অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
একটানা নোনা হাওয়ায় ভেসে আসে দূরে কোরাল রিফের ওপর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের আওয়াজ ৷ লেগুনের টলমল শান্ত জল ঘিরে চাঁদের ফালির মতো সোনালি বালুচর ৷ পিছনে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকা নারকোলশ্রেণীর পত্রমর্মর ৷ নিশীথ জ্যোৎস্নায় মারে-এর পাষাণ চত্বরে অনাবৃত-দেহা তরুণীদের অনায়াসসাধ্য হুলা নাচ আর তার সঙ্গে ঘাটহীন এসরাজের মতো গলায় যতিচ্ছেদহীন একটানা সুরেলা গান ৷ প্রশান্ত মহাসাগরের কোন গহনে লুকোনো আছে এই দেশ ৷
ইউরোপ থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পৃথিবী পরিক্রমার পথ প্রথম দেখিয়েছিলেন পর্তুগিজ নাবিক ম্যাগেলান ৷ সে হল ১৫২০ সাল ৷ তারপর এ পথে বহু নাবিক আনাগোনা করেছেন-মেডানা, ডি কিরো, টাসম্যানে, রজোভিন-কিন্তু পলিনেশিয়ার বহু বিস্তৃত দ্বীপগুলির লূতাতন্তু বেয়ে প্রায় কেন্দ্রস্থল তাহিতিতে পৌঁছতে সভ্যতার আরও আড়াইশো বছর লেগেছিল ৷ ইতিমধ্যে ইউরোপের পণ্ডিতেরা গুনে-গেঁথে বলেছিলেন যে পূর্বে নিউজিল্যান্ড এবং পশ্চিমে ইস্টার আইল্যান্ডের মাঝখানে যে বিরাট ফাঁকা জায়গাটা, যার কোনও ম্যাপ এখনও তৈরি হয়নি, ওখানে লুকিয়ে আছে আস্ত একটা মহাদেশ ৷ থাকতেই হবে, না হলে ভারসাম্যহীন লাট্টুর মতো পৃথিবীটা কবে কেৎরে একদিকে বেরিয়ে যেত ৷ সেই নাম না-জানা দেশ, টেরা অস্ট্র্যালিস ইনকগনিটোর খোঁজে পর পর তিনজন এলেন-১৭৬৪ সালে ক্যাপ্টেন জন বায়রন, কবি বায়রনের পিতামহ ৷ ১৭৬৭ সালে কয়েক মাসের ব্যবধানে এলেন ক্যাপ্টেন ওয়ালিস আর ক্যাপ্টেন বুগেনভিল ৷
তাহিতিতে প্রথম নোঙর করবার সম্মান ওয়ালিসের প্রাপ্য হলেও বিদগ্ধ ফরাসি ভূপর্যটক বুগেনভিলই এ স্বপ্নরাজ্যের সন্ধান ইউরোপকে দেন ৷ এর আগে বায়রন বিফলকাম হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন ৷ এখানকার পুষ্প সুবাসিত বাতাস, অবারিত সমুদ্র পাহাড় জঙ্গলের রূপ রস বর্ণ এবং সর্বোপরি এ দেশের মেয়েদের সহজ হৃদ্যতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, এ যে দেখি নতুন সিয়েরা ৷ প্রাচীন গ্রিসের সিয়েরা দ্বীপের আকাশে বাতাসে এই রকমই প্রণয়ের যাদু মেশানো ছিল ৷ লোকে বলত ভালোবাসার দেশ ৷ ভালোবাসার এই নতুন দেশটি কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত জানা পথ থেকে এত দূরে এবং আড়ালে যে আজকের উড়োজাহাজের যুগেও এক লাফে ওখানে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব ৷ দু-তিনবার প্লেন বদলাতে হবে, কখনও বা পথে রাত্রিযাপন করতে হবে কারণ আপনার নির্ধারিত উড়ানটি হয়তো পরের দিন পাবেন ৷ এ সব উড়ানের অনেকগুলিই দৈনিক নয় ৷ ভারতবর্ষ থেকে পূর্বমুখে গেলে দিনের হিসেব করতে হবে ৷ নিউজিল্যান্ডের পর আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা পার হলেই গতকাল হয়ে গেল ৷ ২৯ তারিখ রওনা হয়ে যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেন সেখানে তখনও হয়তো ২৮ তারিখ চলছে ৷ তাহিতিতে হোটেল বুক করার জন্য পৌঁছবার দিনটি সঠিকভাবে জানা দরকার ৷ ভ্রমণেচ্ছুদের জন্য এখানে একটা সতর্কবাণী ৷ ট্র্যাভেল এজেন্ট বা এয়ারওয়েজের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করে উড়ানের তারিখ এবং সময় সংক্রান্ত সব তথ্য নিজে খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া উচিত ৷ আরেকটি কথা, তাহিতি তথা ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার ভিসা ফরাসি দূতাবাস থেকেই পাওয়া যায় কিন্তু সে ভিসার অনুমোদন আনতে হয় তাহিতি থেকে ৷ ১৫-২০ দিন সময় লাগে ৷
তাহিতি যাবার সহজতম উপায় হল কোয়ান্টাস বা এয়ার ফ্রান্স বা এইরকম কোনও দক্ষিণ গোলার্ধগামী উড়ান কোম্পানির মাধ্যমে পৃথিবী পরিক্রমার টিকিট কাটা ৷ আমরা এয়ার ফ্রান্সের আতিথ্য নিয়েছিলাম এবং একদিন সিডনি, অকল্যান্ড হয়ে তাহিতির পথে রওনা দিলাম ৷ প্রশান্ত মহাসাগর যে বিরাট, পৃথিবীপৃষ্ঠের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে যে তার বিস্তৃতি, এ কিছু নতুন কথা নয় কিন্তু সে যে কত বিরাট তার ধারণা করতে গেলে এর এপার থেকে ওপার উড়ে যেতে হয় ৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশ আর সমুদ্রের মধ্যিখানে বসে চোখ বস্তুর অবলম্বন খোঁজে কিন্তু কোথাও তার চিহ্নমাত্র নেই ৷ গতির মৃদু কম্পনে শরীর অভ্যস্ত হয়ে গেলে হঠাৎ মনে হয় যেন আমরা কোথাও থেকে আসিনি, কোথাও যাচ্ছি না, অনাদি অনন্তকাল ধরে যেন শূন্যে স্থাণু হয়ে বসে আছি ৷ এমন সময়ে হয়তো চোখে পড়ল কড়ে আঙুলের ডগার মতো ছোট্ট একটা দ্বীপ সমুদ্রে মাথা তুলে আকাশের দিকে উঁকি মারছে ৷ মুহূর্তে সময় বোধ ফিরে এল ৷
টেবিল জোড়া সাদা কাগজের ওপর কলম ঝাড়া কালির ফোঁটার মতো প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় ৷ নিউগিনি থেকে ফিজি পর্যন্ত বিষুবরেখার উত্তরভাগে মাইক্রোনেশিয়া, দক্ষিণে মেলানেশিয়া ৷ ফিজির পরে উত্তর-দক্ষিণ সব জুড়ে সেই আমেরিকার কূল পর্যন্ত পলিনেশিয়া ৷ মেলানেশিয়ানরা অস্টালয়েড কৃষ্ণবর্ণ, ঠোঁট মোটা, কোঁকড়া চুল, মাইক্রোনেশিয়ানরা মালয় আর মঙ্গোলিয়ান মেশানো ৷ কিন্তু মেলানেশিয়া এবং মাইক্রোনেশিয়ার তিনগুণ আয়তন সেই হাওয়াই থেকে ইস্টার আইল্যান্ড পর্যন্ত ছড়ানো যে পলিনেশিয়া তার মানুষগুলো কোথা থেকে এল তা নিয়ে পণ্ডিতদের কচকচি আজও শেষ হয়নি ৷ আরও আশ্চর্য এই যে অন্য দুটি এশিয়ার দ্বীপগুলিতে নানা রীতি, নানা ভাষা প্রচলিত থাকলেও সমস্ত পলিনেশিয়া জুড়ে মোটামুটি এক রীতি, এক ভাষা ৷ এই সূত্রে মনে পড়ে থর হাইডরহালের বিখ্যাত কনটিকি অভিযানের কথা ৷ বালসা গাছের ভেলায় চড়ে তিনি এবং তাঁর দলের লোকেরা পেরু থেকে তাহিতি পাড়ি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে পলিনেশিয়ানদের পূর্বপুরুষরা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এসেছিলেন ৷ কাঠামো এবং রঙে আমেরিকার তথাকথিত রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে পলিনেশিয়ানদের কিছু সাদৃশ্য আছে বটে কিন্তু রীতিনীতিতে অনেক তফাত ৷ যাই হোক আমাদের এত হিসেবনিকেশ করবার দরকার নেই ৷ বরং যেখানে যাচ্ছি সেখানকার সম্বন্ধে দু-চার কথা বলি ৷
দক্ষিণ পলিনেশিয়ার মাঝামাঝি জায়গায় মোটমাট ১৩০টি দ্বীপ নিয়ে ফ্রান্সের পলিনেশিয়ান রাজত্ব ৷ রাজত্বটি কায়েম করেছিলেন সেই বুগেনভিল ৷ নামে ১৩০টি দ্বীপ হলেও সামগ্রিক ভূপৃষ্ঠের পরিমাপ মাত্র ৪০০০ বর্গ কিলোমিটার, মানে আধখানা সিকিম, কিন্তু যে জায়গা জুড়ে দ্বীপগুলি ছড়ানো আছে তার ভেতরে গোটা ইউরোপটাকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় ৷ তাহিতিই বৃহত্তম দ্বীপ, প্রায় ১০০০ বর্গ কিলোমিটার পুরো রাজত্বের লোকসংখ্যা দুলক্ষের মতো এবং তার শতকরা ৮০-৮৫ ভাগই থাকে তাহিতিতে ৷ প্রধান শহর এবং রাজধানীর নাম পাপিতে এবং পাপিতের কাছেই ফা-আ আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট আমাদের গন্তব্যস্থান ৷
পাপিতে যখন পৌঁছলাম তখন স্থানীয় সময় রাত সাড়ে এগারোটা ৷ মনে বেশ একটু উদ্বেগ ছিল ৷ বিদেশ বিভুঁই ৷ ভাষা জানি না ৷ ওই রাতদুপুরে পৌঁছে ট্যাক্সিওয়ালার পাল্লায় পড়ে ধন-প্রাণের কী দশা হবে ৷ তাছাড়া সিডনি থেকে যখন টেলিফোনে হোটেল বুক করি, ওরা খালি নামটা আর পৌঁছবার তারিখটা জেনে নিল ৷ না দিল কোনও কম্পিউটার নম্বর, না চাইল ক্রেডিট কার্ড রেফারেন্স-এখন এই নিশিরাতে যদি দেখি হোটেলের দরজা বন্ধ (এমন কিছু পাঁচতারা হোটেল নয়), অথবা ওরা যদি বলে কবে বুক করেছিলে, নামটা লেখা নেই তো-তখন মালপত্তর, গিন্নিকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াব ৷ কিন্ত পূর্বসূরিরা বৃথাই পলিনেশিয়ান আতিথেয়তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে যাননি ৷ অত রাতেও এয়ারপোর্ট জমজমাট ৷ ইমিগ্রেশন, কাস্টমস নামমাত্র, এ সবের মাঝেই পুরনো রীতি অনুযায়ী দেশি পোশাকে মাথায় গলায় ফুলের গয়না পরা কয়েকটি তরুণ-তরুণী অভ্যাগতদের স্বাগত জানিয়েছে-‘আলোহা’, কানে পরিয়ে দিয়েছে ওদের জাতীয় পুষ্প টিয়েরার কর্ণভূষা ৷
এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই ছোটখাটো দৈত্যের মতো ঝাঁকড়াচুলো দেশীয় ড্রাইভার টেনে হিঁচড়ে মালপত্তর গাড়িতে তুলে বললে ‘চলো’ ৷ চেহারা যেমনই হোক ওর হাসিমুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই ৷ তবু জিজ্ঞাসা করি, ‘ভাড়া কত পড়বে?’
‘পাপিতে যাবে তো? সে তো তিনশো ফ্রাঙ্ক ৷’ তিনশো তাহিতিয়ান ফ্রাঙ্ক মানে দশ ডলারের মতো ৷ হোটেলে পৌঁছে দেখি আরেক হাসিমুখো দৈত্য ডেস্ক আলো করে বসে আছেন ৷ নাম শুনেই চটপট হাতে একটা চাবি ধরিয়ে দিয়ে বললে, ‘ওই দোতলায় তোমাদের জন্য সমুদ্রমুখী ভালো ঘর রেখে দিয়েছি, চলে যাও ৷’ এও ডিপোজিট চাইল না বা ক্রেডিট কার্ড দেখতে চাইল না ৷ মালপত্র নিয়ে আমরা বুড়োবুড়ি একটু মুশকিলে পড়েছি দেখে সাঙ্গোপাঙ্গদের কী যেন বলল ৷ ওদের দুজন আমাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল ৷ টিপস দিতে গেলে নিল না ৷ পলিনেশিয়ানরা লম্বা, চওড়া প্রমাণ সাইজের মানুষ, ইংরিজিতে যাকে হেফটি বলে কিন্তু মুখের মৃদুভাবে ওদের অন্তরের সারল্য ফুটে ওঠে ৷
পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙে শুনি এক ঝাঁক শালিক পাখির ঝামেলা ৷ তাড়াতাড়ি পেন্টুলুনে পা গলিয়ে বাইরে এসে দেখি ফুটপাত জুড়ে সত্যিই ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক ৷ পরে জেনেছিলাম যে পলিনেশিয়াতে পাখির রকমফের এবং সংখ্যা কম হওয়াতে শ-দুই বছর আগে আমাদের কিছু দেশি শালিক ছেড়ে দেওয়া হয় ৷ এখন তাদের দৌরাত্ম্যে ওদেশের পাখিগুলো লোকালয় ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে ৷ শুধু শালিক কেন পলিনেশিয়ার বহু প্রাণী, গাছগাছড়া, ফুল, লতা-এমনকী নারকোল গাছ পর্যন্ত সাম্প্রতিক আমদানি ৷ পুরনো পৃথিবীর লোকেরা শোভা বা সুবিধার জন্য নিয়ে এসেছে ৷ কখনও কখনও তাতে বিপরীত ফলও হয়েছে ৷ যেমন কুকু আইল্যান্ডের প্রবাসী বাসিন্দারা পোকামাকড়ের উপদ্রব কমাবার জন্য বাইরে থেকে ব্যাঙ নিয়ে এল ৷ এখন ব্যাঙই সেখানকার মস্ত উপদ্রব হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ এবার বুঝি সাপ আমদানি করতে হয় ৷ দেশজই হোক বা আমদানিই হোক পলিনেশিয়াতে গাছপালা, ফুল, লতা-গুল্মের বাড়বাড়ন্ত খুব ৷ কোনাচে খোঁচওয়ালা খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে সবুজের সমারোহ ৷ নিচে সোনালি বালির চর ঘিরে নীল সবুজ বেগুনি শান্ত সমুদ্রের জল ৷
আমাদের হোটেল রয়্যাল পাপিতের সামনেই পাপিতের জাহাজঘাটা-কিন্তু চেন, পুলি, ক্রেন, ট্রাক, ওয়াগনের কুশ্রী কদর্যতা, ধাতু সংঘাতের উচ্চ আওয়াজ, ভিড়, কোলাহল কিছু নেই ৷ এ ঘাটে কেবল যাত্রীবাহী জাহাজ ভেড়ে, দুশো গজের মতো চওড়া শান বাঁধানো স্ট্র্যান্ড এত পরিষ্কার যে তার ওপর নিজের ছায়া দেখা যায় ৷ গাছপালা, লতা, ফুলে সাজানো ঘাসে ঢাকা জমিতে সিমেন্টের বেঞ্চি পাতা ৷ তারই ফাঁকে ফাঁকে রঙিন কাপড়ে ঘেরা স্টল, এত সকালে ওরা এখনও চোখ খোলেনি ৷ স্ট্র্যান্ডের গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে হাঁসের মতো সাদা বিরাট সমুদ্রগামী জাহাজ, যার গায়ে বিশাল নীল অক্ষরে লেখা Club Mediterranian Pacific tour No. 1, এরাই আসল প্রশান্ত মহাসাগর দেখে ৷ অকল্যান্ড থেকে বেরিয়ে তিন থেকে ছ সপ্তাহ মতো দ্বীপ থেকে দ্বীপ ঘুরে বেড়াবে ৷ জাহাজের অনেক উঁচুতে রেলিং দেওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুয়েকজন সাহেব ঘুমন্ত পাপিতে দেখছেন ৷ স্ট্র্যান্ডের অন্য দিকে কিছুটা কর্মব্যস্ততা দেখা গেল ৷ বারো মাইল দূরে মুরিয়া দ্বীপের প্রথম ফেরি ছাড়ছে ৷ ফেরিঘাটের পাশেই চায়ের স্টলটি খুলেছে ৷ শান্ত সমুদ্রের মোলায়েম হাওয়ায় রংবেরঙের ছাতার তলায় বসে উষ্ণ মধুর চায়ের কাপটি যেন কানে কানে কথা কইল ৷
হোটেলে ফিরে সেজেগুজে যখন বেরোলাম তখন পাপিতে জেগে উঠেছে ৷ হোটেল আর স্ট্র্যান্ডের মাঝখানে তাহিতির শেষ রাজবংশের নামে বিরাট চওড়া রাস্তা বুলেভার্ড পমারে সমুদ্রের ধার দিয়ে শহরের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত চলে গেছে ৷ প্রথমে চাই একজন ট্র্যাভেল এজেন্ট যে আমাদের অন্য দুয়েকটি দ্বীপে যাবার হদিশ দিতে পারবে ৷ ট্র্যাভেল এজেন্ট অচিরে পাওয়া গেল, আমাদের হোটেল বিল্ডিংয়েই নুভেল ফ্রন্টিয়ারস ৷ অভ্যস্ত ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ইংরিজি-ভাষী ফরাসি যুবকটি পথপঞ্জি বানিয়ে দিল: মোটে পাঁচদিন সময় ৷ তাহলে এই সোসাইটি দ্বীপপুঞ্জের ভেতরে থাকাই ভালো ৷ টুয়ামোটু, মার্কুইস-এগুলি বহুদূর হয়ে যাবে আর তা ছাড়া যদি সমুদ্রক্রীড়ার শখ না থাকে তো ও সব জায়গায় গিয়েই বা কী হবে ৷ কালকে চলে যান হুয়াহিনে, পরশু বোরাবোরা, তার পরদিন ফিরে আসুন মুরিয়ায়, দুরাত্রি ওখানে কাটিয়ে আবার পাপিতে ৷
কথার সঙ্গে সঙ্গে টাইপরাইটারের মতো যন্ত্রটায় চাবি টিপে চলেছেন, ‘ওদিন বোরাবোরা থেকে সোজা মুরিয়ায় আসতে পারবেন ভায়া পাপিতে করতে হবে না ৷’ এয়ার তাহিতির উড়ানগুলো বুক করে ভদ্রলোক বললেন, ‘হুয়াহিনের কানেকশন পাচ্ছি না, আপনাদের হোটেল ঠিক করে দিতুম, তা এক কাজ করুন না, ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে আসুন ৷ ততক্ষণে সব ঠিক হয়ে যাবে ৷’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘যা বুক করেছেন তার জন্য কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে যাব কি?’
‘কী দরকার ৷ সব একসঙ্গে দেবেন, আপনারা তো পালাচ্ছেন না ৷’
মানুষের প্রতি মানুষের এই সহজ বিশ্বাসবোধ পলিনেশিয়ার সর্বত্র দেখেছি ৷
পাপিতে শহর দেখার জন্য কিছু গাড়ি ঘোড়ার দরকার হয় না ৷ দুঘণ্টায় পায়ে হেঁটে ঘুরে এলাম ৷ বাড়িঘর, দোকানপাট আর পাঁচটা মফস্বল শহরে যেমন হয়, শুধু লোকগুলো অন্যরকম ৷ ছেলেদের প্রায় সবারই পরনে পেন্টুলুন, গায়ে হাওয়াইয়ান শার্ট বা টি শার্ট, সবই রংচঙা ৷ মেয়েদের মধ্যে বেশ কজন বড় বড় ফুল তোলা রঙিন কাপড়ের দেশি পোশাক পারেয়ো পরে আছে, গায়ে অনুরূপ রঙিন কাপড়ের ঢিলাঢোলা জামা ৷ সেলাই করা ঊর্ধ্বাঙ্গের আবরণ ইউরোপের আমদানি ৷ তার আগে পলিনেশিয়ানরা ওই এক পারেয়ো দিয়েই লজ্জা নিবারণ করত ৷ ছেলেরা বস্ত্রখণ্ডটি বাঁধত কোমরে ৷ মেয়েরা বগলের নিচ দিয়ে বেড় দিত ৷ পোশাকের রং ছাড়াও ভালো লাগল এদের মনের রং ৷ অনাবিল আনন্দরস ৷ একমাত্র চিনে দোকানদারগুলো ছাড়া কারও পেঁচামুখ দেখলাম না ৷ উচ্চশ্রেণীর এক দোকানে ঢুকলাম তাহিতির একান্ত নিজস্ব জিনিস জগৎবিখ্যাত কালো মুক্তো দেখতে ৷ ঢুকেই বলেছি, ‘বাবা, আমরা কিছু কিনতে আসিনি, শুধু দেখতে চাই, কী সে রাজার ঐশ্বর্য ৷’ কত যত্ন করে মেয়েটি আমাদের নানারকমের নানা সাইজের মুক্তো এবং মুক্তোর আভরণ দেখাল!
পাপিতেতে প্লাস্টিকের ছাদ দেওয়া বহুতল বাজারটি দেখবার মতো ৷ আয়তনে শিয়ালদা স্টেশন ৷ একতলায় কাঁচাবাজার ৷ ফলের স্টলে এসে চোখ জুড়িয়ে গেল ৷ আনারস, আম, পেঁপে, কলা, পেয়ারা, তরমুজ, খরমুজ, গোলাপজামের মতো একরকমের ফল, আর কত রকম রং তাদের ৷ লাল কলা, হলদে কলা, সব যেন গাছ থেকে সবে পেড়ে এনেছে ৷ অগুনতি, অজস্র ৷ ফুলের লাইনেও সমান জেল্লা ৷ সবই আমাদের দেশি ফুল ৷ এক জায়গায় ডাঁই করে ডাব বিক্রি হচ্ছে ৷ বয়স্ক খরিদ্দার অনেকেই আমাদের দেশের মতো ডাবের কাটা মুখে মুখ লাগিয়ে চোঁচোঁ করে জল খাচ্ছে ৷ অল্পবয়স্করা সবাই স্ট্র ব্যবহার করে ৷ সবজির বাজারেও সব দেশি সবজি টাটকা তোলা ৷ যেন শীতকালের গড়িয়াহাট মার্কেট ৷ দোতলায় টানা বারান্দা জুড়ে দোকানের পর দোকান ৷ বেশিরভাগই কাপড়-জামা, ট্যুরিস্টদের জন্য পারেয়ো, তাহিতি মার্কা টি শার্ট, টুপি, দ্বীপবাসীদের তৈরি কাঠের খেলনা, টটেম-কিছু সস্তা অলঙ্কারের দোকান ৷ তিনতলা ভর্তি খাবার জায়গা ৷ চারতলায় আবার দোকান ৷
বাজার থেকে বেরিয়ে এ গলি সে গলি করে বুলেভার্ড পমারের দিকে এগোতে এগোতে মনে হল তাহিতির পাহাড় বন সমুদ্রের টলমল বন্যায় শহরের বাড়িগুলো যেন সেই বেদান্তোক্ত ভাসমান কাষ্ঠখণ্ডগুলির মতো বেমানান বিসদৃশ ৷ কোনও ছিরিছাঁদ নেই ৷ সৌষ্ঠব, সামঞ্জস্য বহিরাভরণ কিছুই নেই ৷ ইট, কাঠ, কাচ, লোহার তৈরি কতকগুলো চৌকো খাঁচা একটার ওপর আরেকটা বসিয়ে মানুষের মাথা গোঁজবার জায়গা করা হয়েছে ৷ পলিনেশিয়ানদের দোষ দিই না ৷ ওদের অনাড়ম্বর মুক্ত জীবনে মন্দির, মসজিদ, ক্যাথিড্রাল, কেল্লা, প্রাসাদ কিছুরই প্রয়োজন হয়নি ৷ চাঁদের আলোয়, নারকোলকুঞ্জের মর্মরে অনাবৃত আকাশের তলায় ওদের দেবতারা নেমে আসতেন, তাঁদের অভ্যর্থনার জন্য বড় বড় পাথরের চাঙড়ে গাঁথা বেদীই (ওদেশি ভাষায় মারে-এ) যথেষ্ট ছিল ৷ কেল্লাই বা কী হবে যখন গোষ্ঠীর সব সম্পদে সকলের সমান অধিকার! আর নিজেদের জন্য পাথরের মেঝে, ছিটেবেড়ার দেওয়াল, পাতা ছাওয়া কুটির তো আছেই ৷ তাহিতির শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় এ পর্ণকুটিরগুলি এখনও সমান আরামপ্রদ ৷ দোষী করব তাদের, যারা সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এদেশে শুধু কুড়োতে এসেছিল ৷ সারা পাপিতে শহরে সুদৃশ্য বাড়ি বলতে বোধহয় একটিই আছে ৷ Hotel-De-Ville মানে ওখানকার মিউনিসিপ্যাল অফিস ৷ ইদানীং কয়েকটি পাঁচতারা, সাততারা হোটেল, নানাধরনের অট্টালিকা তৈরি হয়েছে বটে কিন্তু সেগুলি শহর এবং রাজপথ থেকে দূরে নিজ নিজ বৃক্ষবাটিকার মধ্যে এমনভাবে লুকোনো যে চেষ্টা করে খুঁজে বের করতে হয় ৷
কত যুগ-যুগান্তর আগে আদিম পৃথিবীর সমুদ্রতল ফুঁড়ে আগ্নেয়গিরিটা আকাশে মাথা তুলেছিল ৷ তার ধূম্রশীর্ষ অগ্ন্যুদগারী মুখ থেকে গলিত ধাতু প্রস্তর লাভা, ব্যাসাল্টের স্রোত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল সমুদ্রের কূল পর্যন্ত ৷ তারপর কতকাল ধরে বর্ষার ছুরিতে, বাতাসের উকোয়, নির্বাপিত পাহাড়ের গায়ে খাঁজের পর খাঁজ পড়ল, লাঙলের ফলার মতো শৃঙ্গগুলির গা ঘেঁসে স্বল্পকায় ছোট ছোট উপত্যকা ৷ ছাই, মাটি, পাথরের আস্তরণের ওপর সবুজের ঢল নামল-তৃণ, গুল্ম, লতা, বৃক্ষাদি ৷ সমুদ্রও সে সময়ে বসে ছিল না ৷ তার আহ্বানে হাত ধরাধরি করে ছুটে এল প্রবালের দল ৷ নবসৃষ্ট দ্বীপটিকে ঘিরে প্রবাল-বেষ্টনী তৈরি হল ৷ এই হল তাহিতি এবং সমধর্মী দ্বীপদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ৷
সারা দ্বীপ জুড়েই পাহাড় ৷ মানুষের বসবাস সমুদ্রের ধারে ধারে পাহাড়তলির স্বল্প পরিসর জায়গাটি নিয়ে ৷ সেই সূত্রে দ্বীপের চারদিক ঘিরে চক্রাকার রাস্তা আছে ৷ আমাদের ইচ্ছে ছিল সারা দ্বীপটা চক্কর দিয়ে আসব কিন্তু এত বেলায় ট্যুরিস্ট বাসেরা বেরিয়ে গেছে ৷ পাবলিক বাসে করে দ্বীপ ঘুরে আসতে (১১৪ কিলোমিটার) সন্ধে হয়ে যাবে, বাস বদলাতেও হবে ৷ গৃহিণী বললেন, ‘চলো একটা বাসে চড়ে যতটা পারি ঘুরে আসি’ ৷ এই সূত্রে তাহিতি তথা ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার জাতীয় পরিবহন ল্য ট্রাকের সঙ্গে পরিচয় হল ৷ এগুলোকে বাস না বলে ট্রাক বলা হয় এই জন্যে যে চেসিসটা ছোট ট্রাকের ৷ তার ওপর যাত্রী বহনের জন্য রংচঙে কাঠের কেবিনগুলো তাহিতিতেই তৈরি হয় ৷ বসবার বেঞ্চিগুলো কিন্তু আড়াআড়ি নয় ৷ লম্বালম্বি ৷ তাতে ঝাঁকানি বেশি লাগলেও, পায়ের কাছে মালপত্র রাখবার অনেক জায়গা থাকে ৷ সমুদ্রের ধারে ধারে রাস্তা মোটামুটি একই রকম ৷ বাগান, বাড়ি, ছোট ছোট দোকান ৷ তারপর নারকোলশ্রেণী পেরিয়ে বালুবেলা, লেগুনের স্থির জল ৷ এক জায়গায় কন্ডাক্টার আমাদের হাত তুলে দেখাল, ওই দিকে ভেনাস পয়েন্ট ৷ তাহিতির উত্তরতম অংশ, যেখান থেকে ক্যাপ্টেন কুক ১৭৬৯ সালে পূর্ণগ্রাস সূর্যের ওপর দিয়ে শুক্র গ্রহের গতিসময় মেপেছিলেন ৷ মিউটিনি অব দি বাউন্টির ক্যাপ্টেন ব্লাইও এখানে প্রথম নেমেছিলেন ৷
ল্য ট্রাক চলছে থামছে ৷ লোক উঠছে নামছে ৷ একদল স্কুলের মেয়ে উঠেছে ৷ তাদের কী হাসি আর গল্প! আমাদের পাশেই একটি যুগল তখন থেকে খুনসুটি করছে ৷ মেয়েটির হাতে মাথায় কানে ফুলের বাহার, ছেলেটির নীল ড্রাগন মার্কা লাল শার্টের বোতাম খোলা, বয়সের ভারে নুয়ে এক বুড়ি কোনায় বসে চোখ পিট পিট করছে জোড়াটির দিকে, তার ওপাশে ক্লান্ত মায়ের বুক আঁকড়ে রুগ্ন ছেলেটা কাতরাচ্ছে ৷ বোধহয় শহরের হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল ৷ চারদিকের যাত্রীদের চোখে সমবেদনার দৃষ্টি ৷ ঘণ্টা খানেক পরে ট্রাক এসে থামল ছোট্ট একটি গ্রামে ৷ এখান থেকেই ওরা পাপিতে ফিরে যাবে ৷ পাণ্ডোনা উরু (ব্রেড ফ্রুট ট্রি), আম, নারকোল, কলাবাগানের ছায়ায় ঘেরা গ্রামটি, পাতার ছাউনি দেওয়া ঘরবাড়ি ৷ টিনের ছাদের তলায় গোটাতিনেক দোকান, তার মধ্যে একটা খাবার জায়গা ৷ ভাবলাম এই গ্রামে কিছুক্ষণ থাকি, ওই দোকানটায় কিছু খাই, পরের বাসে ফিরে যাব ৷ কিন্তু পরের বাস কখন যাবে তা কেউই বলতে পারল না ৷ প্রশ্নটাই যেন অবান্তর ৷ পরের বাস যখন আসবে তখন ফিরে যাবে, তার আগে তো যেতে পারে না ৷ যুক্তি অনস্বীকার্য ৷ আমরা দেখলাম এখন যে ট্রাকটা ফিরে যাচ্ছে, তাতে উঠে পড়াই ভালো ৷ খাওয়াদাওয়া না হয় পাপিতেতে ফিরে গিয়েই হবে ৷ তাছাড়া আমাদের অন্য অন্য দ্বীপ ভ্রমণের টিকিটগুলো নিয়ে নিতে হবে অফিস বন্ধ হবার আগে ৷
সেদিন সন্ধেবেলা হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখি যে সামনে স্ট্র্যান্ডের ওপর ত্বরিৎ-খাদ্যের মেলা বসে গেছে ৷ যে স্টলগুলো সকালে বন্ধ দেখেছিলাম সেগুলো তো খুলেছেই, তার পাশে পাশে ভিড় করে এসেছে মোটর ট্রাকে সাজানো খাদ্যসম্ভার ৷ চিনা খাবারই বেশি, তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আমেরিকান বার্গার, স্টেক অ্যান্ড চিপস, ইটালিয়ান পিৎজা ৷ কয়েকটি ইংরেজ ছেলেমেয়ের ক্রেপসের দোকানে বেজায় ভিড় ৷ চা-কফি-আইসক্রিমের জন্য আলাদা স্টল, সেখানে পথিকদের যাতায়াত ৷ অন্যগুলিতে বসবার জায়গা আছে ৷ বার বা পানশালা চোখে পড়ল না ৷ তা না থাক ৷ হাসি, গল্প, গান, আলো, খোলা উনুন, হট প্লেট, তাওয়ার ওপর সামনে তৈরি খাদ্যের সুঘ্রাণে জায়গাটা তাজা হয়ে আছে ৷ আমরা রাতের খাওয়া এখানেই সারলাম ৷ দশটা নাগাদ যখন হোটেলে ফিরছি তখন দেখি হোটেলের আশপাশে নাইট ক্লাবগুলোতে সবে চেয়ার টেবিল গোছগাছ করছে ৷ দুয়েক জায়গায় পোস্টার রয়েছে যে রাত বারোটায় হুলা নাচের আসর ৷ যারা নাচতে চায় বা নাচ দেখতে চায় দু-দলকেই সাদর আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে ৷ আমাদের পরদিন বেশ সকালে উড়োজাহাজ ধরতে হবে ৷ হুলাকে পাশ কাটিয়ে হোটেলে ঢুকলাম ৷
ভারি মালপত্র হোটেলে জমা রেখে দুজনে দুটি হাত-পোঁটলা নিয়ে যখন ট্যাক্সিতে উঠলাম সূর্য তখনও পাহাড়ের আড়ালে ৷ মালের রসিদ চাইতে হোটেল ডেস্কের লোকটি বললে, ‘রসিদ আবার কী? তোমরা যে ঘরে মাল রেখে গেলে ফিরে এসে সেখান থেকে আবার তুলে নেবে ৷ এরমধ্যে কোনও লেখাপড়ার দরকার নেই ৷’ ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করে বেরিয়ে পড়লাম ৷ ফা-আ আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের পাশেই এয়ার তাহিতির ল্যান্ডিং স্ট্রিপস ৷ মিনি এয়ারপোর্টটি পরিপাটি সাজানো ৷ কাউন্টারগুলিতে ফুলের বেড়া, ওপাশে চা কফি কোকাকোলার স্টলটি ফুলের গহনায় কনেবউ সেজে বসে আছে ৷ আমাদের গন্তব্য হল সোসাইটি দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে কাছের দ্বীপ হুয়াহিনে, কিন্তু ওয়েটিং রুমে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল বিপরীত দেওয়ালে বোরাবোরার বিরাট ছবিতে ৷ সার্থক সেই ফটোগ্রাফার যার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে স্বল্পায়তন দ্বীপের সবুজ সমতল থেকে খাড়া উঠে যাওয়া মাউন্ট ওটেমাপুর ভ্রূকুটিকুটিল ভয়াল মূর্তি ৷ খালি চোখেও এ দৃশ্য দেখা যায় কেবলমাত্র একটি বিশেষ কোণ থেকে যেখানে লেগুনের জল খাড়ি বেয়ে প্রায় পাহাড়ের কিনারায় পৌঁছেছে ৷ বসে বসে দেখলাম ছোট দুটি ডানা মেলে, গুড়গুড়ে চাকায় ভর করে মিনিবাস সাইজের একটি প্লেন ওয়েটিং রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল ৷
এবার আর নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্র নয় ৷ মাঝে মাঝেই ছোট ছোট পাথুরে দ্বীপ, কুমিরের পিঠের মতো নিমজ্জিত শৈলের শীর্ষভাগ চোখে পড়তে লাগল ৷ কোনওটাতেই লোকবসতি নেই ৷ তবু ডাঙা তো ৷ আধঘণ্টার পথ সহজে শেষ হল, পাঁচ হাজার ফুট নিচে হুয়াহিনে যেন নীল ফ্রেমে আঁটা একটি সবুজ ছবি ৷ আগাগোড়া পাহাড়ি দ্বীপ, ওপর থেকে বোঝা যায় যে আসলে হুয়াহিনে দুটো দ্বীপ, কজওয়ে দিয়ে জোড়া ৷ একই কোরালের বলয় দুটো দ্বীপকে ঘিরে রেখেছে ৷ সোসাইটি দ্বীপবাসীদের ভেতর হুয়াহিন-ওয়ালাদের গোঁয়ার বলে খ্যাতি আছে ৷ উনিশ শতকের মাঝামাঝি যখন এসব দ্বীপের দখল নিয়ে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের ভেতর ঝটাপটি চলছিল তখন হুয়াহিনের গোবিন্দরা বলে বসলেন, আমরা তোমাদের কাউকে চাই না ৷ শুধু তাই নয়, এক ফরাসি হানাদার বাহিনীকে স্রেফ বল্লমের খোঁচায় আর মুগুর দিয়ে পিটিয়ে হটিয়ে দিল ৷ জেদ অবশ্য স্থায়ী হয়নি কিন্তু এই দ্বীপগুলির মধ্যে হুয়াহিনেই ফরাসি দখলে আসে সকলের শেষে ১৮৯৭ সালে ৷ বইতে পড়েছিলাম যে অপর সব দ্বীপ বিদেশি ট্যুরিস্ট নিয়ে নাচানাচি করলেও, হুয়াহিনে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে তার কৃষিবহুল গ্রামীণ জীবন নিয়ে ৷ একদিনে সে জীবনের পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয় ৷ কিন্তু সমস্ত হুয়াহিনেতে বড় গ্রাম মাত্র একটি-ফারে-এ, এয়ারপোর্ট, জাহাজঘাটা ঘেঁসে ৷ শহর বলতে কিছু নেই ৷ পাঁচতারা, সাততারা হোটেলও নেই ৷
আমাদের গেরস্থপোষা হোটেল রিলে মাহানা দ্বীপের অন্য প্রান্তে ৷ উড়োজাহাজ থেকে নেমে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সমুদ্রের খাঁড়ি ঘুরে ঘুরে সেখানে পৌঁছলাম ৷ দুটি দ্বীপের মাঝখানে কজওয়ে পার হবার সময়ে দুদিকে সমুদ্র ৷ হোটেলটি যেন কণ্বমুনির আশ্রম ৷ ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, কয় ছেলে-বৌ, মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি নিয়ে এক ফরাসি পরিবার হোটেলটি চালাচ্ছেন ৷ সবাই হোটেলে কাজ করে ৷ সুখের বিষয় যে মুনি স্বয়ং ধ্যান তপস্যা না করে কোনও ক্লায়েন্টের সঙ্গে শর্টস পরে টেনিস খেলছিলেন ৷ দুপাশে দুটি ইউক্যালিপ্টাস গাছের তোরণ পেরিয়ে লেগুনের ধার জুড়ে বাগান ৷ তারই মাঝে প্রত্যেক অতিথি বা অতিথি-যুগলের জন্য আলাদা আলাদা পলিনেশিয়ান টাইপের কুটির, স্থানীয় ভাষায় ফারে-এ টাওপি ৷ কুটিরে একটি করে প্রমাণ সাইজের শোবার ঘর, সংলগ্ন বাথরুম ৷ সামনে ঢাকা বারান্দায় আরাম করে বসবার বেতের চেয়ার ৷ বারান্দার কোলে দুজনের একান্ত নিভৃতের জন্য ছোট্ট একটি বাগান ৷ কুটিরের মেঝে সিমেন্ট, দেওয়াল ইটের কিন্তু ছাউনিটি পাতার-নারকোল, পান্ডোনাস, নানারকম ঘাস, লতা, নারকোল দড়ি দিয়ে শক্ত করে গাছের ডালপালার ফ্রেমে বাঁধা ৷
ভাগ্যক্রমে লেগুনের ওপরে প্রথম সারিতে একটা ঘর পেয়ে গেলাম ৷ বোঝা নামিয়ে, হালকা জামাকাপড় পরে এসে বসলাম বারান্দায় ৷ এখানে রিফের ভেতরে ছোট ছোট শিলাখণ্ডের মতো দ্বীপ, ওদেশি ভাষায় মোটু ৷ কখনও সমুদ্রে প্রেমিক-যুগল সাঁতার কাটে বা রবারের ভেলায় চেপে ওখানে গিয়ে নিরিবিলি সূর্যস্নান করে ৷ কোথাও কোনও মৎস্যাশী জলের ধারে অচঞ্চল বকের মতো বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে, কাচের চেয়েও স্বচ্ছ জলে বহু দূর পর্যন্ত মাছের ঘোরাফেরা দেখতে পাওয়া যায় ৷ পলিনেশিয়া ছিপের ব্যবহার জানত না, যদিও গাছের ছাল দিয়ে তৈরি জালের বহুধা প্রচলন ছিল ৷ লেগুনের টলমলে জলে দূরে-কাছে নানা রকমের জলযান, মোটরবোট, স্পিড বোট ৷ কিন্তু সবচেয়ে চোখে পড়ে পলিনেশিয়ার যা বৈশিষ্ট্য সেই বিখ্যাত আউটরিগার ক্যানো ৷ আমাদের দেশের তেলো ডোঙার সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য আছে ৷ কেবল নৃত্যপরা সমুদ্রের ঢেউতে স্থির থাকবার জন্য দুটি কাঠের খুঁটি ক্যানোর ওপরে আড়াআড়িভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৷ সেই খুঁটি দুটির প্রান্তে মানে ক্যানো থেকে পাঁচ-ছ হাত তফাতে আরেকটি কাঠের গুঁড়ি বা তক্তা লাগানো, যেটা জল স্পর্শ করছে ৷ সব বাঁধাবাঁধির কাজ নারকোল দড়িতে ৷ পেরেকের ব্যবহার নেই ৷ ভাবলাম বারান্দার সামনে স্বল্প পরিসর বালিয়াড়িটি পেরিয়ে একেবারে জলের কিনারে গিয়ে ঝিনুক কুড়োই ৷ কিন্তু ফিরে আসতে হল ৷ সারি সারি মুক্তবক্ষা এবং ক্বচিৎ মুক্তদেহা রমণী বালিতে তোয়ালে বিছিয়ে সূর্যস্নান করছেন ৷ সেখানে আমার মতো আবৃতদেহ পুরুষের ঘুরে বেড়ানোটা অনধিকার প্রবেশ হবে ৷ পরে হোটেলে খেতে গিয়ে ওখানকার জনৈকাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হুয়াহিনে মানে কী ৷ তিনি জবাব দিলেন, কামিনীর কামকলা ৷
হুয়াহিনেতে যেখানে আমরা ছিলাম সেখানে দোকানপসার, হাটবাজার কিছু নেই ৷ দুবেলাই হোটেলের আহার ৷ ফরাসি রান্না ৷ তবে আমাদের মতো ইতরজনের জন্য স্যান্ডউইচের বন্দোবস্ত আছে ৷ দুপুরে পয়সা বাঁচাবার জন্য তাই খেলাম ৷ রাত্রিতে পরিপাটি ফরাসি খানা ৷ অভাব ছিল খালি সুরার ৷ পলিনেশিয়ার এসব দ্বীপ ফরাসি অধ্যুষিত হলেও সুরা মহার্ঘ্য ৷ সুরা সূত্রে জানিয়ে রাখি যে, পলিনেশিয়ানরা সুরাঘটিত পানীয় তৈরি করতে জানত না ৷ ওদের আনন্দের ভাণ্ড ছিল এবং এখনও আছে গোলমরিচের লতাপাতা বেটে তৈরি কাভা ৷ অ্যালকোহল নয়, এলকালয়েড ৷ নেশাটা সিদ্ধির মতো ৷ আমাদের সোমরস আর কী ৷ পলিনেশিয়ানদের খাদ্য ছিল স্বচ্ছন্দ বনজাত ফল, মূল, কন্দ, কলা, টাবো, ইয়াম, রাঙা আলু আর সকলের ওপরে উরু বা ব্রেড ফ্রুট ৷ ভুতো বোম্বাই আমের সাইজে চিরসবুজ ফলগুলি আগুনে সেঁকে খোসা ছাড়িয়ে খেলে পাউরুটির আস্বাদ আসে ৷ চারদিকে ছড়ানো অজস্র গাছে পাউরুটি ফলে আছে ৷ আমরা ব্রেড ফ্রুট, ব্রেড ফ্রুট গাছ সবই দেখলাম কিন্তু ফলটি আস্বাদ করার সুযোগ হল না ৷ তখন ফলগুলি কাঁচা ৷ এছাড়া রয়েছে লেগুনের জলে অফুরন্ত মাছ, কাঁকড়া, গেঁড়ি, গুগলি, শামুক, পলিনেশিয়ার সবুজ কচ্ছপ ৷ কচ্ছপের পবিত্র মাংসে (সুস্বাদুও বটে) মেয়েদের অধিকার ছিল না ৷ মেয়েদের মন রাখবার জন্য এখানে একটা কথা বলি ৷ মার্কুইস দ্বীপের লোকেরা দেবতার প্রীত্যর্থে নরবলি দিত ৷ নারীদের বলি হবার অধিকার ছিল না ৷ ইউরোপিয়ানরা আসার আগে এ সব দ্বীপে মাংসের খুব চল ছিল না ৷ মাংস জোগাবার মতো বড় প্রাণীরও উৎপত্তি হয়নি এসব ছোট ছোট দ্বীপে ৷ এদের পূর্বপুরুষরা এদেশে বসবাস করতে আসার সময়ে যে কটি শুয়োর এবং কুকুর আনতে পেরেছিল, তাদেরই লালন পালন করে মাংসের অভাব মেটাত এরা ৷
সন্ধেবেলা হোটেলের লাউঞ্জে দেখি, যে ড্রাইভার আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এসেছিল সে বসে আছে ৷ কালকেও ও-ই কাণ্ডারী ৷ কথায় কথায় জানলাম যে একটু আগে বেরোলে এবং সামান্য বেশি খরচ করলে ও আমাদের রাস্তায় ফারে-এ গ্রাম আর তার কাছে হুয়াহিনের বিখ্যাত মারে-এ দেখিয়ে দেবে ৷ ফারে-এ গ্রামে এমন কিছু দেখবার জিনিস নেই ৷ জাহাজঘাটাকে ঘিরে কতকগুলো টিনের দোচালা-চিনেদের দোকান, দুটো কফিখানা, কোপরা মানে রোদে শুকনো নারকোলের শাঁস চালান দেবার ডিপো, নারকোল দড়ি পাকানো এবং নারকোল দড়ির তৈরি পাপোশ, ব্যাগ ইত্যাদি বানাবার কারখানা-এই নিয়ে ফারে-এ ৷ ঘাটে জাহাজ লাগলে যা একটু হৈ চৈ, বাকি সময় রোদে শুয়ে বসে ঝিমোনো ৷ কিন্তু মারে-এ তে পৌঁছে মনে পড়ল হৃতগৌরব বৃদ্ধ সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্না বীরবর্দ্দীর পূর্বপুরুষদের সমাধিক্ষেত্রের কথা ৷ লেগুনের কিনারায় অনেকটা জায়গা জুড়ে আস্ত আস্ত পাথরে গাঁথা আহু বা দেবক্ষেত্রের পাঁচিল ৷ ভেতরে এক ধারে স্টেপস পিরামিডের আকারে মানুষ প্রমাণ উঁচু চতুষ্কোণ ধর্মবেদী, যার মাথায় প্রশস্ত চাতালে জল, মাটি, আকাশের দেবতা এবং পূর্বপুরুষদের জন্য খাদ্য পানীয় সম্ভার রাখা হত ৷ ধর্মবেদীর চারপাশে ছোট বড় নানারকম পাথর পোঁতা, এগুলো হয়তো বা সমাধিচিহ্ন ৷ অন্য জায়গায় স্থানে স্থানে মানুষ বসবার বেদী,পাথর বাঁধানো আঙিনা, কোথাও বা চালাহীন খুপরি খুপরি ঘর ৷ মারে-এ তো কেবল দেবস্থল নয়, এটা একাধারে চণ্ডীমণ্ডপ, গ্রাম-বৃদ্ধদের জটলার জায়গা, আবার পর্বদিনের উৎসবক্ষেত্রও বটে ৷ সারা গ্রামের প্রাণকেন্দ্র ছিল মারে-এ ৷ এখন সে প্রাণচঞ্চলতা আর নেই ৷ একশো বছরের অবহেলায় ভেঙে পড়েছে ধর্মবেদী, ধর্মক্ষেত্রের পাঁচিল, তবুও লেগুনের অবিশ্রান্ত জলকল্লোল, প্রাচীন মহীরুহদের বনমর্মর একইরকম আছে ৷
পলিনেশিয়ানরা ভাষাকে অক্ষরের বন্ধনীতে ধরে রাখতে শেখেনি ৷ ফলে গত দুশো বছরে ক্যাপ্টেন কুক প্রমুখ ইউরোপিয়ান নাবিক এবং পর্যটকরা যা লিখেছেন তার বাইরে এদের কোনও লিখিত ইতিহাস নেই ৷ আবার অক্ষরহীন সমাজ যে শ্রুতি ও স্মৃতি-পূর্বপুরুষের মুখে শোনা কথা-কাহিনী, ধর্ম, কৃষ্টি, ঐতিহ্য-বজায় রাখে তাকে সমূলে বিনাশ করল আত্মম্ভরী, সংকীর্ণমনা, খ্রিস্টান মিশনারিরা ৷ ম্যম তাঁর বিখ্যাত ‘রেন’ নামে বড় গল্পে দক্ষিণ প্যাসিফিকে মিশনারিদের কঠোর অত্যাচারের পরিচয় দিয়েছেন ৷ কাজে কাজেই গ্রামে গ্রামে মারে-এর বদলে এল ছিটেবেড়ার দেওয়ালে টিন লাগানো চার্চ ৷ দেশি পুরোহিতের জায়গা নিলেন দেশি ও বিদেশি পাদ্রীরা ৷ সুখের বিষয় এই যে ফরাসি পলিনেশিয়ার রাষ্ট্রভাষা ফ্রেঞ্চ হলেও, পলিনেশিয়ানরা নিজেদের ভেতরে নিজেদের ভাষায় কথা বলে ৷ এবং সে ভাষা এখন লেখাও হচ্ছে রোমান হরফে ৷ পলিনেশিয়ান ভাষা বাংলা ভাষার মতোই শ্রুতিমধুর ৷ কারণও এক ৷ স্বরবর্ণের প্রাধান্য ৷ যে কোনও দুটি ব্যঞ্জনবর্ণের মাঝখানে একটি স্বরবর্ণ থাকবেই এবং শব্দের শেষ অক্ষরটিও স্বরবর্ণ হবে ৷ হসন্ত নেই ৷ ক্রাইস্ট ওদের ভাষায় কিরিসতো ৷
বিখ্যাত ভূপর্যটক এবং লেখক জেমস মিচেনারের মতে, বোরাবোরা পৃথিবীর সুন্দরতম দ্বীপ ৷ সতর্কবাণী হল এই যে ‘হে পথিক যদি পৃথিবীর সুন্দরতম দ্বীপটিকে সমগ্রভাবে দেখতে চাও তাহলে এয়ারপ্লেনের বাম ভাগে বসিবা’ ৷ এসব প্লেনে সিট নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা নেই ৷ এয়ারপ্লেনের দরজা খুলতেই আমি ছুটে গিয়ে বাঁদিকের এক জোড়া সিট দখল করলাম ৷ একটু পরেই গিন্নি হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির হলেন ৷ মিনিট পনেরো পরেই বাঁদিকে সবুজ উপকূল রেখা-পাহাড় বন দেখা গেল ৷ কিন্তু এ তো সে নয় ৷ এ যে অনেক ছড়ানো হাত পা খেলানো দ্বীপ ৷ ততক্ষণে মাইক্রোফোনে পাইলটের আওয়াজ এল ৷ এখন আমাদের বাঁদিকে যুগ্ম দ্বীপ রাইয়াটিয়া এবং তাহা-সা ৷ দুটি দ্বীপ ঘিরে একক কোরাল-বেষ্টনীটি লক্ষ করুন ৷ সোসাইটি দ্বীপপুঞ্জে তাহিতির পরেই রাইয়াটিয়ার স্থান এবং এক সময়ে রাইয়াটিয়া সমস্ত অঞ্চলটার প্রধান ধর্মকেন্দ্র ছিল ৷ আর দশ মিনিট পরে চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই সুপরিচিত মূর্তি ৷ স্বল্পবাসা নর্তকীর ফাঁপানো স্কার্টের মতো জমি থেকে সোজা ওপরে উঠে গেছে মাউন্ট ওটেমালু আর পাহিয়ার যুগল শৃঙ্গ ৷ এবারে কিন্তু ভয়াল মনে হল না ৷
বোরাবোরার এক চিলতে দ্বীপে এরোপ্লেন নামার মতো সমভূমি নেই ৷ প্লেন নামল মাইল তিনেক দূরে কোরাল রিফ ঘেঁসে অন্য একটি দ্বীপ মোতু মোতায় ৷ এয়ার তাহিতিই বন্দোবস্ত করে সেখান থেকে মোটর লঞ্চে করে মেন ল্যান্ডে নিয়ে গেল ৷ ওপারে পৌঁছে ল্য ট্রাকে করে যে যার ঠিকানায় যাবে ৷ বোরাবোরা পুঁচকে দ্বীপ হলে কী হবে, এ হল কোটিপতিদের লীলাভূমি ৷ এখানকার পাঁচতারা হোটেল বোরাবোরা বা মোয়ানা বিচ পার্ক রয়্যাল পৃথিবীর যে কোনও বিলাসবহুল হোটেলের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে, আর হালে খুলেছে জাপানি পরিচালনায় বোরাবোরা লেগুন রিসর্ট, পুরো একটা মোটু নিয়ে ৷ এ হোটেল এত নাক উঁচু যে এখানকার কর্মচারীদের মধ্যেও দিশি মুখ খুব কম চোখে পড়বে ৷ এদের হোটেলের যে লঞ্চ অতিথিদের পারাপার করে তাতে দেশি লোককে উঠতে দেয় না ৷ আমাদের অত সাধ বা সাধ্য নেই ৷ আমরা গিয়ে উঠলাম বোরাবোরা মোটেলে ৷ তাও, ওদের বাংলো বা ফারে-এ তে নয় ৷ আমরা রইলাম পাশাপাশি দুটো কামরার কোঠা বাড়িতে ৷ অবশ্য প্রত্যেক কামরাই পরিপাটি সাজানো ৷ প্রত্যেকটির সঙ্গেই একটি করে কিচেনেট, বাথরুম এবং তার বাইরে সমুদ্রমুখী খোলা বারান্দা ৷
হুয়াহিনের মতো নিঃসঙ্গপুরী নয় এটা ৷ মোটেলের দুপাশেই অন্য অন্য হোটেল ৷ সামনে বেশ কয়েকটা দোকান রেস্টুরেন্ট ৷ রাস্তায় দেশি-বিদেশি লোকের যাতায়াত ৷ দলবেঁধে সাইকেল যাত্রা ৷ দুপুরে রেস্টুরেন্টে খেয়ে একটু গড়িয়ে বিকেলের আলোয় বেড়াতে বেরোলাম ৷ আধ মাইলটাক যেতেই দুদিকের বাড়িঘর পাতলা হয়ে এল ৷ ঝোপঝাড়, কলাগাছের জঙ্গল, তার মাঝে হঠাৎ একটা হলদে কাঠের বোর্ডে লাল অক্ষরে লেখা কাফে মোয়ানা ৷ চায়ের সময়ও হয়েছে ৷ বেড়ার মধ্যে ঢুকে দেখি ফালি মতো একটা পাতায় ছাওয়া ঘর, হাই বেঞ্চির মতো কাউন্টার এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত ৷ তার ওপাশে চা-কফির জোগানদার সাজসরঞ্জাম নিয়ে দাঁড়িয়ে ৷ সামনে মোটা মোটা কাঠের কুঁদোর ওপর বসবার জায়গা ৷ রং কালো হলেও লোকটার মাজা ঘষা একহারা চেহারা, বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ৷ কিছু এশিয়ান রক্ত থাকা অসম্ভব নয় ৷ ভাঙা ইংরিজি বলে ৷ চা খেতে খেতে গল্পগাছা হল ৷ ওরা বোরাবোরার মানুষ ৷ মাঝখানে কয়েক বছর পাপিতেতে ছিল ৷ সেখানেই ইংরিজি শেখা ৷ এই চায়ের দোকানের পিছনেই খানিকটা খোলা জায়গায় ওর বাড়ি, বাগান ৷ সেখানে বউ আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ওর সংসার ৷ বড় ছেলেমেয়ে দুটি স্কুলে যায় ৷ সরকারি স্কুল ৷ বাস আছে ৷ তবে কি জানো, সব কিছু ফরাসি ভাষায় শেখানো হয় ৷ নিজেদের ভাষার কোনও চর্চা নেই, এমনকী বিদেশি ভাষার ক্লাসও নেই ৷ ছেলেমেয়েগুলো যা তৈরি হচ্ছে ৷ ভাষা ফরাসি, ধর্মে খ্রিস্টান আর টিভির কল্যাণে আচারে ব্যবহারে আমেরিকান ৷ নিজ দেশের কিছুই পেল না ওরা ৷ জিজ্ঞেস করলাম, প্রশান্ত মহাসাগরে বহু দ্বীপ তো স্বাধীন হল, তাহিতি পিছনে পড়ে রইল কেন ৷ ওর মতে, স্বাধীন যারা হল সে সব জায়গায় বিদেশিদের আর পোষাচ্ছিল না ৷ অন্যদিকে দেখ গুয়াম, সামোয়া আমেরিকানদের তাঁবেই থাকতে চায় আর হাওয়াই তো নাম লিখিয়ে পুরোপুরি আমেরিকান হয়ে গেল ৷ আমাদের কপালে কী আছে কে জানে!
আমি কিন্তু হতাশ হইনি ৷ দেড়শো বছরের পরাধীনতা, মিশনারি এবং সরকারি কর্মচারীদের হাতে দেশের ধর্ম, কর্ম, রীতি, নীতির নির্দয় দলন দুলক্ষ লোকের দ্বীপগুলিতে বাৎসরিক দশলক্ষ ট্যুরিস্টের আনাগোনা সত্বেও তাহিতির লোকেরা বজায় রেখেছে তাদের স্বাতন্ত্র্য, সহৃদয়তা, স্বভাব ও আচরণের মৃদুতা যার উল্লেখে ১৮৩৯ সালে চার্লস ডারউইন মন্তব্য করেছিলেন, এদের বর্বর কে বলে? বুদ্ধি বিবেচনায় এদের সভ্যতা যথেষ্ট উন্নত ৷ বিদায় নিয়ে যখন উঠছি, লোকটি টুক করে ভেতরে গিয়ে পাঁচটি সুপক্ক রম্ভা নিয়ে এল ৷ ‘আমার বাগানের কলা ৷ তোমরা খেয়ো ৷ এর দাম দিতে হবে না ৷’ চিরকালের পলিনেশিয়া ৷
সেইদিন সন্ধেবেলা বিদেশিদের কাছে আরেক রকম গল্প শুনলাম ৷ গৃহিণীর একটা পারেয়ো কেনবার শখ ৷ ঝলমলে এক কাপড়ের দোকানের মালিক মেমসাহেব ৷ পরিষ্কার ইংরিজি বলেন ৷ উনি এবং ওঁর স্বামী দুজনেই আর্জেন্টিনার লোক, তবে ওঁর স্বামী সিনেমা টেকনিশিয়ান হিসাবে বহুদিন হলিউডে ছিলেন ৷ ২০-২৫ বছর আগে টাইফুনের ছবি তোলার জন্য এক সিনেমা দলের সঙ্গে ওঁরা তাহিতিতে আসেন এবং এখানেই মানে বোরাবোরায় থেকে যান ৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তখন আমাদের সেই ছেলেবয়সে, পৃথিবী পরিক্রমার বাইরে এই চির বসন্তের দেশে থেকে যাওয়াটা বেশ মজার মনে হয়েছিল ৷ এখন ঠেকে শিখেছি যে ভালো করিনি ৷ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধা নেই, সমাজ নেই, সঙ্গী নেই, অসুখে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই-আর জিনিসপত্রের কী দাম, এর তুলনায় ইউরোপ সস্তা, আমেরিকা আরও সস্তা ৷’
‘জিনিসের যদি এত দাম তো দেশি লোকেরা চালায় কী করে?’
‘ওরা! ওদের আবার কিছু কিনতে হয় নাকি ৷ গাছে কলা, নারকোল, ব্রেড ফ্রুট, রাঙা আলু, লেগুনে মাছ, বাড়িতে মুরগি, হাঁস, শুয়োর পোষে ৷ বাড়ি তো নিজেরাই তৈরি করে পাথর, গাছের ডালপালা পাতা-লতা দিয়ে ৷ প্রত্যেকেরই নিজের নিজের জমি বাগান আছে ৷ কিনতে যদি হয় তো বড়জোর দু-চার টুকরো কাপড় ৷ আগেকার দিনে তাও লাগত না, নরম গাছের ছাল পিটিয়ে নিজেদের পরবার জন্য টাপা কাপড় তৈরি করে নিত ৷’
ক্যাপ্টেন কুকের খেদোক্তি মনে পড়ল, ‘আমাদের একেবারে না জানলে এদের আরও ভালো হত ৷’
ম্যাপে মুরিয়া দ্বীপকে দেখায় ঠিক যেন একটি প্রজাপতি পাখা মেলে রয়েছে ৷ দুদিকে নাকের খাঁজ-দুই খাড়ি, একটি কুকস বে অন্যটি ওপুনহু বে ৷ দুই খাড়ির মাঝখানে আড়াই হাজার ফুট উঁচু মাউন্ট রোতুই যেন জলের ভেতর থেকে সোজা ওপরে উঠে গেছে ৷ দ্বীপের চারদিক ঘিরে রাস্তা এবং এই সব রাস্তার ধারে ছোট ছোট গ্রামবসতি, হোটেল রিসর্ট ৷ মুরিয়ায় কোনও শহর নেই ৷ এয়ারপোর্ট মুরিয়ার উত্তর-পূর্ব কোণে ৷ হোটেল মুরিয়া ভিলেজ উত্তর-পশ্চিমে ৷ লম্বা রাস্তা ধরে খাড়ি দুটি ঘুরে হোটেলে পৌঁছলাম বেলা প্রায় বারোটায় ৷ বেশ জায়গাটা ৷ একটু ট্যুরিস্টি বটে, তবে জীবন্ত ৷ লেগুনের কিনারা ঘিরে কয়েকটা হোটেল ৷ হাইরাইজের জটলা নেই ৷ নিজের বিস্তৃত এলাকায় ছোট ছোট ব্লক, কুটিরের সমষ্টি ৷ তার ওপরে আছে ক্লাব মেডিটারেনিয়ানের তিনশো কুটির নিয়ে সুবৃহৎ পান্থনিবাস ৷ এদের দেখাশোনা করবার জন্য রাস্তার ধারে আধ মাইল ছড়িয়ে দোকান, বাজার, সুপার মার্কেট, বার, রেস্টুরেন্ট ৷ হালে তৈরি হয়েছে প্যতিত ভিলেজ শপিং সেন্টার ৷ আমেরিকান ম্যালের মতো হলেও, তার বহিরাবরণ অত কুৎসিত নয় এবং সব একতলা ৷ এখানেই প্রথম দেখলাম দুটি পিকচার গ্যালারি ৷ দেশি-বিদেশি আর্টিস্টদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী ৷ বহু ছবিকার পাপিতের গণ্ডগোল থেকে পালিয়ে এখানে বাসা করেন ৷
এখানেও আমরা লেগুনের ধারে কুটির পেলাম ৷ দুপুরে খাওয়া, শোয়া, তারপর কুটিরের বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ অলস বিলাসে কাটিয়ে চা খাবার নাম করে বেরোলাম ৷ পয়সা বাঁচাবার জন্য সুপার মার্কেটে একটা ক্রোয়াসঁ (সুস্বাদু ফরাসি ব্রেড রোল) কিনে চায়ের স্টলে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তাদের স্টলে চায়ের সঙ্গে বাইরে কেনা জিনিসটি খেতে পারি কি না ৷ স্বচ্ছন্দে ৷ কিন্তু চা আসবার পরে ক্রোয়াসঁটি মুখে দিয়ে ভালো লাগল না ৷ কেমন যেন শক্ত পোড়া পোড়া ৷ চাওয়ালাকে বললাম, ‘বাপু তোমাদের দেশে ক্রোয়াসঁটি সুবিধার নয় ৷’
‘ওটা তো তোমরা সুপার মার্কেটের ক্রোয়াসঁ খাচ্ছ ৷ আমার নিজের বেক করা জিনিসটি খেয়ে দেখো ৷’
দেখলাম ৷ সত্যিই ভালো ৷ ততক্ষণে অবশ্য লক্ষ করেছি যে লোকটি পলিনেশিয়ান তো নয়ই ৷ ইউরোপিয়ানও নয়, অথচ ফর্সা রং, কোঁকড়া চুল, একহারা হিলহিলে চেহারা, মুখে বসন্তের দাগ ৷ ওর জন্ম কায়রোর কাছে নীল নদের ধারে কোনও গ্রামে ৷ সেখান থেকে রুজি রোজগারের সন্ধানে যুগোস্লাভিয়া গিয়েছিল ৷ গৃহযুদ্ধের উৎপাতে যুগোস্লাভিয়া থেকে গেল অস্ট্রেলিয়া ৷ ওখানে খুব সুবিধা হল না বলে মুরিয়াতে এসে দোকান খুলেছে ৷ আমরা ইজিপ্ট গিয়েছি শুনে খুব খুশি ৷ বললে, আমিও দেশে ফিরে যাব ৷ মুরিয়াতে দোকানটা ভালো চলছে না ৷ ভাবছি ফিজি চলে যাব ৷ সেখানে না হয়, ম্যানিলা, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর আছে ৷ কোথাও কিছু না হলে দেশে তো কয়েক কাঠা জমি-জিরেত যা হয় আছে ৷ আমার মনে হল লোকটা জন্ম-যাযাবর ৷ কোথাও নোঙর ফেলতে চায় না ৷
পরদিন বাস কোম্পানিকে বলে রেখেছিলাম দ্বীপ ভ্রমণে যাব ৷ দ্বীপ ঘোরা তো হবেই, তার সঙ্গে ওরা নিয়ে যাবে মুরিয়ার মাঝ বরাবর সুবিশাল ক্যাথিড্রালের মতো দেখতে আড়াই হাজার ফুট উঁচু মাউন্ট মুরারোয়ার গায়ে তৃণভূমির ওপরে, বেলভিডিয়ারে ৷ এখানে দাঁড়িয়ে সারা মুরিয়ার বনতৃণপর্বতভূমি দেখা যাবে ৷ আর দেখা যাবে প্রাচীন দিনের একটি মারে-এ যেটাকে পুনর্নির্মাণ করে নবকলেবর দেওয়া হয়েছে ৷ এর ওপর বোনাস হল মুরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব কোণ দিয়ে যাওয়ার সময় বড় মাছের পিঠের কাঁটার মতো পাহাড়ের খাঁজকাটা গিরিশ্রেণীর এপার থেকে ওপারে বারো মাইল দূরে তাহিতির উপকূল পর্বতমালার দৃশ্য ৷ তবে লোকে বলে তাহিতির দিক থেকে মুরিয়ার উপকূল আরও সুন্দর দেখায়, বিশেষ করে সূর্য অস্ত যাবার সময় ৷
কিছুই হল না ৷ পরদিন সকাল থেকে বৃষ্টি ৷ গাছের ডাল নোয়ানো, পাতা ঝাঁকানো শন শন হাওয়া ৷ মেঘে মেঘে সামনের পাহাড়টার আধখানা ঢেকে গেল ৷ সকাল থেকে সেজে গুজে বসে আছি ৷ সাড়ে আটটা, নটা, সাড়ে নটা ৷ বাস আর আসে না ৷ দশটা নাগাদ হোটেল থেকে বললে যে ট্যুর বাস আজকে আর বেরোবে না ৷ বেরিয়েই বা কী করবে ৷ বৃষ্টির ঝাপটে কোথাও নামা যাবে না ৷ কিছু দেখা যাবে না ৷ কী আর করি ৷ হোটেল থেকে একটা ছাতা ধার করে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম ৷ রাস্তায় আসতে না আসতে একটি ল্য ট্রাক এসে থামল ৷ দুঘণ্টা অন্তর অন্তর এরা ক্লাব মেডিটারেনিয়ানের সামনে থেকে জাহাজঘাটায় যায় ৷ জাহাজঘাটাই সই ৷ তারপর সেই পুরনো রাস্তা ধরে ওপুনোহা বে, কুকস বে পেরিয়ে জাহাজঘাটা প্রায় একঘণ্টার রাস্তা ৷ রাস্তায় পাপেটোয়াই গ্রামে বাস একটু থামল ৷ মুরিয়ায় ভ্যানিলা চাষের কেন্দ্র এটি ৷ একটি মিউনিসিপ্যাল মার্কেট আছে ৷ কিন্তু বৃষ্টির দৌরাত্ম্যে নেমে কিছু দেখা হল না ৷ জাহাজঘাটায় এমন কিছুই দেখবার নেই, তবে ওখানে পৌঁছে একটা বহু পুরনো কথা মনে পড়ল ৷ অনেক ছেলেবেলায়, এক ভোরে ঝাঁঝাঁ স্টেশনে ট্রেন থামতে, তখনকার মুগ্ধ চোখে দেখেছিলাম কেমন স্টেশনের পাশ ঘেঁসে পাহাড়টা সোজা ওপরে উঠে গেছে ৷ এখানে জেটির পাশে রাস্তার ওপারে তেমনই একটা পাহাড়, আরও সবুজ আরও উঁচু ৷ জাহাজঘাটায় ডাব বিক্রি হচ্ছে ৷ একটা চাইতে ডাবের মুখ কেটে সেখানে একটা সাদা ফুল গুঁজে হাতে তুলে দিল ৷ স্ট্র-এর বাক্সে হাত দিয়েছে, আমি তাকে ইঙ্গিতে নিরস্ত করে ডাবের মুখে মুখ লাগিয়ে চোঁচোঁ করে খেতে শুরু করলাম ৷ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাণ্ড দেখে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের চোখ কপালে ওঠে আর কি!
পরদিন আবার তাহিতি ৷ যে প্লেন আমাদের তাহিতি নিয়ে এল সেটা মিনিবাসও নয়, বরং মারুতি ওমনি ৷ পাশাপাশি দুজন করে মোট আটটি লোক বসে প্লেনের মাঝখানে ৷ প্লেনের দুদিকে দরজা ৷ দুজন করে লোক দুদিক থেকে ওঠে ৷ সিঁড়ির দরকার হয় না ৷ পাইলট প্লেনের সামনে অটোরিকশার মতো সিটে ৷ প্লেনে মাইক্রোফোন দরকার হয় না ৷ সবাই উঠতে পাইলট বলল, তোমাদের মালপত্র আমাদের পরের ফ্লাইটে বড় প্লেনে, মানে মিনিবাসে আসবে মিনিট পনেরো পরে ৷
আরও তিনটি জিনিস দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময়াভাবে প্রথম দুটি দেখা হয়ে উঠল না ৷ প্রথমটি হল গঁগা মিউজিয়াম ৷ এটি দ্বীপের উল্টোদিকে মাতাইয়া গ্রামে, যেখানে গঁগা কয়েক বছর বসবাস করেছিলেন ৷ ট্যাক্সিতে দুঘণ্টার রাস্তা ৷ গঁগার পেন্টিং এখানে কিছুই নেই তবে তাঁর নিজের ব্যবহারের কয়েকটি জিনিস, কাঠখোদাই কাজ, সিরামিক্স রেখে দেওয়া হয়েছে ৷ দ্বিতীয়টি, মার্লোন ব্র্যান্ডোর দ্বীপ ৷ ১৯৬২ সালে ব্র্যান্ডো তাহিতিতে আসেন দ্বিতীয় ‘মিউটিনি অব দি বাউন্টি’ ছবিটি তোলার জন্য ৷ তাহিতির মুক্ত জীবনযাত্রা ব্র্যান্ডোর এত পছন্দ হয় যে তিনি তাঁর ছবির নায়িকা তাহিতির মেয়ে তারিতাকে বিয়ে করে তাহিতি থেকে আধঘণ্টা দূরে কয়েকটি মোটু কিনে সেখানে বসবাস করেন ৷ এ ভালোবাসার পরিণতি বড় ভয়ঙ্কর হয়েছিল, কিন্তু সে অন্য গল্প ৷ ব্র্যান্ডো এখন আর নেই ৷ ১৯৮৩ সালের হ্যারিকেন তাঁর সুখাবাসের বহু অংশ ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৷ কিন্তু তারিতা এখনও সেখানে বাস করেন ৷ যেটুকু অংশ বাকি আছে ট্যুরিস্টরা এখনও তা দেখতে যায় ৷ তৃতীয় দর্শনীয় বিষয়টি হল তাহিতির উত্তর-পশ্চিম উপকূলে বসে মুরিয়ার মাছের পিঠের কাঁটার মতো খাঁজকাটা গিরিশ্রেণীর ওপারে সূর্যের অস্তগমন দেখা ৷ এটি দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল ৷ সূর্যাস্তের বহুল বর্ণনা দিয়ে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাব না, কিন্তু যখন পাহাড়ের এপারের আকাশ অন্ধকার হয়ে অস্তসূর্যের ম্যাজেন্টা রং ওপারে ছড়িয়ে পড়ল তখন মনে হল দ্বীপের আদি অধিবাসীরা ঠিকই বলত ৷ দ্বীপের মৃত আত্মারা এই সময়েই অন্ধকার থেকে চির আলোর দেশে চলে যায় ৷
তাহিতির কথা শেষ করবার আগে, আরও দুটি বিষয়ে সামান্য কিছু বলা দরকার ৷ এক হল ভুবনবিখ্যাত হুলা নাচ ৷ অন্যটি হল গাত্রচর্মের ওপর কালির ফুটকি দিয়ে ছবি আঁকা ট্যাটু ৷ ট্যাটু শব্দটাই এসেছে পলিনেশিয়া থেকে ৷ আঠেরো শতকের আগে ইউরোপে ট্যাটুর প্রচলন ছিল না এবং তখনকার নাবিকেরা পলিনেশিয়ানদের বিচিত্রিত অঙ্গশোভা দেখে চমৎকৃত হয়েছিল ৷ আর সে অঙ্গশোভা সারা শরীর জুড়ে, বিশেষ করে পুরুষদের ৷ মার্কুইস আইল্যান্ডে জিভেও ট্যাটু করা হত ৷ আসলে বসনবৈচিত্র্যের অভাব পলিনেশিয়ানরা মিটিয়েছিল ট্যাটু দিয়ে ৷ আর নাচ হল পলিনেশিয়ানদের জীবনধারার অভিব্যক্তি ৷ গ্রামের ছেলেবুড়ো স্ত্রী-পুরুষ সবাই মিলে এ নাচ নাচত, এমনকী নপুংসকরাও বাদ যেত না ৷ তবে নপুংসকদের স্ত্রীলোকের সঙ্গে নাচবার অধিকার ছিল না ৷ আর সে কত রকমের নাচ ৷ পূজা, যুদ্ধবিগ্রহ, অতিথি অভ্যর্থনা-প্রত্যেক বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা নাচ ছিল ৷ হুলা নাচ হত সৃষ্টিদেবতার উদ্দেশে এবং তাতে কিছুটা আদিরসও মেশানো থাকত ৷ পৃথিবীর নানা দেশের নাচ দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে কিন্তু বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলতে পারি যে পলিনেশিয়ান হুলার মতো এত তরল অঙ্গ সঞ্চালন আর কোথাও দেখিনি ৷ ক্ষুদ্রমনা মিশনারিদের গোঁড়ামিতে সারা উনিশ শতক ধরে ট্যাটু এবং হুলা দুইই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৷ সুখের বিষয় যে বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে পলিনেশিয়ান ভাষার মতোই এসব বিদ্যার চর্চা আবার শুরু হয়েছে ৷
পরদিন তাহিতির পালা শেষ করে রওনা ৷ এয়ার ফ্রান্সের বিশালকায় জাম্বো জেট সগর্জনে আকাশে উঠে গেল ৷ মুহূর্তে মিলিয়ে গেল তাহিতি দ্বীপ ৷ যেন কখনও ছিল না ৷
ভ্রমণ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন