিপজ্জনক ৷ কোথাও বাঁদিকে কোথাও ডানদিকে গভীর খাদ ৷ মাঝখানে সরু গিরিশিরা ধরে বুক দুরদুরে রাস্তা ৷ এই জায়গাটায় আমরা আসলে শিলং মালভূমির সবচেয়ে উঁচু মূল মধ্যশিরাকে পেরিয়ে এলাম ৷ জায়গাটা শিলং শহর থেকে আরও হাজার ফুট ওপরে ৷ মাঝে দুটো বড় গ্রাম পেলাম-লাই লিংকোট আর লিংকারডেম ৷ আমাদের গাড়ি প্রথমটাতে চা খাওয়ার সময় দিয়েছিল ৷ সকালের ঠান্ডা হাওয়া আর মিষ্টি রোদের মধ্যে কং (দিদি)-এর দোকানে শা শাও (লিকার চা) আর জিংবাম (ভাজাভুজি) খাওয়া হল ৷ শেষে কংকে ‘খুবলেই ম’ বা ধন্যবাদ জানিয়ে আবার রওনা ৷ খাসি ভাষা খুব প্রাচীন এবং উল্লেখযোগ্য মনখামের ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে ৷ যদিও এদের নিজস্ব কোনও লিপি না থাকায় ইংরিজি বা রোমান হরফকেই সম্বল করেছে ৷
এবার ঢালুপথে আরও বিশ কিলোমিটার মতো নামার পর এল বড়সড় এক জনপদ ৷ জাতীয় সড়কের দুধারেই অনেক দোকানপাট, লোকজন ৷ কারণ এটাই পিনুরসলা গ্রাম এবং ওই একই নামের ব্লকের সদর ৷ এই পিনুরসলা ব্লকের একদম দক্ষিণপ্রান্তেই রয়েছে দাউকি ৷ পিনুরসলা গ্রামের আরেক বিশেষত্ব হল এর অবস্থান ৷ চেরাপুঞ্জি ও মৌসিনরামের একই সরলরেখায় মাত্র ২৫ কিলোমিটার পূর্বে ৷ অর্থাৎ বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিপাত অঞ্চলের মধ্যেই পড়ে ৷ আলাদা করে মেপে দেখা হয়নি তাই এর গুরুত্ব কম ৷
সময়টা শীত-বসন্তের দোটানায় তাই মেঘের দেশেই মেঘেদের এখনও শীতঘুম ভাঙেনি ৷ অবশ্য রাস্তার পাশের খাদগুলোতে ধবধবে বিড়ালছানার মতো ছোট ছোট মেঘেদের রোদ পোয়াতে দেখেছিলাম ৷ গাড়ির মধ্যে আমরা ছাড়া সবাই স্থানীয় খাসি অথবা জয়ন্তীয়া সম্প্রদায়ের মানুষ ৷ ওদের নিজস্ব চেহারা, ভাষা ও পোশাক নিয়ে স্বমহিমায় উজ্জ্বল ৷ মার্বেনিয়াং-এর সঙ্গে ভাব জমালাম ইংরিজিতে ৷ উনি শিলংয়ে চাকরি করেন এবং দাউকির কাছে একটা গ্রামে শ্বশুরবাড়ি ৷ পরিবারের ছোট কন্যাকে বিবাহের কারণে রীতি অনুসারে একাধারে ঘরজামাই এবং স্থাবর-সম্পত্তির মালিক ৷ বাড়ি ফিরছেন দাউকির বার্ষিক নৌকো বাইচ প্রতিযোগিতা দেখবার জন্য ৷ আমরাও ওঁর কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেলাম সঙ্গে এক টুকরো পান-সুপারি-চুন ৷ অতিথিদের ওইটুকু নেওয়া একান্ত কর্তব্য ৷ না নিলে ওঁকে অপমানিত করা হয় ৷
বেলা প্রায় সাড়ে নটায় রাস্তার ডানদিকে একটা বড় নদী এবং সামনেই রুপোলি লোহার ঝোলা ব্রিজ ৷ খাড়া নদীর পাড় এবং পাহাড়ের গায়ে ঘন সবুজ মাখানো ৷ ব্রিজ পেরিয়ে বাঁদিকে মোড় নিতেই দাউকি ৷ এপারটা কিন্তু জয়ন্তীয়া হিলস জেলার আমলা রেম ব্লক ৷ ছোট্ট জনপদ দাউকি রাস্তার বাঁদিকটায় পাহাড়ের ঢালের ওপর ৷ ডানদিকে ওই পাহাড়ি ওয়া উম ঙট নদী পথশ্রান্তের মতো গা এলিয়ে চওড়া হয়ে শুয়ে আছে ৷ বুকের ওপর অসংখ্য ছোট ছোট নৌকো ৷ ওপারে বালির চরে বাংলাদেশের ট্রাকগুলো বালি তুলছে ৷ মেঘালয়ের নদী বালি-পাথর এনেছে বাংলাদেশের জন্য ৷ কারণ ওপারে বালি-পাথরের খুবই আকাল ৷
ছোট্ট বাজারের মধ্যে গাড়ি থামল ৷ পাশেই একটু উঁচু জমিতে আমাদের আশ্রয় ৷ পূর্তদপ্তরের বিশ্রামগৃহ ৷ বাংলোয় খাবার ব্যবস্থা নেই ৷ বাজারে অবশ্য একদম বাঙালি খাবার মাছ-ভাত ৷ এখানে খাসিরা অনেকেই বাংলা বলে ৷ এছাড়া স্থানীয় বাঙালির সংখ্যাও কম নয় ৷ কিন্তু এ হল শিলহেট জেলার বাংলা ৷ কান পেতে শুনলে ক্রমশ সরল হয় ৷
বিকেলের দিকে এই গ্রামের মোড়ল বা হেডম্যানের সঙ্গে গল্প করতে গেলাম ৷ এই পুরনো দাউকি বাজার অঞ্চলটা ওঁদেরই জমিতে ৷ একটা প্রাচীন কালীমন্দির এখনও আছে ৷ এখানকার সবচেয়ে বড় জমিদার রঙ্কসাই পরিবারের সদস্য ৷ ওঁদের পরিবারই বহুবছর ধরে এখানকার নৌকো বাইচ প্রতিযোগিতা চালাচ্ছেন ৷ অবশ্য মেলা আর খোলামেলা লটারি, জুয়া খেলার মাধ্যমে আমদানিও হয় ৷ এখানকার অদ্যোপান্ত ইতিহাস এবং হালহকিকৎ শুনলাম ওঁর কাছে ৷ মাঝখানে দু-বার চা ও একগাদা পান-সুপারির আপ্যায়ন ছিল ৷ দুঃখ করে বললেন, যদিওবা অল্পকিছু কমলালেবুর ব্যবসা এখনও আছে কিন্তু দেশভাগের পরে পান-সুপারির কারবারটা অনেকটা মার খেয়েছে ৷ সেকালের বিখ্যাত শিলহেটের কমলালেবু আসলে এই খাসি পাহাড়ের ফল ৷
পরদিন হাটবারে ভাগ্যক্রমে সেই বিখ্যাত কমলার দেখা পেলাম ৷ ওঁদের মতে, এর মধ্যেও সবার ওপরে ওয়াখেন গ্রামের লেবু-পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি লেবু ৷ এবার ফসল কম তাই একগণ্ডা ওয়াখেন কমলা কিনতে হল পঁচিশ টাকায় ৷ সন্ধ্যায় বাংলোর অধিকর্তা সহকারী ইঞ্জিনিয়ার মজুমদার মশায়ের সঙ্গে আলাপ হল ৷ উনি শিলংয়ের বাঙালি ৷ সব বন্দোবস্ত করে চৌকিদারকে বলে রাখলেন কাল সকালে আমাদের মও জাপলেন যাবার রাস্তা চিনিয়ে দিতে ৷
মেঘালয়ের আনাচেকানাচে লুকিয়ে আছে অনেক প্রাকৃতিক বৈচিত্র এবং সবকিছুর মধ্যেই জড়িয়ে আছে দারুণ সব লোকগাথা-প্রবাদ আর সংস্কার ৷ সকালে জলখাবার খেয়ে হাঁটা লাগালাম ফিরতি পথে সেই ব্রিজটা পেরিয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার মতো ৷ রাস্তার ডানদিকে পাহাড়ে চড়ার একটা সরু হাঁটাপথ ৷ শুকনো পাতা মাড়িয়ে হালকা জঙ্গলের মধ্যে চড়াই ৷ হঠাৎ বাঁদিকে মোড় নিতেই ঢুকে পড়লাম একটা প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গপথের মধ্যে ৷ ওপারে আলোয় বেরিয়ে কয়েকটা খাড়া ধাপ ৷ আরও কুড়ি-পঁচিশ পা হাঁটতেই একটা কালো পাথরের চওড়া চাতাল ৷ বাঁদিকটায় প্রায় ২৫ ফুটের খাড়া দেওয়াল ৷ নির্দেশ অনুযায়ী ওই দেওয়ালের ওপরে উঠতে পারলে সামনে দারুণ দৃশ্য ৷ একটা মোটা লতানে গাছের কাণ্ড দু-হাতে ধরে পাথরের গায়ে ধাপে ধাপে পা দিয়ে শৈলারোহণের মজা নেওয়া যায় ৷
ওপরে উঠলে প্রথমেই মাথাটা ঘুরে যাওয়া স্বাভাবিক ৷ একে মও জাপলেনের মাথায় স্বল্প পরিসর ৷ সামনে মহাশূন্য অর্থাৎ অনেক নিচে দাউকি শহর এবং উম ঙট নদী আর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের চোখ জুড়নো দৃশ্য ৷ আক্ষরিক অর্থে বিহঙ্গদৃষ্টিতে দেখা ৷
দাউকির লোকজনের মুখে মুখে এই বিশাল ঝুলন্ত পাথরটির কথা শোনা যায় ৷ চিরায়ত খাসি সমাজে প্রকৃতি পুজোর রেওয়াজ ৷ এদের ভগবান থাকেন নানান পাথরে, গাছে, গুহায় ৷ এই পঞ্চাশ ফুট উঁচু ডিম্বাকৃতি বিশাল পাথরটি আগে নাকি ছিল শিলংয়ের কাছেই সিমত গ্রামে ৷
ওখানকার গ্রামবাসীদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে এই প্রস্তরদেবতা রাজি হয়েছিলেন ওই পাহাড়ি গ্রামটাকে সমতলের মতো বানিয়ে দেবেন ৷ তবে একটা শর্ত ৷ চাই একজোড়া পাঁঠা-একটা নিকষ কালো আর একটা নিখুঁত সাদা ৷ দুর্ভাগ্যক্রমে নিখুঁত সাদা পাঁঠা কোথাও পাওয়া গেল না ৷ এদিকে সময় উত্তীর্ণ হল এবং প্রস্তরদেব রাগ করে সটান চলে গেলেন একদম শিলহেটের জাফলং গ্রামে ৷ ওখানকার গ্রামবাসীরা এককথায় দুটো পছন্দসই পাঁঠা বলি দিয়ে ওঁকে তুষ্ট করলেন ৷ প্রস্তরদেবও তখন কথা রাখলেন ৷ তৈরি করে দিলেন এক শস্য-শ্যামল সমতল শ্রীহট্ট ৷ এরপর মও জাপলেনের ইচ্ছা হল এমন এক জায়গায় অধিষ্ঠিত হতে যেখান থেকে তিনি নিজের এই অপূর্ব সৃষ্টিকে সবসময় দু-চোখ ভরে দেখতে পাবেন ৷ এগিয়ে এল একপাল অনুগত ইঁদুর ৷ তৈরি করে দিল বিশাল এক কলাগাছের ভেলা ৷ তারপর নদীর উজান ভেঙে সবাই মিলে মও জাপলেনকে বসিয়ে দিল দাউকির খাড়া পাহাড়ের গায়ে ৷ এখনও বিশাল জাপলেন ঠিক যেন উঁচু অট্টালিকার এক মনোরম বারান্দায় বসে বাংলাদেশের শ্রীহট্টের দিকে তাকিয়ে আছেন ৷ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছেও পাহাড়ের এই অংশটি পুণ্যতীর্থ ৷ কোনও এক সময়ে এক বিখ্যাত মোল্লা সাহেব এখানেই দেহরক্ষা করেছিলেন ৷ সেজন্য উরস উৎসবের সময় দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন মোল্লার মাজারে স্মৃতি তর্পণ করতে ৷
নিচে নেমে এসে সোজা নদীর ধারে ৷ ছোট ছোট নৌকোগুলো কপোতাক্ষ নদীর জলে ছপছপে দাঁড় ফেলে ভেসে বেড়াচ্ছে ৷ এক খাসি মাঝিভাইকে রাজি করিয়ে চড়ে বসলাম নৌকোয় ৷ শীতকালে জল কম তাই স্রোত বেশি নেই ৷ প্রায় চার কিলোমিটার নদীর ভেতরে নৌকোয় যাওয়া যায় বিশাল গ্রাম দারাং পর্যন্ত ৷
শেষদিন, হাতে একটা বেলা বাকি ৷ তাই একটা ট্যাক্সি নিয়ে তামাবিল চেকপোস্ট দেখতে যাওয়া হল ৷ কয়লার ট্রাকের আনাগোনায় এই তিন কিলোমিটার পথও বেশ দুর্গম মনে হয় ৷ তা সত্বেও দূর থেকে দেখা বাংলাদেশের মাটি একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে গেল ৷ হয়তো নাড়ির টান ৷ দাউকিতে দু-রাত্তির কাটিয়ে ফেরার পথে সেই আদিপ্রস্তরদেবকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম ৷ ওঁর বারান্দায় আবার ওঠবার ইচ্ছেটাও গোপন রাখিনি ৷
ভ্রমণ জানুয়ারি, ২০০১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন