অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
গোমুখ থেকে যাত্রা শুরু করে দেবপ্রয়াগে গঙ্গা নাম গ্রহণ করার আগে ও পরে অসংখ্য ছোটবড় নদী মিলিত হয়েছে ভাগীরথীর সঙ্গে ৷ তাদের মধ্যে জাটগঙ্গা, ভীলাঙ্গনা, অলকানন্দার মতো বিখ্যাত উপনদী যেমন আছে, তেমনই বহু ছোট ছোট নদী-নালা ভাগীরথীকে পুষ্ট করেছে ৷ এদের বেশিরভাগই আমাদের কাছে অপরিচিত ৷ ভাগীরথীর এমনই এক অখ্যাত সঙ্গিনী হল দিন গাড ৷ পূর্বের ডোকরিয়ানি বামক থেকে সৃষ্ট হয়ে তার স্বল্পজীবন শেষ হয়েছে বুকির কাছে ৷ আমাদের এবারের ট্রেকিং এই দিন গাড উপত্যকায় ৷
প্রতিবারের মতো দুন এক্সপ্রেস দেরি করে হরিদ্বারে ঢুকল ৷ বেলা বারোটার বাস ধরে তেহরি পৌঁছলাম সন্ধেবেলায় ৷ পরদিন নতুন বাসে উত্তরকাশী ৷ ৩১ মে ২০০০, দুজন পূর্বপরিচিত নেপালি বন্ধুকে সঙ্গী করে গঙ্গোত্রীগামী বাসে চেপে পৌঁছলাম বুকিতে ৷ ছোট জায়গা বুকি ৷ বাসস্ট্যান্ডের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ভাগীরথী ৷ ভাগীরথী-দিন গাড সঙ্গমটি খানিকটা উত্তরে, আমাদের রাস্তায় পড়ে না ৷ ভাগীরথী পার হওয়ার জন্য স্টিলের সাসপেন্স ব্রিজ ৷ বাসস্টপটি নদীর ডানতীরে হলেও, মূল গ্রামটি নদীর বামপারে, নদীবক্ষ থেকে বেশ খানিকটা ওপরে, গাছের ছায়া মাখা পথ ৷ সোনালি শস্য খেত ঘিরে রেখেছে গ্রামটিকে ৷ আমাদের পথ অবশ্য গ্রামে না ঢুকে, পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলে ৷ আরও চড়াই ৷ ওপর থেকে কার্পেটের মতো লাগে খেতগুলিকে ৷ বুনো গোলাপ আর রডোডেনড্রনের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে একটা স্পার পার হই ৷ আমরা এখন ঢুকে পড়েছি দিন গাড উপত্যকায় ৷ নদী অবশ্য পথ থেকে বহু নিচ দিয়ে বইছে ৷ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলা ৷ হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয় ৷ তাড়াতাড়ি আশ্রয় নিই পাথরের আড়াল ৷ তারই মধ্যে নরেন্দ্র এক পাত্র জল নিয়ে আসে ৷ তারপর সেই বৃষ্টি ভেজা জঙ্গলে বসল চায়ের আসর ৷ বৃষ্টি কমলে আবার চলা ৷ পৌঁছে যাই টেল (২৫০০ মিটার) বা তেল ৷ জঙ্গলে ঘেরা এই সবুজ ময়দানটা এক লহমায় ভালো লেগে যায় ৷ একদিকে নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিংয়ের চার-পাঁচটা তাঁবু, অন্য পাশে ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অব হিমালয়ান জিওলজির তাঁবু ৷ প্রথম সংস্থাটি ‘নিম’ ও দ্বিতীয়টি ‘ওয়াদিয়া’ নামেই স্থানীয়দের কাছে বেশি পরিচিত ৷ এখানে আলাপ হল এক গদ্দির সঙ্গে, নাম জ্ঞান সিং ৷ আদতে হিমাচলের লোক, তবে বহু বছর ভেড়া চরাচ্ছেন গাড়োয়ালে ৷
পরদিন প্রথমে উতরাই পথ ৷ নামতে নামতে কানে আসে নদীর গর্জন ৷ অবশেষে দেখা পেলাম দিন গাডের, এযাত্রায় প্রথম বারের জন্য ৷ আবার চড়াই ৷ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলেছি ৷ ছোট ছোট কয়েকটা নালা পার হতে হয় ৷ এই দিন গাড উপত্যকার জঙ্গল বেশ গভীর ৷ বন্যজন্তু থাকাটাই স্বাভাবিক ৷ এমনকী এখানকার একটি অনুচ্চ শৃঙ্গের (৪১৫২ মিটার) নাম রাখাউ টপ, ‘রাখাউ’ মানে ভাল্লুক ৷ তবে পাথর বিছানো, চওড়া পথ ধরে চলেছি বলেই বোধহয় তেমন ভয়ডর লাগছে না ৷ এমনকী যখন ওই জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্প লাগালাম, তখনও না ৷ টেল থেকে সাধারণত সবাই একদিনে যান ক্রোলিতে, পরদিন অল্প হেঁটে ডোকরিয়ানি বামক ৷ আমরা মোটামুটি অর্ধেক অর্ধেক করে দুদিনের পথ ভাগ করে নিই ৷ অর্থাৎ কাল ক্রোলিতে না থেকে সিধে ডোকরিয়ানি বামক ৷
এই দিন গাড উপত্যকা পর্বতপদযাত্রীদের কাছে খুব সুপরিচিত নয় বটে, কিন্তু এখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষজনের নিয়মিত আনাগোনা আছে ৷ যেমন উত্তরকাশীর নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং ৷ এঁরা যুবক-যুবতীদের পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন ডোকরিয়ানি বামক ও তার পার্শ্ববর্তী দ্রৌপদী কি ডান্ডা শৃঙ্গে ৷ আবার ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট ১৯৯২ সাল থেকে ডোকরিয়ানি বামকে হিমবাহ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা চালাচ্ছেন ৷ টেল, ক্রোলি এবং হিমবাহের কাছে তাদের ক্যাম্প রয়েছে ৷ এই দুই সংস্থা ছাড়াও দিন গাডের অন্যতম অতিথি গুর্জররা ৷ গদ্দিদের মতো আধা যাযাবর গোষ্ঠী এরাও ৷ তবে আদি নিবাস কাশ্মীর, আর ভেড়ার বদলে এদের সঙ্গে থাকে মোষ ৷ দিন গাড উপত্যকার ক্রোলি, খেরতাল, দেওকুণ্ড প্রভৃতি স্থানে এদের ছোটবড় আড্ডা আছে ৷ সেখান থেকে এরা দুধ, ক্ষীর ইত্যাদি বিক্রি করেন উত্তরকাশীতে ৷ এমনই কয়েকজন গুর্জরের সঙ্গে দেখা হল ৷ খেরতাল থেকে সকালবেলা বেরিয়ে, বুকিতে ক্ষীর বেচে আবার ফিরছেন খেরতালে ৷ অর্থাৎ আমাদের ক্ষেত্রে প্রায় আড়াই-তিনদিনের পথ পেরতে তাদের লাগে একদিন ৷ চলার পথে বিশ্রাম নেন আমাদের ক্যাম্পে, নিঃসংকোচে চা চেয়ে খান ৷ কোনওরকম শহুরে ভনিতা নেই ৷
পরদিন শুরুতেই একটা নালা পার হতে হয় ৷ তারপর চড়াই পথ ৷ ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলা, দিন গাড আবার অনেক নিচে রয়ে যায় ৷ ফেলে আসা নালার পর আর কোনও জলধারা পাই না ক্রোলির কাছাকাছি পর্যন্ত ৷ এপথের সবচেয়ে কঠিন চড়াই এইটি, গতকাল দিনশেষে এই চড়াই ভাঙতে হলে কষ্ট হত খুব ৷ চড়াই শেষে ক্রোলি (৩৪০০ মিটার) ৷ ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউটের ক্যাম্প আছে এখানে, আছে গুর্জরদের কিছু ঘর আর নদীর অপরপাড়ে নিমের ক্যাম্প ৷ ক্রোলি থেকে আকাশ পরিষ্কার থাকলে দ্রৌপদী কি ডান্ডা, জাওনলি প্রভৃতি তুষারশৃঙ্গের দেখা পাওয়া যায় বলে শুনি, কিন্তু আমরা দেখলাম মেঘে ঢাকা চারদিক ৷ ওয়াদিয়ার এক কর্মীর সঙ্গে তেজবাহাদুরের পরিচয় ছিল ৷ সেই সূত্রে তাঁরা আমাদের আমন্ত্রণ জানান তাঁদের তাঁবুতে ৷ কিন্তু আজ আমাদের আরও এগিয়ে যাবার মতলব ৷ পাহাড়, বুগিয়াল আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দিন গাড-সব মিলিয়ে ক্রোলি জায়গাটি খুবই মনোরম ৷ নদীর পাড়ে নেমে আসি ৷ ব্রিজ পেরিয়ে ডানতীরে ৷ আমাদের দক্ষিণে বইছে দিন গাড, উত্তরে তার উপনদী হুরা গাড, হুরা গাডের উত্তরে আছে মেচা ধার গিরিশিরা ৷ এই মেচা ধারের ওপর থেকেই ১৯৮০ সালে নিমের তৎকালীন প্রিন্সিপাল কর্নেল বলবন্ত সাঁধু দিন গাড উপত্যকাকে দেখে পছন্দ করেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে ৷ পৌঁছই নিমের বেসক্যাম্পে ৷ আরেকটু এগিয়ে ওয়াদিয়ার বেসক্যাম্প (৩৭৬০ মিটার) ৷ আজ আমরা এদের অতিথি ৷ চারদিকে সবুজ ময়দান, সামান্য দূরে বয়ে যাচ্ছে দিন গাড, আর তার ওধারেই দ্রৌপদী কি ডান্ডা-২ (৫৬৭০ মিটার), দ্রৌপদী কি ডান্ডা-১ (৫৭১৬ মিটার) ৷ পূর্বদিকে আমাদের লক্ষ্য ডোকরিয়ানি বামক ৷ তার পিছনের দুটি অনামা ছ হাজারি শৃঙ্গ জাওনলিকে ঢেকে রেখেছে ৷ মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে তুষারশৃঙ্গগুলি ৷ এর মধ্যে সন্ধে নামে, সোনালি হয়ে ওঠে চারপাশের শৃঙ্গগুলি ৷ নির্বাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকা এই সুন্দরীদের দিকে, আর মনে মনে ভাবি এত সহজ, সুন্দর রাস্তা কেন বাঙালি পর্বতপ্রেমীদের এখনও নজরে পড়েনি ৷
পরদিন কখনও মেঘ, কখনও রৌদ্র ৷ তারই মধ্যে চলেছি ডোকরিয়ানি বামক দেখতে ৷ সবুজ ময়দানে চরে বেড়াচ্ছে ভেড়ার পাল ৷ আমাদের পথ তৃণভূমি ছেড়ে পাথরের মধ্যে হারিয়ে যায় ৷ ডোকরিয়ানি হিমবাহের মোরেন অঞ্চল ৷ ছোটবড় বোল্ডার, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে দিন গাড ৷ অবশেষে পৌঁছই হিমবাহের স্নাউটের সামনে (৩৮৩০ মিটার) ৷ কালচে বরফের গহ্বরের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছে জল-যেন গোমুখের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ ৷ পিছনে ভাগীরথী শৃঙ্গত্রয়ের বদলে অনামা ছ হাজারিদ্বয় (৬০৩৪ মিটার, ৬০০২ মিটার) ৷ দক্ষিণে শিবলিঙ্গের বদলে দ্রৌপদী কি ডান্ডা-২ ৷ ভাগীরথী যেমন হু হু করে বেরিয়ে আসে, তেমনটি নয় দিন গাড ৷ শান্ত তার চলন, এমনকী স্নাউটের সামনে ছোট্ট একটি জলাশয় সৃষ্ট হয়েছে ৷
ডোকরিয়ানি বামক প্রায় ৫ কিলোমিটার লম্বা, কিন্তু প্রতি বছর গড়ে ১৭.৪৮ মিটার পিছচ্ছে বলে জানা যায় ৷ সামগ্রিকভাবে হিমালয়ের সর্বত্রই হিমবাহ ছোট হয়ে আসছে, তবে দিন গাডের এই গতি বিপজ্জনকভাবে বেশি ৷ আশা করি প্রকৃতির এই অনুপম সৃষ্টি উপভোগ করতে পারবেন ভবিষ্যতের প্রজন্মও ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন