অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
জিম করবেট-এর ‘জাঙ্গল লোর’-এ একটি ঘটনার কথা উনি খুব রসিকতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন ৷ ওঁদের নৈনিতালের বাড়ি থেকে এক অতিথি নবাগন্তুককে সঙ্গে নিয়ে উনি কালাধুঙ্গিতে নেমে আসছিলেন ৷ বেরিয়েছিলেন অন্ধকার থাকতে ৷ যদিও পথের পুরোটাই প্রায় উতরাই-এ, তবু অনেকখানি পথ ৷ তখনকার দিনে পথ পিচবাঁধানো ছিল না এবং স্বাভাবিক কারণেই দুর্গমও ছিল ৷ কিন্তু পথপাশের যা সৌন্দর্য-কুমায়ুন হিমালয়ে-উঁচু পাহাড় থেকে নিচের গহন বনবেষ্টিত উপত্যকাতে নেমে আসার সময়ে গাছপালা, অর্কিড, ফুল, লতা, পাখপাখালি এবং প্রভাতী বন্যপ্রাণীর যে বৈচিত্র চোখে পড়ে তা যাঁর চোখ বা কান আছে শুধু তাঁরই জন্যে ৷ শুধু তাঁরই জন্যে ৷
চোখ-কান সকলেরই থাকে একজোড়া করে, গর্দভপ্রবর থেকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও ৷ কিন্তু আবার থাকেও না ৷
সেই কারণেই গলদঘর্ম হয়ে যখন কালাধুঙ্গিতে ওঁরা দুজনে এসে পৌঁছলেন, করবেটসাহেব ভদ্রলোককে (উনি ইচ্ছে করেই অর্বাচীনের নামোল্লেখ করেননি!) জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেমন লাগল? পথটুকু?
ভদ্রলোক উত্তরে বলেছিলেন, কী বিচ্ছিরি পথ বা ওইরকমই কিছু ৷
ওই পথ ধরে, ভীমতালের আশ্চর্য সবুজ জলরাশিকে বাঁপাশে রেখে আমারও নৈনিতাল থেকে কালাধুঙ্গিতে আসবার সৌভাগ্য হয়েছিল একাধিকবার ৷ ওই পথের মতো সুন্দর পথ সত্যিই বেশি নেই ৷ জিম করবেট-এর চোখ দিয়ে দেখে কান দিয়ে শুনেই বলছি ৷ এবং হয়তো নিজের চোখ ও কান দিয়েও ৷ এ সৌন্দর্য সাধারণ পর্যটকের উপলব্ধির নয়, যাঁরা ‘পথ’ বলতে পথের মসৃণতার কথাই শুধু বোঝেন, তাঁদের জন্য পৃথিবীর অধিকাংশ সৌন্দর্যই নয় ৷
যে কথা প্রাঞ্জল করে বলার জন্যে এই উপক্রমণিকা তা এই যে, পথ, কখনওই পথে থাকে না ৷ গন্তব্যও থাকে না গন্তব্যে ৷ পথ ও গন্তব্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে পায়ে বা গাড়ির চাকাতে মাড়িয়ে যাওয়া পথের দুপাশে ৷ গন্তব্যে পৌঁছনো আর ভ্রমণ কখনওই সমার্থক নয় ৷ বুড়ি-ছোঁয়া আর ভ্রমণার্থীর অন্তরের আনন্দ, যা পথের সৌন্দর্য, শব্দ-গন্ধ এবং শান্ত নির্লিপ্তির ওপরেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, কখনওই সমার্থক নয় ৷ রবীন্দ্রনাথের গান আছে না? ‘পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে?’-ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকমই ৷ যে ভ্রমণার্থীর অন্তরেই পুষ্প নেই তাঁর ‘ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স’-এ যাওয়ার কোনও মানে নেই ৷
আরও একটা কথা ৷ ভ্রমণ ব্যাপারটার পিণ্ডি চটকে দিয়েছেন একধরনের ব্রিটিশ ও আমেরিকান ট্যুরিস্টরা ৷ তাঁদের দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ানো, কাঁধে ক্যামেরা-ঝোলানো স্বল্পমেয়াদী কন্ডাক্টেড ট্যুরের মানসিকতা দিয়ে ৷ সারা পৃথিবী এখন অন্ধের মতো এই মানসিকতারই শিকার হয়ে গেছে ৷ যা কিছু দ্রষ্টব্য তার সবকিছুই পাঁচ-দশদিনের পুরিয়াতে ভরে গিলে ফেলা, আর যাই হোক প্রকৃত ভ্রমণার্থীর প্রার্থনার নয় ৷ অমন ট্যুরে স্কাউটিং হতে পারে কিন্তু ভ্রমণ হয় না ৷ এই মানসিকতা অন্ধত্বের সাধনাতেই শেষ হয় ৷
একটি ছোট্ট উদাহরণ দিতে পারি ৷ হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী হনলুলু থেকে ‘পার্ল হারবার’ (যেখানে জাপানিরা বোমা ফেলে আমেরিকাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টেনে নামিয়েছিল) এবং মিস্টার ডোল মান্ডি নামের এক ভদ্রলোকের আদিগন্ত আনারসের বাগান দেখার জন্যে রওয়ানা হয়েছি এক সকালে, ব্রেকফাস্ট সেরে ওয়াইকিকি সমুদ্রতটের হলিডে ইন থেকে ৷ কয়েক মাইল যাবার পরেই ড্রাইভার হঠাৎ বাস থামিয়ে দিলেন এবং গাইড চেঁচিয়ে বলে উঠলেন-লুক! দিস ইজ আ পাইনঅ্যাপল ট্রি ৷
চেয়ে দেখি, একটি ডিসিডুয়াস, কিন্তু নাম না-জানা বড় গাছ, আমাদের বছর দশেকের শিমুলের মতো চেহারা তার; এবং তারই পত্রশূন্য ডালে ডালে অগণ্য আনারস বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ৷ এমনভাবে যাতে ওই গাছেরই ফল বলে ভ্রম হয় ৷
আর কি তর সয়! হুড়মুড় করে ট্যুরিস্টরা, যাঁদের অধিকাংশই মেইনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অন্য প্রান্ত জাপান থেকে এসেছিলেন, বাস থেকে নেমে স্টিল ক্যামেরা, এবং মুভি ক্যামেরা দিয়ে (তখনকার দিনে ভিডিও ক্যামেরা তেমন আকছার দেখা যেত না, আবিষ্কার হয়েছে কি না তাও বলতে পারব না ৷) ছবি তুলতে লাগলেন ৷ আমার একার সাধ্য কী যে তাঁদের থামাই?
অবশ্য থামানো উচিতও ছিল না ৷ এই ট্যুরের উদ্যোক্তরা ইচ্ছে করেই, যাঁরা ট্রপিকাল দেশের গাছ-পাতা ফল-ফুল সম্বন্ধে কিছুমাত্রই জানেন না, তাঁদের বোকা বানিয়ে মজা করা ও মজা দেওয়ার জন্যেই ওই বন্দোবস্ত করেছিলেন ৷ যাঁরা জীবনে আনারস গাছ দেখেননি সে বেচারারা জানবেনই বা কী করে ৷ তাছাড়া বোকা-বনাটাও ভ্রমণের আনন্দের মধ্যে গণ্য ৷ হাওয়াইতে যেতে হলে অবশ্য সেপ্টেম্বরে ‘আলোহা’র সপ্তাহে যাওয়াই ভালো ৷
যেখানেই কেউ যাবেন সেখানেই যে ক্যামেরা নিয়ে গাদা-গুচ্ছের ছবি তুলতেই হবে এই Ritual-এর স্বপক্ষে কোনও অকাট্য যুক্তি আছে বলে মনে হয় না ৷ এ বাবদে বাঘা ভ্রমণার্থী এবং সেরা রসিক সৈয়দ মজুতবা আলি সাহেবের সাগরেদ আমি ৷ যাঁরা ওঁর ‘দেশে বিদেশে’ বইখানি পড়েননি তাঁরা দয়া করে পড়ে নিলে জানতে পারবেন দেশভ্রমণ ব্যাপারটার নিগূঢ় তত্ব ৷ ভ্রমণ ব্যাপারটা যে কেমন হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণাও হবে ৷
উনি ক্যামেরাতে পুরোপুরি অবিশ্বাসী ছিলেন ৷ লিখেছেন, চোখের থ্রি পয়েন্ট ফাইভ লেন্সে সব জায়গার ছবি তুলে আমি আমার মস্তিষ্কের ডার্করুমে রেখে দিই ৷ তারপর যখন খুশি ডেভেলপ করে নিই নেগেটিভ ৷ তারপর খুশিমতো প্রিন্ট করি, এনলার্জও করি ৷
আমারও তাই মত ৷ ফটাফট ছবি না তুলে, সার্বেন্দ্রিয় দিয়ে কোনও বিশেষ স্থান, কোনও বিশেষ ক্ষণ, কোনও বিশেষজনকে সমস্ত ইন্দ্রিয়র শক্তি ও অনুভূতির দ্বারা স্মৃতির মণিকোঠায় চিরদিন বন্দী করে রাখা উচিত, যাতে সেই স্থান বা ক্ষণ বা জনকে চিরটাকাল তাদের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-ও স্পর্শসমেত সতেজ সজীব করে রাখা যায় নিজের মনের চোখে, নাকে এবং কানে ৷ ভ্রমণ একটা আর্ট বিশেষ, এক একক তীর্থযাত্রা; সঙ্গে অগণ্য সঙ্গী থাকলেও ৷ ভিড়ের মধ্যেও নির্জনতা খুঁজে নেওয়ার ক্ষমতাও ভ্রমণার্থীর অবশ্যই থাকা উচিত ৷ না থাকলে, তা অর্জন করার চেষ্টা করা উচিত ৷
ভ্রমণের আরও একটা মস্ত বড় দিক, নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখা ৷ যূথবদ্ধ, অন্যচালিত হয়ে; নিজের ইচ্ছা ও খুশিকে পদে পদে পদদলিত করলে ভ্রমণের আসল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যায় ৷
এই জীবনের পথের এখনও হয়তো অনেকখানিই বাকি তবু আমার নিজের দেশের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, এবং পুবের প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে পশ্চিমের শেষ প্রান্ত অবধি দেখার সৌভাগ্যই শুধু নয়, বারে বারে, চিরে চিরে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে বলে নিজেকে ধন্য ও কৃতার্থ বলে মনে করি ৷ কারণ, এ যে স্বদেশ! এমন দেশ আর কোথায় পাব? এ যে জন্মভূমি!
তারই সঙ্গে সৌভাগ্য হয়েছে পশ্চিম গোলার্ধের অধিকাংশ দেশ, জাপান, আফ্রিকা, প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকা, আফ্রিকা এবং ভারতের মধ্যে ভারত মহাসাগরের সেশেলস দ্বীপপুঞ্জ দেখার, পৃথিবীর ম্যাপে সর্ষে দানার মতো দেখায় যে দ্বীপপুঞ্জ ৷ দ্বীপগুলি এতই ছোট যে সবচেয়ে বড় দ্বীপটি, যে দ্বীপে সেই স্বাধীন দেশের রাজধানী, যার নাম ‘মাহে’ তারই আয়তন সবসুদ্ধ কুড়ি-পঁচিশ বর্গকিলোমিটার ৷ কিন্তু ছবির মতো ৷ ছবিও নয়; স্বপ্নের মতো ৷ পৃথিবীতে এমন বেলাভূমি বেশি নেই ৷ হাওয়াই দ্বীপের চারপাশে, আমাদের আন্দামানে, কেরালার কোভালম-এও প্রবালের স্তর আছে কিন্তু প্লেনটা যখন উচ্চতা হারিয়ে ঘুরে ঘুরে নিচে নামে, তখন সেশেলস দ্বীপপুঞ্জকে দেখে মনে হয় স্বপ্নে দেখা কোনও পরীরই দেশ ৷ কত নরম রঙের প্রবালের রঙিন আভা যে জলের নীলকে নানা রঙে আভাসিত করে রাখে তা নিজচোখে না দেখলে ঠিক বোঝা যায় না ৷
কোজাগরী পূর্ণিমাতে সুইটজ্যারল্যান্ডের কোনও ছোট্ট গ্রামের পথে রাতের বেলা পায়ে হেঁটে বেরোলে স্যুইস আল্পস-এর বরফঢাকা চুড়োগুলি খুবই সুন্দর সুন্দর লাগে সন্দেহ নেই ৷ সুন্দর লাগে পুব আফ্রিকার মাউন্ট কিলিমানজারোর বরফাবৃত গোলাকৃতি চেহারাটাও বা দুর্দান্ত মাসাই উপজাতিদের বাস যেখানে, সেই মাউন্ট মেরুকেও-তানজানিয়ার ‘আরুশা’ শহর থেকে ৷ ওই আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে আমাদের বর্ষাকালেই শীতকাল ৷ চমৎকার লাগে আফ্রিকার রুয়েঞ্জোরি রেঞ্জ-এর ‘মাউনটেইন অব দ্য মুন’ বা ‘চাঁদের পাহাড়’ ৷ গা-ছমছম করে, কোনও চাঁদের রাতে আফ্রিকার গোরোংগোরো জ্বালামুখের বলয়ের ওপরের সাফারি লজ-এর বারান্দায় কয়েকহাজার ফুট উচ্চতাতে বসে চাঁদের রাতের আলোছায়ার রহস্যে ঘেরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মৃত আগ্নেয়গিরির গর্ভের দিকে চেয়ে থাকতে ৷ গোরোংগোরোর বলয় ঘিরে প্রাগৈতিহাসিক সব অতিকায় বাওবাব গাছ দাঁড়িয়ে আছে-‘The Upside Down Trees’ এবং সেই জ্বালামুখের গর্ভর মধ্যে পাহাড় আছে ৷ হ্রদ আছে, জঙ্গল আছে, তৃণভূমি আছে, জলের কাছে হলুদরঙা ইয়ালো-ফিভার অ্যাকাসিয়া গাছের বন আছে, আর আছে আফ্রিকার প্রায় অধিকাংশ প্রজাতির বন্যপ্রাণীই ৷ হাতি, দু-খড়্গ গণ্ডার, বুনো মোষ, সিংহ, শিকারি চিতা (আমাদের লেপার্ড নয়), জেব্রা, গ্যাজেলস (নানারকম) কিশোরীর স্বপ্নের মতো ফিকে কমলা-রঙা ঠোঁট, আর পা আর পালকেরও ফ্লেমিংগো পাখির দল হ্রদের মধ্যে ৷
জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপের পাহাড়ের ওপরে বৌদ্ধ গৃহস্থর নির্জন আবাসে-ঝরনার কুলকুলানির মধ্যে পাথর-ফেলা পায়ে-চলা পথ, সাঁকো-বানানো আর বনসাই করা বাগানের মধ্যে হিমরাতে কিছুক্ষণ বসে থেকে ছোট্ট দোতলা কাঠের বাড়ির উষ্ণ অভ্যন্তরে ঢুকে, বাইরে জুতো খুলে রেখে, ঘরের ভেতরের মাদুরের ‘টাটামি’ মেঝেতে বসে জাপানি রাইস-ওয়াইন ‘সাকে’ গরম করে সুন্দর জাপানি ওয়াইন-বোল-এ করে গৃহস্বামীর সঙ্গে পান করাতেও এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা ৷
জাপানের কিছু কোণে এখনও পুরনো, হুবহু আমাদের কীর্তনের সুরের মতো প্রাচীন জাপানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনা যায়-প্রাচীন নাটকে-‘কাবুকাজে’-তে ৷ এখনও খুঁজলে খুঁজে পাওয়া যায় সেই জাপানকে যে-জাপানের আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা চিরদিন ছিল ৷ যে-জাপান আমেরিকান-জাপান নয় ৷ শান্ত, নিভৃত, টেনশন-ফ্রি জাপান ৷ তবে আমার দেখা জাপানের সঙ্গে আজকের জাপানের তুলনা হয়তো চলবে না কারণ আমি জাপানে গেছিলাম প্রায় কুড়ি বছর আগে ৷ যে-জাপানের কথা আমি বলছি তার সঙ্গে কাজ-পাগল বিলাসিতা-পাগল জাপানের কোনও তুলনাই চলে না ৷ পশ্চিমের অনুকরণ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, আজ তা সম্পূর্ণ হয়েছে ৷
অস্ট্রিয়াতে একটি জেলা আছে, তার নাম টিরল ৷ যদি কখনও যেতে পারেন ওদিকে, তবে টিরল-এ থেকে আসবেন কদিন ৷ শুধুই বুড়ি ছুঁয়ে আসবেন না ৷ আমি টিরলেও গেছিলাম শরৎকালেই ৷ তখন ডরফফেস্ট উৎসবের সময় ৷ গ্রীষ্মে, গরুরা সব চরতে গেছিল পাহাড়ে, বড় বড় শেফার্ড-ডগদের পাহারাদারিতে ৷ শীত নামবে শিগগিরি ৷ ‘এল যে শীতের বেলা, বরষ পরে ৷’ তাই গরুদের সব পাহাড় থেকে নামিয়ে আনা হয় তখন ৷ সেই কারণেই গির্জাতে গির্জাতে একটি বিশেষ দিনে প্রার্থনা হয় ৷ বাড়ি বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া নাচ-গান হয় ৷ মার্সিডিজ ও বি এম ডাব্লু গাড়িতে দীর্ঘ সারি বেঁধে, প্রত্যেক গাড়ির বনেটের ওপরে নানাবর্ণের টাটকা ফুলের তোড়া সাজিয়ে রেখে অস্ট্রিয়ানরা চলেছে গির্জাতে উপাসনার জন্যে, দেখতে পাবেন ৷
নয়তো যেতে পারেন গ্রিস-এর কোনও ছোট্ট দ্বীপে, কদিনের জন্যে ৷ যদি পারেন যেতে ৷ ‘জোর্বা দ্য গ্রিক’ ছবিটা কি দেখেছেন? অ্যান্থনি কুইন অভিনীত? না দেখলে, জোগাড় করে দেখে নেবেন একবার ৷ পুরো ইউরোপের মধ্যে গ্রিস এক আশ্চর্য্য স্বতন্ত্র জায়গা ৷ গ্রিসই গ্রিসের তুলনা অথবা গ্রিসে যান সবচেয়ে কম ট্যুরিস্ট পৃথিবীর পূর্বী দেশগুলি থেকে ৷ জানি না কেন ৷ ইউরোপিয়ান ও আমেরিকানদের মধ্যে যাঁদের নির্জনতাপ্রিয়তা আছে এবং ভাবনাচিন্তা করার প্রবণতা আছে তাঁরা গ্রিসে অনেকেই যান ৷
গ্রিসেও যদি না যান, তবে আমার মতো যাঁরা হেমিংওয়ের ভক্ত তাঁরা যেতে পারেন ইউনাইটেড স্টেটস-এ ৷ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই তাঁর ঘর ছিল ৷ তিনি তো আর হতভাগ্য বাঙালি লেখক ছিলেন না ৷ যাবেন তাঁর প্রিয় বাড়িটি দেখার জন্যে ৷ যে-বাড়িতে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন ৷ যেখানে জীবনের শেষে থিতু হয়েছিলেন ৷ আইডাহো, কেচামের বাড়ি, যুক্তরাষ্ট্রে ‘স্নেক’ নদী যেখানে পাহাড়-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সাপেরই মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে ৷ যে-বাড়ির টেরাসে তাঁর প্রিয় বেড়ালদের মধ্যে বসে হেমিংওয়ে মৃত্যুর আগে আগে উদাস চোখে চেয়ে থাকতেন, সেই ‘The Topping House-এ ৷’
এ বাড়িটি এবং পরিবেশ আমার এতই ভালো লেগেছিল যে, আমাদের দেশের বিহারের রাঁচি-পালামৌর সীমান্তে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে জঙ্গল-পাহাড়ঘেরা এবং একটি পাহাড়ি ঝরনার পাড়বসানো যে-বাংলোটি একজন স্কটম্যান-এর কাছ থেকে কিনি ষাটের দশকের শেষে, যে-বাংলোর কথা ‘চানঘরে গান’-এ বলেছি সবিস্তারে, তারও নাম রাখি ‘The Topping House’ ৷ তখনকার ম্যাকলাস্কিগঞ্জ অন্য ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ছিল ৷ তখনকার আমিও অন্য আমি ছিলাম ৷ তখনও এদেশে মানুষ অনেক কম ছিল, গাছ-গাছালি পাখ-পাখালি অনেক বেশি ছিল-লোভ; সর্বগ্রাসী লোভ ছিল না ৷ তখন শান্তি ছিল বড় ৷ শান্ত জীবন ৷ সেইসব দিন হারিয়ে গেছে ৷ সেই আমিও হারিয়ে গেছি ৷
পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছি বটে, বহুবার; কিন্তু আমার দেশের মতো সুন্দর দেশ পৃথিবীতে আর একটিও দেখলাম না ৷ আমাদের বন-জঙ্গল, আমাদের পাহাড়-নদী, আমাদের পাখি-প্রজাপতি, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-শীত-বসন্তের লীলাখেলা-আমাদের দেশের ঊর্ধ্ববাহু সন্ন্যাসীর মতো দাঁড়িয়ে-থাকা গাছেদের অজানা গন্তব্যে অনুক্ষণ, যুগ-যুগান্ত ধরে হেঁটে চলা-আমাদের কুমায়ুন ও গাড়োয়াল হিমালয়, আমাদের গঙ্গা, নর্মদা, তিস্তা, কাবেরী, ব্রহ্মপুত্রর উপত্যকার সৌন্দর্য, আমাদের পূর্বী পাহাড়দের মেঘ-মেঘ, ভেজা-ভেজা, রোম্যান্টিক ব্যক্তিত্ব এসব অন্য দেশ কোথায় পাবে? সুন্দরবনের মতো ভয়াবহ, ভৌতিক, গা-ছমছম করা অথচ এমন সুন্দর Mangrove বনই বা আর কত জায়গাতে আছে?
আমাদের বাঘের মতো সুপুরষ, ব্যক্তিত্বময় প্রাণী, যে-প্রাণী একা একা কাটিয়ে দেয় সারাটা জীবন-মাঝের মিলনকালের সামান্য বিরতি ছাড়া; তেমন প্রাণী তো পৃথিবীর বেশি দেশে নেই! এমন বিচিত্র ও ব্যাপ্ত দর্শনের দেশেই এমন দার্শনিক, দাম্পত্যজীবনের দৈনন্দিনতা ও নিত্য কোলাহল-বর্জিত জীবনের ধারণা-করা জ্ঞানীর উদ্ভব সম্ভব ৷
আমাদের দেশের মতো দেশ পৃথিবীতে সত্যিই নেই ৷ এ দেশের সাধারণ মানুষদের মতো মানুষও নেই; শুধু যদি আমাদের নেতারা একটু মানুষের মতো হতেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলি একটু দায়িত্ববান হতেন, শিক্ষিত শহুরে আমরা যদি একটু কম লোভী হতাম তবে এই দেশকে ভ্রমণার্থীর স্বর্গ করে গড়ে তুলতে পারতাম ৷
দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের কথা বলার ইচ্ছে রইল আলাদা-আলাদা করে ৷ তবে যে সব পাঠক ট্যুরিস্ট-গাইড বা ট্যুরিস্ট প্যাম্লেট চান তাঁরা আমার সেইসব লেখা পড়ে হতাশ হবেন ৷
সবাই যে পথে যান আমি সে পথে কখনওই যাইনি, তাই আমার পাঠকদের জাতও আলাদা ৷ রবার্ট ফ্রস্ট-এর ‘The Road Not Taken’ কবিতাটি যাঁদের পড়া আছে তাঁরা অবশ্যই জানবেন যে, অন্য পথ বেছে নিয়েছিলাম আমি ৷
And that had made all the difference.
ভ্রমণ অক্টোবর, ১৯৯৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন