ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

ভারি সুন্দর পরিবেশে বেশ পরিপাটি কিছু গুহা দেখেছিলাম নর্মদা তীরের পাহাড়ে, ওঙ্কারেশ্বরে ৷ দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম মধ্যপ্রদেশের ওঙ্কারেশ্বর ৷ প্রকৃতির খেয়ালে সেখানে আপনা থেকেই তৈরি হয়েছে নদী জলধারায় ঘেরা ঠিক ওঁ চিহ্নের মতো দেখতে এক আশ্চর্য পাহাড়ি দ্বীপ ৷ শঙ্করাচার্যের সাধনক্ষেত্র দ্বীপভূমির পাহাড়ের সেই গুহা ৷ পাশে রয়েছে তাঁর দীক্ষাদাতা আচার্য গোবিন্দপাদেরও সমাধিস্থান ৷ এখন অসংখ্য সন্ন্যাসী বাস করেন ওঁ-দ্বীপের পাহাড় জুড়ে নানা আখড়ায় আর নর্মদা তীরের গুহাতে ৷ ভাগ্যে থাকলে সেখানে ঠাঁই পেতে পারেন তাঁদের ভক্তরাও ৷ বিদেশি দর্শনার্থীরা এসে ভারতীয় গুরুর চরণে আশ্রয় নিয়ে দিন কাটিয়ে যান হামেশাই ৷ নদীপথে নৌকোয় যেতে যেতে পাশের পাহাড়ে পর্দাটানা গুহার ব্যালকনিতে বসে রোদ পোহাতে দেখা যায় তাঁদের ৷ দেখা যায় ত্রিবেণী সঙ্গমের ধারে পাথরের ফাঁকফোকরে গাঁজার কলকে হাতে একাকী বিভোর হয়ে থাকতে ৷ নদী সেখানে ঘন নীল ৷ সঙ্গমের কাছে জলের স্রোতও প্রচণ্ড ৷ পুবদিক রাঙা করে দুই পাহাড়ের সারির মধ্য দিয়ে নর্মদার বুকে সূর্যোদয় হয় সেদিকে ৷ হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া যায় দ্বীপ ঘুরে আরও বহুদূরে ৷ নির্জনে সাধনার অসামান্য পরিবেশ ৷ না হলে দিনভর অখণ্ড অলস অবসর ৷ চারপাশের প্রকৃতি মোহময় ৷

পর্যটন মানচিত্রে এখনও তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি ওঙ্কারেশ্বর ৷ তীর্থযাত্রীরাই বেশি যান সেখানে ৷ তাঁদের থাকার জন্য অতিথিশালা করেছেন মন্দির কমিটি ৷ হালে একটা হোটেল তৈরি হয়েছে ৷ আর আছে অজস্র ধর্মশালা ৷ হোটেলটা হওয়ার আগে বাসস্ট্যান্ডের কাছে যাত্রিকা ধর্মশালাই ছিল ওঙ্কারেশ্বরের সবচেয়ে ভালো পর্যটকাবাস ৷ বছর সাতেক আগেও তার ডাবলবেড-অ্যাটাচডবাথ ঘরের ভাড়া ছিল মাত্র ৪০ টাকা ৷ সেবারে যখন ওঙ্কারেশ্বর গিয়েছিলাম তখন মন্দিরে পুণ্যার্থীর ভিড় তো কম ছিল না কিন্তু যাত্রিকা ধর্মশালা আমরা ফাঁকাই পেয়েছিলাম ৷ আর এত সস্তায় একটা ঘর দখল করতে পেরে ওঙ্কারেশ্বরে থেকেও গিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন ৷

জ্যোতির্লিঙ্গের জন্য ওঙ্কারেশ্বর পুণ্যতীর্থ সেটা শুনেছিলাম কিন্তু জায়গাটা যে এত সুন্দর, জানা ছিল না আগে ৷ যদিও যাত্রিকা নিবাসটি মন্দির থেকে বেশ দূরে ৷ নদীর কাছে আসতে হলেও হাঁটতে হয় মিনিট পাঁচেক ৷ দোকান বাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটে আসার পথটা তেমন আকর্ষণীয় নয় ৷ তবে আমাদের খারাপ লাগছিল না ৷ প্রধান বসতি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে হলেও পথটাতে তীর্থক্ষেত্রের ছাপ আছে ৷ নদীর ঘাটের কাছে সেদিকটাকে বলে বিষ্ণুপুরী আর নদীর অন্য পাড়ে শিবপুরী ৷ নদীর ওপর প্রশস্ত ব্রিজ গিয়ে পৌঁছেছে ওপারের ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের নিচে ৷ মান্ধাতার আমলে নাকি তৈরি হয়েছিল সেই মন্দির ৷ তাই সেদিকটাকে মান্ধাতাও বলে থাকে লোকে ৷ ব্রিজ পার হয়েই যাওয়া যায় তাছাড়াও অজস্র রঙিন নৌকো যাতায়াত করে এপার থেকে ওপারে ৷ মধ্যপ্রদেশ ভ্রমণে এসে সেবার অজান্তে মান্ধাতার রাজত্বে গিয়ে পৌঁছে আমরা একেবারে অভিভূত ৷ যথাসাধ্য উপভোগ করে নিচ্ছিলাম দিনগুলোকে ৷ আলাপও হচ্ছিল স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে, সাধুবাবাদের সঙ্গে, বিদেশি পুণ্যার্থীদের সঙ্গেও ৷

সন্ধেবেলা মন্দিরে আরতি দেখে, ত্রিপলের নিচে বেঞ্চে বসে রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে, হাঁটতে হাঁটতে ফেরার পথে বাসস্ট্যান্ডের কাছে গুমটি দোকানে পান কিনছিলাম দুজনে ৷ কোন ধর্মশালায় আছি জানতে চাইল পানওয়ালা ৷ যাত্রিকায় উঠেছি শুনে মুখে চোখে বেশ সম্ভ্রম ফুটে উঠল তার ৷ আমাদের মতো পর্যটকের সেখানে থাকাটাই যেন আশা করছিল সে ৷ নিজেরা সম্ভ্রান্ত জানতে পেরে আমরাও যথেষ্ট গর্বিত ৷ হৃষ্টচিত্রে পানের জন্য অপেক্ষা করছি, উল্টোদিক থেকে একদল বিদেশি তরুণ-তরুণীকে হেঁটে আসতে দেখা গেল ৷ আগেও চলতে ফিরতে দেখা হয়েছে তাদের কারও কারও সঙ্গে ৷ আমাদের দেখে হাত নেড়ে সমস্বরে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেল তারা ৷ সকালে পাহাড়ের দিকে আবার দেখা হবে এমন ইঙ্গিতও করে গেল ৷ আমরা খুশি, কিন্তু পানওয়ালা গম্ভীর ৷ ‘এইসব থার্ড ক্লাস সাহেবদের সঙ্গে আপনারা কথা বলেন?’ খুব সংযত গলায় ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল সে ৷ সাহেব আবার থার্ড ক্লাস কী! আমরা হতবাক ৷ বহু আকাঙ্ক্ষিত ফরেন ট্যুরিস্ট বলে কথা! পানওয়ালা অবশ্য সংশয়মুক্ত নয় ৷ ‘থার্ড ক্লাস লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না ৷ মন্দিরের বাইরে কারও কাছ থেকে প্রসাদ নেবেন না ৷ যার তার সঙ্গে মিশবেন না ওঙ্কারেশ্বরে ৷’ যাবার আগে আবার সাবধান করে দিল সে ৷

মিশছিলাম না আমরা কারও সঙ্গেই ৷ নিজেরাই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম যথেচ্ছ ৷ পরদিন গিয়েছিলাম ৩ কিলোমিটার দূরের জৈনতীর্থ সিদ্ধকূট দর্শনে ৷ বিকেলবেলা নৌকো নিয়ে ফেরার পথে দেখা হল আরেকটা ছোট বিদেশি দলের সঙ্গে ৷ সূর্যাস্তে তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চারদিক ৷ নর্মদা তীরের সেদিকের দৃশ্য অন্যরকম ৷ এক চিলতে বালির চরের পাশে দেখা যাচ্ছে লাল মাটির নিচু টিলার ঢাল ৷ দু-চারটে কুটির রয়েছে ঢালের ওপরে ৷ কুটিরের এদিক ওদিকে কয়েক গুচ্ছ ঝাপড়া সবুজ গাছের দল যেন দাঁড়িয়ে আছে বিস্তীর্ণ লাল মাটির ঢালের রুক্ষ সৌন্দর্যকে আরও প্রকট করে তোলার জন্য ৷ সূর্যডোবা আলোয় তাক লাগিয়ে দিচ্ছে তৃণশূন্য লাল টিলার উদ্ভাসিত রূপ ৷ নদীর জলে ডুব দিয়ে বসে ছিল এক পাল মোষ ৷ দিন শেষ হয়ে আসায় ফিরে চলেছে চর পার হয়ে টিলার গ্রামের দিকে ৷ তাকে পিছনে রেখে আমরা যাচ্ছি সঙ্গম পার হয়ে ওঙ্কারেশ্বরে ৷ একটানা ভটভট শব্দ করতে করতে ঢেউ কাটিয়ে চলেছে মোটরবোট ৷ সঙ্গমের কাছে জলের ঘূর্ণিতে মাঝি হাল তুলে নিলে নৌকো ঘুরে যাচ্ছে চরকির মতো পাক খেয়ে ৷ সঙ্গম পার হয়ে এসে আবার তরতর করে ছুটে চলতে পারছে শিকারার মতো নৌকোটা ৷ ডানপাশের পাহাড় থেকে জলে ছড়িয়ে পড়া পাথরের চড়ায় দেখা গেল বিদেশি এক পরিবারকে ৷ রঙিন একটা তাঁবু পাতা হয়েছে চড়াতে ৷ আমাদের নৌকো দেখে খুব খুশি হয়ে ছুটে এসে হাত নাড়ছে একটি চার-পাঁচ বছরের বিদেশি শিশু ৷ চেঁচিয়ে বলছে কিছু ৷ শুনতে পাচ্ছি না নৌকোর মোটরের শব্দে ৷ আমাদের হাত নাড়তে দেখে হাত নাড়ছে তার মা-বাবাও ৷ তাঁবু গোটানোর তোড়জোড় করছিল তারা ৷ দিনটা নদীর ধারে কাটিয়ে বেলাশেষে এবার তাদেরও ফিরে চলার পালা ৷ দৃশ্যটা ভালো লাগছিল আমাদের ৷ যেতে যেতে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল দলটাকে ৷ তাঁবু তোলায় হাত লাগিয়েছে শিশুটিও ৷ ক্রমশ পাহাড়ের ছায়ায় ঝাপসা হয়ে আসা নদীচরে মিশে গেল ছবিটা ৷

ছোট্ট জায়গা ওঙ্কারেশ্বর ৷ দলটার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল পরদিনই মন্দিরের পথে ৷ ফ্রান্স থেকে এসেছে তারা ৷ কয়েক বছর আগেও একবার এসেছিল ভারতে ৷ ছেলে ছিল না তখন ৷ ঘুরতে ঘুরতে দুজনে এসে পড়েছিল ওঙ্কারেশ্বরে ৷ মুগ্ধ হয়েছিল ওঁ-তীর্থ দেখে ৷ এবার এসেছে ছেলের জন্য ৷ এত সুন্দর জায়গা, এমন আধ্যাত্মিক পরিবেশ, এই আনন্দের ভাগ তো দিতে হবে পরের প্রজন্মকেও! সহাস্যে বলেছিল তারা ৷ উত্তরসুরিকে পৃথিবীটা চিনিয়ে দিতে শুরু করেই নাকি ঠিক করেছিল যে আবার আসবে তারা ওঙ্কারেশ্বরে ৷ আমরাও আসব আবার ৷ ঠিক করেছিলাম তখনই ৷

কলকাতা থেকে ওঙ্কারেশ্বরে যাওয়া যায় দুদিক দিয়ে ৷ উত্তরের ইন্দোর অথবা দক্ষিণের খাণ্ডোয়া স্টেশন হয়ে ৷ হাওড়া থেকে শিপ্রা এক্সপ্রেস যাচ্ছে ইন্দোরে ৷ আগেরবার সেদিক দিয়ে যাওয়া হয়েছিল ৷ এবারে খাণ্ডোয়া হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ৷ সেদিকে যাচ্ছে হাওড়া-মুম্বাই মেল ৷ তবে সেই ট্রেন খাণ্ডোয়া পৌঁছয় মাঝরাতে ৷ অসুবিধে নেই, যাওয়া যেতে পারে বেনারসে ট্রেন বদল করেও ৷ বেনারস থেকে মুম্বাইয়ের সব ট্রেনই যাচ্ছে খাণ্ডোয়ায় ৷ আমাদের পছন্দ হল মহানগরী এক্সপ্রেস ৷ সকাল সাড়ে ১১টায় বারাণসী জংশন ছেড়ে খাণ্ডোয়া জংশনে পৌঁছবে পরদিন ভোর ৪টের সময় ৷ সুসময় বলেই মনে হয়েছিল তখন ৷ রওনা দেওয়া গেল শুভ সহস্রাব্দের প্রাক্কালে ৷ উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশের নানা জায়গায় ভ্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে, দিন পনেরোর ছুটিতে ৷

বেনারস থেকে যাত্রা শুরু হল কিছু মন্দগমনে ৷ এলাহাবাদ পৌঁছতেই ট্রেন একঘণ্টা লেট, জব্বলপুরে পৌঁছতে দুঘণ্টা ৷ বেজে গেল রাত ১১টা ৷ ‘নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন’ বললেন কন্ডাক্টর গার্ড, ‘আপনাদের ভালোই হল ৷ সকালের আগে ট্রেন খাণ্ডোয়ায় ঢুকছে না ৷’ কিন্তু যাত্রীর প্রয়োজনে লেট করে না ভারতীয় রেল ৷ কন্ডাক্টর গার্ডের উদ্বিগ্ন ডাকাডাকিতে ঘুমচোখে মালপত্র হাতে যখন খাণ্ডোয়া স্টেশনে নেমে গেলাম আকাশ তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার ৷ ট্রেন পৌঁছে গেছে মাত্র আধঘণ্টা দেরিতে ৷ কম্পার্টমেন্ট থেকে প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে ডিসেম্বর শেষের জবরদস্ত ঠান্ডা ৷

এই সময়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে গরম চা যে-কোনও রেলযাত্রীর কাছে অবিস্মরণীয় ৷ সময় কাটানো গেল কিছুক্ষণ ৷ আকাশ পরিষ্কার হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই ৷ শীতের দিনে ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে এত তাড়াতাড়ি সকাল হবে না ৷ অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়া গেল ৷ স্টেশনের কাছেই বাসস্ট্যান্ড ৷ সরকারি গুমটির বাইরে থেকে ছাড়ছে প্রাইভেট বাস ৷ শোনা গেল, ওঙ্কারেশ্বরের একটা বাস রওনা হয়ে গেছে এইমাত্র ৷ ইন্দোর যাওয়ার বাস পাওয়া যাচ্ছে ৷ সে বাসে মোরটক্কা পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে ৷

মোরটক্কা নামটা মনে ছিল ৷ খাণ্ডোয়া-ইন্দোর মিটার গেজ রেলপথে ওঙ্কারেশ্বর রোড স্টেশনটা সেখানেই ৷ সড়কপথও চলেছে পাশেপাশে খাণ্ডোয়ার সোজা উত্তরে ইন্দোরের দিকে ৷ মাঝামাঝি জায়গায় মোরটক্কা ৷ সেই মোড় থেকে ডানহাতি আরেক রাস্তা গিয়ে পৌঁছেছে ১২ কিলোমিটার দূরের ওঙ্কারেশ্বরের নদীর ধারে ৷ জানা ছিল ১২ কিলোমিটারের সেই কানাগলিতে দূরপাল্লা ছাড়াও স্থানীয় বাস যাতায়াত করে আধঘণ্টা-এক ঘণ্টা অন্তর ৷ মোরটক্কাতেই যাওয়া যাক তাহলে ৷ বাসটায় ভিড় হয়ে যাচ্ছিল ৷ কন্ডাক্টর আপ্যায়ন করে সামনের দিকেই তিনজনের সিট দিলেন ৷ ভালো বাস ৷ ডিলাক্স ছিল এক সময়ে ৷ এখন যদিও সিটের কাপড় ছিঁড়ে স্পঞ্জ উঁকি দিচ্ছে ৷ তবু তো রওনা হওয়া গেল! শহর ছাড়িয়ে বাইরে এসে বাস যখন ফাঁকা রাস্তা ধরল ততক্ষণে ভোর হতে শুরু করেছে ৷ ধু-ধু মাঠের শেষে গাছের সারির পিছন থেকে গোলাপি থালার মতো সূর্য উঠে আসছে ৷

চির পরিচিত সূর্যোদয় ৷ তবু চির নতুন ৷ সারা রাত ট্রেন জার্নির পর দূর বিদেশের অচেনা পরিবেশে অতি সুন্দর সেই মুহূর্ত ৷ যে কোনও ভ্রমণার্থীর স্বপ্নের যাত্রা ৷ কিন্তু ঘোর ভাঙিয়ে দিচ্ছে বাসের প্রচণ্ড ঝাঁকুনি ৷ এ কী অবস্থা রাস্তার! এ তো দুঃস্বপ্নময়!

খাণ্ডোয়া থেকে ওঙ্কারেশ্বরের দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার ৷ পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল দুঘণ্টায় ৷ কিন্তু মোরটক্কায় হাইওয়ের ধারে ব্রেকফাস্ট সেরে বাস বদল করে যখন ওঙ্কারেশ্বর পৌঁছলাম তখন সকাল ৯টা বাজতে চলেছে ৷ নদীর ঘাট থেকে সিঁড়ি ভেঙে যখন টিলার ওপর হোটেল ঐশ্বর্যতে ঢুকলাম তখন রোদ বেশ চড়া হয়ে উঠেছে ৷ মালপত্র নিয়ে হেঁটে আসতে ঘাম ছুটে গেছে ৷

জায়গাটা কিন্তু প্রায় একইরকম রয়েছে ৷ বাসস্ট্যান্ডটার সামান্য উন্নতি হয়েছে ৷ নতুন করে বাঁধানো হয়েছে চত্বরটা ৷ কিছু নতুন দোকানপাট, খাবারের হোটেল হয়েছে ৷ সেখান থেকে এগিয়ে এসে নর্মদার ঘাটের দিকে এখনও সেই পুরনো ছবি ৷ স্নান করছেন পুণ্যার্থীরা ৷ জলে রঙিন নৌকো চলছে ৷ পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাধুবাবাজিরা ৷ দোকানে দোকানে লাল গোলাপি আবিরের ছোট ছোট স্তূপ ৷ সাজানো রয়েছে পুজোর উপকরণ ৷ বাইরে ঝুড়ির পর ঝুড়িতে জড়ো করা রয়েছে নানা আকারের গাঁজার কলকে ৷ পুরি কচুরি মিষ্টির দোকানের পাশেই বিক্রি হচ্ছে বিশুদ্ধ ভাঙের শরবত ৷ একের পর এক রাজপুত সমাজ, জাঠ সমাজ ধর্মশালাগুলোর রংও যেন আগেরই মতো ৷ আর রঙের জন্যই হুবহু এক দেখাচ্ছে গিরিখাতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা কালচে সবুজ নর্মদার অন্য তীরে ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের দিকটা ৷ ঘাটের কাছ থেকে পাহাড়ের গায়ে বেশিরভাগ স্থাপত্যেই সেদিকে ছোপ ধরা পাথুরে রং ৷ তারমধ্যে মাথা উঁচু করে উঠেছে সাদা রঙের পাঁচতলা ওঙ্কারেশ্বর মন্দির ৷ ওপরে দেখা যাচ্ছে পুরনো রাজপ্রাসাদটাকে ৷ পাশ দিয়ে উঠে চলা সিঁড়ির পথটা এদিক থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু পাহাড়ের একেবারে ওপরে গৌরীশঙ্কর মন্দিরের দিকে সোজা উঠে গেছে আরেকটা সিঁড়িপথ ৷ নতুন সাদা রং করার জন্য এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেই লম্বা খাড়া সিঁড়িটাকে ৷ ওঙ্কারনাথ পাহাড় প্রদক্ষিণের জন্য যাত্রীরা চলেন সেদিকে ৷ দুপুরবেলায় রোদের তাপে ধীরে ধীরে যেন ঝিমিয়ে পড়ে ওঙ্কারেশ্বর ৷ বিকেলে দেখি পড়ন্ত আলোয় একইরকম উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মান্ধাতা পাহাড় ৷ এদিক থেকে হলদেটে দেখাচ্ছে ওপারের বাঁক জুড়ে সমস্ত পুরনো স্থাপত্য ৷

যে হোটেলটায় এবার উঠেছি সেটা একেবারে নদীর ধারে, শিবপুরীর ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের উল্টোপাড়ে ৷ বাসস্ট্যান্ড থেকে এসে বিষ্ণুপুরী ছাড়িয়ে এদিকটাকে বলে ব্রহ্মাপুরী ৷ আরেক জ্যোতির্লিঙ্গ মমলেশ্বর মহাদেব রয়েছেন এই পাড়ে ৷ বাসস্ট্যান্ডের যাত্রিকা ধর্মশালার ভাড়া বেড়ে হয়ে গেছে ১৫০ টাকা ৷ বাইরে থেকে পরিচ্ছন্ন, পাহাড় জঙ্গল লাগোয়া ছাদটা তেমনই আকর্ষণীয়, কিন্তু ঘরগুলো এবারে আর তেমন পছন্দসই মনে হল না আমাদের ৷ ব্যবহারে পুরনো হয়ে মলিন হয়ে গেছে, অথবা বদলে গেছি আমরাই ৷ এই হোটেলটা নতুন ৷ ভাড়া দ্বিগুণ হলেও অবস্থান আর রক্ষণাবেক্ষণের হিসেবে সস্তাই বলা যায় ৷ একচিলতে কার্পেটও পাতা হয়েছে ঘরে ৷ তবে মালপত্র নিয়ে বিষ্ণুপুরী থেকে সিঁড়ি ভেঙে এখানে আসা বেশ কঠিন ৷ বাসস্ট্যান্ড থেকে আসা যেতে পারে গাড়ি নিয়ে কিছুটা ঘুরপথে ৷ হাঁটতে হাঁটতেই বিষ্ণুপুরীতে আসছিলাম আমরা অন্য কোনও ভালো ধর্মশালা বা পি ডাব্লু ডি বাংলোয় ঘরের খোঁজে ৷ দূর থেকে হোটেলটাকে দেখাল একজন ৷ সিঁড়ি দিয়ে ঘাটে নেমে আবার উঠে যেতে হবে উল্টোদিকের সিঁড়ি দিয়ে ৷ ভাগ্যিস চলে এসেছিলাম ঝোঁকের মাথায় ৷ বলা যেতে পারে পর্যটকদের থাকার জন্য ওঙ্কারেশ্বরে এখন এটাই সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা ৷ গিরিখাতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদীর দক্ষিণ টিলায় এই হোটেলের সামনে থেকেই এক নজরে দেখা যায় ব্রহ্মাপুরী, বিষ্ণুপুরী ঘুরে ব্রিজ পার হয়ে সামনের শিবপুরীর মন্দিরাঞ্চলের পুরো ছবিটা ৷ ডানদিকে দূরে দেখা যায় মমলেশ্বর মহাদেব মন্দির পার হয়ে উত্তাল নদীসঙ্গম ৷ কাবেরী নদী নর্মদায় মিলেছে সেখানে ৷ বাঁধ তৈরি হয়েছে বহুমুখী পরিকল্পনা নিয়ে ৷

স্থানীয় নদী এই কাবেরী ৷ দক্ষিণ ভারতের সুপ্রসিদ্ধ কাবেরীর সঙ্গে কোনও যোগ নেই তার ৷ আসলে আলাদা কোনও নদীও নয়, নর্মদারই অন্য ধারা বয়ে গেছে দ্বীপ ঘুরে ৷ পুবদিকে দ্বীপের শুরুতে ভাগ হয়ে আবার এসে মূলধারায় মিশে গেছে দ্বীপের শেষে পশ্চিমে ৷ সেদিকেও তৈরি হয়েছে এক সঙ্গম ৷ মাহাত্ম্য বেশি পুবের সঙ্গমের ৷ হিন্দু, জৈন দেবদেবীর ২৪ অবতারের প্রাচীন মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে সেখানে ৷ রয়েছে কোটিতীর্থ স্নানঘাট ৷

নর্মদার দক্ষিণতীরে মমলেশ্বর জোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয় ওঙ্কারেশ্বরের অনেক পরে ৷ পৌরাণিক ইক্ষ্মাকু বংশের রাজা যুবনাশ্বের পুত্র প্রবল পরাক্রান্ত মান্ধাতা যদি ওঙ্কারেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে থাকেন, তবে সেই মন্দিরের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল পরবর্তীকালে যুগ যুগ ধরে ৷ শ্রীবৃদ্ধি হয় ওঁ-দ্বীপেরও ৷ পাহাড়ের মাথায় তৈরি হয় প্রকাণ্ড দুর্গ ৷ মুচকুন্দ কেল্লা বলে তাকে এখন স্থানীয় লোকে ৷ তার উত্তরে কাবেরী নদীর অন্য তীরে ঋষিদের সাধনার জন্য খ্যাত সিদ্ধকূট পাহাড় জৈনতীর্থ হিসেবে প্রসিদ্ধ হয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে ৷ বোঝা যায় এই দ্বীপাঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল প্রসিদ্ধ প্রাচীন নগরী ৷ যা ধ্বংস হয় ১১ শতকে গজনির সুলতান মামুদের আক্রমণে ৷ আশ্চর্যের বিষয়, মামুদের সেই আক্রমণে পাহাড়ের ওপরের দুর্গ প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রক্ষা পেয়ে যায় নিচের ওঙ্কারেশ্বর আর অন্য কিছু মন্দির ৷ যদিও এরপর মোগল আমলে কোনও সময়ে সম্ভবত পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে যায় এই অঞ্চল ৷ কারণ, ঘন জঙ্গলে ছেয়ে যাওয়া পাহাড়ে প্রাচীন ওঙ্কারেশ্বর মন্দির খুঁজে না পেয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে ধরে নিয়ে ১৮ শতকে নর্মদার অন্য তীরে মমলেশ্বর মন্দির স্থাপন করে আবার নতুনভাবে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা হয় এই পুণ্যভূমিকে ৷ এরমধ্যে যদিও ১৬ শতকে গুরুনানক এখানে এসেছিলেন, আর ওঁ-দ্বীপের পর্বত পরিক্রমাও করেছিলেন বলে বিশ্বাস ৷ সেই স্মৃতিতে গুরুদ্বার তৈরি হয়েছে শিবপুরীতেই ৷ এখন উৎসব উপলক্ষে সেখানে উপস্থিত হন শিখ সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষ ৷ এবং আবার জৈনতীর্থের গরিমা ফিরে পেয়েছে সিদ্ধকূট পাহাড় ৷ আর অবশ্যই বহু ভক্ত সমাগমে নিয়মিত পূজিত হচ্ছে ওঙ্কারেশ্বর ও মমলেশ্বর-দুই জ্যোতির্লিঙ্গই ৷ শিবরাত্রি আর কার্তিক পূর্ণিমায় লক্ষ লোকের মেলা বসে যায় জাগ্রত তীর্থ ওঙ্কারেশ্বরে ৷ ব্রহ্মাপুরীতে আমাদের হোটেলের পিছন দিকেই রয়েছে সেই বিশাল মেলাপ্রাঙ্গণ ৷ সেখান থেকে রাস্তা চলে গেছে নতুন তৈরি বাঁধের দিকে ৷

ব্রহ্মাপুরীর এই দিকটা ততটা ভালোভাবে দেখা হয়নি আগেরবার ৷ ব্রহ্মার প্রাচীন মন্দির আছে দেখেছিলাম ৷ দেখা হয়নি জুনা আখড়া, নিরঞ্জনী আখড়ার মতো শতাব্দীপ্রাচীন আশ্রমও ৷ বিষ্ণুপুরীতে প্রাচীন বিষ্ণুমন্দির ছাড়া কিছু নতুন মন্দির আছে ৷ মার্কণ্ডেয় যোগ আশ্রমে ঋষি মার্কণ্ডেয়র মূর্তি, যজ্ঞশালা, ভোজনালয়ের কর্মকাণ্ড দর্শনীয় ৷ দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির হয়েছে সেখানে ৷ তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় শিবপুরীর ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের দিকটা ৷ অতুলনীয় ভাস্কর্যে সমৃদ্ধ সেই মন্দির ৷ পাঁচটি তলে স্থাপিত হয়েছেন পাঁচ শিব ৷ প্রথমতলে মান্ধাতা পূজিত প্রণবলিঙ্গ, অর্থাৎ ওঙ্কারেশ্বর ৷ দ্বিতলে মহাকালেশ্বর ৷ তার সামনের দালান থেকে দেখা যায় নদীর দিকের দৃশ্য ৷ ওপরের তলগুলোতে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন সিদ্ধনাথ, কেদারেশ্বর, গুপ্তেশ্বর মহাদেব ৷ পুজো দিয়ে ভক্তরা চরণামৃত নিয়ে যান ওঙ্কারেশ্বরের ৷ প্রণবলিঙ্গের নিচে সেখানে জল জমে থাকে সবসময় ৷ মহাদেবের সেই চরণামৃত নর্মদারই পুণ্যবারি বলে বিশ্বাস ৷

ভক্তদের আনাগোনায় সকাল সন্ধে গমগম করে ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের গলিপথ ৷ দোকানপাটে ঠাসা সেই গলিপথটাও শিবপুরীর এক অন্যতম আকর্ষণ ৷ বিক্রি হয় নানা মাপের ডিম্বাকার পাথর ৷ গতবার ওঙ্কারেশ্বরে এসেছিলাম ইন্দোর থেকে উজ্জয়িনী, মাণ্ডু, মহেশ্বর ঘুরে ৷ মহেশ্বরে অহল্যাবাঈয়ের প্রাসাদে রানির পুজোর ঘরে এরকম অসংখ্য পাথরের শিবের সংগ্রহ দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম ৷ তারপর ওঙ্কারেশ্বরে এসে দেখা গেল দোকানে দোকানে এমন পাথরের সম্ভার ৷ এখানকার নর্মদার জলের চোরাস্রোতের প্রচণ্ড ঘূর্ণিতে নাকি তৈরি হয়ে যায় পাথরের এমন আকার ৷ মসৃণতা, উজ্জ্বলতা, রঙের বাহার আর মাপের পার্থক্যে তাদের দামেরও পার্থক্য ৷ স্মারক হিসেবে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওঙ্কারেশ্বরের শ্রেষ্ঠ বস্তু ৷ আর তাহলে দোকানে ঘুরে ঘুরে সবচেয়ে কম দামে সবচেয়ে পছন্দসই পাথরটা সংগ্রহ করা ওঙ্কারেশ্বরে এক বড় কাজ ৷

বলতে গেলে সেই করতেই কেটে গেল দিনটা ৷ তারমধ্যে কয়েকবার হোটেলে ফিরে আসার জন্য বার বার নর্মদায় নৌকো পারাপার ৷ মাঝিদের সঙ্গে দরাদরি করতে হয় খুব ৷ তবে সম্ভবত পরে দূরপাল্লায় যাওয়ার আশাতেই উল্টোপারে পৌঁছে দিতে রাজি হয়ে যায় মাত্র দু টাকায় ৷ যদিও তৃতীয় কি চতুর্থবার দেখা দিতেই বেঁকে বসলেন একজন ৷ ‘আপনারা তো আর দূরে কোথাও যাবেন না, খালি এই পার আর ওই পার করবেন সারা দিন! পাঁচ টাকা দিতে হবে,’ ক্ষুব্ধভাবে জানালেন তিনি ৷ অন্যরকম একজনকেও দেখা গেল ৷ পারাপারটা পুরোপুরি ফ্রি পাওয়া গেল তার কাছে ৷ বড়ই ওস্তাদ সেই ছেলে ৷ বলল, ভগবান শঙ্করজির কাছে যাওয়া আসা করবেন বলে নদী পার হবেন, তার জন্য আবার পয়সা কী! কিছুতেই কিছু দেওয়া গেল না তাকে ৷ অগত্যা তাকে নিয়েই পরদিন উষালগ্নে বেরনো হল নর্মদা বিহারে ৷ কোটিতীর্থ ঘুরে কপিলধারা দেখতে ৷

নর্মদার দক্ষিণতীরের পাহাড়ের গোমুখ থেকে উৎসারিত হয়ে কপিলধারা নেমেছে নদীতে ৷ তটভূমিতে সেখানে গোমুখ ঘাট ৷ প্রাচীন মন্দির রয়েছে কাশী-বিশ্বনাথের ৷ লোককথায় শোনা যায়, দূর অতীতে সেখানে এক ব্রহ্মরাক্ষস নাকি ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল মুনিঋষিদের তপস্যায় ৷ তাঁদের আকুতিতে ক্রুদ্ধ মহাদেব ত্রিশূল দিয়ে বধ করেন রাক্ষসকে ৷ তারপর অশুদ্ধ ত্রিশূল শুদ্ধ করার জন্য তাঁর ত্রিশূল ফেলেন নর্মদার তটে ৷ ত্রিশূলাঘাতে পাহাড় ফেটে গোমুখের আকার নেয় ৷ নির্গত হয় কপিলধারা ৷

এমন অনেক গল্প শোনা যায় ওঙ্কারেশ্বরের সাধুবাবাজিদের চ্যালাচামুণ্ডা থেকে শুরু করে সাধারণ লোকের মুখে মুখে ৷ আগেরবার নৌকোয় যেতে যেতে মাঝিও শুনিয়েছিলেন অনেক গল্প ৷ এবারের মাঝি অবশ্য স্পষ্ট বলে দিল যে ওসব কাহিনী সে জানে না, তার বাবা জানে ৷ ওঙ্কারেশ্বরের প্রতিটা পাথর নিয়েই রয়েছে এরকম কাহিনী ৷ এমন মহান জায়গা, ফলে সেসব থাকবেই ৷ না থাকলেও বানিয়ে নেওয়া যায় ৷ কিন্তু বানিয়ে সে বলতে পারবে না ৷ বরঞ্চ নিয়ে যেতে পারে ৬ কিলোমিটার দূরের সপ্তমাতৃকা মন্দিরের দিকে অথবা ৯ কিলোমিটার দূরের কাজলরানি গুহাতে ৷ কাজলরানি এত সুন্দর জায়গা যে একবার গেলে তাজ্জব বনে যেতে হবে ৷ নৌকোর মোটরে অনেক তেল পুড়লেও সেদিকে গেলে নাকি তার দিমাক খুশ হয়ে যায় ৷

যদিও যাওয়ার যা ভাড়া শোনা গেল, আমাদের দিমাক তাতে খুশ হল না ৷ দেখা যাবে কাল সকালে ৷ মহেশ্বর যাওয়ার ইচ্ছে আছে ৷ জিপ পাওয়া গেলে মাণ্ডুতেও যাওয়া যেতে পারে ৷ জিপ অবশ্য পাওয়া যাচ্ছিল না ৷ শেষে যখন পাওয়া গেল একটা, সেও ভাড়া চেয়ে বসল প্রচণ্ড ৷ বাসে গিয়ে মহেশ্বর থেকে মাণ্ডু দেখে একদিনে ফেরা যাবে না ৷ ওঙ্কারেশ্বরের মাত্র ৬৩ কিলোমিটার দূরে মহেশ্বর ৷ কিন্তু শোনা গেল রাস্তার অবস্থা এখন ভীষণ খারাপ ৷ তার জন্যই জিপের এত ভাড়া চাওয়া হচ্ছে ৷ একটা দর জানিয়ে দিয়ে এলাম আমরাও ৷ রাজি থাকলে যেন আমাদের হোটেলে চলে আসে পরদিন ভোরে ৷ না হলে নৌকো নিয়ে যাব কাজলরানি গুহাতে ৷ সেদিন দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর গেলাম মন্দিরের ওপরে রাজবাড়িটা দেখতে ৷

অন্য তীর্থযাত্রীদের সঙ্গেও পরিচয় হতে শুরু করেছে ততক্ষণে ৷ দেখা যাচ্ছে বিদেশিদেরও ৷ ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা ভবঘুরে পোশাকে খোলা মেজাজে ৷ যদিও গতবারের মতো তেমন আলাপ হচ্ছে না তাদের সঙ্গে ৷ হয়তো এবার দলে তিনজন হয়ে একটা পরিবারের মতো দেখাচ্ছে বলে আর ততটা ভবঘুরে হিসেবে গণ্য করছেন না আমাদের ৷ সাধুসন্ন্যাসী আর দোকানদারদের সঙ্গেই তাদের বেশি ভাব ৷ মনে হয় যেন সবসময়েই ব্যস্ত আছেন কোনও কিছুর সন্ধানে ৷ আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান থেকে স্থানীয় বস্তু সংগ্রহ, সবকিছুতেই তাদের অনুরাগ ৷ অনেকের আবার আত্মমগ্ন ভাব ৷ একজনকে দেখলাম ভিখিরিদের লাইনে বসে আছেন ব্রিজের ওপরে ৷ ঠিক ঘেঁসাঘেঁসি করে নয় ৷ একটু দূরে বসে রয়েছেন তদগতভাবে নদীর দিকে তাকিয়ে ৷ থার্ড ক্লাস কিনা কে জানে! বলে দেবার লোকটাও নেই ৷ বাসস্ট্যান্ডের পথে পানের দোকানটা পাওয়া যায়নি অনেক খুঁজেও ৷

ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের কাছ থেকে সিঁড়ি উঠেছে রাজপ্রাসাদে ৷ পুরনো ছাপ ধরেছে পাথরের তৈরি প্রকাণ্ড বাড়িটাতে ৷ যদিও রাজপরিবার এখনও ব্যবহার করেন বাড়ির একদিক ৷ প্রধান দ্বারপথে উঠোন পেরিয়ে আমদরবার ৷ বেশ ঘরোয়া পরিবেশ ৷ জুতো খুলে ভেতরে ঢুকতে হবে ৷ ওপাশের জানালা থেকে দেখা যায় মন্দিরের দিকটা ৷ ভেতরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন সাদাধুতি সাদা পাগড়ি মাথায় বৃদ্ধ রাজকর্মচারী ৷ প্রাসাদ আমরা দেখেছি আগেই ৷ একজনই নতুন আমাদের মধ্যে ৷ ‘আইয়ে ছোটা সাহাব’ বলে ভদ্রলোক আদর করে নিয়ে গেলেন তাকে ৷ সাদামাটা দরবার মহল ৷ কিন্তু গম্বুজাকার সিলিংয়ের কারুকাজ দেখার মতো ৷ মেঝের একপাশে ধপধপে সাদা তাকিয়া গদি পাতা ৷ রাজগদি সেটাই ৷ এখানেই আর্জি জানায় প্রজাবৃন্দ ৷ কর্মচারীরা যথেষ্ট আপ্যায়িত করছিলেন আমাদের ৷ বাধা নেই ছবি তোলাতেও ৷ ছোটা সাহাব ঘুরছে তাদের কোলে কোলে ৷ রাজবাড়িতে এমন খাতির পেয়ে বিলক্ষণ উল্লসিত সে ৷ এতটাই যে, উঠোনের একদিকের দরজা খুলে একটা ছোট মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখে, ভুল করে রাজকন্যা ভেবে বসল তাকে ৷

মহলের এক ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নদীর দৃশ্য দেখতে দেখতে কথা হচ্ছিল কর্মচারীদের সঙ্গে ৷ রাজা শিউশরণ চৌহানের প্রাসাদ এটা, জানালেন তাঁরা ৷ পাহাড়ের গায়ে অতি চমৎকার জায়গায় তৈরি হয়েছে এই প্রাসাদ ৷ নিচে দেখা যাচ্ছে এপারের ওঙ্কারেশ্বর মন্দির ৷ দেখা যাচ্ছে অন্য পারের মমলেশ্বর মন্দিরও ৷ ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের সামনে থেকে নর্মদার তীর ধরে পশ্চিমে এগিয়েছে প্রদক্ষিণ পথ ৷ ১১ কিলোমিটার পুণ্যযাত্রায় প্রদক্ষিণ করে আসা যায় পাহাড়টাকে ৷ গতবার গিয়েছিলাম সেই প্রদক্ষিণে ৷ পাহাড় ডিঙিয়ে এতটা হাঁটার ইচ্ছে নেই এবার ৷ দর্শনীয় মন্দির আছে ওপরে ৷ রয়েছে ভেঙে যাওয়া মুচকুন্দ কেল্লার কয়েকটি তোরণ ৷ চাঁদ-সূরজদ্বার, ভীম-অর্জুনদ্বার প্রভৃতি তাদের নাম ৷ দ্বীপের পুবদিকে ভীম-অর্জুনদ্বার দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নর্মদার তীর ধরে হেঁটে আবার ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরে ফিরে এসে শেষ হয় প্রদক্ষিণ ৷ ভাবছিলাম সেদিকটা থেকে ঘুরে আসা যাক আরেকবার ৷ পাহাড়ের ওপরে ভীম-অর্জুনদ্বার থেকে সুন্দর দেখায় পুবের নদীসঙ্গম ৷ সেখানেই নাকি কিরাতার্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল পরশুরামের ৷ ওঙ্কারেশ্বর মন্দির থেকে বেরিয়ে শঙ্করাচার্য গুহা, গোবিন্দপাদের সমাধিমন্দির দেখে উল্টো প্রদক্ষিণ পথে হেঁটে চলে যাওয়া যায় সেদিকে ৷ আরেকটাও রাস্তা আছে, বললেন বৃদ্ধ রাজকর্মচারী ৷ এই প্রাসাদের পাশ থেকেই সিঁড়িপথে উঠে যাওয়া যাবে পাহাড়ের ওপরে ৷ তারপর পুবদিকে হেঁটে হুণ্ডিকুণ্ডিদ্বার পার হয়ে দেখে আসা যাবে সেদিকটা ৷

ওঙ্কারেশ্বর প্রদক্ষিণ করার পরিকল্পনা তো ছিল না এবার ৷ এই পুণ্যলাভের মায়া ত্যাগ করব বলেই ঠিক করেছিলাম ৷ কিন্তু কপালের লিখন খণ্ডাবে কে! শেষে পুরো পাহাড়টাই চক্কর দিয়ে আসা হল, অথচ নিয়মমতো পরিক্রমার উল্টোপথে ৷

প্রাসাদ থেকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা যখন শুরু হল, ভরদুপুরে তখন প্রখর রোদ ৷ ভোরের দিকেই আসতে হয় পাহাড়ে ৷ কিন্তু যেহেতু তখন গোটা পাহাড় হাঁটার পরিকল্পনা নেই, তাই কষ্টটুকু গায়ে মাখছিলাম না আমরা ৷ ছাতার আড়ালে হেঁটে চলে গেলাম ওপরে ৷ এপথে প্রথম প্রাচীন স্থাপত্য দেখা দিল ভেঙে যাওয়া সিদ্ধেশ্বর মন্দির ৷ ভেঙে পড়েছে পুরোটাই ৷ এক জায়গায় স্তূপ হয়ে আছে অসংখ্য ভাস্কর্য নিয়ে মন্দিরের দেওয়াল স্তম্ভের টুকরোগুলো ৷ পুরাতত্ব বিভাগ বোর্ডে লিখেছেন-১২ শতাব্দীর পূর্বমুখী পঞ্চরত্ন শৈলীর এই মন্দির সম্ভবত ছিল দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের এক প্রতিরূপ ৷ গতবার দেখা হয়নি এদিকটা ৷ দেখিনি তারপরের আশাপুরী মাতার মন্দির, আর হুণ্ডিকুণ্ডিদ্বারও ৷ কেল্লার এই তোরণ তৈরি হয়েছিল গজনির সুলতান মামুদের আক্রমণের অনেক পরে ৷ ১৩ শতকে ৷ সেখান থেকে এগিয়ে পথ ভাগ হয়েছে দুদিকে ৷ এই জায়গাটা চেনা মনে হচ্ছিল আমাদের ৷ কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না যেতে হবে কোনদিকে ৷ আনমনে হেঁটে আসছিলেন এক বিদেশি পর্যটক ৷ কাছে এসে মাথার একপাশে হাত জোড় করে খুব কায়দার এক নমস্কার জানালেন তিনি-হরি ওম ৷ নিজের দেশের পথের হদিশ জানতে ইচ্ছে করে না বিদেশিদের কাছে ৷ উপায় নেই, জিজ্ঞেস করতে হল ৷ ‘কোন মন্দিরে যাবেন? কোন তোরণদ্বার? রয়েছে তো দুদিকেই!’ নাটকীয় ভাবে দুপাশে হাত মেলে দিলেন তিনি ৷ ‘সবই প্রাচীন ৷ সবই সুন্দর ৷ চলে যান যেদিকে ইচ্ছে! আনন্দ করুন ৷ এত আনন্দের জায়গা!’ যথাসাধ্য খুঁটিয়ে খবর নিয়ে বিদায় জানালাম ভদ্রলোককে ৷ হরি ওম ৷ জয় শঙ্কর ৷

সেখান থেকে সামনে পথ গেছে সিদ্ধনাথ মন্দির হয়ে ভীম-অর্জুনদ্বারের দিকে ৷ যেখান দিয়ে গিয়ে শেষ হয় পরিক্রমা ৷ এক চক্কর ঘুরে এলাম সেদিক থেকে ৷ বিকেল হয়ে আসছে তখন ৷ রোদের তেজ কমে গেছে ৷ ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে বয়ে চলা নীল নদীটাকে ৷ সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে ৷ এমন মনোরম বিকেলে তখনই নেমে যেতে ইচ্ছে করছে না পাহাড় থেকে ৷ আবার ফিরে এলাম আগের পথে ৷ ডানদিকে ঘুরে এবার চললাম চাঁদ-সূরজদ্বারের দিকে ৷ প্রথমে সূর্যদ্বার ৷ বিশাল সেই তোরণের ওপরে উঠে বসেছিলেন প্রফেসর শঙ্কুর মতো দেখতে সেই বিদেশি ভদ্রলোক ৷ আমাদের দেখেই দাঁড়িয়ে উঠে নাটকীয়ভাবে হাত ছড়িয়ে ওপর থেকেই শুরু করলেন বক্তৃতা ৷ বুঝলাম এর পরেই চন্দ্রদ্বার পার হয়ে ইচ্ছে হলে আমরা পাকদণ্ডী পথে সেদিক দিয়ে শর্টকাটে নেমে যেতে পারি নিচে ৷ অথবা উঠে যেতে পারি ওপরে গৌরী সোমনাথ মন্দিরের দিকে ৷ ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই ৷ ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছি কাবেরীর অন্য তীরে জৈনতীর্থ সিদ্ধকূট মন্দির ৷ একটু ঢালু পথে নেমে চন্দ্রদ্বার পেরিয়ে গৌরী সোমনাথ মন্দিরের দিকে উঠে যেতে যেতে বোঝা যাচ্ছে যে পার হয়ে আসছি ওঁ-দ্বীপের ওঁ-এর ঠিক মাঝখানের ভাঁজটা ৷ সীতাদেবীর মন্দির, হনুমান মূর্তির পরে দেখতে পাচ্ছি প্রকাণ্ড গৌরীশঙ্কর মন্দিরের প্রাচীন স্থাপত্য ৷ তার একদিকে সারি দিয়ে রাখা রয়েছে এই অঞ্চলে আবিষ্কৃত অসাধারণ সব মূর্তিকলা ৷ পুরাতত্ব বিভাগের এই সংগ্রহ দেখিনি গতবার ৷ পড়ন্ত বিকেলের আলোয় আরও অসাধারণ দেখাচ্ছে মন্দির চত্বর ৷

ছবি তুলে সময় কেটে গেল সেই প্রাঙ্গণে বেশ কিছুক্ষণ ৷ ভাবছিলাম সিঁড়িপথে সেখান থেকে নেমে যাব নিচে ৷ পাহাড়ের গায়ে এই সিঁড়িটাকে দেখে রেখেছি নিচ থেকে ৷ কিন্তু ঠিক মন্দিরের কাছ থেকেই শুরু হয়নি সেই সিঁড়ি ৷ হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোচ্ছিলাম আমরা ৷ গতবার এপথে এসেছিলাম খুব ভোরবেলা ৷ আলো ফোটার আগেই বেরিয়েছিলাম হোটেল থেকে ৷ নদীর ব্রিজ পার হয়ে যখন রওনা হলাম, নর্মদার ওপরে তখন লাল হয়ে উঠছে ভোরের আকাশ ৷ ব্রিজ থেকে মন্দিরের সামনে বাঁদিকে ঘুরে পরিক্রমার শুরু ৷ এবারে ফিরছি উল্টোপথে ৷ পশ্চিমে নদীতীরে নেমে এসে তারপর শুরু হয় পাহাড়ে চড়া ৷ আলো ফুটলে তবেই নদীচরে পা দিতে বলেছিলেন এক সাধু ৷ উপদেশ দিয়েছিলেন পাথরের ওপর লাঠি ঠুকে ঠুকে সাবধানে এগিয়ে যেতে ৷ কারণ বিষধর সাপ থাকে পাথরের ফাঁকে ৷ লোকচলাচল শুরু না হলে বেশ বিপজ্জনক সে পথে যাওয়া ৷ রাস্তা এত ভালো ছিল না তখন ৷ এখন দেখা যাচ্ছে পুরো পথটাই বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে সুন্দর করে ৷

‘সিঁড়ি দিয়ে নামবেন তো এদিকে আসছেন কেন আপনারা!’ বললেন এক পথচলতি সাধুবাবা ৷ ‘সিঁড়িটা তো ফেলে এলেন পিছনে ৷ তবে এদিক দিয়েও যেতে পারেন ৷ ঢালুপথ নেমে গেছে পুরোটাই ৷ কষ্ট হবে না ৷’

পিছনে আর ফিরলাম না ৷ ভালো লাগছিল দুপাশের গাছের সারির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে ৷ সাধুদের আখড়া আছে এখানে নির্জন পথের পাশে ৷ আর রয়েছে অসংখ্য হনুমান ৷ কাঁধের ব্যাগটাকে টানাটানি করে দু-একবার উপদ্রব করল তারা ৷ এক জায়গায় রাস্তার মধ্যে লেজ বিছিয়ে বসে রইল এক পাল ৷ পথের দুপাশে সার দিয়ে পিছন ফিরে বসে পরপর লম্বা লেজগুলোকে বিছিয়ে তারা জানি না কী রসিকতা করল ৷ এক্কা দোক্কা খেলার মতো, খুব সাবধানে পার হলাম আমরা ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ৷ ঘাড় ঘুরিয়ে সারাক্ষণ লক্ষ রাখল তারা লেজে পা দেওয়া হচ্ছে কিনা ৷ কিন্তু নড়ল না এক চুলও ৷ একটু এদিক ওদিক হলেই বোধহয় দুঃখ ছিল কপালে ৷ মনে হল আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে ৷ পার হয়ে এসে দেখি উঠে ঘোরাঘুরি করছে সবকটা ৷

উল্টোযাত্রা করছি, কথাটা মনে হচ্ছিল বার বার ৷ এদিকে কেউ ফেরে না ৷ নিয়মবিরুদ্ধভাবে হাঁটা হয়ে গেল ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ৷ অনেকক্ষণ থেকেই কোলে ওঠার জন্য চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে সঙ্গের একজন ৷ কোলে চড়ে কেউ ট্রেক করে না, বুঝিয়েও বেশিক্ষণ হাঁটতে রাজি করানো যাচ্ছে না ৷ রীতিমতো হাঁপ ধরে যাচ্ছে বয়ে নিয়ে চলতে ৷ নদীটাকে দেখা যাচ্ছে পাশে পাশে ৷ আশা করছি সামনের বাঁকটা ঘুরেই দেখতে পাব ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের চূড়া ৷ কিন্তু পার হয়ে যাচ্ছে বাঁকের পর বাঁক ৷ গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়েছে রাস্তাটা ৷ ভুলে গেছিলাম যে এতটাই হাঁটতে হবে এদিকে এলে ৷

অন্ধকার নেমে আসছে রাস্তায় ৷ তুলনায় আলো বেশি নদীর ওপরে ৷ সবজে নদীর জল চলার পথে পাথরে ধাক্কা খেয়ে মাঝে মাঝে ছড়িয়ে রেখেছে সাদা ফেনার ঢেউ ৷ শনশন আওয়াজ হচ্ছে ঝুলে পড়া ডালের পাতায় ৷ ধর্মরাজদ্বার পার হয়ে আসার পর থেকে দেখা হয়নি কোনও সাধুর সঙ্গেও ৷ রামকৃষ্ণ আশ্রম ছাড়িয়ে কেদারেশ্বর মন্দিরের কাছে দেখি নিরালা পথের পাশে দাঁড়িয়ে দুই ভক্তকে বাণী দিচ্ছেন একজন ৷ উজ্জ্বল গেরুয়া বসনে অতি চমকদার তাঁর সাজসজ্জা ৷ দাঁড়িয়ে আছেন দৃপ্তভঙ্গিতে এক পা পাথরের ওপর রেখে ৷ আর তাঁর পায়ের কাছে বসে আরও উজ্জ্বল চিত্রবিচিত্র পোশাকে হাসি হাসি মুখে আগ্রহ ভরে তাঁর কথা শুনছেন দুই ভিন দেশি তরুণ-তরুণী ৷ কী এত খুশির বাণী জানার আগ্রহ হচ্ছিল আমাদের ৷ এমন একটা আনন্দময় পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছে যে ক্যামরায় ধরে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছিল ছবিটা ৷ দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম ৷ মনে হচ্ছিল অনুমতিও পাওয়া যাবে, এমনই কোমল সর্বংসহ মেজাজে রয়েছেন তাঁরা ৷ কিন্তু দিনের আলো কমে গিয়েছিল, আর তাঁদের আলোচনায় বাধা দিয়ে পরিবেশটা নষ্ট করতেও ভালো লাগল না ৷ চলে এলাম পার হয়ে ৷ তখনও তাঁরা মগ্ন রয়েছেন নিজেদেরই জগতে ৷ কোন অনুকূল স্রোতে ভাসছেন তাঁরা, বোঝা সহজসাধ্য নয় আমাদের এই সম্পূর্ণ বিপরীত পথপরিক্রমায় ৷

দূরে তখন ওঙ্কারেশ্বরের আলো দেখা যাচ্ছে ৷ ব্রিজ পার হয়ে উঠে এলাম বিষ্ণুপুরীর রাস্তায় ৷ সন্ধের খুশির হাওয়ায় সেখানে রাস্তার পাশে ওপেন এয়ার কচুরি জিলিপির দোকানে টেবিল ঘিরে ঘিরে দেশি বিদেশি নানা দলের হুল্লোড় ৷ হাঁপ ছেড়ে বসা গেল ৷ শীতের দিনেও কুলকুল করে ঘামছি তিনজনেই ৷ এক গ্লাস করে শরবত খেলে মন্দ হয় না ৷ সাধারণ শরবত ৮ টাকা ৷ ভাঙের শরবত ১২ টাকা ৷ নিশ্চয়ই ভুল করে ভাঙ দিয়ে দেবে না নিখরচায়! রাতের খাবারও খেয়ে গেলে হয় এখানে ৷ যেখানেই খাই, নিরামিষই খেতে হবে ৷ আমিষ অচল ওঙ্কারেশ্বরে ৷ এই নিরামিষ ডিনারের পর এক গ্লাস ভাঙের শরবত খেয়ে গাঁজার কলকে হাতে আরামেই আছেন দেখছি অনেকে ৷

‘কোথা থেকে ঘুরে আসা হল, বেটা!’ জিজ্ঞেস করলেন পাশের বেঞ্চে বসা এক সাধুবাবা ৷ বললাম তাঁকে কোথা থেকে ঘুরে এলাম ৷ বেশ খুলেই বললাম দুঃখটা ৷ উল্টোযাত্রার পরিক্রমায় কোনও লাভ হল কি? এত কষ্ট করে শেষে পুণ্যের বদলে, উল্টো কিছু হয়ে গেল না তো!

বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন বাবাজি ৷ চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ ৷ তারপর বললেন, ভগবান শঙ্করজির দেশটা তো দেখা হল ৷ সেটাই পুণ্য ৷

ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০

সকল অধ্যায়

১. অর্ধশতাব্দীর আগের বদ্রীনাথ যাত্রা – প্রতাপকুমার রায়
২. মানস অভয়ারণ্য – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩. জলদাপাড়া অরণ্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৪. জলের ধারে ঘর – নবনীতা দেব সেন
৫. জয়ন্তীর মহাকাল মন্দির – উষা সেন
৬. তাহিতি – হরপ্রসাদ মিত্র
৭. মার্কন্ডেয় গঙ্গার উত্স সন্ধানে – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮. কেদার বদ্রী – মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়
৯. তেহরানি হয়রানি – অমিতাভ চৌধুরি
১০. শোনপুরের মেলায় – বরুণ দত্ত
১১. এলেম নতুন দেশে – কমলা মুখোপাধ্যায়
১২. মস্কো থেকে সাইবেরিয়া হয়ে পিকিং – গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩. পাতাল-ভুবনেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
১৪. ইছামতীর মশা – শঙ্খ ঘোষ
১৫. নিকোবরের দ্বীপে – তিলকরঞ্জন বেরা
১৬. তিরতিরে নদী আর শাল জঙ্গলের দেশে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৭. আমার ভ্রমণ – মহাশ্বেতা দেবী
১৮. সুন্দরবন – হীরক নন্দী
১৯. ওপারবাংলার সুন্দরবনে – সমীর সেনগুপ্ত
২০. সাইকেলে পাঁচ বছরে ভূ-পর্যটন – ভূপর্যটক বিমল দে
২১. আঙ্কোর ভাট – প্রীতি সান্যাল
২২. হিমালয়ের সাতকাহন – ত্রিদিব বসু
২৩. স্বপ্নের পথেই যাওয়া যায় – মহাশ্বেতা দেবী
২৪. ছোট কৈলাস – সুভাষ দত্ত
২৫. বালতাল হয়ে অমরনাথ – প্রতাপকুমার রায়
২৬. মধ্য এশিয়া অভিযান – গৌতম ঘোষ
২৭. পথ হারিয়ে সিকিমের জঙ্গলে – রতনলাল বিশ্বাস
২৮. নতুন করে পাব বলে – বন্দনা সান্যাল
২৯. সেবার ব্রেকজার্নি করে – জয়া মিত্র
৩০. চন্দ্রভাগার উৎস চন্দ্রতাল সুর্যতাল – সুনীলকুমার সরদার
৩১. ওঙ্কারেশ্বর – বিশ্বদীপ দত্ত
৩২. সুন্দরবনে দুদিন – পবিত্র সরকার
৩৩. মণিমহেশ – কমলা মুখোপাধ্যায়
৩৪. দিকবিদিকে – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৩৫. তিস্তানদীর উৎসে – শরৎ ঘোষ
৩৬. পশ্চিমে হাওয়াবদল – মধুপর্ণা দত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৭. এক টুকরো নীল চাঁদ – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৩৮. কালিম্পং থেকে তিব্বত – অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
৩৯. সাইলেন্ট ভ্যালি – শিবনাথ বসু
৪০. মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বিলেত যাত্রা এবং আমি – নবনীতা দেব সেন
৪১. বক্সা বাঘ-প্রকল্প – বুদ্ধদেব গুহ
৪২. গানতোক থেকে ইয়ুমথাং – সুতপা ভট্টাচার্য
৪৩. ক্যামেরুন, আগ্নেয়গিরি ও গভীর জঙ্গলের খুদে মানুষেরা – প্রীতি সান্যাল
৪৪. ডুয়ার্সের দুয়ার এখন খোলা – সমরেশ মজুমদার
৪৫. ইউরোপে দিন কয়েক – পূর্ণেন্দু পত্রী
৪৬. রামচন্দ্রের বনবাসের পথ পরিক্রমা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৪৭. আসমুদ্রককেশাস – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
৪৮. নিরলংকার ভ্রমণ – শঙ্খ ঘোষ
৪৯. চেঙ্গিস খানের দেশে – প্রতাপকুমার রায়
৫০. মিজোরামের নীল পাহাড়ে – দীপঙ্কর ঘোষ
৫১. সিন্ধুদুর্গ – বিশ্বদীপ দত্ত
৫২. জিম করবেটের জঙ্গলে – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৩. থর মরুভূমিতে ট্রেকিং – শিবনাথ বসু
৫৪. মরোক্কো ভ্রমণ – হরপ্রসাদ মিত্র
৫৫. ভাগীরথী, রূপনারায়ণ, নোবেল প্রাইজ – নবনীতা দেব সেন
৫৬. গন্তব্য মাচুপিচু – প্রতাপকুমার রায়
৫৭. কই যাইত্যাছি জানি না – শঙ্খ ঘোষ
৫৮. পারাংলা অভিযান – সুনীলকুমার সরদার
৫৯. পুশকিন, মলদভা আর কচি পাতার বাঁশিতে মোত্সার্ট – প্রীতি সান্যাল
৬০. আমাদের ছোট নদী : পার্বতী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
৬১. দেবলোকের পথে পথে – অশোক চক্রবর্তী
৬২. না-ভ্রমণের বৃত্তান্ত – আশাপূর্ণা দেবী
৬৩. এভারেস্টের পাদদেশে যাত্রা – কমলা মুখোপাধ্যায়
৬৪. নীল নদে পাঁচদিন – হরপ্রসাদ মিত্র
৬৫. বারাণসীর ঘাটের কথা – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৬. বালফাক্রমের পাহাড়-জঙ্গলে – সুমিত মুখোপাধ্যায়
৬৭. গৌরীগঙ্গার উৎসব মিলাম হিমবাহ – পুরুষোত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৮. মরুভূমির দিনরাত্রি – পবিত্র সরকার
৬৯. ঢাকা : একুশ বছর পর – অন্নদাশঙ্কর রায়
৭০. ফোকসোমদো হ্রদ – ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
৭১. ইন্টারলাকেন থেকে ইয়ুংফ্রাউ – মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
৭২. কালিন্দী গিরিবর্ত্ম – রথীন চক্রবর্তী
৭৩. একযাত্রায় ভোরামদেরও আর কানহা – হীরক নন্দী
৭৪. মদমহেশ্বরের ডোলিযাত্রা – কাজল দত্ত
৭৫. কেনিয়ায় পাঁচ অরণ্য – প্রতাপকুমার রায়
৭৬. কোনাডা থেকে রেভুপাল ভরম – রতনলাল বিশ্বাস
৭৭. চাঁদের দেশ লাদাখ – কমলেশ কামিলা
৭৮. বোকের তোভ, ইজরায়েল – নবনীতা দেব সেন
৭৯. বিষ্ণুপুর মুকুটমণিপুর – হরপ্রসাদ মিত্র
৮০. ডোকরিয়ানি বামক – অনিন্দ্য মজুমদার
৮১. তাওয়াং থেকে তাসি-চু জং – কমলা মুখোপাধ্যায়
৮২. মেক্সিকো শহরের একটি দিন – প্রীতি সান্যাল
৮৩. আকাশচূড়ায় অভিযান – অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়
৮৪. ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট – শঙ্খ ঘোষ
৮৫. সারেঙ্গেটির জঙ্গলে – হরপ্রসাদ মিত্র
৮৬. এবারের কুম্ভমেলায় – চিন্ময় চক্রবর্তী
৮৭. অন্য পথের পথিক – বুদ্ধদেব গুহ
৮৮. গরুমারা জঙ্গলে – টুটুল রায়
৮৯. নিশীথ সূর্যের দেশ – প্রতাপকুমার রায়
৯০. সবুজ নামদাফাতে – সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়
৯১. পঞ্চকেদার – শিবনাথ বসু
৯২. গোঁসাইকুণ্ড – কমলা মুখোপাধ্যায়
৯৩. অমরকন্টক – হীরক নন্দী
৯৪. আদিম ডুয়ার্সের আধুনিক রূপকথা – সূর্য ঘোষ
৯৫. পার্বতী উপত্যকায় সার পাস – বিদ্যুৎ দে
৯৬. মিয়ানমার, ইরাবতীর সঙ্গে – পবিত্র সরকার
৯৭. রূপসী রিশপ – হীরক নন্দী
৯৮. হিমবাহের জন্মভূমিতে – শেখর ভট্টাচার্য
৯৯. ভাবা জোত পেরিয়ে কিন্নর থেকে স্পিতি – অনিন্দ্য মজুমদার
১০০. ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত – হরপ্রসাদ মিত্র
১০১. বক্সা দুর্গ – টুটুল রায়
১০২. সিন্ধু নদের ধারে – রতনলাল বিশ্বাস
১০৩. মেঘালয়ের দাউকি – সুমিত মুখোপাধ্যায়
১০৪. আমাদের ছোট নদী : লিডার – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১০৫. লাসা – সমীর রায়
১০৬. ২ নম্বর লোভালোয়া স্ট্রিট – অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
১০৭. অযোধ্যা পাহাড় – বিশ্বদীপ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন