অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
কাশীতে এলে প্রথমেই মনকে আপ্লুত করে মানুষের মিছিল ৷ সারা ভারতবর্ষ এসে যেন মিলেছে কাশীর ঘাটে ৷ প্রতিটি ঘাটেই বসেছে মানুষের মহোৎসব ৷ কোথাও চলছে কুস্তির কসরত, কোথাও নির্ভেজাল আড্ডা, কোথাও চলছে পুজোপাট, কোথাও ক্রিকেট চর্চা, আবার কোথাও দেহাতী বউটি তোলা উনুনে ভেজে চলেছে পুরি কচুরি ৷ হাজার হাজার নৌকা-কোনওটা বাঁধা আছে ঘাটের কাছে, কোনওটা যাত্রী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷ এ তো গেল ভোরের কথা ৷ সন্ধেয় যখন দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গামাঈর আরতি হয় তখন তার আরেক চেহারা ৷ এই উৎসবের যে কী আকর্ষণ তা একবার যে কাশী এসেছে সেই বুঝেছে ৷ তাই তো ইতিহাসের চাইতেও পুরনো শহরটাতে লোক ফিরে ফিরে আসে ৷
হাওড়া থেকে অমৃতসর মেল, দুন এক্সপ্রেস, হিমগিরি, জম্মু-তাওয়াই, পূর্বা বা অমৃতসর এক্সপ্রেসের যে-কোনও একটায় চেপে কমবেশি ১৫ ঘণ্টা পরেই বারাণসী ৷ স্টেশন থেকে বেরিয়েই অটো নিয়ে সটান চলে আসুন দশাশ্বমেধে ৷ আজকাল একমুখি ট্রাফিকের ফলে কিছু বিধিনিষেধ পড়েছে ৷ তাই সেটা একটু খোঁজখবর নিয়ে নেবেন ৷ সেরকম বুঝলে রিকশা করে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে চলে আসাই ভালো ৷ গোধুলিয়ার কাছেও থাকতে পারেন ৷ আজকাল অনেক নতুন নতুন হোটেল হয়েছে ৷ ঝাঁ চকচকে এয়ার কন্ডিশনড রেস্তোরাঁ সহ ৷ কিন্তু বারাণসীর প্রাণস্পন্দন পেতে হলে থাকতে হবে গঙ্গার ঘাটের কাছে ৷ এখান থেকে বাবা বিশ্বনাথ দর্শনও সহজ হবে ৷
এ তল্লাটে প্রচুর হোটেল ও ধর্মশালা রয়েছে ৷ সবই সাধারণ মানের ৷ থাকার পক্ষে বেশ ভালো জায়গা দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউস ৷ বহু পুরনো এই বোর্ডিং হাউসটিই একসময় ছিল কাশীতে থাকার একমাত্র ভালো জায়গা ৷ এখন অবশ্য সেই রমরমা নেই ৷ তবে স্থান নির্বাচনের দিক দিয়ে এর তুলনা হয় না ৷ দু কদম এগোলে গঙ্গা আর দু কদম পিছোলে বিশ্বনাথের মন্দির-এত সুন্দর থাকবার জায়গা আর হয় নাকি? টানা বারান্দায় বসে কিংবা দাঁড়িয়ে পুরো কাশী দর্শন হয়ে যাবে ৷ দিবারাত্র স্রোতের মতো পিল পিল করে মানুষ চলেছে কখনও গঙ্গা অভিমুখে আবার কখনও গঙ্গাস্নান অন্তে বিশ্বনাথ দর্শনে ৷ সামনের চায়ের দোকানটি খোলা থাকে সারারাত ৷ আর কী আশ্চর্য! সারারাত ধরে লোকে চা জলখাবার খায় ৷ এই বড় বড় সিঙ্গারা, কচুরি, আর চাট ৷
মালপত্র রেখে থিতু হয়ে প্রথমেই চলুন বিশ্বনাথ দর্শনে ৷ সাইকেলরিকশা, চলমান মানুষ আর উদাসীন ষাঁড়ের পাশ কাটাতে কাটাতেই বিশ্বনাথের গলি ৷ ঘুরপাক খেতে খেতে দুধারের দোকানপাট দেখতে দেখতে শুধুই এগিয়ে চলা ৷ দোকানের বৈচিত্র্য তো রীতিমতো চমকপ্রদ -এই রাবড়ি মেঠাই-যেখানে সারাক্ষণ বিশাল এক কড়াইতে দুধ জ্বাল দিচ্ছে একজন ৷ ভেতর দিকে অষ্টপ্রহরই তৈরি হচ্ছে পেঁড়া আর রাবড়ি ৷ রঙিন সব মিষ্টি-সবুজ বরফি, কমলা পেঁড়া-অক্লেশে গলাধঃকরণ করে ফেলছে নির্বিকার ভক্ত দল ৷ পাশেই চুড়ি, টিপের পসরা, তার পরই শাড়ি, ওদিকে আবার ধাতুমূর্তি, পাথরের বাসন ইত্যাদি ৷ এদিকে মশলার পাহাড় ৷ বেনারসী মশলার কদর তো বিশ্ব জোড়া ৷ খেলনা, পুতুল, নৌকা সবই আছে ৷ চলতে চলতে লক্ষ রাখুন অন্নপূর্ণা মন্দির পেরিয়ে গেল না তো! গলির গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে গেলেও ভয় নেই ৷ ঘুরে ফিরে সেই একই দিকে এসে পড়বেন ৷
বিশ্বনাথের মন্দির আসবার একটু আগে থেকেই শুরু হবে ফুল বেলপাতার প্রসাদী দোকান ৷ তার একটাতে জুতো জোড়া গচ্ছিত রেখে অন্দরে প্রবেশ করুন ৷ দর্শনাদি সেরে নিন নিজের মনোমতো করে ৷ পাণ্ডার প্রকোপ আজকাল নেইই ৷ তবে ভিড়ের সময়ে দর্শনের সময় সংক্ষেপ হয়ে যায় ৷ প্রতিদিন রাত নটার সময় ভারি সুন্দর আরতি হয়, অবশ্যই দেখবেন ৷ এই সময় বিশ্বনাথকে রাজবেশ পরানো হয়, রুপোর সিংহাসনে রুপোর ছত্রীতে তাঁকে অধিষ্ঠিত করা হয় ৷ ৩-৪ জন পুরোহিতের সম্মিলিত বৈদিক মন্ত্রপাঠের আওয়াজে পুরো পরিবেশটাই তখন বদলে যায় ৷ সর্বক্ষণের কলরোল মুখরিত চত্বরে তখন নৈঃশব্দ ৷ আরতির সমাপনে রাজবেশ পরিহিত দেবাদিদেব রুপোর খাটে শয়নে যান ৷ আবার ভোর না হতেই শুরু হয়ে যায় তাঁর আরাধনা ৷
দ্বিপ্রাহরিক আহার সারতে পারেন বোর্ডিং হাউসেই ৷ ছিমছাম বাঙালি আহার ৷ শুক্তো থেকে চাটনি পর্যন্ত পঞ্চব্যঞ্জন সাজানো ৷ এখানে না থাকলেও অনেকে এখানে খেতে আসেন, এমনই বিখ্যাত এখানকার স্পেশ্যাল ভোজ ৷ মাত্র ৩৫ টাকায় দুরকমের মাছ, তরকারি, ডাল, চাটনি, দই কলকাতা শহরেও আজকাল দুর্মূল্য ৷ বড়ই যত্ন করে হাউসের কর্মচারীরা পরিবেশন করেন ৷
ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম সেরে সিধে গঙ্গার ঘাটে চলে আসুন ৷ রোদের তাপ কমে যেতেই দলে দলে লোক নৌকা করে বেরিয়ে পড়েছে হাওয়া খেতে ৷ দশাশ্বমেধ ঘাটের ওপর রঙিন ছাতার তলায় লাখো মানুষ ৷ এই ছাতাগুলো বেনারসের বিশেষত্ব ৷ আপনিও নৌকাবিহার করতে পারেন ৷ ঘাটে তো নৌকা বাঁধাই আছে অষ্টপ্রহর ৷ উঠে পড়লেই হল ৷
গঙ্গাবক্ষ থেকে ঘাটের বিরাট বিরাট ইমারতগুলোকে দারুণ সুন্দর লাগে দেখতে ৷ মৃদুমন্দ হাওয়ার দোলায় নৌকা থেকে থেকে দুলে ওঠে ৷ অমাবস্যা বা পূর্ণিমার সময় অবশ্য ধাক্কাটা জোরেই লাগে ৷ মাঝির লাগাতার ধারাবিবরণীর সঙ্গে সঙ্গে অনাবৃত হয় অনেক না জানা তথ্য ৷ গঙ্গার এক পাড় ঘেঁসে যতদূর দৃষ্টি যায় বাঁধানো ঘাটের সারি ৷ মোট ঘাটের সংখ্যা নাকি ৪৫০ ৷ তবে বাঁদিকে অসি ঘাট থেকে ডাইনে বরুণা ঘাট পর্যন্ত যে গোটা তিরিশেক ঘাট আছে কৌলীন্যে ও বংশমর্যাদায় তারাই অগ্রগণ্য ৷
দশাশ্বমেধ থেকে যাত্রা শুরু করে সামনেই রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাট ৷ দশাশ্বমেধ ঘাটই সব থেকে প্রাচীন ৷ এই ঘাটে স্নান করলে নাকি দশ অশ্বমেধ যজ্ঞের পুণ্য হয় ৷ তাই এই পড়ন্ত বিকেলেও স্নানার্থীর অভাব নেই ৷ রীতিমতো তৈলমর্দন করে স্নানকর্ম চলছে ৷ রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাটে একটি ঝুলন্ত অলিন্দ আছে ৷ ফুরফুরে হাওয়া খাবার দিব্যি জায়গা ৷ বারাণসীর প্রতিটি ঘাটই কোনও না কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির নামে ৷ ঘাটের ওপর তাদেরই তৈরি বাড়ি ৷ প্রতিটির নকশা আলাদা, প্রতিটিতেই রয়েছে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ ৷ মুন্সীঘাট যদি হয় ছিমছাম তো সিন্ধিয়া ঘাটে রাজকীয় বৈভবের পরিচয় ৷ আজকাল অনেক ঘাটেই তৈরি হয়েছে বিলাসবহুল হোটেল-বিত্তবান ও বিদেশিদের ভিড়ই তাতে বেশি ৷ দ্বারভাঙা ঘাটের ওপর যে প্রাসাদোপম বাড়িটিতে এতকাল ঢুকে পড়া যেত স্বচ্ছন্দে আজ সেখানে চলছে পাঁচতারা হোটেল বানানোর কাজ ৷
মণিকর্ণিকা ঘাটে রয়েছে মহাশ্মশান ৷ কখনও নেভে না চিতার আগুন ৷ মাঝি শোনায় শিব পার্বতী একদিন ঘুরছিলেন এখানে ৷ অসাবধানে পার্বতীর কানের মণি পড়ে যায় ৷ বহু সন্ধানেও তা পাওয়া যায় না ৷ ব্যথিতা পার্বতীকে শিব সান্ত্বনা দেন এই বলে যে তার মণি পড়েছে বলেই এই স্থান অতি পবিত্র হয়ে থাকবে এবং এখানে মৃতদেহ দাহ করা হলে তাঁরা সশরীরে স্বর্গধামে যাবে ৷ সেই থেকে ঘাটের নাম মণিকর্ণিকা ৷ এখানে শিবপার্বতীর মন্দিরও রয়েছে ৷ নৌকা বোঝাই করে কাঠ আসে ৷ সেই কাঠ সাজিয়ে তাতেই দাহ করা হয় মৃতদেহ ৷ আগুন জ্বলতেই থাকে ৷
পঞ্চগঙ্গা ঘাটে পঞ্চ নদীর জল এসে মিশেছে ৷ গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, দুর্গা, তৃণা ৷ কীভাবে সেটা অবশ্য তর্কের বিষয় ৷ তবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ৷ লম্বা সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেলেই প্রশস্ত চাতাল ৷ কার্তিক মাসে এখানেই বসে আকাশ প্রদীপের মেলা ৷ লম্বা বাঁশের ডগায় ঝুড়ির মধ্যে ঝুলতে থাকা আলোগুলো এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের অবতারণা করে ৷
সিন্ধিয়া ঘাটের একটু পরেই এক অদ্ভুত মন্দির নজরে পড়ে ৷ ছাদটি একদিকে হেলে পড়ে জল ছুঁই ছুঁই করে ৷ দুরন্ত বাচ্চাদের ডাইভ মারার আদর্শ জায়গা ৷ এক ব্রাহ্মণ সন্তান তার মায়ের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে গড়েছিলেন এই মন্দিরটি ৷ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকালে তিনি জলে তর্পণ করে তার মায়ের উদ্দেশে বলেন ‘মা, তোমার ঋণ শোধ করলাম’ ৷ বলামাত্র মন্দির একদিকে হেলে পড়ে, দৈববাণী হয় ‘মাতৃঋণ শোধ করা যায় না’ ৷
সন্ধে হতে না হতেই সব ভিড় আবার দশাশ্বমেধ ঘাট অভিমুখে ৷ প্রতিটি নৌকা থেকেই প্রদীপ ভাসানো হয় ৷ জলের ওপর প্রদীপ শিখাগুলি নাচতে নাচতে হারিয়ে যায় অন্ধকারে ৷
দশাশ্বমেধ ঘাটের সাজানো মঞ্চে আলো জ্বলে ওঠে ৷ মাইকে বাজে গঙ্গা আরতির গান ৷ পূজারী মহারাজ পেতলের বিশাল পঞ্চপ্রদীপ ঘুরিয়ে গঙ্গামায়ের উদ্দেশে আরতি করেন ৷ অনেকটা হরিদ্বারের গঙ্গা আরতির অনুকরণে ৷ কানে ভেসে আসে সুরেলা স্তোত্রপাঠ আর গুরুগম্ভীর শঙ্খধ্বনি ৷ পরিবেশের নিরিখেই অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে চিরস্মরণীয় ৷
নৌকাবিহারে ক্ষান্তি দিয়ে উঠে এলাম ঘাটে ৷ আলো ঝলমলে শীতলা মায়ের মন্দিরে জোরকদমে আরতি চলছে ৷ গঙ্গা আরতি শেষ হলে তবেই এখানে আরতি শুরু হয় ৷ বর্ষাকালে শীতলা মায়ের বড়ই করুণ দশা হয় ৷ মন্দির তখন জলে আধডোবা ৷ ভক্ত সমাগমে অবশ্য ঘাটতি পড়ে না তখনও ৷
প্রয়াগ ঘাট থেকে একটু ওপরে বেনারসী ঘাটের বড় দোকানটাতে অবশ্যই ঢুকবেন ৷ আলু টিকিয়ার স্বাদ যেন এখনও মুখে লেগে আছে ৷ বেনারসের পানমশলার মতো চাটও বিখ্যাত ৷ বিশেষত দহি ফুচকা ও টিকিয়া চানা ৷ তবে আগে দশাশ্বমেধের দুপাশে যেভাবে লাইন দিয়ে ফুচকার দোকান বসত তার সংখ্যা এখন অনেক কম ৷
বেনারসের বাঙালিটোলার গলি ছিল সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় জায়গা ৷ কেদারঘাটের ঠিক পিছন দিয়ে খানিক এগোলেই সেই বিখ্যাত গলিতে ঢুকে পড়া যায় ৷ গলির দুপাশে পুরনো দিনের একহারা বাড়ি, কোনওরকম জানলা দরজার চিহ্ন দেখি না, শুধুমাত্র ঘুলঘুলির ফোকর টুকু ছাড়া ৷ রাস্তা এত সরু যে দুজন মানুষ পাশাপাশি চলতে গেলেই ঠোকাঠুকি লেগে যায় ৷ তার ওপর গলি তো ঘুরপাক খেয়েই যাচ্ছে ৷ বাঙালিটোলার মুখটায় আছে মধুর দোকান ৷ এখানকার রাবড়ি আর পেঁড়ার স্বাদই আলাদা ৷
নৈশাহার সেরে দু-চার পাক চক্কর মেরে নিন রাস্তায় ৷ এ শহর দিব্যি জেগে থাকে রাতভর ৷ ভয়ের কোনও কারণ নেই ৷ চুরি-ডাকাতি বিশেষ হয় না ৷ বেরতে না চাইলে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসুন ৷ রাত বারোটাতেও সামনের চা-নাস্তার দোকানে ভিড় উপচে পড়ে ৷ এরা সব দোকানি ৷ হিসেবপত্র সেরে বাড়ি যাবার পথে চা-কচৌরি খেয়ে নেয় ৷ ১টার দিকে আসে কুলি, ঠেলাওলার দল ৷ চা-কচৌরির নৈশাহার সেরে তারা রাস্তাতেই গামছা মাথায় শুয়ে পড়ে ৷ রাত দুটো থেকে শুরু হয় সাধু মহারাজদের গঙ্গাস্নান ৷ নিস্তব্ধ রাস্তায় খড়মের খটাখট আওয়াজ তুলে তাঁরা স্নানে যান ৷ কপালে ফোঁটাতিলক কেটে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে চা জল খেয়ে এবার তাঁরা যান বিশ্বনাথ দর্শনে ৷ তারপর বয়স্কা মহিলারা যান পুঁটলি বগলে ৷ এঁদের অবশ্য ফিরতে খানিক সময় লাগে ৷ রাত তিনটে-সাড়ে তিনটের পর থেকে জনসমাগম ক্রমশ বাড়তে থাকে ৷ চায়ের দোকানের শিফটও পরিবর্তন হয় ৷
বারাণসীর ভোরটা অসাধারণ ৷ সূর্য ওঠার অনেক আগে থেকেই ঘাটে ঘাটে লোক পুজোপাঠ, স্নানাদি সারতে থাকে ৷ তারপর যখন প্রথম সূর্যের আলো এসে পড়ে গঙ্গার স্থির জলে, নরম আলোয় ভরে যায় চারধার, মাইকে বাজে সূর্যমন্ত্র, দলে দলে মানুষ ‘ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং…’ বলে সূর্যদেবকে করজোড়ে নমস্কার জানান, তখন সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য ৷ সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এসে ভিড় করে বেনারসের ঘাটে ৷
অহল্যাবাঈ ঘাটের চাতালে বসে রোজ সকালে এক প্রৌঢ় ব্যক্তি মহাদেবকে আহ্বান জানান ৷ নাগপুর স্টেটের মুন্সীঘাট পেরলেই ব্রিজ রামা প্যালেসের বিশাল হোর্ডিং ৷ আদিতে এটি ছিল দ্বারভাঙার রাজবাড়ি ৷ অনেক ঐতিহাসিক বাড়িঘর ভেঙে পড়লেও এই রাজবাড়িটির নির্মাণশৈলী এখনও নজরকাড়া ৷ নতুন করে সংস্কারের কাজ করায় প্রাসাদটি ঝকঝক করছে ৷
চৌষটঘাটের নবদুর্গা মন্দির দর্শন সেরে দিগপতিয়া ঘাটে আসুন ৷ এখানে সীতারামদাস ওঙ্কারদাস স্বামীর আশ্রম আছে ৷ পাশেই ধোবি ঘাটে দমাদম কাপড়ে আছাড় দিচ্ছে ধোবিরা ৷ প্রচুর মহিলা ধোবিও দেখবেন ৷
পেশোওয়াদের তৈরি রাজঘাটের পরের ঘাটটির কাহিনী বড় মজার ৷ এই ঘাটটির নাম নারদ ঘাট ৷ স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে এখানে স্নান করলে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ অবশ্যম্ভাবী ৷ ভয়ে কোনও স্বামী-স্ত্রী জোড়ে নামে না ৷ মানসরোবর ঘাটে প্রদীপকুমারের বাড়ি পেরিয়ে আসুন কামেশ্বর শিবমন্দিরে ৷ রানি রাসমণির ঘাট দেখে চলে আসুন কেদারঘাটে ৷ কেদারেশ্বর শিবমন্দিরের চাতালে কমণ্ডলু হাতে কৌপীন পরা সাধু দেখবেন অনেক ৷ হরিশচন্দ্র ঘাটেও জ্বলে চিতার আগুন ৷ তবে স্থানমাহাত্ম্যে ওপরে বলে মণিকর্ণিকা ঘাটেই দাহকার্য সম্পন্ন হয় বেশি ৷ হরিশচন্দ্র ঘাটে ভিড় কম হয় ৷ একদিকে চলমান জীবনের অবিরাম ধারা, অন্যদিকে নশ্বর জীবনের সমাপ্তি অনুষ্ঠান-জীবনের নিত্যঅনিত্যকে পাশাপাশি পাওয়া-এটাই বোধহয় বারাণসীর চরম উপলব্ধি ৷
একদিন অটো নিয়ে চলুন ব্যাসকাশী বা রামনগর, গঙ্গার পাড়েই বিশাল রাজবাড়ি ৷ কাশীর রাজাদের বসবাস ছিল এখানেই ৷ আপাতত খুব সুন্দর একটি যাদুঘর তৈরি হয়েছে রাজবাড়ির একাংশে ৷ যানবাহন থেকে শুরু করে অস্ত্রশস্ত্র, মূল্যবান আসবাবপত্র, অলংকার, জামাকাপড়-রীতিমতো তাক লাগানো সংগ্রহ ৷ হাতির দাঁতের একটা মাদুর আছে দেখবার মতো ৷
অটো করে কিংবা গাড়ি করে দেখে নিন বারাণসীর অন্যান্য দ্রষ্টব্য ৷ সঙ্গে উপরি হিসাবে সারনাথ ৷ বৌদ্ধধর্মের প্রথম প্রচার এখানেই হয়েছিল ৷ সেই স্মৃতিতে পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন রাজা মহারাজরা এখানে বৌদ্ধ স্তূপ ও সঙ্ঘ গড়ে তুলেছিলেন ৷
সঙ্কটমোচন মন্দির দেখুন সাবধানে, কারণ হনুমানের উপদ্রব ৷ তুলসীমানস মন্দিরে তুলসীদাস বিরচিত রামচরিতের গল্পকাহিনী বিভিন্নরকম চিত্রকল্পের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ৷ লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির, জনার্দন মন্দির-বারাণসীতে মন্দিরের ছড়াছড়ি ৷ সব থেকে ভালো লাগে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি চত্বরে বিড়লাদের মন্দির ৷ পরিচ্ছন্ন, নিস্তব্ধ মন্দির, নিমেষেই এনে দেয় শান্তির প্রলেপ ৷
বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির অন্দরমহলও রীতিমতো চিত্তাকর্ষক ৷ একদা মদনমোহন মালব্য প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান ৷
একদিন বেরিয়ে পড়ুন বেনারসী দেখতে ৷ কিন্তু ভুলেও পা দেবেন না বিশ্বনাথের গলিতে ৷ এখানে সবাই গলাকাটা দাম চাইবে ৷ আপনি বরং পিছন দিকে চকবাজার এলাকায় আসুন ৷ এড়িয়ে চলুন রিকশাওলা, ঠেলাওলার সুন্দর শাড়ি দেখানোর আহ্বান ৷ এদের বাঁধা দোকান আছে যেখান থেকে এরা কমিশন পায় ৷
বারাণসীতে কোনও সিল্ক তৈরি হয় না ৷ আসাম, ব্যাঙ্গালোর থেকে সিল্ক আমদানি করে তার ওপরে কাজ করা হয় ৷ মদনপুরা আর মুবারকপুর বা মুবারকগঞ্জ এই দুজায়গাতেই শাড়ি তৈরি হয় ৷ মদনপুরার শাড়ির মান অনেক ভালো, রং পাকা, কাজ সুন্দর, মোবারকপুরের শাড়ির মান তত ভালো নয়, কাজ কিংবা রঙের তফাৎ প্রথম নজরে আসে না ৷ বেনারসীর হাটে মুবারকগঞ্জই বিকোয় বেশি ৷ এতে মালিকের লাভ বেশি ৷ খোদ কলকাতাতেই নাকি বেশিরভাগ দোকানেই মুবারকি শাড়ি বিক্রি হয় ৷ রিকশা নিয়ে একদিন মদনপুরায় চলে আসুন ৷ একটার পর একটা শাড়ির দোকান, যে কোনওটায় ঢুকে নয়ন সার্থক করতে পারেন ৷ হাজার কয়েক শাড়ির দোকানের মধ্যে একটি দোকান তার সাইনবোর্ডের কারণেই নজরে পড়েছিল ৷ বাংলায় লেখা মেট্রো স্টোরস ৷ বেনারসে একমাত্র বাঙালি শাড়ির দোকান ৷ বাঙালি দেখে বাঙালি দোকানদার উৎসাহের সঙ্গে শাড়ি দেখিয়েছিল ৷ তারা সাতপুরুষ বেনারসে থাকেন ৷ অথচ বাংলা ভোলেননি ৷ বাড়িতে অন্নপূর্ণা, দুর্গার পুজো হয় ৷ দোকানের পিছনের গলিতেই তাদের কারখানা ৷ সরু, নোংরা গলি দিয়ে ঢুকলাম স্যাঁতসেঁতে ভিজে একটা ঘরে ৷ টিমটিমে আলোয় তাঁতে বসে শাড়িতে জরির ফুল ফুটিয়ে তুলছে এক কিশোর ৷ খানদানি ব্যবসা ৷ বেনারসী তাঁতের সিংহভাগ তাঁতিই মুসলিম ৷ সব পরিবারের কিশোরই স্কুল ছুটির পরে তাঁতে বসে কাজ শেখে ৷ জানে ভবিষ্যতে এটাই হবে তার জীবিকা ৷ গোল গোল করে পিচবোর্ডের ওপর সব নকশার গ্রাফ আঁকা ৷ কী অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তা শাড়িতে বসায় এরা না দেখলে বিশ্বাস হয় না ৷ একটা দামি শাড়ি করতে প্রায় ২৫-৩০ দিন সময় লাগে ৷ প্রত্যেকের চোখেই পুরু মোটা চশমা ৷ কম আলোয় চোখ লাগিয়ে কাজ করার কুফল বোঝা গেল ৷
বেনারসের আরেকটি বিখ্যাত দ্রব্য হল এখানকার জর্দা মশলা ৷ দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউস ছাড়িয়ে একটু এগোলেই অনিলের বিখ্যাত জর্দা ৷ মশলার গন্ধে নেশা ধরায় ৷ কৌটোয় কৌটোয় রকমারি এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ ইত্যাদি হাজারো জিনিস ৷ সবই মুখরোচক, দরদাম না করেই কিনে ফেলুন ৷ ঠকবেন না ৷
আর বেনারসের পুজোও খুবই বিখ্যাত ৷ অনেক বাঙালিই এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন ৷ পুজো এলে তা বোঝা যায় ৷ এই সময় কটাদিন বাঙালি উৎসবে মেতে ওঠে ৷ গঙ্গার ঘাটে বসে নৌকা করে ঠাকুর ভাসানোর দৃশ্য আজও চোখে লেগে আছে ৷
এই প্রাচীন শহরের জনাকর্ষণী ক্ষমতা এতই বেশি যে বেনারসে সব সময়ই ভরা সিজন ৷ তবে হোটেল-রেস্তোরাঁর সংখ্যাও অনেক বলে অসুবিধে হয় না ৷ ৩-৪ দিন গঙ্গার ঘাটে দুবেলা ঘুরে বেড়িয়ে, বিশ্বনাথের মন্দির দর্শন করে, রাবড়ি, মালাই, চাট খেয়ে কোথা দিয়ে কেটে যায় টেরও পাওয়া যায় না ৷ হাতে কদিন বেশি সময় থাকলে অনেকে ঘুরে নেন চুনার, এলাহাবাদ ৷ এছাড়াও যাওয়া যেতে পারে ১০০ কিলোমিটার দূরে রাজদেউরিতে ৷ চন্দ্রপ্রভা নদীর ওপরে এক বিশাল বাঁধ তৈরি হয়েছে চন্দ্রপ্রভা ড্যাম ৷ ভারি চমৎকার পরিবেশ ৷ এছাড়া দেওদারি জলপ্রপাতটি এ পথের অন্যতম আকর্ষণ ৷ ১২৫ কিলোমিটার দূরের উইনডাম ড্যামটিও চমৎকার ৷ মীর্জাপুর জেলার এই অঞ্চলটি দ্রুত একটি পিকনিক স্পটে পরিণত হয়েছে এখানকার সৌন্দর্যের জন্য ৷ ঘুরে নেওয়া যায় কাছের সিরসি ৷ মারুতিভ্যান ভাড়া করে সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়া ৷ ১০০০-১২০০ টাকা পড়বে ৷ সঙ্গে নিয়ে নিন প্যাকড লাঞ্চ ৷
ভ্রমণ অক্টোবর, ২০০০
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন